বহুরূপী – ১

মানেকরাম অ্যান্ড লছমিপ্রসাদের প্রকাণ্ড সোনালি সাইনবোর্ডখানা পার্ক স্ট্রিটের মোড়টা যেন আলো করে রেখেছে। পথের এদিকে—ওদিকে অনেকদূর থেকেই নজরে পড়ে বড় বড় ঝকঝকে সোনালি হরফগুলো, আর বিশেষ করে লাল ‘নিয়নে’ লেখা ‘জুয়েলার্স’ কথাটি। বাস্তবিক এত বড় জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান শহরে আর নেই। শোনা যায়, ভারতবর্ষের দেশি রাজারাজড়ারা মানেকরাম লছমিপ্রসাদের বাঁধা খরিদ্দার। খাঁটি কমল হীরের একমাত্র ব্যবসাদার নাকি ওরাই

নামও যেমন, দোকানও তেমনি। সামনে দিয়ে গেলে খানিকক্ষণ তাকিয়ে যেতে হয় দু’পাশের বড় বড় দুটো শো—কেসের দিকে। সন্ধ্যার পর একশো পাওয়ারের আলোয় সাজানো সোনার মাঝে মাঝে চূনি—পান্না—নীলা—হিরের টুকরোগুলো থেকে যেন লাল—নীল—সবুজ—সাদা রঙের বিদ্যুৎ খেলতে থাকে। বিচিত্র ইন্দ্রধনুকে কে যেন ছড়িয়ে—ছিটিয়ে দিয়েছে দু’টো শো—কেসের মধ্যে! দেখলে ধনীর চোখ ওঠে ঝলসে, আর গরিবের চোখে ধাঁধাঁ লেগে যায়।

আর, চোখে পড়ে দোকানের ফটকের দু’পাশে দীর্ঘদেহ পাঠান প্রহরীর হাতে ঝকঝকে কিরীচ লাগানো দুটো সজাগ রাইফেল।

আমাদের গল্পের শুরু এই মানেকরাম লছমিপ্রসাদের দোকান থেকেই।

গত তেরোশো ছাপ্পান্ন সালের ফাল্গুনী—সন্ধ্যায় ঝকঝকে একখানা ছাই রঙের প্রকাণ্ড মোটরকার এসে থামল দোকানের সামনে ফুটপাথের ধারে। ড্রাইভারের আসন থেকে নামল লম্বা—চওড়া সুপুরুষ একটি যুবক। রঙটা মাজা—মাজা শ্যামল, নাকটা খড়্গের মতো উঁচু, ঘন ভুরুর নিচে চোখদুটো খুব বড় না হলেও বুদ্ধিতে উজ্জ্বল। দাড়ি—গোঁফ কামানো নিটোল মুখ। পরনে ধপধপে ঢিলে পাজামা আর গিলে—আস্তিন পাঞ্জাবি। হাল্কা কমলা রঙের দামি একখানাশাল বাঁ—দিকে কাঁধের ওপর থেকে লুটিয়ে প্রায় মাটি ছোঁয়—ছোঁয়। সবটা মিলিয়ে একটা সম্ভ্রান্ত ঘরের ছাপ।

শালটা ভাল করে কাঁধে তুলে দিয়ে যুবকটি দোকানে ঢুকতেই এক মুহূর্তের জন্যে চারদিক স্তব্ধ হয়ে গেল। তার পরেই চাপা একটা গুঞ্জন: লালজি! লালজি!

লালজি বলে ছোকরাটি শহরে পরিচিত বটে, কিন্তু কি যে তার আসল নাম, কেউই বলতে পারে না, হয়তো সে নিজেও ভুলে গেছে। লোকে জানে, লালজি মস্ত ধনী বংশের সন্তান, বাপের অগাধ সম্পত্তি এখন তারই হাতের মুঠোয়। আর জানে, লালজির দরাজ হাতের মুঠো কখনও বন্ধ হয় না। হিসেবি লোকেরা আড়ালে বলে, কাঁচা পয়সার কাপ্তেন। গরিব লোকেরা তারিফ করে বলে, বনেদি বংশের বাচ্চচা তো! তাই টাকার ওপর দরদ নিয়ে জন্মায়নি।

এ—হেন লালজি এসেছে শহরের সেরা জুয়েলার্স মানেকরাম লছমিপ্রসাদের ঘরে। কাউন্টারের ওপাশ থেকে মাথায় ভাটিয়া—টুপি পরা বেঁটে—খাটো একটি বিরাট চর্বির পিণ্ড দু’হাত বাড়িয়ে সাদর আপ্যায়নের হাসি হাসতে হাসতে এগিয়ে এল: আইয়ে, আইয়ে লালজি—সাহাব। আজ আমার খুশকিসমতি, আপনার পায়ের ধুলো আজ আমার দোকানে পড়ল! ভবানীপুরে হীরালাল ভাইয়ার দোকানের সামনে যখনই আপনার গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি, তখনই ভাবি, হয় রাম—এমন কি কসুর করেছি যে, লালজির পায়ের ধুলো আমাদের দোকানে একদিনও পড়ল না?

লোকটি মৃত মানেকরামের ছেলে রাজারাম। ঝানু ব্যবসাদার। দুই কানে দুটো বড় বড় হীরের টপ ছাড়া তার বেশভূষায় এবং অতি অমায়িক ব্যবহারে ধরবার জো নেই যে, এই ব্যক্তি এই কারবারের বারো আনা অংশীদার। সন্ধ্যার পর রোজ দোকানে এসে কারবার দেখাশুনা করা তার বরাবরের অভ্যাস।

কাউন্টারের সামনে সম্ভ্রান্ত খরিদ্দারের জন্যে হালফ্যাশানের সোফা সে টি পাতা। রাজারাম দু’হাত কচলে হাসিমুখে বললে, মেহেরবাণী করে আগে বসুন, তারপর কথা হবে।

কৌচে বসতে না বসতেই একজন কর্মচারী এসে গোলাপ—পাশ থেকে লালজির গায়ে খানিকটা গোলাপ—জল ছিটিয়ে দিল। এটা ওদের অভ্যর্থনার রীতি।

সাদা সিল্কের রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে লালজি বলল, চামেলিটাই আমি পছন্দ করি, গোলাপ—জলে আমার কেমন মাথা ধরে যায়।

এত বড় ধনী খরিদ্দারের আপ্যায়নে প্রকাণ্ড ভুঁড়িসমেত রাজারাম ব্যস্ত হয়ে পড়েছে; আপনি তো শুধু গাহক নন লালজি, আপনি আমার মেহমান!…এই, পান মাঙাও—সিগ্রেট মাঙাও—

লালজির পাতলা চাপা ঠোঁট দুটি অল্প হাসিতে খুলে গেল। হেসে বললে, ব্যস্ত হবেন না রাজারামবাবু, পান আমি কেয়া খয়ের ছাড়া খেতে পারি না। আমার ডিবেটা গাড়ি থেকে কাউকে আনতে বলে দিন।… হ্যাঁ, এবার কাজের কথা বলি।

বলুন।

ভক্ত হনুমানের মতো রাজারাম হাতদুটি জোড় করে দাঁড়িয়ে রইল।

দেখুন—লালজি বলতে লাগল, জড়োয়ার সওদা আমি বরাবর হীরালালের দোকানেই করে থাকি। আমার বাপের আমল থেকে চলেছে কিনা। কিন্তু হীরালালের শো—রুম ছেড়ে আজ আপনাদের দোকানে কেন এলাম জানেন কি?

গদগদ কণ্ঠে রাজারাম বললে, আপনার অনুগ্রহ!

সে—কথায় কোনো কান না দিয়ে লালজি বললে, হীরালালের জিনিস খুবই ভাল। কিন্তু ফ্যাশান, স্টাইল সব সাবেকি। হাল আমলে আর তা চলে না। শুনেছি, আপনাদের ফ্যাশান খুব আপটুডেট, আর গয়নার ডিজাইনও বেশ পছন্দসই—

লালজির মুখের কথা রাজরাম যেন লুফে নিল: তা বৈকি! ফেশন ডিজাইনে মানেকরাম লছমিপ্রসাদ তামাম শহরে একনম্বর! নইলে কি পাকইস্টিটের মতো রাস্তায় দোকান চলে হুজুর?

লালজি কৌচে ভাল হয়ে বসল। বলল, ব্যাপার কি হয়েছে জানেন রাজারামবাবু, আমার এক দূর সম্পর্কের ভাগ্নির কাল বিয়ে। পাত্র হচ্ছে বিলেত ফেরত, তায় জজের ছেলে—মানে একটু বিলিতি ঘেঁষা মানুষ ওরা। তাই কিছু হালফ্যাশানের গহনা দরকার। অবিশ্যি বেশি কিছু নয়, এই ধরুন হাতের কয়েকগাছা, এক আধটা গলার আর কানের—হ্যাঁ, বিয়ের ব্যাপার যখন, তখন যা—যা দরকার বুঝতেই তো পারছেন! মোটমাট হাজার পঁচিশ টাকার মধ্যে হলেই ভাল, দূর সম্পর্কের ভাগ্নিকে আর কত দেওয়া যায় বলুন?

রাজারাম তখন বোধ করি মনে মনে আঁচ করছিল, দূর সম্পর্কের ভাগ্নির জন্যে পঁচিশ হাজার হলে লালজির নিজের ভাগ্নির জন্যে কত হতে পারে? লাখখানেক নিশ্চয়ই! জয় হনুমানজি!

গাড়ি থেকে পানের ডিবে এসে গিয়েছিল। মীনে—করা রুপোর ডিবেটা খুলে লালজি দুটো খিলি মুখে পুরলো। তারপর ডিবেটা রাজারামের সামনে এগিয়ে ধরে বললে, নিন।

রাজারাম হাত কচলে গদগদ স্বরে বললে, পান—হেঁ—হেঁ—হেঁ—থাক, থাক—

পকেট থেকে সোনার জর্দার কৌটোটা বের করে ঈষৎ হেসে লালজি বললে, খাস লক্ষ্নৌয়ের চিজ।

আর কিছু বলতে হল না। রাজারাম একসঙ্গে চার খিলি পান তার মুখবিবরে চালিয়ে দিলে। তারপর তিন আঙুলে বিরাট একটিপ জর্দা নিয়ে নাকে কাছে ধরে অত্যন্ত আরামের সঙ্গে ঘ্রাণ নিলে।

লালজি বললে, কিন্তু একটা কাজ আপনাকে করতে হবে রাজারামবাবু।

একমুখ পান—জর্দা নিয়ে রাজারাম ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে যা বললে, তার অর্থ বোধ করি এই দাঁড়ায়: হুকুম করুন, বান্দা হাজির।

লালজি বলতে লাগল, আসছে বৈশাখেই আবার আমার ভাইঝির বিয়ে। জয় হনুমানজি! ভাইঝি নিশ্চয়ই দূর সম্পর্কের নয়, নিজেরই হবে! লালজির ক্ষুদে ক্ষুদে চোখ দুটো চক চক করে উঠল। তবে বরপক্ষ পেড়াপিড়ি করলে এই ফাল্গুনের শেষ তারিখেই দিতে হবে। তাই বলছিলাম কি, আপনি আমাকে এমন সব গয়না দেখান, যার জোড়া আপনাদের তৈরি আছে। তাতে সুবিধে হবে কি জানেন, একটা সেট আজকে নিয়ে যাই—আর ফাল্গুনেই যদি ভাইঝির বিয়ে দিতে হয়, তাহলে দিনকতক পরেই আর একটা সেট নিয়ে যাব। তখন আর বাছাবাছি পছন্দর ঝামেলা থাকবে না। অবিশ্যি আপনি যদি অন্য খদ্দের পেয়ে যান, সে—কথা আলাদা—স্বচ্ছন্দে বেচে দিতে পারেন। আমার দরকার হলে না হয় নতুন করে গড়িয়ে নেওয়া যাবে, কি বলেন?

কোঁৎ করে পানের রস গিলে রাজারাম বললে, কুছু ভাববেন না লালজি। দু’সেট গয়নাই যখন আপনি লিবেন, তখন দোসরা খরিদ্দার এলে হামি ঘুরিয়ে দোব। আপনার মতো ক’টা খরিদ্দার মেলে?

না, না, সে কি কথা! অন্য খদ্দের এলে ফিরিয়ে দেবেন কেন? তাতে দোকানের পসার নষ্ট হতে পারে। ভাল খদ্দের পেলে গয়নার অন্য সেটটা আপনি স্বচ্ছন্দে বেচে দেবেন। আমি না হয় নতুন করে অর্ডার দোব।

আচ্ছি বাৎ—রাজারাম বিনয়ে নুয়ে পড়ে বলল, হুকুম করুন, জিনিস দেখাই।

সোনার হাতঘড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে লালজি ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার আবার একটু তাড়া আছে কিনা—

শুরু হল অলঙ্কার দেখানো। আলমারি থেকে ভারে ভারে আসতে লাগল ভেলভেট—মোড়া বাক্সর পর বাক্স। তিলমাত্র জায়গা রইল না শ্বেতপাথরের টেবিলটার ওপর। এল চুর্ণি বসানো ব্রেসলেট, পান্নার কর্ণভূষা, এল মুক্তোর কণ্ঠি, আর সাপের চোখের মতো আলো ঠিকরে পড়া কমল হীরের নেকলেস।

রাজারামের মুখে খই ফুটতে লাগল : এই যে দেখছেন চুর্ণি—ফোঁটা ফোঁটা তাজা খুনের মতো, এ হচ্ছে একদম আসলি পাথর। রত্নগড়ের দেওয়ান বাহাদুরের ঘরে খালি এর জোড়ি মিলবে। আর এই মুক্তোর কণ্ঠি—হীরালালের তামাম গদি ঢুঁড়ে কেউ বার করুক তো দেখি এমন চিজ—দেখি হিম্মত! এ মুক্তো নয় হুজুর, মুক্তো নয়, সুন্দরী ঔরতের জমাট—বাঁধা চোখের জল!… আর এই দেখুন—জিনিসের সেরা জিনিস—

ঝলমলে হীরের নেকলসটা রাজারাম আলোয় তুলে ধরলে। পাথরগুলো থেকে নীলাভ বিদ্যুৎ ঠিকরে পড়তে লাগল।

রাজারাম বলতে লাগল, খাঁটি কলম হীরে জনাব, খাঁটি কমল হীরে! এর কদর আপনি ছাড়া আর কে বুঝবে লালজি? ঠিক এই জাতের পাথর পাওয়া যাবে শুধু বরোদার গাইকোয়াড়ের সিন্দুকে। মানেকরাম লছমিপ্রসাদ খাঁটি মাল ছাড়া কারবার করে না হুজুর—আর ডিজাইনও দেখুন একদম—

রাজারামের উচ্ছ্বাস থামিয়ে দিয়ে লালজি শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল, সবগুলোরই জোড়া তৈরি আছে তো?

আছে বৈকি!

বেশ, তাহলে এক সেটের দাম ফেলুন। একটু চটপট—তাড়া আছে কিনা আমার!

রাজারামের ধূর্ত চোখ দুটো লোভে চকচক করে উঠল। কাউন্টার থেকে পেন্সিল আর প্যাড নিয়ে সে বললে, এক মিনিট লালজি—স্রিফ এক মিনিট—হিসেব আমার হয়ে গেল বলে!

লালজি একবার হাতঘড়ির দিকে তাকাল। আটটা বাজতে সতেরো। তারপর পানের ডিবে খুলে আরও দুটো খিলি আর একটু জর্দা মুখে পুরে দিলে।

এক মিনিট নয়, ছ’মিনিট নয়, দামের হিসেব করতে রাজারামের লেগে গেল দশ মিনিটের ওপর। স্লিপটা হাতে করে এসে বললে, সবশুদ্ধ হল চব্বিশ হাজার সাতশো তিপান্ন টাকা। আপনার পক্ষে সামান্য।

রাজারাম পাশের কর্মচারীর দিকে ইঙ্গিত করলে। তারপর অতি অমায়িক হেসে প্রায় কানে কানে বলার মতো বললে, বিলটা করে ফেলব কি?

বিল!—লালজি সোজা হয়ে বসল। ইচ্ছে হলে বিল অবশ্য করতে পারেন রাজারামবাবু, কিন্তু আমি বলছিলাম কি, বিল করা মানেই তো সেলট্যাক্স বাবদ কতকগুলো টাকা গভর্নমেণ্টের হাতে তুলে দেওয়া। আমি কিন্তু এটাকে বোকামি বলব রাজারামবাবু। জিনিস পেলাম আমি, তার বদলে টাকা পেলেন আপনি—ব্যস মিটে গেল। এর জন্যে তৃতীয় পক্ষকে দালালি দেওয়াটা বোকামি নয় কি?

গম্ভীর মুখে রাজারাম শুধু বার দু’য়েক ঘাড় নাড়ল। তাতে ‘হ্যাঁ’ও বোঝাতে পারে, ‘না’ও বোঝাতে পারে।

লালজি বলতে লাগল, আর চব্বিশ হাজার টাকার ওপর সেলট্যাক্স ধরলে নেহাত অল্প টাকা হবে না। তার চেয়ে আমি বলি কি বিলটা আর না—ই তৈরি করলেন। যা দাম হয়েছে, তার ওপর আরও কিছু ধরে পুরো পঁচিশ হাজারই আপনি নিয়ে নিন। সেলট্যাক্সের কিছুটা আমারও বাঁচল, আর আপনারাও কিছু এসে গেল। কি বলুন?

হাতঘড়িটার দিকে লালজি আর একবার তাকাল। আটটা বাজতে পাঁচ।

বিনয়ে নুয়ে পড়ে রাজারাম বললে, আপনার মতো খরিদ্দারের কথা না রাখলে আমাদের কি চলে লালজি?

বেশ বেশ। এই তো সাচ্চচা কারবারীর মতো কথা। পান নিন—

ভুঁড়ি নাচিয়ে হাসতে হাসতে রাজারাম একসঙ্গে আরও চার খিলি পান ধ্বংস করলে।

লালজির দৃষ্টি হাতঘড়ির দিকে। আটটা বাজতে তিন।

তারপর বললে, সঙ্গে নগদ বেশি নেই। চেক দিই?

মাথা কাত করে রাজারাম বললে, দিন। কে না জানে, লালজির চেকে আর গভর্নমেণ্টের নোটে কোন তফাত নেই!

হাসিমুখে লালজি পাঞ্জাবির ডান পকেটে হাত চালিয়ে দিল। তারপর বাঁ পকেটে। তারপর হঠাৎ অত্যন্ত চিন্তিত মুখে বলল, কিন্তু একটা মুশকিল হয়েছে রাজারামবাবু আমার চেক বইটা ফেলে এসেছি হোটেলে—তাই তো কি করা যায়?

তাতে কি হয়েছে?—রাজারাম আশ্বাসের সুরে বলল, সঙ্গে না হয় লোক পাঠিয়ে দিচ্ছি, আপনি এখন হোটেলে ফিরবেন কি?

ফিরতেই হবে, উপায় কি?—লালজি বললে।

হাতঘড়িটায় তখন কাঁটায় কাঁটায় আটটা।

কাউন্টারের ওপাশে দাঁড়ানো একটি কর্মচারীকে ডেকে রাজারাম বললে, লালজি সাহেবের সঙ্গে গিয়ে চেকটা এখুনি নিয়ে এসো। খুব হুঁশিয়ার কিন্তু—দিনকাল বড় খারাপ—

হালকা কমলা রঙের শালখানা কাঁধে তুলে দিয়ে পানের ডিবেটা নিয়ে লালজি যাবার জন্যে উঠে দাঁড়াল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে একখানা দামি চকোলেট রঙের মোটর এসে থামল দোকানের সামনে। ড্রাইভার দরাজ খুলে দিতেই নামল অল্পবয়সী একটি মেয়ে। ঘন সবুজ জর্জেট শাড়ির আবরণে তার সুঠাম দেহের চম্পকবর্ণচ্ছটা যেন মেঘপুঞ্জের মধ্যে সৌদামিনীর মতো বন্দিনী হয়ে আছে। দেহবর্ণ আর সর্ব অবয়বের গঠন মিলিয়ে মেয়েটিকে অসামান্য সুরূপা বলা যায়।

সবুজ মখমলের ওপর জরির কাজ—করা ভ্যানিটি ব্যাগ দুলিয়ে চঞ্চল ছন্দে মেয়েটি দোকানে ঢুকে এল। সেদিকে তাকিয়ে লালজির মুখ প্রফুল্ল হয়ে উঠল। সহর্ষ বিস্ময়ে বলে উঠল, রুকমিণী!… এসো, এসো তুমি একেবারে ঈশ্বরপ্রেরিত! বড় সময়মতো এসে পড়েছ।—আপনার কর্মচারীকে আর কষ্ট করে যেতে হবে না রাজারামবাবু, রুকমিণী যখন এসে পড়েছে, তখন ব্যবস্থা আমি এইখানেই করে দিচ্ছি।… রুকমিণীকে চেনেন তো রাজারামবাবু? চেনেন না? কী আশ্চর্য! স্যার জগদীশ প্রসাদের একমাত্র কন্যা, অল ইন্ডিয়া টেনিশ চ্যাম্পিয়ন—শহরের লাইট পোস্টগুলো পর্যন্ত ওকে চেনে, আর আপনি—

নিজের অজ্ঞতা ঢাকবার জন্যে রাজরাম তাড়াতাড়ি বলে উঠল, বটে, বটে! আমারও তাই চেনা—চেনা লাগছে! খবরের কাগজে ছবি দেখেছি কিনা!…নমস্তে দেবীজি!

রুক্মিণীর পাতলা ঠোঁটের ফাঁকে কুন্দদন্ত দেখা গেল। লালজির দিকে তাকিয়ে বললে, আপনি এখানে? সওদা করতে বুঝি? কই, কি সওদা করলেন, দেখি!

রুক্মিণী জিজ্ঞাসু চোখ তুলে তাকাল।

লালজি বললে, বিপদ দেখো! সওদা করে পকেটে হাত দিয়ে দেখি, হরি! হরি! চেকবই আনতে ভুলে গেছি। তা তুমি চেকবই সঙ্গে এনেছ নিশ্চয়ই? চট করে একখানা চেক লিখে দিয়ে আমায় কৃপা করো তো দেবী!

বঙ্কিম কটাক্ষে তাকিয়ে রুক্মিণী জবাব দিলে, কৃপা নয়, সেবা। লালজির এতটুকু সেবা করতে পেলে আমি ধন্য হই।

তারপর ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে চেকবই আর পেন বের করে জিজ্ঞাসা করলে, কত?

লালজি বললে, পঁচিশ হাজার।

রুক্মিণী চেক লিখতে যাচ্ছিল, বাধা দিয়ে লালজি হঠাৎ বললে, দাঁড়াও, আগে রাজারামবাবুকে জিজ্ঞাসা করে দেখি, এ চেক চলবে কিনা!

রাজারাম যেন মরমে মরে গেল। কানে হাত দিয়ে বলে উঠল, সীয়ারাম, সীয়ারাম! স্যার জগদীশপ্রসাদের মেয়ের চেক যদি না চলে তো সরকারি নোটও চলবে না।

লালজি সহাস্যে বলল, পাকা কারবারী লোক বটে এই রাজারামবাবু। চেকটা তাহলে আপনাদের ফার্মের নামেই লেখা হোক?

খুশিতে রাজারামের ক্ষুদে ক্ষুদে চোকোদুটো চর্বির স্তূপের তলায় প্রায় ঢাকা পড়ে গেল।

রুক্মিণী ততক্ষণে চেকলেখা শেষ করেছে। সেখানা রাজারামের হাতে দিয়ে লালজি বললে, ঠিক আছে?

রাজারাম শুধু গদগদ ভঙ্গীতে ঘাড় নাড়ল।

আচ্ছা চলি।—আজ রাতে বোধহয় সময় পাব না, আমার চেকখানা কাল সকালেই তোমার ওখানে যাবে রুকমিণী। অনেক ধন্যবাদ তোমায়।

যাওয়ার জন্যে লালজি পা বাড়াতেই রুক্মিণী বলে উঠল, বারে! সওদা দেখালেন না?

লালজি বললে, সওদা সামান্যই। খুলে দেখতে পার।

লালজির ইঙ্গিতে কর্মচারীটি প্যাকেট খুলে একে একে সব দেখাল। ঝলমলে অলঙ্কারগুলির দিকে কিছুক্ষণ, তাকিয়ে রুক্মিণী বললে, ভারি সুন্দর তো! আপনার পছন্দ আছে লালজি।

সূক্ষ্ম একটু অর্থপূর্ণ হাসি লালজির চাপা ঠোঁটে দেখা দিল।

সত্যিই আমার পছন্দ আছে। কিন্তু আর নয়, বিয়েবাড়ি যাবার তাড়া আছে আমার।—বলে লালজি এগোল। সঙ্গে সঙ্গে কর্মচারীটি গেল প্যাকেটটা আর পানের ডিবে গাড়িতে তুলে দিতে।

ছাই রঙের গাড়িখানা সাঁ করে অদৃশ্য হয়ে গেল।

সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রুক্মিণী রাজারামকে বলল, দেখুন, লালজি যে সমস্ত অলঙ্কার নিয়েছেন, আমারও কিন্তু ঠিক ওই জিনিস একসেট চাই। ডিজাইনগুলো ভারি পছন্দ হয়েছে আমার।

দু’হাত কচলে রাজারাম সবিনয়ে নিবেদন করল, ওই সব অলঙ্কার আর মাত্র একসেটই আছে। কিন্তু লালজি তাঁর ভাইঝির বিয়ের জন্যে সেগুলো রাখতে বলে গেছেন।

রুক্মিণী কেমন যেন উদাসীন কণ্ঠে বললে, লালজিকে যদি আপনি কথা দিয়ে থাকেন, তাহলে আর উপায় কি বলুন? তবে অলঙ্কারগুলো আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। আচ্ছা—

কৌচ থেকে রুক্মিণী উঠে দাঁড়াল। এত বড় খরিদ্দার হাতছাড়া হয় দেখে রাজারাম শশব্যস্তে বলে উঠল, না, না, কথা—টথা কিছু দিইনি। আর দিলেই বা কি, স্যার জগদীশপ্রসাদের মেয়ের যখন পছন্দ হয়েছে, তখন আমকে দিতেই হবে—আলবৎ দিতে হবে—

সেটা আপনার ইচ্ছে। রুক্মিণীর মুখে তেমনি উদাসীনতা।

রাজারাম বললে, জিনিসগুলো তাহলে দেখে নিন।

আলমারি থেকে এল তেমনি চুনির ব্রেসলেট, পান্নার কর্ণভূষা, মুক্তোর কণ্ঠি, কমল হীরের নেকলেস। রুক্মিণী একবার দেখে নিয়ে বললে, জিনিসগুলো গাড়িতে তুলে দিতে বলুন, আর বিল করুন।

প্রকাণ্ড কচ্ছপের মতো বিপুল দেহ দুলিয়ে রাজারাম প্রায় ছুটেই কাউন্টারে গেল বিল করতে। রুক্মিণী তখন ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে ছোট্ট একটি আর্শি মুখের সামনে ধরে পাউডার—পাফটা মুখে একবার বুলিয়ে নিল। তারপর আর্শি আর পাফটা ভ্যানিটির ভেতর রাখল। সঙ্গে সঙ্গে চেকবই আর পেন।

রাজারামের তখন বিল করা হয়ে গেছে। পুরো সেলট্যাক্স নিয়ে মোট দামটা পঁচিশ হাজারের খানিকটা বেশিই হল। বিলখানার ওপর চোখ বুলিয়ে রুক্মিণী বলল বাঃ! আমার বেলায় বিলটা বেশি হয়ে গেল? অথচ লালজি যা নিয়েছেন, আমিও ঠিক তাই নিয়েছি। চমৎকার বিচার আপনার রাজারামবাবু!

অত্যন্ত অপ্রস্তুত হয়ে রাজারাম মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললে, মানে—ইয়ে হয়েছে—লালজির বেলায় সেলট্যাক্স—

রুক্মিণী ঈষৎ কঠিন কণ্ঠে বললে, আমি পঁচিশ হাজারের এক পয়সাও বেশি দোব না। যান, বিলটা ঠিক করে আনুন!

আমতা আমতা করে রাজারাম কি যেন বলবার চেষ্টা করলে, কিন্তু কিছুই বলা হল না। সামান্য কয়েকশো টাকার লোভ করতে গিয়ে পঁচিশ হাজার টাকার দাঁও ফসকাবে, এমন গর্দভ রাজারাম শেঠ নয়। অতএব সুবোধ বালকের মতই বিলটাকে সে কেটে—ছেঁটে আনে।

বিলটা হাতে নিয়ে একনজর দেখে রুক্মিনি বললে, হ্যাঁ, ঠিক হয়েছে।

তারপর সবুজ মখমলে মোড়া ভ্যানিটি ব্যাগটি খুলে, বিলটিকে সযত্নে রেখে ঋজু ভঙ্গিতে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। পেছন পেছন গিয়ে রাজারাম অমায়িক বিনয়ে বললে, চেকটা—

একটা ঘূর্ণীপাক দিয়ে রুক্ষ্মিণী ঘুরে দাঁড়াল। রুদ্ধ নিঃশ্বাসে রাজারাম প্রত্যাশা করল, রুক্ষ্মিণী এইবার সলজ্জমুখে মার্জনা ভিক্ষা করবে—হয়তো বা একটু মিঠা হাসির সঙ্গে বলবে, ইস! কি ভুলো মন আমার! আর সে কথার উত্তরে রাজারাম ভদ্রতায় বিগলিত হয়ে বলবে, তাতে কি হয়েছে!

কিন্তু না, রুক্মিণীর মুখে—চোখে কোথাও লজ্জার রক্তিমা বা কুণ্ঠার জড়িমা নেই। একটা দৃপ্ত—কঠিন ভঙ্গীতে মুখ তুলে স্পষ্টগলায় সে প্রশ্ন করল, কিসের চেক?

রাজারাম যেন একটা ধাক্কা খেল। ঢোক গিলে বললে, মানে— গয়নাগুলোর দরুণ—

সোজা জবাব এল, সে—চেক তো আগেই দিয়েছি। পুরো পঁচিশ হাজার।

হতভম্বের মতো রাজারাম এক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল। তারপর পানের রস—মাখানো পুরু নিচের ঠোঁটটা ঝুলে পড়ল বোকার মতো। তারপর ক্ষীণ কণ্ঠে শুধু বলল, সে তো লালজির দরুণ—

লালজিকে আমি চিনি না।

কথাগুলো বোমার কয়েক টুকরো ‘স্পিলনটারের’ মতো প্রচণ্ডবগে বিধল রাজারামের হৃৎপিণ্ডে। একপলকে মাথার ভেতরটা তার গোলমাল হয়ে গেল। ছুঁড়িটা কি দিল্লাসি করছে? না অন্য কোন মতলব? কিন্তু স্যার জগদীশপ্রসাদের মতো শরিফ আদমির মেয়ে—! গলায় যথাসম্ভব জোর এনে রাজারাম বললে বড়ি তাজ্জবকি বাৎ! এই একটু আগে লালজির সঙ্গে আপনি কথা কইলেন, তাঁর হয়ে চেক দিলেন, আর এখন বলছেন লালজিকে চিনি না? চিনুন বা না—ই চিনুন, মাল নিয়েছেন, দাম দিয়ে যান। নইলে গাড়ি থেকে মাল নামিয়ে নিতে বাধ্য হব।

তীক্ষ্ন বিদ্রূপের হাসিতে রুক্ষ্মিণীর আরক্ত ঠোঁট দুটি দ্বিধাবিভক্ত হল: বেশ, পারেন তো নামিয়ে নিন।

রাজারাম হন্তদন্ত হয়ে ছুটল চকোলেট রঙের সেই গাড়িখানার দিকে। কিন্তু হরি—হরি, গাড়ির মধ্যে অলঙ্কারের প্যাকেটও নেই, ড্রাইভারও নেই।

পাগলের মতো চিৎকার করতে করতে রাজারাম ফিরে এল।

এ জুয়াচুরি—আমি পুলিশে ফোন করব—লালবাজার থেকে কমিশনার ডাকব—বলব, আমায় ঠকিয়েছে—পঁচিশ হাজার টাকার গহনা ঠকিয়ে নিয়েছে—হায় মহনুমানজি—হায় রাম—!

টেলিফোনের রিসিভারটা তুলে রাজারাম পরিত্রাহি চেঁচাতে লাগল হ্যালো…পার্ক স্ট্রিট থানা—

গোলমালে দোকানের কর্মচারীরা ভীত সন্ত্রস্তভাবে চারপাশে ভিড় করে দাঁড়াল। কে একজন বললে, দরোয়ান, ফটক বন্দ করো—

খটাস করে একটা ধাতব আওয়াজ হল। রুক্মিণী দেখতে পেলে, ফটকের দু’পাশে দণ্ডায়মান পাঠান—প্রহরীদের হাতে ঝকঝকে সঙ্গীন দুটো আড়াআড়ি ভাবে দরজার পথ আগলে রয়েছে!

রুক্মিণী একেবারে রাজারামের মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর সতেজ কঠিন কণ্ঠে বললে, থামুন।

সে—কথায় কান না দিয়ে রাজারাম উন্মত্তের মত বললে, পুলিশ এলে আমি সব কথা জানাব—স্যার জগদীশপ্রসাদের বেটিকে জেল খাটিয়ে ছাড়ব, তবে আমার নাম রাজারাম।

আরক্ত ঠোঁট দুটির ওপর সূক্ষ্ম বিদ্রূপের হাসি আবার দেখা দিল। রাজারামের মোটা ভাঙা গলার আওয়াজ ছাপিয়ে রুক্মিণীর মিহি গলা উঁচু পর্দায় শোনা গেল: তার আগে জেনে রাখুন, একজন ভদ্রমহিলাকে অনর্থক হয়রান করার জন্যে শাস্তি আপনাদেরই পেতে হবে। পুলিশ এলে আমি এই কথাই বলব যে, পঁচিশ হাজার টাকা অলঙ্কারের জন্যে আপনাদের ফার্মের নামে পুরো পঁচিশ হাজার টাকার চেক আমি সই করে দিয়েছি। সে—চেক রয়েছে আপনার কোটের পকেটে, আর তার বিলও রয়েছে আমার এই ব্যাগের মধ্যে। তবু আমাকে আপনারা যথেষ্ট হয়রান করেছেন। পুলিশ এলে আপনাদের এই বেয়াদবি আমি কিন্তু মাপ করব না—ড্যামেজের মামলা করব আপনাদের নামে।

দোকানের গোলমাল এক মুহূর্তে ডুবে গেল স্তব্ধতার।

রাজারামের হাত থেকে রিসিভারটা খসে পড়ে গেল। ডান হাতের মুঠোয় সেটা ধরে রুক্মিণী অতি মধুর গলায় বলল, পুলিশে ফোন কি এবার আমিই করব রাজারামবাবু? না সেপাইদের দরজাটা ছেড়ে দিতে বলবেন?

বাক্যহত স্তম্ভিত রাজারামের কপালে এই ঠাণ্ডাতেও বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছে! শুকনো ঠোঁট দুটোকে জিব দিয়ে চেটে সে শুধু কোনোমতে উচ্চারণ করল দরওয়াজা ছোড় দো!

আবার খটাস করে আওয়াজ হল। ঝকঝকে সঙ্গীন দুটো দরজার দু’পাশে গেল সরে।

আবার সেই তীক্ষ্ন বিদ্রূপের হাসিতে রুক্মিণীর আরক্ত ঠোঁট দুটো দ্বিধাবিভক্ত হল।

বিপর্যস্ত ঘর্মাক্ত রাজারামের দিকে নিতান্ত অবজ্ঞাভরে একবার তাকিয়ে রুক্মিণী শুধু বললে, নমস্তে। তারপর দর্পিত পদক্ষেপে দোকান থেকে বেরিয়ে নিজেই গাড়িতে স্টার্ট দিল।

রাজারাম তখনও মূঢ়ের মতো সেদিকে তাকিয়ে। চকোলেট রঙের গাড়িখানা চোখের আড়াল হতেই রাজারাম তার বিপুল চর্বির পিণ্ড সমেত ধপ করে কৌচে বসে পড়ে বললে, ঠাণ্ডা পানি!

.

চকোলেট রঙের প্রকাণ্ড মোটরখানা এসে দাঁড়াল ওয়েলেশলির এক কফি হাউসের সামনে। দরজার পাশে দাঁড় করানো একটা বোর্ডে বড় বড় রঙিন ইংরাজি আর উর্দু হরফে লেখা:

বিশেষ নাচের আসর

জোহরা বাঈ

আজ রাত্রি দশটায়

.

পাড়াটা বিশেষ অভিজাত নয়, মুসলমান আর অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের সংখ্যাই বেশি এখানে। কিন্তু পাড়াটা অভিজাত না হলেও কফি হাউসটির চটক খুব। শুধু কফিই এখানকার আকর্ষণ নয়, এর প্রধান আকর্ষণ হল হলের মাঝখানে উঁচু নাচের স্টেজ আর দু’পাশে সারি সারি কেবিনগুলো। রাত্রি আটটার পর এই স্টেজের ওপর যখন বিলাসিনী সুন্দরী নর্তকীদের নৃত্যের নামে অঙ্গ—প্রদর্শনী শুরু হয়, তখন দু’পাশের কেবিনগুলো থেকে সোডার বোতল খোলার আওয়াজ পাওয়া যায়। এর জন্যে দোকানের মালিকের কোনো লাইসেন্স রাখার প্রয়োজন হয় না কেন, এ প্রশ্ন আপনারা বরং শহরের পুলিশ—কমিশনারকে করে দেখবেন।

বলা বাহুল্য ওয়েলেশলির এই কফি হাউসটি শহরের যত নিশাচরের একটি বিশেষ আড্ডা।

চকোলেট রঙের গাড়িটা থেকে ঘন সবুজ জর্জেট শাড়িপরা একটি মেয়েকে আমরা নামতে দেখলাম। মুখে কালো রঙের পাতলা নেটের সূক্ষ্ম আবরণ।

স্টেজের ওপর তখন অর্কেস্ট্রা সহযোগে একপাল ‘ব্যালে’র নৃত্য সবে শুরু হয়েছে। ওয়েলেশলির কফি হাউস তখনও ভালভাবে জমেনি। হল ভর্তি হয়ে যায় সাধারণত রাত্রি দশটার পর।

কালো রঙের ঘোমটা ঢাকা মেয়েটি হলের ভেতরে প্রবেশ করতেই ওধার থেকে অল্প দাড়িওলা একজন বয় কফির খালি পেয়ালা হাতে তার পাশ দিয়ে যেতে যেতে নিচু গলায় বলে গেল, সাত নম্বর কেবিন।

মেয়েটি একবার হলের চারপাশে লক্ষ করল। তারপর সোজা গিয়ে সাত নম্বর কেবিনের পর্দা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। ভেতরে এক পেগ ‘জিন’ নিয়ে যে ব্যক্তিটি বসেছিল, দেখতে সে হুবহু আমাদের পূর্বপরিচিত লালজির মতো। তফাতের মধ্যে মুখের সূচলো একজোড়া ভ্রমর—কালো গোঁফ, চোখে একজোড়া নীল গগলস আর মাথায় জরির কাজ করা লক্ষ্মৌয়ী টুপি। একটা সিগারেট ধরাবার জন্যে লোকটি দেশালাই জ্বেলেছিল। মেয়েটি ঢুকতেই জ্বলন্ত কাঠিটা ফেলে দিয়ে বলল, এসো জোহরা একটু দেরি হয়ে গেছে তোমার!

মেয়েটি একটা চেয়ারে বসে পড়ে আস্তে আস্তে মুখের কালো আবরণটা উন্মোচন করল। আমরা যা ভেবেছিলাম, তাই। মেয়েটি রুক্মিণী। কিন্তু কফি—হাউসে তার পরিচয় জোহারা বাঈ।

লোকটির মুখ থেকে সিগারেটটা নিয়ে জোহরা নিজের মুখে দিয়ে জ্বালানো। তারপর একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললে, দেরি হওয়ারই কথা। কাজটা সহজ ছিল না লালজি।

বটে?

মাহাঙ্গু ড্রাইভার এসেছিল?

হ্যাঁ, জিনিসগুলো দিয়ে গেছে।

কোথায় সেগুলো?

লালজি আর একটা সিগারেট ধরাচ্ছিল। ইসারায় টেবিলের ওপর একটা ছোট অ্যাটাচিকেস দেখিয়ে দিল।

লালজির হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে জোহরা বললে, এবার আমি গ্রিনরুমে যাই। দশটায় আমার নাচের প্রোগ্রাম আছে।

লালজি বললে, আমিও উঠব।

কোথায় যাবে?

জিনিসগুলো আর রাত্রেই বেচে ফেলতে হবে। টাকার দরকার জোহরা। নিজের গ্লাসটা এক চুমুকে শেষ করে অ্যাটাচিকেস হাতে লালজি উঠে দাঁড়াব।

জোহরা হঠাৎ পিছু ডাকলে, লাল—

লালজি ফিরে তাকাতেই তার বুকের একান্ত সন্নিকটে এসে জোহরা চাপা গলায় বললে, খুব সাবধানে চলাফেরা করবে লাল—

হঠাৎ একথা?

পঁচিশ হাজার টাকার শোক রাজারাম চট করে ভুলতে পারবে না। পুলিশে খবর দেবে নিশ্চয়ই।

লালজি একটা ধোঁয়ার রিং ছেড়ে বললে, হিসেবে একটু ভুল হচ্ছে জোহরা। পঁচিশ হাজার নয়, পঁচিশ আর পঁচিশ—পঞ্চাশ হাজার।

জোহরা সবিস্ময়ে চাইল : একথার মানে?

মানে, আমার যে চেকবইটা তুমি মানেকরাম লছমিপ্রসাদের দোকানে নিয়ে গিয়েছিলে, সেটা তিন বছর আগে বাতিল হয়ে গেছে। সুতরাং রাজারামের হাতের চেক রাজারামের কাছেই ফিরে আসবে।

কিন্তু ওরা যদি কেস করে?

কেস করলে, স্যার জগদীশপ্রসাদের মেয়ে রুক্মিণীর নামেই করবে। তুমি জোহরা বাঈ—তোমার ভয় কিসের?—লালজি পর পর তিনটে ধোঁয়ার রিং ছাড়লে। তারপর আবার বললে, হ্যাঁ, চেকবইটা সাবধানে রেখো—দরকার হলে না হয় পুড়িয়ে ফেলো।

ফেলব। কিন্তু তুমিও সাবধানে থেকো লাল। আজ ক’দিন থেকে দেখছি, দু’—একটা নতুন মুখ কফি হাউসে আনাগোনা শুরু করেছে—খুব সম্ভব পুলিশের লোক।

সেই পরিচিত সূক্ষ্ম বুদ্ধিদীপ্ত হাসি লালজির ঠোঁটে দেখা গেল। বাঁ দিকের ভুরু তুলে জোহরার প্রতি একবার দৃষ্টিপাত করল। তারপর সিগারেটের টুকরোটা ফেলে, জুতোর আগা দিয়ে মাড়িয়ে বেরিয়ে গেল। ভারি পর্দাটা উঠল দুলে।

সেইদিকে চুপ করে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জোহরা ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলল। আজও তাকে লাল ঠিকমতো বুঝতে পারল না, না পারল সে নিজেকে ঠিকমতো বোঝাতে।

কালো রঙের পাতলা আবরণটা মুখের ওপর ফেলে জোহারা বেরোল কেবিন থেকে। গ্রিনরুমে গিয়ে এখুনি তৈরি হতে হবে। আজ রাত দশটার তার নাচের প্রোগ্রাম।

.

পার্ক স্ট্রিট থানার অফিসারের সামনে রাজারাম তখন নাকের জলে চোখের জলে একাকার হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

দু’জনের প্রত্যেকেই পঁচিশ হাজার টাকার মাল নিয়ে গেছে, বলছেন?

জী হাঁ। একই ডিজাইনের অলঙ্কার।

দু’জনে একসঙ্গে এসেছিল?

জী না। আগে লালজি, তারপর রুকমিণী।

চেকটা কে দিয়েছে?

লালজি।

চেকটা হাতে নিয়ে দারোগা ভুরু কুঁচকে বললেন, কিন্তু সই তো দেখছি রুকমিণী দেবীর?

থতমত খেয়ে রাজারাম বললে, চেকটা রুকমিণী দেয় লালজিকে, লালজি দেয় আমাকে।

তাহলে কার দেওয়া হল?

রুকমিণীর—না, না, লালজির—

দারোগা ধমকে উঠলেন, ঠিক করে বলুন—

আরও থতমত খেয়ে রাজারাম একেবারে গোবরগণেশ হয়ে গেল। প্রায় কেঁদে ফেলে বললে, মাথার কি আর ঠিক আছে দারোগা সাহেব? ছুঁড়িটা একেবারে পথে বসিয়ে গেছে আমাকে।

আপনি ঠিক জানেন যে, সেই মেয়েটিই স্যার জগদীশপ্রসাদের মেয়ে?

জী না। তা ঠিক জানি না। তবে চেহারাটা, খবরের কাগজে জগদীশপ্রসাদের মেয়ের ছবি দেখেছি, অবিকল তাই—মায় চিবুকের ওপর কালো তিলটা পর্যন্ত।

বটে! আগে কখনও দেখেছেন?

জী না!

আচ্ছা, লালজিকে কতদিন জানেন আপনি?

তির—চার সাল হবে।

তবে কি রকম লোক মনে হয় আপনার?

লোক তো ভালই মনে হত, তবে আজকের ব্যাপারটার পর আমার সন্দেহ হচ্ছে—আমি বলছি দারোগাসাহেব রুকমিণীর সঙ্গে লালজিরও নিশ্চয় যোগসাজশ আছে। বেমালুম চোখে ধুলো দিয়ে সরে পড়ল!… হায় রাম, এই দুনিয়া কেবল জুয়াচোরে ভর্তি!

মোটর দু’খানার নম্বর নিয়েছেন?

জী না। তবে লালজির গাড়িখানা ছাই রঙের মাস্টার বুইক, আর রুকমিণীর গাড়ি চকোলেট রঙের—বোধহয় হাডসন।

আচ্ছা আপনি এখন যেতে পারেন শেঠজি।

দারোগা তাঁর কাগজপত্রের ওপর ঝুঁকে পড়লেন। ক্লান্ত—ক্লিষ্ট রাজারাম ফোঁস করে জলহস্তীর মতো একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেল। দরজার ওপাশ থেকে শুধু তার খেদোক্তি শোনা গেল: হায় রাম!

রিপোর্ট লেখা শেষ করেই দারোগ্য টেলিফোনের রিসিভার হাতে নিলেন।

হ্যালো… বিশ্ববার্তা অফিস…হ্যাঁ, রমলা সেনকে চাই, রিপোর্টার রমলা সেন…পার্ক স্ট্রিট থানা থেকে বলছি।… হ্যাঁ, আমি গুপ্ত… একটা ভারি ইন্টারেস্টিং কেস এসেছে রমলা, সময় করে একবার এসো… কেসটা ? ৪২০!

.