বরনারীবরণ

বরনারীবরণ

সজ্জনসংগতির নাম আপনারা নিশ্চয় শুনেছেন। খবরের কাগজে যাঁদের ওয়াকিফহাল মহল বলা হয় তাঁরা সকলেই একমত যে এর মতন উঁচুদরের অভিজাত ক্লাব কলকাতায় আর নেই। নামটি মোহমুদগর থেকে নেওয়া বটে, কিন্তু এখানে এর মানে সাধুসঙ্গ নয়। সজ্জনসংগতি—কিনা শিক্ষিত শৌখিন নরনারীর মিলনস্থান। আপনি যদি আধুনিক শ্রেষ্ঠ লেখক চিত্রকর নটনটী গাইয়ে বাজিয়ে নাচিয়ে দেখতে চান তবে এখানে আসতেই হবে। যদি অলট্রামডার্ন ফ্যাশন আর চালচলন শিখতে চান তবে এই ক্লাব ভিন্ন গত্যন্তর নেই। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, বাৎসরিক চাঁদা নগদ এক শ টাকা। ক জন তা দিতে পারে? চাঁদার টাকা যদি বা যোগাড় করলেন তবু দরজা খোলা পাবেন না। সজ্জনসংগতির সদস্যসংখ্যা ধরাবাঁধা আড়াই শ। যদি একটা পদ খালি হয় এবং অন্তত পঞ্চাশ জন সদস্যের সম্মতি আনতে পারেন তবেই আপনার আশা আছে। কিন্তু যদি আপনার বরাত ভাল হয় তবে সুপারিশের জোরে ক্লাবের কোনও বিশেষ অধিবেশনে আপনি অতিথি হিসাবে বিনা খরচে নিমন্ত্রণ পেয়ে যেতে পারেন।

ক্লাবটি চালাবার ভার যাঁদের উপর তাঁরা পাঁচ বছর অন্তর নির্বাচিত হন। বর্তমান সভাপতি অনুকূল চৌধুরী একজন মনীষী লেখক ও সুবক্তা, বিখ্যাত মাসিক পত্রিকা ‘প্রগামিনী’র মালিক ও সম্পাদক। এঁর বয়স এখন পঁয়ষট্টি, আবাল বৃদ্ধবনিতা সকলের সঙ্গেই মিশতে পারেন সেজন্য সকলেরই ইনি প্রিয়। কর্মাধ্যক্ষ দু জন, কপোত গুহ আর সোহনলাল সাহু। কপোত গুহ ব্যারিস্টার, বয়স চল্লিশের নীচে, পসার নেই কিন্তু পৈতৃক টাকা দেদার আছে। সোহনলাল ধনী কারবারী যুবক, বয়স ত্রিশের কাছাকাছি, খুব শৌখীন, ছাপরার লোক হলেও বাঙালীর সঙ্গেই বেশী মেশেন। ইনি বলেন, বিহার প্রদেশের সমস্তই বাংলার অন্তর্ভুক্ত হওয়া দরকার, নতুবা বিহারী কালচারের উন্নতি হবে না।

বিকাল বেলা প্রগামিনী পত্রিকার অফিসে অনুকূল চৌধুরী, কপোত গুহ আর সোহনলাল সাহু সজ্জনসংগতির আগামী অধিবেশন সম্বন্ধে পরামর্শ করছেন। কপোত গুহ একটু চঞ্চল হয়ে বলছিলেন, এ রকম করে চালানো যাবে না দাদা। প্রত্যেক বৈঠকে সেই একঘেয়ে প্রোগাম, ভূপালী বোসের গান, লুলু চ্যাটার্জীর নাচ, দরদী সেনের ন্যাকা ন্যাকা আবৃত্তি, জগাই বারিকের রাসলীলা ব্যাখ্যা, আর শসার স্যাণ্ডউইচ কেক শিঙাড়া সন্দেশ পেস্তা—বাদাম—ভাজা আইসক্রীম চা।

অনুকূল বাবু বললেন, বেশ তো, কি রকম করতে চাও তাই বল না।

সোহনলাল বললেন, গুহ সাহেবের মন খারাপ হয়ে গেছে দাদা। সেদিন প্রাচী—প্রতীচী সংঘের জয়ন্তী হয়ে গেল, তারা একটি চমৎকার ট্যাবলো দেখিয়েছে। ডলি বাগচীর ক্লিওপেট্রা, পবন ঘোষের অ্যাণ্টনি, আর ইরফান আলীর ঘটোৎকচ দেখে সকলে অবাক হয়ে গেছে। ঘটোৎকচ ক্লিওপেট্রাকে কাঁধে নিয়ে পালাচ্ছে আর অ্যাণ্টনি ভেউ ভেউ করে কাঁদছে। যারা দেখেছে তারা সবাই ধন্য ধন্য করছে।

অনুকূলবাবু বললেন, তোমরাও তো ওইরকম কিছু একটা করতে পার। গজেন গুপ্তকে বললে একদিনের মধ্যে একটা একাঙ্ক নাটক লিখে দেবে।

সোহনলাল বললেন, আমার মতে সিপাহী যুদ্ধের কোনও ঘটনা দেখালে খুব ভাল হবে। এই ধরুন—নানা সাহেব জেনারেল ম্যাকআর্থারকে বন্দী করে এনে নিজের স্ত্রীকে বলছেন, এই ফিরিঙ্গী তোমার জিম্মায় রইল, ফুরসত হলেই একে পাঁচ টুকরো করবে, আমি আবার লড়াইএ চললুম। ম্যাকআর্থার পায়ে পড়ে প্রাণভিক্ষা করলেন। নানী সাহেবার দয়া হল, বললেন, জান নহি লুংগি, সির্ফ নাক কাট দুংগি।

কপোত গুহ ঘাড় নেড়ে বললেন, আমরা কারও নকল করতে চাই না, একেবারে নতুন কিছু দেখাতে চাই। শুনুন দাদা—বিলেতে যেমন মে—কুইন ইলেকশন হয়, আগামী অধিবেশনে আমরা তেমনি উপস্থিত মহিলাগণের একজনকে বসন্তরানী নির্বাচন করব।

—বল কি হে, জষ্টি মাসের গুমোট গরমে বসন্তরানী!

—আচ্ছা, আষাঢ় মাস হতে পারে, তখন গরম কমে যাবে। উপস্থিত মহিলাগণের মধ্যে যিনি সব চেয়ে সুন্দরী তাঁকে আমরা সুন্দরীশ্রেষ্ঠা উপাধি দিয়ে ফুলের মুকুট পরিয়ে দেব, একটি সোনার ঘড়িও উপহার দিতে পারি।

সোহনলাল বললেন, সে খুব ভাল হবে দাদা। খবরটি যদি আগে কাগজে ছাপিয়ে দেওয়া হয় তবে সমস্ত মেম্বার আর মেম্ব্রেসরা তো হাজির হবেনই, বাইরের লোকেও অ্যাডমিশনের জন্য ভিড় করবে। যদি দশ টাকার টিকিট করা হয় তা হলেও বিস্তর লোক তামাশা দেখতে আসবে।

অনুকূলবাবু বললেন, আইডিয়াটা ভাল, কিন্তু সুন্দরীশ্রেষ্ঠা বলা চলবে না, তাতে অনর্থক মনোমালিন্যের সৃষ্টি হবে। সাধারণ লোকে অল্পবয়সী মেয়েদের মধ্যেই সুন্দরী খোঁজে। কিন্তু আমাদের সদস্যারা সকলেই তরুণী নন, অনেকের বয়স হয়েছে অথচ রূপের খ্যাতি আছে। এইসব হোমরাচোমরা ফ্যাট ফেয়ার অ্যাণ্ড ফর্টি বা ফর্টি—উত্তীর্ণা। মহিলারা যদি দেখেন যে তাঁদের কোনও আশা নেই তবে ভীষণ চটে যাবেন, চাই কি ক্লাবের সম্পর্ক ত্যাগ করতে পারেন। তা হলে তো সজ্জনসংগতি উঠে যাবে।

কপোত গুহ চিন্তিত হয়ে বললেন, ভাবিয়ে তুললেন দাদা, আপনার কি অসাধারণ দূরদৃষ্টি! সুন্দরীশ্রেষ্ঠা নির্বাচন—এ কথা বললে সিচুয়েশন একটু ডেলিকেট হবে বটে। কি বললে ভাল হয় আপনিই স্থির করুন।

অনুকূলবাবু বললেন, বরনারীবরণ মন্দ হবে না। যুবতী প্রৌঢ়া বৃদ্ধা কারও বরনারী হতে বাধা নেই। ফুলের মুকুট আর ঘড়ি না দেওয়াই ভাল, একটা জাঁকালো বরমাল্য দিলেই চলবে।

সোহনলাল বললেন, বরনারী ইলেকশন কি রকম হবে? আমার মতে সিক্রেট ব্যালটের ব্যবস্থা করা দরকার, তা হলে সকলেই চক্ষুলজ্জা ত্যাগ করে ভোট দিতে পারবে।

অনুকূলবাবু বললেন, তাতে জনমতের নির্ধারণ হবে বটে, কিন্তু তার পরিণামটা ভেবে দেখেছ? তারক মল্লিকের মেয়ে কিরণশশী—আজকাল যে হ্লাদিনী দেবী নাম নিয়ে গৌড়ীয় লাস্যনৃত্যম দেখাচ্ছে—সেই সব চেয়ে বেশী ভোট পাবে। তার পরেই বোধ হয় সুরেন ভৌমিকের গুজরাটী স্ত্রী কলাবতী ভৌমিক কিংবা আমাদের ডকটর নিয়োগীর স্ত্রী বঞ্জুলা নিয়োগীর চান্স। ভোটে যেই জিতুক, সদস্যারা সবাই তাঁদের স্বামীদের ওপর চটবেন, বাড়িতে মুখ হাঁড়ি করে থাকবেন, একটা পারিবারিক অশান্তির সৃষ্টি হবে। আমাদের মেয়েরা এখনও পাশ্চাত্ত্য নারীর উদারতা পায় নি, সবাই শ্রীরাধার মতন জেলাস। তা ছাড়া ব্যালটে বিস্তর সময় লাগবে, লোকের ধৈর্য থাকবে না। ক্লাবের মেম্বাররা আমোদ চায়, ব্যালটের মতন নীরস ব্যাপারে সময় নষ্ট করা পছন্দ করবে না। ব্যালট নয়, সেকালের স্বয়ংবর সভার মতন কিছু করাই ভাল। সভায় যারা উপস্থিত থাকবেন তাঁদেরই একজনকে বরয়িতা বা বিচারক করা হবে। তিনি বরমাল্য হাতে নিয়ে সভা পরিক্রমণ করবেন, প্রত্যেক মহিলার চেহারা ঠাউরে দেখবেন, তার পর যাঁকে বরনারী সাব্যস্ত করবেন তাঁর গলায় মালা দেবেন। এতে পারিবারিক অশান্তি হবে না। বরমাল্য যাঁকেই দেওয়া হক, মেয়েরা শুধু বিচারকের ওপর চটবেন, তাঁদের স্বামীদের দোষ ধরবেন না।

সোহনলাল বললেন, খুব ভাল হবে। জজ মশাই যখন ঘুরে ঘুরে ইনস্পেকশন করবেন তখন মহিলাদের বুক তড়প তড়প করবে, আর পুরুষরা খুব মজা পাবে। হয়তো চুপি চুপি বাজি ধরবে—ফোর টু ওআন হ্লাদিনী দেবী, থ্রি টু ওআন কলাবতী ভৌমিক। এর চেয়ে আমোদ হতেই পারে না।

আরও কিছুক্ষণ পরামর্শের পর স্থির হল যে আষাঢ় মাসের অধিবেশনে বরনারীবরণের ব্যবস্থা হবে। বিচারক কে হবেন তা নিয়ে এখন মাথা ঘামানোর দরকার নেই, সভাতে স্থির করলেই চলবে। বরনারীর নির্বাচনে কিছু গলদ হলেও ক্ষতি হবে না, সদস্যরা যদি হুজুগে মেতে একটু উত্তেজনা আর আনন্দ উপভোগ করেন তা হলেই আয়োজন সার্থক হবে।

কপোত গুহ আর সোহনলাল সাহু যাবার জন্য উঠলেন। অনুকূল চৌধুরী বললেন, হাঁ, ভাল কথা—আমার বেহাই রাখহরি লাহিড়ী সস্ত্রীক কাশী থেকে আসছেন, পুরী ঘুরে এসে কিছুদিন আমার কাছে থাকবেন। এককালে ইনি গোরখপুর ডিভিশনের বড় এঞ্জিনিয়ার ছিলেন, বেশ পণ্ডিত লোক। বয়স আশি পেরিয়েছে, কিন্তু খুব শক্ত আছেন, তাঁর গিন্নীরও প্রায় বাহাত্তর হবে। কাশীতে ছেলের কাছে থাকেন, কিন্তু সেখানকার গরম এখন আর বুড়ো বুড়ীর সয় না। লাহিড়ী মশাইকে অতিথি হিসেবে একটা নিমন্ত্রণপত্র দিও, তাঁর স্ত্রী থাকমণি দেবীকেও দিও। আমি সস্ত্রীক সজ্জনসংগতিতে যাব, বেহাই—বেহানকে বাড়িতে ফেলে রাখা ভাল দেখাবে না।

কপোত গুহ বললেন, নিশ্চয় নিশ্চয়। সোহনলাল আর আমি আপনার বাড়িতে গিয়ে তাঁদের নিমন্ত্রণপত্র দিয়ে আসব।

কপোত গুহর চেষ্টায় বরানগরের ভাগীরথী ভিলা নামক প্রকাণ্ড বাগানবাড়িটি যোগাড় হয়েছে, এখানেই বরনারীবরণ হবে। সজ্জনসংগতির আড়াই শ সদস্য—সদস্যা সকলেই এসেছেন, তা ছাড়া তাঁদের সুপারিশে প্রায় এক শ জন অতিথি হিসাবে আমন্ত্রিত হয়েছেন। চার দিক গাছে ঘেরা খোলা মাঠে সভা বসেছে। যদি বৃষ্টি হয় তবে বাড়ির বড় হল ঘরে উঠে গেলেই চলবে। স্ত্রীপুরুষের আলাদা বসবার ব্যবস্থা হয় নি, অন্যান্য অধিবেশনের মতন এবারেও সকলে ইচ্ছামত মিলে মিশে বসেছেন। কেবল দশ—বারো জন স্কুল—কলেজের মেয়ে এক পাশে দল বেঁধে মহা উৎসাহে আড্ডা দিচ্ছে।

মাঠের এক ধারে সভাপতি অনুকূল চৌধুরী বসেছেন। নিকটেই তাঁর স্ত্রী সরসীবালা দেবী, বেহাই রাখহরি লাহিড়ী, বেহান থাকমণি দেবী এবং কয়েকজন মান্যগণ্য সদস্য—সদস্যা আর আমন্ত্রিত অতিথি আসন পেয়েছেন। কপোত গুহ, সোহনলাল সাহু এবং অন্যান্য কর্মকর্তারাও কাছে আছেন।

প্রথমেই সভাপতি বললেন, আপনারা আমন্ত্রণপত্রে পড়েছেন যে আজ আমরা এখানে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। আশা করি সেটি সকলেরই উপভোগ্য হবে। আমাদের মামুলী কৃত্য যা আছে তা আগে চুকে যাক, তারপর বরনারীবরণ হবে।

যথারীতি বেহালা এসরাজ বাঁশির কনসার্ট, সংগীত নৃত্য, আবৃত্তি আর জলযোগ শেষ হল। অধ্যাপক কপিঞ্জল গাঙ্গুলী বৈদিক যুগের নক্তগোষ্ঠী বা নাইট ক্লাব সম্বন্ধে একটি সারগর্ভ প্রবন্ধ পড়বার উপক্রম করছিলেন, কিন্তু তাঁর পাশের সদস্যরা তাঁকে থামিয়ে দিলেন। তারপর সভাপতি ঘোষণা করলেন—আজ আমরা উপস্থিত মহিলাগণের মধ্য থেকে একজনকে বরনারী রূপে বরণ করব। বরয়িতা অর্থাৎ বিচারক কে হবেন, কাকে আপনারা এই দুরূহ কর্মের যোগ্যতম মনে করেন, তাঁর নাম আপনারাই প্রস্তাব করুন।

রাজলক্ষ্মী দেবী সাহিত্যভাস্বতী, একজন উঁচুদরের লেখিকা। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে, শ্যামবর্ণ লম্বা চওড়া দশাসই চেহারা, মুখটি বেশ ভারী আর গম্ভীর। দশ বৎসর আগেও এঁর লেখা খুব জনপ্রিয় ছিল, কিন্তু সম্প্রতি অর্বাচীন লেখক—লেখিকাদের উপদ্রবে এঁর বইয়ের কাটতি ক্রমশ কমে যাচ্ছে। রাজলক্ষ্মী দেবী দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, আপনারা যা করতে চাচ্ছেন তা আমাদের ভারতীয় সংস্কারের বিরোধী। প্রকাশ্য সভায় একজন পরপুরুষ একজন পরনারীকে বরনারী আখ্যা দিয়ে মাল্যদান করবে—সেই নারী কুমারী সধবা বিধবা যাই হ’ক না কেন—এ অতি অশোভন নীতিবিরুদ্ধ ব্যাপার। বিলাতে এসব অনাচার চলতে পারে, কিন্তু এদেশের রুচিতে তা সইবে না। আমাদের আদর্শ সীতা সাবিত্রী দময়ন্তী, সর্বসাধারণের দৃষ্টিভোগ্যা বিলাসিনী সুন্দরী নয়। একেই তো আজকালকার মেয়েরা সিনেমার নটী হবার জন্য মুখিয়ে আছে, তার ওপর যদি আপনারা বরনারীবরণ আরম্ভ করেন তবে সমাজ অধঃপাতে যাবে। আমি আপনাদের সংকল্পিত অনুষ্ঠানে ঘোর আপত্তি জানাচ্ছি।

কপোত গুহর বৃদ্ধা পিসী পাশেই বসে ছিলেন। ইনি বললেন, রাজলক্ষ্মী ঠিক কথা বলেছে। বরনারী টরনারী চলবে না, যত সব ইল্লুতে কাণ্ড।

রাজলক্ষ্মী দেবীর স্বামী কাউনসিলার বামাপদ ঘোষাল একটু পিছনে বসে ছিলেন। ইনি লাজুক লোক, বেশী কথা বলেন না। এখন কর্তব্য বোধে দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, বরনারীবরণ আমারও পছন্দ নয়।

সভাপতি বললেন, দুজন সদস্যা আর একজন সদস্য আপত্তি জানিয়েছেন। যদি অন্তত চার আনা সদস্যের অমত থাকে তবে আমরা বরনারীবরণ অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেব। শ্রীযুক্তা রাজলক্ষ্মী দেবী সাহিত্যভাস্বতীর সঙ্গে যাঁরা একমত তাঁরা দয়া করে হাত তুলুন।

রাজলক্ষ্মী, তাঁর স্বামী, আর কপোত গুহর পিসী ছাড়া অন্য কেউ হাত তুললেন না। সভাপতি বললেন, বরনারীবরণে যাদের মত আছে তাঁরা এইবারে হাত তুলুন।

প্রায় তিন শ জন হাত তুললেন, যেসব মেয়েরা আড্ডা দিচ্ছিল তারা দু হাত তুললে। সভাপতি বললেন, দেখা গেল পনরো আনার বেশী সদস্যের সম্মতি আছে, অতএব বরনারীবরণ হবে। এখন আপনাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ বরয়িতা বা বিচারকের নাম প্রস্তাব করুন।

কপোত গুহর তালিম অনুসারে বিখ্যাত উপন্যাসলেখক অরিন্দম সান্যাল দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, আমি প্রস্তাব করছি—খ্যাতনামা চলচ্চিত্র—প্রয়োজক শ্রীযুক্ত ভূপেন হালদার মশাইকে বরনারীবরণের ভার দেওয়া হক। নারীর রূপের সমঝদার এর চাইতে ভাল কেউ নেই। আমার মতে ইনিই যোগ্যতম বরয়িতা।

ভূপেন হালদার দাঁড়িয়ে উঠে করজোড়ে বললেন, আপনারা আমাকে মাপ করবেন, আমি এই কাজের মোটেই উপযুক্ত নই। আমি নারী দেখি ক্যামেরার দৃষ্টিতে, পর্দায় তাঁদের রূপ কি রকম ফুটে উঠবে তাই আমার বিচার্য। রক্তমাংসের নরনারী সোজা চোখে কেমন দেখায় তার অভিজ্ঞতা আমার বিশেষ কিছু নেই।

সোহনলালের উসকানিতে আর একজন সদস্য প্রস্তাব করলেন, প্রবীণ চিত্রকর স্বনামখ্যাত নিখিলেশ্বর সেন মহাশয়কে বরয়িতা করা হক!

নিখিলেশ্বর হাত জোড় করে বললেন, মাপ করবেন মশাইরা। কাচ্চা বাচ্চা নিয়ে ঘর করি, সাহায্য করবার দ্বিতীয় লোক নেই, গৃহিণীই একমাত্র ভরসা। তিনি বাড়িতে ঘরকন্নার কাজে ডুবে আছেন এই মওকায় যদি আমি একজন বরনারীকে মাল্যদান করি তবে গৃহিণী খুশী হবেন না। কাগজে আর ক্যাম্বিসে হরেক রকম বরনারী আঁকতে পারি—শাড়ি সিঁদুর—টিপ পরা মেম, ঢুলু ঢুলু চৈনিক—নয়না ওরিয়েণ্টাল ললনা, পটের সুন্দরী যার পটোলচেরা চোখ মুণ্ডুর বাইরে বেরিয়ে আসে—সব রকমই আমি এঁকে থাকি। কিন্তু একজন জলজ্যান্ত সুন্দরীকে সামনাসামনি বরণ করব এমন বুকের পাটা আমার নেই।

ছাত্রীদের আড্ডা থেকে রব উঠল, যত সব ভীরু কাওয়ার্ড।

প্রতাপগড় কলেজের ভূতপূর্ব প্রিনসিপাল গগন বাঁড়ুজ্যে বললেন, আমাদের সদস্যদের সংকোচ হবারই কথা। এত দিন ধরে যাঁদের দেখে আসছেন তাঁদের একজনকে আজ হঠাৎ বরমাল্য দিতে চক্ষুলজ্জা হতেই পারে। বরনারীবরণের ভার কোনও নতুন লোককে দেওয়াই ভাল। ভাগ্যক্রমে রিটায়ার্ড এগজিকিউটিভ এঞ্জিনিয়ার শ্রদ্ধেয় রাখহরি লাহিড়ী মশাই এখানে উপস্থিত আছেন। ইনি বহুদর্শী বিচক্ষণ ঋষিতুল্য লোক, বয়সে আমাদের সকলের চাইতে বড়, নির্ভীক স্পষ্টবক্তা বলে এঁর খ্যাতি আছে। কর্নেল গ্রেহাম সাহেবকে ইনি মুখের ওপর ড্যাম ফুল বলেছিলেন, সেজন্যই রায়বাহাদুর খেতাব পান নি। আমার প্রস্তাব, এঁকেই বরয়িতা করা হোক।

একজন সদস্য এই প্রস্তাবের সমর্থন করলেন। অনুকূলবাবু তাঁর বেহাইকে বললেন, আপত্তি করবেন না লাহিড়ী মশাই, আপনিই আমাদের ভরসা। রাখহরি বাবু তাঁর পত্নীকে জিজ্ঞাসা করলেন, গিন্নী কি বল, রাজী হব নাকি?

থাকমণি দেবী কানে একটু কম শোনেন, ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারেন নি। অনুকূলবাবুর স্ত্রী সরসীবালা তাঁকে সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিলেন। থাকমণি বললেন, বেশ তো, যাকে পছন্দ হয় মালা দাও না গিয়ে, কে বারণ করছে। আমি তো একটা অখদ্যে থুত্থুড়ী বুড়ী।

সরসীবালা বললেন, ওকি দিদি, খুশী মনে হুকুম দিন, তা না হলে ওঁর যেতে সাহস হবে কেন। সভায় এত লোক ওঁর জন্য হা—পিত্যেশ করছে, ওদের হতাশ করবেন না।

থাকমণি বললেন, হ্যাঁ গো হাঁ, খুশী মনেই বলছি। ওই তো গণ্ডা গণ্ডা রূপসী বসে রয়েছে, যাকে মনে ধরে স্বচ্ছন্দে মালা দিয়ে এস, আমার তাতে কি।

থাকমণি দেবী একটু বেশী বুড়ো হয়ে পড়েছেন, কিন্তু তাঁর স্বামীর চেহারাটি দেখবার মতন। লম্বা মজবুত গড়ন, ফরসা রং, পাকা চুল, পাকা গোঁফ—দাড়ি, যেন থিয়েটারের ভীষ্ম। পত্নীর সম্মতি পেয়ে রাখহরিবাবু দাঁড়িয়ে উঠে স্মিতমুখে বললেন, সভাপতিভায়া, মাননীয় মহিলা ও ভদ্রবৃন্দ, মা—লক্ষ্মীগণ এবং দিদিমণিগণ আমার ওপর আপনারা বড় কঠিন কর্তব্য চাপিয়েছেন। কিন্তু আমি পিছপা নই, এর চাইতেও শক্ত কাজ ঢের করেছি। গোড়াতেই আমি বরনারীর লক্ষণ সম্বন্ধে দু—চার কথা বলতে চাই। ইংরেজীতে প্রবাদ আছে—beauty is skin deep, অর্থাৎ রূপের দৌড় চামড়া পর্যন্ত। কথাটা ডাহা মিথ্যে। শুধু চামড়ায় নয়, নারীর মাংস হাড় মজ্জা সর্বত্রই রূপের সন্ধান করতে হবে।

একটা ফাজিল মেয়ে বললে, চিরে চিরে দেখবেন নাকি সার?

—আরে না না, তোমাদের কোনও ভয় নেই, আমি এক নজরেই ভেতর বার সব টের পাই। যা বলছিলুম শোন। মানুষের যেমন তিন দশা—বাল্য—যৌবন—জরা, নারীর যৌবনেরও তেমনি তিন দশা—আদ্য—মধ্য আর অন্ত্য। এই তিন যৌবনের তোয়াজ বা পরিচর্যার পদ্ধতি আলাদা, প্রসাধন বা মেরামতও এক রকমের হয় না। কি রকম জানেন? মনে করুন একটা ইমারত তৈরী হল। প্রথম পনরো বৎসর তার হেপাজত খুব সোজা, মাঝে মাঝে চুনকাম আর রং ফেরালেই যথেষ্ট। কিন্তু আরও পরে দেখবেন, এক এক জায়গায় পলেস্তারা খসে গেছে, দরজা জানালার রং চটে গেছে। তখন রীতিমত মেরামত করতে হবে। ত্রিশ—চল্লিশ বছর পরে দেখবেন, স্থানে স্থানে ভিত বসে গেছে, দেওয়ালে ফাটল ধরেছে, ছাত চিড় খেয়েছে। তখন শুধু দাগরাজি নয়, থরো রিপেয়ার দরকার, হয়তো দু—চার জায়গায় পিলপে গেঁথে কড়িতে চাড় দিতে হবে, ফাটা দেওয়াল জুড়তে হবে। ফেস লিফটিং জানেন? বিলেতে খুব চলন আছে, আমাদের মা—লক্ষ্মীরা কেউ করিয়েছেন কিনা জানি না। বেশী বয়সে গাল ঝুলে পড়বে রগের চামড়া টেনে সেলাই করে দেয়, তাতে যৌবনশ্রী ফিরে আসে। ফাটা দেওয়াল যেমন লোহার প্লেট আর নাট—বোল্টু দিয়ে টেনে রাখা হয় সেইরকম আর কি! আসল কথা আমাদের এই দেহমন্দির একটা ইমারতের সমান, যতদিন খাড়া থাকে ততদিনই তার তোয়াজ করতে হয়। কিন্তু ইমারত পুরনো হলেই বরবাদ হয় না, হাল ফ্যাশনের অনেক বাড়ির চাইতে আমাদের বাপ—পিতামোর আমলের সেকেলে বাড়ি ঢের ভাল। বরনারীও সেইরকমে বিচার করতে হবে। শুধু কম বয়স আর ওপরচটকে ভুললে চলবে না মশাই, দেখতে হবে বনেদ কেমন, গাঁথনি কেমন, ভূমিকম্প আর ঝড়বৃষ্টির ধকল সইতে পেরেছে কিনা। আচ্ছা, কথা তো বিস্তর বলা হল, এখন ইনস্পেকশন আরম্ভ করা যাক। কই হে সেক্রেটারি, তোমাদের বরমাল্য কই?

কপোত গুহ একটি প্রকাণ্ড মালা এনে বললেন, এই যে সার। রাখবরিবাবু মালাটি হাতে নিয়ে বললেন, বাঃ, খাসা মালাটি, বোধ হয় সের খানিক জুঁই ফুল আছে। বরমাল্য এইরকমই হওয়া উচিত। আজকাল হয়েছে গ্যালভানাইজ তারে গাঁথা ফুল—পাতার মালা, খ্রীষ্টানরা যেমন কবরে দেয়। এক জায়গায় আমাকে ওইরকম একটা মালা দিয়েছিল, গিন্নী রেগে গিয়ে টান মেরে সেটা ফেলে দিয়েছিলেন।

রাখহরি লাহিড়ী মন্থরগতিতে পরিক্রমণ আরম্ভ করলেন। প্রথমেই ছাত্রীদের দলের কাছে এসে বললেন, বগের মত গলা বাড়াচ্ছিস কি, তোদের মালা দিচ্ছি না। তোরা হলি কাঁচা কংক্রিট, পোক্ত হতে বহুকাল লাগবে।

একটি মেয়ে চুপি চুপি বললে, দাদু দয়া করে রাজলক্ষ্মী দেবীর গলায় মালা দিন, ভীষণ মজা হবে।

চোপ বলে ধমক দিয়ে রাখহরি এগিয়ে চললেন। প্রত্যেক মহিলার সামনে এসে একটু থামেন, তার পর আবার চলেন। সভায় চাপা গলায় তুমুল গুঞ্জন আরম্ভ হল। সদস্যরা বলাবলি করতে লাগলেন—বুড়ো কাকে মালা দেবে মনে হচ্ছে? নিশ্চয় হ্লাদিনী দেবীকে—উঃ, কি মারাত্মক কায়দায় শাড়ি পরেছে দেখ। কই না, ওর দিকে একবার তাকিয়েই তো এগিয়ে চলল। ওই দেখ, বঞ্জুলা নিয়োগীকে ঠাউরে দেখছে। নাঃ বুড়োর পছন্দ কিচ্ছু নেই, ঘাড় নেড়ে আবার চলল। বোধ হয় কলাবতী ভৌমিককে পছন্দ করবে। ওঃ, চুল বাঁধার স্টাইলখানা দেখ। আরে গেল যা, ওকেও তো ফেলে চলে গেল! কাকে মালা দেবে বুড়ো, সুন্দরী আর কই? এই মাটি করলে, রাজলক্ষ্মী দেবীর কাছে থেমেছে, শেষটায় ওকেই মনে ধরল নাকি? নাঃ, একটু হেসে ঘাড় নেড়ে আবার চলেছে।

রাখহরি লাহিড়ী সমস্ত মহিলা পরিদর্শন করে ফিরে আসছেন দেখে কপোত গুহ আর সোহনলাল হন্তদন্ত হয়ে তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, কি হল সার, মালা দিলেন না?

এই যে দিচ্ছি ভাই—এই বলে রাখহরি হন হন করে তাঁর বসবার জায়গায় ফিরে এসে মৃদু স্বরে বললেন, গিন্নী! মাথাটা তোল। থাকমণি থতমত খেয়ে ঘাড় উঁচু করলেন, রাখহরি ঝুপ করে মালাটি তাঁর গলায় দিলেন।

নিমেষকালমাত্র সভা চিত্র র্পিতবৎ স্তব্ধ হয়ে রইল। তার পর তিন দিক থেকে তীব্র আলোর ঝলক থাকমণি দেবীর শীর্ণ মুখে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে তিনটে ক্যামেরায় লেন্স উন্মীলিত হল—ক্লিক ক্লিক ক্লিক। থাকমণি চমকে উঠে মুখ বেঁকিয়ে বললেন, আঃ, জ্বালিয়ে মারলে, এদের মতলবটা কি, খুন করবে নাকি?

তুমুল করতালির শব্দে সভা যেন ফেটে পড়ল, যেসব মহিলার রূপের খ্যাতি আছে তাঁরাই সবচেয়ে বেশী হাততালি দিলেন। ছাত্রীর দল হেসে লুটোপুটি খেতে লাগল।

হট্টগোল একটু থামলে রাজলক্ষ্মী দেবী দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, আজকের অনুষ্ঠানটি অতি মনোজ্ঞ হয়েছে, আমরা অনাবিল আনন্দ উপভোগ করেছি। মহিলাদের পক্ষ থেকে আমি শ্রদ্ধাস্পদ শ্রীযুক্ত রাখহরি লাহিড়ী মহাশয়কে অসংখ্য ধন্যবাদ দিচ্ছি, তাঁর বরনারীবরণ অনবদ্য হয়েছে। শ্রীযুক্ত থাকমণি দেবী আজ যে দুর্লভ সম্মান পেলেন তার জন্যে তাঁকেও আমরা অভিনন্দন জানাচ্ছি। তাঁকে মাল্যদান করে শ্রীলাহিড়ী সমস্ত পুরুষজাতির সমক্ষে একটি সুমহান আদর্শ স্থাপন করেছেন। এই বলে রাজলক্ষ্মী দেবী তাঁর স্বামী বামাপদ ঘোষালের দিকে কটমট করে তাকালেন।

সরসীবালা তাঁর বেহানকে বললেন, কি দিদি, এখন খুশী হয়েছেন তো?

—রাম রাম, কি ঘেন্না, কি ঘেন্না বুড়োর বুদ্ধিশুদ্ধি কি একেবারে লোপ পেয়েছে! বাড়ি চল বোন, এখানে আর একদণ্ড নয়, সবাই প্যাঁট প্যাঁট করে তাকাচ্ছে।

১৩৬০(১৯৫৩)