বরকধঝ-কচতটপ রহস্য – ৫

০৫.

বাংলোয় গিয়ে সুকমল সেনের জিপগাড়ি দেখতে পেলাম না। ভোলা উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়েছিল। আমাদের দেখতে পেয়ে দৌড়ে এল। নীতাকে বলল–মেমসায়েব! বিলুবাবু শাসিয়ে গেল, আপনারা এখানে থাকলে বাংলো জ্বালিয়ে দেবে। বিশ্বাসবাবু এসেছিলেন। উনি থানায় খবর দিতে গেছেন। গার্ডরা এখন বাড়িতে গিয়ে ঘুমুচ্ছে। একটা কিছু হলে কে আটকাবে বুঝতে পারছি না।

কর্নেল নীতাকে বললেন তুমি আমাদের রুমে গিয়ে বসো। বেরিও না। আর ভোলা! আমাদের ব্রেকফাস্ট দক্ষিণের বারান্দায় দিয়ে যাও। জয়ন্ত, কুইক! আমাদের রুমের দরজা খুলে দাও গে।

নীতাকে দরজা খুলে ঢুকিয়ে দিয়ে দক্ষিণের বারান্দায় বসলাম। ভোলা ব্রেকফাস্ট দিয়ে গেল। কর্নেল আস্তেসুস্থে টুপি সাফ করলেন। একটা ব্রাশ ওঁর কিটব্যাগেই থাকে। তারপর তেমনি ধীরেসুস্থে খেতে শুরু করলেন। কাঠপাচার নিয়ে সেনসায়েবের সঙ্গে ঝন্টুবাবু, মানে শচীন মজুমদারের বিরোধ এবং পরে মিটমাটের যে ঘটনা নব মালীর কাছে শুনেছি, কর্নেলকে তা জানিয়ে দিলাম। কর্নেল কোনও মন্তব্য করলেন না। তখন বললাম বাবার সঙ্গে মিটমাট। অথচ ছেলের সঙ্গে বিবাদ। ছেলেকে খুন করতে লোক পাঠিয়েছিল। এদিকে নীতা বলছিল, সে কিছুই জানে না। তার কথাবার্তায় অবিশ্বাস করার কিছু পেলাম না।

বলে নীতার কাছে তার জীবনকাহিনী যেটুকু শুনেছি, তার বিবরণ দিলাম। কর্নেল তবু কোনও মন্তব্য করলেন না।

বিরক্ত হয়ে বললাম–কী মনে হচ্ছে বলবেন তো? আপনি তো মাঝে মাঝে দেয়ালের ওপারে কী ঘটছে, তাও নাকি দেখতে পান। এখন পাচ্ছেন না?

কর্নেল ন্যাপকিনে ঠোঁট মুছে দাড়ি ঝেড়ে কফির পট থেকে কফি ঢাললেন। তারপর বললেন–তুমি তো জানো জয়ন্ত, খাওয়ার সময় আমি কথা বলা পছন্দ করি না। বহুবার তোমাকে বলেছি এ কথা। এর তিনটে কারণ আছে, ও বলেছি। এক, গলায় খাবার আটকে যেতে পারে। দুই, অমনোযোগীর পেটে খাদ্য হজম হয় না। তিন, খাদ্যের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হতে হয়।

হেসে ফেললাম।– সরি! ভুলে গিয়েছিলাম। তো এবার বলুন, কেন বিলুবাবুকে সেনসায়েব খতম করতে চান। অর্থাৎ আপনার এ সম্পর্কে থিওরিটা কী?

কর্নেল প্রায় আগুনে জল ঢেলে নিভানোর মতো বললেন–সেনসায়েবই যে ওই লোকটাকে ভোজালির কোপ বসাতে পাঠিয়েছিলেন, তার মূল লক্ষ্য যে নীতাই ছিল না, তা-ই বা কী করে বলা যাবে? তবে এটা ঠিক, লক্ষ্য যতি নীতা হয়, তাহলে বিলুকেও তার হাতে মরতে হতো।

সায় দিতে বাধ্য হলাম।-ঠিক। কিন্তু বিলু কেন ভাবল সেনসায়েবই তাকে খুন করার জন্য বউকে টোপ করেছিলেন?

–এ থেকে শুধু এটুকুই বলা চলে, সেনসায়েব কেমন লোক, বিলু ভালোই জানে। তাছাড়া তার বাবার সঙ্গে সেনসায়েবের বিরোধ ছিল–তুমিই বললে! তাই ঘিরে সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক, সেনসায়েব বাবার ওপর রাগ ছেলের ওপর ঝাড়তে চেয়েছে। আরও একটা কথা। তার প্রেমিকাকে সেনসায়েবের মতো বয়স্ক লোক বিয়ে করেছেন। জয়ন্ত, যার ওপর রাগ থাকে, আক্রান্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে তার ওপরই সন্দেহটা গিয়ে পড়ে।

–তাহলে আপনি বলতে চান বিলুর সন্দেহ ভুল?

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন–আমি কিছুই বলতে চাই না। এই ঘটনা সম্পর্কে নিছক কিছু যুক্তিসম্মত প্রশ্ন তুলেছি। দ্যাটস্ মাচ।

কর্নেল চোখ বুজে দাড়িতে আঁচড় কাটতে থাকলেন। আমার দৃষ্টি গেটের দিকে। বিলু দলবল নিয়ে এসে হামলা করতে পারে। আমি তার প্রাণ বাঁচিয়েছি। কাজেই আমার বিশ্বাস, তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ফেরত পাঠাতে পারব। আর তার আগে অনন্ত বিশ্বাস পুলিশ নিয়ে হাজির হলে তো ভালই। নীতা বেচারার জন্য আমার খারাপ লাগছে। ও জানে না ওর বদ্ধ পাগল বাবা এখন কলকাতায় পুলিশের হাজতে বন্দী।

কর্নেল হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। হাঁক দিলেন–ভোলা।

 ভোলা এসে সেলাম দিল।

–এগুলো নিয়ে যাও। আর শোনো, মেমসায়েব যে আমাদের রুমে আছেন, কাকেও বলো না। বললে তুমিই বিপদে পড়বে। বুঝতে পেরেছ?

ভোলা ব্যস্তভাবে বলল-হ্যাঁ, স্যার। হ্যাঁ, স্যার।

-সেনসায়েব এসে জিজ্ঞেস করলে বলবে, বিলুবাবুর সঙ্গে নদীর ওপারে যেতে দেখেছিলে ফিরতে দেখনি মেমসায়েবকে, কেমন?

–আজ্ঞে। তবে দেখবেন স্যার, আমি গরিব মানুষ। কোনও সাতে-পাঁচে থাকি না।

–মনে রেখো, যা বললাম। এসো জয়ন্ত।

কর্নেল ঘরে ঢুকলেন। আমিও ওঁকে অনুসরণ করলাম। কর্নেল দরজা ভেতর থেকে লক-আপ করে এয়ারকন্ডিশনার চালিয়ে দিলেন। চেয়ারে বসে আছে নীতা। মাথা টেবিলে এবং খোঁপা খুলে চুল এলিয়ে পড়েছে। নিঃশব্দে কাঁদছে।

কর্নেল পাশের চেয়ারে বসে চাপাস্বরে বললেন-মনকে শক্ত করো নীতা। হাতে সময় কম। তোমার সেফটির দায়িত্ব আমার। ওঠো। সোজা হয়ে বসো। কয়েকটা প্রশ্নের জবাব চাইছি তোমার কাছে।

নীতা আত্মসম্বরণ করে বলল–আপনি আমার বাবার মতো। আমাকে বাঁচান আপনি।

–তুমি দেবীবাবুর মেয়ে। তোমার বাবা বদ্ধ পাগল। নাম জিজ্ঞেস করলে বলেন, বরকধঝ কচতটপ। তাই না?

নীতা মাথা দোলাল শুধু।

তোমার বাবা কোথায় আছেন জানো?

–চণ্ডীকাকা চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, বাবা এখানে শচীনজেঠুদের উন্মাদ আশ্রমে আছেন। আমার স্বামী হঠাৎ গতকাল সকালে বলল, চলো। তোমার বাবাকে দেখে আসবে। তারপর এখানে এনে তুলল। আমি ভয় পেয়েছিলাম। হয়তো আমাকে এখানে পার্টি দিতে এনেছে। এবং আমাকে কাকেও অবলাইজ করতে হবে। বিলুকে চিঠি লিখে পাঠানোর এ-ও একটা কারণ। সুযোগটা ছাড়তে চাইনি।

কর্নেল একটু চুপ করে থেকে বললেন–গতরাতে তোমার স্বামী বাইরে বেরিয়ে ছিলেন কি?

–হ্যাঁ। কে দরজা নক করল। তখন বেরিয়েছিল। আমি কিছু জিজ্ঞেস করিনি।

বাই দা বাই, তোমার স্বামী বিয়ের আগে তোমার বাবার অবস্থা জানতেন?

–হ্যাঁ। সবই জানত। আমার মামা ছিলেন কন্ট্রাক্টার। আমার স্বামী ছিল মামার উড সাপ্লায়ার।

আমি বলে উঠলাম–কাঠ সাপ্লাই করতেন ভদ্রলোক? এখনও তো তাই করেন। তাই না?

নীতা বলল–এখন কী করে, আমি বুঝতে পারি না। এখানে-ওখানে পার্টি দেয়। বলে, বিজনেস করছি। কী বিজনেস আমি জানি না। হি ইজ আ স্কাউন্ডেল। আই হেট হিম্।

কর্নেল বললেন–বাই দা বাই, তুমি অমরেশ রায় নামে কাকেও চেনো?

নীতা একটু দ্বিধার সঙ্গে বলল–নামটা চেনা মনে হচ্ছে।

–পরিতোষ লাহিড়ি নামে কাকেও চিনতে?

নীতা তাকাল। একটু পরে বলল–শুনেছি নামটা। মনে পড়ছে না।

কলকাতায় তোমার মামার বাড়ি কোথায়?

–বাগবাজারে।

–নকুল মিস্ত্রি লেনে নয় তো?

 নীতা একটু অবাক হয়ে বলল–হ্যাঁ।

–ওখানে একটা ফ্রিডম-ফাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন আছে, জানো?

লক্ষ্য করিনি।

–বিয়ের সময় তোমার স্বামী কোথায় থাকতেন?

–ওই পাড়াতেই। বিয়ের পর আমরা লেকটাউনে নতুন ফ্ল্যাটে চলে গিয়েছিলাম। এখন সেখানেই থাকি।

–তোমার স্বামী কি একা থাকতেন বিয়ের আগে?

-না। ওর মা ছিলেন। অসুস্থ মহিলা। লেকটাউনে গিয়ে মারা যান। ভদ্রমহিলা খুব ভালো মানুষ ছিলেন। ওঁর কাছেই জানতে পেরেছিলাম, আমার স্বামীর একটা বউ ছিল। সেই মহিলা স্যুইসাইড করেছিলেন। আমি বুঝতে পেরেছি, কেন সুইসাইড করেছিলেন। আর কিছুদিন পরে আমাকেও হয়তো তাই করতে হবে।

নীতা সেন আবার কেঁদে ফেলল। কর্নেল বললেন–তুমি ভালোভাবে যাতে বেঁচে থাকো, আমি তার চেষ্টা করব। তোমার মামা বেঁচে আছেন?

না। গত মাসে স্ট্রোক হয়ে মারা গেছেন। মামার মৃত্যুর পর ওঁদের ফ্যামিলি নানা জায়গায় ছড়িয়ে গেছে। কিন্তু আমার আর আশ্রয় নেই কর্নেল সরকার।

বাই দা বাই, কোনও মিনিস্টারের সঙ্গে মিঃ সেনের খাতির আছে জানো?

-হ্যাঁ। এখানকার লোক। প্রতাপ সিংহ নাম। কলকাতায় একটা পার্টিতে এসেছিলেন। ও আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। মিনিস্টার আমার বাবাকে চেনেন। জিজ্ঞেস করেছিলেন বাবার কথা।

আর একটা প্রশ্ন। তোমাদের ফ্ল্যাটে অমরেশ রায়ের লেখা বাংলার আগস্ট বিপ্লব নামে কোনও বই দেখেছ কখনও?

নীতা শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বলল–হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওতে বাবার কথাও লেখা আছে। আমি পড়েছিলাম কিছুটা। পুরনো বই। ছেঁড়াখোঁড়া অবস্থায় ছিল। আমার স্বামীই আমাকে দিয়েছিল বইটা। লেখকের নামের পাতা ছেঁড়া ছিল। কিন্তু প্রত্যেক পাতায় বইয়ের নাম লেখা ছিল।

–একসময় বইয়ের নাম প্রত্যেক পাতায় ছাপানো থাকত। আজকাল এই রীতি। প্রায় উঠে গেছে। বলে কর্নেল ঘুরলেন আমার দিকে–জয়ন্ত বাইরে গাড়ির শব্দ শুনছি। সাবধানে বেরিয়ে গিয়ে দেখে এসো।

দরজা খুলে দেখি, গেটের ওধারে একটা পুলিশভ্যান থেকে চারজন বন্দুকধারী কনস্টেবল নামছে। তারপর নামলেন এক পুলিশ অফিসার এবং ফরেস্ট ডিপার্টের অনন্ত বিশ্বাস। আমি তখনই ঘরে ঢুকে পড়লাম। বললাম–পুলিশ! অনন্তবাবু বাংলো পাহারা দিতে এনেছেন মনে হলো।

নীতা কী বলতে যাচ্ছিল, কর্নেল ঠোঁটে আঙুল রেখে বললেন–চুপ!

কিছুক্ষণ পরে দরজায় নক হলো। কর্নেল ইশারায় নীতাকে বাথরুমে ঢুকতে বললেন। তারপর গিয়ে দরজা খুললেন। কী ব্যাপার অনন্তবাবু? ভোলা বলল, কে নাকি বাংলোয় আগুন ধরিয়ে দেবে বলে শাসিয়ে গেছে।

অনন্তবাবুর কথা শোনা গেল–হ্যাঁ, স্যার! সেনসায়েব যতবার আসবেন, একটা না একটা ঝামেলা হবে। অথচ কিছু করার নেই। ওপর থেকে ইনস্ট্রাকশন আছে।

কর্নেল বেরিয়ে গেলেন। আমিও বেরিয়ে গেলাম। বারান্দায় বেতের চেয়ারে ঠ্যাং তুলে বসে তরুণ বয়সী পুলিশের দারোগাবাবু জুতোয় বেটন ঠুকছিলেন। অনন্তবাবু বললেন–ছোটবাবু! ইনিই কর্নেলসায়েব। এঁর কথা বলছিলাম আপনাকে। আর ইনি জানালিস্ট।

ছোটবাবু ঠ্যাং নামিয়ে ভদ্রতা দেখালেন। বললেন–বসুন কর্নেলসায়েব! গল্প করা যাক। বিশ্বাস ক’কাপ চা পাঠিয়ে দিন। ওদেরও দেবেন।

কনস্টেবলরা বারান্দা দিয়ে বাংলো পরিক্রমা করছে। তাদের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিয়ে ছোটবাবু আবার বললেন–আসুন কর্নেলসায়েব। বিশ্বাস বলছিল, আপনি নাকি পাখিটাখি দেখতে ভালোবাসেন। পাখিটাখিতে কী আছে বলুন তো?

কর্নেল একটু হেসে বললেন-সদ্য জয়েন করেছেন?

-অ্যাঁ হ্যাঁ।

–ট্রেনিংয়ের পরই এই সাংঘাতিক জায়গায় পোস্টিং?

 সাংঘাতিক কিছু তো দেখছি না। আপনি দেখেছেন নাকি?

 –দেখেছি।

–দেখেছেন? কী দেখেছেন? কোথায় দেখেছেন?

বরকধঝ-কচতটপ।

 ছোটবাবু সোজা হয়ে বসলেন।–আর ইউ জোকিং উইদ মি? মাইন্ড দ্যাট, আই অ্যাম অন ডিউটি।

কর্নেল অট্টহাসি হাসলেন।–সে কী! আপনি এখানকার পাগলাগারদ-সরি! উন্মাদ আশ্রম দেখেননি?

–হোয়াট ডু ইউ মিন টু স্যে?

–এখানকার পাগলরা সাংঘাতিক। কাগজে বিজ্ঞাপন পড়েছি একজন খুনে পাগল পালিয়ে গেছে গরাদ ভেঙে! এটা তো আগে লোকাল পুলিশের জানার কথা। নাম জিজ্ঞেস করলে সে নাকি বলে বরকধঝ-কচতটপ।

তরুণ ছোটবাবু বাঁকা হাসলেন।–দেন ইউ আর দ্যাট ম্যান, আই থিংক!

 কর্নেল অট্টহাসি হেসে বললেন–ঠিক ধরেছেন। আমিই সে।

ছোটবাবু তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন কর্নেল হোন আর যাই হোন। মশাই, বাড়াবাড়ি করলে আপনাকে আমি অ্যারেস্ট করতে বাধ্য হব।

অনন্তবাবু বিব্রতভাবে বললেন–প্লিজ ছোটবাবু! ইনি খুব বিখ্যাত মানুষ। এঁকে—

ছোটবাবু রাগী মুখে বললেন বিখ্যাত হোন আর যা-ই হোন, ডিউটির সময় আমি জোক পছন্দ করি না।

বলে তিনি আগের মতোই বসলেন এবং টেবিলে ঠ্যাং তুলে দিলেন। কর্নেল ও আমি ঘরে ফিরে এলাম। বললাম–অদ্ভুত লোক তো! মফস্বলে অনেক জাঁদরেল দারোগাবাবু দেখেছি, এরকম কখনও দেখিনি।

কর্নেল হাসছিলেন। বললেন–একজন যথার্থ অ্যাংগ্রি ইয়ংম্যান টাইপ বলা চলে। আসলে আজকাল ইয়ংম্যানরা লেখাপড়া শিখে চাকরি জোটাতে পারছে না। দৈবাত জুটে গেলে কাজটা যদি ক্ষমতার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে, বেকার জীবনের ফ্রাস্ট্রেশন অবচেতনায় থেকে এক ধরনের ভায়োলেন্ট রিঅ্যাকশন সৃষ্টি করে।

–প্লিজ বস্, সাইকোলজি আওড়ালে আমার মাথা ধরে।

 কর্নেল বাথরুমের দরজায় নক করে আস্তে বললেন নীতা! বেরিয়ে এসো।

কোনও সাড়া এল না। চমকে উঠেছিলাম। ঝোঁকের বশে বাথরুমে আত্মহত্যা করে বসেনি তো নীতা? সাংঘাতিক কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে তা হলে।

কর্নেল দরজা টেনে ভেতরে ঢুকে গেলেন। আমি দুরুদুরু বুকে উঁকি দিলাম ভেতরে। নীতা নেই। বাথরুমের একটা বাইরের দরজা আছে। সব বাংলোতে থাকে ওটা। সুইপার ঢোকার দরজা। কর্নেল সেদিকে আঙুল তুলে বললেন নীতা ওই দরজা খুলে বেরিয়ে গেছে।

সেই দরজার বাইরে ছাইগাদা, আবর্জনার ভঁই আর আগাছার ঝোপ। এদিক দিয়ে কেউ গেলে কারও নজরে পড়ার কথা নয়। ঝাউ, ক্যাকটাস, লতাগুল্মের জঙ্গল। বোগানভিলিয়ার প্রকাণ্ড ঝোপ, ফুলে লাল হয়ে আছে। কর্নেল শ্বাস ফেলে বললেন-দরজাটা বন্ধ করে দাও।

দরজা এঁটে বললাম–পালিয়ে গেছে নীতা। ভারী অদ্ভুত তো! পাকা অভিনেত্রী বোঝা যাচ্ছে।

কর্নেল আস্তে বললেন–হুঁ। পালিয়ে গেছে। তবে এ পালানো কি ওর বর্তমান জীবন থেকে, নাকি…

কর্নেল কথা শেষ করলেন না। মেঝে থেকে এক টুকরো কাগজ কুড়িয়ে নিলেন। কাগজটার ওপর আমারই দাড়িকাটা ব্রাশ চাপানো। ব্রাশটা কর্নেল আমাকে দিয়ে ঘরে ঢুকলেন। ব্রাশটা ঝটপট বেসিনে রগড়ে ধুয়ে তোয়ালেতে হাত মুছে ঘরে গেলাম। দেখলাম, কর্নেল কাগজের টুকরোটা খুঁটিয়ে পড়ছেন।

আমাকে দিয়ে বললেন–-পড়ে দেখ।

কাগজের টুকরোতে লেখা আছে : ক্ষমা করবেন। এরপর আর আমার এখানে থাকা চলে না। আমাকে চলে যেতেই হতো। এই সুযোগ ছাড়তে পারলাম না।
ইতি
হতভাগিনী নীতা

টেবিলে কর্নেলের সেই ছোট্ট প্যাডটা পড়ে আছে। সেটা ছিঁড়ে কর্নেলেরই কলমে লেখা চিঠি। আঁকাবাঁকা বড়-বড় হরফে লেখা। কর্নেলকে ফেরত দিয়ে বললাম–ওদের ঘরের চাবি নিশ্চয় ওর কাছে ছিল। নিজের জিনিসপত্র নিয়ে যেতে পারত। এভাবে নাটক করে ব্যাকডোর দিয়ে পালাল কেন সেনসায়েবের মেমসায়েব? নিজের ঘরে ঢুকতে অসুবিধা কী ছিল?

কর্নেল মাথা দোলালেন।–রিস্ক নিতে চায়নি। যে কোনও মুহূর্তে সেনসায়েব এসে পড়তে পারেন ভেবেছিল। কিংবা ধরো যা বলছিলাম একটু আগে–নিজের বর্তমান জীবনের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে চলে গেছে।

বাপস্! এই বয়সেও আপনি তুখোড় রোমান্টিক।

কর্নেল দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন–হ্যাঁ। আমি প্রচণ্ড রোমান্টিক। রোমান্টিক বলেই প্রকৃতি এবং মানুষের কাজে রহস্য টের পেলে মেতে উঠি। যাই হোক, ভোলাকে খবর দাও। বারোটায় লাঞ্চ খাব। শোনো! ভোলাকে নীতা সম্পর্কে কোনও কথা বলবে না।….

বাংলো থেকে বেরুনোর সময় দেখলাম, সেই ছোটবাবু নেই। বন্দুকধারী চার কনস্টেবল লনের ওদিকে গাছের ছায়ায় বেঞ্চিতে বসে গল্প করছে! কেউ খৈনি ডলছে। কেউ সিগারেট টানছে। সেনসায়েবের জিপটা নেই। পুলিশভ্যানও নেই।

কর্নেলের সঙ্গে যাওয়া মানেই আফ্রিকান সাফারি। বনবাদাড় ভেঙে আমাকে কোথায় নিয়ে চলেছেন কে জানে। মাঝে মাঝে বাইনোকুলারে পাখি-টাখি খুঁজছেন। কখনও প্রজাপতি দেখেই থমকে দাঁড়াচ্ছেন। অবশেষে একটা পিচরাস্তায় পৌঁছে জিজ্ঞেস করলাম–আমরা যাচ্ছিটা কোথায়?

কুমারচক।

আর কতদূর?

বাঁক ঘুরেই দেখতে পাবে। এটা স্টেশনরোড।

অবশ্য রাস্তায় বাস-ট্রাক-টেম্পো সাইকেল রিকশা আর মানুষজনের আনাগোনা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল কাছাকাছি জনবসতি আছে। বাঁকে পৌঁছে সাইকেল রিকশা নিলেন কর্নেল। রিকশাওলাকে বললেন–মিনিস্টার প্রতাপ সিংহের বাড়ি চেনো?

–মিনিস্টার তো রোববারে মিটিং করে কলকাতা চলে গেলেন স্যার। বিকেলে এসেছিলেন। সন্ধ্যার ট্রেনে চলে গেলেন। এখানে উনি তো থাকেন না!

–আহা, ওর বাড়িটা চেনো কি?

 রিকশাওলার সামনের একটা দাঁত ভাঙা। পানে ঠোঁট রাঙা। অমায়িক হাবভাব। বলল–বাড়ি মানে রাজবাড়ির কথা বলছেন? ওনারা এখানকার রাজা ছিলেন শুনেছি। বাড়িটা আছে। তবে কলেজ হয়েছে। আপনি কলেজে যাবেন তো?

–মিনিস্টার এসে ওঠেন কোথায়?

নদীর ধারে ডাকবাংলোয় ওঠেন। আমাদের রিকশাচালক সমিতি থেকে একবার পিটিশন নিয়ে গিয়েছিলাম। খুব উপকারী মানুষ স্যার! রাজাদের জন্যেই কুমারচকের এত উন্নতি। ইস্কুল কলেজ হাসপাতাল।

কর্নেল একটু ভেবে নিয়ে বললেন–সাবরেজেস্ট্রি অফিস চলো। চেনো তো? দলিল রেজেস্ট্রি হয় যেখানে?

–খুব চিনি।

মফস্বল শহর যেমন হয়। ঘিঞ্জি রাস্তা। ভিড়। দোকানপাট। কিছুক্ষণ পরে সরকারি অফিস এলাকায় পৌঁছুলাম। সাবরেজেস্ট্রি অফিসটা দোতলা! প্রাঙ্গণে একটা বটগাছ। দুধারে চালাঘরে ডিড-রাইটারদের ঘিরে ভিড়। প্রাঙ্গণেও জনারণ্য বলা চলে।

কর্নেল বললেন–ওহে রিকশাওলা। ডিড-রাইটার চণ্ডীবাবুকে চেনো?

রিকশাওলা বলল–খুব চিনি। ডেকে দেব স্যার?

বখশিসের লোভ নিশ্চয় তার এই উৎসাহের কারণ। সে ভিড় ঠেলে প্রাঙ্গণে এগিয়ে গেল একটা চালাঘরের দিকে। একটু পরে ফিরে এসে বলল আধঘণ্টা আগে চণ্ডীবাবু বাড়ি চলে গেছেন স্যার! বাড়ি থেকে অসুখের খবর এসেছিল।

-ওঁর বাড়ি চেনো?

–হুঁউ। চলুন। নিয়ে যাচ্ছি। তবে বাড়ি অব্দি রিকশা যাবে না। একটুখানি হাঁটতে হবে।

রিকশাওলা আমাদের আরও ঘিঞ্জি একটা গলির মুখে নামিয়ে দিল। হাত দু তিন চওড়া একটা গলি দেখিয়ে বলল সে–চলুন।

তার সঙ্গে সেই দম আটকে-যাওয়া গলির ভেতর ঢুকলাম আমরা। সামনে একটা পুরনো শিবমন্দিরে গিয়ে গলিটা শেষ হয়েছে। বাঁদিকে একটা একতলা জীর্ণ বাড়ির দরজায় ধাক্কা দিয়ে রিশাওলা ডাকাডাকি শুরু করল। দরজা খুলে বেরুলেন এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক। খালি গা, পরনে নীল লুঙ্গি। মুখে যেমন লম্বা কঁচাপাকা গোঁফদাড়ি, মাথায় তেমনি লম্বা সন্ন্যাসীচুল। কর্নেলকে দেখে তাকিয়ে রইলেন। কর্নেল নমস্কার করে বললেন–আপনি চণ্ডীবাবু?

আজ্ঞে। আপনারা কোথা থেকে আসছেন স্যার?

কলকাতা। বলে কর্নেল রিকশাওলার দিকে ঘুরলেন।–তুমি অপেক্ষা করো। আমরা এখনই ফিরে যাব।

রিকশাওলা চলে গেলে চণ্ডীবাবু বললেনবলুন স্যার!

–সাবরেজেস্ট্রি অফিসে গিয়ে শুনলাম আপনি বাড়ি চলে এসেছেন। কেউ অসুস্থ নাকি?

-আজ্ঞে আমার ওয়াইফ। প্রেশারের রুগী।

–এখন কেমন আছেন?

–ভাল। তা…

–দেবীবাবু আপনার দাদা?

–আজ্ঞে? চণ্ডীবাবু একটু হকচকিয়ে গেলেন প্রথমে। তারপর সামলে নিয়ে বললেন–দূর সম্পর্কের দাদা। পাগল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। শেষে এখানে উন্মাদ আশ্রমে ভর্তি করলাম। শুনেছি কী করে সেখান থেকে পালিয়ে গেছেন। কোনও মানে, খারাপ খবর আছে নাকি স্যার?

-খারাপ বলতেও পারেন। কলকাতায় দুজন লোককে খুনের দায়ে পুলিশ। ওঁকে ধরেছে।

— চণ্ডীবাবু হাত নেড়ে বললেন–মিথ্যা! একেবারে মিথ্যা। হতেই পারে না। দেবীদা মানুষ খুন করতে পারেন? গায়ে একফোঁটা জোর নেই।

–ওঁর মেয়ে নীতার খবর জানেন?

 চণ্ডীবাবু স্পষ্টত চমকে উঠলেন। নীতা? আজ্ঞে সে তো কলকাতায় থাকে। বড় ঘরে বিয়ে হয়েছে শুনেছি। আমার সঙ্গে বহু বছর আর তার দেখাসাক্ষাৎ যোগাযোগ নেই। নীতার কী হয়েছে স্যার?

–কিছু না। দেবীবাবুর নিজের বাড়ি ছিল তো এখানে?

চণ্ডীবাবুর মুখ সাদা দেখাচ্ছিল। বললেন–এই বাড়ির একটা অংশ ছিল দেবীদার। বউদি মরার পর আমাকে বেচে দিয়েছিল। তখন সুস্থ মানুষ। বেচে, দিয়ে কলকাতায় মেয়েকে নিয়ে চলে গিয়েছিল। নীতার মামা বড়লোক। তার কাছে মেয়েকে রেখেছিল। তারপর এখানে ফিরে এল। তখন দেখি পাগল। শচীন মজুমদার ওনার বন্ধু। তার বাড়িতে থাকত। কখনও আমার কাছে এসেও থাকত। ভবঘুরে বাউণ্ডুলে লোক। ব্রিটিশ আমলে জেল খেটেছিল। কোথায়-কোথায় ঘুরত সবসময়।

কর্নেল আস্তে বললেন–চণ্ডীবাবু। নীতা যদি আপনার কাছে এসে থাকে, তাকে লুকিয়ে রাখবেন। কেউ যেন জানতে না পারে। শচীনবাবুর ছেলে বিলু ওকে মার্ডার করতে পারে। আবার নীতার স্বামীও হয়তো

–আপনারা কি পুলিশ থেকে আসছেন স্যার?

কর্নেল সে কথার জবাব না দিয়ে বললেন–আপনার সঙ্গে যদি নীতার স্বামীর কোনও সম্পর্ক থাকে, তবে সাবধান। তার ছায়া মাড়াবেন না।

চণ্ডীবাবু কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন–আমি কিছু বুঝতে পারছি না স্যার।

–পারছেন। বলেই কর্নেল হাঁটতে শুরু করলেন।

 গলির শেষ প্রান্তে গিয়ে ঘুরে দেখি, তখনও চণ্ডীবাবু তেমনি দাঁড়িয়ে আছেন। কর্নেল রিকশায় উঠে বললেন–এবার আমরা উন্মাদ আশ্রমে যাব। চেনো তো হে?

রিকশাওয়ালা একই সুরে বলল–খুব চিনি। চলুন না স্যাব, যেখানে যাবেন।…

.