বরকধঝ-কচতটপ রহস্য – ২

০২.

 এবড়ো-খেবড়ো রাস্তার ধারে একটা জরাজীর্ণ একতলা বাড়ি। এলাকায় প্রমোটারদের নজর পড়েছে, তার লক্ষণ এখানে-ওখানে দেখতে পাচ্ছিলাম। ডোবা, খানাখন্দ, ঝোপঝাড়ের ফাঁকে নির্মীয়মান বাড়ি এবং চাপা যান্ত্রিক কলরব। পেছনে একটা বস্তি। কড়া নাড়ার পর দরজা খুলল একটি মেয়ে। মুখ থেকে এখনও কিশোরীর আদল মুছে যায়নি। ছিপছিপে গড়ন। লাবণ্য আছে। কিন্তু দেখামাত্র বোঝা যায় ওই লাবণ্যে ঘন বিষাদের ছায়া পড়েছে। অনুমান করলাম, আঠারোর মধ্যে বয়স।

সে আস্তে বললকাকে চাই?

কর্নেল বললেন–এটা কি অমরেশ রায়ের বাড়ি?

মেয়েটি শুধু মাথা দোলাল। বিষণ্ণ চোখে কৌতূহলের চাঞ্চল্য ফুটে উঠল। সম্ভবত কর্নেলের পাদ্রীসুলভ চেহারাই তার কারণ।

–আজকের কাগজে খবরটা পড়ে খুব মর্মাহত হলাম। তুমি কি ওঁর মেয়ে?

–হ্যাঁ। আপনি কোত্থেকে আসছেন?

–আমার নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। তোমার বাবার সঙ্গে একসময় আমার খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। আমাকে বহুবার বলেছেন আসতে। সময় করে উঠতে পারিনি। তবে উনি প্রায়ই যেতেন আমার কাছে। তো হঠাৎ আজ কাগজে সাংঘাতিক খবরটা পড়ে চমকে উঠেছিলাম। তাই ভাবলাম একবার যাওয়া উচিত। তোমার নাম কী মা?

নন্দিনী।

–নন্দিনী, তোমার মায়ের সঙ্গে দেখা করে দুটো কথা বলে যেতে চাই।

নন্দিনী আস্তে বলল–মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ডাক্তার ঘুমের ওষুধ দিয়ে গেছেন।

–ও! তাহলে তো তুমি এতটুকু মেয়ে বড় বিপদে পড়ে গেছ। বাড়িতে আর কে আছে?

পাশের বাড়ির জেঠিমারা আছেন। অসুবিধা হচ্ছে না।

–আলাপ করিয়ে দিই। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরি। ওকে সঙ্গে নিয়ে এলাম, তোমাদের কাছে ডিটেলস জেনে নিয়ে কাগজে ফ্ল্যাশ করবে। তাহলে পুলিশের ওপরতলার টনক নড়বে। বোঝো তো, আজকাল যা অবস্থা। চাপে না পড়লে পুলিশ কিছু করে না।

নন্দিনী একটু ইতস্তত করে বলল–মিনিস্টার প্রতাপ সিনহা বাবাকে চেনেন। কাল দুপুরে ওঁকে ফোন করেছিলাম পাশের বাড়ি থেকে। পুলিশ থেকে ডি সি, এসি–সবাই এসেছিলেন। একটু আগেও

বাহ্। তাহলে তো ভালই। মিনিস্টারের ফোন নম্বর তুমি জানতে ভাগ্যিস।

 –বাবার নোটবইয়ে লেখা ছিল।

–তুমি বুদ্ধিমতী নন্দিনী। কর্নেল টুপি খুলে টাকে হাত বুলিয়ে বললেন– মনে পড়ছে, অমরেশবাবু বলেছিলেন, উনি একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। আগস্ট বিপ্লব নিয়ে একটা বইও নাকি লিখেছিলেন। আমাকে দেবেন বলেছিলেন।

পেছন থেকে এক প্রবীণ মহিলা উঁকি দিলেন–আপনারা কি লালবাজার থেকে আসছেন?

নন্দিনী কিছু বলার আগেই কর্নেল বললেন–না। অমরেশবাবু আমার বিশেষ পরিচিত ছিলেন। আজ কাগজে ওর মৃত্যুর খবর পড়ে ছুটে এসেছি। আমার নাম। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। আর এ হলো দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক। জয়ন্ত চৌধুরি। একে সঙ্গে এনেছিলাম, কাগজে আরও লিখে যদি এই সাংঘাতিক মাডারের তদন্ত ভালভাবে হয়।

ভদ্রমহিলা গম্ভীর মুখে বললেন, খুকু। বসার ঘরের দরজা খুলে দাও। কাগজে ভাল করে ছাপা হলে সত্যিকার কাজ হবে। পারুর বাবা বলছিলেন, মিনিস্টার হাজারটা কাজ নিয়ে ব্যস্ত। পুলিশ দায়সারা কাজ করে কেটে পড়বে। পাগলের কাজই যদি হয়, এখনও ধরতে পারল না কেন? এই তো বঙ্কার মা বলল, ওদের বস্তিতে একজন পাগল ঘুরে বেড়াচ্ছে। আপনারা ও ঘরে গিয়ে বসুন। একটু কড়া করে লিখবেন যেন।

নন্দিনী ভেতরে চলে গিয়েছিল। পাশের একটা ঘরের দরজা খুলে সে ডাকল। কয়েক ধাপ সিঁড়ি রাস্তা থেকে উঠে গেছে। ঘরে ঢুকে দেখি, আলমারি ভর্তি বই। একপাশে সাধারণ সোফাসেট। কোনার দিকে একটা টেবিল আর তিনটে চেয়ার। দেয়ালে প্রখ্যাত দেশনেতাদের ছবি টাঙানো।

ভদ্রমহিলা পর্দা তুলে উঁকি মেরে বললেন–খুকু। যা যা হয়েছে, সব বলবে। আমি চা পাঠাচ্ছি। আর শোনো। প্রথমে পুলিশ গা করেনি, তাও বলবে। পারুর বাবা মিনিস্টারের কথা না তুললে তুমিও তো কিছু জানতে না। হোমরা-চোমরা। অফিসাররাও ছুটে আসতেন না।

উনি অদৃশ্য হলে কর্নেল বললেন বসো নন্দিনী।

নন্দিনী কুণ্ঠিতভাবে একটু তফাতে বসল। বলল বাবাকে আগের রাতেও পাগলটা খুব জ্বালিয়েছিল।

কর্নেল বললেন–জয়ন্ত। তুমি নোট করে যাও। নন্দিনীর সব কথা ডিটেলস নোট করো।

আমার সঙ্গে রিপোর্টারস্ নোটবুক সবসময় থাকে। বিরক্তি চেপে সেটা বের করে ডটপেন বাগিয়ে ধরে বললাম–বলো। সরি! বলুন।

নন্দিনী বলল–আমাকে তুমি বলতে পারেন।

-ওক্কে। বলো।

নন্দিনীর কণ্ঠস্বর শান্ত ও বিষণ্ণ। কিন্তু প্রথম যৌবনের উত্তাপ হয়তো মেয়েদের কী এক স্পর্ধিত সাহসও দেয়। সে একটু পরে খানিকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল।

ততক্ষণে কর্নেল আলমারির বই দেখতে উঠে দাঁড়িয়েছেন। তিনটে পুরনো আলমারি ইংরেজি বাংলা বই আর বাঁধানো পত্রিকায় ঠাসা। কর্নেল তন্নতন্ন করে দেখছে। ঝুঁকে পড়ছেন। কখনও হাঁটু দুমড়ে বসছেন। নন্দিনী ইনিয়ে-বিনিয়ে সে রাতের কথা বলে যাচ্ছে। সে শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ভোরে ঘুম ভেঙে বাবার কথা মনে পড়ে যায়। দরজা খুলে বেরিয়ে এসে দেখে, তখনও তার বাবা ফেরেনি। সে সদর দরজা খুলে রাস্তায় যায়। সেইসময় তাদের বাড়ির কাজের মেয়ে বংকার মা ছুটতে ছুটতে এসে খবর দেয়, এইমাত্র বস্তির কে তার বাবাকে খালের ধারে পড়ে থাকতে দেখেছে। মাথায় চাপ-চাপ রক্ত।

নন্দিনীর কণ্ঠস্বর এতক্ষণে কেঁপে গেল। সে ঠোঁট কামড়ে ধরল! কর্নেল বললেন–দ্যাটস এনাফ। মন শক্ত করো নন্দিনী।

কর্নেল এসে সোফায় বসলেন–তোমার বাবার কালেকশন মূল্যবান। বহু দুষ্প্রাপ্য বই আছে। কিন্তু ওঁর লেখা বাংলার আগস্ট বিপ্লব তো দেখলাম না।

নন্দিনী চোখ বড় করে তাকাল। শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বলল–কদিন আগে বাবা বইটা খুঁজছিল। একটামাত্র কপি ছিল। নেই। আমাকে জিজ্ঞেস করছিল, কাকেও পড়তে দিয়েছি নাকি। আমি বাবার বইটা দেখিনি। মাকে জিজ্ঞেস করছিল। মা-ও জানে না কিছু। বাবা তন্নতন্ন খুঁজে বইটা পায়নি। শেষে স্কুলের লাইব্রেরিতে গেল। লাইব্রেরিতে নাকি একটা কপি ছিল। পাওয়া যায়নি। বাবা বলছিল, ভারি অদ্ভুত ব্যাপার!

–তোমার বাবার কাছে নিশ্চয় অনেকে দেখা করতে বা আড্ডা দিতে আসতেন?

-হ্যাঁ। বাবা ফ্রিডম-ফাইটার ছিল। ফ্রিডম-ফাইটারস অ্যাসোসিয়েশন গতবার সভা করে বাবাকে সংবর্ধনা দিয়েছিল। তারা আসতেন। আমি কাকেও চিনি না। অ্যাড্রেসও জানি না। বাবার নোটবইয়ে থাকতে পারে।

কর্নেল গুরুগম্ভীর স্বরে বললেন-জয়ন্ত! এই বইহারানো পয়েন্টটাও নোট করে নাও। নন্দিনী, তোমার বাবার নোটবইটি নিয়ে এসো। অ্যাসোসিয়েশনের অফিসে যোগাযোগ করবে জয়ন্ত।

নন্দিনী উঠে গেল। আমি কথা বলতে যাচ্ছি, কর্নেল ঠোঁটে আঙুল রেখে নিষেধ করলেন। চায়ের ট্রে নিয়ে সম্ভবত বংকার মা ঢুকল। সেই প্রবীণ মহিলা উঁকি মেরে দেখে বললেন–খুকু কোথায় গেল?

কর্নেল বললেন–পাশের ঘরে।

মহিলা অদৃশ্য হলেন। বংকার মাও চলে গেল। চা খেতে খেতে নন্দিনী একটা কালো মোটা নোটবই নিয়ে ফিরে এল। কর্নেল নোটবইটা তার হাত থেকে টেনে নিলেন। পাতা ওল্টাতে থাকলেন। একটু পরে বললেন-জয়ন্ত। লেখো, ১১৭ বি নকুল মিস্ত্রি লেন, কলকাতা-৫।

আমি লিখলাম। কর্নেল চায়ে চুমুক দিয়েই বললেন-সর্বনাশ আমি তো চায়ে চিনি খাই না। থাক্।

নন্দিনী উঠে দাঁড়িয়ে বলল–চিনিছাড়া চা এনে দিচ্ছি। একটু বসুন!

সে চলে গেলে কর্নেল একটা কাণ্ড করে বসলেন। নোটবই থেকে একটা পাতা সাবধানে ছিঁড়ে দ্রুত ভাজ করে পকেটে ঢোকালেন। আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম।

নন্দিনী ফিরে এসে বসলে কর্নেল পাতা উল্টে বললেন–পরিতোষ লাহিড়ির ঠিকানা আছে দেখছি। আমি ভদ্রলোককে চিনি। অমরেশবাবুর সঙ্গে একবার আমার কাছে গিয়েছিলেন। নন্দিনী কি পরিতোষবাবুকে চেনো?

নন্দিনী একটু ভেবে নিয়ে বললনামটা চেনা মনে হচ্ছে। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। গত সোমবার–না, মঙ্গলবার এসেছিলেন। কোথায় একটা মিটিং হবে। বাবাকে বলতে এসেছিলেন। বাবার যাওয়ার কথা ছিল। আজই তো ডেট ছিল। আজ রোববার।

–কোথায় মিটিং হওয়ার কথা মনে পড়ছে? জয়ন্ত, নোট করে।

 নন্দিনী স্মরণ করার চেষ্টা করছিল। বলল কলকাতার বাইরে কোথায় যেন। নোট বইয়ে টোকা থাকতে পারে। বাবা সব লিখে রাখত।

কর্নেল পাতা উল্টে খুঁজতে ব্যস্ত হলেন। বংকার মা চিনিছাড়া চা দিয়ে গেল। কর্নেল সেই চায়ে দিব্যি চুমুক দিলেন। সত্যি বলতে কি, চা আমি অনেক কষ্টে গিলেছি। নন্দিনীদের চা নন্দিনীর মতো নয়। ঠিক বংকার মায়ের মতোই। কথাটা আমার বৃদ্ধ বন্ধুকে ফেরার সময় বলতে হবে।

নন্দিনী বলল–পেলেন না? আমাকে দিন তো।

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। নোটবইটা ওর হাতে দিয়ে বললেন–থ্যাংকস নন্দিনী। অ্যাসোসিয়েশন অফিস থেকে জেনে নেবে জয়ন্ত। চলি! আর শোনো, মাকে আমার কথা বোলো। ভেঙে পড়ো না। শক্ত হয়ে মাথা তুলে দাঁড়াও। আমার নামটা মনে থাকবে তো? কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। বলে পকেট থেকে নেমকার্ড বের করে দিলেন। কিছু ঘটলে মিনিস্টারকে ফোন করার আগে আমাকে ফোন করে জানাবে।

নন্দিনী কার্ডে চোখ বুলিয়ে উঠে দাঁড়াল। মনে হলো, মেয়েটি বড় সরল আর নিষ্পাপ। কর্নেল ওর সঙ্গে ছলনা না করে নিজের প্রকৃত পরিচয় দিলেই পারতেন। হয়তো ও তাতে সাহস পেত মনে। হয়তো কোনও গোপন কথা বলার ছিল, বলল নাকর্নেলের পরিচয় পেলে তা খুলে বলত। কর্নেলের নোটবইয়ের পাতা চুরির দরকারই হতো না। কিন্তু কর্নেল কেন সে-পথে গেলেন না?

গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ঘোরানোর সময় দেখলাম, কালো নোটবই হাতে নিয়ে নন্দিনী বিষাদের প্রতিমূর্তির মতো নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। আমার মন খারাপ হয়ে গেল।

ভি আই পি রোডে পৌঁছুনো অব্দি কর্নেল চোখ বুজে ধ্যানস্থ ছিলেন। এতক্ষণে চোখ খুলে বললেন–ওহে মৃত্যু! তুমি মোরে কি দেখাও ভয়? সে-ভয়ে কম্পিত নয় আমার হৃদয়। দ্যাটস দ্য পয়েন্ট, ডার্লিং!

–কিসের?

–এই রহস্যের। কল্পনা করো জয়ন্ত! এই জুন মাসের রাতদুপুরে লোডশেডিংয়ের সময় তোমার জানালার ধারে দাঁড়িয়ে কেউ পদ্যটা জোর গলায় আওড়াচ্ছে। তুমি। কী করবে?

–কিছুই করব না। কারণ ধরেই নেব, লোকটা পাগল। পাগলের কথায় কান দিলে তার পাগলামি বেড়ে যাবে। কমন সেন্স!

নাহ। এখন তুমি ঘটনাটা জানো বলেই এ কথা বলছ। আচমকা ওই পাগলামি শুরু হলে অবশ্যই তুমি রেগে যাবে। তাকে ধমকাবে। তাড়া করতেও বেরুতে। পারো। ভেবে বলো।

–হ্যাঁ। তবে তাই বলে তার পিছনে বেশিদূর দৌডুব না।

কর্নেল হাসলেন এবার তুমি ঠিক বলেছ। বেশিদূর তাড়া করে তুমি যাবে না। এটাই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত। অথচ লক্ষ্য করার মতো ঘটনা : পাগল প্রথম রাতে আসে। অমরেশ ধমক দেন। পাগল চলে যায়। দ্বিতীয় রাতে আসে। ধমক দেন। শেষে বেরিয়ে তাড়া করেন। প্রায় হাফ কিলোমিটার। এবার পরিতোষের প্রতিক্রিয়া দেখ। উনি শোনামাত্র বেরিয়ে পড়েন। তাড়া করে যান–সেও প্রায় একই দূরত্ব। পদ্যটার মধ্যে কি কোনও পুরনো তিক্ত স্মৃতি লুকিয়ে ছিল? কোনও সাংঘাতিক ঘটনার গোপন স্মৃতি? তবে অমরেশ পরিতোষের চেয়ে সহিষ্ণু। এটুকুই যা তফাত। আর একটা ব্যাপার লক্ষ্য করার আছে। দুজনকেই পাগল নিয়ে গেছে নির্জন জায়গার দিকে। খুনী সম্ভবত সেখানে ওত পেতে বসেছিল। পাগল তার ফাঁদ।

অবাক হয়ে বললাম–আগে তো কখনও এমন ঝটপট আপনাকে থিওরি দাঁড় করাতে দেখিনি। নোটবইটার চুরি করা পাতায় নিশ্চয় কোনও তথ্য পেয়ে গেছেন।

কর্নেল জিভ কেটে মাথা নেড়ে বললেন-ছিঃ ডার্লিং। আমাকে প্রকারান্তরে চোর বোলোলা না। কাজটা যে-কোনও রহস্যে তথ্য সংগ্রহের মধ্যে পড়ে।

— কী আছে তথ্যে?

–কুমারচক উন্মাদ আশ্রমের ঠিকানা এবং একটি নাম–শচীন্দ্র মজুমদার। আরও কিছু কথা।

চমকে উঠে বললাম–বলেন কী! কিন্তু সেই পলাতক পাগলের সঙ্গে এই কেসের কী সম্পর্ক! আমার মাথা ঘুরছে, বস্!

সাবধান জয়ন্ত! অ্যাকসিডেন্ট করে বসবে। বলে কর্নেল আবার চোখ বুজে হেলান দিলেন।

ইলিয়ট রোডের বাড়িতে কর্নেলকে পৌঁছে দিয়ে ইস্টার্ন বাইপাস হয়ে সল্টলেকের ফ্ল্যাটে যখন ফিরলাম, তখন প্রায় একটা বাজে। সারাপথ পাগল খুঁজেছি। আশ্চর্য ব্যাপার, রোজই রাস্তাঘাটে কত পাগল দেখি, এদিন একটাও দেখলাম না। পুলিশ কি রাজ্যের সব পাগলকে থানায় নিয়ে গেছে? বলা যায় না। মিনিস্টারের কেস।

সেদিনই রাত দশটায় কর্নেলের ফোন পেলাম। বললেন–তুমি আসবে ভেবেছিলাম। এলে না। ভয় পাওনি তো?

অবাক হয়ে বললাম–ভয়? কিসের ভয়?

-পাগলের। হাসি পেল।

–পাগল কি আর কলকাতায় আছে? সবাইকেই সম্ভবত পুলিশে ধরেছে।

‘বরকধঝ-কচতটপ’কে ধরতে পারেনি। কিছুক্ষণ আগে শ্যামবাজারের একটা গলিতে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। তার হাতে একটা ছোট্ট কিন্তু মোটাসোটা লোহার ডাণ্ডা ছিল।

–সর্বনাশ!

–নাহ। খুব ভদ্র পাগল। শিক্ষিতও।

–কিন্তু হাতে লোহার ডাণ্ডা…

–ওর পেছনে কুকুর লাগে। তাই সে ওটা মেট্রোরেলের আবর্জনা থেকে সংগ্রহ করেছে। যাই হোক, ওকে ডিনারের নেমন্তন্ন করলাম। রাজিও হল। কিন্তু আমার গাড়িতে উঠতে গিয়ে হঠাৎ মত বদলাল। ফেলুবাবুর বাড়ি এ রাতে তার নাকি ডিনারের নেমতন্ন। ভুলে গিয়েছিল। ফেলুবাবুর আসল নাম সে বলতে পারল না। শুধু বলল, মিনিস্টার।

ইন্টারেস্টিং! তারপর?

–দৌড়ে পালিয়ে গেল। ডার্লিং! এ বয়সে ছোটাছুটি, বিশেষ করে পাগলের পিছনে–আমাকে মানায় না।

–শ্যামবাজারের গলিতে কেন গিয়েছিলেন?

–সেই নকুল মিস্ত্রি লেন। ফ্রিডম-ফাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের অফিস।

তাই বলুন! বইটা পেলেন?

–নাহ্। বইটা ছিল। কিন্তু খুঁজে পেলেন না ওঁরা। ইস্যুরেজিস্টার খুঁজেও হদিস মিলল না। দোতলায় অফিস। সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসেই এক পাগলের মুখোমুখি হলাম! জিজ্ঞেস করলাম-বরকধঝ-কচতটপ? সবিনয়ে হেসে বলল–আজ্ঞে। তো আমার ডিনারের নেমন্তন্ন নাকচ করে সে পালিয়ে গেল। তখন আবার সেই অফিসে উঠে গেলাম। জিজ্ঞেস করে জানলাম, একজল পাগল কদিন থেকে ওঁদের অফিসে এসে জ্বালাতন করছে। সন্ধ্যার দিকে অফিস খোলে। তখন সে আসে। তাড়া খেয়ে নীচে সিঁড়ির ধাপে চুপচাপ বসে থাকে। ওঁরা কেউ তাকে চেনেন না। অথচ সে বলে, আমিও একজন ফ্রিডম-ফাইটার।

–লাহিড়িসায়েবকে জানিয়ে দিন।

–দিয়েছি। কিন্তু এর চেয়ে ইন্টারেস্টিং খবর আছে, জয়ন্ত! তুমি এলে না। এলে খুব এনজয় করতে। সকালে এসো। বলবখন। রাখছি।

–হ্যালো! হ্যালো! হ্যালো!

বলল।

 –জাস্ট একটু হিন্ট দিন প্লিজ।

–হালদারমশাই সত্যিই কুমারচকে গিয়েছিলেন। রোমাঞ্চকর অভিযান বলা চলে। রাখছি।…

লাইন কেটে গেল। এ একটা বিচ্ছিরি রাত। তালগোল পাকানো রহস্যের মতো নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছি আবার। কতবার মনে-মনে প্রতিজ্ঞা করেছি, আমার বৃদ্ধ বন্ধুর সংসর্গ যত আনন্দদায়ক হোক, ওঁর ওইসব বাতিকের সঙ্গে নিজেকে জড়াব না। শেষাবধি উনিই রহস্যের জট ছাড়াবেন এবং দৈনিক সত্যসেবকের জন্য চমৎকার একটা স্টোরি এমনি-এমনি তো পেয়ে যাব। কাজেই অকারণ আমার হন্যে হওয়ার মানে হয় না। অথচ রহস্য জিনিসটাই এমন এক চুম্বক, যা কাকেও নিরপেক্ষ থাকতে দেয় না। নিজের দিকে টেনে নেয়। নাকানিচুবানি খাইয়ে ছাড়ে।

তা হলে প্রাইভেট ডিটেকটিভদ্রলোক কুমারচকে পাড়ি জমিয়েছিলেন? অনেক প্রাক্তন এবং বর্তমান পুলিশ অফিসার দেখেছি, এমন ছিটগ্রস্ত কাকেও দেখিনি। ওঁর অভিযান কী অর্থে রোমাঞ্চকর ভেবেই পেলাম না। অবশ্য উনি বড় হঠকারী এবং দুর্দান্ত বেপরোয়া এবং জেদি মানুষও বটে।

ঘুম না এলে শক্ত বিষয়ের বই পড়ে দেখতে পারো। আমার এক অভিজাত সাংবাদিক বন্ধুর উপদেশটা মনে পড়ল। ছাত্রজীবনে আঁতলামির নেশায় বাইশ টাকা দামে কেনা জাঁ পল সাত্রে’র ‘বিইং অ্যান্ড নাথিংনেস’ গাব্দা বইটা চমৎকার কাজে দিয়েছে, সেটা সকালে বোঝা গেল অবশ্য। বইয়ের কথাগুলো চোখে ধাক্কা মেরেছে। মাথায় ঢোকেনি। কাজেই চোখ বেচারা কাহিল হয়ে বুজে গেছে।…

.

কর্নেলের তিনতলার ড্রয়িংরুমে ঢুকে দেখি, বৃদ্ধ রহস্যভেদী এখন প্রকৃতিরহস্যে কুঁদ হয়ে আছেন। একগোছা অর্কিড একটুকরো কাটা ডালে সাঁটা এবং সেটা টেবিলে রেখে উনি আতস কাঁচে কী সব দেখছেন। ইশারায় বসতে বললেন আমাকে।

একটু পরে উজ্জ্বল মুখে হাসলেন। হালদারমশাইয়ের উপহার। সচরাচর এত সরু ডালে অর্কিড বাঁচে না। তবে বরাবর বলে আসছি ডার্লিং; প্রকৃতির রহস্য অন্তহীন। হালদারমশাই ডালটা মুচড়ে ভেঙে কষ্ট করে নিয়ে এসেছেন অত দূর থেকে। উনি জানেন, আমি অর্কিড ভালবাসি। তুমি একটু বসো। এটার সঙ্গতি করে আসি।

 কর্নেল তার ছাদের শূন্যোদ্যানে চলে গেলেন। ষষ্ঠী ট্রে-তে কফি আর স্ন্যাক্স এনে দিয়ে চাপাস্বরে বলল–হালদারমশাই কোথায় পাগলাগারদে ঢুকেছিলেন। কপালে হাতে-পায়ে পট্টি বাঁধা। আমার সন্দ, পাগলারা ওনাকে মেরেছে। মার খেয়ে গাছের ডগায় উঠে লুকিয়ে ছিলেন। ইংরিজিতে বলছিলেন তো। সব কথা বুঝতে পারিনি।

বললাম কাল রাতে এসেছিলেন উনি?

আজ্ঞে। বলছিলেন, কোনওরকমে পাইলে এসেছেন। বলেই ষষ্ঠী চলে গেল।

.

ড্রয়িংরুমের কোনা থেকে ছাদে সিঁড়ি উঠে গেছে। সিঁড়িতে কর্নেলের পা দেখা যাচ্ছিল। নেমে এসে বাথরুমে ঢুকলেন। একটু পরে বেরিয়ে এলেন। ইজিচেয়ারে বসে চুরুট ধরিয়ে প্রসন্নমুখে বললেন-কৃত্রিম পদ্ধতিতে অর্কিড চাষ সহজ নয়। এসব পরজীবী উদ্ভিদকে জ্যান্ত গাছের ডাল ছাড়া বাঁচানো কঠিন। তবে কাটা ডালে অর্কিডের খাদ্য যোগান দিলে কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখা যায়। সারারাত ডালটা জারে ঠাণ্ডা জলের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছিলাম। দেখা যাক।

বললাম হালদারমশাই কুমারচকের উন্মাদ আশ্রমে ঢুকে পড়েছিলেন। তারপর পাগলাদের ভোলাই খেয়ে গাছে চড়েছিলেন। সেই গাছের ডালে অর্কিডটা ছিল। ইজ ইট?

কর্নেল অট্টহাসি হাসলেন।–যষ্ঠীর বর্ণনা। হুকতকটা তাই। তবে পাগলারা তো বন্দী। ওঁকে চার্জ করেছিল গার্ডরা। দিনদুপুরে একটা লোক আশ্রমের দেয়ালের ওপর গাছে চড়ে বসে আছে, এটা সন্দেহজনক। এই অবস্থায় ওই অর্কিডটা ওঁকে বাঁচিয়ে দেয়। উনি নিজেকে বটানিস্ট বলে পরিচয় দেন। অর্কিড সংগ্রহের হবির কথাও বলেন।

ষষ্ঠী বলছিল, কপালে হাতে-পায়ে পট্টি বাঁধা।

গাছের ডালের খোঁচায় ছড়ে গেছে। তাড়াহুড়ো নামতে গিয়ে পড়েও গিয়েছিলেন। তবে গার্ডরা প্রথমে ওঁকে পাগল ভেবেছিল। ভাবতেই পারে।

হালদারমশাই বরাবর এ ধরনের অদ্ভুত বিভ্রাট বাধান দেখেছি। হাসতে হাসতে বললাম-সত্যিই রোমাঞ্চকর অভিযান বলা চলে। কিন্তু এতে লাভটা কী হলো?

কিছুটা হয়েছে। উন্মাদ আশ্রমটা বেসরকারি, এটা জানা গেছে। তার সেক্রেটারির নাম শচীন্দ্র মজুমদার, তা-ও জানা গেছে। মিনিস্টার প্রতাপ সিংহমশাই আশ্রমের পৃষ্ঠপোষক এবং সরকারি সাহায্য পাইয়ে দেন। এমন কি, আন্তর্জাতিক সাহায্যও ওঁর চেষ্টায় পাওয়া যায়। হালদারমশাই কতগুলো তথ্য সংগ্রহ করে এনেছেন।

একটু অবাক হয়ে বললাম–শচীন্দ্র মজুমদারের নাম অমরেশবাবুর নোটবইয়ে লেখা ছিল না?

–হ্যাঁ। যে মিটিংয়ের কথা শুনেছিল নন্দিনী, সেটা ওখানেই হওয়ার কথা ছিল। অনিবার্য কারণে পিছিয়ে গেছে।

অনিবার্য কারণ কি অমরেশবাবু এবং পরিতোষবাবুর মৃত্যু?

কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন শচীনবাবু বলেছেন, ম্যানেজিং কমিটির দুজন সদস্যের মৃত্যু। খুন-খারাপির কথা বলেননি। বুদ্ধিমান হালদারমশাই ও-কথা তোলেন-ও নি।

পাগল সম্পর্কে বিজ্ঞাপনটার কথা তোলেননি হালদারমশাই?

নাহ্। তবে শচীনবাবু নিজে থেকেই বলেছেন, আশ্রম থেকে একজন পাগল পালিয়ে গেছে। সে নাকি খুনে প্রকৃতির পাগল। একজনকে সাংঘাতিকভাবে জখম করেছিল। তখন তাকে নির্জন সেলে আটক রাখা হয়। হাতে-পায়ে ডাণ্ডাবেড়ির কথা ভাবা হয়েছিল। ডাণ্ডাবেড়ির অর্ডারও দেওয়া হয়েছিল স্থানীয় কামারশালায়। কিন্তু কী করে সে গরাদ বেঁকিয়ে পালিয়ে গেছে। আশ্চর্য ব্যাপার, তাকে কড়াডোজের ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল। দুজন সাইকিয়াট্রিস্ট ডাক্তার ভলান্টারি সার্ভিস দেন। তাঁরাও কমিটির মেম্বার। কর্নেল চুরুট ধরালেন। ধোঁয়া ছেড়ে টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা প্রচার-পুস্তিকা বের করলেন। পড়ে দেখ। ইন্টারেস্টিং।

চার পাতার চটি বইটায় চোখ বুলিয়ে জানতে পারলাম, ১৯৪২ সালে আগস্ট বিপ্লবের সময় অনেক বিপ্লবী ধরা পড়েন। অনেকের ফাঁসি হয়। অনেকের দীর্ঘমেয়াদী জেল হয়। স্বাধীনতার পরও অনেকে মুক্তি পাননি। কারণ তাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ ছিল। আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতে এবং কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের জটিলতায় তাদের মুক্তি পেতে দেরি হয়েছিল। কিন্তু ততদিনে শারীরিক নির্যাতন আর মানসিক পীড়নে তাঁদের কেউ-কেউ বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছেন। ছয়ের দশকের শেষাশেষি ফ্রিডম-ফাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনগুলো গড়ে ওঠে নানা জায়গায়। কুমারচকেও গড়ে ওঠে। উন্মাদ হয়ে যাওয়া বিপ্লবীদের চিকিৎসা এবং আশ্রয়ের জন্য একটা আশ্রম গড়া হয়। জনা-সাতেক বিপ্লবীকে আশ্রমে আনা হয়েছিল। এখন তারা বেঁচে নেই। কিন্তু আশ্রমটি তুলে দেওয়া হয়নি। সমাজসেবার স্বার্থে সাধারণ উন্মাদদের জন্য কাজ চলতে থাকে। এদিকে মন্ত্রী প্রতাপ সিংহের পৈতৃক বাড়ি কুমারচকে। প্রধানত তারই উদ্যোগে স্বাধীনতাসংগ্রামী সেবাশ্রম নামটা বদলে ‘কুমারচক উন্মাদ আশ্রম’ নাম রাখা হয়।

বইটা ফেরত দিয়ে বললাম–তা হলে গত রাতে আপনি ‘বরকধঝ-কচতটপ’ এর দেখা পেয়েছিলেন এবং সে একটা ফ্রিডম-ফাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের অফিসে গিয়ে জ্বালাতন করে। কাজেই কুমারচক উন্মাদ আশ্রমের পলাতক পাগল একজন প্রাক্তন বিপ্লবী। রাইট?

কর্নেল চোখ বুজে দুলতে দুলতে বললেন–পসিলি!

শচীনবাবুও কি প্রাক্তন বিপ্লবী?

–অবশ্যই।

কফি শেষ করে একটা সিগারেট ধরালাম। আজকাল সিগারেট কমিয়ে দিয়েছি। কিন্তু যা বুঝছি রহস্যটা অতীব জটিল। তাই সিগারেট জরুরি ছিল। বললাম– সেই হারানো বইটা আপনি ন্যাশন্যাল লাইব্রেরিতে খুঁজে দেখতে পারেন। ১৩৩ ১৩৪ পৃষ্ঠায় কী ছিল যে–

কর্নেল আমার কথার ওপর বললেন–হয়তো বইটার আর দরকার হবে না। আমার কাছে ১৯৪২ সালের ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের মিলিটারি সিক্রেট রেকর্ডস-সংক্রান্ত একটা বই আছে। ওতে দেখলাম, সেই বছর নদীয়া জেলায় অক্টোবর মাসের এক ঝড়বৃষ্টির রাত্রে একটা স্পেশাল মিলিটারি ট্রেন দুর্ঘটনা হয়েছিল। নাশকতামূলক কাজ। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো, বর্মা রণাঙ্গণ থেকে পালিয়ে আসার সময় রেঙ্গুন ব্রাঞ্চ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে অনেক নগদ টাকা আর সোনাদানা এনে যশোর বিমানঘাঁটিতে রাখা হয়েছিল। সেখান থেকে সামরিক প্লেনে সেগুলো। পানাগড়ে পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু খারাপ আবহাওয়ার জন্য সেটা সম্ভব হয়নি। বড্ড বেশি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে গিয়ে খামখেয়ালী লেঃ কর্নেল ট্রেডি স্যামসন সিন্দুকটা পাঠিয়ে দেন বহরমপুরে। তারপর ঘুরিয়ে নাক দেখানোর মত করে ট্রেনের লাগেজ ভ্যানে চাপিয়ে কলকাতা পাঠানো হয়। মৌরী নদীর ব্রিজে দুর্ঘটনা ঘটে। সিন্দুকটা আর পাওয়া যায়নি। পরে স্যামসনকে কোর্ট মার্শাল করা হয়। তদন্তকারী ব্রিটিশ অফিসারের মতে, স্যামসন নেটিভদের খুব বিশ্বাস করতেন।

হাসতে হাসতে বললাম–এ তো দেখছি গুপ্তধনরহস্যে পৌঁছুল! বোগাস!

-হুঁ, বরকধঝ-কচতটপ।

তার মানে?

–পুরনো বাংলা বর্ণপরিচয় দেখে নিও। অক্ষর চেনবার জন্য বরকধঝ লেখা থাকত। আর কচতটপ মাস্টারমশাইরা মুখস্থ করাতেন। ক বর্গ, চবর্গ, তবর্গ, টবর্গ, প-বর্গ। তো তুমি গুপ্তধন রহস্য বললে। তুমি লক্ষ্য করে থাকবে, সব গুপ্তধনের গল্পে হেঁয়ালি বা ধাঁধাঁ অনিবার্য। ওটা গুপ্তধন আবিষ্কারের সূত্র। কে বলতে পারে ‘বরকধঝ-কচতটপ’ সেই সূত্র নয়?

–আর ইউ সিরিয়াস, কর্নেল?

–একটা বিষয়ে অন্তত আমি সিরিয়াস। অমরেশ রায় এবং তাঁর সঙ্গীদের সেই সিন্দুক হাতানোই উদ্দেশ্য ছিল। সমস্যা হলো, অমরেশ শুধু আমরা লিখেছেন। সঙ্গীদের নাম লেখেননি। হারানো পাতা দুটোতে ছিল কিনা জানি না।

কর্নেল! কাল রাতে যে পাগলকে দেখেছেন, আমার ধারণা, সে অমরেশবাবুর সঙ্গী ছিল।

কর্নেল একটু পরে আস্তে বললেন-মৌরী নদীর ধারেই কিন্তু কুমারচক উন্মাদ আশ্রম। রেললাইন থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে।

এই সময় টেলিফোন বাজল। কর্নেল ফোন তুলে সাড়া দিলেন। হ্যাঁ, বলো!..বাহ। ওয়েল ডান ডার্লিং!..হ্যাঁ। ওঁর নিরাপত্তা দরকার। খুব সাবধান!..ওটা ফরেন্সিক টেস্টের জন্য পাঠিয়ে দাও।

কর্নেল ফোন রেখে বললেন-বরকধঝ-কচতটপ-কে পুলিশ পেয়ে গেছে।

–মিঃ লাহিড়ির ফোন নাকি?

-হ্যাঁ। শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে নেতাজীর স্ট্যাচুর নীচে দাঁড়িয়ে সেই পদ্যটা আওড়াচ্ছিল। সাদা পোশাকের পুলিশ অফিসার গিয়ে নাম জিজ্ঞেস করতেই বলে, বরকধঝ-কচতটপ। হাতের ডাণ্ডাটা ফরেন্সিক টেস্ট করতে বললাম। দেখা যাক।

আজকের কাগজে পরিতোষ লাহিড়ির খুনের খবর গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছে। গতকাল আমার অল ডে ছিল। দৈনিক সত্যসেবকের আজকের খবরটার ভাষা পড়ে বুঝলাম অন্য কেউ লিখেছে। সম্ভবত সিনিয়র রিপোটার কার্তিকা। পরিতোষবাবুর সংক্ষিপ্ত জীবনীও দেওয়া হয়েছে।

কাগজ ভাঁজ করে রেখে বললাম-একটা খটকা লাগছে। গতকাল ভোরে পরিতোষবাবুর বডি পাওয়া যায়। কিন্তু ওঁর মৃত্যুর খবর কুমারচকের শচীনবাবু কালই পেয়েছিলেন। হালদারমশাইকে বলেছেন উনি। আশ্চর্য।

কর্নেল বললেন–আশ্চর্য ঠিকই। তবে কুমারচক এখন প্রায় শহর হয়ে উঠেছে। টেলিফোন আছে। ট্রাংককলে খবর পাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু এটাই প্রশ্ন, কে ট্রাংককল করল? বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন।–চলো। কাল গড়িয়ায় হরিপদবাবুর বাড়ি যাব ঠিক করেছিলাম। যাওয়া হয়নি। আজ যাওয়া যাক।…

.