বরকধঝ-কচতটপ রহস্য – ১

০১.

 প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদার খবরের কাগজ পড়ছিলেন। হঠাৎ খি-খি করে হেসে বললেন–খাইছে। যত্ত সব পাগলের কারবার!

 জিজ্ঞেস করলাম–পাগল কী করেছে হালদারমশাই?

–পলাইয়া গেছে। বলে হালদারমশাই পকেট থেকে নস্যির কৌটো বের করলেন। একটিপ নস্যি নাকে খুঁজে স্বগতোক্তি করলেন বুঝি না। একজন পাগল পাগলাগারদ থেক্যা পালাইয়া গেছে। তো তার ছবি ছাপাইয়া বিজ্ঞাপন দিয়া লিখছে, খোঁজ দিলে পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার। ক্যান?

হাসি চেপে বললাম–পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হলে নিশ্চয় এর পেছনে কোনও রহস্য আছে। আপনি এই রহস্য ভেদ করুন হালদারমশাই!

প্রাইভেট ডিটেকটিভ আমার রসিকতা গ্রাহ্য করলেন না। তেতো মুখে বললেন–কে পাগল? যে পালাইয়া গেছে, না যে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে সে? কর্নেল স্যার কী কন?

কর্নেল নীলাদ্রি সরকার একটা বই খুলে কী একটা ছবি দেখছিলেন। চওড়া টাকে জানালার পর্দার ফাঁক গলিয়ে আসা সকালের রোদ এসে প্রজাপতির মতো নাচানাচি করছে। ঠোঁটে কামড়ানো চুরুট থেকে ছাই খসে পড়েছে তার ঋষিসুলভ সাদা দাড়িতে। বললেন–হালদারমশাই, পাগলের বিজ্ঞাপন তো পড়লেন। কিন্তু পাগলের খবরটা মিস করলেন?

প্রাক্তন পুলিশ ইন্সপেক্টর এবং বর্তমানে প্রাইভেট ডিটেকটিভ কৃতান্তকুমার হালদার সোজা হয়ে বসলেন। ভুরু কুঁচকে বললেন মিস করলাম?

কর্নেল বই বুজিয়ে রেখে দাড়ির ছাই ঝেড়ে বললেন–হ্যাঁ। তিনের পাতায় ডানদিকের কলম দেখুন।

হালদারমশাই কাগজ খুলে খবরটা বিড়বিড় করে পড়তে শুরু করলেন। গোঁফের দুই ডগা তিরতির করে কাঁপতে থাকল–পাগলের হাতে প্রাক্তন শিক্ষকের মৃত্যু! অ্যাঁ! কি কাণ্ড!…

পড়া শেষ হলে হালদারমশাই আবার একটিপ নস্যি নিলেন। গুলি-গুলি চোখে কর্নেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কাগজটা দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা, আমি যার স্পেশাল রিপোর্টার। কিন্তু খবরের কাগজে যা কিছু বেরোয়, আমার কাছে তার। সবটাই পাঠযোগ্য নয়। বিজ্ঞাপন যেদিন কম থাকে, সেদিন অনেক হাবি-জাবি খবর দিয়ে জায়গা ভর্তি করতে হয়। কিন্তু একইদিনের কাগজে পাগল পালানোর বিজ্ঞাপন আর পাগলের হাতে কারও মারা পড়ার ঘটনা একটু অদ্ভুত লাগল। কাগজ টেনে নিয়ে খবরে চোখ বুলিয়ে রেখে দিলাম। বললাম-বোগাস! পুলিশসোর্স থেকে টেলিফোনে পাওয়া। সন্ধ্যার পর লালবাজারে ফোন করে জেনে নেওয়া হয়–দাদা, আজ কিছু আছে নাকি? তেমন কিছু নেই? নানা। প্লিজ দাদা, যা হয় একটা কিছু দিন। হাসতে হাসতে বললাম–রোজ সন্ধ্যার পর আমাদের এক রিপোর্টারের এই ডায়লগ শুনি।

আমার কথা হালদারমশাইয়ের মনঃপুত হলো না। মাথা নেড়ে বললেন– দুপুর রাত্রে লোডশেডিংয়ের সময় এক পাগল আইয়া শিক্ষকেরে জালাতন করছিল। উনি তারে তাড়া করলেন। তারপর আর বাড়ি ফিরলেন না। পরদিন সকালে শিক্ষকের বডি পাওয়া গেল খালের ধারে। স্কালে ক্র্যাক।

কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন–প্রাক্তন শিক্ষক অমরেশ রায়ের বাড়ি থেকে সেই খালের দূরত্ব প্রায় আধ কিলোমিটারের বেশি।

–অ্যাঁ? হালদারমশাই চমকে ওঠার ভঙ্গি করলেন। কিন্তু খবরে তা তো লেখে নাই। অত্তোদূরে পাগলেরে তাড়াইয়া লইয়া গেছিলেন শিক্ষক ভদ্রলোক? ক্যান? উনিও দেখি এক পাগল।

কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট জ্বেলে বললেন–পাগলের পাল্লায় পড়লে কোনও সুস্থ লোক পাগল হয়ে যান সম্ভবত। কারণ আগের রাতেও একই সময়ে ওই পাগল ওঁকে জালাতে এসেছিল। ওঁর জানালার বাইরে একটা পদ্য আওড়াচ্ছিল।

কন কী? পইদ্য। কিন্তু খবরে তা-ও তো লেখে নাই।

–পদ্যটা সুপরিচিত। ওহে মৃত্যু তুমি মোরে কি দেখাও ভয়? সে-ভয়ে কম্পিত নয় আমার হৃদয়। পাগল একসময় যাত্রা-থিয়েটারে অভিনয় করত কিনা বলা যায় না।

হালদারমশাই খুব অবাক হয়ে বললেন–খবরে তো এসব কিছুই নাই।

বললাম–ব্যাকগ্রাউন্ডটা কর্নেলের যখন জানা, তখন বোঝা যাচ্ছে আমার কথাই ঠিক। এই কেসে রহস্য আছে। বিজ্ঞাপন এবং খবরের ঘটনার মধ্যেও লিংক আছে। তার চেয়ে বড় কথা, অলরেডি কোনও পক্ষ কর্নেলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। সম্ভবত খবরটা কাগজে বেরুনোর আগেই। তাই না কর্নেল?

কর্নেল হাসলেন।–দ্যাটস রাইট, ডার্লিং! তবে বিজ্ঞাপনের পাগল এবং পদ্য আওড়ানো পাগল এক কি-না আমি জানি না। দুটোর মধ্যে লিংকের কথা বলছ। সে-বিষয়ে আমি এখনও সিওর নই। এমন-কি, অমরেশ রায়ের মাথায় সেই পাগলই আঘাত করেছে কিনা তা-ও এ মুহূর্তে বলা কঠিন। অবশ্য ওঁর বডির পাশে রক্তমাখা একটা ছড়ি পাওয়া গেছে। ছড়িটা কিন্তু অমরেশবাবুরই। ওঁর মেয়ে এবং স্ত্রী ওটা শনাক্ত করেছেন।

হালদারমশাই ব্যস্তভাবে বললেন–পাগল ছড়ি কাইড়্যা লইয়া ওনারে মারছে।

–ছড়ির ঘায়ে মাথার খুলিতে এক ইঞ্চি ডিপ ক্র্যাক হতে পারে না হালদারমশাই।

প্রাইভেট গোয়েন্দা চিন্তিত মুখে বললেন–পাগলের হাতে লোহার রড ছিল। তাড়া খাইয়া কোনও খানে পিক আপ করছিল। পাগলের কারবার!

কর্নেল চোখ বুজে হেলান দিয়ে বললেন–অমরেশ বাবুর ছড়িতে রক্ত মাখানো ছিল। কেন? এটা একটা ভাইটাল প্রশ্ন, জয়ন্ত! ওঁর মাথায় যে-ই আঘাত করুক, সে সম্ভবত বোকামি করে ফেলেছে। রক্ত ছড়িতে কেন মাখাতে গেল?

হালদারমশাই মাথা নেড়ে বললেন–সেয়ানা পাগল! তারই কাজ। আমার মতে, কোনও পাগলই পুরা পাগল না, কর্নেল স্যার! আপনি কখনও কোন পাগলেরে গাড়িচাপা পড়তে দ্যাখছেন?

কর্নেল অট্টহাসি হেসে সোজা হয়ে বসলেন।দারুণ বলেছেন তো। সত্যি কোনও পাগল কখনও রাস্তায় গাড়িচাপা পড়ে মরেছে বলে শুনিনি। অথচ দেখা যায়, কত পাগল রাস্তায় চলন্ত গাড়ির মধ্যে দিব্যি হেঁটে যাচ্ছে। রাস্তা পার হচ্ছে অকুতোভয়ে। তবে হ্যাঁ হালদারমশাই, পাগলেরও মৃত্যুভয় আছে। ভূতের ভয় আছে কিনা অবশ্য জানি না। আপনি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।

–যাই গিয়া! বলে হালদারমশাই উঠে দাঁড়ালেন।

বললাম–আপনি কি পাগলের ভূতের ভয় আছে কিনা পরীক্ষা করতে যাচ্ছেন?

হালদারমশাই খি খি করে হেসে বললেন–কী যে কন! চলি কর্নেল স্যার।

উনি বেরিয়ে গেলে বললাম–মনে হচ্ছে, হালদারমশাই এই রহস্যের পেছনে। দৌড়লেন। ওঁর ডিটেকটিভ এজেন্সির অবস্থা নাকি শোচনীয়। কেস-টেসের খুব আকাল পড়েছে।

এই সময় টেলিফোন বাজল। কর্নেল ফোন তুলে সাড়া দিলেন। হ্যাঁ, বলো ডার্লিং..কী?…কোথায়? গড়িয়া? বলো কী! পাগলা এবং সেই পদ্য?..আশ্চর্য! তুমি এসো। আমি আছি। হ্যাঁ, হ্যাঁ? এসো।

কর্নেল ফোন রেখে বললেন–আবার একটা ডেডবডি। হুবহু একই ঘটনা। রাতদুপুরে এক পাগলের জালাতন এবং তাকে তাড়া করে যাওয়া। তারপর সকালে একটা ডোবার পাড়ে ডেডবডি। তবে প্রথম ঘটনায় মৃত ভদ্রলোকের স্ত্রী ও কন্যা আছেন। দ্বিতীয় ঘটনায় মৃতের কেউ নেই। ভদ্রলোকের নাম পরিতোষ লাহিড়ি। আমার মতোই বুড়ো ব্যাচেলার।

কর্নেল আবার সেই বইটা খুলে বসলেন। এবার মলাটে আমার চোখ পড়ল। বাংলার আগস্ট বিপ্লব। আমি ভেবেছিলাম অর্কিড, ক্যাকটাস কিংবা পাখি-প্রজাপতি সংক্রান্ত কোনও বই। আমার বৃদ্ধ প্রকৃতিবিদ বন্ধু এসব ছেড়ে ১৯৪২ সালের ‘আগস্ট বিপ্লবে’ হঠাৎ আগ্রহী হয়ে পড়লেন কেন, চিন্তাযযাগ্য বিষয় বটে। বার দুই প্রশ্নটা তুললাম। কিন্তু কোনও জবাব পেলাম না। অগত্যা সেই পাগলের বিজ্ঞাপনে মন দিলাম।

না, হালদারমশাই বর্ণিত পাগলাগারদ থেকে নয়, এক পাগল পালিয়েছে কুমারচক উন্মাদ আশ্রম থেকে। বয়স প্রায় ৬৪-৬৫ বছর। উচ্চতা সাড়ে পাঁচ ফুট। বিশেষ লক্ষণ : নাম জিজ্ঞেস করলে বলে, বরকধঝ কচতটপ। সাংঘাতিক বিপজ্জনক, পাগল নাকি।

ছবিটা দেখে কিন্তু কিছু বোঝা যায় না। আপাতদৃষ্টে চমৎকার সভ্যভব্য চেহারা। সিঁথিকরা চুল। গায়ে হাফশার্ট। পকেটে কলম। শুধু চোখ দুটি কেমন যেন ক্রুর। নাকি আমারই চেখের ভুল?

একটু পরে বললাম–আচ্ছা কর্নেল, কোনও পাগল সাংঘাতিক বিপজ্জনক হলে তো তার হাতে পায়ে লোহার বেড়ি পরানো হয়। বিজ্ঞাপনে তেমন কিছু বলা হয়নি।

হুঁ।

কুমারচক কোথায় জানেন?

কর্নেল বই থেকে মুখ তুলে একটু হেসে বললেন তুমি কুমারচকে গেলে তোমাদের কাগজের জন্য একটা স্টোরি পেতেও পারো। যাবে নাকি?

নাহ। জায়গাটা কোথায়?

–ঠিকানা তো লেখাই আছে বিজ্ঞাপনে।

বিরক্ত হয়ে বললাম–কুমারচক, জেলা নদীয়া লেখা আছে। কিন্তু লোকেশনটা। কোথায়?

 কর্নেল আঙুল তুলে বইয়ের একটা র‍্যাক দেখালেন–ওখানে ওমালি সায়েবের জেলা-গেজেটিয়ার আছে কয়েক ভল্যুম। আগ্রহ থাকলে খুঁজে বের করো। ঐতিহাসিক তথ্যও পেয়ে যাবে।

দ্রুত বললাম–থাক্। ওসব পোকায় কাটা সেকেলে বই দেখলেই আমার পিত্তি জ্বলে যায়।

ডোরবেল বাজল। কর্নেল হাঁকলেন-ষষ্ঠী।

ডিটেকটিভ দফতরের ডেপুটি কমিশনার অরিজিৎ লাহিড়ী এসে আমাকে দেখে কপট ভঙ্গি করলেন। সর্বনাশ। গাছে না চড়তেই এক কাঁদি আপনারা কাগজের লোকেরা কি বাতাসে খবরের গন্ধ পান মশাই?

আমিও কপট গাম্ভীর্যে বললাম–মিঃ লাহিড়ী! আজ রোববার। আমার ফ্রেন্ড ফিলসফার-গাইডের কাছে আড্ডা দেওয়ার দিন।

অরিজিৎ হাসতে হাসতে বললেন– সরি! ভুলে গিয়েছিলাম।

 কর্নেল বই রেখে ঘুরে বসলেন–যাই হোক, গড়িয়ায় কোনও ডোবার ধারে পাওয়া আবার একটা ডেডবডির ব্যাপারে তোমার মাথা ঘামানোর নিশ্চয় কোনও কারণ আছে অরিজিৎ? এবারেও পুলিশের টপ র্যাংকের টনক নড়াল কে? কাল তুমি খুলে কিছু বলেনি। আমিও বিশেষ মাথা ঘামাইনি। আজ আমার খটকা লাগছে।

অরিজিৎ একটু গম্ভীর হয়ে বললেন–প্রথম ভিকটিম অমরেশ রায় ছিলেন। এক মন্ত্রীর পলিটিক্যাল লাইফের সহকর্মী। সেকেন্ড ভিকটিম পরিতোষ লাহিড়ি– না, আমার কোনও আত্মীয় নন, কিংবা বারেন্দ্র বামুন-ফ্যাক্টরও কোনও ব্যাপার নয়–একই মন্ত্রীর বন্ধু। মানে, দুজনেই একসময় মন্ত্রীমশাইয়ের সঙ্গে ইংরেজতাড়ানো রাজনীতি করেছেন এবং জেল খেটেছেন।

না বলে পারলাম না–কী আশ্চর্য! সেইজন্য কর্নেল ওই বইটা নিয়ে মেতে আছেন?

–মেতে আছি মানে? কর্নেল সকৌতুকে বললেন–মত্ততা পাগলেরও লক্ষণ। জয়ন্ত মাঝে মাঝে আমাকে পাগল সাব্যস্ত করার তালে থাকে। এবং ষষ্ঠীও।

ষষ্ঠীচরণ কফির ট্রে নিয়ে ঢুকছিল। থমকে দাঁড়াল। তারপর কর্নেল চোখ কটমটিয়ে তাকালে সে গম্ভীর মুখে ট্রে রেখে চলে গেল। কফি খেতে খেতে অরিজিৎ ঘটনার বিবরণ দিলেন। পরিতোষ লাহিড়ির বয়স আটষট্টি বছর। একটা দোতলা বাড়ির নিচের তলায় একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন। স্বপাক খেতেন। পাশের ঘরের ভাড়াটে এক নার্স মহিলা। গতরাতে তার নাইট ডিউটি ছিল হাসপাতালে। ওপরতলায় থাকেন বাড়ির মালিক সপরিবারে। তার নাম হরিপদ সেনগুপ্ত। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি অফিসার। অনিদ্রার রোগী। কিন্তু ঘুমের ওষুধ খেতে ভয় পান। শেষ রাতে ঘুম আসে। অনেক বেলা অব্দি বিছানায় থাকেন। তিনিই শুনেছিলেন, নিচে কে বিকট চেঁচিয়ে পদ্য আওড়াচ্ছে। একটু পরে পরিতোষবাবুর ধমক শুনে হরিপদবাবু জানালায় উঁকি মারেন। এরিয়ায় তখন লোডশেডিং ছিল। উনি টর্চের আলো ফেলে দেখেন, পরিতোষবাবু ছড়ি উঁচিয়ে এক পাগলকে তাড়া করে যাচ্ছেন। ব্যাপারটা হাস্যকর। তবে ও নিয়ে আর মাথা ঘামাননি হরিপদবাবু। ভোরবেলা খানিকটা দূরে রেললাইনের কাছে ডোবার ধারে পরিতোষবাবুকে পড়ে থাকতে দেখে এক অবাঙালি ধোপা। সে ওঁকে চিনত। সে হরিপদবাবুর বাড়িতে খবর দেয়।

অরিজিৎ বললেন–এরিয়ার কয়েকজন পাগলকে থানায় ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। হরিপদবাবু শনাক্ত করতে পারেননি। তাদের পদ্য বলতে বলেন ওসি। কেউ কিছু বলেনি। এমন কি, বিচক্ষণ ওসি নিজেই সেই পদ্যটা আওড়ে রিঅ্যাকশন যাচাই করেছেন। ওরা কেউ সাড়া দেয়নি। কাজেই তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন–হরিপদবাবু কি জানতেন মন্ত্রীর সঙ্গে পরিতোষবাবুর চেনাজানা আছে।

নাহ পরিতোষবাবুর একটা ডায়েরিতে নাম ঠিকানা ফোন নম্বর লেখা ছিল। মন্ত্রীমশাইয়ের কয়েকটা চিঠিও পাওয়া গেছে। বাই দা বাই, পরিতোষবাবু স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পেনশন পেতেন। এসব কারণে ওসি মন্ত্রীমশাইয়ের বাড়িতে ফোন করেন। তারপর কী হয়েছে, বুঝতেই পারছেন। মন্ত্রীমশাই আবার আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। পরপর ওঁর দুজন সহযোদ্ধা খুন। সহযোদ্ধা কথাটা ওঁর।

আমি খবরের কাগজটা তুলে নিয়ে বিজ্ঞাপনটার কথা বলতে যাচ্ছিলাম। কর্নেল আমার হাত থেকে কাগজটা প্রায় কেড়ে নিয়ে তিন নম্বর পাতা খুললেন। বললেন–প্রথম খুন শুক্রবার রাতে। প্রথমটা উত্তরে, দ্বিতীয়টা দক্ষিণে। তো অরিজিৎ, কাল তোমাকে বলেছিলাম। উত্তরের সন্দেহভাজন পাগলদের ধরে জেরা করা দরকার। আজ অবশ্য দক্ষিণের সন্দেহভাজন পাগলদের পেছনে দৌড়ুতে বলব না।

 অরিজিৎ হাসলেন–গ্রেটার কলকাতায় পাগলের সংখ্যা লাখখানেক হতেই পারে। মানে ছাড়া-পাগলদের কথা বলছি। আবার দেখুন প্রতিদিনই কত পাগল মেন্টাল হসপিটাল বা লুনাটিক অ্যাসাইলামে ভর্তি হচ্ছে। তবে আমাদের লোকেরা বসে নেই জানবেন। সেই পদ্যপাগলকে খুঁজে বের করা অসম্ভব হবে না। কিন্তু আমার প্রশ্ন অন্যত্র। আপনাকে কালই বলেছি, আমার সন্দেহ কেউ রাত্রিবেলা লোডশেডিংয়ের সুযোগে ওই পদ্যপাগলকে লেলিয়ে দিয়ে ভিকটিমকে বাড়ির বাইরে এনেছে এবং খুন করেছে। তাছাড়া একটা ভাইটাল প্রশ্ন : ওই পদ্যটা শুনেই বা কেন ভিকটিম তাকে তাড়া করছে?

কর্নেল বললেন–হ্যাঁ। তুমি বুদ্ধিমানের মতো একটা পয়েন্ট খুঁজে বের করেছ ডার্লিং। ওই পদ্যে কি কোনও পুরনো গোপন ঘটনার সূত্র লুকিয়ে আছে? কর্নেল খবরের কাগজটা ভাজ করে ড্রয়ারে ঢোকালেন। তারপর বললেন–মন্ত্রীমশাই ব্যাপারটা জেনেছেন কি?

–হ্যাঁ। ডিটেলস জেনে নিয়েছেন।

–পদ্যটা সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করেননি?

নাহ্। তবে কথাটা শোনার পর ওঁকে ভীষণ গম্ভীর দেখাচ্ছিল। আমার ঘাড়ে কটা মুণ্ডু যে ওঁকে জেরা করি? অরিজিৎ দ্রুত কফি শেষ করে আস্তে বললেন এখানেই সমস্যা। এজন্যই আপনার হেল্প চেয়েছি।

বললাম–মন্ত্রী ভদ্রলোক কে?

–প্রতাপকুমার সিংহ।

–তাই বলুন! উনি সঙ্গে একদঙ্গল আর্মড গার্ড নিয়ে ঘোরেন বলে কাগজে খুব ঠাট্টাতামাসা করা হয়। ওঁর বাড়িও নাকি সারাক্ষণ পাহারা দেয় আপনাদের লোকেরা। এ নিয়ে বহুবার কার্টুন আঁকাও হয়েছে কাগজে। এখন মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা ওঁর ক্ষমতার দম্ভ নয়–সম্ভবত আত্মরক্ষার ব্যুহ।

অরিজিৎ সায় দিয়ে বললেন–দ্যাটস রাইট। গত বছর দিল্লিতে ওঁকে মাডারের অ্যাটেম্পট হয়েছিল। গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েছিল কেউ। তাকে ধরা যায়নি। কর্নেল, পদ্যের রহস্যভেদ করুন আপনি। আমি উঠি।

ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ি উঠে দাঁড়ালে কর্নেল বললেন–তোমাদের লোকেরা সর্বত্র সন্দেহভাজন পাগলদের দিকে নজর রেখেছে। নিশ্চয় সেই পদ্যটা আওড়ে পাগলদের রিঅ্যাকশন যাচাই করাও হচ্ছে। তো আমি বলি, রিঅ্যাকশন যাচাই করতে বরং মরণরে উঁহু মম শ্যাম সুমান আওড়ানোর নির্দেশ দাও।

অরিজিৎ হাসতে হাসতে পা বাড়ালেন দরজার দিকে।

কর্নেল বললেন–জাস্ট আ মিনিট। এই পদ্যেও কোনও সাড়া না পেলে তোমাদের লোককে ‘বরকধঝ-কচতটপ’ আওড়াতে বলল। দেখ কি হয়!

অরিজিৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে ভুরু কুঁচকে তাকালেন।

–হোয়াটস দ্যাট, কর্নেল?

 দ্যাটস দ্যাট, ডার্লিং! বরকধঝ কচতটপ। ভুলো না!

-ওঃ কর্নেল! আমার জোকের মুড নেই! বলে পুলিশের গোয়েন্দাকতা বেরিয়ে গেলেন।

কর্নেল আমার দিকে ঘুরে বললেন–বিজ্ঞাপনটার দিকে পুলিশের চোখ পড়েনি। তুমি মাঝে মাঝে বড় অত্যুৎসাহী হয়ে পড়ো জয়ন্ত! তুমি অরিজিৎকে ওটা দেখালে রেডিও মেসেজ চলে যেত কুমারচকে। সেখানকার উন্মাদ আশ্রমে পুলিশ গিয়ে জেরায় জেরবার করত। এই হত্যারহস্যের সঙ্গে যদি দৈবাৎ ওখানে কোনও যোগসূত্র থাকে, তা ছিঁড়ে যেত। কারণ সংশ্লিষ্ট পক্ষ সাবধান হয়ে যেত।

কিন্তু পুলিশের ওটা চোখে পড়া উচিত ছিল।

ভুলে যেও না, পুলিশেও ব্যুরোক্রেসি অর্থাৎ আমলাতন্ত্র আছে। এক দফতরের সঙ্গে অন্য দফতরের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আছে। এ সবই তোমার জানা কথা। তুমি নিউজম্যান।

কর্নেল সেই বইটা আবার হাতে নিলে বললাম–চলি।

-নাহ। একমিনিট বসো। এই পাতাটা শেষ করে নিয়েই বেরুব।

–কোথায়?

 কর্নেল আমার কথার জবাব দিলেন না। হঠাৎ নড়ে উঠলেন। কী আশ্চর্য! বলে বইটার পাতা ওল্টাতে থাকলেন। ব্যস্তভাবে।নাহ্! ফর্মার গণ্ডগোল নয়। কর্নেল দুই পাতার মাঝখানে সেলাইয়ের জায়গা আতস কাঁচে পরীক্ষা করলেন। তারপর শ্বাস ছেড়ে ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন। একটা চুরুট ধরিয়ে আবার বললেন–কী আশ্চর্য!

–আশ্চর্যটা কী, খুলে বলবেন?

–একটা পাতা নেই। ১৩৩ পৃষ্ঠা আর ১৩৪ পষ্ঠা।

কী ছিল ওতে?

-একটা রোমাঞ্চকর বিবরণ। প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টির মধ্যে একটা মিলিটারি ট্রেন আসছে। কজন বিপ্লবী নদীর ব্রিজে লাইনের ফিসপ্লেট সরিয়ে একটু দূরে ঝোপঝাড়ের ভেতর ওত পেতে আছেন। যথাসময়ে ট্রেনটা এসেই ব্রিজ ভেঙে গড়িয়ে পড়ল নদীতে। ঝড়-বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে বিকট শব্দ, ইঞ্জিনের আগুনের ঝলকানি, আর্তনাদ। এর পর লেখক লিখেছেন আমরা তৎকালে যে এক অন্ধ শক্তির বশীভূত ছিলাম। আমাদের লক্ষ্য ছিল গার্ডের কামরার সংলগ্ন মালবাহী ভ্যান। টর্চের আলোয় সেই ভ্যান অন্বেষণে ছুটিয়াব্যস! এখানেই ১৩২ পৃষ্ঠা শেষ। ১৩৫ পৃষ্ঠায় দশম পরিচ্ছেদ।

বইটা কোথায় পেলেন।

–অনেকদিন আগে কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাতে কিনেছিলাম। তুমি তো জানো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমি একজন তরুণ আর্মি অফিসার ছিলাম। বর্মা থেকে গিয়ে পশ্চিম এশিয়ায় থাকার সময় বেঙ্গলে আগস্ট বিপ্লবের খবর পেয়েছিলাম। এ বয়স অব্দি ঘটনাটা আমাকে হন্ট করে। কারণ বাঙালি বিপ্লবীরা কোথাও কোথাও ব্রিটিশ আর্মির সঙ্গেও লড়তে নেমেছিলেন। মেদিনীপুর জেলার একটা বিশাল অঞ্চল স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। দীঘা যাওয়ার পথে কাঁথি পেরিয়ে সম্ভবত রামনগরের কাছাকাছি একটা ক্যানেলের ধারে ব্রিটিশ সৈনিকদের একটা স্মৃতিস্তম্ভ দেখেছিলাম। জানি না সেটা এখন আছে কিনা। ওরা আগস্ট বিপ্লব দমনে গিয়ে মারা পড়েছিল। সম্ভবত সমুদ্রের বন্যায়। সেটা ১৯৪২ সাল। সেবার ওই অঞ্চলে প্রচণ্ড ঝড়ের সময় সমুদ্র ২২ মাইল ছুটে এসেছিল।

কর্নেলের মুখে উত্তেজনার ছাপ পড়েছিল। বললাম বুঝলাম কিন্তু এতদিন বুঝি বইটা পড়েননি?

জাস্ট পাতা উল্টেছিলাম বলতে পারো। বড্ড বেশি ভাবোচ্ছ্বাস আর বাগাড়ম্বর।

–হঠাৎ আজ সকাল থেকে এটা খুঁটিয়ে পড়ার কারণ অনুমান করতে পারছি। দুই আগস্ট বিপ্লবীর হত্যাকাণ্ড। বইটা কার লেখা?

–অমরেশ রায়ের।

–অ্যাঁ?

–হ্যাঁঃ। বলে কর্নেল উঠে দাঁড়লেন।–পরিতোষ লাহিড়ির ডেরায় যাব ভেবেছিলাম। বাড়ির মালিক হরিপদবাবুকে কয়েকটা প্রশ্ন করার ছিল। কিন্তু বইয়ের একটা পাতা হারানো কেমন যেন গোলমেলে ঠেকছে। কাজেই চলো, অমরেশবাবুর বাড়িই যাওয়া যাক। নিশ্চয় ওঁর বাড়িতে বইটার কপি পাওয়া যবে। নিজের লেখা এবং নিজের পয়সায় ছাপানো বই। এক মিনিট। পোশাক বদলে নিই।

ঘড়ি দেখলাম। সওয়া দশটা বাজে। কোনও পাগলের পাল্লায় পড়লে নিষ্কৃতি মিলতে পারে। কিন্তু এই বৃদ্ধ রহস্যভেদীর পাল্লায় পড়লে কী অবস্থা হয়, হাড়ে হাড়ে জানি।…

.