বংশগতি
জীবের বংশপ্রবাহ
জীববিজ্ঞানীগণ বলেন যে, পৃথিবীর যাবতীয় জীবদেহই কোষ বা সেল সমবায়ে গঠিত। অ্যামিবার মতো এককোষবিশিষ্ট জীবেরা বংশবৃদ্ধি করে নিজেকে দুই ভাগ করিয়া। এই ভাগ হওয়াটিকে বলা হয় বিভাজন। বিভাজনের প্রণালী বা কোষাভ্যন্তরের কাণ্ডকারখানা কিছু জটিল। তাই উহার জটিলতাকে বাদ দিয়া আমাদের শুধু এইটুকু জানিয়া রাখা ভালো যে, কোষগুলি পুষ্টিকর আহার পাইলে যথাসময়ে ফাটিয়া যায় ও একটি কোষ দুইটি পূর্ণাঙ্গ কোষে পরিণত হয়। এইরূপে চলিতে থাকে জীবাণুদের বংশবৃদ্ধি।
জীবাণুদের বংশবৃদ্ধির কাজে সময় বেশি লাগে না। কোনো কোনো জীবাণু আশ্চর্য রকম বংশবৃদ্ধি করিতে পারে। প্যারামেসিয়ান নামক প্রোটোজোয়া জাতীয় জীবাণুর সেল এক ইঞ্চির একশত ভাগের এক ভাগের চেয়ে বেশি বড় নহে। তাহার একটি মাত্র জীবাণু লইয়া এক বাটি জলের মধ্যে যদি ছাড়িয়া দেওয়া যায়, তবে সাত দিন পরে গণনা করিলে দেখা যাইবে যে, সেই একটি হইতে জীবাণু জন্মিয়াছে প্রায় দশ লক্ষ। অধিকাংশ রোগের জীবাণুরা এই রকম বা ইহার অপেক্ষাও বেশি বংশবৃদ্ধি করিয়া থাকে।
এককোষী জীবেরা যেমন নিজেকে দুই ভাগ করিয়া বংশবৃদ্ধি করিতে পারে, বহুকোষী জীবেরা তাহা পারে না। বহুকোষী জীব যথা –কীট, পতঙ্গ ইত্যাদির দেহের কোষগুলি দুই জাতীয়। যথা– দেহকোষ এবং জননকোষ। জননকোষগুলি আবার দুই জাতীয়। যথা –পুং জননকোষ এবং স্ত্রী জননকোষ বা ডিম্বকোষ।
দেহকোষ ও জননকোষের বিভাজন প্রণালী একই, অর্থাৎ একটি কোষ বিভক্ত হইয়া দুইটি, দুইটি হইতে চারিটি এবং তাহা হইতে আটটি –এইরূপ সংখ্যাবৃদ্ধি হইয়া থাকে। ব্যতিক্রম হইল এই যে, দেহকোষ বিভক্ত হওয়ার ফলে ঐ জীবটির দেহের বৃদ্ধি বা পুষ্টি হয় এবং জননকোষ বিভক্ত হইয়া জন্ম হয় ঐ জীবটির সদৃশ আর একটি স্বতন্ত্র জীবের। কিন্তু জননকোষদ্বয় একা একা বিভক্ত হইতে পারে না। ইহাতে আবশ্যক হয় পুং জননকোষ ও ডিম্বকোষের লন। এই মিলনকে বলা হয় যৌনক্রিয়া।
মানুষ, পশু, পাখি ইত্যাদি উন্নত পর্যায়ের জীবসমূহের স্ত্রী-পুরুষ ভেদ আছে এবং উহারা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হইয়া যৌনক্রিয়া সম্পাদন করে। কিন্তু জোক, কেঁচো ও শামুকাদি নিম্নস্তরের জীবের ও অধিকাংশ উদ্ভিদের দেহে দুই জাতীয় কোষ মজুত থাকে এবং জল, বায়ু, মাছি ইত্যাদির দ্বারা ঐ দুই জাতীয় কোষের মিলন সাধিত হয়। মিলনমুহূর্তের পর হইতেই আরম্ভ হয় মিলিত কোষটির বিভাজন এবং বিভক্ত হইতে হইতে জন্ম হয় একটি পূর্ণাঙ্গ (সদৃশ) জীব বা উদ্ভিদ-এর।
যতদিন পর্যন্ত এককোষী জীবেরা নিজেদের কেবল দুই ভাগ করিয়া বংশবৃদ্ধি করিত, ততদিন পর্যন্ত জীবজগতে বিশেষ কোনো বৈচিত্র দেখা দেয় নাই। যখন হইতে স্ত্রী-পুরুষ দুইজনের মিলনে বংশবৃদ্ধি হইতে আরম্ভ হইল, তখন হইতে প্রাণীজগতে শুরু হইল নানা পরিবর্তন ও দ্রুত উন্নতি। একটি কোষকে সমান দুই ভাগ করিলে, খণ্ড দুইটি জনয়িতার হুবহু নকল হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু যে স্থলে জনক ও জননী- দুইটি স্বতন্ত্র ব্যক্তি হইতে সন্তানের জন্ম, সেই স্থলে জন্মদাতাদের সঙ্গে সন্তানের ঐকান্তিক মিল তো থাকিতেই পারে না, বরং সন্তানদের পরস্পরের মধ্যেও পার্থক্য থাকে যথেষ্ট। জীবজগতের এতোধিক বৈচিত্রের মূল কারণও হইল যৌন প্রণালীতে বংশবৃদ্ধি।
অতি সাধারণভাবে জীবজগতের বৈচিত্র প্রকাশের কারণ বলা হইল। এখন প্রশ্ন থাকিল এই যে, জীবজন্তুর শরীরে এত রকমের ইন্দ্রিয়, অবয়ব ও যন্ত্রাদির সৃষ্টি হইল কি রকম? এই বিষয়ে বিজ্ঞানীগণ যাহা বলেন, তাহার সারমর্ম এই যে, পৃথিবীর আদিম অবস্থায় কেবল জলজন্তুই ছিল। অ্যামিবা পর্যায় অতিক্রম করিয়া যখন বহুকোষী জলজীব দেখা দিল, তখন তাহারা স্থিরভাবে জলে ভাসিয়া না থাকিয়া কোনো একদিকে জল ঠেলিয়া যাইতে চেষ্টা করিতে লাগিল। সেই অবস্থায় তাহাদের সামনের দিকের সেলগুলি প্রথম খাবারের সন্ধান পাইতে লাগিল, এবং বিরুদ্ধ অবস্থার সঙ্গে সর্বপ্রথম তাহাদের সংঘর্ষ হইতে লাগিল। তাই সামনের দিকের সেলগুলি খাবার সংগ্রহ, শত্রুকে এড়ানো বা দমন করা, দিক নির্ণয় করা প্রভৃতি কাজের ভার লইয়া নিজেদেরকে বিশেষভাবে ঐ কাজের উপযোগী করিয়া তুলিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। এই চেষ্টার ফলে জীবদেহে আস্তে আস্তে গড়িয়া উঠিল মস্তিষ্ক। প্রথমে আহার্য দ্রব্য ভিতরে নিবার জন্য মুখগহ্বর ও গলনালী, পরে চোখ, কান প্রভৃতি বাহেন্দ্রিয়গুলি এবং সঙ্গে সঙ্গে মগজ দেখা দিল। পারিপার্শ্বিক অবস্থার ভিন্নতা বা পরিবর্তন অনুসারে জীবদেহের এই সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বৈশিষ্টও বৃদ্ধি পাইতে লাগিল, আর প্রয়োজনবোধে প্রকাশ পাইল লেজ, ডানা, হাত, পা প্রভৃতি বহিরঙ্গগুলি।
বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, প্রাণীজগতের বিবর্তনের শুরুতে যে রকম করিয়াই ভিন্ন ভিন্ন জাতির উৎপত্তি হইয়া থাকুক না কেন, বর্তমানে উহার জাতীয়তা রক্ষার কারক সেলের অভ্যন্তরস্থ ক্রোমোসোম। কোনো কোনো জাতের সেল সহজ দৃষ্টিতেই দেখা যায়, আবার কোনো কোনো সেল এত ছোট যে, উহার ২৫০০টি সেল এক সারিতে সাজাইলে এক ইঞ্চির বেশি লম্বা হয় না। এত ছোট সেলের ভিতরটি কিন্তু ফুটবলের মতো শূন্যগর্ভ নহে, সেখানে আছে বহু পদার্থ, যাহা ভাবী জীবের জাতি ও প্রত্যঙ্গাদি সৃষ্টির কারক। সেলের মধ্যে ঐ ধরণের একটি পদার্থ ক্রোমোসোম। এই ক্রোমোসোমই জীবের জাতিভেদের জন্য দায়ী।
বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, প্রত্যেক ধাতব পদার্থের পরমাণুতে নির্দিষ্ট সংখ্যক ইলেকট্রন ও প্রোটন থাকে। যেমন –সোনায় ৭৯, রূপায় ৪৭, লোহায় ২৬ ইত্যাদি। একটি পরমাণুতে ৮০টি ইলেকট্রন বা প্রোটন আছে, এইরূপ সোনা জগতে মিলিবে না। কেননা, ঐরূপ সংখ্যা থাকিলে তাহা হইবে পারদ। জীবজগতেও ঐ রকম প্রত্যেক জাতীয় জীবের দেহকোষ বা জননকোষের মধ্যে এক। নির্দিষ্ট সংখ্যক ক্রোমোসোম থাকে, কোথায়ও উহার ব্যতিক্রম হয় না। ধাতব পদার্থের মৌলিকত্ব নির্ভর করে যেমন তাহার পরমাণুর ইলেকট্রন-প্রোটনের সংখ্যার উপর, জীবের জাতীয়তা নির্ভর করে তেমন তাহার দেহের সেলের ক্রোমোসোমের সংখ্যার উপর। কয়েক জাতীয় সেলের ক্রোমোসোমের সংখ্যা দেওয়া গেল।
উদ্ভিদ জীব
বাঁধাকপি – ১৮ গরু – ১৬
ভুট্টা – ২০ কুকুর – ২২
ধান – ২৪ ব্যাঙ – ২৬ মানুষ – ৪৬
গম – ৪২ ঘোড়া – ৩৮ বাঁদর – ৫৪
মানুষের শরীরের যে কোনো অংশের সেল অণুবীক্ষণের সাহায্যে দেখিলে দেখা যাইবে যে, উহার প্রত্যেকটি সেলে ৪৬টি করিয়া (আগে বলা হইত ৪৮টি) ক্রোমোসোম আছে। এক জাতীয় জীবের মধ্যে ক্রোমোসোমের সংখ্যার কখনও ব্যতিক্রম হয় না। জাতি ভেদে সংখ্যার তারতম্য হয় বটে।[২৭]
.
# মানুষের জন্ম প্রকরণ
ভ্রূণ সৃষ্টি
পুরুষের প্রধান জননেন্দ্রিয়ের নাম শুক্রাশয় (Testes)। ইহার ভিতর পাশাপাশি বীচির মতো দুইটি গ্ল্যাণ্ড আছে। গ্ল্যাণ্ডের ভিতরের স্তরের সেলগুলির কাজ –ক্রমাগত ভাগ হইয়া নূতন সেল তৈয়ার করা। সেগুলি দেখিতে ব্যাঙাচির মতো, কিন্তু এত ছোট যে, অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া দেখা যায় না। এই সেলগুলির নাম জননকোষ বা পুং জার্মসেল। ইহারা শুক্রাশয়ের ভিতরে যথেচ্ছ সঁতরাইয়া বেড়ায়। শুক্রাশয়ের সাথে দুইটি সরু নল দিয়া মূত্রনালীর যোগ আছে। দরকারের সময়। জার্মসেলগুলি ঐ নল বাহিয়া মূত্রনালীর ভিতর দিয়া বাহিরে আসিতে পারে।
নারীর শরীরের ব্যবস্থা অন্য রকম। তাহার প্রধান জননেন্দ্রিয় ওভারিদ্বয় (Ovaries) তলপেটের ভিতরে ছোট দুইটি গ্ল্যাণ্ড। উহাদের ভিতরে নির্দিষ্ট সময়ে (পুরুষের মতো সব সময় নহে) একটি করিয়া (পুরুষের মতো অসংখ্য নহে) ডিম্বকোষ বা স্ত্রী জার্মসেল প্রস্তুত হয়। ডিম্বকোষ পুরুষদের জননকোষের তুলনায় অনেক বড়। ওভারির ভিতরে ডিম্বকোষ প্রস্তুত হইয়া পূর্ণতা লাভ করিলেই উহা নলের ভিতর দিয়া জরায়ুতে নামিয়া আসে। জরায়ু শক্ত রবারের মতো একটি থলি। সাধারণ অবস্থায় উহা মাত্র ৩ ইঞ্চি লম্বা। কিন্তু প্রয়োজনমতো যথেচ্ছ বড় হইতে পারে।
স্ত্রী-পুরুষের মিলনের সময়ে পুরুষের অসংখ্য জামসেল স্ত্রীঅগ দিয়া প্রবেশ করিয়া জরায়ুর ভিতরে ঢুকে। সেখানে স্ত্রীর ডিম্বকোষ তৈয়ারী থাকে উহাদের অভ্যর্থনার জন্য। জার্মসেল বা শুক্রকীটগুলি জরায়ুতে প্রবেশ করিয়াই লেজ নাড়িয়া (ব্যাঙাচির মতো ইহাদের লেজ থাকে) সাঁতার কাটিয়া ডিম্বকোষের দিকে ছুটিয়া আসে। উহাদের মধ্যে মাত্র একটিই ডিম্বকোষের ভিতরে ঢুকিতে পারে, কেননা একটি ঢুকা মাত্রই ডিম্বকোষের বাহিরের পর্দায় এমন পরিবর্তন ঘটে যে, অন্য কোনো শুক্রকীট আর ঢুকিতে পারে না। ডিম্বকোষের মধ্যে ঢুকিবার সময়ে শুক্রকীটের লেজটি খসিয়া বাহিরে থাকিয়া যায়।
মানুষের বেলায় সচরাচর প্রতি মাসে নির্দিষ্ট দিনে একটি করিয়া ডিম্বকোষ স্ত্রীলোকের ওভারিতে প্রস্তুত হইয়া জরায়ুমধ্যে শুক্রকীটের আগমনের জন্য অপেক্ষা করিতে থাকে। কোনো জন্তুর তিন মাস, কোনো জন্তুর ছয় মাস, কাহারও বা বৎসরান্তে একবার ডিম্বকোষ জন্মে। যদি সেই সময় পুরুষ জামসেলের সঙ্গে উহার মিলন না হয়, তবে দুই-চারি দিনের মধ্যেই। ডিম্বকোষটি শুকাইয়া মরিয়া যায়। আবার যথাসময়ে (ঋতুতে) আর একটি প্রস্তুত হয়।
পুরুষ ও স্ত্রী সেলের মিলন হইলে মিলনের পরমুহূর্ত হইতে ডিম্বকোষের মধ্যে আশ্চর্য পরিবর্তন ঘটিতে থাকে। স্ত্রী জার্মসেলের মধ্যে ঢুকিবার পর পুরুষ জার্মসেল অর্থাৎ শুক্রকীটের কোষকেন্দ্র আরও বড় হইতে থাকে এবং খানিক বড় হইয়া স্ত্রী জার্মসেলের কোষকেন্দ্রের সঙ্গে একেবারে মিশিয়া যায়। নানা বৈচিত্রময় পরিবর্তনের পর আরম্ভ হয় বিভাজন। একটি হইতে দুইটি, দুইটি হইতে চারিটি এবং তাহা হইতে আটটি –এইভাবে ক্রমাগত বৃদ্ধি পাইয়া তিন সপ্তাহের মধ্যে ডিম্বকোষ সংখ্যায় বাড়িয়া গিয়া আয়তনে এত বড় হয় যে, তখন ভুণ বলিয়া তাহাকে চেনা যায়। মানুষের বেলায় শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গই পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে স্পষ্ট ফুটিয়া উঠে। কিন্তু তখনও উহা ১ ইঞ্চির বেশি বড় হয় না। দুই মাস পরে পুরা এক ইঞ্চি হয় এবং তখন হইতে উহাকে মানুষের ভূণ বলিয়া চেনা যায়। পুরাপুরি শিশুর মতো হইতে সময় লাগে আরও সাত মাস। ন্যূনাধিক নয় মাস (চলিত কথায় দশ মাস) পর জরায়ু বা মাতৃজঠর ত্যাগ করিয়া ভূমিষ্ঠ হয় মানবশিশু।
নারী ও পুরুষের মিলনের অর্থই হইল শুক্রকীট ও ডিম্বকোষের মিলন সাধন। নারী ও পুরুষের রতিক্রিয়া ব্যতীতও যৌনমিলন সম্ভব হইতে পারে। ইহাতে কোনো পুরুষের বীর্য ধারণপূর্বক তাহা যথাসময়ে কোনো কৌশলে নারীর জরায়ুমধ্যে প্রবেশ করাইয়া যৌনমিলন অর্থাৎ শুক্রকীট ও ডিম্বকোষের মিলন ঘটাইতে পারা যায় এবং তাহাতে সন্তানোৎপত্তি হইতে পারে। কিন্তু কোনো প্রকারের যৌনমিলন ব্যতীত সন্তানোৎপত্তি হওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব।
ধর্মজগতে এমন কতগুলি আখ্যায়িকা প্রাপ্ত হওয়া যায়, যাহা প্রোক্ত নিয়মের ব্যতিক্রম। শুনা যায় যে, কামোত্তেজনাবশত কোনো মহাপুরুষের বীর্যস্থলন হইলে, উহা কোনো পাত্রে রাখা হইল এবং ঐ পাত্ৰমধ্যে সন্তান জন্সিল, অথবা কোনো ইতর জীবে উহা ভক্ষণ করিল, আর ঐ ইতর জীবের উদরে (জরায়ুতে নহে) সন্তান জন্মিল ইত্যাদি। আবার কোনো রমণী কোনো পুরুষকে স্বপ্নে দেখিয়া বা কাহাকেও চুমা খাইয়া কিংবা কোনো স্বর্গীয় দূতের বাণী শ্রবণ করিয়াই গর্ভবতী হইল ও সন্তান প্রসব করিল ইত্যাদি। ইহাতে কোনো নারী ও পুরুষ অর্থাৎ শুক্রকীট ও ডিম্বকোষের মিলনের আবশ্যক হইল না। কিন্তু এই জাতীয় অলৌকিক কাহিনীগুলি বিশ্লেষণ করিলে কোনো কোনোটিকে মনে হয় যে, উহা অলীক কল্পনা এবং কোনো কোনোটিতে পাওয়া যায় লৌকিকতার আভাস।
রামায়ণোক্ত সীতাকে বলা হয় অযযানিসম্ভবা। কেননা, তাহার নাকি মাতা ও পিতা কিছুই নাই এবং বাইবেলোক্ত যীশু খ্রীস্টকে বলা হয় অশিশ্নসম্ভব। কেননা, তাহার মাতা আছেন, পিতা নাই। কিন্তু উভয়ত আবার কিংবদন্তীও আছে। কোনো কোনো মতে –সীতা নাকি লঙ্কেশ্বর রাবণের কন্যা। ঐ কন্যাটি জমিলে কোনো গণক রাবণকে নাকি বলিয়াছিলেন যে, ঐ কন্যাটির উপলক্ষে তাহার মৃত্যু হইবে। তজ্জন্য রাবণরাজ কন্যাটিকে কোনো পাত্রে রাখিয়া সমুদ্রজলে ভাসাইয়া দেন এবং কোনো রকমে কন্যাসহ ঐ পাত্রটি মিথিলার রাজা জনকের হস্তগত হইলে তিনি ঐ কন্যাটিকে প্রতিপালন করেন ও রামের নিকট বিবাহ দেন ইত্যাদি।
যীশু খ্রীস্টের আবির্ভাবের সময়ে সখরিয়া (হজরত জাকারিয়া) নামক জনৈক ব্যক্তি ছিলেন ইহুদিদের ধর্মযাজক ও জেরুজালেম মন্দিরের সেবাইত বা পুরোহিত। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান, কারণ তাঁহার স্ত্রী ইলীশাবেত ছিলেন বন্ধ্যা। তাই শতাধিক বৎসর বয়সেও সখরিয়ার কোনো সন্তান ছিল না।
শুনা যায় যে, যীশুর মাতা মরিয়মকে তাঁহার পিতা এমরান মরিয়মের তিন বৎসর বয়সের সময়ে জেরুজালেম মন্দিরের সেবাকার্যের জন্য প্রেরণ করেন এবং সেখানে তিনি সখরিয়া কর্তৃক প্রতিপালিত হন।
সখরিয়া তাহার ১২০ বৎসর বয়সের সময়ে স্বর্গীয় দূতের মারফতে পুত্রবর প্রাপ্ত হন ও তাহাতে ইলীশাবেত গর্ভবতী হন এবং ইহার ছয় মাস পরে অবিবাহিতা মরিয়মও ১৬ বৎসর বয়সে স্বর্গীয় দূতের মারফত পুত্রবরপ্রাপ্ত হইয়া গর্ভবতী হন। যথাসময়ে ইলীশাবেত এক পুত্র প্রসব করেন এবং তাহার নাম রাখা হয় যোহন (হজরত ইয়াহইয়া)।
অবিবাহিতা মরিয়ম সখরিয়ার আশ্রমে থাকিয়া গর্ভবতী হইলে লোকলজ্জার ভয়ে ধর্মমন্দির ত্যাগ করিয়া নিজ জ্ঞাতিভ্রাতা যোসেফ (ইউসুফ)-এর সঙ্গে জেরুজালেমের নিকটবর্তী বয়তুল হাম নামক স্থানে অবস্থান করেন। এই স্থানে যথাসময়ে এক শুষ্ক খজুরবৃক্ষের ছায়ায় যীশু খ্রীস্ট (হজরত ঈসা আ.) ভূমিষ্ঠ হন।
কুমারী মরিয়ম এক পুত্রসন্তান প্রসব করিয়াছেন, ইহা জানিতে পারিয়া তাহাকে তীব্র ভর্ৎসনা করিতে থাকে এবং তাহারা মরিয়মের পালক পিতা সুবৃদ্ধ সখরিয়ার উপর ব্যভিচারের অপবাদ আরোপ করিয়া তাহাকে হত্যা করিতে ধাবিত হয় এবং সখরিয়া এক বৃক্ষকোটরে লুকাইয়া থাকেন। কিন্তু ইহুদিগণ খোঁজ পাইয়া করাত দ্বারা ঐ বৃক্ষটি ছেদন করার সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধ সখরিয়া দ্বিখণ্ডিত হইয়া প্রাণত্যাগ করেন।[২৮]
ইহুদি ধর্মের বিধানমতে, ব্যভিচার ও নরহত্যা– এই উভয়বিধ অপরাধের শাস্তিই হইল প্রাণদণ্ড। এইখানে ব্যভিচারের অপরাধে বা অপবাদে সখরিয়ার প্রাণদণ্ডের বিষয় জানা যায় বটে, কিন্তু সখরিয়াকে বধ করার অপরাধে কোনো ইহুদির প্রাণদণ্ডের বিষয় জানা যায় না।
নারী ও পুরুষ
সৃষ্টি বলা হইয়াছে যে, মানুষের জীবকোষে ক্রোমোসোম থাকে ৪৬টি। কিন্তু ইহারা সবই এক ধরণের নহে। ইহাদের মধ্যে এক বিশেষ ধরণের ক্রোমোসোম আছে, যাহাদের বলা হয় সেক্স ক্রোমোসোম। ইহাদের মধ্যে আবার দুইটি ভাগ আছে। যথা –এক্স (X) ক্রোমোসোম এবং ওয়াই (Y) ক্রোমোসোম। পুরুষের জার্মসেলে এক্স ক্রোমোসোম সব সময় একটিই থাকে, কিন্তু স্ত্রীলোকের ডিম্বকোষ বা এগসেলে থাকে কখনও একটি এবং কখনও দুইটি করিয়া। ওয়াই ক্রোমোসোম শুধু পুরুষেরই থাকে, স্ত্রীলোকের সেলে কখনও থাকে না।
যখন কোনো ডিম্বকোষে দুইটি এক্স ক্রোমোসোম থাকে, এবং তাহা হইতে সূণের উৎপত্তি হয়, তখন তাহা হইতে জন্মে নারী এবং ডিম্বকোষে একটি এক্স ক্রোমোসোম থাকিয়া ভূণের উৎপত্তি হইলে, তাহাতে জন্মে পুরুষ।
যমজ সন্তান সৃষ্টি
ছাগ, মেষ, কুকুর, বিড়াল ও শৃগালাদি পশুরা এক সময়ে দুই, তিন বা চারি-পাঁচটি করিয়া সন্তান প্রসব করে, ইহাতে কোনোরূপ কথোপকথন বা হৈ চৈ হয় না। কেননা, উহা চলতি ঘটনা। কিন্তু মানুষের একবারের গর্ভে ঐরূপ সন্তান জন্মিলে পাড়া, দেশ, এমনকি সময় সময় জগতময় সাড়া পড়িয়া যায়। ক্যানাডার ডিওন পরিবারে এক রমণীর এক গর্ভে পাঁচটি কন্যা জন্মিয়াছিল এবং উহা দেশে-বিদেশে প্রচারিত হইয়াছিল। কেননা ঐ পাঁচটি কন্যাই নাকি বাঁচিয়া ছিল ও পূর্ণবয়স্কা হইয়াছিল। তবে সচরাচর দেখা যায় যে, দুইয়ের অধিক যমজ সন্তানরা হয়তো মৃত অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হয়, নচেৎ ভূমিষ্ঠ হইয়া মারা যায়।
একেবারে গোড়ার অ্যামিবার মতো জীবের দিকটা বাদ দিয়া অপেক্ষাকৃত উন্নত শ্রেণীর জীবের দিকে চাহিলে আমরা দেখিতে পাই যে উহারা হয়তো ডিম্বপ্রসূ, নয়তো বাচ্চাপ্রসূ। ডিম্বপ্রসূদের মধ্যে আবার নানা রকম ডিমের সংখ্যা। যেমন– মাছেরা এক বারে হাজার হাজার, হাঁস-মুরগি পাঁচ-দশ গণ্ডা; কিন্তু কবুতরেরা মাত্র দুইটি ডিম্ব প্রসব করে। মানুষ কিংবা পশুরা ঐরূপ ডিম্ব প্রসব করে না বটে, কিন্তু আসলে উহারাও ডিম্বপ্রসূ জীব। পার্থক্য এই যে, আমরা যাহাদের ডিম্বপ্রসূ বলি, তাহারা সদ্য ডিম্ব প্রসব করে এবং ডিম্ব হইতে বাচ্চা জন্মে বাহিরে থাকিয়া, আর বাচ্চাপ্রসূদের ডিম্ব হইতে বাচ্চা জন্মে গর্ভে অর্থাৎ জরায়ুর ভিতরে থাকিয়া। ডিম্ব অথবা বাচ্চা –মায়েরা যাহাই প্রসব করুক, আসলে ডিমের সংখ্যার উপর নির্ভর করে বাচ্চাদের সংখ্যা।
সাধারণত মানুষের ডিম্বাধারে যথাসময়ে একটি ডিম্বই জন্মে। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে একাধিক ডিম্বও জন্মিয়া থাকে। মানুষের যখন যমজ সন্তান জন্মে, যে কারণেই হউক, তখন গর্ভিনীর গর্ভাধারে ডিম্ব জন্মে দুইটি এবং তখন পুরুষের মিলনে যদি ঐ দুইটি ডিম্বই নিষিক্ত হয়, তবে উহাতে সন্তান জন্মে দুইটি। অনুরূপভাবে তিন, চারি বা পাঁচটি ডিম্ব জন্মিলে সন্তানও জন্মে ঐ কয়টি। বৃটেনে নাকি হাজার করা এক গর্ভে তিনটি সন্তান জন্মিয়া থাকে। ততোধিক সন্তান হওয়া খুবই বিরল, তবে অসম্ভব নহে।
যমজ দুই প্রকার। যথা –অসম যমজ ও সম যমজ।
অসম যমজ –যদি কখনও কোনো নারীর ডিম্বাধারে একই সময়ে দুই বা ততোধিক ডিম্ব জন্মে এবং উহা পুরুষের মিলনে প্রাণবন্ত হয়, তবে যে যমজ সন্তান জন্মে, তাহাকে বলা হয় অসম যমজ।
অসম যমজ সন্তানেরা জরায়ুমধ্যে আলাদা আলাদা ডিম্ব হইতে আলাদা আলাদা ভুণে পরিণত হয় এবং উহাদের ফুল (Placenta) থাকে পৃথক পৃথক, অর্থাৎ যতটি সন্তান জন্মে ততটি। উহারা ভিন্ন ভিন্ন ভূণঝিল্লির ভিতরে বর্ধিত হয়। সন্তানেরা সকলে পুত্র বা সকলে কন্যা অথবা কতক পুত্র, কতক কন্যা হইতে পারে। সন্তানদের দৈহিক চেহারায় ও মানসিক বৃত্তিসমূহে অন্যান্য ভাই-ভগিনীর চেয়ে বেশি মিল থাকে না।
সম যমজ– যদি কখনও কোনো স্ত্রীলোকের একটি ডিম্ব জন্মিয়া শুক্রকীট যুক্ত হইবার পর কোনো কারণে দুই বা ততোধিক খণ্ডে খণ্ডিত হইয়া পড়ে, তবে উহার প্রত্যেক খণ্ড হইতে এক একটি সন্তান জন্মিতে পারে। উহারা একই সূণঝিল্লির মধ্যে আলাদা আলাদা ভূণে পরিণত হইয়া আলাদা আলাদা সন্তান জন্মে, কিন্তু ফুল থাকে একটি। সম যমজ সন্তানগণ হয়তো সকলেই পুত্র নচেৎ সকলেই কন্যা হইয়া থাকে। উহাদের দৈহিক গঠন ও মানসিক বৃত্তিসমূহে আশ্চর্য রকম মিল থাকে। একই ডিম্ব হইতে জন্মলাভ করে বলিয়া একই রকম যোগ্যতাসম্পন্ন হইয়া থাকে। শিল্প, সঙ্গীত, ধর্ম ইত্যাদির যে কোনো একটির প্রতি অনুরাগী হয় সকলে। উহাদের সকলের একই সময়ে স্বাস্থ্যভঙ্গ হয়, একই রুচিসম্পন্ন হয় এবং হাতের লেখাও একই রকম হয়। কেহ কেহ বলেন যে, উহারা দূরে দূরে থাকিয়া একই রকম স্বপ্ন দেখে। তবে পারিপার্শ্বিকতার প্রভাবে উহার কিছু ব্যতিক্রম হইতে পারে এবং কিছু কথার বাড়াবাড়িও হইতে পারে।
.
# বংশ প্রবাহে জীনের প্রভাব
জ্বীন-পরী –এই যুগল নামটি এদেশের আপামর জনসাধারণের কাছে অতি পরিচিত। কিন্তু উহাদের কাহারও সহিত আজ পর্যন্ত জনসাধারণের সাক্ষাতপরিচয় নাই। জ্বীন ও পরী সম্বন্ধে নানাবিধ কেচ্ছাকাহিনীর অন্ত নাই। জ্বীনগণ নাকি আগুনের তৈয়ারী অথচ অদৃশ্য, কিন্তু উহারা মানুষের মতোই এক ধরণের জীব। কোনো কোনো সময় কোনো কোনো জ্বীন নাকি মানুষের উপর বিশেষত মেয়েমানুষের উপর আশ্রয় করিয়া থাকে। উহাকে বলা হয় জ্বীনের দৃষ্টি। জ্বীনের আশ্রয় বা জ্বীনের দৃষ্টি যাহার উপর পতিত হয়, সে নাকি তাহার স্বকীয়তা হারাইয়া ফেলে এবং জ্বীনের মর্জিমাফিক কাজ করে। তথাকথিত জ্বীন ও তাহাদের কার্যকলাপ সম্বন্ধে এক শ্রেণীর মানুষের পুরাপুরি আস্থা থাকিলেও কোনো বিজ্ঞানী আজ পর্যন্ত ঐরূপ কোনো জ্বীনের অস্তিত্বের সন্ধান পান নাই। তবে তাহারা আর এক ধরণের জীনের সন্ধান পাইয়াছেন। সেই জীনেরাও অদৃশ্য, অথচ মানুষের দেহ-মনের উপর আধিপত্য বিস্তার করিয়া থাকে।
সচরাচর দেখা যায় যে, জনক-জননীর সহিত ছেলে-মেয়েদের দৈহিক গঠন ও মানসিক বৃত্তিসমূহের কোনো না কোনো বিষয়ে কিছু না কিছু সাদৃশ্য থাকেই। জনক-জননীর দেহ হইতে জাতক উত্তরাধিকার সূত্রে যে সমস্ত গুণাগুণ প্রাপ্ত হইয়া থাকে, তাহার ধারক ও বাহক কি? এই প্রশ্নের উত্তরে কেহ কেহ বলিয়া থাকেন, “ওসব ইচ্ছাময়ের ইচ্ছা”। কিন্তু বিজ্ঞানীগণ বলেন অন্য কথা। তাহারা বলেন যে, উহার ধারক ও বাহক হইল জীন।
পূর্বে আলোচিত হইয়াছে যে, জীবের জাতীয়তা নির্ভর করে তাহার দেহের জীবকোষের অভ্যন্তরস্থ ক্রোমোসোম-এর সংখ্যার উপর। বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, সেই ক্রোমোসোমগুলিও নিরেট বা শূন্যগর্ভ নহে, উহাদেরও গর্ভে আছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক প্রকার বিন্দু বিন্দু পদার্থ, যাহাদের অণুবীক্ষণেও দেখা যায় না। তাহারা এই জাতীয় অণুকণার নাম দিয়াছেন জীন (Gene)। তাহারা আরও বলেন যে, জনক-জননী তাহাদের ব্যক্তিত্বের যাহা কিছু জাতককে দান করে, এই জীনগণই তাহা বহন করিয়া আনিয়া থাকে। যেমন –চেহারা, চরিত্র, রুচি, অভিলাষ, কণ্ঠস্বর, বাচনভঙ্গি, দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি। এতদ্ভিন্ন কতিপয় শারীরিক ও মানসিক ব্যাধিও মাতা-পিতার নিকট হইতে সন্তান-সন্ততিরা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হইয়া থাকে। যথা –যক্ষ্মা, উপদংশ, উন্মাদ ইত্যাদি। ইহাদেরও ধারক ও বাহক হইল জীন। তবে পারিপার্শ্বিকতার প্রভাবে এবং অন্যান্য কতিপয় কারণে সব ক্ষেত্রে উহা প্রকট রূপ নেয় না।
.
# কৃত্রিম প্রজনন
মানুষের দৈহিক ও মানসিক শক্তির সমষ্টিকেই বলা হয় ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিত্বের অনেক কিছুই লাভ করে মানুষ প্রকৃতি হইতে, জন্মের পর। যেমন –দৈহিক শক্তি অর্জনের জন্য নানাবিধ পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ এবং মানসিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য বিবিধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা সমাজের নিকট হইতে শিক্ষা গ্রহণ ইত্যাদি। এইভাবে যে সমস্ত শক্তি অর্জন করা হয়, তদ্বারা দেহযন্ত্র ও মনোবৃত্তিসমূহের পুষ্টি সাধিত হয় বটে, কিন্তু সৃষ্টি হয় না কিছুরই। ব্যক্তিত্বের মূল বিষয়বস্তু যাহা, তাহা অর্জিত নহে, জন্মগত বা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত।
উত্তরাধিকার প্রাপ্তি কখনও অনিয়মিতভাবে হয় না। সভ্য মানব সমাজে বিশেষত মুসলিম জগতে উত্তরাধিকার বিষয়ক একটি পাকাপাকি বিধান রহিয়াছে, যাহাকে বলা হয় ফরায়েজ বিধান। দ্রুপ জীবজগতেও একটি উত্তরাধিকার বিধান রহিয়াছে। তবে পূর্বাবধি উহা ছিল মানুষের অজ্ঞাত। কিন্তু বর্তমানে জানা গিয়াছে উহার ধারা-উপধারা সবই।
পিতা তাহার সুযোগ্য পুত্রের হাতে সংসারের অনেক কাজ করিবার ক্ষমতা অর্পণ করিয়া থাকেন। অনুরূপ ভগবান তাহার নিজের করণীয় অনেক কাজ করিবার ক্ষমতাহবত মানে ছাড়িয়া দিয়াছেন বিজ্ঞানীদের হাতে। ইহার মধ্যে একটি কাজ হইল কৃত্রিম প্রজনন। এই কাজের জন্য ভগবান পথনির্দেশ দিলেন তাহার পুত্র (?) মেণ্ডেলকে ১৯ শতকের মধ্যভাগে।
মেণ্ডেল (Mendel) ছিলেন অস্ট্রিয়ার এক ক্ষুদ্র শহরের খ্রীস্টানী মঠের একজন পাদ্রী (খ্রীস্টানগণ বিশেষত পাদ্রীগণ ভগবানকে পিতা ও নিজেদেরকে তাহার পুত্র বলিয়া থাকেন)। তিনি লক্ষ্য করিয়াছিলেন যে, একই জাতের ফুল ও ফলের বীজ হইতে নানা ধরণের ফুল ও ফল উৎপন্ন হইয়া থাকে। যেমন– একটি লম্বা জাতের লাউয়ের বীজ হইতে লম্বা, গোল ও মাঝারি ধরণের লাউ জন্সিতে দেখা যায়, একটি আম্রবৃক্ষের বীজ হইতে বিভিন্ন ধরণের আম্রফল ফলিয়া থাকে, যাহাদের স্বাদ, গন্ধ ও বর্ণ হয় ভিন্ন ভিন্ন এবং কোনো মানুষও সর্ববিষয়ে তাহার মাতা ও পিতার অনুরূপ হয় না ইত্যাদি। তাই তিনি ভাবিতেছিলেন যে, প্রকৃতির এইসব খেয়ালিপনা কেন, এই সবের সাথে উহাদের যৌন প্রক্রিয়ার কোনো সম্পর্ক আছে কি না।
তিনি তাহার বাগানে কয়েকটি কড়াইশুটির গাছ লইয়া পরীক্ষা শুরু করিলেন। উহার কোনোটির লতা লম্বা, কোনোটির খাটো; কোনোটির খুঁটি পাকিলে হলুদ রং ধারণ করে, কোনোটি থাকে সবুজ; উহাদের ফুলের রংও ভিন্ন ভিন্ন। তিনি লম্বা জাতের সঙ্গে খাটো জাতের মিশ্রণ ঘটাইয়া প্রথম পরীক্ষা শুরু করিলেন এবং লম্বা জাতের ফুলের পরাগ লইয়া খাটো জাতের ফুলের বীজকোষে লাগাইয়া দিলেন। উহাতে যে ফল উৎপন্ন হইল এবং সেই ফল হইতে যে বীজ জন্সিল, তাহা বপন করিয়া দেখিলেন যে, পরের (দ্বিতীয়) বৎসর সকল চারাই হইল লম্বা জাতের। ইহাদের বীজ পুনঃ বপন করিলে তৃতীয় বৎসরে দেখা গেল যে, উহাদের ৩/৪ ভাগ লম্বা ও ১/৪ ভাগ খাটো গাছ জন্মিল। চতুর্থ বৎসরে উহাদের বীজ পুনঃ বপন করিলে দেখা গেল যে, খাটো গাছের বীজ হইতে শুধু খাটো গাছই জমিল, কিন্তু লম্বা গাছের বীজ হইতে জন্মিল পুনরায় তিন ভাগ লম্বা ও এক ভাগ খাটো। অতঃপর তিনি কড়াইশুটির অন্যান্য গুণ যথা –শুটির রং, ফুলের রং ইত্যাদি লইয়া পরীক্ষা করিয়াও ফল পাইলেন ঠিক একই রকম। তিনি বুঝিতে পারিলেন যে, জীবের গুণগত বৈচিত্রগুলি সবই যৌনঘটিত ব্যাপার।
মেণ্ডেল সাহেবের পথ অনুসরণ করিয়া দেখা গিয়াছে যে, কালো বর্ণের গাভীর সহিত কালো বর্ণের ষাঁড়ের মিলন ঘটাইলে সবগুলি বাচ্চাই কালো বর্ণের হইয়া থাকে এবং কালো বর্ণের গাভীর সহিত শাদা বা অন্য কোনো বর্ণের ষাঁড়ের মিলনের ফলে জন্মে দোআঁশলা বাছুর। লাল, কালো ও শাদা বর্ণের গাভীর সহিত লাল, কালো ও শাদা বর্ণের ষাঁড়ের মিলন ঘটাইলে তাহার ফল দাঁড়ায় এইরূপ —
লাল ষাঁড় কালো ষাঁড় শাদা ষাঁড়
লাল গাভীর বাছুর= লা২ লা-কা লা-শা
কালো গাভীর বাছুর = কা-লা কা২ কা-শা
শাদা গাভীর বাছুর = শা-লা শা-কা শা২*
[* প্রাণতত্ত্ব, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৃ. ১১৬।]
উপরোক্ত হিসাবে দেখা যায় যে, নয়টি বাছুরের মধ্যে লা২, কা২, শা২ –এই তিনটি বাছুর তাহাদের মাতা ও পিতার নিকট হইতে একই বর্ণ (গুণ) প্রাপ্ত হইয়াছে বলিয়া উহারা একই বর্ণ লাভ করিয়াছে এবং অবশিষ্ট ছয়টি দুই বর্ণ লাভ করিয়াছে বলিয়া হইয়াছে দোআঁশলা।
মানুষের উপরেও মেণ্ডেলিয়ান বংশানুক্রমের নিয়ম সমভাবে প্রযোজ্য। ও বাবা উভয়ের যদি কটা চক্ষু থাকে, তাহা হইলে তাহাদের সব ছেলে-মেয়ের কটা চক্ষু হইবে। কিন্তু মা-বাবার যদি কালো চক্ষু থাকে, তবে অধিকাংশ ছেলে-মেয়ের কালো চক্ষু হইলেও কৃচিৎ কটা চক্ষুও হইতে পারে। এইখানে চক্ষু ও চুল সম্বন্ধে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া গেল–
চোখ ও চুলের বৈশিষ্ট অনুসারে মানুষের বংশানুক্রম
জনক জননী সন্তান।
১. কালো চোখ কোঁকড়া চুল x কালো চোখ কোঁকড়া চুল = সব ঐ অথবা ১/৪ কটা চোখ;
১/৪ সোজা চুল।
২. ,, ,, x ,, সোজা চুল = সব কালো চোখ (১/৪ কটাও হইতে পারে);
সব কিংবা অর্ধেক সোজা চুল।
৩. ,, সোজা চুল x ,, ,, = সব কালো চোখ (১/৪ কটাও হইতে পারে);
সব সোজা চুল।
৪. কালো চোখ কোঁকড়া চুল x কটা চোখ কোঁকড়া চুল = সব কিংবা অর্ধেক কালো চোখ; সব
কিংবা ৩/৪ কোঁকড়া চুল।
৫. ,, ,, x ,, সোজা চুল = সব কিংবা অর্ধেক কালো চোখ; সব
কিংবা অর্ধেক কোঁকড়া চুল
৬. ,, সোজা চুল x ,, ,, = সব কিংবা অর্ধেক কালো চোখ; সব
সোজা চুল।
৭. কটা চোখ কোঁকড়া চুল x ,, কোঁকড়া চুল = সব কটা চোখ; সব কিংবা ৩/৪ কোঁকড়া চুল।
৮. ,, ,, x ,, সোজা চুল = সব কটা চোখ; সব কিংবা ১/২ কোঁকড়া চুল।
৯. ,, সোজা চুল x ,, ,, = সব কটা চোখ; সব সোজা চুল।*
[* প্রাণতত্ত্ব, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৃ. ১২৩।]
সাম্প্রতিক কালের জীব ও উদ্ভিদ বিজ্ঞানীগণ মেণ্ডেলিজমের ভিত্তিতে গবেষণা চালাইয়া বংশানুক্রম সম্বন্ধে এক নূতন যুগের সূচনা করিয়াছেন। অণুবীক্ষণাদি যন্ত্রের যতই উন্নতি সাধিত হইতেছে, বিজ্ঞানীগণ ততই ক্রোমোসোমের অভ্যন্তরস্থ সূক্ষাতিসূক্ষ্ম অণু-কণা সম্বন্ধে নব নব তত্ত্ব অবগত হইতেছেন। মেণ্ডেল সাহেব না জানিলেও আধুনিক বিজ্ঞানীগণ জানিতে পারিয়াছেন যে, জীবের বংশানুক্রমে যে কোনোও গুণের জন্য জীনগণই দায়ী। তাই বিজ্ঞানীগণ নানা উপায়ে জীনগণের অবস্থান্তর ঘটাইয়া ঈঙ্গিত গুণসমূহের উৎকর্ষ সাধনে সচেষ্ট হইয়াছেন এবং উহাতে তাহারা সাফল্য অর্জন করিয়াছেন যথেষ্ট।
মনে হয় যে, কৃত্রিম প্রজননে সবচেয়ে বেশি উৎকর্ষ সাধিত হইয়াছে উদ্ভিদ বিশেষত কৃষিবিজ্ঞানে। প্রতি বৎসর নূতন নূতন ধরণের বহু জাতের ফুল-ফলের গাছ উৎপন্ন করিয়া আমাদের উপহার দিতেছেন নার্সারিওয়ালারা। ধান, পাট, আখ, গম ইত্যাদি ফসল, লাউ, কুমড়া ইত্যাদি তরিতরকারি এবং আম, কাঁঠাল, কলা, নারিকেল ইত্যাদি যে সকল উন্নত মানের গাছ গাছড়া এযাবত উদ্ভিদবিজ্ঞানীগণ কৃত্রিম প্রজনন দ্বারা উৎপন্ন করিতে সমর্থ হইয়াছেন, কৃষকগণ তাহার যথাযথ ব্যবহার করিলে দেশের খাদ্যাভাব ও অর্থাভাব দূর হইবে, এইরূপ আশা করা যায়।
কৃত্রিম প্রজননের ফলে গৃহপালিত পশু-পাখিদেরও উৎকর্য হইয়াছে ও হইতেছে প্রচুর। ঐসমস্তের প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় হাঁস-মোরগ ও গবাদি পশুর সর্বাধুনিক খামারগুলি দর্শনে। এখন বিজ্ঞানীগণ কৃত্রিম প্রজননের অভিযান চালাইতেছেন মৎস্যরাজ্যেও এবং সেখান হইতেও কানে আসিতেছে তাহাদের বিজয়ডঙ্কার শব্দ।
কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে মানুষের কৌলিক ব্যাধি ও অন্যান্য দোষ-ত্রুটি সংশোধনপূর্বক কি রকম মনুষ্য সমাজের সর্বাঙ্গীন উন্নতি সাধিত হইতে পারে, সেই বিষয়ে গবেষণা করিবার জন্য বিজ্ঞানের একটি নূতন শাখার সৃষ্টি হইয়াছে, যাহার নাম সুজননবিদ্যা (Eugenics)।
.
# জন্মশাসন
জগতের সব কিছুই পরিবর্তনশীল, এমনকি স্বয়ং জগতটিও তদ্রূপ। তবুও একশ্রেণীর মানুষ। “বিধাতার বিধান অপরিবর্তনীয়” –ইহা বলিয়া জগতের বহু বিষয়কে অপরিবর্তনীয় রূপে ধরিয়া রাখিতে সতত চেষ্টা করে। কিন্তু বিধাতার (প্রকৃতির) বিধানবশতই তাহা অসম্ভব হইয়া পড়ে। বিধাতার অনেক আশীর্বাদ বর্তমানে অভিশাপে পরিণত হইয়াছে। উহার মধ্যে একটি হইল মানুষের বংশবৃদ্ধি।
বংশবৃদ্ধি অর্থাৎ সন্তান-সন্ততি হওয়া নাকি বিধাতার একটি মস্ত বড় আশীর্বাদ। পূর্বে বলা হইত এবং এখনও কেহ কেহ বলিয়া থাকেন যে, যে ব্যক্তির সন্তান-সন্ততির সংখ্যা যত অধিক, সে তত অধিক আশীর্বাদপ্রাপ্ত অর্থাৎ ভাগ্যবান। বিধাতার আশীর্বাদের ফলেই নাকি রাবণের লক্ষ পুত্র, ধৃতরাষ্ট্রের শত পুত্র এবং হজরত আদমের পুত্রকন্যার সংখ্যা নাকি একশত বিশ। যদিও এই যুগে ঐরূপ ঢালাও আশীর্বাদ পৃথিবীর কোথায়ও দেখা যায় না, তথাপি এক দম্পতির দশ-বিশটি সন্তান প্রাপ্তির আশীর্বাদ বিরল নহে। পূর্বে মানুষের বহু সন্তান কাম্যও ছিল। কোনো নববধূকে আশীর্বাদ করিয়া বলা হইত, “তুমি সাত পুতের মা হও”। আর আজ? এক জোড়ার অধিক সন্তান কাহারও কাম্য নহে।
উপরোক্ত আশীর্বাদের ফলে বর্তমানে জগতে ঘটিয়াছে খাদ্যের অভাব ও ঘটিতেছে অনাহারে মানুষের মৃত্যু। আমাদের এই সোনার বাংলাদেশে অনাহারে যাহারা মারা গিয়াছে, তাহাদের সংখ্যা হয়তো হাজার হাজার। কিন্তু তিলে তিলে মৃতের সংখ্যা লক্ষ লক্ষও নহে, কোটি কোটি।
বহু সন্তানের আশীর্বাদের কবল হইতে মানব জাতিকে উদ্ধার করিবার মানসে বর্তমান জগতের জননায়কগণ অধুনা প্রবর্তন করিয়াছেন জন্মশাসন, যাহার প্রচলিত নাম হইল পরিবার পরিকল্পনা বা জন্মনিয়ন্ত্রণ। আর রাষ্ট্রনেতাগণ এই কাজটি সাফল্যমণ্ডিত করিবার ভার অর্পণ করিয়াছেন জীববিজ্ঞানীদের উপর।
বর্তমান জগতের কোনো বিবেকবান ব্যক্তিই জন্ম, মৃত্যু, খাদ্য, সম্পদ ইত্যাদি বিষয়ের দায়-দায়িত্ব বিধাতার মাথায় চাপাইয়া দিয়া নিজে আরামে বসিয়া থাকিতে ইচ্ছুক নহেন। বিশেষত বিজ্ঞানীগণই ইহাতে অগ্রগামী। যদিও পরিবার পরিকল্পনা আন্দোলনের বয়স খুবই অল্প, তথাপি বিজ্ঞানীগণ জন্মনিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে নানাবিধ গবেষণা চালাইয়া উহার জন্য অনেকগুলি উপায় আবিষ্কার করিয়াছেন এবং উহা অবলম্বনে আশানুরূপ ফললাভ হইতেছে।
জন্মনিয়ন্ত্রণ যৌনক্রিয়ানিয়ন্ত্রণ নহে; উহা হইল নারী-পুরুষের সন্তানোৎপাদিকা শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা। নারী ও পুরুষের মিলনের ফলেই সন্তানোৎপাদিত হয় না, উহা হয় শুক্রকীট ও ডিম্বকোষের মিলনের ফলে। তাই নারী ও পুরুষের মিলন অব্যাহত রাখিয়া শুধু শুক্রকীট ও ডিম্বকোষের মিলন ব্যাহত করাই জন্মনিয়ন্ত্রণের মুখ্য প্রক্রিয়া। আর এই কাজের জন্য প্রধানত দুইটি পদ্ধতি অবলম্বন করা হইয়া থাকে। প্রথম পদ্ধতি হইল রতিকালে নানা কৌশলে শুক্রকীট ও ডিম্বকোষের মিলনে বাধাদান করা এবং দ্বিতীয় পদ্ধতি হইল নারী ও পুরুষের ডিম্বাধার ও শুক্ৰাধারে ডিম্বকোষ ও শুক্রকীট জন্মিতে না দেওয়া। আর যদি ইহার একটিও কার্যকর না করা যায়, তবে চরম পদ্ধতি হইল ভূণ নষ্ট করা। কিন্তু ইহা অনভিপ্রেত। প্রথমোক্ত পদ্ধতি দুইটি অনুসারে বিজ্ঞানীগণ এযাবত বহু কৌশল আবিষ্কার করিয়াছেন ও করিতেছেন। তাহার মধ্যে এইখানে কয়েকটি কৌশলের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হইল।
১. পিচকারি বা ডুশ প্রয়োগ –রতিক্রিয়ার অব্যবহিত পরেই শুধু জল অথবা সাবান-জল, কুইনাইনের জল, রজার্স পাউডারের জল, লেবুর রস বা ভিনিগার মিশ্রিত জলের পিচকারি বা ডুশ প্রয়োগে স্ত্রীঅঙ্গ ধৌত করিলে গর্ভসঞ্চারের সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু পুরুষের রেতপাতের সঙ্গে সঙ্গে যদি উহা জরায়ুতে প্রবেশ করিয়া থাকে, তবে এই পদ্ধতি কার্যকর নাও হইতে পারে। ডুশের বহুবিধ প্রয়োগরূপ আছে।
২. স্পঞ্জ –দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতায় প্রায় তিন ইঞ্চি একখানা ভালো নরম স্পঞ্জ সংগ্রহ করিয়া রতিক্রিয়ার পূর্বে উহা ঠাণ্ডা জলে, সাবান-জলে, ফিটকিরি ভিজানো জলে অথবা ঝাজবিহীন তৈলে ভিজাইয়া অল্প নিংড়াইয়া স্ত্রীঅঙ্গের মধ্যে দিয়া, অশুলির সাহায্যে ঠাসিয়া জরায়ুমুখে স্থাপন করিয়া লইতে হয়। এই পদ্ধতি রক্ষা করিয়া কার্য করিলে জন্মরোধ হইয়া থাকে। কিন্তু কার্যকালে স্পঞ্জ জরায়ুমুখ হইতে সরিয়া গেলে গর্ভসঞ্চারের সম্ভাবনা থাকে।
৩. কুইনাইন পেসারি –কুইনাইন পেসারি নামক এক প্রকার ক্ষুদ্র ও গোলাকার বটিকা বাজারে পাওয়া যায়। ইহা কুইনাইন, কোকো প্রভৃতির সংযোগে প্রস্তুত হয়। এই পেসারি মিলনের ১০-১৫ মিনিট পূর্বে শ্রীঅঙ্গে প্রবেশ করাইয়া দিলে উহা গলিয়া যায়। অতঃপর মিলনের ফলে গর্ভসঞ্চার হয় না। কেননা, এই ঔষধটির গুণে শুক্রকীটসমূহ মরিয়া যায়। কিন্তু ঔষধ শক্তিশালী না হইলে অথবা কার্যকালের পূর্বে বটিকা না গলিয়া থাকিলে গর্ভসঞ্চারের আশকা থাকে। বাজারে বহুবিধ পেসারি বাহির হইয়াছে।
৪. জেলি, ক্রীম বা পেস্ট –জেলি, ক্রীম বা পেস্ট বাজারে পাওয়া যায়। ইহা শুক্রকীটম্বংসী মাল-মশলায় তৈয়ারী। ইহার যে কোনো একটি রতিক্রিয়ার পূর্বে উভয়ের জননেন্দ্রিয়ে ব্যবহার করিলে উভয়ের অঙ্গ সঞ্চালনেই স্ত্রীঅঙ্গে প্রক্ষিপ্ত হইয়া যায় এবং উহার সংস্পর্শে শুক্রকীটসমূহ মারা যায়। ফলে গর্ভধারণ ব্যাহত হয়।
৫. কনডম— ইহা একমাত্র পুরুষের ব্যবহারোপযোগী পুরুষাঙ্গের এক প্রকার আবরণী বা খাপবিশেষ। কনডম সাধারণত পাতলা রাবার বা প্লাস্টিকের তৈয়ারী। ইহার একদিক খোলা এবং অপরদিক বন্ধ। এই দেশে ইহা ‘ফ্রেঞ্চ ক্যাপ’ বা শুধু ‘ক্যাপ’ নামেই বহুল প্রচলিত।
মৈথুনের পূর্বে পুরুষাঙ্গে মোজার মতো কনডম পরিধান করিতে হয়। ইহাতে কার্যকালে যে বীর্যপাত হয়, তাহা শ্ৰীঅঙ্গে পতিত না হইয়া কনডমের ভিতরেই থাকিয়া যায়। ইহার ফলে গর্ভসঞ্চার হয় না। বর্তমানে বহুবিধ কনডম বাজারে পাওয়া যায়।
৬. পেসারি –ইহা স্ত্রীলোকের ব্যবহারের জন্য রাবার বা প্লাস্টিক নির্মিত আবরণী। ইহা বিভিন্ন আকৃতির হইয়া থাকে। পেসারিগুলির যে কোনও একটি নারীর জরায়ুমুখে পরাইয়া দিলে উহা জরায়ুগ্রীবায় আঁট হইয়া লাগিয়া থাকে। জরায়ুগ্রীবায় পেসারি চাপিয়া জরায়ুমুখ একেবারে আবৃত থাকে। কাজেই পুরুষের বীর্য জরায়ুতে প্রবেশ করিতে পারে না। ফলে গর্ভসঞ্চার হইতে পারে না। অধুনা বহুবিধ পেসারির প্রচলন হইয়াছে।
৭. শুক্ৰবাহী নালী কর্তন— বন্ধ্যাকরণের উত্তম পন্থা অস্ত্রোপচার। পুরুষের বেলায় অণ্ডকোষের সামান্য চিরিয়া শুক্রবাহী নালিকায় দুই প্রান্তে বাধিয়া ও মধ্যভাগ হইতে এক ইঞ্চি পরিমাণ কাটিয়া ঐ স্থানটি পুরাইয়া দেওয়া হয়। ভালোভাবে অস্ত্রোপচার হইলে ইহাতে পুরুষের যৌন আসক্তি বা আনন্দভভাগে কোনোই বাধা হয় না। সাধারণের মতোই সহবাসে তাহার শুক্রশ্মলন হয়, তবে পরিমাণে কম। কিন্তু উহাতে শুক্রকীট থাকে না বলিয়া গর্ভসঞ্চার হয় না। যদিও ইহা স্থায়ী বন্ধ্যাকরণ, তবে অভিজ্ঞ ডাক্তারগণ পুনঃ অস্ত্রোপচার করিয়া শুক্ৰবাহী নালী জোড়া দিয়া বন্ধ্যাত্ব দূর করিতে পারেন।
৮. শুক্রকোষ দূরীকরণ– শুক্রকোষ দূরীকরণ একটি চরম পন্থা। উহাতে দুইটি কোষই বাহির করিয়া ফেলা হয় এবং তজ্জন্য শরীর, মন ও যৌন স্বাস্থ্যের প্রভূত ক্ষতি হইয়া থাকে। পুরুষ দেহে ও মনে মেয়েলি ভাবাপন্ন হইয়া পড়ে। ইহাতে আর কখনও সন্তানোৎপাদন ক্ষমতা ফিরিয়া আসে না।
৯. ফ্যালোপিয়ান নল কর্তন –ইহাতে ফ্যালোপিয়ান নল বা ডিম্ববাহী নালী কাটিয়া বাঁধিয়া দেওয়া হয়। উহাদিগকে একেবারে ফেলিয়াও দেওয়া যায়। ইহাতে ডিম্বাশয় হইতে। ডিম্বকোষ জরায়ুতে আসিতে না পারায় নারী বন্ধ্যাত্বপ্রাপ্ত হয়। সর্বোৎকৃষ্ট পথ হইল, ঐ নল দুইটির ডিম্বাশয়ের দিকের প্রান্ত দুইটিকে তলপেটের প্রাচীরে প্রোথিত করিয়া দেওয়া। শেষোক্ত প্রক্রিয়ায় আবার দরকার হইলে অনেক ক্ষেত্রে সন্তানোৎপাদনের ক্ষমতা ফিরাইয়াও আনা যায়। এইরূপ বন্ধ্যাকরণে স্ত্রীর স্বাভাবিক যৌন আসক্তি ও আনন্দভোগে কোনো গোলযোগ উপস্থিত হয় না। মাসিক স্রাবেও কোনো গোলযোগ ঘটে না।
১০. ডিম্বাশয় দূরীকরণ –নারীর ডিম্বাশয় দুইটি কাটিয়া ফেলিয়া দিয়া উহাকে চিরবন্ধ্যা করা যায় বটে, কিন্তু তাহার পরিণাম খারাপ হইয়া থাকে। ফলে পুরুষের শুক্রকোষ দূরীকরণের মতো নারীর শরীর ও মনের মেয়েলি ভাব কমিয়া যায় ও পুরুষালি ভাব আসিতে পারে।* [*জন্মনিয়ন্ত্রণ, আবুল হাসানাৎ, পূ, ৮৩-১২৫।]
উপরোক্ত পদ্ধতিসমূহ ছাড়া জন্মরোধের আর একটি পদ্ধতি হইল ঔষধ ব্যবহার করা। বর্তমানে এইরূপ কতগুলি ঔষধ আবিষ্কৃত হইয়াছে, যাহা সেবনে রমণীদের ডিম্বাশয়ে ডিম্বকোষ জন্মে না, অথবা জন্মিলে তাহা নষ্ট হইয়া যায়। ফলে স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে সন্তানোৎপত্তি রহিত হয়।
অনভিপ্রেত হইলেও জন্মশাসনের চরম পদ্ধতি হিসাবে গর্ভপাত ঘটাইবার পদ্ধতিটি বহুদিন হইতে প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে প্রায় সব দেশেই প্রচলিত আছে। ইহাতে এইরূপ কোনো ঔষধ গর্ভিনীকে সেবন করানো বা জরায়ুমধ্যে প্রবেশ করাইয়া দেওয়া হয়, যাহার ফলে ভূণ নষ্ট হয় বা সন্তান মারা যায় এবং জরায়ুর উত্তেজনা বা সঙ্কোচনের দরুন গর্ভপাত হয়। কিন্তু এই সমস্ত প্রক্রিয়ায় সব ক্ষেত্রেই বিপদের আশঙ্কা থাকে, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে আশঙ্কা থাকে গর্ভিনীর প্রাণহানিরও।
আমাদের দেশের বর্তমান সরকার পরিবার পরিকল্পনা বনাম জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করিয়াছেন এবং এই ব্যাপারে সর্বাত্মক সাফল্য লাভের জন্য দেশের প্রায় সর্বত্র উহার যথাবিহিত ব্যবস্থা গৃহীত হইয়াছে ও হইতেছে। আশা করি বিধাতা বর্তমান দুনিয়ার মানুষের দুই সন্তান’-এর প্রার্থনা অচিরেই মঞ্জুর করিবেন।
————
[২৭. প্রাণতত্ত্ব, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৃ. ১০৭, ১০৮।
২৮. ঐতিহাসিক অভিধান, মো. মতিয়র রহমান, পৃ. ২৩, ২৪।]