৫
বিকেলের দিকে রাজেনবাবুর বাড়িতে যাবার কথা ফেলুদা বলেছিল, কিন্তু দুপুর থেকে মেঘলা করে চারটে নাগাদ তেড়ে বৃষ্টি নামল। আকাশের চেহারা দেখে মনে হল বৃষ্টি সহজে থামবে না।
ফেলুদা সারাটা সন্ধে খাতা পেনসিল নিয়ে কী সব যেন হিসেব করল। আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছিল কী লিখছে, কিন্তু জিজ্ঞেস করতে সাহস হল না।
শেষটায় আমি তিনকড়িবাবুর বইটা নিয়ে পড়তে আরম্ভ করলাম। দারুণ থ্রিলিং গল্প। পড়তে পড়তে রাজেনবাবুর চিঠির ব্যাপারটা মন থেকে প্রায় মুছেই গেল।
আটটা নাগাত বৃষ্টি থামল। কিন্তু তখন এত শীত যে বাবা আমাদের বেরোতে দিলেন না।
পরদিন ভোরবেলা ফেলুদার ধাক্কার চোটে ঘুম ভাঙল। ‘ওঠ্, ওঠ্—এই তোপ্সে—ওঠ্!’
আমি ধড়মড়িয়ে উঠে পড়লাম। ফেলুদা কানের কাছে মুখ এনে দাঁতে দাঁত চেপে এক নিশ্বাসে বলে গেল, ‘রাজেনবাবুর নেপালী চাকরটা এসেছিল। বলল বাবু এখুনি যেতে বলেছেন—বিশেষ দরকার। তুই যদি যেতে চাস তো—’
‘সে আর বলতে!’
পনের মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে রাজেনবাবুর বাড়িতে পৌঁছে দেখি তিনি ফ্যাকাশে মুখ করে খাটে শুয়ে আছেন। ফণী ডাক্তার তাঁর নাড়ি টিপে খাটের পাশটায় বসে, আর তিনকড়িবাবু এই শীতের মধ্যেও একটা হাতপাখা নিয়ে মাথার পিছনটায় দাঁড়িয়ে হাওয়া করছেন।
ফণীবাবুর নাড়ি দেখা হলে পর রাজেনবাবু যেন বেশ কষ্ট করেই জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে বললেন, ‘কাল রাত্রে—বারোটার কিছু পরে ঘুমটা ভাঙতে বিদ্যুতের আলোয় আমার মুখের ঠিক সামনে আই স এ মাস্ক্ড্ ফেস্!’
মাস্ক্ড্ ফেস্! মুখোশ পরা মুখ!
রাজেনবাবু দম নিলেন। ফণী মিত্তির দেখলাম একটা প্রেস্ক্রিপ্শন লিখছেন।
রাজেনবাবু বললেন, ‘দেখে এমন হল যে চীৎকারও বেরোল না গলা দিয়ে। রাতটা যে কী ভাবে কেটেছে—তা বলতে পারি না।’
ফেলুদা বলল, ‘আপনার জিনিসপত্তর কিছু চুরি যায় নি তো?
রাজেনবাবু বললেন, ‘নাঃ, তবে আমার বিশ্বাস, আমার বালিশের তলা থেকে আমার চাবির গোছাটা নিতেই সে আমার উপর ঝুঁকেছিল। ঘুম ভেঙে যাওয়াতে জানালা দিয়ে লাফিয়ে…ওঃ—হরিব্ল্, হরিব্ল্!’
ফণী ডাক্তার বললেন, ‘আপনি উত্তেজিত হবেন না। আপনাকে একটা ঘুমের ওষুধ দিচ্ছি। আপনার কম্প্লীট রেস্টের দরকার।’
ফণীবাবু উঠে পড়লেন।
ফেলুদা হঠাৎ বলল, ‘ফণীবাবু কাল রাত্রে রুগী দেখতে গেস্লেন বুঝি? কোটের পিছনে কাদার ছিটে লাগল কী করে?
ফণীবাবু তেমন কিছু না ঘাবড়িয়ে বললেন, ‘ডাক্তারের লাইফ তো জানেনই—আর্তের সেবায় যখন জীবনটাই উৎসর্গ করিচি, তখন ডাক যখনই আসুক না কেন, বেরোতেই হবে। সে ঝড়ই হোক, আর বৃষ্টিই হোক, আর বরফই পড়ুক।’
ফণীবাবু তাঁর পাওনা টাকা নিয়ে চলে গেলেন। রাজেনবাবু এবার সোজা হয়ে উঠে বসে বললেন, ‘তোমরা আসাতে অনেকটা সুস্থ বোধ করছি। বেশ খানিকটা ঘাবড়ে গেস্লুম, জান। এখন বোধহয় বৈঠকখানায় গিয়ে একটু বসা চলতে পারে।’
ফেলুদা আর তিনকড়িবাবু হাত ধরাধরি করে রাজেনবাবুকে বৈঠকখানায় এনে বসালেন।
তিনকড়িবাবু বললেন, ‘স্টেশনে ফোন করেছিলুম যদি যাওয়াটা দু’দিন পেছনো যায়। রহস্যের সমাধান না করে যেতে মন চাইছে না। কিন্তু ওরা বললে এ-টিকিট ক্যানসেল করলে দশদিনের আগে বুকিং পাওয়া যাবে না।’
এটা শুনে আমার ভালোই লাগল। আমি চাইছিলাম ফেলুদা একাই ডিটেক্টিভের কাজটা করুক। তিনকড়িবাবু যেন ফেলুদার অনেকটা কাজ আগে আগেই করে দিচ্ছিলেন।
রাজেনবাবু বললেন, ‘আমার চাকরটার পাহারা দেবার কথা ছিল, কিন্তু আমি নিজেই কাল দশটার সময় তাকে ছুটি দিয়ে দিয়েছি। ওর বাড়িতে খুব অসুখ। বুড়ো বাপ আছে, তার এখন-তখন অবস্থা।’
ফেলুদা বলল, ‘মাস্কটা কেমন ছিল মনে আছে?’
রাজেনবাবু বললেন, ‘খুবই সাধারণ নেপালী মুখোশ, দার্জিলিং শহরেই অন্তত আরো তিন চার শ’ খোঁজ করলে পাওয়া যাবে। আমার এই ঘরেই তো আরো পাঁচখানা রয়েছে—ওই যে, দ্যাখো-না।’
রাজেনবাবু যে মুখোশটার দিকে আঙুল দেখালেন, ঠিক সেই জিনিসটা কাল ফেলুদা আমার জন্য কিনে দিয়েছে।
তিনকড়িবাবু এতক্ষণ বেশি কথা বলেন নি, এবার বললেন, ‘আমার মতে এবার বোধহয় পুলিশে একটা খবর দেওয়া উচিত। একটা প্রোটেক্শনেরও তো দরকার। কাল যা ঘটেছে তার পরে তো আর ব্যাপারটাকে ঠাট্টা বলে নেওয়া চলে না। ফেলুবাবু, তুমি তোমার নিজের ইচ্ছে মত তদন্ত চালিয়ে যেতে পার, তাতে তোমায় কেউ বাধা দেবে না। কিন্তু আমি সব দিক বিবেচনা করে বলছি, এবার পুলিশের সাহায্য নেওয়া দরকার। আমি বরং যাই, গিয়ে একটা ডায়েরি করে আসি। প্রাণের ভয় আছে বলে মনে হয় না, তবে রাজেনবাবু, আপনার ঘণ্টাটা একটু সাবধানে রাখবেন।’
আমরা যখন উঠছি, তখন ফেলুদা রাজেনবাবুকে বলল, ‘তিনকড়িবাবু তো চলে যাচ্ছেন। তার মানে আপনার একটি ঘর খালি হয়ে যাচ্ছে। আমরা যদি আজ রাতটা ওঘরে এসে থাকি, তাহলে আপনার কোন আপত্তি আছে কী?’
রাজেনবাবু বললেন, ‘মোটেই না। আপত্তি কী? তুমি তো হলে আমার প্রায় আত্মীয়ের মত। আর সত্যি বলতে কি, যত বুড়ো হচ্ছি তত যেন সাহসটা কমে আসছে। ছেলেবয়সে দুরন্ত হলে নাকি বুড়ো বয়সে মানুষ ম্যাদা মেরে যায়।’
তিনকড়িবাবুকে ফেলুদা বলল স্টেশনে ওঁকে ‘সী-অফ’ করতে যাবে।
ফেরার পথে যখন নেপাল কিউরিও শপের পাশ দিয়ে যাচ্ছি তখন আমাদের দু’জনেরই চোখ গেল দোকানের ভিতর।
দেখলাম দু’জন ভদ্রলোক দোকানের ভিতর জিনিসপত্র দেখছে আর পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছে। দেখে মনে হয় দু’জনের অনেক দিনের আলাপ।
একজন অবনী ঘোষাল, আর একজন প্রবীর মজুমদার।
আমি ফেলুদার দিকে চাইলাম।
তার মুখের ভাব দেখে মনে হল না সে কোন আশ্চর্য জিনিস দেখেছে।
সাড়ে দশটার সময় স্টেশনে গেলাম তিনকড়িবাবুকে গুড বাই করতে। উনি এলেন আমাদেরও পাঁচ মিনিট পরে।
‘চড়াই উঠে উঠে পায়ে ব্যথা হয়ে গেছে তাই আস্তে হাঁটতে হল।’ সত্যিই ভদ্রলোক একটু খোঁড়াচ্ছিলেন।
নীলরঙের ফার্স্ট ক্লাস কামরায় উঠে তিনকড়িবাবু তাঁর অ্যাটাচিকেস খুলে একটা ব্রাউন কাগজের প্যাকেট ফেলুদাকে দিলেন।
‘এটা কিনতেও একটু সময় লাগল। রাজেনবাবু তো আর কিউরিওর দোকানে যেতে পারলেন না, অথচ কাল সত্যিই অনেক ভালো জিনিস এসেছে। তার থেকে একটি সামান্য জিনিস বাছাই করে ওঁর জন্যে এনেছি। তোমরা আমার নাম করে শুভেচ্ছা জানিয়ে ওঁকে দিয়ে দিও।’
ফেলুদা প্যাকেটটা নিয়ে বলল, ‘আপনার ঠিকানা দিয়ে গেলেন না? মিস্ট্রিটা সল্ভ করে আপনাকে জানিয়ে দেবো ভাবছিলাম যে।’
তিনকড়িবাবু বললেন, ‘আমার প্রকাশকের ঠিকানাটা আমার বইয়েতেই পাবে-তার কেয়ারে লিখলেই চিঠি আমার কাছে পৌঁছে যাবে। গুড লাক!’
ট্রেন ছেড়ে দিল। ফেলুদা আমাকে বলল, ‘লোকটা বিদেশে জন্মালে দারুণ নাম আর পয়সা করত। পর পর এতগুলো ভালো রহস্য উপন্যাস খুব কম লোকেই লিখেছে।’
সারাদিন ধরে ফেলুদা রাজেনবাবুর ব্যাপারটা নিয়ে নানান জায়গায় ঘোরাফেরা করল। আমি অনেক করে বলতেও আমাকে সঙ্গে নিল না। সন্ধেবেলা যখন রাজেনবাবুর বাড়ি যাচ্ছি তখন ফেলুদাকে বললাম, ‘কোথায় কোথায় গেলে অন্তত সেইটে বলবে তো!’
ফেলুদা বলল, ‘দুবার মাউন্ট এভারেস্ট হোটেল, একবার ফণী মিত্তিরের বাড়ি, একবার নেপাল কিউরিও শপ, একবার লাইব্রেরি, আর আরো কয়েকটা জায়গা।’
‘ও।’
‘আর কিছু জানতে চাস?’
‘অপরাধী কে বুঝতে পেরেছ?’
‘এখনও বলার সময় আসে নি।’
‘কাউকে সন্দেহ করেছ?’
‘ভালো ডিটেক্টিভ্ হলে প্রত্যেককেই সন্দেহ করতে হয়।’
‘প্রত্যেককে মানে?’
‘এই ধর—তুই।’
‘আমি?’
‘যার কাছে এই মুখোশ আছে, সেই সন্দেহের পাত্র, সে যে-লোকই হোক।’
‘তালে তুমিই বা বাদ যাবে কেন?’
‘বেশি বাজে বকিস্নি।’
‘বারে—তুমি যে রাজেনবাবুকে আগে চিনতে সে কথা তো গোড়ায় বল নি। তার মানে সত্য গোপন করেছ। আর আমার মুখোশও ইচ্ছে করলে তুমিও ব্যবহার করতে পার—হাতের কাছেই থাকে।’
‘শাটাপ্, শাটাপ্!’