স্বপ্নেন্দু সরে এল জানলা থেকে। হঠাৎ সমস্ত শহরের মানুষ পাগল হয়ে গেল নাকি! সে রেডিও খুলতেই মুখ্যমন্ত্রীর গলা ভেসে এল, ‘বন্ধুগণ। আমরা যে পরিবর্তিত অবস্থায় পৌঁছেছি তাকে কাজে লাগানোর জন্যে আমি কলকাতাবাসীর কাছে আবেদন রাখছি। আপনারা এই পরিস্থিতির সুযোগ নিন। এখন অবস্থা অনেক উন্নত। দলে-দলে মানুষ অফিস-কাছারিতে যাচ্ছেন। ট্রাম-বাসে সহজে চলাফেরা করছেন। কলকাতায় আর কখনও খাদ্যাভাব জলাভাব অনুভূত হবে না। কিন্তু কোনও-কোনও কু লোক এত সুন্দর ব্যবস্থাকে বানচাল করে দিতে চাইছেন। আমি এই বলে তাদের সতর্ক করে দিতে চাই কোনওরকম অশান্তি সরকার সহ্য করবে না। জনসাধারণকে অনুরাধ করছি এর প্রতিবাদ করতে। আপনারা সবাইকে বন্ধুর মতো গ্রহণ করুন।’
এইসময় দরজায় শব্দ হল। রেডিওটাকে বন্ধ করে স্বপ্নেন্দু মুখ ফেরাল। দ্বিতীয়বার শব্দটা হল। কে এল এই সময়ে? সন্ধে হয়ে আসছে। সতর্কবাণী মনে পড়ল। পরিচিত ব্যক্তি ছাড়া চট করে দরজা খোলা উচিত হবে না। স্বপ্নেন্দু জিগ্যেস করল, ‘কে ওখানে?’
‘আমি।’ স্বরটি মহিলার।
‘আমি কে?’
‘আহা, খোলোই না!’
স্বপ্নেন্দুর হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠল। হেনা না? ওর মতো স্বর। হেনা এসেছে ভাবাই যায় না। সে দ্রুত দরজার পাল্লা খুলতেই দেখল মাথায় ঘোমটা দিয়ে হাতে ব্যাগ নিয়ে মহিলা ঘরে ঢুকে পড়ল। কিন্তু এ হেনা নয়, নিশ্চয়ই নয়।
‘কী ব্যাপার?’ মহিলা মুখ তুলতেই হোঁচট খেল। না, এ হেনা নয়। হেনার চিবুক বড় আদুরে, মসৃণ এবং গোলাকার।
‘আমাকে চিনতে পারছ না? হায় ভগবান। আমি আত্রেয়ী।’
‘আত্রেয়ী?’
‘আমি ভেবেছিলাম গলার স্বরে তুমি চিনবে। তোমাকে তো খুব সেনসিটিভ বলে আমি জানতাম। তুমি কি অন্য কোনও মেয়ের কথা ভেবেছিলে?’
‘না-না।’ স্বপ্নেন্দু বুঝতে পারছিল না আত্রেয়ী কেন এল, ‘আসলে ব্যাপারটা এত চমকপ্রদ, বলো কী খবর। বসো!’
‘আমাকে কেমন দেখাচ্ছে স্বপ্নেন্দু—’
মাথার ঘোমটাটা সরিয়ে ফেলল আত্রেয়ী। সাদা করোটিটা ক্যাট-ক্যাট করছে। সেটার আকৃতি গোল। কপালটা উঁচু। চোখের ফুটোদুটো বেশ বড়, নাকের ডগা বসা, চিবুক চৌকো। হেনা সেনকে দেখে মনের যে আরাম হয়েছিল তার বিন্দুমাত্র হল না আত্রেয়ীকে দেখে। কিন্তু কেমন খসখসে শিরশিরানি বোধ করল হৃৎপিণ্ড। স্বপ্নেন্দু জবাব দিল, ‘ভালো।’
‘কিন্তু ও নাকি সহ্য করতে পারছে না। আমিও না।’
‘এটা তো মেনে নিতেই হবে।’
‘সে কথা কে বোঝায় বলো। দরজাটা বন্ধ করে দাও। বাইরে খুব গোলমাল।’
‘এই অবস্থায় এলে কেন?’ স্বপ্নেন্দু দরজাটা বন্ধ করে দিল।
‘না এসে উপায় ছিল না। আমি একটা পাগলের সঙ্গে থাকতে পারি না।’
‘পাগল?’
‘হ্যাঁ। ও পাগল হয়ে গিয়েছে।’
‘সে কি? কেন?’
‘কী বলব তোমাকে! ও পুরুষত্বহীন হয়ে পড়েছিল। অনেক চিকিৎসার পর ও বোধহয় সেরে আসছিল। এইসময় ঘটনাটা ঘটতে ও পাগল হয়ে গেল। এই হারানোটা ও স্ট্যান্ড করতে পারছে না। কাল আমাকে মেরেছে। এরপর আমি থাকি কী করে? না, আর একসঙ্গে থাকা সম্ভব নয়।’ একনাগাড়ে কথাগুলো বলে ঈষৎ হাঁপাতে লাগল সে।
স্বপ্নেন্দু বলল, ‘বসো।’
চেয়ারে বসে আত্রেয়ী জিগ্যেস করল, ‘তুমি অপছন্দ করছ?’
‘না তো। আমি তোমাকে বসতে বললাম কেন?’
‘কিন্তু আমি আর ফিরব না। আমি তোমার সঙ্গে থাকব।’
‘আমার সঙ্গে থাকবে?’ এবার চরমে উঠল স্বপ্নেন্দু।
‘হ্যাঁ। আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। আমি জানি তুমিও আমাকে চেয়েছিলে।’
‘সে তো ছাত্রাবস্থায়!’
‘হ্যাঁ। তখন আমি ভুল করেছিলাম। গ্রেট মিসটেক। এখন সেটা সংশোধন করে নিতে চাই। আমরা তো অমর হয়ে গেছি, কোনও মৃত্যুভয় নেই। আমরা চিরজীবন পরস্পরকে ভালোবাসব।’ আত্রেয়ী এগিয়ে এল কয়েক পা, ‘আমি প্রমাণ করে দেব ভালোবাসা কাকে বলে!’
স্বপ্নেন্দু চমকে উঠল, ‘কী আজেবাজে কথা বলছ? তোমরা স্বামী জানতে পারলে কী হবে ভেবেছ? তা ছাড়া—।’
‘কিছুই হবে না। কারণ আমি তার স্ত্রী নই।’
‘স্ত্রী নও মানে? তোমরা বিবাহিত।’
‘ছিলাম। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমি আর মহিলা নই। মানে যেহেতু আমার ফিমেল অর্গানগুলো নেই তাই ও আমাকে স্ত্রী হিসেবে ক্লেইম করতে পারে না। তা ছাড়া, ও নিজেও তো পুরুষ নেই।’ শব্দ করে হাসল আত্রেয়ী, ‘এখন পৃথিবীতে স্ত্রী-পুরুষ আলাদা করে নেই। কোনওরকম পার্থক্য থাকছে না। এখন একটাই পরিচয় আমাদের, আমরা মানুষ।’
ফাঁপরে পড়ল স্বপ্নেন্দু। সে বলল, ‘কিন্তু তুমি তোমার মা-বাবার কাছে চলে যেতে পারতে। যদি প্রয়োজন হয় আমি পৌঁছে দিচ্ছি।’
‘তারা তো সব পাটনায়। শোনোনি, কলকাতার সঙ্গে বহির্বিশ্বের কোনও যোগাযোগ নেই। তা ছাড়া, তুমি কি আমাকে পছন্দ করছ না?’ তেজি ভঙ্গিতে কথা বলল আত্রেয়ী।
‘না-না, সেকথা হচ্ছে না। তুমি হঠাৎ এখানে উঠলে লোকে বলবে কী?’
‘লোকের আর কাজ নেই যে এ ব্যাপারে মাথা ঘামাবে। তা ছাড়া, আমি যে মেয়ে তাই প্রমাণ করবে কে? স্বপ্নেন্দু!’
‘বলো?’
আত্রেয়ী এগিয়ে গেল স্বপ্নেন্দুর কাছে, ‘আমি ভুল করেছিলাম। এতকাল একটুও শান্তি পাইনি। তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিও না।’
‘কিন্তু তুমি বুঝতে পারছ না, এ হয় না।’
‘কেন হয় না। পৃথিবীর যে-কোনও মেয়ের তুলনায় আমি তোমাকে বেশি ভালোবাসব। তুমি আমার সঙ্গে সাতদিন থাকো। তারপর যদি তোমার আমাকে খারাপ লাগে তাহলে আমি কথা দিচ্ছি আর বিরক্ত করব না।’ কান্নার শব্দ উঠল এই ঘরে। জল নেই, শুধু শব্দে বোঝা যাচ্ছে আত্রেয়ী কাঁদছে।
স্বপ্নেন্দু খুব নার্ভাস বোধ করছিল। আত্রেয়ীকে ছাত্রাবস্থায় তার ভালো লাগত ঠিকই, কিন্তু কখনও প্রেম বলে যে ব্যাপার তা মনে আসেনি। অথচ এখন আত্রেয়ী সেইরকম চাপাতে চাইছে। বাইরে এখন বেশ অন্ধকার। তা ছাড়া, রাস্তার অবস্থা যা তাতে এই রাতটা কোথাও যেতে বলা উচিত হবে না। আজকের রাতটা কোনওরকমে কাটিয়ে দিয়ে কাল সকালে এর বিহিত করতে হবে।
স্বপ্নেন্দু বলল, ‘কেঁদো না আত্রেয়ী! সহজ হও।’
‘তুমি আমাকে এখনই তাড়িয়ে দেবে না তো?’
‘পাগল!’
স্বপ্নেন্দু একদম প্রস্তুত ছিল না। তার কথাটা শেষ হওয়া মাত্র আত্রেয়ী ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। অদ্ভুত অনুভূতি হল স্বপ্নেন্দুর। তার বুকের হৃৎপিণ্ডে মুখ রেখে আত্রেয়ী বলছে, ‘তোমাকে ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি।’ আর তার হৃৎপিণ্ড কাঁপছে। হাড়ে-হাড়ে ঘষা লাগায় শব্দ হচ্ছে। কোনও শারীরিক অনুভূতি নেই। কোনও চাঞ্চল্য নেই। বরং হাড়ের সঙ্গে হাড়ের স্পর্শে একটা অস্বস্তিকর শব্দ কানে আসছে।
অনেক কষ্টে স্বপ্নেন্দু আত্রেয়ীকে ছাড়াতে পারল। স্বপ্নেন্দু ভেবে পাচ্ছিল না কী করবে! আত্রেয়ী তার বুকে মুখ রাখার সময় তার খারাপ লেগেছিল কি? একমাত্র ওই শব্দটি তাকে সচেতন করেছিল। এছাড়া সে যে নরম হয়ে পড়েছিল, বেশ আরাম হচ্ছিল, তা কি মিথ্যে? যে-কোনও মেয়ে বুকে মাথা রাখলেই কি এমন হয়? হেনা সেন যদি জানতে পারে—। ছিঃ। হেনার কথা ভাবতেই দৃশ্যটা তেতো হয়ে গেল। সে আত্রেয়ীকে কথা ঘোরাবার জন্যে জিগ্যেস করল, ‘এলে কী করে? রাস্তায় তো গোলমাল হচ্ছে!’
‘অনেক কষ্টে এসেছি। একটা বাসে উঠেছিলাম। ওরা লেডিস সিটে বসতেই দিল না! বলল, এখন কেউ লেডিস নয়। নেমেই দেখি একটা কাপড়ের দোকান লুঠ হচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি পা চালাতে তিনটে লোক আমার পিছন-পিছন হাঁটতে লাগল।’ আত্রেয়ী দম নিল।
‘তোমার পিছন-পিছন? আগে হলেও কথা ছিল।’
‘না, শরীরের জন্যে নয়। এই শাড়ির জন্যে। ততক্ষণে আমি এই গলির মধ্যে ঢুকে পড়েছি। ওই চায়ের দোকানের লোকটা তখন না থাকলে—।’
‘চায়ের দোকান। অবনীদা! অবনীদা তোমায় দেখেছে?’
‘ওঁর নাম বুঝি অবনীদা! উনি তেড়ে উঠতে লোকগুলো চলে গেল।’
‘আমার কাছে আসছ সেটা ওকে বলেছ?’
‘হ্যাঁ। আমি যে বাড়িটা গুলিয়ে ফেলেছিলাম।’
‘কিছু বলেনি?’ হতাশ গলায় জিজ্ঞাসা করল স্বপ্নেন্দু।
‘কেন? অবনীদা কি তোমার গার্জেন?’
‘তা কেন হবে?’
‘উঃ, স্বপ্ন, তুমি এখনও লোক-নিন্দের ভয়ে মরছ! চলো, তোমার সংসার দেখি।’
‘সংসার? আমার আবার সংসার কী। চাকরটা বোধহয় দেশে গিয়ে বেঁচে গেল। আর কখনও আসবে বলে মনে হয় না। এই তো দুটো ঘর। তুমি ওই ঘরটা ব্যবহার করতে পারো। পরিষ্কার আছে কি না জানি না। কদিন তো ঝাঁট পড়েনি—।’
‘ওই ঘর ব্যবহার করব মানে?’
‘তুমি তো আজ রাত্রে এখানে থাকছ!’
‘নিশ্চয়ই। কিন্তু তার জন্যে আলাদা ঘর ব্যবহার করতে হবে কেন?’
‘তুমি কি আমার সঙ্গে শোবে না?’ আত্রেয়ীর স্বরে বিস্ময়।
‘শোনো, আফটার অল তুমি মেয়ে, পরস্ত্রী।’
‘চমৎকার। একটু আগে তোমাকে বললাম আমি আর কারও স্ত্রী নই। তোমাকে ভালোবাসি বলে ছুটে এসেছি। তবু তোমার হুঁশ হল না। স্বপ্নেন্দু ভয় পেও না, তোমার পাশে শুলে আমার অন্তঃসত্বা হওয়ার কোনও চান্স নেই।’
‘আত্রেয়ী?’
হি-হি করে হেসে উঠল আত্রেয়ী, ‘রাগ করো না। এসব কথা আগে উচ্চারণ করতে লজ্জা করত। এখন একটু-আধটু না হয় করি। পাগলামি ছাড়ো, এখন আমরা একসঙ্গে থাকব। জানো স্বপ্ন, আমি চিরকাল ভাবতাম মানুষ কেন মানুষকে আত্মিক ভালোবাসবে না? কেন শরীর তার অবলম্বন হবে? একটা মেয়ের ঠোঁট, বুক, পাছা, যোনির আকর্ষণে আর-একটা ছেলে কুকুরের মতো পেছনে-পেছনে ঘুরবে কেন? ওটাকে ভালোবাসা বলে? ছি! যখন শরীরের ওইসব ক্ষণিক যাদু শেষ হয়ে যাবে, মেয়েটা ছিবড়ে হয়ে যাবে তখন ছেলেটা সেই কুকুরের মতো লেজ গুটিয়ে আর একটা কুকুরীর সন্ধানে ফিরবে! ভাবতেই ঘেন্নায় শরীর গুলিয়ে উঠত। যাকে বিয়ে করেছিলাম সে তো নর্দমা ঘাঁটার মতো শরীরটা খুঁড়ত। কত মাথা ঠুকেছি কিছুতেই শোনেনি। কিন্ত ঈশ্বর শুনেছিলেন। নইলে হঠাৎ সে নপুংসক হয়ে যাবে কেন? অথচ আবার সেটা ফিরে পাওয়ার জন্যে কী চেষ্টা! না পেয়ে পাগল হয়ে গেল। কার্স, কার্স! পুরুষদের ওই পাশবিক অহঙ্কার আমি সহ্য করতে পারি না। ঈশ্বর আমার মনের কথা বুঝেছেন।’
স্বপ্নেন্দু অবাক হয়ে শুনছিল, ‘তুমি পুরুষদের ভালোবাসতে চাওনি?’
‘হ্যাঁ চেয়েছি। কিন্তু তাতে শরীর থাকবে না। প্লেটোনিক লাভ হল অমর। তাতে দেহের কদর্যভঙ্গি থাকে না। স্বর্গীয়। এসো স্বপ্ন, আমরা সেই স্বর্গীয় প্রেমে অনন্তকাল ডুবে থাকি। তুমি আর আমি।’ হাত বাড়াল আত্রেয়ী।
‘কিন্তু তুমি যে এই হাত বাড়াচ্ছ, সেটাতেও তো দেহের প্রয়োজন হচ্ছে!’
‘না, এই কঙ্কালের হাড়ে রক্তমাংস নেই। অতএব এটা দেহ কেন হতে যাবে?’
আত্রেয়ীর দিকে তাকাল স্বপ্নেন্দু। এই মেয়েটাও কি ওর স্বামীর মতো পাগল হয়ে গেল! হঠাৎ সে জিগ্যেস করল, ‘কিন্তু আমি যদি অন্য কোনও মেয়েকে ভালোবাসি? যদি সে আমাকে সমানভাবে চায়?’
হাসল আত্রেয়ী, ‘এখন তো কেউ মেয়ে নয়। সত্যি কি কাউকে ভালোবাস?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমি বিশ্বাস করি না। আমি তাকে দেখতে চাই।’
‘বেশ, দেখাব।’
আত্রেয়ীয় বসবার ভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছিল সে হতভম্ব হয়ে পড়েছে। শেষপর্যন্ত সে মুখ তুলল, ‘তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছ স্বপ্ন?’
‘মোটেই না। আমি তোমাকে বন্ধু মনে করি।’
‘আমিও তাই চাই। এখন দুজন মানুষের মধ্যে বন্ধুত্বের বেশি কিছু হতে পারে না। তাহলে এমন করে বলছ কেন?’
এইসময় বাইরে খুব হইচই শোনা গেল। স্বপ্নেন্দু দ্রুত জানলায় এসে দেখল নিচের রাস্তায় উন্মত্ত কয়েকটা কঙ্কাল একটি কঙ্কালকে ধরেছে। তারপর তার শরীরে আগুন জ্বালিয়ে দিল লোকগুলো। জ্যান্ত পুড়িয়ে মারছে ওরা। স্বপ্নেন্দুর মাথা খারাপ হয়ে গেল। পাগলের মতো ছোটাছুটি করল লোকটা। একটা আগুনের গোলা রাস্তাময় ছোটাছুটি করছে। তারপর আগুন আপনা-আপনি নিভে গেলে লোকটা হো-হো করে হাসল। তার হাড়ে শুধু সামান্য পোড়া দাগ ছাড়া একটুও ক্ষতি হয়নি। আক্রমণকারীরা হতভম্ব হয়ে পড়েছিল। এবার তারা পালিয়ে গেল যে যার মতন। আক্রান্ত লোকটি চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘আমি অমর। হা-হা-হা মার তোরা, কত মারবি আমায় মার।’
যেন কোনও চলচ্চিত্রের দৃশ্য চোখের সামনে দেখানো হল। স্বপ্নেন্দুর মনে হল একবার রাস্তায় গিয়ে দেখা দরকার। দূরে চিৎকার চেঁচামেচি চলছে এখন। সে রেডিও খুলতেই কোনও শব্দ পেল না। আকাশবাণী কি মৃত? স্বপ্নেন্দু আত্রেয়ীকে বলল, ‘তুমি বসো। আমি একটু দেখে আসছি কী হচ্ছে বাইরে।’
‘আমিও যাব।’
না বলতে গিয়ে থমকে গেল স্বপ্নেন্দু। এই ঘরে আত্রেয়ীকে একা রেখে যাওয়া উচিত হবে না। টেবিলে জারের তলায় ফুলটা রয়েছে। যদি কোনও খেয়ালে চাদরের ঢাকনা সরায় তাহলে ও ফুলটাকে দেখতে পাবে। সে কোনও ঝুঁকি নিতে চাইল না।
আত্রেয়ীকে নিয়ে বাইরে আসতেই দেখল লাঠি নিয়ে কিছু কঙ্কাল ছোটাছুটি করছে। মোড়ের কাছে আসতে সে অবাক হল। অবনীদার দোকানে একটা কঙ্কাল বসে আছে মূর্তির মতো। তার অঙ্গে এক ফোঁটা সুতো নেই। স্বপ্নেদু বলল, ‘আচ্ছা, অবনীদা কোথায়?’
‘আমিই অবনী। স্বপ্নেন্দু?’
‘হ্যাঁ।’
‘বাড়ি ফিরে যাও স্বপ্নেন্দু। দেখছ না মানুষ কেমন পাগল হয়ে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি চলে যাও।’ অবনীদা বলল।
‘কী ব্যাপার?’
‘মানুষ জেনে গেছে এই পৃথিবী থেকে তাদের পাওয়ার কিছু নেই। অথচ তাদের অনন্তকাল অমর হয়ে থাকতে হবে। এমনকী আগুনও তাদের দগ্ধ করছে না। সবাই এই দশা থেকে মুক্তি চায়। সবাই চিতায় শুতে চায় স্বপ্নেন্দু।’
‘সবাই?’
‘হ্যাঁ। আমি তো চাই। তুমি জানো না, আমার স্ত্রী আজ বেরিয়ে গেছে। সে নাকি যে-কোনও উপায়ে আত্মহত্যা করবেই। কত বললাম তবু গেল।’
‘আপনি বাধা দিলেন না?’
‘কী হবে দিয়ে? ওরা আমার লুঙ্গিটাকে খুলে দিয়ে গেল। এই যে উদোম হয়ে বসে আছি খারাপ লাগছে না কিন্তু। বেশ হাওয়া চলছে শরীরে। যাওয়ার সময় আমার ছোট ছেলেটা বলল, মায়ের সঙ্গে থাকবে। জানো, সে বলল মায়ের সঙ্গে? সব নষ্ট হয়ে গেছে, সব সম্পর্ক, কিন্তু স্বপ্নেন্দু শিশুরা এখন মাকে মা বলে জানে।’
অবনীদা বলল, ‘আর দাঁড়িয়ে থেকো না। তোমার সঙ্গে মহিলা আছেন। ওঁর শাড়ি খুলে নেবে ওরা।’
‘কিন্তু পুলিশ নেই?’
‘না। এখন কিছুই নেই। সবাই লুঠ করতে নেমেছে। কারণ লুঠ করলে যদি খুন হয়ে যায় তাহলে সে বেঁচে যাবে। এই মৃত্যুর নাম জীবন।’
স্বপ্নেন্দু ফিরে আসছিল। তাদের পাশের দরজায় তখন একটা অদ্ভুত দৃশ্য। সেই বৃদ্ধ ল্যাম্পপোস্টের গায়ে দড়ি ঝুলিয়ে গলায় ফাঁস ঢুকিয়ে লাফিয়ে পড়ল। তাকে দেখতে ভিড় জমে গেছে। ঘাড়টা সামান্য বেঁকে গেল। কিন্তু লোকটা চেঁচাতে লাগল, ‘আমি কি মরেছি? কী দেখছ তোমরা, আমি কি মরেছি?’
উলঙ্গ সেই কঙ্কালটার দিকে তাকিয়ে একজন চেঁচাল, ‘বললাম মরবেন না, তবু শুনলেন না। এখন ঝুলুন ওখানে সারাজীবন। আমি অত ওপরে উঠে দড়ি কাটতে পারব না। আমি মরেছি, মরলে কেউ চেঁচায়?’
হাউ-হাউ করে কাঁদছিল বুড়ো। ‘দড়ি দিয়েও মারলাম না।’ তার শরীরটা হাওয়ায় দুলছিল একজন লাফিয়ে তার পা-দুটো ঠেলে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘দোল দোল দোল, নো হরিবোল।’
স্বপ্নেন্দু আর দাঁড়াল না। তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে এল। ঘরে ঢুকে আত্রেয়ী বলল, ‘ডিসগাস্টিং। মানুষ কোথায় স্বাভাবিক ভাবে বাঁচার চেষ্টা করবে না মরার জন্যে হেদিয়ে মরছে। এই, আমি শাড়িটা খুলছি।’
স্বপ্নেন্দু অবাক হয়ে দেখল আত্রেয়ী তার শরীর থেকে শাড়ি খুলে ফেলল। জামাটাকে টান মেরে ছুড়ে ফেলে বলল, ‘কেমন দেখাচ্ছে?’
‘জাদুঘরে এইরকম মূর্তি দেখেছি।’
‘এখন তো কলকাতা শহরটাই জাদুঘর হয়ে গেছে। লোকটা ঠিকই বলেছে, বেশ হাওয়া পাস করছে শরীরের ভেতর দিয়ে। হাড় জুড়োচ্ছে। এসো শুয়ে পড়ি। খুব টায়ার্ড লাগছে।’
‘তুমি শোও। আমি—।’
স্বপ্নেন্দু জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নিচে প্রচণ্ড উত্তেজক কিছু চলছে। ঝুঁকে পড়ল সে। সে বৃদ্ধ এখনও ল্যাম্পপোস্টে দোল খাচ্ছে এবং সেই অবস্থায় চিৎকার করে উঠছেন, ‘মেরে ফ্যাল, খোকা তুই মেরে ফ্যাল আমাকে। আমি তোর পায়ে পড়ছি খোকা, এভাবে দোল খাওয়াস না।’
নিচে দাঁড়ানো একটা কঙ্কাল খেঁকিয়ে উঠল, ‘পই-পই করে বলেছিলাম এখন গলায় দড়ি দিলে কেউ মরে না। তখন শুনলে না কেন?’
‘আমি বুঝতে পারিনি। যেমন করে হোক মেরে ফ্যাল আমাকে। আমি তোর বাপ, তোকে হুকুম করছি মার আমাকে।’
‘মার বললেই হল! অত ওপরে ঝুলে তো বেশ মজাসে হাওয়া খাচ্ছ।’ কঙ্কালটি আশেপাশে মজা দেখতে আসা মুখগুলির দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করল, ‘একটা উপায় বলুন তো? আমার মাথায় কিছু আসছে না।’
জনতা সঙ্গে-সঙ্গে উত্তেজিতভাবে নানান রকম পরামর্শ দিতে লাগল। শেষপর্যন্ত স্থির হল নিচে আগুন জ্বালিয়ে বৃদ্ধকে পুড়িয়ে মারা হবে। সেই মতো প্রচুর কাঠ জোগাড় করল। তারপর সোৎসাহে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হল বৃদ্ধের নিচে। দাউ-দাউ করে সেই আগুন বৃদ্ধকে গ্রাস করে ফেলতে স্বপ্নেন্দু চোখ বন্ধ করতে চাইলেও পারল না। তার চোখের পাতা কিংবা মণি নেই তবু সে সব দেখতে পাচ্ছে। এবং দেখে যেতে হবে। আর তারপরেই অদ্ভুত কাণ্ডটা ঘটল। আগুনের শিখা বৃদ্ধের শরীরের খাঁচাকে লালচে করতে না করতে গলায় ফাঁস পরানো দড়িটা পুড়ে গিয়ে খসে পড়ল রাস্তায়। হইহই করে সবাই ছুটে গেল বৃদ্ধের কাছে। বৃদ্ধ উঠে দাঁড়াতে পারছে না। কারণ পতনের পর তার পায়ের হাড় ভেঙেছে। কিন্তু সে সমানে চিৎকার করে যাচ্ছে, ‘মেরে ফ্যাল আমাকে, মেরে ফ্যাল।’
সবাই মিলে ওকে ধরাধরি করে ভেতরে নিয়ে যেতে স্বপ্নেন্দু মুখ ফেরাল। আত্রেয়ী তার বালিশ জড়িয়ে শুয়ে আছে পাশ ফিরে। ওর হাড়গুলো বড্ড বেশি সাদা। বুকের খাঁচায় নিরেট হৃৎপিণ্ডটার দিকে তাকাল সে। ওটাকে ভাঙা যাবে না, কিছুতেই না। আত্রেয়ী ডাকল, ‘কী দেখছে গো?’
স্বপ্নেন্দু বুঝে উঠছিল না সে কী করবে। এই ঘরে আত্রেয়ীর সঙ্গে রাত কাটিয়েছে শুনলে হেনা তাকে কি ভালোবাসবে? তার সঙ্গে সারাজীবন থাকতে চাইবে?
আত্রেয়ী ডাকল, ‘কী হল? এসো কাছে এসো।’
‘কী হবে কাছে এসে?’ স্বপ্নেন্দু সময় নিচ্ছিল।
‘তোমাকে জড়িয়ে ধরে সারারাত ঘুমিয়ে থাকব।’
‘আমার ঘুম আসে না।’
‘আমারও।’
‘তাহলে?’
‘তোমার বুকে মুখ রেখে রাতটা কাটিয়ে দেব।’
স্বপ্নেন্দু টেবিলের দিকে তাকাল। গোলাপটাকে দেখতে তার খুব ইচ্ছে করছিল। কিন্তু আত্রেয়ীর সামনে কাপড় সরিয়ে ওটার দিকে তাকাতে সাহস হচ্ছিল না। ও নিশ্চয়ই লোভী হবে। ওরকম ডাঁটো গোলাপ দেখলে কেউ স্থির থাকতে পারে না। বরং ও ঘুমিয়ে পড়লে, দূর, এখন তো ঘুম চলে গেছে সাধারণ মানুষের চোখ থেকে।
স্বপ্নেন্দু এক পা এগিয়ে এল। একটি নগ্নকঙ্কাল এবার চিৎ হল। মেয়েদের শরীরে মাংস না থাকলে কীরকম বীভৎস হয়ে যায়। রাস্তাঘাটে যত কঙ্কাল চোখে পড়েছে তাদের দেখলেই এটা বোঝা যায়। পুরুষদের হাড়ের গঠন মেয়েদের চেয়ে অনেক সুন্দর। কিন্তু হেনার চিবুক? মাংস বা চামড়া না থাকা সত্বেও কীরকম আদুরে। আর আত্রেয়ী! ওর দিকে তাকিয়ে কোনও অনুভূতিই হচ্ছে না।
আত্রেয়ী আবার ডাকল, ‘এসো না!’
স্বপ্নেন্দু বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়াল, ‘শোনো আত্রেয়ী, আমি একটি মেয়েকে ভালোবাসি। তার নাম হেনা। আমি তার সঙ্গেই থাকতে চাই।’
‘হেনা, সে কে?’
‘আমার বান্ধবী।’
‘তুমি ভালোবাস? কত বছর?’
‘বছর নয়। তিনদিন।’
‘সে কি? তিনদিনে একটা মেয়ের মন বোঝা যায়?’
‘যায়। যে বুঝতে পারে সে একমুহূর্তেই পারে।’
‘আমি বিশ্বাস করি না।’
‘তোমার অবিশ্বাসে আমি কী করতে পারি।’
‘তুমি আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে এসব বলছ।’
‘আমি মিথ্যে বলছি না।’
আত্রেয়ী ধীরে-ধীরে উঠে বসল, ‘আমি সত্যি কিছ বুঝতে পারছি না। মাত্র তিনদিন দেখে তুমি একটি মেয়ের ওপর নির্ভর করতে চাইছ? সে তোমাকে কী দেবে? তারও তো শরীর নেই। মেয়ে বলে তার কোনও আলাদা অস্তিত্বই নেই। আর আমি তোমাকে চেয়ে পাগলের মতো ছুটে এসেছি এই বিপদে—।’ আত্রেয়ীয় গলা রুদ্ধ হল। স্বপ্নেন্দুর মনে হল ওর মুখটা খুব করুণ দেখাচ্ছে।
‘কিন্তু তুমি এতগুলো বছরে আসোনি কেন?’
‘আসতে পারিনি। কারণ ও আমাকে ডিভোর্স দিত না। তা ছাড়া, আমার ওই এঁটো শরীরটাকে আমি তোমায় দিতে পারতাম না স্বপ্নেন্দু। অনেক কষ্টে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলাম। কলেজ জীবনের ছবিটাকে জোর করে মুছে ফেলেছিলাম। কিন্তু সেদিন লিন্ডসে স্ট্রিটে তোমায় দেখে বুঝলাম এতদিন শুধু নিজেকে ঠকিয়েছি। তাই যে মুহূর্তে এই শরীরটা পবিত্র হয়ে গেল অমনি তোমার কাছে ছুটে এলাম স্বপ্ন।’
স্বপ্নেন্দুর মনে হল আত্রেয়ী সত্যি কথা বলছে। কিন্তু সে এই সত্যিটাকে মেনে নেবে কী করে? সে বলল, ‘আত্রেয়ী, আমি তোমার সঙ্গে হেনার আলাপ করিয়ে দেব।’
‘বেশ, কিন্তু আমি তোমার কাছেই থাকব। এতে কি তোমার হেনা আপত্তি করবে?’
‘জানি না। তবে শুনেছি মেয়েরা সতীন পছন্দ করে না।’
‘সতীন? ও, তুমি ভুলে যাচ্ছ আমরা কেউ মেয়ে নই।’
‘তাহলে তো চুকেই গেল। তুমি শুয়ে পড়ো, আমি—।’
‘আমার পাশে শুতে তোমার এখনও আপত্তি? বন্ধু কি বন্ধুর পাশে শোয় না?’
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হাড়ে-হাড়ে কোনও অনুভূতি না হলেও পুরোনো অভ্যেসে বসতে ইচ্ছে করে। স্বপ্নেন্দু খাটে বসে মাথাটা এলিয়ে দিতেই আত্রেয়ী ওর বুকের কাছে সরে এল। এসে বলল, ‘তোমার হৃৎপিণ্ডের শব্দ পাচ্ছি।’
স্বপ্নেন্দু আড়ষ্ট গলায় জিগ্যেস করল, ‘আচ্ছা আত্রেয়ী, এতসব ব্যাপার হয়ে গেল, মানুষের এমন অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটল, সবাই হা-হুতাশ করছে কিন্তু তোমার কোনও প্রতিক্রিয়া হয়নি না?’
‘না।’ আত্রেয়ী হাসল যেন, ‘কারণ আমি আমার শরীরটাকে ঘেন্না করতাম। ওটা আমার শত্রু ছিল। আর কথা বলো না, আমাকে তোমার হৃৎপিণ্ডের আওয়াজ শুনতে দাও।’ আত্রেয়ী স্বপ্নেন্দুর বুকের খাঁচায় কান চেপে ধরল। তার ভেতরে সেই শক্ত স্বচ্ছ মোড়কের ভেতরে যে হৃৎপিণ্ড দপদপ করছিল সে ততক্ষণে অনেক সহজ। হেনাকে সে ভালোবাসে। কিন্তু এই মুহূর্তে সে আত্রেয়ীকেও ভালোবাসে। শরীরের নির্দিষ্ট গণ্ডি যেহেতু আর চারপাশে নেই তাই কোনও অপরাধবোধও আর কাজ করছে না। স্বপ্নেন্দু আর-একবার টেবিলের দিকে তাকাল। ওই কাপড়ের ঢাকনা সরিয়ে জারের আড়ালটা তুললেই তার চোখে ঘুম কিংবা শান্তি নেমে আসত। কিন্তু ওই ঝুঁকি সে কিছুতেই নিতে পারে না। তাকে সারারাত আত্রেয়ীকে পাহারা দিতে হবে।
ভোরবেলায় স্বপ্নেন্দু বলল, ‘চলো, ঘুরে আসি।’
মাঝরাত্রে একটা ঝগড়া হয়েছিল। স্বপ্নেন্দুর পক্ষে সারারাত একনাগাড়ে একই ভঙ্গিতে শুয়ে থাকা সম্ভব নয়। অথচ আত্রেয়ীর কানে হৃৎপিণ্ডের শব্দ পৌঁছনো চাই। এই নিয়ে কথা কাটাকাটি। স্বপ্নেন্দু বলেছিল, ‘এটা উদ্ভট আবদার। বড্ড বেশি চাওয়া।’
তারপর থেকে আত্রেয়ী চুপচাপ হয়ে গেছে। কোনও কথা বলেনি এতক্ষণ। স্বপ্নেন্দু প্রস্তাব করতেও উত্তর দিল না। স্বপ্নেন্দুর ইচ্ছে হল একাই বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু ফুলটাকে এই ঘরে আত্রেয়ীর সঙ্গে একা রেখে যাওয়া অসম্ভব। সে কাছে এল, ‘আত্রেয়ী, আমার সঙ্গে কথা বলবে না!’
আত্রেয়ী মুখ ফেরাল, ‘আমি যে বড্ড বেশি চাই।’
‘একটু কম চাও, তাহলেই তো সব মিটে যায়।’
‘বেশ, সেইটুকু হল তুমি।’ আত্রেয়ী হাসল।
এখন সবে আঁধার সরেছে। কিন্তু রাস্তাঘাটে বেশ মানুষ। যেহেতু কারও চোখে ঘুম নেই তাই রাস্তা রাত্রেও ফাঁকা হয় না। বের হওয়ার সময় আত্রেয়ী আর পোশাক পরেনি। স্বপ্নেন্দু আপত্তি জানলে বলেছিল, ‘এখন আর লজ্জা কি? লোকে তো মেয়ে বলে বুঝবে না। বরং কাপড় থাকলে কেড়ে নিতে পারে।’
স্বপ্নেন্দু তবু ইতস্তত করেছিল, ‘কেমন ল্যাংটো-ল্যাংটো দেখায়। তা ছাড়া, হাড়ের গঠন দেখেও ছেলে-মেয়ে পার্থক্য বোঝা যায়।’
উড়িয়ে দিয়েছিল আত্রেয়ী, ‘ওটা যারা হাড় নিয়ে পড়াশুনো করেছে শুধু তারাই পারে। পাবলিক চিরকাল মুখ্যু।’
এখন রেডিও থেকে বারংবার ঘোষণা করেছে, ‘শান্তি বজায় রাখুন। গুজবে কান দেবেন না। ভোর ছ’টায় মুখ্যমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশে ভাষণ শুনুন।’
বের হওয়ার সময় পকেট ট্রানজিস্টারটা সঙ্গে নিয়েছিল স্বপ্নেন্দু। তার পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি। গলির মোড়ে আসতেই দুটো লোক এগিয়ে এল, ‘এই যে দাদা, জামাকাপড় ছাড়ুন।’
‘ছাড়ব মানে?’ স্বপ্নেন্দুর গলায় বিস্ময়।
‘এখন সব পরা চলবে না। পোশাক ব্যবধান সৃষ্টি করে। খুলে ফেলুন।’
‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।’
‘বোঝার কিছু নেই। আপনার সঙ্গে যে দাদা আছেন তিনি তো পোশাক পরেননি। আপনি ডাঁট মেরে পাঞ্জাবি চাপিয়েছেন। জানেন, কলকাতায় কত লোকের গায়ে একটা সুতো পর্যন্ত নেই? এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সবাই এক হতে হবে। পোশাক মানুষ পরত লজ্জা নিবারণের জন্যে। সেইটি যখন নেই তখন পোশাক খুলে সব মানুষ এক হয়ে যাক।’
স্বপ্নেন্দু আত্রেয়ীর দিকে তাকাল। ওরা ওকে দাদা বলল। চমৎকার। এর মধ্যে ভিড় জমে গেছে। সবাই নগ্ন। একজন বলল, ‘অত কথায় কাজ কি? জোর করে খুলে নিলেই তো হয়।’
প্রথমজন বলল, ‘না-না। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন শান্তি বজায় রাখতে। উনি নিজেই খুলবেন। আমরা ওঁকে ঘেরাও করে রাখব যতক্ষন না খোলেন।’ কোনও জোর-জবরদস্তি কেউ করবেন না।’
‘এই ঘেরাওটা জোর-জবরদস্তি নয়?’ স্বপ্নেন্দু অসহায় হয়ে পড়েছিল।
‘না। এটা একটা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের হাতিয়ার।’
আত্রেয়ী মুখ খুলতে গিয়ে থেমে গেল। ওর মনে হল কথা বললেই যে সে পুরুষ নয় তা বুঝে যাবে ওরা। শেষপর্যন্ত বাধ্য হল স্বপ্নেন্দু। মুহূর্তেই জামাকাপড় উধাও হয়ে গেল। সমস্ত শরীরের হাড় ভোরের হাওয়ায় শীতল হল। এমনকী ট্রানজিস্টারটাও হাতছাড়া হয়ে গেল। শুধু ঘরের চাবিটা কোনওক্রমে বাঁচাতে পারল স্বপ্নেন্দু। প্রথম লোকটি বলল, ‘এতক্ষণে আপনি জনতার সঙ্গে মিশে গেলেন ভাই। যে পোশাক পরবে তাকেই বাধা দেবেন। শান্তি বজায় রাখুন।’
ভিড় ছাড়িয়ে কয়েক পা হেঁটে আত্রেয়ী কথা বলল, ‘তোমাকে তখনই সাবধান করেছিলাম কিন্তু শুনলে না। যাক, মন খারাপ কোরো না। তোমার শরীরের কাঠামো সত্যি চমৎকার।’
স্বপ্নেন্দু কাঁধ নাচাল। চায়ের দোকানটায় আজ বেশ ভিড়। সেখানে অবনীদা কোনজন বুঝতে পারল না স্বপ্নেন্দু। ওরা হাঁটতে-হাঁটতে ট্রাম-রাস্তার পাশে চলে আসতেই দেখল সার-সার ট্রাম জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে আছে। চারধারে শুধু থিকথিকে নরকঙ্কাল। তারা চিৎকার করছে, এ ওকে আক্রমণ করছে। আত্রেয়ীকে নিয়ে স্বপ্নেন্দু একটা গাড়ি-বারান্দার তলায় সরে আসতেই চোখে পড়ল দুজন কঙ্কাল রকে বসে একটা ট্রানজিস্টার চালিয়েছে। তারপরেই ঘোষকের কণ্ঠ শোনা গেল, ‘এখন কলকাতাবাসীর উদ্দেশে ভাষণ দেবেন মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী।’
স্বপ্নেন্দু সরে এল লোকদুটোর কাছে। এবং তখনই সে চিনতে পারল নিজের ট্রানজিস্টারটাকে। হুবহু সেই দাগটা। এই ব্যাটারাই পোশাক খোলার সময় হাতিয়েছে। ওরা এখন স্বপ্নেন্দুকে চিনতে না পারায় মনোযোগ দিয়ে ট্রানজিস্টার শুনছে। স্বপ্নেন্দুর ইচ্ছে হল ওটা কেড়ে নেয়। কিন্তু তখনই মুখ্যমন্ত্রী বলতে শুরু করলেন, ‘বন্ধুগণ, আমরা এখন এক গভীর সমস্যাময় সময়ে রয়েছি। পরিবর্তিত পরিস্থিতি উদ্ভূত অভাবনীয় সুযোগগুলো বানচাল করে দেওয়ার জন্যে কিছু প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সক্রিয় হয়েছে। তারা এই অতিবৈপ্লবিক পরিবর্তনকে মেনে নিতে পারছে না। শহরের চারদিকে অশান্তি এবং গোলযোগ সৃষ্টি করতে চাইছে। এই ষড়যন্ত্র আমরা ধ্বংস করবই। এমনকী এইসব ষড়যন্ত্রকারীরা এখন মৃত্যুকামনা করছে। আপনারা জানেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মৃত্যু হল একটি জঘন্য ব্যবস্থা যা শুধু দালালরাই কামনা করে। এই অতিবৈপ্লবিক পরিবর্তন আমরা মৃত্যুকে জয় করেছি। এখন সমস্ত মানুষ এক এবং অবিনশ্বর। এই দালালগোষ্ঠী ষড়যন্ত্র করছে যাতে মৃত্যু এসে আমাদের এই নবীন সমাজব্যবস্থাকে বানচাল করে দেয়। আমি একথা জোর গলায় ঘোষণা করতে চাই, সমস্ত ষড়যন্ত্র ধ্বংস হয়ে যাবে। আপনারা এদের প্রতিরোধ করুন। শহরে শান্তি বজায় রাখুন।’
ভাষণ শেষ হওয়া মাত্রই যার হাতে ট্রানজিস্টার ছিল সে প্রচণ্ড আক্রোশে ওটাকে ফুটপাথে আছড়ে ফেলতেই সেটা দুমড়ে-মুচড়ে গেল। তারপর চিৎকার করে বলল, ‘শালা জ্ঞান দিচ্ছে। কী বলল আর্ধেক কথা আমি বুঝতেই পারিনি। কী ভাষায় যে কথা বলে!’
তার সঙ্গী বলল, ‘ওটা ভাঙলি কেন? বিবিধ ভারতী শোনা যেত।’
‘একটা গেল তাতে কি, আর-একটা ছিনতাই করে নেব।’
ওরা চলে যাওয়ার পর স্বপ্নেন্দু বলল, ‘ওই ট্রানজিস্টারটা আমার ছিল।’
‘সত্যি! তুমি ওদের বললে না কেন?’
‘বললে শুনত? দেখছ না ওরা কীরকম মাস্তান।’
‘এই জন্য তোমাকে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করেছিলাম।’
‘সারাক্ষণ ঘরে বন্দি হয়ে থাকা যায়!’
‘বন্দি বলছ কেন?’
‘বন্দি নয় তো কি? ঘরে বসে কী করব?’
‘কেন?’ আত্রেয়ী অন্যরকম গলায় বলল, ‘ভালোবাসব।’
চকিতে মুখ ফেরাল স্বপ্নেন্দু। আত্রেয়ী কি পাগল হয়ে গিয়েছে। কোনও-কোনও পাগলকে নাকি সাদা চোখে ঠিক ঠাওর করা যায় না। তাদের ব্যবহার ও কথাবার্তায় সেটা প্রকাশ পায়। আত্রেয়ী কি সেই ধরনের? নইলে ভালোবাসা ছাড়া অন্য কোনও চিন্তা ওর মাথায় নেই কেন?
সে বলল, ‘আমাকে একটু যেতে হবে।’
‘কোথায়?’
‘হেনার বাড়িতে। অনেকদূর। তোমাকে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না।’
‘কিন্তু তুমি যাবে কী করে? দেখছ না আজ ট্রাম-বাস চলছে না।’
‘চলে যাব। তুমি বরং চারপাশ ঘুরে দ্যাখো।’
‘বাব্বা। এ যেন বিল্বকেও হার মানাচ্ছে। বেশ, যাও, তোমাকে তো আমি বাধা দেব না কিছুতেই। আমি রইলাম। চাবিটা দাও।’
‘কীসের চাবি?’
‘ঘরের।’
‘না। ওই ঘরে তোমাকে একা যেতে দিতে পারি না।’
‘কেন?’ আত্রেয়ী এত বিস্মিত যে ওর গলা দিয়ে স্বর বের হল না ভালো করে।
‘রাগ করো না। নিশ্চয়ই এমন একটা কারণ আছে যা এই মুহূর্তে তোমাকে বলতে পারছি না। আত্রেয়ী, ভুল বুঝে না। আমি তোমাকে পরে সব খুলে বলব। তুমি অপেক্ষা করো। আমি ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই চলে আসছি।’
‘কিন্তু আমি তোমাকে চিনব কী করে?’ আত্রেয়ীর গলায় স্বর করুণ।
‘তিন ঘণ্টা পরে ঘরের দরজার সামনে অপেক্ষা কোরো। অন্য জায়গায় থেকো না। আমি ঠিক চলে আসব।’ স্বপ্নেন্দু হাঁটতে শুরু করল।
দূরত্ব কম নয়। কিন্তু স্বপ্নেন্দুর হাঁটতে কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না। এই কয়দিনে নতুন শরীর বেশ অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। পায়ে কোনও ব্যথা অনুভূত হচ্ছে না।
আজ রাস্তায় ট্রাম-বাস নেই। মুখ্যমন্ত্রী বারংবার আবেদন জানানো সত্বেও জনজীবন স্বাভাবিক হয়নি। তার বদলে কাতারে-কাতারে নগ্ন কঙ্কাল রাস্তায় আক্ষেপ করছে, উন্মাদের মতো ছোটাছুটি করছে। তারা কী করবে সেটাই জানে না, কিন্তু চুপচাপ ঘরে বসে থাকা বোধহয় আরও কষ্টকর। অথচ আত্রেয়ী তাকে নিয়ে ঘরেই থাকতে চাইছিল। আত্রেয়ী বলছে ও তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। ভালোবাসলে বোধহয় ওইভাবে নির্জনে থাকা যায়। কিন্তু সে তো হেনাকে ভালোবেসেছে। তবে এতক্ষণে আত্রেয়ীকেও তার খারাপ লাগছে না। কাল রাত্রে আত্রেয়ী তাকে সুন্দর-সুন্দর গান শুনিয়েছে। সে শুনতে চায়নি কিন্তু আত্রেয়ী গেয়ে গেছে। পুরোনো দিনের আবেগ মাখানো গান এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত। এই পরিবেশে সেগুলো মোটেই খারাপ লাগেনি তার। ভালোবাসলে মানুষ গান গাইতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটা ক্রমশ জটিল হয়ে যাচ্ছে। হেনার সঙ্গে বসে আত্রেয়ীর ব্যাপারটা ফয়সালা করতে হবে। কী করে তা সম্ভব সেটাই জানা নেই।
রাজাবাজারের কাছাকাছি পৌঁছে ভিড়টা নজরে এল। অন্তত কয়েকশো কঙ্কাল ভিড় করে কিছু দেখছে। স্বপ্নেন্দু ঠেলেঠুলে এগিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু একজন খেঁকিয়ে উঠল, ‘আঃ মরণ, নজরের মাথা খেয়েছেন নাকি!’
স্বর মেয়েলি, স্বপ্নেন্দু বিনীত ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি ঠিক বুঝতে পারিনি।’
‘বুঝবেন কী করে। দেখার জন্যে তো তর সইছে না।’
‘আপনি মহিলা তা তো বোঝার উপায় নেই।’
‘ঢং। বোঝার উপায় নেই। ভালো করে চেয়ে দেখলেই তো বোঝা যায়।’ বলতে-বলতে কনুই দিয়ে একটা মৃদু ধাক্কা দিল সে। স্বপ্নেন্দু খুব তাজ্জব হল। এতক্ষণ তার ধারণা ছিল পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নারী-পুরুষ একাকার হয়ে গিয়েছে। কাল সারারাত আত্রেয়ীর সঙ্গে থেকেও তাকে নিজের শরীরের থেকে আলাদা বলে মনে হয়নি। সে খুঁটিয়ে দেখল। তারপর স্থির করল, মেয়েকঙ্কালের মুখের গঠন ছোট হয়, হাড়গুলো একটু পলকা এবং নরমভাব মেশানো। সেক্ষেত্রে বালকদের সঙ্গে খুব বেশি তফাৎ হবার কথা নয়। স্বপ্নেন্দু কথা ঘোরাবার জন্যে জিগ্যেস করল, ‘কী হচ্ছে এখানে?’
স্ত্রী-কঙ্কালটি বলল, ‘ওরা একটা লোককে ধরেছে। তার বিচার হচ্ছে।’
স্বপ্নেন্দু ততক্ষণে দেখতে পেয়েছে। ভিড়ের মাঝখানে চার-পাঁচজন আসামীকে বসিয়ে রেখেছে। এবার জেরা শুরু হয়, ‘আপনি মরতে চেয়েছেন, শুধু তাই নয় আপনি আরও পাঁচজনকে মরতে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছেন। কেন?’
লোকটি নির্লিপ্ত গলায় বলল, ‘আমার গণতান্ত্রিক অধিকার আছে মরতে চাওয়ার।’
‘মোটেই না। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন যারা মরতে চায় তারা ষড়যন্ত্রকারী। তারা এই অতি-বৈপ্লবিক ব্যবস্থাকে বানচাল করে দিতে চায়। একবার যদি কেউ মরে যেতে পারে তাহলে সবাই সেই পথ ধরবে। এই অতি-বৈপ্লবিক ব্যবস্থায় কারও ব্যক্তিগত ইচ্ছা পূর্ণ হতে পারে না।’
‘আমি এসব জানি না। আপনারা কি শাস্তি দেবেন আমাকে? আমি বলি, বরং আমাকে মেরে ফেলুন। এখানে কারও কোনও সুখ নেই। মুখ নেই। সব মুখ এক। কারও কোনও যন্ত্রণা নেই। কারও সামনে কোনও রহস্য নেই। উই হ্যাভ লস্ট আওয়ার আইডেন্টিটি। এইভাবে বেঁচে থাকা যায় না। ‘
‘আপনি দালালদের মতো কথা বলছেন।’
‘জানি না। তবে যে দেশে ফুল নেই, গাছ নেই, জল নেই, একটুও সবুজ নেই সেই দেশে আমি অনন্তকাল বেঁচে থাকতে চাই না।’ লোকটা মাথা নাড়ল, ‘এমনকী একটা মেয়ে পর্যন্ত নেই।’
‘ওমেনস লিব কথাটা শুনেছেন? মেয়েরা এতকাল পুরুষদের সমান হওয়ার জন্যে আন্দোলন করছিলেন। আর আপনাদের মতো পুরুষেরা সেই আন্দোলন দাবিয়ে রেখেছিলেন। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মেয়েদের সেই আশা পূর্ণ হয়েছে।’
স্বপ্নেন্দু শুনল স্ত্রী-কঙ্কালটি চাপা স্বরে বলল, ‘ঝাঁটা মার। গতর গেলে মেয়েমানুষের আর কী থাকল!’
‘যা হোক আপনি মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ অমান্য করেছেন। এই জন্যে আপনাকে শাস্তি দিচ্ছি।’
‘চমৎকার। মেরে ফেলুন।’
‘না ওটা করলে মুখ্যমন্ত্রীর হাত নরম হবে।’
লোকটি হাসল, ‘আপনার হাত-পায়ের প্রতি জোড়ে ইলেকট্রিক করাত চালাব যাতে শুধু আপনার বুকের খাঁচাটা ফুটপাথে পড়ে থাকে। হৃৎপিণ্ড তো ভাঙা যাবে না। আপনি চিরকাল ওই অবস্থায় পড়ে থাকবেন। হাঁটাচলা করার স্বাধীনতা থাকবে না।’
স্বপ্নেন্দু ভিড় থেকে বেরিয়ে এল। লোকটা নিশ্চয়ই গর্দভ। নইলে মৃত্যুর জন্যে এঁড়ে তর্ক করে। হঠাৎ তার খেয়াল হল কেউ সঙ্গে আসছে। স্ত্রী-কঙ্কালটিকে সে চিনতে পারল, ‘আপনি? কোথায় যাচ্ছেন?’
‘যাবার তো জায়গা নেই। ওসব দৃশ্য সহ্য করতে পারি না আমি। আপনি বেরিয়ে এলেন বলে আমিও চলে এলাম।’
‘আপনার বাড়ি কোথায়?’
‘বাড়ি নেই। ঘর ছিল। ভাসতে-ভাসতে হাড়কাটায় ঠেকেছিলাম। এখন আমাকে বেবশ্যে বলে চেনা যায় না; না?’ স্ত্রী কঙ্কালটি খিলখিলিয়ে হাসল।
স্বপ্নেন্দু আড়ষ্ট হল। এই কঙ্কালটি একসময় বেশ্যাবৃত্তি করত। অথচ এখন ওকে দেখলে নিজেদের মতোই লাগছে। সে বলল, ‘আমি এবার বাঁদিকে যাব। আপনি যেখানে ইচ্ছে যান।’
‘তাতো বলবেই। এখন আমি বেকার। কিন্তু তখন ধাক্কা দিলে কেন?’
‘আমি তো বললাম আপনাকে লক্ষ করিনি।’
‘ইল্লি আর কী! ধান্দাবাজ লোকেরাই ধাক্কা দেয়।’
স্বপ্নেন্দুর হঠাৎ ভয় এল বুকে। এই স্ত্রী-কঙ্কালটির উদ্দেশ্য সে বুঝতে পারছিল না। সে দৌড়ে পাঁচজন কঙ্কালের সঙ্গে মিশে হাঁটতে লাগল। স্ত্রী-কঙ্কালটি ছুটে এল সেখানে। স্বপ্নেন্দু বুঝতে পারল বেচারা ধাঁধায় পড়েছে। ছয়জনের মধ্যে কে কোনজন তা বুঝে উঠছে না। তারপর একজনের হাত চেপে ধরে স্ত্রী-কঙ্কালটি চিৎকার করে উঠল, ‘এই শালা, ধোঁকা দিয়ে পালিয়ে আসা হয়েছে না?’
সেই লোকটি অবাক ও বিরক্ত হয়ে ধমকে উঠল, ‘আরে, আমার হাত ধরেছিস কেন, ফোট।’ আর-একজন হেসে বলল, ‘ইয়ে শালী রাণ্ডী থি।’
স্ত্রী-কঙ্কালটি বোকার মতো দাঁড়িয়ে পড়লে স্বপ্নেন্দু হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। দ্রুত পা চালাতে লাগল সে। লস্ট আইডেন্টিটি। তা না হলে সে রক্ষা পেত না ওই জাঁহাবাজ স্ত্রী-কঙ্কালটির হাত থেকে! পরিচয় হারিয়ে যাওয়ায় একটা বড় উপকার হল। এখন যে কেউ যে-কোনও ভূমিকায় অভিনয় করতে পারে। এখন শরীর খুব দ্রুত হাঁটতে পারছে। তবু সময় কম লাগল না। রাস্তায় যেতে-যেতে অনেক দৃশ্য দেখেছে স্বপ্নেন্দু। যে যেখানে ইচ্ছে আগুন ধরাচ্ছে। তাতে কারও কোনও আপত্তি নেই যেন। দমকলের গাড়িই নেই কারণ জল অদৃশ্য। এমনকী যার ঘর পুড়ছে তারও যেন সম্পত্তির ওপর মায়া চলে গেছে। সমস্ত মানুষ এখন উন্মাদ। হেনাদের বাড়ির সামনে এসে দেখল প্রচণ্ড ভিড় জমেছে। অনুমানে বুঝল সেখানেও কোনও বিচার-পর্ব চলছে। কৌতূহল হলেও সেদিকে আর পা বাড়াল না সে। একবারে যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে।
দরজা খোলা। ঘরের আসবাবগুলো নেই। সব খাঁ-খাঁ করছে। স্বপ্নেন্দু ডাকল, ‘হেনা।’
ভেতর থেকে কোনও সাড়া এল না। স্বপ্নেন্দু এগোল। কোনও ঘরে কেউ নেই। হতভম্ব হয়ে গেল সে। হেনারা গেল কোথায়? নিজের অজান্তেই সে চিৎকার করল, ‘হেনা।’
স্বপ্নেন্দু বাইরে বেরিয়ে আসতেই দেখল তিনজন একজনকে প্রায় টানতে-টানতে নিয়ে আসছে। যাকে টানছে তার স্বর চিনতে পারল স্বপ্নেন্দু। সে ছুটে গেল সামনে, ‘হেনা, হেনা তোমার কী হয়েছে?’
যারা টানছিল, তারা দাঁড়িয়ে পড়ল। যাকে টানছিল সে সোজা হল। স্বপ্নেন্দু আবার বলল, ‘হেনা, তোমার কী হয়েছে? আমি স্বপ্নেন্দু।’
সঙ্গে-সঙ্গে কান্নায় ভেঙে পড়ল হেনা। মাটিতে উবু হয়ে বসে কান্না জড়ানো স্বরে বলল, ‘ওরা আমার মাকে ধরে নিয়ে গেল।’
‘কেন?’
যারা হেনাকে এনেছিল তাদের একজন বলল, ‘ওঁর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে।’
‘মাথায় ঘিলু নেই খারাপ হবে কী করে?’
‘তাহলে হৃৎপিণ্ড খারাপ হয়ে গিয়েছে। জানলা দিয়ে নিচে ঝাঁপ দিয়েছিলেন মরার জন্যে। হাত-পা ভেঙেছে, মরেননি। সেই অবস্থায় পাগলের মতো মরতে চাইছিলেন। সেই অবস্থায় বিচার করে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশমতো পাতাল-কূপে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এক বছরের জন্যে বন্দি করে রাখতে। আপনি যখন এঁর পরিচিত তখন এঁকে সামলান। আমরা চলি।’ লোকগুলো চলে গেল।
ধাক্কাটা সামলে স্বপ্নেন্দু হেনার মাথায় হাত দিল, ‘হেনা, শান্ত হও।’
‘ওরা মাকে ধরে নিয়ে গেছে। তুমি কিছু করবে না?’ কান্না আছে কিন্তু পরিবর্তিত অবস্থায় জলের তো দেখা পাওয়া যাবে না।
‘এখনই তো কিছু করা যাবে না। তুমি ওঁকে বাধা দাওনি কেন?’
‘দিয়েছিলাম। শোনেননি আমার কথা। উলটে বললেন, তোর তো একটা প্রেমিক আছে, আমি কী নিয়ে থাকব। ভাবতে পারো, আমার মা আমাকে ওই কথা বলল।’
‘কী পরিবর্তন। এখন আমি কী করব!’
হেনাকে তুলে দাঁড় করাল স্বপ্নেন্দু, ‘আমি আছি, তোমার ভয় নেই হেনা।’
‘মাকে কি আমি ফিরে পাব না?’
‘পাবে। এখন তো কেউ মরে না। নিশ্চয়ই চেষ্টা করব আমি। আমার ওপর ভরসা রাখো হেনা। আমি তোমাকে গ্রহণ করতে এতদূরে চলে এসেছি।’
‘সত্যি?’ হেনার স্বরে উত্তাপ।
‘সত্যি। তুমি আমার সঙ্গে চলো।’
‘আমাকে কোনওদিন কষ্ট দেবে না?’
‘না।’
‘কিন্তু কীভাবে থাকব? এখন তো আমাদের বিয়ে হবে না।’
‘আমরা সার্টিফিকেট জোগাড় করব সরকার থেকে। আমি কথা বলেছি।’
‘কিন্তু আমাকে নিয়ে তুমি কী করবে?’
‘আমি ভালোবাসব। আমি তোমাকে সুখী করব।’
‘সত্যি সুখে রাখবে আমাকে?’
‘হ্যাঁ।’
‘কিন্তু এখন তো কলকাতা থেকে সুখ উধাও হয়ে গিয়েছে। তুমি কী করে আমাকে সুখী করবে? তোমার কাছে কি সুখের গোপন মন্ত্র আছে?’
‘কী সুখ তুমি চাও হেনা?’
‘জানি না। একটা অসহায় মেয়ে কী সুখ চাইতে পারে!’
‘আমি তার থেকে অনেক বেশি সুখ দেব তোমাকে। তুমি এসো।’
‘কী সে সুখ?’
‘এখন বলব না। তুমি আমার ঘরে চলো। তারপর তোমাকে দেখাব।’ হেনা বোধহয় অবিশ্বাস করল, কিন্তু অবাধ্য হল না। ধীরে-ধীরে সম্মত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। কয়েক পা হাঁটবার পর স্বপ্নেন্দুর খেয়াল হল, ‘তোমাদের ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। বন্ধ করবে না?’
‘কী হবে বন্ধ করে? ওখানে যা ছিল সব লুঠ হয়ে গেছে মা পড়ে যাওয়ার পরে। তোমার সঙ্গে গেলে আমি আর এখানে ফিরে আসছি না।’
স্বপ্নেন্দু লক্ষ করেছিল হেনার শরীরে পোশাক নেই। অথচ হেনা এ ব্যাপারে খুব সচেতন ছিল। নিশ্চয়ই উত্তেজনায় ওর এ বিষয়ে আর লক্ষ ছিল না। সে হেনার দিকে তাকাল। ওর হাড়ের গঠনেও যেন একটা ছন্দ ছড়ানো আছে।
হেনার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। সারাটা পথ সে কেবল ঘুরে-ফিরে মায়ের কথা বলেছে। স্বপ্নেন্দু তাকে সান্ত্বনা দিয়েছে, পরিচিত কর্তাব্যক্তিকে ধরে সে নিশ্চয়ই হেনার মাকে উদ্ধার করবে। হাঁটতে-হাঁটতে ওরা রাজাবাজারের কাছে পৌঁছে একটা ছোট্ট ভিড় দেখল। ফুটপাথে হাত-পা-মুন্ডুহীন অবস্থায় একটা বুকের খাঁচা পড়ে আছে। অথচ সেই খাঁচায় আটকে থাকা নিরেট আবরণের ভেতর থেকে হৃৎপিণ্ড সমানে চিৎকার করে যাচ্ছে, ‘মেরে ফ্যাল, মেরে ফ্যাল…।’
হেনা চমকে উঠল, ‘কী হয়েছে ওর?’
স্বপ্নেন্দু ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিল। এর মধ্যেই শাস্তি দেওয়া হয়ে গেছে। একে প্রকাশ্যে রাখা হয়েছে যাতে সাধারণ নাগরিকরা মৃত্যুর কথা বলতে ভয় পায়। কিন্তু কি লাভ হচ্ছে ওতে। শাস্তি পাওয়ার পরও তো লোকটা সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এসব কথা হেনাকে বলা যায় না। ঘটনাটা জানালে হেনা চট করে মায়ের অবস্থা ভাববে। ভদ্রমহিলা যদি সচেতন না হন তাহলে তাঁরও এই পরিণতি ঘটবে। সে উদাস গলায় বলল, ‘হয়তো পড়ে-টড়ে হাড়গোড় ভেঙেছে। তুমি আমার হাত ধরো।’
হেনা যেন একটু কাঁপল, ‘যাঃ, খোলা রাস্তায় হাত ধরে হাঁটব কী!’
‘তাতে কী হয়েছে? এখানে কেউ বুঝতে পারবে নাকি আমরা ছেলে-মেয়ে ছিলাম।’
‘ছিলাম।’ ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলল হেনা।
‘হাত না ধরলে ভিড়ের মধ্যে নিজেদের গুলিয়ে ফেলতে পারি।’
এবার হেনা হাত বাড়াল। শীতল না উষ্ণ বোঝা গেল না কারণ স্বপ্নেন্দু আবিষ্কার করল তার নিজের হাতের অনুভূতি হারিয়ে গেছে। সে তবু বলল, ‘তোমার হাত খুব নরম ছিল, না?’
সঙ্গে-সঙ্গে ফুঁপিয়ে উঠল হেনা। ত্রস্ত স্বপ্নেন্দু জিগ্যেস করল, ‘কী হল তোমার?’
‘কেন মনে করিয়ে দাও ওসব?’
‘সরি। আসলে, তুমি এখনও খুব নরম। তোমার মনটা এত নরম—।’
চারধারে অশান্তি বাড়ছে। ওরা থেমে এগোচ্ছিল। রাস্তায় যে যাকে পারছে আঘাত করছে। হাড়ে-হাড়ে ঠকাঠক শব্দ হচ্ছে। একটা জায়গায় বিচার চলছিল বোধহয়। হঠাৎ জনতা খেপে গিয়ে বিচারকদের ধাওয়া করল। বিচারকরা পালাতে-পালাতে চিৎকার করছিল, ‘শান্তি বজায় রাখুন। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন…।’ কিন্তু কে শোনে কার কথা।
বড়রাস্তা তবু নিরাপদ। জনতার মধ্যে মিশে গিয়ে কোনওরকমে এগিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু গলিতে ঢোকা বিপজ্জনক। সেখানে আগুন জ্বলছে। জল নেই, দমকল নেই অতএব আগুনের পোয়াবারো। চোখের সামনে বাড়িঘর পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে—এটা দেখার মধ্যে বেশ মজা আছে বোধহয়। মানুষগুলো এতকাল কোনও উত্তেজনা পাচ্ছিল না। এখন আগুনের খেলা দেখে বেশ আনন্দ পাচ্ছে। কেউ-কেউ আবার সেই আগুনে স্নান করার মতো পাক খেয়ে আসছে। হেনা স্বপ্নেন্দুর হাত ধরে বলল, ‘কলকাতায় যখন আর কিছুই পোড়াবার থাকবে না তখন কী করবে ওরা? কীসে উত্তেজনা পাবে?’
‘জানি না।’
হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়াতে হেনা প্রশ্ন করল, ‘তুমি তখন আমাকে কী দেখাবে বলেছিলে?’
স্বপ্নেন্দু হাসল, ‘অধৈর্য হচ্ছ কেন? আমার ওখানে চলো, তারপর দেখবে।’
হেনা বলল, ‘ভাবতে কেমন লাগে, না? তুমি ডাকলে আর আমি চলে এলাম। একবারও ভবিষ্যতের কথা ভাবলাম না।’
‘তোমার ভবিষ্যৎ তো আমার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে।’
‘কী জানি।’
আর এই সময় আত্রেয়ীর কথা মনে পড়ল স্বপ্নেন্দুর। ও যদি চলে না যায় তাহলে বাড়িতে যাওয়া মাত্র দেখা হবে। ওর কথা শুনলে হেনা কী ভাববে? তাকে যদি বিশ্বাসঘাতক মনে করে চলে আসে?
স্বপ্নেন্দু ভেবে পাচ্ছিল না কী করবে! বলি-বলি করেও বলতে পারল না সে। তার মনে হল এর চেয়ে হেনাদের বাড়িতেই থেকে গেলে হতো। আত্রেয়ী তার খোঁজ পেত না। কিন্তু তখন মনে হয়েছিল হেনাকে নিজের কাছে নিয়ে যাবে, হেনার কাছে থাকার কথা খেয়ালে আসেনি। স্বপ্নেন্দুর হঠাৎ মনে হল সে আত্রেয়ীকে এত ভয় পাচ্ছে কেন? আত্রেয়ী তাকে ভালোবাসে এইটুকু কি হেনা সহ্য করবে না? কোনও পুরুষ যদি তাকে ভালোবাসত তাহলে হেনা কী করত! এখন তো আত্রেয়ী আর মেয়ে নয়। সে স্থির করল, যা হওয়ার হবে। যেমন করেই হোক হেনাকে রাজি করাবে তার সঙ্গে থাকতে।
শেষপর্যন্ত পাড়ায় পৌঁছল ওরা। হেনা বলল, ‘এদিকটা বেশি ঘিঞ্জি না?’
উত্তর কলকাতায় থাকার জন্যে এই প্রথম খারাপ লাগল স্বপ্নেন্দুর। তবু বলল, ‘এসব তো বনেদি পাড়া। প্ল্যান করে তৈরি হয়নি তখন। তবে আমার ঘরে হাওয়া আসে।’ একমাত্র তারাই হাত ধরাধরি করে যাচ্ছে। আর বাকি মানুষ পাগলের মতো চিৎকার করছে। গলিতে ঢুকেই ধোঁয়া দেখতে পেল ওরা। স্বপ্নেন্দুর ভয় হচ্ছিল তাদের বাড়ি ছাই হয়ে গেছে কি না। বাড়ির কথা মনে হতেই চাবির কথা খেয়ালে এল। চাবিটা কোথায়? হাতে নেই তো। সে স্তব্ধ হয়ে গেল। ওরকম দামি গা-তালা চাবি ছাড়া খোলা মুশকিল। কখন যে হাত থেকে টুক করে পড়ে গেছে সেটা তার খেয়ালেই নেই। এখন একটা তালাওয়ালা যদি না পাওয়া যায় তাহলে দরজা ভাঙতে হবে। সে চাপা গলায় বলল, ‘সর্বনাশ।’
হেনা চমকে উঠল, ‘কী হয়েছে? তোমার বাড়িতে আগুন দিয়েছে নাকি?’
‘না। কিন্তু আমি ঘরের চাবি হারিয়ে ফেলেছি?’
‘সে কি?’
‘হ্যাঁ। খুব শক্ত তালা। এখন দরজা খুলব কী করে?’
হেনা এবার হেসে উঠল, ‘তোমার বুকে হাত দিয়ে দ্যাখো।’
‘বুকে?’ স্বপ্নেন্দু অবাক হয়ে নিজের হৃৎপিণ্ডের দিকে তাকাল। এবং তখনই সে তার চাবিটাকে পেল। হৃৎপিণ্ডের চার দিকের শক্ত স্বচ্ছ মোড়কের গায়ে চাবিটা আটকে আছে। ওটা ওখানে কী করে গেল? স্বপ্নেন্দু হাত বাড়িয়ে চাবিটাকে টানতে গিয়ে টের পেল? মোড়কটিতে চুম্বক কাজ করছে। যা কিছু শক্ত তাই বোধহয় এই হৃৎপিণ্ড টেনে নেয়। অদ্ভুত ব্যাপার।
কয়েক পা এগিয়ে অবনীদার চায়ের দোকানটার দিকে নজর যেতেই স্তব্ধ হয়ে গেল স্বপ্নেন্দু। ধিকি-ধিকি আগুন জ্বলছে সেখানে। একটা লোক সামনে উবু হয়ে বসে সেদিকে তাকিয়ে। দোকানটা এখন প্রায় ছাই। স্বপ্নেন্দুর মনে হল লোকটা নিশ্চয়ই অবনীদা। খুব কষ্ট না পেলে কোনও মানুষ ওইভাবে বসে থাকতে পারে না। আর এই দোকান ছাই হওয়ায় সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাবে একমাত্র অবনীদা। সে ডাকল, ‘অবনীদা, না?’
‘হুঁ। তুমি কে ভাই?’ অবনীদার ভঙ্গির পরিবর্তন হল না।
‘আমি স্বপ্নেন্দু।’
‘দ্যাখো, ওরা কিছু না পেয়ে দোকানটাকে জ্বালিয়ে দিয়ে গেল।’
‘কেন? আপনি কী করেছিলেন?’
‘কিছু না। ওদের তো কোনও কাজ করার নেই অথচ কিছু একটা করতে হবে। এই দোকানটা চোখে পড়তেই পুড়িয়ে দিল। খুব হইহই করল যতক্ষণ আগুন জ্বলছিল। তারপর চলে গেল। ওই দ্যাখো ন্যাড়ার বাপ এখনও পড়ে আছে ফুটপাথে।’
স্বপ্নেন্দু চোখ ফেরাল। সেই বৃদ্ধ যে দড়িতে ঝুলছিল, আগুনের ছ্যাঁকা খেয়েছিল সে এখন হাত-পা-হীন অবস্থায় ফুটপাতে পড়ে আছে। কোনও কথা বলছে না কিন্তু তার শরীর নড়ায় বোঝা যাচ্ছে মৃত্যু ধারেকাছে আসেনি।
স্বপ্নেন্দু হেনার হাত ধরে এগিয়ে গেল বাড়ির দিকে। হেনা জিজ্ঞাসা করল, ‘ওর কী হয়েছে?’
‘পড়ে-টড়ে গেছে বোধহয়।’ নিরীহ ভঙ্গিতে বলল স্বপ্নেন্দু।
‘মিথ্যে কথা। নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। ঠিক আছে, আমিই জিজ্ঞাসা করছি।’ ফুটপাথে উঠে সামান্য ঝুঁকে হেনা জিগ্যেস করল, ‘আপনার এরকম হল কেন?’
বৃদ্ধের মুন্ডু হেনার দিকে ফিরল, ‘বলব না।’
‘কেন বলবেন না?’
‘আমার ইচ্ছে তাই বলব না। আবার বলে মুন্ডুটাকে হারাই আর কী?’
হেনা একটু হকচকিয়ে সরে এল। স্বপ্নেন্দু বলল, ‘তেমন কিছু না, হলে কি বলত না?’
হেনার কিন্তু তখনও খুঁতখুঁতুনি যাচ্ছিল না।
সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতেই স্বপ্নেন্দু থমকে দাঁড়াল। একটা কঙ্কাল মুখ ঝুঁকিয়ে বসে আছে দরজার গোড়ায়। ওদের দেখেই সে উঠে দাঁড়াল, ‘স্বপ্নেন্দু না?’
‘হ্যাঁ।’
‘তুমি হেনা?’
হেনা এবার বিস্মিত। স্বপ্নেন্দুর দিকে মুখ ফিরিয়ে জিগ্যেস করল, ‘ইনি কে?’
‘আমি?’ হি-হি করে হাসল আত্রেয়ী, ‘আমি কেউ না! পথের ভিখিরি। দূর ছাই, আমি শুধু ভুলে যাই, এখন তো একটা ভিখিরিও নেই।’
স্বপ্নেন্দু বলল, ‘হেনা, এর নাম আত্রেয়ী। আমরা একসঙ্গে পড়তাম। তারপর ওর বিয়ে হয়ে যায়, যোগাযোগও ছিল না। কাল এই বিপর্যয়ে আমার এখানে এসেছে।’
‘তবু বলতে পারলে না আমরা বন্ধু।’ চিৎকার করে উঠল আত্রেয়ী।
‘ঠিক আছে, বন্ধু।’
হেনা অবাক হয়ে বলল, ‘তোমরা কাল একসঙ্গে ছিলে? তুমি আমাকে একথা বলোনি কেন স্বপ্নেন্দু?’
সঙ্গে-সঙ্গে নেমে এল আত্রেয়ী, ‘এই বোকা, তুমি ওকে ভালোবাস?’
‘জানি না।’
‘কিন্তু ও তোমাকে ভালোবাসে। তুমি তো মেয়ে ছিলে, আমিও। আমরা কী চাইতাম? ছেলেদের সমান হব, তাই না? আজ তো ছেলে-মেয়ের মধ্যে কোনও তফাত নেই। তাহলে শুধু-শুধু মেয়েলিপনা করব কেন?’
‘আপনি আমার হাত ছাড়ুন।’
‘না, ছাড়ব কেন? তোমাকে আমার বন্ধু হতে হবে।’
‘খামোকা বন্ধু হতে যাব কেন?’
‘কারণ তোমাকে স্বপ্নেন্দু ভালোবাসে।’
‘তার সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক?’
আত্রেয়ী বলল, ‘কারণ আমি স্বপ্নেন্দুকে ভালোবাসি।’
চকিতে হেনা জিগ্যেস করল, ‘ও আপনাকে ভালোবাসে?’
‘না। ও তোমাকে ভালোবাসে তাই।’
‘তাহলে?’
‘কী তাহলে? এখন তো আর কিছু পাওয়ার আশা নেই। আমাদের শরীর নেই, নারীত্ব নেই। শুধু হৃৎপিণ্ড আছে যা দিয়ে আমরা ভালোবাসতে পারি। এসো আমরা বন্ধুর মতো থাকি।’
‘না।’
‘কেন?’
‘আমি আপনাকে সহ্য করতে পারছি না।’
‘আমি পারছি।’
‘আপনি পাগল।’
ঠিক এই সময়ে সিঁড়ির নিচে একটি কঙ্কাল এসে দাঁড়াল, ‘স্বপ্নেন্দু আছ?’
স্বপ্নেন্দু বলল, ‘কে আপনি?’
‘আমি অবনীদা।’
‘ও, কী ব্যাপার?’
‘আমাকে একটু জায়গা দেবে স্বপ্নেন্দু, আজকের রাতটার জন্যে। আমার খুব ভয় করছে। ওরা নাকি আবার আসবে।’
‘কারা?’
‘যারা পাগল হয়ে এসব করছে।’
‘আসুন।’
অবনীদা উঠে এলেন। তারপর বললেন, ‘তোমরা বাইরে দাঁড়িয়ে থেকো না। নিচের দরজা খোলা। ওরা দেখলে এখানেও উঠে আসতে পারে।’
স্বপ্নেন্দু দ্রুত নেমে নিচের দরজা বন্ধ করে এল। তারপরে ঘরের চাবি খুলে দিতেই সবাই ভেতরে ঢুকল। স্বপ্নেন্দু বলল, ‘দুটো ঘরে ভাগ করে থাকো। আত্রেয়ী, আমি ভেবেছিলাম তুমি চলে যাবে। তোমাকে বারংবার বলেছি যে আমি হেনাকে ভালোবাসি।’
‘কিন্তু আমি তো তোমাকে ভালোবাসি।’
‘উঃ, আমি পাগল হয়ে যাব।’ স্বপ্নেন্দু চেঁচিয়ে উঠল।
আত্রেয়ী হেসে উঠল খিলখিল করে। তারপর এগিয়ে গেল হেনার কাছে, ‘এখন তো কোনও উপায় নেই, নইলে তোমার শরীরে গন্ধ নিতাম।’
‘মানে?’
‘কী করে ওকে মজালে ভাই?’
হেনা বিরক্ত হল, ‘ভদ্রভাবে কথা বলুন।’
আবার হাসল আত্রেয়ী। তারপর অবনীদার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনাকে আমি চিনি না। কিন্তু বলুন তো, আমি কি অন্যায় করেছি?’
অবনীদা মাথা নাড়লেন, ‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’
এই সময় বাইরের হল্লা আরও বেড়ে গেল। শুধু হাড়ে-হাড়ে শব্দ হচ্ছে। সমস্ত কলকাতা শহরে যেন হাড়ের বাজনা বাজছে।
স্বপ্নেন্দু বলল, ‘আমার বুকটা কেমন করছে হেনা, আমার বুকের ভেতরটা দুলছে।’
হেনা এবার এগিয়ে এল তার সামনে, ‘কিন্তু আমার সুখ? কী সুখ দেবে তুমি?’
‘সুখ?’
‘হ্যাঁ। মিথ্যে বলার চেষ্টা করো না।’
‘মিথ্যে, কী বলছ তুমি?’
‘নিশ্চয়ই। তুমি মিথ্যেবাদী। আমাকে ভালোবাসার বুলি শুনিয়ে ভাঁওতা দিয়েছ। ওই পাগলের সঙ্গে রাত কাটিয়ে গেছ আমার কাছে। কী নেবে তুমি আমার কাছ থেকে? কী লোভ তোমার?’
‘হেনা!’ চিৎকার করে উঠল স্বপ্নেন্দু।
‘চেঁচিও না। আমি আর কিছুতেই ভুলছি না।’ হেনা অবনীদার দিকে তাকাল, ‘এই যে, আপনি শুনুন, এই লোকটা বলেছিল ওর সঙ্গে এলে আমাকে নাকি সুখ দেবে। বলুন ওকে সেই সুখ দিতে!’
অবনীদা বললেন, ‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’
এই সময় আত্রেয়ী এগিয়ে এল, ‘সুখ চাইলেই কি পাওয়া যায়? ‘কাল রাত্রে আমি সুখ পেয়েছিলাম। সুখ পেতে জানতে হয়।’
হেনা চিৎকার করে উঠল, ‘তুমি ওকে সুখ দিয়েছ?’
‘আমি জানি না, বিশ্বাস করো, আমি তোমাকেই ভালোবাসি।’
‘মিথ্যে কথা। কী প্রমাণ আছে এর?’
‘আছে, প্রমাণ আছে।’
‘বিশ্বাস করি না। প্রমাণ দাও।’
‘আমি তোমার হৃদয় শান্ত করে দিতে পারি।’
‘কীভাবে?’
‘তোমার একটুও উত্তেজনা থাকবে না হৃদয়ে।’
এবার অবনীদা বললেন, ‘তুমি কি ম্যাজিক জানো স্বপ্নেন্দু?’
‘তার চেয়ে বেশি। আমার কাছে এমন একটা জিনিস আছে যা কলকাতার মানুষ চিন্তাও করতে পারবে না। বসুন আপনারা ওখানে।’
স্বপ্নেন্দুর স্বরে এমন কিছু ছিল যে বাধ্য হল ওরা খাটে বসতে। স্বপ্নেন্দু এগিয়ে গেল টেবিলের কাছে। তারপর সন্তর্পণে চাদরটা সরাল। আবছা লালচে আভা দেখা গেল। হেনা জিগ্যেস করল, ‘কী ওটা?’
আত্রেয়ী শিশুর গলায় বলল, ‘বাঃ সুন্দর।’
এবার কাচের বড় জারটা। সেটা সরাতেই কাচের বাটির তলায় লাল টকটকে ডাঁটো গোলাপটাকে দেখতে পেল সবাই। উদ্ধত ভঙ্গিতে যেন তাকিয়ে রয়েছে। সেই জলের ফোঁটাটাও তেমন টলটলে।
স্বপ্নেন্দু বলল, ‘এটা রক্তগোলাপ। কলকাতায় কোথাও আর ফুল নেই। শুধু আমার কাছে, আমার কাছে ও বেঁচে আছে। তোমরা ওর দিকে একটু তাকাও, দেখবে হৃৎপিণ্ড শান্ত হয়ে যাবে। আরাম পাবে।’
ওরা তিনজন মুগ্ধ চোখে ফুলের দিকে তাকাচ্ছিল। প্রত্যেকের উত্তেজনা ধীরে-ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল। হেনা অস্ফুটে বলল, ‘আঃ, কী আরাম। স্বপ্নেন্দু, আমি তোমার কাছ থেকে সত্যিকারের সুখ পেলাম। আর-একটুও কষ্ট হচ্ছে না আমার। তুমি কী ভালো!’
অবনীদা বললেন, ‘স্বপ্নেন্দু, আমি কৃতজ্ঞ। আমার হৃৎপিণ্ড জুড়িয়ে গেল।’
শুধু আত্রেয়ী কোনও কথা বলল না।
স্বপ্নেন্দু ডাকল, ‘আত্রেয়ী!’
আত্রেয়ী দুহাতে মুখ ঢাকল ‘আমি চাই না। সুখ চাই না। সারাজীবনে যে একটুও সুখ পেল না তার আর সুখের দরকার নেই। ঢেকে ফেলো ওটাকে।’
হেনা বলল, ‘না।’ তারপর বিছানা ছেড়ে উঠে এল, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি স্বপ্নেন্দু। তুমি আমার ওপর রাগ করো না।’
এই প্রথম শব্দটা শুনে স্বপ্নেন্দু আপ্লুত হল। তার হাত ধরল আত্রেয়ী, ‘তুমি ওই ফুলটা আমাকে দাও।’
‘কেন?’
‘ওটা আমার।’
‘না। এই ফুল তুমি চেয়ো না।’
‘কেন? আমাকে তুমি দিতে পারবে না?’
এবার আত্রেয়ী উঠে এল, ‘আমি কী দোষ করলাম? আমাকে দাও ফুলটা।’
সে হাত বাড়ালে হেনা বাধা দিল, ‘না। আমি নেবো। ও আমাকে দেবে। আমি স্বপ্নেন্দুকে ভালোবাসি।’
‘না, আমি তোমার চেয়ে অনেক বেশি ভালোবাসি ওকে।’ হেনাকে সরিয়ে দিতে চাইল আত্রেয়ী। তারপরেই ঘরে দৃশ্যটা অভিনীত হল। একদা-রমণী দুটো শরীর পরস্পরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল আক্রোশে। এতক্ষণ বাইরের রাস্তায় যে হাড়ের শব্দ হচ্ছিল সেটা এখন চলে এল ঘরের ভেতরে। স্বপ্নেন্দু পাথরের মতো দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখছিল। তার যেন কিছুই করার নেই। সমস্ত আত্মসম্মান, চক্ষুলজ্জা খুইয়ে দুটো মানুষ নিজেদের অহঙ্কার বাঁচাতে একটা ফুলের জন্যে লড়ছে।
এই সময় অবনীদা বাধা দিল। জোর করে ওদের ছাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘ছি-ছি, আপনারা পাগল হয়ে গেলেন নাকি!’
দুজনেই একসঙ্গে চিৎকার করল, ‘আমার ফুলটা চাই।’
অবনীদা বলল, ‘বেশ, স্বপ্নেন্দু যাকে দেবে সেই ফুলটা পাবে। যে পাবে না তাকে এটা মেনে নিতে হবে।’
কিন্তু স্বপ্নেন্দু মাথা নাড়ল, ‘না। ওই ফুলে আমি হাত দেব না।’
‘কেন?’ তিনটে গলা একসঙ্গে প্রশ্ন করল।
‘বিশ্বাস করো, ওই ঢাকনার তলা থেকে বের করে আনলে ফুলটা আর বাঁচবে না। একে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে ঢাকনা সরানো চলবে না।’
‘বিশ্বাস করি না।’ আত্রেয়ী বলল।
‘তুমি প্রমাণ করো কাকে তুমি ভালোবাস।’ হেনা দাবি জানাল।
স্বপ্নেন্দু অসহায় বোধ করল। তারপর মরিয়া হল। কাঁপা হাতে সে কাচের বাটিটাকে স্পর্শ করল। তারপর এক ঝটকায় সেটাকে সরিয়ে ফুলটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে বুকের অদৃশ্য গোলকের ওপর চেপে ধরল।
তিনটে বিস্মিত কঙ্কালের সামনে তখন একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখা দিল। ফুলটাকে হৃৎপিণ্ডে চেপে ধরতেই স্বপ্নেন্দুর সমস্ত শরীর থরথর করে উঠল। তারপর কঙ্কালের ওপর ধীরে-ধীরে মাংস-চামড়া-ধমনি দেখা দিল। শেষপর্যন্ত একটি পূর্ণ মানুষের চেহারায় ফিরে গিয়ে স্বপ্নেন্দু উচ্চারণ করল, ‘মাগো!’ এবং তারপর একটি সম্পূর্ণ মানুষের শরীর ক্রমশ নত হল, নত হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ল।
ওরা তিনজন ছুটে এল সেই শরীরের পাশে। বুকের ওপর ফুলটা শুকিয়ে ছাই হয়ে আছে। স্বপ্নেন্দুর মুখে তৃপ্তির ছাপ, শরীরে প্রাণ নেই। ওরা তিনজন পাগলের মতো কিছুক্ষণ স্বপ্নেন্দুকে ডাকাডাকি করল। তারপর অবনীদা ছুটে গেল জানলায়, শেষপর্যন্ত দরজায়। আত্রেয়ী এবং হেনার সামনে একটি রক্তমাংসের পূর্ণ নগ্ন মানুষ। ওরা দুজন পাগলের মতো সেই মানুষকে স্পর্শ করছিল। একটি মানুষ, তার চোখ নাক মুখ গলা বুক পেট দিয়ে যে সম্পূর্ণ, তাকে দু-হাতে আস্বাদ করতে চাইছিল একদা-রমণীরা।
অবনীদা ততক্ষণে ছুটে গিয়েছে রাস্তায়। পাগলের মতো চিৎকার করে বলছে, ‘শুনুন আপনারা। একটা মানুষ মরে গেছে। সত্যিকারের মৃত্যু। সম্পূর্ণ রক্তমাংসের মানুষ। আমাদের মধ্যে একজনই মরে যেতে পারল। সেই ভাগ্যবান পুরুষটিকে দাহ করতে হবে। শুনুন আপনারা।’
কলকাতার নরকঙ্কালরা অবাক হয়ে শুনছিল, একটা রক্তমাংসের মানুষ মরে যেতে পেরেছে। ঘোর কাটতেই সমস্ত কঙ্কাল ছুটে আসছিল সেই গলিতে। ঈর্ষান্বিত, বিহ্বল সেই নরকঙ্কালের মিছিলের দিকে তাকিয়ে উন্মাদ অবনীদা তখনও চেঁচিয়ে যাচ্ছে, ‘রক্তমাংসের পুরুষ। মরে গেছে, একদম মরে গেছে। সেই ভাগ্যবানের নাম স্বপ্নেন্দু।’
***