গলির মুখে একগাদা কঙ্কাল ভিড় করেছে। স্বপ্নেন্দু দরজার কড়া নাড়ল। প্রথমে কোনও সাড়াশব্দ নেই। তারপর একটা স্বর শোনা গেল, ‘কে?’
‘আমি স্বপ্নেন্দু। দরজা খোলো।’
তবু সময় লাগল। যে খুলল তার দিকে তাকিয়ে স্বপ্নেন্দুর ঠাহর করতে পারল না পরিচয়। সে জিগ্যেস করল, ‘মন্টুদা আছে?’
বসার ঘরে ঢুকে ইজিচেয়ারটার দিকে তাকাতে স্বপ্নেন্দু চমকে উঠল। মন্টুদার শরীর ছিল ছফুট লম্বা। গায়ের রং টকটকে লাল। শরীরে একফোঁটা মেদ নেই। আর পঞ্চাশ বছর বয়সেও মাথা ভর্তি চুল দেখে ঈর্ষা হতো ওদের। অনেক বিখ্যাত পরিচালক মন্টুদাকে ফিল্মে নামাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেকথা শুনলেই হো-হো করে হাসত মন্টুদা, ‘বায়োস্কোপ? ও স্কোপ আর নাই বা নিলাম। এই বেশ আছি। খাচ্ছি-দাচ্ছি বগল বাজাচ্ছি। কী বলিস?’
সেই মন্টুদা ইজিচেয়ারে লম্বা হয়ে পড়ে আছে। পরনে পাঞ্জাবি আর সিল্কের লুঙ্গি। করোটির সাইজটা লম্বাটে। কী বীভৎস সাদা দেখাচ্ছে ওটা। শুধু কঙ্কালের সাইজ দেখে স্বপ্নেন্দু অনুমান করল এ মন্টুদা। এই সময় মন্টুদা কথা বলল, ‘ভেবলে গিয়েছিলি মনে হচ্ছে। বসে পড়।’
‘মন্টুদা—।’ স্বপ্নেন্দু সন্তর্পণে চেয়ারটায় বসল।
‘তুই যদি নাম না বলতিস তাহলে চিনতাম না।’
‘কেন?’
‘আমি এখন কাউকে চিনতেই পারছি না। তুই ভাবতে পারিস আমার বউ আর বড়মেয়েকে গুলিয়ে ফেলেছি দুবার। একেবারে এক সাইজের প্রাোডাকশন। বহুত ঝামেলা হয়ে যাচ্ছে!’ মন্টুদা সোজা হয়ে বসল।
‘তোমার কোনও রিঅ্যাকশন হয়নি?’
‘রিঅ্যাকশন! নিশ্চয়ই! এর চেয়ে আরাম আর কিছুতে কল্পনা করা যায়। চাকরি করতে হবে না এ জীবনে। বেশ পায়ের ওপর পা তুলে বই পড়ব। পৃথিবীর কত বই। তুই সিরিয়াসলি পড়লেও এক হাজারের এক ভাগও একটা জীবনে পড়ে শেষ করতে পারবি না। কিন্তু এখন? মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন আমরা অমর। ডাল-ভাতের ঝামেলা নেই। পৃথিবীর সব বই শেষ করব এখন।’
আরামদায়ক একটা শব্দ উচ্চারণ করল মন্টুদা।
‘কিন্তু বহির্বিশ্বের সঙ্গে আমাদের কোনও যোগাযোগ নেই।’
‘বয়ে গেল। এই কলকাতায় বই-এর অভাব?’
‘হঠাৎ বই নিয়ে পড়লে?’
‘কিছু একটা নিয়ে থাকতে হবে যে রে। নিজেকে খুব অশিক্ষিত মনে হয়। এবার শোধ তুলব। তোর বউদির ঘ্যানর-ঘ্যানর করার দিন খতম।’
‘কেন?’
‘সংসারের কোনও কাজ করো না। বাজার করো না, রেশন করো না। এইসব টিকটিকানি আর শুনতে হবে না। তারও জ্বালা জুড়োল আমিও বেঁচে গেলাম।’ মন্টুদা মুখে হাতে দিল, ‘শুধু সিগারেটের অভাব ফিল করছি।’
‘সেকি? এত জিনিস থাকতে সিগারেটের?’
‘অভ্যেস, ভাই অভ্যেস। সেই পনেরো বছর বয়সে শুরু করেছিলাম।’
‘যাক, তোর খবর কী বল। অনেকদিন বাদে এলি।’
‘মাইরি মন্টুদা, তোমার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে কিছুই হয়নি। যেন আগের অবস্থায় আছ। তোমার কোনও প্রতিক্রিয়া হয়নি।’
‘উপনিষদ পড়েছিস?’
‘না।’
‘ওই তো, জ্ঞান হবে কোত্থেকে? মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণ শুনেছিস?’
‘হ্যাঁ।’
‘তাও শিক্ষা হল না। তিনি বলেছেন, সব কিছু স্বাভাবিক মনে মেনে নিতে। তাহলে আর কোনও কষ্ট থাকবে না। আরে একটা বিপ্লব করতে কত পরিশ্রম, কত সংগ্রাম কত রক্তক্ষয়। অথচ দ্যাখ, আমাদের কিছুই লাগল না অথচ বিপ্লব হয়ে গেল। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন।’
‘মুখ্যমন্ত্রীর এত বাধ্য হলে কবে থেকে?’
‘কারণ, বিরোধী নেতাদের বাণী এখনও কানে আসেনি। সমস্ত খবরের কাগজ এখনও বন্ধ। আরে জীবনটাকে এবার চুটিয়ে উপভোগ কর। পড়বি, গান শুনবি, গান গাইবি। আমরা তো এখন দেবতাদের মতন। রোগ-যন্ত্রণার বালাই নেই।’
মন্টুদার কথা শেষ হওয়া মাত্র একটি বালক দরজায় এসে দাঁড়াল। তার পরনের হাফপ্যান্ট দড়ি দিয়ে কোনওরকমে কোমরে বাঁধা। মন্টুদা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী সমাচার বৎস?’
‘বাবা আমি খেলতে যাব?’
‘আমার অনুমতির কিবা প্রয়োজন?’
‘মা নিষেধ করছে। বলছে মাঠের ঘাস ছাই হয়ে গেছে, ওখানে যেতে হবে না।’
‘চমৎকার। মাকে ডেকে দাও।’
ছেলেটি চলে গেল। মন্টুদা বললেন, ‘খোকা কী লাকি বল তো। সারা জীবন খেলে কাটাবে। ওর শৈশব কোনওদিন কাটবে না। আমরা বলতাম, মানুষের শৈশব হল তার জীবনের গোল্ডেন ডেজ। ও চিরকাল সেই গোল্ডেন ডেজে থাকবে। এর চেয়ে সুখবর আর কী আছে।’
এই সময় কেউ দরজার বাইরে দাঁড়াল। তার শাড়ির একাংশ দেখা যাচ্ছিল। মন্টুদা ডাকলেন, ‘হায়, তুমি ওখানে কেন প্রিয়ে! ভেতরে এসো। এখানে স্বপ্নেন্দু বসে আছে। তোমার দেবর। ওকে দেখে এত লজ্জা কেন?’
বউদি যেন আরও সঙ্কুচিত হলেন। তাঁর নিচু গলা শোনা গেল, ‘কী বলছ?’
‘কী আশ্চর্য! তোমার এ ঘরে ঢুকতে এত লজ্জা কেন?’
‘না, আমি যেতে পারব না।’
মাথা নাড়ল মন্টুদা। তারপর বলল, ‘খোকাকে মাঠে পাঠাও। ও খেলুক।’
‘ওখানে শুধু ছাই।’
‘ছাই মাখুক। মহাদেব ছাই মাখতেন।’
‘যা ইচ্ছে করো।’
‘তোমার মনটা আগের মতো আছে। আরে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলো। তোমার কত কাজকর্ম কমে গেছে, তা দেখছ না!’
বউদি অন্যরকম গলায় বললেন, ‘আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে!’
‘চেষ্টা করলেও পারবে না। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন আমরা অমর।’ কথাটা বলে হো-হো করে হেসে উঠল মন্টুদা। স্বপ্নেন্দু বুঝল বউদি অসন্তুষ্ট হয়ে চলে গেছেন দরজার আড়াল থেকে।
হঠাৎ মন্টুদা বলল, ‘দাবা খেলবি?’
‘দাবা?’
‘চমৎকার সময় কাটানোর খেলা। তুই তো জানিস।’
‘এখন ভালো লাগছে না।’
‘ও।’ মন্টুদা আবার ইজিচেয়ারে শুয়ে পড়ল, ‘তুই এখনও শক কাটিয়ে উঠতে পারিসনি। চেষ্টা কর, চেষ্টা কর। জলের মতো হয়ে যা, যখন যেমন পাত্র তখন তেমন আকার।’
স্বপ্নেন্দু উঠল, ‘আজ চলি মন্টুদা।’
‘চলে আসিস। মন খারাপ হলেই চলে আসিস, আমি ভালো করে দেবো।’
স্বপ্নেন্দু হেসে ফেলল, ‘তুমি সত্যি নমস্য ব্যক্তি।’
সন্ধে হয়ে এসেছিল। রাস্তায় নেমে চমকে উঠল স্বপ্নেন্দু। মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে একটা নগ্ন কঙ্কাল চেঁচাচ্ছে, ‘বেরিয়ে আয় শালা, এক বাপের বাচ্চা হলে সামনে আয়।’ তার ডান হাতে একটা গোলমতন বস্তু দেখা যাচ্ছে। সেটাকে ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে আস্ফালন করছে লোকটা। স্বপ্নেন্দু এগিয়ে যাচ্ছিল, পাশ থেকে একজন বলে উঠল, ‘যাবেন না দাদা, ওর হাতে পেটো আছে।’
‘পেটো?’
‘পুরোনো ঝগড়া। আজ বদলা নিতে এসেছে।’
স্বপ্নেন্দু হতভম্ব হয়ে গেল। যাদের মন্টুদার বাড়িতে যাওয়ার সময় এখানে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল তারা আশেপাশে আড়াল খুঁজে সেঁধিয়েছে। পুরোনো অভ্যেসে এরা প্রাণভয়ে ভীত। কিন্তু যে লোকটা পেটো ছুড়তে এসেছে? স্বপ্নেন্দু লোকটার দিকে তাকাল। সমানে তড়পে যাচ্ছে লোকটা অকথ্য ভাষায়। এই যে এত বড় একটা পরিবর্তন হয়ে গেল কলকাতায়, মানুষ বিপর্যস্ত, তার কোনও প্রতিক্রিয়া কি ওর মধ্যে হয়নি? এখন পুরোনো আক্রোশ টিকে থাকতে পারে? স্বপ্নেন্দুর মাথায় ঢুকছিল না। এ বোধহয় শুধু কলকাতাতেই সম্ভব হতে পারে।
স্বপ্নেন্দু এগিয়ে গেল। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, এখন কলকাতাবাসী অমর। তিনি মিথ্যে কথা বলবেন না। তাই ওই লোকটা যতই শাসাক, তার কিছু করতে পারবে না।
গলির ভেতর থেকে কেউ বেরিয়ে আসছে দেখে লোকটা চিৎকার থামিয়ে মুখ ঘোরাল। ওর হাত ক্রমশ ওপরে উঠে যাচ্ছে। স্বপ্নেন্দু চেঁচাল, ‘আমি স্বপ্নেন্দু, তুমি যাকে খুঁজছ সে নই। হাত নামাও।’
‘বুঝব কী করে? সব শালাকে যে একরকম দেখতে হয়ে গেছে।’
ততক্ষণে লোকটার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে সে। না, লোক নয়। হাড়ের গঠন এবং শারীরিক চাঞ্চল্য প্রমাণ করছে এ তরুণ। স্বপ্নেন্দু বলল, ‘তুমি খামোখা মাথা গরম করছ। তার গলার স্বর কি আমার মতন?’
একটু যেন চিন্তা করল ছেলেটা, তারপর বলল, ‘এক মনে হচ্ছে না।’
‘তাহলে হাত নামাও। তুমি একটা বুদ্ধু, এখন পেটো ছুড়ে কাউকে মারলেও তার কিছু হবে না। রক্তমাংস নেই তো পেটো কী করবে?’
ছেলেটা বলল, ‘জানি।’
‘জানো মানে?’
গলার স্বর নামিয়ে আনল ছেলেটি, ‘ফালতু ভয় দেখাচ্ছি। দেখুন না, শালারা কেমন ছাগলের মতো লুকিয়েছে। দেখে যে কী আরাম লাগছে, কী বলব!’
স্বপ্নেন্দু অবাক হয়ে গেল। তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছেলেটি আবার বলল, ‘নতুন কল বের করতে হবে বুঝলেন? আগে থেকে রোয়াবি না দেখালে ঝট করে অন্য কেউ পাড়ার মাস্তানিটা কব্জা করে নেবে। কেটে পড়ুন।’
স্বপ্নেন্দু আর দাঁড়াল না। ট্রাম-রাস্তায় এসে সে হতভম্ব হয়ে গেল। না, কোনও গাড়ি-ঘোড়ার চিহ্ন নেই। সন্ধে হয়ে গেছে। রাস্তার আলোগুলো এদিকে জ্বলছে না। কেমন যেন গা-ছমছমে ভাব। তাকে যেতে হবে অনেক দূর। আগে হলে কেয়ার করত না। কিন্তু এখন এতটা পথ হেঁটে যাওয়া অসম্ভব। এমনিতে তার পায়ের হাড় কনকন করছে। সন্ধে হচ্ছে বলে লোকজন রাস্তা থেকে কমে যাচ্ছে। স্বপ্নেন্দু ভেবে পাচ্ছিল না সে কী করবে। একটু-একটু করে হেঁটে সে ওয়েলিংটনের মোড়ে চলে এল। জায়গাটা শ্মশানের মতো ফাঁকা। কলকাতা শহরে দাঁড়িয়ে এমন অসহায় সে আর কখনও হয়নি। এইসময় একটা শিস শুনতে পেল সে। কেউ যেন মনের আনন্দে শিস দিয়ে যাচ্ছে। মেরে জুতা হ্যায় জাপানি। চারপাশে চোখ বোলাতে সে ফুটপাথের ধার ঘেঁষে ভিখিরিটাকে দেখতে পেল। দুটো ছেঁড়া চট গায়ে চাপিয়ে রাজার মতো হেলান দিয়ে বসে-বসে শিস দিচ্ছে। তার ঊর্ধ্বাঙ্গে কোনও বস্ত্র নেই। হঠাৎ তাকালে আনন্দমঠের মন্বন্তর গ্রামের ছবিটি মনে পড়ে যায়। চোখোচোখি হতে লোকটা খুকখুক করে হাসল, ‘এই যে বাবু, দুটো পয়সা হবে।’
স্বপ্নেন্দু অবাক হল। ভিখিরিটা এখনও পয়সা চাইছে! কিন্তু হাসল কেন? সে কোনও কথা বলার আগেই ভিখিরিটা চেঁচিয়ে উঠল, ‘লাথি মারি টাকার মুখে। আর আমাকে কারও কাছে পয়সা চাইতে হবে না। কী আনন্দ! আর শালা মানুষের গালাগালি শুনব না। মেরা জুতা হ্যায় জাপানি। এই যে দাদা, দুটো পয়সা হবে।’ নিজের গলাটাকেই বিকৃত করে শোনাল লোকটা।
ঠিক তখন একটা প্রাইভেট গাড়িকে আসতে দেখল স্বপ্নেন্দু। ফিয়াট। গাড়িটা যাচ্ছে তার গন্তব্যস্থলের দিকে। স্বপ্নেন্দু হাত তুলল। সেটা পর্যাপ্ত নয় ভেবে রাস্তার মাঝখানে নেমে গিয়ে ইশারা করতে লাগল থামবার জন্যে। ড্রাইভার যেন খানিকটা ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে থামাল গাড়িটা। স্বপ্নেন্দু ছুটে গেল জানলায়,
‘কোথায় যাচ্ছেন আপনি?’
‘শ্যামবাজার।’
‘আমিও যাব। কোনও কিছু পাচ্ছি না। যদি—।’
‘উঠে বসুন।’
গাড়িতে উঠে স্বপ্নেন্দু বলল, ‘ধন্যবাদ।’
‘কোনও দরকার নেই। আগে আমি কাউকে লিফট দিতাম না। এখন তো কোনও ভয় নেই। এই যে হৃৎপিণ্ড দেখছেন ওটা এমন একটা প্রটেকশনে আছে যা দশটা আণবিক বোমা মারলেও ভাঙবে না। ডু য়ু নো, এটা কী?’
‘না।’
‘আমাদের পাপ। সারাজীবন আমি যে পাপ করেছি এটা তাই দিয়ে তৈরি।’
হেসে ফেলল স্বপ্নেন্দু, ‘তাহলে একটি এক বছরের শিশুর বেলায় কী বলবেন?’
‘সে তার বাপ-মায়ের কাছ থেকে রক্তের সূত্রে ওটা পেয়েছে।’ স্বপ্নেন্দু দেখল গাড়ির কাচে রেডক্রশ চিহ্ন রয়েছে। সে জিগ্যেস করল, ‘আপনি ডাক্তার?’
‘আই ওয়াজ। আমার একটা মরণাপন্ন পেশেন্ট ছিল নার্সিংহোমে। আজ গিয়ে দেখি সে নাকি হেঁটে বাড়ি চলে গেছে। নার্সিংহোমের সবাই বেকার। সুতরাং আমিও। আমি এখন কী করব? মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন আমাদের মৃত্যু নেই। শরীর নেই যখন, তখন অসুখ-বিসুখ করবে না কারও। আমি বেকার হয়ে গেলাম। মুখ্যমন্ত্রী বললেন, যারা খাদ্য ব্যবসায় আছে তাদের তিনি দেখবেন। বাট হোয়াট অ্যাবাউট আস? তা ছাড়া, কেমন যেন অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। সারাদিন রোগী দেখে বেড়াচ্ছি, চেম্বারে পেশেন্ট গিজ-গিজ করছে, সবসময় টেনশন। সারা জীবনে তো কম আর্ন করিনি। সেগুলো নিয়ে আমি কী করব এখন?’ ডাক্তার স্বপ্নেন্দুর দিকে তাকালেন, ‘আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু লিভ। জানেন, আমার কাছে কিছু সায়েনায়েড ছিল। এক ফোঁটা জিভে লাগলে চোখ বন্ধ হয়ে যাবে। মুঠোয় করে মুখে ঢাললাম, হৃদপিণ্ডে মাখালাম। নো রেসপন্স। হাতুড়ি দিয়ে ভাঙবার চেষ্টা করলাম বুকের বাক্সটা। একটুও টসকাল না।’
ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললেন ডাক্তার।
স্বপ্নেন্দু নিচু গলায় বলল, ‘মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন এই পরিবর্তিত অবস্থাকে সহজ মনে মেনে নিতে। অ্যাকচুয়ালি, আপনি আপনার সঞ্চিত টাকা এখন মানুষের উপকারে খরচ করতে পারেন। খাওয়া-পরা অথবা অসুখ-বিসুখ ছাড়াও তো মানুষের অনেক প্রয়োজন আছে। সেগুলো এতকাল আমরা পারতাম না—।’
বাধা দিলেন ডাক্তার, ‘আপনি কম্যুনিস্ট?’
‘না। মোটেই না।’
‘তাহলে রাবিশ কথাবার্তা বলবেন না। আমি সারাজীবন এত কষ্ট করে যা উপার্জন করেছি তা পাঁচজনের জন্যে বিলিয়ে দেব? তার চেয়ে নিজের হাতে পুড়িয়ে ফেললে বেশি আরাম লাগবে।’
স্বপ্নেন্দু কথা বলল না। গাড়ি ততক্ষণে কলেজ স্ট্রিট ছাড়িয়ে গেছে। পথঘাট নির্জন। এবার ডাক্তারের গলায় হাহাকার শোনা গেল, ‘আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ আনন্দটাকে চিরকালের জন্য হারালাম।’
‘কী সেটা?’
ডাক্তারের করোটিটা দুলল, ‘ইঞ্জেকশন। যখন আমি কারও শরীরের কাছে সিরিঞ্জ নিয়ে যেতাম অদ্ভুত শিহরণ হতো। তারপর যখন সুঁচটা তার গায়ে ঢুকিয়ে দিতাম তখন অদ্ভুত প্লেজার হতো। দিনে অন্তত গোটা পাঁচেক ইঞ্জেকশন না দিলে আমার রাত্রে ঘুম আসত না।’
‘সেকি?’
‘আমি অ্যাদ্দিন কাউকে বলিনি। এখন অবশ্য বলতে বাধা নেই। কাউকে বলিনি ঠিক নয়। আমার এক মনস্তাত্বিক বন্ধুকে বলেছিলাম। সে জিগ্যেস করেছিল, আমি কি ইমপোটেন্ট? স্বীকার করিনি তখন। এখন কলকাতার মানুষ আর সেসবের কথা ভাববে না। তাই বলছি, হি ওয়াজ রাইট।’
স্বপ্নেন্দু নড়েচড়ে বসল। লোকটা পাগল নাকি? দু মিনিটের আলাপে যে সব কথা বলছে তা কোনও সুস্থ মানুষ বললে না? হয় পাগল, নয়—স্বপ্নেন্দু মাথা নাড়ল, এসব পরিবর্তিত পরিস্থিতির ফল। এখন মানুষের কিছুই হারাবার ভয়ডর নেই। অতএব নিজের গোপন তথ্য খুলে বললেও ক্ষতি নেই।
‘শ্যামবাজারে কোথায়?’
স্বপ্নেন্দু রাস্তাটার নাম বলল। ডাক্তার বললেন, ‘অয়েল ইন্ডিকেটারের দিকে তাকিয়ে দেখুন। ওটা শূন্যে আটকে আছে। অথচ গাড়িটা সুন্দর চলছে। জল নেই এক ফোঁটা তবু ইঞ্জিন বন্ধ হচ্ছে না। আগে শুনলে পাগল বলতাম। তাই না?’
‘সেকি, পেট্রোল নেই তবু গাড়ি চলছে?
‘দেখছেন তো।’
‘হয়তো আপনার ইন্ডিকেটারটা ঠিক কাজ করছে না।’
‘নো। ওটা ঠিক আছে।’
‘তাহলে?’
‘এটাও বোধহয় পরিবর্তিত পরিস্থিতির রেজাল্ট। আরে মশাই, গাড়িতে যে এক ফোঁটা জল নেই সেটা বিশ্বাস করেন তো। ওই দেখুন হেদোর কী অবস্থা!’
স্বপ্নেন্দু হতভম্ব হয়ে গেল। এখন থেকে গাড়ির জন্য আর পেট্রোলের দরকার হবে না? কী আশ্চর্য! স্বপ্নেন্দুর মোড়ে এসে গাড়িটা থামালেন ডাক্তার। ধন্যবাদ জানিয়ে নেমে যাচ্ছিল সে। ডাক্তার ডাকলেন, ‘শুনুন মশাই, আপনার নাম জানি না। কোনওদিন দেখা হবে কি না তারও ঠিক নেই। তবে আমাকে পাগল ভাবার কোনও কারণ নেই। যে-যে কারণে আগে পাগল ভাবা হতো, এখন সেইসব কারণগুলো বাতিল হয়ে গিয়েছে। বরং আপনার যদি কোনও পাপটাপ থাকে তাহলে বলাবলি করতে শুরু করুন, দেখবেন বেশ হালকা লাগবে।’
গাড়িটা চোখের সামনে থেকে চলে গেলেও স্বপ্নেন্দু দাঁড়িয়েছিল। অদ্ভুত লোক তো! তার পরেই খেয়াল হল, তার নিজের কোনও পাপ আছে কি না। স্বপ্নেন্দু অনেক চিন্তা না করেও তেমন কোনও পাপের কথা মনে করতে পারল না। ছেলেবেলায় একবার একটা বেড়ালকে ঢিল ছুড়ে খোঁড়া করে দিয়েছিল। খুব চুরি করত বেড়ালটা। সে এখন পাপ আদৌ কি না বলা মুশকিল, কিন্তু ওকথা কাউকে বলা যাবে না।
ঘরে ঢুকে বিছানায় চিৎপাত হতে গিয়েই স্বপ্নেন্দুর মনে পড়ল। টেবিলের দিকে তাকাতেই কাচের আড়ালে সেই লাল গোলাপটাকে দেখতে পেল সে। গোলাপটাকে আরও টাটকা আরও বেশি লাল দেখাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে স্বপ্নেন্দুর মন শান্ত হয়ে গেল।
পরের দিন রেডিও খুলে স্বপ্নেন্দু বুঝল কলকাতার অবস্থা বেশ স্বাভাবিক। চমৎকার গানবাজনা হচ্ছে। খবরেও বলা হল, প্রচুর ট্রাম-বাস চলছে সকাল থেকে। গত দুদিনে কলকাতায় খুনজখম দূরের কথা সামান্য ছিনতাই-এর ঘটনা পর্যন্ত ঘটেনি। তবে ধুতি এবং লুঙ্গির চাহিদা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। নাগরিকদের কাছে আবেদন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী, অবিলম্বে যে যার কাজে যোগ দিন। আজ স্বপ্নেন্দু চাদরটাকে বাতিল করল। কারণ ওতে মনের জড়তা ধরা পড়ে। যা হয়েছে তা ওর একার ক্ষেত্রে নয় যখন, তখন প্রকাশ্যে মেনে নেওয়াই ভালো। ঘর থেকে বের হওয়ার আগে সে আবার ফুলটার দিকে তাকাল। চমৎকার তাজা। কলকাতা শহরে একমাত্র তার কাছেই ফুল আছে, খাঁটি ফুল। ওটাকে ছোঁওয়া যাবে না, টেবিল থেকে নড়ানো যাবে না। অথচ এই ঘরে ফুলটা একা পড়ে থাকবে সেটাও ভালো লাগছিল না। স্বপ্নেন্দু একটা চাদর দিয়ে বড় জারটাকে ঢেকে দিল।
আজ ট্রামে-বাসে খুব ভিড়। কিন্তু ভিড় ট্রামে উঠে স্বপ্নেন্দু বুঝতে পারল যতটা মনে হয়েছিল ততটা নয়। এক ভদ্রলোক যার অনেকগুলো দাঁত না থাকায় মুখটা বীভৎস দেখাচ্ছে, বললেন, ‘স্পেস প্রবলেম মিটে গেছে মশাই। আগে ট্রামে-বাসে যত লোক ধরত এখন তার ডবল ধরবে।’
কথাটা শুনে সবাই হো-হো করে হেসে উঠল। একজন বলল, ‘মুখ্যমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন। বিপ্লব এলেও ট্রান্সপোর্ট প্রবলেম সলভ করতে পারত না।’
প্রথমজন স্বপ্নেন্দুর দিকে ফিরে জিগ্যেস করলেন, ‘আপনাদের বাথরুমটাকে কী করবেন ভাবছেন?’
‘বাথরুম?’ স্বপ্নেন্দু হতভম্ব।
‘দূর মশাই। এখন তো আর বাথরুমের প্রয়োজন নেই। খামোকা কিছু ঘর খালি পড়ে থাকবে বাড়িতে-বাড়িতে। আমি ভাবছি ওটা ভাড়া দিয়ে দেব। আমাদের বাথরুমটা বেশ বড়।’
দ্বিতীয়জন বলল, ‘ভাড়ার টাকা নিয়ে কী করবেন দাদু?’
‘কেন? শখের জিনিস কিনব। এই ধরো কালার টিভি।’
‘টিভি? টিভি স্টেশন তো চালু হয়নি।’
‘হয়নি, কিন্তু হবে।’
‘ওঃ, টিভির মেয়েগুলোকে কীরকম দেখাবে ভাবুন তো! আমার বড় মেয়েটা দেখতে ভালো নয় বলে অ্যানাউন্সারের চাকরি পায়নি। এখন আবার অ্যাপ্লাই করতে বলি, কী বলেন?’
স্বপ্নেন্দু বুঝল, কলকাতার মানুষ বেশ সহজেই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। হয়তো মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধে কাজ হয়েছে। তার বেশ ভালো লাগছিল। লিফটের সামনে বিরাট লাইন। কিন্তু আজ অনেক বেশি লোক আসছে বলে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে লাইনটা। স্বপ্নেন্দু দেখল লাইনে তিনটে শাড়ি আছে। তার মানে মেয়েরাও অফিসে এসেছে। তার হৃৎপিণ্ড কাঁপতে লাগল। হেনা সেন আছেন নাকি লাইনে? কী করে হেনাকে চিনবে সে? আজ সকালে রেডিওতে বলেছিল, প্রত্যেক নাগরিক আইডেন্টিটি কার্ড সঙ্গে নিয়ে অফিসে যাবেন। কিন্তু সে কার্ড তো ব্যাগের ভেতরে থাকবে।
স্বপ্নেন্দু ছটফট করছিল। লিফটে উঠে সে শাড়ির দিকে তাকাল। সেদিন হেনা সেন যে শাড়ি পরেছিলেন সেটার সঙ্গে এই তিনটির রং মিলছে না। হেনা যদি তাকে দ্যাখেন তাহলে নিশ্চয়ই হাসবে। সঙ্গে-সঙ্গে খেয়াল হল, তার চেহারাও তো হেনার চেনার কথা নয়।
নিজের ফ্লোরে এসে স্বপ্নেন্দু অবাক হল। দেওয়ালে পোস্টার পড়েছে, কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতা চলবে না, চলবে না। ঘুষখোর অফিসারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। নিজের ঘরে যাওয়ার সময় সে দেখল অফিসে বিরাট জটলা হচ্ছে। বেশ উত্তেজনা। ঘরে ঢুকে সে দেখল তার চেয়ারে কেউ বসে আছে। তাকে দেখে লোকটা উঠে দাঁড়াতে স্বপ্নেন্দু চিনতে পারল। লোকটা নির্জীব গলায় জিগ্যেস করল, ‘আপনি কি সাহেব?’
‘এক গ্লাস জল দাও হরিমাধব।’ বলতে-বলতে খেয়াল হল আর জলের দরকার নেই, জল পাওয়াও যাবে না। হরিমাধব ততক্ষণে তিন হাত দূরে ছিটকে গেছে, ‘মাপ করুন স্যার। আমি ভাবিনি আপনি আসবেন।’
‘ভাবনি?’
‘না স্যার। বিশ্বাস করুন এর আগে আমি কখনও ওই চেয়ারে বসিনি। আজ বড় ইচ্ছে হল। শরীরটা যখন পালটে গেল, নিজেকে ভূতের মতো দেখাচ্ছে যখন, তখন ভাবলাম চেয়ারটায় বসে দেখি কেমন লাগে।’
‘ঠিক আছে।’ স্বপ্নেন্দু চেয়ারটায় বসল। অনেক কষ্টে প্যান্টটাকে কোমরে শক্ত করে বেঁধেছে। কিন্তু কেবলই মনে হয় এই বুঝি পড়ে গেল।
হরিমাধব এগিয়ে এল, ‘স্যার, অফিসের সবাই খুব খেপে গেছে।’
‘কেন?’
‘ওই ট্রান্সফার হবে শুনে। আজ কেউ কাজ করবে না বলেছে।’
‘এখনও ওইসব ওদের মাথায় আছে নাকি?’
‘হ্যাঁ স্যার। আপনি সাবধানে থাকবেন।’ হরিমাধব দরজার দিকে তাকাল, ‘আর হ্যাঁ, ম্যাডাম আপনাকে ফোন করেছিলেন দুবার।’
সঙ্গে-সঙ্গে মিসেস বক্সীর শরীরটা চোখের সামনে ভেসে উঠল।
মরলেও বোধহয় স্বভাব পালটাবে না। তার পরেই ওর হাসি পেল। আর এখন তো হাসি পেতেই তা খুকখুক করে বেরিয়ে পড়ে। কঙ্কালশরীর বোধহয় নিশব্দে হাসতে পারে না। স্বপ্নেন্দু টেলিফোনটার দিকে তাকাল। অপারেটর এসেছে তাহলে।
সে আবার হরিমাধবকে জিগ্যেস করল, ‘তোমার কেমন লাগছে হরিমাধব?’
‘ভালো না স্যার। এই ভূতের চেহারা নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালেই শিউরে উঠি। আমার পরিবারকে আবার ঠিক শাঁকচুন্নির মতো দেখায়। নরক, নরকে এসে গেছি। স্যার, শাস্ত্রে লেখা ছিল কলিযুগের পর নাকি এইরকম সাক্ষাৎ নরকবাস ঘটবে।’ ফুঁপিয়ে উঠল হরিমাধব। স্বপ্নেন্দু তাকাল হরিমাধবের বুকের দিকে। অদৃশ্য গোলকের গর্তে থাকা হৃৎপিণ্ডটা থরথরিয়ে কাঁপছে। তার মানে লোকটার কান্না জেনুইন। মাথাটা পরিষ্কার হয়ে গেল স্বপ্নেন্দুর। এখন কেউ ভান করলে তার বুকের দিকে তাকালেই ধরা পড়ে যাবে। বাঃ ফার্স্ট ক্লাস। এই সময় টেলিফোনটা বেজে উঠল। হ্যালো, বলতেই মিসেস বক্সীর গলা ভেসে এল, ‘কখন এসেছেন? কেউ বলেনি আমি ডেকেছি?’
‘বলেছে।’ স্বপ্নেন্দু নিস্পৃহ স্বরে বলল।
‘বলেছে? তবু আপনি আমার সঙ্গে দেখা করছেন না?’
‘যাচ্ছি। আমি একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলাম।’ রিসিভার নামিয়ে রেখে স্বপ্নেন্দু হরিমাধবকে জিগ্যস করল, ‘আজ অফিসে সবাই এসেছে?’
হরিমাধবের করোটিটা নড়ল, ‘না স্যার, অনেকেই আসেনি। পেটের ধান্ধা যখন আর করতে হবে না তখন মিছিমিছি কেন আসতে যাবে?’
স্বপ্নেন্দুর মনটা খারাপ হয়ে গেল। সবাই আসেনি? তার মানে হেনা সেনও না আসতে পারেন। প্রশ্নটা করতে গিয়েও পারল না, কেমন সঙ্কোচ বোধ হল। হরিমাধব আবার এই নিয়ে গপ্পো করবে। যা করতে হবে তাতে অফিশিয়াল ব্যাপার যোগ না করলে হরিমাধবরা অন্যভাবে দ্যাখে।
ঘর থেকে বেরিয়ে আসামাত্র করিডোরে চিৎকার শুনতে পেল সে। দশ-বারোজন কঙ্কাল বিভিন্ন পোশাকে দাঁড়িয়ে হাত তুলে স্লোগান দিচ্ছে। সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে ওরা। স্বপ্নেন্দুকে দেখেও দেখল না যেন। বোধহয় চিনতে পারেনি। স্বপ্নেন্দু সুড়ুৎ করে মিসেস বক্সীর দরজার কাছে চলে এল। সেখানে একটা কঙ্কাল উর্দি পরে দাঁড়িয়ে আছে।
‘কাকে চাই?’ লোকটা জিগ্যেস করল।
এই প্রথম মিসেস বক্সীর ঘরে ঢুকতে বাধা পেল স্বপ্নেন্দু। বিরক্ত স্বরে সে জিগ্যেস করল, ‘তুমি কে?’
‘আমি ওঁর বেয়ারা। ম্যাডাম কাউকে ঘরে ঢুকতে দেবেন না।’
‘কী আশ্চর্য! তুমি আমাকে চিনতে পারছ না? আমি স্বপ্নেন্দু!’
সঙ্গে-সঙ্গে লোকটা কপালে হাত ঠেকাল ‘ক্ষমা করবেন স্যার। আমার একবার সেরকম মনে হয়েছিল কিন্তু সব মুখগুলো দেখতে যে একরকম। যান স্যার, ম্যাডান আপনাকে যেতে বলেছেন।’
‘এরকম পাহারা তো আগে দাওনি।’
‘ওই যে, অফিসের লোকরা চেঁচাচ্ছে তাই ম্যাডাম বললেন।’
স্বপ্নেন্দু দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। বিশাল ঘরে কেউ নেই। টেবিলের ওপাশে ঘুরন্ত চেয়ারটাও ফাঁকা। স্বপ্নেন্দু একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। ঘরের কোণায়, একটা পর্দা ঘেরা জায়গা আছে। সেখানে ইজিচেয়ারে শুয়ে মিসেস বক্সী বিশ্রাম করেন। কিন্তু লাগোয়া বাথরুমের দরজাটা খোলা। ঘরে যিনি ঢুকলেন তাকে দেখে চমকে উঠল স্বপ্নেন্দু। অসম্ভব বেঁটে এবং রোগা একটা কঙ্কালের গায়ে আলখাল্লা টাইপের ম্যাক্সি জড়ানো। করোটির ওপরে একটা বড় রুমাল বাঁধা। ঘরে ঢুকেই ম্যাডাম স্থির হলেন, ‘কে’?
‘আমি ম্যাডাম, স্বপ্নেন্দু।’
‘আই সি।’ গুড়গুড় করে উনি চলে এলেন নিজের চেয়ারে। তারপর শরীরটা সিধে রেখে বললেন, ‘আমি ভাবছি প্রত্যেকের বুকের ওপরে একটা নেমপ্লেট রাখতে বলব। নইলে চিনতে অসুবিধে হচ্ছে। এত দেরি হল কেন?’
‘অফিসে আসব না ভেবেছিলাম।’
‘সে কি? কেন? এখন তো শরীর খারাপের অজুহাত টিকবে না।’
‘না। চাকরি করব না ভাবছি।’
‘হোয়াট ডু য়ু মিন? আপনি শোনেননি চিফ মিনিস্টার কী বলেছেন? প্রত্যেক নাগরিক এতকাল যা-যা করেছেন এখনও তাই করতে হবে। অন্তত সরকারি, বেসরকারি চাকরিতে যারা ছিলেন তাঁদের নিষ্ঠার সঙ্গে সেই চাকরি করতে হবে। একটা স্পেশাল পুলিশ ফোর্স এই ব্যাপারটা দেখবে।’ খুকখুক করে হাসলেন মিসেস বক্সী, ‘চাকরি করব না বললেই মিটে গেল?’
‘সে কি? পুলিশরাও এখনও অ্যাকটিভ আছে নাকি?’
‘মোর অ্যাকটিভ। আপনি ভাবছেন গুলি করেও যখন কিছু হবে না তখন যা ইচ্ছে করবেন? এর মধ্যে বিজ্ঞানীরা এমন একটা অস্ত্র বের করেছেন যার রিঅ্যাকশনে হৃৎপিণ্ড আধঘণ্টা অসাড় হয়ে যাবে। সেই সময় আপনি নড়তে-চড়তেও পারবেন না। আপনাকে অ্যারেস্ট করে টিউব রেলে ফেলে রাখা হবে।’
‘টিউব রেলে?’
‘ইয়েস। টিউব রেল তো ইনকমপ্লিট। তা ছাড়া, এখন আর টিউবের কোনও প্রয়োজনও হবে না। ট্রান্সপোর্ট প্রবলেম সলভড। তাই টিউবটাকে অন্ধকূপ হিসেবে ব্যবহার করা হবে। পানিশমেন্ট সেল।’ তারপরে অন্য স্বরে মিসেস বক্সী বললেন, ‘ওসব চিন্তা ছাড়ুন। ইউ আর ইয়ং হ্যান্ডসাম। কত ব্রাইট প্রসপেক্ট সামনে পড়ে আছে। আজকের অ্যাটেন্ডেন্স অবশ্য সেভেন্টি পার্সেন্ট। নট ব্যাড।’
স্বপ্নেন্দু ঠিক ঠাওর করতে পারছিল না মিসেস বক্সী ভয় দেখাচ্ছেন কি না। তবু সে জিগ্যেস করল, ‘ডেকেছিলেন কেন?’
মিসেস বক্সী বললেন, ‘স্লোগান শুনেছেন? মানুষের অভ্যেস কোথায় যাবে? এই চেঞ্জড শরীরেও ওরা চেঁচাচ্ছে। এটা বন্ধ করতে হবে।’
‘বলুন কী করব?’
‘আরে, সেটা আপনি ঠিক করুন।’
‘ওই ট্রান্সফার অর্ডারটা বাতিল করে দিন।’
‘সে কি?’
‘ঠিকই বলছি। এখন আর পার্টিরা ঘুষ দিতে আসবে না। কারণ মানুষের অনেক প্রয়োজন আর ঠিক আগের মতো নেই। তা ছাড়া, ঘুষ নিয়ে ওরা কী করবে? টাকারও মূল্য কমে গেছে!’
‘ইউ আর রাইট। আমি অনেকবার ভেবেছি। সত্যি কথা। এখন আর ঘুষ দেবে কে? আর ঘুষ নিয়ে কীই-বা করবে। কিন্তু এটা প্রেস্টিজের ব্যাপার। চট করে আমরা এই সিদ্ধান্ত ওদের জানাব না’—মিসেস বক্সী চেয়ার ছাড়লেন। মহিলার চেহারা এখন আমূল পালটে গেছে। সেই থপথপে মাংসের তালটা চলে যাওয়ায় বেশ ছিমছাম দেখাচ্ছে। কিন্তু ম্যাক্সিটা নিশ্চয়ই ওঁর নয়। মিসেস বক্সী হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালেন, ‘আমাকে খুব কুৎসিত দেখাচ্ছে?’
‘না-না। বিউটিফুল।’
‘ওঃ বাটারিং করবেন না। ওটা আমি একদম পছন্দ করি না। আমি তো প্রথমে এমন শকড ছিলাম যে বিছানা থেকে উঠতেই পারিনি। নাউ আই ফিল ইটস বেটার। অ্যাট লিস্ট উই আর সেভড ফ্রম ইওর হাঙ্গরি আইস।’ তার পরেই হেসে ফেললেন মিসেস বক্সী, ‘রাগ করবেন না। আমি আপনাকে মিন করিনি। ইউ আর গুড। আসুন না আজকে সন্ধেবেলায় আমার বাড়িতে। আমার মেয়ে খুশি হবে।’
‘আপনার মেয়ে?
স্বপ্নেন্দু এতটা তরল হতে ম্যাডামকে কখনও দ্যাখেনি।
‘হ্যাঁ। এবার লরেটো থেকে পাশ করেছে। ম্যাক্সিটা তো ওরই।’
‘ও, ঠিক আছে যাওয়া যাবে।’ স্বপ্নেন্দু উঠে দাঁড়াল।
‘কিন্তু বিনা শর্তে নয়।’
‘মানে?’
‘ওদের ক্ষমা চাইতে হবে বিক্ষোভ করার জন্যে। তারপর আমরা ট্রান্সফার অর্ডারটা ক্যানসেল করব। ও কে?’
যাঃ বাবা। কোন কথা থেকে কোথায় চলে এলেন মহিলা। স্বপ্নেন্দু করোটি নেড়ে বেরিয়ে এল বাইরে।
দুপুরে খবর পাওয়া গেল ওদের গেট মিটিং-এ একদম লোক হয়নি। নেতারা অনেক অনুরোধ করা সত্বেও কর্মচারীরা নাকি সেখানে উপস্থিত হয়নি। তারা বলেছে এখন যেহেতু অফিসে আসা বাধ্যতামূলক তাই আসতে হবে। ট্রান্সফার নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কোনও লাভ নেই। নেতারা নাকি খুব ভেঙে পড়েছে কর্মচারীদের এই ব্যবহারে। টিফিনের পর নেতারা এল তার ঘরে। স্বপ্নেন্দু ওদের বসতে বলল, ‘বলুন, কী চাই আপনাদের?’
‘ওটা করবেন না।’
‘কর্মচারীরা তাই চাইছেন?’
‘এখন তো অনেকেই সরে যাচ্ছে। কিন্তু এটা আমাদের প্রেস্টিজের প্রশ্ন।’
‘মিসেস বক্সীর সঙ্গে কথা বলুন।’
‘না। উনি খুব একরোখা। তা ছাড়া, আমরা আপনাকে মধ্যস্থতা করতে বলছি।’
‘মেনে নিন। অফিস অর্ডার বলে কথা।’
‘মেনে নিলে আমাদের আন্দোলনের মেরুদণ্ড ভেঙে যাবে।’
‘আপনারা আর কী নিয়ে আন্দোলন করবেন?’
‘চাকরি যখন করছি তখন সমস্যা তো আসবেই! তা ছাড়া, এখন থেকে আর আটান্ন বছর বয়সে রিটায়ারমেন্ট নেই। অতএব সমস্যা থাকবেই।’
‘রিটায়ারমেন্ট নেই?’
‘না স্যার। কারণ মানুষ মরছে না। নিউ জেনারেশন আসছে না।’
স্বপ্নেন্দু চমকে উঠল, ‘তাহলে তো প্রমোশনও হবে না।’
‘না স্যার।’
এক মিনিট ভাবল স্বপ্নেন্দু। এই চাকরি চিরকাল করে যেতে হবে? কোনও প্রমোশন নেই? তারপর লোকগুলোর মুখের দিকে তাকাল সে। করোটি দেখে মনের প্রতিক্রিয়া বোঝা যায় না। আর এরা শার্ট পরে আছে বলে ওদের হৃৎপিণ্ড দেখা যাচ্ছে না। হরিমাধবের শার্টের বোতাম একটাও নেই। তাই ওরটা বুঝতে অনেক সুবিধে। হঠাৎ হেনা সেনের কথা মনে পড়ল। সে জিগ্যেস করল, ‘শুক্রবার যে মহিলা তর্ক করেছিলেন তিনি কোথায়? তিনি কি এখন আপনাদের সঙ্গে আছেন?’
নেতারা মুখ চাওয়াচায়ি করল। শেষপর্যন্ত একজন বলল, ‘উনি আসেননি আজ।’
‘ও।’ স্বপ্নেন্দুর মন খারাপ হয়ে গেলেও সে মুখে বলল, ‘ভদ্রমহিলা বিচক্ষণ কথাবার্তা বলেছিলেন। অলরাইট। আপনারা যান, আমি দেখছি কী করা যায়। বুঝতেই পারছেন এসব আমার হাতে নেই।’
‘আমরা জানি স্যার। আপনি মধ্যস্থতা করুন। ততক্ষণ আমরা একটু-আধটু আন্দোলন চালাব।’
‘আন্দোলন চালাবেন মানে?’
‘না চালালে ইমেজ নষ্ট হয়ে যাবে।’
নেতারা চলে গেলে স্বপ্নেন্দু উঠে দাঁড়াল। যাক, প্রবলেম সলভড। তবে একথা এখনই মিসেস বক্সীকে বলা চলবে না। ওঁকেও দুদিন ঝুলিয়ে রাখলে অন্য কাজ নিয়ে টিকটিক করবেন না। শালা, প্রমোশনই যখন কোনওকালে হবে না তখন কাজ দেখিয়ে লাভ কী? টেলিফোনটা শব্দ করতেই বিরক্ত হল স্বপ্নেন্দু। মিসেস বক্সী নির্ঘাত। দরজার দিকে এগিয়ে যেতে-যেতে আবার ফিরে এল সে। সে যে বেরিয়ে যাচ্ছে একথা বলে দেওয়া ভালো।
‘আমি মুখার্জি বলছি।’
যাঃ শালা। থার্ড অ্যাসেসমেন্ট অফিসার মুখার্জির ফাইলটা তো মিসেস বক্সীর কাছে আটকে আছে। সে জবাব দিল, ‘বলুন।’
‘শোনো। তোমাকে শুক্রবারে যে রিকোয়েস্ট করেছিলাম সেটা করতে হবে না। ম্যাডামের অ্যাপ্রুভালের কোনও দরকার নেই।’
‘কেন?’
‘দিগম্বর হয়ে বসে আছি এখন। আমি আর ইন্টারেস্টেড নই।’
টেলিফোন নামিয়ে হেসে ফেলল স্বপ্নেন্দু। বিপ্লবও এতটা কার্যকরী হতো না। মুখ্যমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন। জাঁদরেল ঘুষখোর অফিসার আর ঘুষের জন্যে অনুরোধ করছে না। চমৎকার।
মিসেস বক্সীকে জানাল না স্বপ্নেন্দু। হরিমাধবকে বলে গেল কেউ জিগ্যেস করলে বলতে শরীর খারাপ বলে তাড়াতাড়ি চলে গেছেন। হরিমাধবের বিস্ময় বাড়াল, ‘স্যার, আপনার শরীর খারাপ?’
তৎক্ষণাৎ খেয়াল হল। শরীর কোথায় যে খারাপ হবে? এই অজুহাতটা চিরকালের মতো বাতিল হয়ে গেল। স্বপ্নেন্দু গম্ভীর গলায় বলল, ‘ঠিক আছে। কেউ খুঁজলে বলে দিও জরুরি কাজে বেরিয়েছি।’
এখন দুপুর শেষ হয়নি। রোদের তাপ বড্ড বেশি। কিন্তু ঘাম হচ্ছে না বা হওয়ার কোনও সম্ভাবনা না থাকায় তেমন কষ্ট হচ্ছে না। বাস থেকে নেমে স্বপ্নেন্দু হেসে ফেলল। কন্ডাক্টর চুপচাপ বসে আছে। কোনও যাত্রীকেই টিকিট কাটতে হচ্ছে না। এটা কদ্দিন চলবে কে জানে।
রাস্তাটা নির্জন। হঠাৎ স্বপ্নেন্দুর বুকের ভেতরটায় থম ধরল। তার হৃৎপিণ্ড কাঁপতে শুরু করল। খুব নার্ভাস লাগছে এখন। এইভাবে চট করে চলে না এলেই ভালো ছিল। তারপর মরিয়া হল সে। লাল ব্লাউজ লাল শাড়ির আগুন তাকে চুম্বকের মতো টানছিল।
কলিংবেলের বোতামে আঙুল রাখতেই ভেতরে যেন ঝড় বয়ে গেল। নির্জন দুপুরে বোধহয় আওয়াজ বেশি হয়। কেউ দরজা খুলছে না। মিনিট দুয়েক অপেক্ষা করার পর স্বপ্নেন্দু আবার বেল টিপল। এরপর ধীরে-ধীরে দরজা খুলে দাঁড়ালেন এক মহিলা। মহিলা কারণ তাঁর পরনে সাদা শাড়ি, মাথাটা বিরাট ঘোমটার আড়ালে ঢাকা। সেই পরশুরামের গল্পের চরিত্র যেন।
‘কী চাই?’
‘হেনা সেন আছেন?’ স্বপ্নেন্দুর স্বর কাঁপছিল।
‘আপনি কে?’
‘আমি ওঁর অফিসে কাজ করি। আমার নাম স্বপ্নেন্দু।’
‘ও তুমি। এসো ভেতরে এসো।’ মহিলা দরজা ফাঁক করতে স্বপ্নেন্দু ঢুকে পড়ল। দরজা বন্ধ করে মহিলা কাতর গলায় বললেন, ‘এ কী হল বাবা। আমরা কী এমন পাপ করেছি যে এই শাস্তি পেতে হচ্ছে।’
স্বপ্নেন্দু বুঝল ইনি হেনার মা। মনে পড়ল না সেদিন ইনি তাকে তুমি বলেছিলেন কি না। সে বলল, ‘কী আর করা যাবে বলুন।’
মহিলা বললেন, ‘এইভাবে বাঁচতে চাই না বাবা। তিনি স্বর্গে বসে রইলেন আর আমি চিরকাল এই নরকে পড়ে থাকব? আমার তো বাঁচবার কোনও আকাঙ্ক্ষাই ছিল না। শুধু ওই মেয়েটার একটা হিল্লে করতে পারলে! কলকাতার সব মানুষের কি এই দশা?’
‘হ্যাঁ মাসিমা।’
‘কলকাতার বাইরের?’
‘তাদের কথা জানি না।’
‘পরশু থেকে মেয়ে আমার বিছানা ছাড়েনি। শুধু পড়ে-পড়ে কেঁদে যাচ্ছে। তুমিই প্রথম আমাদের বাড়িতে এলে।’
‘ওঁর সঙ্গে একটু কথা বলা যাবে?’ স্বপ্নেন্দু যেন অনুনয় করল।
‘কথা? ও তো কথাই বলতে চাইছে না। কতবার ওকে বললাম সহজ হতে তা মেয়ে আমাকে খেঁকিয়ে উঠছে। সরে যাও সরে যাও। আমি কাউকে সহ্য করতে পারছি না। ও কি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইবে?’
মহিলা মাথার পড়ে যাওয়া ঘোমটা চট করে টেনে নিলেন। স্বপ্নেন্দু লক্ষ করল এঁর করোটির গায়ে সামান্য হলদে দাগ রয়েছে।
‘তাহলে থাক। ওঁকে বলবেন আমি এসেছিলাম।’ নিশ্বাস ফেলল স্বপ্নেন্দু। মহিলা বললেন, ‘দাঁড়াও। তুমি বড্ড ভালো ছেলে বাবা।’
অবাক হয়ে স্বপ্নেন্দু জিগ্যেস করল, ‘একথা বলছেন কেন?’
‘নিশ্চয়ই কারণ আছে। আমি ভাবছি তুমি যদি নিজে গিয়ে ওকে সহজ হতে বলো তাহলে যদি কাজ হয়।’
‘আপনি যদি বলেন।’ স্বপ্নেন্দুর হৃৎপিণ্ড কাঁপতে লাগল।
‘আগে হলে হয়তো বলতাম না। কিন্তু এখন আমার মাথার ঠিক নেই। দ্যাখো, যদি পারো ওকে সহজ করতে। ওই দরজা দিয়ে যাও।’
স্বপ্নেন্দুর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। তারপর ধীরে-ধীরে সে বাঁদিকের ছোট্ট প্যাসেজটা ধরে সেঁটে একটা ভেজানো দরজার সামনে দাঁড়াল। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল মহিলা নেই। নিজের জামা ঠিক করে নিল স্বপ্নেন্দু। তারপর দরজায় হাত দিল।
ঘরটা অন্ধকার। সমস্ত জানলা বন্ধ। প্রথমে দৃষ্টি চলছিল না। তবু স্বপ্নেন্দু ভেতরে ঢুকতেই খাটটাকে দেখতে পেল। খাটের ওপর হেনা সেন উপুড় হয়ে শুয়ে আছেন। হলদে ফুল তোলা ম্যাক্সি ওর গায়ে। বড় হাতায় কবজি পর্যন্ত ঢাকা। পায়ের হাড় এবং সাদা করোটি এবার দেখতে পেল স্বপ্নেন্দু। উপুড় হয়ে শুয়ে থাকায় হেনা সেন তার উপস্থিতি টের পাননি। স্বপ্নেন্দুর হৃৎপিণ্ড স্থির হয়ে গেল। হেনা সেন ছাড়া নিশ্চয়ই এই ঘরে অন্য কেউ থাকবে না। সে চোখ বন্ধ করতে গিয়েও পারল না। কারণ তার চোখের পাতাই নেই। হৃৎপিণ্ড অনুভবে দৃষ্টিশক্তি যোগাচ্ছে।
সেই হেনা সেন? স্বপ্নেন্দুর মনে হচ্ছিল এখানে না এলেই ভালো হতো। যে মাখনের মতো নরম শরীর তাকে চুম্বকের মতো টেনেছিল সেটাকে স্মৃতিতে বাঁচিয়ে রাখাই উচিত ছিল। এখন তো হেনা সেন তারই মতো বীভৎস। অথচ এই ঘরে ঢোকবার আগে বুকের ভেতর ভূমিকম্প হচ্ছিল তার। তার অনুরণন তো এখনও মেলায়নি।
স্বপ্নেন্দু নিচু স্বরে ডাকল, ‘শুনুন।’
হেনা সেনের কোনও প্রতিক্রিয়া হল কি না বুঝতে পারল না সে। এক পা এগিয়ে সে আবার ডাকল, ‘মিস সেন!’
এবার চকিতে করোটি ঘুরে গেল। আর তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বসে হেনা সেন চিৎকার করে উঠলেন, ‘কে? কে? ও মাগো!’ তার একটা হাত মুখে চাপা দিল।
সঙ্গে-সঙ্গে নিজেকে ধিক্কার দিল স্বপ্নেন্দু। এ কী দেখছে সে। কিন্তু ততক্ষণে সেই চামড়া-মাংস-রক্ত হীন কঙ্কালের মুখটা চাদরে ঢেকে ফেলেছে হেনা সেন। এখনও যেন ঘরের মধ্যে আর্তনাদটা পাক খাচ্ছে। স্বপ্নেন্দু ঘোর কাটিয়ে বলে উঠল, ‘নার্ভাস হবেন না মিস সেন। আমি স্বপ্নেন্দু।’
‘স্বপ্ন?’ সঙ্গে-সঙ্গে হেনা সেনের মাথাটা আলোড়িত হল, ‘আমি চিনি না আপনাকে। কেন এলেন এখানে? বেরিয়ে যান, বেরিয়ে যান বলছি। ওমা, মাগো।’
আর্তনাদ শুনে স্বপ্নেন্দু এতটা অবাক হয়ে গিয়েছিল যে-কোনও শব্দ উচ্চারণ করতে পারেনি প্রথমটায়। যেন সত্যি কোনও মহিলার ঘরে কে আচম্বিতে ঢুকেছে এবং তিনি চিৎকার করছেন আত্মরক্ষার জন্যে। স্বপ্নেন্দুর নামটা শুনেও ওঁর কোনও প্রতিক্রিয়া হয়নি দেখে সে আরও তাজ্জব হল। এখনই সেই মহিলা ছুটে আসবেন এবং তাকে বেরিয়ে যেতে হবে এই আশংকায় স্বপ্নেন্দু দরজার দিকে তাকাল। কিন্তু মহিলার আসার কোনও লক্ষণ দেখা না যাওয়ায় সাহস বাড়ল তার। হেনা সেন এখন দু-হাতে চাদরটাকে আঁকড়ে ধরে কাঁপছেন।
স্বপ্নেন্দু আর এক পা এগোল, ‘মিস সেন। আমি আপনার অফিসে কাজ করি। এই দুদিন আমি আসতে পারিনি। আজ না এসে পারলাম না। আপনি সত্যি আমাকে চিনতে পারছেন না?’
‘না, আমি কাউকে চিনি না।’ উত্তেজনা আছে কিন্তু এবার তার ঝাঁঝ কম।
‘তা কি হতে পারে? আমি শুক্রবারে এখানে এসেছিলাম।’
‘আজ কেন এসেছেন? মজা দেখতে?’
‘মোটেই নয়।’ স্বপ্নেন্দু আবার দরজাটার দিকে তাকাল। মহিলা ওর ওপাশে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে সব শুনছেন কি না কে জানে! তবু সে মরিয়া হয়ে বলল, ‘এই ক’দিন আমি আপনার কথা ভেবেছি।’
‘কী মিথ্যে বলতে এসেছেন!’
‘মিথ্যে নয়। আমার বলা শোভন নয়।’ স্বপ্নেন্দুকে থামিয়ে দিয়ে হেনা সেন বললেন, ‘কী জন্যে এসেছিলেন আমি জানি। এখন তো আর সেসব নেই। আমার শরীর, আমার শরীরটার দিকে তাকালে পুরুষজাতটার চোখ লোভে চকচক করে উঠত। ওই ঘেন্নায় আমি—তা আর এখন কেন? এখন তো আমি একটা কঙ্কাল। এখন আমাকে একটু নিশ্চিন্তে থাকতে দিন।’
‘আপনি ভুল বলছেন।’
‘একটুও না। সেদিন যখন আপনি আমাকে ঘরে ডেকেছিলেন তখনই আমি বুঝতে পেরেছিলাম। সেই চোখ। লালসা থিক-থিক করছে। আজ আমার কিছু নেই। আপনাদের কাছে আমার কোনও মূল্য নেই। উঃ।’
‘আমি আবার বলছি আপনি ভুল বলছেন।’
‘নাঃ।’ চিৎকারটা বাড়ল। তারপর এক টানে চাদর খুলে হিসহিসে গলায় হেনা সেন বললেন, ‘দেখুন চেয়ে দেখুন। এই হলাম আমি।’
স্বপ্নেন্দু এবার ভালো করে দেখল। তার বুক মুচড়ে যাচ্ছিল। সেই ঠোঁটের জাদুকরি হাসি, চোখের কাজ, গালের টোল আর মুখের মায়া কোথায় মিলিয়ে গেল। একটা ছোট্ট কঙ্কালের জেদি মুখ তার দিকে ফেরানো। কিন্তু সেইসঙ্গে তার মনে হল রাস্তাঘাটে এই কদিনে সে অনেক কঙ্কালের মুখ দেখেছে। তাদের চোয়াল, কপাল, নাকের তুলনায় হেনা সেনের মুখ অনেক সুন্দর। অন্তত ওর চিবুকে একটা আলতো আদুরে ভাব মাখানো আছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে মুগ্ধ হল স্বপ্নেন্দু। তারপর বলল, ‘আমার মুখের দিকে দেখুন। আমিও আপনার মতন। তবে একটা কথা বলি, সব হারিয়েও আপনি অনেকের চেয়ে সুন্দর, বেশি সুন্দর।’
‘আবার সেই মিথ্যে কথা! সারাজীবন ধরে এই স্তুতি শুনেছি। আর না। কী আশায় আপনি এসেছেন আমার কাছে? আমার শরীর? তবে দেখুন। নিজের চোখে দেখুন।’ হঠাৎ দুহাতে পাগলের মতো ম্যাক্সিটা খুলে ফেললেন হেনা সেন, ‘দেখুন, ভালো করে দেখুন। আমার শরীরে একটা কটা হাড় ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। আপনারা, পুরুষজাত চিবিয়ে-চিবিয়ে সব নরম সুন্দর গিলেছেন। বাট নাউ আই অ্যাম ফিনিশড। গেট আউট প্লিজ।’ হেনা সেন থরথর করে কাঁপছিলেন।
স্বপ্নেন্দুর মনে হল অসম্ভব সুন্দর একটা দৃশ্য দেখেছে। হেনা সেনের দুটো পা ঈষৎ ভাঁজ করা, কোমর বেঁকানো, বুকের খাঁচার ভেতরে তার হৃৎপিণ্ড ধড়ফড় করছে। যেন কুমোরটুলিতে মূর্তি গড়ার প্রাথমিক কাজ শেষ হয়েছে, এবার মাটির প্রলেপ লাগিয়ে দিলেই হল। সে একটু ঝুঁকে বিছানা থেকে চাদর তুলে নিয়ে হেনা সেনের শরীরে ছড়িয়ে দিল, তারপর বলল, ‘উত্তেজিত হবেন না। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে।’
‘কে বলেছেন?’ হেনা সেনের স্বরে বিস্ময়।
‘মুখ্যমন্ত্রী।’
‘আঃ। আপনি অদ্ভুত লোক তো।’
‘উনি তো অন্যায় কিছু বলেননি। আমাদের যা গিয়েছে তা নিয়ে চিন্তা করে কী লাভ! আমরা তো অমরত্ব পেলাম, তাই না?’
‘কীসের বিনিময়ে অমরত্ব পেলাম? কে চায় এমন অমরত্ব? অন্তত আমি চাই না। আমার ওই শরীরটাকে কৃপণের মতো লোভী হাতগুলোর আওতা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম। কেন, কীসের জন্যে? আমি তো তার ব্যবহারই জানলাম না, তার স্বাদ আমার অচেনা রয়ে গেল চিরজীবনের জন্যে। কে চায় এই অমরত্ব?’
‘উত্তেজিত হবেন না। আপনি বিশ্বাস করুন আমি কোনও অভিসন্ধি নিয়ে আসিনি।’
‘তাহলে কেন এসেছেন?’
‘বলব। আগে জামাটা পরে নিন।’
‘আমি আর শাড়ি পরতে পারব না। আঃ।’
‘কেন পারবেন না? অফিসে আজ তিনজন মহিলাকে শাড়ি পরে যেতে দেখেছি।’
‘অফিসে? অফিসে লোক গিয়েছিল? মেয়েরা গিয়েছিল?’
‘হ্যাঁ। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন সবাইকে স্বাভাবিকভাবেই চলতে। যাঁরা অফিসে যাবেন না তাঁদের পাতাল-নরকে ঠেলে দেওয়া হবে।’
‘পাতাল-নরক?’ হেনা সেনের স্বরে আবার বিস্ময়।
‘হ্যাঁ। ওই যে টিউব রেল হচ্ছিল। ওটা কমপ্লিট হতে সময় লাগবে। কিন্তু এখন আর তেমন ট্রান্সপোর্ট প্রবলেম নেই। তাই টিউবের মুখ বন্ধ করে পুলিশ অপরাধীদের ওখানে ফেলে দেবে।’
‘আমি অফিসে যাব না। এই মুখ, শরীর নিয়ে যেতে পারব না।’
‘তাহলে পাতাল-নরকে যেতে হবে। ঠিক আছে, ব্যাপারটা আমি দেখব। আপনার জামা পরুন আগে। আমি কি ঘর থেকে বেরিয়ে যাব?’
হেনা সেনের মুখ নিচু হল। স্বপ্নেন্দুর মনে হল হেনা লজ্জা পেয়েছেন। সে দেওয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়াতে হেনা সেনকে দেখতে পেল। ছবির বাঁধানো ফ্রেমে হেনা সুন্দর হাসছেন। সেই মোহিনী শরীর আর মুখের হাসিতে ঘর যেন আলো হয়ে গেছে। এই ছবিটাকে খুলে ফেলা উচিত। স্বপ্নেন্দু মনে-মনে বলল।
ঠিক তখন হেনা সেন বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে, ‘বসুন।’
স্বপ্নেন্দু ফিরে তাকাল! হাতাওয়ালা ম্যাক্সি পায়ের গোড়ালি ছুঁয়েছে।
মাথায় একটা কালো রুমাল বাঁধা। স্বপ্নেন্দু বলল, ‘সুন্দর।’
হেনার মাথা সামান্য নড়ল, ‘আবার বানানো কথা!’
‘বিশ্বাস করুন!’ স্বপ্নেন্দুর স্বর ভারী হল।
‘আপনি কি পাগল?’
‘তাই মনে হচ্ছে? জানলাগুলো খুলে দিই?’
‘আলো আসবে যে।’
‘আসুক। এখন থেকে খোলা হাওয়ায় বের হবেন।’
‘আমি পারব না, লজ্জা লাগছে, কেমন—ভাবতে পারছি না।’
‘উহুঁ। বরং দেখবেন পাঁচজনে আপনার দিকে তাকাবে।’
‘আবার?’ হেনা একটা চেয়ারে বসলেন। পাশে স্বপ্নেন্দু।
‘আপনি আমার কাছে কী চান বলুন তো?’
‘আপনার কী মনে হয়?’
‘আমি বুঝতে পারছি না। আমার তো দেওয়ার মতো কিছু নেই। সত্যি বলতে কী এই কণ্ঠস্বর ছাড়া আমি আর মেয়েও নই।’
‘ভুল হল। কণ্ঠে আমাদের স্বর নেই। ওটা বক্ষস্বর হবে। আর তাই যদি বলেন তা হলে আমিও তো পুরুষ নেই। একমাত্র স্বরে সেটা বোঝা যায় আর হয়তো হাড়ের গঠনে। তাই না?’
‘তা হলে? কী চান আপনি?’
‘আপনাকে।’
‘ওঃ, আমি এই কথাটাই তো বুঝতে পারছি না।’
‘বুঝতে হবে না। কাল থেকে অফিসে যাচ্ছেন?’
‘কাল থেকে? না-না।’
‘বেশ যেদিন যাবেন বলবেন। আমি একটা ছুটির দরখাস্তে আপনার সই করিয়ে নিয়ে যাব। বাড়িতে বইপত্র আছে?’
‘আপনি এমনভাবে কথা বলছেন যেন কিছুই হয়নি।’
‘মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন যে এসব নিয়ে একদম মাথা ঘামাবেন না।’
‘কী নিয়ে মাথা ঘামাব?’
‘বলব?’
‘বলুন।’
‘আপনার মায়ের সঙ্গে আলোচনা করুন একটা সমস্যা নিয়ে।’
‘কী সমস্যা?’
‘আপনার বিয়ে হয়ে গেলে উনি কোথায় থাকবেন? আপনার সঙ্গে থাকতে ওঁর আপত্তি আছে কিনা? নাকি এখানেই থাকতে চান!’
‘বিয়ে? আপনি কি সুস্থ?’
‘অবশ্যই।’
‘আমাকে কে বিয়ে করবে? আমি তো আর মেয়েই নই।’
এইসময় দরজায় হেনার মা এসে দাঁড়ালেন। স্বপ্নেন্দু তাঁকে আগে লক্ষ করেছিল। সে উঠে দাঁড়াল, ‘আসুন। আপনার মেয়ে সমানে ঝগড়া করে যাচ্ছে।’
‘মোটেই না।’ হেনা মৃদু আপত্তি করল।
‘সে কি? একটু আগে আপনি চেঁচাচ্ছিলেন না! আমাকে চিনতে পর্যন্ত চাইছিলেন না। বসুন মাসিমা।’
‘না বসব না। তুই ভালো আছিস?’
জবাব দিলেন না হেনা। একটু চুপ করে বললেন, ‘তুমি একটা কাপড় বাঁধো তো মাথায়, বিশ্রী দেখাচ্ছে।’
মহিলা ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘আমাকে আর কী দেখাবে! ভাগ্যিস তুমি এলে বাবা। নইলে ওকে নিয়ে যে কী করতাম আমি! কোনও কথা শুনতে চাইছিল না। শরীর নিয়ে ওর চিরকালই—।’
‘আঃ চুপ করো তো।’ মাকে থামিয়ে দিলেন হেনা সেন।
স্বপ্নেন্দু বলল, ‘আপনারা এক কাজ করুন। বাইরে পৃথিবীতে কী হচ্ছে তা জানতেই পারছেন না। চুলন আপনারা আমার সঙ্গে। বাইরে হেঁটে আসি। নইলে একা-একা ঘরে বসে থাকলে আরও মন খারাপ হবে।’
হেনার মা বললেন, ‘না বাবা। আমার বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে না। তোর ইচ্ছে হলে ঘুরে আয়। স্বপ্নেন্দু যখন বলছে।’ হেনার মা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
হেনা কোনও জবাব দিলেন না। স্বপ্নেন্দু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিগ্যেস করল, ‘কী হল?’
‘আজকে একদম ইচ্ছে করছে না।’
‘ঠিক আছে। কাল তৈরি থাকবেন। এলেই বেরিয়ে পড়তে হবে।’
‘কাল আপনি আসবেন?’
‘নিশ্চয়ই। আর এখন কেউ কিছু বলবে না। পাড়াতেও দুর্নাম হবে না।’
‘আশ্চর্য!’
‘তার মানে?’
‘সত্যি-সত্যি আপনি আসবেন?’
‘হ্যাঁ। বললাম তো লোকলজ্জার কোনও কারণ নেই।’
‘আপনি আমাকে ঠকাচ্ছেন না তো?’
‘ঠকিয়ে আমার কী লাভ?’
‘আমার খুব ভয় করে।’
‘কীসের ভয়।’
‘পুরুষজাতটাকে। ওরা মেয়েদের শুধু শরীরের জন্যেই চায়। সেটা মিটে গেলে আর তাকিয়েও দ্যাখে না। তাই—?
‘এখন তো আর সেসব প্রশ্ন ওঠে না।’
হেনা সেন যেন চেতনায় ফিরলেন, ‘তা বটে। সেজন্যে আরও গোলমাল লাগছে। আপনি যা বলেছেন সব কি সত্যি?’
‘সব। আর এই সব পুরোনো ভাবনাগুলোকে এখন বাতিল করুন। মনটাকে পরিষ্কার করুন। দেখবেন সব কিছু হালকা লাগবে। কলকাতা শহরটার চেহারা একদম পালটে গেছে। আপনি কেন স্মৃতি আঁকড়ে থাকবেন?’
‘পালটে গেছে মানে?’
‘নদীতে জল নেই, পুকুরগুলো খাঁ-খাঁ করছে। একটাও গাছ নেই, ঘাস বাগান ফুল সব ছাই হয়ে গেছে।’ বলতে-বলতে থমকে দাঁড়াল স্বপ্নেন্দু, ‘না সব নয়। একটা ফুল আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে আছে, এখনও।’
‘একটা ফুল? কোন ফুল, কোথায়?’
স্বপ্নেন্দু হাসল, শব্দ হল, ‘সেটা বলা যাবে না। একমাত্র আমিই তার হদিশ জানি।’
‘আঃ, আবার সাজানো কথা!’
স্বপ্নেন্দু বুঝতে পারল, হেনা মনে করেছেন স্বপ্নেন্দু তার কথা বলছে। যেন হেনাকে একটা ফুলের সঙ্গে তুলনা করেছে স্বপ্নেন্দু। সে আর ভুল ভাঙাল না। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি সাজানো কথা বলি না।’
হেনা সেন উঠলেন, ‘আজ যে আমার কী হল!’
‘কী হল?’
‘আপনি আসার আগে মনে হচ্ছিল, থাক, বাদ দিন।’
দরজা বন্ধ করার আগে হেনা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সত্যি কথা বলুন তো, আমি কি খুব কুৎসিত হয়ে যাইনি?’
স্বপ্নেন্দু বলল, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি অনুযায়ী মোটেই না।’
হেনার মাথাটা নিচু হল, ‘আপনি আমার মনটাকে পালটে দিয়ে গেলেন। আবার কবে আসবেন?’
‘কাল।’
‘সত্যি?’
‘হ্যাঁ।’ স্বপ্নেন্দু আর দাঁড়াল না।
বাইরে বেরিয়ে স্বপ্নেন্দুর হাঁটার গতি বেড়ে গেল। জয় করায়ত্ত। এত সহজে যে সে হেনা সেনকে পেয়ে যাবে তা কল্পনায় ছিল না। একথা ঠিক যদি এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন না ঘটত তাহলে ব্যাপারটা এত সহজ হতো না। হেনা সেন তাকে নানাভাবে যাচাই করতেন এবং হয়তো শেষপর্যন্ত ছুড়ে ফেলতেন।
স্বপ্নেন্দু ভাবল, এবার একটা দিন ঠিক করে ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের কাছে ওরা যাবে। হ্যাঁ, তার শরীর নেই। পুরুষ মানুষের কোনও চিহ্ন তার নেই। হেনার মধ্যে মহিলাত্ব পাওয়া যাবে না। কিন্তু ওগুলোই কি সব? পুরুষ এবং মহিলা কি দুজনের শরীরের মধ্যেই তৃপ্তি খুঁজবে শুধু? তাদের মনের আনন্দ বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। হেনা সঙ্গে থাকলে সে ওই আনন্দ পাবেই। দুজনে মিলে গল্প করবে, ভালোবাসবে, বেড়াতে যাবে। আসন্ন ভবিষ্যতের কথা ভেবে স্বপ্নেন্দু শিহরণ বোধ করছিল।
বাস থেকে নেমে চোখের ওপর একটা ঘটনা ঘটতে দেখল সে। একজন মহিলা অলসভাবে হাঁটছিলেন। তাঁর হাতে একটা রেডিও সেট। বোধহয় সারাতে দিয়েছিলেন বা ওইরকম কিছু। হঠাৎ একটা লোক তাঁর হাত থেকে সেটা ছিনিয়ে দৌড়তে শুরু করল। মহিলা চিৎকার করে পিছু ধাওয়া করতে কোত্থেকে আর একটা লোক উদয় হয়ে তাঁর শাড়ির আঁচল টেনে ধরল। পতপত করে শাড়িটা খুলে গেল। মহিলা চেষ্টা করেও সেটাকে আটকাতে পারলেন না। দ্বিতীয় লোকটা শাড়িটা হাতে নিয়ে উলটো দিকে দৌড়ল। স্বপ্নেন্দু এতটা উত্তেজিত হয়েছিল যে সে পিছু ধাওয়া করল দ্বিতীয় লোকটার। কিন্তু দূরত্ব এত বেশি যে তার পক্ষে ধরা সম্ভব নয় বুঝে চিৎকার করতে লাগল যাতে অন্য লোক লোকটাকে ধরে। কিন্তু সে দেখল চারপাশের মানুষজন সে-চেষ্টাই করছে না। বরং হাসাহাসি শুরু হয়েছে। স্বপ্নেন্দু রাগত গলায় বলল, ‘আপনারা হাসছেন? লজ্জা করছে না? একজন মহিলাকে বেইজ্জত করছে সবার সামনে। ছি-ছি!’
জনতার একজন বলল, ‘কে মহিলা? উনি মহিলা তার প্রমাণ আছে?’ থমকে গেল স্বপ্নেন্দু, ‘শাড়ি-ব্লাউজ পরেছেন দেখছেন না?’
‘আপনি শাড়ি-ব্লাউজ পরলে মশাই একইরকম দেখাবে। শোনেননি কাল থেকে ট্রাম-বাসে লেডিস সিট উঠে যাচ্ছে।’
লেডিস সিট উঠে যাচ্ছে? ততক্ষণে ছিনতাইকারী হাওয়া হয়ে গিয়েছে। স্বপ্নেন্দু মহিলার দিকে তাকাল। দুহাতে জামা ঢাকার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। স্বপ্নেন্দু বুঝল পুরোনো সংস্কার এবং অভ্যেস ত্যাগ করতে পারেননি মহিলা।
সকালে শহরটা বেশ ছিমছাম ছিল। দুপুরে কী হয়েছিল স্বপ্নেন্দু জানে না। হেনা সেনের বাড়িতে যতক্ষণ ছিল বাইরের পৃথিবীর কথা খেয়াল ছিল না। কিন্তু বিকেলে মনে হল কলকাতা যেন স্বচ্ছন্দ নয়। মানুষগুলোর ব্যবহার পালটে গিয়েছে।
অবনীদা বসেছিল দোকানে। স্বপ্নেন্দু দেখল দোকানটা ন্যাড়া। জিনিসপত্র কিছুই নেই। স্বপ্নেন্দু জিগ্যেস করল, ‘কেমন আছেন অবনীদা? আমি স্বপ্নেন্দু।’
‘দেখছ তো ভাই। ওগুলো নিয়ে ওরা কী করবে জানি না তবু নিয়ে গেল।’
‘কী নিয়ে গেল?’
‘চায়ের কাপ-ডিশ-কেটলি-জলের ড্রাম!’
‘কারা নিল?’
‘এখন তো চেনা মুশকিল। দলবেঁধে সাত আটজন এসেছিল। লুট করে নিয়ে চলে গেল। বললাম কোনও কাজে লাগবে না ভাই, কিন্তু শুনল না। তুমি কিছু দ্যাখোনি?’
‘মনে হল কিছু একটা হয়েছে।’
‘দোকানপাট লুঠ হচ্ছে, বড়রাস্তার কাপড়ের দোকানগুলো ভেঙে সবাই যে যার বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। এমনকী মিষ্টির দোকান লুঠ করে সেগুলো চটকাচ্ছে মানুষগুলো। এসব কেন হচ্ছে জানো?’
‘কেন?’
‘সবাই বুঝে গেছে তাদের আর পাওয়ার কিছু নেই। পুলিশ এসেছিল লরিতে চেপে। ধাওয়া করতে সবাই পালাল। কিন্তু এর মধ্যেই মানুষ জেনে গেছে পুলিশের পুরোনো বন্দুকগুলো অকেজো হয়ে গিয়েছে। নতুন যে অস্ত্রের কথা শোনা যাচ্ছে তা কেউ চাক্ষুষ করেনি। এখন তাই পুলিশ দেখলে কেউ ভয় পায় না।’
‘অকেজো হয়ে গিয়েছে মানে?’
‘ট্রিগার টিপলেও গুলি বের হচ্ছে না। বোধহয় গুলিগুলোর বারোটা বেজে গেছে। কী ভয়ঙ্কর কথা! চারদিকে এখন অরাজকতা শুরু হয়ে যাবে। তুমি জানো আমার ছেলেটা আমাকে কী বলেছে?’
‘কী?’
‘বলল, একদম চোখ রাঙাবে না। তোমার খাই না পরি? আমি আমার মতো থাকব তুমি নাক গলাবে না। জীবনে যা কিছু সবই তো ভোগ করেছ, আমি কী পেলাম? বোঝো! আমার ভয় হচ্ছে আমাদের সংসারগুলো পর্যন্ত ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। নরক, নরক এসে গেল।’
এইসময় আর-একটা কঙ্কাল এসে হাজির হল। তার দিকে তাকিয়ে চিনতে পারল না স্বপ্নেন্দু। লোকটা বলল, ‘টিভি চালু হয়েছে?
অবনীদা মাথা নাড়ল, ‘জানি না। ওটা ছেলে বগলদাবা করে সরে পড়েছে। বাড়ির সব জিনিস সে হাওয়া করে দিচ্ছে।’
‘কেন?’
‘এখন পড়ে থাকা নাকি মূর্খামি। এমনকী সে তার মাকে বলছে, তুমি আর মা কোথায়, মা হতে হলে তো মেয়েমানুষ হতে হয়।’
স্বপ্নেন্দু আর দাঁড়াল না। তার মন খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। পাশের বাড়ির জানলায় একটি মুখ চিৎকার করে উঠল, ‘কে-কে?’
‘আমি স্বপ্নেন্দু।’
‘ও তুমি। আমি তোমার হরিজ্যাঠা। কিন্তু তুমি স্বপ্নেন্দু তার প্রমাণ কী? আজকাল তো কাউকে বোঝা যায় না। বাপের নাম বলো?’
‘আমার বাবা আপনার বন্ধু ছিলেন। ঈশ্বর তারকনাথ—।’
‘ও বুঝেছি। উই হ্যাভ লস্ট আওয়ার আইডেন্টিফিকেশন। সাম্যবাদ। সাম্যবাদ। কম্যুনিজম! তোমার মুখ্যমন্ত্রী যা বোঝাবেন তাই বুঝতে হবে? বাবা ছেলের দিকে তাকিয়ে চিনতে পারে না। মেয়েকে আর মেয়ে বলে মনে হয় না। হ্যাঁ, শোনো। সবসময় দরজা বন্ধ রাখবে বাবা। কোনও সিকিউরিটি নেই। যে-কোনও মুহূর্তেই বাড়ি লুঠ হতে পারে। বড়রাস্তায় কী হয়েছে শুনেছ?’
‘শুনেছি।’
‘দাঙ্গার সময় এরকম হতো। তখন কারণটা বোঝা যেত। আমি তো দরজা খুলছি না। যা কথা বলার জানলা দিয়ে বলো।’
স্বপ্নেন্দু সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এল। এই সিঁড়ির মুখে কোনও দরজা নেই। ওপরে উঠে পাশাপাশি দুটো ফ্ল্যাট। নিচে দরজা থাকলে কে বন্ধ করবে সেই ঝামেলায় ওটা খোলা রাখা রয়েছে।
ঘরের দরজা বন্ধ করে স্বপ্নেন্দু টেবিলের কাছে চলে এল। চাদর সরাতে ঝাপসা লাল রঙ চোখে পড়ল। সন্তর্পণে বড় জারটা খুলতেই ছোট কাচের বাটির মধ্যে রক্তগোলাপটাকে স্পষ্ট দেখা গেল। সেই একই রকম সতেজ, ডাঁটো পাপড়ি। আর কী আশ্চর্য, সেই জলের ফোঁটাটাও অবিকল রয়ে গেছে। স্বপ্নেন্দু বুঝতে পারছিল একটু হাওয়ার স্পর্শ পেলে ফুলটা হয়তো ছাই হয়ে যাবে। সে কৃপণের মতো ফুলটার দিকে তাকাল। আঃ, হৃৎপিণ্ড ক্রমশ শান্তিতে ভরে যাচ্ছে। কী আরাম।
একটা তোয়ালে নিয়ে মুখ পরিষ্কার করল সে। ধুলো লেগেছিল করোটিতে। তোয়ালেতে বেশ ময়লা। নিজের জামাকাপড় খুলে সে খাটের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। জানলা দিয়ে হাওয়া ঢুকছে ঘরে। ঝিরঝিরে হাওয়া তার হাড়ের মধ্যে দিয়ে স্বচ্ছন্দে এপাশ-ওপাশ করছে। শীতকালে কী হবে? তখন কি হাড় কনকন করবে?
স্বপ্নেন্দুর মনে হেনা সেনের মুখ ভেসে উঠল। নরম চিবুক, গলায় স্বরে এখনও আগের মমতা। হেনা কি তাকে ভালোবেসেছে? স্বপ্নেন্দুর হৃৎপিণ্ড কেঁপে উঠল। আর কিছু চায় না সে। শুধু হেনা ভালোবেসে তার পাশে থাক। ওর সেই মায়া-চোখ আদুরে গাল, মোহিনী হাসি, দম-বন্ধ করা বুক নাই থাকল, কিন্তু হেনা তো আছে। আজ বিকেলে যা দেখল এবং শুনল তাতে কলকাতার পরিবেশটা কাল কী হবে অনুমান করা যাচ্ছে না। মানুষের চরিত্র খুব দ্রুত পালটে যাচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হেনাকে বিয়ে করা দরকার। স্বপ্নেন্দু বিছানা ছেড়ে উঠল। তারপর টেলিফোন ডাইরেক্টরি দেখে ম্যারেজ রেজিস্ট্রারকে ফোন করল।
‘হ্যালো। ম্যারেজ রেজিস্ট্রার অফিস?’
‘হ্যাঁ। কী চাই?’
‘এখন বিয়ে করতে গেলে নোটিশ দিতে হয়?’
‘বিয়ে? কে বিয়ে করবে?’
‘আমি।’ কথাটা বলতে একটু লজ্জা বোধ করল স্বপ্নেন্দু।
‘আপনি কি পাগল হয়ে গিয়েছেন?’
‘মানে? এটা কি ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিস নয়? এস কে রায়—।
‘হ্যাঁ ঠিকই।’
‘আপনার ওখান থেকে আমার এক বন্ধু মাস তিনেক আগে রেজিস্ট্রি করেছে। পাগল বলছেন কেন?’
‘আপনি কাকে বিয়ে করবেন?’
‘যাকে ভালোবাসি তাকে।’
‘তিনি ছেলে না মেয়ে?’
‘কী আজেবাজে কথা বলছেন?’
‘মাপ করবেন। এখন তো কেউ আর ছেলে কিংবা মেয়ে প্রমাণ করতে পারছেন না। ফলে বিয়ে হবে কী করে? পুরোনো আইনে আছে পুরুষ এবং মহিলার মধ্যে বিয়ে হতে পারে। পুরুষে-পুরুষে কিংবা মহিলায়-মহিলায় অথবা নপুংসকদের মধ্যে বর্তমানে বিবাহের কোনও আইন নেই। বুঝলেন মশাই?’ হাসলেন রেজিস্ট্রার। শব্দ হল।
‘সে কি? এখন তাহলে বিয়ে হবে না?’
‘না। তাছাড়া আপনি তো তাজ্জব মানুষ। যেখানে এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানুষ উন্মাদ হয়ে উঠেছে, সম্পর্ক ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে সেখানে আপনি বিয়ের কথা ভাবছেন? ইটস এ নিউজ। খবরের কাগজে ছাপা হওয়া উচিত।’ হে-হে করে হেসে উঠলেন রেজিস্ট্রার।
বিরক্ত এবং হতাশ স্বপ্নেন্দু বলল, ‘জ্ঞান দেবেন না। তাহলে আপনি আছেন কী করতে? আপনার চাকরি তো গেল!’
‘গেল। দুহাতে এতকাল কামিয়েছি ভাই। সব গেল। তবে একটা সুখবর আছে। আপনি সরকারের কাছ থেকে সার্টিফিকেট নিতে পারেন।’
‘সার্টিফিকেট?’
‘হ্যাঁ। আপনি অমুক চন্দ্র অমুক, এক্স শ্রীমতী অমুকের সঙ্গে একসঙ্গে থাকতে চান। এ বিষয়ে এক্স শ্রীমতীর কোনও আপত্তি নেই। তাকেও সই করতে হবে। সরকার আপনাদের পাঁচ বছর একত্রে থাকার অনুমতি দেবেন।’
‘পাঁচ বছর?’
‘স্টেয়িং টুগেদার। তারপর ইচ্ছে করলে ছাড়াও যেতে পারে, আবার ওটা রিনিউ করাতেও পারেন। আগে বিবাহিত জীবন কতদিন টিকত? পঞ্চাশ-ষাট বড়জোর সত্তর। তার বেশি নয়। কিন্তু এখন অনন্ত জীবন। তাই এই ব্যবস্থা। আগে হলে এত কথার জন্যে দক্ষিণা চাইতাম, এখন কী ঠিক করলেন জানাবেন। আমিই না হয় সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা করে দেব।’
‘সার্টিফিকেট যদি না চাই?’
‘মিটে গেল গোল।’ ওপাশ থেকে লাইনটা কেটে দেওয়ার শব্দ হল। রিসিভার নামিয়ে রেখে স্বপ্নেন্দু কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। যাঃ শালা, এই কঙ্কাল শরীরে বিয়েরও ব্যবস্থা নেই। ওর মনে হল মুখ্যমন্ত্রী এই পরিবর্তিত অবস্থার কথা এতটা না ভাবলেও পারতেন। হেনা সেনের মনে পুরোনো সংস্কার জড়িয়ে আছে। বিয়ে ছাড়া একসঙ্গে থাকতে চাইলে হয়! যতই সুন্দরী হও, আধুনিকা হও—বিয়েটি চাই।
এই সময় বাইরে খুব হইচই শোনা গেল। স্বপ্নেন্দু জানলায় গিয়ে দাঁড়াতেই দেখতে পেল তিন-চারজন লোক একটা লোককে ঘিরে ধরেছে। লোকটা মোটরবাইকে বসে। লোকগুলো ওকে টানাটানি করছে। লোকটার কঙ্কাল বেশ রোগাপটকা। হঠাৎ মুখ তুলে সে স্বপ্নেন্দুকে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘দেখুন, এরা আমার বাইক কেড়ে নিতে চাইছে। দিনদুপুরে ছিনতাই করছে!’ লোকগুলো হাসল। একজন বলল, ‘এ বাইক তোর তার প্রমাণ কী?’
‘আমার লাইসেন্স আছে। এই দেখুন!’
‘হে হে হে। এ তো রক্তমাংসের মানুষের ছবি। তোর ছবি তার কী প্রমাণ?’
লোকটা প্রতিবাদ করছিল কিন্তু ওরা ওকে টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে বাইকটাকে নিয়ে চলে গেল।