লিফটের সামনে বিরাট লাইন। পাশাপাশি দুটো লিফট, কিন্তু একটার বুকে আউট অফ অর্ডার-এর লকেট ঝোলানো। ফলে লাইন লম্বা হয়েছে। স্বপ্নেন্দু রুমালে মুখ মুছতে-মুছতে গেট পেরিয়ে থমকে দাঁড়াল। যাঃ শালা।
এখন ঘড়িতে এগারোটা বাজতে দশ। পৌনে এগারোটায় মিসেস বক্সী দেখা করতে বলেছেন। অলরেডি পাঁচ মিনিট লেট। যেভাবে বাসে ঝুলে আসতে হয়েছে তাতে আটতলায় হেঁটে ওঠা অসম্ভব ব্যাপার। সে চোখ বুলিয়ে লাইনের লোক গুনতে লাগল। আটজনের বেশি যদি না নেয় তা হলে তার সুযোগ আসবে চতুর্থ দলে। কী করা যায় বুঝে উঠছিল না স্বপ্নেন্দু। এই সময় তার সমস্ত ইন্দ্রিয় লাফিয়ে উঠল। হেনা সেন! মুহূর্তেই এই একতলাটা যেন বিয়েবাড়ি হয়ে গেল। হেনা সেন ধীরেসুস্থে লাইনের শেষে দাঁড়াতেই স্বপ্নেন্দু চট করে তার পিছনে দাঁড়াল!
হেনা সেন এই আটতলা অফিসের সবচেয়ে সুন্দরী মহিলা। সুন্দরী বললে কম বলা হবে, মহিলার শরীরে যেন ঈশ্বর মেপে-মেপে জাদু মাখিয়ে দিয়েছেন। অমন সুন্দর গড়নের বুক এবং নিতম্ব এবং তার সঙ্গে মেলানো অনেকটা উন্মুক্ত কোমর দেখলেই কলজেটা স্থির হয়ে যায়। মহিলা যখন কথা বলেন তখন আফসোস হয়, কেন শেষ হল। হেনা সেনের সঙ্গে স্বপ্নেন্দুর আলাপ নেই। এতদিন হেনা বসতেন তিনতলায়। সেখানকার বড় অফিসারের সঙ্গে কী একটা গোলমাল হয়ে যাওয়ায় ট্রান্সফার নিয়ে গত পরশু আটতলায় এসেছেন। পদমর্যাদায় স্বপ্নেন্দু অনেক ওপরে, কিন্তু এই বাড়িতে হেনাকে চেনে না এমন কেউ নেই। কিন্তু তাকে?
স্বপ্নেন্দু বাতাসে অসম্ভব মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছিল। সেটা যে সামনের শরীরটা থেকে আসছে তা অন্ধও বলে দিতে পারবে। সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে জামার কলার ঠিক করল। মুখটা অকারণে রুমালে মুছল। যদিও হেনা সেনের চোখ এখন লিফটের দিকে তবু সে নিজেকে স্মার্ট করার চেষ্টা চালাচ্ছিল। মহিলার মাখনরঙা ভরাট পিঠ আর ঘাড় দেখে স্বপ্নেন্দুর মনে হল ওর শরীরে যেন অজস্র ফগ চাপ বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দুর্ধর্ষ! লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন না ফুলের বাগানে—ভঙ্গি দেখলে ঠাওর করা মুশকিল। এখনও পর্যন্ত এই অফিসের কোনও রাঘব বোয়াল ওঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। মহিলার নাকি আত্মসম্মানবোধ খুব।
স্বপ্নেন্দু মিসেস বক্সীর মুখটা মনে করল। আজ ঠিক চিবিয়ে খাবেন তাকে। আটতলার সুপ্রিম বস মিসেস বক্সী। পাঁচ ফুটি ফুটবল। গায়ের রঙ অসম্ভব ফরসা কিন্তু শরীরে কোনও খাঁজ নেই, মুখটা বাতাবি লেবুর কাছাকাছি। সেই মুখে সিগারেট গুঁজে ইংরেজিতে ধমকান। জরুরি মিটিং ছিল। হেনা সেনের কোমরের দিকে তাকিয়ে স্বপ্নেন্দু বলল, থাক মিটিং। লিফটে লাইন পড়লে সে কী করবে। সঙ্গে-সঙ্গে তার খেয়াল হল, মিসেস বক্সী ইচ্ছে করলে তাকে বদলি করে দিতে পারেন।
স্বপ্নেন্দু ঠোঁট কামড়াল। ঠিক সেইসময় হেনা সেন পিছন ফিরে তাকালেন। স্বপ্নেন্দু হাসবার চেষ্টা করল। আহা, কী বুক। হেনা সেন জিগ্যেস করলেন, ‘আপনি কি কিছু বললেন?’
‘আমি? না তো।’ কলজেটা যেন এক লাফে গলায় উঠে এসেছে।
‘মনে হল!’ হেনা সেন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন।
‘না! মনে এই লাইনটার কথা ভাবছিলাম।’ স্বপ্নেন্দুর খেয়াল হল মিসেস বক্সীর বিরুদ্ধে জেহাদটা বোধহয় কিছুটা ঠোঁট ফসকে বেরিয়েছে।
‘লাইন? লাইনের কথা কেউ আবার শব্দ করে ভাবে নাকি?’ হেনা সেন ততক্ষণে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। স্বপ্নেন্দুর খুব ইচ্ছে করছিল কথা বলতে। তার পিছনে এখন আরও দশ-বারো জন দাঁড়িয়ে গিয়েছে।
সে বলল, ‘আপনি তো আটতলায় এসেছেন।’
‘হ্যাঁ।’
‘আমি ওখানকার ডি. ও.। আমার নাম স্বপ্নেন্দু সোম।’
‘স্বপ্নেন্দু? বেশ সুন্দর নাম তো?’
কথাগুলো তার মুখের দিকে না তাকিয়ে বলা। তবু স্বপ্নেন্দুর মনে হল তার নামটাকে এমন সুন্দর করে আজ পর্যন্ত কেউ উচ্চারণ করেনি। লাইনটা টুকুটুক করে এগোচ্ছিল মাঝে-মাঝে। এবারে ওদের সুযোগ এসে গেল। হেনা সেনের হাঁটা দেখে স্বপ্নেন্দুর মনে হল দুটো জমাট ঢেউ পাশাপাশি দুলে গেল। লিফটে জায়গা ভরাট। হেনা সেন ওঠার পর লিফটম্যান দরজা বন্ধ করে দিতে যাচ্ছে দেখে স্বপ্নেন্দু এক চিলতে জায়গায় পা রেখে শরীরকে সেঁধিয়ে দিল। ফলে তাকে এমনভাবে দাঁড়াতে হল যে হেনা সেনের শরীরের অনেকটাই তার শরীরে ঠেকেছে। এত নরম আর এত মধুর কিন্তু এত তার দাহিকাশক্তি যে স্বপ্নেন্দুর মনে হল সে মরে যাবে। আর এই লিফটটা যদি অনন্তকাল চলত। যদি আটতলা ছাড়িয়ে একশো আটতলায় উঠে যেত। কিংবা এই মুহূর্তে লোডশেডিং-ও তো হতে পারত। মাঝামাঝি একটা জায়গায় লিফটটাকে বেশ কয়েক ঘণ্টা আটকে থাকতে হতো তাহলে। কিন্তু এসব কিছুই হল না। বিভিন্ন তলায় যত লোক নামছে তত হেনা সেনের সঙ্গে তার দূরত্ব কমছে। সাততলায় যখন লিফট তখন একহাত ব্যবধান।
স্বপ্নেন্দুর মনে হল তার শরীরে যেন হেনা সেনের বিলিতি গন্ধ কিছুটা মাখামাখি হয়েছে। সে গাঢ় গলায় বলল, ‘যদি কোনও প্রয়োজন হয় তাহলে আমাকে বলবেন মিস সেন।’
‘ওমা আমাকে আপনি জানেন?’
‘চিনি কিন্তু জানি না।’ কথাটা খুব নাটকীয় ভঙ্গিতে বলতেই লিফটের দরজা খুলে গেল। হেনা সেন এমন অপাঙ্গে তাকালেন যে স্বপ্নেন্দু রুমাল মুখে তুলল।
দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসতেই হরিমাধব ছুটে এল, ‘আপনাকে ম্যাডাম আধঘণ্টা ধরে খুঁজছেন। খুব খেপে গেছেন।’
‘খেপে গেছেন?’
‘হ্যাঁ। ইংরেজিতে গালাগাল দিচ্ছিলেন একা বসে।’
স্বপ্নেন্দু দেখল চলে যেতে-যেতে হেনা সেন আবার অপাঙ্গে তাকালেন। কিন্তু এবার তাঁর ঠোঁটে যে হাসি ঝোলানো তার মানেটা বড় স্পষ্ট। মনে-মনে হরিমাধবের ওপর প্রচণ্ড চটে গেল স্বপ্নেন্দু। একদম প্রেসটিজ পাংচার করে দিল বুড়োটা। সে গম্ভীরমুখে নিজের ঘরে এসে বসল।
এই অফিসে সে দুই নম্বর। তার নিচে অন্তত আশিজন কর্মচারী। কিন্তু সবচেয়ে খারাপ অবস্থা তার। ওপরতলা কারণে-অকারণে তাকে ধমকাচ্ছে। আবার নিচের তলার লোকজন সুযোগ পেলেই চোখ রাঙিয়ে যায়। নিচের তলায় কর্মচারীদের ইউনিয়ন আছে। সে না ঘাটকা না ঘরকা। হরিমাধবকে ডেকে এক গ্লাস জল দিতে বলে স্বপ্নেন্দু ট্রান্সফার অ্যান্ড পোস্টিং-এর ফাইলটা খুলে বসল। হেনা সেনকে দেওয়া হয়েছে স্ট্যাটিসটিকে। কোনও কাজ নেই সেখানে। মাসে দুবার রিপোর্ট পাঠালেই চলে। তা ছাড়া, বুড়ো হালদার আছে চার্জে। লোকটা কাজপাগলা মানুষ। ওর সেকশনের সবাই ওর কাঁধে কাজ চাপিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এই অফিসে একটা কথা চালু আছে, স্ট্যাটিসটিক হল পানিশমেন্ট সেল। কোনও পার্টি ওই টেবিলে কোনওদিন যাবে না। সবাই পোস্টিং চায় সেকশনে। হেনা সেনকে ইচ্ছে করেই স্ট্যাটিসটিকে দেওয়া হয়েছে। মিসেস বক্সীর কাণ্ড এটা। এইসময় টেলিফোন বাজল।
‘সোম স্পিকিং।’
‘হোয়াট ডু য়ু ওয়ান্ট?’ মিসেস বক্সীর গলা।
‘মানে?’
‘কাম শার্প। এক্ষুনি চলে আসুন।’
জলটা খেয়ে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল স্বপ্নেন্দু। পকেট থেকে চিরুনি বের করে চুলে বুলিয়ে নিল। তারপর দ্রুত পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। মিসেস বক্সীর ঘরটা বিশাল। কার্পেটে মোড়া। ঘোরানো চেয়ার এবং টেবিল ছাড়াও এক কোণে কালো ডেকচেয়ার রয়েছে বিশ্রাম নেওয়ার জন্যে। দরজা খুলে ভিতরে পা দিতেই মিসেস বক্সীর মুখের সিগারেট দুলতে লাগল, ‘এইরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন অফিসার পেলে আপনি কী করতেন?’
‘মানে?’
‘আপনার কটায় আসার কথা ছিল?’
‘ট্র্যাফিক জ্যাম ছিল ম্যাডাম! তার ওপর লিফট খারাপ।’
‘এইসব সিলি বাহানা কেরানিরা দেয়। আপনি কি ডিমোশন চান!’
স্বপ্নেন্দু মাথা নিচু করল, ‘সরি, কিন্তু এটা অনিচ্ছাকৃত।’
‘আই অ্যাম ফেড আপ। আপনারা কী ভেবেছেন? এটা অফিস না অন্য কিছু? দশটায় অ্যাটেন্ডেন্স। আমি সাড়ে দশটা পর্যন্ত প্রত্যেককে গ্রেস দিয়েছি। কিন্তু এগারোটায় অ্যাটেন্ডেন্স টোয়েন্টি পার্সেন্ট। আপনি ডি. ও. হয়েও ঠিক সময়ে আসছেন না। এক্সপ্লেইন।
‘আমি দুঃখিত।’
‘দ্যাটস দি অনলি ওয়ার্ড য়ু নো। দিস ইজ লাস্ট ওয়ার্নিং।’ সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে মিসেস বক্সী বললেন, ‘বসুন।’
চেয়ারটা টেনে সন্তর্পণে বসল স্বপ্নেন্দু। মহিলা চেয়ারে এমন ডুবে গেছেন যে শুধু মুখ আর বুকের অর্ধাংশ টেবিলের ওপর দৃশ্যমান। বুকের কোনও আদল নেই, যেন দুটো মাংসের তাল এক করে রাখা। স্বপ্নেন্দুর মনে চট করে হেনা সেনের শরীর ভেসে উঠল।
মিসেস বক্সী এবার একটা ফাইল খুললেন, ‘আমার কাছে ক্রমাগত কমপ্লেন আসছে। এই অফিসে এখন ঘুষের ফেস্টিভ্যাল চলছে।’
‘ফেস্টিভ্যাল?’
‘ইয়েস। প্রকাশ্যে যখন ঘুষ নেওয়া হচ্ছে তখন ফেস্টিভ্যাল ছাড়া আর কী বলব? ডি. ও. হয়ে আপনি সেসব খবর জানেন?’
‘অনুমান করতে পারি।’
‘কোনও স্টেপ নিয়েছেন?’
‘স্পেসিফিক কমপ্লেন না থাকলে স্টেপ নেওয়া মুশকিল।’
‘বাট আই ওয়ান্ট টু স্টপ ইট। তোমরা চাই-চাই বলে ইউনিয়ন করবে আবার ঘুষ ছাড়া কোনও কাজ করবে না, এটা হতে পারে না। কীভাবে স্টপ করা যায়?’
এটা খুব জটিল ব্যাপার। এই অফিস ব্যবসায়ীদের জরুরি ব্যাপার নিয়ে কাজ করে। বিভিন্ন সেকশনে তাদের আসতে হয়। দ্রুত কাজ কিংবা কিছু বিপদমুক্ত হওয়ার জন্য তারা পয়সা খরচ করে। কেরানিদের যেটা হাতে নেই তার জন্যে অফিসাররা আছেন। দশজন অফিসার। তারা যেসব কেস নিয়ে ডিল করেন সেখানে মোটা টাকার ব্যাপার। বেশ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান আছে এ ব্যাপারে। অফিসাররা কখনও কমপ্লেন করেন তাঁর অধস্তন কেরানি ঘুষ নিচ্ছে। এটা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সবার ধারণা যে কোনও কাজ করলেই পার্টিরা টাকা দিতে বাধ্য। এমনকী তার রুটিন ডিউটি করলেও।
স্বপ্নেন্দু ডি. ও.। অফিস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, মাইনেপত্র এবং রিপোর্টস সঠিক রাখার দায়িত্ব তার ওপর। পার্টিদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই। সে লক্ষ করেছে হরিমাধব তার পিওন হওয়ায় খুব অখুশি। প্রায় সে অনুরোধ করে বদলির জন্য। তার সমান মাইনের অফিসাররা গাড়িতে অফিসে আসেন, প্লেন ছাড়া বেড়াতে যান না। মনে-মনে বেশ ঈর্ষা বোধ করে স্বপ্নেন্দু। কিন্তু এসব বন্ধ করা যায় কী করে?
‘বোবা হয়ে থাকবেন না। ব্যাচেলাররা যে এমন—!’ কাঁধ নাচালেন মিসেস বক্সী। ‘কিছু বলুন।’
‘দেখুন।’ একটু কাশল স্বপ্নেন্দু। ‘এটা খুব জটিল ব্যাপার। অভ্যেসটা নিচ থেকে ওপরে সর্বত্র। কাকে বাদ দিয়ে কাকে ধরবেন?’
‘ওপরে মানে?’
‘আমি শুনেছি অফিসাররাও একই দোষে দোষী।’
‘দ্যাটস নট আওয়ার বিজনেস। ওদের জন্যে আরও ওপরতলার লোক আছেন। কিন্তু দশ-পাঁচ-একশো টাকার হরির লুট বন্ধ করা ডি. ও. হিসেবে আপনার কর্তব্য।’
‘আমার?’
‘হ্যাঁ। আপনি অফিস বস।’
‘বলুন, কী করতে হবে?’
‘আপনি ট্রান্সফার করুন। আজকেই একটা লিস্ট এনে দিন আমাকে। একটা সেকশনে যে ছমাস আছে তাকে স্ট্যাটিস্টিক কিংবা এস্টাব্লিশমেন্টে পাঠিয়ে দিন। আর নোটিশবোর্ড ঝুলিয়ে দিন কোনও পার্টি অফিসের ভেতর ঢুকতে পারবে না। তাদের যদি কোনও প্রয়োজন থাকে তাহলে রেসপেকটিভ অফিসারের সঙ্গে যেন দেখা করে। প্রথমে এটা করুন তারপর দেখা যাবে।’ মিসেস বক্সী আবার সিগারেট ধরালেন।
স্বপ্নেন্দু তখনও ইতস্তত করছিল, ‘এ নিয়ে খুব ঝামেলা হবে।’
‘ঝামেলা? চাকরিতে ঢোকার সময় তাদের কি বলা হয়েছিল যে যত ইচ্ছে ঘুষ নিতে পারবে? তা ছাড়া, আপনি ব্যাচেলার মানুষ, আপনার ভয় কীসের? বোল্ড হন মশাই, চিরকাল মিনমিন করে গেলে কোনও লাভ হবে না।’
নিজের ঘরে ফিরে এল স্বপ্নেন্দু। ব্যবস্থাটা তার ভালো লাগছিল না। সে নিজে কখনও ঘুষ নেয়নি। হয়তো ঘুষ নেওয়ার বড় সুযোগ তার আসেনি বলে নেয়নি কিংবা এখনও মনে কিছু রুচি এবং নীতিবোধ কটকট করে বলে নেওয়ার প্রবৃত্তি হয়নি। কিন্তু এই হুকুমটা কার্যকর করতে গেলে ভিমরুলের চাকে ঘা পড়বে। তা ছাড়া, কেরানিদের চোখ রাঙাব আর অফিসারদের আদর করব, এ কেমন কথা।
ঠিক তখনই টেলিফোনটা শব্দ করল। ওপাশে তিন নম্বর অ্যাসেসমেন্ট অফিসার মুখার্জি, ‘সোম। বক্সীর বাক্সের চাবিকাঠি তোমার হাতে, আমাকে উদ্ধার করো ভাই।’
‘কী হয়েছে?’
‘একটা মোর দ্যান লাখ কেসে ওঁর অ্যাপ্রুভাল দরকার ছিল। ফাইলটা চেপে রেখেছেন। একবার বলেছিলাম, কোনও কাজ হয়নি। পার্টি বলল, উনি পঞ্চাশ চেয়েছেন। আমি অ্যাসেসমেন্ট অফিসার, কষ্ট করে মাছ জালে ঢোকালাম উনি তার ঝোল খাবেন। বোঝো?’
‘দেখি।’ বলে রিসিভার নামিয়ে রাখল স্বপ্নেন্দু। মিসেস বক্সীর বিরুদ্ধে মাঝে-মাঝে এ ধরনের অভিযোগ হাওয়ায় ভাসে। পাঁচশো-হাজার নয়, বিশ-পঁচিশের কারবারি উনি। পঞ্চাশ এই প্রথম শুনল স্বপ্নেন্দু। এখন সেই মহিলা তাকে নির্দেশ দিচ্ছেন দশ টাকা, বিশ টাকা যারা নেয় তাদের থামাতে হবে।
হরিমাধবকে হুকুম করল সে, ‘বড়বাবুকে পাঠিয়ে দাও।’
বড়বাবু চাকলাদার খুব ভালো মানুষ। সাতে-পাঁচে থাকেন না। আর মাত্র তিনমাস বাকি আছে অবসরের। স্বপ্নেন্দুর ধারণা, লোকটা সৎ।
ঘরে ঢোকামাত্র সে জিগ্যেস করল, ‘আপনি ঘুষ নেন?’
হাঁ হয়ে গেলেন চাকলাদার। তারপর কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, ‘নিতাম। কিন্তু এখন নিই না।’
‘কেন নিতেন, কেন নেন না?’
চাকলাদার নুইয়ে পড়লেন, ‘তখন অভাবের তাড়নায় না নিয়ে পারিনি। কিন্তু ভিক্ষে নিচ্ছি বলে ঘেন্না হয়। তাছাড়া আজ বাদে কাল চলে যাব, এখন আর নোংরা হওয়ার প্রবৃত্তি হয় না।’
স্বপ্নেন্দু লোকটিকে দেখল। মনে হল মিথ্যে বলছেন না। তারপর নিচু গলায় বলল, ‘এই অফিসের যে সমস্ত কেরানিরা ঘুষ নেয় তাদের ট্রান্সফার করতে হবে। ম্যাডামের অর্ডার। আপনি লিস্ট করুন।’
‘সে তো ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে।’
‘হোক।’
‘আর তিন মাস আছি। কেন আমাকে বিপদে ফেলছেন স্যার। ‘
‘কেউ জানবে না। খুব গোপনে করুন। অর্ডারটা আমি এখানে টাইপ করাব না। যান।’
চাকলাদার চলে যেতে স্বপ্নেন্দু চোখ বন্ধ করল। আর সঙ্গে-সঙ্গে হেনা সেনের শরীরটা ভেসে উঠল। সে বিয়ে-থা করেনি। মাত্র তিরিশ বছর বয়স। সরাসরি অফিসার হয়ে ঢুকেছে পরীক্ষা দিয়ে। সামনে ব্রাইট ক্যারিয়ার। কিন্তু হেনা সেন তাকে গুলিয়ে দিল। মহিলার মধ্যে অদ্ভুত মাদকতা আছে। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে সে আবার হরিমাধবকে ডাকল, ‘শোনো স্ট্যাটিস্টিক থেকে মিস সেনকে ডেকে আনো।’
‘উনি এখন অফিসে নেই স্যার।’
‘নেই? তুমি জানলে কী করে?’
‘উনি যে এসেই ক্যান্টিনে যান বিশ্রাম করতে।’
স্বপ্নেন্দু অবাক হয়ে গেল। আচ্ছা ফাঁকিবাজ মহিলা তো। সে বিরক্ত গলায় বলল, ‘ক্যান্টিন তো এই বাড়িতেই। সেখান থেকে ডেকে নিয়ে এসো।’
হরিমাধব চলে যাওয়ার পর স্বপ্নেন্দুর মনে হল না ডাকলেই হতো।
হয়তো মহিলা অসুস্থ, বাইরে থেকে ঠাওর করা যায় না। তাছাড়া ওরকম সুন্দরী মহিলাদের একটু-আধটু সুবিধা দেওয়া দরকার। দশটা-পাঁচটা কলম পিষলে কি ওই শরীর থাকবে? কিন্তু সেই সঙ্গে স্বপ্নেন্দুর ভেতরটা খুব চঞ্চল হয়ে উঠল। সে চট করে চুলটা আঁচড়ে রুমালে মুখ ঘষে নিল। কাল থেকে দুটো রুমাল নিয়ে বেরোতে হবে। একটা খুব দ্রুত ময়লা হয়ে যায়।
আবার টেলিফোন বাজল। ওপাশে সুজিত। ফিল্মে অভিনয় করে বেশ পরিচিত হয়েছে। একসঙ্গে কলেজে পড়ত এবং যোগাযোগ আছে। সুজিত জিগ্যেস করল, ‘কাল বিকেলে কী করছ?’
‘কিছুই না।’
‘চলে এসো আমার বাড়িতে সন্ধে সাতটায়। ফিল্মের কিছু মানুষ আসবে। একটা গোপন খবর ঘোষণা করব।’
‘কী খবর?’
‘উঁহু এখন বলব না। ওটা সারপ্রাইজ থাক। এসো কিন্তু। শুধু বলছি আমি বিয়ে করছি। দারুণ, দারুণ এক মহিলাকে।’
কট করে লাইনটা কেটে দিল সুজিত। রিসিভারটার দিকে তাকিয়ে কেমন যেন ঈর্ষাবোধ করল সে। এমন কিছু ভালো দেখতে নয় কিন্তু সুজিত আজ বিখ্যাত। প্রচুর টাকা পাচ্ছে এবং সেইসঙ্গে দারুণ মহিলাকে বিয়ে করছে। আর সে একটা স্টুডেন্ট হয়েও কলা চুষছে। রাস্তাঘাটে কোনও মেয়ে তার দিকে তেমনভাবে তাকায় না। কলেজ লাইফে সুজিতের থেকে তার সম্ভাবনা অনেক বেশি ছিল।
এই সময় দরজায় শব্দ হতেই মুখ তুলে তাকাল স্বপ্নেন্দু। মনে হল দম বন্ধ হয়ে যাবে তার। হেনা সেনের মুখ থমথমে, ‘ডেকেছেন।’
উঠে দাঁড়াতে গিয়ে খেয়াল হল সে অফিসার। হাত বাড়িয়ে চেয়ারটা দেখিয়ে বলল, ‘বসুন। আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে।’
হেনা সেন এগিয়ে এলেন রাজহাঁসের ভঙ্গিতে।’ ‘কী ব্যাপার?’
‘আগে বসুন, দাঁড়িয়ে কথা বলা শোভন নয়।’
ব্যাপারটা যেন হেনা সেনের মনঃপুত হচ্ছিল না। তবু চেয়ারখানা সামান্য টেনে নিয়ে থমথমে মুখে তিনি বসলেন। স্বপ্নেন্দু সেটা লক্ষ করল। তারপর জিগ্যেস করল, ‘এই অফিসের পরিবেশ আপনার কেমন লাগছে?’
‘ভালোই।’
‘কিন্তু আমার ওপরওয়ালা মনে করেন পরিবেশ আদৌ ভালো নয়। তিনি চান অবস্থার উন্নতি করতে। আপনি সেকশনে আসতে চান?’
‘সেকশনে? না-না। ওখানে অনেক ঝামেলা। আমি বেশ আছি।’
‘কিন্তু মিসেস বক্সী আপনাকে সেকশনে পাঠাতে বলেছেন।’
এবার হাসলেন হেনা সেন, ‘উনি আমাকে সহ্য করতে পারেন না। আপনি নিশ্চয়ই কারণটা বুঝতে পারছেন। সেকশনে যাওয়ায় যাদের ইন্টারেস্ট আছে তাদের পাঠান। আমি চলি।’
‘একটু বসুন।’ স্বপ্নেন্দু খুব অসহায় বোধ করছিল, ‘একটা কথা, এইসব আলোচনার কথা অফিসে গিয়ে বলবেন না।’
‘কেন?’
‘এটা টপ সিক্রেট।’
‘তাহলে আমাকে জানালেন কেন?’
ঠোঁট কামড়াল স্বপ্নেন্দু, ‘আমার মনে হয়েছিল আপনাকে বিশ্বাস করা যায়।’
‘ধন্যবাদ।’ হেনা সেন সামান্য মাথা দুলিয়ে ঘর ছেড়ে চলে যেতে-যেতে ঘুরে দাঁড়ালেন, ‘আমি ভেবেছিলাম আপনি আমাকে এক্সপ্লেনই করতে বলবেন কেন আমি অফিসে এসেই ক্যান্টিনে যাই।’
‘আপনি জানেন আমি সেটা পারি না।’
‘আমি জানি?’
‘জানা উচিত।’
এবার হাসিটা আরও মিষ্টি হল। তারপর বেরিয়ে গেলেন হেনা সেন। কয়েক মুহূর্ত বাদে স্বপ্নেন্দুর খেয়াল হল, এ কী করল সে। একজন অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে চরম অন্যায় হয়ে গেল। শুধু একজন সুন্দরী মহিলার শরীর দেখে সে মাথা খারাপ করে ফেলল? এখন উনি যদি অফিসে বলে বেড়ান তাহলে ম্যাডাম তাকে চিবিয়ে খাবেন। অথচ এখন আর কিছু করার নেই।
বিকেলে অফিসে হইচই পড়ে গেল। হেনা সেন নয়, কী করে যে খবর ফাঁস হয়ে গেছে তা কেউ জানে না। হয়তো হরিমাধব কিংবা বক্সীর বেয়ারা অথবা বড়বাবু, সোর্সটা বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু অফিসের সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গেল। ঝেঁটিয়ে ট্রান্সফার হচ্ছে এই খবরটা আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল; বিকেল চারটেয় জানতে পারল স্বপ্নেন্দু। একজন ছাপ্পান্ন বছরের প্রৌঢ় এসে হাত জোড় করে দাঁড়ালেন, ‘স্যার, আমাকে ধনে-প্রাণে মারবেন না।’
‘কী হয়েছে?’
‘আমার তিনটে মেয়ে। সেকশন থেকে সরিয়ে দিলে ওদের বিয়ে দিতে পারব না। একদম ভরাডুবি হয়ে যাবে স্যার।’ কেঁদে ফেললেন ভদ্রলোক।
‘আপনি জানলেন কী করে?’ স্বপ্নেন্দু সোজা হয়ে বসল।
‘সবাই জানে স্যার।’
তারপর একটার পর একটা অনুরোধ। কারও মেয়ের বিয়ে হয় না, কারও সংসার চলবে না। অফিস থেকে চিৎকার চেঁচামেচি ভেসে আসছিল। স্বপ্নেন্দু টেলিফোন করল মিসেস বক্সীকে। বেজে গেল টেলিফোন। হরিমাধব খোঁজ নিয়ে জানাল ম্যাডাম ঘণ্টাখানেক আগে অফিস থেকে বেরিয়ে গেছেন।
স্বপ্নেন্দুর মাথায় কিছুতেই ঢুকছিল না কী করে খবরটা ফাঁস হয়ে গেল।
সে চাকলাদারকে ডেকে পাঠাল, ‘আপনি স্টাফদের বলেছেন?’
‘না স্যার। তবে শুনেছি ম্যাডাম নাকি ওঁর পিওনকে বলেছেন।’
‘ম্যাডাম?’ স্বপ্নেন্দু হাঁ হয়ে গেল! ঠিক সেইসময় দল বেঁধে স্টাফরা তার ঘরে প্রবেশ করল। একসঙ্গে চিৎকার চেঁচামেচি অভিযোগ এবং গালাগালের বন্যা বয়ে যেতে লাগল। তাকে ঘিরে অনেকগুলো উত্তেজিত মুখ। স্বপ্নেন্দু বলার চেষ্টা করল, ‘আপনারা আমার কাছে এসেছেন কেন? মিসেস বক্সীর কাছে যান। তিনিই অল ইন অল।’
একজন বলল, ‘সে শালী পালিয়েছে।’
‘ঠিক আছে, একজন বলুন। এনি অফ ইউ।’
‘শুনুন। অ্যাদ্দিন ধরে আমরা সেকশনে কাজ করছি, এখন এককথায় সরাতে পারেন না। এতগুলো লোকের ভাতে হাত দেবার কোনও রাইট আপনার নেই।’
‘ভাতে হাত।’
‘নিশ্চয়ই।’
‘কিন্তু এটাতো বেআইনি।’
সঙ্গে-সঙ্গে চিৎকার উঠল। অজস্র অশ্লীল শব্দ। একজন চেঁচিয়ে বলল, ‘অফিসাররা যখন মাল কামান তখন বুঝি আইন থাকে?’
এই যুক্তিটার কাছে নরম হতেই হয়। স্বপ্নেন্দু মিসেস বক্সীকে একথাই সকালে বলেছিল। সে বলল, ‘আমি বুঝতে পারছি। বিশ্বাস করুন আমি এসব কিছু জানি না। মিসেস বক্সী এলে আমি নিশ্চয়ই আলোচনা করব।’
‘আপনি জানেন না?’
‘না।’ স্বপ্নেন্দু স্রেফ অস্বীকার করল।
‘মিথ্যে কথা। তাহলে স্ট্যাটিস্টিক থেকে মিস সেনকে ডেকে পাঠালেন কেন? মিস সেনকে কোন সেকশনে দিতে চান?’
‘মিস সেন?’ ধক করে উঠল স্বপ্নেন্দুর বুক। মহিলা বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন নাকি? ওফ, কী বোকামিই না করেছিল সে। একটা মেয়েছেলের সুন্দর চেহারা দেখে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল!
‘কী, চুপ করে আছেন কেন?’
‘ওর সঙ্গে আমার কী কথা হয়েছে আপনারা জানেন?’ শেষ চেষ্টা করল সে। সঙ্গে-সঙ্গে চিৎকারটা বাড়ল। কেউ একজন ছুটল হেনা সেনকে ডেকে আনতে। তারা সামনাসামনি ভজিয়ে নিতে চায়। স্বপ্নেন্দু ঘামতে লাগল। এই লোকগুলোকে তার ক্ষিপ্ত নেকড়ের মতো মনে হচ্ছিল। তার ঘরে হামলা হচ্ছে অথচ কোনও অফিসার এগিয়ে আসছেন না তাকে উদ্ধারের জন্যে।
কিছুক্ষণের মধ্যে মিস সেনের আবির্ভাব হল। ঘরে ঢুকে বললেন, ‘কী ব্যাপার? আমায় কেন?’ যেন তিনি কিছু জানেন না।
নেতা গোছের একজন প্রশ্ন করল, ‘মিস সেন, আজ সকালে উনি কি ট্রান্সফার পোস্টিং নিয়ে কিছু বলেছিলেন আপনাকে?’
ধীরে-ধীরে মাথা নাড়লেন হেনা সেন। হ্যাঁ।
আর গলা শুকিয়ে গেল স্বপ্নেন্দুর। নিজেকে চড় মারতে ইচ্ছে করছিল তার। সঙ্গে-সঙ্গে উত্তেজনা বাড়ল। মিথ্যুক, লায়ার।
‘কী বলেছিলেন?’
‘আমি অফিসে এসে রেস্ট নিতে ক্যান্টিনে যাই বলে উনি আমাকে বলেছিলেন এটা নাকি অন্যায়, প্রয়োজন হলে আমাকে ট্রান্সফার করে দেবেন। আমার আবার একটু রেস্ট না নিলে চলে না।’
হেনা সেন হাসলেন।
আর স্বপ্নেন্দুর মনে হল সে গভীর কুয়োর তলা থেকে ভুস করে ওপরে উঠে এল। স্পষ্টতই আক্রমণকারীদের মুখে এখন হতাশা। কেউ-কেউ হেনা সেনের দিকে অবিশ্বাসী চোখে তাকাচ্ছে। এবার হেনা সেন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমি জানতে পারি কি কেন এঁদের ট্রান্সফার করা হচ্ছে?’
‘আমি জানি না, মিসেস বক্সী বলতে পারবেন।’
‘এদের বিরুদ্ধে কি প্রমাণ আছে যে এরা পার্টির কাছে ঘুষ নেন? যদি না থাকে তাহলে এরকম অ্যাকশান নেওয়া মানে এদের অপমান করা। অনুমানের ভিত্তিতে আপনারা কিছুই করতে পারেন না।’
হেনা সেন হেসে-হেসে কথাগুলো বলতেই সোচ্চারে তাঁকে সমর্থন করল সবাই।
যাওয়ার আগে স্টাফরা বলে গেল যদি এইরকম অর্ডার বের হয়ে তাহলে কাল থেকে কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। ঘর ফাঁকা হয়ে গেলে রুমালে মুখ মুছল স্বপ্নেন্দু। খুব জোর বেঁচে গেল সে আজ। হেনা সেন তাকে বাঁচিয়ে দিলেন। মহিলা তাকে নাও বাঁচাতে পারতেন! সঙ্গে-সঙ্গে আর-একটা চিন্তা মাথায় আসামাত্র উৎফুল্ল হল সে। মেয়েরা যাকে একটু নরম চোখে দ্যাখে, তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করে, কোথায় যেন পড়েছিল সে, এত ঝামেলার মধ্যেও এটুকু ভাবতে পেরে মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেল তার। খুব ইচ্ছে করছিল হেনা সেনকে ডেকে কৃতজ্ঞতা জানায়। কিন্তু সাহস হল না তার। সঙ্গে-সঙ্গে স্টাফদের মনে অন্যরকম প্রতিক্রিয়া হতে পারে। তবে মহিলা খুবই বুদ্ধিমতী। তাকেও যেমন বাঁচালেন তেমনি স্টাফদেরও চটালেন না। চমৎকার।
স্বপ্নেন্দু ঠিক করল মিসেস বক্সীর ওপর ব্যাপারটা ছেড়ে দেবে। তিনি যা করেন তাই হবে। সে আর এই ব্যাপারে থাকবে না। যদি মিসেস বক্সী চোখ রাঙান তাহলে হেড অফিসে বিস্তারিত জানাবে।
ছুটির পর বেরিয়ে এসে বাসস্ট্যান্ডে কিছুক্ষণ দাঁড়াল স্বপ্নেন্দু। এই সময়টায় তার কিছুই করার থাকে না। মা মারা যাওয়ার পর থেকে বাড়ির কোনও আকর্ষণ তার কাছে নেই। হাঁটতে-হাঁটতে ধর্মতলায় চলে এল সে। আর তখনই আত্রেয়ী তাকে ডাকল, ‘কী ব্যাপার, কেমন আছ?’
স্বপ্নেন্দু মাথা নাড়ল, ‘ভালো। তুমি?’
‘আর থাকা। তুমি তো কোনও খোঁজখবর নাও না।’
‘কী হবে নিয়ে। তাছাড়া তোমার স্বামী তো সেটা পছন্দ করেন না।’
‘ওঃ স্বপ্নেন্দু! এই কথাটা শুনতে-শুনতে আমি পাগল হয়ে গেলাম। আমার সব কাজেই যদি ওর মতামত নিতে হয় তাহলে—!’ বলতে-বলতে কথা ঘোরাল সে, ‘কোথায় যাচ্ছ?’
‘কোথাও না। বেকার মানুষ।’
‘তুমি আবার বেকার। এখনও বান্ধবী পাওনি?’
‘সে কপাল কোথায়?’
‘চলো, আমাদের ওখানে চলো।’
‘মাথা খারাপ। স্ত্রীর বন্ধুকে দেখলে কোনও স্বামী সুখী হয় না।’
‘আমি আর পারছি না স্বপ্নেন্দু। এই লোকটার সঙ্গে একসঙ্গে বাস করা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
স্বপ্নেন্দু রাস্তাটার দিকে তাকাল। অজস্র মানুষ এই সন্ধেবেলায় যাওয়া-আসা করছে। অথচ আত্রেয়ী এই পরিবেশকে ভুলে গিয়ে নিজের মনের কথা স্বচ্ছন্দে বলে যাচ্ছে। স্বপ্নেন্দু তবু বোঝাবার চেষ্টা করল, ‘এভাবে বলো না, তুমি নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছ। অতীতটাকে ভুলে যেও না।’
‘ভুল করেছিলাম।’ তারপরেই যেন খেয়াল হল আত্রেয়ীর, ‘কোথাও বসবে?’
‘তোমার দেরি হয়ে যাবে না?’
‘আই ডোন্ট কেয়ার। তোমাকে এতদিন বাদে দেখলাম। তোমার অফিসের টেলিফোন নাম্বারটা যে কাগজে ছিল সেটাও ছিঁড়ে ফেলেছে, কীরকম ব্রুট।’
‘আজ নয় আত্রেয়ী। আমার মন ভালো নেই।’
‘একদিন কিন্তু আমার কাছে এলে তোমার মন ভালো হয়ে যেত।’
‘সে অনেকদিন আগের কথা। তখন আমরা ছাত্র—।’
‘তোমার নাম্বারটা দাও তাহলে।’
স্বপ্নেন্দু টেলিফোন নাম্বারটা বলতে আত্রেয়ী সেটাকে তিন চারবার নানান রকম করে মনে গেঁথে রাখল তারপর জিগ্যেস করল, ‘তুমি এখনও সেই পুরোনো বাড়িতেই আছ?’
‘আর কোথায় যাব? মা চলে যাওয়ার পর আমি আগলাচ্ছি।’
হঠাৎ ব্যাগ খুলল আত্রেয়ী। তারপর কী ভেবে সেটা বন্ধ করে বলল, ‘তুমি হয়তো আমার কথা আজকাল আর ভাব না, কিন্তু আমার বড্ড মনে পড়ে তোমাকে। আমি ভুল করেছি স্বপ্নেন্দু, বিরাট ভুল।’
আত্রেয়ী চলে গেলে আরও আনমনা হয়ে গেল সে। ছাত্রজীবনে কি তার সঙ্গে আত্রেয়ীর প্রেম হয়েছিল? না, ঠিক প্রেম বলে না ওটাকে। তবে আত্রেয়ীর কাছে যেতে ভালো লাগত তার। আর আত্রেয়ীর নজর ছিল আরও ওপরের দিকে। ভালো চাকুরে, প্রচুর পয়সা এবং ক্ষমতাবান মানুষের জন্যে তার লোভ ছিল। তাই সেই বয়সে ওইরকম একটা মানুষকে পেয়ে সে স্বচ্ছন্দে স্বপ্নেন্দুদের ভুলে যেতে পেরেছিল। কষ্ট হয়েছিল অবশ্যই, কিন্তু সেটা ভুলে যেতে সময় লাগেনি। প্রেম হলে কি তা সম্ভব হতো! আর আজকের আত্রেয়ী তো মধ্যবয়সের এক মহিলা। শরীরে যৌবন নেই। সেই চাপল্য নেই, আকর্ষণ করার ক্ষমতা লোপ পেয়েছে। এই আত্রেয়ীর সঙ্গে নবীন প্রেম হয় না, পুরোনো বন্ধুত্ব রাখা যায় মাত্র। কথাটা মনে হওয়ামাত্র হেনা সেনের শরীরটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। আর সঙ্গে-সঙ্গে দম বন্ধ হয়ে গেল তার। হেনা সেনকে কৃতজ্ঞতা জানানো হল না। কাল এবং পরশু ছুটি। সোমবার ঘরে ডেকে ওটা জানাতে গেলে হয়তো নানান কথা উঠবে। তা ছাড়া, সেদিন অফিসের আবহাওয়া কীরকম থাকবে তাও সে জানে না।
আত্রেয়ীর সঙ্গে দেখা না হলে হয়তো বুকের ভেতর হেনা সেনের জন্যে এতটা আনচান শুরু হতো না। আত্রেয়ী যন্ত্রণাটা যেন তার মনে ছুঁইয়ে চলে গেল। স্বপ্নেন্দুর মনে হল হেনা সেনের বাড়িতে গিয়ে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এলে কেমন হয়? অফিস থেকে বের হওয়ার আগে সে ওর ফাইল থেকে বাড়ির ঠিকানাটা জেনে এসেছে।
পরমুহূর্তেই চিন্তাটাকে বাতিল করল সে। হেনা সেনের বাড়িতে যাওয়া একজন অফিসারের পক্ষে সম্মানজনক হবে না। হেনা যদি বিরক্ত হয় তাহলে অফিসে ঢিঢি পড়ে যাবে। স্টাফরা তো বটেই, মিসেস বক্সীও খড়গহস্ত হবেন। তা ছাড়া, হয়তো গিয়ে দেখবে ওর কোনও সহকর্মী সেখানে বসে আছে। তাহলে? বেইজ্জতের একশেষ। না, এটা অত্যন্ত ঝুঁকি নেওয়া হয়ে যাবে।
এক কাপ চা খেয়ে হাঁটছিল স্বপ্নেন্দু। এই সময় বাচ্চা ছেলেটা পেছনে লাগল। ধর্মতলায় এদের প্রায়ই চোখে পড়ে। একগাদা টাটকা ফুল নিয়ে এরা অনুনয় করে কিনতে। স্বপ্নেন্দু শুনেছে এই সব ফুলের অতীত নাকি ভালো নয়। কবরস্থান থেকে তুলে নিয়ে এসে নাকি বিক্রি করা হয়। তাছাড়া ফুল নিয়ে সে কী করবে? বাড়িতে যার ফুলদানি নেই তার ফুলের কী প্রয়োজন। ছেলেটাকে হাটিয়ে দিলেও সে পিছু ছাড়ছিল না। ফুলগুলোর প্রশস্তি করতে-করতে আকুতি জানাচ্ছিল কেনবার জন্যে। প্রায় বাধ্য হয়ে স্বপ্নেন্দু এবার ফুলগুলোর দিকে তাকাল। আর তখনই তার নজরে পড়ল একটা আধফোঁটা বড় রক্তগোলাপ কীরকম নরম সতেজ চেহারা নিয়ে তাকিয়ে আছে। পুরো ফোটেনি ফুলটা কিন্তু এমন ডাঁটো এবং উদ্ধত ভঙ্গি, পাপড়ির গায়ে জলের ফোঁটা যে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। সে ছেলেটাকে বলল, ‘ওই ফুলটার দাম কত?’
‘আট আনা সাব।’ হাত বাড়িয়ে তুলে দিল সে গোলাপটাকে। লম্বা ডাঁটি এবং তাতে দুটো পাতা। দর করল না স্বপ্নেন্দু। দাম মিটিয়ে দিয়ে নাকের সামনে ধরতেই অদ্ভুত জোরালো অথচ মায়াবী গন্ধ পেল। এবং তখনই মনে হল এই গন্ধটা তার খুব চেনা। চোখ বন্ধ করতেই হেনা সেনের শরীর ভেসে উঠল। আজ সকালে লিফটে হেনা সেনের শরীর থেকে সে এই রকম গন্ধ পেয়েছিল। আদুরে চোখে ফুলটাকে দেখল স্বপ্নেন্দু। আর তারপরেই মনে হল হেনা সেনের শরীরের সঙ্গেও এই ফুলের মিল আছে। এইরকম তাজা, উদ্ধত, অহঙ্কারী এবং মহিমাময়। শেষ শব্দটা ভাবতে পেরে খুব ভালো লাগল তার। মহিমাময়।
ফুলটার দিকে তাকিয়ে স্বপ্নেন্দুর দ্বিতীয়বার মনে হল তার উচিত একবার হেনা সেনের বাড়িতে যাওয়া। সে তো কখনও ফুল কেনেনি। কোনও ফুলওয়ালা তার পিছনে জোটেনি কোনওদিন। আজ কেন হল?
আর ওই ছেলেটার কাছে এই ফুলটাই বা থাকবে কেন যা দেখলে হেনা সেনকে মনে পড়ায়! হেনা সেন থাকে ফুলবাগানের সরকারি ফ্ল্যাটে। তেমন বুঝলে একটা মিথ্যে ওজর দিতে অসুবিধে হবে না। তা ছাড়া, যে মেয়ে তাকে বাঁচাতে অতগুলো সহকর্মীর সামনে কথা সাজাল সে নিশ্চয়ই অফিসে গিয়ে নালিশ করবে না।
এইসব ভেবে স্বপ্নেন্দু একটা ট্যাক্সি ধরল। পারতপক্ষে শেয়ারে ছাড়া সে ট্যাক্সিতে চড়ে না। কিন্তু আজ মনে হল এই ফুলটাকে নিয়ে বাসে ওঠা যায় না। ভেতরে-ভেতরে খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল সে। ঘাম জমছিল কপালে।
সরকারি ফ্ল্যাটের কাছে এসে ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে স্বপ্নেন্দুর মনে হল, এই লাল গোলাপটাকে হাতে ধরে পথ হাঁটা উচিত হবে না। এটাকে দেখলে মানুষের কৌতূহল হবেই। অথচ পকেটে রাখলে ফুলটা নষ্ট হয়ে যাবে। শেষপর্যন্ত সে রুমাল বের করে সযত্নে তাতে ফুলটাকে ঢেকে ঝুলিয়ে নিল এমন করে যে কেউ দেখলে চট করে বুঝতে পারবে না।
নম্বর খুঁজে-খুঁজে ফ্ল্যাটটা পেতে মিনিট পনেরো লাগল। তিনতলায় দরজায় গায়ে লেখা আছে মিস্টার এস. কে. সেন। এই লোকটা কে হতে পারে? হেনার বাবা? মেয়ের অফিসার বাড়িতে এসেছেন শুনলে ভদ্রলোক কী মনে করবেন? কিন্তু এখন ফিরে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। একটু মরিয়া ভাব এসে গেলে স্বপ্নেন্দু কলিং বেলে আঙুল রাখল। আর আশ্চর্য, দরজা খুলল হেনা নিজে।
‘ওমা, আপনি?’ খুব অবাক গলায় প্রশ্ন করল হেনা।
স্বপ্নেন্দু দেখল লাল শাড়ি লাল ব্লাউজে হেনাকে ঠিক রক্তগোলাপটার মতো দেখাচ্ছে। অফিস থেকে ফিরে স্নান করেছে নিশ্চয়ই কারণ লাবণ্য ঢলঢল করছে সারা অঙ্গে। স্বপ্নেন্দু কোনওরকমে বলতে পারল, ‘এলাম।’
‘হ্যাঁ আসুন।’ হেনা সরে দাঁড়াতে স্বপ্নেন্দু ঘরে ঢুকল। সুন্দর সাজানো আধুনিক ঘর। দরজাটা ভেজিয়ে হেনা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী ব্যাপার বলুন তো?’
স্বপ্নেন্দুর খেয়াল হল রুমালটার কথা। ওটা এখনও হাতে ঝোলানো। যতটা সম্ভব ওটাকে আড়াল করে সে কথা বলল, ‘আমি না এসে পারলাম না। আজ আপনি আমাকে অফিসে বাঁচিয়েছেন। আমি যে কী বলে আপনাকে—’
শব্দ করে হেসে উঠলেন হেনা সেন। তাঁর শরীরে পুরীর ঢেউগুলোকে চকিতে দেখতে পেল স্বপ্নেন্দু। হেনা সেন হাসতে-হাসতে বললেন, ‘বলিহারি আপনি! ওই জন্যে বাড়ি বয়ে ধন্যবাদ জানাতে এলেন! এখন যদি খবরটা অফিসে জানাজানি হয়ে যায়? আরে মুখটা অমন করছেন কেন? বসুন-বসুন।’
স্বপ্নেন্দু মাথা নাড়ল, ‘না বসব না। রাতও তো হল।’
‘রাত এমন কিছু হয়নি। দাঁড়ান, আমার মায়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।’ কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হেনা সেন ভেতরে চলে গেলেন। স্বপ্নেন্দু আড়ষ্ট হয়ে বসল। রুমালটাকে সে সন্তর্পণে সোফার ওপর রেখে দিল। তিনঘরের ফ্ল্যাট। অথচ অন্য মানুষের কথাবার্তা শোন যাচ্ছে না।
একটু বাদেই এক প্রৌঢ়াকে নিয়ে হেনা সেন ফিরে এলেন, ‘আমার মা।’
স্বপ্নেন্দুর ইচ্ছে করছিল না প্রণাম করতে কিন্তু সেটা বাড়াবাড়ি হবে মনে হওয়ায় নমস্কার করল সে। মহিলা বললেন, ‘বসুন।’
‘আমাদের অফিসার! খুব জাঁদরেল লোক।’হেনা সেন জানালেন।
মহিলা বললেন, ‘আপনি কি এদিকেই থাকেন?’
‘না। মানে আমার এক বন্ধুর কাছে এসেছিলাম, ভাবলাম দেখা করে যাই।’
‘ওর পুরোনো অফিসের পরিবেশ ভালো ছিল না। একজন তো খুব বিরক্ত করতেন। শেষ পর্যন্ত আমি তাঁকে নিষেধ করলাম বাড়িতে আসতে। আসলে বাবা, এখানে কোনও পুরুষমানুষ যদি ঘনঘন আসে তাহলে নানান কুকথা উঠবে। আমরা মায়ে-মেয়েতে থাকি তো।’
‘সে তো নিশ্চয়ই!’ স্বপ্নেন্দু ঢোক গিলল।
‘ওর বাবা যা রেখে গিয়েছেন তাতে মেয়ের চাকরি করার দরকার হয় না। কিন্তু মেয়ে সে কথা শুনলে তো! এখন একটা ভালো ছেলে পেলে বেঁচে যাই।’
হেনা চাপা গলায় বললেন, ‘আঃ মা! তুমি আবার আরম্ভ করলে!’
প্রৌঢ়া স্বপ্নেন্দুকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওই দ্যাখো, বলতেই আপত্তি। কিন্তু—।’
‘কোনও কিন্তু নয়। এখন ভেতরে গিয়ে রামের মাকে বলো কফি করতে।’
কিন্তু স্বপ্নেন্দু উঠে দাঁড়াল, ‘মাফ করবেন! আমি কফি খাব না! মানে একটু আগে চা খেয়েছি তো!’
‘ও অন্য জায়গায় চা খেয়ে আমার কাছে এসেছেন?’
‘না। মানে, ঠিক আছে, আর একদিন খাব।’
‘আর একদিন খাবেন মানে? শুনলেন না মা একটু আগে কি বলল। ঘনঘন এ-বাড়িতে এলে পাঁচজনে কুকথা বলবে।’ হেনা সেন আবার হাসিতে ভেঙে পড়লেন। স্বপ্নেন্দু ঠোঁট কামড়াল! তাকে স্পষ্ট বলে দেওয়া হচ্ছে আর কখনও এই বাড়িতে এসো না!
প্রৌঢ়া অবশ্য বলে উঠলেন, ‘ছিঃ, এভাবে ঠাট্টা করতে হয়!’
হেনা সেন বললেন, ‘আমি যে ঠাট্টা করলাম তা উনি বুঝতে পেরেছেন। সত্যি চা-কফি খাবেন না?’
স্বপ্নেন্দু মাথা নাড়ল, ‘চলি। আবার দেখা হবে!’
হেনা সেন বলে উঠলেন, ‘আপনার রুমাল পড়ে রইল ওখানে।’
স্বপ্নেন্দুর খেয়াল হল। সে কয়েক পা ফিরে এসে রুমালটাকে তুলে নিল। এতসব সত্বেও তার খুব ইচ্ছে করছিল হেনা সেনের হাতে টাটকা লাল গোলাপটা তুলে দিতে। কিন্তু এইসব কথাবার্তা আর প্রৌঢ়া মহিলার সামনে সেটা দেওয়া অসম্ভব। ওঁরা দরজা পর্যন্ত তাকে এগিয়ে দিলেন। সিঁড়িতে পা দেওয়ার আগে স্বপ্নেন্দু শুনল হেনা বলছেন, ‘ঝামেলাটা নিজের কাঁধে না রেখে মিসেস বক্সীর ওপর চাপিয়ে দিন। আপনার কী দরকার যেচে অপ্রিয় হওয়ার।’
নির্জন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে স্বপ্নেন্দু টলমল হল। হেনা সেন তার সঙ্গে যতই রসিকতা করুন না কেন শেষ সময়ে যে কথাটা বললেন তাতে স্পষ্ট বোঝা যায় ওর প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতি আছে। কোনও-কোনও মানুষের এটা বাহ্যিক স্বভাব থাকে পরিহাস করার, কিন্তু ভেতরের আন্তরিকতা যখন বেরিয়ে আসে তখন বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না। হেনা সেই রকমের মেয়ে।
বুঁদ হয়ে হাঁটছিল স্বপ্নেন্দু। লাল জামা লাল শাড়ি সাদা নিটোল ডানার মতো কাঁধ থেকে হাত নেমে এসেছে যার সেই মেয়ে তার চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছিল। রুমালটাকে নাকের নিচে নিয়ে আসায় সে আবার হেনা সেনের শরীরের ঘ্রাণ আবুক নিতে পারল।
বাড়ি ফিরে স্বপ্নেন্দুর খেয়াল হল আজ রান্না-বান্না বন্ধ। ওর রাতদিনের কাজ করে যে লোকটা সে দেশে গেছে কার অসুখের খবর পেয়ে। সামনে দুদিন ছুটি বলে স্বপ্নেন্দু আপত্তি করেনি। সন্ধেটা এমন ঘোরে কেটে গেল যে এসব কথা মনেও আসেনি। এখন রাত্রে হরিমটর।
দরজা খুলে সে শোওয়ার ঘরে এল। একটা ফুলদানি নেই যেখানে গোলাপটাকে রাখা যায়। টেবিলে একটা সুন্দর কাচের বাটি ছিল, স্বপ্নেন্দু তার মধ্যে ফুলটাকে বসিয়ে দিল। একটুও টসকায়নি সেটা, তেমনি উদ্ধত এবং আদুরে। আর কী টকটকে লাল। কী খেয়াল হতে বাটিটাকে উলটো করে বসিয়ে দিতে স্বপ্নেন্দু আবিষ্কার করল ফুলের রং কাচের আস্তরণ ভেদ করে বেরিয়ে আসছে। আরও রহস্যময় দেখাচ্ছে। সামান্য দূরে সরে কাচ-চাপা ফুলটাকে দেখল সে। ঠিক মধ্যিখানে গর্বিত ভঙ্গিতে ফুলটা রয়েছে।
এক কাপ কফি আর কয়েকটা বিস্কুট খেয়ে শুয়ে পড়ল স্বপ্নেন্দু। আজ সারাদিনে অনেক ঘটনা ঘটে গেল। চারদিকে শুধুই নোংরামো, একমাত্র ব্যতিক্রম হেনা সেন। কিন্তু তাঁর কাছে আগের অফিসের কোনও অফিসার প্রায়ই যেত! লোকটাও কি হেনার প্রেমে পড়েছিল? মনে-মনে খুব জেলাস হয়ে উঠল সে। হেনা লোকটাকে বাড়িতে অ্যালাউ করতেন কেন? হেনারও কি দুর্বলতা ছিল? স্বপ্নেন্দুর অস্বস্তি শুরু হল। তার খেয়াল হল হেনা স্বইচ্ছায় ট্রান্সফার চেয়ে এই অফিসে এসেছেন। দুর্বলতা থাকলে নিশ্চয়ই তা করতেন না।
কিন্তু অফিসের পরিবেশটা জঘন্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর চেয়েও কোনও কলেজে মাস্টারি নিলে অনেক বেশি আরামে থাকা যেত। আসলে এখন মানুষের লোভের কোনও সীমা নেই। চাই আরও চাই। যেমন আত্রেয়ী। একসময় যেটাকে সুখ বলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এখন সেটা থেকে মুক্ত হতে চাইছে। সে সুখের মালা যেন ফাঁস হয়ে বসেছে গলায়। আসলে সেখানেও একটা অতৃপ্তি, যা অন্য লোভ থেকে মনে জন্মেছে। স্বপ্নেন্দু শুয়ে-শুয়ে হাসল। আজ পৃথিবীর সমস্ত মানুষ কোনও-না-কোনও লোভের শিকার। কাকে দোষ দেবে। এই নিয়ে মানিয়ে-গুছিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দিতে হবে। সে নিজেও তো লোভার্ত হয়ে হেনা সেনের বাড়িতে ছুটে গিয়েছিল। অথচ যাওয়ার আগে কতকগুলো বাহানা তৈরি করতে হয়েছিল নিজের কাছে কৈফিয়ত দিতে। নিশ্বাস ফেলেছিল মৃদু তালে স্বপ্নেন্দু। তার তিনতলার ঘরে অল্প-অল্প হাওয়া আসছে। মাথার ওপর ফ্যানটা ঘুরছে না। কলকাতা শহর কখন যে বিদ্যুৎহীন হয়ে গেছে তা টের পায়নি। স্বপ্নেন্দুর চোখের সামনে লাল শাড়ি লাল জামা। শিশুর মতো ঘুমিয়ে পড়ল তাই নিয়ে।
সেই মধ্যরাতে কলকাতার বায়ুমণ্ডলে গুরুতর প্রতিক্রিয়া শুরু হল। কোন হঠাৎ সরে আসা নক্ষত্রের আকর্ষণে পৃথিবীর এই বিশেষ শহরটি উত্তপ্ত হয়ে উঠল। সামান্য ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ায় কলকাতার মানুষের ঘুম ভেঙে গেল। স্বপ্নেন্দু লাফিয়ে বিছানায় উঠে বসে দেখল জানলা দিয়ে প্রচণ্ড তপ্ত বাতাস ঘরে ঢুকছে। এত তার তাপ যে গায়ে ফোস্কা পড়ে যাচ্ছে। এবং সমস্ত শহর জুড়ে মানুষের চিৎকার শুরু হয়েছে। যারা ভয় পেয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল তারা আবার একটা আচ্ছাদন খুঁজছে। মানুষের আর্তনাদে শহরটা উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল। টলতে-টলতে জানলা বন্ধ করে দিতে যেটুকু সময় তাতেই সমস্ত শরীর ঝলসে গেল স্বপ্নেন্দুর। চিৎকার করে উঠল সে। মনে হচ্ছিল অন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অন্ধ ঘরেও উত্তাপ কমছিল না। স্বপ্নেন্দু হাত-মুখ ঘষতেই অনুভব করল চামড়া উঠে আসছে। উন্মাদের মতো সে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। বিছানাটা গরম। কিন্তু আশ্চর্য, পোড়েনি।
জ্ঞান ফেরার পর স্বপ্নেন্দুর প্রথম খেয়াল হল সে বেঁচে আছে। আর আশ্চর্য, তার শরীরে সেই প্রচণ্ড জ্বলুনিটা নেই। প্রথমে মনে হল কাল রাত্রে সে একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছিল। যা শুনেছিল, তা স্বপ্নে! হাতটা মুখে ঘষতে গিয়ে সে চমকে উঠল। স্পর্শ পাচ্ছে না। হাড়ে-হাড়ে যেন সামান্য শব্দ হল। তড়াক করে লাফিয়ে উঠল স্বপ্নেন্দু। লাফাতে গিয়ে শরীরটাকে এতটা হালকা লাগল যে পড়ে যেতে-যেতে সামলে নিল। তারপর নিজেকে দেখে চিৎকার করে উঠল। রাত্রে পাজামা পরে শুয়েছিল স্বপ্নেন্দু। এখন উঠে দাঁড়াতেই সেটা খুলে পড়ে গেল। স্বপ্নেন্দুর গলা থেকে একটা জান্তব শব্দ বেরিয়ে এল। গাপলের মতো সে ছুটে গেল বিশাল আয়নার সামনে। তারপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল মাটিতে। পড়ে স্থির হয়ে গেল।
চেতনা ফিরতে স্বপ্নেন্দু আবার উঠে বসল। তার শরীরে কোথাও মাংস নেই, রক্ত নেই, চামড়া নেই। এমনকী শিরা-উপশিরা পর্যন্ত নেই। শুধু শরীরের খাঁচাটা আস্ত রয়েছে। আর শুনছে হৃৎপিণ্ডের আওয়াজ। ঘড়ির মতো শব্দ করে চলছে সেটা। স্বপ্নেন্দুর মনে হল সে দুঃস্বপ্নটা এখনও দেখে যাচ্ছে। একটু-একটু করে উঠে দাঁড়িয়ে সে চলে এল আয়নার সামনে। মেডিক্যাল কলেজে এইরকম কঙ্কাল দেখেছে সে। আয়নায় একটা কঙ্কালের ছবি ফুটে উঠেছে। ঘাড় ঘুরিয়ে এপাশ-ওপাশ দেখছে কঙ্কালটা। আবার ঠিক কঙ্কালও না! কারণ বুকের খাঁচার মধ্যে ওটা কী। কালচে মতন একটা হৃৎপিণ্ড দেখতে পেল সে। সে দেখতে পাচ্ছে কিন্তু তার চোখ নেই। ডান হাতটাকে ধীরে-ধীরে ওপরে তুলে হৃৎপিণ্ডটাকে ছুঁতে যেতে সেটা শব্দ করে উঠল। সন্তর্পণে হাত বুলিয়ে বোঝা গেল কালচে হৃৎপিণ্ডটাকে একটা অদৃশ্য শক্ত বস্তু ঘিরে রেখেছে। নিরেট অথচ অদৃশ্য গোলকটির শরীরে আঘাত করল সে কিন্তু একটুও ব্যথা লাগল না। আয়নার খুব কাছে চলে এল স্বপ্নেন্দু। একটি পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চির কঙ্কাল তার সামনে দাঁড়িয়ে। তার কোথাও-কোথাও কালচে চামড়া আটকে আছে। কিন্তু সামান্য রক্তমাংসের চিহ্নও নেই।
চোখের গর্তে গর্ত আছে, কিন্তু চোখ নেই। অথচ দেখতে সামান্য অসুবিধে হচ্ছে। সোজাসুজি ছাড়া বাকিটা অদৃশ্য থেকে যাচ্ছে। ডাইনে-বাঁয়ে দেখতে হলে মুখ ঘোরাতে হচ্ছে। নাক আছে কিন্তু কোনও ঘ্রাণশক্তি নেই। জোরে-জোরে নিশ্বাস ফেলল সে। হৃৎপিণ্ডের আরাম হল কিন্তু কোনও গন্ধ পেল না।
মুখ হাঁ করল স্বপ্নেন্দু। জিভ নেই কিন্তু দাঁত আছে। অথচ দাঁতের গোড়ায় মাংস না থাকায় সেগুলোকে নগ্ন বীভৎস দেখাচ্ছে। শরীরের নিম্ন অংশের দিকে তাকাল সে। তলপেট থেকে দুটো শক্ত মোটা হাড় দুপাশে ছড়িয়ে পা হয়ে নিচে নেমে গেছে। তার যৌন অঙ্গ ইত্যাদির চিহ্নমাত্র নেই।
স্বপ্নেন্দু এইসব ভাবতে-ভাবতে কপালে হাত রাখল। তার মাথার মধ্যে কি চিন্তা করার নার্ভগুলো কাজ করছে? ব্রেইনবক্স কিংবা ক্রানিয়ামের ভেতরে কি মস্তিষ্ক অটুট আছে? নিশ্চয়ই আছে। তার ক্রানিয়াম মস্তিষ্ককে বাঁচিয়ে রেখেছে। নইলে সে এতসব ভাবতে পারছে কী করে।
স্বপ্নেন্দু থরথর করে কেঁপে উঠল। এই কি সে? এই কালচে শুকনো চামড়া মাঝে-মাঝে সেঁটে থাকা কঙ্কাল? খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে সে নিজের মাথাটাকে দেখতে চেষ্টা করছিল। হ্যাঁ তাইতো। মা মারা যাওয়ার পর মাথা ন্যাড়া করেছিল। তখন আয়নার সামনে দাঁড়ালে মাথার আকৃতিটা যেমন দেখাত এখন অনেকটা সেইরকমই লাগছে। তবে আকারে ছোট হয়ে গেছে কিন্তু আদলটা পালটায়নি।
বন্ধ দরজার দিকে তাকাল স্বপ্নেন্দু। তার হঠাৎ খুব ভয় করতে লাগল। সে মরে যায়নি। কিন্তু এইভাবে কঙ্কাল হয়ে বেঁচে থাকার কথা কে কবে শুনেছে। পাঁচজনের সামনে বের হলে কী প্রতিক্রিয়া হবে সবার? স্বপ্নেন্দুর হৃৎপিণ্ড কেঁপে উঠে কান্নাটা ছিটকে এল। সামান্য শব্দ হল কিন্তু এক ফোঁটাও অশ্রু বের হল না। চোখের জল নেই অথচ আলোড়িত হৃৎপিণ্ড ঠিক কেঁদে যাচ্ছে। শব্দটার কথা খেয়াল হতে সে সচকিত হল। তার উদর নেই, পাকস্থলী নেই। ধমনী, গ্রন্থি, নালী, পিত্ত, বস্তি, অন্ত্র, যকৃৎ কিছুই নেই। তবু শব্দটা হল। শব্দটা যে মুখ থেকে বের হয়নি এ ব্যাপারে সে স্থির নিশ্চিত। তাহলে? বিছানায় এসে বসল স্বপ্নেন্দু তারপর খুব সন্তর্পণে কথা বলার চেষ্টা করল ‘স্বপ্নেন্দু?’
অবিকল নিজের গলাটা শুনতে পেল সে। শুনতে পেল কী করে? তার কি শ্রবণ-ইন্দ্রিয় কাজ করছে? স্বরযন্ত্র যার নেই সে কথা বলে কী করে? বিশ্বাস হল না ঠিক, স্বপ্নেন্দু আবার একটু জোরে চিৎকার করে ডাকল, ‘স্বপ্নেন্দু।’
আঃ। সত্যি। সে কথা বলতে পারছে। স্বপ্নেন্দু বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করতে গিয়ে খেয়াল করল তার অক্ষিগোলক নেই তাই চোখের পাতা থাকার কথা নয়। তার মানে কখনও ঘুমুতে পারবে না সে। ঘুমুতে পারবে না কিন্তু কথা বলতে পারবে। আচ্ছা, তার কথা কি সামান্য নাকি-নাকি শোনাচ্ছে? ছেলেবেলায় গল্পের বইতে কঙ্কালদের যেরকম চন্দ্রবিন্দু দিয়ে কথা বলতে দেখত সেইরকম? সে আর-একবার শব্দ করল। খুব স্বাভাবিক শোনাচ্ছে না স্বর। প্রথমবার আনন্দে ঠাওর হয়নি কিন্তু এখন মনে হচ্ছে নাকি ভাবটা আছে। কিন্তু স্বরটা বের হচ্ছে কোত্থেকে? দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করতে গিয়ে স্বপ্নেন্দুর কাছে ধরা পড়ল। ওই প্রচণ্ড শক্ত অথচ অদৃশ্য গোলাকার বস্তুটি যা বুকের খাঁচায় হৃৎপিণ্ডটাকে আড়াল করে রেখেছে, শব্দটা আসছে ওর ভেতর থেকে। সে কি শুনতে পাচ্ছে ওই গোলকটির কারণে? মাথাটাকে যতটা সম্ভব বুকের কাছাকাছি নামিয়ে সে কথা বলল। হ্যাঁ, এটাই সত্য। তার শরীরটাকে সচল রাখার সমস্ত জাদু ওই অদৃশ্য গোলকের মধ্যে রয়েছে। শরীর বলতে শুধু এই হাড়গুলো। অত্যন্ত যত্নে সে গোলকটির গায়ে হাত বোলাল। তারপর গুনগুন করে উঠল, ‘এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’। কী চমৎকার! তার স্বরে সুর আছে। একেই তো গান বলে। অথচ এতকাল সে একটা লাইনও সুরে গাইতে পারেনি।
সারাটা দিন স্বেচ্ছাবন্দি হয়ে কাটিয়ে দিল স্বপ্নেন্দু। মাঝে-মাঝে বাইরে থেকে চিৎকার, কান্না ভেসে আসছে! ব্যাপারটি কী জানার জন্যে তার কৌতূহল হলেও সে বিছানা ছাড়ল না। নিজের অতীতের শরীরটার জন্যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। তার দাড়ি কামাতে খুব বিরক্ত লাগত একথা ঠিক, কিন্তু কামানো হয়ে গেলে গালটা কী নরম লাগত! চিবুকের কাছটা কী আদুরে ছিল। শরীরের বিভিন্ন অংশের ছবি একটু-একটু করে মনে পড়ায় স্বপ্নেন্দু আরও ভেঙে পড়ল। এত বছর ধরে সযত্নে লালিত শরীরটা আজ এক লহমায় উধাও, এখন শুধু একটা কঙ্কাল তার পরিচয়। কিছুক্ষণ কাটা ছাগলের মতো ছটফট করলে সে। তারপর নেতিয়ে রইল বিছানায়।
বিকেল হয়েছে কখন? একফোঁটা ঘুম আসেনি চোখে। খিদের কোনও চিহ্ন নেই। স্বপ্নেন্দু ধীরে-ধীরে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে নিজেকে খুব হালকা বোধ করল। তারপর জানলার কাছে এসে সন্তর্পণে পাল্লাটা খুলতে নির্জন রাস্তাটা চোখে পড়ল। একটাও মানুষ নেই। গাড়ি-ঘোড়া চলছে না। এবং বাতাসে একটা ঘোলাটে ভাব। তারপরেই নজরে এল। ঠিক উলটোদিকের বাড়িটার গায়ে বেশ ঝাঁকড়া বটগাছ ছিল। বিকেলবেলায় পাখিরা তাতে হাট বসাত। সেই বটগাছটাকে চেনা যাচ্ছে না। পাতা নেই, ছোট ডালগুলো অদৃশ্য হয়েছে। শুধু মোটা গুঁড়িটা পুড়ে কালচে হয়ে রয়েছে। স্বপ্নেন্দুর অস্বস্তি হচ্ছিল। পৃথিবীটা পালটে গেল নাকি? সবকিছু কেমন অচেনা দেখাচ্ছে। এইসময় সে শক্ত হল। একটা মানুষ আসছে। খুব দ্রুত হাঁটছে লোকটা। অনেকটা কমিক ফিল্মের মতো। চ্যাপলিন এইরকম হাঁটতেন। লোকটা কে? কাছে আসতেই লোকটাকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল স্বপ্নেন্দু। পরনে ফুলপ্যান্ট, ওভারকোট, কিন্তু মাথাটা ন্যাড়া। চুল নেই, মাংস নেই। স্রেফ একটা কঙ্কালের মাথা। পায়ের দিকে নজর দিতে সে দেখল কিছুই নেই সেখানে। লোকটা মুহূর্তেই চোখের আড়ালে মিলিয়ে গেল।
জানলাটা বন্ধ করল স্বপ্নেন্দু। তার মানে, সে একা নয়। আরও কিছু মানুষের চেহারার এই পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু কজন মানুষের? এই ঘরে বসে থাকলে কিছুই জানা যাবে না। চাকরটা থাকলে তাকে ডেকে দেখা যেত।
স্বপ্নেন্দু আর পারল না। পায়জামায় দুটো পা গলিয়ে দড়িটা বাঁধতে গিয়ে দেখল সেটা কোমরে থাকছে না। অনেক কায়দার পর মোটামুটি ভদ্রস্থ হল। গেঞ্জিটা এখন ঢলঢল করছে। তার ওপর পাঞ্জাবিটাকে মনে হচ্ছে হ্যাঙারে ঝোলানো হয়েছে। অভ্যাসে চুলে হাত বোলাতে গিয়ে হোঁচট খেল সে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারা দেখে হঠাৎ হাসি পেয়ে গেল।
তুমি, স্বপ্নেন্দু, তোমার আসল চেহারা হল এই। অবিকল কাকতাড়ুয়া। এতকাল মাংস-চামড়ার দৌলতে খুব ফুটুনি করেছ। আসল বস্তুটিকে চাপা দিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়িয়েছ। তোমার মুখের গড়নে কিঞ্চিত গরিলাদের ছায়া আছে। তোমার পূর্বপুরুষ যে বনমানুষ ছিল এ থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয়।
জুতোগুলোর দিকে তাকাল সে। ওগুলো এখন পায়ে সম্পূর্ণ বেমানান। ঢলঢল করবে, হাঁটা যাবে না। বরং হাওয়াইটা চেষ্টা করা যেতে পারে। পায়ে ঢুকিয়ে দেখা গেল সেটা বেশ বড়, তবে হাঁটা যাচ্ছে। অভ্যেসবশে ঘড়ি পরতে গিয়ে জব্দ হল। স্টেনলেসের ব্যান্ডটা হাত গলে বেরিয়ে আসছে। ওটাকে ছোট করা দরকার। প্রায় ছত্রিশ ঘণ্টা হয়ে গেল কিন্তু দম ফুরোয়নি ঘড়িটার। এটাকে নিয়ে আর কী হবে।
আয়নার দিকে তাকিয়ে মনটা খুঁত-খুঁত করছিল। ন্যাড়া মাথাটা ভীষণ কটকটে লাগছে। চট করে একটা চাদর বের করে একটা পাক বুকে জড়িয়ে মাথাটা ঢেকে নিল স্বপ্নেন্দু। তারপর সন্তর্পণে দরজা খুলল।
বাতাসটা এখনও গরম। তবে সহনীয় হয়ে এসেছে। কয়েক পা হাঁটতেই সে চমকে উঠল। ডানদিকের মোড়ে একটা চায়ের দোকান ছিল। দোকানটা অবিকল রয়েছে। কিন্তু সেখানে বসে আছে গোটা পাঁচেক কঙ্কাল। কঙ্কালগুলোর সাইজ বিভিন্ন রকমের। কেউ খুব মোটা, কেউ রোগা, কেউ বেঁটে কেউ লম্বা। চায়ের দোকানের মালিক অবনীদাকে সে চিনত। ওদের মধ্যে অবনীদা কোনটে? অবনীদা বেঁটেখাটো গোল মাথার ভারি ভালো মানুষ ছিলেন। স্বপ্নেন্দু বেশ কিছুক্ষণ লক্ষ করার পর একটি কঙ্কালকে শনাক্ত করল। টেবিলের ওপর মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। স্বপ্নেন্দু আরও লক্ষ করল পাঁচজনের মধ্যে দুজন সম্পূর্ণ নগ্ন। প্রচণ্ড কুৎসিত দেখাচ্ছে তাদের। অবনীদার পরনে একটা ধুতি জড়ানো। ওপরে সেই শার্টটা। খাকি রঙের, দুদিকে পকেট।
এদের দেখে মন কিছুটা শান্ত হল। তার মানে সে একা নয়। এপাড়ার অনেকেরই এক অবস্থা। স্বপ্নেন্দু ধীরে এগিয়ে যেতে হঠাৎ একজনের নজর পড়ল। চেঁচিয়ে উঠল, ‘আরে, আস্ত মানুষ।’
‘আস্ত মানুষ।’ বাকি চারজন একসঙ্গে উচ্চারণ করল।
স্বপ্নেন্দু কাছাকাছি যেতেই অবনীদা টেবিল থেকে নেমে এদিকে তাকাল। স্বপ্নেন্দু জিজ্ঞাসা করল, ‘অবনীদা।’
‘আরে এ আমাকে চেনে দেখছি।’
‘চিনব না কেন? আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না?’
‘গলার স্বরটা তো চেনা-চেনা লাগছে। কে ভাই আপনি?’
‘আমি স্বপ্নেন্দু।’
‘স্বপ্ন?’ অবনীদা এবার চিনতে পারল, ‘ওঃ, তুমি। কী হল বলো তো, এ কী হল? আমরা কী করে বেঁচে আছি? এই অবস্থায় তো প্রেতেরা বেঁচে থাকে, আমরা কি সবাই প্রেত হয়ে গেলাম?’ অবনীদা আর্তনাদ করল।
‘সবাই?’ স্বপ্নেন্দুর মাথাটা সামান্য এগিয়ে গেল।
‘সবাই। এমনকী আমার তিন বছরের বাচ্চাটা পর্যন্ত। তার চেহারা দেখলে শিউরে উঠতে হয়। অত হেলদি বাচ্চাটা একটা কঙ্কাল হয়ে ঘুরছে।’
‘পাড়াটা এত ফাঁকা লাগছে কেন? কেউ মারাটারা গেল নাকি?’
‘ফাঁকা? কাল সারারাত, আজ সারাদিন তো লোকে পাগলের মতো ছোটাছুটি কান্নাকাটি করেছে। এখন যে যার বাড়িতে ঢুকেছে, কারণ যদি সন্ধে হতেই আবার কালকের সেই গরম লাভার মতো কিছু কলকাতার ওপর বয়ে যায়। একবার তো মাংসমজ্জা শুষে নিয়ে গিয়েছে, এখন তো হাড়গুলো ছাড়া আমাদের আর কিছু নেই।’
অন্য লোকগুলো কেউ কথা বলছিল না। এবার একজন বলল, ‘আজ সন্ধে সাতটায় রেডিও খুলবেন। মুখ্যমন্ত্রী রেডিও থেকে এই বিষয়ে ভাষণ দেবেন।’
‘মুখ্যমন্ত্রী? মুখ্যমন্ত্রী বেঁচে আছেন?’
‘বাঃ বেঁচে থাকবেন না কেন? আমরা কেউ মারা যাইনি।’
‘কিন্তু কী করে জানতে পারলেন যে উনি ভাষণ দেবেন?’
‘তুমি কি এইমাত্র বের হলে?’ অবনীদা জিগ্যেস করল।
‘হ্যাঁ।’
‘বিকেলে পুলিশের জিপ মাইকে বলে গেল।’
‘পুলিশ?’
‘হ্যাঁ। তারা ইউনিফর্ম পরে এসেছিল বটে কিন্তু শরীরের হাল আমাদের মতো। দেখি মুখ্যমন্ত্রী কী বলেন।’
‘আপনার এখানে রেডিও আছে?’
‘হ্যাঁ। চালালে এখন কোনও শব্দ হচ্ছে না। হয়তো স্টেশন খোলেনি। কিন্তু আগে ঢাকা দিল্লি গৌহাটি ধরতে পারতাম। এখন কিছুই আসছে না।’
‘ব্যাটারি ঠিক আছে তো?’
‘হ্যাঁ, সেটা দেখে নিয়েছি। তুমি দাঁড়িয়ে কেন, বসো।’
ওরা জায়গা করে দিলে স্বপ্নেন্দু বেঞ্চিতে বসল। সন্ধে হয়ে গেছে। কিন্তু চারধার অন্ধকারে ঢেকে যায়নি। রাস্তার আলোগুলো জ্বলছিল। স্বপ্নেন্দু বুঝল কাল রাত থেকেই জ্বলছে। আজ সকালে নেভানো হয়নি। সে আড়াচোখে লোকগুলোর দিকে তাকাল। প্রত্যেকের বুকের খাঁচায় কালচে হৃৎপিণ্ড দেখা যাচ্ছে। একজন অন্যমনস্ক হয়ে সেখানে হাত দিতে গিয়ে বাধা পেল। অর্থাৎ সেই অদৃশ্য গোলকে প্রত্যেকের হৃৎপিণ্ড আবদ্ধ। এক-একজনের মাথার করোটিও এক একরকম। কোনটা বেশি লম্বা, কোনটা সামনের দিকে ছুঁচলো। মুখের হাড়ের গঠনে বনমানুষের স্পষ্ট ছাপ। অবনীদার মুখে বেশ গরিলা-গরিলা ভাব আছে। তবে প্রত্যেকের করোটি বেশ মোটা।
স্বপ্নেন্দু দেখল চায়ের উনুনে আঁচ পড়েনি। জিনিসপত্র চারপাশে অবহেলায় ছড়ানো। সে জিগ্যেস করল, ‘অবনীদা, আপনার দোকানের ছেলেটা আসেনি?’
‘এসেছিল।’ মাথা নাড়ল অবনীদা, ‘আর ওকে দিয়ে আমার কী হবে। ওই উনুন ধরিয়ে আর কী হবে। চা খাওয়ার মানুষ কোথায়। আমি একেবারে শেষ হয়ে গেলাম ভাই। ধনেপ্রাণে শেষ।’
এক ব্যক্তি বলল, ‘মানুষ কাজ করে পেটের জন্যে। সেই প্রয়োজন না থাকলে কী হবে কাজ করে। এ দায় থেকে বাঁচা গেল।’
‘যা বলেছেন। আজ সারাদিন কিছুই খাইনি। অথচ দেখুন, আমার একটুও খিদে পাচ্ছে না। অথচ আমার পেটে আলসার ছিল। ডাক্তার বলেছিলেন নিয়ম করে খেতে। একদম যেন খালি পেটে না থাকি। তা পেটই যখন নেই।’
এইসময় তৃতীয়জন হেসে উঠল। সামান্য শব্দ হল। স্বপ্নেন্দু অবাক হয়ে লোকটাকে দেখল। সম্পূর্ণ উলঙ্গ। এই অবস্থায় কোনও মানুষ হাসতে পারে! আমাদের সব গিয়েছে কিন্তু প্রাণ এবং কঙ্কালটা আছে। তাই কীভাবে হাসি আসে? তারপরেই ওর খেয়াল হল, কালকের পর এই প্রথম সে হাসি শুনল। হাসির যদি অপব্যবহারও হয়ে থাকে তাহলেও হাসি ইজ হাসি। তবু লোকটার দিকে তাকিয়ে তার অস্বস্তি হচ্ছিল। সে শান্ত স্বরে বলল, ‘আপনার একটা পোশাক পরা উচিত ছিল।’
‘উচিত ছিল?’ লোকটা আবার খুকখুক করে হাসল, ‘কেন উচিত ছিল?’
‘পোশাক পরা কেন উচিত ছিল তা জিগ্যেস করছেন?’
‘আগে করতাম না। এখন করছি। এখন আমার কোনও গোপন অঙ্গ নেই যে তাকে ঢেকে রাখব। এখন শীতকাল নয় যে হাড় কনকন করবে ঢেকে না রাখলে। গরমের সময় খোলাখুলি থাকলে আরাম হবে। হাওয়া এপাশ থেকে ওপাশে বইলে হাড় জুড়োবে। আপনি বললেই আমাকে শুনতে হবে?’ খুকখুকিয়ে হাসল লোকটা।
অবনীদা বলল, ‘অরবিন্দ, তুমি যা বললে তা, খুব মিথ্যে নয়। তবে কিনা চোখেরও তো একটা ব্যাপার আছে। দেখতে বড় খারাপ লাগে।’
‘সে আলাদা কথা। উনি উচিত বলছেন। উচিত বলার কি? মুখ্যমন্ত্রী নাকি?’
স্বপ্নেন্দু বলল, ‘মুখ্যমন্ত্রী বললে শুনতেন?’
‘এই দ্যাখো আমরা এখানে কী জন্যে বসে আছি? মুখ্যমন্ত্রী সাতটার সময় রেডিওতে কিছু বলবেন বলেই তো। আমরা তো তাঁর কথা শুনব।’
স্বপ্নেন্দু আর কথা বাড়াল না। এক-একটা লোক থাকে ঝগড়াটে টাইপের। যে কোনও ছুতো পেলে তাদের জিভ লকলকিয়ে ওঠে। এতবড় একটা পরিবর্তন হয়ে গেল তবু লোকটার স্বভাব পালটাল না।
স্বপ্নেন্দু আবার লোকগুলোর দিকে তাকাল। সম্পূর্ণ ভৌতিক দৃশ্য। একদিন আগে হলে তবু লোকটার এইরকম চেহারার সঙ্গে বসে আছে ভাবলে বুক শুকিয়ে যেত। এই সময় অবনীদা রেডিওটাকে খুলে দিলেন। সেই কু শব্দ শুরু হয়েছে। এখন বেশ চুপচাপ চারধার। গরম বাতাসটা থেমে গেছে। রেডিওর স্টেশন শুরু হওয়ার সিগন্যালটা বন্ধ হয়ে পুরুষকণ্ঠ শোনা গেল, ‘আকাশবাণী কলকাতা। বিশেষ ঘোষণা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গতকাল থেকে আকাশবাণীর নিয়মিত অধিবেশন বন্ধ রাখতে হয়েছিল বলে আমরা দুঃখিত। এখন সমস্ত কলকাতাবাসীর কাছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিশেষ বক্তব্য রাখবেন।’ কয়েক সেকেন্ড নীরবতার পর মুখ্যমন্ত্রীর পরিচিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘বন্ধুগণ। আমরা অভূতপূর্ব একটি পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে বাধ্য হয়েছি। পৃথিবীর ইতিহাসে কখনও এমন ঘটনার কথা এর আগে শোনা যায়নি। গতকাল রাত সাড়ে দশটার সময় হঠাৎ দূর মহাকাশের একটি নক্ষত্র স্থানচ্যুত হয়। তারই আকর্ষণে পৃথিবীর একাংশে প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। আমাদের দুর্ভাগ্যের কিংবা সৌভাগ্যের বিষয় সেই একাংশটি হল কলকাতা শহর। হঠাৎ বাতাস উত্তপ্ত হয়। এবং পরমাণু বিস্ফোরণের প্রতিক্রিয়া অথবা আগ্নেয়গিরি থেকে উদ্ভূত লাভার মতো একটি হাওয়া কলকাতার ওপর বয়ে যাওয়ায় মানুষের শরীর থেকে রক্ত-মাংস-ধমনি অদৃশ্য হয়ে যায়। শুধু মানুষ নয়, কলকাতার যত পশু-পাখি ছিল তাদেরও এই হাওয়া শিকার করে। মানুষ এবং সুগঠিত প্রাণীরাই শেষ পর্যন্ত জীবিত থাকতে পেরেছেন। সেই সময়ে চালু থাকা কিছু ক্যামেরায় ধরা পড়ে অদৃশ্য লাভার রং ছিল কালো।
‘মাত্র আধঘণ্টা ওই লাভাস্রোতের স্থায়িত্ব কিন্তু তার মধ্যেই আমাদের পরিচিত মানবীয় চেহারা লুপ্ত হয়। কলকাতার চৌহদ্দিতে যত গাছপালা, ফুলের বাগান এবং ঘাস ছিল সব ছাই হয়ে যায়। এই মুহূর্তে আমরা বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন। আমি আমাদের বিজ্ঞানীদের বলেছি তাঁরা যেন অবিলম্বে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আমি তাঁদের এও বলেছি প্রাকৃতিক পরিবর্তনের হেতু আমাদের শরীরিক পরিবর্তন হয়েছে। কোনও অবস্থায় আবার আগের চেহারায় আমরা ফিরে যেতে পারি কি না।
‘বন্ধুগণ! আমি জানি এই পরিবর্তন মেনে নেওয়া খুব কঠিন। এতদিন আমরা যে শরীর দেখে অভ্যস্ত হয়েছি তার ব্যতিক্রম অবশ্যই পীড়া দেবে। কিন্তু জনসাধারণকে অনুরোধ করছি, এই যে পরিবর্তন ঘটে গেল তা আপাতত অনেকগুলো সমস্যা থেকে মুক্তি দেবে। প্রথমত, খাদ্যবস্তুর অভাব আমরা অনুভব করব না। পৃথিবীতে আমরা জন্মগ্রহণ করি এবং জীবিত থাকি কিছু কাজ করবার জন্যে। যা দেশের উপকারে লাগে এবং মনের শান্তি হয়। কিন্তু এতদিন আমরা শরীর টিকিয়ে রাখতে অনেক বাজে সময় ব্যয় করতাম। খাদ্য উৎপাদন এবং সমগ্র সেই খাদ্যকে পরিপাকের উপযোগী করে নিতে অনেক সময় এবং অর্থ নষ্ট হতো। এখন আমাদের আর এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। এ মুহূর্তে আমাদের হাতে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ এবং আধুনিক জীবনের যাবতীয় প্রয়োজনীয় বস্তু মজুত আছে। আমি কলকাতাবাসীর কাছে আন্তরিক আবেদন করছি তাঁরা যেন অবিলম্বে স্বাভাবিক কাজকর্মে যোগ দেন। যে যা করছিলেন এতকাল আগামীকাল থেকেই সেইসব কাজ শুরু করেন। শারীরিক পরিবর্তনের কারণে যাঁরা কর্মচ্যুত হবেন সরকার তাঁদের সমস্ত দায়িত্ব নেবে। আমরা স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হয়েছি, আপনারা সাহায্য করুন। কাল থেকে যে যার কাজে যোগ দিন।
‘বন্ধুগণ, প্রথমেই আমি বলেছি কলকাতা দুর্ভাগ্য কিংবা সৌভাগ্যের অধিকারী। কেন সৌভাগ্য তা ব্যাখ্যা করা দরকার। এতকাল এই যুক্তরাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এবং সামাজিক পরিবেশে আমরা অনেক কাজ ইচ্ছে থাকলেও করতে পারিনি। আমরা একটা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু পরিস্থিতি আমাদের অনেক দূরে থাকতে বাধ্য করেছিল। গতরাত্রে আমরা সেই সৌভাগ্যের অধিকারী হয়েছি। এই শারীরিক পরিবর্তন আমাদের কী-কী সুবিধে এনে দেবে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যায় না গিয়েও প্রধান কয়েকটি কথা জানাচ্ছি। এখন থেকে মানুষের সঙ্গে মানুষের কোনও শারীরিক পার্থক্য থাকবে না। কালার প্রবলেম বা গায়ের চামড়ার পার্থক্যপ্রসূত যে ব্যবধান তা দূর হবে। কলকাতার মানুষের চেহারা এক হয়ে যাওয়ায় কোনও সাম্প্রদায়িক সংঘাত হবে না। খাদ্যদ্রব্যের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। তাছাড়া অর্থনীতির নানান পরিবর্তন আসতে বাধ্য।
‘বন্ধুগণ! কেউ-কেউ আমার কাছে আর-একটি বিষয়ে আশংকার কথা ব্যক্ত করেছেন। শারীরিক পরিবর্তনের কারণে মানুষের প্রজনন ক্ষমতা লুপ্ত হওয়ায় আমাদের বংশধররা পৃথিবীতে আসবে না। এর ফলে কলকাতাবাসীরা একদিন লুপ্ত হবে। কিন্তু আমি বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা আমাকে জানিয়েছেন বিপ্লব আমাদের যা দিতে পারত না এই লাভাস্রোত তা আমাদের দিয়েছে। আমরা এখন অমৃতের সন্তান। মৃত্যুর কালো হাত আর আমাদের স্পর্শ করবে না। আমরা অমর। যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন আমরা বেঁচে থাকব। এই মহান সম্মানের অধিকারী হওয়া যে সত্যি সৌভাগ্যের সেকথা বলাই বাহুল্য। তবু আমি বিজ্ঞানীদের অনুরোধ করেছি তাঁরা গবেষণা করুন। এমন একটা আবিষ্কার করুন, কলকাতাবাসীরা প্রজনন ক্ষমতার অধিকারী হয়। আপনারা স্মরণ করুন, একদিন আগেও আমরা জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য প্রচার চালিয়ে এসেছি। ওই লাল ত্রিকোণ চিহ্নের কোনও প্রয়োজন আর আমাদের নেই। অতএব আমরা আবার জনসাধারণকে অনুরোধ করছি অবিলম্বে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরিয়ে আনুন। নমস্কার।’
এরপরেই ঘোষকের স্বর শোনা গেল, ‘এতক্ষণ কলকাতাবাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। গ্রামোফোন রেকর্ডে রবীন্দ্র-সুর বাজানো হচ্ছে। স্বপ্নেন্দু উঠে দাঁড়াল। রেডিওতে তখন বাজানো হচ্ছে, ‘হে নূতন, দেখা দিক আর বার।’
অবনীদা করোটি ঘুরিয়ে জিগ্যেস করল, ‘চললে?’
‘হ্যাঁ। একটু চারপাশ ঘুরে আসি।’
অবনীদা বলল, ‘কী করব বুঝতে পারছি না। মুখ্যমন্ত্রী বললেন যে যার কাজে ফিরে যেতে। আমি যদি কাল থেকে উনুন ধরাই তাহলে চায়ের খদ্দের পাব? কে খাবে চা?’
অরবিন্দ নামক লোকাটা বলল, ‘তুমি তো দেখছি সত্যি ভালোমানুষ। আরে তোমার উনুন ধরানোর কী দরকার? খাওয়ার-দাওয়ার চিন্তা নেই। পায়ের ওপর পা তুলে দিনরাত গপ্পো করব। এই উনুনটা ভেঙে ফেলে এখানে ভালো আড্ডা মারার জায়গা করো। তোমার তো খাটুনি বেঁচে গেল।’
‘দিনরাত গপ্পো করব? আমার তো সময় কাটবে না।’
স্বপ্নেন্দু বেরিয়ে এল। মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণের প্রতিক্রিয়া কি না কে জানে তবে এখন রাস্তায় নরকঙ্কাল দেখা যাচ্ছে। কেউ-কেউ কাঁদছে। কিন্তু বাকিরা খুব ভয়ে-ভয়ে চারপাশে তাকাচ্ছে। এইসব কঙ্কালেরা পোশাক পরেছে এলোমেলোভাবে। বিছানার চাদর কোমরে জড়িয়ে নিয়েছে কেউ। স্বপ্নেন্দু লক্ষ করল কোনও মহিলা কঙ্কাল নেই রাস্তায়। একটি শিশু কঙ্কালকে বুকের কাছে নিয়ে কুঁজো হয়ে যাওয়া একটি কঙ্কাল ফুটপাতে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়ছে। স্বপ্নেন্দুকে দেখে লোকটা জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কি রক্তমাংসের মানুষ?’
স্বরে বোঝা গেল লোকটা বৃদ্ধ। উত্তর না দিয়ে স্বপ্নেন্দু মাথা থেকে চাদরের আড়ালটা সরিয়ে দিতে বৃদ্ধ মাথা নাড়ল, ‘ওঃ। একই অবস্থা। সব মানুষের একই হাল। এ যে নরক হয়ে গেল।’
‘নরক বলছেন কেন? মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণ শোনেননি?’
‘শুনেছি। কিন্তু তাতে কি মন মানে? দুদিন আগে আমার বউ মারা গেছে। কী সৌভাগ্যবতী ছিল সে। রক্তমাংসের শরীর নিয়ে ড্যাং-ড্যাং করে চিতায় চড়ে গেল।’ বুড়োর স্বরে কান্না মিশল।
‘কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী বললেন আমরাই একমাত্র সৌভাগ্যবান।’
‘সৌভাগ্য? কী জানি!’
‘আজকে আপনার শরীরের কি পরিবর্তন লক্ষ করলেন?’
বৃদ্ধ এবার হাসল, ‘তা হয়েছে বইকী। প্রস্রাব করতে খুব কষ্ট হতো। সেটা দূর হয়েছে। হাঁটতে গেলে পায়ের শিরায় টান ধরত, এখন হচ্ছে না।’
‘তাহলে বলুন, আপনি অনেক ভালো আছেন।’
‘আমার কথা ছেড়ে দাও! এই বাচ্চাটা। মোটে একবছর বয়স। এখনও ভালো করে হাঁটতে পারে না। এর কী হবে? এ কি কখনও বড় হবে?’
স্বপ্নেন্দু বলল, ‘আমি জানি না।’
আর হাঁটতে তার ভালো লাগছিল না। শরীর যদিও হালকা তবু হয়তো অনভ্যাসে ক্লান্তি লাগছিল। স্বপ্নেন্দু বাড়িতে ফিরে এল। পায়ের তলাটা বেশ টনটন করছে। তার মানে এতকাল চামড়া এবং মাংস যে আড়াল রেখেছিল তা না থাকায় ব্যথা হয়েছে।
ঘরে ঢুকে পাঞ্জাবিটা খুলতেই মন খারাপ হয়ে গেল আবার। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখল সে। এই কাঠামোটা তার? অথচ এতকাল এর অস্তিত্ব সম্পর্কে সে সজাগই ছিল না। স্বপ্নেন্দুর খেয়াল হল তার হাড়ের গায়ে মাঝে-মাঝে কালচে পোড়া চামড়া লেগে আছে। এগুলো পরিষ্কার করে ফেললে ভালো হয়। বাথরুমে ঢুকল সে। কল খুলতে অবাক হল সে। জল নেই। এক ফোঁটা জল বের হল না। এই বাড়ির ছাদে একটা ট্যাঙ্ক আছে। সারা দিনরাত জলের আজ পর্যন্ত কোনও অভাব হয়নি। তারপরেই মেরুদণ্ডের হাড় কেঁপে উঠল, কলকাতা শহরের সমস্ত জল গতকালের প্রতিক্রিয়ায় উধাও হয়ে যায়নি তো! জল ছাড়া কি চলছে। মুখ্যমন্ত্রী একবারও এ বিষয়ে কিছু বললেন না। জল হল জীবন, কলকাতায় যদি জল না থাকে—! নিজেকে গালাগাল দিল সে। এখনও উলটোপালটা ভেবে যাচ্ছে। কলকাতার মানুষের আর জলের প্রয়োজন নেই। এখন যে শরীর নিয়ে তাদের বেঁচে থাকতে হবে জল তার কোনও কাজেই লাগবে না। তোয়ালে দিয়ে শরীরটাকে পরিষ্কার করল সে। ক্রমশ হাড়গুলোর চেহারা পালটে যেতে লাগল। বেশ তকতকে দেখাচ্ছিল সেগুলো। আয়নার সামনে এসে দাঁড়াতেই নিজের শরীরটাকে একটু পছন্দসই বলে মনে হল। আর তখনই সুজিতের কথা মনে পড়ল। সুজিত গতকাল ফোন করে বলেছিল আজকে সন্ধ্যায় যেন সে যায়। এই চেহারা নিয়ে যাওয়া যায়? তা ছাড়া, সুজিত, সুজিতের কী অবস্থা? ও তো নামকরা চিত্রাভিনেতা। পাশের ঘরে টেলিফোন। খুব সন্তর্পণে ডায়াল করল স্বপ্নেন্দু। এটা এখনও কাজ করছে কি না কে জানে। কিন্তু ডায়াল টোন ছিল যখন স্বপ্নেন্দু শুনল ওপাশে রিং হচ্ছে। তারপরেই সুজিতের নার্ভাস স্বর কানে এল, ‘হ্যালো।’
‘সুজিত? আমি স্বপ্নেন্দু।’
‘ওঃ!’
‘তুমি কেমন আছ?’
‘আমি? আমি শেষ হয়ে গেছি। কমপ্লিট ব্রোক। আয়নার সামনে দাঁড়াতে পারছি না। কী ভয়ঙ্কর! আমি এখন কী করব? ঘরের দেয়াল জুড়ে আমার যে সুন্দর ছবি সেদিকে তাকালে বুক জ্বলে যাচ্ছে। কেউ আর আমার দিকে ফিল্ম অ্যাক্টর বলে তাকাবে? জানলা দিয়ে দেখলাম রাস্তার মানুষজন আমারই মতো দেখতে। এমনকী আমার চাকরটার সঙ্গেও কোনও পার্থক্য নেই।’
‘মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন বিপ্লবও এতটা সাফল্য আনত না।’
‘রেখে দাও বিপ্লব। এখন আর টালিগঞ্জে কাজ হবে ভেবেছ। আমি আজ সারাদিন আমাদের লাইনের সবাইকে কন্ট্যাক্ট করার চেষ্টা করেছি। তুমি জানো মিস মিত্র আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন!’
‘মিস মিত্র?’
‘ওঃ, তুমি সিনেমা দ্যাখো না নাকি? বাংলার শ্রেষ্ঠ সুন্দরী নায়িকা। কিন্তু গলায় দড়ি দেওয়া সত্বেও ওর মৃত্যু হয়নি। শুধু ঘাড়ের হাড় ভেঙে যাওয়ায় মাথাটা হেলে রয়েছে! এ কী হল স্বপ্নেন্দু?’
‘জানি না। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন মেনে নিতে।’
‘তোমাদের আর কী। এ সব এখন বলতে বাধা নেই। দেহপট সনে নট সকলই হারায়। উঃ, ভগবান, কী যে করি!’
‘তোমার ওখানে আজ আমার—’
‘সেসব ক্যানসেলড। ইয়ার্কি ইচ্ছে? আমার ফ্রিজে গাদাগাদা খাবার। কালকে তিনটে রয়্যাল স্যালুট এনেছিলাম। সবচেয়ে দামি হুইস্কি। সব চোখের সামনে অথচ আমি খেতে পারছি না।’ ওপাশে সজোরে রিসিভার নামিয়ে রাখার শব্দ পেল স্বপ্নেন্দু।
এই প্রথম তার হাসি পেল। মিস মিত্র আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেও পারেননি! মিস মিত্র সত্যিই সুন্দরী। আর তখনই ওর মনে হেনা সেনের মুখ ভেসে উঠল। আজ সারাদিন নিজেকে নিয়ে এমন ব্যস্ত ছিল যে হেনার কথা মনেই পড়েনি। হেনা কেমন আছে? সঙ্গে-সঙ্গে চিৎকার করে উঠল স্বপ্নেন্দু। সেই লোভনীয় শরীর আর তার চলনের ভঙ্গিটা চোখের সামনে দেখতে পেল। না হতে পারে না। হয়তো হেনার ওদিকে অদৃশ্য লাভার স্রোত বয়ে যায়নি। হেনার তীক্ষ্ণ অথচ দীঘির মতো ভারী বুক এবং নিতম্ব, চোখের কারুকাজ স্বপ্নেন্দুর মাথায় কিলবিল করতে লাগল। আর তারপরেই একটা ভয় হৃৎপিণ্ডটাকে আঘাত করল। যদি হেনা সেন আক্রান্ত না হয়, যদি তার শরীর এখনও আগের মতো মাদকতা জড়ানো থাকে তাহলে? স্বপ্নেন্দু ঝিম হয়ে বসে রইল। না, তা হতে পারে না। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন কলকাতার ওপর দিয়ে সেই অদৃশ্য লাভা স্রোত বয়ে গিয়েছে। হেনা সেন কোনওভাবেই বেঁচে যেতে পারে না। ঠিক হল না কথাটা, হেনা সেনের আগের শরীরটা অটুট থাকতে পারে না। যদি হেনা সেন আগের মতো থাকে তাহলে সে কখনও তার সামনে দাঁড়াতে পারবে না। রক্তমাংসের ওই সুন্দরী কখনই একটি জীবন্ত কঙ্কালকে চোখ চেয়ে দেখতে পারবে না। ঘৃণা এবং ভয়ে মুখ ফিরিয়ে নেবে। স্বপ্নেন্দু স্পষ্ট অনুভব করল তার হৃৎপিণ্ড কাঁপছে। হেনা সেনের জন্যে অদ্ভুত একটা আকর্ষণ বোধ করছিল সে। ঈশ্বর নিশ্চয়ই এতটা কঠিন হবেন না। ওই অদৃশ্য লাভস্রোত নিশ্চয়ই হেনার বাড়ির ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। এখন এই রাত্রে কিছু জানবার উপায় নেই। ওর বাড়িতে টেলিফোন আছে কি না তা জানে না স্বপ্নেন্দু। কাছাকাছি হলে না হয় হেঁটে যাওয়া যেত।
ভীষণ কাহিল লাগছিল। আলোটা নেভাতে গিয়ে থমকে গিয়ে দাঁড়াল সে। তার হৃৎপিণ্ড আবার কাঁপছে। শরীর স্থির। তারপর পায়ে-পায়ে সে এগিয়ে গেল টেবিলটার কাছে। কাচের বাতিটা টকটকে লাল হয়ে গেছে। উলটো করে বসানো বাটিটার মধ্যে সেই লাল গোলাপটাকে এখন আরও জীবন্ত দেখাচ্ছে। আরও টাটকা। এমনকী ওর নিটোল নরম পাপড়ির গায়ে সেই জলের ফোঁটাও চকচক করছে। লোভীর মতো ফুলের দিকে তাকিয়ে রইল স্বপ্নেন্দু। কী উদ্ধত ভঙ্গি রক্তগোলাপটার। হাত বাড়াল সে। কিন্তু তারপরেই কথাটা খেয়াল হল। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন কলকাতার কোনও গাছ কিংবা বাগান যদি বেঁচে না থাকে, মাঠের ঘাসগুলো যদি শুকিয়ে ছাই হয়ে গিয়ে থাকে তা হলে এই লাল গোলাপটা এখনও এমন গর্বিত ভঙ্গিতে বেঁচে আছে কী করে? স্বপ্নেন্দুর মনে হল, হয়তো সমস্ত কলকাতায় এই একটিমাত্র জীবিত ফুল। যদি ওটা কোনও ফুলদানি কিংবা টেবিলে খোলা থাকত তা হলে আজ সকালে ছাই হয়ে যেত। কিন্তু কাচের পাত্রের নিশ্ছিদ্র আড়াল ফুলটাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। এবার প্রচণ্ড লোভীর মতো মাথাটাকে কাচের বাটির গায়ে নিয়ে গেল সে। পাপড়ির শরীরের কোষগুলোকে যেন অনুভব করতে পারছে সে। এই কলকাতার কোথাও এই মুহূর্তে আর কোনও উদ্ভিদ নেই শুধু এই ফুলটি ছাড়া। কিন্তু কতদিন এ এইরকম থাকবে? আসতে-আসতে তো শুকিয়ে মরে যাবেই। স্বপ্নেন্দু মাথা নাড়ল। না, কাল রাত্রের ওই ভয়ঙ্কর ঘটনার পরও যখন এ বেঁচে আছে তখন নিশ্চয়ই অনেককাল অটুট থাকবে। ওই কাচের বাটিটাকে সরালে চলবে না। কোনও অবস্থায় ওই বাটিতে হাত দেবে না সে। তাহলে ফুলটা বেঁচে থাকবে। ওকে যেভাবেই হোক বাঁচিয়ে রাখতে হবে। স্বপ্নেন্দু কাচের বাটিটার দিকে তাকাল খুব জোর হাওয়া বইলে কি ওটা উলটে যাবে? ঠিক ভরসা হয় না। সে চারপাশে তাকিয়ে দেখল। তারপর আরও একটা কাচের বড় জার এনে সেটাকে উলটে বাটিটাকে চাপা দিল সন্তর্পণে, যাতে দুটোয় ছোঁয়াছুঁয়ি না হয়ে যায়। তারপরে সে ফিরে এল বিছানায়। দুটো কাচের আড়ালে থাকলেও ফুলের লাল রংটা বোঝা যাচ্ছে। স্বপ্নেন্দুর সেই রূপকথার গল্পটা মনে পড়ল। গভীর সমুদ্রের নিচে একটা ঝিনুকের বুকে কারও প্রাণ লুকনো ছিল। মনে হল ওই দুই কাচের পাত্রের আড়ালে জীবন্ত ফুলটা তার প্রাণ। কারণ ওটার দিকে তাকালেই হৃৎপিণ্ডটা অদ্ভুত শান্ত হয়ে যায়। কোনও চিন্তা মাথায় আসে না, শুধু একটা ভালো লাগায় বিভোর হতে হয়।
কাল সারাটা রাত ঘুম আসেনি। চেষ্টা করেছে স্বপ্নেন্দু, বিছানায় নিথর হয়ে পড়ে থেকেছে। কিন্তু ঘুমুতে পারেনি। তার চোখের পাতা কিংবা অক্ষিগোলক নেই। শোওয়া অবস্থায় সবসময় ঘরের ছাদটায় দৃষ্টি আটকে থেকেছে। এই দৃষ্টি বন্ধ করার কোনও কায়দা তার জানা নেই। শেষপর্যন্ত বুঝতে পেরেছে পরিবর্তিত অবস্থায় তাদের ঘুম আসবে না। ঘুম প্রয়োজন শরীরের। ঘুমন্ত অবস্থায় হৃৎপিণ্ড কাজ করে যায়। তাই শরীর যদি না থাকে তা হলে ঘুমের কী দরকার। অতএব খাবার, জল ইত্যাদির মতো ঘুমও তার জীবন থেকে চলে গেল।
মাঝরাত্রে খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। সে সারাজীবন ঘুমাতে পারবে না এটা চিন্তা করতেই অস্বস্তিটা বেড়ে যাচ্ছিল। অন্যমনস্ক স্বপ্নেন্দু পাশ ফিরে তাকাতেই সেই গোলাপের রংটা দেখতে পেল। আর অমনি তার চিন্তা স্থির হয়ে মিলিয়ে গেল। সে লক্ষ করেছে বেশি উত্তেজিত হলে হৃৎপিণ্ড কাঁপে। ফুলটার দিকে তাকালে সেই কাঁপুনি থেমে যায়। সুন্দর শান্তিতে রাতটা কেটে গেল, ঘুম নেই, কিন্তু ফুলটার দিকে তাকিয়ে থেকে তার একটুও কষ্ট হচ্ছিল না সকালে।
আজও ছুটি। তার কিছুই করবার নেই। রেডিওটা খুলতেই বাজনা শুনতে পেল সে। আর মাঝে-মাঝেই সরকারের পক্ষ থেকে কলকাতাবাসীদের কাছে আবেদন জানানো হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চালু করার জন্যে। খবর শুনল সে। আজ সকালে ট্রামবাস আগের মতো চলতে শুরু করেছে। কলকাতার মানুষ দলে-দলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছেন। মনে হচ্ছে তাঁরা ওই ঘটনার প্রাথমিক আঘাত খুব দ্রুত কাটিয়ে উঠেছেন। আজ ছুটির দিন। মুখ্যমন্ত্রী আবেদন করেছেন কাল থেকে সবাই যেন নিয়মিত অফিস-কাছারিতে যোগ দেন।
দুপুরে বাড়ি থেকে বের হল স্বপ্নেন্দু। সেই পাজামা-পাঞ্জাবি এবং চাদর জড়িয়ে। আজ রাস্তায় অনেক লোক। স্বপ্নেন্দুর ভালো লাগল প্রত্যেকেই যে যার মতো পোশাক পরেছে। ট্রাম স্টপেজের কাছে আসতেই সে একটা স্বর শুনতে পেল, ‘এই যে দাদা, খুব শীত নাকি?’
সে মুখ ফিরিয়ে তাকাতে দেখতে পেল চারটি মাঝারি সাইজের কঙ্কাল একটা রকে বসে আছে। প্রত্যেকের পরনে চাপা প্যান্ট এবং রঙিন জামা। করোটির দিকে তাকালে বোঝা যায় ওদের বয়স খুব বেশি নয়। সে দেখছে বুঝে একজন বলল, ‘অত লজ্জা কেন? আপনার মাথা কি আলাদা? খুলে ফেলুন, খুলে খেলুন। পাঁচজনে দেখুক।’
আর-একজন পিনিক কাটল, ‘যেন লজ্জাবতী বউ!’
স্বপ্নেন্দুর চোয়াল শক্ত হল। এরা যে রকবাজ তা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না! সামনের বস্তির কিছু ছেলে এখানে এসে বসে আড্ডা মারে, খিস্তি করে, প্রয়োজনে বোমাটোমাও ছোঁড়ে। এই দলটা তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এখন সে কিছুই করতে পারে না। এই শরীর নিয়ে মারামারি করার কথা চিন্তা করাও যায় না। কিন্তু এত কাণ্ডের পরও ওরা ওদের স্বভাব ত্যাগ করতে পারেনি সেটাই আশ্চর্যের কথা। এই জেনারেশনের ছেলেগুলো কি কোনও কিছুতেই রিঅ্যাক্ট করে না? তার মনে হল, ওরা আগের মতোই আছে, হয়তো ভালোই আছে।
ধর্মতলার ট্রাম আসছিল। স্বপ্নেন্দু লক্ষ করল ড্রাইভারের শরীরে ওভারকোট, মাথায় মাফলার জড়ানো। কিন্তু লোকটা যে কঙ্কাল তা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। লোকটা নিশ্চয়ই তারই মতো। নইলে এই গরমে ওসব জড়িয়ে বের হয়। ট্রামটা থামতে উঠে পড়ল স্বপ্নেন্দু। বিভিন্ন সাইজের কঙ্কালে সিটগুলো ভরে আছে। কিছু দাঁড়িয়ে। বোঝা যাচ্ছে ছুটির দিন সবাই কলকাতার নতুন চেহারা দেখতে বেরিয়েছে। এবং তখনই তার চোখে পড়ল লেডিস সিটে দুজন মহিলা বসে আছেন। মহিলা, তার কারণ ওঁদের পরনে শাড়ি-ব্লাউজ। আঁচল ঘোমটার মতো মাথায় জড়ানো। স্বপ্নেন্দুর হৃৎপিণ্ড থরথরিয়ে উঠল। মুখের দিকে তাকালে কেমন ছ্যাঁক করে ওঠে। সে আরও একটু সরে এল। লেডিস সিটে কিছু জায়গা খালি আছে। যারা দাঁড়িয়ে তারা ইচ্ছে করেই বসেনি। সে দুই মহিলার মুখের দিকে তাকাল। গোলগাল ছোট্ট করোটি। নাক এবং গালের হনুতে স্পষ্ট পার্থক্য আছে পুরুষদের সঙ্গে। হাতের হাড় সরু-সরু। দেখলেই বোঝা যায় খুব পলকা শরীর। পাশে দাঁড়ানো একজন বলল, ‘বসতে চান বসে পড়ুন। লেডিস উঠলেই হয়ে যাবে।’
একজন মহিলা সেকথা শুনে মুখ তুলেই ফিরিয়ে নিলেন! এঁর নাকের ডগাটা বসা, কপাল উঁচু। কোনও মেয়ের চেহারা এত বীভৎস হতে পারে? মনে হতেই হেসে ফেলল স্বপ্নেন্দু। রাস্তায় বের হলেই বোঝা যাচ্ছে পুরুষরাও কতখানি কুৎসিত দেখতে। এতকাল মাংস, চামড়া এবং রং প্রত্যেকের খামতি আড়াল করে রাখত।
আজ কলকাতার কোনও দোকানপাট খোলেনি। ধর্মতলাটা ছুটির দিনে যেমন, তার থেকেও বেশি খাঁ-খাঁ। যেন হরতাল হয়ে গেছে। শুধু কাতারে-কাতারে মানুষ উৎসুক হয়ে বেরিয়ে পড়েছে। বাস চলছে গোটা কয়েক। কিন্তু প্রাইভেট গাড়ি চোখে পড়ল বেশ কিছু। যারা চালাচ্ছে তাদের ভঙ্গি ঠিক আগের মতনই। ট্যাক্সি একটাও বের হয়নি রাস্তায়।
গড়ের মাঠের অবস্থা খারাপ হয়েছিল পাতাল রেলের কল্যাণে। এখন তো তাকানোই যায় না। সব ঘাস উধাও হয়ে ন্যাড়া হয়ে গেছে চারধার। গাছগুলো পর্যন্ত পোড়া কয়লা। ইডেন গার্ডেন একটা পোড়া বাগানের চেহারা নিয়েছে। আরও কয়েক পা হাঁটার পর চমকে উঠল স্বপ্নেন্দু। গঙ্গায় এক ফোঁটা জল নেই। চাপ-চাপ শক্ত কাদার ওপর মৃত জলচর প্রাণীর হাড় ছড়িয়ে আছে। নদীর কঙ্কালটাকে বীভৎস দেখাচ্ছিল। লঞ্চ এবং জাহাজগুলো নদীর কাদায় আটকে রয়েছে। জল নেই, কাথাটা মনে পড়ল। মুখ্যমন্ত্রী বলছেন বহির্জগতের সঙ্গে কলকাতা বিচ্ছিন্ন। তাহলে এই গঙ্গায় শেষ যেখানে সেখানে কী আছে? স্বপ্নেন্দুর মাথায় ঢুকছিল না। নিশ্চয়ই গোটা সমুদ্রটা উধাও হয়ে যায়নি। অবশ্য সমুদ্র কলকাতার বাইরে।
সারাদিন স্বপ্নেন্দু ঘুরে বেড়াল। মানুষের আচরণ এখন প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তবে রাস্তাঘাটে বিভিন্ন সাইজের কঙ্কালের অকারণ ভিড়। তালতলায় এসে ওর মন্টুদার কথা মনে পড়ল। প্রচণ্ড আড্ডার লোক। বিয়ে-থা করেও ঠিক সংসারী হয়নি। বউদিই সংসার চালিয়ে এসেছেন, মন্টুদা টাকা দিয়ে খালাস। স্বপ্নেন্দু ট্রাম থেকে নেমে পড়ল। মন্টুদার বাবার এ অঞ্চলে বড়লোক বলে খ্যাতি ছিল। গোটা তিনেক বাড়ি আছ। সেগুলোর ভাড়াটে আদ্যিকালের ভাড়ায় বহাল তবিয়তে রয়েছে। এই নিয়ে কোর্ট-কাছারি চলছে। এইটেই মন্টুদার একমাত্র অশান্তির কারণ।