ফুটো

ফুটো

গৌর ছুটতে ছুটতে এসে যে-খবরটি দিলে তাতে আমাদের চক্ষু একেবারে চড়ক গাছ!

ঘনাদা আবার বুঝি মেস ছেড়ে যায়!

আবার?!?!

কী হল কী?? ছুটির দিন দুপুরবেলায় বসবার ঘরের মেঝেয় সবে তখন শতরঞ্জিটা পেতে তাস-জোড়া নিয়ে বসেছি। হঠাৎ এ-সংবাদে যেন যুদ্ধের সময়কার সাইরেনের আওয়াজে ধড়মড় করে উঠে পড়লাম।

প্রথম চোটটা গৌরের ওপরই গিয়ে পড়ল। শিশির তো মারমূর্তি হয়ে বললে— তুই তুই—নিশ্চয়—তুই-ই সব নষ্টের মূল।

আহা, আমি মূল হতে যাব কেন? গৌর নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে উঠল, সব নষ্টের মূলে ওই ফুটো!

ফুটো!!

হ্যাঁ, দেখবেই চলো না।

আর দুবার বলবার দরকার হল না। গৌরের পিছু-পিছু সবাই ঘনাদার তেতলার ঘরে গিয়ে উঠলাম।

উঠে বুঝলাম ব্যাপারটা গুরুতর।

আমাদের এতজনকে এমন হুড়মুড় করে তাঁর ঘরে ঢুকতে দেখেও ঘনাদার কোনও ভাবান্তর নেই।

তিনি গম্ভীর মুখে তাঁর জিনিসপত্র গোছাতে তন্ময়।

জিনিসপত্র বলতে সাধের গড়গড়াটি বাদে একটি ছোট কম্বল জড়ানো বিছানা ও একটি পুরোনো রংচটা ঢাউস তোরঙ্গ।

এই তোরঙ্গটি আমাদের সকলেরই অত্যন্ত কৌতূহলের বস্তু। তার ভেতর কী যে আছে আর কী যে নেই এ নিয়ে বহুদিন আমাদের অনেক গবেষণা তর্কাতর্কি হয়ে গেছে।

কারওর সামনে কোনওদিন এ তোরঙ্গ খুলতে ঘনাদাকে দেখা যায়নি। নিন্দুকেরা তাই এমন কথাও বলে থাকে যে তোরঙ্গটি ঘনাদার গল্পেরই চাক্ষুষ রূপা ওর ভেতর থেকে ঘনাদা না বার করতে পারেন এমন জিনিস নেই, কিন্তু আসলে ওটি একেবারেই ফাঁকা।

আমাদের দেখে আজকেও ঘনাদা সশব্দে তোরঙ্গের ডালাটি বন্ধ করে দিতে ভোলেন না, তারপর তাঁর সেই কম্বল জড়ানো বিছানা নিয়ে এমন ব্যস্ত হয়ে পড়েন যেন সাত রাজ্যের ধন তার মধ্যে তিনি জড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

ব্যাপার কী, ঘনাদা! এত বাঁধাবাঁধি কীসের? আমাদের জিজ্ঞাসা করতেই হয়।

ঘনাদা এতক্ষণে যেন আমাদের দেখতে পান। বিছানা বাঁধা থামিয়ে একটু দুঃখের হাসি হেসে বলেন, আর কেন? এখানে থাকা তো চলল না!

কেন, ঘনাদা!

কী হল, কী?

আমাদের প্রশ্ন ব্যাকুল থেকে ব্যাকুলতর হয়ে উঠে। শিবু উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করে, কালকের মাংসের চাপটা কি সুবিধের হয়নি?

গৌর তাতে রসান দিয়ে বলে, আজ তো আবার গঙ্গার ইলিশ এসেছে।

শিশির সাগ্রহে সিগারেটের টিনটা এগিয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করে, ভাতে, না কাঁচা ঝোল কোনটা আপনার পছন্দ?

কিন্তু ভবী আজ কিছুতেই ভোলবার নয়। গঙ্গার ইলিশের নামেও ঘনাদাকে টলানো যায় না। শিশিরের সিগারেটের টিনের দিকে দৃকপাত পর্যন্ত না করে তিনি ক্লান্তভাবে বলেন, আমার পছন্দে কী যায়-আসে আর। আমি তো আর থাকছি না।

থাকছেন না! কেন বলুন তো! ওয়াশিংটন কি লন্ডন থেকে জরুরি ডাক এল নাকি? এই সংকটকালেও শিবুর মুখ ফসকে রসিকতাটা বোধহয় বেরিয়ে যায়। আমরা কিন্তু শিবুর ওপর খেপে যাই।

কী পেয়েছিস কী, ঘনাদাকে! হেট করে ডাকলেই অমনই উনি চলে যাবেন? সে ইডেন কি ডালেস হলে যেত! বলে কতদিন সাধ্যসাধনা করেও ওঁকে নিয়ে যাওয়া যায় না! না, না সত্যি কী ব্যাপার বলুন তো, ঘনাদা?

ঘনাদা, কেন বলা যায় না, একটু যেন প্রসন্ন হয়েছেন মনে হয়। বিছানা বাঁধার যে দড়িগাছটা এতক্ষণ ধরে নানাভাবে নাড়াচাড়া করছিলেন সেটা ছেড়ে দিয়ে অত্যন্ত গম্ভীর ভাবে বলেন, কেন, সত্যি জানতে চাও?

চাই বই কী! আমরা সমস্বরে আগ্রহ জানাই।

উঠে দাঁড়িয়ে যেন কোনও দারুণ রহস্য উদঘাটন করতে যাচ্ছেন এই ভাবে ঘনাদা আমাদের ইশারায় ঘরের একটা দেওয়ালের কাছে নিয়ে যান। তারপর হঠাৎ নাটকীয়ভাবে একদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলেন, দেখো!

গৌরের কাছে ব্যাপারটা আগে একটু জেনে তৈরি থাকলেও আমরা প্রথমটা একটু হতভম্বই হয়ে যাই।

ঘনাদার আজকাল দৃষ্টিভ্রম হচ্ছে নাকি! সাদা দেওয়ালে স্বপ্ন দেখছেন! তারপর অবশ্য ব্যাপারটা চোখে পড়ে।

মেঝে থেকে দেওয়াল যেখানে উঠেছে, সেখানে একটি কোণে একটা পেনসিল গলাবার মতো ছোট একটা ফুটো!

আমরা অতি কষ্টে হাসি সংবরণ করি, কিন্তু ঘনাদা যেন সহ্যের সীমা পার হয়ে গেছেন এমনই ভাবে বলেন, এই ফাটা-ফুটো ঘরে মানুষ বাস করতে পারে?

আঙুল গলাবার মতো একটা ফুটোয় ঘরটা কেন মানুষের বাসের অযোগ্য হয়ে উঠেছে বুঝতে তখন আর আমাদের বাকি নেই।

অপরাধটা আমাদের সবাইকার। নীচের কলতলাটা অনেকদিন থেকেই ভেঙে চুরে গেছল। বাড়িওয়ালাকে অনেক ধরেটরে দিন কয়েক আগে আমরা সে জায়গাটা নতুন সিমেন্ট দিয়ে মেরামতের ব্যবস্থা করেছি।

কলতলা মেরামত দেখেই ঘনাদা আবদার ধরেছিলেন, কলতলার সঙ্গে তাঁর ঘরটাও একবার মেরামত চুনকাম করে দিতে হবে।

আবদারটা অন্যায়। আমরা ঘনাদাকে অনেক করে বোঝাবার চেষ্টা করেছি। কলতলা সারাচ্ছে বলেই হঠাৎ সমস্ত বাড়ি ছেড়ে দিয়ে তেতলার একটা কুঠরি মেরামত করতে বাড়িওয়ালা রাজি হবে কেন? তা ছাড়া সেটা কি ভাল দেখাবে! কিছুদিন বাদেই সমস্ত বাড়িটা চুনকামের সময় তাঁর ঘরটার যা করা হবে।

কিন্তু কে কার কথা শোনে! ঘনাদা সেদিন থেকে গুম হয়ে যা চেপে রেখেছিলেন, আজ এই ফুটো দিয়েই তা ফাটবার উপক্রম।

অবস্থা সঙ্গিন বুঝে আমাদের বাধ্য হয়েই চাল পালটাতে হয়।

রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে বলি, আপনার ঘরের এ-অবস্থা হয়েছে তা তো জানতাম না।

গৌর সায় দিয়ে বলে, না, এ-ঘর এখুনি মেরামত ব্যবস্থা করা দরকার।

বাড়িওয়ালা যদি রাজি না হয়, আমরা চাঁদা তুলেই আপনার ঘর মেরামত করে দেব! শিশির দরাজ হয়ে ওঠে।

আগুনে জল পড়ে ঘনাদা যখন প্রায় ঠাণ্ডা হয়ে এসেছেন তখন শিবুর একটি বেফাঁস কথায় আবার সব বুঝি মাটি হয়ে যায়!

সত্যি! ফুটো বলে ফুটো? শিবু হঠাৎ ফোড়ন কেটে বসে, ও ফুটো দিয়ে ঘনাদা কোনও দিন গলে যাননি, এই আমাদের ভাগ্যি!

ঘনাদা শিবুর দিকে ঘাড় ফেরান। সেই ঘাড় ফেরাবার ধরন আর তাঁর মুখে আষাঢ়ের মেঘের মতো ছায়া দেখেই আমরা সামলাবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠি।

কিন্তু সামলাব কী? হাসি চাপতে প্রায় দম ফাটার জোগাড়!!

সব হাসির বেগ কিন্তু একটি কথায় ঠাণ্ডা।

কী ফুটো জীবনে দেখেছ হে? ঘনাদার গলা নয় তো যেন মেঘের ডাক শোনা যায়।

আর মেঘের ডাকে চাতকের মতো সব হাসি-ঠাট্টা ভুলে আমরা উৎসুক হয়ে উঠি।

আপনি কী ফুটো দেখেছেন ঘনাদা?

পড়েছেন নাকি কখনও গলে?

হ্যাঁ পড়েছি! ঘনাদা গম্ভীর মুখে আবার তাঁর বিছানায় এসে বসে বলেন, পড়েছি চার কোটি মাইল!

চার কোটি মাইল একটা ফুটো! শিশির প্রায় উলটে পড়ে যায় আর কী!

পৃথিবীটা এফোঁড় ওফোঁড় করলেও তো আট হাজার মাইলের বেশি হয় না। গৌর হতভম্ব হয়ে নিবেদন করে।

না, তা হয় না, নির্বিকার ভাবে ঘনাদা জানান।

তবে…? বলার আগেই যে যেখানে পারি আমরা বসে পড়ি। ঘনাদা শুরু করেন।

প্যারাসুটটা আর যেন খুলতেই চায় না। বিশ হাজার থেকে দশ হাজার ফুট, দশ হাজার থেকে পাঁচ হাজার। পাঁচ থেকে আড়াই, আড়াই থেকে এক হাজার ফুট!

তখনও ঠিক যেন ইটের বস্তার মতো পড়ছি তো পড়ছি-ই!

নীচের তুষার-ঢাকা পৃথিবী বিদ্যুদবেগে আমার দিকে ছুটে আসছে দেখতে পাচ্ছি। আর কটা সেকেন্ড। তারপর বুঝি শরীরের গুঁড়োগুলোও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

কিন্তু ঠিক পাঁচশো ফুটের কাছে আসলটা না হলেও এরকম বিপদের জন্যে ফাউ হিসাবে যে ছোট প্যারাসুটটা সঙ্গে থাকে সেটা খুলে গেল ভাগ্যক্রমে। কিন্তু তাতে কি আর পুরোপুরি সামলানো যায়। ইটের বস্তার মতো না হোক, বেশ সজোরেই নীচে গিয়ে পড়লাম।

কী ভাগ্যি শীতের শেষে তুষার একটু নরম হতে আরম্ভ করেছে, চোটটা তাই তেমন বেশি হল না।

প্যারাসুট গুটিয়ে নিয়ে তারপর গা থেকে খুলে অবাক হয়ে চারিদিকে চাইলাম। ধূ-ধূ করা তুষার-ঢাকা তুন্দ্রা দিগন্ত পর্যন্ত বিছোনো! কিন্তু মিখায়েলের দেখা নেই কেন?

প্যারাসুট নিয়ে সে তো আমার আগেই ঝাঁপ দিয়েছে প্লেন থেকে। এমন কিছু দূরে তো সে নামতে পারে না যে চোখেই দেখা যাবে না ।

পর মুহুর্তেই রহস্যটা পরিষ্কার হয়ে গেল। মিখায়েলকে এখনও মাটির ওপর দেখব কী করে? এখনও সে তো শূন্যলোকে।

প্যারাসুট না খোলার দরুন আমি যেখানে বিদ্যুদবেগে কয়েক মুহূর্তে নেমেছি, সেখানে তার খোলা প্যারাসুট ধীরে সুস্থে ভাসতে ভাসতে এখনও নামছে।

আকাশে তাকিয়ে তার প্যারাসুটটা এবার দেখতে পেলাম। মিনিট খানেকের মধ্যে শ-খানেক গজ দূরে সে নামল।

প্যারাসুট ও সঙ্গের যৎসামান্য লটবহর গুছিয়ে নিয়ে দূরবিন দিয়ে চারিধার আর একবার ভাল করে দেখে অবাক হয়ে বললাম, কই হে, মেরুর একটা শেয়ালও তো দেখতে পাচ্ছি না। তোমার ড. মিনোস্কি এই মহাশশ্মানে কোথায় লুকিয়ে থাকবেন!

আছেন নিশ্চয় কোথাও এখানে! এবং আমাদের তাঁকে খুঁজে বার করতেই হবে।

আহা, সে কথা তো অনেকবারই শুনিয়েছ। কিন্তু জায়গাটা ভুল করোনি তো? এই চেলস্কিন অন্তরীপ হল উত্তর মেরুর দিকে রাশিয়ার শেষ স্থূলবিন্দু। তারপর শুধু অনন্ত মেরুসমুদ্র। ঠিক এই জায়গাটিই ড. মিনোস্কি তাঁর যুগান্তকারী পরীক্ষার জন্যে বেছে নিয়েছেন এ খবরটায় কোনও ভুল নেই তো?

না, তাতে ভুল নেই। মিখায়েল খুব জোর গলায় ঘোষণা করলেও মনে হল তার মনেও একটু সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

সন্দেহ কিন্তু সত্যই অমূলক। তুষার-ঢাকা সেই তুন্দ্রার মধ্যে ড. মিনোস্কিকে আমরা শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেলাম। কিন্তু তার আগে তাঁকে খোঁজার মূলে কী ছিল একটু বলে দেওয়া বোধ হয় দরকার!

অনেকেই বোধহয় জানে না যে গত মহাযুদ্ধের পর থেকে পৃথিবীর দুটি প্রধান শক্তি নিজেদের অজেয় করে তোেলবার জন্য মহাশূন্যে পর্যন্ত ঘাঁটি বানাবার কথা ভাবতে শুরু করেছে। একজন বৈজ্ঞানিক তত তাঁর পরিকল্পনা কাগজে কতকটা প্রকাশও করে দিয়েছেন। পৃথিবী থেকে মাইল পঞ্চাশ উঁচুতে খুদে চাঁদের মতো একটা শূন্যে ভাসমান বন্দর বসানোে হবে। সে বন্দর চাঁদের মতোই পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গে তার চারিধারে ঘুরপাক খাবে। আর সেই বন্দর যে প্রথম মহাশূন্যে ভাসাতে পারবে পৃথিবী বলতে গেলে তার হাতের মুঠোয়। মহাশূন্যে এই বন্দর ভাসানো শুধু রকেট অর্থাৎ হাউই-বিজ্ঞানের দ্বারাই সম্ভব। দুটি মহাশক্তি তাই হাউই-বিজ্ঞান সম্বন্ধে পরস্পরের কাজের ওপর কড়া নজর রেখেছে। এ-বিজ্ঞানে কে কোন দিকে কতখানি এগিয়ে

গেল, সোজাসুজি জানবার উপায় নেই তা বলাই বাহুল্য, তাই দুই রাজ্যের। কল্পনাতীত পুরস্কারের লোভে প্রাণ হাতে নিয়ে বহু গুপ্তচর এই বিষয়ে যথাসম্ভব খবর সংগ্রহ করবার আশায় ঘুরছে।

 

অবশ্য ড. মিনোস্কির ওপর এই গুপ্তচরদের নজর না পড়াই উচিত। হাউই-বিজ্ঞান তাঁর গবেষণার বিষয় নয়। আগের যুগে যেমন আইনস্টাইন, এযুগে তেমনই তিনি অসাধারণ একজন গণিতবিশারদ। অনন্ত সৃষ্টির মধ্যে যে অসীম অঙ্কের রহস্য রয়েছে—তার জট খোলায় তিনি আর সকলের চেয়ে অনেকদূরে এগিয়ে গেছেন।

এই মিনোস্কিও গুপ্তচরদের লক্ষ্য হতে পারেন একথা ভাবতে পারলে বিশ হাজার ফুট থেকে এই চেস্কিন অন্তরীপের ওপর আমি ঝাঁপ দিতে রাজি অবশ্য হতাম না। কিন্তু সে কথা যথাসময়ে বলা যাবে।

দূরবিন চোখে দিয়ে মিখায়েলের সঙ্গে সেই তুষার-ঢাকা তুন্দ্রা যখন আমি তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখছি তখনও আমি জানি যে মিনোস্কিরই গোপন নিমন্ত্রণে তাঁর আশ্চর্য রেডিয়ো-টেলিস্কোপ দেখতে আমি এসেছি। তাঁর নিজের ফরমাশ মতো এই আশ্চর্য টেলিস্কোপ যে রাশিয়ার এক জায়গায় বসানো হয়েছে এ-খবর দুনিয়াসুদ্ধ লোক তখন পেয়েছে। শুধু জায়গাটা যে কোথায় দু-চারজন ওপরওয়ালা বাদে তা রাশিয়ার কেউ জানে না। এ-টেলিস্কোপ এ-যুগে অসাধারণ এক কীর্তি। আলো দিয়ে নয়, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বেতার-তরঙ্গ দিয়ে সুর মহাশুন্যের খবর এ টেলিস্কোপে পাওয়া যায়। অ্যারিজোনার লাওয়েল অবজারভেটারির কি দক্ষিণ আফ্রিকার ব্লুমফনটেনের টেলিস্কোপের চেয়ে এই বেতার-দুরবীক্ষণ-যন্ত্র অনেকগুণ শক্তিশালী। তা ছাড়া এ-টেলিস্কোপের সুবিধে হল এই যে মেঘ, কুয়াশা বা ধোঁয়া কিছুতেই অচল হয় না। আলোর ওপর যার নির্ভর সে-টেলিস্কোপ অ্যারিজোনা বা দক্ষিণ আফ্রিকার মরুর মতো নির্মেঘ নির্মল আকাশের দেশে বসাতে হয়, কিন্তু এ টেলিস্কোপের সেরকম কোনও হাঙ্গামা নেই। এরকম একটি টেলিস্কোপ ইংল্যান্ডেও কিছুদিন হল বসানো হয়েছে, কিন্তু ড. মিনোস্কির টেলিস্কোপ নাকি তার চেয়ে অনেক জোরালো। শুধু তা-ই নয়, এ-টেলিস্কোপের সাহায্যে মিনোস্কি এমন এক আশ্চর্য পরীক্ষা নাকি করছেন বিজ্ঞানের যুগ যাতে পালটে যাবে।

এহেন লোক আমায় নিমন্ত্রণ করেছেন শুনে তেমন অবাক আমি হইনি। কারণ মিনোস্কির সঙ্গে অনেক আগেই আমার আলাপ হয়েছিল। তখন অবশ্য বিশ্ববিখ্যাত তিনি হননি।

নিমন্ত্রণটা বিশ্বাস করলেও এরকম লুকিয়ে সেটা করার কারণ আমি প্রথমটা বুঝতে পারিনি। মিখায়েলই সেটা বুঝিয়ে দিয়েছিল।

কোনও শত্রুপক্ষের লোক না হলেও আমি বিদেশি বটে। আর যত প্রভাব প্রতিপত্তিই থাকে, বিদেশি একজন বন্ধুকে এসব গোপন জিনিস দেখানো মিনোস্কির পক্ষেও শোভন নয়। নেহাত আমাকে ভাল করে জানেন বলেই নিজের একান্ত বিশ্বাসী শিষ্য মিখায়েলের কাছে নিজের গোপন আস্তানার ঠিকানা জানিয়ে তারই মারফত এ-নিমন্ত্রণ তিনি করে পাঠিয়েছেন। তাঁর গোপন ঠিকানা মিখায়েলেরও আগে জানা ছিল না।

এ-নিমন্ত্রণের কথা যখন আমি শুনি তার কিছুদিন আগে মিখায়েলের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। আলাপ সে কতকটা গায়ে পড়েই করেছিল, কিন্তু হাতির মতো বিরাট চেহারার খরগোসের মত শান্তশিষ্ট লোকটাকে আমার খারাপ লাগেনি তার জন্য। মিনোস্কির দূত হয়েই সে যে আসল কথার সুযোগের অপেক্ষায় আমার সঙ্গে এভাবে আলাপ জমিয়েছে, এটুকু জানবার পর তার ওপর যেটুকু বিরাগ ছিল তা-ও কেটে গেছে। নিমন্ত্রণের কথা জানবার পর মিখায়েলের পরামর্শ মতো ওপরওয়ালাদের কাছে যেটুকু খাতির আছে তা-ই কাজে লাগিয়ে মিথ্যে অজুহাতে প্লেন জোগাড় করে তা থেকে প্যারাসুটে যথাস্থানে নামবার ব্যবস্থা করি। পাছে কেউ সন্দেহ করে বলে মিখায়েল নিজে এ সব জোগাড়যন্ত্রের ব্যাপারে মাথা গলায়নি। মাথা গলানো উচিত নয় বলেই আমায় বুঝিয়েছিল।

আসলে মিথ্যে সে যে কিছু বলেনি, সেই তুষার-ঢাকা তুন্দ্রার রাজ্যে মিনোস্কির গোপন মানমন্দির খুঁজে পাবার পর ভাল করেই বুঝলাম।

মানমন্দিরটি এমনভাবে তৈরি যে নেহাত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে না দেখলে তা তুষার-ঢাকা তুন্দ্রার অংশ বলেই মনে হবে। খুঁজে বার করতে সেই জন্যেই আমাদের অত কষ্ট হয়েছিল।

মানমন্দিরের ভেতর ঢুকে সমস্ত কষ্ট কিন্তু সার্থক মনে হল। এই চিরতুষারের দেশে মাটির নীচে এমন স্বর্গপুরী যারা বানিয়েছে মনে মনে তাদের তারিফ না করেও পারলাম না।

কিন্তু আরামে স্বর্গপুরী হলেও এ কীরকম মানমন্দির! কোথায় আশ্চর্য যন্ত্রপাতি, কোথায় বা আর সব লোকজন?

বাইরে যেখানে পারা-জমানো শীত, মানমন্দিরের ভেতরে সেখানে ঠাণ্ডার কোনও বালাই নেই। বড় একটা জাহাজের মতো পরম সুখে দিন কাটাবার সব রকম আয়োজন উপকরণই সেখানে প্রচুর। শুধু আসল জিনিসের কোনও চিহ্ন নেই।

শেষ পর্যন্ত মিনোস্কির কাছে নিজের কৌতূহলটা প্রকাশ না করে পারলাম না।

বিরাট একটা চাকার মতো প্যাঁচ লাগানো দরজা খুলে মিনোস্কি নিজেই আমাদের সিঁড়ি দিয়ে ভেতরে নিয়ে এসেছিলেন। প্রথমটা একটু অবাক হলেও আমায় চিনতে পেরে তাঁর আনন্দ যেন আর ধরে না।

একি, দাস! তুমি! তুমি এখানে আসবে আমি ভাবতেই পারিনি। বলে আমার হাত ধরে সজোরে তিনি ঝাঁকানি দিয়েছিলেন।

আমিও একটু ঠাট্টা করে বলেছিলাম, আমিই কি পেরেছিলাম। হঠাৎ প্লেনটা বিগড়ে যাওয়ায় প্যারাসুটে নেমে পড়লাম!

ওঃ, প্যারাসুটে নেমেছ।

তাঁর বিস্ময়টুকু দেখে হেসে বলেছিলাম, সাধে কি আর নেমেছি! আপনার শিষ্য এই মিখায়েলের কাছে শুনলাম, অন্য কোনও রকম নামা নাকি আপনার পছন্দ নয়। তবে প্যারাসুটের দড়ি যেভাবে জড়িয়ে গেছল খুলতে আর একটু দেরি হলে আপনার নিমন্ত্রণ রাখা এ জন্মে আর হত না।

তাই নাকি! এত কাণ্ড করে তোমাকে নিমন্ত্রণ রাখতে হয়েছে! বলে তিনি বেশ একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন।

মিখায়েল অবশ্য একান্ত অনুগত শিষ্যের মতো এর মধ্যে একটি কথাও বলেনি।

মিনোস্কি এখন ঘুরে ঘুরে সমস্ত জায়গাটা আমাদের দেখাচ্ছিলেন। তারই মধ্যে এক সময় আমার মনের কথাটা বলে ফেললাম। এ সব দেখে কী হবে, ড. মিনোস্কি! এর বদলে কুইন মেরি কোনও বড় জাহাজ দেখলেই তো পারতাম।

জাহাজই তো দেখছেন। মিনোস্কির মুখে অদ্ভুত একটু হাসি।

জাহাজ দেখছি। ঠাট্টাটা বুঝতে পারলাম না। মিখায়েলের গলা এতক্ষণে প্রথম শোনা গেল। সে গলার স্বর যেন অন্যরকম!

ঠাট্টা নয়! সত্যিই এটা জাহাজ। এমন জাহাজ এ-পর্যন্ত কেউ কল্পনাও করেনি।

জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে মিনোস্কি আবার বললেন, কিন্তু ঠাট্টার বদলে একটু ঠাট্টা করলেই বা দোষ কী! গুপ্তচর মিচেল যে আমার শিষ্য মিখায়েল হয়ে উঠেছে এটা একটু বেয়াড়া ঠাট্টা বলেই তো আমার মনে হয়।

অবাক হয়ে আমি যা বলতে যাচ্ছিলাম তাতে বাধা দিয়ে মিনোস্কি বললেন, তুমি শেষে এই নীচ কাজে নামবে আমি ভাবিনি, দাস।

ব্যাকুলভাবে এবার জানালাম, বিশ্বাস করুন ড. মিনোস্কি আমি এসবের কিছুই। জানি না। মিখায়েলকে সত্যিই আপনার শিষ্য ভেবে ওর কথায় বিশ্বাস করেছিলাম।

ছদ্মবেশী মিচেল এবার নির্লজ্জভাবে হেসে উঠে বললে, তোমার মতো আহাম্মককে তা না বিশ্বাস করাতে পারলে এখানে আসবার প্লেন, নামবার প্যারাসুট জোগাড় হত কী করে! আমার কার্যোদ্ধারই যে নইলে হত না।

কার্যোদ্ধার সত্যি হয়েছে ভাবছ? মিনোস্কি বজ্রস্বরে বলে উঠলেন, আমাদের পুলিশ এতই কাঁচা মনে করো! তোমরা এখানে রওনা হবার সঙ্গে সঙ্গে তারা সব কথা আমায় বেতারে জানিয়ে দিয়েছে। আমায় সাহায্য করবার প্রহরীও তারা পাঠাচ্ছিল। আমিই বারণ করে দিয়েছি।

বারণ করে ভাল করেননি ডা. মিনোস্কি। মিচেলের আসল চরিত্র তার গলার স্বরেই এবার বোঝা গেল, কী পরীক্ষা আপনি এখানে করছেন এখনও জানতে পারিনি, কিন্তু এখানকার যা কিছু দরকারি জিনিস সব সমেত আপনাকেও এখান থেকে পাচার করবার ব্যবস্থা করতেই আমি এসেছি। আমার নির্দেশ পেয়ে আমাদের দুটি প্লেন শিগগিরই এখানে নামবে।

অবিচলিতভাবে মিনোস্কি একটু হেসে বললেন, কিন্তু নেমে কিছু পাবে কি?

হ্যাঁ পাবে! মিচেল দাঁত খিচিয়ে উঠল, কোনও চালাকি যাতে তার আগে আপনি না করতে পারেন সেজন্যে আপনাকে একটু বাঁধব। এই সুটকো কালা আদমিটা অবশ্য ধর্তব্যই নয়।

যেমন চেহারা তেমনই মত্ত হাতির মতোই পদভরে ঘর কাঁপিয়ে মিচেল এবার এগিয়ে এল। পর মুহূর্তেই দেখা গেল ঘরের এক কোণের একটা সোফার ওপর ডিগবাজি খেয়ে পড় সে কাতরাচ্ছে।

জামাটা যেটুকু লাট হয়েছিল ঠিক করে বললাম, আর কিছু দরকার হবে ডা. মিনোস্কি?

ধন্যবাদ দাস! আর কিছুর দরকার নেই। তুমি না সাহায্য করলেও অবশ্য কিছু

ক্ষতি হত না। আমি তৈরি ছিলাম।

কাতরাতে কাতরাতেও মিচেল গর্জে উঠল, তৈরি থাকার করে দিচ্ছি। আমাদের লোকেরা এখানে নামল বলে!

তার আগে তোমাকে যে অনেক নামতে হবে। বলে মিনোক্তি আমার দিকে ফিরলেন, শোনো দাস, বিজ্ঞানের এক আশ্চর্য পরীক্ষা এবার আমি করতে যাচ্ছি। পরীক্ষায় বাঁচব কি মরব আমি জানি না। তাই এই শয়তানকেই শুধু আমার সঙ্গী করতে চাই। তুমি ইচ্ছে করলে এখন চলে যেতে পারো!

এত বড় সৌভাগ্য শুধু ওই শয়তানই পাবে। আমি কী অপরাধ করলাম!

হেসে আমার পিঠ চাপড়ে মিনোস্কি বললেন, এই জবাবই তুমি দেবে জানতাম। যাও ওই সোফাটায় আরাম করে বসে গিয়ে, যাও!

সোফায় বসতে না বসতেই মিনোস্কি দেওয়ালের একটি কী বোতাম টিপলেন। সঙ্গে সঙ্গে মেঝের একটা জায়গা ফাঁক হয়ে যেন ভোজবাজিতে অদ্ভুত একটা যন্ত্র বেরিয়ে এল। সে যন্ত্রের একটা কী হাতল টেনে ধরতেই কী যে হল কিছুই আর জানতে পারলাম না।

জ্ঞান যখন হল তখন দেখি ঠিক সেই ঘরেই সেই সোফাতেই বসে আছি। মিচেল তখনও অসাড় হয়ে তার জায়গায় পড়ে আছে। আর মিনোস্কি ঘরের একদিকের কাঁচের জানলার ধারে দাঁড়িয়ে বাইরে কী দেখছেন।

তাঁর কাছে ছুটে গিয়ে বললাম, কী হল কী বলুন তো? কী দেখছেন আপনি? নিজেই দেখো না, বলেই তিনি হাসলেন।

দেখে সত্যিই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। মেরুর তুষার-ঢাকা তুন্দ্রার বদলে এ যে টকটকে লাল বালির মরুভূমি! একি! সাহারা নাকি! সবিস্ময়ে বলে ফেললাম।

মিনোস্কি এবার সশব্দে হেসে উঠে বললেন, না, তার চেয়ে আর একটু দূর—এ হল মঙ্গল গ্রহের লাল বালির মরুভূমি। মঙ্গল গ্রহকে যার জন্য লাল দেখায়।

মঙ্গল গ্রহ! আমার না মিনোস্কির কার মাথা খারাপ হয়েছে তখন ভাবছি। কিন্তু তুষার-ঢাকা তুন্দ্রার বদলে লাল মরুভূমি তো সত্যিই দেখতে পাচ্ছি। পৃথিবীর কোনও মরুভূমির সঙ্গে তার মিলও নেই।

আমায় আবার সোফায় নিয়ে এসে বসিয়ে মিনোস্কি বললেন, সত্যিই, মঙ্গল গ্রহে আমরা নেমেছি। আমার পরীক্ষা সফল।

আমার বিমূঢ়তায় একটু হেসে তিনি আবার বললেন, মঙ্গল গ্রহ এবার পৃথিবীর কত কাছে এসেছে খবরের কাগজেও তা বোধহয় পড়েছ। পৃথিবী থেকে তার দূরত্ব এখন চার কোটি তিন লক্ষ মাইলের কাছাকাছি। কিন্তু এত কাছে এলেও, কোনও হাউই যন্ত্র দিয়ে ঘণ্টায় চার হাজার মাইল ছুটেও মাস দেড়েকের আগে আমরা পৌঁছতে পারতাম না। সে জায়গায় প্রায় চক্ষের নিমেছে আমরা এসেছি বলা যায়।

কিন্তু এলাম কী করে! আমি আগের মতোই বিমূঢ়।

এসেছি ফুটো দিয়ে গলে। আমার বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখের দিকে চেয়ে তিনি বললেন, হ্যাঁ, সত্যিই ফুটো! মহাশূন্যের ফোর্থ ডাইমেনসন মানে চতুর্থ মাপের ফুটো। লম্বা, চওড়া, উঁচু—এই তিন মাপ দিয়েই সৃষ্টির সব কিছু আমরা দেখতে জানি। গণিত-বিজ্ঞান এ ছাড়া আরও মাপের সন্ধান পেয়েছে, কিন্তু তা কাজে লাগাতে কেউ পারেনি এ পর্যন্ত। আমার এই পরীক্ষায় প্রথম সেই চতুর্থ মাপের জগৎ মানুষের আয়ত্তে এল।

ব্যাপারটা তোমায় আর একটু ভাল করে বোঝাই। খুব লম্বা একটা চিমটে মনে করো। এক দিকের ডগা থেকে আর এক দিকের ডগায় পৌঁছতে হলে একটা পিপড়েকে সমস্ত চিমটেটা মাড়িয়ে যেতে হবে। তাতে তাকে হাঁটতে হবে ধরো তিন গজ। কিন্তু চিমটের একটা ফলা থেকে আর একটা ফলা মাত্র এক ইঞ্চি দূরে যদি থাকে আর ওপরের চুলা থেকে নীচের ফলায় যাবার একটা ফুটো যদি পিপড়েটা পায় তা হলে এক ইঞ্চি নেমেই তিন গজ হাঁটার কাজ তার সারা হয়ে যাবে। লম্বা, চওড়া ও উঁচু—এই তিন মাপের জগতে যা অনেক দূর, চতুর্থ মাপ দিয়ে সেখানে অতি সহজে পৌঁছোবার এমন অনেক ফুটো মহাশূন্যে আছে। তেমন একটা ফুটোই আমি খুঁজে পেয়েছি।

এবার উৎসাহে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, মঙ্গল গ্রহটা তা হলে তো ঘুরে দেখতে হয়।

হেসে আমায় নিরস্ত করে মিনস্কি বললেন, না, না, এবার সেজন্যে তৈরি হয়ে আসিনি। তা ছাড়া এ ফুটো থাকতে থাকতেই পৃথিবীতে ফিরে যেতে হবে। অন্তত ওই শয়তান মিচেলটার জ্ঞান হবার আগে।

মিচেলের জ্ঞান পৃথিবীতে ফিরেই হয়েছিল। তখন তার হাতে হাতকড়া। প্লেনে করে মিনোস্কিকে চুরি করতে যারা নেমেছিল তাদের অবস্থাও তথৈবচ।

ঘনাদার কথা শেষ হতে না হতেই শিবু বলে উঠল, এই বছরেই তো জুন জুলাই-এর মাঝামাঝি মঙ্গল গ্রহ পৃথিবীর অত্যন্ত কাছে এসেছিল শুনেছি। কিন্তু সশরীরে তখন আপনি এই মেসেই ছিলেন মনে হচ্ছে।

কোনও উত্তর না দিয়ে শিশিরের হাত থেকে সিগারেটের টিনটা অন্যমনস্কভাবে তুলে নিয়ে ঘনাদা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।