অমন তাকাতে নেই, তোর এই দৃষ্টির সম্মুখে প্রতিবার
অসহায়, বড়ো অসহায় মনে হয়। কেন প্রহরে প্রহরে
আমাকেই লক্ষ্য করে ছুড়ে দিস একরাশ ভীষণ হিংস্রতা
আদিম ব্যাধের মতো? খোকা তুই বাড়াসনে অতিশয় নোংরা
তীক্ষ্ণ নখ বারবার আমার গলার দিকে, চোখে লাল ছিটে
দিসনে লাগতে ওরে। ঘাতকেরই এমন ধরন, এ ঘাতক দ্রুত
কর্কশ রয়ঙ্ক হচ্ছে তোর অভ্যন্তরে, সরে দাঁড়া, এ বিশদ
ছায়া থেকে ওরে সরে দাঁড়া তুই, চলে যা আড়ালে।
শত বর্ষা, মনে হয়, পারবে না ধুয়ে নিতে অমন হিংস্রতা,
এমন কি তোর জননীও হস্তাবলেপে কি চুম্বনে চুম্বনে
মুখের কঠিন রেখাবলী তোর পারবে না করতে কোমল
কিছুতেই। ফিরে আয়, আমার মিনতি শোন, ওরে ফিরে আয়
পৈশাচী বলয় থেকে পিতৃবক্ষে, মাতৃক্রোড়ে, পড়ার টেবিলে।
প্রত্যহ কিছু না কিছু ভাঙছিস তুই, গ্লাস, প্লেট, চায়ের পেয়ালা,
আলমারির কাচ খুঁটিনাটি কত কিছু, মাঝে-মাঝে
মনে হয়, বুঝি তুই সূর্যোদয় সুর্যাস্তকে ফেলবি গুঁড়িয়ে
কী বিরোধভাসে মজে। হায়, তোর সমান বয়সী
আমার গোপন স্বপ্নটিকে করছিস খান খান। এ কেমন
ভাঙার খেলায় তুই মেতেছিস হে উদাস, হে ক্রুদ্ধ কিশোর?
যখন চিৎকার করে তোর এই আধোয়া শরীর, জীর্ণ ঘর
আমাদের নিমেষেই ভয়ার্ত হরিণ হয়ে যায়, উপদ্রুত,
উল্মুক কৈশোর তোর একা ভাসমান লাভা স্রোতে। আমি চোখ
কেবলি ফিরিয়ে নিই; কোত্থেকে পেলিরে তুই এমন চিৎকার?
একটি খঞ্জর হয়ে, একটি কৃপাণ হয়ে, বর্শা হয়ে আর
ভয়ংকর শর হয়ে কাঁপছিস তুই। ভাবি, যদি তোকে ঐ
গোলাপের অভ্যন্তরে, হরিণীর পেটের ভিতর কিংবা সুস্থ
দূরগামী মেঘে ঘুম পাড়িয়ে রাখার মন্ত্র জানতাম,
যদি তোকে বাস্তবিক আমার চোখের মণি, আমার হৃৎপিণ্ড
বানিয়ে ফেলতে পারতাম। আমার সকল বেলা কালবেলা হয়ে যায়।
তুই কি পিতৃঘ্ন হবি শেষে? তোর মুখের ভূভাগ থেকে ক্রুর
ছায়া সরে গেলে শূন্যতা ছড়িয়ে থাকে, চোখ থেকে
দজ্জাল লালিমা মুছে গেলে, বুকের ভিতর আমি পুনরায়
কী মধুর প্রত্যাবর্তনের ধ্বনি শুনি, ফিরে আসে ঝাঁক ঝাঁক শাদা হাঁস,
বিরূপ বাগানে জ্বলে ফুলের উল্লাস, সুকোমল শুশ্রূষায়
সতেজ পালক পায়, পায় স্নিগ্ধ রঙ আমার আহত গুপ্ত পাখি।
এত্ত তো ক্ষণিক দৃশ্য। পর মুহূর্তেই তোর দৃষ্টি জ্বলন্ত তীর দেখে
তোর অন্তর্গত ঘাতকের প্রবল দুর্বার জাগরণ দেখে
কেমন বিহ্বল হয়ে যাই। তপ্ত কুয়াশার ঘোরে মনে পড়ে-
একদা আমিও ক্রুর তাকাতাম আমার পিতার
দিকে কখনও সখনও।
হত্যা উঠতো কি নেচে মগজে আমার? বহু দূরে
হয়তো আমার পিতা অবচেতনার ঘনারণ্যে অস্ত্র হাতে
হঠাৎ দিতেন ঝাঁপ তাঁর স্নেহময় জন্মদাতার ওপর।
তাহলে তোর কী অপরাধ? কেন তোকে মিছেমিছি সর্বক্ষণ
ভীষণ অসুস্থ ভাবি? তুই তো বিপজ্জনক এক উত্তরাধিকারী শুধু।