ফরাসি-জর্মন
গল্প শুনিয়াছি, এক পাগলা মার্কিন নাকি পুরস্কার ঘোষণা করিয়াছিলেন যে, ‘হস্তী’ সম্বন্ধে যে সর্বোৎকৃষ্ট প্রবন্ধ লিখিবে তাহাকে এক লক্ষ পৌন্ড পারিতোষিক দেওয়া হইবে। প্রবন্ধের বিষয়টি যে বৃহৎ সে সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ নাই; তাহা না হইলে মার্কিন বিশেষ করিয়া এই বিষয়টিই নির্বাচন করিবেন কেন?
সে যাহাই হউক, খবর শুনিবামাত্র ইংরেজ তৎক্ষণাৎ কুকের আপিসে ছুট দিল। হরেক সাজসরঞ্জাম যোগাড় করিয়া পক্ষাধিককাল যাইতে-না-যাইতেই সে আসামের বনে উপস্থিত হইল ও বৎসর শেষ হইবার পূর্বেই কেতাব লিখিল ‘আসামের পার্বত্যাঞ্চলে হস্তী শিকার’।
ফরাসি খবর শুনিয়া ধীরে সুস্থে চিড়িয়াখানার দিকে রওয়ানা হইল। হাতিঘর বা পিলখানার সম্মুখে একখানা চৌকি ভাড়া লইয়া আস্তে আস্তে শ্যাম্পেনে চুমুক দিতে লাগিল। আড়নয়নে হাতিগুলির দিকে তাকায় আর শার্টের কফে নোট টুকে। তিন মাস পর চটি বই লিখিল লামুর পারমি লেজেলে অর্থাৎ ‘হস্তীদের প্রেমরহস্য’।
জর্মন খবর পাইয়া না ছুটিল কুকের আপিসে, না গেল চিড়িয়াখানায়। লাইব্রেরিতে ঢুকিয়া বিস্তর পুস্তক একত্র করিয়া সাত বৎসর পর সাত ভলুমে একখানা বিরাট কেতাব প্রকাশ করিল; নাম ‘আইনে কুংসে আইনকুরুঙ ইন ডাস স্টুডিয়ম ডেস এলোফান্টেন’, অর্থাৎ ‘হস্তীবিদ্যার সংক্ষিপ্ত অবতরণিকা’।
গল্পটি প্রাক-সোভিয়েট যুগের। তখনকার দিনে রুশরা কিঞ্চিৎ দার্শনিক ভাবালু গোছের ছিল। রুশ খবর পাইয়া না গেল হিন্দুস্থান, না ছুটিল চিড়িয়াখানায়, না ঢুকিল লাইব্রেরিতে। এক বোতল ভদকা (প্রায় ‘ধান্যেশ্বরী’ জাতীয়) ও ত্রিশ বান্ডিল বিড়ি লইয়া ঘরে খিল দিল। এক সপ্তাহ পরে পুস্তক বাহির হইল, ‘ভিয়েদিল লিলি ভি এলেফান্ট?’ ‘তুমি কি কখনও হস্তী দেখিয়াছ?’ অর্থাৎ রুশ যুক্তি-তর্ক দ্বারা প্রমাণ করিয়া ছাড়িল যে হস্তী সম্বন্ধে যেসব বর্ণনা শোনা যায় তাহা এতই অবিশ্বাস্য যে তাহা হইতে এমন বিরাট পশুর কল্পনা পর্যন্ত করা যায়। না। অর্থাৎ হস্তীর অস্তিত্ব প্রমাণাভাবে অস্বীকার করিতে হয়।
আমেরিকান এইসব পন্থার একটিও যুক্তিযুক্ত মনে করিল না। সে বাজারে গিয়া অনেকগুলি হাতি কিনিল ও বার্থে নয়, সত্য সত্যই ‘হাতি পুষিল’। কুড়ি বৎসর পরে তাহার পুস্তক বাহির হইল ‘বিগার অ্যান্ড বেটার এলেফেন্টস-হাউ টু গ্রো দেম?’ অর্থাৎ ‘আরও ভালো ও আরও বৃহৎ হাতি কী করিয়া গজানো যায়।’ শুনিয়াছি আরও নানা জাতি প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়েছিলেন, তন্মধ্যে হস্তীর স্বদেশবাসী এক ভারতবাসীও নাকি ছিলেন। কিন্তু ‘নেটিভ’ ‘কালা আদমি’ বলিয়া তাঁহার পুস্তিকা বরখাস্ত-বাতিল-মকুব-নামঞ্জুর-ডিসমিস অসিদ্ধ করা হয়। অবশ্য কাগজে-কলমে বলা হইল যে, যেহেতু ভারতবাসী হস্তীকে বাল্যাবস্থা হইতে চিনে তাই তাহার প্রত্যক্ষ জ্ঞান তাহাকে পক্ষপাতদুষ্ট করিতে পারে!
গল্পটি শুনিয়া হস্তী সম্বন্ধে জ্ঞান বাড়ে না সত্য, কিন্তু ইউরোপের ভিন্ন ভিন্ন জাতি ও মার্কিন সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ ঘোলাটে ধারণা তবুও হয়। সব জাতির বিশেষত্ব লইয়া আলোচনা সম্ভবপর নহে, করিবার প্রয়োজনও নাই, কারণ প্রাচ্য জাতিসমূহের কথা ছাড়িয়া দিলে (আর ছাড়িতেই হইবে, কালা-ধলা একাসনে বসিতে পারে শুধু দাবার ছকেই) সত্যই বিদগ্ধ বলিতে বোঝায় জর্মন ও ফরাসিকে। বাদবাকি সকলেই ইহাদের অনুকরণ করে। তবে জর্মনরা নতমস্তকে স্বীকার করে যে কনট্রেশন ক্যাম্পের অনুপ্রেরণা তাহারা ইংরেজের নিকট হইতে পাইয়াছিল। নিতান্ত তাহারা কোনও জিনিস অর্ধপক রাখিতে চাহে না বলিয়াই এই প্রতিষ্ঠানটিকে পূর্ণ বৈদগ্ধ্যে পৌঁছাইয়াছিল।
জর্মন যদি কোনও ভারতবাসীকে পায় তবে ইতি-উতি করিয়া যে কোনও প্রকারে তাহার সঙ্গে আলাপ জুড়িবার চেষ্টা করিবেই। আলাপ হওয়ামাত্র কালবিলম্ব না করিয়া আপনাকে এক গেলাস বিয়ার দিবে, তার পর আপনার কালো চুলের প্রশংসা করিবে ও আপনার বাদামি (তা আপনি যত ফর্সাই হউন না কেন) অথবা কালো রঙের প্রশস্তি গাইবে। তার পর আপনাকে প্রশ্নবাণের শরশয্যায় শোয়াইয়া ছাড়িবে, ‘আপনারা দেশে কী খান, কী পরেন, সাপের বিষে মানুষ কতক্ষণে মরে, সাধুরা শূন্যে উড়িতে পারেন কি না, কান্ট বড় না শঙ্কর, তাজমহল নির্মাণ করিতে কত খরচ হইয়াছিল, অজন্তার কলা মারা গেল কেন, কামশাস্ত্রের প্রামাণিক সংস্করণ কোথায় কোথায় পাওয়া যায়, সর্পপূজা এখনও ভারতবর্ষে চলে কি না, সাধারণ ভারতবাসীর গড়পড়তা কয়টি স্ত্রী থাকে, হিন্দু-মুসলমান ঝগড়া কেন? ’
‘কিন্তু হাঁ’, বার-তিনেক মাথা নাড়াইয়া বলিবে, ‘হ্যাঁ, গান্ধী একটা লোক বটে। ওরকম লোক যিশুখ্রিস্টের পরে আর হয় নাই। ইংরেজকে কী ব্যতিব্যস্তই না করিল। গোলটেবিল বৈঠকের পর তাহার কথা ছিল বাইমার শহরে আসিবার। কিন্তু আসিলেন না; আমরা বড়ই হতাশ হইয়াছিলাম। সত্যই কি গান্ধী গ্যেটেকে এত ভক্তি করেন যে তামাম ইউরোপে এই একমাত্র বাইমারই তাঁহার মন কাড়িল? ’
ভারতবাসীর প্রতি সাধারণ জর্মনের ভক্তি অসীম ও ভারতবর্ষ সম্বন্ধে তাহার কৌতূহলের অন্ত নাই ॥