ফ্ল্যাট বাড়িটাকে মৃদু চাবকাচ্ছে ঘন ঘন এই
শীত, পঞ্চাশোর্ধ্ব ত্বকে দাঁত
বসায় তাতার হাওয়া। গৃহিণীর হাতে বোনা সোয়েটার গায়ে,
খাঁজময় গলায় জড়ানো
প্রেমিকার আদরের মতো কস্ফার্টার, বারবার
হাত ঘষে খানিক আরাম
পেতে চাই। সে কখন থেকে রোদ্দুরের প্রত্যাশায়
বসে আছি, জেগে আছি নাকি
তন্দ্রার গুহায়
ঢুলছি একাকী ক্রমাগত? বয়ে যায় চারপাশে
স্রোতের ধরনে কিছু। প্রাগৈতিহাসিক
পানি প্রত্যুষের
গাল বেয়ে নামে আর গাছের সবুজ
চোখ থেকে খ্রিস্টপূর্ব রূপসীর অশ্রুর মতোই
টপ টপ করে পড়ে শিশিরের জল।
হাওয়া বয়, হাওয়া বয়, বড় কষ্ট হয়
দু’পায়ে মাড়িয়ে যেতে ভোরের শিউলি,
মমতা জড়িয়ে আছে ঝরে-পড়া শিউলির ঘ্রাণে।
আশেপাশে আড়চোখে তাকিয়ে ঈষৎ
কে বালিকা বধূ
কুড়ায় শিউলি তার সলজ্জ আঙুলে,
যেন সে নিঃশব্দে নিচ্ছে তুলে নিরিবিলি
নিজেরই শৈশব।
টিনের পাতের মতো কুয়াশা রয়েছে
পাতা এক ফালি মাঠে আর
ফুটপাত-ঘেঁষা ঘাসে কে যেন দিয়েছে রুয়ে টলটলে ফুল,
কী শুভ্র জলজ। কুয়াশার মধ্যে দিয়ে একা-একা হেঁটে যেতে
আজও ভালো লাগে। এরকম ভোরবেলা
শাল মুড়ি দিয়ে একা নিঃশব্দে কে যায়?
তুখোড় ঘাতক নাকি হঠাৎ শহরে চলে-আসা
দেবদূত, খেয়ালী, অপটু। হয়তোবা
পেটরোগা, স্বাস্থ্যান্বেষী প্রৌঢ় কোনো, ঘরে যার আছে
আইবুড়ো মেয়ে, যাকে পাড়ার বখাটে যুবকেরা
করেছে ক্রমশ খর জিভের খোরাক, আল্লা যার
চোখে ঢেলে দেন
ঘড়া ঘড়া পানি, স্বপ্ন যার সেরামিক
তৈজসের মতো হয়ে যায় খান খান।
শিশির-নিমগ্ন ঘাসে রোদের ঝিলিক দেখে তার
মনে পড়ে শৈশবের গ্রাম।
স্মৃতি ওড়ে ঝাঁক ঝাঁক, যেন
অন্তহীন পথ
নির্ভুল পেরিয়ে-আসা পরিযায়ী সবুজ খঞ্জনা। মনে পড়ে
শীতভোরে ফজরের নামাজের পরে
নানা ভাই রেহেলে কোরান রেখে ঘন কুয়াশার
নেকাব-সরানো
প্রথম আলোর মতো আয়াতের শুদ্ধ উচ্চারণে
দুলে দুলে কোঠাবাড়িটাকে
কেমন সঙ্গীতময় করে তুলতেন,
আমার রূপসী নানি হ্যারিকেন নিভিয়ে যেতেন
রান্নাঘরে, টাটকা পিঠের ঘ্রাণে জিভে
ঝরনাধারা যেত বয়ে আর মাতামহের পবিত্র
আয়াতের সুরে সুরে আমার চোখের পাতা জুড়ে
সাইবেরিয়ার
সোনালি বাটান পাখি বসত কোমল, আজ আমি
সেই সুর থেকে দূরে, বহুদূরে। শুধু মনে পড়ে
সেকালে হিমেল
সকালে কবিতা তার কুঙ্কুমের দাগ অগোচরে
আমার কপালে রেখে গ্যাছে।
কুয়াশার ঘেরাটোপে ঢাকা এ শহর
ঢাকায় হঠাৎ
সুজাতাকে মনে পড়ে। তার
ঘরে শীত আজ
মৃত্যুর ঠোঁটের মতো জমে থাকে, ঘরের ভেতরে
এতটুকু তাপ নেই, গরম পানির
ব্যাগ কাছে টেনে নিয়ে সুজাতা এখন বড় একাকিনী
শুয়ে আছে বেগানা পশ্চিমে। হাড়ে তার
চুপিসারে হিম ঢুকে পড়ে,
যেনবা সিঁধেল চোর, রাত্রির তৃতীয়
প্রহরেও সুজাতার চোখ জ্বলে অনিদ্রায়
সুলেমান বাদশার রত্নের মতন।
কী এক যন্ত্রণা তাকে সেঁকছে ভীষণ কড়া আঁচে
বারবার। কেবল চুম্বন নয়, নবজাতকের মুখও চায়
শেষমেশ মেরুন রঙের তার স্তনের বোঁটায়।
সৌন্দর্যের দিকে হাত বাড়াই, অথচ মধ্যপথে
হাত, বলা যায়, প্রায়
শিলীভূত, এই শীতে, প্রিয়
ওষ্ঠে ঠোঁট রাখবার মুকুলিত সাধ
তুষারের নিচে
চলে যায় অকস্মাৎ, যে-পাখি গাইতে
আসে গান আমার উদ্যানে
নিমেষে কবন্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, আমি
কাঁদতে গিয়েও
কান্না ভুলে যাই, শুধু হি হি কেঁপে উঠি
নিজেকেই
কবরে শায়িত দেখে। মেয়ে হস্টেলের
অনূঢ়া ছাত্রীর হু হু যৌবনের মতো
শীতের দুপুর ঢলে পড়ে
বিকেলের কোলে।
আমি যেন সেই শীতকাতুরে একাকী
ভগ্নকণ্ঠ পাখি,
যে প্রাচীন ধ্বস্ত নগরীর বিরানায় গান গায়
অত্যন্ত বেসুরো,
ঘোরে না খাদ্যের খোঁজে আনাচে-কানাচে,
মেদমজ্জা ক্ষয়ে গ্যাছে, হাড়
পুড়ে পুড়ে হয়ে গ্যাছে কালি, মরা ঘাস
ওড়ে কালো ধ্বংসস্তূপে বেহাগের সুরে।
পড়েছে শীতের হাত গাছগাছালিতে, শস্যক্ষেতে,
পুকুরের ঘাটে, হাটে, হাই-রাইজ দালানে
সংসদ ভবনে, রক্তাপ্লুত কসাইখানায়, লঞ্চ
টার্মিনালে
দোকানে, সাইনবোর্ডে, কলোনির বারান্দায়, সোফাসেটে আর
ফুটপাতে পশুর ধরনে
শুয়ে-থাকা মানুষের বিপন্ন কাঁথায়,
কুলিকামিনের
আগুন-পোহানো রাতে, নেশামগ্ন মেথরপট্রিতে।
কেবল পড়েনি
আমার হৃদয়ে, নইলে কী করে এমন
হিমাতুর রাতে
হৃদয়ের তন্তুজালে বসন্ত মল্লিকা সারাভাই
হয়ে যায় আর তার মুদ্রা থেকে পবিত্র তাপের
বিচ্ছুরণে সেজে ওঠে আমার গোপন
কবিতার খাতা?