প্ৰথম খণ্ড – বন্ধু–বিপন্ন
প্রথম পরিচ্ছেদ – বিবাহে বিঘ্ন
বীরবিক্রমের সহিত ইন্দ্রানন্দের ভগিনী দরিয়ার বিবাহ হইবে সকলই স্থির, হঠাৎ বীরবিক্রম অনুপস্থিত হইলেন। বিবাহের দিন স্থির হইয়াছিল—কিন্তু বিবাহ হইল না।
আমরা যাঁহাদের কথা বলিতেছি, তাঁহারা সকলেই সম্ভ্রান্ত নেপালী। ইন্দ্রানন্দের পিতা গুণারাজ একজন ধনাঢ্য বণিক। নইনিতাল সহর হইতে পাঁচ ছয় ক্রোশ দূরে তাঁহার বাসস্থান – সুন্দর উদ্যানে পরিবেষ্টিত সুন্দর অট্টালিকা।
দরিয়া তাঁহার একমাত্র কন্যা। ইন্দ্রানন্দই তাঁহার একমাত্র পুত্র। দরিয়ার বয়স পনের ও ইন্দ্রানন্দের বয়স পঁচিশ বৎসরের অধিক নহে।
বীরবিক্রমের বাড়ী নইনিতাল সহরে। তাঁহার পিতা মাতা ভাই ভগিনী—কেহ নাই। এক সময়ে তাঁহার পিতা নইনিতালের একজন অতি ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন, কিন্তু তাঁহার অবর্তমানে তাঁহার বিষয়-সম্পত্তি অন্যের হস্তে গিয়া পড়িয়াছিল, বীরবিক্রম তাহার কিছুই পায় নাই।
তবে তাঁহার নিজের যত্নে ও উদ্যমে তিনি উন্নতি করিতে সক্ষম হইয়াছেন। তিনি নেপাল সরকার হইতে নইনিতালের উকীল নিযুক্ত হইয়াছেন। রূপে গুণে চরিত্রে বীরবিক্রম আদর্শ যুবক। সকলেই জানিত, তিনি দিন দিন অধিকতর উন্নতি লাভ করিতে পারিবেন। এই জন্যই দরিয়ার পিতা গুণারাজ, বীরবিক্রমের সহিত কন্যার বিবাহ দিবার জন্য ব্যগ্র হইয়াছিলেন। বিশেষতঃ তিনি জানিতেন, দরিয়া বীরবিক্রমকে বড় ভালবাসে, সে অপর কাহাকেই আর বিবাহ করিবে না।
বীরবিক্রমও দরিয়াকে বড় ভালবাসিতেন। শৈশবে উভয়ে একত্রে আহার বিহার, খেলা-ধূলা করিয়াছেন; এখন আপনা-আপনই উভয়ের হৃদয়ে যৌবনের সঙ্গে সঙ্গে প্রণয়ের সুস্নিগ্ধ রশ্মি বিকীর্ণ হইয়া পড়িয়াছে।
গুণারাজে ও বীরবিক্রমের পিতায় বড়ই সৌহাৰ্দ্দ ছিল। উভয়ে বাল্য-বন্ধু; কাজেই পিতৃমাতৃহীন বীরবিক্রম প্রায় গুণারাজের পরিবারভুক্ত হইয়া গিয়াছিলেন।
বীরবিক্রম নইনিতালে একটি ক্ষুদ্র বাটীতে একা বাস করিতেন; তবে সময় পাইলেই তিনি গুণারাজের বাড়ীতে আসিতেন। দরিয়ার সহিত সুখে সময়াতিপাত করিয়া আবার নইনিতালে ফিরিয়া যাইতেন।
তাঁহারা বড়ই সুখে সময়াতিপাত করিতেছিলেন; কিন্তু কয় মাস হইতে বীরবিক্রমের কি এক পরিবর্ত্তন ঘটিয়াছে; তাঁহার আর সে স্ফূর্ত্তি নাই—সে হাসি নাই—দিন দিন তাঁর আকৃতিরও
তাঁহার এই পরিবর্তনে সর্ব্বদা হাস্যময়ী দরিয়ার মুখেও কালিমার ছায়া পড়িল। পাহাড়িয়া নেপালী বালিকারা যেমন সতত হাস্যময়ী, আনন্দময়ী, তেমন জগতের আর কোন প্রদেশে নাই। সেই পাহাড়িয়া বালিকাদিগের মধ্যে দরিয়া সর্ব্বাপেক্ষা আনন্দময়ী ছিল; কিন্তু বীরবিক্রমের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে তাহারও পরিবর্তন ঘটিল। সে পূর্ব্বের ন্যায় হাসে বটে, কিন্তু তাহার সে হাসিতে আর পূর্ব্বভাব নাই, যেন কেমন তাহা বিষাদমাখা। এই সকল দেখিয়া প্রবীণ বিচক্ষণ গুণারাজ যত শীঘ্র সম্ভব কন্যার বিবাহ দেওয়া স্থির করিলেন। বিবাহের সকল স্থির, কিন্তু বীরবিক্রম নাই।
গুণারাজ বলিলেন, “আমি যাহা ভাবিয়াছিলাম, তাহাই ঠিক। যে কারণেই হউক, বীরবিক্রমের মাথা খারাপ হইয়া গিয়াছে। ওর বাপেরও মাথার ঠিক ছিল না। সময়ে সময়ে পাগলের মত হইত। এখনও কেহ বলিতে পারে না যে, সে মরিয়াছে, না কোথায় নিরুদ্দেশ হইয়া গিয়াছে। দরিয়া তাহাকে নিতান্ত ভালবাসে, তাহাই বিবাহ দিতে রাজী হইয়াছিলাম। যাহাই হউক, ভালই হইয়াছে, অন্য সম্বন্ধ দেখিতে হইল। দরিয়া কিছুদিন পরে তাহাকে ভুলিয়া যাইবে।”
গুণারাজ এ বিষয়ে সম্পূর্ণই ভুল বুঝিয়াছিলেন। দরিয়ার মন সেরূপ ছিল না। পাহাড়িয়া বালিকার মন যেমন লঘু—তেমনই আবার কাঠিন্যে পাষাণকেও অতিক্রম করে। তাহাদের মনে সহজে কোন দাগ বসে না; কিন্তু যদি কোন দাগ বসে, তবে তাহা কখনও যায় না। দরিয়ার ভালবাসা ভুলিবার ভালবাসা ছিল না। সে বীরবিক্রমকে সর্বান্তঃকরণে ভালবাসিয়াছিল। বীরবিক্রমের জন্য তাহার ভাবনা বাড়িল। কি করিবে কিছুই স্থির করিতে পারিল না; শরাহ হরিণীর ন্যায় অসহ্য যাতনায় ছট্ফট্ করিতে লাগিল। মুখ ফুটিয়া কোন কথা কাহাকেও বলিতে পারে না। দুই দিন সে এইরূপে কাটাইল, কি করিবে না করিবে মনে মনে ভাবিল। তৎপরে সে তাহার দাদা ইন্দ্রানন্দের সহিত গোপনে দেখা করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল।
এ কাজ সহজে হইল না; কারণ তাহার পিতা তাহার মনের অবস্থা বুঝিতে পারিয়াছিলেন। তিনি তাহাকে চোখে চোখে রাখিয়াছিলেন।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – ভ্রাতা ও ভগিনী
একদিন অপরাহ্ণে বাটীর পশ্চাদ্বর্ত্তী উদ্যানে ইন্দ্ৰানন্দ একটা অতি দুষ্ট ঘোড়ায় চড়িবার চেষ্টা করিতেছিলেন। ভগিনীকে সেইদিকে আসিতে দেখিয়া তিনি তখনকার মত সে চেষ্টা পরিত্যাগ করিলেন। ভগিনীর মুখ দেখিয়া চমকিত হইলেন, দরিয়ার সুন্দর মুখকান্তি প্রস্ফুটিত গোলাপকেও লজ্জা দিত, আজ তাহার মুখ সম্পূর্ণ পাংশুবর্ণ হইয়া গিয়াছে। তিনি বলিয়া উঠিলেন, “দরি, তোর অসুখ করেছে?”
দরিয়া জোর করিয়া একটু হাসিল। হাসিয়া বলিল, “না—কই।”
ইন্দ্রানন্দ ঘোড়া ছাড়িয়া দিয়া তাহার নিকট আসিয়া বলিলেন, “হাঁ, অসুখ করেছে—দেখি।” বলিয়া দরিয়ার কপালে হাত দিলেন। দরিয়া হাসিয়া উঠিল। কিন্তু সে হাসিতে আনন্দটুকু আর নাই। ইন্দ্রানন্দ তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। দরিয়া সলজ্জভাবে মস্তক অবনত করিল। ইন্দ্রানন্দ হাসিয়া বলিলেন, “ওঃ! বুঝেছি।”
দরিয়া মস্তক তুলিল। বলিল, “কি বুঝেছ, দাদা?”
“তুই বীরবিক্রমের জন্য ভাবছিস। আমি বলছি, সে নিশ্চয়ই কোন কাজে গেছে, দুই এক দিনের মধ্যে এসে পড়বে।”
“না—দাদা।”
ইন্দ্রানন্দ দরিয়ার কাতরস্বরে বিচলিত হইয়া তাহার দিকে দেখিলেন। দেখিলেন, তাহার দুইচক্ষু জলে ভরিয়া গিয়াছে।
ইন্দ্রানন্দ ভগিনীকে বড় ভালবাসিতেন, তাঁহার মন নিতান্তই কোমল ছিল, ভগিনীর চোখে জল দেখিয়া তাঁহারও চোখে জল আসিল। বলিলেন, “দরি, আমি তার সন্ধানে নিজেই আজ নইনিতালে যাব—তা হলে হবে ত?”
দরিয়া ম্লানহাসি হাসিয়া বলিল, “তুমি যাবে—আমার আর কারও কথা বিশ্বাস হয় না। কিন্তু বাবাকে কিছু বলে কাজ নাই।”
“দরকার কি—অন্য কোন কাজের নাম করে যাব। তুই ভাবিস না, আমি ঠিক খবর নিয়ে আছি।”
“দাদা, নিশ্চয় তাঁর কোন বিপদ্ হয়েছে। যদি তাই হয়—তা হলে তুমি তাঁর সাহায্য করো।”
“আরে পাগলি! আমি করব না ত কে করবে?”
ইন্দ্রানন্দ ভগিনীকে টানিয়া লইয়া বাড়ীর ভিতর আসিলেন। তিনি সেইদিন বৈকালে পদব্ৰজে নইনিতালের দিকে রওনা হইলেন।
ইন্দ্রানন্দ সন্ধ্যার সময় বীরবিক্রমের বাড়ী আসিয়া দেখিলেন, বীরবিক্রম বাড়ি নাই। বীরবিক্রম যে কোথায় গিয়াছেন, কখন ফিরিবেন, তাহা তাহার একমাত্র “কেটা” ভৃত্য কিছুই বলিতে পারিল না।
বীরবিক্রম ও ইন্দ্রানন্দ উভয়ে প্রায় সময়বস্ক। কেবল যে বীরবিক্রম ভগিনীপতি হইবেন বলিয়া পরিচয়, এরূপ নহে, ইন্দ্রানন্দের সহিত বীরবিক্রমের আবাল্য বন্ধুত্ব। বীরবিক্রমের চাকর ইহা জানিত। সে সসম্মানে বসিবার ঘর খুলিয়া দিল। বীরবিক্রমের সহিত দেখা না করিয়া এখান হইতে নড়িব না স্থির করিয়া ইন্দ্রানন্দ বসিলেন, পকেট হইতে সিগারেট বাহির করিয়া টানিতে লাগিলেন।
ক্রমে এক ঘণ্টা কাটিল, দুই ঘণ্টা কাটিয়া গেল, ক্রমে রাত্রি বেশী হইতে লাগিল; কিন্তু তখনও বীরবিক্রমের দেখা নাই। ইন্দ্রানন্দ ক্রমে বড় ব্যস্ত হইয়া উঠিতে লাগিলেন। তিনি ভাবিলেন, “যত রাত্রি হোক না কেন, দেখা না করে আমি যাব না—এইখানেই আজ স্থিতি।”
ক্রমে রাত্রি এগারটা, তখনও বীরবিক্রম ফিরিল না। তখন ভৃত্যকে ডাকিয়া কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। ভৃত্য বলিল, “না—এই ক মাস থেকে এই রকম মাঝে মাঝে বাড়ী আসেন না। প্রায়ই অনেক রাত্রে ফেরেন।“
ভৃত্য চলিয়া গেল। ইন্দ্রানন্দ ক্রমে বন্ধুর জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন। তিনি স্থির হইয়া বসিয়া থাকিতে পারিলেন না, কিন্তু কি করিবেন, এত রাত্রে কোথায় তাহাকে খুঁজিবেন, তাহাও কিছু স্থির করিতে পারিলেন না, উঠিয়া ঘরের ভিতরে পাইচারী করিতে লাগিলেন।
সহসা নিকটে কাহার পদশব্দ শ্রুত হইল, কে দ্বার খুলিয়া ব্যস্তসমস্তভাবে গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন। চমকিত ও ভীত হইয়া ইন্দ্ৰানন্দ একপার্শ্বে দাঁড়াইলেন। যিনি প্রবেশ করিলেন, ইন্দ্ৰানন্দ তাঁহাকে প্রথমে বীরবিক্রম বলিয়া চিনিতে পারিলেন না। তাঁহার মুখ মৃত্যুবিবর্ণীকৃত, তাঁহার চক্ষু যেন ফাটিয়া বাহির হইয়া আসিতেছে, তাঁহার মুখে রক্তের চিহ্নমাত্র নাই। তাঁহাকে দেখিলে বোধ হয়, তিনি যেন এইমাত্র কি একটা ভয়াবহ কাণ্ড করিয়াছেন।
বীরবিক্রম ইন্দ্রানন্দকে দেখিতে পান নাই; বোধ হয়, তিনি তখন কিছু দেখিতে পাইতেছিলেন না। তিনি সহসা আলোকের নিকট গিয়া নিজের হাত দুখানা ও পরিধেয় বস্ত্রাদি দেখিয়া শিহরিয়া উঠিলেন।
ইন্দ্রানন্দ সভয়ে স্পন্দিতহৃদয়ে দেখিলেন, বীরবিক্রমের করতল রক্তাক্ত। দেখিয়া তাঁহার কণ্ঠ হইতে এক অব্যক্ত অস্পষ্ট শব্দ ধ্বনিত হইল। চমকিতভাবে বীরবিক্রম তাঁহার দিকে ফিরিয়া দাঁড়াইলেন। তাঁহাদের উভয়ের চক্ষু উভয়ের চক্ষে মিলিত হইল। উভয়েই অতিমাত্রায় বিস্মিত সহসা কাহারই আগে কথা কহিতে সাহস হইল না।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – করতল—রক্তাক্ত
অবশেষে ইন্দ্রানন্দ প্রথমে কথা কহিলেন। কিন্তু বিশেষ চেষ্টা করিয়াও তিনি নিজের স্বর স্বাভাবিক করিতে সক্ষম হইলেন না, কম্পিতস্বরে বলিলেন, “বীর—তুমি—তুমি—এত রাত্রি কোথায় কি করিতেছিলে? আমি তোমার অপেক্ষায় এতক্ষণ একা বসিয়া আছি।”
তখনও বীরবিক্রম পাষাণমূর্ত্তিবৎ ইন্দ্রানন্দের দিকে নির্নিমেষনেত্রে চাহিয়াছিলেন। সহসা তাঁহার যেন সংজ্ঞা হইল। কিছু বিরক্তভাবে বলিলেন, “তুমি ইন্দ্রানন্দ, এত রাত্রে এখন! আমার কাছে কি চাও? কি মনে করিয়া আসিয়াছ?”
ইন্দ্রানন্দ প্রাণের বন্ধুর নিকটে এরূপ কথা শুনিবার আশা করেন নাই, হৃদয়ে বড় ব্যথা পাইলেন; কোন উত্তর দিতে পারিলেন না।
বীরবিক্রম পকেট হইতে একখানা রুমাল বাহির করিয়া অতি স্থিরভাবে নীরবে হাতের রক্ত মুছিতে আরম্ভ করিল। দেখিয়া ইন্দ্রানন্দের প্রাণ কাঁপিয়া উঠিল। ভগ্নকণ্ঠে বলিলেন, “বীরবিক্রম, তোমার কাছে আমার আসা কি নূতন—না ইহাতে কোন আশ্চর্য্যের বিষয় আছে? তোমার কাছে যে আমাকে কিছু মনে করিয়া আসিতে হইবে, এ জ্ঞান আমার এতদিন ছিল না।”
ইন্দ্রানন্দের কথায় বীরবিক্রম বড় লজ্জিত হইলেন। বলিলেন, “আনন্দ, কিছু মনে করিয়ো না, ভাই। তুমি আসিলে আমি কবে অসন্তুষ্ট হইয়াছি? আমার মনটা বড় ভাল নয়—পথে আসতে একটা কাণ্ডে মনটা বড়ই খারাপ হইয়া গিয়াছে।”
ব্যাপার কি, সে নিজেই বলিবে মনে করিয়া ইন্দ্রানন্দ কোন উত্তর দিলেন না। তখন বীরবিক্রম বলিলেন, “একটি স্ত্রীলোক অন্ধকারে আর কুয়াশায় দেখিতে না পাইয়া উপরের রাস্তা হইতে একেবারে নীচের রাস্তায় পড়িয়া গিয়াছিল। আমি তখন সেখান দিয়া আসিতেছিলাম। কি করি, তাহাকে তুলিয়া অনেক কষ্টে হাঁসপাতালে রাখিয়া আসিলাম; তাই ফিরিতে এত দেরী হইয়াছে। তাহার সর্ব্বাঙ্গ কাটিয়া গিয়া রক্তারক্তি হইয়াছিল। দেখিলে না—তাহাকে তুলিতে গিয়া আমারই হাতে কত রক্ত লাগিয়াছিল।”
ইন্দ্রানন্দ বীরবিক্রমের ভাবে বুঝিলেন যে, এ কৈফিয়ৎ সত্য নহে; তিনি যে ঘটনার উল্লেখ করিলেন, তাহাতে তাঁহার হাতে রক্ত লাগে নাই। তবে নিজের মনের ভাব সহসা প্রকাশ করা যুক্তিসঙ্গত নহে ভাবিয়া ইন্দ্ৰানন্দ বলিলেন, “স্ত্রীলোকটি বাঁচিয়া আছে ত?”
“না,” বলিয়া বীরবিক্রম উঠিলেন। বলিলেন, “আমার শরীরটা বড় ভাল নয়, সকাল সকাল শোওয়াই উচিত।”
এই বলিয়া তিনি ভৃত্যকে আহার্য আনিতে বলিলেন। ইন্দ্রানন্দ বুঝিলেন, বীরবিক্রম কোন একটা বিষম বিভ্রাটে পড়িয়াছেন, তাঁহার মনের স্থিরতা নাই—তিনি আজ বেশী কথা কহিতে নারাজ; সুতরাং ইন্দ্রানন্দ আর কিছু জিজ্ঞাসা করিলেন না।
আহারাদির পর ইন্দ্রানন্দ শয়ন করিলেন। তিনি বালিসটি সরাইয়া ভাল করিয়া মাথায় দিতে গিয়া দেখিলেন, তাহার নীচে একখানি কাগজ রহিয়াছে। কক্ষ মধ্যে আলো জ্বলিতেছিল। সেই আলোকে ইন্দ্রানন্দ দেখিলেন, সেই কাগজখণ্ডে কেবল মাত্র লেখা আছে;–
“আজ রাত্রি আটটার সময় দেওপাট্টা ঘাটে আসিবে। না আসিলে মহা অনর্থ ঘটিবে।”
ইন্দ্রানন্দ কাগজখানি পকেটে রাখিলেন। ঘুমাইবে চেষ্টা করিয়া কম্বলে আপাদমস্তক আবৃত করলে তাপাদার জানা করিলেন—কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসিল না। একটু তন্দ্রা আসে অমনি স্বপ্নে বীরবিক্রমের রক্তমাখা হাত দেখিয়া তিনি শিহরিয়া জাগিয়া উঠেন। এইরূপ অবস্থায় তাঁহার সমস্ত রাত্রিটা কাটিয়া গেল। অতি প্রাতে তিনি উঠিলেন। নইনিতালে চিরকালই শীত। কিন্তু আজ যেন শীত অতিশয় বেশী হইয়াছে। চারিদিক কুহেলিকায় পূর্ণ, এক হাত দূরের লোক দেখা যায় না।
ইন্দ্রানন্দ উঠিয়া বাহিরে আসিলেন। দেখিলেন, বীরবিক্রমের চাকর গৃহকার্য্যে ব্যস্ত হইয়াছে। ইন্দ্রানন্দ জিজ্ঞাসা করিলেন, “বীরবিক্রম উঠেছেন?”
ভৃত্য বলিল, “তিনি আধঘণ্টা হ’ল চলে গেলেন। আপনি জিজ্ঞাসা করলে বলতে বলে গেছেন তিনি এবেলা ফিরবেন না—জরুরী কাজ আছে।”
ইন্দ্রানন্দ বন্ধুর এরূপ ব্যবহারে অতিশয় দুঃখিত হইলেন। মনে মনে বুঝিলেন, পাছে তিনি পূর্ব্বরাত্রের কোন কথা জিজ্ঞাসা করেন, এই ভয়েই বীরবিক্রম সরিয়া গিয়াছেন। যাহা হউক, আর এখানে থাকা অনর্থক বিবেচনা করিয়া ইন্দ্রানন্দ চিন্তিত মনে গৃহাভিমুখে ফিরিলেন।
সকলেই অবগত আছেন, নইনিতালে এক বিস্তৃত হ্রদ আছে। ইন্দ্ৰানন্দ সেই হ্রদের পার্শ্ববর্ত্তী পথ দিয়া যাইতেছিলেন। একস্থানে আসিয়া দেখিলেন, অনেক লোক জমিয়াছে, জনতার ভিতরে পুলিসের লোকও আছে।
ব্যাপার কি দেখিবার জন্য ইন্দ্রানন্দ সেই জনতার নিকটস্থ হইলেন। দেখিলেন, পুলিসে হ্রদের জল হইতে একটা মৃতদেহ টানিয়া তীরে তুলিয়াছে। মৃতদেহের বুকে কে ছোরা মারিয়াছে—সে ছোরা এখনও তাহার হৃদয়ে বিদ্ধ রহিয়াছে।
দেখিয়া ইন্দ্রানন্দের হৃদয় কাঁপিয়া উঠিল; সহসা বীরবিক্রমের রক্তাক্ত করতল তাঁহার মনে পড়িয়া গেল। কাহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে তাহার আর সাহস হইল না। দ্রুতপদে গৃহাভিমুখে চলিলেন।
.
ইন্দ্রানন্দ কিছুদূর গিয়াছেন, এই সময়ে এক ব্যক্তি পথিপার্শ্ব হইতে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়, দেওপাট্টা ঘাটে নাকি একটা ভয়ানক খুন হয়েছে?’
ইন্দ্রানন্দ কোন উত্তর না দিয়া বেগে তথা হইতে চলিয়া গেলেন, তখন তাঁহার ধমনীতে রক্তস্রোত প্রবলবেগে ছুটিতেছিল।
বীরবিক্রমের বাসায় উপাধানের নিম্নে যে একখণ্ড কাগজ পাওয়া গিয়াছিল, তাহাতে দেওপাট্টা ঘাটের উল্লেখ ছিল। ইন্দ্রানন্দ ভাবিতে লাগিলেন, এ প্রহেলিকার অর্থ কি? এক মুহূর্ত্তে তাঁহার চোখে নবোদিত প্রভাতের উজ্জ্বল দিবালোক ম্লান হইয়া গেল।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ – পিতা ও পুত্র
ইন্দ্রানন্দ উদ্বেগপূর্ণ হৃদয়ে গৃহে ফিরিলেন। দরিয়া ব্যাকুল হৃদয়ে তাঁহার প্রতীক্ষা করিতেছিল। ইন্দ্রানন্দ বাড়ীর নিকটস্থ হইতে না হইতে সে তাঁহাকে ধরিল। ইন্দ্রানন্দ দরিয়াকে দেখিয়া কিংকৰ্ত্তব্যবিমূঢ় হইলেন। কি করিবেন, কি বলিবেন, কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া মনে মনে বড়ই ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন।
দরিয়াও দাদার বিচলিতভাব লক্ষ্য করিল। সে-ও কোন কথা বলিতে পারিল না। বিস্মিত ও ভীতভাবে দাদার মুখের দিকে একদৃষ্টে ম্লান মুখখানি তুলিয়া চাহিয়া রহিল। ভগিনীর জন্য ইন্দ্রানন্দ আজ হৃদয়ে বড় ব্যথা পাইলেন।
উভয়ে নীরবে বাড়ীর দিকে চলিলেন। তাঁহারা বাড়ীর নিকটস্থ হইলে দরিয়া তাঁহার হাত ধরিল। ইন্দ্রানন্দ দাঁড়াইলেন। গম্ভীরভাবে বলিলেন, “দরি, বীরবিক্রমের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। যদি আমার পরামর্শ শোন, তবে তাহার কথা আর মনে করিয়ো না, তাহার মাথা একদম খারাপ হইয়া গিয়াছে।”
দরিয়া দাদার মুখের দিকে তাহার আকর্ণবিশ্রান্ত চক্ষু দুটি স্থির রাখিয়া বলিল, “দাদা, তুমি ভুল মনে করিতেছ।”
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “ভুল নয়, আমি স্বচক্ষে তাহাকে দেখিয়া আসিয়াছি—তাহার পর সে নাকি একটা কি গোলমালেও পড়িয়াছে।”
দরিয়া ব্যগ্রভাবে বলিল, “সেইজন্য এখন আমাদের আরও তাঁহাকে দেখা উচিত।”
ই। আমরা তাহার কিছুই সাহায্য করিতে পারিব না।
দ। না পার, আমি পারিব। আমি আজই তাঁহার কাছে যাইব।
ই। তুই কি পাগল হলি, দরি?
দ। পাগল কি জানি না—আমি যাব।
ইন্দ্রানন্দ তাহার ভগিনীর হৃদয় বুঝিতেন; তিনি জানিতেন, দরিয়া যাহা করিতে ইচ্ছা করে, তাহা সে করে—কেহই তাহাকে বিরত করিতে পারে না। ইন্দ্রানন্দ তাহার জন্য ভীত হইলেন।
তাঁহার সম্পূর্ণ বিশ্বাস যে, বীরবিক্রমই খুন করিয়াছেন, কেন খুন করিয়াছেন, তাহা তিনি নিজেই জানেন। এখন ভগিনী যদি উন্মত্তার মত তাঁহার নিকটে যায়, তাহা হইলেও মহা বিপদ্! লোকলজ্জার সীমা থাকিবে না। ইন্দ্রানন্দ ভগিনীকে বুঝাইয়া কহিলেন, “দরি, স্থির হও, যদি তুমি স্থির হইয়া বাড়ীতে থাক, কোন গোলযোগ না কর, তবে আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি, যেমন করিয়া হক, বীরবিক্রমের কি হয়েছে, জানিব। আর যদি সে যথার্থই কোন বিপদে পড়িয়া থাকে, প্রতিজ্ঞা, করিতেছি যে, আমি প্রাণ দিয়াও তাহাকে রক্ষা করিব।”
দরিয়া বলিল, “আমার মাথায় হাত দিয়া বল।”
অগত্যা ইন্দ্রানন্দ ভগিনীর মস্তক স্পর্শ করিয়া প্রতিজ্ঞা করিলেন। তখন দরিয়া বলিল, “যা জানিতে পারিবে, আমাকে বলিবে?”
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “তাহাই হইবে।” তখন উভয়ে গৃহাভিমুখে চলিল।
ইন্দ্রানন্দের পিতা গুণারাজ শুনিয়াছিলেন যে, ইন্দ্রানন্দ বীরবিক্রমের সন্ধানে গিয়াছিল। তাহাই পুত্র আসিবামাত্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “তাহার সঙ্গে দেখা হইল?”
ইন্দ্রানন্দ দেখিলেন, সত্য কথা বলিলে অনেক কথা বলিতে হয়, হয়ত তাহার পিতার জেরায় পড়িয়া সকল কথাই তাঁহাকে বলিয়া ফেলিতে হইবে। এই ভাবিয়া তিনি প্রকৃত ব্যাপার গোপন করাই শ্রেয়ঃ মনে করিলেন। কিন্তু মিথ্যা কথা বলার তাহার অভ্যাস ছিল না, মুখে বাধিয়া যাইতে লাগিল। সভয়ে বলিলেন, “না, দেখা হয় নাই।”
গুণারাজ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায় গিয়াছে?”
ইন্দ্রানন্দ ইতস্ততঃ করিয়া বলিলেন, “সে কথা কাহাকেও সে বলিয়া যায় নাই। কাজ আছে বলিয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে।”
পুত্রের কথার ভাবে গুণারাজ তাঁহাকে কতক সন্দেহ করিলেন, মনে মনে বুঝিলেন, ইন্দ্রানন্দ তাঁহাকে মিথ্যাকথা বলিতেছে। কিন্তু তিনি আর কিছু জিজ্ঞাসা করিলেন না।
“রক্ষা পাইলাম,” ভাবিয়া ইন্দ্রানন্দ প্রথম সুযোগেই তথা হইতে সরিয়া পড়িল। সারাদিন ধরিয়া ইন্দ্রানন্দ কেবল বীরবিক্রমের কথাই ভাবিলেন। শেষে কি একটা উপায় স্থির করিয়া, মৃদুহাস্য করিয়া আপনমনে বলিল, “আমাকে দেখিতেছি ডিটেক্টিভগিরী করিতে হইবে? এ রহস্য ভেদ করিতে না পারিলে আমার আর শান্তি নাই।”
তাঁহার ভগিনীর উপর—বীরবিক্রমের উপর ইন্দ্রানন্দের ভয়ানক রাগ হইতে লাগিল। তিনি এ পৰ্য্যন্ত ভাবনা-চিন্তা কাহাকে বলে, তাহা জানিতেন না—আমোদ-প্রমোদ লইয়া, হাসি তামাসার বিমল আনন্দে দিন কাটাইতেন; কিন্তু বীরবিক্রমের রক্তমাখা হাত আর সেই দেওপাট্টা ঘাটের খুনী লাস দেখা অবধি তাঁহার আহার নিদ্রা নষ্ট হইয়া গিয়াছে। সর্ব্বদাই সেই রক্তাক্ত হাত তাঁহার মনে পড়িতেছে।
কতক নিজের জন্য, কতক ভগিনীর জন্য এ ব্যাপারের ভিতরে কি রহস্য আছে, তাহা জানিবার অভিপ্রায়ে ইন্দ্রানন্দ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইলেন। ভাবিলেন “বীরবিক্রম কিছুতেই বলিবে না, কাজেই আমাকে চেষ্টা করিয়া ভিতরকার সকল কথাই বাহির করিতে হইবে। এও কি পারিব না?”
ইন্দ্রানন্দ পর দিবসেই একবার দেওপাট্টা ঘাটে যাইতে মনস্থ করিলেন। ভাবিলেন, “সেদিন কে বীরবিক্রমকে দেওপাট্টা ঘাটে যাইতে লিখিয়াছিল, নিশ্চয় সে-ও গিয়াছিল—কোথায় গিয়াছিল, তাহাই আমাকে প্রথমে দেখিতে হইবে। যে লোকটার লাস জলে পাওয়া গিয়াছে, সেই বা কে, তাহাও আমাকে জানিতে হইবে।”
পর দিবস আহারাদির পর ইন্দ্রানন্দ আবার নইনিতাল অভিমুখে রওনা হইতেছেন, এই সময়ে তাঁহার পিতা তাঁহাকে ডাকিলেন। ইন্দ্রানন্দ ফিরিলেন। ইন্দ্রানন্দ সম্মুখবর্ত্তী হইলে গুণারাজ জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি নাকি নইনিতালে যাইতেছ?”
ইন্দ্রা। হাঁ, আর একবার বীরবিক্রমের সন্ধান লইব মনে করিয়াছি।
গুণা। শুনিলাম, দেওপাট্টা ঘাটে নাকি যে লাস পাওয়া গিয়াছে, তাহা দয়ামলের। এই দয়ামল অনেক দিন বীরবিক্রমের বাবার কাছে চাকরী করিয়াছিল। লোকটা ভয়ানক জুয়াচোর, নানা ষড়যন্ত্র করিয়া বীরবিক্রমের পিতা গোলাপ সার সমস্ত বিষয় ফাঁকি দিয়া লইয়া নিজে বড়লোক হইয়াছিল। যেখানে তাহার লাস পাওয়া গিয়াছে, তাহারই নিকটে গোলাপ সার বাড়ী ছিল। কিন্তু দয়ামল সে বাড়ী ভাড়া দিয়াছিল। আমি জানি, অনেক দিন থেকে সে বাড়ী খালি পড়িয়া আছে। সন্ধান লইয়ো, যথার্থ দয়ামলই খুন হইয়াছে কি না।
ইন্দ্রা। যাইতেছি, যতদূর পারি, সন্ধান লইব।
পিতার কথা শুনিয়া তাঁহার যেটুকু সন্দেহ ছিল, দূর হইল। তিনি এখন নিশ্চয়ই বুঝিলেন যে, পিতৃ-শত্রু দয়ামলকে বীরবিক্রমই খুন করেছেন।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ – কে এ বালিকা?
নিতান্তই বিষণ্ণচিত্তে ইন্দ্রানন্দ নইনিতালে আসিলেন। অনুসন্ধান করিয়া জানিলেন যে, সত্যসত্যই দয়ামল খুন হইয়াছে। যেদিন রাত্রে ইন্দ্রানন্দ বীরবিক্রমের রক্তাক্ত হাত দেখিয়াছিলেন, সেইদিন হইতে দয়ামল নিরুদ্দেশ। সে নিরুদ্দেশ হওয়ায়, তাহার স্ত্রী পুলিসে সংবাদ দেয়, বলে যে তাহার স্বামী দেওপাট্টা ঘাটে বিশেষ কাজ আছে বলিয়া সন্ধ্যার সময় বাটীর বাহির হইয়া যান, আর তিনি ফিরেন নাই। পুলিস দেওপাট্টা ঘাটে লাস পাইলে দয়ামলের স্ত্রীকে সংবাদ দেয়। সে আসিয়া স্বামীকে সেনাক্ত করিয়াছে। যথার্থ দয়ামলই খুন হইয়াছে। এই সকল শুনিয়া ইন্দ্ৰানন্দ ভাবিলেন, “দিনের বেলায় সেখানে যাওয়া কর্ত্তব্য নহে, রাত্রে গোপনভাবে সন্ধান লইতে হইবে।”
ইন্দ্রানন্দ এদিকে ওদিকে নানা স্থানে ঘুরিয়া দিনের বেলাটা কাটাইয়া দিলেন। রাত্রি প্রায় আটটার সময় তিনি দেওপাট্টা ঘাটের দিকে চলিলেন
তিনি এ পর্যন্ত নইনিতালের এ দিকটা ভাল করিয়া কখনও দেখেন নাই; প্রকৃতপক্ষে এ দিকে লোকের বড় চলা-ফেরা ছিল না। এখানে কতকগুলি ভাঙ্গা বাড়ী ছিল। ভাঙ্গা বলিয়া এই সকল বাড়ীর ভাড়া হইত না। ইন্দ্রানন্দ দেখিলেন, ঘাটের নিকটেই এক স্থানে স্তূপাকার কাঠ পড়িয়া আছে। নিকটে দুই একখানি ছোট ‘ডিঙ্গি’ নৌকা বাঁধা রহিয়াছে। কোন দিকে জন-মানবের সম্পর্ক নাই। এ স্থানটি শহরের সম্পূর্ণ বাহিরে। দূরস্থ গ্রামে যাইতে হইলে কেহ কেহ এই পথে যাইত।
এক্ষণে রাত্রে পথে কেহই নাই। চারিদিক শব্দশূন্য। নিশাচর পক্ষীর কর্কশ কণ্ঠে এক একবার সেই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ হইতেছিল, অন্ধকার ও কুাটিকায় চারিদিক আচ্ছন্ন।
ইন্দ্রানন্দ অতি সন্তর্পণে যাইতেছিলেন। রাস্তার দূরে দূরে যে আলো ছিল, তাহাতেই একটু একটু চারিদিক দেখা যাইতেছিল। ইন্দ্ৰানন্দ কাষ্ঠস্তূপের উপর দিয়া একটা ভাঙ্গা বাড়ীর নিকটে আসিলেন। চারিদিক ভাল করিয়া দেখিলেন। বুঝিলেন, এই সকল বাড়ী প্রকৃতই খালি পড়িয়া আছে, এখানে জনপ্রাণী নাই।
“এমন নির্ব্বোধ আমি, গোয়েন্দাগিরী করিবার উপযুক্ত স্থানই ইহা বটে—ফিরিতে হইল,” বলিয়া ইন্দ্রানন্দ আবার সাবধানে রাজপথের দিকে আসিতে লাগিলেন। একস্থানে রাশীকৃত কাঠ পড়িয়াছিল, দূর হইতে পথের আলোকস্তম্ভের আলো সেইখানে পড়িয়াছিল। ইন্দ্রানন্দ সেইখান দিয়া ফিরিতেছিলেন—সহসা স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইলেন। দেখিলেন, একটি বালিকা কাষ্ঠস্তূপের পার্শ্বে মুখ সরাইয়া লইল।
ইন্দ্রানন্দ মুহূৰ্ত্তমাত্র সেই বালিকার মুখ দেখিয়াছিলেন; তাহাতেই তিনি বুঝিয়াছিলেন, সেই মুখখানি বড় সুন্দর—তেমন আর কখনও তিনি দেখেন নাই।
সহসা এই রাত্রে এইরূপ স্থানে এই বালিকার মুখ দেখিয়া প্রথমে তাঁহার ভয় হইয়াছিল; কিন্তু ইন্দ্রানন্দ জাতিতে নেপালী—গুর্খা—ভয় কাহাকে বলে জানিতেন না। ভাবিলেন, “তবে এখানে লোক আছে—এই বালিকা কোথায় গেল, আমাকে দেখিতে হইল।”
এই ভাবিয়া ইন্দ্ৰানন্দ আবার অগ্রসর হইলেন। যেখানে বালিকাকে দেখিয়াছিলেন, অতি সন্তর্পণে ও সাবধানে সেইদিকে চলিলেন। কিন্তু তিনি প্রথমে যেখানে বালিকাকে দেখিয়াছিলেন, তথায় গিয়া দেখিলেন, বালিকা সেখানে নাই।
ইন্দ্রানন্দ বালিকার সন্ধানে আরও অগ্রসর হইলেন। ক্রমে আবার সেই ভাঙ্গা বাড়ীর নিকট আসিয়া পড়িলেন। ভাবিলেন, নিশ্চয়ই বালিকা এই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়াছে।
এই ভাবিয়া ইন্দ্ৰানন্দ ঐ ভাঙ্গা বাড়ীর দ্বারে ধাক্কা দিবার উপক্রম করিতেছেন—ঠিক সেই সময়ে নিকটে মনুষ্যের পদশব্দ শুনিয়া চমকিত হইয়া ফিরিয়া দাঁড়াইলেন। দেখিলেন, তাঁহার পার্শ্বে একটি বালিকা, এ বালিকা—পাহাড়িয়া।
বালিকা কম্পিতকণ্ঠে সভয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলিল, “তুমি এ বাড়ীর ভিতর যেয়ো না? বাড়ীর ভিতর একজন লোক মরে আছে।”
ইন্দ্ৰানন্দ বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “তুমি কেমন করিয়া জানিলে?”
বালিকা সেইরূপ অস্পষ্টস্বরে কম্পিত কণ্ঠে বলিল, “আমি দেখেছি—আমি তাকে মরতে দেখেছি।”
এই ভয়াবহ কথা শুনিয়া, সেই নির্জ্জন রাত্রে সেই জনমানবসমাগম শূন্য স্থানে আর থাকা কৰ্ত্তব্য নয়, ভাবিয়া ইন্দ্রানন্দ সত্বর রাজপথের দিকে যাইবার জন্য অগ্রসর হইলেন। তখনই তাঁহার দিকে ছুটিয়া গিয়া কাতরভাবে সেই বালিকা বলিল, “আমাকে ফেলে যেয়ো না—দুদিন হলো এই মড়া রয়েছে।“
বালিকার কথায় সহসা ইন্দ্রানন্দের মনে বীরবিক্রমের রক্তাক্ত হাত দুখানা উদিত হইল। তাঁহার কণ্ঠ হইতে নির্গত হইল, “দু দিন?”
বালিকার সর্ব্বাঙ্গ কাঁপিতেছিল। সে বলিল, “হাঁ, দু দিন। সেই পৰ্য্যন্ত আমি বাহিরে এখানে আছি—বাড়ীর ভিতর যেতে পারি নি।”
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – বালিকা—বিপন্না
ইন্দ্রানন্দের হৃদয় বালিকার কাতরকণ্ঠে দ্রবীভূত হইয়া গেল। তিনি বালিকার মুখ অন্ধকারে ভাল দেখিতে পাইতেছিলেন না; তথাপি বুঝিলেন, বালিকার মুখখানি অতি সুন্দর। বয়ঃক্রম বেশী নহে—চতুৰ্দ্দশ কি পঞ্চদশ বর্ষ হইবে। তাহার পরিধানে মলিন বসন, শীতে অনাহারে কষ্টে সে যে পীড়িত, তাহাও ইন্দ্রানন্দ বুঝিতে পারিলেন।
ইন্দ্রানন্দের হৃদয় করুণাপূর্ণ। তিনি বালিকার জন্য বড় ব্যথিত হইলেন। কি করিবেন, কি বলিবেন, কিছুই ভাবিয়া পাইলেন না।
বালিকা বলিল, “আমার সঙ্গে যাবে?”
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “আমি গিয়ে কি করিব? তোমার উচিত পুলিসকে খবর দেওয়া।”
বালিকা কেবল মাথা নাড়িল। তৎপরে কম্পিতস্বরে বলিল, “না—না—না। তাকে একেবারে মেরে ফেলেছে।”
ইন্দ্রানন্দ ভাবিলেন, তিনি এখানে আসিয়া একেবারেই ভাল করেন নাই। বলিলেন, “তা হইলে তোমার এখনই পুলিসে খবর দেওয়া উচিত।”
বালিকা বলিল, “নানা—যিনি এই কাজ করেছেন, তিনি আমাকে আর দাদিয়াকে বড় যত্ন করেন। পুলিস জানতে পারলে তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে ফাঁসী দিবে। তা হলে আমাদের কি হবে।”
ইন্দ্রা। যদি তুমি পুলিসকে এত ভয় কর, তবে কেমন করে এ সব কথা আমাকে বলিতেছ? বালিকা। আমার বলবার ইচ্ছা ছিল না—কিন্তু আমি দু দিন বাহিরে রয়েছি—দু দিন কেউ এদিকে আসে নি— দু দিন ঘরের ভিতর সে রয়েছে। তোমাকে দেখে তাই কথা কয়েছি— তোমাকে দেখে ভাল লোক বলে মনে হয়েছিল।
সহসা বালিকা নীরব হইল—সে যেন নিতান্ত অবসন্ন হইয়া পড়িয়া পার্শ্বস্থ প্রাচীরে ভর দিয়া হেলিয়া দাঁড়াইল, আর কোন কথা কহিল না।
ইচ্ছা করিলে এই সময়ে ইন্দ্রানন্দ অনায়াসেই সেখান হইতে পলাইতে পারিতেন। তিনি প্রথমে ভাবিলেন, স্পষ্টই বোধ হইতেছে এ স্থান চোর ডাকাতের আড্ডা, এই বালিকাও নিশ্চয় তাহাদের দলেরই একজন। এইরূপ ভাণ করিয়া, তাঁহাকে ভুলাইয়া পড়ো বাড়ীর ভিতরে লইয়া যাইতে চায়। ভিতরে গেলে সকলে পড়িয়া তাঁহার যাহা কিছু আছে কাড়িয়া লইবে। কিন্তু পর মুহুর্ত্তেই তিনি হৃদয় হইতে এ সন্দেহ দূর করিলেন; বালিকার বিষণ্ণ সুন্দর সকরুণ মুখখানি প্রথম দর্শনেই তাঁহার হৃদয়ে অঙ্কিত হইয়া গিয়াছিল। তিনি ভাবিলেন, এই বালিকাকে এ অবস্থায় তিনি যদি ফেলিয়া যান, তবে তাহার অপেক্ষা নরাধম পাষণ্ড আর কে সংসারে আছে! তিনি এই বালিকার সবিশেষ বিবরণ জানিবার জন্য উৎসুক হইলেন। আরও ভাবিলেন হয় ত এই বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করিলে বীরবিক্রম সম্বন্ধেও কোন সন্ধান পাইতে পারেন।
এই সকল ভাবিয়া তিনি যেখানে বালিকা প্রাচীর অবলম্বন করিয়া ক্লান্তভাবে দাঁড়াইয়াছিল, সেইখানে আসিলেন। বলিলেন, “তুমি যখন বলিতেছ, তখন আমি ভিতরে যাইব। আলো আছে?
বালিকা অস্পষ্টস্বরে বলিল, “না তবে ভিতরে গেলে বাতী আছে।”
ইন্দ্রানন্দের দোষের মধ্যে কিছু উদ্ধত। তিনি দ্বারে আঘাত করিলেন। দেখিলেন, দ্বার বদ্ধ ছিল না, এক আঘাতেই খুলিয়া গেল। তিনি একটি অন্ধকারপূর্ণ কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিলেন।
তাঁহার হৃদয়ে প্রচুর সাহস থাকিলেও এই অন্ধকারময় গৃহমধ্যে আসিয়া তাঁহার হৃদয় সবলে স্পন্দিত হইতে লাগিল। কিন্তু মুহূর্ত মধ্যে তিনি তাঁহার হৃদয়ের এই দুর্ব্বলতা দূর করিলেন। বলিলেন, “বাতী কোথায়?”
বালিকা কোথা হইতে অন্ধকারে একটা অৰ্দ্ধদগ্ধ বাতী আনিয়া তাহার হাতে দিল। ইন্দ্ৰানন্দ পকেট হইতে দিয়াশালাই বাহির করিয়া বাতী জ্বালিলেন। বাতীর আলোকে বালিকার মুখের দিকে চাহিয়া তিনি বিস্মিত হইলেন—এরূপ বিশাল সুন্দর চক্ষু তিনি পূর্ব্বে আর কখনও দেখেন নাই।
তিনি তখন গৃহটিও ভাল করিয়া দেখিয়া লইলেন। গৃহমধ্যে যে সকল জিনিষ ছিল, তাহাতে তিনি স্পষ্টই বুঝিলেন, এ বাড়ী নিতান্ত পড়ো বাড়ী নহে, এখানে লোকজনের বসবাস আছে।
তখন তাঁহার মনে পূর্ব্বে যে সন্দেহ হইয়াছিল, এক্ষণে আবার তাহাই হইল। তিনি ভাবিলেন, বালিকা তাঁহাকে এ পৰ্য্যন্ত যাহা যাহা বলিয়াছে, সর্ব্বৈব মিথ্যা। সে তাঁহাকে ভুলাইয়া বাটীর ভিতর আনিয়াছে। বালিকা কি যেন কান পাতিয়া শুনিতেছে দেখিয়া তাঁহার সন্দেহ আরও বৃদ্ধি পাইল। তিনি বালিকার দিকে চাহিলেন। কিন্তু সেই সুন্দর মুখখানি দেখিয়া তাঁহার সকল সন্দেহ মুহূর্ত্ত মধ্যে তিরোহিত হইল।
সপ্তম পরিচ্ছেদ – বালিকা—অনাহারক্লিষ্টা
বালিকা প্রাচীরে পিঠ দিয়া দাঁড়াইয়াছিল। অস্পষ্টস্বরে বলিল, “ঐ ঘরে।”
ইন্দ্রানন্দ শিহরিয়া উঠিলেন। বলিলেন, “আমার দেখার ইচ্ছা নাই।” তৎপরে বালিকা আবার কান পাতিয়া যেন কি শুনিতেছে দেখিয়া তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কি শুন্ছ?”
বালিকা কেবল মাত্র বলিল, “কিছুই না।”
ইন্দ্রা। তুমি এই পড়ো বাড়ীতে কি করছিলে?
বালিকা। কেন, আমরা এখানে থাকি।
ইন্দ্রা। আমরা কে? আর কে থাকে?
বালিকা। দাদিয়া।
ইন্দ্ৰা। দাদিয়া কে?
বালিকা। আমার মার মা। আমরা বড় গরীব, তাই এখানে থাকি, এখানে ভাড়া দিতে হয় না।
ইন্দ্রা। একি উচিত?
বালিকা। তা আমি কি জানি। তবে আমি শুনেছি, দাদিয়ার মনিবের এ সব বাড়ী ছিল।
ইন্দ্রা। তিনি কে?
বালিকা। বীরবিক্রম—তাঁর বাপের কাছে দাদিয়া দাসী ছিল।
বীরবিক্রমের নাম শুনিয়া ইন্দ্ৰানন্দ স্বতঃই চমকিত হইয়া উঠিলেন, বালিকা তাহা লক্ষ্য করিল। বলিল, “বীরবিক্রমকে তুমি চেন?”
ইন্দ্রানন্দ একটু ইতঃস্তত করিয়া বলিলেন, “না—নাম শুনেছি।”
বালিকা কিয়ৎক্ষণ তাঁহার মুখের দিকে অবাক হইয়া চাহিয়া রহিল। ক্ষণপরে বলিল, “তিনিই তোমায় এখানে পাঠিয়েছেন?”
“না।”
“তবে তুমি এখানে এসেছ কেন?”
“এই পথে যাচ্ছিলাম, তুমি ডাকলে বলে।”
এই সময়ে ইন্দ্রানন্দের দৃষ্টি দ্বারের দিকে পড়িল। তিনি দেখিলেন কে দ্বার বন্ধ করিয়া দিয়াছে। মুহূর্ত্ত মধ্যে তাঁহার হৃদয় আবার সন্দেহে পূর্ণ হইল। তিনি সত্বর গিয়া দ্বার খুলিবার চেষ্টা করিলেন, চেষ্টা ব্যর্থ হইল—দ্বার খুলিল না। তখন তিনি স্পষ্ট বুঝিলেন যে, এই ধূৰ্ত্ত বালিকা তাঁহাকে ভুলাইয়া এই ঘরের ভিতর আনিয়া আটকাইয়াছে। এখনই তাহার দলস্থ লোক আসিয়া তাঁহাকে আক্রমণ করিবে।
তিনি অত্যন্ত অধীরভাবে সবলে দ্বারে পদাঘাত করিতে গেলেন; কিন্তু কি পায়ে লাগিয়া একেবারে ভূপতিত হইলেন।
বালিকা ছুটিয়া তাঁহার পার্শ্বে জানু পাতিয়া বসিয়া কাতরকণ্ঠে বলিল, “লাগে নাই ত– আমি দরজা বন্ধ করে দিয়েছি, তুমি ব্যস্ত হচ্ছ কেন?”
ইন্দ্ৰানন্দ বলিয়া উঠিলেন, “তুমি কিজন্য আমায় এমন করে বন্ধ করেছ।”
বালিকা ব্যাকুলভাবে বলিল, “আমি আর এক রাত্রি একা থাকলে পাগল হয়ে যাব— তোমার লাগে নাই ত? তুমি যাবে না বল, আমি দরজা খুলে দিচ্ছি।”
ইন্দ্রানন্দ উঠিয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন, “সব কথা যদি আমায় বল, তা হলে আমি যাব না। নতুবা তবে আমায় বন্ধ করে রাখলেও আমি থাকব না—দরজা ভেঙে বেরিয়ে যাব।”
বালিকা নীরবে গিয়া দ্বার খুলিয়া দিল। ধীরে ধীরে সবিনয়ে বলিল, “হয়েছে—এখন যাবে না, বল।”
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “সে কথা ত আগেই বলেছি। এখন তোমার সব কথা বল।”
বালিকা অতি মৃদুস্বরে বলিল, “এই দিকে এস।” সে বাতী হাতে লইয়া পার্শ্ববর্ত্তী গৃহে প্রবেশ করিল। ইন্দ্রানন্দ তাহার সঙ্গে সঙ্গে চলিলেন।
পরবর্ত্তী ঘরটি আরও অন্ধকার। বোধ হয়, দিনেও আলো না জ্বালিলে এ ঘরে কিছুই দেখা যায় না। তথায় দুই-একখানা চেয়ার ও একটা অৰ্দ্ধ ভগ্ন টেবিল ছিল। বালিকা ইন্দ্রানন্দকে বসিতে ইঙ্গিত করিল। সহসা পার্শ্ববর্ত্তী একটি অর্দ্ধোন্মুক্ত দ্বারের দিকে চাহিয়ে সে বড় কাঁপিতে লাগিল— সে সভয়ে কম্পিত অৰ্দ্ধস্ফুট স্বরে সম্মুখস্থ সেই অর্দ্ধোন্মুক্ত দ্বারের দিকে অঙ্গুলী নির্দ্দেশ করিয়া বলিল, “ঐ ঘরে—” ইন্দ্রানন্দের হৃদয় সবলে স্পন্দিত হইতে লাগিল। তিনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেই গৃহের দিকে চাহিলেন। তাহার মনে হইল যেন কে সেই গৃহমধ্যে গোঁ গোঁ শব্দ করিল। প্রকৃতই তাঁহার সাহস হৃদয় হইতে অন্তর্হিত হইতেছিল।
সহসা তাঁহার পশ্চাতে একটা গুরুভার দ্রব্যের পতন শব্দ হইল। সঙ্গে সঙ্গে আলোটাও নিবিয়া গেল। তিনি ঘোর অন্ধকারে নিমগ্ন হইলেন। কোন দিকে কিছুই দেখিতে পাইলেন না।
তখন তাঁহার সমস্ত সাহস তিরোহিত হইল। তিনি লম্ফ দিয়া দ্বারের দিকে ফিরিলেন। অন্ধকারে হাতড়াইয়া হাতড়াইয়া দ্বার পাইলেন। ভাবিয়াছিলেন, দ্বার রুদ্ধ হইয়াছে, তাহা নহে, দ্বার খোলা আছে। তিনি যেমন দুই-এক পদ অগ্রসর হইয়াছেন—অমনি গৃহতল হইতে কাহার কাতরোক্তি শুনিতে পাইলেন। বিচলিতচিত্তে তিনি ফিরিয়া দাঁড়াইলেন। সেই রাত্রের পাহাড়ের শীতেও তাঁহার গলদঘর্ম্ম ছুটিয়াছিল।
ইন্দ্রানন্দ পকেট হইতে তাড়াতাড়ি কম্পিত হস্তে দিয়াশালাই বাহির করিয়া জ্বালিলেন। সেই আলোকে দেখিলেন, বালিকা তাঁহার পদ পার্শ্বে পড়িয়া আছে।
ইন্দ্রানন্দ আরও একটা দিয়াশালাই জ্বালিলেন। সেই আলোকে বালিকার মুখের দিকে চাহিলেন। দেখিলেন, বালিকা মূৰ্চ্ছিতা হইয়াছে।
ইন্দ্রানন্দ দেখিলেন, বালিকার হাত হইতে বাতীটা দূরে গিয়া পড়িয়াছে। তিনি প্রথমে বাতীটা তুলিয়া লইয়া জ্বালিলেন। ঘর আলোকিত হওয়ায় তাঁহার সাহস আবার দেখা দিল। নিজ দুর্ব্বলতার জন্য ইন্দ্রানন্দ মনে মনে বড় লজ্জিত হইলেন।
তিনি বালিকার মস্তক নিজ ক্রোড়ে তুলিয়া লইয়া তাহার মূৰ্চ্ছাপনোদনের চেষ্টা পাইতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরেই বালিকা একবার দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিল। পরে ধীরে ধীরে চক্ষুরুন্মীলন করিল। সে এমনই ভাবে শূন্যদৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল যে, তাহাকে দেখিয়া ইন্দ্ৰানন্দ ভয় পাইলেন ‘
ক্ষণপরে বালিকা অতি অস্পষ্টস্বরে বলিল, “আমি—আমি—ওগো, আমি যে দু দিন খাইনি।”
অষ্টম পরিচ্ছেদ – জ্বলন্ত চক্ষু
ইন্দ্রানন্দের করুণ হৃদয় বিগলিত হইল, তিনি বলিলেন, “হতভাগিনী, না জানি তোমার কত কষ্ট হইতেছে। তোমার মুখ দেখিয়া ইহা আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল। এস, এই চেয়ারখানা ঠেসান দিয়ে বস, আমি এখনই তোমার জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসি। আমি কাছেই একখানা দোকান দেখে এসেছি।”
বালিকা কাতরকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, “না—না—না—আমি এখানে আর একা থাকতে পারব না।”
ইন্দ্রানন্দ সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া তাহাকে ক্রোড়ে তুলিয়া লইলেন। নিকটস্থ চেয়ারে তাহাকে বসাইয়া দিলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ বাহির হইয়া যাইতে উদ্যত হইলেন; কিন্তু অতি ব্যগ্রভাবে বালিকা তাঁহার বসনাগ্র দুই হাতে চাপিয়া ধরিল। তাহার উঠিবার ক্ষমতা ছিল না; সে ব্যাকুলভাবে ইন্দ্রানন্দের দিকে চাহিয়া বলিল, “তুমি তা হলে আর আসবে না?”
“কেন ভয় পাও—আমি এখনই আসিব। তুমি কি মনে কর তোমাকে এই অবস্থায় ফেলিয়া যাইব?” এই বলিয়া ইন্দ্রানন্দ সত্বর সে গৃহ হইতে বহির্গত হইলেন। বালিকা উঠিবার চেষ্টা করিল, উঠিতে পারিল না। পাষাণমূর্তির ন্যায় একদৃষ্টে তাঁহার দিকে হতাশভাবে চাহিয়া রহিল। শেষে ইন্দ্রানন্দ বাড়ীর বাহির হইয়া যান দেখিয়া, সে কাঁদিয়া উঠিল। ইন্দ্রানন্দ ফিরিলেন।
তখন বালিকা সজলনেত্রে বলিল, “যদি কারও সঙ্গে তোমার দেখা হয়, তা হলেও তুমি আসিবে বল?”
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “আসিব, তুমি নিশ্চিন্ত থাক। কাহার সঙ্গে আমার দেখা হইতে পারে মনে কর?”
“দাদিয়া যদি ফিরে আসেন—আমার কেবলই মনে হচ্ছে দাদিয়া এখনই ফিরে আসবেন, এমন করে আমায় একেবারে ফেলে যাবেন না।”
“ভয় নাই, আমি তোমার বুড়া দাদিয়ার ভয়ে পলাইব না।”
“তুমি তাহাকে চেন না।”
“পরে চিনিব—ভয় নাই, আমি এখনই আসিতেছি।”
ইন্দ্রানন্দ আর তিলার্দ্ধ বিলম্ব না করিয়া বালিকার জন্য কিছু আহারাদি সংগ্রহের জন্য দ্রুতবেগে তথা হইতে রাজপথে আসিলেন।
নিকেটই একটা দোকান ছিল। তিনি সত্বর তথায় যাহা পাইলেন, তাহাই লইয়া আবার পড়ো বাড়ীর দিকে চলিলেন।
তাহার বোধ হইল, যেন পড়ো বাড়ীর উপরের ঘরে তিনি মুহূর্ত্তের জন্য একটা আলো দেখিতে পাইলেন। কিন্তু তিনি জানিতেন, বাড়ীতে কেহই নাই; সুতরাং ভাবিলেন, তাঁহারই নিজের ভুল হইয়াছে।
পরে কিয়দ্দূর অগ্রসর হইয়া তিনি দেখিলেন যে, কতকগুলি কাঠ কে যেন সরাইয়াছে; তিনি সেদিকে বিশেষ লক্ষ্য না করিয়া বাড়ীর দরজার নিকট আসিলেন। দেখিলেন দ্বার রুদ্ধ। তিনি বাহির হইয়া যাইবার সময় দ্বার খোলা রাখিয়া গিয়াছিলেন। এই সকল দেখিয়া তিনি স্পষ্ট বুঝিলেন যে, তাঁহার গমনের পর নিশ্চয়ই কেহ এই বাড়ীতে আসিয়াছে। তিনি বালিকাকে যে অবস্থায় রাখিয়া গিয়াছিলেন, সে কখনই উঠিয়া আসিয়া দরজা বন্ধ করিতে পারে না।
একবার তাঁহার মনে হইল যে, এখন এখান হইতে তাহার চলিয়া যাওয়াই কৰ্ত্তব্য; কিন্তু তৎক্ষণাৎ সেই বালিকার মলিন মুখ তাঁহার মনে পড়িল। তিনি দ্বারে সজোরে আঘাত করিলেন। দেখিলেন, দ্বার খোলা আছে। তিনি সাহসে ভর করিয়া গৃহমধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন।
প্রথম প্রকোষ্ঠ অতিক্রম করিয়া তিনি দ্বিতীয় প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিলেন। সেখানে বাতী তেমনই জ্বলিতেছে, কিন্তু বালিকা নাই। তিনি যে চেয়ারে তাহাকে বসাইয়া রাখিয়া গিয়াছিলেন, সে চেয়ার শূন্য।
তিনি বিস্মিত হইয়া গৃহের চারিদিকে চাহিতে লাগিলেন; কিন্তু কোনদিকেই কেহ নাই; মনে বড় ভয় হইল, এ বাড়ীর বিষয়—এই বালিকার বিষয়—কিছুই বুঝিতে না পারিয়া তিনি আরও ভীত হইলেন।
সহসা তাঁহার ভূতের কথা মনে পড়িল। এ বাড়ীতে যে খুন হইয়াছে, তাহা ইন্দ্ৰানন্দ জানিতেন। শুনা যায় যে, খুনের বাড়ীতে প্রায়ই ভূত দেখা যায়। তবে কি তিনি এতক্ষণ এক প্রেত-বালিকার সহিত কথা কহিতেছিলেন। তাঁহার সর্ব্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল।
এই সময়ে তাঁহার দৃষ্টি একটা গবাক্ষের দিকে পড়িল। তিনি স্পষ্ট দেখিতে পাইলেন, সেই জানালার ছিদ্র দিয়া দুইটা উজ্জ্বল চক্ষু প্রদীপ্তনক্ষত্রের ন্যায় জ্বলিতেছে। সেই ভীষণ দৃষ্টি তাঁহাকেই নিরীক্ষণ করিতেছে। এইবার তাঁহার অবশিষ্ট সাহসটুকুও নষ্ট হইল; তাঁহার বক্ষের স্পন্দন এত দ্রুততর হইয়া উঠিল যে, সেই শব্দ যেন তিনি কানে শুনিতে লাগিলেন। তাঁহার বোধ হইল যেন তাঁহার পা দুইখানা ভূগর্ভে প্রোথিত হইয়া যাইতেছে। ইচ্ছা থাকিলেও তিনি এক পদ অগ্রসর হইতে পারিলেন না।
তিনি অনিচ্ছাসত্ত্বেও সশঙ্কভাবে আবার সেই জানালার দিকে চাহিলেন। সেই দুই উজ্জ্বল চক্ষু তখনও তাঁহার দিকে তেমনি ভীষণ ভাবে চাহিয়া আছে। তিনি তখন লম্ফ দিয়া পাগলের ন্যায় সে গৃহ পরিত্যাগ করিয়া বাহিরে আসিলেন।
নবম পরিচ্ছেদ – মীনা
ইন্দ্রানন্দ যেমন ঘরের বাহিরে আসিয়া পড়িয়াছেন—অমনিই কে পশ্চাৎ হইতে তাঁহার বস্ত্র ধরিয়া টানিল। তিনি চমকিত হইয়া ফিরিলেন। দেখিলেন, আবার সেই বালিকা—এখন তাহার মুখ যেন আরও বিবর্ণ। সে অতি মৃদুস্বরে বলিল, “তুমি—তুমি—এসেছ—ভাল করনি।”
প্রকৃত কথা বলিতে কি, এই অপরিচিত বালিকা ইহারই মধ্যে ইন্দ্রানন্দের হৃদয়ে অনেকখানি স্থান অধিকার করিয়া ফেলিয়াছিল। ইন্দ্রানন্দ ভয় পাইয়াছেন, পলাইতে পারিলে বাঁচেন, তথাপি বালিকাকে ছাড়িয়া যাইতে প্রাণ চাহিতেছিল না। বলিলেন, “ভাল করি নাই? একটু আগে তুমিই না আমাকে ফিরিয়া আসিতে জেদ করিয়াছিলে?”
ইন্দ্ৰানন্দ বিস্মিত হইয়া দেখিলেন যে, তিনি বালিকাকে যেরূপ দূর্ব্বল অসহায় অবস্থায় রাখিয়া গিয়াছিলেন, এখন আর তাহার সে অবস্থা নাই। তাহার সেই নিষ্প্রভ চক্ষুদুটির দৃষ্টি এখন প্রখর, সতেজ, দীপ্ত। বিকারগ্রস্ত রোগী নিতান্ত দূর্ব্বল হইলেও তাহার দেহে যেমন একটা অমানুষিক শক্তির সঞ্চার হয়, ইন্দ্রানন্দ দেখিলেন, এই বালিকারও ঠিক সেই ভাব হইয়াছে।
বালিকা অতি মৃদুস্বরে—প্রায় তাঁহার মুখ ইন্দ্রানন্দের কানের কাছে আনিয়া বলিল, “হাঁ, আগে বলেছিলাম—এখন—এখন—আমার দাদিয়া ফিরে এসেছেন। তুমি গেলেই তিনি এসেছেন— উপরে আছেন।”
“আমি একটা জানালার ফাটলে কাহার দুটি চোখ জ্বলিতে দেখিয়াছিলাম; বোধ হয়, সে তোমার দাদিয়ারই চোখ।”
বালিকা নিরুত্তর। ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “তোমার দাদিয়াকে আমার ভয় কি—আমি তাঁহাকে সকল কথাই বলিব।”
বালিকা সভয়ে বলিল, “না–না–না—তুমি তাঁকে জান না।”
ইন্দ্রানন্দ খাদ্যাদি বাহির করিয়া বলিলেন, “ভাল তাই হবে—এখন তোমার জন্য এ সব আনিয়াছি—তুমি খাও।”
বালিকা সেইরূপ শঙ্কিতভাবে বলিল, “না—না—না—দাদিয়া দেখলে রক্ষা রাখিবে না। তুমি যাও—এখনও সময় আছে।”
এই বালিকাকে ছাড়িয়া যাইতে ইন্দ্রানন্দের প্রাণ চাহিতেছিল না। তিনি বলিলেন, “তুমি না খাইলে আমি কিছুতেই যাইব না।”
বালিকা তাঁহার দিকে সকরুণনেত্রে চাহিল। কিয়ৎক্ষণ নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার পর কি ভাবিয়া সংক্ষেপে বলিল, “দাও।”
ইন্দ্ৰানন্দ যাহা যাহা আনিয়াছিলেন, একে একে সমস্ত বালিকাকে দিলেন। সে নীরবে সেগুলি খাইতে লাগিল। তখন ইন্দ্রানন্দ বুঝিলেন, যথার্থই বালিকা দুইদিন আহার করে নাই।
সে পার্শ্ববর্তী পাত্র হইতে এক গ্লাস জল ঢালিয়া সমস্ত পান করিল; এবং ইন্দ্রানন্দের দিকে চাহিয়া বলিল, “হয়েছে—আমি খেয়েছি। এখন দাদিয়া তোমায় দেখবার আগেই চলে যাও।”
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “তোমার দাদিয়াকে আমার ভয় কি? তুমি এরকম জায়গায় থাকিবার উপযুক্ত নও। আমি তোমার বিষয় সব না শুনিয়া এখান থেকে এক পা নড়িব না।”
বালিকা সচকিতে মুখ তুলিয়া তাঁহার দিকে চাহিল। এবং ধীরে ধীরে বলিল, “তুমি দাদিয়াকে চেন না—তোমার বিপদ্ হবে।”
ইন্দ্রানন্দ বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “কি আপদ! তোমার দাদিয়াকে আমি ভয় করিব কেন?” এবার বালিকা বড় হতাশ হইয়া পড়িল। ক্ষণপরে বলিল, “কি জানিতে চাও বল—এখনই বল। দাদিয়া এখনই নেমে আসবে।”
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “তোমার কথা আমি সব জানিতে চাই।”
বালিকা তাড়াতাড়ি বলিল, ‘ওগো, আমার কথা আমি কিছুই জানি না। এই দাদিয়া আমার নিজের দাদিয়া কি না তাও আমি জানি না। আমার মা বাপ কে ছিল, তাও আমি জানি না। একটি স্ত্রীলোক আমাকে মানুষ করে। তার কাছে দাদিয়া যাওয়ায় সে আমাকে এর সঙ্গে আসতে বলে, সেই পৰ্য্যন্ত আমি এখানে। আমার আর কেউ নাই।”
ইন্দ্রানন্দ বুঝিলেন, বালিকার কথা সত্য; কিন্তু বালিকা তাঁহাকে সত্বর বিদায় করিবার জন্য অতি সংক্ষেপে সারিয়া লইল। ইন্দ্রানন্দ তাহার কথায় সন্তুষ্ট হইতে পারিলেন না। তিনি কি জিজ্ঞাসা করিবেন, কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া বলিলেন, “তোমার নাম কি?”
বালিকা বলিল, “যিনি আমাকে মানুষ করেছিলেন, তিনি আমাকে মীনা বলে ডাকতেন।” ইন্দ্রানন্দ কি বলিতে যাইতেছিলেন, কিন্তু বালিকা সত্বর তাঁহার কাপড় ধরিয়া টানিল। অস্পষ্টস্বরে বলিল, “চুপ্।”
ইন্দ্রানন্দ দেখিলেন, তাহার মুখখানি ভয়ে কেমন এক রকম হইয়া গিয়াছে। তাহার সৰ্ব্বাঙ্গ কম্পিত হইতেছে। সে ভীতিবিস্ফারিত নেত্রে পশ্চাদ্দিকে চাহিয়া আছে। ইন্দ্ৰানন্দও চমকিত হইয়া সেইদিকে চাহিলেন। দেখিলেন, এক বৃদ্ধা অনতিদূরে দাঁড়াইয়া স্থিরনেত্রে তাহাদিগের দুইজনকেই দেখিতেছে, অন্ধকারে তাহার সেই চক্ষু জ্বলিতেছে। ইন্দ্রানন্দ বুঝিলেন, ইনি সেই দাদিয়া।
দশম পরিচ্ছেদ – বৃদ্ধা—ভয়ঙ্করী
ইন্দ্রানন্দের স্বতঃই মনে হইয়াছিল যে, তিনি তৎক্ষণাৎ তথা হইতে চলিয়া যাইবেন। এ বাড়ীর সকলই বিভীষিকাময়, হয় ত জীবন সঙ্কটাপন্ন হইতে পারে; কিন্তু তৎক্ষণাৎ মীনার ম্লান মুখখানি তাঁহার মনে পড়িল, তিনি তখন নিজের কাপুরুষতার জন্য বড় লজ্জিত হইলেন।
তিনি ভাবিলেন, “আমি কি নির্ব্বোধ! একটা বুড়ীকে দেখিয়া ভয়ে পালাইতেছিলাম? এই অসহায় বালিকাকে’ এই রাক্ষসীর হাতে ফেলিয়া যাইতেছিলাম? প্রাণ দিয়াও ইহাকে রক্ষা করিব।”
তিনি স্ফীতবক্ষে বৃদ্ধার সম্মুখে দাঁড়াইলেন। কিন্তু সে বৃদ্ধা তাঁহার দিকে দৃষ্টিপাত না করিয়া মীনাকে কহিল, “এ কে?”
মীনা ভয়ে ভয়ে বলিল, “দাদিয়া, এই বাড়ীতে একা আসতে আমার বড় ভয় করছিল, তাই এই ভদ্রলোকটি আমাকে সঙ্গে করে রেখে যেতে এসেছিলেন।”
বৃদ্ধা পেচকের ন্যায় তীব্রকণ্ঠে বলিল, “এখন তুই আর একা নস্।”
মীনার পা হইতে মাথা পৰ্য্যন্ত কাঁপিতেছিল। মীনার মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না। ইন্দ্ৰানন্দ বলিলেন, “আমি কেন এসেছি আপনাকে বলা উচিত।” বৃদ্ধা তাঁহার কথায় কর্ণপাত না করিয়া হাত নাড়িয়া মীনাকে গৃহ হইতে বাহির হইয়া যাইতে আজ্ঞা করিল। মীনা নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও ধীরপাদক্ষেপে ঘরের বাহির হইয়া গেল।
মীনা কি করে, কোথায় যায় দেখিবার জন্য ইন্দ্রানন্দ বাহিরের দিকে মুখ ফিরাইলেন, অমনই আলো নিবিয়া গেল। তিনি ঘোর অন্ধকারে নিমগ্ন হইলেন। ব্যাপার সুবিধাজনক নয় দেখিয়া, তিনি যেমন লাফাইয়া দ্বারের দিকে যাইবেন, ঠিক সেই সময় সবলে বজ্রমুষ্টিতে কে তাঁহার গলা টিপিয়া ধরিল। তিনি বুঝিলেন, কোন মহাবলবান্ লোক তাঁহাকে ধরিয়াছে। দৃঢ়মুষ্টি পেষণে তাঁহার শ্বাসরুদ্ধ হইয়া গেল। আচম্বিতে এরূপভাবে আক্রমণ করায় ইন্দ্রানন্দ আত্মরক্ষা করিতে সক্ষম হইলেন না।
সেই বৃদ্ধাই ইন্দ্রানন্দের গলদেশ চাপিয়া ধরিয়াছিল। এখন সে ইন্দ্রানন্দকে সবলে টানিয়া লইয়া একটা গৃহমধ্যে ছুড়িয়া ফেলিয়া দিয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিল। বৃদ্ধার শরীরে এ অসুরের শক্তি কোথা হইতে আসিল? ইন্দ্ৰানন্দ কিছুই ভাবিয়া ঠিক করিতে পারিলেন না।
ইন্দ্রানন্দ মুহূৰ্ত্ত মধ্যে উঠিয়া দাঁড়াইলেন। কিন্তু ঘোর অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। এরূপভাবে এই ভয়াবহ স্থানে এক মুহূর্ত্ত নিশ্চিন্ত থাকা উচিত নহে ভাবিয়া, তিনি পকেট হইতে দিয়াশলাইর বাক্স বাহির করিলেন। তাহাতে আর দুটিমাত্র কাঠি অবশিষ্ট ছিল। তিনি অতি সাবধানে একটি জ্বালিলেন। সেই আলোকে দেখিলেন, গৃহে ধূলিস্তূপ ব্যতীত আর কিছুই নাই। সে গৃহমধ্যে মৃতদেহ নাই দেখিয়া তিনি অনেকটা আশ্বস্ত হইতে পারিলেন।
তিনি দ্বার খুলিতে প্রয়াস পাইলেন; কিন্তু দেখিলেন, বাহির হইতে দ্বার সুদৃঢ়রূপে আবদ্ধ, গৃহের কোনদিকে গবাক্ষ নাই, তিনি প্রাণপণে চীৎকার করিলেও স্বর কোন রূপেই বাহিরে যাইবার উপায় নাই। আর যদিও বা যায়, কে শুনিবে? এত রাত্রে এদিকে জনপ্রাণী আসে না।
দিয়াশলাইটি যথাসময়ে নিবিয়া গেল। তিনি আর একটি কাঠি জ্বালিলেন। পদাঘাতে শব্দ করিয়া দেখিলেন, গৃহতল কাষ্ঠে প্রস্তুত, ঠিক এই সময়ে একবার নড়িয়া উঠিল। তৎপরে এক একখানা তক্তা সরিয়া যাইতে আরম্ভ করিল। ইন্দ্রানন্দ লাফাইয়া দ্বারের পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইলেন। নতুবা তিনি নিশ্চয়ই ঐ গৃহের নিম্নে পতিত হইতেন। গৃহনিম্নে কি আছে, তিনি দেখিতে পাইলেন না। এই সময়ে তাঁহার শেষ দিয়াশলাই কাঠিটিও নিবিয়া গেল। তিনি ভাবিলেন, “মীনা কি জানে যে, এরা আমাকে এ রকম ভাবে এই ঘরে আটক করিয়াছে? না না—সে জানে না—অসহায় বালিকা বদমাইসদের হাতে পড়িয়াছে। যেমন করিয়া পারি, প্রাণ দিয়া আমি তাহাকে রক্ষা করিব। না—না—সে কখনই এ রকম নয়। সে জানিতে পারিলেই আমাকে নিশ্চয় এখান থেকে বাহির করিয়া দিবে।”
সহসা দরজা খুলিবার শব্দ হওয়ায় ইন্দ্রানন্দ উদ্যত কর্ণে রহিলেন। তিনি অন্ধকারে বুঝিতে পারিলেন, কে ধীরে ধীরে দ্বার খুলিতেছে। তৎপরে কে অতি মৃদুস্বরে বলিল, “চুপ্।”
অন্ধকারে কে তাঁহার হাত ধরিল। ইন্দ্রানন্দ স্পর্শে বুঝিলেন, হাতখানি কোমল ও ক্ষুদ্র—এ হাত নিশ্চয়ই সেই মীনার। ইন্দ্রানন্দ মৃদুকণ্ঠে বলিলেন, “কে, মীনা?”
তাঁহার কানের নিকটে মুখ লইয়া ততোধিক মৃদুকণ্ঠে মীনা বলিল, “হাঁ, আমি মীনা—খুব আস্তে—চুপ—এখন কোন কথা নয় –এস।”
ইন্দ্রানন্দ নিশ্বাস বন্ধ করিয়া সঙ্গে চলিলেন।
মীনা তাঁহাকে অন্ধকারে ঘরের ভিতর দিয়া অতি সাবধানে পা টিপিয়া টিপিয়া লইয়া চলিল। অবশেষে সে একটি দ্বার খুলিয়া তাঁহাকে আস্তে আস্তে ঠেলিয়া বাহির করিয়া দিয়া দ্বার বন্ধ করিয়া দিল।
ইন্দ্রানন্দ দেখিলেন, তিনি বাহিরে আসিয়াছেন। সম্মুখেই দেওপাট্টা ঘাট। এরূপ ভয়াবহ ব্যাপারে তিনি আর কখনও পড়েন নাই।
একাদশ পরিচ্ছেদ – আবার মীনা
বাহিরে আসিলে শীতল বায়ু মস্তকে লাগায় ইন্দ্রানন্দ কতকটা প্রকৃতিস্থ হইতে পারিলেন। কিন্তু তখনও তাঁহার বুক কাঁপিতেছিল। তিনি সুবিস্তৃত হ্রদের তীরে উপবিষ্ট হইলেন। এখন অনেক কথাই তাঁহার মনে হইতে লাগিল। তিনি কি করিতে আসিয়াছিলেন, আর কি করিলেন। তবে তাঁহার এখানে আসা একেবারে নিষ্ফল হয় নাই। মীনা বীরবিক্রমকে চেনে, কিন্তু বীরবিক্রম মীনাকে চেনেন কি, তাহা তিনি জানিতে পারেন নাই। তাহার দাদিয়া যে বীরবিক্রমকে জানে, তাহাতে সন্দেহ নাই। বৃদ্ধা তাঁহার পিতার নিকট চাকরী করিত, বীরবিক্রমও নিশ্চয় তাহাকে জানেন। তিনি যে মধ্যে মধ্যে এইখানে আসেন, সে বিষয়েও বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই।
তিনি বীরবিক্রমের বাটীতে যে কাগজ দেখিয়াছিলেন, সম্ভবতঃ এই বৃদ্ধাই সে পত্র লিখিয়াছিল। সেই পত্র পাইয়া নিশ্চয়ই বীরবিক্রম এখানে আসিয়াছিলেন। দয়ামল তাঁহার পিতার বিষয় সমস্ত ফাঁকী দিয়া লইয়াছিল। তাহার প্রতি বীরবিক্রমের যে জাত-ক্রোধ হইবে, তাহাতে আর আশ্চর্য্য কি? তাহাকে সমুচিত দণ্ড দিবার জন্য কি বীরবিক্রম এই বৃদ্ধা ও তাহার সঙ্গী বদমাইসের দলের সঙ্গে মিশিয়াছিলেন? সম্ভব—সংসারে সকলই সম্ভব। তবে বীরবিক্রমের ন্যায় লোক যে এক ব্যক্তিকে ভুলাইয়া এইখানে এই নির্জ্জন স্থানে আনিয়া তাহাকে খুন করিবেন, তাহার পর তাহার দেহ জলে ভাসাইয়া দিবেন—কিছুতেই ইন্দ্রানন্দের প্রাণ এ কথা বিশ্বাস করিতে চাহিল না। তবে সে রাত্রে তাঁহার হাতে রক্ত আসিল কোথা হইতে? বীরবিক্রম কি এরূপ ভয়ানক লোক? তাঁহাকে যে সকলে অতি মহৎ লোক বলিয়া জানিত। যাহাই হউক, তাঁহাকে এ রহস্য উদ্ভেদ করিতেই হইবে। নিশ্চয়ই এই সকল ব্যাপারের মধ্যে গূঢ় রহস্য নিহিত আছে। এই বৃদ্ধাই বা কেন এত স্থান থাকিতে এই নিৰ্জ্জন পড়োবাড়ীতে বাস করে? খুন হইবার পর হইতে সে কোথায় চলিয়া গিয়াছিল, কেন এখানে ছিল না, আবার কেনই বা এখানে ফিরিয়া আসিল?
মীনা তাঁহাকে যাহা যাহা বলিয়াছিল, তাহা অবিশ্বাস করিতে প্রাণ চাহিল না। তিনি সেই বালিকার স্বচ্ছ মুখ-দর্পণে তাহার স্বচ্ছ হৃদয়ের প্রতিবিম্বপাত হইতে দেখিয়াছিলেন।
তিনি আরও ভাবিয়া দেখিলেন, মীনা নিশ্চয়ই এই বৃদ্ধার নাতিনী। ইহার উপর বৃদ্ধার জোর না থাকিলে যে তাহাকে মানুষ করিয়াছিল, সে কেন তাহাকে সহজে ছাড়িয়া দিবে। যে তাহাকে মানুষ করিয়াছিল, নিশ্চয়ই সে তাহার পূর্ব্ববৃত্তান্ত জানে। ইন্দ্রানন্দ বীরবিক্রমের সহিত দেখা করিয়া তাঁহার নিকট মীনা সম্বন্ধে সকল কথা জিজ্ঞাসা করা স্থির করিলেন।
কিন্তু সে কে তাহা জানেন না। তিনি মীনাকে একথা জিজ্ঞাসা করিবার জন্য ব্যগ্র হইলেন। প্রকৃত কথা বলিতে কি, তাহাকে এমন বিপদসঙ্কুল স্থানে ছাড়িয়া যাইতে কোন মতেই তাঁহার প্রাণ চাহিতেছিল না। তিনি ভাবিলেন, “মীনাকে দেখিলে স্পষ্টই বুঝিতে পারা যায় যে সে কোন সম্ভ্রান্ত গৃহস্থের কন্যা। যদিও তাহার পরিহিত বস্ত্রাদি মলিন, যদিও সে নিতান্ত দারিদ্র্য-কষ্টে আছে, কিন্তু ভাব-ভঙ্গিতে সহজেই প্রতীয়মান হয়, সে ভদ্রবংশজাতা। সে নিতান্ত অশিক্ষিতাও নহে। তাহার কাছে তিনি যতটুকু সময় ছিলেন, তাহাতেই তিনি বুঝিয়াছেন যে, সে ছোট লোকের মেয়ের ন্যায় মূর্খ নহে। যে কেহ তাহাকে লালনপালন করুক না কেন, সে মীনাকে ভদ্রবংশজাতা বলিয়া জানিত। সেজন্য তাহাকে লেখাপড়া শিখাইয়াছে। তবে মীনা এই ভয়াবহ স্থানে কেন? এটা যে একটা ভয়ানক নরঘাতী দস্যুদের আড্ডা! কেন সে নীরবে এত কষ্ট সহ্য করিয়া এই মনুষ্যবাসের সম্পূর্ণ অনোপযোগী স্থানে বাস করিতেছে? নিশ্চয়ই ইহার গুরুতর কারণ আছে। তিনি তাহার ভাব দেখিয়া স্পষ্ট বুঝিয়াছেন যে, সে ইচ্ছা করিয়া এখানে আসে নাই। নিতান্ত দায়ে পড়িয়া তাহাকে এখানে থাকিতে হইতেছে।
তিনি এই সকল জানিয়া-শুনিয়া কোন্ প্রাণে কেমন করিয়া তাহাকে এই স্থানে ফেলিয়া যাইবেন? সে যে নিতান্ত কাপুরুষের কাজ। তাহা হইলে তাঁহার মত ঘোর পাষণ্ড আর কে? তাঁহার কি, যেমন করিয়া হউক, এই অসহায় বালিকাকে এই দস্যুদিগের হস্ত হইতে রক্ষা করা কৰ্ত্তব্য নহে?
ইন্দ্রানন্দ হ্রদতীরে বসিয়া এই সকল ভাবিতেছিলেন। তিনি এইরূপ যত ভাবিতে লাগিলেন, ততই আর একবার—আর একটিবার মাত্র মীনাকে দেখিবার জন্য তাঁহার হৃদয় ব্যগ্র হইয়া উঠিতে লাগিল। তিনি ব্যগ্রভাবে উঠিলেন।
যে বাড়ীতে একটু পূর্ব্বে তিনি বন্দী হইয়াছিলেন, যেখানে তাঁহার জীবন ঘোর সঙ্কটাপন্ন হইয়াছিল, যেখানে তিনি স্পষ্ট বুঝিয়াছিলেন, বদমাইসেরা বাস করিতেছে, তিনি আবার সেই বাড়ীর দিকে চলিলেন।
মীনাকে তাঁহার অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিবার ছিল। সে সকল জিজ্ঞাসা না করিয়া তিনি কিছুতেই বাড়ীতে ফিরিবেন না, স্থির করিলেন।
প্রথমে তিনি যে দ্বার দিয়া মীনার সহিত এই বাড়ীর ভিতরে প্রবিষ্ট হইয়াছিলেন, এক্ষণে আবার তিনি সেই দ্বারের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন।
তিনি কিয়ৎক্ষণ দ্বারের সম্মুখে নীরবে দণ্ডায়মান রহিলেন। কি করিবেন, কিছুই ভাবিয়া পাইলেন না।
চারিদিক নীরব নিস্তব্ধ, ঘোর অন্ধকার, শীতও খুব। তিনি একবার চারিদিকে চাহিলেন। পাহাড়শ্রেণী অতিকায় দানবদলের ন্যায় অন্ধকারে শ্রেণীবদ্ধভাবে দাঁড়াইয়া আছে।
এরূপ অন্ধকারে, এরূপ স্থানে দাঁড়াইয়া থাকা কৰ্ত্তব্য নহে, ভাবিয়া তিনি ধীরে ধীরে দ্বারে আঘাত করিলেন। দ্বারের পার্শ্ব দিয়া তিনি গৃহমধ্যে আলোক দেখিতে পাইতেছিলেন। সুতরাং ভাবিলেন, নিশ্চয়ই কেহ না কেহ গৃহমধ্যে আছে।
দ্বারে আঘাত করিয়া তখন তাঁহার মনে হইল, যদি মীনা গৃহমধ্যে না থাকে, যদি দস্যুদের কেহ থাকে, কি যদি সেই বৃদ্ধাই থাকে, তাহা হইলে তিনি কি করিবেন? মীনা দরজা না খুলিয়া অন্য কেহ দরজা খুলিলে তিনি কি বলিবেন?
তিনি কি করিবেন-না-করিবেন ভাবিতেছেন, এইরূপ সময়ে ধীরে ধীরে দ্বার নিঃশব্দে খুলিয়া গেল। তাঁহার হৃদয় স্পন্দিত হইয়া উঠিল। তিনি সবিস্ময়ে দেখিলেন—সম্মুখে মীনা।
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – হ্রদতটে
তাঁহাকে দেখিয়া মীনাও নিতান্ত বিস্মিত হইল। সে ভ্রুকুটি করিল, হয় ত সে বিরক্ত হইল- একটি কথাও কহিল না। কাঠের পুতুলের ন্যায় অবনতমুখে দাঁড়াইয়া রহিল। তখন ইন্দ্ৰানন্দ তাহার অতি নিকটস্থ হইয়া অতি মৃদুস্বরে বলিলেন, “তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে।”
মীনা কোন কথা কহিল না। বোধ হয়, কহিতে পারিল না। ভয়ে সে নিতান্ত বিহ্বলভাবে ছিল। পরে অতি মৃদুস্বরে বলিল, “তুমি আবার কেন এখানে এলে—তুমি আবার কেন এখানে ফিরে এসেছ? দেখলে না—কি হয়েছিল?”
ইন্দ্রানন্দ তাহার হাত ধরিলেন। মীনা হাত সরাইয়া লইল না, নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল। ইন্দ্ৰানন্দ বলিলেন, “আমি তোমার সঙ্গে না দেখা করে যেতে পারি না—এদিকে এস, তোমার সঙ্গে কথা আছে।”
সহসা মীনা তাহার হাত টানিয়া লইয়া রাগিয়া বিরক্ত হইয়া বিষণ্ণভাবে বলিল, “না—না- না—তুমি শীঘ্র যাও—তুমি কি পাগল হয়েছ? জেনে শুনে—আবার এখানে এসেছ।”
এবার ইন্দ্রানন্দ বিরক্ত হইলেন। বলিলেন, “পাগলই বটে—আমি পাগল কি আর কিছু, এখনই দেখিতে পাইবে। আমি এখনই পুলিসে খবর দেব। তোমাকে সাবধান করে দিতে এসেছি।”
মুহূর্ত্তের জন্য যেন মীনার সর্ব্বাঙ্গ কম্পিত হইল। তৎপরে সে অতি ধীরে ধীরে, অতি গম্ভীরভাবে বলিল, “হাঁ, পুলিসে খবর দেবে—দিয়ো। তবে তোমার বন্ধু বীরবিক্রমকে আগে এ কথা বলো।”
এই কথা শুনিয়া ইন্দ্রানন্দ স্তম্ভিত হইলেন। তবে বীরবিক্রম যে তাঁহার বন্ধু, তাহাও এই বালিকা জানে; তবে বীরবিক্রম যে দয়ামলকে খুন করিয়াছেন, তাহাতে আর সন্দেহ নাই; এই বালিকা নিশ্চয়ই সেই ভয়াবহ ব্যাপার দেখিয়াছে। তিনি নিৰ্ব্বাক হইয়া স্তম্ভিতভাবে দাঁড়াইয়া রহিলেন। মীনা অগ্রসর হইল, তাঁহাকে পশ্চাতে আসিতে ইঙ্গিত করিল। ইন্দ্রানন্দ নীরবে তাহার অনুসরণ করিলেন।
ক্রমে মীনা কাষ্ঠস্তূপের নিকটে আসিয়া দাঁড়াইল। অন্ধকারে ইন্দ্রানন্দ তাহাকে ভাল দেখিতে পাইতেছিলেন না, কিন্তু তাহার স্বরে স্তম্ভিত হইলেন। এরূপ কাতরতাপূর্ণ করুণকণ্ঠ তিনি জীবনে আর কখনও শুনেন নাই। মীনা বলিল, “আপনি আমার কাছে একটি অঙ্গীকার করিবেন?” এই প্রথম সে তাঁহাকে আপনি বলিয়া সম্বোধন করিল। তাহার স্বরে ইন্দ্রানন্দের দ্রবাহ হৃদয় সিক্ত হইয়া গেল।
তিনি বলিলেন, “কি অঙ্গীকার বল?”
মীনা সেইরূপ কাতরস্বরে বলিল, “অঙ্গীকার করুন, আজ আপনি এখানে যাহা দেখিলেন, তাহা পুলিসে বা কাহাকেও বলিবেন না।”
ইন্দ্রানন্দ কি করিবেন, কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া বলিলেন, “কেমন করিয়া এ অঙ্গীকার করি? এখানে একজন খুন হইয়াছে, আমি জানিয়া-শুনিয়া এ কথা যদি প্রকাশ না করি, তবে আমার পক্ষে বড় অন্যায় কাজ হইবে।”
মীনা অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া কহিল, “খুন আমরা করি নাই, আপনার বন্ধু করিয়াছেন।”
এই কথায় ইন্দ্রানন্দের সর্ব্বাঙ্গ কম্পিত হইল; তাঁহার কণ্ঠ হইতে বাক্য নিঃসৃত হইল না।
তখন মীনা বলিল, “একটু আগে আপনাকে আমি রক্ষা করিয়াছি, অন্ততঃ সেইজন্যও কি আমার এই অনুরোধ রাখিবেন না?”
সে ইন্দ্রানন্দের হাত ধরিল। ইন্দ্রানন্দের শিরায় শিরায় অগ্নি ছুটিল। তিনি রুদ্ধপ্রায়কণ্ঠে বলিলেন, “তুমি যাহা বলিবে তাহাই করিব।”
মীনা তাহার দীর্ঘায়তচক্ষু বিস্ফারিত করিয়া তাঁহার দিকে চাহিল। ইন্দ্রানন্দের চক্ষু তাহার চক্ষুর সহিত মিলিত হইল। সেই দৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে যেন তাঁহার হৃদয়ের নিভৃত প্রদেশে কি এক অনির্বচনীয় সুধালহরী বহিল। তিনি ব্যাকুলভাবে সেই বালিকার বিষণ্ণতা-মাখা মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন।
মীনা বলিল, “আমার অনুরোধ—অঙ্গীকার করুন, আর আপনি কখনও এখানে আসিবেন না— অঙ্গীকার করুন, আপনি আজিকার সমস্ত কথা ভুলিয়া যাইবেন, অঙ্গীকার করুন—আপনি আমাকে ভুলিবেন।”
নিমিষমধ্যে মীনা তাঁহার হাত ছাড়াইয়া লইয়া অন্ধকারে অন্তর্হিতা হইল। ইন্দ্রানন্দ তাহাকে আর দেখিতে পাইলেন না। বিষণ্ণচিত্তে সেই নিৰ্জ্জন হ্রদতটে অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিলেন। তাহার পর হতাশভাবে গৃহাভিমুখে চলিলেন।
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – ইন্দ্রানন্দ—বিভ্রাটে
নিদারুণ উদ্বেগের সহিত যুদ্ধ করিতে করিতে ইন্দ্রানন্দ ধীরে ধীরে গৃহাভিমুখে চলিলেন। তিনি পাহাড়িয়া, নতুবা এই গভীর অন্ধকার রাত্রে এই নিদারুণ শীতে পাহাড়ের পথ অতিক্রম করিতে পারিতেন না। তাঁহার এরূপ কার্য্য খুব অভ্যস্ত। সুতরাং তিনি নইনিতালের কোন স্থানে না থাকিয়া গৃহাভিমুখে চলিলেন।
কিন্তু তিনি যত গৃহের নিকটবর্ত্তী হইতে লাগিলেন, ততই তাঁহার হৃদয় সবলে স্পন্দিত হইতে লাগিল। তিনি ভগিনী দরিয়াকে কি বলিবেন? পিতা জিজ্ঞাসা করিলে তাঁহাকেই বা কি বলিবেন? পিতাকে যাহা হয় বলিয়া বুঝাইতে পারিবেন, কিন্তু দুষ্ট ভগিনীটিকে বুঝান সহজ হইবে না। তিনি দরিয়ার স্বভাব বেশ জানিতেন, তাহার শিরায় শিরায় গুর্খা রক্ত প্রধাবিত— সে কিছুতেই বীরবিক্রমের দোষ দেখিতে পাইবে না। মান-সম্ভ্রম সকল ভুলিয়া সে তাঁহার নিকটে ছুটিবে — সে কিছুতেই কোন কথা কানে তুলিবে না।
ইন্দ্রানন্দের বয়সই বা কি এমন বেশী? তিনি সংসারের এখনও বিশেষ কিছুই দেখেন নাই। তিনি জীবনে কখনও এরূপ ব্যাপারে লিপ্ত হয়েন নাই; কাজেই তিনি কি করিবেন, কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না। তবে তিনি ইহা স্থির করিলেন যে, বাড়ীতে গিয়া তিনি ভগিনীর নিকট হইতে দূরে দূরে থাকিবেন। তিনি মনে মনে আপনা হইতেই একটু লজ্জা বোধ করিতেছিলেন। তিনি গিয়াছিলেন বীরবিক্রমের অনুসন্ধানে, কিন্তু মীনাকে দেখিয়া তিনি সে কথা প্রায় ভুলিয়া গিয়াছিলেন। এইরূপ নানা চিন্তায় উৎপীড়িত হইয়া তিনি বাড়ীর দ্বারে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তখন রাত্রির অবসান হইয়াছে।
তিনি মনে মনে স্থির করিয়াছিলেন যে, কাহারও সহিত দেখা না করিয়া আস্তে আস্তে নিজের ঘরে গিয়া শুইয়া পড়িবেন। বলিবেন, তাঁহার অসুখ হইয়াছে, অসুখের ভাণ করিয়া পড়িয়া রহিবেন, কাহারও সহিত কথা কহিবেন না।
তিনি চোরের ন্যায় পা টিপিয়া টিপিয়া অন্যের অলক্ষ্যে বাড়ীতে প্রবেশ করিতে যাইতেছিলেন, এই সময়ে কে পশ্চাৎ হইতে তাঁহার জামা চাপিয়া ধরিল। তিনি চমকিতভাবে পশ্চাদ্দিকে ফিরিলেন।
তিনি যে ভয় করিয়াছিলেন, সম্মুখে তাহাই–এ যে দরিয়া!
তাহার চক্ষু বিস্ফারিত, তাহার মুখ পাংশুবর্ণ, তাহার ভাব কেমন এক রকম—তাহাকে দেখিলেই স্পষ্ট বোধ হয়, সে সমস্ত রাত্রি জাগিয়া কাটাইয়া দিয়াছে। ইন্দ্রানন্দের হৃদয় সবেগে স্পন্দিত হইতে লাগিল। তাঁহার মনে হইল, সেখান হইতে ছুটিয়া পলায়ন করাই কৰ্ত্তব্য, কিন্তু তাঁহার পা উঠিল না।
দরিয়া তাঁহার মুখের দিকে ক্ষণকাল ব্যাকুলভাবে চাহিয়া থাকিয়া কেবল মাত্র বলিল, “দাদা!” ভগিনীর কষ্ট দেখিয়া বীরবিক্রমের উপর ইন্দ্রানন্দের অতিশয় ক্রোধ জন্মিল। এরূপ নরাধমকে এরূপ বালিকা কেন এত ভালবাসে? তাঁহার মনে হইল যে, বীরবিক্রম যদি এখন তাঁহার সম্মুখে থাকিত, তাহা হইলে তিনি তাঁহার উভয় কর্ণ প্রাণপণ বলে মৰ্দ্দন করিয়া হাতের সুখবিধান করিয়া লইতেন। তিনি কোন কথা কহেন না দেখিয়া দরিয়া বলিল, “আমার কাছে কিছু লুকাইয়ো না দাদা, কি হয়েছে বল।”
ইন্দ্ৰানন্দ সবেগে কহিলেন, “না—বলবার যো নাই।”
দরিয়া আবার ব্যাকুলভাবে তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিল। তৎপরে ধীরে ধীরে বলিল, “কেন কেন বলা যায় না। তবে কি বীরবিক্রম এখন অন্য কাকেও—”
ইন্দ্রানন্দ বিরক্তভাবে বলিলেন, “তা কি তুমি দেখিতে পাইতেছ না? সে এখানে আসে না— একেবারে আমাদের ভুলিয়া গেছে।”
দরিয়া অতি ধীরে ধীরে অতি গম্ভীরভাবে কহিল, “তা হতেও পারে—নাও পারে। যাই হোক তুমি সমস্ত রাত্রি বাড়ী এস নাই, তোমার ভাব দেখিয়া বোধ হইতেছে, তুমি কিছু জেনেছ। আমায় খুলিয়া সব বল। মনে কর না যে, দরিয়া ভারী বোকা।”
ইন্দ্রানন্দ হতাশ হইলেন—প্রাণ থাকিতে বীরবিক্রমের সম্বন্ধে সেইসব ভয়ানক ব্যাপারের ঘৃণ্য পাপকাহিনী কোনমতেই ভগিনীকে বলিবেন না, প্রতিজ্ঞা করিলেন; কিন্তু দরিয়া তাঁহাকে কিছুতেই ছাড়ে না।
ইন্দ্রানন্দ ক্রুদ্ধ, বিরক্ত, হতাশ হইয়া বলিলেন, “তবে শোন—আমি আবার বলিতেছি, তাহার মাথা একদম খারাপ হইয়া গিয়াছে—সে যত বদ লোকের সঙ্গে মিশিয়াছে; লোকে বলিতেছে, সে এমন কাজ করিয়াছে, যে ফাঁসীকাঠে ঝুলিতে পারে। শুনিলেনা আরও কিছু শুনিতে চাও?”
দরিয়া স্তম্ভিতভাবে অবাক হইয়া তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিল। ইন্দ্রানন্দ ভাবিলেন, তাঁহার ন্যায় পাষণ্ড এ ত্রিসংসারে আর কেহ নাই। ইন্দ্রানন্দের মনে বড় অনুতাপ হইতে লাগিল; রাগের বশে সহসা এতগুলা কথা দরিয়াকে বলিয়া ফেলা ভাল কাজ হয় নাই। ইন্দ্রানন্দেরই বা দোষ কি? তাঁহার নিজের মাথার ঠিক ছিল না—অনেক কারণে তাঁহার মস্তিষ্ক একেবারে বিকৃত হইয়া গিয়াছিল।
দরিয়া অর্দ্ধস্ফুটস্বরে বলিল, “তবে কি তিনি কাকেও খুন করেছেন?”
ইন্দ্ৰানন্দ কোন কথা কহিলেন না। দরিয়া দুই হাতে সবলে নিজের বুক চাপিয়া ধরিল। পড়িতেছিল, কিন্তু অতিকষ্টে আত্মসংযম করিল। কতকটা প্রকৃতিস্থ হইয়া বলিল, “দাদা, তুমি কি শুনেছ—কি জেনেছ—আমি সব জানতে চাই। আমাকে বলিতেই হইবে।”
ইন্দ্রানন্দ উর্দ্ধশ্বাসে তথা হইতে ছুটিয়া পলাইতে চাহিলেন; কিন্তু দরিয়া তাঁহার হাত টানিয়া ধরিল। নিমেষের জন্য দরিয়া আত্মসংযম হারাইয়াছিল। নিমেষ মধ্যে সে নিজেকে সামলাইয়া আগেকার সেই শান্ত গম্ভীরমূর্তি ধারণ করিল। বলিল, “দাদা—সব বল।”
ইন্দ্ৰানন্দ ক্ষিপ্তপ্রায় হইয়া বলিলেন, “বলিব আমার মাথা, আর তোমার মুণ্ড। আমরা আর কি করিতে পারি?”
দরিয়া স্থিরভাবে বলিল, “তুমি কি জেনেছ তাই বল।”
ইন্দ্রানন্দ ভাবিলেন, “এই বালিকা তাঁহাকে পাগল না করিয়া ছাড়িবে না।” তিনি হতাশভাবে বলিলেন, “আমি সব কথা তোমায় বলিতে পারিব না—সে শক্তি আমার এখন নাই।
“কি জেনেছ—তাই বল।”
“জেনেছি দয়ামলকে খুন করিয়া বীরবিক্রম তাহার লাস জলে ফেলিয়া দিয়াছে— দেখিতেছ, আমরা আর ইহার কি করিব? তাহার কথা আর মনে আনিয়ো না।”
“দাদা, তোমার ভুলও হতে পারে। বীরবিক্রম এরূপ কাজ কখনও করিবেন না। যা হোক, তিনি এখন বিপদে পড়িয়াছেন, এখন তাঁহার সাহায্য করা আমাদের কর্ত্তব্য; তিনি কি করিয়াছেন কি না করিয়াছেন, সে বিষয়ে আমি কিছু ভাবি না; তোমরা না কর, আমি তাঁহার সাহায্য করিব, আমি তাঁহার কাছে যাইব।”
চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ – প্রলাপে
ইন্দ্রানন্দ ভাবিলেন, দরিয়া নিশ্চয়ই বীরবিক্রমের নিকটে যাইবে। সে যা মনে করে, না করিয়া ছাড়ে না। তিনি বলিলেন, “সে নইনিতালে নাই—কোথায় গিয়াছে কেহ বলিতে পারে না। বাড়ীতে যে চাকরটা আছে, তাকে বলে গেছে আট দশ দিন আসিবে না, এখন আর তুমি গিয়ে কি করিবে, তাঁর সঙ্গে দেখা হইবে না।’
দরিয়া কিয়ৎক্ষণ নীরবে নতমুখে দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার পর কোন কথা না বলিয়া সহসা তথা হইতে চলিয়া গেল। ইন্দ্রানন্দ দরিয়ার দিকে চাহিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন।
সমস্ত রাত্রের জাগরণে পরিশ্রমে, উত্তেজনায় ইন্দ্রানন্দ নিতান্ত ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন। তাহার উপর সমস্ত রাত্রের হিম, কুজ্ঝটিকা, শীত তাঁহার মাথার উপর দিয়া গিয়াছে; তিনি আর দাঁড়াইতে পারিতেছিলেন না। সত্বর গিয়া নিজের বিছানায় শুইয়া পড়িলেন।
কাহারও সহিত দেখা করিতে, কাহারও সহিত কথা কহিতে তাঁহার বড় ভয় হইতেছিল। তিনি চেষ্টা করিয়াও নিদ্রা যাইতে পারিলেন না। গত রাত্রের সকল ঘটনা তাঁহার মনে আসিতে লাগিল। একটু তন্দ্রা আসিলেই হয় মীনা, না হয় দাদিয়াকে স্বপ্নে দেখিতে পান; অথবা দেখেন, সেই অন্ধকার ঘরে যেন কে তাঁহাকে খুন করিতেছে, অমনই চমকিত হইয়া উঠেন। ক্রমে তিনি অত্যন্ত অস্থির হইয়া উঠিলেন।
এই সময়ে কে বাহির হইতে ডাকিলেন, “আনন্দ!”
তিনি অন্যমনে ছিলেন, মনুষ্যের স্বরেও তিনি চমকিত হইয়া উঠিলেন। পদশব্দে বুঝিতে পারিলেন যে, তাঁহার পিতা আসিতেছেন। তিনি চুপ্ করিয়া পড়িয়া রহিলেন। তাঁহার পিতা সেই গৃহে তাঁহার শয্যার পার্শ্বে আসিয়া আবার ডাকিলেন, “আনন্দ!”
ইন্দ্রানন্দ আর এরূপভাবে পড়িয়া থাকিতে পারিলেন না। অতি মৃদুস্বরে বলিলেন, “বড় অসুখ হয়েছে?”
“কি হয়েছে?” বলিয়া গুণারাজ পুত্রের কপালে হাত দিয়া দেখিলেন। বলিলেন, “কে তোমাকে ঠান্ডায় হিমে রাত্রে এখানে ফিরিতে বলিয়াছিল? নইনিতালে থাকিতে পার নাই, এত লোক রহিয়াছে।”
ইন্দ্রানন্দ কথা কহিলেন না।
গুণারাজ জিজ্ঞাসা করিলেন, “যে খবর লইতে বলিয়াছিলাম, তাহার কি হইল?”
ইন্দ্রানন্দ কাতরস্বরে বলিলেন, “সে মরে গেছে।”
“তবে সে-ই খুন হয়েছে?”
“হাঁ।”
“বীরবিক্রমের সঙ্গে দেখা হয়েছিল?”
“না, সে আট-দশ দিনের জন্য কোথায় গেছে।”
“ঘুমাও, ঘুমালে শরীর ভাল হইবে,” বলিয়া গুণারাজ চলিয়া গেলেন।
ইন্দ্রানন্দ ভাবিলেন, “তবে কি বাবাও সন্দেহ করিয়াছেন? তাহা না হইলে তাঁর এ সব খবর লইবার দরকার কি? দয়ামল খুন হইল কি না হইল, তাহাতে তাঁহার কি? তাহার পরেই আবার বীরবিক্রমের খবর নেওয়া কেন? নিশ্চয়ই বাবা সন্দেহ করিয়াছেন যে, বীরবিক্রমই দয়ামলকে খুন করিয়াছে। পাপকথা ঢাকা থাকিবে না।
ইন্দ্রানন্দ একান্ত অস্থিরভাবে বিকারগ্রস্ত রোগীর ন্যায় বিছানায় পড়িয়া ছট্ফট্ করিতে লাগিলেন। সহসা তিনি বলিয়া উঠিলেন, “আমি আর ভাবিতে পারি না—আমি পাগল হইতে বসিয়াছি।”
তিনি অসুখের ভাণ করিয়া পড়িয়া থাকিবেন, তাহা হইলে কাহারও সহিত দেখা করিতে হইবে না মনে করিয়াছিলেন; কিন্তু সত্য সত্যই তাঁহার জ্বর আসিল। ক্রমে জ্বর ভয়ানক হইয়া উঠিল গত রাত্রের সেই শীতের প্রকোপ কোথায় যাইবে? ক্রমে ঘোরতর জ্বরে তিনি সংজ্ঞাহীন হইয়া পড়িলেন।
বাড়ীর সকলেই তাঁহার জন্য বড় চিন্তিত হইয়া উঠিলেন। জ্বরের প্রকোপে তিনি নানাবিধ প্রলাপ বকিতে আরম্ভ করিলেন। কখনও বলেন, “আমি স্বচক্ষে দেখিয়াছি।” আবার কখনও বলেন, “আমরা এ কাজ করি নাই—তোমার বন্ধু করেছে।” প্রায়ই তিনি বলিতেছিলেন, “মীনা, এ স্থান তোমার উপযুক্ত নয়”
“মীনা, প্রাণ দিয়া আমি তোমাকে রক্ষা করিব,”
“মীনা, আমি তোমায় ভুলিব, এ অঙ্গীকার আমি কিছুতেই করিতে পারি না।”
দরিয়া ভ্রাতার পার্শ্বে বসিয়া শুশ্রূষায় নিযুক্তা ছিল। পিতা গুণারাজও একমাত্র পুত্রের পীড়ায় ব্যাকুলচিত্তে তাঁহার শয্যার পার্শ্বে দাঁড়াইয়াছিলেন।
তিনি দরিয়ার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মীনা কে?”
দরিয়া বলিল, “জানি না, বাবা।”
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ – ভয়ঙ্করী মূৰ্ত্তি
সপ্তাহ মধ্যেই ইন্দ্রানন্দের জ্বর ত্যাগ হইল। কিন্তু তিনি নিতান্ত দুর্ব্বল হইয়া পড়িয়াছিলেন। উঠিয়া বাড়ীর বাহিরে যাইবার শক্তিও তাঁহার ছিল না। তিনি সেইদিন হইতে সাহস করিয়া ভগিনীর দিকে চাহিতে পারিতেন না; তাঁহার সর্ব্বদাই ভয় হইতেছিল, কখন কি সে তাঁহাকে বলিয়া ফেলে। কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয়, সে বীরবিক্রমের কথা আর কিছুই উত্থাপন করিল না।
তিনি আরও একটু সুস্থ হইলে, একদিন বৈকালে উদ্যানে বেড়াইতেছিলেন। তিনি এ পর্যন্ত তাঁহার সেই সকল চিন্তা মন হইতে কোন মতেই দূর করিতে পারেন নাই। বীরবিক্রমের কথা, খুনের কথা, পড়ো বাড়ীর কথা সর্ব্বদাই তাঁহার মনে উদিত হইতেছিল। মীনার সেই বিষাদমাখা মুখ কিছুতেই তিনি ভুলিতে পারেন নাই।
তিনি চিন্তিতমনে বাগানে পদচারণা করিতেছিলেন, এমন সময়ে একজন মালী আসিয়া তাঁহাকে বলিল, “বাবুজী, এক বুড়ী মাগী এসে বড় জ্বালাতন করিতেছিল, সে আপনার কথা—বীরবিক্রম সাহেবের কথা—দিদিমণির কথা জিজ্ঞাসা করিতেছিল।”
মালীর কথায় ইন্দ্রানন্দের মনে সহসা মীনার দাদিয়ার কথা উদিত হইল। তিনি বলিলেন, “সে কোনদিকে গেল?”
“এই বাগানেই কোথা লুকিয়ে আছে, বোধ হয়, বুড়ীটা পাগল।”
“দেখতে পেলে তাড়িয়ে দিয়ো,” বলিয়া ইন্দ্ৰানন্দ গৃহাভিমুখে ফিরিলেন। তিনি বৃদ্ধার সহিত দেখা করিতে নিতান্তই অনিচ্ছুক—তাহার সহিত দেখা করিতে তাঁহার বড় ভয় হইতেছিল। তিনি ভাবিলেন, “সে এখানে আমাদের বাড়ী কি করিতে আসিবে? বোধ হয়, আর কেহ হইবে।”
এই সময়ে পার্শ্ববর্ত্তী একটা ঝোপের মধ্যে কি একটা শব্দ হইল। চমকিতভাবে, ইন্দ্ৰানন্দ সেইদিকে ফিরিলেন, সম্মুখে দাঁড়াইয়া–দাদিয়া।
ইহাকে দেখিয়া অবধি ইন্দ্রানন্দের ইহার প্রতি কেবল একটা ভাব হইয়াছিল, দেখিলেই হৃদয়ে মহা আশঙ্কার উদ্রেক হইত। এক্ষণে ইহাকে তাঁহাদের নিজের বাগানে দেখিয়া তাঁহার হৃদয় দ্রুতবেগে স্পন্দিত হইয়া উঠিল। তিনি বৃদ্ধার মুখ দেখিয়া ইহাও বুঝিলেন যে, বৃদ্ধা তাঁহাকে দেখিয়া অতিশয় আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়াছে। যেন সে তাঁহাকে এরূপভাবে জীবিতাবস্থায় উদ্যানমধ্যে পরিক্রমণ করিতে দেখিবার প্রত্যাশা করে নাই। সে নিশ্চয়ই ভাবিয়াছিল যে, তিনি সেই পড়ো- বাড়ীর ভয়াবহ অন্ধকারময় ঘরের গর্ভে পড়িয়া অনেক দিন মরিয়াছেন। এখন তাঁহাকে জীবিত দেখিয়া সে নিতান্তই আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়াছে।
ইন্দ্রানন্দ বৃদ্ধাকে রাত্রে দেখিয়াছিলেন; তাহার মুখ তখন ভাল দেখিতে পান নাই। এক্ষণে দিনের আলোতে তাহার মুখ দেখিয়া তিনি শিহরিয়া উঠিলেন; এরূপ কদাকার, এরূপ ভয়ানক মুখ তিনি আর কখনও দেখেন নাই। স্বতঃই তাঁহার মনে হইল, মীনা কেমন করিয়া এই রাক্ষসী- ডাকিনীর কাছে থাকে। ইন্দ্রানন্দ তখন কি বলিবেন, কি করিবেন তাহাই ভাবিতে লাগিলেন।
বৃদ্ধাও নীরবে এতক্ষণ একদৃষ্টে তাঁহার দিকে চাহিয়াছিল। এখন সে মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার সে বন্ধু কোথায় গো, বাপু?”
ইন্দ্ৰানন্দ আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া বলিলেন, “কে বন্ধু!”
বৃদ্ধা পৈশাচিক হাসি হাসিয়া বলিল, “ওঃ! তুমি জান না—বটে! যার জন্য দেওপাট্টা ঘাটে গিয়েছিলে গো।”
ইন্দ্ৰানন্দ স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। বৃদ্ধা সেইরূপভাবে বলিল, “সে বন্ধু পাঠায় নি, তা আমি জানি—তার দরকার হলে সে সেখানে নিজে যায়।”
ইন্দ্রানন্দ বীরবিক্রমের জন্য বিশেষ দুঃখিত হইলেন। যাহার পশ্চাতে এমন একটা পিশাচী লাগিয়াছে, তাহার মত দুর্ভাগা এ সংসারে আর কে? তিনি কি করিবেন-না-করিবেন মুহূর্ত্ত মধ্যে স্থির করিয়া বিরক্তভাবে বলিলেন, “বীরবিক্রম এখানে নাই। তিনি বিদেশে কাজে গিয়াছেন। তুমি এখনই এখান হইতে দূর হও। আর তুমি কখনও যদি এখানে এস, তাহলে তোমাকে আমি পুলিসে ধরাইয়া দিব।”
বৃদ্ধা বিকট হাস্য করিল। বলিল, “পুলিস! বটে, পুলিস দিয়ে ধরিয়ে দেবে? এই কথাটা তোমার সেই বন্ধুকে আগে বলো, দেখো সে কি পরামর্শ দেয়?” আবার সেইরূপ বিকট হাসি হাসিল।
তাহার হাসিতে ইন্দ্রানন্দ রুষ্ট হইলেন। বলিলেন, “যদি সহজে তুমি না যাও, আমি লোক দিয়া গলা টিপিয়া বার করে দিব।”
বৃদ্ধা আবার সেইরূপ বিকট হাস্য করিল। ইন্দ্রানন্দ চীৎকার করিয়া মালিদিগকে ডাকিলেন। নিমেষ মধ্যে বৃদ্ধা ঝোপের মধ্যে লুকাইল।
তখন মালীরা আসিয়া ইন্দ্রানন্দের আদেশ পাইয়া সমস্ত বাগান তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিল; কিন্তু কেহ কোথায়ও সেই বৃদ্ধাকে আর দেখিতে পাইল না।
ইন্দ্রানন্দ চিন্তিত হইলেন, এবং তাঁহার মনে মনে বড় ভয়ও হইল। নিজের জন্য নহে— ভগিনীর জন্য তিনি ভীত হইলেন।
ষোড়শ পরিচ্ছেদ – এ মীনা কে?
পর দিবস নিজ প্রকোষ্ঠে বসিয়া ইন্দ্রানন্দ সেই পড়ো বাড়ীর কথাই ভাবিতেছিলেন; এমন সময় দরিয়া ধীরে ধীরে আসিয়া তাঁহার পার্শ্বে বসিল। দরিয়াকে দেখিলেই ইন্দ্রানন্দের হৃদয় কাঁপিয়া উঠিত।
ইন্দ্ৰানন্দ কোন কথা কহিলেন না। বহুক্ষণ দরিয়াও কোন কথা কহিল না। কিয়ৎক্ষণ পরে অতি ধীরে ধীরে সে উঠিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “দাদা, মীনা কে?”
সহসা সম্মুখে দংশনোদ্যত সর্প দেখিলে লোকে যেরূপভাবে চমকিত হয়, ইন্দ্রানন্দেরও তাহাই হইল। তিনি চমকিত হইয়া ভগিনীর মুখের দিকে চাহিলেন। কোন কথা কহিলেন না।
দরিয়া আবার ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করিল, “দাদা, মীনাটি কে?”
ইন্দ্রানন্দ কি বলিবেন, স্থির করিতে না পারিয়া বলিলেন, “মীনা—মীনা—মীনা আবার কে কই তা ত আমি কিছুই জানি না।”
দরিয়া বলিল, “আমার নিকট লুকাইয়ো না দাদা; মীনা কে, আমাকে বলিতেই হইবে।’
মস্তক কণ্ডুয়ন করিতে করিতে ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “মীনা—হাঁ—তা—তার কথা কে তোমায় বলিল?”
“তুমি।”
“আমি? না।”
“হাঁ, জ্বরে পড়িয়া কেবলই তুমি মীনার নাম সব সময় করিয়াছ,—এ মীনা কে, দাদা?”
ইন্দ্রানন্দ বুঝিলেন, জ্বরের প্রকোপে, তিনি মীনার নাম করিয়াছিলেন। হয় ত আরও কত কি বলিয়াছেন; তিনি নিতান্তই ভীত হইলেন। বলিলেন, “আর কি বলেছি? বাবা কি শুনেছেন? “
“না, আর বেশী কিছু বল নাই। এখন এই মীনা কে, আমায় বল—বলিতেই হইবে, দাদা।”
“শুনে তোমার লাভ কি?”
“লাভ আছে—এই মীনা জানে, বীরবিক্রম খুন করেছেন কি না?”
“তা তুমি কেমন করে জানিলে?”
“যেমন করেই জানি না।”
“না বলিলে, আমি কিছুই বলিব না।“
“তুমি জ্বরের সময় খুনের কথা বলিয়াছ, পড়ো বাড়ীর কথা বলিয়াছ, এই পড়ো বাড়ীতে নিশ্চয়ই এ মীনা থাকে—সে সব জানে। আমি তার সঙ্গে দেখা করিব, করিতেই হইবে।”
ইন্দ্ৰানন্দ ভীত হইয়া বলিলেন, “হাঁ, এই পড়ো বাড়ীতে একটি ছোট মেয়ে থাকে, তার নাম মীনা।”
“তোমার সঙ্গে তার দেখা হইয়াছে; সে কি বলিয়াছে, আমায় বল।”
“সে বলিয়াছে—হাঁ, সে তখন সেইখানে ছিল।”
“সে কি বলিয়াছে আমায় বল।”
ইন্দ্রানন্দ ভগিনীর অত্যধিক আগ্রহ দেখিয়া নিতান্ত ভীত হইলেন। কোন কথা গোপন করিবার ক্ষমতা তাঁহার এখনও হয় নাই। তিনি বলিলেন, “তুমি যদি অধীর না হও ত সব বলি।’
দরিয়া ম্লান হাসি হাসিয়া বলিল, “তুমি কি আমায় জান না—বল।”
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “সে এই ভয়ানক কাণ্ড স্বচক্ষে দেখেছে।”
তিনি ভাবিয়াছিলেন, দরিয়া এই কথা শুনিয়া নিতান্ত বিচলিত হইবে। কিন্তু দরিয়া কিছুমাত্র চাঞ্চল্য প্রকাশ করিল না। স্থিরভাবে বলিল, “সে স্বচক্ষে দেখেছে, বীরবিক্রম দয়ামলকে খুন করেছে।”
ইন্দ্রানন্দ মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে বলিলেন, “হাঁ, সে তাই বলে।”
“তার বয়স কত?”
“পনের বৎসর হবে।
“দেখিতে কেমন?”
ইন্দ্রানন্দের মুখ আরক্ত হইয়া উঠিল।
দরিয়া তাহা দেখিল। বলিল, “দাদা, তুমি তাকে ভালবাসিয়াছ?”
এ কথা ইন্দ্রানন্দ নিজ হৃদয়ে উদয় হওয়া সত্বেও হৃদয়কে তাহা ব্যক্ত করিতে দেন নাই। তিনি ভগিনীর কথা শুনিয়া চমকিতভাবে তাহার মুখের দিকে চাহিলেন
দরিয়া অতিশয় গম্ভীরভাবে বলিল, “তুমি কেমন করে জানিলে বীরবিক্রম এই মীনাকে ভালবাসে না?”
ইন্দ্ৰানন্দ ব্যগ্র হইয়া বলিলেন, “তা আমি জানি।”
“কেমন করে জানিলে?”
“বীরবিক্রম তাহাকে কখন দেখে নাই।”
“তবে বীরবিক্রমকে সে খুন করিতে কিরূপে দেখিল?”
“সে আর একটা পাশের ঘরে ছিল।”
“কিন্তু বীরবিক্রম কিজন্য এই পড়োবাড়ীতে যাবেন? এই মীনাই সর্ব্বনাশের মূল।”
“না।”
“না কেন? হাঁ।”
ইন্দ্রানন্দ ভগিনীর ভাব দেখিয়া ভীত হইয়া কোন কথা কহিলেন না। দরিয়াও কোন কথা না কহিয়া বহুক্ষণ নীরবে বসিয়া রহিল।
সহসা দরিয়া বলিল, “দাদা, আমাকে ঠকাইতে চেষ্টা করিয়ো না। সেদিন রাত্রে কি কি হয়েছিল, আমায় সব বল—বলিতেই হইবে।”
ইন্দ্রানন্দ ভগিনীর নিকটে আর গোপন করা দুষ্কর দেখিয়া, সে রাত্রে যাহা যাহা হইয়াছিল, কিছুই বাদ না দিয়া সমস্তই ভগিনীকে বলিলেন। দরিয়া নীরবে বসিয়া শুনিল। একটি কথাও কহিল না।
সমস্ত শুনিয়া দরিয়া মৃদুহাস্যে বলিল, “এই তোমার মীনা?”
ইন্দ্ৰানন্দ বলিয়া উঠিলেন, “আমার মীনা কি রকম?”
দরিয়া বলিল, “হাঁ, তোমার মীনা এই একটা রকম—শোন। তোমার মীনার ভুল হইয়াছে। সে স্বচক্ষে বীরবিক্রমকে খুন করিতে দেখে নাই, সে কেবল অনুমানের উপর নির্ভর করিয়া বলিয়াছে—যে, বীরবিক্রম দয়ামলকে খুন করিয়াছেন। আমি এই মীনার সঙ্গে একবার দেখা করিব।”
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “দেখ দরি, তুমি যদি এই রকম পাগলামী কর, তাহা হইলে বীরবিক্রমের উপকার না হইয়া অপকার হইবে।”
“কেন?”
কেন? তুমি বালিকা মাত্র, তুমি এই সকল ব্যাপারের মধ্যে গেলে ভাল না হয়ে মন্দই হবে; লাভের মধ্যে পুলিসে বীরবিক্রমকে সন্দেহ করিবে, এখনও তাহাকে সন্দেহ করে নাই, তোমার জন্য করিবে।”
“কেন?”
“আবার কেন? এই খুনের ভিতরে যে বীরবিক্রম নিশ্চয় জড়িত আছেন, তাহারা তখন সহজেই ইহা ভাবিবে। কে না জানে, তোমার সঙ্গে বীরবিক্রমের বিবাহের সকল কথা স্থির হইয়াছে।”
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ – দরিয়া বড় শক্ত মেয়ে
দরিয়া কোন উত্তর না দিয়া কিয়ৎক্ষণ নীরবে রহিল। তৎপরে বলিল, “সব বুঝি, কিন্তু আমার যা ধারণা, শোন।”
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “বল।”
“এই পড়ো বাড়ীতে একদল বদমাইস আড্ডা লইয়াছে, যে কারণেই হোক বীরবিক্রম এই বাড়ীতে গিয়াছিলেন। যে রাত্রে দয়ামল খুন হয়, তিনি সে রাত্রে এই বাড়ীতে ছিলেন। খুব সম্ভব, যেমন করিয়া ভুলাইয়া বীরবিক্রমকে বদমাইসেরা এই বাড়ীতে লইয়া যায়, দয়ামলকেও সেইরূপে লইয়া গিয়াছিল। আমার মনে হয়, তোমার সেই গুণমন্ত মীনাটি এই কাজে খুব পাকা।।
“কি কাজে সে—”
“থাম দাদা—শোনু। যদি তাহাই না হইবে এই মীনাটি এই পড়ো বাড়ীতে বদমাইসদের দলে থাকিবে কেন? তাহার কাজই এই—সে লোক ভুলাইয়া বাড়ীর ভিতরে নিয়ে যায়; তার পর বদমাইসেরা তার যথাসৰ্ব্বস্ব কেড়ে নেয়, কিম্বা তাদের দিয়ে খত লিখিয়ে নেয়।”
ভগিনীর কথা ইন্দ্রানন্দের প্রাণে অনেকটা ঠিক বলিয়া বোধ হইতেছিল তথাপি তিনি বলিলেন, “তোমায় সত্য কথা বলিতে কি—আমারও প্রথমে এই কথাই মনে হয়েছিল; পরে বুঝিতে পারি, মীনা সে রকমের নয়।”
“যার মুখ প্রাণে এঁকে যায়, তার বিষয় ঐ রকম হয়। সে ঠিক তোমায় ভুলিয়ে নিয়ে গিয়াছিল—তারা তোমায় ঘরের ভিতরও ঠিক আটকাইয়াছিল, হয় ত তোমারও দয়ামলের অবস্থা হইত–”
ইন্দ্রানন্দের সেই অন্ধকার ঘরের কথা মনে পড়িল। তিনি শিহরিলেন।
দরিয়া বলিল, “তার পর তোমার সৌভাগ্য যে, যেমন তার মুখ তোমার ভাল লেগেছে, তারও তেমনই তোমার মুখ ভাল লেগেছিল, তাই তোমাকে উদ্ধার করিয়া বাড়ীর বাহির করিয়া দিয়াছে।”
ভগিনীর কথা ইন্দ্রানন্দের প্রাণে ঠিক বলিয়া বোধ হইতেছিল। তবে কি তিনি মীনাকে যেরূপ ভাবিতেছেন, সে কি তেমনই তাহাকে ভাবিতেছে। তিনি সকল কথা ভুলিয়া গিয়া বলিলেন, “সে বলেছিল, ‘আমায় ভুলে যাও—’ আমি তাহার কাছে এক রকম অঙ্গীকার করেছিলাম যে, সে রাত্রের কথা কাহাকেও বলিব না।”
দরিয়া ম্লান হাস্যের সহিত বলিল, “দাদা, তোমার এখনও আমাদের মন বুঝিবার বিলম্ব আছে—যাক সে কথা, এখন আমাদের একটা কাজ করিতে হইবে।”
“কি বল?”
“বীরবিক্রম যে খুন করেন নাই, তা স্থির। সম্ভবতঃ এই তোমার মীনা সব কথা জানে, তোমাকে বলে নাই।”
“না—না—সে মিথ্যাকথা বলে নাই।”
“তবে তার ভুল হইয়াছে।”
“তা হতে পারে।”
“তা হলে সে চেষ্টা করিলে, যথার্থ কে দয়ামলকে খুন করিয়াছে, তা জানিয়া আমাদের বলিতে পারে।”
“তা কি সে করিবে? “
“করিবে, তুমি মেয়ে মানুষের মন জান না। সে কেবল তোমার জন্যই এ কাজ করিবে। না হলে সে রাত্রে তোমায় রক্ষা করিত না।”
“তার কি আর দেখা পাব?”
“না পাবে কেন? চেষ্টা করিতে হইবে। আমরা গোয়েন্দা হইয়া বীরবিক্রমকে নিদোষ সপ্রমাণ করিব। যে দয়ামলকে খুন করিয়াছে, তাহাকে ধরাইয়া দিব। পারিবে না?”
“তুমি ইহার কি করিবে?”
“তা পরে দেখিতে পাইবে।”
“যদি তুমি এ রকম পাগলামী কর, তবে আমি কিছুই করিব না।”
“যদি তুমি প্রতিশ্রুত হও, দয়ামলকে যে খুন করিয়াছে, তাহাকে খুঁজিয়া বার করিবে, তাহা হইলে আমি চুপ করিয়া থাকি।”
“তাই স্বীকার—এ গোয়েন্দাগিরী করিব।”
“সাতদিন দেখিব।”
“আমি তোমার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিব—এই পর্য্যন্ত বলিতে পারি। আমি যে তোমায় বড় ভালবাসি, তা কি জান না? তা ছাড়া বীরবিক্রম আমার পরম বন্ধু।”
“তুমি আমার এই কাজ কর, আমিও তোমার এক কাজ করিব।”
“কি কাজ, দরি?”
“মীনা।”
এই বলিয়া দরিয়া তথা হইতে ঝড়ের বেগে ছুটিয়া চলিয়া গেল। ইন্দ্রানন্দ বহুক্ষণ তথায় নীরবে একা বসিয়া রহিলেন। তাহার পর কি ভাবিয়া নইনিতালে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইতে চলিলেন। তিনি এই ব্যাপারের এবার একটা কিছু মীমাংসা না করিয়া “গৃহে ফিরিবেন না, স্থির করিলেন।
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ – আশ্চর্য্যের বিষয়
ইন্দ্রানন্দ পিতার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া বলিলেন, “আমি দিন কতক নইনিতালে থাকিব, মনে করিয়াছি।”
গুণারাজ তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “কেন?”
“দরিয়া বীরবিক্রমের জন্য বড় ব্যস্ত হইয়াছে।”
“আমরা সকলেই হইয়াছি। সে কোথায় গিয়াছে, সন্ধান পাইলে?”
“না—তাহারই সন্ধানে যাইব।”
“তোমার গিয়া বিশেষ কি ফল হইবে?”
“আমি না গেলে দরিয়া যাইবে—আপনি ত তাকে জানেন।
গুণারাজ কন্যাকে ভাল রকম জানিতেন, তাহাকে প্রাণের সহিত ভালবাসিতেন। তাঁহার স্ত্রী জীবিত নাই, সুতরাং দরিয়াই তাঁহার চক্ষের মণি ছিল। তিনি বলিলেন, “যাও— কোথায় থাকিবে?”
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “বীরবিক্রমের বাড়ীতেই থাকিব।”
গুণারাজ কোন কথা কহিলেন না। ইন্দ্রানন্দ চলিয়া গেলেন।
ইন্দ্রানন্দ সেই দিবস অপরাহ্ণে বীরবিক্রমের বাড়ী আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ভৃত্যকে বীরবিক্রমের কথা জিজ্ঞাসা করিলেন, কিন্তু সে তাঁহার কোনই সন্ধান দিতে পারিল না। বীরবিক্রম এপর্য্যন্ত কোন সংবাদ দেন নাই—তিনি কোথায় গিয়াছেন, কোথায় আছেন, তাহা কেহই বলিতে পারে না।
ইন্দ্রানন্দের একটি বাক্স কুলির মাথায় ছিল, তিনি ভৃত্যকে বলিলেন, “আমার বাক্স ভিতরে লও—আমি দিনকতক এখানে থাকিব।”
ভৃত্য ইন্দ্রানন্দের মুখের দিকে চাহিল, তৎপরে কুলির নিকট হইতে বাক্স লইয়া বাড়ীর ভিতর রাখিল। কুলিকে বিদায় দিয়া ইন্দ্ৰানন্দ ভাবিলেন, “গোয়েন্দাগিরি এখান থেকেই আরম্ভ করা যাক—প্রথমে এই চাকরটাকে জেরা করে দেখি, এ কিছু জানে কি না।”
ইন্দ্রানন্দ ভৃত্যকে ডাকিলেন—বীরবিক্রম সম্বন্ধে তাহাকে নানা কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। কিন্তু সে কোন সংবাদই দিতে পারিল না। এদিকে কয় মাস হইতে বীরবিক্রম অনেক রাত্রে বাড়ীতে ফিরিতেন—কোন কোন দিন একেবারেই আসিতেন না; এ ছাড়া সে আর কিছুই সংবাদ দিতে পারিল না। তিনি কোথায় যান, তাহাও সে বলিতে পারিল না।
এখন গোয়েন্দা-পদাভিষিক্ত ইন্দ্রানন্দ যাহা অন্য সময়ে তিনি এরূপ করা নিতান্তই গর্হিত ও অভদ্রোচিত কাৰ্য্য বিবেচনা করিতেন, এখন সেই কার্য্যে নিযুক্ত হইলেন। তিনি বীরবিক্রমের গৃহ খানা-তল্লাসী আরম্ভ করিলেন। তাঁহার কাগজ পত্র দেখিতে লাগিলেন। প্রথম তাঁহার মনে বড় ঘৃণা হইতে লাগিল; কিন্তু বীরবিক্রমের ভালর জন্য তাঁহাকে এরূপ করিতে হইতেছে বলিয়া মনকে প্রবোধ দিলেন।
কিন্তু এই বিস্তৃত খানাতল্লাসীতেও তিনি কিছুই জানিতে পারিলেন না। তবে সামান্য একটা বিষয় জানিলেন এবং সেজন্য নিতান্তই আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া উঠিলেন।
তিনি গৃহতল হইতে এক টুকরা কাগজ তুলিয়া লইলেন। দেখিলেন, সেখানি মনিঅর্ডারের রসীদ। বীরবিক্রম যাহাকে মনিঅর্ডার করিতেছেন, তাহার নাম পড়িয়া ইন্দ্রানন্দ আরও বিস্মিত হইলেন। দেখিলেন, বীরবিক্রম দয়ামলের স্ত্রীকে পঞ্চাশ টাকা মনিঅর্ডার করিতেছেন। কিন্তু মনিঅর্ডারে প্রেরকের নাম বীরবিক্রম নহে—অন্য আর একটা নাম—বীরবিক্রম মনিঅর্ডার না করিলে অপরের রসীদ তাঁহার গৃহে আসিবে কেন? বীরবিক্রমই এই মনিঅর্ডার করিয়াছেন। লেখাটাও তাঁহার হস্তাক্ষরের মত। বেনামী করিয়া দয়ামলের স্ত্রীকে টাকা পাঠাইবার অর্থ কি?
ইন্দ্রানন্দ শুনিয়াছিলেন যে, দয়ামলের মৃত্যুর পর তাহার স্ত্রী বড়ই কষ্টে পড়িয়াছে। দয়ামল যতদিন বাঁচিয়াছিল, সকলেই তাহাকে ধনী লোক বলিয়া জানিত; কিন্তু তাহার মৃত্যুর পর তাহার সম্পত্তি অপেক্ষা দেনাই অধিক বাহির হইল। পাওনাদারগণ তাহার সমস্ত সম্পত্তি দখল করিয়া রহিল। তাহার স্ত্রী বড়ই কষ্টে পড়িল। অধিকাংশ স্থলে পাপলব্ধ অর্থের পরিণাম এইরূপই হইতে দেখা যায়। ইন্দ্রানন্দ ভাবিলেন, “দয়ামলের বিধবা স্ত্রীর প্রতি বীরবিক্রমের এত দয়া কেন? যদিই বা দয়া হয়, তবে বেনামী করিয়া তাহাকে টাকা পাঠাইবার অর্থ কি? যে দয়ামল এক দিন তাহার পিতার সর্ব্বস্ব অপহরণ করিয়াছিল, তাহার স্ত্রীর প্রতি বীরবিক্রমের দয়া খুবই আশ্চর্য্যের বিষয় সন্দেহ নাই। ব্যাপার যা হইয়াছে, তাহা বেশ বুঝিয়াছি। দরি যাহাই বলুক—বীরবিক্রম যে দয়ামলকে খুন করিয়াছে, তাহাতে আর কোন সন্দেহ নাই। এখন অনুতাপ হইয়াছে—তাহাই এই প্রায়শ্চিত্ত। যাহাই হউক ইহার শেষ না দেখিয়া ছাড়িতেছি না; কিন্তু এখন কি করা যায়। এখন বেলা থাকিতে থাকিতে একবার পড়ো বাড়ীটি ভাল করিয়া দেখা কৰ্ত্তব্য।”
ইন্দ্রানন্দ একটা চুরুট ধরাইয়া, তাড়াতাড়ি বাড়ীর বাহির হইয়া পড়িলেন। ভৃত্যকে বলিলেন, “যদি আমার ফিরিতে দেরী হয়—আমার খাবার ঠিক করিয়া রাখিয়ো।”
ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ – বিফল প্ৰয়াস
দেওপাট্টা ঘাটের নিকট আসিয়া ইন্দ্ৰানন্দ সেই পড়ো বাড়ীর চারিদিক বিশেষ লক্ষ্য করিয়া দেখিতে লাগিলেন। বাড়ীটাকে দেখিলেই অতি জীর্ণ বলিয়া বুঝিতে পারা যায়; আশে পাশে আরও দুই একটা বাড়ী ভগ্নাবস্থায় স্তূপীকৃত হইয়া পড়িয়া আছে। এরূপ বাড়ীতে যে কেহ বাস করিতে পারে, তাহা বোধ হয় না। তবুও ইন্দ্রানন্দ সন্ধান করিবার জন্য ঘাটের যেখানে দুই একখানা নৌকা বাঁধা ছিল, সেইদিকে চলিলেন। এই সকল নৌকায় দুই একজন লোক ছিল, তিনি ইহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই পড়ো বাড়ীতে কে থাকে বলতে পার?”
তাহারা একটু বিস্মিত হইয়া তাঁহার দিকে চাহিল। একজন বলিয়া উঠিল, “ও রকম ভাঙা বাড়ীতে কি কখনও মানুষ থাকতে পারে মশাই? “
আর একজন বলিল, “মানুষ নাই—তবে লোকে বলে ভূত আছে।”
ইন্দ্রানন্দ যাইতেছিলেন, ফিরিয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন, “কেন লোকে এ কথা বলে জান, কেউ কি কিছু এ বাড়ীতে দেখেছে?”
একজন জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি এত কথা জিজ্ঞাসা করছেন কেন?”
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “একজন দালাল আমার কাছে এই জায়গা বেচিতে গিয়াছিল, তাই একটু সন্ধান করিতেছি।”
একজন বলিল, “মশায়, এমন কাজ করবেন না। যার বাড়ী সে সেদিন এখানে খুন হয়েছে। তার লাস এই ঘাটেই ভাসছিল।”
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “হাঁ শুনেছি, বাড়ীটা সস্তা বলেই কিনিবার ইচ্ছা করেছি। তোমরা কেউ কিছু এ বাড়ীতে দেখেছ?”
তাহাদের মধ্যে একজন বলিল, “কখনও কখনও রাত্রে যেন বাড়ীর মধ্যে আলো জ্বলে।”
ইহাদের নিকট আর অধিক কিছু জানিবার সম্ভাবনা নাই দেখিয়া ইন্দ্রানন্দ সে স্থান পরিত্যাগ করিলেন। তখন তিনি সেই পড়ো বাড়ীর দরজার দিকে চলিলেন। সেদিন যদিও তিনি অন্ধকার রাত্রে বাড়ীটার ভিতর প্রবিষ্ট হইয়াছিলেন, তথাপি তিনি পথ ভুলেন নাই। দেখিলেন, সেই কাঠের স্তূপগুলা এখনও পড়িয়া আছে। কিন্তু কাঠগুলি ঠিক আগেকার মত নাই। কেহ সেগুলিকে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত করিয়াছে।
সেই সকল কাঠের স্তূপের মধ্য দিয়া একটা অপরিসর পথ বাড়ীর দ্বার পর্য্যন্ত গিয়াছিল, ইন্দ্রানন্দ দেখিলেন, সে পথ এবার আর নাই। কে কাঠগুলি টানিয়া আনিয়া পথ বন্ধ করিয়া দিয়াছে। এখন কাঠের স্তূপের উপর দিয়া না গেলে বাড়ীর দ্বারে যাইবার উপায় নাই।
যে দ্বার দিয়া মীনা তাঁহাকে বাহির করিয়া দিয়াছিল, তিনি অনেক অনুসন্ধানেও সে দ্বার দেখিতে পাইলেন না। তিনি হতাশ হইলেন না, অতি সাবধানে কাঠের স্তূপের উপর দিয়া চলিতে লাগিলেন। ক্রমে অতি সন্তর্পণে বাড়ীর দ্বারে আসিলেন। দেখিলেন, দ্বার রুদ্ধ; কেবল রুদ্ধ নহে—একটা বড় তালা দ্বারের উপরে ঝুলিতেছে।
তিনি দ্বারে সবলে ধাক্কা মারিলেন; কিন্তু দ্বার কিছুমাত্র নড়িল না। তাঁহার বোধ হইল, যেন দ্বার ভিতর হইতে বন্ধ রহিয়াছে। বাটীর দ্বিতলে দুই তিনটি জানালা ছিল—সেগুলিও বন্ধ। তিনি কিংকৰ্ত্তব্যবিমূঢ় হইলেন। ভাবিলেন, এই খুনের হাঙ্গামার পর বদমাইসের দল দিন-কতক এ বাড়ী ছাড়িয়া পলাইয়াছে। অন্যত্রে গা ঢাকা দিয়া আছে—মীনা ও তাহার দাদিয়া তাহাদের সঙ্গে গিয়াছে। দাদিয়া যে এখানে নাই, তাহা তিনি পুৰ্ব্বেই অনুমান করিয়াছিলেন। তিনি ভাবিয়াছিলেন, সে এখনও তাঁহাদের বাড়ীর নিকট কোথায় লুকাইয়া আছে।
মীনাকে দেখিতে না পাইয়া ইন্দ্ৰানন্দ মনে মনে বড় ব্যথিত হইলেন। পুনঃ পুনঃ দ্বারে ধাক্কা মারিতে লাগিলেন; কিন্তু কেহ কোন সাড়া দিল না। বাড়ীতে জন-প্রাণীর কোন চিহ্ন নাই।
এদিকে সন্ধ্যারম্ভ হইয়াছে। ইন্দ্রানন্দ হতাশচিত্তে রাজপথের দিকে ফিরিলেন। কাঠের স্তূপ অতিক্রম করিতে করিতে কিছুদূর আসিয়া সহসা ইন্দ্রানন্দ একবার পড়ো বাড়ীর দিকে ফিরিয়া চাহিলেন। তাঁহার যেন বোধ হইল, বাড়ীর উপরের একটা জানালা কে একটু খুলিয়াছে। নিমেষের জন্য তিনি যেন সেই জানালায় মীনার মুখ দেখিতে পাইলেন—ভাল করিয়া দেখিতে-না-দেখিতে জানালা বন্ধ হইয়া গেল।
ইন্দ্ৰানন্দ স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইলেন। দ্রুতপদে আবার ফিরিয়া সেই বাড়ীর দ্বারে আসিলেন এবং দ্বারে সবলে বারংবার ধাক্কা দিয়া ‘মীনা—মীনা’ বলিয়া ডাকিতে লাগিলেন। কেহ কোন উত্তর দিল না।
ইন্দ্রানন্দ কিয়ৎক্ষণ দ্বারের সম্মুখে দাঁড়াইয়া রহিলেন। আবার একবার দ্বারে ধাক্কা দিয়া ডাকিলেন— শেষে অগত্যা হতাশভাবে সে স্থান পরিত্যাগ করিলেন। মনে মনে ভাবিলেন, “আমি মীনার কথা ভাবিতেছিলাম, তাহাই হঠাৎ যেন তাহার মুখ দেখিলাম বলে মনে হইয়াছিল। সে এখানে থাকিলে নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে দেখা করিত। তাহার রাক্ষসী দাদিয়া তাহাকে নিশ্চয়ই সঙ্গে করিয়া কোথায় লইয়া গিয়াছে। যেমন করিয়া হয়, তাহাকে এই বদমাইসের দল হইতে রক্ষা করিব।
ইন্দ্রানন্দ বীরবিক্রমের বাড়ীতে ফিরিয়া আসিলেন। দেখিলেন, বীরবিক্রম ফিরিয়া আসেন নাই—তাঁহার কোন সংবাদও আসে নাই।
বিংশ পরিচ্ছেদ – সূত্ৰান্বেষণ
সন্ধ্যার পরেই ইন্দ্রানন্দ আবার বাহির হইলেন। এবার তিনি দয়ামলের স্ত্রীর সহিত সাক্ষাৎ করা স্থির করিয়াছিলেন। দয়ামলের বাড়ী সন্ধান করিয়া বাহির করা তাঁহার পক্ষে আয়াসসাধ্য হইল না—দয়ামলের স্ত্রীর সহিত তাঁহার দেখা হইল।
অবগুণ্ঠনে মুখাবৃত করিয়া দয়ামলের স্ত্রী দাঁড়াইয়া রহিল। ইন্দ্রানন্দ কি বলিয়া কথা আরম্ভ করিবেন, সহসা ভাবিয়া পাইলেন না।
দয়ামলের স্ত্রীই প্রথমে কথা কহিল। সে অবগুণ্ঠনের ভিতর হইতে বলিল, “আপনার কি দরকার?”
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন “আপনার স্বামীর মৃত্যু সম্বন্ধে দুই-একটা কথা জানিতে আসিয়াছি।”
সে চক্ষু মুছিতে মুছিতে জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি কি পুলিসের লোক? “
কি উত্তর দিবেন, ইন্দ্রানন্দ স্থির করিতে পারিলেন না। ইতস্ততঃ করিয়া বলিলেন, “না, আমি একজন গোয়েন্দা—আপনার স্বামীকে কে খুন করিয়াছে, তাহার অনুসন্ধান করিতেছি।”
দয়ামলের স্ত্রী মৃদুস্বরে ক্রন্দন করিতে করিতে বলিল, “আপনি কি জানিতে চান? আমি যাহা জানিতাম, সব ত বলিয়াছি?”
সে পুলিসের নিকট কি বলিয়াছে, ইন্দ্রানন্দ তাহা জানিতেন না; বলিলেন, “আপনার স্বামী সেদিন রাত্রে কেন সেই পড়োবাড়ীতে গিয়াছিলেন, বলিতে পারেন?”
“সব ত বলিয়াছি। তিনি আমাকে বিশেষ কিছুই বলেন নাই। যাইবার সময় বলিয়াছিলেন, তিনি একটা বিশেষ কাজে যাইতেছেন—ফিরিতে রাত হইবে। হায়! অভাগীর অদৃষ্টে তাঁহাকে আর ফিরিতে হইল না।” বলিয়া দয়ামলের স্ত্রী কাঁদিতে লাগিল।
ইন্দ্রানন্দ বুঝিলেন, এ কিছুই জানে না। প্রকাশ্যে বলিলেন, “কাহারও উপর আপনার সন্দেহ হয়?”
“না, আমি কেমন করে জানিব?”
“কাহারও সঙ্গে আপনার স্বামীর বিশেষ ঝগড়া ছিল কি?”
“তা জানি না।”
তাহাকে আর কি জিজ্ঞাসা করিবেন, ইন্দ্রানন্দ ভাবিয়া পাইলেন না। সহসা তাঁহার মনিঅর্ডারের রসীদের কথা মনে পড়িল। তাহাই যে আসল কথা। ইন্দ্রানন্দ জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনাকে কেহ পঞ্চাশ টাকা পাঠাইয়াছে?”
বিধবা বলিল, “আপনাকে কে বলিল?”
ইন্দ্রানন্দ সুবিজ্ঞ পুলিস-কর্ম্মচারীর ন্যায় গম্ভীরভাব ধারণ করিয়া বলিলেন, “আমাদের অনেক খবর রাখিতে হয়।”
দয়ামলের স্ত্রী বলিল, “হাঁ, আমি ত এ কথা আপনাদের জানাইয়াছি।” সে ইন্দ্রানন্দকে পুলিসের লোক বলিয়াই জানিয়াছিল।
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “কে টাকা পাঠিয়েছে মনে করেন?”
“কিরূপে জানিব। আপনারা ত বলে গেলেন সন্ধান করিবেন।
“হাঁ, আমরা সে সন্ধান লইতেছি।” ইহার নিকট আর কিছু জানিবার সম্ভাবনা নাই দেখিয়া ইন্দ্রানন্দ উঠিলেন। উঠিয়া বলিলেন, “যে আপনার স্বামীকে খুন করিয়াছে, শীঘ্রই আমরা তাহাকে ধরিব।”
দয়ামলের স্ত্রী কাঁদিতে লাগিল। ইন্দ্রানন্দ আর তথায় বিলম্ব করা কর্ত্তব্য নয় ভাবিয়া সত্বর গৃহে ফিরিলেন।
আর একবার রাত্রে পড়ো বাড়ীতে যাইবার জন্য তাঁহার ইচ্ছা হইল। একবার মীনার সহিত দেখা করিবার জন্য মন অত্যন্ত ব্যগ্র হইয়া উঠিল। মনে করিলেন, হয় ত তাহারা ভয়ে দিবসে এই বাড়ীতে থাকে না। রাত্রে পথে লোক-চলাচল বন্ধ হইলে এইখানে আসে। আবার ভাবিলেন, “থাক আজ আর গিয়ে কাজ নাই, যদি তাহাদের কেহ কোথাও লুকিয়ে থেকে আমাকে আজ দেখিয়া থাকে—তা হইলে তারা নিশ্চয়ই আর আজ রাত্রে এখানে আসিবে না। তা যেখানেই থাক, তাহারা এমন সুন্দর আড্ডা ছাড়িয়া সহজে কোথাও যাইবে না; দুই একদিনের মধ্যে নিশ্চয়ই ফিরিয়া আসিবে। কাল রাত্রে একবার দেখা যাইবে। ইতিমধ্যে আমাকে সন্ধান লইতে হইবে, এই দাদিয়া বুড়ীকে এখানকার কেহ চিনে কি না।“
তিনি বীরবিক্রমের বাড়ীতে রাত্রে বসিয়া এইরূপ নানা চিন্তা করিতেছিলেন, এই সময়ে কে বাহিরের দরজায় ধাক্কা মারিল। ভৃত্য ছুটিয়া দরজা খুলিতে গেল। বীরবিক্রম ফিরিয়া আসিয়াছেন, ভাবিয়া ইন্দ্ৰানন্দ ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। কিন্তু দেখিলেন, ভৃত্যের সহিত আসিল—একটি অপরিচিত ভদ্রলোক। ভদ্রলোকটি বলিলেন, “আপনি বীরবিক্রম সাহেব নহেন?”
ইন্দ্রানন্দ বিচলিতভাবে বলিলেন, “না, আমার নাম ইন্দ্রানন্দ—আমি গুণারাজ সাহেবের পুত্র।”
“ওঃ! আপনার নাম শোনা আছে বটে। বীরবিক্রম সাহেব কোথায় বলিতে পারেন কি?”
“না, আমরা সকলেই তাঁহার জন্য বড় ভাবিত আছি।”
“কাহার উপর সন্দেহ হয়?”
“কি সন্দেহ?”
“এই দয়ামলের মত তাঁহাকেও কেউ খুন করিয়াছে।”
ইন্দ্ৰানন্দ লম্ফ দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, “আপনি বলেন কি?“
তিনি অতি ধীরে ধীরে বলিলেন, “আমি কিছুই বলিতেছি না। নিশ্চয়ই বীরবিক্রম সাহেব কোন বিশেষ কাজে অন্যত্রে গিয়াছেন। তাঁর সঙ্গে আমার একটু কাজ ছিল, আর একদিন আসিব বসুন।”
এই বলিয়া তিনি প্রস্থান করিলেন।
* * * * *
এই অপরিচিত ব্যক্তির নিকট ইন্দ্রানন্দ যাহা শুনিলেন, সে কথা কখনও তাঁহার হৃদয়ে মুহূর্তের জন্যও উদয় হয় নাই। তবে কি দয়ামলের ন্যায় সত্য সত্যই কেহ বীরবিক্রমকেও খুন করিয়াছে? হয় ত দরিয়া যাহা বলিয়াছে, তাহাই ঠিক—এই পড়ো বাড়ীতে একদল বদমাইস আড্ডা লইয়াছে। তাহারা মীনাকে দিয়া লোক ভুলাইয়া গভীর রাত্রে এই বাড়ীতে লইয়া আসে। যাহা কিছু তাহাদের সঙ্গে থাকে, কাড়িয়া লইয়া তাড়াইয়া দেয়। যে জোর-জবরদস্তি করে তাহাকে মারিয়া ফেলে। হয় ত দয়ামলেরও এই অবস্থা হইয়াছে, হয় ত সে রাত্রে বীরবিক্রমেরও সেই অবস্থা হইয়াছিল, তিনি কোন গতিকে প্রাণে বাঁচিয়া বাড়ী ফিরিয়াছিলেন। হয় ত দয়ামলই এই বদমাইসদলের নেতা ছিল, হয় ত দয়ামলই বীরবিক্রমকে অন্ধকারে আক্রমণ করে। বীরবিক্রম বলবান, তাহার হাতের ছোরা কাড়িয়া লইয়াছিলেন। আত্মরক্ষা করিতে গিয়া দয়ামলকে হত্যা করিয়াছিলেন। হয় ত দলপতির এইরূপ মৃত্যু হওয়ায় তাহার দলস্থ লোকরা বীরবিক্রমকে খুন করিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়। হয় ত তাহারা বীরবিক্রমকে খুন করিয়া তাঁহার মৃতদেহ কোথায় লুকাইয়া ফেলিয়াছে। নতুবা বীরবিক্রম এরূপভাবে নিরুদ্দেশ হইবার লোক নহেন; তবে কি মীনার প্রকৃতি এমনই ভয়ানক! তবে কি সে ছল করিয়া এইরূপ লোক ভুলাইয়া পড়োবাড়ীতে লইয়া যায়—কি ভয়ানক! এমন সৌন্দর্য্যের ভিতর এমন কালসর্প লুকাইয়া আছে! আমাকেও ত পড়োবাড়ীর ভিতর লইয়া গিয়াছিল। আমাকেও ত কে অন্ধকারে আক্রমণ করিয়াছিল, অন্ধকারে আটকাইয়াছিল, নিশ্চয়ই আমার নিকট যাহা কিছু ছিল, কাড়িয়া লইত। তবে মীনাই আমাকে সে রাত্রে রক্ষা করিয়াছিল। সে এই বাড়ী থেকে আমাকে বাহির না করিয়া দিলে আমার প্রাণরক্ষার অন্য উপায় ছিল না। না, দরি যাই বলুক, মীনা কখনও এ রকম হইতে পারে না। তাকে দেখিলে দরি কখনই এ রকম বলিতে পারিত না। নিশ্চয়ই কোন কারণে সে এই সকল বদমাইসের হাতে পড়িয়াছে। তাহাকে যেমন করিয়া হউক, এ নরক হইতে উদ্ধার করিতে হইবে–রক্ষা করিতে হইবে। সত্যই কি তবে বীরবিক্রম আর বাঁচিয়া নাই? এই সকল চিন্তায় ইন্দ্রানন্দ বড়ই অস্থির হইয়া উঠিলেন। তিনি আহার করিতে পারিলেন না; এবং সমস্ত রাত্রি বিছানায় পড়িয়া ছট্ফট্ করিতে লাগিলেন।
একবিংশ পরিচ্ছেদ – নূতন আশঙ্কা
সকালে ইন্দ্রানন্দ ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলেন। কিন্তু কে তাঁহার হাত ধরিয়া নাড়া দেওয়ায় ইন্দ্ৰানন্দ চমকিত হইয়া উঠিয়া বসিলেন। দেখিলেন, পার্শ্বে তাঁহার পিতা দণ্ডায়মান। তিনি তাঁহাকে এখানে দেখিয়া নিতান্ত বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “আপনি!”
তিনি বলিলেন, “হাঁ, আমি রাত্রে এলাহাবাদ থেকে একখানি টেলিগ্রাম পাইয়াছি; আমি এখনই এলাহাবাদে চলিলাম। এক সপ্তাহের মধ্যে ফিরিব। বাড়ীতে কেহ নাই—তুমি সেখানে যাও।”
গুণারাজের নানা স্থানে কাজ-কারবার ছিল; এলাহাবাদেও ছিল; সেখান হইতে টেলিগ্রাম আসায় তিনি এলাহাবাদে রওনা হইতে বাধ্য হইলেন।
তিনি প্রস্থান করিলে ইন্দ্রানন্দ কি করিবেন, তাহাই ভাবিতে লাগিলেন। তিনি আর একবার পড়োবাড়ীটা রাত্রে না দেখিয়া কিছুতেই গৃহে ফিরিতে পারিবেন না। যেমন করিয়া হউক, আর একবার সেই মীনার সঙ্গে দেখা করিতেই হইবে; নতুবা বাড়ী গিয়াও নিশ্চিন্ত হইতে পারিবেন না দরিয়া তাঁহাকে পাগল করিয়া তুলিবে। কতবার তাঁহার পিতা বাড়ী হইতে অনুপস্থিত হইয়াছেন, কতবার দরিয়া একলা থাকিয়াছে; সুতরাং তাহার জন্য ভাবনা নাই। ইন্দ্রানন্দ ভাবিয়া দেখিলেন, যদি তাঁহাকে যাইতেই হয়, কাল যাইবেন। আজ রাত্রে একবার পড়োবাড়ী দেখিতেই হইতেছে।
এই সময়ে ভৃত্য আসিয়া বলিল, “একজন পুলিসের লোক বাড়ীর কাছে ঘুরিতেছে।” ইন্দ্ৰানন্দ বুঝিয়াছিলেন যে, কাল যে ব্যক্তি বীরবিক্রমের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছিলেন, তিনি নিশ্চয়ই পুলিসের লোক। ভাবিলেন, “আমিই কেবল বীরবিক্রমকে সন্দেহ করি নাই— দেখিতেছি, পুলিসেও তাঁহাকে সন্দেহ করিয়াছে—নতুবা তাহারা এরূপে তাঁহার সন্ধান করিবে কেন? বীরবিক্রম কি বাঁচিয়া আছেন? বাঁচিয়া থাকিলে নিশ্চয়ই এতদিনে ফিরিতেন—না হয় পত্রও লিখিতেন।” ইন্দ্রানন্দ পুলিস-কৰ্ম্মচারীর সহিত দেখা করাই কর্ত্তব্য মনে করিলেন। তাড়াতাড়ি বাহিরে আসিলেন। দেখিলেন, গত দিবস যে ভদ্রলোকটি আসিয়াছিলেন, তিনিই বটে। ইন্দ্ৰানন্দ তাঁহার নিকটস্থ হইলেন।
তাঁহাকে দেখিয়া সেই ব্যক্তি বলিলেন, “মহাশয় এখনও আপনি এইখানেই আছেন যে,– বাড়ীতে যান নাই?”
ইন্দ্রানন্দ বলিলেন, “নইনিতালে আমার একটু কাজ আছে।”
“বীরবিক্রম সাহেবের কোন সন্ধান পাইলেন?”
“না, আপনি কি জন্য তাহাকে খুঁজিতেছিলেন, শুনিতে পাই কি?”
“সামান্য একটু কাজ ছিল।”
“আপনি সেদিন খুনের কথা বলিয়াছিলেন—আপনি কি তবে মনে করেন যে, কেহ তাঁহাকে খুন করিয়াছে?”
“খুনও করিতে পারে—তিনি নিজেও আত্মহত্যা করিতে পারেন।”
“তিনি কেন আত্মহত্যা করবেন?”
“এই ফাঁসীকাঠ হইতে রক্ষা পাইবার জন্য।”
ইন্দ্রানন্দ স্তম্ভিত হইলেন। তাঁহার মুখ হইতে কথা বাহির হইল না। ভদ্রলোকটিও কোন কথা না কহিয়া দ্রুতপদে প্রস্থান করিলেন।