প্ৰথম খণ্ড – খুন না ইন্দ্রজাল!
“Heard you that?
What prodigy of horror is disclosings.”
Lillo “FaTaL CURIOSITY
প্রথম পরিচ্ছেদ – বিবাহ বিভ্রাটে
“কি হবে গো, সর্ব্বনাশ হ’ল।” বলিয়া একটা সৌন্দর্য্যময়ী সুবেশা বালিকা তড়িদ্বেগে বৈঠকখানা-গৃহে প্রবেশ করিল। বয়ঃক্রম পঞ্চদশ বৎসর হইবে। যৌবনের সকল সুষমাই তাহার সুকুমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে বিকাশোন্মুখ।
যে কক্ষে বালিকা প্রবেশ করিল—সেটা একতল সদর বৈঠকখানা, অতি সুন্দররূপে সজ্জিত ও বৃহৎ। দেয়ালে দেয়ালগিরি ও নানাবিধ চিত্র। সেই সকল চিত্রাবলীর মধ্যে একখানি বৃহদায়তন তৈলচিত্র (অয়েল পেইন্টীং)। তাহাতে একটী ভুবনমোহিনী বালিকার মূর্ত্তি অঙ্কিত রহিয়াছে। এতদ্ব্যতীত নানাবিধ দেশী ও বিদেশীয় বিলাস সামগ্রীর কোন অভাব নাই।
কক্ষতলে একটী গালিচা বিস্তৃত, তাহার উপর বসিয়া দুই ব্যাক্তি কি কথোপকথন করিতেছিলেন। তদুভয়ের মধ্যে একজন এই বাটীর কর্তা মহাশয়; বয়ঃক্রম চল্লিশ বৎসর হইবে- নাম রামকুমার চৌধুরী। অপর ব্যক্তি যুবক,—বয়স চব্বিশ বৎসর—উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ; মুখকান্তি অতি সুন্দর-প্রফুল্ল—প্রীতিব্যঞ্জক। নাম দেবিদাস মুখোপাধ্যায়।
অদ্য রামকুমারবাবুর একমাত্র কন্যা বিমলার বিবাহ, পাত্র যুবক দেবিদাস। রামকুমারবাবু যাহাতে এ বিবাহ সম্পূর্ণ রূপে গোপনে সম্পাদিত হয়, তাহার ব্যবস্থা করিয়াছেন। ইহার কারণ ঘটনা-প্রসঙ্গে আমরা পরে প্রকাশ করিব।
রামকুমারবাবু ভাগিনেয়ীকে সেরূপ ব্যাকুলভাবে প্রবেশ করিতে দেখিয়া বিস্মিত হইলেন। কহিলেন,–”কি হয়েছে তোমার?”
বালিকার নাম—পরিমল। পরিমল হাঁপাইতে হাঁপাইতে নয়নদ্বয় অধিকতর বিস্ফারিত করিয়া বলিল—”সৰ্ব্বনাশ! বিমলা নাই!”
“বিমলা নাই কি! কোথা গেছে?
পরিমল এবার কাঁদিয়া ফেলিল—”ওগো, কি হবে গো, আমি এই তার ঘর থেকে আসছি— আমাদের বিমলা নাই!”
রামকুমারবাবু বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “নাইত–গেল কোথা তবে? খুঁজে দেখ গিয়ে—বোধ—”
পরিমল বাধা দিয়া বলিল, “আর কোথা খুঁজে দেখবো—দেখে আর হবে—কি!” রামকুমারবাবু রাগান্বিত হইয়া বলিলেন, “হতভাগা মেয়ে! বিমলা বোধ হয় বাগানে গেছে। এস, দেবিচরণ (দেবিদাসকে দেবিচরণ বলিয়া ডাকিতেন) আমরা খুঁজে দেখি—এ হতভাগা মেয়ে এমন তিলকে তাল করিতে পারে।” বলিয়া, উঠিয়া দাঁড়াইলেন।
পরিমল তাঁহার হাত ধরিয়া উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া উঠিল—সেই ক্রন্দনে রামকুমারবাবু এককালে স্তম্ভিত এবং ভীত হইলেন।
দে। পরিমল! কি হয়েছে বেশ করে খুলে বল দেখি।
রা। কান্না কেন—হয়েছে কি?
প। কি বলবো গো—আমার হাত পা যে কাঁপছে, আমি যে দাঁড়াতে পাচ্ছি না—ভয়ে আমার যে প্রাণ উড়ে যাচ্ছে—(উদ্দেশে) হা মা কালি! তোমার মনে এই ছিল! কি হবে গো! আমাদের বিমলা কোথা গেল গো—কেন আমি তাকে একা ফেলে রেখে—আমার ঘরে মরতে গেছলেম্!”
রামকুমারবাবু সদ্বিবেচক এবং দৃঢ়চিত্ত; তিনি বলিলেন, “হয়ত বিমলা কোন কারণবশতঃ কোথায় গিয়াছে। তাহাকে না দেখিতে পাইয়াই পরিমল এতাধিক অধীর হইয়াছে। তাহার পর বলিলেন, “দেবিচরণ একটু অপেক্ষা কর; আমি একবার অনুসন্ধান করে এখনি আছি—বোধ হয় বাগানে গেছে—না হয় নিশ্চয় ত্রিতলের ছাদে বসে আছে।”
প। (উচ্চৈঃস্বরে—কাঁদিয়া) “না—সে নাই—নাই। আমি বেশ জানি! তার ঘরময় রক্ত— বিছানাময় রক্ত; তাকে কে কেটে ফেলেছে—খুন করে গেছে—খুন—”
“খুন—কি—বল্লি খুন! বিমলা নাই?” বলিতে বলিতে রামকুমারবাবু পতনোন্মুখ হইলেন। দেবিদাস ধরিয়া ফেলিলেন।
রা। দেবিচরণ! তুমি থাক—আমি এখনি ফিরে আসবো, দেখি, বিধাতা আমার অদৃষ্ট-আকাশে কি কালমেঘ তুলেছেন।
দেবিদাসের হস্ত হইতে নিজ হস্ত ছিনাইয়া লইলেন।
পরিমল তাঁহার পদতলে নিপতিত হইয়া বলিতে লাগিল, “না—না! কি ভয়ানক! মামাবাবু তোমার পায়ে পড়ি; যেও না, যেও না, সে ঘরে যেও না; পাড়ার যে যেখানে আছে, ডেকে আন, পাহারাওয়ালা ডাক! সে দেখলে তুমি বাঁচবে না; আমি বেশ জানি, তুমি কখন তা দেখে বাঁচতে পারবে না; ঘর রক্তগঙ্গা হয়েছে, বিয়ের কাপড় চোপড় জামা সব রক্তে মাখা হয়ে গেছে; বিমলা নাই! হা মা কালি! তুমি আমাদের একি করলে! কেন আমাদের এ সর্ব্বনাশ হ’ল!” বলিতে বলিতে তাহার সেই কাতরকম্পিত দেহলতা অবসন্ন হইয়া আসিল। অভাগিনী মূৰ্চ্ছিতা হইল।
তখনই রামকুমারবাবুর আদেশে দুইজন পরিচারিকা আসিয়া তাহাকে স্থানান্তর করিল।
রামকুমারবাবু বলিলেন, “তবে দেবিদাস, তুমি এইখানে থাক—যদি বিমল বাঁচত, তোমার হ’ত; মরেছে সে—এখন সে কেবল আমার,—আমার! তোমার কি, তুমি কেন সাধ করে আপনাকে ব্যথিত করবে? তুমি এইখানে থাক, আমি এখনি আসছি।” দেবিদাসকে গৃহমধ্যে রাখিয়া বাহির হইতে কবাট রুদ্ধ করিলেন। উন্মত্তের ন্যায় ছুটিলেন। বিমলার শয়নগৃহে যাইবার সোপানশ্রেণী অতিক্রম করিবার কালে বারেক নিপতিত হইলেন; ভ্রুক্ষেপ নাই, সাধ্যমত ছুটিলেন।
প্রায় গৃহদ্বারে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। আর সে গতির দ্রুততা নাই, আশঙ্কায় পদদ্বয় অবসন্ন! শোকার্ত্ত জনক ভগ্নহৃদয়ে নিজ দুহিতার মৃত্যুকক্ষদ্বারে আসিয়া দাঁড়াইলেন। দ্বার উন্মুক্ত ছিল; গৃহটী উত্তর মুখ। পশ্চিম দিকস্থ একটী গবাক্ষ উন্মুক্ত ছিল, পার্শ্বে একটী বৃহৎ আম্রতরু সেই গবাক্ষ-সংলগ্ন হইয়া রহিয়াছে, দুই একটী শাখা তন্মধ্য দিয়া কক্ষমধ্যে উঁকি মারিতেছে। সেই গবাক্ষ-মধ্য দিয়া শুক্লপক্ষীয়া সপ্তমীর অর্দ্ধশশীর কিরণচূর্ণ সেই গৃহতলে পড়িয়া রক্ততরঙ্গে ক্রীড়া করিতেছে। দ্বারদেশে একস্থানে খানিকটা রক্ত জমিয়া রহিয়াছে।
দুই হস্তে বক্ষ চাপিয়া শোকাকুল রামকুমার মুহূর্তের পর গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন, কক্ষতল শোণিত তরঙ্গে ভাসিতেছে। ভয়ে, শোকে চক্ষু মুদিয়া সেই রক্তসিক্ত গৃহতলে বসিয়া পড়িলেন।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – আগন্তুক
বঁড়িষা বেহালার দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তে, পরিমাণে প্রায় দশ বিঘা স্থান যুড়িয়া একটা অট্টালিকা উন্নতমস্তকে দণ্ডায়মান। উক্ত পরিমাণের সমুদায় স্থান যে কেবল গৃহাবলীতে পূর্ণ তাহা নহে; অন্ততঃ দুই বিঘা জমীর অভ্যন্তরে ইমারতের সকল অংশ পরিপূর্ণ, বাকী চতুর্দ্দিকে ইষ্টক-প্রাচীর বেষ্টিত ফলোদ্যান, কিঞ্চিদ্দূর হইতে দেখিলে একখানি অভিনব সুচারু চিত্র বলিয়া ধারণা জন্মিয়া থাকে।
পাঠক মহাশয়, আমরা এই বাটীর দুর্ঘটনা পূর্ব্বোক্ত অধ্যায় হইতে আন্দোলন করিতে আরম্ভ করিয়াছি। ইহার একমাত্র অধিপতি জমীদার রামকুমারবাবু।
যদিও আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি যে তিনি দৃঢ়চিত্ত ও সদ্বিবেচক; কিন্তু এক্ষণে সে বিবেচনা ও দৃঢ়তা যুগপৎ লোপ পাইল। তিনি চিৎকার করিয়া ক্ষুদ্রমতি বালকের ন্যায় ক্রন্দন করিয়া উঠিলেন, “বিমলা! মা আমার,—আমার কি সর্ব্বনাশ করিলি, তুই যে আমার একমাত্র বুকভরা আনন্দটীর মত ছিলি; তোর সেই সুন্দর মুখখানিতে যে আমার সকল সুখ নিহিত ছিল; তোর সেই বিশালনয়ন দুটীতে আমার প্রাণের হাসিকে যে ফুটে উঠতে দেখতেম্। তুই যে আজ দ্বাদশ বৎসর মাতৃহীনা, আমি যে তোকে আপনি বুকে করে রেখে পালন করেছিলেম্, তার ফল কি এই! আমার এই প্রাণভরা স্নেহের কি প্রতিদান এই! হতভাগিনি! তুই যে আমার একমাত্র আলো হয়েছিলি; তুই ভিন্ন আর আমার কে আছে! তোরেই বা দোষ দিই কেন, দোষ আমার অদৃষ্টের। তুই গেছিস, সেই সঙ্গে আমার সব গেছে; সুখ নাই, শান্তি নাই, আশা নাই—তৃপ্তি নাই; আছে শুধু এই যন্ত্রণাদীর্ণ হৃদি, শোকসন্তপ্ত প্রাণ, তাও থাকবে না—আমার মরণই ভাল।”
মুহুর্ত্তের ক্ষণিক অস্তিত্ব মুহূর্তে মুহূর্তে একদিকে বহিয়া গেল—কিন্তু শোকান্ধ-আঁখি পিতার সেই দুঃখ—সেই ক্লেশ—সেই শোক—সেই হা হুতাশ তাঁহার হৃদয় জুড়িয়া ক্ষুধার্ত লোলজিহ্বা কুকুরের ন্যায় বসিয়া রহিল।
রামকুমারবাবু উঠিলেন—আর একবার দেখিলেন; – আর কিছু নাই, শুধু কক্ষতল রক্তপ্লাবিত—শুধু শয়নশয্যা রক্তকলঙ্কিত, একখানি বৃহচ্ছুরিকা শোণিত লিপ্ত হইয়া সেই রক্তাক্ত শয্যায় পড়িয়া। তিনি কোন দ্রব্য স্পর্শ করিলেন না; যেমন ছিল তেমনি রহিল। তিনি কবাট চাবিবন্ধ করিলেন।
তিনি পুনর্ব্বার বৈঠকখানা গৃহাভিমুখে ধাবিত হইলেন; দ্বার মুক্ত করিয়াই বলিলেন, “দেবিচরণ! তুমি আমায় কোন কথা জিজ্ঞাসা করো না; করলেও নিশ্চয় জানিও কোন উত্তর পাইবে না, আমার এখন যা কর্ত্তব্য, আমি এখন তাই করবো! এখন চাই আমি তীব্র প্রতিহিংসা, এ যন্ত্রণানল নির্ব্বাণের শীতল বারি; আমার বিমল অপঘাতে মরেছে; তার জন্য যত স্নেহ-যত মমতা আমার হৃদয়ে ছিল, এখন তা সব হিংসার ছদ্মবেশে সেজে, জেগে উঠেছে জাবে।”
দেবিদাস তাঁহাকে ধরিয়া বসাইলেন ও কহিলেন, “আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না, আমাকে সকল কথা অনুগ্রহপূর্বক খুলে বলুন দেখি।”
রামকুমারবাবু পূর্ণোদ্বেগে কহিলেন, “না, দেবিচরণ, সকল কথা কি, আমি সে সকলের একটী শব্দমাত্রও তোমাকে শুনাব না। আর শোন, তুমি এখনই এখান থেকে চলে যাও, তুমি আর এ বাটীতে আসবার উপযুক্ত নও।” নাটকীয় অভিনেতার ন্যায় দুই হস্ত উর্দ্ধে তুলিয়া তাহার পর বলিতে লাগিলেন;—”শোন, দেবি! এখন আমি চাই তাকে, তার বক্ষের রক্ত পান করতে, যে পাষণ্ড আমার বিমলার বুকে নির্দয় ছুরি বসাইয়াছে। আমি সহজে ছাড়বো না, দেখে নেব; এখনিই যাও তুমি! আমার মনের ঠিক নাই—তোমাকে আমি অপমান করে ফেলতে পারি।”
উচ্চমনা গৰ্ব্বিত যুবক রামকুমারবাবুর মনের গতি এবং রূঢ়তা হৃদয়ঙ্গম করিতে না পারিয়া তন্মুহূর্ত্তে স্থানত্যাগ করিলেন। তখন তাঁহার হৃদয়ের ব্যথা সম্পূর্ণরূপে মুখে প্রতিফলিত হইয়াছিল। কেন যে রামকুমারবাবু তাঁহার সহিত এরূপ ব্যবহার করিলেন, পাঠক মহাশয় আমাদিগের বক্ষ্যমান ঘটনাপ্রসঙ্গে অবগত হইতে পারিবেন।
রামকুমারবাবু সেই রাত্রে ডিটেক্টীভ্ অফিসের সুপারিন্টেণ্ডেন্টকে টেলিগ্রাফ্ করিলেন; নিম্নলিখিত বাক্য কয়েকটা লিখিলেন মাত্ৰ; –
“Send me the best detective you have in your employ at once! Immense rewards will attend his success!*
[* অবগত মাত্রে আমার নিকট আপনার অধীনস্থ সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দাকে প্রেরণ করিবেন, কৃতকাৰ্য্য হইলে তিনি বিশেষ রূপ পুরস্কৃত হইবেন।]
তাহার পর তিনি আপনার ভৃত্যবর্গকে তাঁহার কন্যার শবদেহ অনুসন্ধানের নিমিত্ত নিকটবর্ত্তী স্থানসমূহে প্রেরণ করিলেন; শেষ রাত্রিতে সকলে অকৃতকাৰ্য্য হইয়া প্রত্যাগমন করিল।
প্রাতঃকালে দেবিচরণ সাক্ষাৎ প্রার্থনা করিলেন—রামকুমারবাবু তাঁহাকে বলিয়া দিলেন, সে যেন আর কখন তাঁহার বাটীতে পদার্পণ না করে। পরিমল দিবসের মধ্যে দুই তিনবার মাতুল রামকুমারবাবুর নিকট আসিল; রামকুমারবাবু তাঁহার সহিত কথা কহিলেন না; তা একবার দুই একটা কথা পরিমল জিজ্ঞাসিল—তাহাতে সে এমনই তিরস্কৃত হইল যে আর কথা কহিতে সাহস করিল না,—ক্ষুণ্নমনে প্রস্থান করিল।
ক্রমে রাত্রি আসিল, রামকুমারবাবুর মনের স্থিরতা নাই, গৃহের চতুর্দ্দিকে কেবল বেড়াইতেছেন; কৈ কোন গোয়েন্দাও ত দেখা দিল না, ক্রমে রাত্রি এগারটা বাজিল, আপনার শয়নগৃহে গিয়া একখানি কেদারা টানিয়া উপবেশন করিলেন, হস্তে একটী পিস্তল লইলেন।
রামকুমারবাবু উদ্যানপার্শ্বস্থ একটী গবাক্ষ উন্মোচন করিয়া দিলেন; দেখিলেন আকাশ মেঘপূর্ণ, সেই রন্ধ্রলুপ্ত মেঘমাঝে তারা নীলিমা, নিহারিকা, শশী মগ্ন হইয়াছে; গভীর অন্ধকার সকল ঢাকিয়া ফেলিয়াছে; ক্রমে ভীষণ রবে ঝটিকা প্রধাবিত হইতে লাগিল; বৃষ্টি নামিল, বিদ্যুতের আলো যদিও মধ্যে মধ্যে আঁধার রাশির নিমিষ-অস্তিত্ব মাত্র লোপ করিতেছে, কিন্তু পরক্ষণেই দ্বিগুণ ঘনীভূত হইতেছে। বুঝিলেন, তাঁহার হৃদয়ে বিপ্লব, ইহা অপেক্ষা আজ শতগুণে ভীষণতম।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – সঞ্জীবচন্দ্ৰ
ক্রমে রাত বারটা বাজিল, এমন সময় এক নূতন ঘটনা ঘটিল। রামকুমারবাবু চমকিত হইলেন। নিজের পিস্তল করে লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন, “কে তুমি? উত্তর দাও নতুবা মৃত্যু নিশ্চয়।”
কথা শেষ হইতে না হইতে এক ব্যক্তি কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিল, রামকুমারবাবু হতভম্ব হইয়া পড়িলেন; কিছু বুঝিতে পারিলেন না। দেখিলেন, আগন্তুক দীর্ঘাকৃতি, মাংসপেশীতে বক্ষ প্রশস্ত, পৃষ্ঠ,—দীর্ঘহস্ত—স্ফীত; দেখিলেই শক্তিমন্ত বলিয়া বোধ হয়। বর্ণ হিমগৌর, দৃষ্টি অতি তীক্ষ্ণ, মুখশ্রী অতিসুন্দর, দেহ বলময়, বয়স পাঁচিশ ছাব্বিশ বৎসর হইবে।
রামকুমারবাবু পুনরপি কহিলেন, “কে তুমি উত্তর দাও, নতুবা মৃত্যু নিশ্চয়।” আগন্তুক কহিলেন, “মহাশয়, আপনি যাকে চান, আমি সেই লোক।”
“কিরূপে তুমি এখানে আসিলে?”
“সম্মুখদ্বার মুক্ত ছিল।”
“মিথ্যা কথা, তুমি তস্কর।”
“বেশ ত, তাতেই বা ক্ষতি কি, আপনি ত জাগ্রত আছেন। শুধু জাগ্ৰত নয়, সশস্ত্রও আছেন।”
“কি অভিপ্রায়ে এসেছ? দূর হও।”
“তস্কর কোন্ অভিপ্রায়ে প্রবেশ করে?”
“এখন তামাসার সময় নয়, শীঘ্র বল, নতুবা আমি তোমাকে গুলি করতে সঙ্কুচিত হব না।” ‘মহাশয়ের গুলি করবার পূর্ব্বে যদি মহাশয় আহত হন?”
“দুরাত্মা, দস্যু তুমি!”
“হাঁ আমি ডাকাত, আমাদের সর্দ্দার আপনার গৃহে ডাকাতি করবার অভিপ্রায়ে এই পত্ৰ দিয়েছেন।”
“দেখি, কই দাও।”
বলিষ্ঠ যুবক একখানি পত্র বাহির করিলেন। রামকুমারবাবু দক্ষিণ হস্তে নিজ পিস্তল আগন্তুকের বক্ষলক্ষ্যে ঠিক রাখিয়া বাম হস্তে পত্র গ্রহণ করিলেন। কহিলেন, “কে পাঠাইয়াছে?”
“এই মাত্র ত বল্লেম; পড়ে দেখুন।”
রামকুমারবাবু জানিতেন যে, গুপ্ত দস্যুগণ সহজে বা সহসা নিজ নিজ অভীষ্টসিদ্ধ করিতে না পারিলে, তাহারা তাহাদিগের অভিপ্রেত লক্ষ্য ব্যক্তিকে অন্যমনস্ক করিবার কৌশল অবলম্বন করে, তদ্ধেতু তিনি নিজ পিস্তল পূর্ব্বমত প্রস্তুত রাখিয়া মনে মনে পাঠ করিলেন।
পত্র পাঠ সঙ্গেই তাঁহার মনের গতি পরিবর্ত্তিত হইল, এককালে তিনি আগন্তুকের হস্তদ্বয় ধারণ করিলেন।
প্রেরিত পত্রে লিখিত ছিল;
“মহাশয়!
আপনার টেলিগ্রামের উত্তরে এই লোক প্রেরণ করিলাম। এই ব্যাক্তি দ্বারা আপনার আশাতীত উপকার হইতে পারে। আপনি সমস্ত পৃথিবী অনুসন্ধান করিলে এরূপ সুনিপুণ গোয়েন্দা আর পাইতে পারেন কি না তাহা সন্দেহ। এই ব্যক্তিকে আমার দক্ষিণ হস্ত বলিয়া জানিবেন; কোন গুরুতর কার্য্যে পড়িলে আমি ইহাকেই প্রেরণ করি এবং ইনি এ পর্যন্ত কখন যে বিষয়ে হউক, বিফলকাম হন্ নাই, আপনি সম্পূর্ণ রূপে বিশ্বাস করিতে পারেন এবং ইহার অভিমতে সকল কাৰ্য্য করিবেন।”
রামকুমারবাবু বিশেষ আনন্দ প্রকাশ করিয়া, আগন্তুকের হস্ত ধরিয়া কহিলেন, “মহাশয়ের নাম? নিবাস?”
“সঞ্জীবচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। নিবাস বৰ্দ্ধমান।”
“আমার বিষয় কিছু অবগত আছেন কি?”
“না। আমাকে যদি নিযুক্ত কয়েন, তবে একবার দেখতে পারি।”
“বেশ! এখন আপনি কি করতে চান?”
“আমি এখন আপনার মুখ হতে সব কথা শুনতে চাই। বলুন দেখি ব্যাপারটা কি?”
“ব্যাপার ভয়ানক; চুরি নয়, জাল নয়—খুন! আমার কন্যাকে খুন করেছে, লাশ অবধি সরিয়েছে।”
“কখন?”
“গত শনিবার রাত্রে নয়টার পর।’ এই সঙ্গে রামকুমারবাবু বিবাহের ও দেবিদাসের কথা উক্ত করিলেন।
স। দেবিদাসের বাড়ী কোথায়, তার কে কে আছে?
রা। কেহই নাই, নিতান্ত শিশু অবস্থায় পিতৃমাতৃহীন হয়, আমার শ্বশুর মহাশয় কর্তৃক প্রতিপালিত হয়। তিনি দেবিচরণকে পুত্রের ন্যায় ভালবাসিতেন।
স। তাঁর নাম কি, নিবাস কোথায়?
রা। ঘনশ্যাম মুখোপাধ্যায়। ভবানীপুর; তাঁরই বাটীতে দেবিচরণ থাকে।
স। তাঁর কতদিন মৃত্যু হয়েছে?
রা। বেশী দিন নয়—তিন মাস। তাঁর মৃত্যুর পূর্ব্বে তিনি এক উইল করেন।
স। সে উইলের মর্ম্ম কি, আপনি জানেন?
রা। বেশ জানি, সে উইল আমার কাছে আছে; দিনের বেলা হ’লে দেখাতে পারতেম। তিনি দেবিচরণকে বড় ভালবাসিতেন, সে কথা পূৰ্ব্বেই আপনাকে আমি বলেছি, আমার কন্যাকেও তিনি তদপেক্ষা কম ভাল বাসিতেন না। তাঁর বার্দ্ধক্যের স্নেহ এই দুই জনেই অধিকতর লাভ করেছিল। তিনি দেবিচরণের সঙ্গে তাঁহার দৌহিত্রী—আমার কন্যা বিমলার বিবাহ দিতে বড় উৎসুক ছিলেন, তাই মৃত্যু পূর্ব্বে এই মর্ম্মে উইল করেন যে ওদের বিবাহ কার্য্য সমাধা হ’লে তাঁর অতুল সম্পত্তি দ্বিভাগ করে দুজনে অধিকার করবে; অর্দ্ধাংশ দেবিচরণ,— অর্দ্ধাংশ আমার কন্যা বিমলা। আর দু একটা মাসিক ব্যবস্থা আছে সে সামান্যই।
স। আর যদি এ বিবাহ না ঘটে, কিম্বা উভয়ের মধ্যে কেউ এ বিবাহে অস্বীকার করে?
রা। যে অস্বীকার করবে, সে সমস্ত বিষয়ের সিকি অংশ মাত্ৰ পাবে।
স। আচ্ছা উভয়ের মধ্যে কাহারও যদি বিবাহের পূর্ব্বে মৃত্যু হয়।
রা। যে জীবিত থাকবে তার সমস্তই।
স। আচ্ছা উভয়ের মধ্যে কিরূপ সম্প্রীতি ছিল, জানেন?
রা। তা ছিল, কিন্তু গত রাত্রের ঘটনা হতে আমার সে অন্ধ বিশ্বাস একেবারে দূর হয়েছে। স। না, দেবিচরণের উপর আমি কোন সন্দেহ করতে পারি না। আমার অনুমানে সে এ হত্যাকাণ্ডে আদৌ লিপ্ত নাই।
রা। সেই,—নিশ্চয়ই সেই, বিশেষ কারণ আছে।
স। কি বলুন?
রা। আমার গৃহে আমার একটী ভাগিনেয়ী আছে।
স। তার বয়স কত?
রা। প্রায় চতুৰ্দ্দশ হবে।
স। বিবাহ হয়েছে?
রা। না। গত দুই বৎসর আমি জমীদারি কার্য্য-সম্বন্ধে এত ঝঞ্ঝাটে ছিলাম, যে সংসারের কিছু দেখতে পারি নাই। এখন একস্থানে বিবাহের কথা ঠিক করেছি।
স। যাক্, মেয়েটার নাম কি? তার পিতামাতা জীবিত আছেন?
রা। নাম পরিমল; অতি শিশুকালে পিতৃমাতৃহীন হয়; প্রায় আট বৎসর গত হল পরিমলের পিতা সপরিবারে গঙ্গাসাগর যাত্রা করেন, পথে দারুণ দুর্যোগে নৌকাডুবি হয়, তাতে পরিমলের পিতা মাতার মৃত্যু হয়। একজন দাঁড়ী পরিমলকে উদ্ধার করে। পরিমল আমার কাছে সেই অবধিই আছে।
স। ইহার মধ্যে বিশেষ কারণটা কি আছে, বলুন দেখি?
রা। প্রায় তিন সপ্তাহ গত হইল, একদিন দেখলেম আমার কন্যা বিমলা একজন হিন্দুস্থানী ভিক্ষুককে নিজ করকোষ্ঠী দেখাচ্ছে; আমি পাশের গৃহে ছিলেম, তাদের সকল কথাই বেশ স্পষ্ট শুনতে পেয়েছিলাম। হিন্দুস্থানীটা বল্লে যে, ‘দেবিচরণ অন্য রমণীর প্রণয়ে আবদ্ধ; তুমি (বিমলা) তার আশা ত্যাগ কর। তোমাদের বাড়ীতে শীঘ্রই একটা ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটিবে।’
স। (রামকুমারবাবুর মুখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া) যাক্–ও কথা যাক্—দেবিচরণ যে অন্য রমণীর প্রণয়ে আবদ্ধ সে রমণীটা কে?
রা। সে ওই পরিমল।
স। পরিমল কিনা, সে কি প্রকারে জানলে? যে এমন নাম ধরে গণে বলে দিতে পারে— তার ভিক্ষাবৃত্তি কেন?
রা। সে কি প্রকারে জেনেছিল—তা সে ব’লে গেছে। সে একদিবস আমাদের উদ্যানে দেবিচরণকে পরিমলের সঙ্গে এক স্থানে বসে থাকতে দেখেছিল—আর উভয়ের প্রণয়দৃঢ়তার প্রতিজ্ঞাও শুনেছিল। তার মাঝে দেবিচরণকে এ কথাও বলতে শুনেছিল যে, যদি বিমলা কন্টক ঘুঁচে, তবে আমরা অতুলৈশ্বর্য্যের অধিপতি হব।
স। কোন দিন সে দেখেছিল—তা, কিছু বলেছে?
রা। হাঁ—বলেছিল বটে—কিন্তু—সেটা ঠিক মেলে নাই—তখন দেবিচরণ আমার সঙ্গে কোন কাৰ্য্যবশতঃ মুর্শিদাবাদে গিয়েছিল। কিন্তু যাই হ’ক—আমি জোর করে বলতে পারি—এটা ছাড়া আর সকলই অতি সত্য।
স। সকল কথাই মিথ্যা—এ কথা আমিও বেশ জোরের সহিত বলতে পারি। মহাশয়! আপনি বড় অধৈর্য্য হয়ে পড়েছেন দেখছি; আপনার অমূলক সন্দেহ দূর করুন। আর দেখুন—যে ব্যক্তি আমাদিগকে কার্য্যভার অর্পণ করে, সে যদি আমাদিগের উপর আপনার ন্যায় স্বেচ্ছাচারী হয়—তার বিষয়ে আমরা কিছু করে উঠতে পারি না। যা বলি তা শুনুন; আমি যা জিজ্ঞাসা করি, তার উত্তর দিন। বিশেষতঃ আপনি নিদোষী দেবিচরণকে যে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছেন—তারপর রহস্যোদ্ভেদ হ’লে আপনাকে সে জন্য অনুতাপ করতে হবে।
রা। আপনি বিরক্ত হচ্ছেন কেন? আমার আরও প্রমাণ আছে, যাতে আপনিও আর আমার কথার প্রতিবাদ করতে পারবেন না।
স। (হাস্য করিয়া) তবে আর কি মহাশয়—আপনিত এক প্রকার কার্য্য শেষ করেছেন-বোধ করি আমাকে আর আবশ্যক হবে না।
রা। না না—আপনাকে আবশ্যক আছে বই কি?
স। কোন্ কাৰ্য্যে?
রা। দেবিচরণকে গ্রেপ্তার করা—তার এ গুপ্তকাণ্ডের রহস্যভেদ করা।
স। সে আমার ক্ষমতাতীত—আপনারও। আমি বেশ জানি সে ব্যক্তি সম্পূর্ণ নিদোষী। রা। কিসে জান্লেন?
স। সে কথা আপনাকে আমি বলতে পারি না—যেটুকু আপনাকে জানাবার—সেইটুকুই জানালেম। আপনি বৃথা সন্দেহ করছেন।
রা। আমার এ সন্দেহ নয়—নিশ্চয় জানিবেন। আমি এতদূর মুর্খ নই যে একজন নিদোষীকে সন্দেহের বশে দোষী বলব। আপনি আমার সঙ্গে আসুন—যে ঘরে এ কাণ্ড হয়েছে—একবার সেই ঘরে চলুন।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ – ক, খ, গ, ঘ, ঙ
সঞ্জীববাবুকে সঙ্গে লইয়া রামকুমারবাবু উঠিলেন। আলোক হস্তে তিনি সঞ্জীববাবুর অগ্রে অগ্রে চলিলেন। তখনও প্রকৃতির তুমুল বিপ্লব চলিতেছিল–ঝটিকান্দোলিত পাদপশ্রেণী গভীর শব্দে মর্ম্মকাতরতা প্রকাশ করিতেছিল।
গৃহে প্রবেশমাত্র সঞ্জীববাবু কিয়ৎকালের জন্য স্তম্ভিত হইলেন, পরে বেশ ধীরতার সহিত সকল পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিলেন। প্রথমতঃ ভিত্তি-বিলিপ্ত রক্তের ঘ্রাণ লইলেন—কি ভাবিয়া একটু হাসিলেন মাত্র।
শয্যার উপর একখানি রক্তাক্ত ছুরিকা পড়িয়া ছিল, তাহা পাঠকবর্গ অবগত আছেন; সেই ছুরিকাখানি দেখাইয়া রামকুমারবাবুকে বলিলেন—”এ ছুরিখানা কি পূর্ব্বাবধি এইরূপ ভাবেই পড়িয়া আছে—না আপনি রেখেছেন?”
“না—ঠিক ওই স্থানে ছিল—এখনও আছে—কেহই উহা স্পর্শ করে নাই—আমিও না।” তখন সঞ্জীববাবু নিবিষ্টচিত্তে ছুরিকা কিরূপ ভাবে পড়িয়া আছে দেখিয়া, নিজ হস্তে তুলিয়া লইলেন এবং তাহাতে যে রক্ত মাখানো ছিল—তাহা ভাল করিয়া দেখিতে লাগিলেন।
রামকুমারবাবু দৃঢ়তার সহিত কহিলেন—”কেমন মহাশয়?”
স। আপনি কি এই ছুরিখানি চিনেন?
রা। উত্তমরূপে চিনি।
“কার? দেবিচরণের?”
“দেবিচরণের।”
“নিশ্চয়?”
“নিশ্চয়।”
“বেশ কথা; যদিও তার নামটী ছুরি হতে ঘসে অনেকটা তুলে ফেলা হয়েছে। তবুও এই ছুরিখানিতে আমি দেবিচরণের সম্পূর্ণ নির্দোষীতার প্রমাণ পেলেম।”
“কি বল্লেন,–এ ছুরিখানাও তার নির্দোষিতার প্রমাণ হ’ল? কখনই না—এ কথা আমি ও কখনই বিশ্বাস করতে পারি না—এ ছুরি সে পাষণ্ডের পাপের, খুনের—পাষণ্ডপনার প্রত্যক্ষ ও জ্বলন্ত প্রমাণ।”
সঞ্জীববাবু “তা যাই হোক” বলিয়া সেই পালঙ্কের নিম্নে হামাগুড়ি দিয়া প্রবেশ করিলেন। তাঁহার নিকটেই নিজের অক্ষ (Focus) বিশিষ্ট লণ্ঠান ছিল, তাহা বাহির করিয়া শয্যার নিম্নাংশ বিশেষ করিয়া দেখিতে লাগিলেন।
পশ্চিম অংশে যে গবাক্ষ উন্মুক্ত ছিল—তাহার বহিদিকস্থ আলিসায় দেখিলেন কাহার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদচিহ্ন রক্তদ্বারা বহিঃরেখাঙ্কিত হইয়া রহিয়াছে। নিজ অঙ্গুলি দ্বারা সে পদচিহ্নগুলি মাপিয়া লইলেন, শেষে সমস্ত রক্তসিক্ত শয্যা উল্টাইয়া ফেলিলেন, শয্যানিম্নে একখানি ছিন্নপত্র ছিল— গ্রহণ করিলেন। লণ্ঠানের তীক্ষ্ণরশ্মি দেয়ালে ফেলিয়া দেখিলেন—তাহাতেও রক্তের ছিটা স্থানে স্থানে লাগিয়াছে। তাহা দেখিয়া উচ্চশব্দে না হাসিয়া থাকিতে পারিলেন না।
রামকুমারবাবু জিজ্ঞাসিলেন;–”মহাশয়ের এ হাসির কারণ কি?”
সঞ্জীববাবু “মহাশয়ের মত-অনুকুলে আর একটা প্রমাণ প্রাপ্ত হয়েছি।” বলিয়া ছিন্ন পত্রখানি দেখাইলেন। সে পত্রের উপরি ভাগের ও এক পার্শ্বের কতকটা নাই এইরূপ লিখা ছিল,
“জানি না। এখনও তুমি বিবাহে অস্বীকা
যাইব। আমি তোমাকে পূৰ্ব্বে বলি
কি হইবে দেখিবে যদি জীবনের আশা ক
আমাকে বিবাহ করিলে নিশ্চয় তু
এখনও আমার কথা শোন নতুবা থু
করিব। তোমার পিতা আমাকে অনে
আজন্ম দুঃখিনী হইবে, আমার নাম দিলা
বুঝিতে পারিয়াছ, খুন করিব তাই নাম ে
আর কি; তোমার সহিত আমার ে
ক, খ, গ, ঘ, ঙ,
সাং পাঠশালা।
পত্রপাঠ মাত্র রামকুমারবাবু “কি ভয়ানক—কি ভয়ানক—নরাধম পিশাচ—নরকে স্থান হবে না!” বলিয়া চীৎকার করিয়া উঠিলেন।
সঞ্জীববাবু কহিলেন, “মহাশয়—এত অধীর হবেন না—আমি যা জিজ্ঞাসা করি উত্তর দিন।”
“কেমন মহাশয়, এখন দেখলেন—কি ভয়ানক ব্যাপার!”
“যাক্ সে পরে হবে—আচ্ছা, আপনার ভাগিনেয়ী কি খৰ্ব্বাকৃতি?”
“আপনি কিরূপে জানলেন—তাকে দেখেছেন কি?”
“না—আমি কোন বিষয়ে অনুভব করেছি মাত্র।” সেই ক্ষুদ্র পদচিহ্নের কথা গোপন রাখিলেন।
“হাঁ আপনি যথার্থ অনুভব করেছেন—আপনি কি পরিমলকেই সন্দেহ করছেন?”
“কাহাকেও না—এখনও আমি কাহাকেও কোন সন্দেহ করতে পারি না—করতেও চাহি না— কাজে চাই। কিন্তু আমি এ গভীর রহস্যভেদ করবার জন্য প্রাণ অবধি পণ করলেম্। আপনি কি এখন শয়ন করবেন, না আমার সঙ্গে যাবেন?”
“কোথা যাবেন আপনি?”
“আপনার কন্যা বিমলার অনুসন্ধানে যদি আমার সঙ্গে যেতে ইচ্ছা করেন—তবে আসুন।” এই বলিয়া পশ্চিম পার্শ্বস্থ গবাক্ষ দিয়া আম্রবৃক্ষ বহিয়া সঞ্জীববাবু উদ্যানে নামিলেন।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ – পুষ্করিণীর তটে
সঞ্জীববাবু উদ্যানের দক্ষিণাংশে ক্রমাগত চলিলেন। রামকুমারবাবু অল্পক্ষণ পরে আসিয়া তাঁহার সঙ্গী হইলেন। তখন আকাশ পরিষ্কার হইয়াছে—একখানিও মেঘ নাই, ঝড়, বৃষ্টি, বিদ্যুদ্বিকাশ—কিছুই নাই; প্রকৃতি বেশ শান্তভাব ধারণ করিয়াছে। ধরণীর সীমান্ত হইতে দূরসীমান্তে সীমান্তে যে ভীষণ প্রভঞ্জন ছুটিতেছিল, তাহা এখন স্নিগ্ধ মৃদুসমীরণে পরিণত হইয়াছে। মধ্যে মধ্যে তরুলতাগণ পত্রসঞ্চিত জলবিন্দু সমীরান্দোলিত হইয়া সশব্দে নিক্ষেপ করিতেছে। স্বচ্ছ নীলিমার বুকে অনেক ধৌত প্রস্ফুটিতজ্যোতিঃ নক্ষত্র ফুটিয়াছে। সে বিশ্বপ্লাবী গাঢ়-অন্ধকারের বহু পরিমাণেই হীনতা ঘটিয়াছে।
উভয়ে কিয়দ্দূর অগ্রসর হইয়া একটা পুষ্করিণীর নিকটস্থ হইলেন। দূর হইতেই সঞ্জীববাবু নিজ লণ্ঠানের তীক্ষ্ণ রশ্মিমালা সরোবরের আঁধারবুকে নিক্ষেপ করিলেন; কি দেখিয়া স্থির হইয়া দাঁড়াইলেন!
রামকুমারবাবুও দাঁড়াইলেন, জিজ্ঞাসিলেন;–”মহাশয়! অমন ক’রে সহসা দাঁড়ালেন যে?” স। যদি না অধীর হন, কিছু আপনাকে দেখাতে পারি।
রা। (সভয়ে) আমার কন্যার মৃতদেহ নাকি?
স। যদি না আপনি অধৈর্য্য হ’য়ে পড়েন, এক ভয়ানক সামগ্রী দেখাতে পারি।
রা। সে জন্য চিন্তা নাই, সকলি আমি অবশ্য সহ্য করিব।
স। এই লণ্ঠানের আলোক ধ’রে বরাবর চেয়ে দেখুন দেখি।
রামকুমারবাবু চাহিয়া দেখিলেন,—পুষ্করিণীর তটস্থ জলপার্শ্বে কি চিক্মিক্ করিয়া জ্বলিতেছে। বলিলেন,–”জিনিসটা কি?”
সঞ্জীববাবু তন্মুহূর্তে তট হইতে একটী ছিন্নহস্ত তুলিয়া আনিলেন, হস্তটী যে কোন রমণীর, তাহা বেশ বুেঝা যাইতেছে। অনামিকায় একটী হীরকাঙ্গুরী ছিল। তদ্দর্শনে রামকুমারবাবুর মুখে কথা ফুটিল না–থর্ থর্ করিয়া চলদলপত্রের ন্যায় কাঁপিতে লাগিলেন, বিস্ফারিত, নিষ্পলক নেত্রে চাহিয়া রহিলেন। রুদ্ধশ্বাস হইয়া বসিয়া পড়িলেন।
সঞ্জীববাবু বলিলেন, “এখন এমন করলে চলবে না, আমি ত পূৰ্ব্বেই আপনাকে বলেছি, এবং সতর্ক করেছি। আমার কথা শুনুন, একেবারে হতাশ হবেন না; আপনি জানবেন—আমি আপনাকে মিথ্যা প্রবোধ দিতেছি না, এর মধ্যে অনেক ষড়যন্ত্র আছে। এই ছিন্নহস্ত পাইয়া আমার বেশই সুবিধা হয়েছে।
রামকুমারবাবুর মর্ম্মভেদ করিয়া যেন কথা কয়েকটী বাহির হইল, “সঞ্জীববাবু, আপনি সব খুলে বলুন, চেপে রাখবেন না, আমার প্রাণের ভিতর কি হচ্ছে,—তা আপনি কি বুঝবেন?”
স। আমি সকল দিকে না সুবিধা করলে, আপনাকে কি ক’রে আমার কথা বুঝাব; আর আপনিও কিছু বুঝতে পারিবেন না।
রা। এখন কি হবে?
স। কিসের কি হবে?
রা। হতভাগিনী বিমলার খণ্ড বিখণ্ড মৃতদেহ এই পুষ্করিণীর মধ্যে পতিত আছে; এখন সে সকল তুলে ফেলতে হবে। সঞ্জীববাবু, আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি আমার ভৃত্যদের দু’চার জনকে ডেকে আনি।
স। কোন প্রয়োজন নাই, আপনি কি জানেন, এ পুষ্করিণীর মধ্যে আপনার কন্যার মৃতদেহ আছে?
রা। আপনি কি বলেন?
স। কেবল এই হাতখানা ব্যতীত এখানে আর কিছুই নাই।
রা। আর কোথায় থাকবে?
স। আমি তার সন্ধান করবো।
রা। আপনি কি পূর্ব্বে—জানতেন যে, এই হাতখানা এখানে ছিল।
স। না।
রা। তবে কি করে জানলেন যে, বিমলার শবদেহ এখানে নাই? স। সে কথা পরে বলবো।
এমন সময় সঞ্জীববাবুর কর্ণে কাহার মৃদু পদধ্বনি প্রবেশ করিল।
স। আপনি কিয়ৎক্ষণ অপেক্ষা করুন, আমি এখনি আছি, আমি যতক্ষণ না আসি, অন্য কোন স্থানে যাবেন না।
রা। (চুপি, চুপি) কোথায় যাবেন এখন?
“বেশী দূর যাব না, এই উদ্যানের মধ্যেই থাকবো,—খুব সাবধান, আপনি এই বৃক্ষটীর পশ্চাদ্দিকে বসে থাকুন।”
“ভয়ের কারণটা কি—আমি ত কিছুই বুঝতে পাচ্ছি না।”
“যা বল্লেম, তা শুনুন, – মনুষ্যের বিপদ পদে পদে; কে জানে কোথা দিয়ে, কখন, কেমনে বিপদ এসে উপস্থিত হয়?”
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – এ রমণী কে?
রামকুমারবাবুকে তথায় রাখিয়া সঞ্জীববাবু ক্রমশঃ উদ্যানের উত্তর দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলেন।
প্রিয় পাঠক পাঠিকাদিগের সঞ্জীববাবু সম্বন্ধে একটী কথা বোধ হয় জিজ্ঞাস্য হইতে পারে—যে তিনি এত প্রমাণ সত্ত্বেও দেবিদাসকে দোষী বলিয়া মনে করিতেছেন না কেন? বিশেষ কারণ আছে—সঞ্জীববাবু বেহালায় আসিয়াই অগ্রে গ্রামস্থ অন্যান্য লোকের নিকট হইতে কতক কতক সন্ধান লইয়াছিলেন। একবার রামকুমারবাবুর বাটীতে অলক্ষ্যে প্রবেশ করিয়া এদিক ওদিক দেখিয়া শেষে দেবিদাসের উদ্দেশে ভবানীপুর যাত্রা করেন। পরে অভিপ্রেত স্থানে গিয়া দেখিলেন; দেবিদাস বহির্ব্বাটীতে বসিয়া কি ভাবিতেছেন। এক একবার দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া এদিক ওদিক চাহিতেছেন। সঞ্জীববাবু তাঁহার সঙ্গে অন্যান্য প্রসঙ্গে দুই চারিটী কথা তুলিলেন। দেখিলেন, তাঁহার সেই নিৰ্ম্মল মুখে পাপের কোন কলঙ্করেখা নাই, সে মুখমণ্ডল সরলতাপূর্ণ—পবিত্রতাসজীব- নিষ্কলুষতাদেদীপ্যমান।
সঞ্জীববাবু কোন পুরুষের কিম্বা স্ত্রীলোকের মুখ বারেক দেখিবামাত্র তাহার চরিত্র তাহার মুখে, নয়নে স্পষ্ট দেখিতে পাইতেন।
.
উদ্যানের উত্তরাংশে (যে দিকে রামকুমারবাবুর শয়নগৃহ) সঞ্জীববাবু অনেক দূর চলিলেন। প্রায় পুষ্করিণী হইতে একশত হস্ত অগ্রসর হইয়া দেখিলেন, একটী রমণী ক্রমশঃ তাহাকে পশ্চাতে ফেলিয়া দ্রুত চলিতেছে, এক একবার পশ্চাদ্দিকে ফিরিয়া দেখিতেছে।
রমণীর মুখমণ্ডল শুভ্রবসনাবগুণ্ঠনাবৃত, বিমুক্তকৃষ্ণালকা বসনাভ্যন্তর হইতে নিতম্ব-সন্নিধানে অগ্রভাগ বাহির করিয়া দুলিতেছে।
সঞ্জীববাবু পূৰ্ব্বাপেক্ষা দ্রুত অনুসরণ করিলেন। কিন্তু কিছুতেই তাহার নিকটস্থ হইতে পারিলেন না। যে ব্যবধান পূর্ব্বে উভয়ের মধ্যে পড়িয়াছিল, তাহাই রহিল। অবশেষে রমণী অস্তমিতরবির হিরণ্ময়ী রশ্মিমালার শেষ মুহূর্ত্তের অস্তিত্বের মত কোথায় মিলাইল, দেখিতে পাইলেন না। নিরস্ত হইলেন না, চলিলেন। আরও কিছুদূর গিয়া দেখিলেন, একস্থানে কৰ্দ্দমিত উদ্যানপথে কাহার পদচিহ্ন রহিয়াছে। তিনি সহজেই অনুভব করিয়া লইলেন, এই পদচিহ্নগুলি অচিরপ্রস্থিতা ছায়ারূপিণী সেই রমণীর। অঙ্গুলি দ্বারা মাপিয়া দেখিলেন, হত্যাগৃহে যে চরণ চিহ্ন দেখিয়াছিলেন, সে সঙ্গে ঠিক মিলিল। মনে দারুণ সন্দেহ হইল—রমণী কে?
তিনি রামকুমারবাবুর বাটীর চতুৰ্দ্দিক দুইবার ঘুরিয়া দেখিলেন—কোথায় কোন গৃহে আলো নাই। কেবল পূৰ্ব্বপার্শ্বস্থ কোন প্রকোষ্ঠে একটী স্তিমিত দীপ জ্বলিতেছিল; তাহার ক্ষীণালোক মুক্ত গবাক্ষদ্বার দিয়া নীচের একটী বৃক্ষশিরে আসিয়া পড়িয়াছে। গবাক্ষসংলগ্ন ভূমিচুম্বিলৌহনল বহিয়া, তিনি সেই ক্ষীণালোকপূর্ণ গৃহাভ্যন্তরে প্রবিষ্ট হইলেন। প্রীতিবিস্ফারিত নয়নে দেখিলেন, একটী বালিকা, শুভ্র শয্যোপরে একাকিনী গভীর নিদ্রায় নিদ্রিত। রাজীবমুখমণ্ডল, যেন শ্বেত, তটিনিনীরে কে উৎপল ভাসাইয়া রাখিয়াছে। সুকৃষ্ণ ভ্রূযুগলের কর্ণপ্রান্ত অবধি সুদীর্ঘ বিস্তার কৃষ্ণকেশরাশি পরিস্কৃত, শুভ্র উপাধানে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত রহিয়াছে। নিদ্রা-শিথিল মৃণালবৎ হস্তযুগ বক্ষোপরি রক্ষিত। করাঙ্গুলিগুলি ঈষদ্বিকুঞ্চিত; কে যেন কুসুমবেদীর উপর চম্পককলির ক্ষুদ্র গুচ্ছদ্বয় সযত্নে রাখিয়াছে। নিশ্বাস প্রশ্বাসে অল্প নড়িতেছে—দুলিতেছে। কিয়ৎক্ষণপরে সেই নিদ্রিতা বালিকা চক্ষু ঈষদুম্মীলনে পাশ ফিরিল, যেন পূর্ণিমার স্বচ্ছাকাশে শুভ্র শ্বেত জোছনাবক্ষে বারেক তড়িদ্বিকাশ হইল; দেখিয়া সঞ্জীববাবু মুগ্ধ হইলেন। সহজেই বুঝিলেন এই নিদ্রিতা সুন্দরীই পরিমল। তখন সহসা তাঁহার মনে দেবিদাসের উপর কিছু সন্দেহ হইল; কিন্তু পূৰ্ব্বকথা স্মরণ মাত্রে সে সন্দেহ দূরীভূত হইল। রমণীর পার্শ্ববিক্ষিপ্তবসনাদি পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন, কোন অংশ ভিজা নহে। পদদ্বয় দেখিলেন শুষ্ক—অকদম—পরিস্কৃত। মাপিলেন—পূর্ব্বাপেক্ষা পরিমাণে অর্দ্ধাঙ্গুলি ন্যূন। অকৃতকাৰ্য্য হইয়া, পূৰ্ব্বপথ ধরিয়া, অবতরণ করিয়া পুষ্করিণীর দিকে চলিলেন। মনে নানাপ্রকার কথা তোলাপাড় করিতে লাগিলেন, “পরিমল যে এ রাত্রে বাহির হইয়াছিল তাহার ত কোন প্রমাণ পাইলাম না। তবে সে রমণী কে? সে যেই হোক, তার মনে যে বিশেষ দুরভিসন্ধি আছে, সন্দেহ নাই। আমাকে ক্রমেই এক রহস্য হইতে আর এক গভীর রহস্যে পড়িতে হইতেছে; কিন্তু আমি সহজে ছাড়িব না।” এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে নিষ্ফল মনোরথ হইয়া রামকুমারবাবুর নিকটে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, রামকুমারবাবুর শঙ্কাসঙ্কুচিত হইয়া সেই বৃক্ষপার্শ্বে নীরবে বসিয়া আছেন। জিজ্ঞাসিলেন, “কোন ব্যাক্তিকে কি এখান দিয়ে যাইতে দেখিয়াছিলেন? কোন শব্দ শুনেছিলেন?”
“না।”
“তাইত।”
“আপনি কি সন্দেহে একথা বলছেন?”
“না; কিছু না। তবে এইমাত্র আমি বড় প্রতারিত হয়েছি।”
সপ্তম পরিচ্ছেদ – এরা কে?
সঞ্জীববাবুর কথা শেষ হইতে না হইতে রামকুমারবাবুর কর্ণের পার্শ্ব দিয়া সাঁ করিয়া একটা কি চলিয়া গেল। দূর হইতে পিস্তলের শব্দও সেই সঙ্গে কর্ণরন্ধ্রে প্রবেশিল। অল্প পরেই আর একটা শব্দ আসিল—বোধ হইল কে যেন দূরস্থ কোন বৃক্ষ হইতে লাফাইয়া পড়িল।
সঞ্জীববাবু বলিলেন—”আপনি ঘাসের উপর শুয়ে পড়ুন, নয়—ফিরে যান, আজ আবার মৃত্যুর বিভীষিকা আপনার অনুসরণ করছে। আমায় এখনি এস্থান ত্যাগ করতে হবে।
রা। না। আমি এখন এখানে থাকিব।
স। আপনি এখানে এখন একা থাকতে ভরসা করেন?
রা। নতুবা আমি আপনার সঙ্গে যাব।
স। না, তাহ’লে আমার কোন কাজ হবে না।
রা। তবে আমি এইখানেই থাকি।
স। খুব সাবধান, আপনার কাছে পিস্তল আছে?
রা। আছে।
যে দিক দিয়া শব্দ আসিয়াছিল, সঞ্জীববাবু সেই দিকে চঞ্চল চরণে। চলিলেন। বামহস্তে একখানা বৃহৎ ছুরিকা লইলেন; দক্ষিণ হস্তে পিস্তলটী ঠিক করিয়া ধরিলেন।
.
কিছু দূর যাইয়া নক্ষত্রালোকে সঞ্জীববাবু দেখিলেন, বৃক্ষমূলে তিন জন বসিয়া কি কথা কহিতেছে। আর একজন তাহাদিগের মধ্যে মাটিতে পড়িয়া ছট্ ফট্ করিতেছে—গ্যাঙাইতেছে। তাহাদিগের কর্তাবার্তা শুনিবার জন্য সঞ্জীববাবু একটী অনতিদুরস্থ বৃক্ষমূলপার্শ্বে দাঁড়াইলেন।
একজন তাহাদিগের ভিতর হইতে বলিল, “বেটা, মারবি কোথায়, না নিজেই গাছ থেকে পড়ে মরলি!”
যে রক্তাক্ত হইয়া ধুলায় লুটাইতেছিল, গ্যাঙাইতে গ্যাঙাইতে বলিল, “বাপরে গেলুম,— আ—মি—আর—বাঁচ—বো—না,—”
একজন বলিল,–“হিরু চল, এই বেলা একে ধরাধরি ক’রে নিয়ে যাই।”
হি। আর নিয়ে গিয়ে কি হ’বে? দেখছিস না—মাথাটা দুফাক্ হ’য়ে গেছে; এখনি মরে যবে; অত উঁচু থেকে পড়েছে।
উত্তরে সে ব্যক্তি বলিল, “মলেও নিয়ে যেতে হবে, বাঁচলেও নিয়ে যেতে হবে, নৈলে শেষে এক ফ্যাসাদ বেঁধে যাবে। আর চণ্ডীতলার ভাঙ্গাবাড়ী এখান থেকে কত দূরই বা হবে।”
হি। তাইত—এক করতে গিয়ে আবার এক কাণ্ড হয়ে যাবে; বাগানের ওদিকে একটা ডোবা আছে—তাতে ফেলে আসি আয়।
সেই ব্যাক্তি। না, না,—আমার কথা শোন্–বুঝিস্ ত ভারি।
এই বলিয়া সকলে আহত ব্যক্তিকে ধরাধরি করিয়া তুলিয়া কিয়ৎদূর অগ্রসর হইল।
এমন সময় সঞ্জীববাবু বৃক্ষান্তরাল হইতে নিজ পিস্তলের শব্দ করিলেন, সভয়ে বাহকেরা (হিরু ও সঙ্গীদ্বয়) সেই আহত ব্যক্তিকে সশব্দে ভূতলে ফেলিয়া উর্দ্ধশ্বাসে পলায়ন করিল। যদিও সঞ্জীববাবু চেষ্টা করিলে তাহাদিগকে ধরিতে পারিতেন; কিন্তু এখন আবশ্যক. বোধ করিলেন না। নিকটস্থ লণ্ঠানের তীক্ষ্ণরশ্মি উন্মোচন করিয়া দেখিলেন; হতভাগ্যের মৃত্যু হইয়াছে। তিনি সেই মৃতদেহ ক্রমশঃ পুষ্করিণীর দিকে টানিয়া লইয়া চলিলেন।
সঞ্জীববাবুর হস্তে লণ্ঠান থাকায় রামকুমারবাবু সহজে তাঁহাকে চিনিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, কি হয়েছে?
মৃতের মুখে লণ্ঠান ধরিয়া কহিলেন, “এ ব্যক্তিকে আপনি চিনেন বা কখন দেখেছেন?”
রামকুমারবাবু প্রথমে দেখিয়া ভীত হইলেন; পরে প্রকৃতিস্থ হইয়া কহিলেন,–-“না—চিনি না—কখন দেখিও নাই।”
“বেশ করে দেখুন। আর কখন দেখেছেন কি না।”
“না—আমি একে পূৰ্ব্বে কখনও দেখি নাই—কিন্তু মুখখানা কিছু দেবিচরণের মতন দেখতে।”
“সে কথা যাক্—দেখেছেন কি না বলুন।”
“না—একে খুন করলে কে?”
সঞ্জীববাবু সকল বৃত্তান্ত বলিলেন।
রা। এখন এ শব কোথায় রাখবেন?
স। এইখানেই থাক্—সময় বিশেষে আমার কার্য্যে প্রয়োজন হবে।
উদ্যানস্থ নিকটবর্ত্তী একটা চাতালের খিলানের মধ্যে সেই মৃতদেহ ঢুকাইয়া দিলেন।
রা। এখন আপনি কি করবেন?
স। এখন কতকগুলি কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করবো।
তৎসন্নিধানস্থ সেই ছিন্নহস্ত হইতে হীরকাঙ্গুরীটী উন্মোচন করিয়া বলিলেন,–”আপনি কি এ অঙ্গুরী চিনেন?”
রা। চিনি বৈকি—আমার কন্যা বিমলারই।
স। বেশ করে দেখুন—আপনি উত্তমরূপ চিনতে পেরেছেন? আপনার কন্যার বয়স কত হবে?
রা। তের।
স। (সহাস্যে) বটে। তবে মহাশয়—আপনার এ হাত দেখে এত ভীত হবার কোন কারণ নাই; এ হাত আপনার বিমলার নয়।
রা। আপনি কি করে জানলেন?
স। আমি যে প্রকারেই জানি, সে কথা আপনাকে বলবো না; আমার কথা নিশ্চয় বলে জানিবেন। আর দেখুন জীবিত রমণীর শরীর হতে এ হাত কাটা হয় নাই, কোন মৃতা স্ত্রীলোকের হবে—ঠিক কাটা স্থান দিয়ে রক্ত নিঃসৃত হয় নাই, কে মাখায়েছে।
রা। এর কারণ কি?
স। এর কারণ আমরা এক ভয়ানক, কঠিন, দুর্ভেদ্য রহস্যের মধ্যে গিয়া পড়েছি।
রামকুমারবাবু ব্যগ্রতার সহিত কহিলেন—”আপনি কি মনে করেন, আমার কন্যা মরে নাই?”
স। অনেকটা সম্ভব বটে। এখন এ সন্দেহ বেশ সহজেই আমার মনে নিচ্ছে যে সে জীবিত আছে।
রা। (উদ্বেগে ও উদ্দেশে) “হা ঈশ্বর! এ সন্দেহ যেন সত্য হয়। হা ঈশ্বর!”
স। মহাশয়, উদ্বিগ্ন হবেন না—যে কালে আপনার কার্য্যে আমি প্রাণপণ করেছি, সেকালে একটা না একটা কিছু করে ছাড়ছি না। এর জন্য যত দিন গত হোক—যত বিপদের মুখে আমাকে প্রবেশ করতে হোক্—তা আমি কৰ্ব্বো।
রা। সে মহাশয়ের অনুগ্রহ।
স। অনুগ্রহ আর কি—আপনি কি অনুগ্রহ করে আমাকে বিশ্বাস করেন।
রা। করি, আপনার প্রত্যেক কার্য্যে আমার বিশ্বাস ক্রমেই বদ্ধমূল হচ্ছে।
স। যদি আমাকে বিশ্বাস করেন—তবে আমার কথা অবিশ্বাস করবেন না। আমি তিন দিনের মধ্যে আপনার জীবিত কন্যাকে আনয়ন করে আপনাকে অর্পণ কৰ্ব্বো।
রা। আপনি আমাকে বৃথা আশ্বাস দিচ্ছেন।
স। এ অভ্যাস আমার আদৌ নাই।
রা। তবে কি আমি বিমলাকে পাব?
স। খুব সম্ভব—যাতে পান তার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা কবো। আপনার বাড়ীতে পরিমল ভিন্ন আর স্ত্রীলোক নাই?
রা। চার জন দাসী আছে।
স। আপনার গৃহে তারা দিন রাত থাকে?
রা। না, তিনজন সন্ধ্যার পর চলে যায়—একজন রাত্রে থাকে।
স। যে দাসী রাত্রে থাকে, তার নাম?
রা। মঙ্গলা।
স। বয়স কত?
রা। পঞ্চান্ন ছাপ্পান্ন
স। (স্বগতঃ) তবে সে নয়।