প্ৰথম খণ্ড – অদৃষ্ট গণনা (জীবন্মৃত্যু )

জীবন্মৃত রহস্য (হিপ্‌নটিক্ উপন্যাস)

উৎসর্গ

শ্রদ্ধাস্পদ কবিবর
শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মহাশয় করকমলেষু

উপক্রমণিকা

রাত্রি গভীর, নিরন্ধকার, নির্নক্ষেত্র এবং নীরব। অতি দূরে দেবদারুশ্রেণীর অন্তরালে সূর্য্যোদয় হইয়াছে, এবং কোটী কোটী স্বর্ণকররেখা ধীরে ধীরে ধরণীর তৃণশ্যামল বক্ষঃ বেষ্টন করিতেছে। পাখীরা প্রভাতী গায়িতেছে; এবং এক শাখা হইতে অপর শাখায়, কখন এক বৃক্ষ হইতে অপর বৃক্ষে উড়িয়া বসিতেছে; এবং কোনটা উড়িয়া একেবারে অদৃশ্য হইয়া যাইতেছে। ক্রমে নির্মেঘ আকাশ রৌদ্রোজ্জ্বল, নিবিড় তরুশীর্ষ রৌদ্ররঞ্জিত, ক্রমে দিগদিগন্ত প্রস্ফুট ও সজীব হইয়া উঠিতে লাগিল; চাহিয়া চাহিয়া কিশোরীর বিস্ময়বিস্ফারিত চক্ষু নিমীলিত হইয়া গেল; তথাপি সে দেখিতে লাগিল, সেই অপূৰ্ব্ব দৃশ্য—সেই রৌদ্রময়ী রজনী—তারা নাই—মেঘ নাই—অন্ধকার নাই, এবং সূর্য্যের সেই স্বর্ণকিরণ দেবদারু-পত্রের অগ্রভাগ হইতে ঝরিয়া ঝরিয়া তাহার সুন্দর মুখমণ্ডলে পড়িতেছে। তাহার সর্ব্বাঙ্গ ব্যাপিয়া স্বেদশ্রুতি হইতে লাগিল—পরক্ষণে সংজ্ঞাশূন্য হইয়া সেখানে পড়িয়া গেল।

পার্শ্বে একজন কুৎসিতা যুবতী দাঁড়াইয়া ছিল, সে তাড়াতাড়ি তাহার মূর্ছিত দেহ নিজের কোলে টানিয়া তুলিয়া লইল। এবং মূর্ছিতার আপাদমস্তক হস্ত সঞ্চালন করিয়া মৃদুস্বরে কি একটা মন্ত্রপাঠ করিতে লাগিল।

অনতিবিলম্বে মূর্ছিতার মোহ অপনোদন হইল। সে ধীরে ধীরে নিদ্রোখিতের ন্যায় উঠিয়া বসিল। এবং বিস্মিত দৃষ্টিতে চারিদিকে চাহিতে চাহিতে কহিল, “জুলেখা, আমি কোথায়?”

জুলেখা পার্শ্ববর্তিনীর নাম। জুলেখা বলিল, “কেন, তোমাদের জাহিরায়। সেলিনা, অমন করিয়া চারিদিকে চাহিতেছ কেন, তোমার কি ভয় করিতেছে? এই যে আমি কহিয়াছি, ভয় কি?” সেলিনা জুলেখার মুখের দিকে চকিতনেত্রে একবার চাহিল। তাহার পর বলিল, “আমার এখানে বড় ভয় করিতেছে; চল, বাড়ীর ভিতরে যাই।”

“চল যাইতেছি,” বলিয়া জুলেখা সেলিনাকে ধরিয়া তুলিল।

সেলিনা কহিল, “আমার সর্ব্বাঙ্গ অবশ হইয়াছে; চলিব কি—উঠিয়া দাঁড়াইতে পা কাঁপিতেছে।”

জুলেখা বলিল, “যাহাতে জোর পাও, তাহা করিতেছি।”

পুনরায় জুলেখা, সেলিনার পা হইতে মাথা পর্যন্ত মন্ত্রপাঠের সহিত হস্ত সঞ্চালন করিতে লাগিল। এবং এক একবার তাহার কপালে নিজ বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের চাপ দিতে লাগিল। তাহার পর জিজ্ঞাসা করিল, “কেমন, এখন বেশ সুস্থ হইয়াছ?”

সেলিনা বলিল, “হাঁ, এখন আর আমাকে ধরিতে হইবে না—আমি নিজেই বেশ যাইতে পারিব।”

জুলেখা বলিল, “তবে চল।”

যাইতে যাইতে জুলেখা বলিল, “এখন কাঁউরূপীকে চিনিতে পারিলে? আমার কথায় আর অবিশ্বাস নাই?”

সেলিনা বলিল, “এ সব গুপ্তবিদ্যা তুমি কোথায় শিখিলে? তুমি পিশাচ-সিদ্ধ—তোমার অসাধ্য কৰ্ম্ম কিছুই নাই।”

জুলেখা বলিল, “সবই কাউরূপীর মহিমা—তিনি দিনকে রাত করিতে পারেন—রাতকে দিন করিতে পারেন; একটা প্রমাণ ত আজ দেখিলে।”

সেলিনা বলিল, “কাউরূপী কে?”

জুলেখা। দেবতা।

সেলিনা। না, অপদেবতা।

.

প্ৰথম খণ্ড – অদৃষ্ট গণনা (জীবন্মৃত্যু)

প্রথম পরিচ্ছেদ – বিবাহে বিপদ

বালিগঞ্জের একটী সুসজ্জিত স্নিগ্ধ বাংলোর মধ্যে বসিয়া চারিজন লোক প্রচুর হাস্য পরিহাসে, বিদ্রূপ কৌতুকে একদিন গ্রীষ্মের স্তব্ধ প্রভাত অতিবাহিত করিতেছিলেন।

তাঁহাদিগের এক জনের নাম, মিঃ আর্ দত্ত, ওরফে রাসবিহারী দত্ত। ইনিই এই সুরম্য উদ্যান-বাটিকার সত্বাধিকারী। তাঁহার বয়ঃক্রম পঞ্চাশ বৎসর হইবে। মাথার চুল অধিকাংশ শুভ্র। তাঁহার মুখাকৃতি ও কৃষ্ণচক্ষুর তীক্ষ্ণদৃষ্টি দেখিয়া সহজেই বুঝা যায়, তিনি এক জন উচ্চশ্রেণীর বুদ্ধিমান্

বাকী তিন জনের দুইজন দত্ত মহাশয়ের ভাগিনেয়। তদুভয়ের নাম অমরেন্দ্রনাথ মিত্র, এবং সুরেন্দ্রনাথ বসু। উভয়েই সমবয়স্ক। বয়ঃক্রম ত্রিশ বৎসরের বেশী নহে। অপর লোকটি একজন সাহেব, নাম মিঃ বেন্টউড। বেন্টউডের বয়ঃক্রম চল্লিশ বৎসর হইলেও তাঁহার মুখমণ্ডল যৌবনশ্রীযুক্ত। দেহ দীর্ঘ, সবল, সুস্থ, পরিষ্কৃত। তাঁহার দৃষ্টি, মুখ এবং মুখভাবের উপর যেন একটী ছদ্ম আবরণ সংলগ্ন আছে, এপর্য্যন্ত একবারও তাহা উন্মুক্ত করা হয় নাই, সুতরাং সে আবরণের স্থায়িত্ব সম্বন্ধে কেহ কখনও কোন সন্দেহ করিতে পারিত না। বরাবর এক ভাবেই লোকে তাঁহাকে দেখিয়া আসিতেছে। ‘চক্ষু হৃদয়ের দর্পণ স্বরূপ’ কথাটা এখানে একেবারেই খাটে না। যাহা হউক এই বেন্টউড সাহেব একজন উত্তম চিকিৎসক। স্বীয় পারদর্শিতায় তিনি অতি অল্প সময়ে সৰ্ব্বত্র প্রসিদ্ধি ও যশঃ আশাতীতরূপে অর্জ্জন করিয়াছিলেন।

দত্ত সাহেব ও বেন্টউড উভয়ের মধ্যে খুব বন্ধুত্ব। অবসর পাইলেই বেন্টউড, দত্ত সাহেবের উদ্যান-বাটীকায় আসিয়া প্রচুর চা, চুরুট ও বিস্কুট উপভোগ করিতেন। এবং সেই উপভোগের সময় উভয়ে মিলিয়া অত্যন্ত উৎসাহের সহিত হাস্য পরিহাস ও বিদ্রূপ কৌতুকে মনোনিবেশ করিতেন।

আজও চা’র অভাব নাই—চুরুটের অভাব নাই—বিস্কুটের অভাব নাই—সুতরাং বাধাশূন্য গল্পস্রোতঃ হাস্যকলনাদে খরতর বেগে বহিতেছে।

অমরেন্দ্রনাথ একখানি ইংরাজী সংবাদ-পত্র লইয়া পাঠ করিতেছিলেন। সুরেন্দ্রনাথ একদৃষ্টে বেন্টউডের গল্পকালীন, মুখের ভাবভঙ্গি অনন্যমনে কৌতুকাবিষ্টচিত্তে দেখিতেছিলেন। বেন্টউডও এক একবার সুরেন্দ্রনাথের মুখের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চাহিতেছিলেন। বেন্টউডের এইরূপ বারংবার তীক্ষ্ণদৃষ্টিপাতে সুরেন্দ্রনাথ মৃদুহাস্যের সহিত তাঁহাকে বলিলেন, “আপনি আমার মুখের দিকে এরূপ ভাবে বারংবার চাহিতেছেন কেন?”

বেন্টউড বলিলেন, “তোমার মুখ দেখিলে আমার আর একটি লোকের কথা প্রায়ই মনে পড়ে। অনেক দিন হ’ল, সে লোকটা মারা গিয়াছে।”

দত্ত সাহেব কহিলেন, “তিনি কি আপনার কোন একজন বন্ধু ছিলেন?”

বেন্টউড বলিলেন, “বন্ধুত্ব? সে লোকটা আমার অত্যন্ত বিদ্বেষী ছিল; আমি তাহাকে আন্তরিক ঘৃণা করিতাম।”

সুরেন্দ্রনাথ সপরিহাসে খপ্ করিয়া কহিলেন, “বোধ করি, আমি সে জন্য আপনার ঘৃণার পাত্র না হ’তে পারি।”

বেন্টউড সাহেব তৎক্ষণাৎ বলিলেন, “সে কি কথা! তা’ তুমি হ’তে যাবে কেন? তবে অনেক সময় মুখের সাদৃশ্যে চরিত্রটা অনেকেরই এক রকমই দেখা যায়। কি জানি, হয়ত ইহার পর তুমি আমার পরম বিদ্বেষী হইয়া উঠিতে পার, সেজন্য হয়ত আমিও তোমাকে আন্তরিক ঘৃণা করিতে পারি। বিশেষতঃ আমরা দুজনে সমব্যবসায়ী। আচ্ছা, সুরেন্দ্রনাথ, তুমি কি পামিষ্ট্রী* বিশ্বাস কর?”

[* Palmistry সামুদ্রিক বিদ্যা, করতলের রেখাদি বিচারের দ্বারা ভবিষ্য বিষয় গণনা করা।]

সুরেন্দ্রনাথ মাথা নাড়িয়া বলিলেন, “না।”

দত্ত মহাশয় আর একটি চুরুটে অগ্নিসংযোগপূর্ব্বক বলিলেন, “কি বাজে কথা নিয়ে মত্ত হ’লে মিঃ বেন্টউড!”

বেন্টউড সে কথায় কোন উত্তর না করিয়া অমরেন্দ্রের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “তুমি কি পামিষ্ট্রী বিশ্বাস কর?”

অমরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “কিছু না। আপনি?”

“আমি সর্ব্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করি,” বলিয়া বেন্টউড সাহেব নিজের চেয়ারখানা টানিয়া লইয়া সুরেন্দ্রের সম্মুখে বসিলেন। এবং সুরেন্দ্রনাথের দক্ষিণ ও বাম হস্তের কর-রেখাদি বিশেষ মনোযোগের সহিত দেখিতে লাগিলেন। দেখিয়া ক্ষণপরে বলিলেন, “জীবন্মুত্যু—তোমার জীবনে জীবনমৃত্যু একটা প্রধান ঘটনা। সুরেন্দ্রনাথ, এ প্রহেলিকার অর্থ কি বল দেখি?”

শুনিয়া, শিহরিত হইয়া, চকিত হইয়া বিস্ময়সংক্ষুদ্ধকণ্ঠে সুরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “জীবনমৃত্যু! ডাক্তার সাহেব, আপনার এ অসঙ্গত কথার কোন মানে খুঁজিয়া পাই না।”

বেন্টউড। সহজে ইহার মানে হইবে না। আমি ত পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, এ একটি দুর্ভেদ্য প্রহেলিকা।

“জী-ব-ন-মৃ-ত্যু!” চক্ষু, ললাট, নাসিকা, কুঞ্চিত করিয়া অমরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “বোধ হয়, আপনি পক্ষাঘাতের কথা বলিতেছেন?”

বেন্টউড। ঠিক হইল না।

চুরুটে একটী সুদীর্ঘ টান দিয়া দত্তসাহেব বলিলেন, “তবে কি কোন প্রকার মৃগীরোগ নাকি হে?”

বেন্টউড। তাহাও নয়।

সুরেন্দ্রনাথ অবিশ্বাসের হাসি হাসিয়া বলিলেন, “মিঃ বেন্টউড, আপনিই আপনার এ প্রহেলিকার অর্থ করিতে পারেন। আমাদের সাধ্যায়ত্ব নয়।”

বেন্টউড বলিলেন, “না, আমি নিশ্চয় করিয়া কিছুই বলিতে পারি না। যা’ ঘটিবার সম্ভাবনা, তা’ আমি অনুভবে কিছু বুঝিতে পারিয়াছি মাত্র।”

সুরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আপনি কি অনুমান করিয়াছেন, বলুন। আমাকে লইয়াই যখন এ অদ্ভুত প্রহেলিকার সৃষ্টি, এ সম্বন্ধে যা’ কিছু সমস্ত বিষয় জানিতে আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে।”

বেন্টউড সাহেব বলিলেন, “ভবিষ্যতের কথা যত অপ্রকাশ থাকে, ততই ভাল। তোমার অদৃষ্ট-লিপি জীবন থাকিতে তোমার মৃত্যু, যদি না তুমি—” সে কথা চাপা দিয়া বলিলেন, “তুমি কি এ বিপদের হাত এড়াইতে চাও?”

সুরেন্দ্র। মনে করিলে কি পারি?

বেন্ট। পার বৈকি। যদি না তুমি জীবনে কখন বিবাহ কর, তাহা হইলে এ বিপদ্ না ঘটিতে পারে।

সু। বুঝিতে পারিলাম না।

বেন্ট। কখনও বিবাহ করিয়ো না।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – বিপদের কারণ

বেন্টউড দেখিলেন, কথাটা শুনিয়া সুরেন্দ্রনাথের মুখ রক্তাভ হইয়া উঠিল। কথাটা শুনিয়া হঠাৎ যে তাঁহার একটু চিত্ত-চাঞ্চল্য ঘটিয়াছিল, সেই চিত্ত-চাঞ্চল্যের ভাবটিও একবার ক্ষণকালের জন্য সুরেন্দ্রনাথের মুখমণ্ডলে সুস্পষ্ট প্রকটিত হইল; তাহাও ডাক্তার বেন্টউড দেখিলেন। দেখিয়া বলিলেন, “কথাটা অবিশ্বাস করিয়ো না। আমি যাহা বলিলাম, একান্ত অভ্রান্ত জানিবে।”

সুরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “পূর্ব্বে আপনার এ উপদেশ মান্য করিতে পারিতাম, এখন আর উপায় নাই। আমাকে বিবাহ করিতেই হইবে। গোপন করিবার প্রয়োজন দেখি না, আমি একজনকে ভালবাসিয়ছি; এবং তাহাকে বিবাহ করিবার জন্য প্রতিশ্রুতও হইয়াছি।”

দত্ত সাহেব মাথা নাড়িয়া, চুরুটে একটা দমভোর টান দিয়া, রাশীকৃত ধূম উদ্গীরণ করিতে করিতে অত্যন্ত উৎসাহের সহিত বলিলেন, “সুরেন্দ্রনাথের বিবাহ অতি শীঘ্রই দিতে হইবে।”

বেন্টউড বলিলেন, “তাহা হইলে শীঘ্রই আপনা হইতেই সুরেন্দ্রনাথের অদৃষ্ট-লিপি সফল হইবে।”

দত্ত সাহেব বলিলেন, “সামান্য গণনার উপর নির্ভর করিয়া চলিলে চলে না।”

বেন্টউড বলিলেন, “সুরেন্দ্রনাথ, তুমি যাকে বিবাহ করিবে মনস্থ করিয়াছ, আমি জানি। কিন্তু তুমি নিশ্চয়—”

বাধা দিয়া অমরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “সকলেই জানে, মিস্ আমিনার সহিত সুরেন্দ্রনাথের বিবাহের কথা হইতেছে।”

বেন্টউড বলিলেন, “তাই কি, সুরেন্দ্রনাথ? তুমি কি মিস্ আমিনার নিকট প্রতিশ্রুত হয়েছ? সত্য বল।”

সুরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “না, মিস্ আমিনা নয়—মিস্ সেলিনার নিকটে আমি প্রতিশ্রুত হইয়াছি।”

কথাটা শুনিয়া অমরেন্দ্রনাথের মুখ একেবারে অন্ধকার হইয়া গেল; কতকটা বেন্টউডেরও, এবং কতকটা দত্ত সাহেবেরও।

অমরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “তুমি প্রতিশ্রুত হইয়াছ, এইমাত্র। তোমার প্রতিশ্রুতিতে বড় আসে-যায় না। মিস্ আমিনাকেই তুমি বিবাহ করিবে।”

সুরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “সে সম্বন্ধে আমি তোমার পরামর্শ চাহি না। আমি আমার ইচ্ছামত চলিব।”

অমরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “অনেকে অনেক রকম ইচ্ছা ক’রে থাকে—ফলে বিপরীত ঘটে। তুমি মিস্ সেলিনাকে এখন হইতে ভুলিতে আরম্ভ কর।”

সুরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “তোমার নিকট আমি কোন উপদেশ চাহি না।”

দত্ত সাহেব বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “কি আপদ, তোমাদের যে লঘুগুরু-জ্ঞান নাই। আমার ঘরে বসিয়া, আমারই সামনে বসিয়া তোমাদের এই সব কথা নিয়ে তর্ক করা বুদ্ধিমানের কাজ হয় না। [বেন্টউডকে নির্দ্দেশ করিয়া] বিশেষতঃ এই একজন আমাদের বন্ধু লোক রহিয়াছেন, ইনিই বা মনে করিবেন কি?”

বেন্টউড সাহেব বলিলেন, “বোধ হয়, আর আমি বড় বেশিক্ষণ বন্ধুলোক থাকিব না। যে কথা আমি প্রকাশ করিব মনে করিয়াছি, তাহাতে আমি বন্ধুর পরিবর্তে আপনা হইতে নিশ্চয়ই একজন ঘোরতর শত্রুতে পরিণত হইব।”

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – প্রণয়ে অন্তরায়

ভ্রূভঙ্গী করিয়া সুরেন্দ্রনাথ বেন্টউডের মুখের দিকে চাহিলেন। বলিলেন, “ডাক্তার বেন্টউড, আপনি এ কথা বলিতেছেন কেন?”

বেন্ট। কেন বলিতেছি—একটা কারণ আছে। তুমি তবে সেলিনাকে ভালবাস? এবং তোমার একান্ত ইচ্ছা, তুমি তাহাকে বিবাহ কর, কেমন কি না?

সু। হাঁ, আমি তাহাকে ভালবাসি। সে কথা কেন? আপনি কি বলিতেছিলেন, বলুন।

বেন্ট। [অমরেন্দ্রের প্রতি] তোমারও ভাবগতিক দেখিয়া, কথাবার্তা শুনিয়া আমি বেশ বলিতে পারি, সেলিনাকে তুমিও খুব ভালবাস।

অ। হাঁ—হাঁ—তা—তা—বটে—হাঁ, আপনি ঠিক বলিয়াছেন।

বেন্ট। [মৃদু হাস্যে] আমার বিবেচনায় কথাটা বড় ভাল বলিয়া বোধ হয় না, যে একজন—

দত্ত। [বাধা দিয়া] কথাটা ত ভালই নয়। কোন ভদ্রকন্যার নাম লইয়া বৈঠকখানা ঘরে এরূপ আলোচনা করা খুবই একটা গর্হিত কাজ। যাক্, এখন ও সব কথা থাক্—

“মিঃ দত্ত, আপনি আর এক মুহূর্ত্ত অপেক্ষা করুন, মিস সেলিনা সম্বন্ধে আমাদের তিন জনের মধ্যে কাহার কিরূপ মনোভাব, সেটা আমরা পরস্পরে যাহাতে ঠিক বুঝিতে পারি, সে বিষয়ে—” এই বলিয়া বেন্টউড একটু ইতস্ততঃ করিতে লাগিলেন।

অমরেন্দ্রনাথ কথাটার শেষ অবধি শুনিবার জন্য ডাক্তার বেন্টউডের মুখের দিকে ব্যগ্রদৃষ্টিতে চাহিয়া রহিলেন। এবং সুরেন্দ্রনাথ কিছু উষ্ণ হইয়া রোষসংক্ষুদ্ধকণ্ঠে বলিলেন, “মিস্ সেলিনার কথায় আপনার কোন প্রয়োজন নাই।”

বেন্টউড বলিলেন, “খুব প্রয়োজন আছে—আমিও সেলিনাকে ভালবাসি –”

“আপনিও সেলিনাকে!” বলিয়া, অমরেন্দ্রনাথ চমকিত চিত্তে দাঁড়াইয়া উঠিবার উপক্রম করিলেন। এবং সুরেন্দ্রনাথ, অগ্রাহ্যের হাসি হাসিয়া বলিলেন, “এ কখনই সম্ভব নয়, কারণ—”

বেন্টউড বাধা দিয়া বলিলেন “সুরেন্দ্রনাথ, কারণ দেখাইতে ব্যস্ত হইতে হইবে না—কারণটা আমি নিজে জানি। আমার বয়স হইয়াছে—দুই-একগাছি করিয়া চুলগুলিও সাদা হইতে আরম্ভ করিয়াছে। সেলিনার ন্যায় নবীনা সুন্দরীর যে আমি সম্পূর্ণ অযোগ্য, তাহা আমি জানি। কিন্তু তোমাদের বয়স আছে, রূপ আছে, গুণ আছে, সুখ-সৌভাগ্য তোমাদের অনুকূল; এ সব বিষয়ে তোমাদের অদৃষ্টই যে সর্ব্বাগ্রে সুপ্রসন্ন হইবে, এ কথা কে অস্বীকার করিবে? তথাপি দেখা যাক, কে জয়ী হয়।”

অমরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “বেশ কথা, আপনি সুরেন্দ্রনাথের ভবিষ্যৎ গণনা করিয়াছেন। ভবিষ্যতে আমার কি হইবে, বলুন দেখি; আপনাদের রহস্যপূর্ণ নাটকের আমিও একজন অভিনেতা।”

বেন্টউড বলিলেন, “এখন থাক্, আজ এ বিষয় লইয়া যথেষ্ট আলোচনা করা হইয়াছে। সেলিনা যেরূপ রূপবতী, তাতে সে আমাদের তিন জনের ত দূরের কথা, সহস্রের অনুরাগ আকর্ষণ করিতে পারে। এজন্য আমরাও কেহ কাহাকে দোষী করিতে পারি না। মিস্ সেলিনার অপরিসীম সৌন্দর্য্যই আমাদিগের এ অন্ধ-উন্মত্ততার একমাত্র কারণ। ঘটনাটা তোমাদিগকে এখন হইতেই বুঝাইয়া দিয়া সতর্ক করিবার জন্যই এই প্রসঙ্গের অবতারণা করিয়াছিলাম। বেশ, এখন হইতেই আমরা তিন জনে সেলিনার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিব। যাহার প্রতি জয়শ্রী প্রসন্না হইবেন—সেই সেলিনাকে লাভ করিবে।”

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – বিষ-গুপ্তি

দত্ত সাহেব বলিলেন, “থাক্, ও সকল কথায় আর কোন প্রয়োজন নাই।

মিঃ বেন্টউড, আমি তোমাকে আজ একটা নূতন জিনিষ দেখাইব।”

এই বলিয়া তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন। তাঁহার পার্শ্ববর্তী দেয়ালে অনেক-গলি অস্ত্র ঝুলান ছিল। সে রকম ধরণের অস্ত্রাদি সহরে বড়-একটা দেখিতে পাওয়া যায় না। পাৰ্ব্বত্য অসভ্য জাতির মধ্যে সেই সকল অস্ত্রের ব্যবহার হইয়া থাকে। তন্মধ্য হইতে একটি বাছিয়া লইয়া তিনি টেবিলের উপর রাখিলেন। সেটা দেখিতে অনেকটা মোটা কাঁচা বেতের মত—এক হস্ত দীর্ঘ।

দত্ত সাহেব বলিলেন, “ছোটনাগপুর হইতে আমি এই ভয়ানক অস্ত্রটা সংগ্রহ করিয়া আনি।”

“ইহাতে ভয়ানকের ত কিছুই দেখিতেছি না,” বলিয়া বেন্টউড সেই অস্ত্রটি লইবার জন্য হাত বাড়াইলেন।

মিঃ দত্ত তাড়াতাড়ি সেটি টেবিল হইতে তুলিয়া লইয়া বলিলেন, “হাত দিবেন না, বড় সাংঘাতিক। হাতে একটু বিধিলে আর উপায় নাই—সেই মুহূর্ত্তে জীবন-লীলার শেষ হইয়া যাইবে। ইহার ভিতরে বিষ আছে।”

“বিষ! বলেন কি!” বলিয়া বেন্টউড চকিত হইয়া একটু সরিয়া বসিলেন। বলিলেন, “কই, আমি ত এ রকম অস্ত্র আর কখনও দেখি নাই।”

অমরেন্দ্রনাথ সেই সময়ে বেন্টউডের দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখিয়াছিলেন। বেন্টউডের সেই একান্ত ব্যগ্রতা ও অত্যধিক চকিত ভাব অমরেন্দ্রনাথের অকপট বলিয়া বোধ হইল না।

সুরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “এইটিই মামা মহাশয়ের অমূল্য সম্পত্তি। মনে করিলে ইনি এই নিরীহ অস্ত্রটীর সম্বন্ধে গণিয়া গণিয়া পঞ্চাশটি লোমহর্ষণ গল্প বলিতে পারেন।”

মিঃ দত্ত বলিলেন, “নিরীহ! এমন কথা মুখে আনিয়ো না। দেখুন, মিঃ বেন্টউড, ইহার ভিতরে এখনও বিষ আছে, গোখুরা সাপের বিষের মত এ বিষ বড় ভয়ানক! আপনি যদি এই মুখের দিক্‌টা একটু চাপিয়া ধরেন, এই মুহূর্ত্তেই আপনার মৃত্যু হইবে।”

অমরেন্দ্রনাথ দেখিলেন, মিঃ বেন্টউডের চক্ষু একবার অত্যন্ত জ্বলিয়া উঠিল। তিনি তাঁহার দিকে নজর রাখিলেন। বেন্টউডের মুখভাবে বোধ হইতে লাগিল, যেন তাঁহার কিছু চিত্ত-চাঞ্চল্য ঘটিয়াছে।

বেন্টউড অতি সন্তর্পণে, ধীর হস্তে সেই বিষাক্ত অস্ত্ৰ উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিতে লাগিলেন। সেই বিষাক্ত অস্ত্রটা এক হস্ত পরিমিত দীর্ঘ। দেখিতে অনেকটা কাঁচা বেতের মতন, কিন্তু সেটা বেত নহে, কোন গাছের শাখা—প্রস্তরের ন্যায় শক্ত। দুই মুখ ছোট বড় চুনী পান্নায় খচিত— সোনা দিয়া বাঁধান; সেটা মোটামুটি কারুকার্য্যে শিল্প-চাতুর্য্যের তেমন কোন বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায় না।

বেন্টউড জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি এ অদ্ভুত অস্ত্র কেমন করিয়া সংগ্রহ করিলেন?”

দত্ত মহাশয় গম্ভীর ভাবে বলিতে লাগিলেন, “অনেক কষ্টে সংগ্রহ হইয়াছে, মিষ্টার বেন্টউড—অনেক কষ্টে! ছোটনাগপুরের কোল জাতিদের যে প্রধান মাকী, তাহার কাছে ছিল। তাহাদের সমাজের মধ্যে মাকী হৰ্ত্তাকৰ্ত্তা বিধাতা। কেহ কোন অপরাধ করে, মান্কী তাহার দণ্ড দিবে; এমন কি তাহাদের মধ্যে যে কেহ যে কোন একটা কাজ করিবে, আগে মান্কীর কাছে তাকে আবেদন করিতে হইবে। যাহাকে সহজে বশে আনিতে না পারে, এমন কোন দুৰ্দ্দান্ত লোককে হত্যা করিতে হইলে মান্কীকে এই অস্ত্র ব্যবহার করিয়া নিজের অভীষ্ট সিদ্ধ করিতে হয়। তাহারা এই অস্ত্রকে ‘চালেনা-দেশম’ বলিয়া থাকে। আমি নিজে ইহার নাম রেখেছি, ‘বিষ-গুপ্তি’। এই দেখুন–না, এটা অনেকটা গুপ্তিছড়ীর ধরণে তৈয়ারী।” এই বলিয়া দত্ত মহাশয় সেই বিশ-গুপ্তির গোড়ার দিকের একখানি সুন্দর নীল পাথরের উপর যেমন অঙ্গুষ্ঠের একটু চাপ দিলেন, সেটার অপর মুখ দিয়া সর্প-জিহ্বার ন্যায় একটী ক্ষুদ্র ও তীক্ষ্ণমুখ লৌহ-শলাকা বাহির হইল। ছাড়িয়া দিতে সেই লৌহ-শলাকা তৎক্ষণাৎ ভিতরে অন্তর্হিত হইয়া গেল।

বেন্টউড বলিলেন, “ঐ সূচের অগ্রভাগটা বোধ হয় বিষাক্ত।”

দত্ত সাহেব মাথা নাড়িয়া বলিলেন, “আপনি যাহা মনে করিয়াছেন, তাহা ঠিক নয়। এই গুপ্তির ভিতরে বিষ আছে। যে সূচটা বাহির হইতে দেখিলেন, ওটা ফাঁপা। উপরের এই নীলা পাথরখানা টিপিয়া ধরিলে, বিষ ভিতর হইতে সূচের মুখে নামিয়া আসে। এই বলিয়া বিষ-গুপ্তি পুনরায় যথাস্থানে সংলগ্ন করিয়া রাখিলেন।

অমরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “এখন এ বিষ-গুপ্তি কাজের বাহিরে গিয়া পড়িয়াছে—সে মারাত্মক গুণটা এখন আর নাই; তাহা হইলে আপনি আর এমন ভাবে বাহিরে ফেলিয়া রাখিতেন না।”

দত্ত সাহেব বলিলেন, “হাঁ, অনেক দিন হইতে আমার কাছে আছে; ভিতরের বিষটা একেবারে শুখাইয়া যাওয়াই সম্ভব। যাহাই হোক, তা’ বলিয়া কিছুতেই বিশ্বাস করা যায় না।”

সরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “যদি বিশ্বাস করিতে না পারেন, তবে ওটা এমন ভাবে বাহিরে ফেলিয়া রাখা আপনার ঠিক হয় না। এ সব সাংঘাতিক অস্ত্র খুব সাবধানে রাখাই ভাল। আশ্চর্য্য কি, ঐ বিষ-গুপ্তি লইয়া হয় ত কোন দিন একটা ভয়ানক বিপদ ঘটিয়া যাইতে পারে।”

দত্ত সাহেব কিছু বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “আঃ, কি বিপদ্! বিপদ্ আর হবে কি? আজ কত বৎসর ধরিয়া এখানেই রহিয়াছে। কে আর উহাতে হাত দিতে যাইবে?”

ডাক্তার বেন্টউড কিছু বলিলেন না; অত্যন্ত চিন্তিত ভাবে সেই বিষ-গুপ্তির দিকে বারংবার চাহিয়া দেখিতে লাগিলেন। অমরেন্দ্রনাথ, ডাক্তারের মুখের দিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখিয়াছিলেন। বেন্টউড আরও দুই একবার বিষ-গুপ্তির দিকে চাহিয়া তাহার পর সুরেন্দ্রনাথের দিকে চাহিলেন। ক্ষণপরে অমরেন্দ্রনাথের মুখের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিলেন।

বেন্টউডের সেই স্থিরদৃষ্টিতে সহসা অমরেন্দ্রনাথের এক প্রকার অননুভূতপূৰ্ব্ব চিত্ত-চাঞ্চল্য উপস্থিত হইল। বোধ হইল, ডাক্তারের সেই দৃষ্টির ভিতর হইতে একটা বৈদ্যুতিক তেজ নিঃসৃত হইয়া আসিতেছে। মেসমেরিজম্ প্রক্রিয়ায় যে তীক্ষ্ণতর স্থিরদৃষ্টির আবশ্যক হয়, ইহাও অনেকটা সেই রকমের। অনতিবিলম্বে অমরেন্দ্রনাথ বুঝিতে পারিলেন, নিজের যেন কিছু ভাবান্তরও ঘটিল, বারংবার সেই বিষ-গুপ্তি দেখিবার জন্য এবং তাহা হস্তগত করিবার জন্য মনের ভিতর একটা ইচ্ছা ক্রমশঃ বলবতী হইয়া উঠিতেছে বুঝিয়া বিস্মিত হইলেন। তবে কি কোন দুরভিসন্ধি সিদ্ধির জন্য ডাক্তার তাহাকে হিপ্‌নটাইজ করিবার চেষ্টা করিতেছেন। চিন্তাকুল অমরেন্দ্রনাথের মনে একবার এইরূপ একটা সন্দেহও হইল। সতর্ক হইলেন, তাড়াতাড়ি সে ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিলেন; এবং উদ্যানে পরিক্রমণ করিতে লাগিলেন। সেখান হইতে ঘরের ভিতরকার দৃশ্য কিছু কিছু দেখা যাইতেছিল। এবং গবাক্ষ উন্মুক্ত থাকায় দত্ত সাহেব ও সুরেন্দ্রনাথের কথোপকথন বেশ সুস্পষ্ট শ্রুত হইতে ছিল। অমরেন্দ্রনাথ দেখিলেন, জানালার পার্শ্বেই ডাক্তার বেন্টউড এখনও ঠিক সেইরূপ ভাবে বসিয়া আছেন, মুখে কথা নাই এবং তাঁহার সেই ভীষণোজ্জ্বল দৃষ্টির একটা প্রাখর্য্য যেন প্রতিক্ষণে বায়ুপ্রবাহে সঞ্চালিত হইয়া তাঁহাকে অভিভূত করিয়া তুলিতেছে। এবং তাঁহার মনের ভিতর বহুবিধ পাপ-কল্পনা আশ্রয় করিতেছে। অমরেন্দ্রনাথ সেখান হইতে অনেক দূরে সরিয়া গেলেন। প্রভাতের স্নিগ্ধ বায়ু-প্রবাহে তাঁহার শরীর এবং বিভ্রান্ত মন ক্রমশঃ সুস্থ হইতে লাগিল।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – পরিচয়

এইবার মিঃ আর দত্ত এবং তাঁহার উভয় ভাগিনেয়ের পরিচয় কিছু পরিষ্কার করিয়া দেওয়া আবশ্যক।

পূর্ব্বে মিঃ আর দত্ত ডেপুটী ম্যাজিষ্ট্রেট ছিলেন। এই সচল পদে অভিষিক্ত হইয়া অন্যান্যের ন্যায় তাঁহাকেও ঘন ঘন এক জেলা হইতে অন্য জেলায় চালিত হইতে হইয়াছিল। প্রথম প্রথম সেই শ্রমস্বীকারটা বিপত্নীক এবং অপুত্রক জীবনে অত্যন্ত প্রীতিপ্রদ ও কৌতূহলজনক বোধ হইত। তাহার পর জানি না, কিসের জন্য সহসা তিনি কিয়ৎ পরিমাণে শান্তিপ্রিয় হইয়া উঠিলেন। কলিকাতা সহরের মধ্যে তাঁহার পৈত্রিক ভূসম্পত্তি যথেষ্ট ছিল, এবং নিজেও যথেষ্ট অর্থ উপার্জ্জন করিয়াছেন। তাহারই প্রচুর উপস্বত্বে তাঁহার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কোন অসম্ভাবনা ছিল না দেখিয়া, তিনি সেই সচলপদ ত্যাগ করিয়া কলিকাতা সহরের পূর্ব্ব প্রান্তে তরুচ্ছায়া-ঘন তৃণশ্যামল সৌন্দৰ্য্যবহুল স্নিগ্ধ বালিগঞ্জের এক শান্তিপ্রদ নিভৃত উদ্যানবাটীতে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। এবং তাঁহার আশ্রয়ে সেইখানে তাঁহার ভাগিনেয়দ্বয় প্রতিপালিত হইতে লাগিল। তদুভয়ের একজনের নাম সুরেন্দ্রনাথ এবং অপরের নাম অমরেন্দ্রনাথ

দত্ত মহাশয়ের বিধবা ভগ্নী, মৃত্যু-পূর্ব্বে রক্ষণাবেক্ষণের ভারসহ নিজের অসহায় শিশু-পুত্র সুরেন্দ্রনাথকে তাঁহার হস্তে অর্পণ করিয়া যান। অমরেন্দ্রনাথের পিতার আর্থিক অবস্থা বেশ উন্নত ছিল, অপেক্ষাকৃত উন্নত করিবার প্রবল আকাঙ্ক্ষায় তিনি ব্রহ্মদেশে গিয়া ব্যবসা আরম্ভ করেন; ফল হইল—বিপরীত। অমরেন্দ্রনাথের পিতা সেখানে নিজের চরিত্র ঠিক রাখিতে পারিলেন না; ঘোরতর মদ্যপ ও বেশ্যাসক্ত হইয়া উঠিলেন। সেই সময়ে আবার পত্নী-বিয়োগ হওয়ায় তাঁহার বুদ্ধিশুদ্ধি আরও বিশৃঙ্খল হইয়া উঠিল; এবং তিনি এই বন্ধনহীন অবস্থায় অধঃপতনের পথে নিরতিশয় তীব্রবেগে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। পরিশেষে যখন তাঁহার জ্ঞানচক্ষুঃ উন্মীলিত হইল, তখন দেখিলেন, তিনি নিঃসম্বল – পথের ভিখারী; এবং যেখানে আসিয়া পড়িয়াছেন, সেখান হইতে উঠিবার আর কোন উপায়ই নাই। দুঃসহ অনুতাপে মৰ্ম্মাহত হইয়া একদিন আত্মহত্যা করিলেন। তখন অমরেন্দ্রনাথ পঞ্চবর্ষীয় বালক। অমরেন্দ্রের পিতৃকুলের অনেক ধনবান্ আত্মীয় বৰ্ত্তমান ছিলেন; কিন্তু তন্মধ্যবর্তী কাহারও এই নিরাশ্রয় শিশুর প্রতি করুণার সঞ্চার হইল না। দত্ত মহাশয় তখন ব্যগ্র হইয়া উঠিলেন, সেই হতভাগ্য পঞ্চমবর্ষীয় চঞ্চল বালককে টানিয়া রাখিতে তাঁহার স্নেহপূর্ণ হৃদয়ে এবং শান্তিপূর্ণ গৃহে প্রচুর স্থান ছিল। তিনি অমরকে তাঁহার অসহায় শৈশব হইতে সযত্নে ও সস্নেহে মানুষ করিয়া তুলিতে লাগিলেন।

এই দুই ক্ষুদ্র শিশুর শুভ-আগমনে এবং সুখ-সম্মিলনে, অপার আনন্দে নিঃসন্তান দত্ত মহাশয়ের হৃদয় পরিপূর্ণ এবং গৃহ সুশ্রাব্য মধুর হাস্যকলরবে মুখরিত হইয়া উঠিল।

এই শিশু দুটী যখন নিতান্ত ছোট, তখন ভগ্নশৃঙ্গের গোবৎসপালমধ্যবর্ত্তীর ন্যায় দত্ত মহাশয় তাহাদিগের সহিত গল্প করিতেন, অপরাহ্নে প্রশস্ত উদ্যানে আসিয়া লুকাচুরি খেলিতেন। সে খেলায় পাঠক, তোমার আমার তেমন আনন্দ কিছুমাত্র না থাকিলেও দত্ত মহাশয়ের এত ছিল যে, তাহা বর্ণনাতীত। কখন বা তিনি সেই দুই শিশুর মধ্যবর্তী হইয়া, তাহাদিগের দুইটী ক্ষুদ্র কোমল মুষ্টির মধ্যে নিজের তজ্জনী প্রবিষ্ট করাইয়া অত্যন্ত গম্ভীর ভাবে, ধীরপাদবিক্ষেপে আসন্ধ্যা সেই পুস্পসৌরভাকুল উদ্যান প্রদক্ষিণ করিয়া বেড়াইতেন। যখন কোন অদ্বিতীয় বস্তু যুগপৎ সেই দুই শিশুর মনোযোগ আকর্ষণ করিত, এবং সেই অদ্বিতীয় বস্তু হস্তগত করিবার জন্য উভয়ে সিক্ত করুণ প্লুতস্বরের সহায়তা গ্রহণ করিত, তখন এক একবার ভূতপূর্ব্ব ডেপুটী ম্যাজিষ্ট্রেটকে সাতিশয় ব্যাকুল এবং যার-পর-নাই ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠিতে হইত। বলা বাহুল্য, নিঃসন্তান দত্ত মহাশয়ের অন্তঃকরণ পুত্রস্নেহে উচ্ছ্বলিত হইয়া উঠিয়াছিল।

তাহার পর যখন অমর ও সুরেন্দ্র কিছু বড় হইল, তখন দত্ত মহাশয় স্থানীয় কালেজে তাহাদিগকে ভর্ত্তি করিয়া দিলেন; এবং বাটীতে তাহাদিগের জন্য নিজে গৃহ-শিক্ষকের পদ গ্রহণ করিলেন। সুবিজ্ঞ দত্ত মহাশয়ের একান্ত আগ্রহে এবং সুচারু অধ্যাপনায় সুরেন্দ্রনাথ ও অমরেন্দ্রনাথ ঘোটকারোহীয় ন্যায় অতি দ্রুত উন্নতির পথে চালিত হইতে লাগিল। এবং অসম্ভব অল্প সময়ের মধ্যে উভয়েই বিশ্ববিদ্যালয় হইতে স্ব স্ব নামের শেষে দুই-চারিটী ইংরাজী বর্ণ সংযোগ করিবার অধিকার প্রাপ্ত হইল। তখন দত্ত সাহেব তদুভয়কে বিলাতে পাঠাইয়া দিলেন; এবং তাঁহাদিগের সমুদয় ব্যয়-ভার নিজ স্কন্ধে গ্রহণ করিলেন।

কিছুকাল পরে সুরেন্দ্রনাথ একটি উৎকৃষ্ট ডাক্তার ও অমরেন্দ্রনাথ তেমনই একটি উৎকৃষ্ট ব্যারিষ্টার হইয়া স্বদেশে প্রত্যাগমন করিল।

তাহাদিগের কার্যারম্ভের অনিতকালপূর্ব্বে—যখন অমরেন্দ্রনাথ আদালতে সবে মাত্র যাতায়াত আরম্ভ করিয়াছে, এবং সুরেন্দ্রনাথ একটি ডিস্পেন্সারী খুলিবার চেষ্টায় স্থান নির্ব্বাচন করিয়া ঘুরিতেছে, সেই সময়ে আমাদিগের এই অনতিক্ষুদ্র আখ্যায়িকার আরম্ভ।

সুরেন্দ্রনাথের কিংবা অমরেন্দ্রনাথের মাতা কেহই দত্ত মহাশয়ের সহোদরা ছিলেন না। খুল্লতাত সম্পৰ্কীয়া ভগ্নী হইতেন।

তাঁহার স্বহস্থে মানুষ করা ভাগিনেয় দুইটীর স্কন্ধে তাঁহার সমগ্র স্থাবরাস্থাবর সম্পত্তি চাপাইয়া পরম নিশ্চিন্তমনে তিনি ইহলোক পরিত্যাগ করিতে পারিবেন, এরূপ একটা আশা দত্ত মহাশয়ের হৃদয়ে পূর্ব্বাপর বদ্ধমূল ছিল। দত্ত মহাশয় নিজে সাহেবী মেজাজের লোক ছিলেন, তাঁহার চাল-চলন, ভাব-ভঙ্গি, আচার-ব্যবহার সকলই সাহেবী ধরণের। কাহারও সহিত বড় একটা মিশিতেন না—মিশিতে হইলে সাহেবের সঙ্গে। নিজের ভাগিনেয় দুইটীকে ঠিক নিজের মনের মতন করিয়া গড়িয়া তুলিতে লাগিলেন।

দত্ত মহাশয় ইতিমধ্যে তাঁহার ভাগিনেয়দ্বয়ের বিবাহের একটা বন্দোবস্ত করিয়া রাখিয়াছিলেন। অতুলরূপৈশ্বর্য্যমধ্যবর্ত্তিনী মিস্ আমিনার সহিত সুরেন্দ্রনাথকে এবং সমৃদ্ধিসম্পন্ন ইংরাজ-দুহিতা মিস্ সেলিনার সহিত অমরেন্দ্রনাথকে পরিণয়-সূত্রে আবদ্ধ করিবার জন্য দত্ত মহাশয়ের বিশেষ আগ্রহ ছিল; এবং সেজন্য তিনি যথেষ্ট চেষ্টাও করিতেছিলেন। এদিকে সুরেন্দ্রনাথ এবং অমরেন্দ্রনাথ একমাত্র সেলিনাকেই প্রণয়-চক্ষে দেখিতে আরম্ভ করিয়াছিল। দত্ত সাহেব বুঝিতে পারেন নাই, যৌবনোদ্ধত হৃদয়ে প্রণয়াবেগ রুদ্ধ হইবার নহে, তাঁহার সমুদয় চেষ্টা সেখানে একদিন ভাসিয়া যাইবে। এবং তাঁহার সফল হইবার সম্ভাবনা নাই। এখন তাঁহারা নিজের ভাল-মন্দ বাছিয়া লইতে শিখিয়াছেন; সুতরাং সেজন্য তাঁহাদিগের আর কাহারও মুখাপেক্ষী হইবার আবশ্যকতা নাই।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – পরিচয়

দত্ত সাহেবের বাটীর অনতিদূরবর্তী আর একটি দ্বিতল অট্টালিকা, স্বীয় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় এবং মনোহারিত্বে সর্ব্বাগ্রে ও অতি সহজে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অট্টালিকার চতুৰ্দ্দিক স্থ তৃণাবৃত উন্মুক্ত স্থান, অনতি উচ্চ প্রাচীর, ক্রোটন ও ঝাউশ্রেণীর দ্বারা চতুর্দ্দিক্ বেষ্টিত। সেই শ্যামল তৃণক্ষেত্রের মধ্যে মধ্যে এক একটি পুষ্পিত বৃক্ষ শোভা পাইতেছে। কেবল সম্মুখে নহে, বাড়ীখানির চারিদিকে প্রশস্ত বারান্দা, সেখানে টবের উপরে শ্রেণীবদ্ধ অনেক রকম ফুলের গাছ।

মিসেস্ মার্‌শন এই বাটীতে বাস করেন। প্রায় সাত বৎসর হইল, তিনি এই বাড়ীখানি পছন্দ করিয়া ক্রয় করিয়াছেন। মিসেস্ মার্শনের স্বামী জীবিত নাই। তিনি একমাত্র কন্যাকে লইয়া এইখানে আজ প্রায় সাত বৎসর কাল বাস করিতেছেন। কন্যার নাম সেলিনা।

সেলিনার পিতা মিঃ মার্‌শন বেশ একজন কাজের লোক ছিলেন। আসামে এক চা বাগানের স্থাপনা করিয়া তিনি প্রভূত অর্থ উপার্জ্জন করেন। সেইখানে কোন সংক্রামক ব্যাধিতে তাঁহাকে ইহলোক ত্যাগ করিতে হয়। তাঁহার মৃত্যুর পরে পত্নী মিসেস্ মার্‌শন চা বাগানখানি রাখিবার জন্য কিছুদিন চেষ্টা করিয়াছিলেন; তাহার পর অর্থোপার্জ্জনের আর কোন আবশ্যকতা নাই দেখিয়া সে চেষ্টা ত্যাগ করিলেন; এবং বাগান হস্তান্তরিত হইয়া গেল। তিনি সেলিনাকে লইয়া কলিকাতায় উপস্থিত হইলেন। কলিকাতায় আসিয়া কিছুদিন চৌরঙ্গীতে ভাড়াটীয়া বাটীতে বাস করেন; তাহার পর বালিগঞ্জের এই সুরম্য অট্টালিকা ক্রয় করিয়া সেখান হইতে উঠিয়া আসিলেন।

মিসেস্ মার্‌শন যখন কলিকাতায় আসেন, তখন তাঁহার সহিত আর একটী প্রাণী আসিয়াছিল—তাহারও কিছু পরিচয় আবশ্যক; কারণ, এই আখ্যায়িকার সহিত তাহার যথেষ্ট সংশ্রব আছে। তাহার নাম জুলেখা। জুলেখা কৃষ্ণাঙ্গী, কৃশাঙ্গী, এবং কিছু দীর্ঘাঙ্গী; বয়স ত্রিশ বৎসর। মুখাকৃতি দেখিতে নিতান্ত মন্দ না হইলেও তাহাতে যেন কি একটা ভীষণতার ছায়া সতত লাগিয়া রহিয়াছে। কৃষ্ণচক্ষুর দৃষ্টি দীপ্ত উল্কার ন্যায় অত্যন্ত উজ্জ্বল, সচরাচর তেমন দেখিতে পাওয়া যায় না। সে দৃষ্টিতে যেন একটা বৈদ্যুতিক-প্রবাহ মিশ্রিত আছে, এবং একেবারে তীক্ষ্ণ শরের ন্যায় তাহা বিদ্ধ করে।

যখন মিঃ মার্‌শন চা বাগানের কাজ আরম্ভ করেন, তখন তিনি ছোটনাগপুর হইতে কোল-জাতীয় অনেক কুলী সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছিলেন। তাহাদিগের মধ্যে কতক স্ত্রীলোকও ছিল। স্ত্রীলোকদিগের মধ্যে এই জুলেখা এখন অবশিষ্ট আছে। জুলেখার মা তাহাকে সঙ্গে লইয়া চা বাগানে কাজ করিতে আসিয়াছিল। জুলেখার মাকে কিংবা তাহার কন্যাকে চা বাগানে একদিনও কাজ করিতে হয় নাই। তাহারা মার্‌শনদিগের সংসারের কাজ-কর্ম্মে নিয়োজিত হইয়াছিল, এবং অত্যল্পকালের মধ্যে তাহাদিগের প্রভুর উপরেও প্রভুত্ব বিস্তার করিতে সমর্থ হইয়াছিল। জুলেখার মা মৃত্যুপূর্ব্বে মিঃ ও মিসেস মার্শনের হাতে তাহার কন্যারত্ন (?) সমর্পণ করিয়া যায়। মিঃ এ জগতে নাই, মিসেস্ অদ্যাবধিও সেই মৃতার অনুরোধ রক্ষা করিয়া আসিতেছেন। তিনি আসাম ত্যাগ করিবার সময়ে জুলেখাকে ত্যাগ করিতে পারিলেন না—সঙ্গে লইলেন; কেবল অনুরোধ রক্ষার্থ নহে, জুলেখার উপর মিসেস্ মার্শনের অনস্ত বিশ্বাস। বিশেষতঃ সে সেলিনাকে নিজের হাতে মানুষ করিয়াছে, সেলিনার সহিত তাহার বড় ভাব।

জুলেখা জাতিতে খাড়িয়া। ছোটনাগপুরের অসভ্যদিগের মধ্যে এইরূপ একটা ধারণা অত্যন্ত প্রবল যে, খাড়িয়া জাতি অনেক মন্ত্রৌষধি জানে, তাহারা যাদু জানে; আরও তাহারা এমন অনেক দ্রব্যগুণ জানে, যাহাতে মরা মানুষ বাঁচে—এবং বাঁচা মানুষ মরে। এমনকি, মনে করিলে তাহারা মনুষ্য নামক চেতন পদার্থকে উদ্ভিদে পরিণত করিতে পারে। বিশেষতঃ জুলেখাও সেই সকল বিষয়ে বড় কম নহে, আসামবাসীদিগের মধ্যেও কেহ কেহ সে পরীক্ষা পাইয়াছে। কিন্তু রাজধানী কলিকাতায় শিক্ষিতমণ্ডলীর মধ্যে সে বিশ্বাস আদৌ স্থান পায় না; সুতরাং এখানে অদ্যাবধি জুলেখার কোন পরীক্ষা গ্রহণ করা হয় নাই; সে পরিচারিকা- পরিচারিকার মতন থাকে; অধিকন্তু সেলিনার সহিত তাহার বড় ভাব।

সেলিনার বয়ঃক্রম অষ্টাদশ বৎসর; এখনও অবিবাহিতা। ইংরাজদের নিকট ইহাতে আশ্চর্য্যের কিছুই নাই; ঐ বয়সে বিবাহ হইলে বরং সেটা তাঁহাদের নিকট অত্যন্ত আশ্চর্য্যজনক বোধ হয়, এবং এই বিবাহকে তাঁহারা সবিস্ময়ে বাল্য-বিবাহের শ্রেণীভুক্ত করিয়া থাকেন। সেলিনা অতিশয় সুন্দরী। পূর্ণযৌবনসমাগমে তাহার সর্ব্বাঙ্গ পরিপুষ্ট। রূপ দেহে ধরে না, সূৰ্য্যালোক যেমন বর্ষাশেষের পরিপূর্ণ, স্ফটিক-বিমল, স্বচ্ছসলিলা নদীর তলদেশে পর্য্যন্ত কম্পিত হইতে থাকে, সেলিনাকে হঠাৎ দেখিয়া মনে হয়, সেই রকমের একটা চঞ্চলোজ্জ্বল লাবণ্য তাহার সৌকুমাৰ্য্যময় সর্ব্বাঙ্গ ব্যাপিয়া তাহার হৃদয়ের নিভৃত প্রদেশ অবধি অবিশ্রাম সঞ্চালিত হইতেছে; এবং চলিতে ফিরিতে, উঠিতে বসিতে তাহার সেই লাবণ্যের একটা তরঙ্গ উঠে। বোধ হয়, যেন তাহার আপাদমস্তক ব্যাপিয়া নবীন যৌবন এবং সৌন্দর্য্যের একটা ঘোরতর সংগ্রামাভিনয় আরব্ধ হইয়াছে। যেখানে দাঁড়ায়, দাঁড়াইবার ললিতকোমল ভঙ্গীতে সেখানটা আলো করিয়া দাঁড়ায়; যেখান দিয়া যায়, চলিবার সুকুমার চরণ-বিন্যাসে সেখানটা আলো করিয়া যায়, এবং চলিয়া গেলে তৎক্ষণাৎ সেই স্থানটা দর্শকের নিতান্ত অপ্রিয় হইয়া উঠে।

তাহার সেই শরন্মেঘমুক্ত চন্দ্রের ন্যায় মুখমণ্ডল, তাহার সেই প্রভাতবাতাহতনীলোৎপলবৎ কৃষ্ণচক্ষুঃ স্পন্দিততার ঈষচ্চঞ্চল, তাহার সেই ঈষদুন্নত গ্রীবার বঙ্কিম ভঙ্গী, তাহার সেই অনতি প্রশস্ত, কর্পূর কুন্দেন্দুশুভ্র নিৰ্ম্মল ললাট, এবং সেই ললাটের উপর ভ্রমরকৃষ্ণ কুঞ্চিত অলকগুচ্ছ, অনেকেরই হৃদয় অতি সহজে মন্ত্রমুগ্ধ এবং তুমুলবিপ্লববিহ্বল করিয়া তুলিতে পারে। ইহার জন্যই সেদিন দত্ত সাহেবের বাংলোয় বসিয়া চা চুরুটে মনসংযোগ করিতে না পারিয়া তিনটী প্রাণী একটা কলহের সূত্রপাত করিয়াছিল। সেই তিনজনের মধ্যে কে কতদূর পরিমাণে সেলিনার হৃদয় অধিকার করিতে সমর্থ হইয়াছিল, বলিতে পারি না; কিন্তু তাহাদের অপেক্ষা জুলেখা যে সেলিনার হৃদয়ে নিজ আধিপত্য বিস্তার করিতে বেশী কৃতকার্য্য হইয়াছিল, তাহা নিশ্চিত।

জুলেখা নিজ জন্মভূমির ভূত প্রেত, ডাক ডাকিনী প্রভৃতির অলৌকিক ঘটনাবলীতে সেলিনার মস্তিক পরিপূর্ণ করিয়া তুলিয়াছিল। সেলিনা তাহার মুখে সে সকল ভীষণ কাহিনী কখন অর্দ্ধ-বিশ্বাস, কখন বা রুদ্ধ নিঃশ্বাসের সহিত শ্রবণ করিত।

জুলেখার মুখে যাহা শুনিত, সেলিনা তাহা আবার সুরেন্দ্রনাথের নিকট গল্প করিত। সুরেন্দ্রনাথ সে সমুদয় হাসিয়া উড়াইয়া দিতেন, এবং এই অন্ধ-বিশ্বাসের জন্য সেলিনাকে তিনি মৃদু তিরস্কারও করিতেন। সুরেন্দ্রনাথ এমন সহজবোধ্য বিবিধ যুক্তির দ্বারা সেই সকল কাহিনীর অলীকত্ব সপ্রমাণ করিতেন যে, সেলিনা তাহাতে অতি সহজে নিজের ভ্রম বুঝিতে পারিত। আবার যখন জুলেখার হাতে গিয়া পড়িত, তখন তাহার হাতে সে আবার পূৰ্ব্বাবস্থা প্রাপ্ত হইত। সেই সকল তন্ত্রমন্ত্রের অশ্রুতপূর্ব কাহিনীতে তাহার হৃদয় অবসাদগ্রস্ত এবং নিতান্ত বিষন্ন হইয়া পড়িত। তাহার কিছুই ভাল লাগিত না। এক একবার মনে করিত, সুরেন্দ্রনাথের সহিত বিবাহ হইলে ইহার পর সে এই মায়াবিনী জুলেখার হাত হইতে এককালে মুক্তি পাইবে।

জুলেখাও সেলিনার মনের কথা মনে মনে বুঝিতে পারিত; এবং তাহার বিরুদ্ধে দণ্ডায়মন সুরেন্দ্রনাথকে সে আন্তরিক ঘৃণা করিত। এবং এই প্রণয়ী-যুগলের মধ্যে একটা বিচ্ছেদ ঘটাইয়া দিতে সে সৰ্ব্বদা সচেষ্ট থাকিত। তাহাদের সর্ব্বশক্তিমান্ কাউরূপী বিশ্বার করে না, সিঙ্গিবোঙ্গা মানে না—এমন একটা লোক সেলিনাসুন্দরীর স্বামী হইবে, ইহা জুলেখার একান্ত অসহ্য বোধ হইত।

সপ্তম পরিচ্ছেদ – সেলিনা ও জুলেখা

একদিন অপরাহ্নে দ্বিতলের বারান্দায় বসিয়া জুলেখা সেলিনার কেশবেশবিন্যাস করিয়া দিতেছিল। সেখানে আর কেহ ছিল না। নববর্ষার শ্যামশ্রীর উপর সায়াহ্নরবির স্বর্ণকর ও ধূসর মেঘচ্ছায়ার তুলিকাসম্পাতে মুক্তপ্রকৃতি হাস্যময়ী; ধারাপাতপুষ্ট সুনিবিড় বকুলগাছের পল্লবে এবং অদূরবর্তী সুরেন্দ্রনাথদিগের অট্টালিকার কার্ণিসে রৌদ্র ঝিক্‌মিক্ করিতেছিল। বারান্দায় রৌদ্র প্রবেশ করিতে পারে না। সেখানে সুসিক্ত স্থূল খস্থস্-যবনিকা হইতে একটা মৃদুগন্ধ এবং মৃদুস্নিগ্ধতা নিঃসৃত হইতেছিল। সেলিনা চুপ করিয়া বসিয়াছিল; এবং তাহার একরাশ চুল লইয়া জুলেখা অস্থির হইয়া উঠিয়াছিল। কাহারও মুখে কথা নাই।

সেলিনা বারংবার অদূরবর্তী সুরেন্দ্রনাথদিগের বাটীর ছাদের দিকে সতৃষ্ণনেত্রে চাহিয়া দেখিতেছিল। জুলেখার সেদিকে যে লক্ষ্য ছিল না, তাহা নহে। সেলিনাকে সেইদিকে ঘন ঘন চাহিতে দেখিয়া সে মনে মনে নিরতিশয় বিরক্ত হইতেছিল। শেষে আর থাকিতে পারিল না; কহিল, “সুরেন্দ্রনাথের জন্য তুমি পাগল হবে, দেখছি।”

সেলিনা কহিল, “সুরেন্দ্রনাথের জন্য আমি পাগল হইয়াছি।”

কথাটা শুনিয়া জুলেখার চক্ষু অতি তীব্রভাবে জ্বলিয়া উঠিল। এবং নিজেদের ভাষায় সুরেন্দ্রনাথের উপর দুই একটা কটু শব্দ বর্ষণ করিল। সেলিনা বোধ হয়, তাহা বুঝিয়া থাকিবে, তাড়াতাড়ি বলিল “জুলেখা, চুপ কর, কাজ ভাল হইতেছে না; তাঁর নামে এমন জ্বলিয়া উঠি কেন?”

জুলেখা কহিল, “কেন? সে আমার হাত থেকে তোমাকে কাড়িয়া লইবে, আর আমি চুপ করিয়া বসিয়া থাকিব? কখনই না!”

সেলিনা কহিল, “আমি যদি অপর কাহাকে বিবাহ করি, তাহা হইলেও আমি ত তোর হাতছাড়া হইয়া যাইব। তাহার আর কথা কি? তোর ইচ্ছা, এ জন্মে আমার বিবাহ না হয়, কেমন না?”

জুলেখা। তা’ কেন, তুমি আর যাকে ইচ্ছা সাদি কর, আমার তাতে একতিল আপত্তি নাই। কিন্তু, তুমি বেয়াদব্ সুরেন্দ্রনাথকে কিছুতেই সাদি করিতে পারিবে না। সে আমার চক্ষুঃশূল।

সেলিনা। [হাসিয়া] কেন, তিনি তোর কাঁউরূপী সিঙ্গিবোঙ্গা বিশ্বাস করেন না বলিয়া?

জু। দিনের বেলায় সিঙ্গিবোঙ্গার নাম করিলে বড় আসে-যায় না, রাত্রে ও নাম মুখে আনিতে নাই। যখন আমার ভাল জ্ঞান হয় নাই, একদিন সন্ধ্যার সময় এক্‌লা ঐ সিঙ্গিবোঙ্গার নাম—

সে। [বাধা দিয়া] রাখ্—তোর গল্প রাখ, ও সব কথা আর আমার কাছে তুলিস্ না, আমার বড় ভয় করে।

জু। সিঙ্গিবোঙ্গার নামে সকলকেই ড্যর্ করিতে হয়। তোমার সুরেন সিঙ্গিবোঙ্গা মানে না; আমাকে মানে না; দেখি, সে কেমন ক’রে তোমাকে বিবাহ করে।

সে। নিশ্চয়ই বিবাহ হইবে।

জু। তোমার মার মত নাই।

সে। সে আমি বুঝিব; আমি যদি মাকে বলি, মা কি আমার কথায় অমত করিবেন?

জুলেখার অন্ধকার মুখ আরও অন্ধকার হইল। বিষণ্ণ ভাবে সে বলিল, “যে আমার চক্ষুঃশূল—যাকে আমি একেবারে দেখিতে পারি না, তুমি তাকে কেন বিবাহ করিবে?”

সে। তুই দেখিতে পারিস্ কি না, সে কথায় আমার কোন প্রয়োজন নাই; আমার পছন্দে আমি বিবাহ করিব। তুই কি আমায় অমরেন্দ্রনাথকে বিবাহ করিতে বল্সি? সুরেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁহার তুলনা করিয়া দেখিলে, তিনি ত কাঁউরূপী সিঙ্গিবোঙ্গাকে আরও বেশী অবিশ্বাস করেন।

জু। না, অমরেন্দ্রনাথকে কেন বিবাহ করিবে?

সে। তবে কি ডাক্তার বেন্টউডকে বিবাহ করিতে বল নাকি? এমন অদ্ভুত লোক আর কখনও দেখি নাই।

জু। বড় চমৎকার লোক—বড় ভাল্ লোক, লোকটা বড় ধাৰ্ম্মিক।

“আমার ত কিছুতেই তা’ মনে হয় না,” বলিয়া সেলিনা ধীরে ধীরে উঠিয়া গেল; এবং বারান্দার শেষপ্রান্তে গিয়া দাঁড়াইল। সেখানে দিনশেষের লোহিতকিরণচ্ছটা অদূরবর্তী ঝাউ ও দেবদারুর পত্রান্তরাল মধ্য দিয়া বর্ষিত হইতেছে। হেমকরসম্পাতে সেলিনার সুন্দর আরক্ত মুখখানি তখন সদ্যঃপ্রোদ্ভিন্ন রক্তোৎপলের ন্যায় অতি সুন্দর। সেলিনার মনে সুখছিল না, তাহার মুখ বিষণ্ণ দৃষ্টি বিষণ্ণ, হৃদয় বিষণ্ণ, সেই অপ্রসন্ন বিষণ্নতার মধ্য দিয়া বর্ষারাত্রির স্বচ্ছ জ্যোৎস্নার মত একটা অপ্রসন্ন জ্যোতিঃ তাহার অপরিসীম নবীন সৌন্দর্য্যে প্রতিক্ষণে উজ্জ্বলতর হইয়া বিচ্ছুরিত হইতেছিল। অনেকক্ষণ ধরিয়া সেলিনা বহির্জগতের মনোমদ দৃশ্য দেখিতে দেখিতে সহসা কি মনে করিয়া আবার জুলেখার কাছে ফিরিয়া আসিল; এবং জুলেখার মুখের উপরে স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া বলিল, “জুলেখা, বেন্টউডের সঙ্গে আমার বিবাহে তোর এত আগ্রহ কেন?”

জুলেখা কহিল, “বড় চমৎকার মানুষ তিনি, এমন মানুষ আমি এ দেশে আর দেখি না। বড় ভাল মানুষ!”

সে। আমি তাঁকে অত্যন্ত ঘৃণা করি।

জু। কিন্তু, তিনি তোমায় অত্যন্ত ভালবাসেন। আমি তাঁর নিজের মুখে সে কথা অনেকবার শুনিয়াছি।

সে। [সহাস্যে] তোর এত টান্ দেখে বোধ হয়, বেন্টউড তোকে কোন মন্ত্রে একেবারে যাদু করিয়া ফেলিয়াছেন। তুই তাঁকে এত ভয় করিস্ কেন?

“জুলেখা কাহাকেও ভয় করিবার মেয়ে নয়। আমাকে মন্ত্রে যাদু করা দুই পাটি দাঁতের কাজ নয়।” এই বলিয়া জুলেখা সহসা কোন প্রেতাত্মার আবির্ভাব আশঙ্কা করিয়া ভীতভাবে চারিদিকে চাহিতে লাগিল। তাহার পর বলিল, “জুলেখার গুণ তোমার জানা আছে-সে বেন্টউডকে সাত ঘাটের জল খাইয়ে আনিতে পারে। যাই হোক্, তোমায় এখনই হোক্ আর দুই দিন পরে হোক্, বেন্টউডকে বিয়ে করিতেই হইবে।”

সে। বিষ খাইয়া মরিতে হয়—তাহাও স্বীকার, বেন্টউডকে আমার ছায়া স্পর্শ করিতে দিব না—বিবাহ ত দূরের কথা। আমি সুরেন্দ্রনাথকে হৃদয় সমর্পণ করিয়াছি।

জু। যা খুসি এখন তাই কর—জুলেখা বাঁচিয়া থাকিতে সুরেন্দ্রকে তুমি কখনই পাবে না। সে। কে বলিল—তোর কাঁউরূপী, না সিঙ্গিবোঙ্গা?

জু। দুজনের একজন

সে। আমি তোর ওই দুজনের একজনকেও বিশ্বাস করি না। আমি সুরেন্দ্রনাথের মুখে শুনিয়াছি, ও সব মূর্খ লোকের কুসংস্কার।

জু। [ক্রোধে] মুখ সাম্‌লিয়া কথা কও, সেলিনা।

সে। ডাক্তার সাহেব তোর কাঁউরূপীকে খুব বিশ্বাস করে না?

জু। সে কথা আমি জানি না। কিন্তু, সেলিনা নিশ্চয় জেন, যদি আমাদের কাঁউরূপী সত্য হয়, কখনই সুরেন্দ্রনাথের সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে না।

সে। বেশ, পরে দেখা যাবে। কিন্তু এখন—

সেলিনার মুখের কথা মুখে রহিয়া গেল। দুই হস্ত প্রসারিত করিয়া জুলেখা উচ্চকণ্ঠে ডাকিল, “আশানুল্লা!”

উঠিতে পড়িতে তখনই শীর্ণকায় আশানুল্লা আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার বয়স ত্রিশ বৎসর। কিন্তু তাহাকে দেখিতে পনের বৎসরের বালকের মত। যেমন বেঁটে, তেমনি সূক্ষ্মবস্ত্রাবৃত নরকঙ্কালের ন্যায় কৃশ—মুখে দাড়ী-গোঁপের চিহ্নমাত্রও নাই। বর্ণ শুষ্ক এবং সুকৃষ্ণ। পরিধানে অতি জীর্ণ শতগ্রন্থিপূর্ণ একখানি মলিন বস্ত্র। সেই মূর্তিমান দারিদ্র্য আশানুল্লাকে সেলিনা অনেক সময়ে অনেক অনুগ্রহ করিত; কোন দিন সে খাইতে না পাইলে সেলিনা তাহাকে খাইতে দিত—কখনও বা কিছু পয়সা দিয়া সাহায্য করিত। সেজন্য সে সেলিনার অতিশয় বাধ্য হইয়াছিল; দিনের মধ্যে একবার-না-একবার সে সেলিনার সহিত দেখা করিবেই; কিন্তু জুলেখাকে সে বাঘের মত দেখিত; যদিও জুলেখার কাঁউরূপী প্রভৃতির অর্থ ভালরূপে একদিনও আশানুল্লার বোধগম্য হয় নাই, তথাপি সে তাহাকে অত্যন্ত ভয় করিত।

সেলিনা তাহাকে স্নেহকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, “আজ কেমন আছিস, আশানুল্লা? কোন অসুখ হয় নাই ত?”

আশা। “না মা, বেশ ভাল আছি। আজ একটা বড় মজা হয়েছে। পথে আজ হুজুর সুরেন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা হয়েছিল; তিনি আমাকে আজ একটা টাকা দিয়াছেন।

সে। হাঁ, তিনি বড় দয়ালু লোক—আমি তা’ জানি। টাকাটা দিল কেন?

আশা। তিনি আমাকে আপনার কথা জিজ্ঞাসা করলেন, আমি বল্লুম “ভাল আছে;” আর তিনি পকেটের ভিতরে একবার হাত দিয়ে, টপ্ করে একটা টাকা বার ক’রে আমার দিকে ছুড়ে ফেলে দিলেন।

হাসিয়া সেলিনা বলিল, “যাক্, ওসব বাজে কথায় কাজ নাই, তুই এখন যা।” বলিয়া সেলিনা তথা হইতে চঞ্চল চরণে নিজের শয়ন-গৃহের দিকে চলিয়া গেল।

.

জুলেখা আশানুল্লাকে নিভৃতে পাইয়া, তাহার কাণের কাছে মুখ লইয়া মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, “ডাক্তার সাহেব আর কি বলেন?”

“চালেনা-দেশম্।”

শুনিয়া জুলেখা চমকিত হইয়া উঠিল। তাহার আপাদমস্তক ব্যাপিয়া একটা কম্প আসিয়া উপস্থিত হইল। সে একান্ত বিস্ময়বিহ্বল হয়া তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আশানুল্লার দিকে একবার চাহিয়া দেখিল।

অষ্টম পরিচ্ছেদ – মন্ত্রবল না HYPNOTISM?

জুলেখার সেইরূপ ভাব বৈলক্ষণ্য দেখিয়া

আশানুল্লা অতিমাত্র বিস্মিত হইল। ‘চালেনা-দেশমের’ গভীর রহস্য এবং তাহার অর্থ সে কিছুমাত্র হৃদয়ঙ্গম করিতে পারে নাই। ক্ষণপরে জুলেখা নিজেদের মাতৃভাষায় আপন মনে কি বলিতে বলিতে একটা রৌদ্রস্নাত দেবদারু গাছের দিকে অন্যমনে চাহিয়া রহিল।

জুলেখার সেইরূপ ভাব দেখিয়া দুৰ্ব্বলহৃদয় আশানুল্লার কিছু ভয়ও হইয়াছিল। সে ভীতকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি আপনার মনে কি বল্‌ছ? আমি ত—”

বাধা দিয়া জুলেখা কলিল, “আমি যা’ বলছি তোর মত সাতটা এলেও বুঝতে পারবে না। দেখ, আমার চোখের দিকে ঠিক একদৃষ্টে চেয়ে থাক্।”

ভয়ে ভয়ে, নিতান্ত অনিচ্ছায় আশানুল্লা জুলেখার চোখের দিকে চাহিয়া রহিল।

জুলেখার স্থিরদৃষ্টিতে তাহার চোখের দিকে চাহিতে চাহিতে, তাহার মুখের কাছে বক্রগতিতে দুই তিনবার উভয় হস্ত সঞ্চালন করিয়া অনুচ্চস্বরে একটা কি মন্ত্রপাঠ করিল।

সহসা অননুভূতপূর্ব্ব দারুণ নিদ্রাঘোর আসিয়া আশানুল্লার সমুদয় চিত্তবৃত্তি একেবারে আচ্ছন্ন করিয়া দিল। এবং ক্রমে তাহার চক্ষু বিনত, সংজ্ঞা বিলুপ্ত ও মন জুলেখার বশীভূত হইল।*

[* মস্তক হইতে পদাঙ্গুলির অগ্রভাগ পর্য্যন্ত সহস্র সহস্র সূক্ষ্মতম শিরা মানব-শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ব্যাপ্ত হইয়া রহিয়াছে। এই সূক্ষ্মতম শিরাগুলিকে স্নায়ুমণ্ডলী বলে। কোন একটী শিরা কাটিলে তন্মধ্যে রক্তস্রোতঃ প্রবাহিত হইতে দেখা যায়, কিন্তু এই সকল স্নায়ুতে কি চলাচল করে, তাহা কোন যন্ত্রের সাহায্যে না দেখিলে জানিবার কোন উপায় নাই। এক্ষণে বৈজ্ঞানিক পণ্ডিতেরা স্থির করিয়াছেন যে, ঐ সকল স্নায়ুতে এক প্রকার তাড়িত প্রবাহিত হয়। চর্চ্চা রাখিলে ইচ্ছাশক্তির প্রাবল্যে অঙ্গুলির অগ্রভাগ হইতে অথবা দৃষ্টির দ্বারা এই তাড়িত-প্রবাহ অন্যের শরীরে সঞ্চালিত করা যাইতে পারে। শরীরে অপরিমিত তাড়িতের সমাবেশে লোকে অজ্ঞান বা মুগ্ধাবস্থা প্রাপ্ত হয়। এইরূপ চক্ষে চক্ষে চাহিয়া, ইচ্ছাশক্তির প্রভাবে তাড়িত-প্রবাহ সহযোগে একজন আর একজনকে মুগ্ধ বা নিদ্রিত করার নাম মেমেরিজম্। মেসমেরিজমের অপর নাম হিপ্‌টীজম্—হিপ্‌টীজম্ মেমেরিজমের চরমোৎকর্ষ। মুগ্ধ ব্যক্তি সেই সময়ে সম্পূর্ণরূপে মুগ্ধকারীর বশীভূত ও আজ্ঞাধীন হইয়া পড়ে; এবং তাহার অনেক অত্যাশ্চর্য্য ক্ষমতা জন্মে। সেই ক্ষমতায় সে মুগ্ধকারীর অনুমতিক্রমে অনেক অশ্রুতপূৰ্ব্ব কথা ও অদৃষ্টপূর্ব্ব দর্শনের বৃত্তান্ত বলে, ভূত ভবিষ্যৎ বর্ত্তমানের কথা বলে; এবং বহুদূরস্থ ব্যক্তি সেখানে তখন কি করিতেছে, তাহা যেন নিজে এখানে স্পষ্ট দেখিতে পাইতেছে, এরূপ বর্ণনা করে। এইরূপ অবস্থায় মুগ্ধকারী ভিন্ন অপর কাহারও কথা তাহার কর্ণগোচর হয় না, সুতরাং অপরের কোন প্রশ্নেও উত্তর করিতে পারে না। মুগ্ধকারী কোন কার্য্যের জন্য তাহাকে কোন স্থানে যাইতে আদেশ করিলে, সে স্থান যেমনই দুর্গম এবং সেই কাৰ্য্য যেমনই দোষাবহ হউক না কেন, হিতাহিত-বিবেচনাশূন্য হইয়া মুগ্ধব্যক্তি নিদ্রিত বা অভিভূত অবস্থায় উঠিয়া নিজের অজ্ঞাতে মুগ্ধকারীর নির্দ্দিষ্ট স্থানে যাইয়া নিৰ্দ্দিষ্ট কাৰ্য্য সম্পন্ন করিয়া আসিবে। কিন্তু তাহার পর যখন মুগ্ধব্যক্তির সেই অবিভূত অবস্থার বিলোপ হইয়া জ্ঞানের সঞ্চার হয়, তখন তাহার সে সকল কথা কিছুই মনে থাকে না—চেষ্টা করিয়াও মনে করিতে পারে না। যাহাদের ইচ্ছাশক্তি ও হৃদয় দুর্ব্বল, তারা সামান্য চেষ্টায় মুগ্ধ হইয়া থাকে। পরিশিষ্টে ইহার বিস্তৃত বিবরণ লিখিত হইল।]

জুলেখা কহিল, “চালেনা-দেশম্’ এখন কোথায় আছে? ঠিক করিয়া কহ।”

মন্ত্রমুগ্ধ আশানুল্লা নিঃসংজ্ঞাবস্থায় বলিল, “দত্ত সাহেবদের বাড়ীতে বাংলো ঘরের ভিতর আছে।”

“ঘরের কোথায় আছে?”

“দেওয়ালের গায়ে।”

“তুমি এখন সেই বাংলোর ভিতর যাও।”

“আসিয়াছি।”

“ওখানে আর কেহ আছে?”

“কেহ না।”

“চালেনা-দেশম্’ কি রকম দেখতে?”

“সবুজ রং, একহাত লম্বা, মোটা বেতের মত দেখতে। সোনা দিয়ে বাঁধান, দামী চুণীপান্নার কাজ করা।”

জুলেখা ধীরে ধীরে দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়া একবার আশানুল্লার ললাট স্পর্শ করিল। তাহার পর বলিল, “চালেনা-দেশমের’ ভিতরে কি আছে দেখ, আমি তোমার কাছে উহার ভিতরের কথা জানিতে চাই।”

“ভিতরে একটা সরু রূপার নল আছে, নলের মুখের কাছে লোহার একটা খুব সরু সূচ আছে।” ক্ষণপরে—”সূচটা ফাঁপা।”

“সেই রূপার নলের ভিতরে কোন বিষ আছে?

“না।”

“ঠিক করিয়া কহ।”

“বিষ শুখাইয়া গেছে।”

“সূচের ভিতরে বিষ আছে?”

“না—বিষ শুখাইয়া গেছে।”

এমন সময়ে অদূরে কাহার পদশব্দ শুনিতে পাইয়া জুলেখা চকিত হইল। এবং আশানুল্লার মুখের উপরে তাড়াতাড়ি দুই-একবার হস্তদ্বয় সঞ্চালন করিয়া তাহাকে প্রকৃতিস্থ করিল। আশানুল্লা নিদ্রোত্থিতের ন্যায়, উভয় হস্তে চক্ষু মার্জ্জনা করিতে করিতে চারিদিকে চাহিতে লাগিল; এবং সম্মুখে জুলেখাকে দেখিয়া অতিমাত্র বিস্মিত হইল।

জুলেখা বলিল, “তোকে আমি সিঙ্গিবোঙ্গার যাদু করেছিলেম। ‘চালেনা-দেশমের’ যা’ কিছু সব খবর, আমি তোর মুখ থেকে বা’র ক’রে নিয়েছি।”

শিহরিয়া আশানুল্লা বলিল, “চালেনা-দেশম্!” না আমি ত তার কিছু জানি না। ডাক্তার সাহেবের মুখে আমি শুধু নামই শুনেছি। এই কতক্ষণ হ’ল, আমি রাস্তা দিয়ে আছি; এমন সময়ে ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে দেখা। তিনি আমায় ডেকে বললেন, ‘তুই কি এখন সেলিনা বিবির কাছে যাচ্ছিস্?’ আমি বললেম, ‘হাঁ।’ তিনি বলেন, ‘তা’ হ’লে তুই একবার জুলেখার সঙ্গে দেখা করে বলিস্, ডাক্তার সাহেব ব’লে দিয়েছেন, ‘চালেনা-দেশম্।’ কিন্তু আমি আর কিছু—”

বাধা দিয়া জুলেখা বলিল, “তা’ আমি জানি, আমি সিঙ্গিবোঙ্গার মারফৎ তোর আত্মাকে দত্ত সাহেবের বাড়ীতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন; ‘চালেনা-দেশমের’ কথা আমি তোর মুখে সব শুনেছি।

শিহরিয়া আশানুল্লা দুইপদ পশ্চাতে হটিয়া আসিয়া ভীতিকম্পিতকণ্ঠে বলিল, “না খেতে পেয়ে ম’রে যাব, তবু আর আমি তোমার সামনে আস্ত না। আমি জানি, তুমি ভূত প্রেত ডাইনী যাদু নিয়ে কোন্ দিন আমাকে মেরে ফেলবে। আমার একটু একটু মনে পড়েছে—যখন তুমি আমাকে তোমার দিকে চাইতে ব’লে আমার মুখের দিকে চেয়ে রৈলে, তখনই আমার মনের ভিতরে যেন কি রকম হ’তে লাগ্‌ল।”

জুলেখা বলিল, “যা, রান্নাঘরের কোণে তোর জন্যে কিছু খানা রেখে এসেছি, গিয়ে খেয়ে আয়।”

খানার নামে আনন্দাতিশষ্যে আশানুল্লার চক্ষু বিস্ফারিত এবং রসনা সরস হইল; এবং তাহার হাস্যপ্রোদ্ভিন্ন শুষ্ক অধরৌষ্ঠের মধ্য দিয়া অনেকগুলি দত্ত যুগপৎ বিকসিত হইল। আশানুল্লা ছুটিয়া চলিয়া গেল।

নবম পরিচ্ছেদ – সাক্ষাতে

জুলেখার নিকট হইতে পলাইয়া সেলিনা নীচে নামিয়া আসিল। দেখিল, অদূরে সুরেন্দ্রনাথ আসিতেছেন। সুরেন্দ্রনাথকে দেখিয়া আগ্রহভরে সেলিনা ছুটিয়া গিয়া তাঁহার হাত ধরিল। সুরেন্দ্রনাথ তাহাকে প্রেমভরে বাহুবেষ্টন করিয়া মুখচুম্বন করিলেন। সেলিনা লজ্জারক্তমুখে মস্তক অবনত করিল।

সুরেন্দ্রনাথ তাহার ললাট হইতে আনয়নবিলম্বী অলকগুচ্ছ সরাইতে সরাইতে প্রেমপূর্ণ কণ্ঠে কহিলেন, “সেলিনা, কেমন আছ?”

সেলিনা কহিল, “বড় ভাল নয়; জুলেখা আমাকে অত্যন্ত বিব্রত করিয়া তুলিয়াছে। চল, আমরা উপরের ঘরে গিয়া বসি।”

সুরেন্দ্রনাথ ও সেলিনা দ্বিতলের একটি কক্ষে গিয়া বসিলেন।

সুরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “যাহাতে জুলেখার একটু শাসন হয়, আমি তোমার মাকে বলিয়া সে চেষ্টা করিব। আর আমি তোমার মার নিকট কোন কথা গোপন করিব না—আজ আমি প্রকাশ্যভাবেই তাঁহার কাছে আমাদের পরস্পর গভীর প্রণয়ের কথা প্রকাশ করিব। এবং যাহাতে তিনি তোমার সহিত আমার শীঘ্র বিবাহ দেন, নিজেই তাঁহার নিকট প্রস্তাব করিয়া দেখিব, তিনি কি বলেন। সম্মত হন—ভাল, তাহা হইলে জুলেখার হাত হইতে তুমিও শীঘ্র মুক্তি পাইবে।”

সেলিনা। [চিন্তিত ভাবে] যদি না সম্মত হন –

সুরেন্দ্র। না হইবার কারণ ত কিছুই দেখি না।

সে। জুলেখা ইহার ভিতরে রহিয়াছে।

সু। জুলেখা কি করিবে? ইহাতে তার কোন হাত নাই।

সে। খুব আছে। জুলেখা কখনই আমার মাকে সম্মত হইতে দিবে না। বিশেষতঃ মা জুলেখাকে বড় ভয় করেন।

সু। জুলেখাকে তোমার মা ভয় করেন! এ কেমন কথা হইল? জুলেখা ত তোমাদের দাসী। সে। জুলেখা বড় সহজ মেয়ে নয়, সে অনেক গুপ্ত-বিদ্যা জানে।

সু। [বাধা দিয়া] ও সব ভুল—ভুল—একটা ঘোর কুসংস্কার।।

সে। তোমার উপরে জুলেখার বড় রাগ।

সু। তার রাগে আমার কিছু আসে-যায় না। তার মত শতটা জুলেখার রাগে আমার কিছুই হইবে না। কিন্তু তার সঙ্গদোষে তোমার মতিগতির ক্রমশঃ অধঃপতন হইতেছে দেখিয়া, আমি বড়ই উদ্বিগ্ন হইয়াছি। যেমন করিয়া পারি, আমি তাহার হাত হইতে তোমাকে মুক্ত করিব। জুলেখা কি করিয়া আমাদের বিবাহে বাধা দিবে? তোমার মা নিশ্চয়ই এ সকল গুরুতর বিষয়ে একজন অশিক্ষিত কুলী-রমণীর পরামর্শ লইয়া কাজ করিবেন না।

সে। জুলেখার অমতে মা বোধ হয়, কিছুতেই মত দিতে পারিবেন না।

সু। কেবল তোমার মা নহেন, তুমিও জুলেখাকে যথেষ্ট ভয় কর দেখিতেছি। যা-ই হোক্‌, আজ আমি নিজেই তোমার মার কাছে আমাদের বিবাহের প্রস্তাব করিব; দেখি তিনি কি বলেন- তাহার পর আমি জুলেখাকে বুঝিব

সে। আজ তুমি মার কাছে আমাদের বিবাহ প্রস্তাব করিবার জন্য হঠাৎ ব্যগ্র হইতেছ কেন, বুঝিতে পারিলাম না।

সু। কেবল অমর দাদার জন্য আমি এ কথা এতদিন প্রকাশ করিতে সাহসী হই নাই। অনেক দিন হইতে তিনি, তোমাকে ভালবাসেন, এবং তিনি অত্যন্ত বদ্রাগী লোক। পাছে আপনা-আপনি ভিতরে একটা বিবাদের সূত্রপাত হয়, এই ভয়েই আমি এতদিন আমাদিগের প্রণয় গোপন করিয়া আসিতেছিলাম; কিন্তু প্রসঙ্গক্রমে কাল সব আমার মুখ দিয়াই প্রকাশ হইয়া গিয়াছে। হয়ত আজ অমর দাদাও একবার তোমার মত জানিতে আসিবেন।

সে। আমি ত তাঁহাকে ভালবাসি না—আমি তোমাকে ভালবাসি।

সু। আমি তা’ জানি, কিন্তু তিনি ত তা’ জানেন না। যখন তিনি তোমাদের কাছে এ কথা শুনিবেন, তখন তিনি স্বেচ্ছায় এ বিবাহ-সঙ্কল্প ত্যাগ করিতে পারিবেন; আর তাহাতে আমাদেরও পরস্পর মনোবিবাদ ঘটিবার সম্ভাবনা থাকিবে না।

সে। তুমি কি তাঁকে বড় ভয় কর?

সু। হাঁ, আমার নিজের জন্য নয়, আমাদের পরস্পরের মধ্যে যদি এরূপ একটা মনোমালিন্য ঘটে, তাহা হইলে মামা মহাশয় অত্যন্ত মনঃক্ষুণ্ণ হইবেন; কিন্তু কাল তোমার কথা লইয়া তাঁহার সহিত আমার অনেক বচসা হইয়াছে। বেন্টউড সেই বচসার একমাত্র কারণ।

সে। [শিহরিয়া] বেন্টউড! ডাক্তার?

সু। হাঁ, তিনিও তোমার রূপে মুগ্ধ

সে। আমি তা জানি, তাঁকে ভালবাসা দূরে থাক, সাপের চোখের মত তাঁহার চোখ দুটি কেমন এক রকম ভীষণ, তাঁকে দেখলেই আমার বড় ভয় করে। জুলেখার বড় ইচ্ছা যে, ডাক্তার বেন্টউডের সঙ্গে আমার বিবাহু হয়।

সু। [বিরক্ত ভাবে] মরুক্ তোমার জুলেখা, এ সকল কথায় তার দরকার কি? তার নিজের কি আর কোন কাজ নাই?

তাঁহারা উভয়ে যে কক্ষে কথোপকথন করিতেছিলেন, তথা হইতে বাড়ীর সম্মুখের পথ এবং গেট বেশ দেখা যায়। উভয়ে দেখিলেন দুই হাত ঊর্দ্ধে তুলিয়া জুলেখা রাস্তার দিকে দ্রুতপদে যাইতেছে। তাহার মুখ চোখের ভাব কেমন-এক-রকম—অস্থির। সে ছুটিয়া গিয়া গেটের সম্মুখে দাঁড়াইল; এবং দুই হাত প্রসারিত করিয়া উচ্চকণ্ঠে বলিতে লাগিল, “কাঁউরূপী—কাঁউরূপী!”

সেলিনা শঙ্কিতভাবে কহিল, “নিশ্চয় বেন্টউড এখনই আসিবেন। যখনই জুলেখা ঐখানে দাঁড়াইয়া এরূপ ব্যাকুল ভাবে ‘কাউরূপী’ ‘কাঁউরূপী’ বলিয়া চীৎকার করে; দেখিতে না দেখিতে ডাক্তার বেন্টউড আসিয়া উপস্থিত হন—ইহার অর্থ কি?”

সুরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “তোমার কথাটা আমি ঠিক বুঝিতে পারিলাম না।”

সেলিনা কহিল, “জুলেখা ও বেন্টউডের মধ্যে একটা কোন যোগাযোগ আছে। যখনই বেন্টউড আমাদের বাড়ীর দিকে আসেন—জুলেখা তা আগে থেকেই জানিতে পারে। এই প্রমাণ দেখ না, এখনই বেন্টউডের আবির্ভাব হয়।”

সেলিনার কথা শেষ হইতে-না-হইতে বেন্টউড সাহেব গেটের সম্মুখে দেখা দিলেন। জুলেখা তাঁহার পদতলে ব্যাকুলভাবে লুটাইয়া পড়িল। বেন্টউড তাহাকে ধরিয়া তুলিলেন। এবং রাস্তায় বাহির হইয়া যাইতে অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিলেন।

জুলেখা বাহির হইয়া গেল।

দশম পরিচ্ছেদ – বিবাহ-প্রস্তাবে

যে কক্ষে বসিয়া সুরেন্দ্রনাথ ও সেলিনা কথোপকথন করিতেছিলেন, মিঃ বেন্টউড রুমালে মুখ মুছিতে মুছিতে সেইখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

সেলিনা বেন্টউডকে কহিল, “জুলেখা জানু পাতিয়া বসিয়া আপনাকে এমন ব্যাকুলভাবে কি বলিতেছিল?”

বেন্টউড কহিল, “কিছুই না, জুলেখা বড় কৃতজ্ঞ। জুলেখার একবার সাংঘাতিক পীড়া হয়; আমিই তাহাকে নীরোগ করি, তাহা ত তুমি জান; সেই অবধি জুলেখা আমাকে বড় ভক্তি করে।”

সুরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “আপনি কি ছোটনাগপুর অঞ্চলে কখনও গিয়াছিলেন?”

বেন্টউড কহিলেন, “আমি পৃথিবীর অনেক অঞ্চলেই গিয়াছি।”

সুরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “আপনি কোল্জাতিদের কাউরূপী সাধনার কি কোন সংবাদ রাখেন?”

বেন্টউড কহিলেন, “সকল বিষয়েই কিছু কিছু সংবাদ রাখা আমার অভ্যাস। কিন্তু বলিতে কি, কোল্‌দের ইন্দ্রজাল তন্ত্রমন্ত্রের উপর আমার বিশেষ কিছু আস্থা নাই।” তাহার পর সেলিনার দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “তোমার মা কেমন আছেন?”

সেলিনা বলিল, “ভাল আছেন। আপনি কি এখন তাঁর সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছেন?”

বেন্টউড বলিলেন, “কেবল তোমার মার সঙ্গে দেখা করিতে আসি নাই; তোমার সঙ্গে এবং এই ভদ্রলোকের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করিবার আমার বিশেষ প্রয়োজন আছে।”

সুরেন্দ্রনাথ উত্তেজিত কণ্ঠে বলিলেন, “এখানে আমার সহিত সাক্ষাতে আপনার এমন কি প্রয়োজন? তাই যদি বা হয়, আপনি অনায়াসে আমাদের বাড়ীতে যাইতে পারিতেন।”

বেন্টউড কহিলেন, “তোমার যে এখানে দেখা পাইব, তা’ আমি পূৰ্ব্ব হইতেই জানিতাম; সুতরাং তোমাদের বাড়ীতে যাইবার জন্য অতিরিক্ত কষ্ট স্বীকারের কোন অবশ্যকতা দেখিলাম না।” সুরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “আমি যে এ সময়ে এখানে থাকিব, তাহা আপনি কি করিয়া জানিতে পারিলেন?”

বেন্টউড কহিলেন, “কাল তোমাদের বাংলো ঘরে বসিয়া যে সকল কথাবার্তা হইয়াছিল, তাহাতে আমি এ অনুমানটা সহজেই করিতে পারিয়াছি। [ঘৃণাভরে] যা-ই হোক—সুরেন্দ্রনাথ, দেখি, জয়শ্রী কাহার অনুকূল হন।”

কথাটার অর্থ সেলিনা ভাল বুঝিতে পারিল না। সবিস্ময়দৃষ্টিতে সে একবার বেন্টউড, এবং একবার সুরেন্দ্রনাথের মুখের দিকে ঘন ঘন চাহিতে লাগিল। দেখিল, বেন্টউড সাহেব বিদ্রূপব্যঞ্জক ভ্রূভঙ্গি করিয়া সুরেন্দ্রনাথের দিকে চাহিয়া আছেন। ক্রোধাবেগে সুরেন্দ্রনাথের চক্ষুঃ জ্বলিতেছে— সুরেন্দ্রনাথ অতিকষ্টে ক্রোধ সম্বরণের চেষ্টা করিতেছেন। পাছে একটা দুর্ঘটনার সূত্রপাত হয়—এই ভয়ে সেলিনার হৃদয় উদ্বেলিত হইয়া উঠিল। সেলিনা বলিল, “আপনারা বসুন, আমি মাকে ডাকিয়া অনিতেছি।”

এই বলিয়া সেলিনা দ্রুতপদে তথা হইতে চলিয়া গেল। অনতিবিলম্বে মাতাকে সঙ্গে করিয়া ফিরিয়া আসিল। এবং নিজে তথা হইতে চলিয়া যাইবার উপক্রম করিল।

বেন্টউড বাধা দিয়া কহিলেন, “মিস্ সেলিনা, একটু অপেক্ষা কর। তোমার মার নিকটে তোমার সম্বন্ধেই আমার একটা কথা আছে।”

কথাটা কি, সেলিনা অনুভবে বুঝিতে পারিল। তাহার মুখ মলিন হইয়া গেল। সে নীরবে এক পার্শ্বে দাঁড়াইয়া রহিল।

সেলিনার মাতাকে সম্বোধন করিয়া বেন্টউড কহিলেন, “দেখুন, এতদিন আপনাদের বাড়ীতে যে আমি যাতায়াত করিতেছি, ইহার ভিতরে অবশ্যই একটা অভিপ্ৰায় থাকা সম্ভব। নিরর্থক কেহ কোন কাজ করে না। আপনাকে আর আপনার কন্যাকে আজ আমি একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে আসিয়াছি। আশা করি, আপনাদের কাছে আমি আমার প্রশ্নের সদুত্তর পাইব।”

বিস্মিত হইয়া সেলিনার মাতা কহিলেন, “কথাটা কি?”

বেন্টউডের কথার ভাবে এবং চোখ দেখিয়াই সেলিনা তাঁহার মনোভাব বেশ বুঝিতে পারিল। ব্যগ্রকণ্ঠে সেলিনা বেন্টউডকে কহিল, “আপনি এ কথা তুলিবেন না—উত্তর শুনিয়া আপনার মনে কষ্ট হইতে পারে।”

বেন্টউড বলিলেন, “সেজন্য আমি চিন্তিত নহি।” পরে সেলিনার মাতার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “আমি আপনার কন্যার রূপে মুগ্ধ। যে দিন আমি সেলিনাকে দেখিয়াছি, সেইদিন হইতেই আমি তাহাকে ভালবাসিতে আরম্ভ করিয়াছি, আমার একান্ত আগ্রহ, আমার সহিত সেলিনার বিবাহ হয়। মিস্ সেলিনা, তোমার মত কি?”

বেন্টউডের এইরূপ প্রস্তাবে সুরেন্দ্রনাথ মনে মনে অত্যন্ত বিরক্ত হইলেন। গৰ্ব্বিতস্বরে তিনি কহিলেন, “মিঃ বেন্টউড, আপনি আমার নিকটে আপনার এ প্রশ্নের সদুত্তর পাইবেন। সেলিনার আশা আপনি এখন হইতে ত্যাগ করুন—সেলিনা কখনই আপনার হইবে না; সে আমাকে বিবাহ করিবার জন্য আমার নিকটে প্রতিশ্রুত হইয়াছে।”

সেলিনার মাতা রুক্ষস্বরে কহিলেন, “সেলিনা, এ কথা সত্য না কি?”

সেলিনা বলিল, “সত্য, যদি বিবাহ করিতে হয়, তবে সুরেন্দ্রনাথকেই আমি বিবাহ করিব।”

সেলিনার মাতা অতিশয় রুষ্ট হইলেন। কহিলেন, “হতভাগা অবাধ্য মেয়ে! তুমি কিছুতেই আমার অমতে বিবাহ করিতে পারিবে না। আর সুরেন্দ্রনাথের এরূপ ব্যবহারে আমি অতিশয় দুঃখিত হইলাম। মাতাপিতার অজ্ঞাতে কোন বালিকার মনকে এরূপে ভিন্ন পথে পরিচালিত করা ভদ্রসন্তানের উচিত কাজ নয়। তুমি বড়ই অন্যায় কাজ করিয়াছ; এ সম্বন্ধে তুমি এ পর্যন্ত কোন কথাই আমাকে বল নাই।”

সুরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “না বলিবার একটা বিশেষ কারণ ছিল। তার পর যখন আজ মিঃ বেন্টউড নিজের হঠকারিতা দেখাইলেন, তখন কাজেই আমাকে এ কথা প্রকাশ করিতে হইল।”

মৃদুহাস্যে বেন্টউড কহিলেন, “সুরেন্দ্রনাথ, ইহাতে তুমি আমার হঠকারিতা কি দেখিলে?”

দৃঢ়স্বরে সুরেন্দ্রনাথ করিলেন, “যতদূর হইতে হয়। আপনি মিস্ সেলিনাকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখুন, মিস্ সেলিনা সর্ব্বতোভাবে আপনার এ প্রস্তাবে অস্বীকার করিবে।”

বেন্টউড কহিলেন, “মিস্ সেলিনা!”

রুক্ষস্বরে সেলিনার মাতাও বলিলেন, “সেলিনা!”

সেলিনা উভয়েরই মুখপানে নিতান্ত বিনীতভাবে চাহিয়া কহিল, “যদি বিবাহ করিতে হয়, আমি সুরেন্দ্রনাথকে ছাড়া আর কাহাকেও বিবাহ করিব না।”

‘এই যদি আমার প্রশ্নের সদুত্তর হয়, তাহা হইলে আর আমার এখানে থাকিবার কোন আবশ্যকতা নাই। এই বলিয়া বেন্টউড উঠিলেন। উঠিয়া বলিলেন, “মিস্ সেলিনা, মনে থাকে যেন, একদিন ইহার জন্য তোমাকে যথেষ্ট অনুতাপ করিতে হইব।”

সেলিনা কহিল, “ইহাতে আমি এমন কিছুই দেখিতেছি না, যাহার জন্য পরে আমাকে কিছুমাত্র অনুতপ্ত হইতে হইবে।”

বেন্টউড দৃঢ়স্বরে কহিলেন, “এখন দেখিতেছ না, যখন সুরেন্দ্রনাথের মৃত্যু হইবে—তখন দেখিবে।”

কথাটা শুনিয়া সেলিনা শিহরিয়া উঠিল, সেলিনার মাতা শিহরিয়া উঠিলেন, এবং সুরেন্দ্রনাথ শিহরিয়া উঠিলেন। একটা বিপদাশঙ্কায় সেলিনার গোলাপাভ সুকোমল গণ্ডের রক্তরাগ মলিন হইতে লাগিল।

সুরেন্দ্রনাথ ঘৃণাব্যঞ্জক স্বরে কহিলেন, “কাল মিঃ বেন্টউডের মুখে এই রকম একটা কথা একবার শুনিয়াছিলাম যে, যদি আমি বিবাহ করি, আমাকে জীবস্মৃত হইতে হইবে। আমার বিশ্বাস, মিঃ বেন্টউডের মস্তিষ্কের কোন দোষ আছে। সময়ে সময়ে সেটা এইরূপে প্রবল হইয়া প্ৰকাশ পায়।”

বেন্টউড দৃঢ়স্বরে কহিলেন, “সুরেন্দ্রনাথ, আমি একবার তোমাকে সতর্ক করিয়াছি। আজও আবার বলিতেছি, বিবাহের কিছু পূর্ব্বে বা পরে নিশ্চয়ই জীবমৃত্যু তোমার অদৃষ্ট-লিপি। আমার কথা প্রতি মুহূর্ত্তে স্মরণ করিয়ো। এখন আমি চলিলাম।”

বেন্টউড সদর্পপাদক্ষেপে তথা হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন।

বেন্টউড বাহিরে আসিয়া দেখিলেন, সম্মুখদ্বারে জুলেখা তখনও তাঁহার অপেক্ষায় দাঁড়াইয়া আছে।

তাহার দিকে তীব্র কটাক্ষপাত করিয়া বেন্টউড কহিলেন, “কিছুতেই কিছু হইল না—এখন ‘চালেনা-দেশম্’ ছাড়া আর কোন উপায়ই নাই।”

একাদশ পরিচ্ছেদ – মা ও মেয়ে

বেন্টউড চলিয়া গেলে সুরেন্দ্রনাথ সেলিনার মাতাকে বলিলেন, “বোধ হয়, জুলেখার পরামর্শে আপনি আমার সহিত এরূপ ব্যবহার করিতেছেন। একটা অশিক্ষিতা সাঁওতালনী আপনার ন্যায় সুশিক্ষিতা বুদ্ধিমতীকে যে এরূপে নিজের ইচ্ছানুসারে পরিচালিত করিতেছে, ইহা বড়ই আশ্চর্য্যের বিষয়।”

সেলিনার মাতা বলিলেন, “জুলেখা এ সম্বন্ধে আমাকে কোন কথা বলে নাই। যদিও আমি কোন কোন বিষয়ে তার পরামর্শ লইয়া থাকি, কিন্তু এ বিষয়ে আমি তা’ আবশ্যক বোধ করি না। তোমার সহিত সেলিনার বিবাহ দিতে আমার আদৌ ইচ্ছা নাই—হইতেও দিব না। আপাততঃ তুমি আমাদের বাড়ী হইতে—”

মলিনমুখে সেলিনা বলিল, “মা—তুমি—”

সেলিনার মা সেলিনার কথায় কর্ণপাত না করিয়া সুরেন্দ্রনাথকে পরিষ্কার কণ্ঠে বলিলেন, “চলিয়া যাও। আমি অনুমতি না পাঠাইলে এখানে আর আসিয়ো না। সুরেন্দ্রনাথ, তোমার ব্যবহারে আমি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইয়াছি।”

সুরেন্দ্রনাথ চেয়ার ছাড়িয়া উঠিলেন। কোনরূপ ক্রোধের লক্ষণ তখন তাঁহার মুখমণ্ডলে প্রকটিত হইল না। ধীরভাবে তিনি বলিলেন, “আপনার আদেশ প্রতিপালিত হইবে; কিন্তু আমি যাইবার সময়েও আপনাকে বিশেষ করিয়া বলিয়া যাইতেছি, সেলিনার আশা আমি কিছুতেই ত্যাগ করিতে পারিব না।”

সেলিনাও সেই সঙ্গে বলিয়া উঠিল, “মা, আপনি যাহাই বলুন না কেন, সুরেন্দ্রনাথ ছাড়া আমি আর কাহাকেও বিবাহ করিব না; বরং অবিবাহিতা থাকিব।”

সেলিনার মাতা বলিলেন, “সে আমি বুঝিব। সুরেন্দ্রনাথের চিন্তা এখন হইতে মন থেকে দূর করিতে চেষ্টা কর। আমি যাহাকে বলিব, তুমি তাহাকে বিবাহ করিবে।”

“আপনি কি বেন্টউডের সহিত আমার বিবাহ দিতে মনস্থ করিয়াছেন?”

“না—অমরেন্দ্রনাথের সঙ্গে।”

কথাটা শুনিয়া সুরেন্দ্রনাথ চমকিত হইলেন। বলিলেন, “আপনি কি অমর দাদার সহিত আপনার কন্যার বিবাহ দিবেন?”

সেলিমার মাতা বলিলেন, “হাঁ, অমরেন্দ্রনাথ তোমার অপেক্ষা সেলিনাকে ভালবাসে। তাহাকে বিবাহ করিলে সেলিনা সৰ্ব্বতোভাবে সুখী হইবে।”

সেলিনা বলিল, “আমি কখনই মিঃ অমরেন্দ্রনাথকে বিবাহ করিব না—আমি তাঁহাকে ঘৃণা করি।”

সেলিনার মাতা বলিলেন, “তাহাতে বড় আসে-যায় না। অমরেন্দ্রনাথকে নিশ্চয়ই তুমি বিবাহ করিবে।”

কথাটা শুনিয়া সুরেন্দ্রনাথ দুঃখিতভাবে বলিলেন, “নিশ্চয়ই?”

সেলিনার মাতা বলিলেন, ‘হাঁ, সুরেন্দ্রনাথ, নিশ্চয়ই। তুমি তোমার মামা মহাশয়কে ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করিয়ো।”

সুরেন্দ্রনাথ শিহরিয়া বলিলেন, “তিনি কি আমার বিরুদ্ধে দাঁড়াইবেন?”

“তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়ো।”

“আমি কিছুতেই বিশ্বাস করি না।”

সেলিনার মাতা পুনরপি কহিলেন, “তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়ো।”

সেলিনা কহিল, “আমি এ কথা বিশ্বাস করি না। আমি তাঁহাকে জানি—তিনি অতিশয় দয়ালু, তাঁহার হৃদয় উদার এবং মহৎ; তিনি আমাকেও যথেষ্ট স্নেহ করেন। যাহাতে আমি সুখী হই, তিনি অবশ্যই—”

বাধা দিয়া সেলিনার মাতা কহিলেন, “যথেষ্ট হইয়াছে, সেলিনা, আর তোমার বক্তৃতার প্রয়োজন নাই—তুমি নিজের ঘরে যাও। আর সুরেন্দ্রনাথ, তুমিও নিজের পথ দেখ।”

সেলিনার ম্লান মুখের দিকে একবার সতৃষ্ণ দৃষ্টিপাত করিয়া সুরেন্দ্রনাথ উঠিলেন; এবং বিষাদ-বিদীর্ণ হৃদয়ে তিনি তথা হইতে বাহিরে আসিলেন।

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – বিপদের সূচনা

যখন সুরেন্দ্রনাথ বাটী ফিরিলেন, তখন পশ্চিমাকাশে গোধূলির রক্তরাগ সন্ধ্যার অন্ধকারে ক্রমশঃ মলিন হইয়া আসিতেছিল।

সুরেন্দ্রনাথ বাংলো ঘরে গিয়া, একখানা চেয়ার টানিয়া বসিলেন। সেখানে আর কেহই ছিল না। অনন্তর খানসামা রহিমবক্স এক পেয়ালা চা লইয়া উপস্থিত হইলে তিনি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মামা মহাশয় কোথায়?”

রহিমবক্স বলিল, “তিনি এইমাত্র বেন্টউডের সহিত দেখা করিতে গিয়াছেন। বেন্টউডের নিকট হইতে একজন লোক তাঁহাকে ডাকিতে আসিয়াছিল।”

সুরেন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করিলেন, “অমর দাদা কোথায়?”

রহিমবক্স বলিল, “তিনি বোধ হয়, মিস্ আমিনার সহিত দেখা করিতে গিয়াছেন।”

রহিমবক্স চলিয়া গেল।

সুরেন্দ্রনাথ আপন-মনে বলিতে লাগিলেন, “অমর দাদার মনের অভিপ্রায়টা ভাল বুঝিতে পারিতেছি না; একদিকে মিস্ সেলিনাকে বিবাহ করিবার জন্য তাহার মা’র সহিত এক রকম বন্দোবস্ত ঠিক করিয়া রাখিয়াছে, আবার এদিকে মিস্ আমিনার বাড়ীতে মধ্যে মধ্যে যাওয়া আছে— দূর হৌক, ও সকল আর ভাবিব না।” এই বলিয়া মিল্টনের “প্যারাডাইস লষ্ট” নামক পুস্তকখানা লইয়া পড়িতে আরম্ভ করিলেন। তাঁহার মনের অবস্থা ভাল ছিল না; সুতরাং পাঠে মনোনিবেশ হইল না। তিনি বইখানা টেবিলের উপরে রাখিয়া ভাবিতে লাগিলেন। পরে কক্ষ-প্রাচীর-লগ্ন বিষগুপ্তির উপরে সহসা তাঁহার নজর পড়িল। অতি সন্তর্পণে তিনি তথা হইতে সেটা উঠাইয়া লইলেন; এবং ঘুরাইয়া ফিরাইয়া বেশ করিয়া দেখিতে লাগিলেন।

এমন সময়ে সেখানে দত্ত সাহেব বিষণ্ণভাবে প্রবেশ করিলেন। সুরেন্দ্রনাথের হাতে সেই বিষাক্ত অস্ত্রটা দেখিয়া, তিনি বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “একি সুরেন্, তুমি এ সাংঘাতিক অস্ত্রটা লইয়া কি করিতেছ? হঠাৎ একটা সর্ব্বনাশ করিয়া বসিবে!”

সুরেন্দ্রনাথ তাড়াতাড়ি সেই বিষ-গুপ্তিটা যথাস্থানে রাখিয়া দিলেন। বলিলেন, “আপনি কি মিঃ বেন্টউডের বাড়ী হইতে এখন আসিতেছেন?”

দত্ত সাহেব কহিলেন, “হাঁ, তিনি ঐ বিষ-গুপ্তিটা আমার নিকট হইতে কিনিয়া লইতে চাহেন।” সু। কেন, তিনি ইহা লইয়া কি করিবেন?

দত্ত। তা’ আমি বলিতে পারি না। তাঁহার কথার ভাবে বুঝিতে পারিলাম যে, তিনি অনেক দেশ ভ্রমণ করিয়াছেন; সকল দেশের একটা না-একটা আশ্চর্য্যজনক বস্তু তিনি সংগ্রহ করিয়াছেন। কিন্তু ছোটনাগপুরের তেমন কোন আশ্চর্য্যজনক বস্তু তিনি সংগ্রহ করিতে পারেন নাই। এইরূপ একটা বিষ-গুপ্তি সংগ্রহের জন্য তিনি পূর্ব্বে অনেক চেষ্টা করিয়াছেন, কিন্তু সে চেষ্টা সফল হয় নাই। আমার কাছে এখন এই বিষ-গুপ্তি দেখিয়া তিনি এটা কিনিয়া লইতে চাহেন। কিন্তু আমি বিক্রয় করিতে সম্মত হই নাই।

সুরেন্দ্র। কেন আপনি সম্মত হইলেন না? এমন সাংঘাতিক জিনিস ঘরে রাখিয়া লাভ কি?

দত্ত সাহেব কহিলেন, “সাংঘাতিক জিনিষ বলিয়াই ত আমি ইহা হস্তান্তর করিতে পারিতেছি না। যদিও উহার ভিতরের বিষ শুখাইয়া গিয়াছে, তথাপি পাঁচ-সাত জনের জীবনান্ত করিবার ক্ষমতা এখনও উহার বেশ আছে। যদি আমি এই বিষ-গুপ্তিটা কাহাকেও দিই, তাহার পর এই বিষ-গুপ্তি লইয়াই যদি কোথাও কোন বিভ্রাট ঘটে—কেহ মৃত্যুমুখে পতিত হয়, তাহা হইলে সে পাপ আমারই হইবে। সেজন্য আমাকেই হয়ত চিরকাল অনুতাপ করিতে হইবে। যা-ই হোক্‌, অমরের কথা মত কাজ করিতে হইবে–আর এটা এমন করিয়া বাহিরে ফেলিয়া রাখা হইবে না। আহারাদির পর আজই আমি এটা নিজের লোহার সিন্দুকে চাবিবন্ধ করিয়া রাখিয়া দিব।”

সুরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “অমর দাদা মিস্ আমিনাদের বাড়ীতে গিয়াছেন?”

দত্ত সাহেব কহিলেন, “হয়ত তাহার ফিরিতে রাত হইবে। চল, আমরা দুজনে এখন আহারাদি করি গিয়া। বিশেষতঃ বেড়াইয়া আসিয়া আমার কিছু ক্ষুধার উদ্রেক হইয়াছে।”

সুরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “আমি আজ আপনাকে একটি কথা জিজ্ঞাসা করিব মনে করিয়াছি। আপনি যদি অনুমতি করেন তাহা হইলে বলিতে পারি।”

দত্ত সাহেব কহিলেন, “কি, বল।”

সুরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “আপনি কি মিস্ সেলিনার সহিত অমর দাদার বিবাহ দিবেন, মনস্থ করিয়াছেন?”

দত্ত সাহেব একুট ইতস্ততঃ করিলেন; তাহার পর বলিলেন, “না, এ সম্বন্ধে, আমি কিছু মনস্থ করি নাই—করিবার কোন আবশ্যকতাও দেখি না। এ সকল বিষয়ে আমি কেন হস্তক্ষেপ করিব? সেলিনা যদি অমরকে ছাড়িয়া তোমাকে বিবাহ করিতে ইচ্ছা করে, তাহাই হইবে।”

সুরেন্দ্রনাথ বিনতমস্তকে বলিলেন, “সেলিনার সেইরূপ ইচ্ছা।”

দত্ত সাহেব বলিলেন, “বটে! তুমি কি তাহাকে এ সম্বন্ধে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলে?”

সুরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “হাঁ, কিন্তু তাহার মা কিছুতেই সম্মত নহেন। তাঁহার একান্ত ইচ্ছা, অমর দাদার সহিত সেলিনার বিবাহ হয়।”

দত্ত সাহেব কহিলেন, “তাঁর এ একান্ত ইচ্ছায় একটা বিশেষ কারণ আছে। কেন যে সেলিনার মাতা অমরেন্দ্রের সহিত তাহার কন্যার বিবাহ দিতে চাহেন, সে কথা আহারাদির পর বলিব—এখন নয়। এখন এস, আহারাদি করিবে।”

সুরেন্দ্রনাথ এ সম্বন্ধে আপাততঃ আর কোন কথার উত্থাপন করিতে সাহস করিলেন না। মিঃ দত্তের সহিত ভিতর বাটীতে আহার করিতে গেলেন। আহারে বসিয়া অন্যান্য বিষয় লইয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া উভয়ের অনেক কথা হইল। তাঁহাদের আহারাদি শেষ হইলেও অমরেন্দ্রনাথ গৃহে ফিরিলেন না।

মিঃ দত্ত এবং সুরেন্দ্রনাথ পুনরায় বাংলো ঘরে আসিয়া বসিলেন। বসিয়া দত্ত সাহেব চুরুট টানিতে আরম্ভ করিলেন। অমরেন্দ্রনাথকে কন্যা সমর্পণে সেলিনার মাতার এ অত্যাধিক আগ্রহের কারণ শুনিবার জন্য সুরেন্দ্রনাথ দত্ত সাহেবের গম্ভীর মুখের দিকে ঘন ঘন সতৃষ্ণ দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন। তাঁহার মনে হইতে লাগিল, হয়ত ইহার ভিতরে এমন একটা রহস্য প্রচ্ছন্ন আছে, যাহা তাঁহার মাতুল মহাশয়ের মুখ দিয়া নিঃসৃত হইয়া গেলে, তাঁহার এ মর্ম্মদাহের অনেকটা উপশম হইতে পারে।

মিঃ দত্ত বলিলেন, “সুরেন্দ্র, আমি তোমার মুখ দেখিয়া বুঝিতে পারিতেছি, তুমি সেই কথা শুনিবার জন্য অত্যন্ত উৎসুক হইয়াছ। আচ্ছা, আমি বলিতেছি শোন—”এই বলিয়া দত্ত সাহেব বিস্ময়-বিস্ফারিত দৃষ্টিতে অবাঙ্গুখে দেয়ালের দিকে চাহিয়া রহিলেন।

দত্ত সাহেবের এইরূপ আকস্মিক ভাব-বৈলক্ষণ্যে সুরেন্দ্রনাথ চমকিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হইয়াছে? আপনি সহসা এমন ভাবে চাহিতেছেন কেন?”

দেওয়ালের দিকে অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়া দত্ত সাহেব কম্পিতকণ্ঠে বলিলেন, “কি সৰ্ব্বনাশ!” সে বিষ-গুপ্তি কোথায় গেল? একি ব্যাপার!”

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – বিপদ—আসন্ন

সুরেন্দ্রনাথ দেয়ালের দিকে চাহিয়া দেখিলেন। সবিস্ময়ে দেখিলেন, সেখানে বিষ-গুপ্তি নাই। কিয়ৎক্ষণ উভয়ে অবাঙ্গুখে পরস্পর মুখের দিকে চাহিতে লাগিলেন। কিন্তু সেরূপ কিংকর্তব্যবিমূঢ়াবস্থায় এক মুহূর্ত্ত অতিবাহিত করিয়া কোন ফল নাই ভাবিয়া মিঃ দত্ত তখনই রহিমবক্সকে ডাকিলেন।

রহিমবক্স আসিলে দত্ত সাহেব তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিষ-গুপ্তিটা কোথায়?”

প্রভুর ভাব-গতিক দেখিয়া রহিমবক্স ভীত হইল। সভয়ে মৃদুকণ্ঠে বলিল, “বিষ-গুপ্তি কি, হুজুর?”

মিঃ দত্ত দেওয়ালের দিকে অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়া বলিলেন, “এইখানে যে সোনা দিয়া বাঁধানো একটা সবুজ বেত ছিল, আমি সেইটের কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি।”

রহিমবক্স বলিল, “হুজুর, সেটাত এইখানেই রোজ দেখিতাম, কে নিয়েছে, আমি কেমন করিয়া বলিব? আমি ত কাকেও নিতে দেখি নাই।”

দত্ত। এ ঘরে কে আলো দিয়ে গেছে?

রহিম। আমি, হুজুর।

সুরেন্দ্র। জানালা কে খুলেছিল?

রহিম। আমি। যতক্ষণ না আপনারা আহারাদি শেষে এ ঘরে আসেন, ততক্ষণ জানালা খুলিয়া রাখিবার জন্য আমার উপরে হুজুরের এমন হুকুম আছে। আমি ইচ্ছা করিয়া খুলি নাই।

মিঃ দত্ত সুরেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সুরেন্, তোমার কি অনুমান, কোন বাহিরের লোক কি বিষ-গুপ্তিটা চুরি করিয়াছে?”

সুরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আমার তাহাই বোধ হয়। আচ্ছা রহিমবক্স, আজ সন্ধ্যার পর জুলেখাকে এদিকে আসিতে দেখিয়াছ?”

রহিম। না—দেখি নাই, হুজুর।

সুরেন্দ্র। আশানুল্লাকে?

রহিম। তাহাকে আজ সাত-আট দিন দেখি নাই।

সুরেন্দ্র। কতক্ষণ তুমি এ ঘরে আলো দিয়া গিয়াছ?

রহিম। আপনাদের ঘরে আসিবার পাঁচ-সাত মিনিট আগে।

সুরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “তাহা হইলে পাঁচ-সাত মিনিট আগে এ ঘর অন্ধকার ছিল। ঘরে আলো না থাকিলে, কেমন করিয়া চোরে সে বিষ-গুপ্তি হস্তগত করিবে। আচ্ছা, তুমি যখন আলো দিয়া যাও, তখন দেয়ালে বিষ-গুপ্তি ছিল কি না, দেখিয়াছিলে?”

রহিম। না, আমি এদিকে তখন লক্ষ্য করি নাই।

মিঃ দত্ত বলিলেন, “আচ্ছা রহিমবক্স, তুমি এখন যাও। বাড়ী ছাড়িয়া এখন আর কোথায় যাইয়ো না।”

রহিমবক্স চিন্তিত মনে ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল।

দত্ত সাহেব সুরেন্দ্রনাথকে বলিলেন, “তুমি রহিমকে যেরূপ ভাবে প্রশ্ন করিতেছিলে, তাহাতে বোধ হয়, কোন লোকের উপরে তোমার কিছু সন্দেহ হইয়াছে।”

সুরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আপনার অনুমান মিথ্যা নহে—আমি জুলেখাকে সন্দেহ করিতেছি।”

“কেন, জুলেখাকে সন্দেহ করিবার কারণ কি?”

“কারণ অনেক আছে—সে অনেক কথা। রহিমবক্সের মুখে যেরূপ শুনিলাম, আহারাদির শেষে আমাদের এ ঘরে আসিবার পাঁচ মিনিট আগে ঘর অন্ধকার ছিল। বিষ-গুপ্তি কোথায় কি ভাবে আছে, অবশ্যই চোরের তাহা পূর্ব্ব হইতে জানা ছিল।”

“তোমার কথা যুক্তিযুক্ত বিবেচনা করি, কিন্তু, জুলেখা কখনও এ ঘরে আসে নাই।”

“জুলেখা আসে নাই, কিন্তু ডাক্তার বেন্টউড আসিয়াছেন।”

“বেন্টউড! বেন্টউড কি ইহার ভিতরে আছেন?”

“নিশ্চয়ই—আপনি তাঁহাকে বিষ-গুপ্তি বিক্রয় করিতে চাহেন নাই; কাজেই তিনি এই উপায় অবলম্বন করেছেন। জুলেখা তাঁহার বড় অনুগত—জুলেখার হাত দিয়াই তিনি বিষ-গুপ্তি আত্মসাৎ করিয়াছেন। আপনাকে সব কথা প্রকাশ করিয়া না বলিলে আপনি আমার এ দৃঢ় বিশ্বাসের কারণ ভাল বুঝিতে পারিবেন না।”

এই বলিয়া সুরেন্দ্রনাথ সেইদিন সন্ধ্যার পূর্ব্বে সেলিনাদের বাটীতে যাহা যাহা ঘটিয়াছিল, তৎসমুদয় বলিতে আরম্ভ করিলেন।

বিশেষ মনোনিবেশ সহকারে দত্ত সাহেব, সুরেন্দ্রনাথের কথাগুলি শুনিয়া বলিলেন, “সেলিনার মা তোমার সহিত এরূপ ব্যবহার করিয়াছেন শুনিয়া, অতিশয় দুঃখিত হইলাম।”

সুরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “সেলিনার সহিত আমার বিবাহ হয়, তাহা কি আপনার অভিপ্রেত নহে?”

দত্ত সাহেব বলিলেন, “ইহাতে আমার অভিপ্রায়ের কোন প্রয়োজন হইতেছে না। আমি ত তোমাকে পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, সেলিনা নিজের অভিপ্রায় অনুসারে বিবাহ করিবে।”

এমন সময়ে সেই কক্ষমধ্যে অমরেন্দ্রনাথ প্রবেশ করিলেন। মিঃ দত্ত তাঁহাকে দেখিয়া বলিলেন, “এই যে অমর এসেছ! ফিরিতে এত রাত হইল যে?”

অমরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “মিস্ আমিনা তাহার সহিত একবার দেখা করিবার জন্য আমাকে বিশেষ করিয়া অনুরোধ করিয়াছিল; আজ সময় পাইয়া একবার তাহার সহিত দেখা করিতে গিয়াছিলাম। সুরেন্দ্রনাথের নির্দয় ব্যবহারের জন্য মিস্ আমিনা আমার কাছে অত্যন্ত দুঃখ প্রকাশ করিতে লাগিল।” সুরেন্দ্রনাথের প্রতি “সুরেন, সরলহৃদয়া মিস্ আমিনার সহিত তোমার এরূপ কঠিন ব্যবহার করা অতিশয় অন্যায় হইতেছে।”

সুরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “মিস্ আমিনা ত পূৰ্ব্বেই শুনিয়াছে, আমি সেলিনাকে বিবাহ করিবার জন্য প্রস্তুত হইতেছি।”

অমরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “তোমার এ অভিসন্ধি আমারও অনবগত নহে; আমিও সকল শুনিয়াছি। কিন্তু সুরেন্ তুমি নিশ্চয় জানিয়ো, আমি বা সেলিনার মা জীবিত থকিতে কিছুতেই তোমার এ আশা পূর্ণ হইবে না।”

সুরেন্দ্রনাথ উত্তেজিত কণ্ঠে বলিলেন, “কাহার আশা পূর্ণ হইবে, কি না হইবে, সে কথা সেলিনাকে জিজ্ঞাসা করিলে ঠিক উত্তর পাওয়া যাইবে।”

অমরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “সেজন্য আমি কিছুমাত্র চিন্তিত নহি। আমি সেলিনাকে এ সম্বন্ধে কোন কথা এ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করি নাই; তাহাতে বিশেষ কোন প্রয়োজন দেখি না। কিন্তু সুরেন, আমি তোমাকে বিশেষ সতর্ক করিয়া দিতেছি, তোমার এ দুরাশা যত শীঘ্র পার, ত্যাগ করিতে চেষ্টা কর, নতুবা বিপদে পড়িবে। ডাক্তার বেন্টউডের সহিত সেলিনার বিবাহ হয়, তাহাও স্বীকার; কিছুতেই আমি তোমার এ সঙ্কল্প সিদ্ধ হইতে দিব না।”

সুরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “তোমার ন্যায় তাঁহারও অদৃষ্ট সুপ্রসন্ন। জুলেখা তাঁহার হইয়া চেষ্টা করিতেছে; আর সেলিনার মাতা তোমার একান্ত পক্ষপাতী; তাহা হইলেও আমি কিছুমাত্র চিন্তিত নহি।”

অমরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “চিন্তিত নও? তুমি কি বেন্টউডের কথা এত শীঘ্র ভুলিয়া গিয়াছ? তোমার বিবাহে তোমার জীবনমৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।”

সুরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আমি এমন অৰ্ব্বাচীন নহি যে, বেন্টউডের একথা আমাকে বিশ্বাস করিতে হইবে। তোমার ন্যায় সুশিক্ষিতের এরূপ ভুল বিশ্বাসের জন্য বরং আমি দুঃখিত।”

অমরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “বিশ্বাস অবিশ্বাস লইয়া কোন তর্কের আবশ্যকতা নাই—যাহার যে বিশ্বাস, তাহার সে কারণ জানে। কিন্তু সুরেন্দ্রনাথ! তোমার যেন বেশ স্মরণ থাকে, ডাক্তার বেন্টউড বড় সহজ লোক নহেন; শুধু তোমার কথা বলিতেছি না—আমাদের উভয়েরই পক্ষে বেন্টউড বড় ভয়ানক লোক।”

সুরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “তা আমি জানি, বিশেষতঃ আমার বিশ্বাস, বেন্টউড আমাদের বিষ-গুপ্তিটা চুরি করিয়াছেন।”

“বিষ-গুপ্তিটা!” চকিতভাবে এই কথা বলিয়া অমরেন্দ্রনাথ দেয়ালের যেখানে বিষ-গুপ্তি থাকিত, সেইদিকেই বিস্ফারিতনেত্রে চাহিয়া রহিলেন। তাঁহার মুখ বিবর্ণ হইল এবং আপাদমস্তক কাঁপিতে লাগিল। ভীতিকম্পিত কণ্ঠে কহিলেন, “বিষ-গুপ্তি নাই—চুরি গিয়াছে—কি সৰ্ব্বনাশ! সুরেন্দ্রনাথ, এখন হইতে আমাদের দুজনকেই খুব সাবধানে থাকিতে হইবে।”

চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ – রোগশয্যায়

তাহার পর এক সপ্তাহ অতীত হইয়া গিয়াছে—ইতোমধ্যে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে নাই। অমরেন্দ্রনাথ এবং সুরেন্দ্রনাথ পূৰ্ব্বাপেক্ষা অনেকটা শান্ত ভাব ধারণ করিলেন, কেহ কাহারও নিকটে আর সেলিনার নাম, কিম্বা তাহার সম্বন্ধে কোন কথার উত্থাপন করিতেন না। এবং উভয়ে উভয়ের প্রতি সতত একটী সতর্ক দৃষ্টি রাখিয়া চলিতেন।

ইতিমধ্যে তদুভয়ের কাহারও সহিত মিস্ সেলিনার দেখা হয় নাই। যাহাতে কাহারও সহিত সেলিনার আর সাক্ষাৎ না হয়, সেলিনার মা তাহার একটা সুবন্দোবস্ত করিয়াছেন। তিনি সেলিনাকে আর বাটীর বাহির হইতে দিতেন না। জুলেখার পরামর্শ ছাড়া তিনি কোন কাজ করিতেন না— ইহাতেও জুলেখার মন্ত্রণা ছিল।

সেলিনার মাতার মাথার ব্যায়রাম ছিল, তাহাতে মধ্যে মধ্যে তাঁহাকে শয্যাগত হইতে হইত। তাঁহার আহার আর নিদ্রা এই দুইটী ছাড়া আর কোন কাজ ছিল না; সুতরাং একটা কিছু রকম না থাকিলে জীবনটা নিতান্ত একঘেয়ে হইয়া পড়ে, এই জন্যই বোধ হয়, বিধাতা তাঁহার মস্তিষ্কে এইরূপ একটা পীড়ার আরোপ করিয়া রাখিয়াছিলেন। একটু ত্রুটিতেই পীড়াটা সজাগ হইয়া উঠিত। সেদিন সুরেন্দ্রনাথের সহিত সেই বাগ্বিতণ্ডার পর হইতেই পীড়াটা কিছু প্রবল হইয়াছে। দুই বেলা ডাক্তার দেখিতেছে—ডাক্তার বেন্টউড স্বয়ং।

বেন্টউড আসিলে সেলিনা তাহার মাতার কক্ষ ত্যাগ করিয়া এক একদিন উঠিয়া বাহিরে যাইত। কোনদিন বা মা’র অনুজ্ঞায় অপেক্ষা করিত। বেন্টউড আসিয়া তাহার মুখের দিকে এরূপভাবে ঘন ঘন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করিতেন, তাহাতে সেলিনার মন নিতান্ত অপ্রসন্ন হইয়া উঠিত। সে দৃষ্টিতে কি একটা বিভীষিকা মিশ্রিত থাকিত, সেলিনা কিছুতেই তাহা অনুভব করিতে পারিত না। সেই দৃষ্টিতে যেন একটা অপূৰ্ব্বানুভূত মোহ সঞ্চালিত হইয়া তাহার সর্ব্বাঙ্গ প্রায় অবসন্ন করিয়া তুলিত। বেন্টউড মেসমেরিজম্ বা হিপ্‌টীজম্ প্রক্রিয়ায় খুব অভ্যস্ত ছিলেন; সেইজন্য সহজেই তাঁহার স্থির দৃষ্টিপাতে মনের ভিতরে এইরূপ একটা অনিবার্য্য চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করিত।

একদিন সেলিনা তাহার মুখের দিকে বেন্টউডকে সেইরূপ ভাবে চাহিতে দেখিয়া কহিল, “আপনি এরূপ ভাবে আমার দিকে চাহিবেন না—আমার বড় ভয় হয়। আপনার দৃষ্টি বড় ভয়ানক।”

বেন্টউড বলিলেন, “যাহার সহিত কথা কহিতে হয়, তাহার দিকে না চাহিয়া, অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া–-”

বাধা দিয়া তারস্বরে সেলিনা বলিলেন, “আমার সঙ্গে আপনার কথা কহিতে হইবে না—আমি এখনই উঠিয়া যাইতেছি।”

রোগশয্যায় পড়িয়া সেলিনার মাতা সব শুনিতেছিলেন। সেলিনার এইরূপ রূঢ় ব্যবহারে তিনি অত্যন্ত রুষ্ট হইলেন। বলিলেন, “সেলিনা, তোমার স্পর্দ্ধা বাড়িয়াছে, দেখিতেছি।”

সেলিনা জননীর কথায় কর্ণপাত না করিয়া তৎক্ষণাৎ কক্ষের বাহির হইয়া গেল। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া সেলিনার মাতা কহিলেন, “সেলিনাকে লইয়া যে আমি কি করিব, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। মেয়েটা ক্রমে বড় অবাধ্য হইয়া উঠিতেছে।”

বেন্টউড কহিলেন, “আমার বিশ্বাস, অমরেন্দ্রের সহিত সেলিনার বিবাহ দিবার সংকল্প যত দিন না আপনি ত্যাগ করিবেন, ততদিন সেলিনার এ অবাধ্যতা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাইতেই দেখিবেন।” সেলিনার মাতা কহিলেন, “সেলিনা আমার যতই অবাধ্য হউক না কেন, যেমন করিয়া পারি, আমি অমরেন্দ্রের সহিত তাহার বিবাহ দিবই।”

বেন্টউড কহিলেন, “অমরেন্দ্রের হস্তে কন্যা সমর্পণ করিতে আপনার এত আগ্রহ কেন, বুঝিলাম না। এমন কি আমার প্রস্তাবও আপনি একেবারে অগ্রাহ্য করিলেন। মিঃ অমরেন্দ্র তেমন ধনবান্ নহে। যদিও তিনি ব্যারিষ্টার-অ্যাট-ল, কিন্তু এখনও তাঁহার তেমন পসার হয় নাই; পরে হইবে কিনা, তাহারই বা ঠিক কি? তাঁহার মাতুল মহাশয়ের যাহা কিছু বিষয়-সম্পত্তি আছে, তাহাও আবার দুই ভাগ হইবে।”

সেলিনার মাতা বলিলেন, “তা’ আমি জানি। কিন্তু সেলিনার যে বিষয়-সম্পত্তি আছে, তাতে সে নিতান্ত দরিদ্রকে বিবাহ করিলেও জীবনে কখন অর্থাভাবের কষ্ট তাহাকে ভোগ করিতে হইবে না। বার্ষিক বিশ হাজার টাকার আয়ে একটা ভদ্র-পরিবার সসম্মান সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে প্রতিপালিত হইতে পারে।”

একে সেলিনা পরমসুন্দরী, তাহার উপরে তাহার বার্ষিক আয় বিশ হাজার টাকা; দেখিয়া- শুনিয়া বেন্টউডের লোভ আরও শতগুণ বৰ্দ্ধিত হইল।

সেদিন তিনি সেই বিশ হাজার টাকার চিন্তা লইয়া নিজের বাটীতে ফিরিয়া আসিলেন। মনে মনে স্থির করিলেন, এ সুযোগ সহজে ত্যাগ করা নিতান্ত নির্ব্বোধের কাজ। প্রতিজ্ঞা করিলেন, যেমন করিয়া হউক, সেলিনাকে বিবাহ করিতেই হইবে। এবং যাহাতে সেলিনাকে কোন রকমে হস্তগত করিতে পারেন, এমন একটা উপায় উদ্ভাবনের চেষ্টা করিতে লাগিলেন।