প্লাবন ও পুনঃ সৃষ্টি
মানুষ, পশু, পাখি, তরুলতা ইত্যাদি যাহা আমরা বর্তমানে দেখিতে পাইতেছি, ইহারা প্রাথমিক সৃষ্টির বংশধর নহে। জগদ্ব্যাপী এক মহাপ্লাবনের ফলে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত জীব ও উদ্ভিদাদি ধংসপ্রাপ্ত হইয়াছিল এবং গুটিকতক যাহারা জীবিত ছিল, তাহাদের বংশাবলীতে বর্তমান জগত ভরপুর।
উক্তরূপ একটি প্লাবনের কাহিনীকে কেন্দ্র করিয়া নানা দেশে নানা রকম প্রবাদ সৃষ্টি হইয়া, ঐগুলি জাতিবিশেষের মধ্যে বেশ প্রসিদ্ধি লাভ করিয়া আছে। এইখানে আমরা উহার কয়েকটি কাহিনীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিতেছি।
# হিন্দুদের কাহিনী
পৌরাণিক শাস্ত্রাদিতে জলপ্লাবনের বিস্তৃত বিবরণ দেখিতে পাওয়া যায়। ঐ প্লাবনে মহর্ষি মনু যাবতীয় জীবজন্তু ও উদ্ভিদাদির বীজ রক্ষা করিয়াছিলেন এবং তাহা হইতেই আধুনিক জীবাদির সৃষ্টি হইয়াছে।[৪১] (শতপথ ব্রাহ্মণ– প্রথম খণ্ড, অষ্টম ব্রাহ্মণ, দশম অধ্যায়; মৎস্য পুরাণ– প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায়; মহাভারত– বনপর্ব, সপ্তাশীত্যধিক শততমাধ্যায় দ্রষ্টব্য)।
.
# ইরানীয়দের কাহিনী
ইরানীয়দের জেল-আভেস্তা গ্রন্থের ভেন্দিদাদ অংশে এক প্রলয়ঙ্করী প্লাবনের বিষয় লিখিত আছে। তবে উহা জলপ্লাবন নহে, তুষারপাত। উক্ত বিবরণে অহুর মজদা (ঈশ্বর) জীবাদি ধ্বংসের জন্য যিম (যম)-কে বলিতেছেন, “বিবঘতের পুত্র যিম! এই জীবজন্তু সমাকুল পৃথিবীতে ভীষণ শৈত্য উপস্থিত হইবে। তাহা হইতে সর্ববিধ্বংসী তীব্র তুষার উৎপন্ন হইয়া পৃথিবীকে ধ্বংস করিয়া ফেলিবে। সেই তুষার পৃথিবীপৃষ্ঠে সর্বত্র বিতস্তি (১৪ অগুলি) পরিমাণ পুরু হইয়া বিদ্যমান থাকিবে। পর্বতের উচ্চ চূড়া হইতে আরম্ভ করিয়া সমুদ্রের তলদেশ পর্যন্ত সমভাবে তুষারাবৃত হইবে। যে সকল প্রাণী অরণ্যে বাস করে, যাহারা পর্বতের উপর অবস্থিত থাকে, অথবা যাহারা অধিত্যকা প্রদেশে বাস করে –এই সর্বব্যাপী তুষারসম্পাতে সেই ত্রিবিধ প্রাণীই মৃত্যুর ক্রোড়ে আশ্রয় লইবে। যে সকল চারণক্ষেত্র তৃণ-শল্পে পরিপূর্ণ রহিয়াছে, যেখানে স্বচ্ছসলিলা স্রোতস্বিনী প্রবাহিত হইতেছে এবং যেখানে আজিও ক্ষুদ্র-বৃহৎ পশ্বাদি বিচরণ করিতেছে –সেই সকল স্থান হইতে, সেই ভীষণ শৈত্যাধিক্যের পূর্বে মানুষের, কুকুরের, পক্ষীর, মেষের, বৃষের বীজ সংগ্রহ করিয়া আন এবং তৎসমুদয় রক্ষার জন্য ভর প্রস্তুত করিয়া রাখ।”[৪২]
উক্ত কাহিনীটির সহিত অন্যান্য কাহিনীগুলির তিনটি বিষয়ে আপাতপার্থক্য দেখা যায়। প্রথমত, অন্যান্য কাহিনীতে পাওয়া যায় জলপ্লাবন আর এইখানে তুষারপ্লাবন। তবে জল ও তুষার মূলত একই পদার্থ। দ্বিতীয়ত, অন্যান্য কাহিনীতে দেখা যায় যে, ঈশ্বর কোনো এক ব্যক্তিকে ভবিষ্যদ্ববাণী করিয়াছেন এবং অচিরেই তাহা ঘটিয়াছে; আর এইখানে উহা ঘটিয়াছে কি না, তাহার উল্লেখ নাই। বোধহয় যে, ঘটিয়া গিয়াছে। তৃতীয়ত, অন্যান্য কাহিনীতে ঈশ্বর বলিয়াছেন নৌকা তৈয়ার করিতে, আর এইখানে বলিয়াছেন ভর তৈয়ার করিতে। কিন্তু অনুবাদকগণ ‘ভর’ শব্দের অর্থ করিয়াছেন স্থান বা নৌকা। জেন্দ-আভেস্তার অনুবাদক অধ্যাপক ডারমেস্টাটর ভরকে বলিয়া গিয়াছেন নোয়ার আর্ক, অর্থাৎ নূহের নৌকা।
.
# প্রাচীন মিশরীয় ও গ্রীসবাসীদের কাহিনী
জলপ্লাবন সম্বন্ধে শাস্ত্রগ্রন্থগুলিতে যেরূপ বর্ণনা দৃষ্ট হয়, প্রাচীন জাতিদিগের অনেকের মধ্যেই সেইরূপ কিংবদন্তী প্রচারিত আছে। উহাতে নাম-ধামাদির পার্থক্য থাকিলেও কিছু না কিছু মিল আছেই।
মিশরীয়গণ বলেন –নুন বা নু নামক বন্যার প্রকোপে পৃথিবীর সমস্ত পদার্থের বীজ জলমগ্ন। ও নষ্ট হইয়া যায়। সেই জলপ্লাবনে ওসিরিস নামক এক ব্যক্তি রক্ষা পাইয়াছিলেন। ওসিরিস যখন আর্ক বা নৌকায় আরোহণ করেন, তখন পৃথিবী অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল। কিছুকাল পরে আলোকের উদয় হয় এবং আলোকের সঙ্গে সঙ্গে ভূখণ্ড জাগিয়া উঠে। তখন সমস্ত জীবজন্তু ও উদ্ভিদাদির বীজসহ তিনি ভূতলে অবতরণ করেন। বহি (নৌকা) হইতে অবতরণ করিয়া তিনি প্রথমে দ্রাক্ষালতা রোপণ করেন, অতঃপর মনুষ্যদিগকে কৃষিকার্য শিক্ষা দেন। ধর্ম ও নীতি বিষয়ে মনুষ্যসমাজে তিনিই প্রথম শিক্ষা প্রচার করিয়াছিলেন।
গ্রীসবাসীদের জলপ্লাবনের বর্ণনায় দেখিতে পাওয়া যায় –পৃথিবীতে পাপাচারের বৃদ্ধি দেখিয়া জিউস (গ্রীসবাসীদের ঈশ্বর) বড়ই রুষ্ট হন এবং বন্যার দ্বারা গ্রীসদেশকে প্লাবিত করেন। অত্যুচ্চ পর্বতশৃঙ্গ ভিন্ন সকলই জলমগ্ন হইয়া যায়। সেই সময় একটি আর্ক (নৌকা, মতান্তরে সিন্দুক) প্রস্তুত করিয়া ডিউকেলিয়ন সস্ত্রীক রক্ষা পাইয়াছিলেন। তাঁহার পিতা প্রমিথিউস তাহাকে জলপ্লাবন সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছিলেন এবং পিতাই পুত্রকে তরণী নির্মাণ করিতে উপদেশ দেন। নয়দিন কাল জলের উপর সেই তরণী ভাসমান ছিল। অবশেষে পারনাসাস পর্বতের (ইহুদি-খ্রীস্টানরা বলেন অরারট এবং মুসলমানগণ বলেন যুদী পাহাড়) শিখরদেশে ডিউকেলিয়ন অবতরণ করেন।[৪৩]
এই সময় জিউস তাহার নিকট হারমেসকে পাঠাইয়া দেন এবং তাহাকে সাহায্য করিতে প্রতিশ্রুত হন। ডিউকেলিয়ন তখন সেই নির্জন স্থানে মনুষ্যগণকে ও সহচরদিগকে পাঠাইয়া দিবার প্রার্থনা জ্ঞাপন করেন। তদনুসারে জিউস ডিউকেলিয়ন ও তাহার স্ত্রী পীঢ়া, এই উভয়কে শূন্যের দিকে প্রস্তরখণ্ড নিক্ষেপ করিতে বলেন। পীঢ়া যে সকল প্রস্তরখণ্ড নিক্ষেপ করেন, তাহাতে নারী জাতির সৃষ্টি হয় এবং ডিউকেলিয়নের নিক্ষিপ্ত প্রস্তর হইতে পুরুষগণ উৎপন্ন হয়। এই সময় হইতে গ্রীসে প্রস্তর যুগের লোকের অভ্যুদয় হইয়াছিল। ডিউকেলিয়ন আর্ক হইতে অবতরণ করিয়া জিউস ফিক্সিয়স অর্থাৎ পরিত্রাণকর্তা ঈশ্বরের পূজা করিয়াছিলেন।
.
# কালদিয়া ও চীনের কাহিনী
প্রাচীন কালদীয় জাতির মধ্যে জলপ্লাবনের যে বিবরণ প্রচলিত আছে, তাহাতে জানা যায় যে, ইসুগ্রাস রাজার রাজত্বকালে কালদিয়ায় জলপ্লাবন সংঘটিত হইয়াছিল। ওয়ানো নামক দেবতা সেই রাজাকে জলপ্লাবনের বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেন। ওয়ানো দেবতার ঊৰ্ধভাগ মনুষ্যের ন্যায়, অধোভাগ মীনসদৃশ। সেই দেবতার উপদেশে এক বৃহৎ অর্ণবপোত (নৌকা) প্রস্তুত করিয়া রাজা সপরিবারে আত্মরক্ষা করিয়াছিলেন। বর্তমান মনুষ্যগণ তাহারই বংশধর।
প্রাচীন চীন দেশেও জলপ্লাবনের কাহিনী প্রচারিত আছে। চীনাগণ বলেন যে, সেই ভীষণ জলপ্লাবনে মহাত্মা পয়ান সু সপরিবারে রক্ষা পাইয়াছিলেন এবং তাহাদের বংশাবলীই বর্তমান মানবগোষ্ঠী।[৪৪]
.
# সিরিয়া, কিউবা, পেরু ও ব্রাজিলের কাহিনী
সিরিয়া দেশে জলপ্লাবনের বিষয় প্রচারিত আছে। একটি গুহা দেখাইয়া প্রাচীন সিরিয়াবাসীগণ বলিতেন, এই গুহার মধ্য দিয়া সেই জলপ্লাবনের জল বাহির হইয়াছিল।
কিউবা দ্বীপে জলপ্লাবনের এবং নৌকার সাহায্যে মাত্র কয়েকজন লোকের প্রাণরক্ষার বিষয় প্রচারিত আছে।
পেরু দেশের বিবরণে প্রকাশ, পৃথিবীতে মাত্র ছয়টি মানুষ সেই জলপ্লাবনে রক্ষা পাইয়াছিল।
ব্রাজিলের বিবরণটি বেশ কৌতুকপ্রদ। এম. থেবেট তদ্বিষয় লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন –কেরেবি জাতীয় সুমে একজন সভ্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন। তাহার দুই পুত্র টামেণ্ডোনের ও আরিকোন্ট। সেই দুই পুত্রের মধ্যে পরস্পর সদ্ভাব ছিল না। দুই ভ্রাতা দুইরূপ প্রকৃতিসম্পন্ন ছিল। টামেণ্ডোনের শান্তিপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু আরিকোণ্ট যুদ্ধবিগ্রহ ভালোবাসিতেন। এই হেতু উভয়ে উভয়কে ঘৃণা করিতেন এবং উভয়ে প্রায়ই বিবাদ-বিসম্বাদ ও যুদ্ধ-বিগ্রহ চলিত। একদিন আপনার বল-বিক্রম দেখাইবার জন্য আরিকোন্ট আপনার সহোদরের আবাসভবনের দ্বারদেশ লক্ষ্য করিয়া অস্তনিক্ষেপ করেন। এই ঘটনায় গ্রামকে গ্রাম একেবারে আকাশে উঠিয়া যায়। টামেণ্ডোনের তখন ভূমির উপরে সজোরে আঘাত করেন। সেই আঘাতে ভূগর্ভ হইতে অবিরাম জলস্রোত প্রবাহিত হইতে থাকে। সেই জল আকাশে মেঘমণ্ডল পর্যন্ত উচ্চ হইয়া উঠে এবং তাহাতে পৃথিবী প্লাবিত হয়। টামেণ্ডোনের ও আরিকোট দুই ভাই তখন মিলিত হইয়া পরিবারাদি সঙ্গে লইয়া এক অত্যুচ্চ পাহাড়ে আরোহণ করেন। কিছুকাল পরে জল কমিয়া আসিলে তাহারা পর্বত হইতে অবতরণ করিয়াছিলেন। অবশেষে দুই ভাইয়ের দুই বংশে বিভিন্ন জাতির উৎপত্তি হয়।[৪৫]
.
# ইহুদি, খ্রীস্টান ও মুসলমানদের কাহিনী
তৌরিত গ্রন্থখানা সেমিটিক জাতিরা প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে সকলেই মান্য করিয়া থাকেন। বিশেষত তৌরিতের আদিপুস্তক অংশে বর্ণিত প্লাবনকাহিনীটিকে সকলেই বিশ্বাস করিয়া থাকেন। উক্ত পুস্তকে লিখিত আছে, ঈশ্বর নোয়াকে (হজরত নূহকে) বলিতেছেন, “আর সাত দিন পরে আমি চল্লিশ দিন চল্লিশ রাত্রি অবিরাম বারিবর্ষণ করাইব, যে কোনো প্রাণী, আমি সৃষ্টি করিয়াছি, তাহাদের সমস্ত ধংসপ্রাপ্ত হইবে। পৃথিবীতে কাহারও চিহ্নমাত্র রাখিব না। সেই বৃষ্টির জল পনর হাত উচ্চ হইয়া থাকিবে” ইত্যাদি। ইহার পর ঈশ্বর নোয়াকে নৌকা প্রস্তুত করিয়া সকল প্রাণীর ও সকল সামগ্রীর বীজ তাহাতে রক্ষা করিতে উপদেশ দেন। পরমেশ্বরের আদেশমতো নোয়া নৌকা প্রস্তুত করেন এবং সেই নৌকায় পবিত্র জন্তুদিগের সাতটি পুরুষ ও সাতটি স্ত্রী এবং অপবিত্র জন্তুদিগের দুইটি পুরুষ ও দুইটি স্ত্রী গৃহীত হয়। নোয়া, নোয়ার স্ত্রী এবং হেম, শাম, জাফেট নামক তাহার পুত্রত্রয় ও তাহাদের স্ত্রীগণ সেই নৌকায় আরোহণ করিয়াছিলেন। নানা জাতীয় পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গদি সেই নৌকায় রক্ষিত হইয়াছিল। নোয়ার সেই নৌকায় রক্ষিত মনুষ্যাদি হইতে পুনরায় সংসারে পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ ও বৃক্ষ-লতাদির উদ্ভব হইয়াছে।[৪৬]
.
# সুমেরীয় ‘গিলগামেশ’ কাহিনী
মানব সভ্যতার গোড়ার দিকে যখন সবেমাত্র লেখার প্রচলন হইয়াছে, তখন লেখা হইত কাদামাটি বা গাছের পাতায়। দূর-দূরান্তে সংবাদ আদান-প্রদানের জন্য চিঠি ও পুঁথিপত্তর পাতায়ই লেখা হইত। কোনো লেখাকে দীর্ঘস্থায়ী করিতে হইলে, উহা লেখা হইত পাথর খোদাই করিয়া। কিন্তু উহা বিস্তর শ্রম ও সময়সাপেক্ষ। পক্ষান্তরে কাদামাটির উপরে লেখা যায় সহজে, কিন্তু উহা বেশিদিন স্থায়ী হয় না। ইহার পর আবিষ্কার হইল কাদামাটির চাকতির উপর লিখিয়া ঐগুলিকে পোড়াইয়া কঠিন করা। এককালে ঐ রকম লেখার প্রচলন ছিল সুমের দেশে। তৎকালে ঐ দেশে আসুরবানিপাল নামক একজন বিদ্যোৎসাহী সম্রাট ছিলেন এবং তাহার একটি গ্রন্থাগার ছিল। কালক্রমে ঐ গ্রন্থাগারটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। অধুনা প্রত্নতাত্ত্বিকগণ উক্ত ভগ্নপটি খনন করিয়া প্রাপ্ত হইয়াছেন আসুরবানিপালের গ্রন্থাগারটি ও তন্মধ্যে বহু মৃৎচাকতির গ্রন্থ।
বারোখানা মৃৎচাকতির উপরে লিখিত তিনশত পঙক্তি সমন্বিত গিলগামেশ নামক একখানি মহাকাব্য উদ্ধার করা হইয়াছে, তাহার কতগুলি পাওয়া গিয়াছে নিনেভের ভগ্নস্তূপমধ্যে আসুরবানিপালের গ্রন্থালয়ে। উক্ত গ্রন্থের দ্বিতীয় স্তরে লেখা আছে একটি মহাপ্লাবনের কাহিনী।
ঐ কাহিনীটিতে বলা হইয়াছে– সুদূর অতীতে দেবতারা মানব জাতিকে ধ্বংস করার সংকল্প করিয়া পৃথিবীতে প্লাবন সৃষ্টির জন্য দেবসেনাপতি এলিনকে আদেশ দিয়াছিলেন। দৈবানুগ্রহে পূর্ব হইতে সংবাদ পাইয়া আত্মরক্ষার জন্য উৎনা পিসতিম একটি নৌকা প্রস্তুত করিয়া রাখিয়াছিলেন। অতঃপর বাত্যাদেবতা এনলিন যখন প্লাবন দ্বারা পৃথিবী নিমজ্জিত করিলেন, তখন উৎনা পিসতিম ও তাহার পত্নী সেই বজরায় উঠিয়া প্রাণ রক্ষা করিয়াছিলেন এবং তাহারা জীবকুলের বংশরক্ষার জন্য প্রত্যেক জাতীয় এক এক জোড়া পশু-পাখি নৌকায় তুলিয়া লইয়াছিলেন, সেই জন্যই প্রাণীজাতি ধংস পায় নাই।
একটু আয়াস স্বীকার করিয়া গিলগামেশ মহাকাব্যের প্লাবন কাহিনীর সহিত অন্যান্য দেশের কাহিনী মিলাইয়া দেখিলে বুঝা যাইবে যে, নানান ভঙ্গির কাহিনী সত্ত্বেও উহাদের মধ্যে কিছু না কিছু মিল আছেই।
.
# মূল প্লাবন
এত অধিক প্লাবন কাহিনীর মধ্যে বিশেষ কোনো একটি সত্য, না সবগুলিই সত্য, অথবা সবগুলিই কি মিথ্যা –কয়েক বৎসর আগে পর্যন্ত এই সকল কথার সঠিক উত্তর দেওয়া কাহারও পক্ষে সম্ভব ছিল না। আলোচ্য প্লাবনের একটি চাক্ষুষ প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে বর্তমান বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে মেসোপটেমিয়ার প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে। উহাতে একটি প্রচণ্ড মহাপ্লাবনের নিদর্শন ভূগর্ভে পাওয়া গিয়াছে, যাহার তুলনা সাধারণ বন্যার সঙ্গে করা চলে না। মাটির নিচে ৮ ফুট পুরু একটি পলিমাটির স্তর আবিস্কৃত হইয়াছে, যাহা অসাধারণ কোনো প্রলয়ঙ্কর প্লাবনের সাক্ষ্য দেয়। আর একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য সুস্পষ্ট প্রমাণ এই যে, পলিস্তরটির নিচের ও উপরের মধ্যে স্থানীয় সংস্কৃতির একটি পূর্ণচ্ছেদ দেখা যায়। এই কথা সত্য যে, বন্যাপ্লাবিত স্থানগুলির সমস্ত সংস্কৃতি বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছিল। পলিস্তরের নিচে পড়িয়া। আছে নব প্রস্তরযুগের গ্রাম্য সংস্কৃতির নিদর্শন –হাতে গড়া বিচিত্র হাঁড়ি-কুড়ি, প্রস্তরাস্ত্র; সেখানে ধাতুদ্রব্যের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় না। কিন্তু সেই পলিস্তরের ঠিক উপরের ভাগেই ধাতুযুগের সম্পূর্ণ নূতন সভ্যতার নানাবিধ উপকরণ দেখিতে পাওয়া যায়। সৌভাগ্যক্রমে প্লাবিত ভূখণ্ডের কোনো কোনো স্থানে দুই সভ্যতার মধ্যে এই রকম পূর্ণচ্ছেদ দেখা যায় না। এমন কতগুলি টিলার মতো উঁচু স্থান ছিল, যাহা প্লাবনেও জলমগ্ন হয় নাই; অথচ সেই স্থানগুলি প্লাবিত ভূখণ্ডেরই অন্তর্গত। এইখানে সংস্কৃতির পূর্বাপর পারম্পর্য নষ্ট হয় নাই। নব প্রস্তরযুগ ধীরে ধীরে কিরূপে ধাতু যুগে রূপান্তরিত হইল, তাহার ধারাবাহিক ইতিহাস রহিয়াছে এইখানের স্তরের মধ্যে সংরক্ষিত। এই রকম স্তর হইতে আরও জানা যায় যে, ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিসের নিম্নভাগে সুমের দেশে প্রস্তরযুগের গ্রামগুলি হইতেই এরেক, এরিদু, লাগাস, উর (হজরত ইব্রাহিমের জন্মস্থান), লারসা প্রভৃতি ঐতিহাসিক নগরগুলির উৎপত্তি হইয়াছিল।
প্রত্নতাত্ত্বিক স্যার লিওনার্ড উলি প্রসঙ্গক্রমে বলিয়াছেন, “এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই যে, আমরা যে বন্যার নিশ্চিত প্রমাণ পাইয়াছি, সেই বন্যাই হইল সুমেরীয় প্রবাদকথার ও ইতিহাসের বন্যা, আবার বাইবেলেরও প্রাবন সেই বন্যা, যে বন্যাকে অবলম্বন করিয়া নোয়ার আখ্যায়িকা রচিত হইয়াছিল।”[৪৭]
————
৪১. পৃথিবীর ইতিহাস, ৩য় খণ্ড, দুর্গাদাস লাহিড়ী, পৃ. ১২৮।
৪২. পৃথিবীর ইতিহাস, ৩য় খণ্ড, দুর্গাদাস লাহিড়ী, পৃ. ১২৫।
৪৩. পৃথিবীর ইতিহাস, ৩য় খণ্ড, দুর্গাদাস লাহিড়ী, পৃ. ১৩০, ১৩১।
৪৪. পৃথিবীর ইতিহাস, ৩য় খণ্ড, দুর্গাদাস লাহিড়ী, পৃ. ১৩১।
৪৫. পৃথিবীর ইতিহাস, ৩য় খণ্ড, দুর্গাদাস লাহিড়ী, পৃ. ১৩১, ১৩২।
৪৬. পৃথিবীর ইতিহাস, ৩য় খণ্ড, দুর্গাদাস লাহিড়ী, পৃ. ১২৬।
৪৭. প্রাচীন ইরাক, শচীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, পৃ. ২৪-২৬, ১৮৮–১৯৩।