প্রাণের প্রহরী

প্রাণের প্রহরী

কাব্য নাটক
[একজন ডাক্তারের চেম্বার। সাহেব পাড়ায়। সন্ধের পর এ অঞ্চল নিঝুম হয়ে আসে। চেম্বারটি বেশ প্রশস্ত ও পরিচ্ছন্ন। টেবিল ও অনেকগুলি চেয়ার ছাড়াও একটি কালো রেক্সিনে মোড়া গদির বিছানা। সেখানে দুজন বয়স্ক যুবক বসে আছে। এদের নাম প্রতীক ও সংবরণ।
ডাক্তারের দশাসই চেহারা। গলার আওয়াজ গমগমে। তাঁর নাম হৃষীকেশ। বাই ঋষি বলে ডাকে। তিনি একটু চেঁচিয়ে কথা বলেন, অনেকটা নাটুকে ধরনের। তিনি প্রকৃতপক্ষে একটি প্রৌঢ় চেহারার শিশু।
দূর থেকে ডাক্তারের গলার আওয়াজ শোনা যায় : ব্যাপারটা কী? ব্যাপারটা কী? ব্যাপারটা কী?]
প্রতীক : ঐ আসছে ঋষি, সারা পাড়াটা কাঁপিয়ে
সংবরণ : সারাদিন এত খাটনি, তবুওকে ক্লান্ত হতে দেখি না কখনো!
ডাক্তার : ব্যাপারটা কী হে! এত চুপচাপ
বসে আছো কেন? দূর থেকে ভাবলাম
কেউ নেই, আলো জ্বলছে, যেন বাগানের মধ্যে একটা ঘর।
কী রে সংবরণ, কী যেন ভাবছিস মনে মনে?
প্রতীক : চুপচাপ থাকবো না কি, নাচানাচি
করবো দু’জনে?
সংবরণ : আর ঠিক পাঁচ মিনিট দেখতাম, তারপর
কেটে পড়তাম।
ডাক্তার : আরে বোস্ বোস, এত রাগারাগি কেন,
আমি একা বহুক্ষণ এখানে ছিলাম। এসময়
কোনো সুস্থ মানুষের দেখা পেতে খুব
মন চায়। সারাদিন রুগী আর রুগী!
কটা বাজলো?
প্রতীক : সাড়ে আটটা, না, না, তার পাঁচ মিনিট কম
ডাক্তার : যথেষ্ট হয়েছে। আজ রুগী দেখা এখানে খতম?
কানাই, কানাই, কেউ এলে বলবি, আটটার পর
সব অসুখের ছুটি। আমি নেই, দরজা বন্ধ কর,
এখন আনন্দ হবে, ফুর্তি হবে…
কে ওখানে?
সংবরণ : কেউ না তো?
ডাক্তার : মনে হলো একটা ছায়া
সংবরণ : কিছু নেই।
ডাক্তার : ও, এক পার্শী মহিলাকে দেখে আসছি এই মাত্র,
মাগীর অসুখ নেই কোনো
সংবরণ : ল্যাঙ্গোয়েজ! ল্যাঙ্গোয়েজ!
ডাক্তারা : যত বলি, মা-জননী, তোমার তো অসুখ কিচ্ছু না!
তবু ঘ্যানোর ঘ্যানোর করে বলে, ঠিকমতো ওষুধ দিচ্ছে না!
এখানে সেখানে ব্যথা, প্রতিদিন ঘুম যাচ্ছে কমে,
বড়লোক, টাকার বাণ্ডিল, ঘুম হয় টাকার গরমে?
প্রেসার নর্মাল, স্টুল, ইউরিন, কিংবা রক্তে চিনি,
সমস্ত পরীক্ষা করে দেখা হলো, স্বাভাবিক। তবু
প্রতিদিনই
ডাক পড়ে।
প্রতীক : আহ্ ঋষি, রাত্তির অনেক হলো, আমরা এখনো
পেচ্ছাপ বাহ্যির কথা শুনবো? এর মানে হয় কোনো?
ডাক্তার : না, না, ফুর্তি হবে, আজ ফুর্তির দরকার
আমারই সবচেয়ে বেশি। কে ওখানে?
সংবরণ : কেউ না তো?
ডাক্তার : মনে হলো, ঠিক যেন কোনো
মেয়ে, বার-বার ভুল হচ্ছে কেন এরকম?
প্রতীক : টাকার ধান্দায় এত পরিশ্রম!
এরপর চোখে সর্ষেফুল দেখবে তুমি, ঋষি!
ডাক্তার : (নিচু গলায়, আগেকার ভাষায় যাকে বলা হতো
‘জনান্তিকে’। অর্থাৎ তাঁর এ-কথাটা অন্য কেউ শুনতে
পাবে না)
না, সে রকম নয়। ঠিক বাবলুর অসুখের পর
একটি নারীর ছায়া দেখতে পাই ক’দিন অন্তর
চুপ করে দরজার পাশে এসে নিঃশব্দে দাঁড়ায়
আবার চোখের এক পলক ফেলার আগে চলে যায়
আমি তো চিনি না, ওকে?
প্রতীক : মেয়েটি কেমন দেখতে?
ডাক্তার : (চমকে) কোন্ মেয়েটি?
প্রতীক : ঐ যে পার্শী মেয়েছেলে, যার কথা তুমি বলছিলে।
ডাক্তার : অসুন্দর পার্শী আমি এ পর্যন্ত দেখিনি কখনো,
ডাক্তারি শাস্ত্রের মতে যে শরীরে রোগ নেই কোনো
তবুও অসুখ থাকে সেখানেও। এই যে মহিলাটি,
রোগ নেই, তবু তিনি অসুস্থ যে সে কথাও খাঁটি!
সংবরণ : তোমাদের প্রচণ্ড সুবিধে,
শুধু আমাদের যা কিছু দুর্ভোগ
যে অসুখ সারাতে পারো না, বলে দাও,
‘ওটা মানসিক রোগ!’
ডাক্তার : হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ! সকলেরই খুব রাগ ডাক্তারের প্রতি,
অথচ ডাক্তার ছাড়া চলেও না, কিছু হলে কাকুতি মিনতি।
অন্যান্য সময়ে দূর শালা! মনের অসুখ চিনে নিতে
ভুল তো হতেই পারে। ইচ্ছে আছে মনটাকে ল্যাবরেটরিতে
একদিন ঠেসে ধরবো। পঞ্চভূত মানুষের দেহে
ক্ষিতি, অপ, তেজ, বায়ু আর ব্যোম। অত্যন্ত সস্নেহে
শরীর এদের পোষে। এর মধ্যে পঞ্চমটি বাদে
বাকি চারিটিকে ঢের নেড়েচেড়ে দেখা গেছে, কিন্তু গোল বাধে
অদ্ভুত জিনিসটি নিয়ে, ঐ ব্যোম, অথাৎ শূন্যতা
তার কোনো দিশা নেই, কোনো শাস্ত্রে নেই তার কথা।
সংবরণ : এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের লেখা আছে, তা পড়োনি বুঝি?
তা পড়বে কেন? ডাক্তারেরা বই-টই পড়ে না। শুধু মাত্র রুজি
রোজগারের ধান্দাতেই মত্ত
ডাক্তার : বাজে কথা বলো না হে! প্রতিদিন দশ কি বারোটি
গ্রন্থপাঠ করি আমি। মানুষের নোখ থেকে মাথার করোটি,
হাড় মজ্জা রক্তের জীবন, এর চেয়ে বড় গ্রন্থ আছে?
প্রতীক : এ সমস্ত শস্তা দার্শনিকতা দিয়ে পেট ভরবে ভাই?
ঢের হলো! মাল কড়ি ছাড় কিছু মাল টাল খাই?
ডাক্তার :হ্যাঁ, হ্যাঁ, ফুর্তি হবে, আজ ফুর্তির দরকার
আছে খুব আমার নিজেরই। মন ভালো নেই।
দিতে হবে এক ড়ুব ফুর্তির সাগরে কিছুক্ষণ।
কে, কে ওখানে?
প্রতীক : জ্বালানৈ দেখছি আজ। থেকে থেকে বারবার কে, কে?
ভুল হতে হতে তবু মানুষ তা খানিকটা শেখে?
রাত্তিরে ঘুমোও না বুঝি?
ডাক্তার : না, না, ভুল নয়, খুব স্পষ্ট চোখে দেখা
বাবলুর অসুখের পর থেকে
[নেপথ্যে একজন কেউ ডাকলো, ডাক্তারবাবু, ডাক্তারবাবু! নদীতে
মাঝিরা যে রকম সুর করে জল মাপে, সেই রকম কণ্ঠস্বর।]
সংবরণ : ঐ তো এসেছে কেউ
প্রতীক : ফের কোনো রুগী-টুগী
সংবরণ : এ লোকটিই বহুক্ষণ থেকে আছে দরজার পাশে
ডাক্তার : না, না, এ সে নয়। একে জানি। চিনি এর গলার আওয়াজ
মাঝে মাঝে আসে। সাত দিন পর আবার এসেছে বুঝি আজ।
[আগন্তুকের প্রবেশ। বৃদ্ধ, মুখে সাতদিনের পাকা দাড়ি। একটা
রঙ জ্বলে যাওয়া নীল জামা গায়, সে আর কারুর প্রতি ভ্রূক্ষেপ না
করে শুধু ডাক্তারের দিকে চেয়ে থাকে।
আগন্তু : ডাক্তারবাবু, ডাক্তারবাবু?
ডাক্তার : কে, ধরণী?
আবার এসেছে, তুমি এখনো মরোনি
আগন্তু : (সাগ্রহে) মরবো, ডাক্তারবাবু?
ডাক্তার : মরার কি অন্য কোনো জায়গা পেলে না?
আমার কাছেই বুঝি আছে শুধু দেনা?
আগন্তু : মরবো, ডাক্তারবাবু?
ডাক্তার : সাতদিন কোথা ছিলে? ফের চাড়া দিয়ে উঠে এলে?
আগন্তু : মরবো, ডাক্তারবাবু?
ডাক্তার : চুপ করো! মরণের উচ্চারণ এখানে নিষেধ।
[ডাক্তার পকেট থেকে তিরিট চল্লিশটা টাকা বার করে দিলেন।
লোকটি কোনো কৃতজ্ঞতা বা নমস্কার না জানিয়ে নিঃশব্দে চলে
গেল।]।
প্রতীক : কী ব্যাপার লোকটাকে দিলে এত টাকা?
আমাদের ফুর্তির খোরাক সব ফাঁকা?
সংবরণ : আগেও দেখেছি, তুমি ঐ বুড়োটাকে টাকা দাও, ব্ল্যাকমেল নাকি?
ডাক্তার : ব্ল্যাকমেলই বটে! এই বুড়ো লোকটি প্রাক্তন নাবিক,
ছিল জলে ভ্রাম্যমাণ। এখন ডাঙায় এসে দিক
হারিয়েছে। ও চেনে না শহরের বাঁধা পথ; মাটির নিয়ম
ও জানে না। সংসারের বুদ্ধি ওর কম
ও বোঝে না নিজের সুবিধে
বাড়িতে পাঁচটি বাচ্চা, রোগা বউ, আর আছে খিদে
বেকারের খিদে পাওয়া বড় দোষ।
বেকারের ছেলেদের খিদে পাওয়া আরও বেশি দোষ!
প্রতীক : আবার দুঃখের গপ্পো! আজ শুধু অনন্ত ঝামেলা।
ডাক্তার : না, না, না, না; এবারই তো শুরু হবে খেলা।
সংবরণ : ও বেকার, কিন্তু তুমি কেন দিতে যাবে ওর অন্ন?
তুমি কি সমাজ? নাকি রাষ্ট্র? নাকি দাতাকর্ণ?
ডাক্তার : সে সব কিছু না। আমাদের প্রত্যেকেরই জীবন চর্যায়
এরকম ফাঁক থাকে। ঐ লোকটা শূন্য হাতে বাড়ির দরজায়
যদি ফেরে, ঠিক পাখির ছানার মতো, পাঁচটি হাঁ করা মুখ
মেলে আছে, ওরা রোগী, এর নাম খিদের অসুখ!
ও তো পয়সা চায় না,
বিষ চায়! দু তিনবার ওর বাড়ি গেছি।
যা দেখেছি,
মনে হয়, এতকাল বইপত্রে যা কিছু শিখেছি
সেখানে উত্তর নেই এসবের।
এ পর্যন্ত খিদের ওষুধ বেরিয়েছে? তবে?
নাকি বিষ দেবো?
আমি তো ডাক্তার, কিছু দিতে হবে—
প্রতীক : ওসব বাতেলা ছাড়ো, মাল আনো
মালের উৎসবে।
ঝুঁদ হয়ে থাকি। তুমি অতি বুদ্ধ তাই এখনো উত্তর
চাও, এখনো বিবেক নিয়ে প্যানপান, ধুত্তোর
ডাক্তার : কানাই, নিয়ায়, আজ ফুর্তি করি,
মন ভালো নেই।
আমার নিজের ছেলে হাসপাতালে
সংবরণ : এমন ফুটফুটে ছেলে, তার কিছু হতেই পারে না
ডাক্তার : সুইডেন থেকে তার জন্য কিছু অ্যামপিউল, কেনা
বিশেষ দরকার।
প্রতীক : ‘মাই সান, মাই এক্সিকিউশানার’
ডাক্তার : (চমকে) তার মানে?
প্রতীক : ওরে পুত্র, জল্লাদ আমার’,
ডাক্তার : কার পুত্র? কে জল্লাদ?
প্রতীক : প্রত্যেক পিতার পুত্র, পিতার জল্লাদ
এক ছোকরা এই নিয়ে লিখেছে কবিতা।
দিনে দিনে বাড়ে কালকেতু, দিনে দিনে বড় হয় ছেলে
আর তুমি, তার পিতা ততই মৃত্যুর দিকে যাও তুমি হেলে!
ডাক্তার : এক্ষেত্রে আমিই বুঝি পুত্র হন্তা, সেই বুঝি ভালো…
মাত্র ন’বছর, এর মধ্যে মৃত্যু শিয়রে দাঁড়ালো।
এ কি প্রতিশোধ?
আমি বহুবার বহু বাড়ি থেকে
মৃত্যুকে ফেরাই।
তাই মৃত্যু এবার কি জাল ফেলে ছেঁকে
আমারই সংসারে দেবে থাবা?
সংবরণ : কী রকম আছে বাবলু?
ডাক্তার : যখন ঘুমন্ত থাকে, ভালো থাকে,
হাসে, কথা বলে,
সত্যিই ঘুমের মধ্যে হাসে কথা বলে। যখনই সে জেগে ওঠে,
অসহ্য যন্ত্রণা,
যেন কাকে দ্যাখে
ক্যাবিনের বাইরে, কেউ নেই তবু দ্যাখে
সংবরণ :কী ঠিক অসুখ ওর?
ডাক্তার : নেফ্রটিক সিনড্রম। ঠিক বুঝবে না তোমরা,
দুটি কিডনিতেই অজানা অসুখ।
সংবরণ : অজানা অসুখ?
ডাক্তার : আশ্চর্য হলে কি? শুধু মন নয়,
মনুষ্য শরীরে
এখনো অচেনা কিছু রয়ে গেছে।
প্রতীক : বিশ্বাস করি না। তুমি চিকিৎসা ছেড়ে মন্ত্র নাও
সংবরণ : কিডনির অসুখ? আজকাল প্রায়ই শুনি
মাদ্রাজে ভেলোরে,
চমৎকার সেরে যায় সব
প্রতীক : আরও একটু সরে
হোয়াইট ফিল্ড গ্রামে যাও, ছাই ভস্ম,
হাওয়া থেকে ফুল…
ডাক্তার : ও সমস্ত কথা থাক, এসো খাই
সংবরণ : ঋষি, তুমি বড়ই অস্থির হয়ে আছো
ডাক্তার : হয়তো বাঁচানো যায়, আজ থেকে মাস দেড়েক আগে
ডাক্তার লোম্যান নামে একজন সেন্ট পিটার্সবার্গে
পরীক্ষা চালিয়েছেন বাঁধা-মৃত্যু দশজন রোগীর শরীরে
নতুন ওষুধ কিংবা বিষ–ফল হলো ঠিক যেন মেঘ চিরে
হঠাৎ বিদ্যুৎ কিংবা বজ্রপাত কিংবা আশীর্বাদ,

পাঁচজন বেঁচে গেছে, পাঁচটি বাঁচেনি!
সংবরণ : পাঁচজন বেঁচে গেছে, পাঁচটি বাঁচেনি?
এ যে সাঙ্ঘাতিক
এ কি সার্থকতা নাকি ব্যর্থতারই আর এক দিক
ডাক্তার : যাক আর ঐ কথা নয়। ভুলে থাকতে চাই
ফুর্তি হোক। শালা মরণের মুখে ছাই
দাও, তুড়ি মারো, এই তো এসেছে গ্লাসে ঢালা
কে ওখানে?
কে ওখানে?

দ্বিতীয় দৃশ্য
(হাসপাতাল, ক্যাবিনের মধ্যে খাটে ঘুমিয়ে আছে বাবলু। ন দশ বছর বয়েস। তাকে ঘিরে চার-পাঁচজন ডাক্তার। কলের মুখ মেঘলা, ঋষি তাঁর অধ্যাপক এক প্রবীণ ডাক্তারকে শেষবার অনুরোধ করলেন :]।
ঋষি : স্যার, নতুন ওষুধ এইমাত্র আমি নিজে
সব ঝুঁকি নিয়ে ভেবেচিন্তে ভরেছি সিরিঞ্জে,
আপনি দিন
স্যার : ঋষি, তুমি ক্ষমা করো, আমাকে বলল না
বুড়ো হয়ে গেছি, আজকাল হাত কাঁপে
ঋষি : স্যার, কে না জানে আজও কলকাতা কিংবা
সারাদেশে আপনার তুল্য চিকিৎসক বেশি নেই
স্যার : তবু তুমি ক্ষমা করো এই বৃদ্ধটিকে।
যে ওষুধ পরীক্ষিত নয়, জেনেশুনে তা আমি কী করে
দিই?
তোমার সন্তান সে যে আমারও অনেক আদরের।
ওকে আমি কী করে অজানা পথে নিয়ে যাবো, বলো?
ঋষি : (অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে) ডক্টর লাহিড়ী, আমি
আপনাকে যদি
লাহিড় : না, না, ঋষি ক্ষমা করো।
ঋষি : ডাক্তার সামন্ত? আপনিও ভয় পেয়ে সা
মন্ত : ভয় নয়, ঋষি, এ যে অর্ধেক হত্যার
ঝুঁকি নেওয়া।
ঋষি : অর্ধেক জীবন? তার ঝুঁকি নেওয়া যায় না?
ঠিক আছে। তা হলে আমিই নিজে পুত্রাঘাতী হবো,
নিজ হাতে এই বিষ আমি ওর শরীরে মেশাবো।
আপনারা সবাই বাইরে যান তবে
[ঘর খালি। ঋষি ছেলেকে ডাকলেন]
ঋষি : বাবলু, বাবলু, ঘুম থেকে উঠে আয়, আমরা।
দুজনে ফের ভোরবেলা বাগানে বেড়াবো
বাবলু : বাবা–
ঋষি : বাবলু, বাবলু
বাবলু : বাবা, তুমি কত দূরে?
ঋষি : এই তো এখানে আমি, শিয়রের কাছে
বাবলু : ভীষণ যন্ত্রণা! বাবা তুমি হাত ধরে নিয়ে যাও,
আমাকে অনেক দূরে এমন কোথাও
যেখানে একটুও ব্যথা নেই–
ঋষি : এই দ্যাখ, আমার ডান হাতে ছুরি, আমি
চোখের নিমেষে
তোকে নিয়ে যাবো সব যন্ত্রণার শেষে
এক শান্ত অন্য দেশে
বাবলু : খুলতে পারি না চোখ, এত ব্যথা,
কেন এত ব্যথা?
ঋষি : চোখ যে খুলতেই হবে, অন্ধকারে কী করে না
দেখে
যাবি সেই অন্য দেশে?
বাবলু : ছুরি নেই? এ যে ইঞ্জেকশান!
ঋষি : বাবলু, বাবলু, শোন,
খুব মন দিয়ে তুই শোন,
সিরিঞ্জে ভরেছি আমি নতুন ওষুধ কিংবা বিষ
হয়তো উঠবি বেঁচে, কিংবা চলে যাবি পরপারে
যদি পরপার বলে কিছু থাকে, সেখানে আমাকে দোষ দিস, ভেবে
নিস, বাবা তোকে সজ্ঞানে স্বেচ্ছায়
পাঠিয়েছে সেইখানে। আর যদি কোনোক্রমে বেঁচে
উঠিস তা হলে সেটা তোরই নিজের জয়।
বাবলু : বাবা, তুমি সব যন্ত্রণার শেষ করে দাও
ঋষি : দেবো, তাই দেবো, তোর মা আমাকে মাথার
দিব্যিতে
নিষেধ করেছে, বুঝি কেঁদে কেঁদে অন্ধ হয়ে যাবে।
আত্মীয়-বন্ধুরা, চিকিৎসক, কেউ রাজি নয়
তুই রাজি? তুই ছেলেবেলা থেকে দারুণ সাহসী
বাবলু : আমি রাজি। আমাকে ওষুধ দাও, কিংবা বিষ
ঋষি : তাই হোক। চোখ চেয়ে থাক
(মৃত্যুর প্রবেশ। মহাভারতের বর্ণনার মতন অনেকটা তার রূপ। সে
একটি নারী। সর্বাঙ্গে কালো পোশাক। নতুন তামার বাসনের মতন
গাত্রবর্ণ। পিঠের ওপর গুচ্ছ গুচ্ছ আঙুর ফলের মতন কোঁকড়ানো
চুল। তার চোখে জল]
মৃত্যু : একটু দাঁড়াও ঋষি। কথা আছে
ঋষি : কে তুমি?
মৃত্যু : চেয়ে দেখো। খুব কি অচেনা লাগে? বহুবার
দেখা
হয়েছে তোমার সঙ্গে
ঋষি : তুমি নেই? খরা মাঠে বিমানের ছায়ার মতন
চকিত মিলিয়ে যাও
মৃত্যু : বারবার ফিরে আসি
ঋষি : আমাকে না দেখে বুঝি মন কাঁদে? এমন প্রণয়?
আপাতত বাইরে যাও
মৃত্যু : আমি এই শিশুটির অনন্তকালের ধাত্রী
আমি তমসার মধ্য দিয়ে ওর হাত ধরে
নিয়ে যাবো
ঋষি : তুমি এই ছেলেটিকে জননীর কোল থেকে ছিঁড়ে
নিয়ে যেতে চাও।
মৃত্যু : আমি এই শিশুটিকে কালের সীমানা ভেঙে শুধু
অসীমে পাঠাবো, দাও…
ঋষি : ওর মা’র স্নেহ, আর আমার বুকের ভালোবাসা
তাও কি অসীম নয়? পৃথিবীর এই মায়াপাশ
যদি ছিন্ন করো বারবার, তবে কেন তা বেছাও?
মৃত্যু : ঋষি, তুমি দেখেছছ অনেক মৃত্যু, শুভ ও অশুভ
তবু কেন অস্থিরতা? সব মিথ্যে আমি শুধু ধ্রুব
ঋষি : তুমি অহংকারী, তবু তোমার দু চোখে
কেন জল? তোমার কি চক্ষু রোগ?
মৃত্যু : আমার হৃদয় নেই, তবু আমি দুঃখী।
আমি একা।
আমার আকাঙ্ক্ষা নেই, তবু আমি নিত্য ভ্রাম্যমাণা,
অনধিকারিণী আমি, অথচ আমিই হাত পাতি
বাবলু : বাবা, তুমি কার সঙ্গে কথা বলছো?
ঋষি : কেউ না, বাবলু সোনা! নিছক মনের ভুল,
ছায়া।
বাবলু : বাবা, তুমি সব ব্যথা শেষ করে দাও
ঋষি : এই তো এক্ষুনি দিচ্ছি, দেখি ডান হাত
মৃত্যু : ঋষি, থামো
ঋষি : আঃ, বিরক্ত করো না, যাও
মৃত্যু : ঋষি, তুমি হেরে যাবে
ঋষি : যাই যাবো। তবু আমি কোনোদিন না লড়ে
ছাড়িনি
তুমি নয়, মৃত্যু নয়, জীবনের কাছে আমি ঋণী!
তুমি নারী, তুমি সরো, যমরূপী পুরুষ পাঠাও
যার সঙ্গে সরাসরি দ্বন্দ্বযুদ্ধ হয়, তুমি যাও।
মৃত্যু : শোনো ঋষি, কেন এই চঞ্চলতা, এখনো দু মাস
দিতে পারি ওর আয়ু, এখনো রয়েছে ওর শ্বাস,
কেন তা থামাবে তুমি? এই পৃথিবীর রূপ রস
আরও কিছুদিন ওর প্রাপ্য, ওর নবীন বয়স
দ্বিগুণ শক্তিতে সব নিতে পারে, ততটুকু নিক
আমি ওকে স্নেহ দিয়ে ঘিরে রাখবো জননী অধিক।
ঋষি : কে চায় তোমার কৃপা? আমি আছি প্রাণের প্রহরী।
শেষ নিশ্বাসের সঙ্গে লড়ে যাই, মুষ্টি মধ্যে ভ্রমরকে ধরি।
এই যে তরল বিষ, এর মধ্যে অর্ধেক জীবন,
অথবা অর্ধেক মৃত্যু, দেখি আমি এর মধ্যে কোন্
অর্ধাংশটি জিতে যায়, আমি আছি জীবনের দিকে
—তোমার সন্তান নেই, রাক্ষসিনী, তাই তুমি এই শিশুটিকে
নিয়ে জয়ী হতে চাও?
রাক্ষসিনী, রাক্ষসিনী!
মৃত্যু : ঋষি, শান্ত হও
বাবলু : বাবা, বড় ব্যথা, তুমি ব্যথা শেষ করে দাও
ঋষি : দেবো রে, বাবলু সোনা, দেখি ডান হাত
মৃত্যু : ঋষি, শোনো
ঋষি : চুপ!
[ঋষি ইঞ্জেকশানের সূচ ছুরির ভঙ্গিতে ঢুকিয়ে দিলেন বাবলুর হাতে।
বাবলু দুবার বাবা বলে ডেকেই থেমে গেল হঠাৎ। তার গলায়
সেতারের তার ছেড়ার মতন শেষ শব্দ হলো। ঋষি সে দিকে
একটুক্ষণ চুপ করে চেয়ে থেকে সিরিঞ্জটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন।]
মৃত্যু : ঋষি, তুমি হেরে গেলে
ঋষি : (শান্ত ভাবে) জানি। ওর ব্যথা শেষ হয়ে
গেছে
মৃত্যু : আগেই বলেছি হেরে যাবে
ঋষি : খেলতে এসেছি তাই আমি জানি খেলার নিয়ম,
হারজিৎ আছে। শুধু তুমি আর তোমাদের যম
কখনো হারো না, শুধু জয় নিয়ে দারুণ উল্লাস।
এবার তো সুখী হলে? নিয়ে যাও শিশুটির লাশ।
আমার প্রাণের টুকরো এই শিশু
মৃত্যু : সুখী নই, সুখী নই
যতবার জিতে যাই, ততবার মনে মনে হারি
অনন্ত কালের মধ্যে
আমি এক সুখ-শূন্য নারী।
এই হাত দুঃখ দিয়ে গড়া, চোখ দুঃখের সমাধি
এসো ঋষি, তুমি আমি দুজনেই একসঙ্গে কাঁদি।

এর পর ঋষি ও মৃত্যু দুজনে বাবলুর দুপাশে হাঁটু গেড়ে বসে।
জনে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে কিন্তু কেউই চোখের জল
ফে লে কাঁদে না। তারপর মৃত্যু হাত বাড়িয়ে বাবলুকে ছুঁতেই ঋষি
মুখ ফিরিয়ে নেয়। তখন যবনিকা নামে।

[এই কাব্য নাটকটি কেউ অভিনয় করতে চাইলে আগে লেখকের অনুমতি নেওয়া প্রয়োজন। অভিনয়ের সময় লাইনগুলি কবিতার মতন নয়, গদ্যের মতন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উচ্চারণ করতে হবে। এবং দক্ষিণা স্বরূপ লেখককে দিতে হবে অন্তত একটি নীল রঙের জামা কলারের সাইজ, আটত্রিশ। ]