পঁচিশ
‘জিনা-শুনলে?’ গলা খাট করে বললাম।
ওর মুখের চেহারার ভীতিমাখা অভিব্যক্তিই বলে দিল প্রতিটা শব্দ শুনেছে ও।
‘কিশোর, আমাদেরকে এখান থেকে পালাতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব চলে যেতে হবে অন্য যে কোনখানে!’
‘হুম, কিন্তু সেজন্যে একটা প্ল্যান তো চাই,’ বললাম।
বাতাসে দু’হাত ছুঁড়ল জিনা।
‘প্ল্যানের পরোয়া করি না আমি। এই জঘন্য, ঘেমো রুপোলী পোশাক ছেড়ে অন্য কিছু পরাটাই এখন প্রথম কাজ আমাদের!’
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম ওর দিকে।
‘কী বললে এইমাত্র?’ জিজ্ঞেস করলাম।
ও আমার দিকে এমনভাবে চাইল যেন বদ্ধ উন্মাদ আমি।
‘বলেছি জঘন্য, ঘেমো রুপোলী পোশাক।’
‘পেয়েছি!’ বিস্ফোরিত হলাম।
‘কী?’ উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল জিনা।
‘আমাদের জামাকাপড়!’
‘কিশোর, তোমার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘পারা উচিত!’ চেঁচিয়ে উঠেই, পরক্ষণে গলা নামালাম। উত্তেজিত ফিসফিসে স্বরে কথা বলছি। ‘যুক্তি আছে আমার কথায়।’
ধৈর্যের সঙ্গে, জিনাকে ব্যাখ্যা করলাম আমার চিন্তা-ভাবনা।
‘জিনা, তুমি বুঝতে পারছ না? আমি এখন সব বুঝে গেছি। ক্যাপ্টেন এক নাগাড়ে মিথ্যে কথা বলে যাচ্ছে আমাদের কাছে। টেরোড্যাকটিলটাকে অতীত থেকে ভবিষ্যতে নিয়ে এসেছিল সে।
‘তো?’ একদৃষ্টে চেয়েই রইল জিনা আমার দিকে, হতভম্ব ভাবটা কাটেনি।
‘তো সে আমাদেরকে ভবিষ্যতে পাঠাতে পারে। কাজটা কীভাবে করতে হয় জানে লোকটা। এবং আমার ধারণা, এখন আমিও জানি!’
ছাব্বিশ
পর্দার ফাঁক দিয়ে উকি দিল জিনা, আঁধারে কেউ ঘাপটি মেরে আমাদের কথা শুনছে কিনা দেখতে
এবার আবার আমার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তা সেটা কীভাবে?’
‘মনে করার চেষ্টা করো,’ শুরু করলাম, ‘প্রথম যখন তুমি ওই টাইম ক্যাপসুলটা থেকে বেরিয়েছিলে।’
মাথা ঝাঁকিয়ে লজ্জায় লাল হলো জিনা
‘লোকটা আমাকে তখনই কাপড় পাল্টে এই বিশ্রী সিলভার সুটটা পরতে বাধ্য করে। ও কথা ভোলা যায়?’
‘ঠিক!’ বলে উঠলাম। ‘আমার সাথেও একই কাজ করেছে। প্রথমটায় ভেবেছিলাম উর্দি পরাতে চায় বুঝি।’
সাগ্রহে মাথা ঝাঁকাল জিনা, বিস্ফারিত চোখে আমার সব কথা গিলছে।
‘কিন্তু এখন আমি জানি আমরা যে পোশাকে এখানে এসেছিলাম সেগুলো ছিল ভবিষ্যতের জামাকাপড়। ওগুলো পাল্টে যা পরেছি তা ভবিষ্যতের পোশাক বলে মনে হলেও, আসলে বিশ শতকের কস্টিউম, সে আমলের সুতো-কাপড় দিয়ে তৈরি।’
‘কিশোর,’ অধৈর্য শোনাল জিনার কণ্ঠ। এর কি সত্যিই কোন অর্থ আছে? আমি তো আশা-ভরসা হারিয়ে ফেলছি।’
‘একটু ধৈর্য ধরো,’ সান্ত্বনা দিয়ে বললাম। ‘আমার ধারণা আমরা যদি নিজেদের পোশাক পরি-ভবিষ্যতের পোশাক-তাহলে একটা সময়চক্র তৈরি হবে। এবং জামাকাপড়গুলো আমাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে আমাদের নিজস্ব সময়ে।’
দাঁত বেরিয়ে পড়ল জিনার।
‘বুঝেছি। নিখুঁত পরিকল্পনা!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল।
আমি এখন সত্যিই উত্তেজনা অনুভব করছি।
‘ক্যাপ্টেন আমার শর্টস, শার্ট আর স্নিকার্স নিয়ে যাওয়ার সময় বিড়বিড় করে কিছু একটা আওড়াচ্ছিল। ‘নো প্রমাণ! নো প্রমাণ!’ বলছিল লোকটা। এর মানে সে আমাদের সময়ের কোন চিহ্ন কিংবা প্রমাণ চোখের সামনে রাখবে না। তার কারণ সে জানে ওই কাপড়গুলো আমাদেরকে নিজেদের সময়ে ফিরিয়ে নিতে পারে।’
‘তারমানে তুমি বলছ,’ প্রশ্ন করল জিনা, ‘নিজেদের আসল জামাকাপড় পরলেই আমরা বাড়ি ফিরতে পারব? খুব বেশি সহজ মনে হচ্ছে না ব্যাপারটা?’
‘আমি কোন নিশ্চয়তা দিতে পারছি না,’ জবাবে বললাম। ‘তবে কখনও-কখনও সমাধানটা পানির মত সহজই হয়।’
এটাই আমাদের শেষ আশা।
জিনাকে অনুসরণ করে হল ধরে পা চালালাম।
‘ক্যাপ্টেন ডিনার থেকে ফিরবে যে কোন মুহূর্তে,’ ফিসফিস করে বলল ও। ‘যা করার এখনই করতে হবে, কিশোর।’
‘হ্যাঁ,’ সম্মতি দিলাম।
আশপাশে কেউ নেই-একজন মাত্র পাহারাদার ছাড়া। বড় কামরাটায় বসে খবরের কাগজের পাতাগুলো পড়ছে আর খিকখিক করে হাসছে সে। হামাগুড়ি দিয়ে ওর পাশ কাটালাম। লোকটার দৃষ্টিসীমার আড়ালে এসেই এক লাফে দাঁড়িয়ে পড়ে দৌড়ে গেলাম টাইম মেশিনটার পাশ দিয়ে।
কাপড় রাখার ক্লজিটটার কাছে গিয়ে হাতলটা ধরে টানলাম।
বন্ধ।
ভুলেই গেছিলাম, ক্যাপ্টেন এটা সবসময় তালা মেরে রাখে। চাবির গোছাটা কোটের পকেটে থাকে তার।
আমাদের কপাল খারাপ।
দরজাটা পরীক্ষা করলাম। পলকা। দরজার পাশে ঝুলছে ক্যাপ্টেনের কাঠের মুগুরটা।
ওটা পেড়ে নিয়ে তালায় সজোরে আঘাত করতে থাকলাম যতক্ষণ না দরজাটায় চিড় ধরল।
জিনা সতর্ক পাহারায় ছিল।
‘তাড়াতাড়ি করো, কিশোর, ফিসফিসিয়ে বলল। ‘কাপড়গুলো নিয়ে ভাগি চলো।’
শেষমেশ তালাটা খসে পড়ল। এক টানে দরজাটা খুলে পাগলের মত হাতড়ালাম ভেতরটা।
ক্লজিটটা শূন্য।
সাতাশ
বলাবাহুল্য, মুষড়ে পড়লাম আমরা। এটাই আমাদের শেষ সুযোগ ছিল।
হতাশায় দু’হাত ছুঁড়ল জিনা।
‘আমাদের জামাকাপড়!’ বিলাপ করে উঠল। ‘কোথায় নিয়ে গেছে ওরা?’
‘এক মিনিট!’ বললাম। মেঝের ওপরে হাত বোলালাম। পেছনদিকে চৌকো এক প্যানেল পেলাম। চৌকোটার এক পাশে ছোট্ট এক ধাতব আঙটা।
ট্র্যাপডোর!
আঙটাটা ধরে টানছি আমি। বৃথা।
এবার ক্লজিটের গোবরাটে একটা পা রেখে আরও জোরে টানলাম।
খুলে গেল দরজাটা। ক্লজিটের নকল তলদেশ উঠে এল।
ওই তো, গাদা করে রাখা আমাদের পোশাক-আশাক। আমাদের প্রিয় আধুনিক জামাকাপড়।
মেরুন-সাদা সকার জার্সিটা দেখে কী খুশিই না হলাম! আর আমার বাতিগুলো! সোলে বাতি জ্বলা নতুন স্নিকারজোড়া!
জিনাকে নিয়ে ছোট ঘরটায় চলে এলাম, বুকে কাপড়চোপড়গুলো আঁকড়ে ধরে।
এবার পরস্পরের দিকে পিঠ ফিরিয়ে যার-যার রুপোলী সুট খুলে নিজেদের পোশাক-পরিচ্ছদ পরে নিলাম।
উল্টো ঘুরে যখন একে অন্যের দিকে চাইলাম, চওড়া হাসি আমাদের মুখে।
জিনার পরনে ওর চকচকে গোলাপী ব্লগস, সাদা বারমুডা শর্টস আর এক ফ্যাকাসে গোলাপী হল্টার। কাপড়গুলো সামান্য কুঁচকে গেলেও চমৎকার দেখাল আমার চোখে।
দীর্ঘ একটি উদ্বিগ্ন মুহূর্ত ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা, সময়চক্র কাজ শুরু করবে সে অপেক্ষায়।
হাতজোড়া ঝাঁকালাম আমি, ভাবখানা এমন যেন ভবিষ্যতে ফেরার গতি বাড়বে এর ফলে।
মেঝেতে ক্লগস ঠুকল অধৈর্য জিনা।
বুক দুরুদুরু করছে আমার, মুখের ভেতরটা শুকনো।
১৯৩০-এর দশক থেকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় হওয়ার প্রতীক্ষায় অস্থির দু’জনে।
অপেক্ষা করেই চলেছি।
এবার দু’জনেই হাল ছেড়ে দিয়ে ধপ করে বসে পড়লাম কৌচে।
‘চেষ্টাটা ভাল ছিল, কিন্তু কাজ হলো না, বলল জিনা।
‘দাঁড়াও!’ চেঁচিয়ে উঠলাম। ‘আরেকটা আইডিয়া এল এইমাত্র!’
কিন্তু দড়াম করে খুলে গেল দরজাটা এবং ক্যাপ্টেন গটগটিয়ে প্রবেশ করল ঘরে। প্রমাদ গণলাম।
আমাদের সাজপোশাকের দিকে একনজর চাইতেই ক্রোধে সরু হলো তার চোখের পাতা।
‘কী করছ তোমরা?’ ঘাউ করে উঠল।
এবার দু’হাতে দু’জনকে চেপে ধরল।
‘এসো আমার সাথে,’ খেঁকিয়ে উঠল।
‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাদেরকে?’ বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে কোনমতে বলল জিনা।
‘তোমরা শুরু থেকেই যেখানে যেতে চাও,’ জবাব দিয়ে, টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলল।
আমাদের আতঙ্ক টের পেয়েই যেন, হলওয়েতে থমকে দাঁড়াল ক্যাপ্টেন এবং চাইল জিনার উদ্দেশে।
‘তুমি হবে সুন্দরী এক ব্যাঙকন্যা, রাজকুমারী।’
এবার পাঁই করে ঘুরল আমার দিকে। তর্জনী দিয়ে জোরে খোঁচা দিল আমার বুকে।
‘ঠিক বলেছি না, গিরগিটি কুমার?’ ঘোষণা করল।
আটাশ
আরেকটি শব্দ উচ্চারণ না করে, ক্যাপ্টেন টাইম আমাদেরকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চলল হল ধরে।
লোকটা কোথায় নিচ্ছে আমাদের? মাছের বড় ট্যাঙ্কটার কাছে?
না। আমাদেরকে হিঁচড়ে নিয়ে গেল টাইম মেশিনটার কাছে।
‘ঢোকো,’ আদেশ করল।
‘আমাদেরকে কোথায় পাঠাচ্ছেন আপনি?’ কর্কশ শোনাল আমার কণ্ঠ।
‘অতীতে, তোমাদের বন্ধু টেরোড্যাকটিলটার কাছে। তোমাদেরকে মজা করে খাবে ওটা। এটাই তোমাদের প্রাপ্য।’
আমাদেরকে ঠেলে ভেতরে ঢুকিয়ে দিল, এবার সামনে ঝুঁকে নব ঘোরাতে লাগল, সে সঙ্গে লিভারে মৃদু চাপ দিচ্ছে।
‘ভবিষ্যতের জঞ্জালের ঝামেলা থেকে বাঁচা গেল, বলল। এবার আমাদের পেছনে সশব্দে লাগিয়ে দিল হ্যাচটা।
থরথর করে কাঁপতে লাগল মেশিনটা।
‘কিশোর!’ ফুঁপিয়ে উঠল জিনা, ‘আমার ভয় করছে। আমি ডাইনোসরদের যুগে ফিরে যেতে চাই না!’
অজানা শঙ্কায় বুক ঢিবঢিব করছে আমার। কোনমতে নবগুলো ঘুরিয়ে, লিভারগুলোকে উল্টো সেটিং দিলাম।
ক্যাপ্টেন টাইম হয়তো চেয়েছে আমাদেরকে অতীতে পাঠাতে। কিন্তু আমরা চাই ভবিষ্যতে যেতে।
অপেক্ষায় রয়েছি। এতটাই নার্ভাস লাগছে আহাজারি করতে ইচ্ছে হলো।
আহাজারি! আর্তনাদ!
দ্য স্ত্রিমিয।
‘পেয়েছি!’ চিৎকার ছাড়লাম।
জিনাকে আগের চাইতেও ভীত-সন্ত্রস্ত দেখাল।
‘আবার কী হলো, কিশোর?’
আমার শর্টসের পেছনের পকেটে হাত ঢোকালাম।
প্রায় ভর্তা হয়ে গেলেও এখনও রয়েছে ওগুলো! আমার ক্যারামেল ক্রিমির প্যাকটা।
‘মাত্র দুটো আছে,’ বিড়বিড়িয়ে বললাম। ‘যথেষ্ট।
‘যথেষ্ট মানে?’ জবাব চাইল জিনা।
ওকে একটা ক্যারামেল ক্রিমি দিলাম।
‘ওটা মুখে পুরে চিবোতে থাকো,’ বললাম।’
মাথা নেড়ে দাঁত দেখাল আঙুল ইশারায়।
‘তুমি খালি ভুলে যাও। আমার ব্রেস!’
ও কী বলছে এসব?
‘জিনা, অযথা সময় নষ্ট কোরো না। খাও। দাঁতে লেগে যাবে ভাবছ? লাগুক, তাও তো ডাইনোসরের পেটে যাওয়ার চেয়ে ঢের ভাল।’
ও একদৃষ্টে চেয়ে রইল আমার দিকে, বোঝেনি।
আমি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলাম।
‘আধুনিক যুগের ক্যাণ্ডি একটা সময় সুড়ঙ্গ তৈরি করবে। আমি এখন পরিষ্কার বুঝতে পারছি। আমাদের ভেতরে-বাইরে এমন কিছু থাকতে হবে যা ভবিষ্যতের জিনিস! আমরা ইতিমধ্যে মডার্ন কাপড়চোপড় পরেছি। এখন মডার্ন ক্যাণ্ডি খেতে হবে। এবং এটা আমাদেরকে আমাদের সময়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।’
মেশিনটা এখন দস্তুরমত কাঁপছে, প্রচণ্ড গতিতে দুলছে সামনে- পেছনে।
‘তোমার কথাই যেন ঠিক হয়, বলল জিনা। হাতে ধরা ক্যাণ্ডিটার দিকে চেয়ে রইল।
‘খেয়ে নাও!’ টাইম মেশিনের ক্রমেই বেড়ে চলা শব্দ ছাপিয়ে চিৎকার করে বললাম ওর উদ্দেশে।
আমারটা এরমধ্যেই চিবোতে শুরু করেছি।
মুখ ভরে উঠল আঠাল মিষ্টিতে এবং আমার গলা বেয়ে নেমে যেতে লাগল সিরাপের মত।
এতে কি কাজ হবে? আমার ভাবনাটা কি আদতেই ঠিক?
পরনের পোশাক আর ক্যাণ্ডি কি সত্যিই আমাদেরকে সময়ের সামনের দিকে নিয়ে যাবে?
ক্যাপসুলটির দেয়ালগুলোর উদ্দেশে চাইলাম। চড়া গুঞ্জনধ্বনি তুলে কাঁপতে আরম্ভ করেছে সবকটা দেয়াল। এবার ওগুলো ঝাপসা হয়ে গিয়ে অদ্ভুত এক হলদে আভা ছড়িয়ে পড়ল আমাদের ওপরে।
‘জিনা, আমি আবছা হয়ে যাচ্ছি!’ চেঁচিয়ে উঠলাম।
জিনার দেহ নিরেটই রয়েছে। ও-ও আমার মতন ঝাপসা হচ্ছে না কেন?
টাইম মেশিনের দেয়ালগুলো মিলিয়ে যেতেই, দেখা গেল ক্যাপ্টেন টাইমের ক্রুদ্ধ মুখখানা।
‘কোন্ সাহসে তোমরা কন্ট্রোলগুলো রিভার্স করলে, অ্যাঁ!’ বাজখাঁই চিৎকার ছাড়ল সে।
আমার মাথার ভেতরে যেন বিস্ফোরিত হলো তার কণ্ঠস্বর।
সামনে হাত বাড়িয়ে জিনার বাহু চেপে ধরল লোকটা।
‘তুমি এখানে থাকছ, রাজকুমারী! আমার কাছে!’
ইঞ্চি-ইঞ্চি করে ক্যাপ্টেন টাইম ওকে টেনে বের করে নিচ্ছে ক্যাপসুল থেকে ফিরিয়ে নিচ্ছে নিজের সময়ে!
আমি ঝাপসা হচ্ছি, মিলিয়ে যাচ্ছি। জিনা আমার সঙ্গে মিলাচ্ছে না কেন?
এবার টের পেলাম সমস্যাটা কোথায়।
ক্যাণ্ডি। ক্যারামেল ক্রিমি। ও এখনও ওটা খায়নি।
‘ক্রিমিটা চিবাও!’ চিৎকার করে বললাম। নইলে চিরতরে পেছনে পড়ে থাকবে!’
‘দেরি হয়ে গেছে! হাহাকার করে উঠল জিনা। ‘অনেক দেরি হয়ে গেছে!’ ফোঁপাচ্ছে। এবার কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠল, ‘বিদায়, কিশোর! ভাল থেকো।
‘ক্যাণ্ডিটা!’ চেঁচালাম, অনুভব করলাম ওর কাছ থেকে অনেক দূরে চলে গেছি।
ক্যাণ্ডিটা ওকে মুখে পুরতে দেখলাম। জোরে কামড় দিল।
ওটা কামড়াতেই, ক্যাপ্টেন ক্রমেই ছোট হয়ে আসতে লাগল। আমরা তাকে পেছনে ফেলে দিয়েছি।
‘চিবাও!’ গর্জালাম। ‘চিবাতে থাকো!’
আমরা এখন সামনে ধেয়ে যাচ্ছি, মানুষজন আর শহর ভেদ করে, সময়ের বুক চিরে। আমার দেহের প্রতিটা কোষ শিহরিত হচ্ছে, পাশ দিয়ে যখন অস্পষ্ট মুখ, দালানবাড়ি আর অচেনা জায়গাগুলো ঝলসে পেরিয়ে যাচ্ছে।
গায়ের চামড়া যেন পুড়ে যাচ্ছে আমার।
‘চিবাতে থাকো!’ চিৎকার করে জিনাকে বললাম। ‘কাজ হবে! হতেই হবে।’
গলার কাছে উঠে এসেছে আমার হৃৎপিণ্ড। ঝলমলে বাতি আর বর্ণিল বিস্ফোরণ দেখছি চারপাশে। বাতাস ভেদ করে পড়ে যাচ্ছি আমি। শোঁ-শোঁ বাতাস তীব্র গতিতে পাশ কাটাচ্ছে, পতনের গতি যতই বাড়ছে আমার।
সহসাই দু’হাতের নিচে মসৃণ, ঠাণ্ডা ধাতবের স্পর্শ পেলাম। চোখ মেলে নিচের দিকে চাইলাম।
এক ধাতব বার আঁকড়ে রয়েছি।
ধাতব সেফটি বার।
আমি এখন দ্য বিস্ট-এ!
জিনা আর আমি এ মুহূর্তে সগর্জনে নেমে যাচ্ছি সেই শেষ পাহাড়টা বেয়ে। আমার পেছনে, অন্যান্য রাইডারদের তুমুল আর্তনাদ। বিনোদন পার্কটির উজ্জ্বল বাতিগুলো চমকাচ্ছে, মিটমিট করছে, ঘুরছে আমাকে ঘিরে।
আকাশটা বেগুনী রঙ ধরেছে। কমলা চাঁদটা অকাতরে আলো বিলাচ্ছে।
তবে আজ পূর্ণিমা নয়।
পেরেছি আমরা। নিজেদের জায়গায় আর সময়ে ফিরে এসেছি। ক্যাণ্ডি চিবোতে চিবোতে চোয়াল ব্যথা হয়ে গেছে আমার।
‘সাবাস, কিশোর!’ খুশিয়াল গলায় চিৎকার ছাড়ল জিনা।
দ্য বিস্ট মন্থর হয়ে খটখটিয়ে থেমে দাঁড়াল প্ল্যাটফর্মে।
বেরিয়ে এসে, হাঁটু গেড়ে বসে শীতল, অপরূপ সুন্দর কংক্রিটে চুমো খেলাম। কখনও আবার এটাকে দেখব ভাবিনি।
কিন্তু এখন বাজে কটা? কী বার আজ? আমরা তো বেশ কয়েকদিন লাপাত্তা ছিলাম
‘কিশোর, দেখো!’ তর্জনী দেখাল জিনা।
আতশবাজির ফোয়ারায় রীতিমত বিস্ফোরিত হয়েছে আকাশ, চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল কমলা, নীল, গোলাপী আর বেগুনী রঙের ছড়াছড়ি।
‘আজ বুধবারই আছে, কিশোর! আমরা যে দিন উধাও হয়েছিলাম!’
‘কীভাবে জানলে?’ প্রশ্ন করতেই, মস্ত বড় এক সাদা রকেট পাক খেয়ে শূন্যে ভেসে উঠল এবং রঙবেরঙের দ্যুতি ছড়িয়ে বিস্ফোরিত হলো।
‘মনে নেই তোমার? সেই আতশবাজি।’ খোশমেজাজে চিৎকার ছাড়ল জিনা। এজন্যেই তো আজ পার্কে এসেছিলাম আমরা। আতশবাজি দেখতে!’
মাথা ঝাঁকালাম, এখনও বিমূঢ় ভাবটা কাটেনি। এবার মনে পড়ল।
আজ রাতে আতশবাজির প্রদর্শনী হওয়ার কথা ছিল, পার্ক বন্ধ হওয়ার আধ ঘণ্টা আগে।
‘এর মানে বুঝতে পারছ, কিশোর?’ প্রশ্ন করল আমার বান্ধবী, ওর চোখের তারা নেচে উঠল।
‘না। কী?’ জিজ্ঞেস করলাম।
‘এর মানে আমরা আবারও দ্য বিস্ট-এ চড়তে পারব!’ পরমুহূর্তে, বাহু চেপে ধরে আমাকে টেনে নিয়ে চলল ও প্ল্যাটফর্মের দিকে।
‘চলো, আরেকবার!’
***