প্রাগৈতিহাসিক – ২০

বিশ

‘আমি চাই আপনারা নিজের চোখেই দেখুন আমি কতটা ব্রিলিয়ান্ট,’ অহঙ্কার ভরে বলল ক্যাপ্টেন টাইম। দেখে মনে হচ্ছে এক খেপা বিজ্ঞানী টাইম মেশিনের কন্ট্রোলে মহাব্যস্ত।

জিনা আর আমি লোকটার পেছনে দাঁড়িয়ে তার কাণ্ড-কারখানা দেখছি। দ্য বিস্ট-এর খোঁজে পার্কে ব্যর্থ তল্লাশী চালানোর পর তিন দিন পেরিয়ে গেছে।

ক্যাপ্টেন রেগে কাঁই হয়ে গিয়েছিল আমাদের ওপরে। তবে আবারও ক্ষমা করেছে। আজ সকালে দ্বিতীয় শো থেকে আমাদেরকে সরিয়ে নিয়েছে সে, ভবিষ্যৎ থেকে কীভাবে আরেকজনকে আমদানী করছে দেখাতে চায়।

খানিকটা উত্তেজনা অনুভব করছি আমি।

লোকটা হয়তো আমাদের চেনা কাউকে আনবে। তার কাছে হয়তো খাবার-দাবার থাকবে!

আমি ভয়ানক ক্ষুধার্ত। শুধু হট ডগ, কোকাকোলা, আইসক্রিম, পপকর্ন, ক্যাণ্ডি অ্যাপ্‌ এসবের কথা ভাবি।

এমনকী জিনাও এখন বুভুক্ষু হয়ে রয়েছে। গতরাতে, এতটাই ক্ষুধার্ত ছিলাম আমরা, বাচ্চা দর্শকদের ছোড়া মটরশুঁটিগুলো পর্যন্ত খেতে বাধ্য হয়েছি।

বেপরোয়া হয়ে গেছি আমরা! কিংবা তারচাইতেও বেশি কিছু। এমনই দুর্দশা আমাদের।

‘হ্যাঁ!’ মেশিনটা উজ্জ্বল লাল আভা ছড়িয়ে, থরথর করে কেঁপে উঠে দুলুনি শুরু করতেই বুনো উল্লাসে চিৎকার ছাড়ল ক্যাপ্টেন। ‘দেখা যাক ভবিষ্যৎ থেকে আসা আজকের সৌভাগ্যবান ব্যক্তিটি কে!’

ভয়ানকভাবে এপাশ-ওপাশ দুলছে ক্যাপসুলটা, মেঝেতে থপ- থপ আর ঘষা খাওয়ার শব্দ উঠেছে

‘ক্ব-কী হচ্ছে এটা?’ তুতলে বলে অস্বস্তির সঙ্গে পিছিয়ে যেতে.. লাগল জিনা।

সামনে-পেছনে সে কী তুমুল দুলুনি যন্ত্রটার, মেঝেতে সজোরে বাড়ি খাচ্ছে।

বিশাল এবং প্রচণ্ড শক্তিশালী কিছু একটা বেরিয়ে আসছে ওটার ভেতর থেকে।

‘সমস্যাটা কী?’ কোলাহল ছাপিয়ে গর্জন ছাড়লাম।

নার্ভাস দেখাচ্ছে ক্যাপ্টেন টাইমকে, গলা খাঁকরাল সে। ‘কোন সমস্যা নেই, আমি হলফ করে বলছি,’ ব্যাখ্যা দিল। ‘ভয় পেয়ো না, বাচ্চারা।’

প্রবল আলোড়নটা থামল। যন্ত্রটা এমুহূর্তে একদম নিথর-নিষ্কম্প।

আমরা তিনজন নীরবে চেয়ে অপেক্ষা করছি, কিন্তু কিছুই ঘটল না।

ক্যাপ্টেনকে দেখে মনে হলো হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে।

‘দেখলে তো? বলেছিলাম না, কোন সমস্যা নেই? এখন সরে দাঁড়াও।’

বড় করে হাত নাড়িয়ে আমাদেরকে পেছাতে বলল সে। অপর হাতটা বাড়িয়ে হ্যাচ খুলে দিল।

নিমেষে টাইম মেশিনের ভেতর থেকে লম্বা, কালো এক ঠোঁট বেরিয়ে এল।

ওটা ঝট করে ঘুরে গেল। পরমুহূর্তে, ক্যাপ্টেনের মাথার একপাশ কামড়ে ধরল। ঠোকরাল তার ললাটের পাশে। ক্যাপ্টেনের কপালে রক্তাক্ত এক ক্ষতচিহ্ন দেখলাম।

লোকটা টলমল পায়ে পিছু হটে দড়াম করে আছড়ে পড়ল মেঝেতে, নড়ছে না।

পিলে চমকানো চিল চিৎকার ছেড়ে মস্তবড় কালো এক সরীসৃপ মাথা তুলল টাইম মেশিনটা থেকে। চোয়ালজোড়া হাঁ হয়ে রয়েছে ওটার। দু’সারি ক্ষুরধার দাঁত দেখলাম।

দু’পাশে প্রকাণ্ড কালো থাবার আঁচড় কেটে বেরিয়ে আসতে প্রাণান্ত যুঝছে ওটা।

কালো চামড়ার বিশাল এক ডানা টেনে মুক্ত করল প্রাণীটা, এবার আরেকটা। দেখে মনে হচ্ছে ক্যাপসুলের অতিকায় ধাতব ডিম থেকে বুঝি ছানা ফুটছে।

ক’মুহূর্ত ক্যাপসুলের মাথায় বসে রইল ওটা, হতভম্ব ক্যাপ্টেনের দিকে চোখ নামিয়ে চেয়ে রয়েছে। এবার লম্বা ঠোঁটজোড়া খুলল কানে তালা লাগানো তীক্ষ্ণ শব্দ করে।

আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘জিনা, এটা টেরোড্যাকটিল!’

বিকটদর্শন প্রাণীটা জ্বলজ্বলে সবুজ চোখজোড়া ঘুরিয়ে আমাদের উদ্দেশে চাইল। আরেকটা রক্ত হিম করা ডাক ছেড়ে, ঢাউস কালো পাখা দুটো একবার ঝাপটাল।

এবার জোরাল কটাস শব্দে চোয়াল লাগিয়ে, লাফিয়ে নামল মেঝেতে। আমাদের দিকে তেড়ে আসছে গলা বাড়িয়ে।

‘পালাও, কিশোর!’ জিনা চিৎকার ছাড়ল গলা ফাটিয়ে।

আমি এক চুল নড়তে পারলাম না।

ও জোরে ঝাঁকুনি দিল আমাকে।

‘পালাও!’ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য দৌড়নোর আগে আমার কানে চিৎকার করে বলে গেল ও। ‘জান নিয়ে পালাও!’

কিন্তু আমার দশা নট নড়ন চড়ন নট কিচ্ছু।

ভীতিমাখা চোখে হিংস্র প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীটাকে ডানা ঝাপ্টে আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখছি। ধারাল দাঁতগুলো পরস্পর ঘষা খাচ্ছে ওটার।

একুশ

শেষ পর্যন্ত নড়তে পারলাম।

পিছিয়ে গেলাম, মরিয়ার মত চোখ দিয়ে খুঁজলাম আত্মরক্ষার জন্য যদি কিছু পাই।

এক কাঠের চেয়ার! তুললাম ওটা। মাথার ওপরে উঁচিয়ে ধরে-ছুঁড়ে মারলাম টেরোড্যাকটিলটাকে লক্ষ্য করে।

এক থাবায় ওটাকে লুফল প্রাণীটা। কৌতূহলী হলদে-সবুজ চোখে নিরীখ করল চেয়ারটাকে।

ওদিকে, আমি পরখ করছি ওটার শাণিত নখরগুলো। ওগুলো একেকটা বাঁকা, লম্বা ছোরার সমান।

সভয়ে ঢোক গিললাম। ওই তীক্ষ্ণ নখরগুলো গেঁথে যাচ্ছে আমার শরীরে ভাবতেই মুখ তেতো লাগল।

প্রাগৈতিহাসিক সরীসৃপটা কামড়ে কামড়ে ভাঙতে লাগল চেয়ারটাকে। দর্শকদের রক্ত পানি হলো মড়মড় শব্দে। চেয়ারটা একটু পরেই জ্বালানী কাঠের টুকরোয় পরিণত হলো। চেয়ারটা চিবানো শেষে, কাঠের বাদবাকি ছিলকাগুলো এক পাশে ছুঁড়ে দিয়ে আমার দিকে আবারও দৃষ্টি ফেরাল টেরোড্যাকটিলটা।

এসময় মেঝে থেকে মৃদু গোঙানীর শব্দ উঠল 1

মাথা চেপে ধরে উঠে বসেছে ক্যাপ্টেন। দানবটাকে দেখামাত্রই চাপা আর্তনাদ ছাড়ল সে।

‘না!’

টেরোড্যাকটিলটা বাতাসে ভেসে উঠলে মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল আমার। জোরে জোরে ঝাপ্টা খাচ্ছে ওটার চামড়ার ডানা দুটো, ঠাণ্ডা, চিমসে গন্ধ দমকা বাতাসের সঙ্গে ভক করে নাকে এসে লাগল আমার।

শূন্যে ভাসছে ওটা, হাওয়া দিচ্ছে আমাকে। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ভয়ঙ্কর মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করছি আমি।

কিন্তু ওটার সবুজ চোখজোড়া আমার নয়, ক্যাপ্টেনের ওপর স্থির। ক্ষুধার্ত চাউনি সে চোখে।

পলকে দানবটা সাঁ করে নেমে আসতেই ভয়ার্ত চিৎকার ছাড়ল ক্যাপ্টেন। ওটা ক্ষুরধার নখরে গেঁথে বেচারাকে তুলে নিল শূন্যে।

‘বাঁচাও!’ আর্তনাদ করে উঠল ক্যাপ্টেন, পাজোড়া ছুঁড়ছে, বাহু দুটো আছড়াচ্ছে বাতাসে। ‘বাঁচাও-প্লিজ!’

জিনা লাফিয়ে উঠে, মেঝে থেকে দু’ফিট ওপরে ভাসমান অসহায় ক্যাপ্টেনের লাথি-ছোঁড়া পায়ের একটা চেপে ধরার চেষ্টা করল।

আমিও লাফালাম। ক্যাপ্টেনের এক পাটী জুতো চেপে ধরতে পারলাম আমি। জিনা আঁকড়ে ধরল আমাকে। দু’জন মিলে ঝুলে থেকে ক্যাপ্টেনকে মাটিতে টেনে নামানোর প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলাম।

মাথার ওপরে দানবীয় সরীসৃপটা চামড়ার প্রকাণ্ড ডানাজোড়া ঝাপ্টাচ্ছে, তার ফলে ধুলোর ঝড় উঠছে মেঝে থেকে, হুশ-হুশ শব্দ হচ্ছে। আমরা তিনজন যেন দড়ি টানাটানি খেলছি।

এবং হতভাগ্য ক্যাপ্টেন হচ্ছে সেই রশি।

শেষ অবধি, সবাই মিলে দলামোচা পাকিয়ে পড়ে গেলাম মেঝেতে, এবং আমাদের ওপর ধপাস করে পড়ল ক্যাপ্টেন টাইম।

‘ধন্যবাদ,’ শ্বাসের ফাঁকে আওড়াল সে। ‘তোমাদের দু’জনকেই ধন্যবাদ!’

কিন্তু আমাদের বিপদ এখনও কাটেনি।

তীক্ষ্ণ ডাক ছেড়ে জীবটা চক্কর দিচ্ছে আমাদের মাথার ওপরে। শোঁ করে নেমে এসে কাকে আবার ছোঁ মেরে তুলে নেবে আল্লা মালুম।

‘এসো!’ গর্জে উঠে, এক টানে দাঁড় করালাম জিনাকে। ‘লুকোই!’

‘এদিকে!’ ক্যাপ্টেন চেঁচিয়ে উঠল, উঠে দাঁড়াল হাঁচড়েপাঁচড়ে।

ক্যাপ্টেন আমাদেরকে পেছনে নিয়ে দৌড়ে সরে গেল টাইম মেশিনটার কাছ থেকে, ঘরগুলোর দিকে চলেছে, হিংস্র প্রাণীটার কবল থেকে ছুটে পালাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। তবে তার দৌড়ের গতি এতই বেশি, নাগাল ধরতে বেগ পেতে হলো আমাদের।

ওদিকে দানব উড়ন্ত সরীসৃপটা প্রায় ধরে ফেলছে

ধরে আমাদেরকে। ওটার দীর্ঘ, ভারী আর শীতল ছায়া আমাদের গ্রাস করছে টের পাচ্ছি।

ওটা শিকারি পাখির মত সাঁ করে নিচে নেমে আসতেই মাথার ওপরে কালো ছায়াটা দীর্ঘতর হলো। জান উড়ে গেল ভয়ে।

পাকা মেঝেতে ধুপধাপ শব্দ তুলছে আমাদের পায়ের পাতা। অলিম্পিকে একশো মিটার স্প্রিন্ট দিচ্ছি মনে হলো। কিন্তু আচমকা পায়ের তলা থেকে সরে গেল মেঝে। শূন্যে পাজোড়া ছুঁড়ছি আমি।

পরক্ষণে, ডানাধারী দানবটা দু’থাবায় বিধিয়ে নিল আমাদের দু’জনকে।

আমাদের সুটের কাপড়ে গেঁথে গেছে ওটার লম্বা, ধারাল নখরগুলো।

ওটা শূন্যে, উঁচু থেকে আরও উঁচুতে তুলে ফেলল আমাদেরকে, একজোড়া অসহায় ইঁদুরছানার মতন।

বাইশ

জিনা আর আমি শরীর মুচড়ে হাত-পা ছুঁড়ছি, টেরোড্যাকটিলটা যখন আমাদেরকে উঁচু ছাদের কাছে বয়ে নিয়ে গেল।

আগু-পিছু করে উড়ছে ওটা। কী যেন খুঁজছে মনে হলো।

নিজের বাসা?

কিংবা হয়তো কোন বিশাল পর্বত, আমাদেরকে যেখানে নামিয়ে ধারাল ঠোঁট দিয়ে ছিঁড়ে খুঁড়ে খাবে।

প্রাণীটা শোঁ করে মেঝের দিকে নেমে না আসা তক অপেক্ষা করলাম। এবার হাত বাড়িয়ে ওটার নখর থেকে মুক্ত করলাম জিনার রুপোলী সুট।

দীর্ঘ আর্তনাদ ছেড়ে ওকে মেঝেতে খসে পড়তে দেখলাম।

এবার একই কাজ করলাম আমিও, ডানাধারী বিভীষিকাটার থাবা থেকে নিজেকে ছাড়াতে বেকায়দা ভঙ্গিতে পেছনে হাত নিয়ে গেলাম।

একটু পরেই, কাপড় ছেঁড়ার ফড়ফড় শব্দ পেলাম। এবার দড়াম করে আছড়ে পড়লাম মেঝেতে।

শ্বাস নিতে হাঁসফাঁস করছি। বুক থেকে বেরিয়ে গেছে সবটুকু বাতাস।

এসময় অপার্থিব কর্কশ এক চিৎকার বাতাস চিরে দিল। ত্রস্ত চোখে ঝট করে চাইলাম ছাদের দিকে।

সরীসৃপটা ছাদের কাছে প্রকাণ্ড এক কালো শকুনের মত পাক খাচ্ছে, অপেক্ষায় রয়েছে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।

এবার ঘুরে-ঘুরে নেমে আসতে লাগল করালদর্শন জীবটা, বিশাল, প্রাণঘাতী কোন সাঁড়াশির মত কট-কট করে খুলছে আর বন্ধ করছে ঠোঁট।

জিনা আর আমি জড়সড় হয়ে রইলাম ওটার ছায়াতলে।

লোভীর মত আমাদেরকে সরু, সবুজ চোখে জরিপ করছে মূর্তিমান আতঙ্ক। অপেক্ষা করছে যেন মোক্ষম মুহূর্তটির।

দ্রুতলয়ে ঠোঁট খুলছে আর বন্ধ করছে প্রাগৈতিহাসিক সরীসৃপ, শব্দটা ভয়ে অসাড় করে দিচ্ছে আমাদেরকে।

জিনা মুখে হাত চাপা দিল।

পেটের ভেতর মোচড় মারল আমার। বুক ঢিবঢিব করছে।

বিকটদর্শন সরীসৃপটার শ্বাসে মাংস পচা দুর্গন্ধ।

দু’হাতে মাথা চেপে ধরে আত্মরক্ষার দুর্বল চেষ্টা করলাম। জানি এটা অর্থহীন।

সাক্ষাৎ শয়তানটা সাঁ করে নেমে এল নিচে, আমাদেরকে জ্যান্ত ঠুকরে খুবলে খেতে হামলে পড়বে এখুনি।

তেইশ

এবার বিশালদেহী উড়ন্ত সরীসৃপটা আতঙ্কিত চিৎকার ছাড়ল।

প্রাণপণ যুঝছে, তবুও সাঁই-সাঁই করে উড়ে গেল পেছনদিকে। অবাক নয়নে দেখলাম টাইম মেশিনের দিকে টেনে নেয়া হচ্ছে দানবটাকে। ডানা ঝটপটাচ্ছে, কানে তালা লাগানো চিৎকার করছে। কিন্তু নিরুপায় দেখাল ওটাকে।

ক্যাপসুলের দরজা খুলে গেল হাট হয়ে।

দানবটা যথাসাধ্য লড়ল, কিন্তু মেশিনটা গিলে নিল ওটাকে। খোলা হ্যাচের কিনারায় আঁচড় কাটল ওটার ধারাল নখরগুলো।

পাগলের মত ডানা ঝাপ্টাচ্ছে, সময়ের শক্তির বিরুদ্ধে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়ছে।

কিন্তু ওটা আসলে হেরে যাওয়া সংগ্রাম করছে। সরীসৃপটার শরীর খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে গেল এবং মেশিনটা শুষে নিল ওগুলো।

বাঁ পাখাটা ছিঁড়ে, খসে অদৃশ্য হয়ে গেল, ওটাকে ভেতরে টেনে নিল টাইম মেশিন।

জিনা চিৎকার ছেড়ে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল।

আমি দম বন্ধ করে, অবাক বিস্ময়ে দেখে যাচ্ছি।

ক’মুহূর্তের মধ্যেই হিংস্র টেরোড্যাকটিলটা উধাও হলো, ছিঁড়ে টুকরো-টুকরো হয়ে। সময়চক্র গিলে নিয়েছে ওটাকে।

দৌড়ে গেলাম যন্ত্রটার কাছে, সারা শরীর কাঁপছে থরথরিয়ে।

জিনা আর আমি মিনিটখানেক অপেক্ষা করলাম, তারপর আমি উঁকি দিলাম মেশিনটার ভেতরে। ফাঁকা।

যন্ত্রটা থেকে ক্ষীণ ধোঁয়া বেরোচ্ছে। মুরগির রোস্টের মত গন্ধ বাতাসে।

এসময় ক্যাপ্টেন টাইম উদয় হলো, রীতিমত হতবিহ্বল আর ঘোরগ্রস্ত। টলতে টলতে টাইম মেশিনটার কাছে গিয়ে পরীক্ষা করতে লাগল ওটা।

‘আমরা আপনার জান বাঁচিয়েছি,’ জিনা বলল তাকে, তার আস্তিন ধরে টানল। ‘এবার আমাদেরকে বাড়ি পাঠিয়ে দিন।’

লোকটা স্রেফ উপেক্ষা করল ওকে।

‘হ্যাঁ, আমাদের ফিরিয়ে দিন!’ জোর দাবি জানালাম।

শেষমেশ পিছিয়ে এসে মাথা চুলকাল লোকটা।

‘সম্ভব নয়, মৃদুকণ্ঠে বলল। ‘যন্ত্রটা ভেঙে গেছে। তোমরা এখানে আটকা পড়েছ চিরদিনের জন্য।’

চব্বিশ

অনেক পরে, সে রাতে রাজকুমারীর ছোট্ট কামরাটির ধুলোময় কৌচে তখন শুয়ে আমি।

খাবার হজম করার চেষ্টা করছি। রীতিমত কঠিন হচ্ছে কাজটা।

আজই প্রথম ডিনারে আমার প্লেট সাফ করেছি।

টেরোড্যাকটিলের ধাওয়া খেলে যে কারও খিদে পাওয়াই তো স্বাভাবিক, তাই না?’

‘কী করব এখন আমরা?’ জিনা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল। ‘পালাব কীভাবে?’

জবাবটা দেয়ার আগেই, এক চিলতে ঘরটার ঠিক বাইরে একাধিক কণ্ঠস্বর শুনলাম।

কৌচ ছেড়ে উঠে পড়ে, পা টিপে টিপে দরজার কাছে গেলাম। শ্বাস চেপে আড়ি পাতলাম।

‘বাচ্চাগুলোকে খসিয়ে ফেলতে হবে, ক্যাপ্টেন,’ এক পুরুষকণ্ঠ বলছে।

‘সে আমি জানি না ভেবেছেন?’ উত্তর দিল ক্যাপ্টেন।

‘কী করবেন, কীভাবে করবেন জানি না, তবে কাজটা সেরে ফেলুন। কর্তৃপক্ষ কিন্তু আজ এখানে এসেছিল।’

‘কর্তৃপক্ষ?’ ক্যাপ্টেন জবাব চাইল।

‘ন্যাকা সাজবেন না। শিশুশ্রমের লোকজন। আজ তারা কার্নিভালে এসে ছোঁক ছোঁক করছিল, অনেক প্রশ্ন করেছে। ওই যে ছোঁড়া-ছুঁড়ি দুটো সেদিন পালিয়েছিল না? মেলার মাঠে ইচ্ছেমত দাপিয়ে বেড়িয়েছে ওরা, সবার নজর কেড়েছে।

‘অমন আর ঘটবে না,’ বলল ক্যাপ্টেন।

‘ঠিক। অমন আর ঘটবে না, কারণ আপনি ওদেরকে সরিয়ে দেবেন।’

‘কীভাবে?’ ক্যাপ্টেনের প্রশ্ন।

‘যা করতে হয় করুন। আপনি না মহাপ্রতিভাধর বিজ্ঞানী?! স্রেফ এটা নিশ্চিত করুন ওদের কাউকে যেন কাল থেকে আর এখানে দেখা না যায়।’