এক
কাঠের ট্র্যাকে খটখটিয়ে থেমে গেল গাড়িটা। ফোঁস করে তৃপ্তির দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম আমি।
এবার পাশ ফিরে চাইলাম জিনার দিকে। ক’দিনের জন্য আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছে ও। মেরি চাচী ডেকেছে।
‘কী, বলেছিলাম না তোমাকে?’ ব্যাঙের ডাক বেরোল গলা দিয়ে।
শেষ চার মিনিট একটানা চিৎকার-চেঁচামেচি আর হাসাহাসি করে গলাটা গেছে আমার।
খুশির হাসি হেসে, সেফটি বার থেকে হাত সরাল জিনা।
‘ঠিকই বলেছিলে, কিশোর। দুর্দান্ত লেগেছে আমার!’ চেঁচিয়ে উঠল ও।
রকি বিচ ফ্যান্টাসি আইল্যাণ্ডে একসঙ্গে প্রায় এক বছর পর এলাম দু’জনে। অবশ্য দ্রুতই অভাবটুকু পুষিয়ে নিচ্ছি আমরা। এরমধ্যেই তিনবার দ্য বিস্ট-এ চড়া হয়ে গেছে আমাদের। মুসা আর রবিনকে খুব মিস করছি। মুসার বাসায় মেহমান এসেছে আর রবিন শহরে নেই।
তৃতীয়বার রাইডটা একটু অন্যরকমভাবে উপভোগ করেছি আমরা। সবচেয়ে খাড়া পাহাড়টা থেকে সাঁ সাঁ করে নামার সময় চোখ বুজে রেখেছিলাম।
শুনতে সোজা মনে হলেও আসলে মোটেই তা নয়। চোখ বোজা, ওদিকে ট্র্যাক ধরে তীব্র গতিতে নেমে যাচ্ছে বগিটা, মনে হবে এই বুঝি দুনিয়াটা পায়ের তলা থেকে সরে গেল। বাতাস ভেদ করে পড়ে যাচ্ছ তুমি। একটানা স্রেফ পড়েই চলেছ অতলে।
হেসে আঙুল দেখালাম জিনার মাথার দিকে। খাড়া হয়ে আছে চুলগুলো। কোন কার্টুন ছবির চরিত্র বারবার উঁচু কোন পাহাড় থেকে ইচ্ছেমত লাফিয়ে পড়লে যেমনটা দেখায় আরকী।
হেসে উঠে, হাত বুলিয়ে চুল সমান করল জিনা। এটা দ্য বিস্ট-এর কীর্তি। চুল খাড়া করে দিয়েছে। ভেতরটাও নাড়িয়ে দিয়েছে।
ওটা সবচেয়ে দীর্ঘ আর ভীতিকর কাঠের কোস্টার
গাড়িটা থেকে নামলাম আমরা। কংক্রিটের প্ল্যাটফর্মে পা রাখতেই কেমন রবারের মতন অনুভূতি হলো ও দুটোয়। এক্সিট র্যাম্পের দিকে ঝিম ধরা মাথা নিয়ে টলতে টলতে চলেছে যাত্রীরা, বলাবলি করছে রাইডটা কী চমৎকার ছিল।
আমিও এগোচ্ছি, হঠাৎই জিনা গটগটিয়ে হেঁটে গেল আমার সামনে দিয়ে।
‘কিশোর, চলো, আবার চড়ি।’ এবার পিছিয়ে এসে বলল। চোখজোড়া চকচক করছে।
র্যাম্পে ঘুরে দাঁড়িয়ে অতিকায় রোলার কোস্টারটার দিকে চোখ তুলে চাইলাম। রাতের বেগুনী আকাশের পটভূমিতে প্রকাণ্ড আর কালচে দেখাচ্ছে যন্ত্রটাকে।
কাঠের বিশাল ভারাটি থেকে একাধিক ফ্লাডলাইট আলো বিলাচ্ছে নিচে। কোস্টারটার ঘুরপাক খাওয়া, নেমে আসা, ঝাঁপানো, অনেক উঁচুতে উঠে যাওয়া সব ধরনের ভঙ্গিই চোখে পড়ছে আবছাভাবে।
রোমাঞ্চ অনুভব করলাম।
লোকে বলে রাতে নাকি দ্য বিস্ট-এ ভূতে হানা দেয়।
সন্দেহ নেই, মানুষ ভয় পেতে ভালবাসে বলেই এসব কথা রটিয়েছে।
তবে মনের গভীরে, লোকে আদপেই বিশ্বাস করে না সত্যিই ভূত বলে কিছু আছে। ওটা নিছকই বানোয়াট গল্প, তাই না?
যাকগে, জিনা আজ উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে। কোস্টারটায় আবারও চাপতে এক পায়ে খাড়া। তর সইছে না ওর।
‘রাত হয়ে যাচ্ছে…’ ওকে বললাম
‘এমন কোরো না, কিশোর।’ সজোরে আমার পিঠে চাপড় দিল ও।
ব্যথায় চোখ-মুখ কুঁচকে ফেললাম।
‘আমি ক্লান্ত,’ অভিযোগ করলাম। হাতঘড়ি দেখে নিলাম এক পলকে। ‘পার্ক কিন্তু বন্ধ হয়ে যাবে একটু পরেই।
‘এসো তো,’ মধুর সুরে ডাকল ও। আরেকবার চড়লে এমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। ব্যাপারটা কী? পূর্ণিমা দেখে ভয় পাচ্ছ নাকি?’
শ্রাগ করে চোখ তুলে চাইলাম। কমলারঙা পেল্লায় চাঁদটা এখনও পুরো গোলগাল হয়ে ওঠেনি।
দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
‘আচ্ছা, আর একবার।’ একটা আঙুল তুলে দেখালাম।
‘গুড বয়!’ খুশি হয়ে উঠল জিনা।
‘কিন্তু তার আগে,’ বললাম, ‘স্ন্যাক বারে যেতে হবে আমাকে। জ্বালানী দরকার।
‘যাও, তবে দেরি কোরো না। ওরা কিন্তু লোক তুলছে।’
লাইনের শেষ প্রান্তে প্রায় ছুটে গেল জিনা, পায়ের চকচকে গোলাপী ব্লগজোড়ায় খটাখট শব্দ তুলে।
আমি তড়িঘড়ি চললাম স্ন্যাক বার অভিমুখে। সৌভাগ্য, আমার সামনে লাইনে মাত্র একজন। দুর্ভাগ্য, সে খুবই ধীর গতিতে এগোচ্ছে, বিন্দুমাত্র তাড়া নেই তার।
ছেলেটির টি-শার্টের পেছনের সবুজ ডে-গ্লো ব্রন্টোসরাসটার দিকে চেয়ে রয়েছি, ওর পিঠ পুড়িয়ে দুটো ফুটো করতে চাইলাম, ও যাতে চটজলদি কাজটা সেরে ফেলে। একটা স্ন্যাক কিনতে মানুষের এত সময় লাগে?
চকিতে পিছু ফিরে চাইলাম। কোস্টারে ঢোকার সারিটা নড়তে আরম্ভ করেছে।
জিনা ওর কাঠের তলীওয়ালা জুতো ঠুকে হাত নেড়ে ডাকল আমাকে। ওর ঠোঁটের ভাষা পড়তে পারলাম।
জলদি এসো!
অসহায়ের মত শ্রাগ করলাম। ক্যারামেল ক্রিমিয় না নিয়ে দ্য বিস্টে উঠব না।
এবারের গরমে ক্যারামেল ক্রিমিয় আমার সবচাইতে পছন্দের ক্যাণ্ডি। গত সামারে মার্শম্যালো বস্ খেয়েছি ইচ্ছে মত। কিন্তু কে জানে কেন, কোম্পানি হঠাৎই ওটার উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে।
তাই এবার আমার পছন্দ ক্যারামেল ক্রিমিয়। খুবসে সাঁটাচ্ছি। ঠিক যেমনটা বিজ্ঞাপনে বলে, ‘ক্রিমি দাও, নইলে ভিরমি খাব।’
আমার সামনের ব্রণ্টো-বয় সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না ম্যাঙ্গো- ম্যাঙ্গো মাঞ্চ্যি নাকি ফুটি-টুট-টুট নেবে। আমার অবশ্য ম্যাঙ্গো- ম্যাঙ্গো মাঞ্চিয়টাই বেশি প্রিয়। স্বাদটা জিভে লেগে থাকে ফ্রুটির প্রায় দ্বিগুণ সময়।
আমার পেছনে এসে যোগ দিল দুটো মেয়ে। লম্বা মেয়েটির মাথায় দীর্ঘ, বাদামী বিনুনি। অন্যজন খাট, মাথায় পাঙ্কমার্কা লাল চুল। আমার চেয়ে বয়সে খানিকটা বড় ওরা, পরনে লাল চেককাটা শর্টস আর অবিকল একরকম ছোট, সাদা টি-শার্ট। স্নিকার্স আর মোজাও হুবহু এক।
বান্ধবীরা কখনও সখনও একই ধরনের সাজপোশাক পরতে ভালবাসে। কিন্তু কেন? মনে করে লোকে তাদের যমজ ভাববে? ধ্যাত, এ দু’জনকে তো দূর সম্পর্কের জ্ঞাতিবোনও মনে হচ্ছে না।
‘সামান্থা, চল, অত ভয় পাস না,’ বান্ধবীকে বলল খাটজন। ‘ভয়ের কিছু নেই।’
‘আছে,’ সামান্থা জোর গলায় বলল।
সামান্থা ঘুরে দাঁড়িয়ে চোখ দিয়ে দ্য বিস্টকে মাপল। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখান থেকে ওটা প্রায় ঢাকা পড়েছে পুরু, কালো কাঠের আড়ালে
শব্দ যদিও পাওয়া যাচ্ছে-কাঠের ট্র্যাকে চাকার ঘর-ঘর, আর বগিতে বসা লোকজনের চিল চিৎকার। আর্তচিৎকারটা একইসঙ্গে ওঠা-নামা করছে, তীক্ষ্ণ এক সম্মিলিত আর্তনাদের মতন।
আওয়াজটা অদ্ভুত।
এজন্যই বোধহয় কেউ-কেউ এটাকে আর্তনাদের যন্ত্র বলে।
বেঁটে মেয়েটি চিবুক ঝাঁকাল আমার উদ্দেশে
‘ওকেই জিজ্ঞেস কর না। ও তো এইমাত্র কোস্টারটা থেকে নামল।’
‘তাই?’ সামান্থা ঘুরে এমনভাবে আমার দিকে চাইল, আমি যেন এখুনি মঙ্গলগ্রহ থেকে ফিরেছি।
সামান্য মাথা ঝাঁকালাম।
‘সবাই যেমন বলে ওটা কি আসলেই সেরকম ভয়ঙ্কর?’ সামান্থার ব্যগ্র প্রশ্ন।
ভেবে দেখার ভান করলাম।
‘হ্যাঁ, ভয়ানক এক কোস্টার ওটা,’ জানালাম।
সামান্থার চোখজোড়া আরও বড়-বড় হয়ে গেল, এবং ও বান্ধবীকে কনুইয়ের আলতো গুঁতো দিল।
‘দেখলি? তোকে বলেছিলাম না? আমি, বাবা, কিছুতেই ওটায় চড়ছি না।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুঃখের হাসি হাসলাম।
‘ভয় পেতে না চাইলে এখানে এসে লাভ কী? ওটার মজাও তো কম নয়!’
এবার সামান্থা আর তার বান্ধবীর দিক থেকে ঘুরে দাঁড়ালাম। ধীরগতি ব্রণ্টো-বয় তখনও কাজ সারতে পারেনি। ওদিকে, জিনা তুমুল হাতছানি দিয়ে চলেছে আমাকে। সারিটা ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে কিনা গেটের কাছে।
শেষমেশ ছেলেটার কাঁধে টোকা দিতে বাধ্য হলাম।
‘ম্যাঙ্গো-ম্যাঙ্গো মাঞ্চিয় নাও,’ বললাম ওকে। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে আমার।
ছেলেটা উল্টো ঘুরল, অনিশ্চিত ভঙ্গিতে ঠোঁট কামড়াচ্ছে। কটন ক্যাণ্ডি মেখে আঠাল আর গোলাপী হয়ে আছে ওর গালজোড়া।
‘সত্যি বলছ?’ জিজ্ঞেস করল।
‘একদম, জোর গলায় বললাম।
আমার ধারণা হলো ছেলেটা বিশেষজ্ঞ চেনে, কারণ ফ্রুটি-টুট- টুটস্ রেখে মাঞ্চির জন্য টাকা দিল ও। সঙ্গে আরও পাঁচটা ক্যাণ্ডি।
মনে হলো কাজটা কি ঠিক করলাম?
এবার ক্যাণ্ডির সারিতে অতিচেনা গোলাপী-বেগুনী রোলগুলো খুঁজতে লাগলাম। মাথায় ঘুরছে টিভির বিজ্ঞাপনের সেই জিঙ্গল: ‘ক্রিমি দাও, নইলে ভিরমি খাব!’
‘পেয়েছি!’ রোলটা ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে কাউন্টারে বসা মহিলার উদ্দেশে টাকাটা ছুঁড়ে দিলাম প্রায়।
তারপর দৌড়ে ফিরে এসে লাইনের শেষ প্রান্তে দাঁড়ালাম। গেটগুলো দিয়ে তখন ঢুকে গেছে বেশির ভাগ মানুষ।
ব্যস্তসমস্ত হয়ে র্যাম্প ধরে প্ল্যাটফর্মে উঠে এলাম, বগিগুলোতে জিনাকে খুঁজছি।
ওকে যখন দেখলাম, থমকে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ে শ্বাস চাপলাম।
এ কী! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না।
দুই
আশ্চর্য! প্রথম বগিটার প্রথম আসনটিতে বসে রয়েছে জিনা।
হাসছে, আনন্দে আটখানা।
সবাই ওই সিটগুলোতে বসতে চায়।
মানে, ওগুলোই সবার সেরা। ওখানে বসলে প্রতিটা বাঁক আর মোচড়, ওঠা-নামা ভালভাবে অনুভব করা যায়। সোজা কথা, তোমার আর নিখাদ আতঙ্কের মাঝে আর কোন কিছুর অস্তিত্ব থাকে না।
কিন্তু জিনা তো ছিল সারির শেষ দিকে। রাইডের সেরা সিটগুলো ও বাগাল কীভাবে?
‘সাবাস, জিনা,’ অভিনন্দন জানালাম।
চোখের তারা নেচে উঠল ওর।
‘যারা এখানে বসেছিল তারা শেষ মুহূর্তে সরে পড়েছে,’ ব্যাখ্যা করল ও। পাশের সিটটা চাপড়াল।
মাথা ঝাঁকালাম, রীতিমত মুগ্ধ।
‘বিশেষ করে,’ দম্ভের সঙ্গে আরও বলল ও, ‘যেই না বলেছি প্রথম বগিটা ভুতুড়ে।’
শিউরে উঠলাম।
‘কথাটা তো সত্যি, ঠিক না?’ বলল ও।
জবাব দিলাম না। তার বদলে, সেফটি বার দড়াম করে নেমে আসার আগেই এক লাফে ভেতরে ঢুকে পড়লাম।
‘এত দেরি করলে কেন?’ আমি জুত করে বসতেই জিজ্ঞেস করল ও। ‘ভেবেছিলাম আমার একাই বুঝি চড়তে হবে।’
জড়ানো গলায় উত্তর দিলাম।
আমার উদ্দেশে ঝুঁকল ও।
‘কী বললে?’ প্রশ্ন করল।
আঠাল ক্যারামেলে দাঁতে দাঁত লেগে অস্পষ্ট কথা বেরোচ্ছে মুখ দিয়ে। ঢোক গিললাম।
‘সে লম্বা কাহিনী,’ আবারও বললাম, এবার আরেকটা ক্রিমি মুখে চালান করে চিবোতে লাগলাম।
অবিশ্বাস্য রকমের আঠাল মিষ্টিটুকু আমার মুখ ভরিয়ে তুলল এবং গলা দিয়ে হড়কে নামল সিরাপের মত।
একেবারে চিনির স্বর্গ।
আহা, কী স্বাদ!
‘নেবে একটা?’ রোলটা বাড়িয়ে ধরলাম জিনার দিকে।
মাথা নেড়ে মুখ ভর্তি ব্রেসের ঝলক দেখিয়ে দিল ও। এখন আর স্রেফ ধাতব নয়, রঙবেরঙের নতুন ব্রেস এসেছে বাজারে।
ওরগুলো গোলাপী আর বেগুনী।
‘তুমি যে এখন ব্রেস পরো মনেই থাকে না,’ বললাম।
চোখ ঘোরাল জিনা।
ভোলো কীভাবে জানি না, আমি তো পারি না। ক্যাণ্ডি, আপেল, পপকর্ন কিংবা পছন্দের কোন কিছুই খাওয়া যায় না। অসহ্য!’
ব্রেস নিয়ে বেজায় অসন্তুষ্ট জিনা। ওগুলো যদিও সুদৃশ্য, নতুন ডিজাইনের। আমার মনে হয় ওর অস্বস্তি লাগে। সাবধান থাকতে হয় হাসতে গিয়ে যেন দাঁত বেরিয়ে না পড়ে।
আমি অবশ্য বলি ব্রেস সত্ত্বেও ওকে সুন্দর লাগে, ও বিশ্বাস করে না যদিও।
আমার ব্রেস পরতে হয় না, এমনকী দাঁতে কোন সমস্যাও নেই।
চাচী তো বলে এটা নাকি ছোটখাট এক অলৌকিক ঘটনা, কারণ আমি যে পরিমাণ ক্যাণ্ডি খাই! নিজেকে ভাগ্যবান ছাড়া আর কী বলব!
এখনও সুযোগ আছে যেহেতু, আরেকটা ক্যারামেল ক্রিমি মুখে পুরলাম এবং রোলটা গুঁজলাম আমার জিন শর্টসের পকেটে।
বগিটা সামনের দিকে নড়তে শুরু করতেই আলতো এক টান অনুভব করলাম।
এইবার!’ পেছনের বগির লালচুলো মেয়েটি তার বয়ফ্রেণ্ডের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বলল। তরুণ ছেলেটা অস্ফুটে গুঙিয়ে উঠল।
গাড়িটা গতি বাড়াতেই পরস্পর চোখাচোখি করে হাসলাম জিনা আর আমি। হেডরেস্টে ঠুকে গেল আমাদের মাথা, তিনটে পাহাড়ের মধ্যে প্রথম আর সবচাইতে খাড়াটায় যেই উঠতে লাগলাম আমরা। কাঠের মঞ্চে ক্যাঁচকোঁচ শব্দ তুলে ক্রমেই উঁচু থেকে উঁচুতে উঠছি।
ট্র্যাক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে চকিতে জিনার উদ্দেশে চাইলাম। পাহাড়চূড়ার দিকে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রয়েছে ও। মনে হচ্ছে যেন মহাশূন্যে উঠে যাচ্ছি। গাড়িটা এবার গতি কমিয়ে নিথর হয়ে গেল।
পাহাড়শীর্ষে দমবদ্ধ একটি মুহূর্তের জন্য টলে উঠলাম আমরা।
অনেক, অনেক নিচে কালচে গাছগাছালির মাথা নাচছে। ঠাণ্ডা বাতাস আমাদের মাথার চুলে আর জামাকাপড়ে পরশ বোলাতেই, আচমকা স্বৰ্গীয় সুখ পেলাম। এবার সাঁ সাঁ করে নেমে যাওয়ার পালা।
‘হুপ!’
নামার সময় খটখটিয়ে উঠল গাড়িটা।
জিনা বাহুজোড়া শূন্যে ছুঁড়ল, এবার মুখ হাঁ করে তীক্ষ্ণ চিৎকার দিল।
ক্রমেই আমরা নিচে, গাছপালার ঘূর্ণি অরণ্যের উদ্দেশে নেমে আসছি।
তালগোল পাকানো আলো-ছায়ার ভেতর দিয়ে ছিটকে গেলাম আমরা, কানে আসছে ভয়ার্ত চিৎকার-চেঁচামেচি।
বারটা আঁকড়ে ধরলাম আমি, দু’বাহু আড়ষ্ট, গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছি।
যতবারই এই কোস্টারটায় উঠি; নিজেকে বলি এবার আর আর্তচিৎকার ছাড়ব না।
কিন্তু প্রথম পাহাড়টার মাঝামাঝি নামতে না নামতেই প্রতিবারই উপলব্ধি করি, আর্তনাদই হচ্ছে এ রাইডটির প্রাণ। অগত্যা, চিৎকার না করে পারি না। আর ব্যাপারটা ভয়ানক উপভোগও করি।
এমুহূর্তে ঘুরপাক খেয়ে এক পাতাল সুড়ঙ্গে ঢুকলাম আমরা, নিশ্ছিদ্র আঁধার পুরোপুরি গিলে নিল আমাদেরকে।
‘উ-উ!’ জিনার তীক্ষ্ণ চিৎকার কানে এল।
এবার তেমনি আচমকাই আবার বেরিয়ে এলাম সুড়ঙ্গ থেকে, তীক্ষ্ণ এক বাঁক ঘিরে পাক খেলাম। আমার বাহু চেপে ধরল জিনা।
‘উফ!’
আমার চোখে উড়ে এসে পড়ল ওর চুল, রীতিমত অন্ধ করে দিল আমাকে। চোখ থেকে চুল সরাচ্ছি, আচমকা উল্টোদিকে ছুটলাম আমরা।
হাসছে, চেঁচাচ্ছে প্রাণ খুলে, জিনা রীতিমত গর্জে উঠে জানাল রাইডের এ অংশটাই ওর সবচেয়ে প্রিয়।
আমি জবাব দেয়ার আগেই, ঝাঁকুনি খেয়ে পেছনদিকে চলে গেলাম আমরা, এবার আরেকটা পাহাড় বেয়ে উঠছি।
পরমুহূর্তে, সগর্জনে নামতে লাগলাম নিচের গভীর, অন্ধকার উপত্যকার দিকে, পেটের ভেতর গুলোচ্ছে। বাতাসের জোরাল ধাক্কা টের পাচ্ছি গালজোড়ায়, খোঁচা দিচ্ছে চোখে।
ঝলমলে আলোর রশ্মি ঢেউয়ের মতন বয়ে গেল আমার ওপর দিয়ে।
এবার বগিটা এক ঝাঁকিতে সমান্তরাল হলো, আমাদেরকে আছড়ে ফেলল কালিগোলা অন্ধকার এক সুড়ঙ্গে, এর শুরু আর শেষ কোথায় জানি না। মনে হচ্ছে অনন্ত মহাশূন্য ভেদ করে ছুটে চলেছি।
একটু পরে, সুড়ঙ্গ ছেড়ে বেরোতেই, চোখ ধাঁধিয়ে গেল উজ্জ্বল আলোয়।
হাঁফাচ্ছি, শ্বাসের জন্য আঁকুপাঁকু করছি, বগিটা এবার রওনা হলো কমলারঙা বিশাল চাঁদটাকে লক্ষ্য করে এক পাহাড় বেয়ে উঠে যাচ্ছে সাঁই-সাঁই করে। এবার আবার নামার পালা, এক সুড়ঙ্গ দিয়ে ডিগবাজি খেল। নিচের দিকটা উঠে গেছে ওপরে।
তারপর কমে এল গতি।
মনে হচ্ছে মুখটা ফেটে গেছে বুঝি আমার, বাতাসে যেন পুড়ে গেছে। মুখের ভেতর প্রতিটা দাঁত যেন কাঁটা ফোটাচ্ছে।
কাঠের ট্র্যাকে খটখট শব্দে থেমে পড়ল গাড়িটা।
চোখ বুজে নিস্পন্দ বসে রইলাম আমি।
মহাসাগরে ঢেউয়ের ওপর সারা দিন সাঁতরালে কেমন লাগে জানই তো। বিছানায় শুয়ে থাকলেও তখন মনে হয় ঢেউয়ের দোলায় সারাক্ষণ দুলছ বুঝি।
কোস্টারটা থামার পর, দু’মুহূর্তের জন্য তুমি চোখ বুজে চুপচাপ বসে থাকো, অনুভব করতে থাকো প্রতিটা বাঁক আর পাক, প্রতিটা উত্থান-পতন-তিন মিনিট চল্লিশ সেকেণ্ডের রাইডটার।
চোখ মেলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম।
‘ধন্যবাদ, জিনা। ভাগ্যিস তুমি আবার চড়তে চেয়েছিলে!’ বলে পাশ ফিরে চাইলাম।
এ কী!
এ হতে পারে না।
আবারও!
মাথা নেড়ে চোখ পিটপিট করলাম। কিন্তু তাতেও কোন কিছু পাল্টাল না।
ক’মুহূর্ত আগে আমার পাশে যে আসনটিতে বসে ছিল জিনা, সেটি ফাঁকা।
জিনা লাপাত্তা!
তিন
বুকের ভেতর হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে।
জিনা গেল কোথায়?
নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। স্বচ্ছভাবে ভাবতে চাইছি। গভীর শ্বাস টানলাম। ধীরে, ধীরে।
ও তো আমার পাশেই ছিল। প্রথম পাহাড়টা বেয়ে নামার সময় বাহুজোড়া শূন্যে ছুঁড়েছিল মনে আছে।
ওর চুল আমার চোখে এসে পড়েছিল এটাও মনে পড়ছে। আর ওর সেই আর্তচিৎকার। ওর তীক্ষ্ণ, চড়া আর্তনাদের শব্দে আমার ডান কানটা একরকম গেছে বলা যায়।
ওর চিৎকার কি কোন এক পর্যায়ে থেমে গিয়েছিল?
কোন এক সুড়ঙ্গ ভেদ করে আমরা যখন ছুটছিলাম তখন কি পড়ে গেছে ও?
অসম্ভব।
সেফটি বার নামানো অবস্থায় কেউ পড়তে পারে না।
সিটটায় হাত রাখলাম। এখনও গরম হয়ে রয়েছে ওর দেহের তাপে। রাইড শেষ হতেই কি আলগোছে সটকে পড়েছে জিনা, আমি চোখ খোলার আগেই?
আমার সঙ্গে চালাকি করলে কিন্তু ভাল হবে না! বকা দিয়ে ওর ভূত ছাড়িয়ে দেব।
সেফটি বার তুলে বেরিয়ে এলাম বগি থেকে। জনতার ভিড় ঠেলে নীল উর্দি পরা লোকটার কাছে চলে গেলাম।
‘আপনি কি সাদা শর্টস পরা কোন মেয়েকে রাইড থেকে নামতে দেখেছেন?’ জিজ্ঞেস করলাম। কাকের মত কর্কশ শোনাল আমার কণ্ঠস্বর।
‘বাছা,’ ব্যথিত কণ্ঠে জবাব দিল লোকটা, ‘রোজই তো সাদা শর্টস পরা কত মেয়েকে দেখছি।’
কথা তো সত্যি।
‘ও হয়তো রাইড থেকে আগেই নেমে গেছে,’ আশান্বিত গলায় বাতলে দিলাম। ‘হয়তো ওটা থামার আগেই।’
মাথা নাড়ল লোকটা।
‘আমি ডিউটিতে থাকতে তা সম্ভব নয়। গাড়ি একদম না থামা পর্যন্ত সেফটি বার লক করা থাকে।
বগিগুলোর দিকে চকিতে ঘাড় ফিরিয়ে চাইলাম। বার আর সিটের দূরত্ব মাপলাম দৃষ্টি দিয়ে।
‘আমার বন্ধু হালকা-পাতলা,’ জানালাম। ‘বার নামানো অবস্থাতেই হয়তো ফাঁক গলে বেরিয়ে গেছে কোনভাবে।’
‘অসম্ভব,’ ভোঁতা গলায় বলল লোকটা। ‘এক্সিট গেটের কাছে খুঁজে দেখোগে যাও।’
বিমর্ষচিত্তে মাথা ঝাঁকালাম।
‘কিংবা মেসেজ সেন্টারে খোঁজ নাওগে,’ কথার খেই ধরল লোকটা, পার্ক ছাড়তে উদ্যত জনতার মাথার ওপর দিয়ে তর্জনী দেখাল। ‘যা করার জলদি করো। পার্ক কিন্তু এখুনি বন্ধ হয়ে যাবে।’
লোকটার তর্জনী লক্ষ্য করে পার্কের মাঝখানে আইফেল টাওয়ারের যে উঁচু রেপ্লিকাটি রয়েছে সেটির উদ্দেশে চাইলাম।
এবার দুর্বলভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে র্যাম্প ধরে টলতে টলতে এগোলাম।
এক্সিট গেটে জিনাকে পেলাম না। ধারেকাছেও নেই ও।
টাওয়ারের কাছে মেসেজ সেন্টারের দিকেও যেতে পারে।
কিন্তু আমি এত দুশ্চিন্তা করছি কেন?
রাইড থেকে নেমে মেসেজ সেন্টারে আমার জন্য কোন বার্তা রাখতে যাবে সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। মানে, কী কারণে ও অমন কাজ করতে যাবে?
তাছাড়া বার্তাটা কী ধরনেরই বা হতে পারে?
প্রিয় কিশোর, আমি বাতাসে মিলিয়ে গেছি। আমাকে খুঁজে বের করো। তোমার বন্ধু-জিনা।
রাগটা ফেনিয়ে উঠছে আবারও। মুখে গরম অনুভূতি টের পাচ্ছি। ডেনিম শর্টসের দু’পকেটে মুঠো পাকানো হাতজোড়া ঢোকানো আমার।
ভরটেক্স-এর পাশ কাটালাম। ভরটেক্স হচ্ছে ইস্পাতের অতিকায় এক রোলার কোস্টার। যাত্রীদের মাথা নিচু, পা উঁচু করা থেকে নিয়ে সব ধরনের ঘুরপাক খাওয়ায় ওটা। লাঞ্চের আগে চেপেছিলাম আমরা, পেট যখন অনেকটাই খালি ছিল।
কোস্টারটাকে দেখার পর থেকেই আমার আর জিনার মাথায় ঢুকে গেছে ভাবনাটা, কোনভাবে ভরটেক্সের নিচে সেঁধোতে পারলে যাত্রীদের পকেট থেকে খসে পড়া আলগা টাকা-পয়সা কুড়োনো যেত। তারা যখন হেঁট মুণ্ড ঊর্ধ্ব পদ হয়ে অসহায়ের মত ঘুরতে থাকে আরকী!
জিনা এখন হয়তো ভরটেক্সের নিচে, হামাগুড়ি দিয়ে খুচরো টাকা-পয়সা কুড়োচ্ছে।
কিংবা হয়তো নয়।
এমুহূর্তে, ওল্ড-টাইম ফিফটি ক্যাফেটির পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। ওরা ওখানে বার্গার আর শেক পরিবেশন করে। এক মহিলা শাটার টেনে নামাচ্ছিলেন।
ক্যাফেটায় দৌড়ে ঢুকে পড়লাম দুলকিচালে, এক লোক যেখানে স্পঞ্জ দিয়ে টেবিলগুলো মুছছিলেন।
‘লম্বা চুলের একটা মেয়ে, পায়ে গোলাপী ব্লগ-এখান থেকে কি এইমাত্র কোন বার্গার কিনেছে?’ উৎসুক গলায় প্রশ্ন করলাম। ‘বার্গারে কেচাপ কিংবা অন্য কিছু পছন্দ করে না মেয়েটা।’
স্পঞ্জওয়ালা লোকটি সটান সিধে হলেন।
‘আজকের মত কিচেন বন্ধ হয়ে গেছে। ও এখানে আসেনি,’ জানালেন।
খুঁজেই চলেছি। আমার পাশ দিয়ে দলে-দলে ক্লান্ত আর সন্তুষ্ট মানুষজন পার্কিং লটের উদ্দেশে হেঁটে যাচ্ছে। জিনাকে তাদের মাঝে খুঁজলাম, প্রতি মুহূর্তে বুকের ভেতরে জমাট বাঁধছে অজানা ভয়।
একটু পরেই পার্কটা বন্ধ হতে চলেছে। জিনা নেই তো নেই, কোথাও নেই।
কী করব এখন? ওকে ছাড়াই বেরিয়ে যাব?
বাস্কেটবল গেম বুথটা অতিক্রম করলাম, সবকটা বাতি নেভানো, হুপগুলো নিথর আর শূন্য।
আজ বিকেলেই আমার সাথে রাজি ধরেছিল জিনা। আমি টানা আটটা থ্রো বাস্কেট করতে পারলে পাঁচ ডলার দেবে। হেরে যায় ও।
পকেটে হাত ভরে বাজিতে জেতা পাঁচ ডলারের সেই নেতানো নোটটার স্পর্শ নিলাম।
‘জিনা! এবার গলা ছেড়ে চিৎকার করলাম, বারবার ঘুরে- ঘুরে জনতাকে জরিপ করছি। ‘দেখা দাও…তোমার পাঁচ ডলার এখুনি ফিরিয়ে দেব!’
ক’জন আগন্তুক আমার দিকে কৌতুকের দৃষ্টিতে চাইল। কিন্তু জিনা তার পাঁচ ডলার দাবি করতে এল না তাদের ভেতর থেকে।
দুলকিচালে ছুটে চলেছি, ডানে-বাঁয়ে চাইছি, অন্ধকার গেম বুথ, স্যুভনিয়ার স্ট্যাণ্ড আর স্ন্যাক বারগুলোয় দৃষ্টি বোলাচ্ছি। ও কি কোনওটার ছায়ায় লুকিয়ে থেকে আমাকে দেখছে? খুব মজা নিচ্ছে?
ও আমার সঙ্গে এমনটা কীভাবে করতে পারল? ও কি আসলেই ভাবছে ব্যাপারটা মজার?
না, মোটেই তা নয়।
‘ভদ্রমহিলা ও মহোদয়গণ, লাউডস্পিকারে কড়কড় করে উঠল এক নারী কণ্ঠ, ‘রকি বিচ ফ্যান্টাসি আইল্যাণ্ড আজকের মত বন্ধ হতে চলেছে। আপনারা দয়া করে এক্সিটের দিকে আসুন। সবাই ভাল থাকবেন।‘
ভাল থাকার কোন উপায় আছে? আমি তো ভাল নেই।
জনতার ভিড়ে মিশে আইফেল টাওয়ারের দিকে চলেছি, ওপাশেই গেটগুলো। এবার থমকে দাঁড়িয়ে লোকজনকে পাশ কাটাতে দিলাম।
ধীরেসুস্থে ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্য বিস্ট-এর দিকে চাইলাম।
আমি হয়তো ভুল পথে চলেছি।
ও হয়তো আদতে কোস্টারটা ছেড়ে যায়নি।
আমি এখুনি ওখানে ফিরে গেলে হয়তো ওকে পেয়ে যাব।
অন্ধকারাচ্ছন্ন প্ল্যাটফর্মে জিনা নিশ্চয়ই আমার অপেক্ষায় রয়েছে, ভয়ে জড়সড়-চোখজোড়া বিস্ফারিত।
কিংবা হয়তো গেটের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে আমার জন্য, বুকের কাছে দু’বাহু ভাঁজ করে, রেগেমেগে মাটিতে পা ঠুকছে, আমি না বলে-কয়ে কোথাও চলে গেছি ভেবে।
আমি পথের ওপর দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক চাইলাম।
বুঝতে পারছি না কোনদিকে যাব, পেছনে না সামনে।
জানি না রাগ করব নাকি ভয় পাব।
শুধু একটা কথা জানি।
আজ রাতে আমি এই পার্ক ছেড়ে যাচ্ছি না। কোনমতেই না।
জিনাকে না নিয়ে যাব না।
চার
কর্মীরা সবকটা গেট লাগিয়ে তালা মারার পরও পার্কে থাকতে হলো আমাকে। নইলে লুকোতাম কোথায়? বন্ধের সময় গোটা এলাকাটা নীল উর্দি পরা নিরাপত্তাকর্মীদের ভিড়ে গিজগিজ করছিল।
চরকির মতন ঘুরে ইন্টারন্যাশনাল স্ট্রিট ধরে ফিরতি পথে ছুটে চললাম, নিথর ফোয়ারাগুলো পেরিয়ে ফিরে এলাম পার্কের মূল অংশে।
বাতাসে কেমন ভেজা গন্ধ এবং ঘন, সবুজ কুয়াশার আড়ালে ঢাকা পড়েছে কমলা রঙের চাঁদটা।
হঠাৎই ঠাণ্ডা লেগে উঠল। হয়তো আঁধার ঘনিয়েছে বলেই। চারদিক ফাঁকা আর শান্ত। বিন্দুমাত্র কোলাহল নেই।
অথচ ক’মিনিট আগেও কী আলো ঝলমলে জমজমাট ছিল পার্কটা। ফোয়ারাগুলো সচল ছিল, লাউডস্পিকারে গমগম করে বাজছিল ধুমধাড়াক্কা গান।
আলোগুলো এখন নিভু নিভু। সবকটা ফোয়ারা বন্ধ। একটা লাউডস্পিকারও চালু নেই। দৌড়চ্ছি, আমার স্নিকারের সোলের খুদে বাতিগুলো মিটমিট করে জ্বলছে, প্রথমে একটা, তারপর আরেকটা, ঠিক সঙ্কেতের মতন।
এস ও এস সিগন্যাল।
কিন্তু এখানে আমাকে সাহায্য করার কেউ নেই। গার্ডদের কারও সঙ্গে কথা বললে, আমাকে সোজা অফিসে পাঠাবে।
প্রতিটা রেস্তোরাঁ, দোকান, বুথ- সব কিছু বন্ধ, তালা মারা আর অন্ধকার। শুধু গাছপালার মাথা ছুঁয়ে মৃদু বাতাস বয়ে যাওয়ার ফিসফিস শব্দ।
থেমে দাঁড়িয়ে এক রিফ্লেকটিং পুলের দিকে দৃষ্টি নামালাম। কালো কাঁচের মত কাঁপছে ওটা। আমার মুখটা চেয়ে রয়েছে আমারই দিকে, মলিন আর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।
এটা যে সত্যিই ঘটছে বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। গলা শুকিয়ে আসছে আতঙ্কে।
আচমকা এক শব্দে ঝট করে মাথা উঁচু হলো আমার।
গেমস্ অ্যালির ওদিকটা থেকে কে যেন আসছে। এক দৌড়ে লেমোনেড স্ট্যাণ্ডের পাশে যে ওয়েস্ট বাস্কেটটা আছে ওটার পেছনে গিয়ে লুকোলাম।
লেবুর গন্ধে ভরপুর বাস্কেটটা, নাক সুড়সুড় করছে আমার।
দু’জন নিরাপত্তাকর্মী অলস ভঙ্গিতে হেঁটে গেল, পথের ওপর ফ্ল্যাশলাইটের আলো বোলাচ্ছে। স্ট্যাওটার সামনে থামল ওরা।
ধক করে উঠল আমার বুকের ভেতরে। আবারও নাক সুলসুল করে উঠল। গলার পেছনে হাঁচি সুড়সুড়ি দিচ্ছে। রাতারাতি লেবুতে অ্যালার্জি জন্মাল নাকি আমার!
আমার পেছনে ঝোপঝাড়ে ফ্ল্যাশলাইটের রশ্মি বোলাল ওরা এবং ওয়েস্ট বাস্কেটটাতে হেলান দিতে এল। গুটিসুটি মেরে নিজেকে প্রায় একটা বল বানিয়ে ফেললাম, হাঁচি চাপতে টিপে ধরলাম নাক।
‘ইস, খেলাটায় যদি বাজি ধরতাম!’ ওদের একজন আরেকজনকে বলল। ‘তাহলে আজকে আমি বড়লোক।’
‘তুমি, আমি দু’জনেই,’ অপরজন জবাবে বলল। ‘আহা, এখন এক গ্লাস লেমোনেড পেলে হত।’
‘গরম চা পেলেও মন্দ হত না,’ ওর সঙ্গী জানাল। ‘রাতে ভাল বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে।’
নিরাপত্তাকর্মীরা টহল শুরু করতেই ফ্ল্যাশলাইটের আলো সরে গেল আমার কাছ থেকে।
হুশ করে স্বস্তির শ্বাস ফেললাম। এবার পরপর তিনটে হাঁচি দিলাম।
জঘন্য অনুভূতি
গার্ডদের কাছ থেকে আবারও লুকিয়ে রয়েছি বিশ্বাস হতে চাইছে না। এ ঘটনা যে আবারও ঘটছে বিশ্বাস করা সত্যিই কঠিন
কিন্তু ঘটছে তো।
গত বছর গরমের সময় পার্ক বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আটকা পড়ি জিনা আর আমি। ওর পাগলামিতে সায় দিয়ে রাতটা পার্কেই কাটাতে চাই দু’জনে।
দ্য বিস্ট-এর গোড়ায় ওভারল পরা এক দাড়িওয়ালা বুড়োর দেখা পাই আমরা, রাতে যে বগিগুলো পরীক্ষা করে। তার নাম পি. ডি. ওয়ার্নার।
পি. ডি. আমাদেরকে ফায়ারলাইট পার্কের কথা বিস্তারিত বলে, একসময় ঠিক এখানেই ছিল বিনোদন পার্কটা। ষাট বছর আগে এক ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত হয় ওটা। মারা যায় কয়েকশো মানুষ। সে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা।
তারপর পি. ডি. আমাদেরকে রাতের ঘূর্ণি-কুয়াশা ভেদ করে দ্য বিস্ট-এ চড়ার প্রস্তাব দেয়।
রাইডটা অতুলনীয় ছিল।
সমস্যা ছিল একটাই।
আমরা অতীতে চলে যাই।
ষাট বছর আগে।
সেই ফায়ারলাইট পার্কে।
পিটার নামে এক ছেলের সঙ্গে পরিচয় হয় আমাদের। একটা খবরের কাগজ উড়ে এসে আমার গোড়ালীতে পেঁচিয়ে না যাওয়া অবধি ওর সঙ্গে চমৎকার সময় কাটে। খবরের কাগজটি সেই তারিখের ছিল যেদিন টর্নেডো আঘাত হানার কথা।
আমরা ওদেরকে সতর্ক করার শত চেষ্টা করেও পারিনি। ঘূর্ণিঝড়টা যখন মাথার ওপর আমরা তখন অদ্ভুত এক ব্যাপার আবিষ্কার করি। আমাদের কিশোর বন্ধু পিটার আর পি. ডি. ওয়ার্নার একই মানুষ, তবে ভিন্ন দুটি সময়ের।
ভাগ্যক্রমে, দ্য বিস্টকে পেয়ে যাই আমরা এবং সময়মত লাফিয়ে উঠে পড়ি ওটায়। ঘূর্ণিঝড়ের কবল থেকে বেঁচে ফিরি বর্তমান সময়ে।
কিন্তু পিটারকে সঙ্গে করে আনতে পারিনি।
ঘটনাটা ভোলার মত নয়।
সে রাতে, পার্ক ছাড়ার সময়, আমরা পিটারের নাম জানতে পারি, সামনের গেটের কাছে আরও অনেকের সঙ্গে ওর নামটাও খোদাই করা রয়েছে এক স্মৃতিস্তম্ভে। সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাটির স্মরণে পার্ক কর্তৃপক্ষ ওটা বসিয়েছে।
তারপর দুটি ব্যাপার জানতে পারি আমরা।
আমাদের বন্ধু পিটার মারা পড়েছিল টর্নেডোর আঘাতে।
এবং ওভারল পরা বৃদ্ধ পি. ডি. বিনোদন পার্কটির বিশেষ নৈশকর্মী নয়।
পি. ডি. আসলে ভূত। কিশোর পিটারের প্রেতাত্মা, বহু বছর আগে যে মারা যায়।
লোকে ঠিকই বলে।
দ্য বিস্ট সত্যিই ভুতুড়ে এক কোস্টার।
ওটার কথা ভাবতে পারছি না আমি এমুহূর্তে। কিন্তু আমার মন কু গাইছে, পার্কে স্রেফ হারিয়ে যায়নি জিনা।
ও হারিয়েছে সময়চক্রে!