৮
নিউ ইয়র্ক মিউজিয়ামে তোশির রাইট হ্যান্ড ম্যান ছিলেন জন ট্র্যাভার্স নামে একজন লোক। তোশির মৃত্যুর পর উনিই এখন ফিলাটেলি সেকশনটা দেখাশোনা করছেন। তোশির কাছেই ওঁর নামটা শুনেছিলাম, কিন্তু আলাপ-পরিচয় হয়নি। একেনবাবু যখন হঠাৎ বললেন, “চলুন স্যার, মিস্টার ট্র্যাভার্সের সঙ্গে একটু কথা বলে আসি।” আমি একটু অবাকই হলাম। “কেন বলুন তো, আপনি কি এই চুরিতে উনিও যুক্ত বলে সন্দেহ করছেন নাকি?”
“না না, স্যার। তবে কিনা কথায় কথায় দু-একটা জিনিস বেরিয়ে পড়তে পারে যেটা নিয়ে আমরা হয়তো কিছুই ভাবিনি।”
প্রমথ খুব মন দিয়ে ফ্রি-তে পাওয়া কমিউনিটি নিউজপেপার থেকে স্টোর-কুপন কাটছিল। কুপন কাটা থামিয়ে একেনবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, “গোয়েন্দামশাই মনে হচ্ছে এবার একটু হাবুডুবু খাচ্ছেন, তাই খড়কুটো যা পাচ্ছেন সেটাই ধরার চেষ্টা করছেন?”
“তা একটু খাচ্ছি স্যার। আসলে খুনি ধরা সহজ, চোর ধরা অনেক কঠিন।”
“তা যাওয়াটা কখন হবে?”
“আপনাদের সবার যখন সুবিধা। আমি সেইমতো মিস্টার ট্র্যাভার্সকে ফোন করব।”
ঠিক হল বিকেল তিনটে নাগাদ যাব। আমার তখন ক্লাস নেই। প্রমথ বলল ওই সময় ওরও ল্যাব ফাঁকি দিতে কোনো অসুবিধে নেই। এরপর অবশ্য সব নির্ভর করছে মিস্টার ট্র্যাভার্সের ওপর- ওঁর তখন সময় থাকবে কিনা।
.
আমরা আড়াইটে নাগাদ কলেজ থেকে রওনা দিলাম। পথে মিস্টার মেহেতার ট্র্যাভেল এজেন্সি পড়ে। সেখানে গাড়িটা থামানোর জন্য একেনবাবু একটু বায়না ধরেছিলেন। কিন্তু কারণটা জানি বলে আমি আর প্রমথ পাত্তা দিলাম না। তা ছাড়া এইসময় ওখানে পার্কিং পাওয়া খুব কঠিন। ভাগ্যিস থামিনি, না থেমেও গাড়ির ভিড়ে মিউজিয়ামে পৌঁছোতে পৌঁছোতে প্রায় তিনটেই বাজল।
জন ট্র্যাভার্স আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। লম্বা-পাতলা চেহারার শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান। চোখে মোটা লেন্সের চশমা। উশকোখুশকো ব্লন্ড চুল কপালের ওপর এসে পড়েছে। জিনস, স্নিকার, টিশার্ট… একেবারে অ্যানথ্রোপলজিস্ট মার্কা চেহারা। ঘরটা তোশির। মাস তিনেক আগে যেরকম দেখেছিলাম, ঠিক সেরকমই আছে। শুধু তোশি নেই। কেমন একটু অদ্ভুত লাগল।
কিছু কিছু আমেরিকান আছে যাদের ব্যবহার এত সুন্দর আর স্বচ্ছ, অল্পক্ষণের মধ্যেই মনে হয় বহুদিনের চেনা। খেয়ালও হয়নি কখন ‘হ্যালো’, ‘হাউ আর ইউ’ ছেড়ে আড্ডা মারতে শুরু করেছি! জনও তোশির মতো বিদগ্ধ। অনেক দেশ ঘুরেছেন। ভারতবর্ষ সম্পর্কেও দেখলাম প্রচুর জ্ঞান। গল্পগুজবের ফাঁকে একেনবাবু প্রাইসলেস বুদ্ধের কথা তুললেন। জন দুঃখ করে বললেন চুরিটা মিউজিয়ামের পক্ষে কী প্রচণ্ড ক্ষতিকর! বলতে গেলে একটা ইতিহাস প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া। একেনবাবু তখন বললেন, “কেন স্যার, মিস্টার মেহেতার কাছে তো স্ট্যাম্পের একটা কপি আছে, সেটা কিনলেই তো হয়!”
“হ্যাঁ, তা অবশ্য হয়।” কথাটা সায় দিয়েই বলা, কিন্তু উৎসাহের অভাবটা স্পষ্ট।
“মনে হচ্ছে স্যার, এটাতে একটু কিন্তু কিন্তু আছে?”
“আপনি ঠিকই ধরেছেন। আসলে এসব ব্যাপারে একাধিক সমস্যা। প্রথমত, ইন্সিয়োরেন্স থাকলেও প্রাইসলেস বুদ্ধের ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে পেতে বহুদিন লাগবে। শেষ পর্যন্ত যখন পাওয়া যাবে, তখন তা দিয়ে মিস্টার মেহেতার স্ট্যাম্প কিনতে পারা যাবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ। তা ছাড়া আমরা তো চোখ বুজে কোনো স্ট্যাম্প কিনতে পারি না। অথেন্টিসিটি, মানে আসল-নকল বিচারের ব্যাপারও আছে।”
“সেটা কি খুব বড়ো সমস্যা স্যার?”
“কীসের কথা বলছেন, অথেন্টিসিটি?”
“হ্যাঁ।”
“সেটা সব সময়েই সমস্যা। আর্ট বলুন, স্ট্যাম্প বলুন, অ্যান্টিক বলুন, সব কিছুতেই এত জালজোচ্চুরি!” কথাটা বলেই জন যোগ করলেন, “আমি অবশ্য মিস্টার মেহেতা সম্পর্কে কিছু বলছি না।”
“না না, স্যার, আমি বুঝতে পারছি।”
“দাঁড়ান, একটা মজার জিনিস দেখাই,” বলে জন দুটো ডলার নোট ড্রয়ার থেকে বার করলেন। “একটু দেখে বলুন তো কোনটে আসল আর কোনটে নকল?”
আমরা তিন জনই নোট দুটো নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করলাম। দেখতে হুবহু এক। এমনকী নোট দুটো ছুঁলেও মনে হয় একই ধরনের টেক্সচার! প্রথমে আমিই স্বীকার করলাম আমার সাধ্যি নেই তফাত বোঝার। প্রমথও পারল না। একেনবাবু বেশ খানিকক্ষণ চেষ্টা করে অবশেষে হাল ছাড়লেন।
জন তখন একটা বড়ো ম্যাগনিফাইং গ্লাস বার করে নোট দুটোর ডান কোনায় একটা জায়গা দেখিয়ে বললেন, “দেখুন তো এটা দিয়ে কোনো তফাত দেখতে পান কিনা?”
ম্যাগনিফাইং গ্লাসের মধ্যে দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ দেখার পর আমরা সবাই আবিষ্কার করলাম কয়েকটা জায়গায় দাগের রকমফের আছে।
একেনবাবু বললেন, “তফাতটা তো বুঝতে পারছি স্যার, কিন্তু কোনটে আসল?”
জন ম্যাগনিফাইং গ্লাস ধরে একটু দেখে বললেন, “এইটে।”
একেনবাবু দুটো নোট আবার হাতে নিয়ে বললেন, “অ্যামেজিং স্যার। চোখে আঙুল দিয়ে তফাতটা না দেখিয়ে দিলে কিছুই বুঝতে পারতাম না। এখনও খালি চোখে বুঝছি না।”
আড্ডা দিতে দিতে বিকেল পার হয়ে গেল। কথার ফাঁকে একেনবাবু জনকে টুক করে জিজ্ঞেস করলেন মিউজিয়াম থেকে স্ট্যাম্প চুরি করা খুব কঠিন কিনা।
“খুবই কঠিন। দিনের বেলায় সবসময় ঘরে গার্ড পাহারা দিচ্ছে। বিকেলে মিউজিয়াম বন্ধ করার আগে প্রত্যেকটা এক্সিবিট ভালো করে চেক করা হয়। তারপর দরজায় চাবি পড়ে।”
“কিন্তু রাত্রে যদি কেউ চাবি খুলে ঢোকে?”
“মিউজিয়ামের মধ্যে ঢুকলে লাভ হবে না। কারণ প্রত্যেকটা ঘরে আলাদা ইলেকট্রনিক সিকিউরিটি আছে। সিকিউরিটি কোড ঠিকমতো না টিপে ঘরে ঢুকলেই অ্যালার্ম বাজবে।”
“কোডগুলো কারা জানেন স্যার?”
“স্ট্যাম্প সেকশনের কোডটা আমি জানি। আর জানেন মিউজিয়াম-সিকিউরিটির যিনি হেড।”
“আপনি যে চেক করার কথা বলছিলেন, সেটা কারা করেন স্যার?”
“সাধারণত সেকশনের ভার যাঁর ওপর তিনিই করেন। এখন যেমন স্ট্যাম্পের সেকশনটা আমি করছি।”
“কিছু মনে করবেন না স্যার, আপনি যা বর্ণনা করলেন, তাতে মনে হচ্ছে প্রাইসলেস বুদ্ধ তোশি নিজে ছাড়া আর কেউই সরাতে পারেন না।”
কথাটাতে জন ট্র্যাভার্স একটু অসন্তুষ্ট হলেন। “আপনি তোশিকে বোধহয় ভালো করে চিনতেন না, তাই কথাটা বলছেন। আমি বলেছি চুরি করাটা কঠিন, কিন্তু তার মানে এই নয় যে অসম্ভব!”
ফেরার পথে একেনবাবু জোরজার করে আমাদের থামিয়ে মিস্টার মেহেতার অফিসে গেলেন। আমি আর প্রমথ কেউই গাড়ি থেকে নামলাম না। কিন্তু অনেকক্ষণ আসছেন না দেখে শেষ পর্যন্ত তাড়া দিতে নামতে হল। মিস্টার মেহেতার মুখে দেখলাম একটু চাপা হাসি। বুঝলাম একেনবাবুর স্ট্যাম্পের ব্যাখ্যান শেষ হয়েছে।
আমাকে দেখেই একেনবাবু বললেন, “আমার হয়ে গেছে স্যার, চলুন।”
আমি মিস্টার মেহেতাকে হাত নেড়ে বললাম, “চলি।”
একেনবাবু দরজার দিকে হাঁটা দিয়ে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললেন, “একটা কথা স্যার, আপনি শিওর যে তোশি আপনাকে সেদিন এক বারই ফোন করেছিলেন?”
সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গ বলেই বোধহয় মিস্টার মেহেতার কথাটা বুঝতে কিছুক্ষণ সময় লাগল। তারপর বললেন, “হ্যাঁ, কেন বলুন তো?”
“আমার কেন জানি মনে হল স্যার, দু-বার ফোন করেছিলেন।”
“হোয়াই?”
“কে জানে স্যার, মাথাটা এত গুলিয়ে যাচ্ছে আজকাল। যাক গে, তার মানে আপনি ওঁর একটা মেসেজই পেয়েছিলেন?”
“রাইট।”
“যেটাতে আপনাকে উনি কোবাইয়ে যেতে বলেছিলেন?”
“হ্যাঁ।”
“ক’টা নাগাদ মেসেজটা পেয়েছিলেন স্যার?”
“আটটার একটু আগে। আপনাকে তো আমি কালকেই এটা বলেছি!” মিস্টার মেহেতা শুধু হতভম্ব নন, একটু বিরক্তও।
“বলেছিলেন কি স্যার? ও, তাহলে ঠিক আছে। থ্যাংক ইউ স্যার।” বলে একেনবাবু আবার হাঁটা দিলেন।
মিস্টার মেহেতা এমনভাবে একেনবাবুর পেছনে তাকালেন যেন একটা অর্ধোন্মাদ দর্শন করছেন। তার জন্য অবশ্য আমি ওঁকে দোষ দিতে পারি না!