প্রাইসলেস বুদ্ধ – ৭

পরদিন কলেজে আমার ঘরে বসে খাতা দেখছি, সমর এল। বলল, “খবর শুনেছিস?”

“খবর! কী খবর?”

“সেদিন বিভাসদার বাড়িতে আগুন লাগার কারণ জানা গেছে। ঘটনাটা অ্যাক্সিডেন্ট নয়, আসন।”

“হোয়াট?”

“হ্যাঁ। কেউ এক তলায় পেট্রোল ঢেলে দেশলাই জ্বালিয়ে অদৃশ্য হয়েছে।”

“কেন?”

“সেটা পরিষ্কার নয়। তবে ইন্সিয়োরেন্সের টাকার জন্য হওয়ার চান্সটাই বেশি। এক তলায় যে ইটালিয়ান বইয়ের দোকানটা ছিল, সেটা একদমই চলছিল না। কিন্তু দামি দামি বই দোকানে নাকি অনেক ছিল। তাই পুলিশ সন্দেহ করছে ওর মালিকই সম্ভবত কীর্তিটি করেছে। আগুনে নষ্ট হয়ে গেছে বলে বইগুলোর পুরো দাম এখন ইন্সিয়োরেন্স কোম্পানিকে দিতে হবে।”

“মাই গড! কিন্তু এটা তো শুধু আগুন লাগানো নয়, এটা তো মার্ডার!”

“মার্ডারটা অ্যাক্সিডেন্ট, কারণ বিভাসদার বাড়ি থাকার কথা ছিল না। আমরা সবাই জানতাম উনি বস্টন যাচ্ছেন।”

“তুই বলছিস দোকানের মালিক সেটা জানত?”

“শিওর। বিভাসদার সঙ্গে লোকটার প্রায়ই কথা হত।”

“তার মানে বিভাস চৌধুরী নেই ভেবেই আগুনটা জ্বালানো হয়েছিল?”

“আই থিংক সো। তবে লোকটা নিজে বোধহয় জ্বালায়নি। কারণ পুলিশের খবর হল শুক্রবার বিকেল থেকেই দোকানের মালিক মেয়ের কাছে উইকএন্ড কাটাতে গিয়েছিল। মেয়ে থাকে লং আইল্যান্ডে!”

“তুই এত কথা কার কাছ থেকে শুনলি?”

“আমাদের ডিন বলছিলেন। পুলিশ আর ফায়ার ডিপার্টমেন্টে অনেকের সঙ্গে ওঁর চেনাশোনা। তাদের কারোর কাছ থেকেই নিশ্চয় জেনেছেন। একেনবাবুকে একটু বল না, উনি নিশ্চয় আরও খোঁজখবর আনতে পারবেন।”

“তা বলব। কিন্তু কী আশ্চর্য বল তো, বিভাস চৌধুরী বস্টন চলে গেলে এভাবে মৃত্যুটা ঘটত না!”

“ঠিক। শুক্রবার সকালেও বিভাসদার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, তখন পর্যন্ত তো না যাবার কোনো সম্ভাবনার কথা শুনিনি!”

বিকেলে বাড়ি ফিরে দেখি একেনবাবু খুব মন দিয়ে ‘The World Encyclo- pedia of Stamps’ পড়ছেন। আমি একটু ঠাট্টা করে বললাম, “কী ব্যাপার, আপনি যে প্রাইসলেস বুদ্ধের খোঁজ করতে গিয়ে ছোটোখাটো রিসার্চ শুরু করে দিয়েছেন?” একেনবাবু বইটা মুড়ে রেখে বললেন, “ফ্যাসিনেটিং বই স্যার, মনটাকে একেবারে ধরে রাখে! 

“তা বুঝলাম। কিন্তু স্ট্যাম্প থেকে মনকে সরিয়ে এবার আপনাকে আরেকটা জিনিসের খোঁজ করতে হবে।” ওঁকে সমরের খবরগুলো জানাতে যাচ্ছি, দেখলাম ইতিমধ্যেই সব কিছু ওঁর কানে পৌঁছেছে। শুধু পৌঁছোনো নয়, উনি স্যাল বেত্রো- যিনি সেই ইটালিয়ান বইয়ের দোকানের মালিক, তাঁর সঙ্গে কথাও বলে এসেছেন।

“স্যাল বেত্রোকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেনি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। 

“না না স্যার, অ্যারেস্ট করবে কেন! একটু জিজ্ঞাসাবাদ করেছে শুধু। আসলে স্যার এদেশে দোকানে আগুন লাগলে সন্দেহ জাগে মালিকের ওপরে। তবে এক্ষেত্রে মোটিভটা স্ট্রং নয়।”

“এটা কেন বলছেন?”

“কারণ ভদ্রলোকের দোকানটার দরকার ছিল, টাকার নয়।”

“তার মানে?”

“মিস্টার বেত্রোর বয়স প্রায় সত্তর। কোটিপতি মানুষ। নিউ ইয়র্ক শহরেই ওঁর তিন-তিনটে বাড়ি। বইপাগল লোক, বইয়ের দোকানটাই ছিল ওঁর একমাত্র নেশা। সেই জন্য আর কাউকে না পাঠিয়ে উনি নিজে প্রতিদিন ওখানে এসে বসতেন।”

“তাহলে আগুনটা লাগাল কে?”

“সেটা একটা পাজল স্যার। পুলিশের থিয়োরি হল এটা মিস্টার বেত্রোর কোনো শত্রুর কাজ। মিস্টার বেত্রোকে আজ যা দেখলাম, তাতে সেই শত্রুর খুবই আনন্দ হওয়ার কথা। ভদ্রলোক খুব ভেঙে পড়েছেন। বইয়ের শোক তো বটেই, তা ছাড়া বিভাস চৌধুরীকেও ভদ্রলোক খুব পছন্দ করতেন মনে হল।”

 “আপনি পুলিশের থিয়োরির কথা বললেন। আপনার নিজের কোনো থিয়োরি আছে?”

“না স্যার। আমার মনে হয়, এটাই এখন পর্যন্ত বেস্ট থিয়োরি। তবে কিনা মানুষ আগেও আমাকে ধোঁকা দিয়েছে।”

“কথাটা একটু বুঝিয়ে বলবেন? আপনিও তো দেখছি রহস্যের সৃষ্টি করছেন?”

“না, মানে স্যার এই মিস্টার বেত্রোর কথা ভাবছিলাম। ভালোকথা, প্রমথবাবুকে দেখছি না!”

প্রমথ বহু বছর বাঁচবে। একেনবাবুর কথা শেষ হতে না হতেই ও ঘরে ঢুকল। আবার আমাদের একপ্রস্থ আলোচনা হল। প্রমথ একটা ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট তুলল। আগুনটা নাকি লেগেছিল ন’টা নাগাদ। তখন নিশ্চয় বিভাস চৌধুরী ঘুমোতে যাননি। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে উনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন না কেন? 

এঁর সত্যিকারের উত্তর আমরা কেউই জানি না। তবে প্রথমেই ধরে নেওয়া হয়েছে বিভাস চৌধুরী জেগেছিলেন, সেটা সত্যি নাও হতে পারে। তা ছাড়া যদি অনেক পেট্রোল ঢালা হয়ে থাকে, তাহলে বাড়ির কাঠ আর বইয়ের কাগজ- এই তিনটের কম্বিনেশনে আগুন একেবারে দাউদাউ করে উঠেছিল। আচমকা চারদিকে ওরকম আগুন দেখলে মানুষ হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। কী করণীয় বুঝতে বুঝতেই পালাবার সময়টুকু তিনি হয়তো হারিয়েছিলেন। 

একেনবাবু হঠাৎ উঠে একটা ফোন করলেন। যাঁকে ফোন করলেন তিনি নেই, তাই অ্যানসারিং মেশিনে দেখলাম মেসেজ রাখছেন। “একেন্দ্র সেন বলছি স্যার, বাপিবাবু আর প্রমথবাবুর বন্ধু। একটা কথা কালকে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিলাম, আপনার যদি এঁর মধ্যে সময় হয়…” মেসেজটা বোধহয় শেষ করার সময় পেলেন না! আমাদের দিকে তাকিয়ে হতাশভাবে বললেন, “যাঃ স্যার, কানেকশানটা কেটে গেল।”

“কাকে ফোন করছিলেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। 

“মিস্টার মেহেতাকে। কিন্তু অ্যানসারিং মেশিন হঠাৎ কানেকশনটা কেটে দিল স্যার!”

“আপনার গলার স্বর বোধহয় পছন্দ হয়নি,” প্রমথ টিপ্পনী কাটল। 

“টাইমিংটা কম করে সেট করা আছে আর কি।” আমি বললাম। 

অ্যানসারিং মেশিনের মেসেজ রাখার টাইমগুলো কম-বেশি করে সেট করা যায়। একেনবাবুর মতো অবস্থা আমারও আগে হয়েছে। মেসেজ শেষ করার আগেই কাট। 

একেনবাবু মাথা চুলকোচ্ছেন দেখে প্রমথ বলল, “কী এমন হাতি-ঘোড়া খবর দেওয়ার দরকার ওঁকে?”

“আপনি শুনলে রাগ করবেন স্যার।”

“আপনার সেই স্ট্যাম্প?” প্রমথ কড়া স্বরে প্রশ্ন করল। 

“আসলে গিন্নিকে ওটা পাঠাতে বলেছি,” একটু কাঁচুমাচু মুখে একেনবাবু বললেন। “হয়তো কিছুই পাওয়া যাবে না। তবে মিস্টার মেহেতা লাইনের লোক, একটু যদি চেষ্টা করে দেখেন।”

প্রমথ একেনবাবুর কথাগুলো পুরোপুরি উপেক্ষা করে বলল, “চল বাপি, রান্না শুরু করি।”