৪
একেনবাবুকে সকাল থেকে দেখছি না। দেখলে একটা খুব গরম খবর দিতে পারতাম। নিউ ইয়র্ক মিউজিয়াম থেকে নাকি ‘প্রাইসলেস বুদ্ধ’ নামে একটা বিখ্যাত স্ট্যাম্প চুরি গেছে! উনি হয়তো নামটা শুনে থাকবেন— এত যখন ‘স্ট্যাম্প কালেক্টর’ বলে নিজেকে জাহির করেন। আমার কাছে ‘ইনভার্টেড জেনি এয়ারমেল’ও যা ‘প্রাইসলেস বুদ্ধ’ও তাই— শুধু কয়েকটা শব্দ। তবে দামটা দেখে চক্ষু চড়কগাছ! কুড়ি হাজার ডলার! রিপোর্টারের কথায় ‘দ্য মার্কেট প্রাইস অফ দ্য প্রাইসলেস বুদ্ধ ইজ এস্টিমেটেড টু বি ওভার টোয়েন্টি থাউজেন্ড ডলার্স’! একটা ছোট্ট কাগজের টুকরোর এত দাম!
প্রাইস অফ দ্য প্রাইসলেস বুদ্ধ- কথাগুলো পড়তে পড়তে আমার প্রমথ কথা মনে হল। ওর মতে এভরিথিং হ্যাজ এ প্রাইস। প্রাইসলেসেরও যে প্রাইস আছে দেখলে নিশ্চয় ও খুব মজা পাবে। প্রমথ আবার আজ তাড়াহুড়ো করে কলেজ চলে গেছে। ল্যাবে এক ভিজিটার আসছে- তার জন্য ওকে তদারকি করতে হবে। আসতে আসতে সেই বিকেল।
চুরিটা নিঃসন্দেহে বড়ো খবর, কিন্তু আমার মাথায় আরও কয়েকটা জিনিস ঘুরছে। তোশি ছিলেন নিউ ইয়র্ক মিউজিয়ামের ফিলাটেলি সেকশনের প্রধান। ফিলাটেলি সেকশন হল যেখানে স্ট্যাম্পের সংগ্রহগুলো থাকে। সেখান থেকে এরকম একটা দামি স্ট্যাম্প অদৃশ্য হল, আর সেটা ধরা পড়ল তোশির মৃত্যুর ঠিক পর পরই! সামথিং ইজ রং সামহোয়্যার। নিউ ইয়র্ক টাইমসেও এটা উল্লেখ করেছে। পুলিশ যে জোর তদন্ত শুরু করেছে সে খবরটাও আছে।
হয়তো তোশির কোনো কারণে হঠাৎ অনেক টাকার দরকার হয়ে পড়েছিল। আর কোনো পথ খুঁজে না পেয়ে উনি স্ট্যাম্পটা চুরি করে বিক্রি করেছিলেন। পরে ধরা পড়ে যাবার লজ্জা থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন! কিন্তু এটা ভাবা কি যুক্তিযুক্ত? কুড়ি হাজার ডলার অনেক হলেও তোশির মতো লোকের কাছে এটা এমন কোনো বড়ো অঙ্ক নয় যে জোগাড় করতে সমস্যা হবে। আরও একটা সম্ভাবনা আছে। ধরা যাক মিউজিয়ামেরই কেউ স্ট্যাম্পটা চুরি করেছিল। তোশি ধরে ফেলেছিলেন কে করেছে। তোশি তাকে বলেছিলেন স্ট্যাম্পটা ফেরত নিয়ে এলে উনি থানা-পুলিশ করবেন না। লোকটা তা না করে তোশিকে খুন করে। কী করে লোকটা তোশির ঘরে ঢুকে খুন করে পালাল, সেটা পরিষ্কার নয়। তবে এরকম কিছু ঘটা মোটেই অসম্ভব নয়! তোশি যেরকম ভদ্রলোক— অপরাধীকে শোধরাবার সুযোগ দেওয়া ওঁর পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। তোশির মন নাকি গত দু-দিন ভীষণ খারাপ ছিল, ওঁর ল্যান্ডলেডি ডরোথি স্মিথ জানিয়েছেন। এইসব কারণেই কি? আসলে পুরো ব্যাপারটাই কনফিউজিং!
আমি কলেজ গেলাম বটে, কিন্তু মাথায় একরাশ চিন্তা নিয়ে। যাবার পথে রাস্তার ধারে নিউজ স্ট্যান্ডে একটা খেলো পত্রিকা চোখে পড়ল। প্রথম পাতাতেই বিরাট করে তোশির একটা ফোটো। তার নীচে লেখা ‘ডিড হি স্টিল দ্য স্ট্যাম্প?” আমি এই পত্রিকাটা এক-আধ সময় উলটে পালটে দেখেছি। চাঞ্চল্যকর খবর ছাড়া আর কিছু এরা ছাপে না। তখনই ঠিক করলাম একেনবাবু এলে ওঁকে উদ্বুদ্ধ করব এই চুরির ব্যাপার নিয়ে একটু মাথা ঘামাতে। একেনবাবুর অনেক দোষ—উলটোপালটা বকেন, জামাকাপড়ের ছিরিছাঁদ নেই, সিগারেট খোর (আমার আর প্রমথর তীব্র আপত্তিতে সিগারেট খাওয়া একটু কমেছে), ঘ্যানঘ্যান করে লোককে পাগল করে দেন, কিন্তু নিঃসন্দেহে তিনি দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা। গত তিন বছরে এটা সার বুঝেছি। শুধু আমরা নই, নিউ ইয়র্ক পুলিশের হোমরাচোমরা কর্তারাও সেটা জানেন। প্রাইভেট ডিটেকটিভদের প্রতি তাঁদের যে বৈরী মনোভাব, একেনবাবুর ক্ষেত্রে সেটা নেই। বেশ অনেকগুলো কেসে ওঁরাই এগিয়ে এসে একেনবাবুর সাহায্য চেয়েছেন। তার প্রধান কারণ একেনবাবু কাউকেই ছোটো করার চেষ্টা করেন না। নিজে রহস্যের সমাধান করেও ভাব দেখান সকলের জন্যেই সেটা সম্ভব হয়েছে!
বিকেলে বাড়ি ফিরে দেখি সারা ঘর সিগারেটের ধোঁয়ায় ভরতি। একেনবাবুর ঠ্যাং কফি টেবিলে তোলা, মুখে সিগারেট, চোখ বন্ধ। ইদানীং তাড়া দিয়ে আমার অ্যাপার্টমেন্টে ওঁর সিগারেট খাওয়া বন্ধ করিয়েছি। তাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “একী আপনি এখানে আবার সিগারেট খাচ্ছেন?”
“তাই তো স্যার, একদম ভুলে গিয়েছিলাম। আসলে এই চুরির ব্যাপারটা আমাকে বড্ড বদার করছে।”
“চুরি? কোন চুমি?”
“এই প্রাইসলেস বুদ্ধের কেসটা স্যার। আপনি আজ নিউ ইয়র্ক টাইমস দেখেননি?”
কথাটা শুনে আমি যে কী খুশি হলাম বোঝাতে পারব না। বললাম, “কী আশ্চর্য, আমি আজ কলেজ যেতে যেতে ভাবছিলাম আপনাকে বলব ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখতে! হাজার হোক, তোশিকে আমরা চিনতাম, তাঁর নামে পত্রিকাতে এসব লেখা…।”
“আমারও সেই পয়েন্ট স্যার। সেই জন্যই আমি ইনস্পেকটর ল্যান্ডির কাছে গিয়েছিলাম।”
“ইনস্পেকটর ল্যান্ডি! তিনি তো হোয়াইট প্লেইসে আছেন!”
“না স্যার। কয়েক মাস হল ওখানকার চাকরি ছেড়ে নিউ ইয়র্ক পুলিশে ঢুকেছেন। ওঁর ওপরেই মিস্টার নাকাজিমার তদন্তের ভার পড়েছে।”
কথাটা শুনে আমি একেনবাবুকে আমার মার্ডার থিয়োরিটা বললাম। সেটা শুনে একেনবাবু বললেন, “আপনার লজিকগুলো ঠিক আছে স্যার। কিন্তু ইনস্পেকটর ল্যান্ডি একেবারে নিশ্চিত তোশির মৃত্যু হচ্ছে আত্মহত্যা।”
“চুরির ব্যাপারটাও কি উনি দেখছেন?”
“মনে হয় না স্যার, উনি হচ্ছেন হোমিসাইডের লোক। তবে যারা দেখছে তাদের চিনি। তবু ভাবলাম স্যার, একটু খোঁজখবর করি। মিস্টার নাকাজিমার অনারের প্রশ্নটা তো রয়েছেই, তা ছাড়া স্যার, আমি জানি আপনারা হাসবেন, কিন্তু স্ট্যাম্পের ব্যাপারে আমার একটা উইকনেস আছে।”
আমি গম্ভীরভাবে বললাম, “আপনি হাই স্কুলে স্ট্যাম্প জমাতেন- এই তো? না, আমি মোটেই হাসব না। আর প্রমথ যদি হাসার চেষ্টা করে আমরা দু-জনে মিলে ওর মাথায় ডান্ডা মারব।”
“কী যে বলেন স্যার! “
কিছুক্ষণ বাদেই প্রমথ ফিরল। ও কিছুই জানত না। সব কিছু শুনে দেখলাম বেশ উত্তেজিত। বলল, “বলুন, কোথায় যেতে চান, সাঁ করে নিয়ে যাব।
প্রমথর এক বন্ধু তার হন্ডা সিভিক গাড়িটা প্রমথর জিম্মায় রেখে ছুটিতে গেছে। সেই থেকে আমার টয়োটা টারসেলে আর চড়ছে না। আমার গাড়ি নাকি ঘটর ঘটর করে চলে, আর ওর গাড়ি যায় সাঁ করে।
একেনবাবু বললেন, “দাঁড়ান স্যার দাঁড়ান, যাবার আগে কোথায় যাব সেটা তো একটু ভেবে নিই।”
প্রমথ বলল, “আপনি বসে বসে ভাবুন, আর চোর সেই সুযোগে মালসমেত হাওয়া হোক। আপনি মশাই বাপির সঙ্গে বড্ড বেশি মিশছেন। জেমস বন্ডের মুভি দেখেননি! এখন অ্যাকশনের প্রয়োজন, ঘরে বসে বাপির মতো অঙ্ক কষা নয়।”
আমি বললাম, “এই ব্যাটা, তুই আমার পেছনে লাগছিস কেন?”
প্রমথ দেখলাম বেশ মুডে আছে। বলল, “তোরা ভাব, আমি ততক্ষণ রান্না চাপাই। চিকেনের ঝোল আর রাইস। কি বলিস?”
বললাম, “ফাইন।”
“আমি একটু সাহায্য করি স্যার?”
“খেপেছেন! আপনি আমার সর্বনাশ না করে বরং চোরের সর্বনাশ করুন।” একেনবাবু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “প্রমথবাবুকে নিয়ে স্যার পারা গেল না।”
প্রমথ তখন হেমন্তের পুরোনো আধুনিক গান ‘অলির কথা শুনে…’ গাইতে গাইতে আলু-পেঁয়াজ কাটতে শুরু করেছে।
আমরা যখন ডিনার খাচ্ছি তখন ফোনটা এল। শিরো মাৎসুয়োকা নামে এক ভদ্রলোক একেনবাবুর সঙ্গে কথা বলতে চান। একেনবাবু উঠে বারান্দায় গিয়ে কয়েক মিনিট কথা বলে ফিরে আসতে জিজ্ঞেস করলাম, “ভদ্রলোকটি কে? কী চান?”
“তোশির চেনাজানা কেউ হবেন। কী জানি একটা দরকারি কথা আছে, কিন্তু ফোনে বলতে চান না। বললেন কাল সকালে আমরা এক বার ওঁর কাছে আসতে পারব কিনা।”
“হঠাৎ আপনাকে ফোন করলেন যে?”
“পুলিশের কাছে খবর পেয়েছেন স্যার আমরাও চুরিটা নিয়ে ইনভেস্টিগেট করছি। মনে হয় সেই জন্যেই। যাবেন নাকি স্যার?”
“কোথায় থাকেন?”
“ওয়ালডর্ফ অ্যাস্টোরিয়াতে।”
ওয়ালডর্ফ! আমাদের মুখটা হাঁ হয়ে গেল! ওয়ালডর্ফ অ্যাস্টোরিয়া হচ্ছে নিউ ইয়র্কের সবচেয়ে নামিদামি হোটেল। ভদ্রলোক নিঃসন্দেহে দারুণ ধনী!