প্রাইসলেস বুদ্ধ – ৩

ব্রুকশায়ার ফিউনারেল হোম হল লং আইল্যান্ডে-আমার বাড়ির থেকে বেশ অনেকটা দূরে। পৌঁছোতে পৌঁছোতে আমাদের একটু দেরিই হল। তবে দেরি শুধু আমাদেরই হয়নি, তখনও দেখি অনেক লোক আসছে। সবার হাতেই ফুলের তোড়া। আমরাই এসেছি বোকার মতো খালি হাতে। কী আর করা! 

হলঘরে ঢোকার মুখে খোলা একটা বড়ো খাতা, সবাই সেখানে নিজের নাম-ধাম লিখছে। এদেশে সব কিছুরই একটা রেকর্ড রাখা চাই। কী এসে যায় কে এল বা না এল। যাঁর জন্য আমরা এসেছি তিনি তো আর দেখছেন না! আমি এক বার ভাবলাম সই করব না। কিন্তু যে লোকটা খাতার পাশে দাঁড়িয়েছিল, সে পেনটা এগিয়ে দিয়ে এমনভাবে ‘স্যার’ বলল যে তখন না করাটা নিতান্তই অভদ্রতা। 

হলঘরে লোক গিজগিজ করছে। এক প্রান্তে একটা বিশাল টেবিলে তোশির ফোটোর চারপাশে গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল। কফিন-টফিন কোথাও নেই। বাঁচা গেল! সেটাই অবশ্য অনুমান করেছিলাম। মৃত্যুর পর দিন তিনেক না কাটলে সাধারণত কবর বা ক্রিমেশন হয় না। এটা স্মরণসভাই। থমথমে গুরুগম্ভীর আবহাওয়া। এদিক-ওদিক অনেক জাপানি মুখ। তাদের মধ্যে নিশ্চয় তোশির আত্মীয়স্বজনও আছে। আমরা তো কাউকেই চিনি না, কাকেই-বা সান্ত্বনা দেব! 

স্টেজের ঠিক নীচে ঘরের এককোণে একটা ডায়াস। সেখানে এক লালমুখো সাহেব দাঁড়িয়ে টাই ঠিক করছিলেন। তিনিই প্রথমে একটি নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন। মনে হল নিউ ইয়র্ক মিউজিয়ামের কেওকেটা। তোশির অজস্র প্রশংসা করলেন। বললেন, “তোশি শুধু জ্ঞানী ছিলেন না, একজন সমাজ-সচেতন মানুষ ছিলেন। হার্লেমের দুঃস্থ বাচ্চাদের জন্য নিউ ইয়র্ক মিউজিয়ামেই উনি অনেক প্রোগ্রাম চালু করেছিলেন। তোশির অভাব কোনোদিনই পূরণ হবে না—” বার বার কথাগুলো বললেন। শেষে অবশ্য যোগ করলেন, “পৃথিবী থেমে থাকে না। তোশির অসম্পূর্ণ কাজগুলো এখন অন্যদের সম্পূর্ণ করতে হবে…।”

সাহেবের গলার স্বর এত ঘ্যানঘ্যানে আমার ঘুম পাচ্ছিল। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম একেনবাবুর চোখও ঢুলুঢুলু। প্রমথর অবস্থাটা দেখতে যাচ্ছি, তখন চোখে পড়ল আমাদের সামনের সারিতে একেবারে বাঁ-কোনায় বসে আছেন মিস্টার মেহেতা। না, এবার আমার চিনতে এতটুকু সময় লাগল না। 

এরপর ছোটোখাটো দুয়েকটা বক্তৃতা চুকে যাবার পর যখন বের হচ্ছি, তখন দেখি মিস্টার মেহেতাও বেরোচ্ছেন। জিজ্ঞেস করলাম, “চিনতে পারছেন?”

উনি জবাব দিলেন, “কী মুশকিল, কাস্টমারদের না চিনলে আমাদের চলে! আজ খুব ভোর ভোর উঠেছিলেন দেখলাম!”

“তা উঠেছিলাম। আপনিও তো উঠেছিলেন?”

“আমরা ব্যাবসা করি, আমরা কি অত ঘুমোতে পারি!” মিস্টার মেহেতা রহস্য করলেন। 

ইতিমধ্যে সবাই রাস্তায় নেমে এসেছি। প্রমথ জিজ্ঞেস করল, “আপনি তোশিকে চিনলেন কী করে? উনিও কি আপনার কাছ থেকে টিকিট কাটতেন?”

“না,” মাথা নাড়লেন মিস্টার মেহেতা। “ওঁর সঙ্গে আলাপ একটা ব্যাবসার ব্যাপারে।”

“আপনার তো ট্র্যাভেলিং-এর ব্যাবসা জানতাম। অন্য কিছুও আছে নাকি?”

“তা আছে, মিস্টার সমাদ্দার,” মিস্টার মেহেতার মুখে মৃদু হাসি। “আমার একটা স্ট্যাম্পের ডিলারশিপ আছে। মিস্টার নাকাজিমা ছিলেন আমার একজন বড়ো অ্যাডভাইজার। প্রচুর জ্ঞান ছিল ওঁর এই ফিল্ডে।”

“আমিও স্যার স্ট্যাম্প জমাতাম একসময়।”

“তাই নাকি?” মিস্টার মেহেতা একেনবাবুর দিকে তাকালেন। ওঁর চোখে কৌতূহলের থেকে উপেক্ষার ভাবটাই বেশি। একেনবাবুর চেহারা বা ব্যক্তিত্ব— কোনোটাই প্রথম দর্শনে শ্রদ্ধার উদ্রেক করে না। পরিচয় করিয়ে দিলাম, কিন্তু কতটা বিশ্বাস করলেন বুঝলাম না। ভাবলেন নিশ্চয় মজা করছি! 

“ক্লাস টেন অবধি স্যার রেগুলার স্ট্যাম্প জমিয়েছি। স্কটসের ক্যাটালগটাও আমার কাছে ছিল।” একেনবাবু ওঁর বিদ্যে জাহির করতে পেরে ভীষণ খুশি। 

“ওরে বাব্বা, তাহলে তো আপনি সিরিয়াস স্ট্যাম্প কালেক্টর!” মিস্টার মেহেতা বললেন। ওঁর গলায় ঠাট্টার সুর স্পষ্ট। এদেশে যে লোকটা স্ট্যাম্পের ডিলার, সে নিশ্চয় দামি দামি স্ট্যাম্প নিয়ে কারবার করে। স্কুলের ছাত্রদের স্ট্যাম্প জমানোটা তাদের ধর্তব্যের মধ্যেই নয়। কিন্তু একেনবাবুকে সেটা কে বোঝাবে! 

“তা একসময় জমিয়েছি,” মিস্টার মেহেতাকে একেনবাবু বললেন। “মিস্টার নাকাজিমাও যে স্ট্যাম্পের অথরিটি সেটা জানতাম না। জানলে … 

আমি আর থাকতে পারলাম না। বললাম, “চলুন একেনবাবু, ওঁর নিশ্চয় দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

মিস্টার মেহেতা বললেন, “না, না, দেরি কিছু নয়। তবে একদিন আসবেন আপনার বন্ধুকে নিয়ে। ওঁর স্ট্যাম্পে যখন এত ইন্টারেস্ট, আমি কিছু কালেকশন দেখাব।”

মিস্টার মেহেতা চলে যেতেই প্রমথ একেনবাবুকে কড়কাল। “আপনি তো মশাই আচ্ছা যা হোক! লোকটা হচ্ছে স্ট্যাম্পের ডিলার। নির্ঘাত হাজার হাজার ডলারের স্ট্যাম্প নিয়ে কারবার করে। আর আপনি কিনা ওকে আপনার হাই স্কুলের কালেকশনের কথা বলছেন!”

ধমক খেয়েও একেনবাবু চুপ করলেন না। “আমার হাই স্কুলের কালেকশন কিন্তু খুব খারাপ ছিল না, স্যার!”

“থামুন মশাই, আর শুনতে চাই না।”

একেনবাবু এবার আমাকে সাক্ষী মানলেন, “প্রমথবাবু রাগ করছেন, স্যার। কিন্তু আমার একটা স্ট্যাম্প ছিল যেটার দাম স্কটস ক্যাটালগে লেখা ছিল পাঁচশো ডলার। আমি বলছি স্যার কুড়ি বছর আগেকার কথা। এখন নিশ্চয় তার দাম অনেক গুণ বেড়ে গেছে।”

আমি বললাম, “সে কী! অত দামের স্ট্যাম্প আপনার কাছে ছিল, আর আপনি বিক্রি করেননি!”

“তখন তো জানতামই না কাকে বিক্রি করা যায়।”

“এখনও আছে ওটা?”

“আছে স্যার, দেশে গিন্নির ভল্টে।” তারপর একটু থেমে বললেন, “বুঝলেন স্যার, ভালো হল আজ এখানে এলাম।” বলেই বোধহয় একটু লজ্জা পেলেন। “মানে মিস্টার নাকাজিমার মৃত্যুটা খুবই দুঃখের— সেটা বলছি না। কিন্তু এই যে, মিস্টার মেহেতার সঙ্গে পরিচয় হল।”

প্রমথ ওঁকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “মানে আপনার স্ট্যাম্পটা বেচে এবার টু- পাইস বাগাবার সুযোগ পাবেন- এই তো? একেই বলে কারোর পৌষ মাস, কারোর সর্বনাশ!”

“ছি, ছি, স্যার, কী যে বলেন!”

.

আমরা যখন বাড়ি ফিরলাম তখন রাত প্রায় ন’টা। সবাই এত টায়ার্ড যে রান্না করতে ইচ্ছে করল না। প্রমথ বলল, “বহুদিন পিৎজা খাইনি। চল টমিজ-এ যাই।” উত্তম প্রস্তাব। টমিজ ইদানীং একটা ভেজিটেরিয়ান পিৎজা চালু করেছে— মাশরুম, হট পেপার, পেঁয়াজ, আর ব্রকলি দিয়ে। পিৎজাতে মোৎজারেলা চিজ তো থাকবেই। কিন্তু তা ছাড়াও আরও কয়েকটা চিজ মিশিয়ে জিনিসটা যা তৈরি করে-একেবারে বাঘের বাচ্চা টেস্ট! পিৎজা শুনে একেনবাবু অবশ্য একটু ঘ্যানঘ্যান শুরু করেছিলেন। উনি একেবারে ভেতো বাঙালি। কিন্তু শেষমেশ হাল ছেড়ে দিলেন। 

সোমবার ন’টা বলেই বোধহয় টমিজ পিৎজারিয়া একেবারেই ফাঁকা। মালিক টমি টেলিফোনে ইটালিয়ান ভাষায় কারোর সঙ্গে খোশগল্প করছে। আমাদের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে এমনভাবে হাতটা ঘোরাল যার অর্থ যেখানে খুশি বসো। আমরা সাধারণত বসি ডান দিকের শেষ টেবিলটাতে—একেবারে জানলা ঘেঁষে। সেই টেবিলে দেখলাম একজন বসে আছে। অন্ধকারে ঠিক চিনতে পারিনি। প্রমথ বলল, “আরে, ও তো আমাদের সমর।”

সমর উলটো দিকে মুখ করে বসেছিল বলে আমাদের দেখতে পায়নি। প্রমথ ওর ঘাড়টা ধরে ঝাঁকিয়ে বলল, “এই ব্যাটা, একা একা খেতে এসেছিস যে?”

ও চমকে বলল, “আরে তোরা!”

সমরের সঙ্গে প্রমথর খুব দোস্তি। ওরা হল ব্রিজের পার্টনার। একসময় দু-জনে মিলে নানান কম্পিটিশনে খেলতে যেত। আজকাল হয় উৎসাহ কমেছে, নয় আর সময় পায় না। 

“অর্ডার দিয়েছিস?” প্রমথ প্রশ্ন করল। 

“এইমাত্র দিলাম।”

“কী দিলি?”

“তাতে তোর কী?” আমি বিরক্ত হয়ে বললাম। “খাবে তো ও!”

“আঃ, চুপ কর তো! মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ করে খাব। কী দিয়েছিস বল।”

“পেপারোনি।”

“গুড! তাহলে আমরা একটা ভেজিটেরিয়ান, আর একটা সসেজ? কি রে বাপি, আর কিছু লাগবে?”

“না, দুটোই যথেষ্ট।”

“আপনি মশাই চুপ কেন? কিছু সাধ থাকে তো বলে ফেলুন, পরে নইলে পস্তাবেন।”

“কী যে বলেন, স্যার! আপনারা এসব ব্যাপারে এক্সপার্ট।”

ইতিমধ্যে টমির চ্যালা এসে দাঁড়িয়েছে। প্রমথ তাকে অর্ডার দিয়ে সমরকে বলল, “তোশি মারা গেছেন শুনেছিস?”

সমর চমকে বলল, “তোশি? কোন তোশি— তোশি নাকাজিমা?”

“হ্যাঁ। ওর ফিউনারেল থেকেই তো আমরা আসছি।”

“ফিউনারেল নয়, স্মরণসভা।” আমি শুদ্ধ করে দিলাম। 

সমরের মুখ একেবারে হাঁ। বলল, “কী বলছিস যা-তা।”

আমি বললাম, “কালকের নিউ ইয়র্ক টাইমসে তো বড়ো করে বেরিয়েছে- চোখে পড়েনি?”

“কাল যা দিন গেছে, পত্রিকা খোলার সময় পাইনি! আর আজ তো সারাদিন লাইব্রেরিতে। বাট দিস ইজ শকিং- পর পর বিভাসদা, তোশি। কী হয়েছিল জানিস?”

“সুইসাইড,” আমি বললাম। 

“আই কান্ট বিলিভ ইট!”

“তুই তো ওঁকে ভালোই চিনতিস, তাই না?”

“তা চিনতাম। মানে আমি ওঁকে চিনতাম বিভাদোর সূত্রে। ওঁরা খুব বন্ধু ছিলেন।”

“একেই বলে নিয়তি স্যার, দু-জনেই কেমন একসঙ্গে চলে গেলেন।” একেনবাবু স্বগতোক্তি করলেন। 

“আপনি কি এর মধ্যে কোনো যোগ খুঁজে পাচ্ছেন নাকি?” প্রমথ ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল। 

“না, না স্যার। কথার কথা বললাম আর কী!” একেনবাবু থতমত খেয়ে উত্তর দিলেন। 

“উনি সুইসাইড করতে গেলেন কেন?” সমর নিশ্চয় তার উত্তরটা আমাদের কাছ থেকে আশা করে না, তাও প্রশ্নটা করল। 

“হু নোজ! স্মরণসভায় সে নিয়ে তো কিছু শুনিনি।” প্রমথ ঘাড় ঝাঁকাল।

সমরকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তোর সঙ্গে ওঁর লাস্ট দেখা হয়েছিল কবে?”

“এই তো ক’দিন আগে।”

“তখন কেমন ছিলেন উনি, দেখে কি কিছু মনে হয়েছিল… ডিপ্রেশন বা হতাশায় ভুগছেন?”

“একদমই না— বরং উলটো। আমাকে আর বিভাসদাকে টেনে নিয়ে গেলেন এশিয়া সোসাইটিতে ওঁর ছেলেবেলার বন্ধুর আর্ট এক্সিবিশন দেখাতে। যেতে যেতে কত মজার গল্প করলেন।”

“মানুষের কখন যে কী হয় স্যার!” একেনবাবু মন্তব্য করলেন। 

“ওঁর আচরণের মধ্যে সবসময় একটা ছেলেমানুষি ভাব ছিল,” সমর একটু অন্যমনস্কভাবেই বলল। “অথচ কী রেসপন্সিবল পজিশনে ছিলেন! নিজের কাজ ভীষণ ভালোবাসতেন। নেশা আর পেশা এক হয়ে গেলে যা হয় আর কী।”

“পেশায় তো কিউরেটর ছিলেন, নেশাটা কী?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। 

“নেশার জন্যই তো ওঁর ওই পেশা,” সমর উত্তর দিল। “আসলে উনি কম্পিউটার সায়েন্সের লোক ছিলেন। ইনফ্যাক্ট বিভাসদা আর উনি একসঙ্গেই পিএইচডি করেন। কিন্তু ওঁর স্ট্যাম্পের নেশা এত ছিল যে লাইন চেঞ্জ করে খুব অল্প মাইনেতে হিউস্টন বা ডালাসের একটা মিউজিয়ামে ফিলাটেলি সেকশনে কাজ নেন।”

“দ্যাটস স্ট্রেঞ্জ।” প্রমথ বলল। 

“কেন?” সমর জিজ্ঞেস করল। 

“লাইনই যদি চেঞ্জ করবেন, তাহলে অত কষ্ট করে পিএইচডি করলেন কেন?” উত্তরটা আমিই দিলাম, “মানুষের মনে যখন কিছু আসে, তখন অত হিসেব- নিকেশ করে আসে না!”

“শুধু তাই নয়,” সমর বলল, “আমি বরং বলব উনি খুব ভুল পথ বাছেননি। এই নিউ ইয়র্কেই হাজার গণ্ডা কম্পিউটার সায়েন্সের লোক আছে—কে তাদের চেনে? কিন্তু স্ট্যাম্পের জগতে নিউ ইয়র্কে এমন কেউ নেই যে তোশিকে চেনে না।”

“তুই কী করে জানলি?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল। 

“একবার আমি আর বিভাসদা ওঁর সঙ্গে একটা স্ট্যাম্প অকশনে গিয়েছিলাম। ওখানেই দেখলাম বড়ো বড়ো স্ট্যাম্প কালেক্টাররা তোশিকে কত সম্মান করে। দু-এক জন তো অ্যাডভাইস চাইল নিলামে কদ্দূর পর্যন্ত ডাকা উচিত। আর আমি হেঁজিপেঁজি দু-দশ ডলারের স্ট্যাম্প যারা জমায় তাদের কথা বলছি না। নিলামের স্ট্যাম্পগুলোর মধ্যে ধর একটা ছিল বিখ্যাত ইনভার্টেড জেনি এয়ারমেল। 

আমি জীবনে ইনভার্টেড জেনি এয়ারমেলের নাম শুনিনি। তবে সমর এমনভাবে নামটা বলল যে বুঝলাম স্ট্যাম্প জগতের একটি রত্নই হবে। 

“আপনি স্যার মনে হচ্ছে স্ট্যাম্প সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন।” একেনবাবুর কথাটা প্রশ্ন না মন্তব্য ঠিক বোঝা গেল না। 

সমর বলল, “অনেক কিছু জানি বলার স্পর্ধা নেই— তবে এক-আধটা বই পড়েছি।”

সমর হচ্ছে বইয়ের পোকা। হেন জিনিস নেই যা পড়ে না। প্রমথর মতে ও হচ্ছে লিভিং এনসাইক্লোপিডিয়া। 

“আসলে স্যার আমিও একসময় স্ট্যাম্প জমাতাম।”

“আঃ, আবার আপনি হাই স্কুলের স্ট্যাম্প জমানোর কথা শুরু করেছেন!” প্রমথ বিরক্ত হয়ে বলল। 

“তা নয় স্যার, আমি বাপিবাবুকে বলছিলাম আমার কাছে একটা স্ট্যাম্প ছিল, ক্যাটালগে যার দাম দেখেছিলাম পাঁচশো ডলার। আমি স্যার কুড়ি বছর আগেকার কথা বলছি।” তারপর সমরের দিকে তাকিয়ে একেনবাবু প্রশ্নের সুরে বললেন, “এখন নিশ্চয় স্যার ওটাকে বিক্রি করলে দু-তিন হাজার পাব?”

“হয়তো পাবেন,” সমর একটু যেন অন্যমনস্ক 

“হয়তো কেন স্যার, আপনার কি মনে হচ্ছে নাও পেতে পারি?”

সমরের এসব প্রশ্ন সম্ভবত ভালো লাগছে না! দুই পরিচিত জনের মৃত্যুতে মন নিশ্চয় খারাপ। ভাবলাম অন্য কোনো প্রসঙ্গ এনে কথাটা ঘোরাই। তার অবশ্য দরকার হল না। প্রমথ বলল, “চুপ করুন তো মশাই! দু-দুটো লোক ডেড, আর আপনি আপনার দু-পয়সার ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে পাঁচালি পাড়ছেন!”

একেনবাবুর থাবা খেয়ে চুপ করে যাওয়াটা সমরের বোধহয় খারাপ লাগল। বলল, “আমি বলতে চাচ্ছিলাম সব কিছু নির্ভর করছে আপনার স্ট্যাম্প কী অবস্থায় আছে তার ওপর। ক্যাটালগে সাধারণত সুপারফাইন মিন্ট কন্ডিশনে যে স্ট্যাম্পগুলো আছে তার দাম দেওয়া থাকে।”

“মিন্ট কন্ডিশন মানে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। 

“যেটা কোনোদিন ব্যবহার করা হয়নি, অর্থাৎ ক্যানসেলড নয়—ওপরে কোনো পোস্ট অফিসের ছাপ নেই। 

“আর সুপারফাইন?”

“সুপারফাইনের অর্থ স্ট্যাম্পটা একেবারে নিখুঁত অবস্থায় আছে। অর্থাৎ‍ চারদিকের পারফোরেশনগুলো নষ্ট হয়নি। স্ট্যাম্পটা ওয়েল সেন্টারড, মানে তার ছবিটা ঠিক একেবারে মধ্যিখানে বসানো। পেছনের আঠা সম্পূর্ণ অটুট। স্ট্যাম্পে কোনো ভাঁজ নেই, দাগ নেই। যেমনভাবে তৈরি হয়েছিল, ঠিক তেমনভাবেই আছে।”

“আর তা যদি না থাকে? 

“তাহলে দেখতে হবে কন্ডিশন কতটা খারাপ। তার ওপর নির্ভর করবে দাম।”

“দামের কতটা তফাত হতে পারে স্যার?” একেনবাবু প্রশ্ন করলেন। 

“এর সহজ কোনো উত্তর নেই। নির্ভর করছে বাজারে ও ধরনের ক’টা স্ট্যাম্প আছে তার ওপর। ধরুন, সুপারফাইন মিন্ট কন্ডিশনে যে স্ট্যাম্পের দাম হাজার ডলার সেই স্ট্যাম্পই একটু বাজে অবস্থায় হয়তো একশো ডলারে পাওয়া যাবে। ক্যানসেলড—অর্থাৎ পোস্ট অফিসের ছাপ থাকলে হয়তো দশ-কুড়ি ডলারে। অবশ্য কিছু কিছু স্ট্যাম্পের বেলায় মিন্ট আর ক্যানসেলডের মধ্যে অল্পই তফাত, কারণ কোনোটাই সহজলভ্য নয়। সবই হল ডিমান্ড আর সাপ্লাইয়ের প্রশ্ন।”

“আমারটা স্যার মিন্ট কন্ডিশনে নয়,” একেনবাবুর গলাটা মনে হল একটু বিমর্ষ। 

“তার মানেই যে সস্তা তা নয়।” সমর একটু সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল। “আপনার কাছে স্ট্যাম্পটা আছে?”

“না, স্যার।”

“থাকলে কোনো ডিলারের কাছে নিয়ে যেতে পারতেন- নিউ ইয়র্কে বহু স্ট্যাম্প ডিলার আছে। মোটামুটি আইডিয়া পেতেন।”

“আজকেই একজন স্ট্যাম্প ডিলারের সঙ্গে আলাপ হল স্যার, মিস্টার 

মেহেতা। চেনেন নাকি ওঁকে?”

“নিশ্চয়। ওঁর তো একটা ট্র্যাভেল এজেন্সিও আছে।”

“উনি কি রিলায়েবল লোক স্যার? মানে আপনি যতটুকু জানেন?”

“আমার কোনো ধারণাই নেই। তোশি আজ বেঁচে থাকলে আপনাকে বলতে  পারতেন।”