প্রাইসলেস বুদ্ধ – ২

সোমবার সকালে ঘুম ভেঙে গেল খুব ভোরে। আমার কাছে খুব ভোর মানে অবশ্য পাঁচটা। বরাবরই আমি একটু ঘুমকাতুরে, আটটা-ন’টার আগে সাধারণত উঠি না। সেই জন্যই চেষ্টা করি দুপুরের ক্লাসগুলো নিতে, যাতে শুধু আটটা-ন’টা কেন, ইচ্ছে করলে আরও কয়েক ঘণ্টা আরাম করে বিছানায় গড়াতে পারি। 

ঘড়িতে পাঁচটা দেখে আমি আবার চোখ বোজার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুতেই ঘুম এল না। এত ভোর, কিন্তু জুন মাস বলে বাইরে যথেষ্ট আলো। ইতিমধ্যেই বেশ কর্মব্যস্ততা শুরু হয়েছে! হাত-মুখ ধুয়ে কফি বানাতে গিয়ে দেখি বাড়িতে দুধ নেই। সকালে এক কাপ কফি না হলে আবার ভীষণ মাথা ধরে যায়। প্রমথর মতে এটা সাইকোলজিক্যাল। ওর সঙ্গে তর্ক করার অর্থ হয় না, একই কথা সাত বার রিপিট করবে। কারণ যাই হোক, মাথা ধরাটা তো মিথ্যে নয়! নাঃ, কফি আমাকে খেতেই হবে। নীচে প্রমথর কাছে নিশ্চয় দুধ পাওয়া যাবে। প্রমথ আর একেনবাবু থাকেন আমার ঠিক নীচের অ্যাপার্টমেন্টে। ওদের অ্যাপার্টমেন্টের ডুপ্লিকেট চাবিটা আমার কাছে থাকে। আমার অ্যাপার্টমেন্টের চাবিও ওদের দিয়েছি। বলতে গেলে দুটো অ্যাপার্টমেন্টকেই আমরা একটা বাড়ি হিসেবে ব্যবহার করি, রান্না-খাওয়া সবসময় একসঙ্গেই হয়। 

কিন্তু চাবি খুঁজতে গিয়ে মনে পড়ে গেল, কাল রাতে ওদের ওখানেই আমার চাবিগুলো সব ফেলে এসেছি। এত আচ্ছা ফ্যাসাদ হল! ওরা যদিও সাধারণত আমার থেকে আগে ওঠে, কিন্তু এত সকালে নিশ্চয় ওঠেনি। বেল বাজিয়ে ঘুম ভাঙানো যেতে পারে অবশ্য। একেনবাবু তাতে মাইন্ড করবেন না। কিন্তু প্রমথ গাল দিয়ে আমার ভূত ভাগিয়ে ছেড়ে দেবে। বিশেষ করে যখন শুনবে যে আমার সাইকোলজিক্যাল প্রবলেম কফির জন্য ওর ঘুম ভাঙিয়েছি। 

কী আর করা। দুধ ছাড়াই এক কাপ কফি খেলাম। কিন্তু ঠিক জুত হল না। মোড়ের মাথায় টমির পিৎজার ঠিক পাশে একটা গ্রোসারি স্টোর আছে চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকে। সেখান থেকে পারতপক্ষে কিছু কিনি না, সব কিছুর গলাকাটা দর। নিরুপায় হয়ে আজ সেখানেই গেলাম। দরজাটা খোলা রেখে যেতে হল, চাবি নেই। তবে এই ভোরে কে আর চুরি করতে আসবে! চোরেরা নিশ্চয় নাইট ডিউটি দিয়ে এখন শুয়ে পড়েছে। 

মাত্র সাড়ে পাঁচটা। কিন্তু তাও দেখলাম দোকানে বেশ কয়েক জন খরিদ্দার। নিউ ইয়র্কের লোকরা কি ঘুমোয় না? দুধ কিনলাম। একটা ট্রে-তে কতগুলো চকোলেট ক্রোসাঁ সাজানো ছিল। চকোলেট ক্রোসাঁ হচ্ছে মুচমুচে রুটি আর ভেতরে চকোলেটের পুর। চকোলেট আমার দারুণ প্রিয়। লোভে পড়ে তারও দুটি কিনলাম। দাম মিটিয়ে বেরিয়ে আসছি, দেখি একজন ভারতীয় ভদ্রলোক ব্যস্ত হয়ে ঢুকছেন। কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখাচোখি হল। চেনা চেনা মুখ, কিন্তু মনে করতে পারলাম না কে। আমার দিকে তাকিয়ে ‘হায়’ বললেন। আমিও বললাম ‘হায়।” এদেশে অবশ্য চেনা-অচেনা সবাইকে ‘হায়’ বলা যায়। উনি যে আমাকে চেনেন- সেটা নাও হতে পারে। তবু চেনা চেনা লাগা সত্ত্বেও কাউকে না চিনতে পারলে আমার ভারি অস্বস্তি হয়। সারাটা পথ ভাবতে ভাবতে এলাম। বাড়িতে যখন ঢুকছি তখন নামটা মনে পড়ল। আরে, উনি তো মিস্টার মেহেতা! ভদ্রলোক একজন ট্র্যাভেল এজেন্ট, আমাদের বাড়ি থেকে কয়েক ব্লক দূরেই ওঁর এজেন্সি। গত ডিসেম্বরেই ওঁর ওখানে গিয়েছিলাম প্রমথর টিকিটের ব্যাপারে। ডিসেম্বর মাসে হঠাৎ করে দেশে যাবার টিকিট পাওয়া যায় না। অনেক ঝামেলা করে উনি প্রমথকে টিকিট পাইয়ে দিয়েছিলেন। 

অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকেই এক বার ঘুরে ঘুরে দেখে নিলাম সব কিছু ঠিকঠাক আছে কিনা। এভাবে দরজা লক না করে তো কোথাও আগে যাইনি! ইন্সপেকশন শেষ করে কফি বানিয়ে রোববারের নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর লেট এডিশন নিয়ে বসলাম। কালকে হুড়োহুড়ির মধ্যে অর্ধেকও পড়া হয়নি! হঠাৎ খেয়াল হল শনিবার রাত্রে যখন আগুন লেগেছে, তখন বিভাস চৌধুরীর খবর নিশ্চয় থাকবে। বেশ খানিকক্ষণ খুঁজে খবরটা চোখে পড়ল। মাত্র কয়েক লাইন। নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির একজন অধ্যাপক মারা গেছেন উল্লেখ আছে। কিন্তু নাম-ধাম কিছু নেই, ধরে নিচ্ছি পুলিশ তখনও নিকট আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করে উঠতে পারেনি। আমার অবশ্য মনে হল এক্ষেত্রে নাম গোপন রাখা অর্থহীন। অনেকেই তো আমরা জানি মৃত অধ্যাপক কে 

বিভাস চৌধুরীর নাম নেই ঠিকই, কিন্তু আরেকটা নাম চোখে পড়ল যাঁকে আমি চিনি। খবরটাও বেশ বড়ো করে ছাপানো হয়েছে। নিউ ইয়র্ক মিউজিয়ামের অ্যাসিস্ট্যান্ট কিউরেটর তোশি নাকাজিমা আত্মহত্যা করেছেন। যোগাযোগটা একটু অদ্ভুত, কারণ তোশিকে আমি প্রথম দেখি বিভাস চৌধুরীর ঘরে। শুনেছিলাম ওঁরা দু-জনেই নাকি এক সময় বার্কলেতে পড়তেন। বার্কলে হল ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার একটা বিখ্যাত ক্যাম্পাস। তোশির সঙ্গে এর পরে অবশ্য আমার অনেক বারই দেখা হয়েছে। এত বড়ো কাজ করেন, নামিদামি লোকদের সঙ্গে দহরম-মহরম, কিন্তু ভারি মিশুকে ও ভদ্র। একবার আমি আর প্রমথ একেনবাবুকে নিয়ে নিউ ইয়র্ক মিউজিয়ামে গিয়েছিলাম। মিউজিয়ামে একেনবাবু সঙ্গে থাকা মানে একটা টর্চার। অফুরন্ত মাল্টি-ডিরেকশানাল কোয়েশ্চেন, একবার এটা, একবার সেটা- যার মাথামুণ্ডু কিছুই নেই। তোশি যে শুধু আমাদের সঙ্গে সারাক্ষণ ছিলেন তা নয়, একেনবাবুর সব প্রশ্নের উত্তর ঠান্ডা মাথায় দিয়ে গিয়েছিলেন। একেনবাবু একেবারে মুগ্ধ। ওঁর অবশ্য অল্পেতেই মুগ্ধ হবার হ্যাবিট আছে! ফেরার পথে বলেছিলেন, “জ্ঞানের পাহাড় স্যার, আর কী বিনয়ী!” 

আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খবরটা পড়লাম। কেন আত্মহত্যা করেছেন মোটেই পরিষ্কার নয়। লং আইল্যান্ডে ওঁর বাড়ির ল্যান্ডলেডি ডরোথি স্মিথ নাকি তোশিকে শনিবার রাত বারোটা নাগাদ ফিরতে দেখেন। ডরোথি স্মিথ এক তলায় থাকেন, তোশি দোতলায়। ডরোথি তাঁর অতিথিদের বিদায় জানাতে দরজা খুলে কথা বলছিলেন, তখন তোশিকে দেখেন সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠছেন। তোশির আচরণ ওঁর একটু অদ্ভুত লাগে, কারণ অন্য সময় দেখা হলে উনি সবসময় হাসেন, মাথা ঝুঁকিয়ে বাও করে ‘হায়’ বলেন। ওই দিন কোনো কথা না বলে উঠে যান। তোশির মুখ দেখে ডরোথির মনে হয় কোনো কারণে উনি খুব বিচলিত। যাই হোক, অতিথিরা চলে যাবার পর মিনিট পাঁচেকও হয়নি, ওপর থেকে ডরোথি একটা শব্দ শোনেন। ওঁর মনে হয় গুলির শব্দ, আর সঙ্গে সঙ্গে পুলিশে ফোন করেন। পুলিশ যে রিভলবারটা ঘরে পেয়েছে সেটা নাকি তোশিরই। পুলিশের সন্দেহ এটা সুইসাইড। মূল খবর এইটুকুই। এছাড়া তোশির একটা ছোট্ট জীবনী ছাপা হয়েছে, সেইসঙ্গে নিউ ইয়র্কের জাপান অ্যাসোসিয়েশন সোমবার বিকেল ছ’টায় ব্রুকশায়ার ফিউনারেল হোমে স্মরণসভার আয়োজন করেছে তার ঘোষণা। এত তাড়াতাড়ি? অবাকই লাগল! 

জীবনীটা চট করে পড়ে নিলাম। জাপান থেকে বার্কলেতে এসেছিলেন পড়াশুনো করতে। পড়াশুনো শেষ করে কিছুদিন অধ্যাপনা করেন, তারপর নিউ ইয়র্ক মিউজিয়ামে যোগ দেন। নিউ ইয়র্ক মিউজিয়ামে উনি নাকি ফিলাটেলি সেকশনের হেড ছিলেন। বড়ো কাজ করতেন জানতাম, কিন্তু এটা জানতাম না। খবরটা শেষ হয়েছে ওঁর শান্ত ও মধুর ব্যবহারের প্রশংসা করে। এটা ওঁকে যারা একবার দেখেছে তারাই জানবে। এরকম ধীর-স্থির ঠান্ডা মাথার একজন লোক হঠাৎ কেন আত্মহত্যা করলেন সেটাই প্রশ্ন। মানুষের মনের মধ্যে কী চলছে বুঝতে পারা এত কঠিন! বাইরে থেকে দেখে কারোর সম্পর্কে একটা ধারণা করি, মুহূর্তের মধ্যে সেই ধারণা কীরকম ভেঙে চুরমার হয়ে যায়! 

.

আটটা নাগাদ একেনবাবু আর প্রমথ ওপরে এল। প্রমথর মুখ অত্যন্ত ব্যাজার। প্রতি সোমবারই এটা হয়। দু-দিন ছুটির পর আবার কাজ করতে যেতে হবে বলে সোমবার হচ্ছে ওর ‘হেল-ডে’। ওদের তোশির খবরটা দিতেই একেনবাবু বললেন, “মাই গুডনেস স্যার, ওরকম একজন শান্ত-মাথা পণ্ডিত লোক খামোখা সুইসাইড করতে গেলেন কেন?” 

একেনবাবু বোধহয় আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, প্রমথ খ্যাঁকখেঁকিয়ে উঠল, “কেন মশাই, সুইসাইড কি শুধু মাথা-গরম মূর্খরাই করে?” তারপর আমায় জিজ্ঞেস করল, “তুই খবরটা পেলি কোত্থেকে?” 

ওদের নিউ ইয়র্ক টাইমসটা দেখালাম। নিঃশব্দে নিউজটা পড়ে দু-জনের উদ্দেশেই একেনবাবু বললেন, “কি স্যার, ফিউনারেলে যাবেন নাকি?” 

“ধ্যেত, কবর-ফবরের মধ্যে আমি নেই,” বলতে বলতে কুকি-জার খুলে প্রমথ একটা কুকি মুখে পুরল। 

“কবরের প্রশ্ন আসছে কোত্থেকে? লেখা আছে স্মরণসভা। তা ছাড়া তোশি তো খ্রিশ্চান নয়, নিশ্চয় বৌদ্ধ বা শিন্টো-ফিন্টো কিছু হবে।” বললাম বটে, কিন্তু শিন্টো সম্প্রদায়ের কেউ মারা গেলে কী করা হয় আমার কোনো ধারণাই নেই। 

“চলুন স্যার। চেনাজানা মানুষ, তার ওপর উনি হচ্ছেন এশিয়ান!” 

একেনবাবু এমনিতে বাঙালি দি গ্রেট। কিন্তু আজকাল দেখি খুব ‘আমরা এশিয়ান, আমরা এশিয়ান’ করেন। ঠিক হল বিকেলে আমরা সবাই যাব। প্রমথ শুধু ঘোষণা করল, “ফিউনারেল হচ্ছে দেখলে কিন্তু ব্যাক করব, আগে থেকেই তোদের বলে দিচ্ছি।” 

প্রমথ ডেডবডি দেখতে ভালোবাসে না। আমিও যে বাসি তা নয়। এদেশে আবার ফিউনারেল হোমে ডেডবডিতে সুগন্ধ ঢেলে, রংচং মাখিয়ে এমনভাবে সাজিয়ে রাখে মনে হবে জীবন্ত — শুধু ঘুমিয়ে আছে। এই ব্যাপারটাকে এদেশে ‘এমবাম’ করা বলে, যাতে দাহ বা সমাধির আগে মৃতের পুরোনো রূপটা শেষ বারের মতো সবাই দেখে যেতে পারে। কেন জানি না, মরদেহটাকে ওভাবে সাজিয়ে সবাইকে দেখানো 

আমার একদম পছন্দ হয় না।