১১
আমরা বাড়ি ফেরার মিনিট দশেকের মধ্যেই একেনবাবু ফিরলেন।
“আমি সম্পূর্ণ কনফিউজড। ব্যাপারটা পরিষ্কার করে বলুন তো। কী করে আপনি বুঝলেন বিভাস চৌধুরীর মৃত্যুর সঙ্গে প্রাইসলেস বুদ্ধের যোগাযোগ আছে?”
প্রমথও সায় দিল। কিন্তু সেইসঙ্গে একটা খোঁচা দিতে ভুলল না। “পয়েন্টগুলো একটু সহজ করে বুঝিয়ে বলবেন যাতে বাপির মাথায় ঢোকে। নইলে পরে লেখার সময় ও উলটোপালটা করে ফেলবে।”
“কী যে বলেন স্যার, প্রফেসর মানুষ!”
“প্রফেসর হয়েছে বলে কি দিগ্গজ হতে হবে নাকি! যাক সে-কথা, এবার বলুন তো চটপট।”
একেনবাবু শুরু করলেন। “একটা জিনিস স্পষ্ট স্যার, মিস্টার তোশির মতো ভদ্রলোক প্রাইসলেস বুদ্ধ চুরি করবেন না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে উনি স্ট্যাম্পটা মিউজিয়াম থেকে সরাননি।”
“তার মানে?”
“বলছি স্যার। মিস্টার মাৎসুয়োকা মিস্টার তোশিকে প্রাইসলেস বুদ্ধের একটা কপি সোমবারের মধ্যে জোগাড় করে দিতে বলেছিলেন। মিস্টার তোশি খবর পেয়েছিলেন মিস্টার মেহেতার কাছে স্ট্যাম্পের একটা কপি আছে। প্রশ্ন হচ্ছে সেটা আসল না নকল। আসল বা নকল ধরার একমাত্র উপায় হচ্ছে জানা আসল স্ট্যাম্পের সঙ্গে সেটাকে মিলিয়ে দেখা। ঠিক কিনা স্যার?”
“রাইট,” প্রমথ বলল।
আমি বুঝলাম একেনবাবু কোনদিকে এগোচ্ছেন। “তার মানে কি আপনি বলতে চান মিস্টার মেহেতার স্ট্যাম্পটা মিলিয়ে দেখার জন্য মিউজিয়াম থেকে প্রাইসলেস বুদ্ধ কাউকে না জানিয়েই নিয়ে এসেছিলেন তোশি? কিন্তু সেটা তো বেআইনি। তোশি কেন সেটা করতে গেলেন?”
“আমারও সেটা মনে হয়েছিল স্যার। কিন্তু মিস্টার তোশির দিকটা বিবেচনা করুন। উনি মিস্টার মাৎসুয়োকাকে বাবার মতো ভক্তি করেন। তাঁর অনুরোধ মিস্টার তোশির কাছে দেবতার আদেশ, সেটা ওঁকে রাখতেই হবে। আর এটা তো ঠিক চুরি করা নয়। মিস্টার তোশি শনিবার সন্ধ্যায় প্রাইসলেস বুদ্ধকে গোপনে মিউজিয়াম থেকে বার করে আনবেন ঠিকই, কিন্তু রাত্রে মিস্টার মেহেতার স্ট্যাম্পটা মেলানো হয়ে গেলেই তো পরদিন মিউজিয়াম খোলার আগেই যথাস্থানে ওটা রেখে আসবেন! কার কী এসে যাচ্ছে তাতে?”
“বুঝলাম, তারপর?”
“তার পরের খবর আমরা সবাই জানি স্যার। শনিবার রাত্রে মিস্টার তোশি হঠাৎ আত্মহত্যা করলেন। কারণটা কী হতে পারে? প্রাইসলেস বুদ্ধ-কে কি কোনো কারণে উনি হারিয়েছিলেন? সেক্ষেত্রে পরদিন সকালে স্ট্যাম্পটাকে স্বস্থানে রেখে দিতে পারবেন না! এই নিয়ে তদন্ত হবে এবং দোষটা ওঁর ওপরেই পড়বে। চুরির অপবাদ মাথা পেতে নেওয়ার থেকে আত্মহত্যার পথটাই উনি বাছলেন। কিন্তু এটা ভেবেই আমার মনে হল কী করে প্রাইসলেস বুদ্ধ-কে উনি হারালেন? তখনই সম্ভাবনাটা মাথায় এল। মনে আছে স্যার, মিস্টার মাৎসুয়োকা বলেছিলেন, এই স্ট্যাম্পে অনেক সূক্ষ্ম আঁচড়, তার কোনটা ঠিক মিলছে না ধরতে পারা মোটেই সহজ ব্যাপার নয়। কিন্তু মানুষের চোখ যেটা সহজে ধরতে পারে না, কম্পিউটার সেটা পারে স্যার। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ল মিস্টার বিভাস চৌধুরীর কথা। বাপিবাবু, আপনিই তো বলেছিলেন উনি কম্পিউটার দিয়ে কঠিন কঠিন প্যাটার্ন মেলাতে পারেন, তাই না?”
“দ্যাটস ট্রু।”
“এটা মনে আসার পর থেকেই জটগুলো সব খুলতে শুরু করল। আমি ঘটনাগুলোকে পরপর সাজালাম। মিস্টার তোশি নিশ্চয় বন্ধু বিভাস চৌধুরীকে ধরেছিলেন সাহায্য করার জন্য। মিস্টার তোশি নিজে স্ট্যাম্প চেনার জহুরি ঠিকই, কিন্তু সেইসঙ্গে যদি কম্পিউটারেরও সাহায্য পাওয়া যায়, তাহলে অনেক বেশি নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। বন্ধুর অনুরোধে বিভাসবাবু শেষ মুহূর্তে বাইরে যাবার প্ল্যান পালটালেন। এসব জিনিস অবশ্য একটু গোপনেই করতে হবে। কিন্তু তাতে অসুবিধে নেই। আমার মনে পড়ে গেল সমরবাবু বলেছিলেন বিভাস চৌধুরীর বাড়িতেই কম্পিউটারের সব গ্যাজেট থাকত। মিস্টার মেহেতা যখন শুনলেন শুধু মিস্টার তোশি নন, কম্পিউটারও ব্যবহার করা হবে ওঁর স্ট্যাম্পটা যাচাই করার জন্য, তখন তিনি দারুণ ঘাবড়ালেন। ওঁর স্ট্যাম্পটা যে জাল ছিল আমার কোনো সন্দেহ নেই। তবে উনি বোধহয় ভেবেছিলেন চোখের পরীক্ষায় ওটা উতরে যাবে। কিন্তু এখন তো মহা সমস্যা হল। ওঁর জালজোচ্চুরি সব ধরা পড়ে যাবে। আর যাবে এমন একজনের কাছে যাঁর কথায় বড়ো বড়ো স্ট্যাম্প ডিলাররা ওঠে-বসে! উনি নিজে স্ট্যাম্প নিয়ে কারবার করেন, ওঁর কাছে এটা বাস্তবিকই জীবন-মরণ সমস্যা।
আটটা নাগাদ ওঁর জাল স্ট্যাম্পটা নিয়ে বিভাস চৌধুরীর কাছে যাবার কথা ছিল। মিস্টার তোশিও ওই সময়েই আসবেন। কম্পিউটারে দুটো স্ট্যাম্প পরীক্ষা করে মেলাতে বেশি সময় লাগার কথা নয়। টেস্ট রেজাল্ট পজিটিভ হলে, দরদাম নিয়ে কথা হবে। মিস্টার মেহেতা চট করে তাঁর প্ল্যান ঠিক করলেন। মিস্টার বিভাস চৌধুরীকে আটটার একটু আগেই ফোন করে বললেন মিস্টার তোশি আসামাত্র তাঁকে কোবাই রেস্টুরেন্টে পাঠিয়ে দিতে। ঠিক কী অজুহাত দিয়েছিলেন সেটা আন-ইম্পর্টেন্ট। মিস্টার তোশির কোবাইয়ে যাওয়া আর ফিরে আসার মধ্যে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময়। ওই সময়টুকু মিস্টার মেহেতার দরকার ছিল। ধরে নিচ্ছি মিস্টার তোশি কোবাই রেস্টুরেন্টে যাবার আগে মিউজিয়ামের স্ট্যাম্পটা ওঁর বিশেষ বন্ধু বিভাসবাবুর কাছে রেখে গিয়েছিলেন কম্পিউটারে স্ক্যান করে রাখার জন্যে। পরে যাতে মিস্টার মেহেতার স্ট্যাম্পের সঙ্গে ওটা ম্যাচ করানো যায়। মিস্টার তোশি বেরিয়ে যাবার কিছুক্ষণ বাদে মিস্টার মেহেতা ওঁর নকল স্ট্যাম্পটা নিয়ে মিস্টার বিভাস চৌধুরীর কাছে গেলেন। বিভাসবাবুকে স্ট্যাম্পটা দিয়ে মিস্টার মেহেতা মিস্টার তোশির স্ট্যাম্পটা দেখতে চাইলেন। অতি সাধারণ একটা অনুরোধ। মিস্টার চৌধুরী সেটা বার করে দেখালেন। সেটাকে হস্তগত করে মিস্টার মেহেতা মিস্টার চৌধুরীকে খুন করলেন…।”
“কীভাবে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“আমার বিশ্বাস গলায় ফাঁস লাগিয়ে স্যার, সেটাই সহজ পথ।”
“মাই গড।”
“লাভ-লোকসানের জন্য মানুষ কী নিদারুণ হিংস্র অমানুষ হতে পারে স্যার কল্পনা করাও কঠিন! যাই হোক, খুন করার পর মিস্টার মেহেতা নিজের নকল স্ট্যাম্পটা ওখানে রেখে মিস্টার তোশির আনা আসল স্ট্যাম্পটা নিয়ে বেরিয়ে এলেন। …”
“বেরিয়ে এসে আগুনটা লাগান, তাই তো?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“সেটাই আমার ধারণা স্যার।”
“বুঝলাম না, আগুনই যদি লাগালেন… তাহলে ওঁর জাল স্ট্যাম্পটা ওখানে রেখে আসার লজিকটা কী?” প্রমথ প্রশ্ন তুলল।
“এটা আমার থিয়োরি স্যার… ফায়ার ব্রিগেড যদি দ্রুত আগুন নিভিয়ে ফেলত, তাহলে ওই স্ট্যাম্পটা পুলিশ দেখতে পেত। তারা বুঝত না, ওটা আসল না নকল। এমনকী মিস্টার তোশিও হয়তো বুঝতে পারতেন না। মিস্টার মেহেতা সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকতেন।”
“এখন মনে হয় বুঝতে পারছি ব্যাপারটা,” আমি বললাম। “আগুন তো দ্রুত নেভেনি… আর মিস্টার তোশি রাত্রে কোবাই থেকে বিভাস চৌধুরীর বাড়িতে এসে যখন পোড়া বাড়িটা দেখলেন, বুঝতে পারলেন প্রাইসলেস বুদ্ধ আর নেই! ভগ্নহৃদয়ে বাড়ি ফিরে গিয়ে আত্মসম্মান রক্ষা করতে নিজেকে হত্যা করলেন। ঠিক কিনা?”
“আপনারা তো সব সময়েই ঠিক বলেন স্যার।”
.
এখানে একটু যোগ করতে হবে, একেনবাবুর প্রাইসলেস বুদ্ধের রহস্য উদ্ঘাটন পুরোপুরি নির্ভুল নয়। মিস্টার মেহেতা খুনি হতে পারেন, কিন্তু আর্সেনিস্ট নন। আগুন যে লোকটা লাগিয়েছিল তাঁর সঙ্গে মিস্টার মেহেতার কোনো সম্পর্কই ছিল না। আর যেহেতু পুরো বাড়িটাই পুড়ে গেছে, জাল স্ট্যাম্পটা ওখানে না রেখে এলেও চলত। তাতে অবশ্য মিস্টার মেহেতার লাভ কিছুই হত না। উনি এখন খুনের আসামি হয়ে জেলে। ওঁর নিজের স্বীকারোক্তি, ভল্ট থেকে উদ্ধার হওয়া মিউজিয়ামের প্রাইসলেস বুদ্ধ, ওঁর করা বা পাওয়া ফোন কলের রেকর্ড ইত্যাদি, ইত্যাদি… সব কিছুই গেছে ওঁর বিপক্ষে।
প্রমথর মতে আর্সনিস্টের পরিচয় বার করতে ভুল করে একেনবাবু এই কেসে একশোতে একশো পাননি, সত্তর পেয়েছেন। একেনবাবু অবশ্য খুশি, “পাশ তো করেছি স্যার।”