প্রাইসলেস বুদ্ধ – ১০

১০

মিস্টার মেহেতা ফাইল ক্যাবিনেট খুলে কীসব জানি ঘাঁটছিলেন। আমাদের দেখে খুবই অবাক। “কী ব্যাপার?”

“আসলে স্যার এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, “ ঘাড়টা বাঁ-হাত দিয়ে ঘষতে ঘষতে একেনবাবু বললেন। “হঠাৎ একটা প্রশ্ন মনে এল। ভাবলাম আপনার কাছে এসে একটু ক্লিয়ার করেই যাই। খুব ডিস্টার্ব করলাম কি স্যার?”

ফাইল ক্যাবিনেটটা আস্তে করে বন্ধ করলেন মিস্টার মেহেতা। “আমাকে এক জায়গায় যেতে হবে মিস্টার সেন, আজ একটু তাড়া আছে।”

“জানি স্যার, আপনি হচ্ছেন বিজি ম্যান। আমি একদম সময় নেব না।” বলে একেনবাবু ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। 

মুখে খালি ‘স্যার’ ‘স্যার’ করলে কী হবে, কার্টসি বস্তুটা যে কী সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই একেনবাবুর নেই। থাকলে হুট করে এভাবে মিস্টার মেহেতার এখানে আসতেন না, আর এরকম অভ্যর্থনা পাওয়ার পর দুম করে এভাবে বসতেন না। বলা বাহুল্য, আমি আর প্রমথ দাঁড়িয়ে রইলাম। 

ডেস্কের ওপর দু-একটা কাগজ পড়েছিল। সেগুলোকে প্রথমে ড্রয়ারে ঢুকিয়ে চাবি লাগিয়ে ড্রয়ারটা বন্ধ হয়েছে কিনা পরীক্ষা করলেন মিস্টার মেহেতা। তারপর রিস্টওয়াচটার দিকে এক পলক তাকিয়ে মিস্টার মেহেতা বললেন, “আমার হাতে কিন্তু পাঁচ মিনিটেরও কম সময়। বলুন কী জানতে চান?”

একেনবাবু আধবোজা চোখে, কড়ে আঙুল দিয়ে কান খোঁচাতে খোঁচাতে বললেন, “সেদিন আপনি বলেছিলেন স্যার, শনিবার সন্ধ্যায় মিস্টার তোশির এখানে আসার কথা ছিল প্রাইসলেস বুদ্ধটা কেনার ব্যাপারে। ঠিক কিনা?”

“হ্যাঁ বলেছিলাম।” উত্তরটা দিয়ে মিস্টার মেহেতা আমার আর প্রমথর দিকে তাকালেন, ভাবটা এ কোথাকার উন্মাদ! 

‘ক’টার সময় ওঁর আসার কথা ছিল স্যার?”

“মিস্টার সেন, আপনি এই এক প্রশ্ন আমাকে অন্তত দু-বার আগে করেছেন। দু-বারই আপনাকে আমি উত্তরটা দিয়েছি। আপনি কি আশা করছেন এবার আপনাকে আমি অন্য কোনো উত্তর দেব?”

“না, না, তা নয় স্যার। আসলে কতগুলো জিনিস নিয়ে আমার একটু খটকা লাগছে।”

“যেমন?”

“চট করে ঠিক বোঝাতে পারব না স্যার। কিন্তু মিস্টার তোশির এই আত্মহত্যাটা আমাকে বড়ো ফাঁপরে ফেলেছে।”

“কেন মিস্টার সেন, মানুষ কি আত্মহত্যা করে না?” একেনবাবুর চোখে চোখ রেখে মিস্টার মেহেতা প্রশ্নটা করলেন। 

“না না, তা কেন স্যার, নিশ্চয় করে।”

“তাহলে আপনার সমস্যাটা কোথায়? আপনার কি ধারণা তোশি মানুষ নয়?”

“আমি বুঝতে পারছি স্যার, আপনি কী বলছেন।” একেনবাবু একটু কাঁচুমাচু হয়ে বললেন। 

“না, আপনি বুঝতে পারছেন না।” গলাটা বেশ কঠোর করে বললেন মিস্টার মেহেতা। “বুঝতে পারলে একটা সাধারণ আত্মহত্যাকে আপনি ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস বানিয়ে তুলতেন না। আপনি নিজের সময় নষ্ট করছেন, তার থেকেও বড়ো কথা আমার সময় নষ্ট করছেন।”

“আই অ্যাম সরি স্যার।” কথাটা একেনবাবু বললেন বটে কিন্তু চেয়ার থেকে উঠলেন না। বরং আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বসুন না স্যার, দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”

প্রমথ বোধহয় যাচ্ছেতাই কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। আমি চোখ পাকিয়ে ওকে সামলালাম। 

“আপনি যদি আরেকটু ধৈর্য ধরেন স্যার, আমার মাত্র কয়েকটা প্রশ্ন‍ই বাকি আছে।” মিস্টার মেহেতাকে বললেন একেনবাবু। 

এরপরও যে একেনবাবুর কোনো প্রশ্ন বাকি থাকবে মিস্টার মেহেতা সেটা বোধহয় কল্পনাও করেননি। একেনবাবুর দিকে এক ঝলক তাকিয়ে কোনো কথা না বলে দেয়ালে বসানো ভল্টটার দিকে এগিয়ে গেলেন। 

“প্রশ্নগুলো করি স্যার? কথা দিচ্ছি, জাস্ট দু-মিনিট।”

হাতল ঘুরিয়ে ভল্টটা ঠিকমতো বন্ধ কিনা পরীক্ষা করতে করতে নীরস গলায় মিস্টার মেহেতা বললেন, “করুন।”

“থ্যাংক ইউ স্যার,” একেনবাবু বললেন। “হ্যাঁ, যেটা নিয়ে কথা হচ্ছিল….. আমার এখন বেশ মনে পড়ছে আপনি বলেছিলেন মিস্টার তোশির আটটা নাগাদ এখানে আসার কথা ছিল। কিন্তু আপনি এও বলেছিলেন, আটটার একটু আগে দোকানে এসে আপনি অ্যানসারিং মেশিনে একটা মেসেজ পান যে উনি এখানে না এসে কোবাইয়ে যাচ্ছেন। কোবাইয়ে যাবার ডিরেকশনটাও উনি আপনার জন্য রেখেছিলেন।”

“দ্যাটস রাইট।” মিস্টার মেহেতা ফিরে এসে ওঁর ডেস্কে ঠেসান দিয়ে কথাটা বললেন। 

“আপনি আরও বলেছিলেন স্যার, উনি একটাই মেসেজ রেখেছিলেন।”

“সেটা আমি এখনও বলছি।”

“আপনি কি স্যার আপনার অ্যানসারিং মেশিনটা পালটেছেন বা ওটাতে কিছু চেঞ্জ করেছেন?”

একেনবাবুর কি মাথাখারাপ হল? এবার শুধু মিস্টার মেহেতা নয়, আমি আর প্রমথও অবাক হয়ে ওঁর দিকে তাকিয়ে আছি। 

“না, কিন্তু তাতে আপনার কোনো আপত্তি আছে?” মিস্টার মেহেতার গলায় শ্লেষের ভাবটা পরিষ্কার। 

“না স্যার। তবে কিনা ব্যাপারটা এতে আরও কমপ্লিকেটেড হয়ে গেল।”

“তার মানে?”

“মানে স্যার, আমি আপনার অ্যানসারিং মেশিনে সেদিন একটা মেসেজ রাখার চেষ্টা করলাম। নিজের নাম আর মাত্র কয়েকটা কথা বলতে না বলতেই কানেকশন কেটে গেল। আমি তো স্যার কনফিউজড হয়ে গিয়েছিলাম। বাপিবাবু পরে আমাকে বললেন, মেসেজ বক্সে মেসেজ রাখার টাইম নাকি আগে থেকেই সেট করা যায়। তাই আমি বুঝতে পারছি না অত বড়ো মেসেজ মিস্টার তোশি কী করে আপনার অ্যানসারিং মেশিনে রাখলেন?”

দেখা গেল মিস্টার মেহেতা বেশ হতচকিত। কিন্তু সামলে নিলেন। “এগুলো হচ্ছে মাইনর ডিটেল মিস্টার সেন। তোশি মেসেজ রেখেছিল, সেটা তো ভুল নয়। একটা না দুটো, তাতে কী এসে যাচ্ছে? আপনার যদি সন্দেহ থাকে তাহলে কোবাইয়ে খোঁজ করুন না। তারা নিশ্চয় জানাতে পারবে তোশি ওখানে গিয়েছিল কিনা।”

“আমি খোঁজ নিয়েছি স্যার। মিস্টার তোশি ওখানে গিয়েছিলেন। আপনার ফোনের কথাও ওঁরা বলেছেন।”

“তাহলে?”

“শুধু একটাই খটকা স্যার। সেটা হল মিস্টার তোশি আপনাকে যেতে বলেছিলেন, না আপনি মিস্টার তোশিকে যেতে বলেছিলেন।”

“আপনার এই ছোটোখাটো খটকাগুলোর বিহিত কিন্তু আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়, মিস্টার সেন। আপনার আর কিছু জিজ্ঞেস করার আছে?”

“না স্যার, থ্যাংক ইউ।” একেনবাবু চেয়ার থেকে উঠে পড়লেন। 

একেই বোধহয় বলা যায় বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া। মন বলছিল একটা বড়ো কিছু ঘটবে। কিন্তু কোথায় কী? করলেন খামোখা কতগুলো অসংলগ্ন প্রশ্ন—যার প্রত্যেকটা উত্তর সবার জানা। সত্যি! একেনবাবুর কি মাথাখারাপ হল? এভাবে এসে বোকার মতো প্রশ্ন করে নিজেকেই তো ছোটো করলেন! প্রমথর মুখ দেখলাম অসম্ভব গম্ভীর। ওকে চিনি। এখান থেকে বাইরে যাওয়ামাত্র একেনবাবুকে ও তুলোধোনা করবে। 

আমরা বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। প্রথমে প্রমথ, তারপর আমি, একেবারে শেষে একেনবাবু। হঠাৎ একেনবাবু থেমে গেলেন। ঘাড় ঘষতে ঘষতে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, “ও হ্যাঁ স্যার, আরেকটা কথা। এটা কিন্তু আপনার পক্ষে খুবই সুখবর। 

“সুখবর?” মিস্টার মেহেতা ঠিক বুঝলেন না একেনবাবু কী বলতে চান। “হ্যাঁ স্যার। খবর পেলাম নিউ ইয়র্ক মিউজিয়ামের প্রাইসলেস বুদ্ধটা আসলে জাল ছিল।” গলাটা একটু চাপা করে অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে কথাটা বললেন একেনবাবু। 

মিস্টার মেহেতার ভুরুটা কোঁচকাল। “তার মানে?”

“মিস্টার মাৎসুয়োকার সঙ্গে কথা হচ্ছিল স্যার। শিরো মাৎসুয়োকা। চেনেন তো ওঁকে?”

“কী কথা হচ্ছিল?” মিস্টার মেহেতা মনে হল একটু উদ্বিগ্ন। 

“এই প্রাইসলেস বুদ্ধের কথা। ওঁর আবার এ ব্যাপারে একটু অবসেশন আছে কিনা। ওল্ড ম্যান স্যার, কিন্তু এখনও স্ট্যাম্পটা পাবার আশা ছাড়েননি। জাপান থেকে ফোন করেছিলেন। আপনার কথা অবশ্য ওঁকে আমি বলেছি। ওয়ান্ডারফুল ম্যান স্যার। স্ট্যাম্পের ইতিহাস একেবারে গুলে খেয়েছেন— ওশন অফ নলেজ। কিন্তু স্যার দাম্ভিকতা নেই।”

“আঃ, কথাটা কী হচ্ছিল বলবেন তো!” এবার আর উদ্বিগ্নতা চেপে রাখতে পারলেন না মিস্টার মেহেতা। 

“ও, হ্যাঁ স্যার। উনি একেবারে নিশ্চিত প্রমাণ পেয়েছেন যে প্রাইসলেস বুদ্ধটা জাল। মানে আপনারটা নয়- নিউ ইয়র্ক মিউজিয়ামেরটা।”

“দ্যাটস ননসেন্স!”

“না স্যার, আজই আমার সঙ্গে ওঁর কথা হয়েছে। আসলে প্রাইসলেস বুদ্ধের এনগ্রেভ প্রিন্টিং-এর মাস্টার প্লেটটা নাকি পাওয়া গেছে। সেটার একটা ছাপ দেখে উনি বুঝতে পেরেছেন।”

“কী বুঝতে পেরেছেন?” মেহেতার চোখে একটা অবিশ্বাসের ভাব। 

“ব্যাপারটা হল স্যার, মিস্টার মাৎসুয়োকা প্রাইসলেস বুদ্ধ ভালোবাসেন বলে মিস্টার তোশি তার খুব ভালো একটা ছবি তুলে ওঁকে উপহার দিয়েছিলেন। এটা কিন্তু কেউ জানে না স্যার। ব্যাপারটা পুরোপুরি আন-অফিসিয়াল। মিস্টার তোশি কাউকে না জানিয়েই ছবিটা তুলেছিলেন। যাই হোক উনি যখন মারা গেছেন তখন লোকে জানলেই-বা কী এসে গেল—ঠিক কিনা স্যার? তবে ছবিটা একেবারে দারুণ! মিস্টার মাৎসুয়োকার দুধের স্বাদ অন্তত ঘোলে মিটেছে।” কথাটা বলে একেনবাবু আচমকা কেমন জানি থেমে গেলেন। 

“তারপর কী?”

“হ্যাঁ স্যার, সেই ছবিটার সঙ্গে এনগ্রেভিং প্লেটের ছাপটা উনি মিলিয়ে দেখেছেন। সবগুলোই ঠিক শুধু বুদ্ধের মুখের কয়েকটা আঁচড়ে একটু গণ্ডগোল আছে! অবশ্য আপনার তাতে ভালোই হল স্যার। াের এখন বমাল ধরা পড়লে আপনার স্ট্যাম্পটা সেই অদ্বিতীয়ই থেকে যাচ্ছে!”

একেনবাবুর শেষ কথাতে মিস্টার মেহেতার উৎফুল্ল হবার কথা কিন্তু উনি কীরকম জানি মিইয়ে গেছেন। 

“একটা অনুরোধ আছে স্যার।”

“কী?”

“আপনার প্রাইসলেস বুদ্ধটা কি এক বার দেখতে পারি?”

“কেন?”

“একটা জিনিস একটু পরীক্ষা করতাম স্যার।”

“কী পরীক্ষা করবেন?” মিস্টার মেহেতা একটু সচকিত। 

“মিস্টার মাৎসুয়োকা বুদ্ধের থুতনির নীচে একটা খুব ছোট্ট দাগের কথা 

বলেছেন, সেটা মিউজিয়ামের স্ট্যাম্পটাতে নেই— সেই দাগটা কীরকম সেটা একটু দেখতাম স্যার।”

মিস্টার মেহেতা বললেন, “স্ট্যাম্পটা এখানে নেই।” গলাটা মনে হল একটু কেঁপে গেল। 

“কোথায় আছে স্যার?”

“আমার বাড়িতে।”

“অত দামি স্ট্যাম্প স্যার, এখানে আপনার ভল্টে না রেখে বাড়িতে রেখেছেন?”

“কেন তাতে আপনার কোনো আপত্তি আছে?” মিস্টার মেহেতা বেশ রূঢ়ভাবে কথাটা বললেন। 

“না, তা নয় স্যার, তবে ব্যাপারটা একটু কমপ্লিকেটেড হয়ে গেল।”

“কমপ্লিকেটেড?”

“তার মানে এখন আমাকে আপনার বাড়ি যেতে হবে স্ট্যাম্পটা দেখতে।”

“আর ইউ ম্যাড মিস্টার সেন?”

“কেন স্যার?”

“কেন সেটা আপনাকে বুঝিয়ে বলতে হবে? আপনার সমস্যাটা কী? কেন আপনি এভাবে আমার সময় নষ্ট করছেন?”

“না স্যার, আপনাকে ফাঁকি দেবার উপায় নেই। বরং সত্যি কথাটাই বলি। আসলে আমার একটু সন্দেহ হচ্ছে।”

“সন্দেহ, কীসের সন্দেহ?”

“আমার মনে হচ্ছে স্যার আপনি স্ট্যাম্পটা আমাকে দেখাতে চান না।”

“ওহ গড, হোয়াট ননসেন্স!”

“না স্যার, সিরিয়াসলি বলছি। আপনি বোধহয় ভয় পাচ্ছেন পাছে কিছু আবিষ্কার হয়ে যায়।”

“ভয় পাব কেন? কী আবিষ্কার হবে, আমি কি স্ট্যাম্পটা চুরি করেছি?” মিস্টার মেহেতা প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন। 

কথাটার কোনো উত্তর না দিয়ে হঠাৎ একটা সিগারেট ধরালেন একেনবাবু। “ব্যাড হ্যাবিট স্যার, এখনও ছাড়তে পারলাম না।” কথাটা বোধহয় আমাদের সবার উদ্দেশেই বললেন। 

মিস্টার মেহেতার ইতিমধ্যে ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে। ডেস্কে একটা কিল মেরে বললেন, “চুলোয় যাক আপনার হ্যাবিট, আমার প্রশ্নের জবাব দিন! 

সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে একেনবাবু বললেন, “শুধু চুরি নয় স্যার, আমার ধারণা তার থেকে অনেক বড়ো অপরাধ আপনি করেছেন। বিভাস চৌধুরী আগুনে পুড়ে মারা যাননি। তাঁকে হত্যা করা হয়েছে, আর হত্যাকারী হচ্ছেন আপনি।”

হোয়াট! প্রমথ আর আমি অবাক হয়ে দু-জনে দু-জনের দিকে তাকাচ্ছি। একেনবাবুর এই মূর্তি আমি আগেও দেখেছি। চোখে-মুখে একটা গভীর আত্মপ্রত্যয়। উনি জানেন উনি যা বলছেন তার থেকে বড়ো সত্য আর কিছু হতে পারে না। এদিকে মিস্টার মেহেতার মুখ দেখে আমি বুঝতে পারছি যে কোনো মুহূর্তে প্রলয় ঘটবে। ওঁর সারা শরীর উত্তেজনায় কাঁপছে, চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরোচ্ছে। আমার তো ভয়ই করছে লাফিয়ে উঠে রোগাপটকা একেনবাবুর টুটি না টিপে ধরেন। মিস্টার মেহেতা অবশ্য গামা পালোয়ান নন। আমি আর প্রমথ দু-জনে মিলে ওঁকে কবজা করতে পারব। কিন্তু ডেস্ক-ড্রয়ারে যদি রিভলবার বা ছুরি থাকে! ভাগ্যক্রমে আমি ওঁর থেকে খুব একটা দূরে নয়। দরকার হলে একটা ডাইভ দিয়ে ওঁকে ধরতে পারব। প্রমথও দেখলাম পজিশন নিচ্ছে। শুধু একেনবাবুর কোনো বৈকল্য নেই। স্থির দৃষ্টিতে মিস্টার মেহেতার দিকে তাকিয়ে উনি বলে চললেন, “হ্যাঁ স্যার। আপনি বিভাস চৌধুরীর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে হত্যা করে মিউজিয়ামের প্রাইসলেস বুদ্ধটা তুলে নিয়ে আসেন। তারপর অপকর্মটা ঢাকার চেষ্টা করেন ভদ্রলোকের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে। গুড প্ল্যান স্যার, ভেরি গুড প্ল্যান। শুধু একটাই সমস্যা। আপনি জানতেন না মিউজিয়ামের ওই স্ট্যাম্পটাও ছিল নকল। এখন আপনার স্ট্যাম্পটা বার করে পরীক্ষা করলেই সব কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। ঠিক কিনা স্যার?”

একেনবাবু কী মাথামুণ্ডু বলছেন বোঝার আগেই শুনলাম মিস্টার মেহেতার চিৎকার, “গেট আউট! এই মুহূর্তে গেট আউট!”

একেনবাবু নড়লেন না। দরজার দিকে মুখ ফিরিয়ে ডাকলেন, “ইনস্পেকটর ল্যান্ডি!”

বিস্ময়ের ওপর বিস্ময়! কখন নিঃশব্দে ইনস্পেকটর তাঁর দলবল নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন খেয়াল করিনি। 

উনি সদলবলে ঘরে ঢুকতেই একেনবাবু বললেন, “আপনার কাছে তো সার্চ ওয়ারেন্ট আছে স্যার, তাই না?”

মাথা নাড়লেন ইনস্পেকটর। 

“চমৎকার স্যার। তাহলে প্রথমে দেখা যাক, প্রাইসলেস বুদ্ধটা ভল্টে আছে কিনা। সেখান থেকে বোঝা যাবে মিস্টার মেহেতা কত দূর সত্যবাদী।”

“ভল্টের চাবিটা দিন,” সাড়ে ছ’ফুট লম্বা ইনস্পেকটর ল্যান্ডি মিস্টার মেহেতার একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আদেশ করলেন। মিস্টার মেহেতার মুখটা একেবারে ছাইয়ের মতো সাদা। চেয়ারটা শক্ত করে ধরে আছেন। 

“চাবিটা!” আরেক বার ধমকে উঠলেন ইনস্পেকটর ল্যান্ডি। 

পকেট থেকে বার করে চাবিটা দিলেন মিস্টার মেহেতা। ভল্টের দরজাটা যখন খোলা হচ্ছে তখন মিস্টার মেহেতা আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। হাউহাউ করে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে শুরু করলেন, আর সেইসঙ্গে অসংলগ্ন প্রলাপ, “আমি চাইনি… সত্যিই চাইনি… কিন্তু আমার আর কোনো পথ খোলা ছিল না… বিশ্বাস করুন…।”

পুলিশ এখন তাদের কাজ শুরু করবে। আমি আর প্রমথ ওখানে এখন অবাঞ্ছিত। একেনবাবু বাড়ি ফিরলে ওঁর কাছ থেকে শুনতে হবে পুরো বৃত্তান্ত।