প্রশংসার নিন্দা

প্রশংসার নিন্দা

মানুষ প্রশংসা করে দুই ধরনের মানুষকে। এক. যাদের প্রশংসা প্রাপ্য; দুই. যাদের প্রশংসা প্রাপ্য নয়। আমার আলোচনার বিষয়বস্তু প্রশংসার এই দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রাপকেরা, এবং একই সাথে, এ প্রশংসা যারা করেন তারা। এ প্রশংসা কখনো প্রশংসাকারীর মনের ভেতর থেকে আসে না, আসে তার বনের ভেতর থেকে। মানুষের মগজে স্বার্থসিদ্ধির যে-বনটি রয়েছে, সেটিই এ প্রশংসার আসল উৎস, আর এ প্রশংসাগুলোকেই আমরা বলি তোষামোদ বা দালালি।

মানুষ তোষামোদ করে কেন? এ প্রশ্নের সরল উত্তর হলো, তোষামোদ যাকে করা হয়, তিনি সেটি খুব উপভোগ করেন। তবে আসল কারণটি এরকম সরল নয়। তোষামোদের প্রকৃত কারণটি বুঝতে হলে সবার আগে আমাদেরকে এর পেছনের রাজনীতিটি বুঝতে হবে।

লক্ষ করলে দেখা যাবে, যারা তোষামোদ করেন, তাদের অধিকাংশ‍ই সমাজের পিছিয়ে-পড়া জনগোষ্ঠীর মানুষ। ‘পিছিয়ে-পড়া জনগোষ্ঠী’ বলতে অনেকে দরিদ্র কৃষক, শ্রমিক, মজুর ও অশিক্ষিত জনগণকে বুঝে থাকেন, যা সঠিক নয়। পিএইচডি করা সম্পদশালী মানুষও ‘পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী’র অংশ হতে পারেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে ছাত্র-শিক্ষকরা আছেন, এবং আমাদের যারা সরকারি কর্মচারী, তারাও এ জনগোষ্ঠীর অংশ। এমন কি প্রধানমন্ত্রীর সাপেক্ষে, আমাদের মন্ত্রিপরিষদ সদস্যরাও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানুষ। বিষয়টি ধন-সম্পদ বা শিক্ষা-দীক্ষার নয়, বিষয়টি ক্ষমতা ও মেরুদণ্ডের।

কোনো অসম সমাজে ক্ষমতা দ্বারাই নির্ধারিত হয় মানুষের সামাজিক নিয়তি। সমাজটিতে কে কতোখানি সমীহ পাবে, কে কতোটুকু প্রভাব বিস্তার করবে, তা নির্ধারিত হয় ওই সমাজে মানুষের ক্ষমতার বণ্টন দ্বারা। প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাজে ক্ষমতার এ বণ্টন সুসম হলেও, অগণতান্ত্রিক বা ছদ্মগণতান্ত্রিক সমাজসমূহে এ বণ্টন অসম। এ অসম সমাজগুলোকে বলা যেতে পারে শয়তানের সমাজ।

শয়তানের সমাজে ক্ষমতার কিছু মই তৈরি হয়। এটি আপনা-আপনিই হয়, এবং এ মইয়ে চড়ার জন্য যে-গ্রাহকশ্রেণি, সেটিও আপনা-আপনিই সৃষ্টি হয়। তোষামোদ যিনি করেন, তিনি এ ক্ষমতার মইয়ের পাদদেশের অংশ, আর তোষামোদ যিনি উপভোগ করেন, তিনি এ ক্ষমতার মইয়ের চূড়ার অংশ। মইটির চূড়ার জীবন আর তলার জীবন এক নয়। এ দুই জীবনের বৈষম্য যতো বেশি হয়, সমাজে উৎপাদিত মোট দালালির পরিমাণও ততো বেশি হয়।

কিন্তু সমাজ যদি প্রকৃত অর্থেই গণতান্ত্রিক হয়, তাহলে ওই সমাজে ক্ষমতার এ মইটি থাকে না। ইংল্যান্ড বা নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী যখন ট্রেন ও সাইকেলে চড়ে অফিস করেন, বা কোনো পাবলিক পার্কে তাঁরা যখন জটলাবিহীন হাঁটাহাঁটি করেন, অথবা কোনো হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়ে তাঁরা যখন রোগীর তিরস্কারের শিকার হন, তখন আমরা বুঝতে পারি— তাঁদের সমাজে ক্ষমতার ওই মইটি নেই। ওখানে মইয়ের বদলে আছে নানা পথ। এসব পথের যেকোনো একটি ধরে হাঁটলে একজন মানুষ সরল পথেই পৌঁছুতে পারেন ক্ষমতার কেন্দ্রে। তবে তাদের দেশে ক্ষমতার যে- কেন্দ্রবিন্দু, তা খুবই পানসে। ওই কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছে তাঁরা দেখতে পান, প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির জীবনের চেয়ে সাধারণ নাগরিকের জীবনই অধিক আরামের। এ জন্য নানা তুচ্ছ কারণে তাদেরকে আমরা পদত্যাগ করতে দেখি। অনেকেই একবার প্রধানমন্ত্রী হলে, বাকি জীবনে আর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার নাম নেন না।

তারা জানেন, ক্ষমতা আর দায়িত্ব এক জিনিস নয়। দায়িত্ব পালন করা একটি পরিশ্রমের কাজ, যা ক্লান্তিকর। কিন্তু ক্ষমতা মাদকের মতো। সারাক্ষণ শুধু উপভোগ করতে ইচ্ছে হয়। উত্তেজনা আর উত্তেজনা। যে- ব্যক্তি মাদকে অভ্যস্ত, সে সহজে মাদক ছাড়তে চায় না। কেউ ৩৩৩ নাম্বারে ফোন করে খাদ্য-সাহায্য চাইলে তাকে খাদ্য সাহায্য দেওয়াটা হলো দায়িত্ব। আর তাকে খাদ্য-সাহায্য না দিয়ে কোনো অজুহাতে জেল-জরিমানা করাটা হলো ক্ষমতা। ক্ষমতা প্রয়োগের এ স্বাদ মাদক নেয়ার চেয়েও মিষ্টি। শরীরে হেরোইন বা কোকেন নিলে যে আবেশ আসে, ক্ষমতা চর্চা করার সময়ও এরকম জাদুকরী আবেশের সৃষ্টি হয়।

ক্ষমতার যারা শিকার বা ভিক্টিম, তারা এটি অনুধাবন করতে পারে। তখন তাদেরও সাধ জাগে, ক্ষমতা, সম্মান, সমীহ— এ মাদকগুলোকে একটু চেখে দেখার। এ চেখে দেখার বাসনা থেকেই ক্ষমতার মইয়ের পাদদেশ থেকে তারা নানা জনের নামে স্লোগান দেন, পোস্টার সাঁটান। তাদের বিশ্বাস— স্লোগান ও পোস্টারের শব্দে বিরক্ত হয়ে, একদিন-না- একদিন মইয়ের চূড়ায় থাকা ব্যক্তিটি, কিছু ক্ষমতার বিস্কুট তাদের দিকেও ছুড়ে মারবেন।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে ‘বড় ভাই’ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তার পেছনের কারণও ক্ষমতার এ মাদককে একটু চেখে দেখা। শিক্ষক— রাজনীতির যে-ছাগলটি, এটিও এ কারণেই টিকে আছে। কেবলই শিক্ষক, কেবলই অধ্যাপক, এ জীবন খুব নীরস। জীবনকে সরস করতে হলে স্বাদ পেতে হবে উপাচার্য বা কোনো কমিশনের চেয়ারম্যান পদের। প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাজে এ স্বাদ শিক্ষকরা স্বাভাবিক পথেই পান; কিন্তু আমরা যে-সমাজে আছি, সেখানে এ স্বাদ পেতে হলে একজন শিক্ষককে হাঁটতে হয় নানা বিকৃত পথে।

এ বিকৃত পথগুলোরই একটি হলো তোষামোদ বা ফন্দিবাজি প্রশংসা। তারা জানেন, কার প্রশংসা করলে কী পাওয়া যাবে। সত্যেন বোস বা জগদীশচন্দ্রের প্রশংসা করে যে কোনো লাভ নেই, কাজী নজরুলের মাজার জিয়ারত করে যে কোনো নগদ প্রাপ্তির আশা নেই, এটি তারা বুঝেন। এ জন্য তারা বেছে বেছে প্রশংসা করেন শুধু বিশেষ বিশেষ মানুষদের, আর জিয়ারত করেন শুধু বিশেষ বিশেষ মাজার। বাংলাদেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মাজারে আমি অনেককেই যেতে দেখি, কিন্তু তারা ওই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে কতোটা ভালোবাসেন তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। যারা ওই ব্যক্তিকে ভালোবাসেন, তাদের তো খিচুড়ি রান্না শিখতে বিদেশ যাওয়ার কথা নয়; কানাডা ও লন্ডনে তাদের আরেকটি বাড়ি থাকার কথা নয়। আমার তো মনে হয়, গ্রামের মানুষরা যে নানা পীর-মুর্শিদের মাজারে মানত আদায় করে থাকে, সেগুলো অনেক বেশি অকৃত্রিম ও ভালোবাসাপূর্ণ।

তোষামোদের যে-রাজনীতিক রূপটি, তা শুধু ক্ষমতার মই বেয়ে উপরে ওঠার রূপ নয়। ক্ষমতার মইটির কাছাকাছি থাকাও তোষামোদকারীর লক্ষ্য থাকে। বিসিএসের কথাই ধরা যাক। এমন অনেক মানুষ আমি পেয়েছি, যারা ট্রাফিক সার্জেন্টের হাত থেকে মোটরসাইকেল বাঁচানোর জন্য পুলিশ ক্যাডারের কারও ছবি ফেসবুকে দিয়ে তোষামোদ করে থাকে। আমার ধারণা, এ ধরনের তোষামোদ ওই পুলিশ কর্মকর্তাও বুঝতে পারেন, কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলেন না (কেউ কেউ হয়তো উপভোগও করেন)। এ কথা প্রশাসন ক্যাডারের তরুণদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এক ছেলেকে দেখলাম, প্রশাসন ক্যাডারে সুযোগ পাওয়া এক তরুণের জন্য ৩০-৩৫ লাইনের একটি অভিনন্দন-রচনা লিখে ফেসবুকে প্রকাশ করেছে।

বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের তরুণরা যে অভিনন্দন কম পান, এর কারণও ক্ষমতা। মানুষ জানে, ট্রাফিক সার্জেন্ট মোটরসাইকেল আটকালে কলেজের শিক্ষক কোনো কাজে আসবে না।

আবার কেউ কেউ ‘অমুক ক্ষমতাধর আমার পরিচিত, তার সাথে আমার ওঠাবসা আছে’— এটি জাহির করতেও তোষামোদ করে থাকে। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে যতো পোস্টার আছে, তার আশি ভাগ এ ঘরানার পোস্টার। এর উদ্দেশ্য হলো, চারপাশের মানুষকে একটু সতর্ক করে দেয়া, যেন পোস্টারওয়ালার সাথে কেউ লাগতে না আসে।

কোনো রাষ্ট্রে আইনের শাসন বহাল থাকলে, এবং রাষ্ট্রের পরিচালকদের ওপর মানুষের আস্থা থাকলে, এ ধরনের তোষামোদের কোনো প্রয়োজন পড়ে না। তোষামোদের প্রয়োজন পড়ে তখন, যখন মানুষ টের পায় যে— কোনো মানবিক নীতি ও আইন দ্বারা সমাজ শাসিত হচ্ছে না। সমাজ শাসিত হচ্ছে কিছু মানুষের খামখেয়ালি দ্বারা, অথবা কিছু মানুষ কর্তৃক উদ্ভাবিত নিপীড়নমূলক আইনের

আইনের শক্তিতে। আমাদের দেশের নিম্ন আদালতগুলো মাত্র দু-তিন মিনিট শুনানি নিয়ে মানুষকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়ে থাকে। একজন মানুষকে জামিন না দেয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত একজন বিচারক মাত্র তিন মিনিটে কীভাবে নেন? একমাত্র খামখেয়ালি ছাড়া আর কোনো উপায়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব বলে মনে করি না।

বিচারের আগেই কাউকে শাস্তি দেয়ার মানসিকতা, সমাজে তোষামোদ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ। মানুষ যখন টের পায় যে, কোথাও বেআইনি পীড়নের শিকার হলে আদালতগুলোও তাকে রক্ষা করতে পারবে না, তখন সে আদালতের বিকল্প খোঁজার চেষ্টা করতে থাকে। এ চেষ্টা থেকেই সে নানা ক্ষমতাধর ব্যক্তির তোষামোদ করে থাকে। তার আশা, ভবিষ্যতে কোনো বিপদে পড়লে, আদালত তাকে রক্ষা না করলেও পোস্টার বা ফেসবুক প্রোফাইলে দেয়া বিশেষ ক্ষমতাবান ব্যক্তিটি তাকে রক্ষা করবেন। কিন্তু বিচারকরা যদি স্বাধীনভাবে মানুষের মৌলিক অধিকারগুলির সুরক্ষা দিতেন, তাহলে এ ধরনের তোষামোদ কমে যেতো।

এখানে আমি একটি উদাহরণ দিতে চাই। দিলদার গ্রুপের দুই ছেলে একটি মামলার পর বিশেষ অ্যাম্বুলেন্সে করে বিদেশে চলে গিয়েছিলেন। তারা হয়তো এমন কাউকে তোষামোদ করতেন, যিনি তাদের যেকোনো দুর্যোগ থেকে রক্ষা করার ক্ষমতা রাখেন। কিন্তু দিলদার গ্রুপের ছেলেরা একপর্যায়ে বুঝতে পারেন, দেশে ফিরে যাওয়াই ভালো। এ জন্য তারা বিদেশ থেকেই জামিনের আবেদন করেন। কিন্তু আদালত তাদের এ আবেদন শুনেনইনি। উল্টো উষ্মা প্রকাশ করে তাদের জরিমানা করেন। এটি কেন করা হয়েছিলো? এর পেছনে খামখেয়ালি ছাড়া কী এমন যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে? যিনি একটি মামলাকে আইনিভাবে মোকাবেলা করার জন্য দেশে ফিরতে চাচ্ছেন, এবং এ উদ্দেশ্যে দেশের আদালতের কাছে জামিন প্রার্থনা করছেন, তাকে আদালত সে সুযোগ না দিয়ে দেশের কী উপকার করলো? কোনো উপকারই করেনি। আদালত দিলদার গ্রুপের ছেলেদের পুনরায় তোষামোদের দিকেই ঠেলে দিলেন। এরপর তারা তাদের নিজস্ব তোষামোদি প্রক্রিয়াতেই দেশে ফিরে এসেছিলেন, এবং চব্বিশ ঘণ্টার ভেতরেই জামিন লাভ করেছিলেন।

কোনো রাষ্ট্রে অন্তত একটি প্রতিষ্ঠান থাকতে হয়, যেটির ওপর ধনী- গরিব সকল মানুষ নির্ভয়ে নির্ভর করতে পারবেন। যেকোনো প্রকৃত গণতন্ত্রে আদালতগুলোই এ ভূমিকা পালন করে থাকে।

কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, মানুষ তো অরাজনীতিক কারণেও তোষামোদি করে থাকে, এটিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? যেমন ছাত্র কর্তৃক শিক্ষকের তোষামোদি, ভক্ত কর্তৃক লেখকের তোষামোদি, অনুসারী কর্তৃক মতাদর্শের তোষামোদি, ইত্যাদি।

দেখুন, এ তোষামোদগুলোও রাজনীতিক, কিন্তু এর রাজনীতিক রূপটি এতোটা প্রকাশ্য নয় বলে তা সহজে ধরা যায় না। একজন ছাত্র অবশ্যই তার শিক্ষকের প্রশংসা করতে পারেন, কিন্তু তা যখন প্রশংসার গণ্ডি পেরিয়ে তোষামোদের আকার ধারণ করে, তখন বুঝতে হবে ছাত্রটির অন্য মতলব আছে। সে হয়তো কোনো কোর্সে নাম্বার বেশি পেতে চায়, অথবা ওই শিক্ষকের বিশেষ কোনো ক্ষমতার আনুকূল্য পেতে চায়। আমি কয়েকজন ছাত্রকে চিনি, যারা ভালো ‘রিকমেন্ডেশান লেটার’ পাওয়ার আশায় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের তোষামোদি করতো। এ কারণগুলো কিন্তু রাজনীতিক। ছাত্র তার ভবিষ্যৎ লাভের আশায় এ তোষামোদি করে থাকে।

এটি লেখকদের বেলায়ও ঘটে। কিছু অসৎ ভক্ত, নানা অভিপ্রায়ে তাদের পছন্দের লেখকের তোষামোদি করে থাকে। যেমন- ভিন্নমতের কোনো লেখককে ঘায়েল করা, অপছন্দের কোনো মতাদর্শের বিরুদ্ধে আরামদায়ক যুক্তি উদ্ভাবন করা, লেখকের সাথে ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করা, লেখকের সাথে আমার খাতির আছে, এ খবর সমাজে প্রচার করা, মিথ্যে প্রশংসা করে লেখককে ধ্বংস করা, এরকম নানা কারণে ভক্তরা লেখকের তোষামোদি করতে পারে। ভক্তদের এ আচরণগুলোও রাজনীতিক। রাজনীতি শুধু ভোটে দাঁড়ানো বা ইলেকশন করা নয়, ইলেকশনের বাইরেও রাজনীতি আছে। মানুষ জন্মের পর থেকে কবরে ঢোকার আগ পর্যন্ত যা করে, তা সবই রাজনীতিক কর্মকাণ্ড। এমনকি প্রার্থনাও। তারা জানে, বেহেশতেরও নানা স্তর আছে। উঁচু স্তরের ফেরদাউস রেখে নিচু স্তরের ‘মাকাম আল-আমিন’-এ তারা কেন যাবে?

বিভিন্ন মতাদর্শের অনুসারীরা, তাদের নিজ নিজ মতাদর্শের পক্ষে, বা ওই মতাদর্শের কোনো প্রচারকের পক্ষে, যে-তোষামোদ বা দালালি করে থাকেন, তাও রাজনীতিক। হাজার হাজার মতাদর্শের মধ্যে তার মতাদর্শের মাথাটিকেই তিনি সবচেয়ে উঁচুতে রাখতে চান। এ জন্য যা যা করা দরকার তিনি তা করেন। এতে তোষামোদকারীর কিছু ইহলৌকিক ও পারলৌকিক স্বার্থও জড়িত থাকে। বাংলাদেশে যে ওয়াহাবি-সুন্নি মারামারিটি আছে, তা টিকে আছে মূলত এ দুই মতাদর্শের অনুসারীদের তোষামোদির কারণে। এক পক্ষের অনুসারীরা আরেক পক্ষের অনুসারীদের ধুলোয় মিশিয়ে দিতে চান। তাদের নেতারা এমন এমন অপ্রয়োজনীয় কথা বলেন, যা স্রেফ এ অনুসারীদের খুশি এবং চাঙ্গা রাখার জন্যই বলেন। এখানে তোষামোদের একটি উল্টো চিত্র পাওয়া যায়। সব জায়গায় নিচের মানুষরা উপরের মানুষদের তোষামোদি করলেও এখানে দেখা যায় নেতারা তোষামোদ করছেন অনুসারীদের! এক মাহফিলে আমি নিজ কানে শুনেছি, এক পক্ষের বড়ো বক্তা আরেক পক্ষের বড়ো বক্তাকে ‘পানখোর বুইড়া ছাগল’ নামে অভিহিত করছেন, এবং এটি শুনে মাহফিলের শ্রোতারা খুব আনন্দ পাচ্ছেন।

তোষামোদের উপকারিতা কী? তোষামোদের কোনো উপকারিতা নেই। এর শুধু অপকারিতাই আছে। হ্যাঁ, ব্যক্তিগত লাভ এতে কিছু হয়, কিন্তু তা আসলে লাভের মুখোশে ক্ষতি। তোষামোদ, তোষামোদকারী ব্যক্তি ও এর গ্রহীতা উভয়ের ব্যক্তিত্বকেই নষ্ট করে। যার সুযোগ ছিলো উৎকর্ষ সাধনের, সে তোষামোদ পেয়ে ধাবিত হয় অবকর্ষের দিকে। যেকোনো সমালোচনাকেই সে গিবত মনে করে, এবং সমালোচনাকারীকে জ্ঞান করে শত্রু। এটি তাকে ধীরে ধীরে স্বেচ্ছাচারী একনায়কে পরিণত করে। প্রশংসা ছাড়া সে আর কিছু শুনতে চায় না। মাদকাসক্তের মতো সে হয়ে ওঠে প্রশংসাসক্ত। এই তোষামোদের মাদক যাকে একবার পেয়েছে, তার শরীর না হোক, আত্মা যে কবুতরের খোপ হয়ে গেছে, এ ব্যাপারে আমার সন্দেহ নেই।

তোষামোদ একপ্রকার আনন্দ-অভ্যাসের সৃষ্টি করে। ফলে যাদের ক্ষমতা আছে তোষামোদ প্রাপ্তির, তারা সারাক্ষণ এমনভাবে কাজ করেন, যেন কাজটি শেষে তারা কিছু তোষামোদ পান। শুধু প্রশংসা পাওয়া তাদের লক্ষ্য নয়। তাদের লক্ষ্য হলো মাদকের মতো উপভোগ্য তোষামোদ, যা পেয়ে তারা অবশ ও বুঁদ হয়ে থাকবেন আনন্দ সুখে। ফলে কোনো নীতি বা প্রিন্সিপল নয়, তারা তাদের কাজে প্রাধান্য দেয়া শুরু করেন ব্যক্তিগত আবেগকে।

যেমন, কয়েক মাস আগে কিছু ক্ষমতাধর ভদ্রলোক, লম্বা চুলের ছেলেদেরকে সেলুনে ঢুকিয়ে চুল ছাঁটাতে বাধ্য করেছেন। তাদের দাবি, এগুলো অসামাজিক চুল। আমার ধারণা, তারা নিউটনকে রাস্তাঘাটে পেলে তাকে ধরেও সেলুনে ঢুকিয়ে দিতেন। এই যে কাজগুলো, এগুলো কিন্তু পরিষ্কারভাবে অসাংবিধানিক কাজ। একজন স্বাধীন নাগরিকের যেভাবে খুশি সেভাবে চুল রাখার অধিকার রয়েছে।

যারা ক্রিমিনাল ল’ পড়েছেন তারা জানেন যে, বিনা সম্মতিতে কারও একটি চুল স্পর্শ করা হলো ‘ব্যাটারি অফেন্স’, কারও একটি চুল কাটা হলো ‘অ্যাকচুয়াল বডিলি হার্ম বা এবিএইচ অফেন্স’, এবং চুল কাটাতে গিয়ে কারও মাথার তালু কেটে ফেলা হলে, তা হবে ‘গ্রিভাস বডিলি হার্ম বা জিবিএইচ অফেন্স’, এবং এর প্রত্যেকটিই কিন্তু ফৌজদারি আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

কিন্তু ভদ্রলোকেরা এসবকে আমলে না নিয়ে, আমলে নিয়েছেন সামাজিক বাহ্বা প্রাপ্তিকে। এই অন্ধ বাবা খুবই মারাত্মক তোষামোদি। কোনো সমাজে অন্ধ মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেলে, এরকম বাহ্বা খুব বেড়ে যায়। তখন ক্ষমতাকে যারা উপভোগ করেন, দায়িত্বকে যারা ক্ষমতা জ্ঞান করেন, এবং ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করাকে যারা ক্ষমতা-চর্চা মনে করেন, তারা নিয়মিত মাদকের মতো এ বাবা পেতে চান।

তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় তোষামোদ যিনি করেন তার। সে তোষামোদ করতে গিয়ে পরিণত হয় দাস বা গোলামে। এক মানুষ আরেক মানুষের দাসে পরিণত হচ্ছে, এটিকে আমি উৎসাহিত করতে পারি না। একবার কারও গোলাম হয়ে গেলে, তার বিরুদ্ধে কথা বলা খুব মুশকিল হয়ে ওঠে। তিনি কোনো অন্যায় করলে, তার প্রতিবাদ করা গোলামের পক্ষে আর সম্ভব হয় না।

এ জন্য হৃদয় থেকে সালাম না এলে কাউকে সালাম দেয়া যাবে না। হৃদয় থেকে প্রশংসা না এলে কারও প্রশংসা করা উচিত হবে না। কাউকে ভয় পেয়ে তার সম্পর্কে ভালো ভালো মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে হবে। অপ্রয়োজনীয় স্লোগান পরিহার করতে হবে। নিজেকে ক্ষুদ্র ভাবার মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে। শরীরের মেরুদণ্ডের চেয়ে মনের মেরুদণ্ডটিকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। মস্তিষ্কের ঘুমন্ত ক্ষমতাকে জাগ্ৰত রাখতে হবে।

বিশেষ উদ্দেশ্যে ক্ষমতাবান মানুষদের ছবি, ফেসবুক ও পোস্টারে প্রচার করার অভ্যাস বাদ দিতে হবে। হিংসা ও বিদ্বেষের দাস হওয়া যাবে না। এগুলো মানুষের আত্মমর্যাদার সাথে যায় না। দায়িত্বকে দায়িত্ব জ্ঞান করতে হবে। এটিকে ক্ষমতা ভাবার অর্থ হলো- আপনি একজন অদক্ষ ও বেঁটে মানুষ। দায়িত্ব পালনের জন্য আপনি উপযুক্ত নন। অন্যের মতো হওয়ার চিন্তাও মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোকে সম্মান করা শিখতে হবে। কারও দুর্ভোগকে উপভোগ করা যাবে না। পালবেঁধে নয়, একা একা চলার অভ্যাস করতে হবে। মনে রাখতে হবে- ভেড়ার পাল যতো বড়ো হয়, ভেড়ার ভাগ্যও ততো ছোটো হয়।

প্রশংসা করতে হবে পরিমিতভাবে। প্রশংসা করার আগে ভেবে দেখতে হবে, লোকটি প্রশংসার যোগ্য কি না। প্রশংসা পেতে পারেন, এমন কোনো কৃতিত্ব তার আছে কি না। কাউকে রুটিন দায়িত্ব পালনের জন্য প্রশংসা করা যাবে না। কেউ সরকারি টাকায় কিছু করে দিলে, তার জন্য প্রশংসা করতে হবে করদাতাদের। কারণ করদাতারা টাকার যোগান না দিলে, তিনি ওই কাজটি করতে পারতেন না। যারা জনগণের টাকার কৃতিত্ব নিজেদের পকেটে নিতে চান, তাদের ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে।

হ্যাঁ, কেউ যদি তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন, তবে তাকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাতে পারেন। কিন্তু তোষামোদ করা যাবে না। ধন্যবাদ ও তোষামোদ এক জিনিস নয়। কারও কাজে খুশি হলে তাকে পরিমিত ভাষায় আপনার খুশি হওয়ার ব্যাপারটি জানিয়ে দিন। এতে তিনি কাজ করতে উৎসাহ পাবেন। কিন্তু কখনো অতিরঞ্জিত প্রশংসা করে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেবেন না। কারণ প্রশংসা একপ্রকার ঘুমের বড়ি। এ বড়ির কাজ হলো– সক্ষম মানুষকে অক্ষম করে তোলা।