প্রথম পরিচ্ছেদ । বোম্বেটে না বর্বর
বোম্বেটে কাকে বলে সবাই তা জানে। বোম্বেটে বা জলদস্যু পৃথিবীর সব দেশেই সব সময়ে ছিল। এখনও আছে।
তবে বোম্বেটে-জীবনের গৌরবময় যুগ আর নেই। আগেকার বোম্বেটের ক্ষমতা ছিল অবাধ ও খ্যাতি ছিল আশ্চর্য, এখনকার বোম্বেটেরা তাদের কাছে হচ্ছে তিমিমাছের কাছে পুঁটিমাছের মতো।
উড়োজাহাজ, বাষ্পীয় পোত ও বেতার টেলিগ্রাফের মহিমায় আজ আর কোনও বোম্বেটেই বেশি মাথা তুলতে বা বেশিদিন কোথাও গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে পারে না। চিনে বোম্বেটেরা আজও মাঝে মাঝে মাথা চাগাড় দেয় বটে, কিন্তু তাদের জারিজুরি ওই চিনা সমুদ্রের ভিতরেই। চিনদেশের ভিতরকার অবস্থা ভালো নয়, রাজ্যবিপ্লব নিয়েই সেখানকার গভর্নমেন্ট ব্যতিব্যস্ত, সেইজন্যেই চিনে বোম্বেটেরা মাঝে মাঝে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করবার সুযোগ পায়।
অন্যান্য দেশের আধুনিক বোম্বেটেরা উল্লেখযোগ্য জীব নয়। তারা আছে—এইমাত্র
বাংলাদেশে ‘বোম্বেটে’ কথাটি বেশিদিনের নয়। বারো ভুঁইয়ার সময়ে বাংলাদেশে পোর্তুগিজ জলদস্যুদের বিষম উপদ্রব হয়েছিল। তখনকার রডা, গঞ্জালিস ও কার্ভালো প্রভৃতি জলদস্যুর নাম বাঙালি এখনও ভুলতে পারেনি, কারণ বর্গির অত্যাচার ও মগের অত্যাচারের মতো পোর্তুগিজ জলদস্যুদের অত্যাচারও ছিল তখনকার বাংলাদেশের নিত্য নৈমিত্তিক বিভীষিকা। ওই সময়েই ‘বোম্বেটে’ কথাটি বাংলাদেশে চলতে শুরু হয়। ইংরেজি Bombasdies-এর বাংলা হচ্ছে ‘গোলন্দাজ সৈন্য’। পোর্তুগিজ জলদুস্যরা গোলন্দাজিতে অর্থাৎ কামান-বন্দুকের ব্যবহারে দক্ষ ছিল। তাই বোধহয়, ওই ইংরেজি কথাটা থেকে বাংলা ‘বোম্বেটিয়া’ বা ‘বোম্বেটে’ কথাটির সৃষ্টি হয়, আর সাধারণভাবে জলদস্যুদেরই প্রতি ব্যবহৃত হতে থাকে।
‘বোম্বেটে’ কথাটি খাঁটি বাংলা কথা না হলেও খাঁটি বাঙালি বোম্বেটের অভাব বাংলাদেশে ছিল না। তবে এখানে তো সমুদ্রতীরবর্তী নগর বেশি নেই, কাজেই বোম্বেটেদের ছোট ছোট নৌকো করে নদ-নদীর ভিতরে এসেই ব্যবসা চালাতে হত। বড় বড় জাহাজে চড়ে পৃথিবীর নামজাদা বোম্বেটেদের মতো সমুদ্রের উপর বড়রকমের ডাকাতি করার সুযোগ তাদের বেশি ছিল না।
সেকেলে বাংলার জল-ডাকাতদের সাধারণ নিয়ম ছিল এই রকম : কোনও যাত্রীনৌকো দেখলেই তারা নিজেদের নৌকো নিয়ে তার কাছে গিয়ে বলত, ‘আমাদের আগুন নিবে গেছে। একটু আগুন দেবে ভায়া?’ যাত্রীনৌকোর লোকেরা কোনরকম সন্দেহ না করে আগুন দেওয়ার জন্যে বোম্বেটে নৌকোর পাশে গিয়ে হাজির হত এবং অমনি সেই সুযোগে বোম্বেটেরা যাত্রীনৌকোর ভিতরে লাফিয়ে পড়ে সর্বনাশের সৃষ্টি করত। বারে বারে এমনি ঠকে শেষটা অচেনা নৌকো আগুন চাইলেই তারা তাড়াতাড়ি আরও তফাতে সরে পড়ে পলায়ন করত।
বাংলাদেশে জল-ডাকাতরা প্রায়ই ছিপনৌকো ব্যবহার করত। এখানকার ডাঙার ডাকাতরা তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্যে ব্যবহার করত ‘রণপা’। রণপা হচ্ছে দুটো লম্বা বাঁশের ডান্ডা—মানুষের মাথার চেয়ে অনেক উঁচু। সেই ডান্ডার মাঝখানে পা রাখবার জায়গা থাকে। (ইউরোপেরও অনেক দেশের চাষিরা শস্যখেতে চলাফেরা করবার সময়ে এমনই রণপা ব্যবহার করে থাকে।) কিন্তু বাংলার ডাঙার ডাকাতরাও জলপথে তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্যে বোম্বেটেদেরই মতো ছিপ ব্যবহার করত।
আইনের চোখে অপরাধী হলেও সামাজিক হিসাবে, আগেকার বোম্বেটেরা বোধহয় সাধারণ খুনি বা ডাকাতের চেয়ে উচ্চশ্রেণির জীব ছিল। কারণ, দেখা যায়, আগেকার এমন কয়েকজন লোক নৌ-যোদ্ধারূপে বিখ্যাত হয়ে প্রভূত যশ ও রাজসম্মান অর্জন করে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় অমর হয়ে রয়েছেন, যাঁদের বোম্বেটে বললে খুব ভুল করা হয় না।
যেমন ভাস্কো ডা গামা। পোর্তুগালের এই নামজাদা যোদ্ধা-নাবিক পোর্তুগিজ অধিকৃত ‘ভারতবর্ষে’র বড়লাটরূপে কোচিতে প্রাণত্যাগ করেন (১৫২৪)। কিন্তু আফ্রিকার স্থানে স্থানে ও ভারতের কালিকটে তিনি যেসব কাজ করে গেছেন, তা বোম্বেটের পক্ষেই সাজে। পোর্তুগালের আর এক নাবিক নেতা ফার্নান ম্যাগেল্যানও স্বদেশে যথেষ্ট শ্রদ্ধা প্রীতি লাভ করেছেন, কিন্তু তিনি সাধারণ ইতর বোম্বেটের চেয়ে ভালো লোক ছিলেন না।
ইংল্যান্ডকে স্পেনের ‘আর্মাডা’র কবল থেকে বাঁচিয়ে এবং অনেক নতুন নতুন দেশ আবিষ্কার ও ব্রিটিশসাম্রাজ্যভুক্ত করে স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক আজ স্বদেশভক্ত বীর বলে সুপরিচিত। সে হিসাবে সত্য সত্যই তিনি এই সম্মানের অধিকারী। কিন্তু জলদস্যুরা যে কাজ করলে নিন্দিত হয়, তাঁর অনেক অ্যাডভেঞ্চারের মধ্যেই তা লক্ষ করা যায়। ড্রেক একালে জন্মালে, পৃথিবী বোধহয় তাঁকে ক্ষমা করত না। ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়ে তিনি যথেচ্ছভাবে লুঠতরাজ করেছেন, হাজার হাজার অসহায় মানুষকে হত্যা করেছেন, বড় বড় শহরকে আগুনের মুখে সমর্পণ করেছেন। সে দেশের লোকের কাছে তিনি নিশ্চয়ই বীর নামে পরিচিত হয়নি। যুদ্ধের নামগন্ধ নেই, নগর লুণ্ঠনও শেষ হয়ে গেছে, তবু হাইতি দ্বীপের রাজধানী স্যান্টো ডোমিঙ্গো শহরের নিরীহ বাসিন্দাদের উপর ড্রেক অনবরত গুলিগোলা বৃষ্টি করেছেন। নগরের চতুর্দিকে যখন ভীষণ অগ্নির তাণ্ডবলীলা, নিরপরাধ নর-নারী ও শিশুর আর্তনাদে যখন আকাশ-বাতাস পরিপূর্ণ এবং ড্রেকের সৈন্যরা যখন ক্রমাগত গুলিগোলা বৃষ্টি করে একেবারে নেতিয়ে কাবু হয়ে পড়েছে, তখনও লক্ষাধিক মুদ্রা ঘুষ না পাওয়া পর্যন্ত ইংল্যান্ডের এই মহাবীর তুষ্ট হতে পারেননি।
পনেরো, ষোলো ও সতেরো শতাব্দীতে ইংল্যান্ডবাসীরা নৌ-যোদ্ধা ও বোম্বেটেকে যে প্রায় অভিন্ন বলে মনে করত, তার অসংখ্য ঐতিহাসিক প্রমাণ আছে। তখন সমুদ্রে ও সাগর তীরবর্তী স্থানে শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করবার সময়ে, ইংরেজরা অধিকাংশ সময়েই সাধারণ বোম্বেটেদের সাহায্য গ্রহণ করত। ইংল্যান্ডের রাজা, রানি ও শাসনকর্তারা পর্যন্ত বেতনভুক্ত নিয়মিত নৌ-সৈন্যদের সঙ্গে বোম্বেটেদের পালন করতে লজ্জিত হতেন না—যেমন হতেন না বাংলা দেশের বারো ভুঁইয়ারাও। রাজার সাহায্য পেয়ে বোম্বেটেদেরও বুক দশহাত হয়ে উঠত, তারা রাজশত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করবার অজুহাতে নিরীহ প্রজাদের ধন-প্রাণ নির্ভয়ে লুণ্ঠন করত।
এই শ্রেণির বোম্বেটেদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে হেনরি মর্গ্যান। এই ভীষণ বোম্বেটেকে ইংল্যান্ডের রাজসরকার টাকা, জাহাজ ও লোকজন দিয়ে সাহায্য করেন। তার ফলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছাকাছি দ্বীপপুঞ্জে এবং দক্ষিণ আমেরিকার উত্তরাঞ্চলে কারুর পক্ষে ধন-প্রাণ বজায় রেখে বাস করাই অসম্ভব হয়ে ওঠে। পানামার মতো শহরেও হেনরি মর্গ্যান হানা দিতে ভয় পায়নি, তার কবলগত হয়ে পানামার অধিকাংশ অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংস হয়ে যায় এবং যথাসর্বস্ব হারিয়েও এখানকার কত হাজার বাসিন্দা যে মৃত্যুমুখে পড়তে বাধ্য হয়, তার কোনও হিসাব নেই। ওই ওঁচা বোম্বেটেকে জলদস্যুরা পর্যন্ত ঘৃণা করত। কারণ সে কাক হয়েও কাকের মাংস খেত,—অর্থাৎ মর্গ্যান কেবল পরিচিত নির্দোষ ব্যক্তিরই ধন-প্রাণ কেড়ে নিত না, নিজের দলের লোকদেরও টাকা দু-হাতে চুরি করত। জলপথে ও স্থলপথে অসংখ্য অত্যাচার, নরহত্যা, লুণ্ঠন ও পাপকাজ এবং বোম্বেটেদেরও তহবিল তছরুপ করে, শেষটা সে সকলকে ফাঁকি দিয়ে হঠাৎ একদিন লুকিয়ে সরে পড়ে। তখন ইংলন্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লসের ধর্মভাব হঠাৎ জেগে উঠল। তাঁর হুকুমে মর্গ্যানকে ধরে দেশে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু বোম্বেটে সর্দারকে স্বচক্ষে দেখে রাজার মন এত খুশি হয়ে উঠল যে, শাস্তি দেওয়া দূরে থাক, ‘স্যার’ উপাধি ও ‘কর্নেল’ পদ দিয়ে তিনি তাঁকে আবার জামাইকা দ্বীপের ছোটলাট করে পাঠালেন।
রেমব্রান্ডের মতো বিশ্ববিখ্যাত ও সর্বজনমান্য চিত্রকর আঁকলেন কর্নেল স্যার হেনরি মর্গ্যানের ছবি এবং যার মরা উচিত ছিল ফাঁসিকাঠে, ছোটলাটের উঁচু, পুরু ও নরম গদিতে বসে সে সাধু-অসাধুর শাসনভার অর্থাৎ মুণ্ডপাতের ভার পেয়ে চোদ্দো বছর সুখে সম্মানে কাটিয়ে তিয়াত্তর বৎসর বয়সে পরম নিশ্চিন্তভাবে ইহলোক ত্যাগ করলে! পাপের এমন জয়ের দৃষ্টান্ত পৃথিবীর অন্য কোনও দেশের ইতিহাসে দেখা যায় না! এমনকি আজও দেখি, অনেক নামজাদা ইংরেজ লিখিয়ে এই বোম্বেটের কলঙ্ক ক্ষালনের জন্যে প্রাণপণে ব্যর্থ চেষ্টা করছেন। আশ্চর্য!
অথচ ওই সময়কার ইউরোপীয় ঐতিহাসিকরা কানহোজি আংগ্রেকে জলদস্যু রূপে বর্ণনা করতে লজ্জিত হননি। ভারতে যখন ঔরংজেবের রাজত্ব, মারাঠি নৌ-বীর কানহোজি আংগ্রের নামে তখন আরবসাগরগামী সমস্ত জাহাজ ভয়ে থরহরি কম্পমান হত। স্থলপথে ছত্রপতি শিবাজির মতন জলপথে কানহোজি আংগ্রেও ছিলেন সমান অজেয়। ইংল্যান্ডে জন্মালে তিনি ড্রেক বা নেলসনেরই মতো পৃথিবীজোড়া অমর নাম অর্জন করবার সুযোগ পেতেন। মোগল, ইংরেজ, ওলন্দাজ ও পোর্তুগিজদের কোনও জাহাজই তাঁর কবল থেকে সহজে নিস্তার পেত না। ইংরেজ ও অন্যান্য ইউরোপীয় জাতিরা একসঙ্গে অনেক যুদ্ধজাহাজ নিয়ে বারবার তাঁকে আক্রমণ করেছে, কিন্তু প্রতিবারই একাকী লড়েও জলযুদ্ধে জয়ী হয়েছেন মহাবীর কানহোজি আংগ্রেই! অথচ তখন ইউরোপের পূর্বোক্ত জাতিরা স্থলযুদ্ধের চেয়ে জলযুদ্ধেই বেশি বিখ্যাত ছিলেন। বারবার পরাজিত শত্রুদের কলমে ‘বোম্বেটে’ বলে নিন্দিত এই অসাধারণ ভারতীয় নৌ-বীরের বীরত্বকাহিনি যে আজও এখানে ঘরে ঘরে পরিচিত হয়নি, আমাদের ঐতিহাসিকদের পক্ষে এটা অল্প কলঙ্কের কথা নয়। বাংলা ভাষায় প্রায় তিন যুগ আগে পুরাতন ‘ভারতী’তে একবার কানহোজি আংগ্রে সম্বন্ধে একটি ছোট প্রবন্ধ দেখেছিলুম, তারপর আর কারুর তাঁকে মনে পড়েনি!
সাধারণ হত্যা বা দস্যুতার মধ্যে লুকোচুরি ও কাপুরুষতা আছে যতটা, বোম্বেটের কাজে যে ততটা নেই, সত্যের অনুরোধে এ কথা স্বীকার করা চলে অনায়াসেই। সে যুগে বোম্বেটেদের প্রাধান্য ছিল খুব বেশি, তখন সমুদ্রযাত্রার সময়ে প্রত্যেক জাহাজের আরোহীরাই তাদের দেখা পাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়ে যেতেন ও সাবধান হয়ে থাকতেন এবং বোম্বেটেদের ভয়ে অধিকাংশ সওদাগরি জাহাজেও কামান-বন্দুক ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র রাখা হত। অনন্ত সমুদ্র,—সাধারণ খুনে বা ডাকাতের মতো বোম্বেটেরা অতর্কিতে হঠাৎ এসে আক্রমণ করতে পারত না, তাদের অনেক দূর থেকেই স্পষ্ট দেখা যেত এবং আক্রান্তরাও আত্মরক্ষা করবার সুযোগ পেত যথেষ্ট। কিন্তু তবু যে তারা বাঁচতে পারত না, তার প্রধান কারণ হচ্ছে বোম্বেটেদের সাহস ও বীরত্ব।
তবে জলদস্যুদের এত নিন্দা কেন? তাদের মূলমন্ত্র হচ্ছে, জোর যার মুল্লুক তার। এ মূলমন্ত্র সমাজের শান্তিরক্ষার পক্ষে অচল। তার উপরে সেকালকার বোম্বেটেদের নিষ্ঠুরতা ও হিংসুকতা ছিল অসম্ভব—দয়ামায়ার অস্তিত্ব পর্যন্ত তারা মানত না। অধিকাংশ সময়েই তারা কোনও জাহাজ দখল ও লুট করে সমস্ত আরোহীকেই নির্বিচারে সমুদ্রের জলে নিক্ষেপ করত। প্রাণে মারবার আগে অনেক লোককে তারা অমানুষিক যন্ত্রণা দিতেও ছাড়ত না। তারা নরপশু ছিল বলেই তাদের সমস্ত সাহস ও বীরত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভস্মে ঘৃতাহুতির মতো। যে বীরত্বে ক্ষমা নেই, দয়া নেই, মনুষ্যত্ব নেই, তা একেবারেই উল্লেখযোগ্য নয়।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জের ফরাসি জলদস্যু লোলোনজের পাশবিক বীরত্বের কাহিনি আমরা পরে বিবৃত করব। ব্রেজিলিয়ানো নামে আর এক বোম্বেটের গল্পও আমরা পরে বলব, যা পড়তে পড়তে পাঠককে শিউরে উঠতে হবে। এ শ্রেণির লোকের সাহস ও বীরত্ব না থাকলেই ভালো ছিল।
জলদস্যু হচ্ছে প্রাচীন যুগেরই জীব। গ্রিকদের সময়েও জলদস্যুদের প্রভাব ছিল যথেষ্ট। সে সময়ে সমুদ্রে বেরিয়ে এক জাহাজ যদি আর এক জাহাজকে দেখতে পেত, তাহলে সর্বাগ্রে প্রশ্ন করত, ‘তোমরা বোম্বেটে, না সওদাগর?’ রোমানদের সময়েও গ্রিক বোম্বেটেরা দলে এত ভারি ছিল যে, ভূমধ্যসাগর দিয়ে সাধারণ জাহাজ প্রায় চলাফেরা করতে পারত না বললেই চলে।
ভূমধ্যসাগরে বোম্বেটে জাহাজের সংখ্যা তখন এক হাজারের কম ছিল না। রোমানরা শেষটা বাধ্য হয়ে বিপুল এক রণতরীর বাহিনী পাঠিয়ে এই দস্যুতা দমন করেছিল। কিন্তু এর পরেও অনেকবার জলদস্যুদের অত্যাচারে রোমকে যারপরনাই কষ্টভোগ করতে হয়েছিল। সেকালকার ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, পোর্তুগাল ও স্পেনের সমুদ্রতীরবর্তী নগরগুলি নানাদেশি বোম্বেটেদের অত্যাচারে যখন তখন ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছাড়ত।
পঞ্চদশ শতাব্দীর আরম্ভে চিনারা সিংহলদেশের উপরে কী বিষম ডাকাতি করেছিল এইবারে সেই কথাই বলি। চেং হো নামে এক চিনা-খোজা একবার জাহাজে চড়ে সিংহলদেশে গিয়েছিল। সেখানে বুদ্ধদেবের পবিত্র দাঁত আছে শুনে সে আব্দার ধরে বসল, তাকে ওই দাঁত উপহার দিতে হবে। বলাবাহুল্য, সিংহলের তখনকার রাজা অলগাক্ষোনারা (?) তার সে অন্যায় আব্দার গ্রাহ্য করলেন না। চেং হো সেবারের মতো মুখ চুন করে খালি হাতেই চিনদেশে ফিরে গেল।
কিন্তু ১৪০৯ খ্রিস্টাব্দে বাষট্টিখানা জাহাজ নিয়ে সে আবার সিংহলদেশে আবির্ভূত হল। সিংহলের রাজার সৈন্যদের সঙ্গে চিনাদের তুমুল লড়াই লেগে গেল। সেই ফাঁকে চেং হো একদল সৈন্য নিয়ে সিংহলি সৈন্যদের চোখে ধুলো দিয়ে হঠাৎ রাজধানীতে এসে কৌশলে নগর দখল করল এবং রাজা ও রাজপরিবারের ছেলেমেয়ে ও রাজ্যের প্রধান প্রধান লোকদের বন্দি করে সটান আবার চিনদেশে গিয়ে হাজির হল। পরে রাজ্যচ্যুত রাজাকে চিনারা আবার সিংহলদেশে পাঠিয়ে দিয়েছিল বটে, কিন্তু তারপর, কিছুকাল পর্যন্ত সিংহল দেশকে চিনসম্রাটের অধীনতা স্বীকার করে কর পাঠাতে হত! এই বোম্বেটেগিরির পরে, ভারতসাগরে চিনাদের প্রভাব দুর্দমনীয় হয়ে উঠেছিল।
চিনদেশেরও সমুদ্রতীরবর্তী স্থানগুলি নিরাপদ ছিল না—সেসব জায়গায় জাপানি বোম্বেটেরা সকলকে নাস্তানাবুদ করে তুলেছিল। ষোড়শ শতাব্দীর পর ইংরেজ ও ওলন্দাজ বোম্বেটেদের দৌরাত্ম্যেও চিনাদের বড় কম নাকাল হতে হয়নি।
আগেই বলেছি, ইংরেজরাও সেকালে বোম্বেটের ব্যবসায়ে যথেষ্ট বদনাম কিনেছিল। রানি এলিজাবেথ অনেক ইংরেজ বোম্বেটেকে নিজের নৌ-সেনাদলে ভর্তি করে নিয়েছিলেন। সে সময়ে জন স্মিথ নামে এক মহা ধড়িবাজ বোম্বেটের জ্বালায় ইংরেজরা পর্যন্ত অস্থির হয়ে উঠেছিল এবং তাকে বন্দি করে ফাঁসিকাঠে লটকে দেওয়ার জন্যে চারিদিকে সাড়া পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু কেউ তাকে ধরতে পারেনি।
এমন যে শয়তান, তারও মনে ছিল প্রচুর দেশভক্তি। হঠাৎ সে একদিন নিজেই কর্তৃপক্ষের কাছে এসে হাজির—ধরা দিলে মুক্তি নেই জেনেও। সকলেই অবাক হয়ে গেল! কিন্তু বোম্বেটে জন স্মিথ বললে, ‘দেশের বিপদ দেখেই আমি ধরা দিচ্ছি। সবাই প্রস্তুত হও। আমি স্বচক্ষে দেখে এসেছি, ইংল্যান্ড ধ্বংস করবার জন্যে ‘স্প্যানিস আর্মাডা’ আসছে।’ এ খবর তখনও দেশের কেউ পায়নি,—শুনেই সারা ইংল্যান্ডে ‘সাজো সাজো’ রব উঠল, সকলে যথাসময়ে সাবধান হওয়ার সুযোগ লাভ করলে। বলাবাহুল্য, বোম্বেটে জন স্মিথের নিঃস্বার্থ আত্মসমর্পণ ব্যর্থ হল না। কেবল শাস্তি থেকে মুক্তি নয়—সেই সঙ্গে সে যথেষ্ট পুরস্কারও লাভ করল।
স্পেন থেকে মরক্কোয় বিতাড়িত হওয়ার পর ষোড়শ শতাব্দীর মূররা ভয়ংকর বোম্বেটে রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল। তাদের ভয়ে ভূমধ্যসাগরের ব্যাবসা-বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো হয়েছিল। সারা ইউরোপের শক্তি তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উঠতে পারেনি। প্রথমে উর্জ ও পরে তার ভাই খয়েরুদ্দিনের নামে তখনকার খ্রিস্টান নাবিকদের বুক ভয়ে ঠান্ডা হয়ে যেত। কারণ মূর বোম্বেটেরা কেবল জাহাজ লুট করত না, উপরন্তু খ্রিস্টানদেরও ধরে নিয়ে গিয়ে আফ্রিকায় গোলাম করে রাখত এবং তাদের পথের কুকুরের মতো কষ্ট দিত। একবার আন্দ্রিয়া ডোরিয়া নামে এক নৌ-বীর বহু জাহাজ ও সৈন্য নিয়ে জলযুদ্ধে মূর বোম্বেটেদের হারিয়ে দেন এবং তাদের কবল থেকে বিশ হাজার খ্রিস্টান স্ত্রী-পুরুষকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন—তাদের মধ্যে ইউরোপের অনেক বড়ঘরের ছেলেমেয়েও ছিল। কিন্তু তবু মূর বোম্বেটেরা কাবু হয়ে পড়ল না। অবশেষে কয়েক শত বৎসরের প্রাণপণ চেষ্টার পরে, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে, মূর জলদস্যুদের প্রতাপ দূর হয়। ইংরেজ নৌ-সেনাপতি লর্ড এক্সমাউথ ওলন্দাজদের সঙ্গে মিলে মূর বোম্বেটেদের আস্তানা ভেঙে দেন এবং তারপর ফরাসিরা আলজিয়ার্স দেশ অধিকার করলে মূররা আর মাথা তুলতে পারলে না। ইউরোপে এমন বোম্বেটের বিভীষিকা আর কখনও হয়নি।