প্রথম খণ্ড – খুন ও চুরী

প্রথম খণ্ড – খুন ও চুরী

প্রথম পরিচ্ছেদ – গৃহত্যাগ

হরমসজী বোম্বাই সহরের একজন প্রধান ধনাঢ্য ব্যক্তি। এলফিনস্টোন সার্কেলে তাঁহার প্রাসাদতুল্য অট্টালিকা। উহার ত্রিতলে তিনি সপরিবারে বাস করিতেন। নিম্নে তাঁহার প্রকাণ্ড আফিস।

হরমসজী অনেকরূপ ব্যবসা-বাণিজ্য করিতেন, কিন্তু ব্যাঙ্কিং, অথবা টাকা দেনা-পাওনা, মজুত রাখা, হুণ্ডি প্রভৃতির কার্য্য করাই তাঁহার প্রধান ব্যবসায় ছিল।

তাঁহার নিবাস সুরাট নগরে। তিনি ধনবানের সন্তান নহেন। অতি শৈশবেই তিনি পিতৃমাতৃহীন হইয়াছিলেন। এখন তিনি যে অতুল ঐশ্বর্য্যের অধীশ্বর, তাহা তাঁহারই স্বোপর্জিত। তিনি রিক্তহস্তে বোম্বে সহরে আসিয়াছিলেন; কিন্তু নিজের চেষ্টা, উদ্যম ও যত্নে বহু অর্থোপার্জ্জন করিয়া তিনি এক্ষণে পার্শী-সমাজের মধ্যে একজন মহা সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি হইয়াছেন।

ধনোপার্জন না করিয়া বিবাহ করিব না, মনে মনে ইহা স্থির করিয়া তিনি অল্প বয়সে বিবাহ করেন নাই। যখন তাঁহার বয়স ছত্রিশ বৎসর, তখন তিনি রাজাবাঈকে বিবাহ করেন। রাজা বাঈ-এর বয়ঃক্রম তখন প্রায় বিংশ বৎসর হইয়াছিল।

বিবাহের দুই বৎসর পরে তাঁহাদের এক কন্যা হয়। সেই কন্যা কমলাবাঈ এক্ষণে ষোড়শ বর্ষীয়া পূর্ণ-যৌবনা হইয়াছেন। কমলাবাঈ এর ন্যায় সুন্দরী, চিরসুন্দরী পার্শী রমণীগণের মধ্যেও অতি বিরল ছিল।

কমলাবাঈ যে, কেবল রূপে অতুলনীয়া, তাহা নহে; তাঁহার ন্যায় সুশিক্ষিতা, গুণবতী রমণীও বড় একটা দেখিতে পাওয়া যায় না। সকলেই কমলার রূপে-গুণে বিশেষ মুগ্ধ।

হরমসজীর আর কোন সন্তানাদি হয় নাই। তবে তাঁহার পরিবারে আর একটি যুবক বাস করিতেন। ইঁহার নাম রস্তমজী। ইনি হরমসজীর একটি বন্ধুর পুত্র। ইঁহাকে তিনি পুত্র নির্ব্বিশেষে ভালবাসিতেন। নিজের ধন-সম্পত্তি সকলই ইঁহাকে দিয়া বিশ্বাস করিতেন। ইঁহার বিংশ বৎসর বয়স হইতে-না-হইতেই, তিনি ইঁহাকে নিজ কেসিয়ার নিযুক্ত করিয়াছিলেন। এই পাঁচ-ছয় বৎসর রস্তমজীই ব্যাঙ্কের সমস্ত কার্য্য করিতেছেন। রস্তমজী ও কমলাবাঈ এক সঙ্গে লালিত- পালিত বলিলে অত্যুক্তি হয় না। উভয়ের মধ্যে স্বভাবতই ভালবাসা জন্মিয়াছিল। উভয়ে উভয়কে বড় ভালবাসিতেন।

বিবাহের পর হইতে এই সতের-আঠার বৎসর হরমসঙ্গী সপরিবারে বড়ই সুখে কাটাইয়াছিলেন। দিন দিন তাঁহার ধন-মান-যশঃ বৃদ্ধি পাইতেছিল। শোক, দুঃখ, চিন্তা ও বিষণ্ণতার ছায়া তাঁহার শান্তিনিকেতনের ছায়াস্পর্শও করিতে পারে নাই।

কিন্তু চিরকাল কাহারও সমান যায় না। এক বৎসর হইল, একটি লোক আসিয়া গোপনে রাজাবাঈ-এর সহিত সাক্ষাৎ করিল। কি কথা হইল, হরমসজী তাহা কিছুই জানিতে পারিলেন না। তিনি শুনিলেন যে, তাঁহার স্ত্রীর এক ভগ্নীর ছেলে তাঁহার কাকার সহিত বোম্বেয় আসিয়াছেন। তাঁহারা দিন কতক এইখানেই থাকিবেন।

হরমসজী জানিতেন, তাঁহার স্ত্রীর এক ভগ্নী ছিলেন। সেই ভগ্নীর স্বামী বহু বৎসর হইল, রেঙ্গুনে ব্যবসা করিতে যান; তদবধি, তাঁহাদের আর কোন সন্ধান নাই। তিনি তাঁহার স্ত্রীর কথা বিশ্বাস করিলেন। তাঁহার কাছে শুনিলেন, তাঁহার সেই ভগ্নী ও ভগ্নিপতি উভয়েরই রেঙ্গুনে মৃত্যু হইয়াছে। সেই ভগ্নিপতির ভ্রাতা ভ্রাতুষ্পুত্রকে সঙ্গে লইয়া বোম্বেয় বেড়াইতে আসিয়াছেন।

পরে তাঁহারা উভয়েই হরমসজীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিলেন। একজন অতি সুপুরুষ যুবক, তাঁহার নাম মাঞ্চারজী, ইনিই হরমসজীর শালী-পুত্র। অপরের বয়স চল্লিশের অধিক ইহার নাম বর্জরজী। ইঁহার চেহারা দেখিলে সহসা ভক্তি বা বিশ্বাস করিতে ইচ্ছা হয় না; অথচ ইনি কুরূপও নহেন। কথাবার্তায় লোকের মন ভুলাইতে ইনি সিদ্ধহস্ত। অন্ততঃ একদিনের আলাপেই হরমসজী ইঁহার প্রতি বড়ই প্রীত হইলেন।

হরমসজী ইঁহাদিগকে নিজের বাড়ীতে আসিয়া বাস করিতে বিশেষ অনুরোধ করিলেন; কিন্তু তাঁহারা ইহাতে কিছুতেই সম্মত হইলেন না, তবে প্রত্যহ কোন-না-কোন সময়ে একবার আসিতে প্রতিশ্রুত হইলেন। এক মাস যাইতে-না-যাইতে বর্জরজী, হরমসজীর ব্যাঙ্কে লক্ষ টাকা জমা রাখায় তাঁহার উপর হরমসজীর বিশ্বাস ও ভক্তি অধিকতর বৃদ্ধি পাইল।

ইঁহাদের আগমনে কেবল দুইজন সন্তুষ্ট হইলেন না—কমলাবাঈ ও রস্তমজী। কিন্তু উভয়ের কাহারও কোন কথা মুখ ফুটিয়া বলিবার উপায় ছিল না।

দুইমাস যাইতে-না-যাইতে হরমসজী একদিন রস্তমজীকে গোপনে ডাকিয়া বলিলেন, “দেখ, কমলা এখন বড় হইয়াছে। এখন তোমার আর আমাদের বাড়ী থাকা ভাল দেখায় না। ইহারই মধ্যে নানা লোকে নানা কথা কহিতে আরম্ভ করিয়াছে। তাহার নামে কোন কলঙ্ক রটিলে তুমি নিশ্চয়ই বিশেষ দুঃখিত হইবে।”

রস্তমজী বলিলেন, “নিশ্চয়ই। আমি আজই অন্যত্রে থাকিবার বন্দোবস্ত করিব।”

হরমসজী বলিলেন, “আমি এইজন্য আজ হইতে তোমার একশত টাকা মাহিনা বাড়াইয়া দিলাম। অন্যত্রে থাকিতে তোমার খরচও কিছু বাড়িবে।”

রস্তমজী বলিলেন, “আপনি ত আমাকে যথেষ্টই দিতেছেন।”

সেইদিন বাসা স্থির করিয়া রস্তমজী, হরমসজীর বাড়ী পরিত্যাগ করিলেন। কমলাবাঈকে কোন কথা বলিবার সুযোগ পাইলেন না। দেখিলেন, কমলাবাঈ সেদিন অন্যত্র গিয়াছে বা প্রেরিত হইয়াছে। সাক্ষাতের সুবিধা হইল না।

তিনি অন্যত্র বাসা লইবার দিন-কতক পরে পেষ্টনজী তোরাবজী নামে একটি ধনাঢ্য যুবক বোম্বে সহরে আসিলেন। তিনি হরমসজীর নামে পত্র আনিয়াছিলেন। রস্তমজী শুনিলেন, তিনি কমলাবাঈ-এর পাণি-প্রার্থী।

পেষ্টনজী, বর্জরজী ও মাঞ্চারজী তিন জনেরই সহিত রস্তমজীর পরিচয় হইল—বন্ধুত্বও হইল। নিজের দুঃখের কারণের জন্য তিনি কাহারও উপরই রাগ করিতে পারিলেন না। মনের দুঃখ মনেই লুকাইয়া রাখিলেন।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – উদ্যানে

প্রায় তিন মাস অতীত হইয়াছে। ইহারই মধ্যে রস্তমজীর চরিত্রেও বিশেষ একটা পরিবর্ত্তন ঘটিয়াছে। তিনি সে রস্তমজী আর নাই। কমলাকে হারাইয়াই তাঁহার এই পরিবর্ত্তন ঘটিয়াছে। মনের যন্ত্রণা লাঘব করিবার জন্য এখন হইতে তিনি জুয়া ও মদ ধরিয়াছেন।

তিনি বেশ জানিতে পারিয়াছিলেন, মাঞ্চারজী ও পেষ্টনজী উভয়েই কমলাকে ভালবাসেন; উভয়েই কমলা-লাভের জন্য ব্যাকুল। যদিও তাঁহার ইঁহাদের সহিত বিশেষ সৌহার্দ জন্মিয়াছিল, এক সঙ্গে খেলা, আমোদ-প্রমোদ করিতেন, তথাপি তিনি ইঁহাদের মনে মনে অত্যন্ত ঘৃণা করিতেন। ইঁহাদের উপর তাঁহার আন্তরিক ক্রোধ ছিল। নিজের ঈর্ষানলে নিজেই সৰ্ব্বদা দগ্ধ হইতেন।

ইহাদের মনের ভাব অন্যরূপ ছিল না। মনে মনে ইঁহাদেরও রস্তমজীর উপর মৰ্ম্মান্তিক আক্রোশ ছিল। তিনজনই উষ্ণরক্ত যুবক, মধ্যে মিষ্ট-চরিত্র প্রৌঢ় বর্জরজী না থাকিলে হয়ত অনেক দিনই ইঁহাদের পরস্পর বিশেষ বিদ্বেষভাব প্রকাশ পাইত। হয় ত একটা খুন-খুনীর ব্যাপার ঘটিত।

রস্তমজীর আরও রাগ, ইঁহারা প্রত্যহই কমলাবাঈকে দেখিতে পাইতেন, তাহার সহিত কথা কহিতেন, হাস্য-পরিহাস করিতেন; কিন্তু প্রায় এক বৎসর কাটিয়া গেল, তিনি একবারও কমলার সহিত দেখা করিতে পারিলেন না। হরমসজী তাঁহাকে কমলার সহিত দেখা করিতে একেবারেই নিষেধ করিয়া দিয়াছিলেন।

রস্তমজী আর একবারমাত্র কমলার সহিত দেখা করিবার জন্য বড়ই ব্যাকুল হইয়াছিলেন। কিন্তু এতদিন কাটিয়া গেল, তথাপি তিনি তাহার কোনই সুবিধে পাইলেন না; দিন রাত্রি তিনি এক অসহনীয় যাতনা, দুৰ্দ্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা ও ব্যাকুলতা হৃদয় মধ্যে পোষণ করিতে লাগিলেন

তিনি তাঁহার হৃদয়ের জ্বালা কাহাকেও জানাইতেন না। কেবল তাঁহার প্রাণের বন্ধু ফ্রামজীকে কখন-কখনও বলিয়া যাতনার উপশম করিতেন। ফ্রামজী তাঁহার সমবয়সী, তাঁহারই ন্যায়, হরমসজীর ব্যাঙ্কে একাউন্ট্যান্টের কাজ করিতেন। তাঁহাদের পরস্পর এতই বন্ধুত্ব ছিল যে, দুইজনে একই জুতা, একই পোষাক, একই কাপড় পরিতেন, একই আহার-বিহার করিতেন।

একদিন রাত্রি প্রায় দশটার সময়, রস্তমজী রাস্তায় ঘুরিতে ঘুরিতে এলফিনস্টোন সার্কেলের নিকট আসিলেন। অন্যমনস্কে এলফিনস্টোন সার্কেলের সুন্দর উদ্যানে প্রবিষ্ট হইলেন। ভাবিলেন, উদ্যানের নির্জ্জনতায় ও অবাধ বায়ু-প্রবাহে হয় ত তাঁহার হৃদয় কতকটা শান্তিলাভ করিতে পারে। উদ্যানের মধ্যে প্রবেশ করিয়া কিছুদূরে আসিয়া তিনি দেখিলেন, অনতিদূরে এক স্থানে একখানি বেঞ্চের উপর বসিয়া করলগ্নকপোলা একটি সুন্দরী নির্জ্জনে চিন্তামগ্না রহিয়াছে। তাহার পার্শ্বে আসিয়া রস্তমজী স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইলেন। এ যে কমলাবাঈ! কমলাবাঈ তাঁহার দিকে চমকিত হইয়া চাহিল, তৎপরে সত্বর উঠিয়া দাঁড়াইল।

রস্তমজী বলিলেন, “কমলা, এতদিন পরে তোমার দেখা পাইয়াছি—”

কমলাবাঈ বাধা দিয়া বলিল, “তুমি কি আমাকে পিতৃ-আজ্ঞা লঙ্ঘন করিতে বল? তিনি আমাকে তোমার সঙ্গে দেখা করতে মানা করেছেন।”

রস্তমজী বলিলেন, “কখনও নয়। তবে যখন দেখা হইয়াছে, তখন কেবল দুইটি কথা জিজ্ঞাসা করিব।”

কমলাবাঈ কোন উত্তর দিল না। মস্তক অবনত করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

রস্তমজী বলিলেন, “তুমি কি পেষ্টনজীকে বিবাহ করিবে?”

“না।”

“মাঞ্চারজীকে?”

“না।”

“আর কখনও কি তোমার সহিত আমার দেখা হইবে?”

“আমাকে ভূলে যাও,” বলিয়া কমলাবাঈ গমনোদ্যতা হইল।

“আমার জন্য তুমি যাইবে কেন? আমিই যাইতেছি,” বলিয়া রস্তমজী সত্বরপদে উদ্যান হইতে বাহিরে হইয়া পড়িলেন। যতক্ষণ তাঁহাকে দেখা গেল, কমলা বাঈ তাঁহার দিকে অনিমেষদৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল।

কমলাবাঈ দেখিল যে, রস্তমজী রাজপথে আসিবামাত্র একটি বালক তাঁহার হস্তে একখানি পত্র দিল। তিনি গ্যাসের নিকট গিয়া পত্রখানি পাঠ করিয়া পকেটে রাখিলেন। বালককে বিদায় দিয়া তিনি যেমন অগ্রসর হইবেন, অমনই বর্জরজীকে সম্মুখে দেখিতে পাইলেন। কমলা দেখিল, তাঁহারা দুইজনে কেবল দুই-একটি কথা কহিয়া দুইজনে দুইদিকে চলিয়া গেলেন।

রস্তমজী দ্রুতপদে অনেক দূর অগ্রসর হইয়া গেলেন। কমলা স্পষ্ট দেখিল যে, মাঞ্চারজী বাগানের একটা ঝোপের মধ্য হইতে বাহির হইয়া গোপনে তাঁহার অনুসরণ করিলেন। ক্রমে উভয়েই তাঁহার দৃষ্টির বহির্ভূত হইয়া গেলেন।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – অদ্ভুত চুরী

পরদিবস প্রাতে বেলা দশটার সময় বর্জরজী, হরমসজীর ব্যাঙ্কে উপস্থিত হইলেন। তখন ও হরমসজী বা তাঁহার কেসিয়ার রস্তমজী আসেন নাই। একাউন্ট্যান্ট ফ্রামজী ও অন্যান্য কর্ম্মচারিগণ উপস্থিত।

বর্জরজী কেসিয়ারকে না দেখিয়া বলিলেন, “কি আশ্চৰ্য্য! কাল আমি হরমসজী সাহেবকে আর রস্তমজীকে বিশেষ করিয়া বলিয়া গেলাম যে, দশটার সময়ই আমার টাকার দরকার, আর দুজনের একজনেরও এখনও দেখা নাই! বড়ই দুঃখের বিষয়।”

তাঁহার কথা শুনিয়া ফ্রামজী নিজের আসন হইতে উঠিয়া আসিয়া বলিলেন, “রস্তমজী এখনই আসিবেন। আমি জানি, দশটার সময় আপনার টাকা চাই বলিয়া তিনি কাল আপনার লাখ টাকা ব্যাঙ্ক হইতে আনিয়া সিন্দুকে রাখিয়া গিয়াছেন। তিনি এখনই আসিবেন।”

বর্জরজী বলিলেন, “আমি তাঁহার জন্য কাজকর্ম্ম বন্ধ করিয়া এখানে বসিয়া থাকিতে পারি না। নিজের টাকা জমা রাখিয়া দরকারের সময় ভিখারীর মত দাঁড়াইয়া থাকিবে কে? হরমসজী সাহেব কোথায়?”

“আমি দেখিতেছি। বোধ হয়, তিনি বাড়ীতেই আছেন,” বলিয়া ফ্রামজী সত্বর হরমসজীর অনুসন্ধানে গেলেন। পাঁচ-সাত মিনিট পরে ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন, “তিনি বাড়ীতে নাই, কোন কাজে বাহিরে গিয়াছেন।”

বর্জরজী বলিলেন, “কি আশ্চর্য্য! এ রকম চমৎকার ব্যাঙ্ক আমি আর কখনও কোথায় দেখি নাই।”

“রস্তমজী এখনই আসিবেন। তিনি কখনও বিলম্ব করেন না।”

“তা দেখাই যাইতেছে। যাহা হউক, আমি এক ঘণ্টার মধ্যে ফিরিয়া আসিব। আমার টাকা যেন ঠিক থাকে।”

“নিশ্চয়ই থাকিবে।”

বর্জরঙ্গী ক্রোধভরে চলিয়া গেলেন। ফ্রামজীও নিজ কার্য্যে মনসংযোগ করিতে চেষ্টা করিলেন।

রস্তমদী ঠিক দশটার সময় আফিসে আসিতেন; তাঁহার কখনও বিলম্ব হইত না। আজ সাড়ে দশটা বাজিয়া গেল, তথাপি রস্তমজীর দেখা নাই। প্রিয় বন্ধু ফ্রামজী তাঁহার জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন।

যাহাই হউক, প্রায় এগারটার সময় রস্তমজী আফিসে প্রবিষ্ট হইলেন। তাঁহাকে দেখিলেই স্পষ্ট বোধ হয়, তিনি সমস্ত রাত্রি নিদ্রা যান নাই।

তিনি আসিবামাত্রই ফ্রামজী বলিলেন, “বর্জরজী টাকার জন্য ঠিক দশটার সময় আসিয়াছিলেন। তোমার দেখা না পাইয়া বড়ই বিরক্ত হইয়া চলিয়া গিয়াছেন।”

রস্তমজী বলিলেন, “আমার আসিতে একটু বিলম্ব হইয়াছে। তাঁহার টাকা আমি কালই ব্যাঙ্ক থেকে আনিয়া ঠিক করিয়া রাখিয়াছি।”

“সে কথা আমি তাঁহাকে বলিয়াছি।”

“এবার কখন তিনি আসিবেন?”

“এগারটার সময়।”

“এগারটা ত বাজে। আমি তাঁহার জন্য এখনই সিন্দুক হইতে টাকা বাহির করিয়া রাখিতেছি। এবার তাঁহাকে এক মিনিটও দেরী করতে হইবে না।”

এই বলিয়া রস্তমজী তোষাখানায় প্রবেশ করিলেন। তোষাখানার সিন্দুক তিনি ও হরমসজী ব্যতীত আর কাহারও খুলিবার সাধ্য নাই। ঐ সিন্দুকের একটি চাবী রস্তমের নিকট থাকে, অপরটি স্বয়ং হরমসঙ্গী রাখেন।

সেই সিন্দুকের তালা অতি অদ্ভুত কৌশলে নির্ম্মিত। তালার গায়ে কতকগুলি চাকার উপর ইংরাজী অক্ষর বসান আছে। চাকা ঘুরাইয়া কোন একটি সাঙ্কেতিক শব্দ প্রস্তুত করিয়া এক সারিতে রাখিতে হয়; তাহার পর চাবী বন্ধ করিয়া অক্ষরগুলি এদিকে ওদিকে করিয়া গোলমাল করিয়া দিতে হয়। সিন্দুক খুলিবার সময় সেই অক্ষরগুলি ঠিক করিয়া সমশ্রেণীতে সাজাইয়া পুনরায় সেই সাঙ্কেতিক শব্দ গঠন করিতে পারিলে তবে সিন্দুক খোলা যাইত। কিন্তু সেই সাঙ্কেতিক শব্দ কেবল রস্তমজী ও হরমসঙ্গী জানিতেন; সুতরাং সহস্র চেষ্টা করিলেও এই সিন্দুক অপর কাহারও খুলিবার সাধ্য ছিল না।

রস্তমজী সহসা সবেগে তোষাখানা হইতে বাহির হইয়া আসিয়া বলিলেন, “সর্বনাশ হইয়াছে!”

কৰ্ম্মচারিগণ সকলেই বিস্মিত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন।

ফ্রামজী বলিলেন, “কি হইয়াছে?”

‘ব্যাকুলভাবে রস্তমজী বলিলেন, “সৰ্ব্বনাশ! সব চুরী গিয়াছে।”

সকলে সমস্বরে বলিয়া উঠিলেন “কি চুরী গিয়াছে?”

রস্তমজী বলিলেন, “টাকা—টাকা। সিন্দুকে আর একটি পয়সাও নাই।”

সকলে স্তম্ভিত ও নিৰ্ব্বাক্! কেবল একজন বৃদ্ধ কৰ্ম্মচারী বলিলেন, “রস্তমজী সাহেব, অধীর হইবেন না। হয় ত কোন বিশেষ কারণে হরমসজী সাহেব রাত্রে সিন্দুক হইতে টাকা বাহির করিয়া লইয়াছেন।”

এই সময়ে স্বয়ং হরমসজী তথায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বলিলেন, “কি হইয়াছে?”

প্রথমে কেহই কোন উত্তর দিতে পারিলেন না। তিনি আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হইয়াছে?”

তখন রস্তমজী বলিলেন, “আপনি ত জানেন, বর্জরজী আজ তাঁহার টাকা চাহেন বলিয়া ব্যাঙ্ক থেকে কাল লাখ টাকা বাহির করিয়া সিন্দুকে রাখি।”

হরমস। তা জানি। তার পর হয়েছে কি?

রস্তম। সে টাকা সিন্দুকে নাই।

হরমস। কি?

রস্তম। সিন্দুকে এক পয়সাও নাই।

হরমস। সিন্দুকে এক পয়সাও নাই! চুরী! এখনও পুলিসে খবর দাও নাই কেন? একজন এখনই পুলিসে যাও—ছুটে যাও।

একজন পুলিসে ছুটিল।

এই সময়ে বর্জরজী তথায় উপস্থিত হইলেন। তাঁহাকে দেখিয়া হরমসজী বলিলেন, “কোন কারণে আপনাকে এখন নগদ টাকা দিতে পারিলাম না, ক্ষমা করিবেন। বোম্বাই ব্যাঙ্কের উপর চেক দিতেছি।”

হরমসজী নিজ আফিসে গিয়া বর্জরজীকে চেক লিখিয়া দিলেন। বর্জরজী চলিয়া যাইবার পর তিনি রস্তমজীকে তথায় ডাকিলেন। রস্তমজী গৃহে প্রবিষ্ট হইলে বলিলেন, “আগে দরজা বন্ধ করিয়া দাও।”

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – অনুযোগ

হরমসজী কিয়ৎক্ষণ নীরবে থাকিয়া অতি গম্ভীরভাবে বলিলেন, “কে সিন্দুক খুলিল?”

রস্তমজী অতি বিষণ্ণভাবে কহিলেন, “কেমন করিয়া বলিব?”

হরমসজী বলিলেন, “তুমি কিম্বা আমি ব্যতীত গুপ্তকথা কেহ জানিত না। তুমি কিম্বা আমি ব্যতীত আর কাহারও সাধ্য নাই যে, এই সিন্দুক খুলে।”

রস্তমজী বলিলেন, “সুতরাং আমি ব্যতীত আর কেহ টাকা নিতে পারে না।”

হরমসঙ্গী দৃঢ়স্বরে বলিলেন, “তাহা হইলে স্বীকার করিতেছ যে, তুমিই টাকা লইয়াছ?”

রস্তমজী কাতরভাবে বলিলেন, “ভগবানের নিকট শপথ করিয়া বলিতেছি, আমি ইহার কিছুই জানি না। কাল সিন্দুকে টাকা রাখিয়াছিলাম, আজ সিন্দুক খুলিয়া দেখি, টাকা নাই।”

হরমসজী রুষ্ট হইলেন, ভর্ৎসনার স্বরে বলিলেন, “হতভাগ্য যুবক। তবে কে টাকা লইল?”

রস্তমজী কথা কহিলেন না। নীরবে অবনতমুখে ভূমি নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। হরমসজীও বহুক্ষণ নীরবে রহিলেন, তৎপরে রস্তমজীর দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চাহিয়া বলিলেন, “দেখ, তোমাকে আমি পুত্র নির্ব্বিশেষে পালন করিয়াছি। যথাসৰ্ব্বস্ব দিয়া তোমাকে বিশ্বাস করিয়া থাকি। আজ পৰ্য্যন্ত তোমাকে কখনও অবিশ্বাস করি নাই। নিজের ছেলের মত তোমাকে বাড়ীতে রাখিয়াছি, আমাকে মিথ্যা কথা বলিয়ো না।”

রস্তমজী তথাপি কোন উত্তর করিলেন না দেখিয়া, হরমসঙ্গী পুনরায় বলিলেন, “পিতার নিকট সন্তান দোষ করিলেও স্বীকার করা কর্তব্য। আমি তোমার পিতৃতুল্য, আমার নিকট স্বীকার কর।”

রস্তম। কি স্বীকার করিব? স্বীকার করিবার কিছুই দেখিতেছি না।

হরমস। দেখ, এখনও বলিতেছি, আমার নিকট স্বীকার করিলে আমি তোমাকে কেবল যে ক্ষমা করিব—তাহা নহে, যাহা হইয়া গিয়াছে, তাহা ভুলিব। এ কথা জগতের জনপ্রাণী জানিতে পারিবে না।

রস্তম। আপনি আমাকে কি বলিতে বলেন?

হরমস। সত্যকথা। মানুষ সকল রকমে ভাল হইলেও সময় সময় লোভের বশীভূত হইয়া জীবনের মধ্যে এমন দুই একটি কুকার্য্য করিয়া ফেলে। স্বীকার কর আমি তোমাকে ক্ষমা করিব। সত্যকথা বলিলে, যেমন ভালবাসিতাম, যেমন বিশ্বাস করিতাম, সেইরূপই করিব।

রস্তম। আমি আপনাকে সত্যকথাই বলিয়াছি। আমি টাকা লই নাই।

হরমসজী, রস্তমজীর বারংবার এইরূপ সংক্ষিপ্ত উত্তরে মনে মনে পূর্ব্ব হইতেই ক্রমশঃ রুষ্ট হইতেছিলেন। এবার তাঁহার ক্রোধ সীমাতিক্রম করিয়া উঠিল। তিনি এবার অত্যন্ত কঠিনভাবে বলিলেন, “নির্ব্বোধ! তুমি কি মনে কর যে, আমি তোমার কথা কিছুই জানি না। তোমার কোন সংবাদই আমি রাখি না—এমনই অর্বাচীন আমি! আমার কানে তোমার সকল কথাই আসে। আমার বাড়ী ছাড়িয়া তোমার যে দুৰ্দ্দশা হইয়াছে, সে সংবাদও আমি ভাল রকম রাখি। জুয়া খেলিয়া অসৎ-সংসর্গে মিশিয়া কুকাজে তুমি কত টাকা নষ্ট করিয়াছ, তাহা কি আমি জানি না।”

রস্তমজী নীরব।

হরমসজীও বহুক্ষণ নীরবে বসিয়া রহিলেন। তৎপরে বলিলেন, “রস্তম, যাহা হইয়া গিয়াছে, সে বিষয়ে আমি কিছু মনে করি নাই। সিন্দুকটা ভাল করিয়া আর একবার দেখ, হয়ত ভূলক্রমে তুমি টাকা দেখিতে পাও নাই। আমি সন্ধ্যা পর্য্যন্ত এ বিষয়ের উচ্চবাচ্য করিব না। আশা করি, সব টাকা পাওয়া না যাক, অধিকাংশ পাওয়া যাইবে। যাও, ভাল করে খুঁজে দেখ।” এবার রস্তমজী কথা কহিলেন। বলিলেন, “মহাশয় আমি টাকার এক পয়সাও লই নাই, সুতরাং আমি এক পয়সাও ফেরৎ দিতে পারি না।”

ক্রোধভরে হরমসঙ্গী উঠিয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন, “তবে কি তুমি বলিতে চাও, সেই টাকা আমি লইয়াছি?”

রস্তমজী কথা কহিলেন না।

হরমসজী বলিলেন, “এখনও সত্যকথা বল। এতক্ষণে পুলিস আসিয়াছে। কিন্তু বুঝিয়া দেখ, ইহার পর আর আমার হাত থাকিবে না—এখনও আমি তোমাকে রক্ষা করিতে পারি।”

রস্তম। আমি সত্যকথাই বলিয়াছি।

হরমস। তবে তাই হউক, তুমি টাকা লইয়াছ—কি আমি লইয়াছি, তাহা বিচারালয়েই সপ্রমাণ হউক। এস, আমার সঙ্গে এস।

উভয়ে বাহিরের ঘরে আসিলেন; তথায় দুইজন পুলিশ কর্ম্মচারী উপস্থিত ছিলেন। হরমসজী তাঁহাদের সম্ভাষণ করিয়া বলিলেন, “আপনারা বোধ হয় শুনিয়াছেন, কি জন্য আপনাদিগকে সংবাদ দেওয়া হইয়াছে।”

ইনস্পেক্টর বলিলেন, “হাঁ, চুরী হইয়াছে।”

হরমসজী। গত রাত্রে লাখ টাকা আমার সিন্দুক থেকে চুরী হইয়াছে। সিন্দুকের চাবী আমার নিকট একটা এবং আমার কেসিয়ার রস্তমজীর নিকট একটা থাকে।

ইনস্পেক্টর। বাহির হইতে কাহারও ক্যাস-ঘরে প্রবেশ করিবার সম্ভাবনা আছে?

হরমসজী। সম্ভবতঃ নয়। একজন সর্ব্বদাই রাত-দিন সেখানে পাহারায় থাকে।

ইনস্পেক্টর। কাল রাত্রে কে পাহারায় ছিল?

হরমসজী সেই প্রহরীকে ডাকিলেন।

প্রহরী বলিল, সে কাল সমস্ত রাত্রিই জাগিয়া ছিল। কেবল স্বয়ং হরমসজী ভিতরের দ্বার দিয়া গৃহে প্রবেশ করিতে পারেন, কিন্তু তিনি কাল রাত্রে আসেন নাই।

ইনস্পেক্টর। এ কথা তুমি নিশ্চয় বলিতে পার?

প্রহরী। নিশ্চয় পারি।

ইনস্পেক্টর। বেশ, ঘরগুলি একবার দেখা যাক—দাদাভাস্কর ভাল করিয়া দেখ।

দাদাভাস্কর ডিটেক্‌টিভ-ইনস্পেক্টর। তিনি উঠিলেন—ইনস্পেক্টর ও হরমসঙ্গী ঘরগুলি দেখিতে লাগিলেন; কিন্তু দাদাভাস্কর এক মুহূর্তের জন্যও তাঁহার দৃষ্টি রস্তমজীর দিকে রাখিতে ভুলিলেন না।

সকলে অন্য গৃহে গমন করিলে রস্তমজী বিষণ্নমনে তথায় বসিয়া রহিলেন। সহসা পার্শ্বের একটি দরজা খুলিয়া গেল। রস্তমজী চমকিত হইয়া চাহিয়া দেখিলেন, সম্মুখে দাঁড়াইয়া—কমলা বাঈ।

কমলাও স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইল; তৎপরে বলিল, “তুমি! বাবা কোথায়? মার বড় অসুখ, তাই তাঁকে বলতে এসেছিলাম।”

রস্তমজী ব্যাকুলস্বরে বলিলেন, “হাঁ, আমি রস্তমজী। তোমার বাল্যসখা—এখন চোর, জেলে যাব। তোমার বাবা পুলিস নিয়ে অপর ঘরে।”

কমলা বিস্মিত হইয়া কহিল, “সে কি!”

“সব শুনিতে পাইবে। এখন যাও, দয়া করে আর কষ্ট দিয়ো না।” এই বলিয়া রস্তমজী কমলাকে সেই গৃহ হইতে বাহির করিয়া দ্বার রুদ্ধ করিলেন।

দাদাভাস্কর অন্তরালে ছিলেন। রস্তমজী একা বসিয়া কি করেন, তাঁহার মুখভাবের কোনরূপ পরিবর্ত্তন হয় কি না—এই সকল পৰ্য্যবেক্ষণ করিবার জন্য দাদাভাস্কর ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেও তিনি অন্তরালে হইতে রস্তমজীর উপরে দৃষ্টি রাখিয়াছিলেন। দাদাভাস্কর এ দৃশ্য দূর হইতে দেখিলেন। দেখিয়া মনে মনে বলিলেন, “এতক্ষণে ব্যাপারটা সব বুঝিলাম। কেসিয়ার রস্তমজী, ব্যাঙ্কার হরমসজীর কন্যাকে ভালবাসে। কন্যাও তাহাকে ভালবাসে। ব্যাঙ্কার মহাশয় কন্যার সহিত কেসিয়ারের বিবাহ দিতে সম্মত নহেন। এরূপ অবস্থায় কিরূপে তাহাকে সরান যায়। জেলই সুপ্রশস্ত ব্যবস্থা। তাই টাকাগুলি নিজে সরিয়ে তাহার নামে এই চুরীর মামলার বন্দোবস্ত খুব বুদ্ধিমানের মতই হইয়াছে, সন্দেহ নাই।”

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – তদন্তে

এই সময়ে হরমসজী ও ইনস্পেক্টর তথায় উপস্থিত হইলেন। ইনস্পেক্টর বলিলেন, “এখন ক্যাস-ঘর দেখা যাক। এস, দাদাভাস্কর।”

তাঁহারা চারিজনেই ক্যাস-ঘরে প্রবিষ্ট হইলেন। বিশেষ করিয়া চারিদিক লক্ষ্য করিয়া ইনস্পেক্টর বলিলেন, “বাহির হইতে এ ঘরে আসিবার কোন উপায়ই নাই।”

দাদাভাস্কর সিন্দুকটি বিশেষ করিয়া পরীক্ষা করিয়া বলিলেন, “সিন্দুকের উপরের তালা কেহ জোর করিয়া খুলিবার চেষ্টা পায় নাই। তালার উপর তেমন কোন চিহ্ন দেখিতেছি না। যে কেহ এ সিন্দুক খুলুক না কেন, তার কাছে ইহার চাবী ছিল, আর তার গুপ্তকথাটিও জানা ছিল। চাবী খুলিবার স্থানে একটা আঁচড়ের দাগ লাগিয়াছে বটে, কিন্তু ইহাতে জানা যাইতেছে যে, লোকটা খুব তাড়াতাড়ি সিন্দুক খুলিয়া তাড়াতাড়ি বন্ধ করিয়াছিল; নতুবা চাবীর ঘেঁসড়ার দাগ এই কুলুপের উপর পড়িত না। দাগটা একবার দেখুন।

ইনস্পেক্টর। তা স্পষ্টই দেখা যাইতেছে। এরূপ অবস্থায় আমি আমার কর্তব্য কাজ করিতে বাধ্য। (রস্তমজীর প্রতি) রস্তমজী, আমি আপনাকে এই চুরি অপরাধে গ্রেপ্তার করিলাম।

রস্তমজী বলিলেন, “আমি শপথ করিয়া বলিতেছি, আমি নিরপরাধ।

ইনস্পেক্টর। নিরপরাধ হইলে নিশ্চয়ই মুক্তি পাইবেন। হরমসজী সাহেব, আপনার সহিত আরও দুই একটি কথা আছে।

হরমসজী। আসুন, আমার আফিস-গৃহে।

ইনস্পেক্টর। দাদাভাস্কর, আসামী রহিল।

অনন্তর তাঁহারা উভয়ে প্রস্থান করিলেন। দাদাভাস্কর একখানি চেয়ারে উপবিষ্ট হইয়া, তন্দ্রার ভাণ করিয়া, চক্ষু মুদিত করিয়া চিন্তামগ্ন হইলেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁহার অর্দ্ধনিমীলিত চক্ষু রস্তমজীর উপরে ন্যস্ত ছিল।

রস্তমজী একখানা চেয়ারে বসিয়া একটা পেন্সিল লইয়া নাড়া-চাড়া করিতে লাগিলেন। দাদাভাস্করের তীক্ষ্ণদৃষ্টি দেখিল যে, রস্তমজী একখানা কাগজে কয়েকছত্র কি লিখিলেন। লিখিয়া তাড়াতাড়ি মুড়িয়া ফেলিলেন।

এই সময়ে ফ্রামজী আসিয়া বলিলেন, “রস্তমজী, চুরী কে করিল?”

রস্তমজী বলিলেন, “কেমন করিয়া বলিব, ভাই?”

দাদাভাস্কর দেখিলেন, রস্তমজী সেই মোড়া কাগজখানি অতি সন্তর্পণে লুক্কায়িতভাবে ফ্রামজীর হাতের ভিতর দিলেন। ফ্রামজী ধীরে ধীরে গিয়া নিজস্থানে বসিলেন।

দাদাভাস্কর ভাবিলেন, “ওঃ! এর ভিতর অনেক কাণ্ড আছে।”

এই সময়ে ইনস্পেক্টর ফিরিয়া আসিয়া রস্তমজীকে বলিলেন, “আপনার যা কিছু বলিবার আছে, ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বলিতে পারেন—এখন চলুন।”

রস্তমজী উঠিয়া দাঁড়াইলেন। তৎপরে হরমসজীর দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “মহাশয়, এই আপনার চাবী, আপনার খাতাপত্র সব বুঝিয়া লউন। আপনার তহবিলেও কিছু টাকা কম আছে।”

ইনস্পেক্টর। ওঃ! কেবল চুরী নহে,—তহবিল তছরূপও আছে।

রস্তমজী সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া বলিলেন, “আমার মাহিনার হিসাবে কিছু অগ্রিম লইয়াছি,—আফিসে অন্যান্য লোকও কিছু কিছু লইয়াছেন। সকলেরই হিসাব আছে। আমার পাঁচ হাজার টাকা আপনার ব্যাঙ্কে জমা আছে। আমি আমার পাওনা হইতে যদি কিছু বেশি লইয়া থাকি, তবে ঐ টাকা হইতে লইবেন।”

হরমসজী কোন কথা কহিলেন না। ইনস্পেক্টর আসামী লইয়া প্রস্থান করিলেন। রস্তমজীকে সকলেই ভালবাসিতেন, সকলেরই চক্ষে জল আসিল। কেহ কেহ একেবারে কাঁদিয়া ফেলিলেন। ফ্রামজী চীৎকার করিয়া বলিলেন, “আমি জোর করিয়া বলিতেছি, রস্তমজী টাকা চুরী করেন নাই।”

“কি?” বলিয়া হরমসজী তাঁহার দিকে ফিরিলেন।

ফ্রামজী বলিলেন, “আমি শপথ করিতে পারি, রস্তমজী এ চুরীর কিছুই জানেন না।”

“ভগবান্ তাই করুন,” এই বলিয়া হরমসজী সত্বর নিজ আফিস গৃহে প্রবিষ্ট হইলেন। তিনি প্রকৃতই রস্তমজীকে বড় ভালবাসিতেন।

সেদিন ব্যাঙ্কের আর কোন কাজ-কর্ম্ম হইল না।

বাহিরে আসিয়া দাদাভাস্কর ইনস্পেক্টরকে বলিলেন, “আমার একটু কাজ আছে, আপনি আসামী লইয়া যান। আমি পরে যাইতেছি।”

তিনি আপত্তি করিলেন না। আসামীকে লইয়া গাড়ীতে উঠিলেন।

দাদাভাস্কর নিকটস্থ একটা দোকানে গিয়া বসিলেন। মনে মনে বলিলেন, “কেসিয়ার মহাশয়ের গুপ্ত চিঠীখানি চাই। এখানি হস্তগত হইলে এই চুরী রহস্যের একটা-না-একটা দ্বার উদঘাটিত হইবেই। কে চুরী করিয়াছে, তাহা যদিও বেশ বুঝিতে পারা গিয়াছে, তবুও চিঠীখানা চাই। লুকান চিঠী ভাল নয়। ফ্রামজী সাহেব এখনই চিঠী বিলি করিবার জন্য বাহির হইবেন। সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। জরুরী পত্র নিশ্চয়ই। এই যে ফ্রামজী সাহেবের আবির্ভাব—আর দেরী সহে নাই।”

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – অদ্ভুত খুন

বলা বাহুল্য, এই অদ্ভুত চুরীর ব্যাপার লইয়া বোম্বাই সহরে খুব একটা হুলুস্থূল পড়িয়া গেল। যেখানে-সেখানে হাটে-বাজারে সর্বত্র এই কথা। লোকে কাজকর্ম্ম ছাড়িয়া ইহারই আন্দোলন করিতে লাগিল। এই সময়ে আর একাট ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডে সহরবাসীদিগের মস্তক আরও চঞ্চল করিয়া তুলিল।

সেই হত্যাকাণ্ড ও চুরী সংক্রান্ত ব্যাপার “গুজরাটী” পত্রে যাহা লিখিত হইয়াছিল, তাহা আমরা নিম্নে উদ্ধৃত করিলাম;-

“গত মঙ্গলবার রাত্রে দুইটী ভয়াবহ ঘটনা এ সহরে ঘটিয়াছে। আমাদের যতদূর স্মরণ হয়, বোম্বাই সহরে এরূপ ঘটনা বহুকাল ঘটে নাই।

“সোমবার রাত্রে একটার সময় একজন ভাড়াটিয়া গাড়ীর গাড়োয়ান গিরগামের মোড়ের পাহারাওয়ালাকে আহ্বান করে। সে আসিয়া দেখে যে, গাড়ীর ভিতর একজন ভদ্র পার্শীর মৃতদেহ। তখনই পাহারাওয়ালা গাড়ীসুদ্ধ লাস থানায় লইয়া আসে। ডাক্তার পরীক্ষা করিয়া বলেন যে, অতিরিক্ত ক্লোরাফর্ম্মে লোকটার মৃত্যু হইয়াছে। প্রকৃতই ক্লোরাফর্ম্মে ভিজান একখানি রুমাল লোকটির মুখের উপর ছিল। ঐ রুমালের এককোণে লেখা, “ফ্রামজী।”

“কোচ ম্যান বলে যে, গ্রান্টরোডের মোড়ে একজন পার্শী ভদ্রলোক তাহাকে ডাকিয়া বলেন, ‘এই ভদ্রলোক বড় মাতাল হয়েছেন, এঁকে বাড়ী পৌঁছাইয়া দাও। গিরগামে পৌঁছিলে ইনি বাড়ীর ঠিকানা বলিয়া দিতে পারিবেন।’ এই বলিয়া তিনি একজম মদ্যপকে গাড়ীতে তুলিয়া দিয়া সত্বরপদে একটা গলির ভিতর প্রবিষ্ট হয়েন; কিন্তু একটু পরেই ফিরিয়া আসিয়া বলেন, ‘না, আমিই একে পৌঁছাইয়া দিয়া আসিতেছি।’ এই বলিয়া তিনি গাড়ীতে উঠিয়া বসেন। গাড়ী গিরগামের মোড়ের নিকট আসিলে ইনি গাড়ী থামাইতে বলেন। গাড়ী থামিলে ইনি নামিয়া বলেন, ‘ইনি আমার সঙ্গে আর যাইতে চাহে না। একটু আগে গেলেই এঁর বাড়ী।’ এই বলিয়া তিনি সত্বরপদে চলিয়া যান। কোচম্যান মোড়ে আসিয়া পাহারাওয়ালাকে ডাকে। তাহার পর মৃতদেহ দেখিতে পাওয়া যায়।

“পুলিশ তদন্ত করিয়া আরও একজন কোচম্যানকে পাইয়াছে। সে বলে যে, রাত্রি প্রায় একটার সময় পূর্ব্বোক্ত কোচম্যান যেরূপ বেশযুক্ত পার্শী ভদ্রলোকের কথা বলিয়াছে, ঠিক সেইরূপ একটি লোক গিরগামের গাড়ী দাঁড়াইবার স্থানে আসিয়া তাহাকে কলবাদেবী রোডে যাইতে বলে। কোচম্যান তাহাকে তথায় পৌঁছিয়া দিয়াছিল।

“মৃতব্যক্তি যে কে, পুলিস প্রথমে কিছুই স্থির করিতে পারেন নাই। এক্ষণে অনুসন্ধানে জানা গিয়াছে, ইঁহার নাম পেষ্টনজী, কলিকাতার কোন ধনাঢ্য সওদাগরের পুত্র। কয়েক মাস হইল, বোম্বে বেড়াইতে আসিয়াছিলেন।

“ইনি বিখ্যাত ব্যাঙ্কার হরমসজীর নিকট পত্র লইয়া আসিয়াছিলেন। সর্ব্বদাই তাঁহার বাড়ীতে যাতায়াত করিতেন। তাঁহার কন্যার সহিত বিবাহের কথাবাৰ্ত্তাও হইতেছিল।

“হরমসজীর শ্যালিকা-পুত্র মাঞ্চারজী পুলিসের নিকট বলিয়াছেন যে, ঘটনার রাত্রে প্রায় রাত্রি বারটার সময় তিনি হরমসজীর কেসিয়ার রস্তমজীর সহিত পেষ্টনজীকে কথাবার্তা করিতে দেখিয়াছেন। তিনি তখন ব্যস্ত হইয়া বাসায় যাইতেছিলেন, তাহার পর কি হইয়াছে—জানেন না।

“হরমসজীর বন্ধু ও আত্মীয় বর্জরজী বলিয়াছেন যে, সেই রাত্রে প্রায় বারটার সময় তাঁহার সহিত রস্তমজীর এলফিনস্টোন সার্কেলের বাগানের সম্মুখে দেখা হইয়াছিল। তিনি দেখিয়াছিলেন যে, রস্তমজী ব্যস্ত হইয়া গ্রান্টরোডের দিকে গিয়াছিলেন।

‘পুলিস আরও তদন্তে জানিয়াছেন যে, সেই দিন প্রাতে হরমসজীর একাউন্টেন্ট ফ্রামজী, পাটরিজ কোম্পানীর দোকান হইতে এক শিশি ক্লোরাফর্ম্ম কিনিয়াছিলেন। মৃতের মুখের উপর ক্লোরাফর্ম্ম ভিজান যে রুমাল পাওয়া গিয়াছে, সে রুমালের কোণে লেখা, “ফ্রামজী।”

“যে ব্যক্তি সেই রাত্রে গাড়ী করিয়া কলবাদেবী রোডে আসিয়াছিল, সে যে ফ্রামজী, তাহাও প্রমাণ হইয়াছে। তিনি গাড়ী হইতে নামিলে বিটের পাহারাওয়ালা তাঁহাকে সেলাম দিয়াছিল। সে এখন শপথ করিয়া বলিতেছে, যে ব্যক্তি গাড়ী হইতে সে রাত্রে নামিয়াছিল, সে নিশ্চয়ই ফ্রামজী।

“ফ্রামজী পুলিসের নিকট বলিয়াছেন; তিনি সে রাত্রে আদৌ বোম্বে সহরে ছিলেন না। কোথায় ছিলেন, তাহা তিনি কোন ক্রমেই বলিবেন না। আরও বলিয়াছেন যে, মফঃস্বলের একটি ডাক্তার বন্ধু লেখায় তাঁহাকে পাঠাইয়া দিবার জন্য তিনি ক্লোরাফর্ম্ম কিনিয়াছিলেন। যে কোটের পকেটে এই ক্লোরাফর্ম্ম ও রুমাল ছিল, তাহা তাহার পূর্ব্বদিনে তাঁহার বাসা হইতে চুরী গিয়াছে।

“ইহাই ত এই ভয়াবহ লোমহর্ষণ হত্যাকাণ্ডের বিবরণ। পুলিশ এখনও এই হত্যাকাণ্ডের জন্য কাহাকেও ধৃত করেন নাই। সেই রাত্রে হরমসজীর ব্যাঙ্ক হইতেও লাখ টাকা চুরী গিয়াছে। এই চুরির জন্য পুলিস কেসিয়ার রক্তমজীকে গ্রেপ্তার করিয়াছেন। এই চুরীর সহিত এই হত্যাকাণ্ডের কোন সম্বন্ধ আছে কি না, তাহা এখন আমরা কিছুই বলিতে পারি না। আমাদের বোম্বের পুলিস দক্ষতার জন্য জগদ্বিখ্যাত; নিশ্চয়ই তাঁহারা এই রহস্য ভেদ করিতে পারিবেন।

“আমরা এ সম্বন্ধে এক্ষণে অধিক আর কিছুই বলিব না। যে অপরাধী, সে নিশ্চয়ই বিচারে সমুচিত দণ্ড পাইবে। আমরা এই পর্যন্ত বলিতে পারি, এরূপ খুন ও চুরী এ সহরে পুলিসের চোখের উপর সম্ভব হইলে, কাহারই আর ধনপ্রাণ নিরাপদ নহে।”

সপ্তম পরিচ্ছেদ – গুপ্তপত্র

দাদাভাস্কর ফ্রামজীর প্রতীক্ষায় ছিলেন। ফ্রামজী বাহির হইয়া আসিবা মাত্র দাদাভাস্কর তাঁহার নিকটস্থ হইলেন। ফ্রামজী অতি সত্বরপদে যাইতেছিলেন। দাদাভাস্কর দ্রুতপদে নিকটস্থ হইয়া বলিলেন, “মহাশয়, একটু দাঁড়ান।”

চমকিত হইয়া ফ্রামজী ফিরিলেন। দাদাভাস্কর বলিলেন, “আপনি একটি সংবাদ দিলে আমি বিশেষ বাধিত হইব।”

ফ্রামজী। আমি! কি সংবাদ?

দাদাভাস্কার। আজ্ঞে হাঁ।

ফ্রামজী। আপনাকে ত আমি চিনি না।

দাদাভাস্কর। আপনার স্মরণশক্তি বড় তীক্ষ্ণ নয় দেখিতেছি। আপনি একটু পূর্ব্বেই আমাকে দেখিয়াছিলেন।

ফ্রামজী তখন দাদাভাস্করকে চিনিলেন। পুলিসের লোক তাঁহাকে কি জিজ্ঞাসা করিতে চাহে ভাবিয়া, একটু উদ্বিগ্নও হইলেন; বলিলেন, “কি জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন, বলুন।”

দাদা। রস্তমজী একটু আগে আপনাকে একখানা পত্র দিয়াছিলেন।

ফ্রামজী। আপনার ভুল হইয়াছে—তিনি আমাকে কোন পত্র দেন নাই।

দাদা। দুঃখের বিষয়, আমার প্রায়ই ভুল হয় না। যাহা হউক, আশা করি, আমাকে কঠোর প্রথা অবলম্বন করিতে হইবে না।

ফ্রামজী। হাঁ, রস্তমজী আমাকে একখানা পত্র দিয়াছিলেন বটে, কিন্তু আমি সে পত্র পড়িয়া ছিঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়াছি।

দাদা। কেন আমাকে বৃথা ভুলাইবার চেষ্টা পাইতেছেন, ইহাতে আপনি নিজেই বিপদ্‌গ্ৰস্ত হইবেন। সে পত্র আপনার পকেটেই আছে, আপনি সেই পত্র যথাস্থানে বিলির জন্য বাহির হইয়াছেন! যাহা হউক, যখন আপনি আমার হাতে পড়িয়াছেন, তখন আপনার দ্বারা সে পত্রের যথাস্থানে পৌঁছিবার আশা বড়ই কম। এখন অনুগ্রহ করিয়া পত্রখানি আমাকে দিন।

ফ্রামজী। প্রাণ থাকিতে নয়।

দাদা। কেন বিপদ ডাকিতেছেন? আমার পরামর্শ যদি গ্রহণ করেন, তবে এ চুরীর হাঙ্গামার একেবারে তফাতে থাকিবেন। ভাল চাহেন—এখনই পত্রখানি বাহির করিয়া দিন।

ফ্রামজী। কিছুতেই দিব না।

দাদা। তাহা হইলে আমি দুইজন কনেষ্টবল ডাকিতে বাধ্য হইব। তাহারা আপনার দুইখানি হাত ধরিয়া থানায় লইয়া যাইবে। তথায় আপনার পকেট অনুসন্ধান করিলেই পত্রখানি পাইব। তবে কথাটা হইতেছে এই, তাহাতে নিজেকে একটু পরিশ্রম করিতে হইবে, কিছু আপনাকেও অপমানিত হইতে হইবে; বলুন, সেটাই কি আপনি বড় সুবিধাজনক মনে করেন?

ফ্রামজী একটু চিন্তা করিয়া বলিলেন, “আমি এখন আপনার হাতে, এই সে পত্র লউন— ইহাতে আপনার কোন কাজেই হইবে না।”

দাদাভাস্কর পত্রখান লইয়া পাঠ করিলেন। তাহাতে এই কয় ছত্রমাত্র লেখা ছিল;–

“রতন!

যদি আমার উপর এক বিন্দুমাত্রও ভালবাসা থাকে, তবে এই পত্র পাইবামাত্র কোন কথা না বলিয়া, বাড়ীর সমস্ত দ্রব্য লইয়া অন্যত্র উঠিয়া যাইয়ো। যাহাতে কেহ তোমার সন্ধান না পায়, তাহা করিবে। চুরীর অপরাধে আমি ধৃত হইয়াছি। আমার কথা রাখ বা না রাখ, সে তোমার ইচ্ছা, কিন্তু ইহা স্থির জানিয়ো,আমার জীবন-মরণ ইহার উপর নির্ভর করিতেছে। ফ্রামজীকে তোমার নূতন ঠিকানা বলিয়ো, তাহা হইলেই আমি জানিতে পারিব।

রস্তমজী।”

পত্রপাঠান্তে ললাট কুঞ্চিত করিয়া দাদাভাস্কর বলিলেন, “না, এ পত্র আমার বিশেষ কাজে আসিবে না। যাহা হউক, আপনাকে আর কষ্ট পাইতে হইবে না, আমিই এ পত্র রতনকে দিব। নিশ্চয়ই রতন রস্তমজীর বিশেষ বন্ধু। তিনি কোথায় থাকেন?”

ফ্রামজী। কিছুতেই তাহা বলিব না।

দাদা। আমি সে সন্ধান নিজেই লইতে পারিব। ইচ্ছা করিলে এ বিষয়ে আপনি আমায় সাহায্য করিতে পারেন। না করেন, আমি রস্তমজীর কোন ভৃত্যকে জিজ্ঞাসা করিলে সে নিশ্চয়ই বলিয়া দিবে। তবে আপনি বলিলে আপনার পক্ষে ভাল হইত; নতুবা বুঝিব, আপনিও এ চুরির মধ্যে কিছু জড়িত আছেন।

ফ্রামজী কিয়ৎক্ষণ নীরব থাকিয়া রতনের ঠিকানা বলিয়া দিলেন। দাদাভাস্কর জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই বন্ধুটি স্ত্রীলোক না পুরুষ? আমার কথার পরিস্কার উত্তর দিলে আপনারই উপকার।”

ফ্রামজী। স্ত্রীলোক।

দাদা। ওঃ! তাহা হইলে স্ত্রীলোকও ইহার ভিতরে আছেন। এত ভ্রম আমার! নতুবা এতটা মজা হইবে কেন? তাই বলি, স্ত্রীলোক ব্যতীত সংসারে কোন কাজ হয় কি? যেখানে ফৌজদারী মালা—সেইখানেই জলজীয়ন্ত স্ত্রীলোক।

ফ্রামজী। রস্তমজী এ চুরির কিছুই জানেন না।

দাদা। খুব ভাল কথা, তবে আপনাকে সৎপরামর্শ দিই, আপনি এ বিষয়ে বেশী সংশ্লিষ্ট থকিবেন না—থাকিলে বিপদে পড়িবেন।

এই বলিয়া দাদাভাস্কর সত্বরপদে তথা হইতে প্রস্থান করিলেন। তিনি ফ্রামজীর নিকট যে ঠিকানা পাইয়াছিলেন, সেইদিকেই দ্রুতপদে চলিলেন।

শীঘ্রই দাদাভাস্কর রতন যে বাড়ীতে থাকিত, তাহার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন। দেখিলেন, বাড়ীটি ছোট বটে, কিন্তু দেখিতে বড়ই সুন্দর। চারিদিকে ক্রোটন ও ফুলের বাগান।

দ্বারে একজন ভৃত্য দণ্ডায়মান ছিল। দাদাভাস্কর তাহাকে সেই পত্রখানি দেখাইয়া বলিলেন, “রস্তমজী সাহেব এই চিঠী রতনবাঈকে দিতে বলিয়াছেন। তিনি কোথায়?”

ভৃত্য বলিল, “চিঠী আমাকে দিন।”

দাদাভাস্কর বলিলেন, “দিতে হুকুম নাই। নিজের হাতে বিবিকে পত্র দিয়া উত্তর লইতে বলিয়াছেন।”

“তবে দাঁড়ান। বিবিকে খবর দিই”, বলিয়া ভৃত্য বাটীর ভিতর চলিয়া গেল। কিয়ৎক্ষণ পরে ফিরিয়া আসিয়া তাঁহাকে ভিতরে যাইতে ইঙ্গিত করিল। দাদাভাস্কর সত্বর গৃহে প্রবিষ্ট হইলেন।

তিনি দেখিলেন, বাড়ীটি অতি সুন্দরভাবে সজ্জিত। নানা মূল্যবান্ আসবাবে পূর্ণ। প্রাচীরে বড় বড় দর্পণ, সুন্দর সুন্দর ছবি। নিম্নে ভাল ভাল গালিচা ও কার্পেট। যেখানে যেটি দিলে সুন্দর মানায়, সেইখানে সেইটি দিয়া সাজান।

দাদাভাস্কর মনে মনে ভাবিলেন, “রস্তমজী সৌখীন লোক বটে।”

এই সময়ে পার্শ্ববর্ত্তী একটি দ্বার উন্মুক্ত হইল। দাদাভাস্কর সেইদিকে চাহিলেন। তিনি যাহা দেখিলেন, তাহাতে বিস্মিত ও মুগ্ধ হইলেন। দেখিলেন, একটি অষ্টাদশবর্ষীয়া অলোকসামান্য লাবণ্যময়ী যুবতী দণ্ডায়মানা। তিনি সেরূপ অপরূপ সৌন্দর্য্য আর কখনও দেখেন নাই। দেখিলেন, যুবতী সুন্দর গুজরাটী বেশে সজ্জিতা। তাহার পরিহিত সুচিক্কন কারুকার্য্যেময় সাড়ীর ভিতর দিয়া তাহার দেহের বর্ণবিভা বিকীর্ণ হইতেছে। তাহার সুকৃষ্ণ কেশদাম স্কন্ধে, পৃষ্ঠে, গুচ্ছে গুচ্ছে লুটাইয়া পড়িয়াছে। তাহার সমুজ্জ্বল আয়ত কৃষ্ণতার নয়নদ্বয়ে চঞ্চলদৃষ্টি—যেন প্রতিক্ষণে বিদ্যুৎ ঝকিতেছে।

দাদাভাস্কর বিস্ময় বিহ্বল হইয়া ক্ষণকাল দুই অতি-বিস্ফারিত-নেত্রে সেই রূপসুধা পান করিতে লাগিলেন।

অষ্টম পরিচ্ছেদ – রতনবাঈ

রতনবাঈ মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, “আপনার এখানে কি প্রয়োজন?”

দাদাভাস্কর তাহার হাতে রস্তমজীর পত্র দিলেন।

রতনবাঈ পত্রপাঠ করিয়া স্তম্ভিত ও ব্যাকুল হইল। তাহার সর্ব্বাঙ্গ কাঁপিতে লাগিল; – মুখের রক্তরাগ পাণ্ডুর হইয়া গেল। কিন্তু পরমুহূর্ত্তেই রতনবাঈ কিছু প্রকৃতিস্থ হইয়া বীণাকণ্ঠে বলিল, “এ সব কি? চোর বলিয়া ধৃত হইয়াছেন কেন?”

দাদা। হরমসজীর ব্যাঙ্কের সিন্দুক থেকে লাখ টাকা চুরী গিয়াছে। সেই সিন্দুকের চাবী তাঁহার কাছে আর হরমসজীর কাছেই থাকিত। উহা খুলিবার গুপ্তকথা কেবল তাঁহারা দুজনেই জানিতেন, সুতরাং টাকা আর কে লইবে?

রতন। মিথ্যা কথা! রস্তমজী কখনও টাকা লয়েন নাই।

দাদা। তিনি কিম্বা হরমসজী ভিন্ন আর কে লইবে?

রতন। তবে হরমসজীই লইয়াছেন—তিনি এখন কোথায়?

দাদা। যথাস্থানে—হাজতে।

রতন নিকটস্থ একটি আলমারীতে ভর দিয়া দাঁড়াইল; নতুবা হয় ত সে পড়িয়া যাইত। বহুক্ষণ সে অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া চিন্তিতভাবে দাঁড়াইয়া রহিল। পরে কিছু প্রকৃতিস্থ হইয়া বলিল, “আমি এখনই তাঁহার সহিত দেখা করিতে যাইব।”

দাদাভাস্কর বলিলেন, “সেট কি ভাল হইবে? তিনি আপনাকে লুকাইয়া থাকিতে বলিয়াছেন।”

“কাহারও কথা শুনিব না। রস্তমজী বিপদে-আর আমি এখনও নিশ্চিন্ত বসিয়া আছি!”

“আপনি গেলে তাঁহাকে আরও বিপদে পড়িতে হইবে।”

“কেন?”

“—না হইলে তিনি কেন আপনাকে লুকাইয়া থাকিতে লিখিয়াছেন। আরও লিখিয়াছেন যে, আপনার লুকিয়ে থাকার উপর তাঁহার জীবন মরণ নির্ভর করিতেছে।”

“কেন তিনি এমন লিখিয়াছেন?”

“ইহা আপনারই বুঝিয়া দেখা উচিত। তিনি আপনার জন্য অনেক টাকা খরচ করিতেন।” তাঁহার মাহিনার অপেক্ষা তাঁহার খরচ অনেক বেশী; এ সব টাকা কোথা হইতে আসিত? এখন লোকে যদি আপনার কথা জানিতে পারে, বিচারে যদি এ কথা প্রকাশ পায়, তবে সকলই মনে করিবে, এই সকল খরচ যোগাইবার জন্যই রস্তমজী ব্যাঙ্ক হইতে টাকা লইয়াছেন।”

রতনবাঈ ব্যগ্রভাবে বলিল, “না—না, —তিনি আমার জন্য অনেক খরচ করিতেন বটে, কিন্তু তাঁহার টাকা ছিল। তিনি কখনই পরের টাকা লইতে পারেন না।”

“লোকে আপনাকে দেখে, আর আপনার এই বাড়ী ঘর আসবাব দেখে তা কি বিশ্বাস করিবে?”

“তিনি আমাকে ভালবাসেন না, — তিনি কমলাবাঈকে ভালবাসেন। তিনি দয়া করে আমাকে আশ্রয় দিয়াছেন—আমি তাঁহাকে ভালবাসি বলিয়া আমাকে স্থান দিয়াছেন। আমি না বুঝিয়া তাঁহাকে এত খরচ করাইয়াছি। আমার মরণ হইল না কেন?”

রতন কাঁদিয়া উঠিল। বহুক্ষণ ধরিয়া, বস্ত্রাঞ্চলে মুখ ঢাকিয়া কাঁদিতে লাগিল। তৎপরে সহসা বলিয়া উঠিল, “হাঁ, আমি তাঁহার এ আদেশ পালন করিব। তিনি যখন আমাকে লুকাইয়া থাকিতে হুকুম দিয়াছেন, তখন আমি নিশ্চয়ই তাহাই থাকিব। কিন্তু আমি কোথায় যাইব, তাহা ত জানি না।”

দাদাভাস্কর বলিলেন, “আমার স্ত্রীর নিকট দিন কতক থাকিতে পারেন। তিনি প্যারেলে থাকেন; সেখানে কেহ আপনার সন্ধান পাইবে না।”

রতন তাঁহার মুখের দিকে চাহিল।

দাদাভাস্কর বলিলেন, “রস্তমজী আমাকে নিতান্ত বিশ্বাসী না জানিলে আপনার নিকট পাঠাইতেন না।”

“ফ্রামজীকে পাঠাইলেন না কেন?”

“ফ্রামজী তাঁহার সঙ্গে থানায় গিয়াছেন।

“এ সব কে দেখিবে?”

“ফ্ৰামজী।”

“চলুন, তবে আর দেরী করিবেন না। পুলিস এখনই আসিতে পারে।”

“তা পারে।”

দাদাভাস্কর ভৃত্যকে গাড়ী ডাকিতে আজ্ঞা করিলেন। রতন সত্বর বেশ বিন্যাস করিয়া, সামান্য কিছু বস্ত্রাদি ও যে টাকা হাতে ছিল, তাহা লইয়া গাড়ীতে আসিয়া উঠিল। ভৃত্যদিগকে বলিল, “আমি শীঘ্র ফিরিব।”

গাড়ী ভিক্টোরিয়া ষ্টেশনে পৌঁছিল। রেলে উঠিয়া দাদাভাস্কর রতনকে লইয়া প্যারেলে আসিলেন। সেখানে তাঁহার স্ত্রীকে রতনবাঈকে বিশেষ যত্নে রাখিতে বলিয়া ও নিজের উদ্দেশ্য জানাইয়া তিনি তখনই আবার বোম্বের দিকে রওনা হইলেন।

দাদাভাস্কর পথে আসিতে আসিতে ভাবিলেন, “যাহা হউক, অন্ততঃ একজন সাক্ষী আমার হস্তগত হইল। দেখা যাক্, কত দূর কি হয়।”

তিনি একখানি গাড়ী লইলেন। সত্বর আসিয়া ফ্রামজীর সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। তাঁহাকে একপার্শ্বে ডাকিয়া আনিয়া গোপনে বলিলেন, “রস্তমজীর পত্র রতনবাঈকে দিয়াছি। রতনবাঈ পত্রানুযায়ী কার্য্য করিয়াছে। তখনই সে বাড়ী ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছে।”

ফ্রামজী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায়?”

দাদা। তা আমাকে বলে নাই, আপনাকে পত্র লিখিবে, বলিয়াছে।

ফ্রামজী। বাড়ী ঘর কাহার জিম্মায় রাখিয়া গেল?

দাদা। সেইজন্যই আপনার নিকট আসিয়াছি। তিনি যতদিন না ফিরেন, সে সব আপনাকেই দেখিতে বলিয়া গিয়াছেন। আপনি এখনই সেখানে একবার যান।

ফ্রামজী। এখনই যাইব।

ফ্রামজীর নিকট হইতে বিদায় হইয়া দাদাভাস্কর পুলিস আফিসের দিকে যাত্রা করিলেন।

নবম পরিচ্ছেদ – বেনামী পত্ৰ

ফ্রামজী প্রিয়বন্ধু রস্তমজীর-জন্য বড়ই চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন ছিলেন। যত শীঘ্র সম্ভব, আফিসের কাজ শেষ করিয়া তিনি রতনবাঈ-এর বাড়ী আসিলেন। সকলই সেইরূপ আছে, কেবল রতন বাঈ নাই। সেই সুন্দরীর অভাবে আজ যেন সুন্দর বাড়ীখানি কি একখানা বিষাদের মেঘে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিয়াছে।

তিনি বাড়ীর সমস্ত ঘর একে একে চাবী বন্ধ করিলেন। তৎপরে ভৃত্যদিগকে ডাকিয়া বলিলেন, “দেখ বিবি সাহেব দিন-কয়েক অন্যত্রে গিয়াছেন, রস্তমজীর নামে যে মিথ্যা নালিশ হইয়াছে, তাহারই জন্য তিনি গিয়াছেন। তোমরা ভাবিয়ো না—খুব সাবধানে থাকিবে।”

তিনি রতন বাঈয়র বাড়ীর সমস্ত বন্দোবস্ত ঠিক করিয়া নিজের বাড়ীর দিকে চলিলেন। বাড়ীর নিকটস্থ হইলে তাঁহাকে একজন পাহারাওয়ালা সেলাম করিল। সহসা তাঁহার পেষ্টনজীর খুনের কথা ও গুজরাটী কাগজের বর্ণনা মনে পড়িল, তিনি দাঁড়াইলেন।

এই পাহারাওয়ালাকে তিনি বিশেষ চিনিতেন। বিটের পাহারাওয়ালা বলিয়া, মধ্যে মধ্যে বকশিস দিতেন। সে-ও তাঁহাকে দেখিলেই সেলাম দিত। তিনি তাহাকে বলিলেন, “তুমি বলিয়াছ, পেষ্টনজীর খুনের রাত্রে আমাকে গাড়ী থেকে এখানে নামিতে দেখিয়াছ, ঠিক মনে করে দেখ দেখি—সে আমি কিনা?”

পাহারাওয়ালা উত্তর করিল, “না, ঘুমচোখ ছিল, তবে আপনি যে রকম কোট পাগড়ী পরেন, তারও তাই পরা ছিল।”

“এখান থেকে আমার বাড়ী দেখা যায়। তুমি কি দেখেছিলে যে, তিনি আমার বাড়ীতে প্রবেশ করেছিলেন?”

“এখন মনে পড়েছে, সে লোকটি আপনার বাড়ীতে যায় নাই; একটু আগে গিয়াই একটা গলির ভিতরে যায়। আমি মনে করেছিলাম—”

“তার পর আর তাকে দেখেছিলে?”

“না।”

“খুব ভাল করে ভেবে দেখ দেখি, সে লোকটি কি আমার চেয়ে লম্বা না ছোট?”

“এখন মনে পড়ছে, তিনি আপনার চেয়ে অনেক বেশী লম্বা। হাঁ, বেশ মনে পড়ছে, তখনই মনে হয়েছিল, যেন তিনি একটা ছোট কোট গায়ে দিয়েছেন।”

“এই কথা তোমাদের বড় সাহেবকে আজই জানাইতে ভুলিয়ো না।

বলিয়া ফ্রামজী নিজ গৃহাভিমুখে দ্রুতপদে প্রস্থান করিলেন। বাড়ীতে আসিয়া দেখিলেন, রেজিষ্টারী ডাকে তাঁহার জন্য একটি ছোট বাক্স, আসিয়াছে; কে পাঠাইয়াছে, কোথা হইতে পাঠাইয়াছে, তাহা দেখিবার জন্য তিনি সেই বাক্সটি উল্টাইয়া-পাল্টাইয়া বারংবার দেখিতে লাগিলেন। দেখিলেন, কোলাবা ডাকঘরেরর মোহর আছে।

তিনি বাক্সটি খুলিয়া দেখিলেন, বাক্সটি নোটে পূর্ণ। নোটগুলি বাহির করিয়া দেখিলেন, সবগুলিই দশ টাকার। গণিয়া দেখিলেন, পাঁচ হাজার টাকার নোট।

বাক্সের ভিতর একখানি পত্র ছিল। তিনি পাঠ করিলেন;

“ফ্রামজী সাহেব,

আপনি রস্তমজীর বিশেষ বন্ধু। তাহাই আপনার নিকট এই পাঁচ হাজার টাকা পাঠাইলাম। তাঁহার মোকদ্দমা চালাইবার টাকা নেই। তাঁহার বিশেষ শুভানুধ্যায়ীর নিকট হইতে ইহা যাইতেছে, বলিয়া গ্রহণ করিবেন। তিনি নিৰ্দ্দোষ, এই টাকায় ভাল উকীল কৌন্সিলী দিয়া তাঁহাকে খালাস করিবেন। আপনাকে বিশেষ করিয়া বলা নিষ্প্রয়োজন।

রস্তমজীর জনৈক শুভাকাঙ্ক্ষী।”

ফ্রামজী ভাবিলেন, “এ টাকা কে পাঠাইল? রস্তমজীর যে যেখানে আত্মীয় স্বজন বন্ধু-বান্ধব অছেন, তাহা আমি সব জানি। আমি জানি না, এমন আর কে আছেন? আমার ত এমন কারও নাম এখন মনে পড়ে না। তবে হয় ত হরমসজীর এখন অনুতাপ হইয়াছে। তিনিই এ টাকা লইয়াছেন, নতুবা আর কেহই লইতে পারে না। আর কাহার লইবার সাধ্যও নাই। এখন একজন নিরপরাধ লোক জেলে যায় দেখিয়া অনুতাপ হইয়াছে, হয় ত তাহাই তাঁহার উকীল কৌন্সিলীর খরচের জন্য এই টাকা বেনামী করিয়া পাঠাইয়াছেন। যাহাই হউক, যখন এ টাকা আর ফেরৎ দিবার উপায় নাই, তখন এ টাকায় আমি নিশ্চয়ই রস্তমজীকে খালাস করিতে পারিব। পাপীর টাকায় পুণ্যের জয় হইবে।

.

ফ্রামজী সেই রাত্রেই বোম্বের একজন বিখ্যাত উকীলের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। তিনি সকল কথা শুনিয়া বলিলেন, “মোকদ্দমা যে খুব কঠিন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। কারণ দুইজন ব্যতীত সিন্দুক অপর কাহারই খুলিবার কিছুমাত্র সম্ভাবনা নাই। তাহা হইলে, টাকা হয় হরমসজী, না হয় রস্তমজী লইয়াছেন। হরমসজীর বিরুদ্ধে সন্দেহ করিবার কোন কারণ নাই।”

ফ্রামজী বলিলেন, “রস্তমজীর বিরুদ্ধেই বা কি আছে?”

উকীল বলিলেন, “যথেষ্ট—রস্তমজীর একটি রক্ষিতা স্ত্রীলোক আছে। তিনি তাহার জন্য জলের মত অর্থ ব্যয় করিয়া আসিতেছেন। ইহার উপর তাঁহার জুয়াখেলা আছে,—মদও আছে,—তিনি যাহা মাহিনা পান, তাহাতে তাঁহার এত খরচ কোন ক্রমেই চলিতে পারে না।”

ফ্রামজী বলিলেন, “আমি জানি, তিনি কোম্পানীর কাগজের কেনা বেচায় অনেক টাকা পাইয়াছিলেন।”

উকীল বলিলেন, “প্রমাণ করা শক্ত, জুরীরা স্বভাবতই মনে করিবে যে, এইরূপ দুই হাতে খরচ করায় রস্তমজীর নিতান্তই টাকার টানাটানি হইয়াছিল, টানাটানিতে অনেকে যাহা করে, তিনিও তাহাই করিয়া ছিলেন। নিতান্ত দায়ে পড়িয়া সিন্দুক হইতে টাকা লইয়াছেন। যাহাই হউক, বিশেষ চেষ্টা করিয়া দেখা যাইবে। একেবারে যে কোন আশা নাই, এমন কথা বলি না।”

নিতান্ত বিষণ্ণচিত্তে ফ্রামজী গৃহে ফিরিলেন। সে রাত্রে রতনবাঈ-এর কোন সংবাদ পাইলেন না।

দশম পরিচ্ছেদ – আবার বেনামী পত্ৰ

সন্ধ্যার কিঞ্চিৎ পরে দাদাভাস্কর গৃহে ফিরিলেন। স্ত্রীকে গোপনে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিছু সন্দেহ করে নাই ত?”

স্ত্রী। না।

দাদা। কোন অযত্ন হয় নাই ত? খুব খুসী আছে ত?

স্ত্রী। হাঁ।

দাদা। এখন কোথায়?

স্ত্রী। সমস্ত দিন ছটফট করছে। এক মিনিট এক জায়গায় স্থির থাকতে পারছে না। এখন একটু ঐ দিকে বেড়াচ্ছে। আহা, বাছা বড় কষ্ট পাচ্ছে।

দাদা। ওর ভালর জন্যই চেষ্টা পাওয়া যাচ্ছে। তাতে আর কষ্ট না পেলে চলবে কেন?

স্ত্রী। ভাল কথা মনে পড়েছে। একখানা চিঠী আমাকে ডাকে দিতে দিয়েছিল, কিন্তু তোমাকে দেখাব বলে দিই নাই। ভাল করি নাই কি?

দাদা। বেশ বুদ্ধিমতীর কাজই করেছ। কই দেখি?

গৃহিণী পত্রখানি স্বামীর হস্তে দিলেন। দাদাভাস্কর তাহা তাড়াতাড়ি খুলিয়া পাঠ করিলেন—

“শ্রদ্ধাস্পদ বর্জরজী সাহেব,

রস্তমজীর বিপদের কথা আপনি নিশ্চয়ই শুনিয়াছেন। আপনাদের উভয়ে বাহিরে বন্ধুত্ব থাকলেও ভিতরে ভিতরে যে বিরোধ ভাব আছে, তাহা আমি জানি। যাহাই হউক, আপনার টাকার অভাব নাই। আশা করি, আপনি প্রাণপণ চেষ্টা করিয়া রস্তমজীকে এ বিপদ্ হইতে উদ্ধার করিবেন।

যদি না করেন, তবে নিশ্চয় জানিবেন, আপনার সহিত সেদিন মাঞ্চারজীর যে কথোপকথন হইয়াছিল, আমি অপর ঘর হইতে সব শুনিতে পাইয়াছিলাম, এখন তাহা সকলকে প্রকাশ করিয়া দিব।

আমি এখন কোথায় আছি, আপনাকে জানাইতে পারিলাম না। তাহা শুনিবার আপনার কোন প্রয়োজনও নাই।

রতনবাঈ।”

দাদাভাস্কর পত্রখানি আবার পূর্ব্ববৎ আঁটিয়া বলিলেন, “দেখিতেছি, ইহার ভিতর অনেক ব্যাপার আছে। যত সহজ ভাবিয়াছিলাম, তত সহজ নহে।”

এই সময়ে রতনবাঈ সেখানে আসিয়া পড়িল। তাহার হস্তে একখানি পত্র। রতনবাঈ বলিল, “এই পত্র একটি ছেলে আমার হাতে দিয়া ছুটিয়া পলাইয়া গেল।”

দাদাভাস্কর বলিলেন, “পত্রখানি কি দেখিতে পারি?”

রতনবাঈ পত্রখানি তাঁহার সম্মুখে ফেলিয়া দিল। দাদাভাস্কর পড়িলেন—

“আমি রস্তমজীর বিশেষ বন্ধু। তাঁহারই জন্য আপনার সহিত গোপনে দুই-একটি কথা বলা আবশ্যক। পাছে অন্যত্র দেখা করিতে আপনি ইতস্ততঃ করেন বলিয়া, আমি প্রকাশ্য স্থানই স্থির করিলাম।

রাত্রি নয়টার সময় প্যারেল ষ্টেশনের প্লাটফর্ম্মে আমি থাকিব। সেইখানে আসিলেই আমার সঙ্গে দেখা হইবে।”

দাদাভাস্কর পত্র পাঠ করিয়া বলিলেন, “আপনি কি যাইবেন?”

রতন। নিশ্চয়।

দাদা। আপনার ইহাতে বিপদ ঘটিতে পারে।

রতন। আর আমার বিপদাপদ কি আছে! আর আমার কিছুতেই ভয় নাই। নয়টা বাজে। এই বলিয়া সে মুহূৰ্ত্তমধ্যে বাহির হইয়া গেল।

দাদাভাস্কর লম্ফ দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। স্ত্রীকে বলিলেন, “এ ছুঁড়ীটা বদ্ধ পাগল—শীঘ্র আমার কাপড় দাও।”

তিনিও শীঘ্র একটা ছদ্মবেশ পরিয়া বাহির হইয়া গেলেন। তিনি দেখিতে পাইলেন, রতন বাঈ প্যারেল স্টেশনে প্রবিষ্ট হইল। তিনিও দূরে থাকিয়া তাহার অনুসরণ করিতে লাগিলেন।

তিনি দেখিলেন, একটি মোটা পার্শী ভদ্রলোক একখানা বেঞ্চের উপর বসিয়া আছেন। রতনবাঈকে দেখিয়া তিনি ধীরে ধীরে উঠিয়া দাড়াইলেন। রতনবাঈ তাহার নিকটস্থ হইল। দাদাভাস্কর নিকটে অন্ধকারে লুক্কায়িত হইলেন।

পার্শী ভদ্রলোকটি রতনকে কি বলিলেন। তখন উভয়ে সেই বেঞ্চের উপর উপবিষ্ট হইলেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ দাদাভাস্কর তাঁহাদের কোন কথা শুনিতে পাইলেন না। তিনি মনে মনে বলিলেন, “আমি কি গাধা, আরও কাছে যাওয়া দরকার ছিল।”

বহুক্ষণ ধরিয়া উভয়ের কথোপকথন হইল। তৎপরে উভয়ে উঠিয়া দাঁড়াইলেন। উভয়ে ষ্টেশনের বাহিরে আসিয়া একখানা গাড়ীতে উঠিলেন। দাদাভাস্কর বলিলেন, “এইবার সব বিদ্যেই টের পাওয়া যাইবে।”

গাড়ী চলিল। দাদাভাস্কর নিঃশব্দে আসিয়া গাড়ীর পিছনে বসিলেন। মনে মনে বলিলেন, “এখন যত ইচ্ছা জোরে হাঁকাও।”

ক্রমে গাড়ী বহুদূর আসিয়া একটা বাড়ীর সম্মুখে থামিল। দাদাভাস্কর সত্বর নামিয়া অন্ধকারে লুকাইলেন। দেখিলেন, কোচম্যান লম্ফ দিয়া নীচে নামিল। কিন্তু তিনি পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করিলেন, তবুও কেহ গাড়ী হইতে নামিল না। তখন তিনি ব্যাপার কি দেখিবার জন্য ধীরে ধীরে গুঁড়ি মারিয়া গাড়ীর নিকটস্থ হইলেন। অতি সন্তর্পণে গাড়ীর ভিতর উঁকি মারিয়া দেখিলেন। হা অদৃষ্ট! এ কি! গাড়ীর ভিতরে জনপ্রাণী নাই। তিনি মনে মনে বলিলেন, “শেষে দাদাভাস্করকেও গাধা বানাইল? আমার চোখে ধূলা দিল! নিশ্চয়ই এই গাড়ীর ভিতর এক দ্বার দিয়া উঠিয়া, কখন অন্য দ্বার দিয়া নামিয়া গিয়াছে।”

তিনি ভাবিলেন, কোচম্যানকে দুই-একটা কথা জিজ্ঞাসা করিবেন। কিন্তু সে তাঁহার প্রশ্ন শুনিয়া এমনই কুৎসিত ভাবে তাঁহাকে গালি দিয়া উঠিল যে, তিনি দুই পদ সরিয়া দাঁড়াইলেন। সে ঘোড়াকে চাবুক লাগাইয়া তীরবেগে অর্ন্তদ্ধান হইয়া গেল।

বহুক্ষণ দাদাভাস্কর হতবুদ্ধি হইয়া তথায় দণ্ডায়মান রহিলেন। আর এখানে দাঁড়াইয়া থাকা বৃথা ভাবিয়া তিনি ধীরে ধীরে গৃহের দিকে ফিরিলেন। ভাবিলেন, “এ নিশ্চয়ই ফ্রামজীর কাজ।”

.

দাদাভাস্কর বাড়ী আসিয়া দেখিলেন, রতনবাঈ ফিরে নাই। তখন তিনি বুঝিলেন, রতনবাঈ তাঁহার হাত হইতে পলাইয়াছে। তিনি নিতান্তই কিংকৰ্ত্তব্যবিমূঢ় হইলেন। ভাবিলেন, “হরমসজী যে রকম লোক, সেও রতনবাঈকে হাত করিতে পারে। সে ছেলেমানুষ বই ত নয়। যাহা হউক, কাল ইহার বিশেষ তদন্ত করিতে হইবে।”

একাদশ পরিচ্ছেদ – কৃষ্ণজী বলবন্ত কীৰ্ত্তিকর

পরদিবস প্রাতেই পুলিস-আফিস হইতে দাদাভাস্করকে ডাক পড়িল। তিনি সত্বর বেশ-বিন্যাস করিয়া রওনা হইলেন।

তিনি আফিসে প্রবিষ্ট হইলে তাঁহারই ন্যায় একজন ইনস্পেক্টর বলিলেন, “সুপারিন্টেণ্ডেন্ট যে তোমায় খুঁজছেন—শীঘ্র যাও।”

দাদাভাস্কর সত্বরপদে সুপারিন্টেণ্ডেন্টের আফিস-ঘরে প্রবেশ করিলেন। সেই গৃহে একখানি বৃহৎ টেবিলের সম্মুখে একজন অৰ্দ্ধপক্ক কেশ মারাঠী ভদ্রলোক বসিয়া আছেন। তাঁহার সোনার চশমার পশ্চাৎ হইতে তাঁহার চক্ষু দুইটি তারার মত জ্বলিতেছে। ইনিই বিখ্যাত ডিটেটিভ সুপারিন্টেণ্ডেন্ট কৃষ্ণজী বলবন্ত কীর্ত্তিকর।

দাদাভাস্কর তাঁহাকে সসম্ভ্রমে সেলাম করিলে তিনি বলিলেন, “ব্যাঙ্ক চুরী কেসের কতদূর কি করিলে হে? আজই যে রিপোর্ট দেওয়া চাই। আমাদের দোষে আসামী বেচারা হাজতে পচিতে পারে না।”

দাদাভাস্কর মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে বলিলেন, “এখন মাষ্টার—এখন—”  

কীর্ত্তিকর গম্ভীরভাবে বলিলেন, “জানি, এখনও তুমি কিছুই করিতে পার নাই, বরং সমস্ত গণ্ডগোল করিয়াছ।”

দাদাভাস্কর বিনীতভাবে অত্যন্ত সংকোচের সহিত বলিলেন, “মাষ্টার, আমার এ বিষয়ে তত দোষ নাই। আমি প্রাণপণে চেষ্টা পাইতেছি। এ ব্যাপারের কোন একটা সূত্র নাই।”

কীর্ত্তকর রুষ্ট হইয়া বলিলেন, “তুমি একটি প্রকাণ্ড গাধা। কেন? ইহার প্রধান সূত্রই ত তুমি প্রথম দিনেই লক্ষ্য করিয়াছিলে? বুদ্ধি থাকিলে দোষীকে এতদিনে ধরিতে পারিতে।”

দাদাভাস্কর ভয়ে ভয়ে বলিলেন, “কি সূত্র আপনি বলিতেছেন?”

কীর্ত্তিকর বিরক্তভাবে বলিয়া উঠিলেন, “কেন? হরমসজীর চাবীতে কি রস্তমজীর চাবীতে সিন্দুক খোলা হইয়াছিল, তাহা তুমি ইচ্ছা করিলে অনায়াসেই জানিতে পারিতে।”

দাদাভাস্কর বলিলেন, “কেমন করে?”

কীর্ত্তিকর বলিলেন, “মনে আছে, সিন্দুকের তালার উপর রঙের ঘেঁড়া দাগ দেখেছিলে?”

দাদাভাস্কর মাথা নাড়িয়া বলিলেন, “হাঁ।”

কীর্ত্তিকর বলিলেন, “যে চাবীতে সিন্দুক খোলা হইয়াছিল, নিশ্চয়ই তার মুখে একটু না-একটু রং লেগে থাকা সম্ভব, তখনই তোমার দুই চাবীই দেখা উচিত ছিল। তোমার মত এমন চেপে চোখ বুঝে থাকলে সূত্র ত দূরের কথা—খুব মোটা রজ্জুও দেখিতে পাওয়া যায় না।”

দাদাভাস্কর বলিলেন, “হাঁ, এখন বুঝেছি।”

কীর্ত্তিকর বলিলেন, “এই দাগের চোর ধরা পড়িবে। ইহাতেই আমি তাহাকে ধরিব।”

দাদাভাস্কর বলিলেন, “আপনিও তাহা হইলে এ মোকদ্দমার তদন্ত করিতেছেন?”

কীর্ত্তিকর বলিলেন, “হাঁ, কিছু কিছু, কিন্তু ভার তোমার উপর আছে, যাহা হউক, তুমি যাহা সন্ধান লইয়াছ, সমস্ত আমাকে বল।”

দাদাভাস্কর যাহা যাহা করিয়াছিলেন, সমস্তই বলিলেন। কেবল রতনবাঈ তাঁহার চোখে কিরূপে ধূলা দিয়াছিল, তিরস্কারের ভয়ে তাহাই কেবল বলিতে সাহস করিলেন না।

কীর্ত্তিকর বলিলেন, “দাদাভাস্কর, তুমি একটা কথা ভুলিয়া যাইতেছ। কতদূর তুমি সেই খালি গাড়ীর পিছনে পিছনে গিয়াছিলে?”

দাদাভাস্কর আশ্চর্যান্বিত হইয়া কীর্ত্তিকরের মুখের দিকে চাহিলেন; সবিস্ময়ে বলিলেন, “মাষ্টার, তাও আপনি জানেন?”

কীর্ত্তিকর মৃদুহাস্যে বলিলেন, “আমি সব খবর রাখি হে—সব খবর রাখি! আমার কাছে কোন কথা গোপন করিবার চেষ্টা করিয়ো না।”

দাদাভাস্কর বলিলেন, “ওঃ! এখন বুঝেছি, আপনিই সেই মোটা পার্শী—কিন্তু এমন মোটা হইলেন কি করে? আপনাকে আমিও চিনিতে পারি নাই।”

কীর্ত্তিকর বলিলেন, “এখনও ছদ্মবেশ কাকে বলে তুমি তা জানিতে পার নাই। চোখ আর ঠোঁটের ভঙ্গী বদলাইতে না পারিলে কেহই ছদ্মবেশ ধরিতে পারে না।

দাদা। তা হইলে রতনবাঈ আপনাকে সব বলেছে?

কীৰ্ত্তি। হাঁ।

দাদা। তবে আপনি জানেন, সে এখন কোথায় আছে।

কীৰ্ত্তি। জানি। সে, এখনও আমার হাতে আছে, আমার পরামর্শ মত কাজ করছে।

দাদা। তা হইলে আমার আর কি করবার আছে?

কীৰ্ত্তি। অনেক আছে—ব্যস্ত হইয়ো না।

দাদা। আপনি কি তবে চোর কে, তা জানিতে পারিয়াছেন?

কীৰ্ত্তি। তা ঠিক এখনও বলিতে পারি না। তবে এই পর্যন্ত বলিতে পারি, হরমসজী বা রস্তমজী এ দুজনের মধ্যে কেহই টাকা চুরী করেন নাই। এ দিকে এস।

দাদাভাস্কর সম্মুখে সরিয়া দাঁড়াইলেন। কীর্ত্তিকর তাঁহার সম্মুখে একখানি বড় ফটোগ্রাফ রাখিয়া বলিলেন, “এ ফটোগ্রাফ কিসের দেখিতে পাইতেছ?”

“হাঁ, এ দেখিতেছি সেই সিন্দুকের তালার ফটোগ্রাফ।”

“এই সেই দাগ দেখিতেছ। চাবীর স্থান হইতে ইহা নীচের দিকে গিয়াছে; ভাল করে দেখ, এটা বাম দিক্ হইতে ডান দিকে গিয়াছে।”

“তাহা এখন বেশ স্পষ্ট দেখিতেছি।”

“তুমি স্বভাবতই মনে করিয়াছিলে, যে লোক টাকা লইয়াছে, সিন্দুক খুলিবার সময় তাহারই চাবীতে এই দাগ হইয়াছিল। ভাল কথা, আমি এই একটা তালা ঠিক সেই রকম গ্রীণ রং-এর পাইয়াছি। এই চাবী, দেখ দেখি, দাগ পড়ে কি না?” বলিয়া কীর্ত্তিকর বাক্সের ভিতর হইতে একটা সবুজ রং মাখান তালা বাহির করিলেন।

দাদাভাস্কর চাবী দিয়া সেই তালায় দাগ করিবার চেষ্টা পাইয়া বলিলেন, “এ রং ভারি শক্ত, সহজে দাগ পড়ে না।”

“সে তালার রং আরও শক্ত ছিল, সুতরাং চোরের কম্পিত হস্তে চাবী সরিয়া পড়িয়া এ দাগ হইতে পারে না।”

“এখন বুঝিতেছি, নিশ্চয়ই এ দাগ হইতে খুব জোর লাগিয়াছিল।”

“হাঁ, খুব জোর না লাগিলে এরূপ দাগ পড়া সম্ভব নহে। তবে দাগটি কিরূপে পড়িয়াছে, সে বিষয়ে তোমার কি মনে হয়?”

“মাষ্টার মহাশয়, আপনার কথা শুনে আমার মাথার ভিতরে ভয়ানক গোলমাল বাঁধিয়া গিয়াছে, কিছুই ভাল বুঝিতে পারিতেছি না।”

“তবে দেখ।”

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – মুক্তির উপায়

কীর্ত্তিকর উঠিয়া দাঁড়াইলেন। দরজার কড়ায় সেই গ্রীণ রঙের তালাটা লাগাইয়া দিয়া দাদাভাস্করকে বলিলেন, “এই দরজার নিকট এস। মনে কর, আমি এই দরজা এই চাবী দিয়া · খুলিতে চাই, আর তুমি আমাকে কোন মতে দরজা খুলিতে দিবে না। এই আমি চাবী লাগাইতে উদ্যত হইলাম, তুমি এখন কি করিবে?”

দাদাভাস্কর বলিলেন, “আমি আপনার হাত ধরিয়া টানিয়া নিজের দিকে আনিব।”

কীর্ত্তিকর বলিলেন, “ঠিক কথা। আমি এই চাবী লাগাইতেছি, তুমি আমার হাত ধরিয়া বাধা দাও।”

কীর্ত্তিকর চাবী লাগাইতে উদ্যত হইলেন। দাদাভাস্কর তাঁহার হাত ধরিয়া বল প্রয়োগে বাধা দিতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন; অমনি সেই তালাতে চাবীর একটা দাগ পড়িয়া গেল। যেমনি দাগ পড়া—অমনি দাদাভাস্করের একটি অত্যুচ্চ লম্ফ প্রদান—যেন স্বর্গ হস্তগত হইল।

কীর্ত্তিকর বলিলেন, “দেখ দেখি এখন, সিন্দুকে ঠিক এমনই ধরণের একটা দাগ পড়িয়াছিল কিনা?”

দাদাভাস্কর উৎসাহের সহিত বলিলেন, “তাই ত—ঠিক ত!”

“এখন কিছু বুঝিতে পার?”

“এখন গাধাও বুঝিতে পারে।”

“কি বুঝিলে?”

“স্পষ্ট বুঝিতে পারিতেছি। চুরীর সময় দুজন ছিল। একজন চাবী খুলিতে চেষ্টা পাইতেছিল, আর একজন বাধা দিতেছিল। তা হলে আমি যাহা মনে করিয়াছিলাম, তাহাই ঠিক; রস্তমজী চুরী করে নাই। রস্তমজী ইচ্ছা করিলেই যখন-তখন সিন্দুক খুলিতে পারিত, সুতরাং সে কেন আর একজনকে লইয়া চুরী করিতে যাইবে। সে বাধা দিতে পারে, কিন্তু তাহাই বা কিরূপে হইবে?”

“সংসারে সবই সম্ভব। মনে কর, তাহার প্রিয়বন্ধু ফ্রামজী চুরী করিতে যাইতেছিল, সে বাধা দিয়াছিল।”

“খুব সম্ভব। আপনি কি তবে ফ্রামজীকেই চোর মনে করেন?”

“আমি এখন স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পরি নাই—এখন ঠিক করিয়া কিছুই বলিতে পারি না।”

“কিন্তু রস্তমজী এবং হরমসজী ভিন্ন আর কেহ গুপ্তকথা জানিত না। বস্তুমজী যদি টাকা না লইয়া থাকে, তবে হরমসজী নিশ্চয়ই লইয়াছেন।”

“যে কারণে রস্তমজীর উপর সন্দেহের কারণ নাই, সেই কারণে হরমসজীর উপরও নাই। তিনি যখন ইচ্ছা, তখনই সিন্দুক খুলিতে পারিতেন। এত গোপনে খুলিবার প্রয়োজন কি? তাহার টাকা তিনি লইবেন, তাহাতে কে প্রতিবন্ধক দিতে যাইবে?”

“তাও ঠিক কথা। তবে কে চুরী করিল?”

“সুতরাং তৃতীয় ব্যক্তি চুরী করিয়াছে। এই তৃতীয় ব্যক্তিকে খুঁজিয়া বাহির করাই আমাদের কাজ।”

“আপনি কি অনুমান করেন? বাড়ীর ভিতরের সিঁড়ী দিয়া ক্যাস ঘরে আসা যায়, চোর ভিতরের সেই সিঁড়ী দিয়াই কি আসিয়াছিল?”

“সম্ভব।”

“কি ভয়ানক! তবে কি আপনি মনে করেন যে, হরমসজীর স্ত্রী বা কন্যা এই টাকা লইয়াছেন?”

“আমি এখন কিছুই মনে করি নাই। সন্ধানে থাক, আমিও আছি। শীঘ্র চোর ধরা পড়িবে।”

“আমাকে কি করিতে বলেন?”

‘পরে বলিয়া দিব। এখন তোমার রিপোর্ট কমিশনার সাহেবের কাছে নিজেই লইয়া যাও।’ যদি তিনি কোন কথা বলেন, সব বুঝাইয়া দিয়ো। নিরপরাধ লোককে জেলে ফেলিয়া রাখা উচিত নহে।”

“আমি এখনই যাইতেছি।”

“কমিশনার সাহেব একেবারে রস্তমজীকে ছাড়িবেন না। বোধ হয়, তাহার পাঁচ হাজার টাকার জামিন চাহিবেন। তাহা হ তুমি হরমসজীকে রস্তমজীর জামিন হইতে বলিবে। দেখ, তিনি কি বলেন।”

“তিনি জামিন হইতে নিশ্চয়ই স্বীকার করিবেন না।”

“আমার বিশ্বাস—হবেন।”

“মাষ্টার, আপনার অপেক্ষা অধিক কে বুঝিবে?”

দাদাভাস্কর সমস্ত কথা রিপোর্টে লিখিয়া স্বয়ং কমিশনার সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। তিনি সকল কথা শুনিয়া বুঝিলেন যে, প্রকৃতই এরূপ অবস্থায় রস্তমজীর চুরী করা সম্ভব নহে তবে তাঁহার বিরুদ্ধে প্রমাণও অনেক আছে; কিন্তু, যখন সন্দেহ আছে, তখন তাঁহাকে আর হাজতে রাখা ঠিক নহে।

কীর্ত্তিকর যাহা ভাবিয়াছিলেন, তাহাই হইল। কমিশনার সাহেব পাঁচ হাজার টাকার জামিনে তাঁহাকে ছাড়িয়া দিতে হুকুম দিলেন। হুকুম শুনিয়া দাদাভাস্কর চিন্তিত মনে হরমসজীর বাড়ীর দিকে চলিলেন।

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – রাজাবাঈ

দাদাভাস্করের বিন্দুমাত্র বিশ্বাস ছিল না যে, হরমসজী, রস্তমজীর জামিন হইবেন। তবুও সর্দ্দারের হুকুমে তিনি তাঁহার সহিত দেখা করিতে চলিলেন। ব্যাঙ্কে আসিয়া দেখিলেন, হরমসজী সেখানে নাই। দাদাভাস্করকে আসিতে দেখিয়া ফ্রামজী সত্বর তাঁহার নিকট আসিয়া সাদর সম্ভাষণ করিলেন। দাদাভাস্কর জিজ্ঞাসা করিলেন, “হরমসজী সাহেব কোথায়?”

ফ্রামজী। তিনি এখনও আফিসে আসেন নাই। উপরে নিজের বৈঠকখানায় আছেন। কেহ আসিলে সেইখানেই তাঁহাকে সংবাদ দিতে আজ্ঞা করিয়াছেন।

দাদা। তবে তাই সংবাদ দিন।

ফ্রামজী। নূতন কিছু সংবাদ আছে কি? শুনিতে পাই না?

দাদা। নিশ্চয়, আমরা প্রমাণ পাইয়াছি যে, রস্তমজী টাকা চুরী করেন নাই।

ফ্রামজী আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া বলিলেন, “আমি ত আগেই আপনাকে এ কথা বলিয়াছিলাম।”

দাদাভাস্কর মনে মনে বলিলেন, “ভায়া, তুমি সহসা এত আহ্লাদ প্রকাশ করো না।” তাঁহার কথা শুনিয়া ব্যাঙ্কের কর্ম্মচারিগণ আসিয়া দাদাভাস্করকে ঘেরিলেন। সকলেই উদ্‌গ্রীব হইয়া জিজ্ঞাসা করতে লাগিলেন, তিনি কি খালাস পাইয়াছেন?”

দাদা। এখনও পান নাই,—হুকুম হইয়াছে। পাঁচ হাজার টাকার জামিনে খালাসের হুকুম হইয়াছে। সেইজন্য হরমসজী সাহেবের নিকট আসিয়াছি; যদি তিনি জামিন হন

ফ্রামজী। তিনি কি হইবেন?

দাদা। দেখা যাক জিজ্ঞাসা করে। নতুবা আর কে হতে পারে?

ফ্রামজী। জামিন না পাওয়া যায়, টাকা জমা দিলে হতে পারে?

দাদা। নিশ্চয়।

তখন ব্যাঙ্কের সমস্ত কর্ম্মচারী একবাক্যে বলিলেন, “আমাদের যাহার যাহা সঞ্চিত আছে, সকলেই রস্তমজীর খালাসের জন্য জমা রাখিতে প্রস্তুত আছি।”

দাদা। দেখা যাক, একবার হরমসজী সাহেবকে সংবাদ দিন।

উপরে সংবাদ দেওয়া হইল। হরমসজী দাদাভাস্করকে উপরে পাঠাইয়া দিতে বলিলেন।

দাদাভাস্কর প্রকোষ্ঠ মধ্যে প্রবেশ করিলে হরমসজী তাঁহাকে বসিতে বলিলেন। তৎপরে বলিলেন, “আর কিছু কি অনুসন্ধানের জন্য আসিয়াছেন!”

“না, তা ঠিক নয়। তবে আমরা প্রমাণ পাইয়াছি যে, রস্তমজী আপনার টাকা চুরী করেন নাই।

“তবে কে চুরী করিয়াছে?”

“তা এখনও বলিতে পারি না।”

“তবে কাহাকে সন্দেহ করেন?”

“এখন কাহাকেও নয়।”

“চোর ধরা ত চাই।”

“নিশ্চয়ই ধরা পড়িবে।”

“আপনার তবে রস্তমজীকে ছাড়িয়া দিয়াছেন?”

“এখনও দিই নাই, সেইজন্যই আপনার নিকট আসিয়াছি।”

“কেন?”

“পাঁচ হাজার টাকা জামিনে তাঁহার খালাসের হুকুম হইয়াছে তাঁহার জামিন হন, এমন লোক এখানে কেহ নাই। আপনি তাঁহার জামিন হইবেন কি না, তাহাই জানিতে আসিয়াছি।”

“আমি!”

কেন নয়? যখন তিনি আপনার টাকা চুরী করেন নাই, তখন আপনারই জামিন হওয়া কৰ্ত্তব্য।”

“কখনও নয়—তাহার উপর আমার আর বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নাই।”

“তিনি চুরি করেন নাই, তবুও নয়।”

“আপনার এ অনুরোধ অন্যায়। আর কোন কথা আছে?”

“না”, বলিয়া দাদাভাস্কর উঠিয়া দাঁড়াইলেন। এই সময়ে সহসা পার্শ্বের দরজা খুলিয়া গেল। রাজাবাঈ স্বামীর পার্শ্বে আসিয়া অতি ব্যাকুলস্বরে বলিলেন, “তুমি জামিন হও।”

হরমসঙ্গী অত্যন্ত বিস্মিতভাবে পত্নীর মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “কি আশ্চর্য্য! আমি? কখনও নয়—তুমি এ সব ব্যাপারের কি বুঝ?”

রাজাবাঈ বলিলেন, “আমি পুনঃপুনঃ বলিয়াছি যে, রস্তমজী টাকা চুরী করে নাই; তথাপি আমার কথা বিশ্বাস হয় না। সে নিরপরাধ,—তুমি তার জামিন না হইলে কে হইবে?”

“এ সব বিষয় তুমি কিছু বুঝিবে না—যাও।”

“তুমি সম্মত না হইলে আমি যাইব না,—কিছুতেই যাইব না।”

“বিরক্ত করিয়ো না।”

রাজাবাঈ সহসা স্বামীর পদপ্রান্তে জানু পাতিয়া বসিয়া কাতরকণ্ঠে বলিলেন, “তোমাকে আমি কখনও এরূপভাবে কিছুর জন্য অনুরোধ করি নাই। এত জেদও করি নাই, আজ আমার অনুরোধ রাখ।”

হরমসজী উঠিয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন, “একেবারে কাণ্ড-জ্ঞান হারাইলে! দেখিতেছ না, এখানে একজন অপর লোক রহিয়াছে?”

এই বলিয়া তিনি রাজাবাঈ-এর হাত ধরিয়া তুলিলেন। রাজাবাঈ-এর দুই চক্ষু দিয়া জলধারা বহিতেছিল। হরমসজী তাহার হাত ধরিয়া অন্য গৃহে গেলেন।

দাদাভাস্কর মনে মনে বলিলেন, “এই চুরি সংবাদ আমার গুরু কীর্ত্তিকর মহাশয় যাহা জানেন না, তাহা এই ভদ্রমহিলা অবগত আছেন। এ কথা যদি মিথ্যা হয়, তাহা হইলে এই দাদাভাস্করটি সত্যসত্যই একটি প্রকাণ্ড হস্তী-মূর্খ।”

কিয়ৎক্ষণ পরে হরমসজী ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন, “মহাশয়, আমি জামিন হইব চলুন।”

দাদাভাস্কর সহসা হরমসজীর এই মত পরিবর্তনে বিশেষ আশ্চর্যান্বিত হইলেন না, কারণ তাঁহার গুরুদেব এ ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ব্বেই করিয়াছিলেন।

তাঁহারা উভয়ে নীচে নামিয়া আসিলেন। তৎপরে নীরবে বাড়ীর বাহির হইয়া গেলেন। ব্যাঙ্কের কর্ম্মচারিগণ তাঁহাদের দিকে আশ্চৰ্য্যান্বিতভাবে চাহিয়া রহিল। একজন বৃদ্ধ বলিলেন, “হরমসজী সাহেব রস্তমজীকে বড়ই ভালবাসেন। দেখিতেছ না, জামিন হইতে যাইতেছেন।”

চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ – মুক্তি

আজ সাতদিন হইল, রস্তমজী কারাগারে আবদ্ধ রহিয়াছেন। তিনি নিজের দুঃখে ম্রিয়মাণ, কাহারও সহিত কোন কথা কহেন না। অন্যান্য বন্দিগণ তাঁহার দিকে চাহিয়া থাকে, কেহ কেহ বা তাঁহাকে বিদ্রূপ করে, তিনি লজ্জায় অপমানে সর্ব্বদাই মৃত্যু বাঞ্ছনীয় মনে করেন। এই সাতদিনে যেন তিনি বার্দ্ধক্যে উপনীত হইয়াছেন।

নানা চিন্তায় তাঁহার মন সৰ্ব্বদাই আকুল। কখন মনে করেন, এ অপমান মাথায় করিয়া আর বাঁচিয়া ফল কি? আত্মহত্যা করি না কেন? আবার মনে করেন, না, আত্মহত্যা করিয়া মহাপাতকী হইব না। আমি যে নিরপরাধ, তাহা জগতে প্রচার করিয়া তবে মরিতে হয় মরিব? আবার ভাবিলেন, কেহই আর আমার খবর লইতেছে না। সকলেই কি আমাকে ভুলিয়া গেল? ফ্রামজীও কি ভুলিল? সে-ও কি আমাকে খালাস করিবার জন্য কিছুই চেষ্টা করিবে না? আমার মরণই ভাল। কমলাও নিশ্চয় আমাকে চোর ভাবিয়াছে। সে কি মনে করিতেছে? আর আমার এ জেল হইতে বাহির হইয়া লাভ কি? আর কিরূপে লোকালয়ে মুখ দেখাইব? কখন কখন তাঁহার হৃদয়-দর্পণে চকিতে রতনের মুখ প্রতিফলিত হয়। তিনি ভাবেন, হায়, সে আমায় বড় ভালবাসে, সে আমাকে ভুলে নাই। সে আমার জন্য বড়ই কষ্ট পাইতেছে! সে নিশ্চয়ই আমার চিঠী পাইয়া সে বাড়ী ছাড়িয়া গিয়াছে! কোথায় গিয়াছে কে জানে—নিশ্চয়ই কত কষ্ট পাইতেছে!

এই সময়ে কারাগারের দ্বার উন্মুক্ত হইবার শব্দ হইল। তিনি চমকিত হইয়া দ্বারের দিকে চাহিলেন।

দ্বার খুলিয়া গেল। একজন কারা-রক্ষক আসিয়া তাঁহাকে কটুকণ্ঠে বলিল, “বেরিয়ে আয়, সাহেব ডাকছে!”

রস্তমজী মনে মনে কাতরভাবে বলিলেন, “ভগবান, আর কেন? আমার মাথায় বজ্রাঘাত করুন। আর আমার এ অপমান সহ্য হয় না!”

তিনি নীরবে কারা-রক্ষকের সঙ্গে চলিলেন। সাহেবের সম্মুখে আসিলে সাহেব বলিলেন, “তোমার জামিনে খালাসের হুকুম হইয়াছে—এই কাগজে সই কর।”

রক্তমজী, সাহেবের কথা ভাল বুঝিলেন না। কলের পুত্তলীর ন্যায় কাগজে সই করিলেন। সাহেব বলিলেন, “এ আসামী খালাস।”

কারা-রক্ষক তাঁহাকে সঙ্গে আসিতে ইঙ্গিত করিল। তিনি তাহার সঙ্গে সঙ্গে চলিলেন।

সহসা তিনি দেখিলেন, তিনি কারাগারের বাহিরে—রাজপথে। পশ্চাতে কারাগারের লৌহ কবাট মহাশব্দে রুদ্ধ হইল। তিনি কিয়ৎক্ষণ স্তম্ভিত হইয়া তথায় দণ্ডায়মান রহিলেন। ক্রমে ধীরে ধীরে তাঁহার বিবেচনা শক্তির পুনরাবির্ভাব হইল। তিনি তখন বুঝিলেন, তিনি কারামুক্ত হইয়াছেন। জামিনে এখন তাঁহাকে সহসা ছাড়িয়া দিল—তবে কি প্রকৃত চোর ধরা পড়িয়াছে, এইরূপ নানা চিন্তায় তাঁহার মন বড় ব্যাকুল হইতে লাগিল। তিনি দেখিলেন, রাস্তার অনেকেই তাঁহার দিকে সবিস্ময়ে চাহিতেছে,—তাহাই তিনি আর সেখানে দাঁড়াইয়া থাকা উচিত নহে বিবেচনা করিয়া দ্রুতপদে চলিলেন।

তিনি কোথায় যাইবেন, তাহার কিছুই স্থিরতা নাই। এইরূপে অন্যমনস্কে তিনি দ্রুতপদে চলিলেন। এই সময়ে পশ্চাৎ হইতে কে তাঁহার পৃষ্ঠে হস্তস্থাপন করিল। তিনি চমকিত হইয়া ফিরিলেন। দেখিলেন, মাঞ্চারজী — হরমসজীর শালী-পুত্র। ইঁহার সহিত তাঁহার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা জন্মিয়াছিল। সুতরাং ইঁহার সহিত দেখা হওয়ায় রস্তমজী প্রথমে লজ্জা বোধ করিয়াছিলেন, কিন্তু একজন পরিচিত লোকের মুখ দেখিয়া মনে বড় আনন্দ হইল।

মাঞ্চারজী বলিলেন, “কত যে খুসী হইয়াছি, তাহা বলিতে পারি না। পুলিস নিতান্ত বেকুব, তাই তোমাকে ধরিয়াছিল; আমরা সকলেই জানিতাম, কখনই তোমার দ্বারা এ কাজ হইতে পারে না।”

রস্তমজী বলিলেন, “তোমরা যে সকলে আমাকে নির্দোষ মনে করিয়াছিলে, ইহাতেই আমি খুসী।”

মাঞ্চারজী বলিলেন, “সকলই শুনিয়াছিলাম, তোমার জামিনে খালাসের হুকুম হইয়াছে। কখন খালাস হইলে? না খালাস হইলে আমি যথাসৰ্ব্বস্ব খরচ করিয়া তোমাকে নিশ্চয়ই খালাস করিতাম।”

রস্তম। তোমাদের ভালবাসা আমি জানি।

মাঞ্চার। এখন কোথায় যাবে? আমার ওখানে চল।

রুস্তম। না, আমি ফ্রামজীর সঙ্গে দেখা করিয়া পরে বাসায় যাইব মনে করিয়াছি। ব্যাঙ্কে আর যাইব না। তুমি যদি একটা কাজ কর, তবে আমার বড় উপকার হয়।

মাঞ্চার। কি বল, এখনই করিব।

রস্তম। যদি ফ্রামজীকে সংবাদ দাও। সে এখন ব্যাঙ্কে আছে, এখনই ছুটী লইয়া যেন বাসায় যায়। আমি সেখানে তাহার জন্য অপেক্ষা করিব।

মাঞ্চার। আমি এখনই যাচ্ছি—রাত্রে আবার দেখা করিব।

এই বলিয়া মাঞ্চারজী সত্বর ব্যাঙ্কের দিকে প্রস্থান করিলেন। রস্তমজী চিত্তিমনে রতনের বাড়ীর দিকে চলিলেন। তাঁহার বোধ হইতে লাগিল, যেন রাস্তার সকলেই বিদ্রূপব্যঞ্জকনেত্রে আজ তাঁহার দিকে চাহিতেছে।

রতনের বাড়ীর সম্মুখে আসিয়া রস্তমজী বাড়ীতে প্রবেশ করিতে পারিলেন না। সবেগে তাঁহার হৃদয় স্পন্দিত হইতে লাগিল। তাঁহার বোধ হইল যেন বাড়ীতে জন-মানব নাই; এমনই – নীরব—এমনই নিস্তব্ধ।

বহুক্ষণ তিনি বাড়ীর সম্মুখে পরিক্রমণ করিলেন, অবশেষে বুকে সাহস বাঁধিয়া কম্পিতপদে গৃহে প্রবিষ্ট হইলেন।

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ – আবার বন্দী

স্পন্দিতহৃদয়ে রস্তমজী উপরে উঠিলেন; দেখিলেন, সমস্ত ঘরই বদ্ধ, চাবী দেওয়া, জনপ্রাণী নাই। যে গৃহে একদিন আমোদ-প্রমোদের উচ্চরোলে সতত প্রতিধ্বনিত হইত — আজ তাহা নীরব-নিস্তব্ধ।

ভৃত্যদিগের গৃহেও চাবী বন্ধ। বোধ হয়, বাড়ী মনিব-বিহীন দেখিয়া তাহারা বন্ধু-বান্ধবের সহিত দেখা-সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছে।

রস্তমজীর হৃদয়ে বড়ই দারুণ বেদনা বোধ হইল। তিনি সত্বর সে বাড়ী পরিত্যাগ করিলেন। তিনি ধীরে ধীরে কলবাদেবী রোডে ফ্রামজীর বাড়ীর দিকে চাললেন। ধীরে ধীরে তাঁহার গৃহে প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন, ফ্রামজী তাঁহার প্রতীক্ষা করিতেছেন।

তিনি মাঞ্চারজীর নিকট সংবাদ পাইয়া তৎক্ষণাৎ গাড়ী করিয়া নিজের বাড়ীতে আসিয়াছিলেন; সুতরাং রস্তমজীর তথায় উপস্থিত হইবার বহুপূর্ব্বেই তিনি বাড়ী আসিয়াছিলেন।

দুইবন্ধুর এরূপ সম্মিলনের দৃশ্য আমরা বর্ণনা করিবার প্রয়াস পাইব না। উভয়েরই চক্ষে দরবিগলিতধারে নয়নাশ্রু বহিল।

রস্তমজী একটু প্রকৃতিস্থ হইয়া বলিলেন, “কে আমার জামিন হইয়াছেন, জান?”

ফ্রামজী বলিলেন, “খুব সম্ভব, হরমসজী হইয়াছেন। দাদাভাস্কর তাঁহার নিকট তোমার জামিন হইবার জন্য অনুরোধ করিতে আসিয়াছিলেন। তার পর উভয়ে একত্রে বাহির হইয়া যান।”

রস্তমজী কোন কথা কহিলেন না।

ফ্রামজী বলিলেন, “বোধ হয়, এখন অনুতাপ হইয়াছে।”

“তবে কি তুমি মনে কর, টাকা তিনিই লইয়া এ চুরীর দাবী আমার উপর দিয়াছেন?”

“আর কে লইবে? আর কে সঙ্কেতের গুপ্তকথা জানিবে? তোমার কি মনে পড়ে, কখন কাহাকেও তুমি সে কথা বলিয়াছিলে?”

“কাহাকেও নয়।”

“এই দেখ,” বলিয়া ফ্রামজী টাকাসহ যে পত্র পাইয়াছিলেন, তাহা রস্তমজীকে দেখাইলেন। বলিলেন, “এ ত যে টাকা লইয়াছে, তাহারই কাজ—নতুবা আর কে এত টাকা পাঠাইবে?”

রস্তমজী বলিলেন, “কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না, ভাই। তিনি নিজের টাকা নিজে কেন চুরী করিবেন? এ টাকাই বা কে পাঠাইল?”

“কমলাবাঈ পাঠাইতে পারেন।”

“না না—সে আমাকে ভুলিয়া গিয়াছে।”

উভয়েই কিয়ৎক্ষণ নীরবে বসিয়া রহিলেন। তৎপরে রস্তমজী বলিলেন, “যেমন করিয়া হউক, এ অপবাদ ঘুচাইতে হইবে। আমি যে নিৰ্দ্দোষ, জগতকে তাহা জানাইতেই হইবে। আমরা প্রাণপণে পুলিসকে সাহায্য করিব, তাহা হইলে নিশ্চয়ই চোর ধরা পড়িবে?”

ফ্রামজী বলিলেন, “আমরাও এ বিষয়ের বিশেষ সন্ধান লইব। আমি এ কাৰ্যে নিযুক্ত আছি।”

রস্তমজী ক্ষণেক নীরবে থাকিয়া সহসা বলিলেন, “রতন কোথায়?”

ফ্রামজী উত্তর করিলেন, “জানি না। তোমার পত্র আমি তাহাকে দিতে পারি নাই। দাদাভাস্কর সে পত্র সেইদিনই আমার নিকট হইতে কাড়িয়া লইয়াছিলেন। তিনিই পত্র তাহাকে দিয়াছিলেন। তুমি তখনই তাহাকে যাইতে বলিয়াছিলে,—সে তখনই সে বাড়ী ত্যাগ করিয়া যায়?”

“কোথায়?”

“সন্ধান করিয়া জানিয়াছি যে, সে দাদাভাস্করের বাড়ীতে প্যারেলে লুকাইয়া ছিল।”

“এখনও কি সেখানে আছে?”

“না, আমি সন্ধান লইয়াছিলাম—সে সেখানে নাই। আমি দাদাভাস্করের স্ত্রীর সহিত দেখা করিয়াছিলাম। তিনি বলিলেন যে, কার পত্র পেয়ে সে তার সঙ্গে প্যারেল ষ্টেশনে রাত্রি নয়টার সময় দেখা করিতে যায়—আর ফেরে নাই। কোথায় গিয়াছে, কেহ জানে না।”

“তাহাকে কেহ কোনখানে আটক করিয়া রাখিয়াছে।”

“খুবই সম্ভব,—কিন্তু তাহাকে আটকাইয়া রাখাও বড় সহজ নহে।”

রস্তমজী ম্লানহাসি হাসিয়া বলিলেন, “হাঁ, সে আটক থাকিবার মেয়েই বটে। যাহা হউক, তাহার সন্ধান করা আবশ্যক। তুমি এখনই একবার দাদাভাস্করের সঙ্গে দেখা কর। সকল কথা তাঁহাকে বলিল, তিনি নিশ্চয়ই তাহার অনুসন্ধান করিবেন।”

“এখনই যাইব। কোথায় তোমার দেখা পাইব?”

“আমি বাসায় যাইতেছি। সেইখানে তোমার জন্য অপেক্ষা করিব।”

দুইজনে বাড়ী হইতে বহির্গত হইলেন। ফ্রামজী সত্বরপদে কোর্টের দিকে প্রস্থান করিলেন। রস্তমজী কোনদিকে যাইবেন, স্থির করিতে না পারিয়া তথায় কিয়ৎক্ষণ অপেক্ষা করিতে লাগিলেন।

রস্তমজী সেইখানে ধীরে ধীরে পদচারণা করিতেছেন, এমন সময়ে কে আসিয়া তাঁহার পৃষ্ঠে হস্তস্থাপন করিল। তিনি চমকিত হইয়া ফিরিয়া দেখিলেন—একজন পুলিস-ইনস্পেক্টর

ইনস্পেক্টর বলিলেন, “আপনার নামে একখানা ওয়ারেন্ট আছে। পেষ্টনজীর খুনের জন্য আপনাকে গ্রেপ্তার করিলাম।”

রস্তমজী স্তম্ভিত হইয়া বলিলেন, “পেষ্টনজী—পেষ্টনজীর খুন! কোন পেষ্টনজী, –কবে খুন হইল?”

ইনস্পেক্টর খুনের কথা সংক্ষেপে বলিলেন। শুনিয়া রস্তমজী বলিলেন, “বলেন কি, গাড়ীর ভিতরে তিনি এরূপ ভাবে খুন হইয়াছেন! সেই রাত্রে যে তাঁহার সঙ্গে গিরগামের কাছে আমার দেখা হইয়াছিল।”

ইনস্পেক্টর বলিলেন, “আপনাকে আমার বলা কর্তব্য,—আপনি এখন যাহা বলিবেন, পরে তাহা আপনারই বিরুদ্ধে যাইবে।”

“তবে আমি কিছুই বলিব না।”

এই সময়ে কে পশ্চাৎ হইতে বলিলেন, “ভয় নাই রস্তমজী, আমি তোমাকে খালাস করিব।”

রস্তমজী ফিরিয়া দেখিলেন, একটি বৃদ্ধ মারাঠী ভদ্রলোক।

রস্তমজী বলিলেন, “আপনাকে ত আমি চিনি না।”

বৃদ্ধ বলিলেন, “আমি তোমার পিতার বিশেষ বন্ধু ছিলাম। সকল বিষয় জেলে সাক্ষাৎ করিয়া বলিব।”

“আপনি আমার বন্ধু ফ্রামজীকে আমার বিপদের কথা বলিবেন। তিনি এই বাড়ীতে থাকেন।”

বৃদ্ধ বলিলেন, “বলিব।”

ইনস্পেক্টর সত্বর একখানা গাড়ী ডাকিয়া তাঁহার আসামী লইয়া প্রস্থান করিলেন।

বার ঘণ্টা যাইতে না যাইতে হতভাগ্য রস্তমজী আবার কারাগারে নিক্ষিপ্ত হইলেন।