উপন্যাস
বড় গল্প
সংকলন
রচনা

প্রথম অধ্যায় । গ্রিস ও ভারত

প্রথম অধ্যায় । গ্রিস ও ভারত

আলেকজান্ডার হচ্ছেন পৃথিবীর প্রথম দিগবিজয়ী।

তাঁর আগে আর কোনও বীর দিগবিজয়ে যাত্রা করেননি এমন কথা বলছি না। প্রাচীন মিশর, ব্যাবিলন, আসিরিয়া, ভারত ও পারস্য প্রভৃতি দেশের ইতিহাস পড়লে আরও কয়েকজন দিগবিজয়ীর নাম জানা যায়। কিন্তু তাঁদের দৃষ্টিশক্তি ও দিগবিজয়ের ক্ষেত্র ছিল সংকীর্ণ। তাঁদের আদর্শবাদও তেমন উচ্চ ছিল না। এবং তাঁদের দিগবিজয়ের ফলে সমগ্র পৃথিবীতে যুগান্তরও উপস্থিত হয়নি।

তিন বা একাধিক মহাদেশের উপরে যাঁরা ধূমকেতুর মতন ছুটে গিয়েছেন এবং যাঁরা আজ পর্যন্ত মানুষের চিন্তার রাজ্যে প্রভাব বিস্তার করে আছেন—যেমন আলেকজান্ডার, হানিবল, সিজার, চেঙ্গিস খাঁ, তৈমুর লং ও নেপোলিয়ন—যথার্থ দিগবিজয়ী বলি তাঁদের। কারণ, এঁদের দিগবিজয়ের পিছনে ছিল এক-এক শ্রেণির আদর্শবাদ। এঁদের মধ্যেই সর্বপ্রথমে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন আলেকজান্ডার।

ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা। আলেকজান্ডারের যুগে মানুষ এই তিনটির বেশি মহাদেশের নাম জানত না। এবং তিন মহাদেশেই এমন অনেক জায়গা ছিল, যা তখনও পৃথিবীর সভ্য দেশগুলির অন্তর্গত ছিল না। আজ ইংরেজ, জাপান, আমেরিকান, রোমান, জার্মান, ফরাসি ও স্পেনীয় প্রভৃতি কত জাতির কথাই শুনতে পাই। কিন্তু তখন তাদের নামকরণ পর্যন্ত হয়নি। তাদের দেশ ছিল ঘৃণ্য বর্বরদের দেশ। অনেক দেশ তখনও সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। তখনকার মানচিত্রে সেসব দেশের স্থান পর্যন্ত ছিল না।

কিন্তু যেসব দেশ তখন সভ্যতার উচ্চতম শিখরে আরোহণ করেছিল, আলেকজান্ডারের কবল থেকে তারা কেউই মুক্তি পায়নি। এমনকী তখনকার দিনে গ্রিকদের পক্ষে অতি দুর্গম ও দূরদেশ ভারতবর্ষেও তিনি ছুটে গিয়েছিলেন। যদিও তখনকার দিনের সর্বশ্রেষ্ঠ ভারতীয় রাজার (ধননন্দ) সঙ্গে তাঁর শক্তিপরীক্ষা হয়নি এবং ভীত সৈনিক ও সেনাপতিদের বিদ্রোহিতায় অধিকাংশ ভারতবর্ষকে নাগালের বাইরে রেখেই তাঁকে প্রত্যাগমন করতে হয়ছিল, তবু তিনি বিজয়পতাকা তুলে যেটুকু অগ্রসর হতে পেরেছিলেন, সে যুগের পক্ষে তাই-ই ছিল কল্পনাতীত, অসম্ভব ব্যাপার!

আলেকজান্ডারের কাছে একটি কারণে আমরা চিরকৃতজ্ঞ থাকব। তাঁর ভারত অভিযানের ফলেই ভারতবর্ষের সত্যিকার ঐতিহাসিক যুগ আরম্ভ হয়েছে।

আলেকজান্ডারের আগমনের অনেক আগেই ভারতবর্ষ যে সভ্যতার শীর্ষস্থানে উঠেছিল, সে বিষয়ে কোনওই সন্দেহ থাকতে পারে না। কিন্তু প্রাচীন ভারতবাসীরা এক বিষয়ে রীতিমতো পশ্চাৎপদ ছিলেন। লিখিত ইতিহাস বলতে আজ আমরা যা বুঝি, প্রাচীন ভারতবর্ষে কেউ তা রচনা করেনি। কাব্য, পুরাণ, নাটক বা অন্যান্য গ্রন্থে আমরা ভারতীয় ইতিহাসের অনেক মালমশলা পাই বটে, কিন্তু সেগুলি অত্যন্ত অগোছালো অবস্থায় এমন নানা বিষয়ের সঙ্গে মিশিয়ে আছে যে, তাদের ভিতর থেকে সত্যিকার মানুষকে আবিষ্কার করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের কবির কল্পনা ও অবাস্তব প্রলাপ বলে মেনে নিলে আর কোনও গোলমালই থাকে না; কিন্তু তাদের ঐতিহাসিক সত্য রূপে দেখাতে গেলেই আমাদের সহজ-বুদ্ধি বিদ্রোহী হয়ে দাঁড়ায়। রাম, রাবণ, কুম্ভকর্ণ, শ্রীকৃষ্ণ, ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, ভীম ও অর্জুন প্রভৃতি নামধারী ঐতিহাসিক ব্যক্তি যে ছিলেন না, একথা কে জোর করে বলতে পারে? কিন্তু কবির আকাশচারী কল্পনা ও অবাস্তব অত্যুক্তি তাঁদের মনুষ্যত্বকে এমন ভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে, ওঁদের আর সত্যিকার মানুষ বলে মনে হয় না এবং সকলেই জানেন, ইতিহাস হচ্ছে সত্যিকার মানুষদেরই কীর্তিকাহিনি।

উপরন্তু প্রাচীন ভারতীয় লেখকরা ধরতে গেলে সাল-তারিখের কোনও ধারই ধারতেন না। সাল-তারিখ ভুললে ইতিহাস হয়ে দাঁড়ায় উপহাস। বেশিদিনের কথা নয়, স্বর্গীয় দুর্গাদাস লাহিড়ি বহু খণ্ডে বিভক্ত প্রকাণ্ড একখানি ‘পৃথিবীর ইতিহাস’ রচনা করেছিলেন। সেই গ্রন্থে প্রাচীন ভারতবর্ষের কথা বলতে গিয়ে তিনি গুপ্তবংশীয় চন্দ্রগুপ্তকে ধরে নিয়েছিলেন মৌর্য চন্দ্রগুপ্ত বলে। অথচ ভারতের প্রথম সম্রাট, গ্রিকবিজয়ী মৌর্য চন্দ্রগুপ্ত ও গুপ্তবংশীয় চন্দ্রগুপ্তের মধ্যে ছিল সুদীর্ঘ কয়েক শতাব্দীর ব্যবধান! এই দুই সম্রাটের মাঝখানে হয়েছে কত বংশের উত্থান ও পতন এবং ভারতবর্ষের উপরে পড়েছে একাধিকবার অন্ধ যুগের কালো যবনিকা।

আজকাল ভারতের নানা প্রদেশে হাজার হাজার শিলা বা তাম্রলিপি ও প্রাচীন মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে বা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা তাদের পাঠ উদ্ধার করে এতকাল পরে ইতিহাসপূর্ব যুগের অনেক সাল-তারিখ ও গুপ্তরহস্য আবিষ্কার করেছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ওসব লিপি বা মুদ্রা প্রভৃতি ইতিহাস রচনার জন্যে প্রস্তুত হয়নি।

আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের ফলেই ভারতবর্ষে আরম্ভ হয়েছে সত্যিকারের ঐতিহাসিক যুগ। আলেকজেন্ডারের আগেও গ্রিসের সঙ্গে যে ভারতবর্ষের সম্পর্ক একেবারেই ছিল না, তা নয়; তাঁরও অনেক আগে (খ্রিঃ পূঃ ৫১০ ) স্কাইল্যাক্স নামে এক গ্রিক ভ্রমণকারী ভারতে বেড়িয়ে গিয়েছিলেন। ভারতীয় সৈনিকরাও পারস্য সম্রাট দরায়ুসের পক্ষাবলম্বন করে গ্রিসে গিয়ে যুদ্ধ করে এসেছে। এমনিভাবে আরও কোনও কোনও দিক দিয়ে ভারতের সঙ্গে গ্রিসের অল্পস্বল্প পরিচয় সাধন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এটুকু পরিচয়ের দাম খুব বেশি ছিল না। গ্রিকরা তখনও ভারতকে নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাত না।

কিন্তু আলেকজান্ডারের অভিযানের পরেই গ্রিকরা ভারতবর্ষকে সর্বপ্রথমে ভালো করে চিনতে পারলে। তার ফলে নানা গ্রিক-লেখক ও ভ্রমণকারী স্বচক্ষে ভারতবর্ষকে দেখে তখনকার কথা নিয়ে আলোচনা করে গিয়েছেন। এরপরে ভারতের দৃষ্টি হয়ে পড়ে সুদূর প্রসারিত। তারপর নানা যুগে নানা দেশি ভ্রমণকারী এসে ভারতের অনেক উজ্জ্বল ছবি এঁকে গিয়েছেন। এইসব ছবির ভিতর থেকেই প্রাচীন আর্যাবর্তের অখণ্ড না হোক—কতকটা সম্পূর্ণ ইতিহাস ও সাল-তারিখ উদ্ধার করা সম্ভবপর হয়েছে। মাঝে মাঝে ফাঁক থেকে গিয়েছে বটে, কিন্তু বহু স্থলেই ফাঁকগুলি পূর্ণ করতে পারা গিয়েছে প্রাচীন শিলালিপি ও মুদ্রা প্রভৃতির দ্বারা। আলেকজান্ডার এদেশে না এলে ভারতবর্ষের ইতিহাসকে এমন ভাবে পুনরুদ্ধার করতে পারা যেত না।

আলেকজান্ডার ভারত ত্যাগ করবার পরেই সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত গ্রিকদের আর্যাবর্ত থেকে বিতাড়িত করলেন বটে, কিন্তু ভারতের সঙ্গে গ্রিসের সম্পর্ক বিলুপ্ত হয়নি। আলেকজান্ডারের সেনাপতি সেলিউকসের মেয়েকে চন্দ্রগুপ্ত নিজে বিবাহ করেন। তাঁর সভায় বর্তমান থাকেন গ্রিক-রাজদূত মেগাস্থিনিস। তাঁর দেহরক্ষীরূপে নিযুক্ত থাকে অনেক গ্রিকনারী! এবং বিজয়ী রূপে না হোক, বিভিন্ন কাজ নিয়ে শতশত গ্রিক যে মৌর্যযুগের ভারতবর্ষে বাস করত, এটুকু আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি। চন্দ্রগুপ্তের পৌত্র সম্রাট অশোক অনেক ভারতবাসীকেও গ্রিসে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করবার জন্যে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এর কী ফল হয়েছিল জানি না, তবে এটা দেখতে পাই যে, মৌর্য-রাজশক্তির পতনেরও বহুকাল পরে (খ্রি. পূ. ২১) গ্রিসের প্রধান নগর এথেন্সে একজন ভারতীয় বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বৌদ্ধধর্মের মহিমা দেখাবার জন্যে জ্বলন্ত চিতায় স্বেচ্ছায় আত্মাহুতি দিচ্ছেন!

ভারতের নাট্যশালা থেকে মৌর্য-নৃপতিরা চিরবিদায় নেবার পরে ভারতবর্ষের উপরে আবার গ্রিক প্রভাব বাড়তে থাকে। ভারতের প্রান্তদেশে এবং উত্তর ভারতে একাধিক গ্রিক নরপতি রাজত্ব করেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছেন মেনান্ডার—এঁর জয়পতাকা প্রায় পাটলিপুত্রের (বর্তমান পাটনা) কাছ পর্যন্ত এসে পড়েছিল এবং ইনি ও এঁর সমস্ত গ্রিক সভাসদ বৌদ্ধধর্ম পর্যন্ত অবলম্বন করেছিলেন (খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে)। এরই কয়েই বৎসর পরে দেখি, তক্ষশিলার (বর্তমান পেশোয়ার অঞ্চল) অধিবাসী গ্রিক-রাজদূত হেলিয়োডোরাস হিন্দুধর্ম অবলম্বন করে বাসুদেবের নামে একটি স্তম্ভ প্রতিষ্ঠা করছেন! ‘বেসনগর স্তম্ভ’ নাম নিয়ে সেটি আজও বিদ্যমান আছে। এইসব দৃষ্টান্ত দেখেই বোঝা যায়, আলেকজান্ডারের পরবর্তী কালে গ্রিকরা নিজেদের কেবল ভারতবাসী বলেই মনে করতেন না, তাঁরা ভারতীয় ধর্ম পর্যন্ত গ্রহণ করতে ছাড়েননি।

বহু ঐতিহাসিকের মত হচ্ছে, গ্রিকদের আগমনের আগে ভারতবর্ষে মূর্তিপূজা ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করবার পদ্ধতি প্রচলিত ছিল না। হিন্দু ও বৌদ্ধরা নাকি মূর্তি গড়তে ও মন্দির তৈয়ারি করতে শেখেন গ্রিকদের কাছ থেকেই। অথচ এখনকার ইউরোপীয় গ্রিকদের মাথার করে রাখলেও পৌত্তলিক বর্বর বলে ঘৃণা করেন হিন্দুদেরই!

ভারতীয় ভাস্কর্য শিল্পও এক সময়ে আশ্রয় নিয়েছিল গ্রিক শিল্পীদের কাছে। তার ফলে উত্তর ভারতের বিখ্যাত গান্ধার ভাস্কর্যের আবির্ভাব। পরবর্তী যুগে এই ভাস্কর্য কেমন করে ভারতের নিজস্ব শিল্প হয়ে উঠেছিল, এখানে সবিস্তারে তা দেখাবার দরকার নেই।

সংস্কৃত ভাষায় আজও কিছু কিছু গ্রিক শব্দ বর্তমান আছে। সংস্কৃত নাট্য-সাহিত্যেরও উপরে অল্পস্বল্প গ্রিক প্রভাব থাকতে পারে। কেউ কেউ বলেন, নেই।

কিন্তু যাঁরা প্রথম হিন্দু-জ্যোতির্বিজ্ঞান রচনা করে গেছেন তারা যে গ্রিকদেরই শিষ্য, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কারণ গার্গী-সংহিতায় স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে : ‘যবনরা (গ্রিকরা) বর্বর বটে, কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রথম প্রকাশ হয়েছে তাদের মধ্যেই। এবং এই কারণে তাদের দেবতা বলে ভক্তি করা উচিত।’

আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের ফলেই আর্যাবর্তের জ্ঞান ও চিন্তার রাজ্যে এসেছে এমনি উন্নতিমূলক নানা পরিবর্তন। তিনি সাহস করে অগ্রবর্তী না হলে আর কোনও গ্রিক যে এই বিপদসঙ্কুল পথে পদার্পণ করতেন না, সে কথা নিশ্চিত রূপেই বলা যায়।

ভারতবর্ষের উপরে রক্তাক্ত খড়গ তুলে এসে দাঁড়িয়েছেন আরও কত দিগবিজয়ী! তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য হচ্ছেন তাতার তৈমুর লং, গজনীর মামুদ, পারসি নাদির শা ও আফগান আহম্মদ শা আবদালি! কিন্তু তাঁদের অভিযানের ফলে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে শুধু রক্ত-সাগরের তরঙ্গ। বারংবার ভারতের সোনার ভাণ্ডার লুণ্ঠন করে তাঁরা দস্যুর মতন অদৃশ্য হয়েছেন, কিন্তু তাঁদের কাছ থেকে ভারত পায়নি কোনও দান। তাঁরা ডাকাতি করেছেন মাত্র, মানবতার পরিচয় দেননি।

আলেকজেন্ডার রক্তলোভী দিগবিজয়ী ছিলেন না, তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে নিষ্ঠুর হলেও আদর্শবাদী ছিলেন। পরে দেখাব, প্রাচ্যের সঙ্গে প্রতীচ্যের মধুর মিলন সাধন করবার জন্যে তাঁর প্রাণের আকাঙ্ক্ষা ছিল কতখানি প্রবল!