উপন্যাস
বড় গল্প
সংকলন
রচনা

প্রথম। পালা শুরুর আগে

প্রথম । পালা শুরুর আগে

আধুনিক ইতিহাস বলে, কুরুক্ষেত্রের যোদ্ধাদের কাহিনি হচ্ছে পৌরাণিক রূপকথা। এখানে ঐতিহাসিকদের সঙ্গে তর্ক করবার দরকার নেই। রামায়ণী কথাকেও তাঁরা আমল দেন না। এ নিয়েও গোলমাল করে লাভ নেই।

কিন্তু আজ আমরা যে মহাবীরের কাহিনি বলতে বসেছি, তিনি পৌরাণিক ইতিহাস-পূর্ব যুগের মানুষ নন। কেবল প্রাচীন ইতিহাসে, ভ্রমণ কাহিনিতে, কাব্যে ও নাট্য-সাহিত্যেই তাঁর নাম অমর হয়ে নেই, তাঁকে সত্যিকার রক্ত-মাংসের মহাবীর বলে স্বীকার করেছেন আধুনিক ঐতিহাসিকরাও। সপ্তম শতাব্দীর আর্যাবর্ত গৌরবোজ্জ্বল হয়ে আছে একমাত্র তাঁরই নামের মহিমায়। তিনি হচ্ছেন ভারতের শেষ হিন্দু-সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। এই বলে তিনি নিজের নাম সই করতেন—মহারাজাধিরাজ শ্রীহর্ষ। ইতিহাস তাঁকে হর্ষবর্ধন বলে জানে।

ভারতে সাম্রাজ্য-প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে হর্ষবর্ধন হচ্ছেন চতুর্থ স্থানীয়। ঐতিহাসিক ভারতে সর্বপ্রথম সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গ্রিকবিজয়ী চন্দ্রগুপ্ত (৩২৩ বা ৩২২ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে কিংবা তারও দুই-এক বৎসর আগে)। তাঁর সাম্রাজ্য মৌর্যসাম্রাজ্য নামে বিখ্যাত। এই বিশাল সাম্রাজ্যের উপরে পূর্ণ গৌরবে প্রভুত্ব বিস্তার করেন যথাক্রমে তাঁর পুত্র ও পৌত্র বিন্দুসার ও অশোক। ২৩২ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে সম্রাট অশোকের মৃত্যুর প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই মৌর্যসাম্রাজ্যের অধঃপতন আরম্ভ হয়। তারপর অর্ধ শতাব্দী যেতে না যেতেই লুপ্ত হয়ে যায় মৌর্যরাজ্য।

মৌর্যদের কয়েক শতাব্দী পরে দ্বিতীয় ভারতীয় সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিলেন সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত। তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন ৩৩০ খ্রিস্টাব্দে। দিগবিজয়ে বেরিয়ে প্রায় সারা ভারতবর্ষ তিনি জয় করেছিলেন। এই দ্বিতীয় ভারতসাম্রাজ্য ইতিহাসে গুপ্তসাম্রাজ্য নামে বিখ্যাত। সমুদ্রগুপ্তের আরও তিন জন প্রসিদ্ধ বংশধর হচ্ছে সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত (কালিদাসের কাব্যের বিক্রমাদিত্য), সম্রাট প্রথম কুমারগুপ্ত এবং সম্রাট স্কন্দগুপ্ত। শেষোক্ত সম্রাটের মৃত্যুর (৪৬৭ খ্রিঃ) পর গুপ্তসাম্রাজ্যের পতন আরম্ভ হয় বটে, কিন্তু গুপ্তরাজারা আরও কিছুকাল পর্যন্ত সিংহাসন রক্ষা করতে পেয়েছিলেন।

সম্রাট স্কন্দগুপ্তের মৃত্যুর পরে ভারতের উপরে বিদেশি ও বর্বর হুনদের প্রাধান্য ক্রমেই বেড়ে উঠতে থাকে। হুন রাজা মিহিরকুল শেষটা এমন অত্যাচার আরম্ভ করে যে, মালবের অধিপতি যশোধর্মদেব তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে বাধ্য হন। যশোধর্মদেবের আহ্বানে ভারতের আরও কয়েকজন রাজা এসে তাঁর সঙ্গে যোগ দেন। ৫২৮ খ্রিস্টাব্দে মিহিরকুলের সঙ্গে যশোধর্মদেবের স্মরণীয় যুদ্ধ হয়। মিহিরকুল পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায়।

এই যশোধর্মদেবই হচ্ছেন তৃতীয় ভারতীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর যে শিলালিপি পাওয়া গিয়েছে তাতে স্পষ্ট ভাষায় লেখা আছে, তিনি পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে পশ্চিমে আরব সাগর পর্যন্ত এবং উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে ত্রিবাঙ্কুরের শেষ পর্যন্ত ভূভাগের অধিকারী ছিলেন। তাঁর আনুমানিক মৃত্যুকাল হচ্ছে ৫০০ খ্রিস্টাব্দ।

আশ্চর্য কথা হচ্ছে এই যে, এত বড়ো একজন দিগবিজয়ী সম্রাট সম্বন্ধে ইতিহাস আর বিশেষ কিছুই বলতে পারে না। কিংবা এ জন্যে বিস্মিত না হলেও চলে। কারণ, ইংরেজ ঐতিহাসিক যে সম্রাট সমুদ্রগুপ্তকে ‘ভারতীয় নেপোলিয়ন’ উপাধি দিয়েছেন, এক শত বৎসর আগেও আমরা তাঁর নাম পর্যন্ত জানতুম না। দৈবগতিকে এলাহাবাদের অশোক স্তম্ভের উপরে উৎকীর্ণ সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি হরিষেণের লিখিত এক শিলালিপি পাওয়া গিয়েছে, তাই আজ আমরা তাঁর অপূর্ব ও বিচিত্র কাহিনি জানতে পেরেছি। সুতরাং এমন আশা করলে অন্যায় হবে না যে, হয়তো অদূর-ভবিষ্যতে ওই ভাবেই আমরা হঠাৎ একদিন সম্রাট যশোধর্মদেবেরও সম্পূর্ণ বা প্রায়-সম্পূর্ণ ইতিহাস সংগ্রহ করতে পারব।

ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ভারতবর্ষের মধ্যে একমাত্র বৃহৎ নাম ছিল যশোধর্মদেবের। কিন্তু ষষ্ঠ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক বা সামাজিক অবস্থা কীরকম ছিল, আজ পর্যন্ত তা আবিষ্কৃত হয়নি। বড়জোর এইটুকু বলা যায়, যশোধর্মদেবের মৃত্যুর পর উত্তরভারতে আর কোনও একচ্ছত্র সম্রাট বিদ্যমান ছিলেন না। উত্তরাপথের ভিন্ন ভিন্ন দেশে রাজত্ব করতেন ভিন্ন ভিন্ন রাজারা এবং মিহিরকুল না থাকলেও উত্তর-পশ্চিম পাঞ্জাবের এখানে-ওখানে মাথা তোলবার চেষ্টা করত ছোট ছোট হুন রাজারা বা তাদের নিকট সম্পর্কীয় গুর্জর-বংশীয় দলপতিরা।

উত্তর ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে তখন (ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ ভাগে) রাজত্ব করতেন যেসব অপেক্ষাকৃত পরাক্রান্ত রাজা, তাঁদের মধ্যে প্রধানত এই তিনজনকে নিয়ে আমাদের কাহিনি আরম্ভ করব। থানেশ্বরের প্রভাকরবর্ধন। মালব দেশের গুপ্তবংশীয় রাজা দেবগুপ্ত। মগধ, গৌড় ও রাঢ় দেশের গুপ্তবংশীয় রাজা শশাঙ্ক নরেন্দ্রগুপ্ত।