উপন্যাস
বড় গল্প
সংকলন
রচনা

প্রথম। গোড়াপত্তন

প্রথম। গোড়াপত্তন

আফগানিস্তানের উত্তরে তুর্কিস্থান। সেইখানে আছে সমরখন্দ নগর। এই সমরখন্দ কেবল প্রাচীন গৌরবের জন্যে নয়—আর এক কারণেও হতে পারে চিরস্মরণীয়।

পৃথিবীতে তিনজন দিগবিজয়ীর তুলনা নেই। খ্রিস্ট-পূর্বাব্দের আলেকজান্ডার দি গ্রেট, ত্রয়োদশ শতাব্দীর চেঙ্গিজ খাঁ ও চতুর্দশ শতাব্দীর তৈমুর লং।

জুলিয়াস সিজার, হানিবল ও নেপোলিয়ন প্রভৃতিও প্রথম শ্রেণির দিগবিজয়ী বটে, কিন্তু পূর্বোক্ত তিন বীরের কীর্তিকলাপ তাদের চেয়ে ঢের বেশি অসাধারণ ও বিস্ময়কর।

আলেকজান্ডার, চেঙ্গিজ ও তৈমুর—এই তিনজনের সঙ্গেই সমরখন্দ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করতে পেরেছিল এবং ওই তিন দিগবিজয়ীই সমরখন্দ থেকে যাত্রা করেছিলেন ভারতবর্ষের দিকে। বেশ বোঝা যায়, সেকালে সোনার ভারতে পদার্পণ করতে না পারলে কেহই নিজের দিগবিজয়-কাব্য সম্পূর্ণ হল বলে মনে করতেন না।

আর কেবল সেকালেই বা বলি কেন সর্বকালেই ভারত দিগবিজয়ীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে নেপোলিয়নও আসতে চেয়েছিলেন ভারতবর্ষের দিকে। এ যুগের হিটলারও তাই চেয়েছিলেন, জাপানিদেরও প্রাণের সাধ তাই ছিল। দিগবিজয়ীদের ভারত লুণ্ঠনের পথ সর্বাগ্রে খুলে দিয়েছিলেন বোধ হয় পারস্য সম্রাট প্রথম দরায়াস।

কিছু কম ছয় শত বৎসর আগে এক মহাবীর বসেছিলেন সমরখন্দের সিংহাসনে; কিন্তু কেবল সেই ক্ষুদ্র সিংহাসনে তাঁর স্থান সংকুলান হল না, তিনি চাইলেন পৃথিবীর রাজতন্ত্র। পৃথিবীপতি হওয়ার জন্যে তিনি বার বার রণক্ষেত্রে ছুটে গেলেন এবং প্রত্যেকবারই ফিরে এলেন রক্তাক্ত বিজয়ী রূপে! তাঁর সাম্রাজ্যের দুই সীমানা হল ইউরোপের মস্কো এবং ভারতের দিল্লি!

স্পেন, ইংল্যান্ড ও ইউরোপের অন্যান্য দেশের রাজারা তাঁর মন রাখবার ও তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করে নিরাপদ হওয়ার জন্যে দূত ও নানা উপঢৌকন পাঠাতে লাগলেন। তিনি সেসব রাজাকে নগণ্য মনে করে খাপ থেকে তরোয়াল খুললেন না, তাঁদের আশ্বাস দিয়ে বললেন, ‘ভয় নেই, সমুদ্রে খালি বড় মাছই থাকে না, ছোট মাছরাও থাকে।’

মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি স্তিমিত দৃষ্টি তুলে দেখলেন, পৃথিবীতে তখনও তাঁর যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী আছে মাত্র একজন—মহাচিনের অধিপতি! এটা তাঁর সহ্য হল না—ঊনসত্তর বৎসর বয়সে তরবারি হাতে নিয়ে ধরলেন তিনি চিনের পথ। কিন্তু চিনের ছিল বরাত জোর—’ভগবানের চাবুক’ ফিরিয়ে নিলেন ভগবান স্বয়ং!

এই বিচিত্র দিগবিজয়ীকে ইতিহাস তৈমুর লং বলে জানে। এঁরই বংশধর বাবর ভারতে এসে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন মোগল রাজবংশ।

তৈমুরের বংশধরদের মোগল বলা হয় বটে, কিন্তু এখানে একটু গোলমাল আছে। উত্তর এশিয়া থেকে যুগে যুগে যাযাবর জাতীয় যেসব যোদ্ধা পঙ্গপালের মতন ভারতে, চিনদেশে, পারস্যে ও ইউরোপের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল, কোনও নির্দিষ্ট নামে তাদের পরিচিত করা সহজ নয়। গ্রিক ঐতিহাসিক হিরোডোটাস তাদের ডেকেছেন, ‘সিথিয়ান’ বলে, রোমানরা তাদের ‘হুন’ নামে ডেকেছে এবং চিনারা ডেকেছে ‘হিউয়াং-নু (Hiung-nu) নামে। চেঙ্গিজ খাঁ যখন ওই যাযাবরদের এনে এক পতাকার তলায় দাঁড় করান, তখন তাদের মধ্যে ছিল মাঞ্চু, তাতার, মোগল প্রভৃতি বহু জাতির লোক। পরে চেঙ্গিজের মোগল সাম্রাজ্যের মধ্যে গণ্য হয়ে ওই নানাজাতির লোককে এক ‘মোগল’ নামেই ডাকা হত। আসলে তৈমুরকে কেউ বলেন তাতার, কেউ বলেন তুর্কি।

সমরখন্দ নগরের কাছে ওকগাছের অরণ্য। তারপর এক গিরিসঙ্কট—দুই দিকে তার ছয় শত ফুট উঁচু লাল বালি-পাথরের দেওয়াল। স্থানীয় লোকেরা ‘লৌহ-দ্বার’ বলে ডাকে এবং এর ভিতর দিয়ে দুটির বেশি উট পাশাপাশি যেতে পারে না। এখানে বর্শাদণ্ডের উপরে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে পাহারা দেয় রৌদ্রদগ্ধ তামাটে বর্ণের দীর্ঘদেহ প্রহরীরা।

এই পথ দিয়ে খানিকদূর অগ্রসর হলে একটি পাহাড়ে-ঘেরা তরু-শ্যামল ক্ষেত্রের উপরে এসে পড়া যায়। সেখানে আছে একটি নগর, নাম তার ‘সবুজ শহর’। তার চারিদিকে খাল কাটা। কাবুলি ডুমুর ও খুবানি গাছের সারির উপরে দেখা যায় সাদা সাদা গুম্বুজ বা মসজিদের বুরুজ।

১৩৩৫ (মতান্তরে ১৩৩৬) খ্রিস্টাব্দে এই সবুজ শহরে তৈমুরের জন্ম।

যাত্রীর দল আসে আর চলে যায় সবুজ শহরের ভিতর দিয়ে—মুখে তাদের সর্বদাই যুদ্ধের গল্প। এই গল্প শুনতে শুনতে তৈমুর বেড়ে উঠতে লাগলেন। তৈমুর মাতৃহারা হন অল্প বয়সেই। তাঁর বাবা ছিলেন বার্লাস গোষ্ঠীর তাতার জাতীয় সর্দার, কিন্তু কোনও গ্রাম বা দুর্গ তাঁর দখলে ছিল না। তাঁর নাম তারাগাই। তিনি সংসারে উদাসীন ব্যক্তি, সর্বদাই তীর্থভ্রমণ ও ধর্মকর্ম নিয়ে ব্যস্ত। টাকাকড়ি তাঁর ছিলও না, টাকা রোজগারের চেষ্টাও তিনি করতেন না।

তৈমুর বাজপাখি, কুকুর আর সমবয়সি সঙ্গীদের নিয়ে পথে পথে খেলা করে বেড়ান। পথ দিয়ে চলে যায় দলে দলে পারসি, আরবি, ইহুদি ও হিন্দু সওদাগর; কেউ ঘোড়ায় চড়ে, কেউ উটের পিঠে, কেউ পদব্রজে,—পণ্য তাদের কিংখাব, রেশম বা কার্পেট। তাদের দলে গিয়ে ভিড়ে তৈমুর বাইরের জগতের খবর শোনেন।

তারাগাই বলেন, ‘বাছা তৈমুর, এই পৃথিবীটা হচ্ছে সাপ আর বিছা ভরা সোনার পাত্রের মতন। এর প্রতি আমার কোনও মায়া নেই।’

এসব কথা তৈমুরের মনকে স্পর্শ করে না।

তিনি ভালোবাসেন দাবা ও পোলো খেলতে এবং বনে বনে শিকার করতে। অল্পস্বল্প কোরান মুখস্থ করেছিলেন, কিন্তু লেখাপড়া খুব বেশি শেখেননি। তিনি জানতেন তাতারদের ধর্ম হচ্ছে যুদ্ধ করা, তাদের আভিজাত্য হচ্ছে তরবারির আভিজাত্য।

সবুজ শহরের বার্লাস তাতাররা তখনও নিজেদের অতীতকে ভোলেনি। চেঙ্গিজ খাঁ তাদের চোখ ফুটিয়ে দিয়ে গেছেন। তাতাররা জানে একদিন তারা পৃথিবী জয় করেছিল।

তাদের মধ্যে যাদের শহরের মধ্যে বাড়ি আছে, তারাও বাস করে তাঁবুর ভিতরে। আজও তারা যাযাবর ধর্ম ছাড়তে পারেনি; বলে, ‘কাপুরুষরাই দুর্গ তৈরি করে লুকোবার জন্য।’

তাদের আজানুলম্বিত বাহু, মোটামোটা দেহের হাড়, দাড়ি-গোঁফ ভরা মুখ—তারা সাধ্যমতো চেষ্টা করে, ঘোড়ার পিঠ ছেড়ে যাতে না মাটিতে নামতে হয়। যখন পায়ে হাঁটে, চলে নবাবি চালে এবং কারুকে দেখে ফিরে বা সরে দাঁড়ায় না।

পদব্রজে তারা বাঘ শিকার করতে যায় এবং লড়ায়ে যায় হাসতে হাসতে। তাদের দলে এমন লোক খুব কম, যাদের দেহে নেই অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন। তাদের মধ্যে এমন লোকও খুব কম, ছাদের তলায় বিছানায় শুয়ে বরণ করে যারা মৃত্যুকে। ডোরা-কাটা রেশমি জামার তলায় পরে তারা ইস্পাতের বর্ম। যুদ্ধের সুযোগ না পেলে তারা সুখী হয় না। একদিকে তারা যেমন মুক্তহস্ত ও অতিথিপরায়ণ, অন্যদিকে তেমনি গোঁয়ার ও নিষ্ঠুর।

বাবার মুখে তৈমুর শুনলেন, ‘বৎস, চেঙ্গিজ খাঁ যখন পৃথিবী জয় করলেন, তখন তাঁর ছেলে চাগাতাই পেলেন আমাদের এ অঞ্চলের শাসনভার। কিন্তু আজ চাগাতাইয়ের বংশধর বিলাসের স্রোতে হাবুডুবু খাচ্ছেন আর রাজ্যের সর্বেসর্বা হয়েছেন তাঁর আমির কাজগান।’

আমির কাজগানের নাম সকলের মুখে মুখে। তাতাররা দলে দলে যায় কাজগানের ফৌজে ভর্তি হওয়ার জন্যে।

তৈমুর এখন প্রথম যৌবনে পা দিয়েছেন। এই বয়সেই তাঁর দেহ হয়ে উঠেছে যেমন সুন্দর ও সুগঠিত তেমনই বৃহৎ ও বলিষ্ঠ। তীক্ষ্ণনেত্র, কঠিন চরিত্র। তিনি কথা কন কম, তাঁর কণ্ঠস্বর সুগম্ভীর ও মর্মভেদী। হাসি-ঠাট্টার ধারও মাড়ান না!

কোনও বলবান তাতার যুবকও যে-ধনুকের ছিলা মাত্র বুক পর্যন্ত টানতে পারে, তৈমুর সেই ধনুকের ছিলা আকর্ষণ করেন কান পর্যন্ত। তরবারি ক্রীড়ায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার।

পুত্রের ভাবভঙ্গি ব্যবহারে যোদ্ধার পূর্ণ লক্ষণ দেখে পিতা তারাগাই ছেলেকে পরামর্শ দিলেন, আমির কাজগানের সভায় যাওয়ার জন্যে। পিতার পরামর্শের মধ্যে ভাগ্যদেবীর আহ্বান শুনে তৈমুর রাজসভার দিকে যাত্রা করলেন!

তাঁর জীবনের আসল অ্যাডভেঞ্চার আরম্ভ হল।