প্রতীজ্ঞা পালন – ৫

৫ 

সাহেব বিস্মিতভাবে বলিলেন, “ছাড়িয়া দিব! বলেন কি?” 

গোবিন্দরাম মৃদুহাস্য করিয়া বলিলেন, “ইহাতে বিস্ময়ের কথা কি দেখিতেছেন?”

“ইহাকে ছাড়িয়া দিব কি বলিয়া?” 

“ছাড়িয়া দিতে বলিতেছি—সঙ্গে সঙ্গে ইহার উপর নজর রাখিতেও বলিতেছে।” 

“হাঁ, এখন আপনার মতলব বুঝিয়াছি, তাহা হইলে তাহার অনুসরণ করিলে সে কোথায় থাকে, জানিতে পারিব।” 

“নিশ্চয়ই।” 

“তবে এ না জানিতে পারে যে, ইহার সঙ্গে লোক আছে।” 

“তাহা ত নিশ্চয়ই—এ রকম লোক আপনার নিকট অনেক আছে। ছদ্মবেশ ধরা আবশ্যক, এক সময় আমি এমন ছদ্মবেশ ধরিয়াছি যে, আমার স্ত্রীও আমাকে চিনিতে পারে নাই।” 

“তাহা আমরা সকলেই জানি।” 

“আচ্ছা, তবে দেখা যাক, এখন আমাদের কি করা আবশ্যক; একমাত্র ভয় যে, লোকটা আপনার লোকের চোখে ধূলি দিয়া না সরিয়া যায়। তবে পুলিসের যে লোক এরূপ গাধা হইবে, তাহাকে তখনই কর্ম্মচ্যুত করা আবশ্যক। আরও দেখুন, এই হাবা যদি চালাক হয়,তাহা হইলে ভাবিবে যে, পুলিশ তাহার সঙ্গ লইয়াছে; এরূপ হইলে এ কখনই বরাবর বাড়ী যাইবে না,অনেক স্থানে ঘুরিবে—ধৈর্য্য থাকিলে অবশেষে ইহার ঠিকানা নিশ্চয়ই জানিতে পারা যাইবে। যাহাই হউক, এ লোকটা সম্বন্ধে বোধ হয়, এত গোলযোগ ভোগ করিতে হইবে না—এ হাবা ও কালা, খুব সম্ভব এ বাক্সে কি আছে জানে না, সুতরাং ইহাকে ছাড়িয়া দিলে এ বরাবর নিজের বাড়ীতেই যাইবে। একবার ছাড়া পাইলে এ কোন-না-কোন স্থানে যাইবে—কোথায় যায় দেখুন। তবে আমার বিশ্বাস এ কলিকাতায় থাকে না।” 

“তাহা যদি হয়, এ রেলে কোনখানে যাইতে পারে না—ইহার নিকট টাকা নাই।”

“হাঁ, তবে হাঁটিয়াও যাইতে পারে—যেখানেই যাক, আপনার লোক যেন ইহার সঙ্গ না ছাড়ে। এখন এই পর্যন্ত পরামর্শ দিতে পারি, পরে কি ঘটে দেখিয়া কর্ত্তব্য স্থির করিতে হইবে।” 

গোবিন্দরাম উঠিয়া দাঁড়াইলেন। সাহেবও উঠিলেন। গোবিন্দরাম বলিলেন, “আমার ছেলে আমার জন্য অপেক্ষা করিতেছে। অনুমতি দিন, তাহার নিকটে যাই।”

সাহেব বলিলেন, “হাঁ, আর আপনার সময় নষ্ট করিব না; তবে আর একটা কথা বলিতে চাই।”

“বলুন।” 

“এ বিষয়টার ভার আপনি লইলে ভাল হয়; গভর্ণমেন্ট এজন্য আপনার উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিবেন।”

“না, অনুগ্রহ করিয়া মাপ করুন। এ কাজ ছাড়িয়া দিয়াছি, আর করিবার ইচ্ছা নাই। তবে আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে যেটুকু আসে, আমি সর্ব্বদাই সেটুকুই সরকারী কার্য্যে দিতে প্রস্তুত আছি। এ বয়সে শারীরিক পরিশ্রম আর চলে না; সুতরাং আর আমাকে এ কার্য্যে নিযুক্ত হইতে বলিবেন না। আপনার পুলিসে অনেক সুদক্ষ লোক আছেন।” 

“আপনার মত কেহ নাই।”

“অনুগ্রহ করিয়া প্রশংসা করেন মাত্র। আমি একজনের নাম করিতে পারি, তিনি সুদক্ষ লোক।” 

“কাহার কথা বলিতেছেন?” 

“কৃতান্তকুমার।” 

“হাঁ, তিনি সুদক্ষ বটেন—অনেক বড় বড় মোকদ্দমার কিনারা করিয়াছেন। তবে— “তবে কি বলুন? শুনিয়াছি, ডিটেকটিভ কাজে তিনি খুব সুদক্ষ।” 

“হাঁ, এ কথা সত্য—তবে তাহার উপর আমাদের তত বিশ্বাস বা আস্থা নাই; কারণ তাঁহার প্রকৃত পরিচয় আমরা জানি না; তিনি ঠিক বাঙ্গালী কি না, সন্দেহ আছে। তিনি বলেন, তাঁহার পিতা মাতা পাঞ্জাবে ছিলেন।” 

“তাঁহার জন্মের সহিত আমাদের সম্পর্ক কি? তিনি কাজের লোক—আমরা ইহাই চাই।” 

“কাজের লোক স্বীকার করি।” 

“তাহা হইলে তাঁহার উপরে ভার দিন।” 

“হাঁ, বিবেচনা করিয়া দেখিব; উপস্থিত আপনার পরামর্শ মত কাজ করা যাক।” 

“হাঁ, এখনই হাবাকে ছাড়িয়া দিন।” 

“তাহাই হইবে।” 

সাহেব প্রস্থান করিলেন। গোবিন্দরাম সত্বর আসিয়া পুত্রের সহিত মিলিত হইলেন। 

এদিকে সাহেব থানায় ফিরিয়া আসিয়াই রামকান্ত ও শ্যামকান্ত নামক দুইজন পুলিশ কর্মচারীকে ডাকিয়া তাহাদের কি করিতে হইবে, বিশেষরূপে বুঝাইয়া দিলেন। বলিলেন, “যদি কোন গতিকে এ পালাইয়া যায়, তাহা হইলে তোমাদের চাকরী থাকবে না। 

উভয়েই বলিল, “হুজুর, আমাদের বিশেষ কিছু বলিতে হইবে না।” সাহেব ইহাদের দুইজনকে বিশেষ বিশ্বাস করিতেন, এইজন্যই এই গুরুতর ভার ইহাদের উপর ন্যাস্ত করিলেন। ইহারাও দুইজন এরূপ কার্যভার পাইয়া মনে মনে বড়ই সন্তুষ্ট হইল। মনে মনে একটু গৰ্ব্বও হইল। এই রমাকান্ত ও শ্যামকান্তের কাজ —বড় বড় ডিটেকটিভদিগকে সৰ্ব্বতোভাবে সাহায্যে করা; এবং তাঁহাদের উপদেশ অনুসারে কাজ করা; ছোটখাট কাজ ইহাদের দ্বারা সবই হইয়া থাকে। যাহা হউক, সাহেব এই দুই ব্যক্তিকে সঙ্গে লইয়া হাজতে আসিলেন। হাবাকে বাহির করিয়া আনা হইল। সাহেব বলিলেন, “তোমাকে ভুলক্রমে গ্রেপতার করা গিয়াছিল; তোমাকে ছাড়িয়া দিলাম, যাও।” 

তাহার পর তাহাকে তাহার সেই তিনটা সিকি, দুয়ানি ও কয়লাখন্ড দেওয়া হইল। সে কোন কথা কহিল না, হতভম্বের ন্যায় চারিদিকে চাহিতে লাগিল। একজন পুলিস-কর্মচারী তাহাকে ধাক্কা দিয়া জেল হইতে রাজপথে ঠেলিয়া বাহির করিয়া দিল। 

সে পথে দাঁড়ইয়া এদিকে ওদিকে চাহিতে লাগিল। সে কোথায় আসিয়াছে, বোধ হয় তাহা বুঝিতে পারিল না। কিয়ৎক্ষণ দাঁড়াইয়া তাকিয়া সে ধীরে ধীরে পূৰ্ব্বমুখে চলিল। কিয়দ্দুর গিয়া আবার দাঁড়াইল; তৎপরে পথিপার্শ্বস্থ একটা বাড়ীর দ্বারদেশে হতাশভাবে বসিয়া পড়িল। 

প্রায় অৰ্দ্ধঘন্টা সেখানে বসিয়া রহিল। তৎপরে উঠিয়া পশ্চিমদিকে চলিল। কিছুদূর গিয়া আবার দাঁড়াইল, ব্যাকুলভাবে চারিদিকে চাহিতে লাগিল, আবার ফিরিল। সে ধীরে ধীরে ফিরিয়া আসিয়া জেলের দ্বারে দাঁড়াইল। সে তথা হইতে আর নড়ে না। 

রামকান্ত ছুটিয়া গিয়া সাহেবকে সংবাদ দিল, “হাবা আবার এখানে ফিরিয়া আসিয়াছে। 

সাহেব বিস্মিত হইলেন। মনে মনে ভাবিলেন, গোবিন্দরামের মতলব আজ খাটিল না। তিনি প্রকাশ্যে বলিলেন, “যাও আমি এখনই যাইতেছি।” 

সাহেব গাড়ীতে উঠিতেছিলেন, এমন সময়ে দেখিলেন, গোবিন্দরাম একটি যুবকের সহিত যাইতেছেন। তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে আহ্বান করিলেন। গোবিন্দরাম পুত্রকে পথে অপেক্ষা করিতে বলিয়া সাহেবের নিকট আসিলেন। সাহেব বলিলেন, “আপনার মতলব খাটিল না?” 

“কেন, কি হইয়াছে?” 

“হাবাকে ছাড়িয়া দিলে সে এদিক-ওদিক ঘুরিয়া আবার জেলের দরজায় আসিয়াছে।” 

“হাঁ, আমিও তাহাই ভাবিতেছিলাম।” 

“কি ভাবিতেছিলেন।”

“এ লোকটা কলিকাতার রাস্তা চিনে না। কোথায় কোন পথে যাইবে স্থির করিতে না পারিয়া, আবার যথাস্থানে ফিরিয়া আসিয়াছে।” 

“এখন উপায়?” 

“উপায় আছে। নিশ্চয়ই লোকটাকে গাড়ী করিয়া এখানে আনা হইয়াছিল।” 

“হাঁ, গাড়ীতে।” 

“কাজেই সে পথ কিছুই দেখিতে পায় নাই। ইহার অনুসরণ করিতে কাহাকে নিযুক্ত করিয়াছেন?”

“রামকান্ত ও শ্যামকান্তকে।” 

“ভাল, দুইজনেই সুদক্ষ লোক। এই লোকটাকে হাতীবাগানের পথে যেখানে গ্রেপ্তার করিয়াছিল, সেইখানে ইহাকে ছাড়িয়া দিন—সেখান হইতে খুব সম্ভব,লোকটা পথ চিনিতে পারিবে।” 

“ইহাতে এ সন্দেহ করিয়া আরও বদমাইসী করিতে পারে।” 

“যদি এ যথার্থ দোষী হয়, তাহা হইলে নিশ্চয়ই এ অবস্থায় ইহার নিকট কিছু অবগত হওয়া অসম্ভব; তবে আমার বিশ্বাস, এ খুনের বিষয়ে কিছু জানে না, সুতরাং আপনার লোকেদের কোন স্থানে না কোন স্থানে লইয়া যাইবে; অন্ততঃ চেষ্টা করিয়া দেখা উচিত। আমি যাইতে পারি? আমার ছেলে অপেক্ষা করিতেছে।” 

‘আচ্ছা আসুন, আমরাও ইহার একবার পরীক্ষা করিয়া দেখিব।” 

গোবিন্দরাম চলিয়া গেলেন। সাহেবও এই পরামর্শ,কার্য্যে পরিণত করিবার জন্য তৎপর হইলেন। হাবাকে হাতীবাগানের থানায় লইয়া গিয়া যে দুইজন পাহারাওয়ালা তাহাকে ধরিয়াছিল, তাহাদের দিয়া তাহাকে হাতীবাগানের রাস্তায় পাঠাইয়া দেওয়া হইল। 

রামকান্ত ও শ্যামকান্ত ছদ্মবেশে—একজন মুটে আর একজন ফিরিওয়ালা সাজিয়া পূৰ্ব্ব হইতে তথায় উপস্থিত ছিল। 

পাহারাওয়ালাদ্বয় হাবাকে ছাড়িয়া দিয়া বলিল, “বাপু, আর যেন আমাদের হাতে পড়িয়ো না—এখন বিদায় হও।” 

এই বলিয়া তাহারা তাহাকে যেখানে গ্রেপ্তার করিয়াছিল, ঠিক সেইখানে ছাড়িয়া দিয়া থানার দিকে চলিয়া গেল। 

হাবা কিয়ৎক্ষণ পাহারাওয়ালাদ্বয়ের দিকে চাহিয়া রহিল। তাহারা দৃষ্টির বহিভূর্ত হইলে, হাবা এদিক ওদিক চাহিতে লাগিল, কিন্তু নড়িল না। সে বহুক্ষণ তথায় দাঁড়াইয়া রহিল। রামকান্ত ও শ্যামকান্ত ভাবিল যে, হাবা বোধ হয় সেখান হইতে আর নড়িবে না 

অবশেষে হাবা উত্তর দিকে চলিল, একটা বাড়ীর প্রাচীরে কি দেখিল, তৎপরে সেই পথ ধরিয়া দ্রুতপদে চলিল। 

রামকান্ত ও শ্যামকান্ত সত্বরপদে তাহার অনুসরণ করিল। 

রামকান্ত প্রাচীরটা দেখিয়া মনে মনে বলিলেন, “ও হরি! এই জন্য বেটা ট্যাকে একখানা কয়লাখন্ড রাখিয়াছিল—পথ চিনিবার জন্য বাড়ীর গায়ে দাগ দিয়াছিল—এখন সে চিনিয়া ঠিক স্বস্থানে যাইতে পারিবে।” হাবা নানা পথ অতিক্রম করিয়া চলিল। অনেক ঘুরিয়া ফিরিয়া অবশেষে বাগবাজারে আসিয়া উপস্থিত হইল। 

এইস্থানে সে কিয়ৎক্ষণ দাঁড়াইয়া নিকটস্থ একখানা বাড়ীর প্রাচীর বিশেষ লক্ষ্য করিয়া দেখিতে লাগিল; তাহার পর আবার চলিল। 

অবশেষে কলিকাতার প্রান্তভাগে আসিয়া সে একটি প্রাচীর বেষ্টিত বাড়ীর দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইল। রামকান্ত অনন্দে উৎফুল্ল হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “এতক্ষণ ভায়া আমার যথাস্থানে আসিয়াছে।” 

পূর্ব্ব বন্দোবস্ত মত রামকান্ত অগ্রবর্ত্তী হইয়া কিয়দ্দূরে গিয়া দাঁড়াইল, শ্যামকান্ত অপর দিকে রহিল।

পুলিসের সাহেবও ইহাদের দুইজনকে হাবার সঙ্গে দিয়া নিশ্চিন্ত থাকিতে পারেন নাই। সুবিখ্যাত ডিটেকটিভ-ইনস্পেকটর অক্ষয় কুমারকেও ইহার অনুসরণে পাঠাইয়াছিলেন। অক্ষয় কুমার গাড়ী করিয়া হাবার সঙ্গে সঙ্গে আসিয়াছেলেন। 

হাবা যে বাড়ীর দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইল, তাহার দ্বার ভিতর হইতে রুদ্ধ ছিল; সে কড়া নাড়িল। কিন্তু কেহ দরজা খুলিতে আসিল না। তখন সে আরও জোরে ঘন ঘন কড়া নাড়িতে লাগিল; তবুও কেহ উত্তর দিল না। 

পার্শ্বে একটা ছোট মুদির দোকান ছিল। দোকানী মুখ বাড়াইয়া মৃদুস্বরে বলিল, “পাখি উড়ে গেছে—কড়া নেড়ে আর হবে কি, বাপু?” 

অক্ষয় কুমার গাড়ী হইতে নামিয়া মুদীর নিকটস্থ হইয়া বলিলেন, “এ বাড়ীটায় কি কেহ নাই?”

মুদী বলিল, “বোধ হয়, কাল রাত্রে এ বাড়ীতে যারা ছিল, উঠে গেছে—কই, ঝি মাগীটাকেও আজ সকাল হইতে দেখিতেছিনা।” 

“তাহা হইলে লোকটাকে এ কথা বলা ভাল। বেচারা মিছামিছি কড়া নাড়িতেছে।” 

“ও নিজেই জানিতে পারিবে। আর আমিও ঠিক জানি না, তাহারা গিয়াছে কি না; ঝি মাগী বলেছিল বটে যে, তাহার মনিব দেশে যাইবে।” 

“যে কড়া নাড়িতেছে, ও লোকটাকে তুমি কি চেন না?”

“না, কই কখনই দেখি নাই।” তাহার পর বিরক্ত ভাবে বলিল, “বাপু, এত কথায় তোমার দরকারটা কি?” 

“বোধ হয়, লোকটা বাড়ী ভুল করিয়াছে।” বলিয়া অক্ষয় কুমার হাবার নিকট আসিলেন। তখনও হাবা কড়া নাড়িতেছিল। অক্ষয় কুমার পশ্চাৎ হইতে তাহার স্কন্ধে হস্তার্পণ করিলেন। তখন হাবা চমকিত হইয়া ফিরিল। 

অক্ষয় কুমার তৎক্ষণাৎ তাহার হাত ধরিয়া টানিয়া তাহাকে গাড়ীর নিকট আনিলেন— একরূপ ঠেলিয়া দিয়া তাহাকে গাড়ীতে তুলিলেন। তাহার পর রামকান্ত ও শ্যামকান্তকে নিকটে আসিতে ইঙ্গিত করিলেন। শ্যামকান্তকে বলিলেন, “গাড়ীতে ইহার পাশে বস—দেখিয়ো যেন পালায় না।” তাহার পর রামকান্তকে বলিলেন, “তুমি এই বাড়ীর দরজায় পাহারায় থাক। আমি একাকী এই বাড়ীর ভিতরে যাইব; যদি দরজা বন্ধ থাকে, ভাঙিতে হইবে। যতক্ষণ তুমি আমার বাঁশীর শব্দ না শুনিতে পাও, ততক্ষণ ভিতরে যাইয়ো না—এক পা এখান হইতে নড়িয়ো না।” 

এই বলিয়া তিনি মুদীর দিকে রুষ্ট নেত্রে চাহিয়া শাসাইয়া কহিলেন, “একটি কথা যদি কাহাকে বল, মজা টের পাইবে—আমরা পুলিসের লোক।” 

পুলিসের নাম শুনিয়া মুদীর মুখ একেবারে এতটুকু হইয়া গেল। সে ব্যাপার কি দেখিবার জন্য দোকান ছাড়িয়া রাস্তায় আসিয়াছিল, সত্বর গিয়া আবার দোকানে উঠিল। 

অক্ষয় কুমার বাড়ীটা বিশেষরূপে লক্ষ্য করিয়া দেখিতে লাগিলেন। এটি একটি ছোট একতলা বাড়ী—চারিদিকে একটু বাগান আছে। বাড়ীর জানালা সব খোলা রহিয়াছে—কেহ যে এ বাড়ীতে নাই, এমন বোধ হয় না। 

তিনি সহজেই প্রাচীর উলঙ্ঘন করিয়া বাড়ীর ভিতরের উদ্যানে আসিলেন। খুনের রাত্রে বৃষ্টি হইয়াছিল, এখন কদম শুকাইয়া গিয়াছে; কিন্তু কতকগুলো পায়ের দাগ স্পষ্ট দেখিতে পাইলেন। 

তন্মধ্যে কতকগুলো বড় বড় খালি পায়ের দাগ, ও কতকগুলো ভাল জুতার দাগ। এই বড় পা ও ছোট জুতার দাগ পাশাপাশি রহিয়াছে; সব দাগেরই মুখ বাড়ীর দিকে—বাহিরের দরজা হইতে বাড়ীর ভিতরে গিয়াছে; কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় একবারও ইহাদের বাড়ী হইতে ফিরিয়া দরজায় যাইবার দাগ নাই। 

অক্ষয় কুমার ইহা লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, “এটা আশ্চয্যজনক সন্দেহ নাই। ইহাতে বোধ হইতেছে, এই বাড়ীর পশ্চাতে একটা অতিরিক্ত দরজা আছে,তাহা দিয়া বাহির হইয়া লোক দুইটা আবার সদর দরজা দিয়া প্রবেশ করিয়াছিল। বড় পায়ের দাগ যে হাবার,তাহাতে কোন সন্দেহ নাই আর একজন—জুতাওয়ালা—সেই নিশ্চয়ই খুনী। এই সকল পায়ের দাগের ছাঁচ লওয়া আবশ্যক হইবে। দেখা যাইতেছে, যখন খুনী হাবার সহিত এই বাড়ীতে প্রবেশ করিয়াছিল, তখন দরজা খোলা ছিল;কেহ তাহাদের দরজা খুলিয়া দিতে আসে নাই। আসিলে তাহারও পায়ের দাগ থাকিত। এখন দেখা যাউক; বাড়ীর দরজা বন্ধ না খোলা।” 

যাহাতে পায়ের দাগগুলো নষ্ট না হয়, এরূপ সতকর্তার সহিত তিনি বাড়ীর দরজায় আসিলেন। দেখিলেন, দরজা বন্ধ নহে—একটা দরজা অর্দ্ধোম্মুক্তো রহিয়াছে। তিনি গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন, প্রথমে একটি বারান্দা; তাহার পর একটি বড় ঘর—বেশ সু-সজ্জিত—বোধ হয়, রমণীর এটা বসিবার ঘর ছিল। পার্শ্বে একটি অপেক্ষাকৃত ছোট ঘর—এ ঘরটিও বেশ সু-সজ্জিত;একপার্শ্বে একখানি সুন্দর পালঙ্ক রহিয়াছে—দেখিলেই বুঝিতে পারা যায় যে, এটা রমণীর শয়ণগৃহ ছিল। এই ঘরে কয়েকটা বাক্স রহিয়াছে। অক্ষয় কুমার দেখিলেন, যেরূপ বাক্সে রমণীর দেহ পাওয়া গিয়াছে, ঠিক সেইরূপ আর একটি বাক্স এখানে রহিয়াছে। তিনি মনে মনে বুঝিলেন, এই বাক্স দেখিয়াই জানা যাইতেছে, মৃত রমণী এই বাড়ীতেই খুন হইয়াছে। 

যে ঘরে তিনি প্রবেশ করিয়াছিলেন, সে ঘরটি মধ্যেবর্ত্তী বড় ঘরের দক্ষিণ দিকে স্থাপিত। এখন তিনি বামদিককার ঘরে প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন, সে ঘরটিও বেশ সাজান। নীচে একখানি সুন্দর কার্পেট পাতা;—সেই কার্পেটের উপর কতকগুলি তাস পড়িয়া আছে। অক্ষয় কুমার বলিলেন, “দেখি, এই তাসের ভিতর ইস্কাবনের টেক্কা আছে কিনা।” 

তিনি তাসগুলো কুড়াইয়া লইয়া এই কক্ষের পরবর্ত্তী কক্ষে প্রবেশ করিলেন; তথায় যাহা দেখিলেন, তাহাতে চমকিত হইয়া দন্ডায়মান হইলেন। দেখিলেন, ভাঙা গেলাস, ডিকেন্টার গৃহতলে চারিদিকে বিক্ষিপ্ত একপার্শ্বে একখানা কোচ ছিল, তাহা উল্টাইয়া পড়িয়াছে; দেখিলেই বোধ হয়, দুই বা ততোধিক ব্যক্তির এইখানে একটা ঘোরতর যুদ্ধ হইয়া গিয়াছে। অক্ষয় কুমার আপন মনে বলিলেন, “আমি ভাবিতে ছিলাম, রমণী নিজ শয়নগৃহে খুন হইয়াছে। না, তাহা নহে, যেরূপ দেখিতেছি, তাহাতে বেশ বুঝিতে পারা যায়, এখানে হত হইয়াছে। তাবে তাহার মৃতদেহ দেখিয়া বোধ হয় না যে, সে মৃত্যু কালে আত্মরক্ষা করিবার জন্য এত চেষ্টা পাইয়াছিল; অথচ এখানে যে একটা বেশী রকমের মারামারি ঠেলাঠেলি হইয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। এই ত রক্তের দাগও রহিয়াছে—কিন্তু ছোরা তাহার বুকে বসাইলে এত রক্ত পড়িবার সম্ভবনা নাই—অথচ এখানে এইদিকে বরাবর রক্তের দাগ রহিয়াছে; তাহা হইলে রমণী খুনীর হাত হইতে রক্ষা পাইবার জন্য এই দিকে ছুটিয়া পলাইয়াছিল। দেখি, এই দরজা দিয়া কোথায় যাওয়া যায়, রক্ত দরজা পর্যন্ত রহিয়াছে।” 

এই বলিয়া তিনি সেই দরজা খুলিনেন, তৎপরে বিস্মিতভাবে কয়েক পদ পশ্চাতে হাঁটিলেন। বলিলেনা, “একি! এখানে যে আরও একটা!” 

দ্বারের উপর রন্ধনগৃহে যাইবার পথ, সেই পথের মধ্যে একটি মৃতদেহ উপুড় হইয়া পড়িয়া আছে—তাহার সর্ব্বাঙ্গ রক্তাপ্লুত। 

এটি একটি পুরুষের মৃতদেহ—বয়স বোধ হয় পঞ্চাশ বৎসর হইবে–সবল—দীর্ঘ—হৃষ্টপুষ্ট। পরিধানে শান্তিপুরের ভাল কালাপেড়ে ধুতি। গায়ে একটা ভাল শার্ট, তাহার উপর একটি আলপাকার কোট। কোটের পকেট হইতে একটি মোটা সোনার চেন ঝুলিতেছে। চেনেও রক্ত লাগিয়াছে। তাহার কোঁচা খুলিয়া গিয়াছে, কোটেরও দুই একস্থান ছিঁড়িয়া গিয়াছে। তাহার কপাল ও মস্তক ফাটিয়া গিয়াছে—ক্ষতমুখে রক্ত জমিয়া কালো হইয়া রহিয়াছে। 

অক্ষয় কুমার বলিনেন, “লোকটাকে দেখিতেছি, কেহ সম্মুখ হইতে খুবজোরে লাঠি মারিয়াছে,তাহাই মথাটা ফাটিয়া গিয়াছে। ঘরের যেমন অবস্থা দেখিতেছি, তাহাতে দুইজনে যে খুব একটা মারামারি হইয়াছিল, বেশ বুঝিতে পারা যাইতেছে। লোকটা স্ত্রীলোকের মৃত দেহটা সরাইয়া পরে এই মৃত দেহটা সরাইবা মনে করিয়াছিল—হাবা ধরা পড়ায়ই সকল গোল হইয়া গিয়াছিল। কিন্তু একটা বিষয়ে আমি বড় আশ্চৰ্য্যান্বিত হইতেছি যে,স্ত্রীলোকটাকে যেমন তাহার অজ্ঞাতসারে খুন করিয়াছিল, ইহাকে তাহা করে নাই কেন? ইহাকে খুন করিতে রীতিমত একটা দাঙ্গা করিতে হইয়াছে। এরূপ অবস্থায় এ লোকটা খুন না হইয়া সে নিজেই খুন হইতে পারিত।” 

মৃতদেহটা ভাল করিয়া দেখিয়া অক্ষয় কুমার বলিলেন, “ লোকটা যে পয়সাওয়ালা লোক, তাহা স্পষ্ট দেখা যাইতেছে। বোধ হয়, কোন পল্লি গ্রামের জমিদার, সুতরাং এ লোকটাকে জানিতে অধিক কষ্ট পাইতে হইবে না। ইহাকে চিনিতে পারিলে স্ত্রীলোকটারও সন্ধান হইবে। একটা বিষয় নিশ্চিত যে, পয়সার লোভে এ খুন হয় নাই। ইহার পকেটে এখনও সোনার চেন ঝুলিতেছে—এই বাড়ী হইতেই যে, কোন দ্ৰব্য কেহ লইয়াছে, তাহাও বোধ হয় না। তাহা হইলে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যাইতেছে, সাধারণ চোর ডাকাতের কাজ নয়।” 

তিনি চিন্তিতমনে ধীরে ধীরে বাহিরের দিকে আসিলেন। ভাবিলেন, “এ বাড়ীতে যে দুই-দুইটা খুন হইয়াছে, তাহা কেহ জানে না। আমরা যে এখানে আসিয়াছি, তাহা কেবল মুদি জানে। তাহার মুখ বন্ধ রাখা কঠিন হইবে না। যে খুন করিয়াছে, যে স্ত্রীলোকের লাস চলিয়া গিয়াছিল, আর ফিরিয়া আসিতে পারে নাই। যদি গোলযোগ না করা যায়, সে ভাবিতে পারে আমরা এ বাড়ীর এখনও সন্ধান পাই নাই; সুতরাং আজ রাত্রে এই লাসটা সরাইবার জন্য সে আসিতে পারে। অন্ততঃ একটু অপেক্ষা করিয়া দেখিতে ক্ষতি কি? এক রাত্রে আর কি অনিষ্ট হইবে? আমি আজ রাত্রে নিজেই এ বাড়ীতে পাহারায় থাকিব।” 

মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া তিনি বাহিরে আসিলেন। শ্যামকান্তকে বলিলেন, “তুমি হাবাকে লইয়া থানায় চলিয়া যাও, তাহাকে সাবধানে রাখিতে বলিয়া যত শীঘ্র পার, আর দুইজন লোকে লইয়া এখানে আসিবে—কাৰ্য্যক্ষম লোক আনিবে।” 

শ্যামকান্ত গাড়ীতে উঠিয়া গাড়ী হাঁকাইয়া দিল। রামকান্ত বলিল, “আমায় কি করতে বলেন?”

অক্ষয় কুমার বলিলেন, “তুমি দূর হইতে প্রচ্ছন্নভাবে এই দরজায় পাহারায় থাক।” 

“আর উহারা আসিলে?” 

“নিকটেই সকলকে পাহারায় থাকিতে বলিবে।” 

“অপনি?” 

“আমি ভিতরে থাকিব। যদি কেহ বাড়ীতে প্রবেশ করে, ভাল—প্রতিবন্ধক দিয়ো না। তোমরা যে পাহারায় আছ, তাহা যেন কেহ জানিতে না পারে।”

“সে কথা বলিতে হইবে না।” 

“বেশ, আমি না ডাকিলে বা বংশীধ্বনি না করিলে বাড়ীর ভিতরে যাইয়ো না।” 

“বুঝিয়াছি, ইন্দুর ধরিবার কল পাতিতেছেন।” 

“কতকটা—দেখি কতদূর কি হয়।” 

“এখন সবে সন্ধ্যা–কতরাত্রে আসিবে কে জানে।” 

“আসে ত বেশী রাত্রেই আসিবে। যদি কিছু আহার করিতে চাও তাহারা আসিলে একজনকে দিয়া খাবার আনাইয়া লইয়ো।” 

“আর আপনি কি খাইবেন?”

“আমার পক্ষে এক রাত্রি আহার না করিলে কিছু আসে যায় না।” বলিয়া অক্ষয় কুমার আবার গৃহমধ্যে প্রবেশ করিতেছিলেন—কি ভাবিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইলেন; বলিলেন, “দরজা থেকে নজর যেন এক মিনিটের জন্যও না যায়—খুব সাবধান! যে আসিবে, সে স্ত্রীলোক হইলেও হইতে পারে।” 

রামকান্ত বিস্মিতভাবে বলিলেন, “স্ত্রীলোক! 

“হাঁ, একজন দাসী এ বাড়ীতে ছিল, সেও অন্তর্হিত হইয়াছে। সেও আসিতে পারে, তবে সম্ভব, সে আসিবে না। আসিবে এই হাবার মনিব। যে-ই আসুক, যাহা বলিলাম, তাহা করিয়ো—খুব সাবধান।” 

“বলিতে হইবে না—খুব সাবধানে থাকিব।” 

অক্ষয়কুমার আর কোন কথা না বলিয়া গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন। তখন অন্ধকারটা বেশ ঘনাইয়া আসিয়াছে। 

কোথায় লুকাইয়া থাকিবেন, তাহাই তিনি ভাবিতে লাগিলেন। তখন অন্ধকার হইয়াছিল, একটা আলো না হইলে নহে। তিনি দেখিলেন, শয়ন-গৃহে বাতীদানে একটা বাতী রহিয়াছে; তিনি পকেট হইতে দিয়াশলাই বাহির করিয়া সেই বাতীটা জ্বালিলেন। 

বংশীধ্বনি করিলে বাহিরে যাহাতে শব্দ যায়, সেইজন্য তিনি একটা জানালা একটু খুলিয়া রাখিলেন। ঘরের দরজা গুলিও খুলিয়া দিলেন। ইহাতে কেহ বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলেই তিনি দেখিতে পাইবেন। 

এখন তিনি কোথায় লুকাইয়া থাকিবেন, তাহারই সন্ধান লইতে লাগিলেন। দেখিলেন, শয়ণ-গৃহের পার্শ্বে কাঠের একটা ছোট ঘর আছে। অক্ষয়কুমার ভাবিলেন, “এই ঘরটাই লুকাইবার বেশ স্থান—এখানে লুকাইয়া থাকিলে আমি সবই দেখিতে পাইব; অথচ এখানে আমি যে লুকাইয়া আছি, তাহা কেহ সন্দেহ করিবে না।” 

এখন ধৈর্য্য ও সাহস বিশেষ আবশ্যক। কতক্ষণে কে আসিবে কি না, তাহার কোন স্থিরতা নাই। দ্বিতীয়তঃ—খুনীর সহিত দেখাসাক্ষাৎ করা কম সাহসের কাজ নহে। যে লোকটা দুই-দুইটা খুন করিয়াছে, সে যে আর একটা অনায়াসে করিবে, তাহার আর আশ্চর্য্য কি? এই ক্ষুদ্র গৃহে অক্ষয়কুমার নীরবে বসিয়া রহিলেন। ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়া যাইতে লাগিল। ক্রমে কলিকাতা শহর নিস্তব্ধতার ক্রোড়ে আশ্রয় লইল—এখনও কেহ আসিল না। 

বোধ হয়, রাত্রি বারোটার সময় কাহার পদশব্দ অক্ষয়কুমারের কর্ণে প্রবেশ করিল। এতক্ষণে তাঁহার পরিশ্রম সার্থক হইল ভাবিয়া, তিনি সোৎসাহে উৎকর্ণ হইয়া রহিলেন। 

যথার্থই একব্যক্তি অতি সাবধানে গৃহমধ্যে প্রবেশ করিতেছে। অতি সাবধানে বড় ঘরে আসিতেছে—ঘর অন্ধকার দেখিয়া সে ধীরে ধীরে বলিল, “বিনোদ—বিনোদ—তুমি কোন ঘরে?” 

অক্ষয়কুমার বুঝিলেন, বিনোদবিহারী নয়—বিনোদিনী। তিনি কষ্টে নিশ্বাস পর্যন্ত করিয়াছিলেন, পাছে কোন শব্দ হয়; কিন্তু আগন্তুক কোন সন্দেহ করে নাই। কেহ যে লুকাইয়া আছে, তাহা তাহার মনে হয় নাই। লোকটা ধীরে ধীরে অতি সাবধানতার সহিত শয়ণ-গৃহে আসিল। আবার বলিল, “বিনোদ, তুমি কি ঘুমাইয়াছ?” 

শয়ন-গৃহের একপার্শ্বে বাতীটা জ্বলিতেছিল, তাহাতে সমস্ত গৃহটা তত আলোকিত হয় নাই। অক্ষয় কুমার আগন্তুককে দেখিতে পান নাই—কেবল তাহার পদশব্দ ও কন্ঠস্বর শুনিয়াছিলেন। এবার সে লোকটি পালঙ্কের দিকে গেল। মশারি সরাইয়া দেখিতে উদ্যত হইল। 

অক্ষয়কুমার ভাবিলেন, “এখন কি করা উচিত—ইহাকে ধরা উচিত না এ কি করে দেখা উচিত? এ যে খুনী, তাহাতে সন্দেহ নাই। দুঃখের বিষয়, এখান হইতে ইহার মুখ দেখিতে পাইতেছি না। এ লোকটা বিনা উদ্দেশ্য এ বাড়ী আসে নাই। ভাবিয়াছে, আমরা এ বাড়ীর কোন সন্ধান পাই নাই, তাহাই এই লাসটাকে সরাইয়া ফেলিতে আসিয়াছে; আমি এখনই ইহাকে ধরিতে পারি—বাঁশি বাজালেই রামকান্ত প্রভৃতি আসিয়া পড়িবে—দেখা যাক, লোকটা কি করে। এই সময়ে লোকটা শয্যা হইতে মশারি তুলিয়া ফেলিয়া দেখিল; বলিল, “কি মুস্কিল! এত রাত্রে আবার কোথায় গেল? বাড়ীতে কেহ নাই বলিয়াই বোধ হয়। আবার দরজাও খোলা—এ বাতিটাই বা কে এখানে রাখিল?” 

এই সময়ে দুর্ভাগ্যবশতঃ অক্ষয় কুমারের নাকে কি একটা পোকা প্রবেশ করিল। তিনি বহু চেষ্টা সত্ত্বেও হাঁচি বন্ধ করিতে পারিলেন না—মহাশব্দে হাঁচিয়া ফেলিলেন। 

তিনি প্রকৃতিস্থ হইবার পূর্ব্বেই সেই লোকটা কাঠের ঘরের দ্বারের কাছে আসিল; এবং নিমেষ মধ্যে বাহির হইতে শিকল লাগাইয়া দিল, পরক্ষণে দ্রুতপদে গৃহ হইতে পলায়ন করিল। 

অক্ষয় কুমার বন্দী হইলেন। তিনি দ্বার অনেক ঠেলাঠেলি করিলেন কিন্তু কিছুতেই খুলিতে পারিলেন না; সুতরাং সেই লোকটার অনুসরণ করিতে পারিলেন না। 

যে ঘরে অক্ষয়কুমার বন্দী হইলেন, সে ঘরটি অপরিসর, কোন জানালা ছিল না, তিনি বংশীধ্বনি করিলে সে শব্দ যে বাহিরে রামকান্ত প্রভৃতি শুনিতে পাইবে, সে সম্ভবনা অল্পই ছিল। এক চিৎকার করা—তাহা তিনি প্রথমে সাহস করিলেন না। ভাবিলেন, “নিশ্চয়ই লোকটার নিকট ছোরা বা পিস্তল আছে, সে আমাকে খুন করিতে দ্বিধা করিবে না। দেখা যাক, অপেক্ষা করিয়া। সে নিশ্চয়ই শীঘ্র বাড়ী হইতে বাহির হইবে, তখন রামকান্ত প্রভৃতি নিশ্চয়ই তাহাকে ছাড়িবে না।” এইরূপে মনকে প্রবোধ দিয়া অক্ষয়কুমার সেই দুর্গন্ধময় ক্ষুদ্র ঘরটিতে বন্দী রহিলেন। ঘন্টার পর ঘন্ট কাটিয়া গেল, তবুও কেহ তাঁহার উদ্ধারের জন্য আসিল না। তখন তিনি উচ্চৈঃস্বরে রামকান্তকে ডাকিতে লাগিলেন; বোধ হয়, এই ক্ষুদ্র গৃহ হইতে তাঁহার স্বর বাহিরে পৌঁছিল না; তাঁহার উদ্ধারের জন্যও কেহ আসিল না। 

অক্ষয়কুমারের কষ্টের বর্ণনা নিষ্প্রয়োজন, শারীরিক কষ্ট অপেক্ষা তাঁহার মানসিক কষ্টটা শতগুণ হইয়াছে; তাঁহার এই অবস্থা হইয়াছে, শুনিলে লোকে কি বলিবে? তাঁহার মুখ দেখাইবার উপায় থাকিবে না; একটা বদমাইস খুনীতে তাঁহাকে এরূপ বোকা বানাইল! যাহা হউক, উপায় নাই। ক্রমে প্রাতঃকাল হইল। ক্ষুদ্র গৃহে আলো প্রবেশ করায় অক্ষয়কুমার বুঝিলেন, ভোর হইয়াছে। এই সময়ে তিনি শুনিলেন, বাহির হইতে কে ডাকিতেছে, “ইনস্পেক্টর বাবু, আপনি কোথায়?” অক্ষয়কুমার সেইখান হইতে চিৎকার করিয়া উঠিলেন। রামকান্ত লম্ফ দিয়া গৃহের দ্বারে আসিয়া বিস্মিত হইয়া বলিল, “আপনি ইহার ভিতরে!” 

অক্ষয়কুমার মহা ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন, “হাঁ, শীঘ্র শিকল খুল 

রামকান্ত তৎক্ষণাৎ শিকল খুলিয়া দিল। অক্ষয়বাবু বাহির হইয়া আসিলেন। তিনি প্রথমেই জিজ্ঞসা করিলেন, “তাহাকে ধরিয়াছ ত?” 

রামকান্ত বিস্মিত হইয়া বলিল, “কাহাকে?” 

“কাহাকে! যে এই বাড়ীতে রাত্রে আসিয়াছিল।” 

‘কেহ ত আসে নাই, বড় সাহেব কেবল একজনকে আপনার কাছে পাঠাইয়াছিলেন, সে আপনার সহিত দেখা করিতে আসিয়াছিল।” 

“গাধা—পাগল—” অক্ষয়কুমার আরও কি বলতে যাইতেছিলেন। (বাধা দিয়া) “দুইয়ের একটাও নয়। সত্যিই বলিতেছি, আন্দাজ রাত্রি বারোটার সময় কেবল একজন লোক বাড়ীর ভেতর ঢুকিয়াছিল।” 

“তুমি তাহাকে ধরিলে না কেন?” 

“আপনি বলিয়াছিলেন যে, কাহাকে বাড়ীতে ঢুকতে দেখিলে তাহাকে যেন বাধা দেওয়া না হয়; হুকুম শুনিব—না কি করিব?”

“হাঁ, তাহা বলিয়াছিলাম, বটে; কিন্তু সে যখন বাহির হইল, তখন তাহাকে ধরিলে না কেন?” 

“বাহির হইলে কি করিতে হইবে, তাহা আপনি বলেন নাই; কেবল বলিয়াছিলেন, বাঁশী বাজাইলে বাড়ীর ভিতরে আসিয়ো—তবুও আমি লোকটাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, সে কে? তাহাতে সে বলিল, ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের লোক।” 

এবার অক্ষয়কুমারের ক্রোধ সীমাতিক্রম করিয়া উঠিল। বলিলেন, “আর তুমি গাধার মত তাহাই বিশ্বাস করিলে?” 

“কেবল কথায় বিশ্বাস করি নাই—সে কার্ড দেখাইয়াছিল।” 

“কার্ড দেখাইল! কিসের কার্ড?” 

“ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের। সে বলিল, সাহেব তাহাকে বিশেষ একটা জরুরী কথা বলিবার জন্য পাঠাইয়াছেন।” 

“তোমার মাথা—সে-ই আমাকে আটকাইয়া রাখিয়া গিয়াছিল।” 

অক্ষয়কুমার আরও ক্রোধান্বিত হইয়া উঠিলেন। বলিলেন, “ইহাকে গাধা না বলে আর কি বলে? তুমি বিলক্ষণ জান যে, আমরা এখানে আসিয়াছি, সাহেব তাহার কিছুই জানে না—এই বাড়ীতে যে খুন হইয়াছে, তাহাও তিনি অবগত নহেন।” 

“রামকান্ত বলিল, আমি ভাবিয়াছিলাম যে, শ্যামাকান্ত হাবাকে লইয়া যাওয়ায় সাহেব সকল জানিতে পারিয়াছেন।” 

“তোমার মত পন্ডিত হইলেই এইরূপ মনে করে—তুমি খুনীকে হাতে পাইয়াও ছাড়িয়া দিলে।” রামকান্ত বিস্মিত হইয়া উঠিল, “বলেন কি—খুনী!”

অক্ষয়কুমার রাগতভাবে বলিলেন, “হাঁ, খুনী। তোমার বুদ্ধির দোষে সে আজ হাতে পড়িয়াও পলাইল। তোমার চাকরীর দফারফা হইয়া গিয়াছে—এমন মূর্খের পুলিশে থাকা উচিত নয়। এই লোকটা কিনা অনায়াসে তোমার চোখে ধুলা দিয়া চলিয়া গেল—লজ্জার কথা-লজ্জার কথা।” 

রামকান্ত লজ্জায় মুখ অবনত করিল। তৎপরে বলিল, “হাঁ, আমারই দোষ হইয়াছে—আমি সাত বৎসর পুলিশে কাজ করিতেছি, আর আমার চোখে ধূলা দিয়া গেল। আমাকে দূর করিয়া দিন—সত্যিই আমি পুলিশে কাজ করিবার উপযুক্ত নই।”

অক্ষয়কুমার বলিলেন, “কার্ডখানার নম্বরটা দেখিলে না কেন? এখন বল, অত মনে হয় নাই।”

“হাঁ, এ কথাও ঠিক, এ কথাও আমার তখন মনে হয় নাই।” 

“চতুষ্পদ বলে আর কাহাকে?” 

“যাহা হইবার তাহা হইয়া গিয়াছে—তবে ইহাও আপনি জানিবেন, আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি, যতক্ষণ তাহাকে ধরিতে না পারিতেছি, ততক্ষণ আমি নিশ্চিন্ত হইব না। তাহাকে যদি ফাঁসী দিতে না পারি, তাহা হইলে আমার নাম রামকান্ত নয়।” 

“তাহাকে তুমি পুনরায় দেখিলে চিনিতে পারিবে?” 

“হাঁ, তাহার চোখ দেখিয়া চিনিতে পারিব। হাঁ, চোখ বেশ ভাল করিয়া দেখিয়াছিলাম, তাহার জোড়া ভ্রূ ছিল—তা ছাড়া তার গলায় একটা লাল কম্ফর্টার জড়ান ছিল।” 

“এ সহরে হাজার হাজার লোক লাল কম্ফর্টার ব্যবহার করে।” 

“সে কথা সত্য, তবে এ কথাও বলি, যদি আমি তাহাকে ধরিতে না পারি, আমার নাম রামকান্ত নয়।”

“তোমার নাম হোক আর নাই হোক, তাহাতে সরকারের বিশেষ ক্ষতিবৃদ্ধি নাই। যাক্, তোমার এই প্রথম ভুল হইয়াছে—আমি এবার আর তোমার নামে রিপোর্ট করিব না।” 

রামকান্ত, কথা শুনিয়া আনিন্দত হইয়া বলিল, ‘তাহা হইলে এবার আমায় মাপ কররিলেন?”

“হাঁ, তবে দুটা কথা আছে?” 

“বলুন, যাহা বলিবেন, তাহাই করিব।” 

“প্রথমতঃ—এ কথা আর দ্বিতীয় ব্যক্তিকে বলিবে না।” 

“আমার মুখ দিয়া একটি কথাও বাহির হইবে না। 

“দ্বিতীয়তঃ—যে রূপে হয়, তুমি এই লোকটাকে খুঁজিয়া বাহির করিবে।”

“নিশ্চিন্ত থাকুন, আমি ইহাকে খুঁজিয়া বাহির করিব।” 

“বাজে কথা কহিয়ো না, আমি কাজ চাই। আর সকলে কোথায়?”

“যেখানে যেখানে তাহাদের পাহারায় রাখিয়াছি, সেইখানেই তাহারা আছে।” 

“বেশ, যাও এখানকার থানার ইনস্পেক্টরকে এইখানে নিয়ে এস—এখানে আর একটা লাস আছে।”

“লাস! কোথায়?” 

“এই বাড়ীতে—রান্নাঘরের পাশে। এবার স্ত্রীলোকের নয়—একটা পুরুষের মৃতদেহ পড়িয়া আছে।”

রামকান্ত বলিল, “তাহা হইলে দুইটা খুন! কি সৰ্ব্বনাশ! তাহা হইলে লোকটা দুইজনকে খুন করিয়াছে?”

অক্ষয়কুমার বলিলেন, “হাঁ করিয়া থাকিয়া সময় নষ্ট করিয়ো না। থানায় গিয়া ইনস্পেক্টরকে পাঠাইয়া দিয়া কৃতান্তবাবুর সন্ধানে যাইবে। তাহাকেও এখানে চাই।” 

“তাহা হইলে কৃতান্তবাবুও এই তদন্তে থাকিবেন?”

“তোমার এত কথার কাজ কি? যা বলিলাম কর।” 

“কাহার সঙ্গে কাজ করিতে হইবে, জানা উচিত—সকলের অনুসন্ধানের ধারা এক রকম নয়।” 

“তোমাকে কৃতান্তবাবুর সঙ্গে কাজ করিতে হইবে।” 

রামকান্ত দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিল, “সরকারের মহিনা নাই —যাহার সঙ্গে বলিবেন, তাহার সঙ্গে কাজ করিব। তবে গোবিন্দরামের—” 

“তিনি এ কাজ ছাড়িয়া দিয়াছেন।” 

“জানি, তাঁহার সঙ্গে অনেক দিন কাজ করিয়াছিলাম—তাঁহার মত আর লোক হয় না।” 

“তাহা আমরা সকলেই জানি, তোমাকে আর কষ্ট করিয়া বলিতে হইবে না; এখন বাজে বাক্যব্যয় না করিয়া যাহা বলিলাম, সেই কাজে শীঘ্র যাও।”

“এখনই চললাম”, বলিয়া রামকান্ত সত্বর থানার দিকে চলিল। রামকান্ত চলিয়া গেলে অক্ষয়কুমার বৈঠকখানা গৃহে আসিয়া বসিলেন। তিনি জানিতেন, যখন খুনী কিম্বা তাহার লোক সন্দেহ করিয়া তাঁহাকে আট্‌কাইয়া গিয়াছে, তখন সে আর এ বাড়ীর দিকে আসিতেছে না। সম্ভবতঃ কাল রাত্রে সে কলিকাতায় পলাইয়াছে। অক্ষয়কুমার আপন মনে বলিলেন, “হাতে পাইয়াও তাহাকে ধরিতে পারিলাম না, গাধা রামকান্তের দোষে এটাই হইল—এখন গতানুশোচনা বৃথায়—ভবিষ্যতে এরূপ আর না হয়, সেজন্য আমাকে বিশেষ সাবধান হইতে হইবে। রামকান্ত বলিল তাহাকে চিনিতে পারিবে—আর চিনিয়াছে! কি মুস্কিল! আমি কাল তাহার মুখটা একবার ও দেখিতে পাইলাম না।” 

অক্ষয়কুমার বসিয়া বসিয়া খুনীর কথা ভাবিতেছিলেন। এই সময়ে একখানা গাড়ী আসিয়া দরজায় লাগিল। তিনি উঠিয়া জানালায় গিয়া দেখিলেন, শ্যামবাজার থানার ইনস্পেক্টর আসিয়াছেন। তিনি সত্বর বাহিরে গিয়া তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া আনিলেন। প্রথমেই তাঁহাকে মৃতদেহ যে স্থানে পড়িয়াছিল, সেইখানে লইয়া গেলেন। তিনি মৃতদেহ দেখিবামাত্র বলিয়া উঠিলেন, ‘এই যে তিনি! কি সৰ্ব্বনাশ, এমন অবস্থা!” 

অক্ষয়কুমার বিস্মিতভাবে বলিলেন, “আপনি কি ইহাকে চেনেন?” 

ইনস্পেক্টর বলিলেন, “ভালরকমে চিনি, ইনি শ্যামবাজারে থাকেন—মেদনিপুরের জমিদার, দুই দিন হইল, বাড়ী ফিরেন নাই—ইহার ছেলে আমাকে ইহার নিরুদ্দেশের সংবাদ দেন। আমি ইহারই সন্ধান করিতেছিলাম।” 

“এই মৃতদেহ যে তাঁহার, এ বিষয়ে আপনার কোন সন্দেহ নাই?”

“যদিও ইহার সর্ব্বাঙ্গ ফুলিয়াছে, তবুও ইঁহার মুখের চেহারার ত বড় পরিবর্তন হয় নাই। ইঁহার সহিত আমার বেশ আলাপ-পরিচয় ছিল, ইঁহাকে শ্যামবাজারের সকলেই চিনে।” 

“খুব বড়লোক?’ 

“হাঁ, শুনিয়াছি, লাখ টাকার উপর জমিদারীর আয়।” 

“নাম কি?” 

“সুধামাধব রায়।” 

“ইঁহার কয়টি ছেলে?” 

“দুটি ছেলে—বড়টির বয়স প্রায় বাইশ বৎসর। যাহা হোক, আমি মনে করিতেছিলাম, ইঁহার সন্ধানের জন্য আমাকে অনেক কষ্ট পাইতে হইবে—একটা কাজ হইল।” 

“আপনার কাজ হইল বটে, আমাদের কিছুই এখনও হয় নাই—তবে খুন যেখানে হইয়াছে, যখন সে বাড়ীটা জানা গিয়াছে, তখন খুনীকে ধরা বড় কঠিন হইবে না। দেখা যাক, কৃতান্ত বাবু কি বলেন, তাঁহাকে ডাকাইয়া পাঠাইয়াছি।” 

“কৃতান্তবাবু—যিনি সম্প্রতি ডিটেক্‌টিভ-ইনস্পেক্টর হইয়াছেন?” 

“হাঁ, লোকটা ক্ষমতাপন্ন—যতক্ষণ কৃতান্তবাবু না আসেন, ততক্ষণ আমরা কতকটা কাজ করি। আমরা জানিলাম, এই মৃতলোকটি মেদনিপুরের জমিদার, নাম সুধামাধব রায়। ইঁহার চরিত্র কিরূপ ছিল?” 

“সাধারণত বড়লোকের যেরূপ হয়।” 

“বুঝিয়াছি, এই বাড়ীতে তাঁহার রক্ষিতাটি ছিল—তাহার নাম কি, আপনার জানা উচিত।” 

“ঠিক নাম জানি না, তবে একটি যুবতি স্ত্রীলোক মাস ছয়েক হইতে এই বাড়ীতে আছে জানিতাম।”

“কখনও ইহাকে দেখিয়াছিলেন?” 

“বোধ হয়, দেখিয়া থাকিব–হাঁ, মনে পড়িয়াছে, ঐ পাশে একজন মুদী আছে—সে আমার কাছে নালিশ করিয়াছিল যে, এই বাড়ীতে ইহারা আসা পর্য্যন্ত পাড়ায় বড় গোলমাল হইতেছে। তাহাই আমি অনুসন্ধানে আসিয়াছিলাম, এই স্ত্রীলোকের সঙ্গে দেখাও করেছিলাম। অনুসন্ধানে জানিলাম, খালি-বাড়ী পাইয়া মুদী তাহার অনেক দ্রব্যাদি রাখিত, ইহারা আসিয়া ঐ সকল বাহির করিয়া দেওয়ায়, রাগে থানায় গিয়া নালিশ করিয়াছিল। আমি মুদীকে ধমকাইয়া দিয়াছিলাম।” 

‘সেই স্ত্রীলোটিকে দেখিলে চিনিতে পারিবেন?” 

“বোধ হয় না—অনেক দিন আগে দেখিয়াছিলাম।” 

“এই স্ত্রীলোকেরই মৃতদেহ বাক্সের মধ্যে পাওয়া গিয়াছে।” 

“বলেন কি!” 

“হাঁ, আপনি তাহার ফটোগ্রাফ দেখিলে তাহাকে হয় ত চিনিতে পারিবেন। 

“আপরার কাছে আছে না কি?” 

“না, আপনাকে আফিসে ডাকাইয়া পাঠাইব। এই মুদীও ইহাকে চিনিতে পারে।” 

“নিশ্চয় পারিবে—আমি কেবল তাহাকে একবার মাত্র দেখিয়াছিলাম—মুদীটা নিশ্চয়ই অনেকবার দেখিয়াছে।” 

“এ বাড়ীটা কাহার?” 

“তাহা ঠিক জানি না—অনুসন্ধান করিব।” 

“বাড়ীওয়ালাও ইহাদের বিষয় নিশ্চয় অনেক সন্ধান পারিবে।” 

“খুব সম্ভব।” 

“এখন কথা হইতেছে যে, কে ইহাকে খুন করিল—যেই করুক, অর্থলোভে করে নাই, দামী ঘড়ী, ঘড়ীর চেন এখনও ইহার পকেটে রহিয়াছে। আমি একটা সিদ্ধান্তে আসিয়াছি, তবুও দেখা যাক, কৃতান্তবাবু আসিয়া কি বলেন।”

“বোধ হয় তিনি এই গাড়ীতে আসিতেছেন” 

গাড়ীর শব্দ শুনিয়া উভয়ে জানালার নিকটে আসিলেন। দেখিলেন, রামকান্ত ও কৃতান্তবাবু গাড়ী হইতে নামিতেছেন। 

রামকান্ত নামিল, কিন্তু কৃতান্তবাবু নামিলেন না। বোধ হয়, রামকান্ত পুনঃপুনঃ বলায় তিনি গাড়ী হইতে বাহির হইলেন। একখানা মোটা চাদর মুড়ী দিয়া তিনি নামিলেন; তাহার পর সত্বরপদে গৃহ মধ্যে প্রবেশ করিলেন। 

অক্ষয়কুমার হাসিয়া বলিলেন, “দেখিলেন, কৃতান্তবাবুর বেশ একটা নতুন ধাঁচ আছে—বড় সতর্ক।”