প্রতীজ্ঞা পালন – ৪৫

৪৫

আজ প্রাতে সুরেন্দ্রনাথের ফাঁসী হইবে। তিনি প্রসিদ্ধ ডিটেকটিভ গোবিন্দরামের পুত্র এবং নিজে উকিল সুতরাং তাঁহার ফাঁসী দেখিবার জন্য লোকে-লোকারণ্য হইয়াছে। 

রামকান্ত ও শ্যামকান্ত সমস্ত রাত্রি নানাস্থনে ছুটাছুটি করিয়াছে, কিন্তু কিছুই করিতে পারে নাই, ফাঁসী স্তগিত হয় নাই। কেবল কথার উপর নির্ভর করিয়া ফাঁসী স্থগিত হইবে কেন? 

হতাশচিত্তে রামকান্ত গোবিন্দরামকে একথা বলিবার জন্য স্টেশনে ছুটিল। ক্ষণপরে একখানা ট্রেন আসিল, শেষে আরও একখানা আসিল, কিন্তু তাহাতেও গোবিন্দরাম আসিলেন না। রামকান্ত ভাবিল, বোধ হয় তিনি গাড়ী ধরিতে পারেন নাই—ঘোড়ার গাড়ীতে আসিতেছেন। 

সমস্ত রাত্রি গেল, তবুও গোবিন্দরাম আসিলেন না। তখন রামকান্ত নিতান্ত অস্থির হইয়া উঠিল; ভাবিল, হয়ত তিনি বরাবর জেলে গিয়াছেন। এইরূপ ভাবিয়া সে শ্যামকান্তকে সঙ্গে লইয়া জেলে উপস্থিত হইল। তথায় ভীষণ জনতা। সে জনতা ঠেলিয়া যাওয়া সহজ নহে। তখন প্রায় ভোর হইয়াছে, চারিদিকে পরিষ্কার হইয়া আসিতেছে, ঠিক ছয়টার সময় ফাঁসী হইবে। 

রামকান্ত বলিল, “আর কি! গুরুদেব কিছুই করিয়া উঠিতে পারে নাই—সেই দুঃখে আর আসেন নাই।” 

শ্যামকান্ত বলিল, “তাহা নয়—তিনি সে প্রকৃতির লোক নহেন—ঐ দেখ, তিনি আসিয়াছেন, ঐ জেলের ভিতর যাইতেছেন—সঙ্গে কে রহিয়াছে।” 

রামকান্ত দেখিল, প্রকৃতই গোবিন্দরাম দুইটি লোকের সঙ্গে জেলে প্রবেশ করিলেন; তখন দুইজন সাহেব গোবিন্দরামের নিকটস্থ হইলেন। শ্যামকান্ত বলিল, এতদূর হইতে ভাল চিনিতে পারিতেছি না—সাহেব দুটি কে?” 

“বোধ হয়, জেলের সুপারিন্টেন্ডেন্ট।” 

“এই ত বড় সাহেবও আসিয়াছেন—এইবার আসামীকে আনা হইবে।” 

“এত পরিশ্রম বৃথা হইল!” 

“সবই ভগবানের হাত।”

“গুরুদেবের জন্য দঃখ হয়।” 

“কি করিবে বল— চেষ্টা ত যথেষ্টই করা হল।” 

“গুরুদেব এত খুনী ধরিয়া নিজের ছেলের মামলায় হারিলেন—এবার আর অধিক দিন বাঁচিবেন না।”

“চুপ—আসামী আসিতেছে।” 

প্রকৃতই সম্মুখে প্রহরী পরিবেষ্টিত হইয়া সুরেন্দ্রনাথ ফাঁসী কাষ্ঠের নিকটে নীত হইলেন। তাঁহাকে দেখিবার জন্য চারিদিক হইতে অসংখ্য লোক পরস্পর ঠেলাঠেলি করিতে লাগিল। 

আর পাঁচ মিনিট—আর পাঁচ মিনিট পরে সুরেন্দ্রনাথ ইহ-জীবনের মত এ সংসার পরিত্যাগ করিবেন। পাঁচ মিনিট অতীত হইয়া গেল—সুরেন্দ্রনাথের ফাঁসী হইল না। সহসা সকলে দেখিল, সুরেন্দ্রনাথ প্রহরীবেষ্টিত হইয়া যেরূপে আসিয়াছিলেন, আবার সেইরূপ প্রহরিবেষ্টিত হইয়া জেলের দিকে প্রস্থান করিলেন। 

সহসা এই ব্যাপার দেখিয়া সকলে নানারূপ আলোচনা করিতে লাগিলেন; ইহাতে একটা মহা গোল উঠিল। তখন পুলিস-প্রহরিগণ সকলকে জেল হইতে বাহির করিয়া দিতে লাগিল; ফাঁসীর কথা জিজ্ঞাসা করিলে তাহারা উত্তর করিল, “ফাঁসী হইবে না—ফাঁসী স্থগিত হইয়াছে।” কেহই কিছু বুঝিতে না পারিয়া যে যাহার গৃহাভিমুখে প্রস্থান করিতে লাগিল। 

রামকান্ত বলিল, “ব্যাপার কি! তবে কি গুরুদেব কার্য্যেদ্ধার করিয়াছেন?” 

শ্যামকান্ত বলিলেন, “আগেই ত বলিয়াছিলাম—চল, গুরুদেবের সঙ্গে দেখা হইলেই সকল জানিতে পারিব।” 

৪৬

প্রকৃতই সুরেন্দ্রনাথের ফাঁসী হইল না। এদিকে গোবিন্দরাম ট্রেন না পাইয়া বিশেষ চেষ্টায় তৎক্ষণাৎ একখানা গাড়ী সংগ্রহ করিয়া তীরবেগে কলিকাতার দিকে ছুটিলেন। 

ভোর হইবার কিঞ্চিৎ পূৰ্ব্বে কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সঙ্গে হাবা ও সেই ব্রাহ্মণ। 

তিনি তৎক্ষণাৎ পুলিসের বড় সাহেবের সহিত দেখা করিলেন। সাহেবকে অধিক কিছু বলিতে হইল না। সাহেব হাবাকে দেখিয়াই সকল ব্যাপার বুঝিতে পারিলেন; অধিকন্তু বিনোদিনীর দাসীর সেই আত্ম-কাহিনীতে প্রায় সকল তথ্যই আবিস্কৃত হইয়া পড়িল; তখন সাহেব ঝটিতে গোবিন্দরাম হাবা ও ব্রাহ্মণকে লইয়া উচ্চ কর্ম্মচারিগণের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন; তৎপরে ফাঁসী হইবার একটু আগেই জেলে আসিয়া ফাঁসী স্থগিত করিলেন। ফাঁসী হইল না বটে, তবে সুরেন্দ্রনাথকে আরও কয়েকদিন জেলে থাকিতে হইয়াছিল। 

কৃতান্ত সম্বন্ধে অনুসন্ধান আরম্ভ হইল। মাতাল শ্যামসুন্দরকে হাত করিয়া কৃতান্ত নরেন্দ্রভূষণের সমস্ত অর্থ যে একা আত্মসাৎ করিবার চেষ্টায় ছিল, তাহার অনেক প্রমাণ পাওয়া গেল। 

নরেন্দ্রভূষণবাবুর চারি ভগিনীর চারি ওয়ারিসান ছিল, প্রথম শ্যামসুন্দর—দ্বিতীয় সুহাসিনী—তৃতীয় লীলা—চতুর্থ বিনোদিনী। 

শেষের তিনজনকে সরাইতে পারিলেই সমস্ত টাকা শ্যামসুন্দর পায়—শ্যামসুন্দর পাইলেই কৃতান্তের হইবে; মাতালের নিকট হইতে আত্মসাৎ করিতে কতক্ষণ—একটা নাম সহি করিয়া লইতে পারিলেই হইল। বিনোদিনী খুন হইয়াছিল, কৃতান্তই যে তাহাকে খুন করিয়াছিল, তাহা হাবাও স্বীকার করিল। হাবা এখন ইঙ্গিতে মনোভাব প্রকাশ করিবার ক্ষমতা লাভ করিয়াছে। 

কৃতান্তই যে হাবাকে রামকান্ত বা শ্যামকান্তরে চক্ষে ধূলা দিয়া লইয়া গিয়াছিল, তাহাও হাবা স্বীকার করিল। সুহাসিনী ও লীলাকে হত্যা করিবার জন্য সে যাহা করিয়াছিল, তাহারও সমস্ত প্রমাণ পরে পাওয়া গেল। 

তাহারা সকলে এক সঙ্গে অগ্নিতে পুড়িয়া না মরিলে কৃতান্তের যে ফাঁসী হইত, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। যাহা হউক, ভগবান স্বয়ং তাহাদের দন্ড দিয়াছেন, তাহাদের আর মাননীয় বিচারালয়ে নীত হইতে হয় নাই। যথা সময়ে সুরেন্দ্রনাথ জেল হইতে খালাস হইয়া পিতৃচরণে প্রমাণ করিলেন। বৃদ্ধ গোবিন্দরামের দুই চক্ষু আনন্দাশ্রুতে পূর্ণ হইয়া গেল। 


***

আমাদের কি বলিতে হইবে যে, নরেন্দ্রভূষণের সমস্ত টাকা—প্রায় আট লক্ষ টাকা দুই সমভাগে বিভক্ত হইল? একাংশ সুহাসিনী পাইল—অপরাংশ লীলা পাইল। 

গোপাল কন্যাকে লইয়া কলিকাতায় আসিয়া বড়লোকের মত বাস করিতে লাগিল। সে যথাসময়ে বড় ঘরে সুপাত্র দেখিয়া তাহার বিবাহ দিল। 

সুহাসিনীর সহিত যে সুরেন্দ্রনাথের বিবাহ হইল, একথা বলা বাহুল্য মাত্র। সুরেন্দ্রনাথের ওকালতীতে এখন খুব পশার হইয়াছে। 

গোবিন্দরাম যথাসময়ে পৌত্র পৌত্রার মুখ দেখিয়া, তাহাদের ঘাড়ে-পঠে করিয়া সুখী হইলেন। 

শ্যামকান্ত ও রামকান্ত চিরকাল তাঁহার অনুগত থাকিল। উভয়েই চাকরী পরিত্যাগ করিয়া গোবিন্দরামের কৃপায় সুখে স্বচ্ছন্দে দিনযাপন করিতে লাগিল। এ সংসারে পাপীর প্রাবল্য ও সাফল্য প্রথমে দেখিতে পাইলেও কখনও চিরকাল থাকে না; অবশেষে ধর্ম্মের জয় হয়। 

কে খুন করিল, আর কে সেইজন্য কত সহ্য করিল! কিন্তু সুরেন্দ্রনাথ এত কষ্ট না করিলে অবশেষে এত সুখী হইতে পারিতেন না। 

দুঃখ ব্যতীত সুখস্বাদ হয় না। 

সুখস্যনন্তরং দুঃখং দুঃখস্যনন্তরং সুখং।
চক্রবৎ পরিবর্তন্তে দুঃখানি চ সুখানি চ।। 

সমাপ্ত।