প্রতীজ্ঞা পালন – ৪০

৪০ 

যথা সময়ে গোবিন্দরাম গঙ্গার ঘাটে আসিলেন। তখন সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে, কিন্তু রামকান্তের এখনও দেখা নাই। অনেক রাত্রি পর্য্যন্ত গোবিন্দরাম ঘাটে অপেক্ষা করিলেন 

কিন্তু রামকান্ত আসিল না। কে জানে; সে কেন এত বিলম্ব করিতেছে? গোবিন্দরাম বড়ই ভাবিত হইলেন; নিশ্চিত বুঝিলেন যে, তাহার কোন বিপদ ঘটিয়াছে, নতুবা রামকান্ত যে তাঁহার সহিত দেখা করিবে না, ইহা কখনই হইতে পারে না। 

গোবিন্দরাম চিন্তিত ও উৎকণ্ঠিত হৃদয়ে বাসায় ফিরিলেন। স্বয়ং রামকান্তের অনুসন্ধান করিলে লোকে সন্দেহ করিবে, সমস্ত কাজও পন্ড হইতে পারে, এই ভাবিয়া তিনি সেই রাত্রেই শ্যামকান্তের সহিত দেখা করিয়া তাহাকে সমুদয় বুঝাইয়া বলিলেন, তাহার পর তাহাকে রামকান্তের অনুসন্ধানে সোদপুর প্রেরণ করিলেন। 

তাঁহার তাড়াতাড়ি কলিকাতায় আসিবার আরও একটা বিশেষ কারণ ছিল। পরদিন তাঁহার সহিত কৃতান্তের দেখা করিবার কথা ছিল—গঙ্গার ধারে সেই বাগান বাড়ীতে মাতালের সহিত কথা কহিয়া তাঁহার সন্দেহ বিশ্বাসে পরিণত হইয়াছিল। তাহাই তিনি এখন কৃতান্তের সহিত দেখা করিবার জন্য ব্যগ্র হইলেন। 

তিনি রাত্রেই কলুটোলার বাড়ীতে আসিয়া নবাব সাজিলেন। প্রাতেই ঘনশ্যামের আসিবার কথা ছিল, ঘনশ্যামই যে কৃতান্ত, এ বিষয়ে তাঁহার আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। 

অতি প্রাতে ঘনশ্যাম উপস্থিত হইলেন; নবাব তাঁহাকে বিশেষ সমাদর করিয়া বসাইলেন। তৎপরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তাঁহার পর—কতদূর কি করিলেন?”

ঘনশ্যাম বলিলেন, “আপনার কার্য্যেদ্ধার করিয়াছি। নরেন্দ্রভূষণ বাবুর ওয়ারিসানের সন্ধান পাইয়াছি।”

“ওয়ারিসান কেবল একজনই আছেন?” 

“কেবল একজনই আছেন, বলিয়াই ত এখন জানিতে পারিয়াছি—অন্যান্য সকলে জীবিত নাই।”

“ইনি কে? কোথায় আছেন?” 

“ইনি কলিকাতায় নিকটেই আছেন।” 

“কোথায় আছেন?” 

“সোদপুর—গঙ্গার উপরে এক বাগান বাড়ীতে থাকেন। ইহার নাম শ্যমসুন্দর, ইনি নরেন্দ্রভূষণবাবুর জ্যেষ্ঠা ভগিনীর দৌহিত্র।” 

গোবিন্দরাম মনে মনে বলিলেন, “তবে আমার ভুল হয় নাই—এই অপদার্থটাকে হাত করিয়া দূরাত্মা সমস্ত টাকা নিজেই আত্মসাৎ করিবার চেষ্টায় আছে।” পরে প্রকাশ্যে গম্ভীরভাবে বলিলেন, “তাহা হইলে নরেন্দ্রভূষণবাবুর ইনিই একমাত্র ওয়ারিসান—আর কেহ নাই। ইহাকে এ সম্পত্তির কথা বা আমার কথা বলিয়াছেন?” 

“না, এখনও কিছু বলি নাই।” 

“তবে আর ইহাকে বলিতে বিলম্ব করা কর্ত্তব্য নয়। আমিও যে তাঁহাকে যথেষ্টে টাকা দিব, তাহাও বলিবেন; তবে নরেন্দ্রভূষণবাবুর আরও ওয়ারিসান থাকিলে আম আরও সন্তুষ্ট হইতাম।” 

“আমি কাল ইহাকে আপনার কাছে লইয়া আসিব।” 

“তাহা হইলে আপনি আজই সোদপুরে যাইতেছিনা?” 

“হাঁ, আজ বৈকালে গিয়া তাঁহাকে সকল কথা বলিব, কাল সঙ্গে করিয়া আনিব।” 

এই সময়ে তথায় আর এক ব্যক্তি উপস্থিত হইল। তাহার ছদ্মবেশ সত্ত্বেও গোবিন্দরাম তাহাকে দেখিবামাত্র চিনিলেন, সে রামকান্ত। ঘনশ্যামবেশী কৃতান্ত তাহাকে চিনিল কি না, তাহা গোবিন্দরাম বুঝিতে পারিলেন না। কৃতান্তও উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন, নবাব সাহেবকে সেলাম করিয়া সহাস্য বদনে বিদায় হইলেন। 

তিনি গৃহ হইতে বাহির হইতে না হইতে রামকান্ত বলিয়া উঠিল “ওকে যেতে দেবেন না।” গোবিন্দরাম বলিলেন, “এখনও সময় হয় নাই—কাল সকলে জালে পড়িবে।” 

“আপনি জানেন না, সব কথা—এলোক কাল সুহাসিনী, লীলা আর আমাকে তিনজনকেই ডুবাইয়া মারিবার চেষ্টা করিয়াছিল। ভগবানই অমাদের রক্ষা করিয়াছেন।” 

“সে কি? সব বল।” 

রামকান্ত বলিতে লাগিল—গোবিন্দরাম কিয়দংশ শুনিয়া বলিলেন, “ইহারা তোমাদের আটকাইয়া রাখিয়াছিলেন কেন? লীলা ও সুহাসিনী জীবিত থাকিলে ত ইহাদের উদ্দেশ্য পূর্ণ হইত না।” 

“জীবিত থাকিত না—জলে ডুবিয়া মরিত; তাহার পর রাত্রে মৃতদেহ দুইটা রেল লাইনে ফেলিয়া আসিত।” 

“যাহা হউক, এখন তাহারা কোথায়?” 

“আমি তাহাদের সঙ্গে করিয়া আনিয়া, তাহাদের বরাহনগরে রাখিয়া আসিয়াছি।’ 

“কিরূপে বাহির হইলে?” 

“জলে ঘর পূর্ণ হইলে সাঁতরাইয়া জানালা দিয়া বাহির হইয়া আসিলাম। একেবারে গঙ্গার আসিয়া পড়িলাম, সাঁতরাইয়া তীরে উঠিয়া একেবারে বরাহনগরে—বেটারা এতক্ষণে জানিতে পারিয়াছে—আপনি ইহাকে ছাড়িয়া দিয়া ভাল করিলেন না।’ 

“কাল ইহাদের সদলে ধরিব। এখন প্রমাণ যথেষ্ট পাওয়া গিয়াছে, ইহারাই বিনোদিনীকে খুন করিয়াছে, ইহারাই লীলা ও সুহাসিনীকে খুন করিবার চেষ্টা করিয়াছিল, ইহারাই মাতালটার সঙ্গে মিলিয়া নরেন্দ্রভূষণের টাকা পাইবার চেষ্টা করিতেছে; এখন সুরেন্দ্র খালাস পাইবে, কালই ধরা পড়িবে।” 

“কৃতান্ত সেখানে গিয়া যখনই দেখিবে যে আমরা পলাইয়াছি, তখনই সে সদলে সরিয়া পড়িবে।”

“এ কথা ঠিক আমাদের আর দেরি করা উচিত নয়।” 

“তবে কি করিতে বলেন?” 

“চল—এখনই পুলিসকে সংবাদ দিয়া, সোদপুরে গিয়া ইহাদের গ্রেপ্তার করি। ইহারা পলাইলে সব কাজ পন্ড হইবে।” 

“তাই চলুন, আর দেরি করিবেন না।” 

তখন তাঁহারা উভয়ে ছদ্মবেশ পরিত্যাগ করিয়া লালবাজারের পুলিস-আফিসের দিকে চলিলেন। তথায় আসিয়া বড় সাহেবের সহিত দেখা করিলেন। 

সাহেব সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিলেন, “আপনি এখানে!”

গোবিন্দরাম বলিলেন, “হাঁ, আমি রামকান্তকে সঙ্গে আনিয়াছি।” 

“আপনি জানেন যে পুলিস আপনাদের দুইজনকেই অনুসন্ধান করিতেছে?” 

“হাঁ জানি, আপনি সকল শুনিলে আর এ কথা বলিতেন না। আমার পুত্র যে নির্দোষী, তাহা আমি প্রমাণ করিতে আসিয়াছি।” 

সাহেব কিয়ৎক্ষণ বিস্মিতভাবে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। গোবিন্দরাম বলিলেন, “আপনি মনে করিতেছেন যে, এখন প্রমাণ প্রয়োগ বৃথা 

“হাঁ, পরশু ফাঁসী হইবে।” 

“তাহাও জানি, কালই খুনিদের ধরাইয়া দিব—সেইজন্য আপনার কাছে আসয়াছি। সহজ লোকের সহিত কাজ নহে, তাহাই এতদিন কিছু করিতে পারি নাই।” 

“সহজ লোক নহে—কে সে?” 

“নিজে কৃতান্ত।” 

সাহবে মৃদুহাস্যা করিলেন; তৎপরে ধীরে ধীরে বলিলেন, “আমি জানিতাম, আপনি কৃতান্তের স্কন্ধেই এ খুনে দায়ে চাপাইবেন—আপনি আমাদের পুরাতন কৰ্ম্মচারী, সুতরাং আপনার ত্রুটি ধরিব না। আপনি কি করিয়াছেন, কি না করিয়াছেন, সব আমরা জানি।” 

গোবিন্দরাম বিস্মিতভাবে বলিলেন, “আপনারা জানেন! কি জানেন?” 

“এই নবাব প্রভৃতি সাজিবার কথা।” 

“হাঁ, তাহা ত ছেলেকে নিদোষী সপ্রমাণ করিবার জন্য?” 

“আপনি কৃতান্তের প্রতি যেরূপ দৃষ্টি রাখিয়াছিলেন, তাহাও আমরা সব জানি।” 

“আপনি তাহাকে সাবধান করিয়া দেন নাই?” 

“আমরা আপনার শত্রু নই।” 

“আমি আপনার নিকটে বিশেষ কৃতজ্ঞ রহিলাম।” 

“দুঃখের বিষয়, আপনি এত করিয়াও পুত্রকে রক্ষা করিতে পারিলেন না।” 

“আমি তাহাকে রক্ষা করিয়াছি। আমি সপ্রমাণ করিব যে, কৃতান্তই সেই স্ত্রীলোককে—বিনোদিনীকে খুন করিয়াছে।” 

“বলুন সব শুনি।” 

“সংক্ষেপেই আপনাকে সব বলিতেছি। আপনি জানেন যে, কৃতান্ত কোন সম্পত্তির এক ওয়ারিসানের অনুসন্ধান করিতেছিল।” 

“হাঁ, নরেন্দ্রভূষণ বাবুর সম্পত্তি। এ বিষয়ে সে কিছুই গোপন করে নাই, সম্প্রতি সে আমাকে বলিয়াছে যে, একজন ওয়ারিসানকে খুঁজিয়া বাহির করিয়াছে।” 

সে তাহাকে অনেকদিন পাইয়াছে, তাহাকে হাত করিয়া এ সম্পত্তি নিজে গ্রাস করিবার চেষ্টায় ছিল। নরেন্দ্রভূষণের আরও তিনজন ওয়ারিসান আছে,তাহার মধ্যে একজন এখন আর নাই। সে বিনোদিনী— তাহাকে কৃতান্ত খুন করিয়াছে।” 

“কি! এই বিনোদিনী নরেন্দ্রভূষণের ওয়ারিসান?” 

“হাঁ, আরও দুইজন আছে—ইহাদের তিনজনকে হত্যা করিয়া কৃতান্ত সমস্ত টাকা গ্রাস করিবার চেষ্টায় ছিল। তাহার পর অন্য ওয়ারিসান বরাহনগরে, নাম সুহাসিনী—যাহার সহিত আমার পুত্রের বিবাহ স্থির হইয়াছে।” 

“এ সকল আপনি প্রমাণ করিতে পারিবেন?” 

“প্রমাণ সংগ্রহ না হইলে এ সকল কথা আপনাকে বলিতাম না।”

“অন্য ওয়ারিসান কে?” 

“চন্দননগরের পয়েন্টম্যান গোপালের কন্যা লীলা।” 

“লীলা! যে লীলা চুরি গিয়াছে?” 

“হাঁ, কৃতান্তই তাহাকে লইয়া গিয়াছিল, একবার চন্দনগরে রেল লাইনে টাকা ছড়াইয়া ইহাকে হত্যা করিবার চেষ্টা করিয়াছিল, আর একবার দমদমায় ইহাকে চুরি করিবার চেষ্টা সফল হয় নাই, তাহার পর ইহাকে চুরি করিয়া লইয়া গিয়া সোদপুরের বাগানে আটকাইয়া রাখিয়াছিল।” 

“ইহা কি সব সত্য?” 

“প্রমাণ না পাইলে আপনাকে বলিতাম না। কৃতান্ত সুহাসিনীকেও চুরি করিয়া সেইখানে লইয়া গিয়াছিল। দুইজনকেই ডুবাইয়া মারিবার চেষ্টায় ছিল, কেবল রামকান্তই তাহাদিগকে রক্ষা করিয়াছে। এই বাড়ীতেই নরেন্দ্রভূষণের ওয়ারিসান শ্যামসুন্দরকে রাখিয়াছে, সে অপদার্থ—মাতাল—কৃতান্তের হাতের পুতুল।” 

“প্রমাণের কথা বলুন।” 

“সুহাসিনী ও লীলাকে ডাকিয়া পাঠান। এই শ্যামসুন্দরকে গ্রেপ্তার করিয়া আনুন। আমার বিশ্বাস, এই বাড়ীতে বিনোদিনীর সেই নিরুদ্দিষ্টা দাসীও থাকে, সে-ও ধরা পড়িবে।” 

রামকান্ত বলিল, “এখানে একটা স্ত্রীলোক ও একটা পুরুষ আছে, ইহারা এই বাড়ীর দাসদাসী—ইহারাই সুহাসিনী আর লীলাকে খুন করিবার চেষ্টা করিয়াছিল। আমার দফাও প্রায় রফা করেছিল, অনেক কষ্টে রক্ষা পাইয়াছি।” 

বড় সাহেব চিন্তিতভাবে গোবিন্দরামকে বলিলেন, “আ পনার কথা অবিশ্বাস করিতে চাহি না, নিশ্চয়ই আপনি প্রমাণ পাইয়াছেন।” 

গোবিন্দরাম সগর্ব্বে বলিলেন, “ইহারা ধরা পড়িলে আপনিও সকল প্রমাণ পাইবেন।” 

“আচ্ছা, আপনার কথায় নির্ভর করিয়া ইহাদের গ্রেপ্তারের বন্দোবস্ত করিতেছি—তবে আপনি কি একবার আপনার পুত্রের সহিত দেখা করিতে চাহেন?”

“দেখা করিতে চাহি, এ কথা আপনি জিজ্ঞাসা করিতেছেন? ইহাদের ধরিয়া আনি, তাহার পর দেখা করিব—তাহাকে খালাস করিব।” 

সাহেব বলিলেন, “বরং এখন একবার দেখা করিবেন চলুন।” 

৪১ 

গোবিন্দরাম পুত্রের সহিত দেখা করিবার জন্য ব্যাকুল হইয়াছিলেন, সেইজন্য এ প্রস্তাবে আপত্তি করিতেন না। দুই-এক ঘন্টা দেরিতে কৃতান্ত এ তাহার দল তাঁহার হাত হইতে পলাইতে পারিবে না; বিশেষতঃ শ্যামকান্তকে তাহাদের পাহারায় পাঠাইয়াছেন, তবুও আবার তৎক্ষণাৎ রামকান্তকে সোদপুরের পাঠাইলেন। তাহাকে বলিয়া দিলেন, জেল হইতে ফিরিয়া তিনি সাহেবের সহিত যত শীঘ্র পারেন, সোদপুরে উপস্থিত হইবেন। 

গোবিন্দরাম সাহেবের সহিত জেলে আসিলেন। ফাঁসীর আসামীদিগের ঘর জেলের একপার্শ্বে স্থাপিত সেইদিকে আসিয়া সাহেব বলিলেন, “যদি ইচ্ছা করেন, আপনি একাকী দেখা করিতে পারেন—তবে দেখিবেন—” 

গোবিন্দরাম বাধা দিয়া বলিয়া উঠিলেন, “ন—ন—আপনিও ‘থাকিবেন, আমি জানি, সে নিৰ্দ্দোষী; সুতরাং আমি কোন ভয় করি না।”

সাহেব কোন কথা না কহিয়া সঙ্গে সঙ্গে চলিলেন। যে প্রকোষ্ঠে সুরেন্দ্রনাথ অবরুদ্ধ ছিলেন, একজন প্রহরী তাহার লৌহদ্বার সশব্দে খুলিয়া দিল। গোবিন্দরাম দেখিলেন, হাতে হাত-কড়ী ও পায়ে বেড়ী পরিয়া সুরেন্দ্রনাথ বিমর্ষ ভাবে এক কোণে নীরবে বসিয়া আছেন। 

সুরেন্দনাথ পিতাকে দেখিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। তাঁহাকে এ অবস্থায় দেখিয়া গোবিন্দরাম অশ্রুজল সম্বরণ করিতে পারিলেন না; কিন্তু সুরেন্দ্রর চোখে জল নাই। 

গোবিন্দরাম বলিলেন, “আমি তোমাকে রক্ষা করিতে আসিয়াছি। আজ তুমি নিদোষী সপ্রমাণ হইবে।”

সুরেন্দ্রনাথ রুদ্ধকন্ঠে বলিলেন, “বাবা আমি ত নিদোষী ন‍ই।” 

গোবিন্দরাম ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “এ কথা বলিয়ো না, আমি বিনোদিনীর খুনীকে বাহির করিয়াছি, সে তোমার সর্ব্বনাশ করিবার জন্য যথাসাধ্য করিয়াছে, সে আর কেহ নহে—সে কৃতান্ত।” 

“হাঁ, কৃতান্ত—কৃতান্তই বিনোদিনীকে জানিত।” 

এই কথা শুনিয়া সাহেব, সুরেন্দ্রনাথের নিকটস্থ হইলেন। তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া সুরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আমি মরিতে প্রস্তুত হইয়াছি, সুতরাং সমস্ত কথা এখন বলিতে পারি।” তৎপরে তিনি পিতার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “সকল শুনিলে হয় ত আপনি আমার এই মৃত্যুকালে আমাকে ক্ষমা করিতে পারেন।” 

গোবিন্দরাম ব্যাকুলভাবে বলিলেন, “তবে কি আমারই ভুল?” 

সুরেন্দ্র দৃঢ়ভাবে বলিলেন, আমি অনেক দূর পর্য্যন্ত মিথ্যাকথা বলিয়াছি, আর বলিব না, সকল কথা আজ আপনাদের খুলিয়া বলিব। আমিই খুনের পরদিন রাত্রে বাগবাজারে বাড়ীতে গিয়াছিলাম, বিনোদিনীর ছবি সে নিজে আমাকে দিয়াছিল, তবে সে যে খুন হইয়াছে, আমি তখনও জানিতাম না।” 

গোবিন্দরাম ব্যগ্রভাবে বলিয়া উঠিলেন, “তাহা হইলে আমি ঠিক জানি তুমি তাহাকে খুন কর নাই।”

সুরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আমি ছেলেবেলায় এক সময়ে এই বিনোদিনীকে চিনিতাম—তাহার পর তাহার কথা ভুলিয়া গিয়াছিলাম, সে সুমাধব রায়ের রক্ষিতা হইয়াছিল। আমার সঙ্গে ইহার অনেক কাল দেখা-সাক্ষাৎ হয় নাই। কয়েক মাস হইল, হঠাৎ একদিন ইহার সহিত আমার দেখা হয়, আমি পলাইতেছিলাম, কিন্তু ইহার কাকুতি-মিনতিতে ইহার বাড়ীতে গেলাম। তখন শুনিলাম, যদিও এ সুমাধব রায়ের আশ্রয়ে আছে, তবুও একজন তাহার উপরে বড় অত্যাচার করিতেছে। তাহার হাত হইতে তাহাকে রক্ষা করিবার জন্য সে আমাকে অনেক অনুনয়-বিনয় করিল।” 

গোবিন্দরাম বলিলেন, “আমরা জানিয়াছি, কেন সে খুন হইয়াছে?” 

সুরেন্দ্রনাথ বলিতে লাগিলেন, “আমি মধ্যে মধ্যে তাহার সিহত দেখা করিতে সম্মত হইলাম। মধ্যে মধ্যে তাহার কাকুতি-মিনতিপূর্ণ পত্র পাইয়া তাহার সঙ্গে বাধ্য হইয়া দেখা করিয়াছিলাম। এই সুমাধবও আমাকে দেখিতে পায়, ইহাতে সে ঈর্ষায় উন্মত্তপ্রায় হইয়াছিল, তবে আমাকে কিছু বলে নাই। একদিন বিনোদিনী আমাকে জোর করিয়া তাহার একখানা ছবি দিয়া বলিল, “আমি বেশীদিন বাঁচিব না, এখানা থাকিলে তবুও আমার কথা তোমার মনে পড়িবে।” আমি ছবিখানা পকেটে রাখিলাম। সেইদিন তাহার কাছে শুনিলাম যে, একটা লোক তাহাকে বহুদিন হইতে কষ্ট দিতেছে, এমন কি তাহাকে খুন করিবার ভয় দেখাইয়াছে।” 

গোবিন্দরাম জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই লোকটা কি বিনোদিনীর বাড়ীতে তোমায় দেখিয়াছিল?”

সুরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “দেখিয়াছিল কি না বলিতে পারিব না। তবে বিনোদিনীর দাসী ইহার করতলগত ছিল, সুতরাং সে নিশ্চয়ই তাহাকে আমার কথা বলিয়াছিল।” 

গোবিন্দরাম বলিলেন, “তাহা হইলে সে-ই বিনোদিনীকে খুন করিয়া তোমার স্কন্ধে দায় চাপাইবার জন্য সমস্ত আয়োজন করিয়াছিল?” 

সুরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “হাঁ, এই লোকই বিনোদিনীকে খুন করিয়াছিল।” 

গোবিন্দরাম, সাহেবের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “আপনি শুনিলেন।” 

সাহেব বলিলেন, “দুঃখের বিষয়, আদালেত এসব কথা কিছুই বল নাই—এ লোকটার নাম বোধ হয় তুমি শুনিয়া থাকিবে।” 

সুরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “হাঁ, ইহাকে কখনও দেখি নাই বটে, কিন্তু ইহার নাম বিনোদিনীর কাছে শুনিয়াছিলাম—ইহার নাম কৃতান্ত।”

গোবিন্দরাম সাহেবকে আবার সবেগে বলিয়া উঠিলেন, “শুনিলেন?” 

সুরেন্দ্রনাথ বিমর্ষভাবে বলিলেন, “আমি বিনোদিনীকে খুন করি নাই বটে—তথাপি আমি খুনী—আমি বাঁচিতে ইচ্ছা করি না।” 

গোবিন্দরাম এ সাহেব উভয়েই সমস্বরে বিস্মিত ভাবে বলিয়া উঠিলেন, “তুমি খুনী! তবে তুমি কাহাকে খুন করিয়াছ?” 

সুরেন্দ্রনাথ দৃঢ়স্বরে বলিলেন, “সুমাধব রায়কে।” 

৪২

সাাহেব বলিলেন, “ইহা খুন স্বীকার করা হইতেছে, আমি তোমাকে প্রথমেই সাবধান করিয়া দিতেছি।”

সুরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “সাবধান হইবার আবশ্যকতা নাই—আমি খুন করিয়াছি, সুতরাং আমি মরিতে প্ৰস্তুত আছি।” 

গোবিন্দরাম অস্পষ্টস্বরে বলিলেন, “তবে সত্যই।” 

সাহেব বলিলেন, “যদি ইচ্ছা কর কি ঘটিয়াছিল বলিতে পার।” 

সুরেন্দ্রনাথ বলিতে লাগিলেন, “আমি খুনের দিন প্রায়া রাত্রি দশটার সময়ে বিনোদিনীর সঙ্গে দেখা করিতে যাই—দেখি, তাহার বাড়ীর দরজা খোলা রহিয়াছে—ভিতর হইতে আলো দেখা যাইতেছে—আমি ভিতরে প্রবেশ করিয়া বসিবার গৃহে আসিয়া দেখিলাম, তথায় সুমাধব বসিয়া মদ খাইতেছে; সে আমাকে দেখিবামাত্র বাঘের মত লাফাইয়া আমাকে আক্রমন করিল—একখানা ছোরা বাহির করিয়া আমার বুকে বসাইতে চেষ্টা করিল। আমি দুৰ্ব্বল নহি, নতুবা সে আমাকে নিশ্চয়ই খুন করিত; আমি নিরুপায় হইয়া তাহাকে সবলে দূরে ঠেলিয়া দিলাম; তাহার মাথাটা সেইখানের এক পাথরের টেবিলে আঘাতিত হইল, টেবিল ও সে দুই-ই ভূমিসাৎ হইল। সে পড়িয়া আর নড়ে-চড়ে না দেখিয়া আমি তুলিতে গেলাম—কিন্তু আমি ভয়ে উর্দ্ধশ্বাসে তথা হইতে পলাইলাম।” 

সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিনোদিনীর সহিত দেখা করিলে না?”

সুরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “না, আমি সে বাড়ীতে আর এক মুহূর্তও ছিলাম না। সেদিন সে রাত্রিটা কিরুপে কাটিয়াছিলাম, তাহা অন্তর্যামী ভগবান জানেন। কতবার ভাবিলাম, হয় ত লোকটা মরে নাই, কেবল অজ্ঞান হইয়াছিল। সে বাঁচিয়া আছে কিনা, আর বিনোদিনীই বা কোথায়, ইহা জানিবার জন্য আমি পরদিন প্রায় বারটা রাত্রে সেই বাড়ীতে গেলাম, দেখি বাড়ীতে কেহ নাই—অথচ দরজা খোলা—আমি বিনোদিনীর শয়ন গৃহে গিয়া তাহাকে ডাকিলাম, তাহার পর যাহা হইয়াছিল, আপনারা সকলই জানেন।” 

সাহেব বলিলেন, “আদালতে এ সব কথা তোমার বলা উচিত ছিল; তুমি আত্মরক্ষা করিবার জন্য সুমাধবকে দূরে ফেলিয়া দিয়েছিলে, তাহাতে তাহার মাথায় আঘাত লাগিয়া তাহার মৃত্যু হইয়াছিল; এ অবস্থায় কখনই তোমার ফাঁসীর হুকুম হইত না।”

“আমিই তাহাকে খুন করিয়াছি, সুতরাং আমার দন্ড আমিই লইব; আমি কাহারও উপর দোষ দিই না; দোষ আমার অদৃষ্টের। সুহাদিনী ভাবিত আমি খুনী—”

গোবিন্দরাম বলিলেন, “সে এ কথা ভাবিত না—ইহারা তাহাকেও খুন করিবার চেষ্টা করিয়াছিল।” সুরেন্দ্রনাথ বলিয়া উঠিলেন, সে কি! তাহাকে খুন করিতে চাহিয়াছিল? সে কি কেন?” গোবিন্দরাম বলিলেন, “সে সব পরে বলিব, এখন তৎপর না হইলে বদমাইসগণকে গ্রেপ্তার করিতে পারিব না।”

সাহেবও এ প্রস্তাবে অনুমোদন করিলেন। তখন উভয়ে সত্বর জেল হইতে বাহিরে আসিলেন। 

বাহিরে আসিয়া গাড়ীতে উঠিয়া গোবিন্দরাম সাহেবকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখনও কি আপনি সুরেন্দ্রকে দোষী মনে করেন?” 

সাহেব বলিলেন, “আমার বিশ্বাস হইয়াছে, আপনার পুত্র স্ত্রীলোটিকে খুন করে নাই।” 

“তাহার পর অপরটি টেবিলে পড়িয়া মাথায় আঘাত লাগায় মরিয়াছে।” 

“সেটা প্রমাণ সাপেক্ষ।” 

“এ বিষয়ে সে মিথ্যাকথা বলিবে কেন?” 

“না বলাই সম্ভব, তবে এতদিন গোপন করাই সন্দেহজনক হইয়াছে।” 

“যাহা হউক, কৃতান্ত ও তাহার দল ধরা পড়িলেই আপনি সকল ব্যাপার জানিতে পারিবেন।”

“আপনি বলিতেছেন বটে তাহারাও আত্মসমর্পণ করিবে—সকল কথা অস্বীকার করিবে—তাহাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ চাহি—সেই হাবাকে পাওয়া যায় নাই—এ সমস্ত বিষয়ের জন্য সময় আবশ্যক।” 

“হাঁ, তাহা নিশ্চয়।” 

“তাহা হইলে সময় কোথায়? পরশ্বঃ সকালে ইহার ফাঁসী হইবে— ফাঁসী বন্ধ করিবার উপায় কি? “লাটসাহেবকে টেলিগ্রাফ করিলে হইতে পারে।” 

“প্রমাণ চাই—অনর্থক টেলিগ্রাফ করিলে কি ফল হইবে?” 

গোবিন্দরামের বুক দমিয়া গেল, তিনি হতাশভাবে বলিলেন, “তবে উপায়?” 

সাহেব বলিলেন, “আমার ক্ষমতায় যাহা সম্ভব, তাহা সমস্তই আপনার জন্য আমি করিতে প্রস্তুত আছি।” 

“আমি আজই কৃতান্তকে সদলে গ্রেপ্তার করিয়া আনিব।” 

“আমার কয়েকজন সুদক্ষ লোক আপনার সঙ্গে দিতেছি।” 

“তাহা হইলেই হইবে, ভগবান আমার সহায়।” 

“যান, ভগবান আপনার পুত্রকে রক্ষা করুন, ইহাতে আমরা বিশেষ সুখী হইব।” 

জেল হইতে ফিরিয়া পুলিসের লোক সংগ্রহ করিতে গোবিন্দরামের অনেক বিলম্ব হইয়া গেল। গোবিন্দরাম লোকজন লইয়া গাড়ী করিয়া সোদপুরের দিকে প্রস্থান করিলেন। সন্ধ্যার প্রাক্কালে তাঁহারা সকলে সেই বাগান-বাড়ীর নিকটবর্ত্তী হইলেন। 

৪৩

গোবিন্দরাম যাহা করিবেন, তাহা সমস্তই মনে মনে আগে স্থির করিয়াছিলেন, সুতরাং ভাঙা বাড়ীর নিকটে আসিয়া সেইরূপ কার্য্য আরম্ভ করিলেন। পুলিসের লোক দিয়া সর্ব্বাগ্রে বাড়ীটার চারিদিক ঘিরিয়া ফেলিলেন।শ্যামকান্ত ও রামকান্ত উভয়েই পূর্ব্ব হইতেই বাড়ীর পাহারায় ছিল, এক্ষণে তাহারা গোবিন্দরামকে দেখিয়া নিকটে আসিল। 

সেই বদজাত মাগীটা ছিল, যে ঘরের নীচেকার গহ্বরের রামকান্ত, লীলা ও সুহাসিনীকে ফেলিয়া দিয়াছিল, তাঁহারা প্রথমে সেই ঘরটা অনুসন্ধান করা আবশ্যক বিবেচনা করিলেন। 

এই ঘরটির পশ্চাতে—একটু দূরে অবস্থিত—সম্ভবতঃ পূৰ্ব্বে গোশালা ছিল। তাঁহারা এই গৃহে আসিলেন। ঘরের দ্বার খোলা ভিতরে কেহ নাই। 

তাহারা ঘরটি বিশেষরূপে দেখিয়া কোন কিছুই দেখিতে পাইলেন না। যে দ্বার দিয়া তাহারা রামকান্তকে ফেলিয়া দিয়াছিল, তাহা খোলা পড়িয়া আছে—লম্বা দড়ী ও কুয়া হইতে ঘটি তুলিবার একটা কাঁটা পড়িয়া আছে; উকি মারিয়া তাহারা দেখিলেন, ভিতরে জল নাই। 

তখন রামকান্ত বলিল, “যাহা ঘটিয়াছে, তাহা আমি স্পষ্ট বুঝিতে পারিতেছি; কৃতান্ত আপনার সহিত দেখা করিবার জন্য ঘনশ্যাম হইয়া কলিকাতায় গেলে, ইহারা আমাদের মৃতদেহ জল হইতে তুলিবার জন্য এই কাঁটা ফেলিয়াছিল, তাহার পর জল ভাটায় বাহির হইয়া গেলে এই অন্ধকূপের ভিতরে কিছুই দেখিতে না বুঝিয়াছে যে আমরা পলাইয়াছি; কৃতান্ত আসিয়া এ কথা শুনিয়াছে, সুতরাং সকলে তখনই অন্তর্হিত হইয়াছে; তবে আশ্চর্য্যের বিষয়, কিরূপে পলাইল, আমরা তাহার কিছুই জানিতে পারিলাম না।”

গোবিন্দরাম ক্ষুন্নমনে বলিলেন, “এই রকমই হইয়াছে, আর এখানে সময় নষ্ট করা বৃথা—বাড়ীটা দেখা যাক্।” 

তাহারা সত্বর সেই বাড়ীর দিকে চলিলেন। দরজা জানালা সমস্ত খোলা, এ বাড়ীতে কেহ আছে, তাহা বাহির হইতে বুঝিতে পারা যায় না। গোবিন্দরাম বলিলেন, “এত করিয়াও এই দুরাত্মাদের ধরিতে পারিলাম না।” 

সহসা একটা ঘরে ঢুকিয়া রামকান্ত একবার বিস্ময়সূচক শব্দ করিয়া উঠিল; সকলে “ব্যাপার কি! “ বলিয়া সেই দিকে ছুটিলেন। দেখিলেন, শ্যামসুন্দর ঘোর মাতাল অবস্থায় অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া আছে। 

তাহার নড়িবার বা উঠিবার ক্ষমতা নাই। ইহাকে দেখিয়া গোবিন্দরামের হৃদয় আনন্দে পূর্ণ হইল; তিনি বলিলেন, “অন্ততঃ একটাকে পাওয়া গিয়াছে—দেখা যাক্ ভগবান কি করেন?” 

এক ব্যক্তিকে শ্যামসুন্দরের পাহারায় রাখিয়া গোবিন্দরাম সদলে তখন সমস্ত ঘর অনুসন্ধান করিয়া উপরে চলিলেন। উপরের ঘরে কেহ নাই, ত্রিতলে আসিয়া দেখিলেন, সিঁড়ির ঘরের পার্শ্বে একটি ছোট ঘর আছে, স্পষ্টই বুঝিতে পারা যায়, এই ঘরে একটি স্ত্রীলোক থাকিত, তাহার চুল বাঁধিবার উপকরণাদি তখনও গৃহতলে এরূপভাবে পড়িয়া আছে যে দেখিয়া বোধ হয়, চুল বাঁধিতে-বাঁধিতেই সে পলাইয়াছে। 

রামকান্ত একখানা খাম তুলিয়া লইয়া বলিলেন, “এই ত কৃতান্তের নাম। 

প্রকৃতই এই খামের উপর কৃতান্তের নাম ঠিকানা ছিল। তাঁহারা সেই ঘনশ্যামের নামে লিখিত দুই-একখানা পত্রও পাইলেন। সেই পত্রে সে তাহাকে অনেক কাঁদাকাটি করিয়া তাহার প্রতি অত্যাচার করিতে নিষেধ করিয়াছে।” 

রামকান্ত বলিল, “আর প্রমাণ কি চাই—তবে পাখী উড়িয়া গিয়াছে।” 

গোবিন্দরাম বলিলেন, “নিশ্চয়ই বেশী দূর পলাইতে পারে নাই—ধরিতে হইবে।” 

“কলিকাতায় নিশ্চয় যায় নাই।” 

“স্টেশনে স্টেশনে এখনই টেলিগ্রাফ করিলে ধরা পড়িবে।” 

“তাহা হইলে আর দেরি করিবেন না।” 

“আমি হাবাটাকেই চাই, নিশ্চয় তাহাকেও তাহারা সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছে, অথবা কোথায় আটকাইয়া রাখিয়াছে—যাহা হউক, তুমি এখনই গিয়া সাহেবকে সংবাদ দাও, আমরা যাহা যাহা এখানে পাইয়াছি, সব তাঁহাকে বলিয়ো, যাহাতে ফাঁসী স্থগিত থাকে, তাহা করিতে যেন তিনি ত্রুটি করেন না—একদিন ফাঁসী স্থগিত থাকিলে আমি নিশ্চয়ই সুরেনকে রক্ষা করিতে পারিব।” 

রামকান্ত বলিল, “আমি এখনই চলিলাম–এ অবস্থায় নিশ্চয়ই ফাঁসী স্থগিত থাকিবে।” 

গোবিন্দরাম এখন স্পষ্টই বুঝিলেন, কৃতাত্ত পলাইয়াছে—সে যেরূপ ধূর্ত্ত তাহাকে ধরা সহজ হইবে না, অথচ আর সময় নাই—একদিন মাত্র, একদিনের মধ্যে সে কি ধরা পড়িবে? 

তিনি বাড়ীতে পাহারা রাখিয়া বাহিরে আসিলেন। সহসা দূরে এক ব্যক্তির উপর তাঁহার দৃষ্টি পড়িল—এই লোকটিকে তিনি সেদিন গঙ্গাতীরে একটি যুবকের সহিত মন্দিরে প্রবেশ করিতে দেখিয়াছিলেন—সেইদিন হইতে ইহার উপর তাঁহার একটু সন্দেহ হইয়াছিল, লোকটির আকৃতি ব্রাহ্মণ পন্ডিতের মত। 

তাঁহাকে দেখিবামাত্র গোবিন্দরাম ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটিয়া তাঁহার নিকটস্থ হইলেন; বলিলেন, “মহাশয় কি একটি যুবকের সঙ্গে ঐ মন্দিরে পার্শ্বে গিয়াছিলেন?” 

“হাঁ, কেন বলুন দেখি।” 

“আমার ছেলের জীবন আপনার কথার উপর নির্ভর করিতেছে।”

“সে কি—আপনি বলেন কি।” 

“সে লোকটি কে?” 

“একজন হাবা লোক।” 

গোবিন্দরাম আনন্দে রুদ্ধপ্রায় কন্ঠে বলিলেন, “আমিও তাহাই ভাবিয়াছিলাম।” 

ব্রাহ্মণটি গোবিন্দরামকে পাগল স্থির করিয়া মৃদু হাসিয়া চলিয়া যাইতেছিলেন; কিন্তু গোবিন্দরাম তাঁহার পথরোধ করিয়া দাঁড়াইলেন; বলিলেন, “মহাশয় আমাকে পাগল ভাবিতেছেন, আমি পাগল নই—ঐ হাবা লোকটির উপরে আমার ছেলের জীবন নির্ভর করিতেছে।” 

“আমি আপনার কথা কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না।”

“উহার বিষয়ে আপনি কি জানেন?” 

“এই জানি যে, সে আমার কাছে কথা কহিতে ও লিখিতে শিখিতেছে। আমি হাবাদিগকে শিখাইতে জানি।” 

“কোথায় ইহার বাড়ী?” 

“ঐ বাগানে যে বাবুটি থাকিতেন, তাঁহারই লোক; কিন্তু আমার তারি অনুগত, আমি দয়া করিয়া তাহাকে গোপনে ঐ মন্দিরে শিখাইতেছিলাম।” 

“কিছু শিখিয়াছে?” 

“অনেক—এখন মনের ভাব বেশ প্রকাশ করিতে পারে—আপনি এ সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন কেন?” 

“বাগবাজারে একটি স্ত্রীলোক খুন হইয়াছিল, একথা আপনি শুনিয়াছিলেন?” 

“হাঁ, একটি নয় দুটি।” 

“আপনি আরও শুনিয়া থাকিবেন, এই স্ত্রীলোকের মৃতদেহ এক হাবা লইয়া যাইতেছিল।”

“হাঁ, তাহাও শুনিয়াছিলাম বটে।” 

“সেই হাবা নিরুদ্দেশ হইয়াছে, তাহাকে পাইলে আসামীর দন্ড হইত না।” 

“আসামী কি আপনার কেহ হন?” 

“আমার ছেলে।” 

“হাঁ, আপনি এখন তাঁহার প্রাণরক্ষা করিতে পারেন।” 

“আমি? সে কি! আমি কি জানি?” 

“আপনাকে সকল কথা পরে বলিব, এ বাড়ীতে কৃতান্ত বলিয়া একটা লোক ছিল, সে-ই স্ত্রীলোকটিকে খুন করে; আপনি যে হাবাকে শিখাইতেছেন, সেই হাবাই মৃতদেহটা লইয়া যাইতেছিল।” 

“আপনি বলেন কি! আমি কখনও ইহা সন্দেহ করি নাই।” 

“আর একদিনের মধ্যে ইহাদিগকে ধরিতে না পারিলে আমার ছেলের ফাঁসী হইবে–এখন এই হাবা কোথায়, আমায় শীঘ্রই বলুন।” 

“এই বাড়ীতে যাঁহারা ছিলেন, তাঁহারা আজ চলিয়া গিয়াছেন—বোধ হয়, সে হাবাও তাঁহাদের সঙ্গে গিয়াছে; তবে সে আমার যেরূপ অনুগত, আমার কাছে বিদায় না লইলে যাইবে না। কাল আমাকে বলিয়াছিল যে, রাত্রে তাঁহারা রওনা হইবেন; তাহা হইলে বোধ হয়, এখানে কোথায় গিয়াছে—এখনই আসিবে।” 

“তাহা হইলে আপনি মনে করেন, সে নিশ্চয়ই একবার আসিবে?” 

“অমার সঙ্গে দেখা না করিয়া যাইবে না। আমি তাহার সঙ্গে দেখা করিবার জন্যই এদিকে এখন আসিয়াছি।” 

এই সময়ে একজন পাহারাওয়ালা আসিয়া বলিল, “তিনজন পুরুষ ও দুইজন স্ত্রীলোক বাড়ীটার ভিতরে প্রবেশ করিয়াছে।” 

গোবিন্দরাম বলিয়া উঠিলেন, “তাহারা ত তোমাদের দেখিতে পায় নাই?” 

“না, আমরা সকলেই ঝোপের আড়ালে লুকাইয়া আছি।” 

“বেশ, খুব সাবধান—আমি এখনই যাইতেছি।” 

পাহারাওয়ালেক বিদায় করিয়া দিয়া গৌীবন্দরাম ব্রাহ্মণের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “আপনিই এখন আমার ছেলের প্রাণরক্ষা করিতে পারেন।” 

“কিরূপে বলুন।” 

“আপনি হাবাকে জিজ্ঞাসা করিলে সে নিশ্চয়ই আপনাকে সকল কথা বলিবে—আপনার সাক্ষ্যই আমার ছেলে রক্ষা পাইবে।” 

“এরূপ ব্যাপারে আমার অসম্মত হওয়া পাপ–আপনি বলিলে আমি সাক্ষ্য দিব।” 

“আপনাকে আজই আমার সঙ্গে যাইতে হইবে।” 

“যখন বলিবেন, তখনই যাইব—আমার দ্বারা যদি একজনের প্রাণরক্ষা হয়।” 

“চিরকালের জন্য আপনার কেনা হইয়া রহিলাম।” 

ব্রাহ্মণের ঠিকানা জানিয়া লইয়া গোবিন্দরাম পুলিস-কৰ্ম্মচারিদিগের কাছে গেলেন। তাহাদিগকে বলিলেন, “আমরা ভাবিয়াছিলাম, দুরাত্মারা পলাইয়াছে; তাহা নহে, পাঁচজন বাড়ীতে প্রবেশ করিয়াছে, একজন সেই মাগী—দ্বিতীয় বিনোদিনীর ঝি—অপর দুইজন কৃতান্তের অনুচর—আর অপর স্বয়ং কৃতান্ত। ইহাদিগকে গ্রেপ্তার করিতে হইবে–এখন হইতে সকলের প্রস্তুত হওয়া আবশ্যক; এরূপ লোক সহজে ধরা দিবে বলে বোধ হয় না।” 

তখন বেশ রাত্রি হইয়াছে, চারিদিকে অন্ধকারে পূর্ণ হইয়াছে সহসা কি এক আলোকে চারিদিক উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল—সকলে বলিয়া উঠিলেন, “আগুন—বাড়ীতে আগুন লাগিয়াছে।” 

গোবিন্দরাম বলিলেন, “মাতালটা বাড়ীতে আগুন লাগাইয়া দিয়াছে—চল—শীঘ্র চল।” 

একজন বলিল, “কাঠের সিঁড়ীতে আগুন ধরিয়াছে—আর সিঁড়ী নাই—জানালা দিয়া লাফাইয়া না পড়িলে পুড়িয়া ছাই হইবে।” 

গোবিন্দরাম বলিলেন, “যেমন করিয়া হয়, ইহাদিগকে রক্ষা করিতে হইবে।” 

৪৪

গৃহমধ্যে হইতে পুনঃ পুনঃ স্ত্রীলোকের আর্তনাদ ধ্বনি উঠিতে লাগিল। এমন সময়ে উপরের একটা জানালা সহসা খুলিয়া ফেলিল—সে স্বয়ং কৃতান্ত। কৃতান্ত বাড়ীর চারিদিকে পুলিস দেখিতে পাইয়া সেইখান হইতে ব্যাঘ্রের ন্যায় গৰ্জ্জন করিয়া উঠিল। 

গোবিন্দরাম চিৎকার করিয়া বলিলেন, “লাফ দাও—লাফ দাও—আমার লোকে তোমার ধরিবে।” কৃতান্ত গোবিন্দরামকে চিনিয়া বলিল, “ও! তুই—তুই সেই বুড়ো বদমাইস, আমার কাজ শেষ হইয়াছে, তোর ছেলেও কাল ভোরে ফাঁসী যাইবে।” সঙ্গে সঙ্গে পিস্তলের আওয়াজ হইল, একটি গুলি গোবিন্দরামের কানের পাশ দিয়া চলিয়া গেল। 

একজন লোক গোবিন্দরামকে বলিল, “সাবধান—আপনার মৃত্যু হইলে আপনার ছেলে বাঁচিবে না—কৃতান্ত পিস্তল ধরিয়াছে।” 

গোবিন্দরাম বৃক্ষান্তরালে দাঁড়াইলেন। বাড়ীটির দ্বিতলের মেঝে কাষ্ঠনির্মিত, সোপানশ্রেণীও কাষ্ঠনির্মিত, তা ছাড়া পুরাতন জানালা-দরজা, কড়ি-বরগা শুকাইয়া বারুদের ন্যায় হইয়াছিল—আগুন পাইয়া চারিদিক হইতে ধূ-ধূ করিয়া আগুন জ্বলিয়া উঠিল। এই বহা অগ্নিকান্ড হইতে কাহারও রক্ষা পাইবার সম্ভবনা নাই 

এই সময়ে একটি প্রৌঢ়া স্ত্রীলোক মহা আৰ্ত্তনাদ করিতে করিতে যে গবাক্ষে কৃতান্ত দাঁড়াইয়া রহিয়াছে, সেইদিকে ছুটিয়া আসিল এবং গবাক্ষ দিয়া লাফাইয়া পড়িবার উপক্রম করিল; কিন্তু কৃতান্তকুমার দুইহাতে সবেগে তাহাকে নিজের বুকের উপর জড়াইয়া ধরিল। স্ত্রীলোকটি আরও চিৎকার করিয়া উঠিল। কৃতান্তকুমার বিকট অট্টহাসি হাসিয়া বলিল, “কোথায় যাইবে, আমাকে ফেলিয়া কোথায় পলাইবে? সে উপায় নাই—এক যাত্রায় পৃথক ফল! কখনই তাহা হইবে না—আমি মরিব, তোমাকেও আমার সঙ্গে মরিতে হইবে।” কৃতান্ত কুমার তাহাকে সেইভাবে সবলে ধরিয়া রহিল। 

স্ত্রীলোকটি প্রাণভয়ে আরও চিৎকার করিতে লাগিল। বলিল, “ওগো, ছেড়ে দাও, আমি মরিতে রাজি আছি, কিন্তু এমন করিয়া জীবন্ত আগুনে জ্বলিয়া-পুড়িয়া মরিতে পারিব না—আগুন—আগুন—চারিদিকে আগুন–ধূ-ধূ-ধূ -” 

কৃতান্তকুমার বলিল, “আরে পোড়ামুখি! মরিতে ভয় পাইতেছিস—আমি পুড়িয়া মরিতে পারিব, আর তুই পারিবি না? আয়, তোর পোড়ামুখ আরও পুড়াইয়া দিই।” 

এই বলিয়া কৃতান্তকুমার বিকটহাস্যে চারিদিক প্রকম্পিত করিয়া সেই স্ত্রীলোকটিকে বুকে চাপিয়া পশ্চাদ্বর্ত্তী নিবিড় ধুম্র ও অগ্নিরাশির মধ্যে প্রবেশ করিল। আর তাহাদিগকে দেখা গেল না, ধূম্রাগ্নির বিচিত্র যবানিকার অন্তরাল হইতে কেবল সেই স্ত্রীলোকের আকুল আর্তনাদ ও কৃতান্তের বিকট অট্টহাস্য যুগপৎ ধ্বনিতঃ হইতে লাগিল। 

পরক্ষণে সেই স্ত্রীলোকটি চিৎকার করিতে করিতে আবার সেই উন্মুক্ত গবাক্ষের দিকে ছুটিয়া আসিল। তখন তাহার পরিহিত বস্ত্রাদিতে অগ্নিসংযোগ হইয়াছে, তাহার উন্মুক্ত কেশদামেও লেলিহান অগ্নি শিখা বিস্তার করিয়াছে—আর রক্ষা নাই—রমণী প্রাণভয়ে গবাক্ষ হইতে লাফাইয়া ভূতলে পড়িল। সকলে স্তম্ভিত—পড়িয়াই রমণী অজ্ঞান হইল। তখন গোবিন্দরাম ও অন্যান্য আর সকলে আসিয়া তাহাকে অগ্নিমুখ হইতে রক্ষা করিবার জন্য বিস্তর চেষ্টা করিলেন, তৎক্ষণাৎ অগ্নি নিৰ্ব্বপিত হইল, কিন্তু রমণীর রক্ষার কোন উপায় না দেখা গেল না—তাহার সর্ব্বাঙ্গ তখন একেবারে ঝলসিয়া গিয়াছে। 

ক্ষণপরে সকলের একান্ত চেষ্টায় রমণীর সংজ্ঞালাভ হইল; সে মাটিতে পড়িয়া ছটফট করিতে লাগিল, কেবল ‘জল’’জল’করিয়া চিৎকার করিতে লাগিল। কখন বলিল, “হাঁ, আমার পাপের ফল ঠিক হইয়াছে— উঃ! কি জ্বালা, আর পারি না গো!” একবার বলিল, “বিনোদিনী বিনোদিনী! আমায় রক্ষা কর, আমার কোন দোষ নাই।”

গোবিন্দরাম জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিনোদিনী তোমার কে?” 

রমণী বলিল, “বিনোদিনী আমার কেউ নয়, আমি তাঁর বাঁদী; কিন্তু সে আমাকে তাহার নিজের বোনের মত ভালবাসিত; কিন্তু এমন পোড়াকপালী, কালামুখি আমি—আমিই তাকে খুন করিয়াছি—আমার জন্যই সে মরিয়াছে।” 

গোবিন্দরাম বলিলেন, “তুমি তাহাকে খুন করিলে কেন? সে তোমার কি করিয়াছিল?” 

রমণী বলিল, “কি করিয়াছিল? বেশি যত্ন করিত—বেশি ভালবাসিত–আমাকে বেশি সুখে রাখিয়াছিল —তাই। মহাপাপী কৃতান্তকুমারের কথায় ভুলিয়া, টাকা-গহনার লোভে পড়িয়া বিশ্বাসঘাতিনী হইয়াছি।” 

গোবিন্দরাম বলিলেন, “কি হইয়াছিল আমাদের সব বল; নিজমুখে সব স্বীকার করিলে তোমার কিছু পাপ ক্ষয় হইতে পারে।” 

রমণী বলিল, “এ পাপের ক্ষয় নাই, তা নাই থাক, সব বলিব, সবই বলিতে হইবে। যখন আমি বিনোদিনীর কাছে ছিলাম, তখন কৃতান্ত আমার সঙ্গে গোপনে দেখা করিয়া নানা রকমে লোভ দেখাইতে লাগিল; আমি লোভে পড়িয়া তাহার কথায় ভুললিাম। কৃতান্ত আগেও অনেকবার বিনোদিনীকে খুন করিবার চেষ্টা করিয়াছিল, কাজে কিছুই করিয়া উঠিতে পারে নাই; বিনোদিনী ভয় পাইয়া সাবধান হইয়া গিয়াছিল। তখন কোন রকমে কিছু সুবিধা না করিতে পারিয়া কৃতান্ত আমাকে হস্তগত করিল। দুইজনে মিলিয়া বিনোদিনীকে খুন করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম। আমার মনে খুব বিশ্বাস ছিল, বিনোদিনীকে খুন করিতে পারিলে তাহার হীরামুক্তার গহনাগুলি সব আমার হইবে। একদিন রাত্রে আমি বিনোদিনীর ঘরে ঢুকিয়া পালঙ্কের নীচে লুকাইয়া ছিলাম; বিনোদিনী ভিতর হইতে দরজা বন্ধ করিয়া শুইয়া পড়িল। যখন বুঝিতে পারিলাম, সে ঘুমাইয়াছে, আমি দরজা খুলিয়া বাহিরে আসিয়া কৃতান্তকে খবর দিলাম। কৃতান্ত বাহিরে বাগানে লুকাইয়া ছিল। সে আসিয়া আমাকেই খুন করিতে বলিল; আমি কিছুতেই রাজী হইলাম না। তখন কৃতান্ত আমাকে একখানা তাস বিনোদিনীর বুকের উপরে চাপিয়া ধরিতে বলিল, আমি তাহাই করিলাম। কৃতান্ত সেই তাসের উপর দিয়া বিনোদিনীর বুকে ছুরি বসাইয়া দিল। তখনই সে বিনোদিনীর লাসটা একটা বাক্সে পুরিয়া ফেলিল; তাহার পর লাসটা সেখান হইতে সরাইবার জন্য একটা হাবার মাথায় সেই লাসশুদ্ধ বাক্সটা চাপাইয়া তাহাকে সঙ্গে লইয়া চলিয়া গেল।” 

গোবিন্দরাম বলিলেন, “হাঁ, আমরা জানি, বিনোদিনীর বুকে আমরা সে তাস দেখিয়াছি; সেখানা ইস্কাবনের টেক্কা। সে তাস তুমি কোথায় পাইয়াছিলে?’ 

“সে তাস বিনোদিনীরই ছিল” 

“কিন্তু আমরা সেই তাসের তাস বহুবাজারে সুরেন্দ্রনাথের বাসায় দেখিয়াছি। সে তাসগুলি সবই আছে, কেবল ইস্কাবনের টেক্কাখানিই নাই; বলিতে পার কেন এরূপ হইল?” 

“বিনোদিনীকে সুরেনবাবু সেই দামী তাস কিনিয়া দিয়েছিলেন, সেই তাস বিনোদিনীর বড় আদরের ছিল। আমি একদিন ঐ তাসগুলি হইতে ইস্কাবনের টেক্কা হারাইয়া ফেলি; আমার মনে বড় ভয় হইল; বুঝিলাম, আমি সেই তাস নষ্ট করিয়াছি জানিতে পারিলে বিনোদিনী রক্ষা রাখিবে না। আমি তাসগুলো লুকাইয়া রাখিলাম; তাহার পর একদিন সুরেন্দ্রবাবু আসিলে তাঁহাকে তাস হারাইবার কথা বলিলাম, বিনোদিনীকে কোন কথা বলিতে মানা করিয়া দিলাম, ঠিক ঐ রকম তাস মিলাইয়া কিনিয়া আনিবার জন্য ঐ তাসগুলি তাঁহাকে দিলাম। সুরেন্দ্রবাবু তাসগুলি পকেটে ফেলিয়া লইয়া গেলেন। তাহার পর একদিন সেই হারানো টেক্কাখানি পাওয়া গেল। কিন্তু সুরেন্দ্রবাবুর দেখা না পাইয়া সেই তাস গুলি আর চাহিতে পারি নাই। আর যখন বিনোদিনী খুন হইল, তখন আর তাসেই বা কি দরকার? সে তাসগুলি এখনও সুরেন্দ্রবাবুর কাছেই আছে।” 

রমণীর অবস্থা ক্রমেই খারাপ হইতেছিল। ক্রমেই যন্ত্রণার বৃদ্ধি—সে যাহা বলিল, তাহাতে বিনোদিনীর খুন সম্বন্ধে সকল রহস্যেরই উদ্ভেদ্য হইয়া গেল। গোবিন্দরাম তাহার মুখে যাহা শুনিলেন, একখানা কাগজে সব লিখিয়া ফেলিলেন; এবং সেখানে যাহারা উপস্থিত ছিলেন, তাঁহাদের কাছে সাক্ষর করাইয়া লইলেন। 

গোবিন্দরাম ভাবিয়া দেখিলেন, বিনোদিনীর দাসীর মৃত্যু আসন্ন, তাহার জীবনাশা একেবারে নাই, অর্দ্ধঘনন্টার মধ্যেই তাহাকে ইহোলোক ত্যাগ করিতে হইবে। আর কৃতান্ত! সহস্রশিখা অগ্নিগ্রাস হইতে কে তাহাকে রক্ষা করিবে? এতক্ষণ তাহারও এই দাসীর দশা ঘটিয়াছে; তবে আর এখানে অপেক্ষা করার ফল কি? হয় ত ঠিক সময়ে কলিকাতায় পৌঁছতে না পারিলে সকল শ্রম পন্ড হইবে–সুরেন্দ্র বাঁচিবে না। 

গোবিন্দরাম বলিলেন, “ইহাদিগকে রক্ষা করিবার কোন আশা নাই, তবুও চেষ্টা করিয়া দেখ—আমি আর সময় নষ্ট করিতে পারি না; আজ রাত্রের মধ্যে কলিকাতায় উপস্থিত হইয়া ফাঁসী স্থগিত করিতে হইবে—নতুবা—নতুবা –”

তিনি উর্দ্ধশ্বাসে ব্রাহ্মণের বাড়ীর দিকে ছুটিলেন। তথায় গিয়া দেখিলেন, যথার্থই হাবা তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছে—ব্রাহ্মণ তাহাকে বসাইয়া রাখিয়াছেন; নতুবা সে-ও নিশ্চয় সেই বাড়ীতে কৃতান্তের সহিত প্রবেশ করিত, তখন সুরেন্দ্রকে রক্ষা করিবার কোন উপায় থাকিবে না। 

গোবিন্দরাম ব্রাহ্মণকে কাল বিলম্ব করিতে দিলেন না। তাঁহাকে ও হাবাকে লইয়া স্টেশনের দিকে উর্দ্ধশ্বাসে ছুটিলেন। 

কিন্তু এমনই দুর্ভাগ্য যে, তাঁহারা যেমন স্টেশনে প্রবেশ করিলেন, অমনই গাড়ী ছাড়িয়া চলিয়া গেল। কি সৰ্ব্বনাশ!