৩০
রামকান্ত বাহিরে আসিলে একটি লোকের উপরে তাহার দৃষ্টি পড়িল, সেই লোকটি চিন্তিত মনে কলিকাতার দিকে চলিতেছে। ইহাকে দেখিয়াই রামকান্তের মনে হইল যে, ইহাকে সে কোথায় দেখিয়াছে; প্রথমে মনে করিতে পারিল না। ক্ষণপরে ইহার কথা মনে পড়িল; যেদিন সে শ্যামকান্তকে লইয়া হাবার প্রতীক্ষায় জেলের দ্বারে পাহারায় ছিল, যেদিন হাবা তাহার চাকরীর দফারফা করিয়া পলাইয়া যায়, সেইদিন কৃতান্তকে দেখিয়া এই লোকটা তাহাকে তাঁহার কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিল। তখন রামকান্ত ইহাকে তাড়াইয়া দিয়াছিল। তখন তাহার কৃতান্তের উপর কোন সন্দেহ ছিল না—কাজেই ইহার অনধিকার-চর্চায় বিরক্ত হইয়াছিল।
এক্ষণে কৃতান্ত সম্বন্ধে সামান্য বিষয়ও তাঁহাদের লক্ষ্য করা প্রয়োজন হইয়াছে, তাহাই এলোকটা কেন যে কৃতান্তের কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, তাহা জানিবার জন্য রামকান্ত উৎসুক হইল। যদি ঘনশ্যাম যথার্থই কৃতান্ত হয়, তাহা হইলে হয় ত এই লোকটা তাহাও জানিতে পারে। রামকান্ত দ্রুতপদে তাহার নিকটস্থ হইয়া বলিল, “তোমাকে কোথায় দেখিয়াছি বলিয়া বোধ হয়।”
লোকটি তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, “কই, আমার ত মনে হয় না।”
রামকান্ত বলিল, “হাঁ, আমার বেশ মনে পড়িতেছে, তুমি একদিন লালবাজোরের কাছে আমাকে একটা লোকের কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলে?”
লোকটি আবার তাহার দিকে চাহিয়া রহিল। তৎপরে ধীরে ধীরে বলিল, “যেন মনে হয়, একজনকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম—সে অনেক দিনের কথা।”
“হাঁ, অনেক দিন হইল—আমার কিন্তু বেশ বনে আছে। আমারই একটি পরিচিত লোকের কথা তুমি জিজ্ঞাসা করিয়াছিলে।”
“হাঁ, মনে পড়িয়াছে—সেই লোকটি কে জানিবার আমার একটু দরকার ছিল।”
“তখন একটা কারণে মন বড়ই খারাপ ছিল, তাহাই তখন তোমার কথায় উত্তর দিতে পারি নাই। এই লোকটির তোমার কি কোন কাজ আছে?”
“একটু আছে—বলিতে ক্ষতি নাই। আমি চন্দননগরে পয়েন্টম্যনের কাজ করি—একদিন তিনি আমার আমার সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছিলেন।”
“কেন, কোন কাজ ছিল?”
“বলিলেন যে, তিনি কোথায় শুনিয়াছেন আমার মেয়ে না কি কাহার অনেক টাকা পাইবে।”
“তাহার পর?”
“শেষে তিনি বলিলেন, তাঁহার ভুল হইয়াছে—সে আমার মেয়ে নয়; এই সময়ে গাড়ী আসিয়া পড়ায় আমি ছুটিয়া পেেয়ন্ট ধরিতে গেলাম।”
“এইজন্য তুমি কি তাহাকে খুঁজিতেছ?”
“ঠিক এইজন্য নয়,আমার বিশ্বাস যে, তিনি ইচ্ছা করিয়া লাইনের উপর কতকগুলি টাকা ছড়াইয়া চলিয়া যান; তিনি টাকাগুলি ভুলিয়া ফেলিয়াছেন, ভাবিয়া আমার মেয়ে তাঁহাকে দিবে বলিয়া সে টাকাগুলি কুড়াইতে আরম্ভ করে—এই সময়ে একেবারে গাড়ী আসিয়া পড়ে, সে শুইয়া পড়ে, তাহার উপর দিয়া গাড়ী চলিয়া যায়, কেবল ভগবান তাহাকে সেদিন রক্ষা করিয়াছিলেন।”
“এ তুমি কেবল অনুমান করিতেছে, হয় ত লোকটি ভুল করিয়াই টাকা ফেলিয়াছিল।”
“প্রথমে তাহাই মনে করেছিলাম; কিন্তু পরে আমার স্ত্রীর কতকগুলা কাগজ পাইয়াছি, তাহাতে জানিতে পারিলাম যে, আমার শ্বাশুড়ী একজন বড়লোকের ভগনীর কন্যা, তাহা হইলে আমার মেয়ে এই বড়লোকের টাকা পাইলেও পাইতে পারে; সুতরাং সেই লোকটি শেষে বলিয়াছিলেন যে, তাঁহার ভুল হইয়াছে; এখন বুঝিতেছি, এ কথা মিথ্যা বলিয়াছেন।”
“তুমি এ বড়লোকের কথা জানিতেন না?”
“না, তিনি বিদেশে গিয়া বড়লোক হইয়াছিলেন। তাঁহার ভগীনিদের সব গরীব লোকের সঙ্গে বিবাহ হইয়াছিল।”
“এই বড়লোকের নাম জানিতে পারিয়াছ?”
“হাঁ, তাঁহার নাম নরেন্দ্রভূষণ, তিনি পশ্চিমে গিয়া বড়লোক হইয়াছিলেন।” নরেন্দ্রভূষনের নাম শুনিয়া রামকান্ত প্রকৃতই বিশেষ বিস্মিত হইল। কিন্তু নিজ মনোভাব গোপন করিয়া বলিল, “তোমার সঙ্গে কথা কহিয়া দেখিতেছি, ভালই হইল—আমি একজন লোককে জানি, তাঁহার কাজই এই নষ্ট সম্পত্তির উদ্ধার করা—তাঁহার নাম নরহরিবাবু—প্রাচীনলোক, তুমি তাঁহার কাছে গিয়া একটা বন্দোবস্ত করিলে তোমার মেয়েকে তিনি এই টাকা পাইয়া দিতে পারেন।”
“তিনি কোথায় থাকেন?”
“কলিকাতায়–সিমলায়—সেখানে তাঁহার কথা জিজ্ঞাসা করিলেই সকলে তাঁহার বাড়ী দেখাইয়া দিবে।” ‘যে লোকটি আমার কাছে গিয়াছিলেন, তিনি কে—তাঁহার নাম কি জান?”
“হাঁ, জানি, তাঁহার নাম কৃতান্ত বাবু—তিনি কি করেন জানি না—এক সময়ে একটা দোকানে আলাপ হইয়াছিল।”
“আমার বোধ হয়, লোকটা ইচ্ছা করিয়া লাইনের উপর টাকা ছড়াইয়া আমার মেয়েকে মারিতে চেষ্টা পাইয়াছিল।”
“না—না—এ কখনও হইতে পারে না, তোমার মেয়েকে ইহার মারিবার উদ্দেশ্য কি? তোমার মেয়ে কত বড়?”
“মেয়েকে এখানে একটি বন্ধুর বাড়ী আনিয়াছি। একদিনের ছুটি লইয়া আসিয়াছি—এই যে এইখানেই বন্ধুর বাড়ী—তামাক খাবে?”
“ক্ষতি কি?”
গৃহদ্বারে পিতাকে দেখিয়া লীলা ছুটিয়া বাহিরে আসিল। গোপাল বলিল, “যাও লীলা, খেলা করোগে।”
লীলা বলিল, “বাবা ঐখানে থেকে ফুল তুলিয়া আনিব?”
“যাও, কিন্তু বেশীদূরে যাইয়ো না, মা।”
“না, ঐতো—ওখান থেকে আনিব।”
লীলা ছুটিয়া ফুল তুলিতে গেল। গোপাল তামাক সাজিতে আরম্ভ করিল।
রামকান্ত বলিল, “তোমার মেয়েটি ত বেশ –একে দেখিলেই সকলেই বলিবে, এ বড়ঘরের মেয়ে।”
গোপাল সনিশ্বাসে বলিল, “আমরা চিরকালই গরীবলোক—খেটে খুটে খাই।”
“এখন বোধ হয়, আর গরীব থাকিবে না।”
“এই নরেন্দ্রভূষণবাবু যদি কিছু রাখিয়া গিয়া থাকেন, তাহ হইলেও তাহার কিছুই আমি জানি না।”
“সেই জন্যই ত নরহরিবাবুর কাছে তোমাকে যাইতে বলিতেছি।”
“হাঁ, যখন কাগজগুলো পাইয়াছি, তখন লীলার জন্যও আমার একটু সন্ধান লওয়া উচিত।”
“নিশ্চয়ই—নরহরিবাবুর হাতে কাগজগুলি দিলেই তোমার সব কাজ তিনি নিজে ঠিক করিয়া দিবেন। তিনি আগে এক পয়সাও চাহেন না—তোমার মেয়ের সম্পত্তি পাইলে, তখন তিনি তাঁহার পারিশ্রমিক চাহিবেন।”
“আমি দুই-একদিনের মধ্যেই একদিন ছুটি লইয়া তাঁহার সঙ্গে দেখা করিব।”
কোন দিন, কখন যাইবে বলিলে আমি সে সময়ে অঁহার বাড়ী যাইতে পারি, তাঁহার সঙ্গে আমার বিশেষ আলাপ-পরিচয় আছে।”
“তাহা হইলে ত ভালই হয়—পরশু সকালে যাইব।”
“বেশ আমিও আসিব—তবে ইহাও তোমায় বলি, মেয়েটাকে খুব সাবধানে রাখিয়ো।”
“কেন—কেন?তাহার ভয় কি?”
“আছে—ভাল লোক, মন্দ লোক এ সংসারে সব রকমেরই লোক আছে।”
“কেন, তাহারা কি করিবে?”
‘এই নরেন্দ্রভূষণবাবুর অনেক ওয়ারিসান থাকিতে পারে—তাহা হইলে তাঁহার সম্পত্তি ইহাদের সকলের মধ্যে সমভাবে ভাগ হইবে; কাজেই ইহাদের মধ্যে যদি কোন বদলোক থাকে, তাহা হইলে এ লোক নিজে বেশী টাকা লোভে অপর ওয়ারিসানদের সরাইবার চেষ্টা করিতে পারে।”
“বল কি!”
“হাঁ, এসংসারে সবই সম্ভব।”
“তাহা হইলে আমি ত ঠিক ভাবিয়াছি যে, তবে এ লোকটা ইচ্ছা করিয়াই আমার মেয়ের সম্মুখে টাকা ছড়াইয়াছিল।”
“তাহা যাহাই হউক, সেইজন্যই বলিতেছি, তোমার মেয়েটিকে একটু সাবধানে রাখিয়ো—এখন সে কোথায় গেল,দেখিতে পাইতেছি না।”
গোপাল লম্ফ দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল — যথার্থই লীলা আর সেখানে নাই, সে নিকটেই ফুল কুড়াইতেছিল— কিন্তু এখন সে আর সেখানে নাই। গোপাল তাহার সন্ধানে উন্মাদের ন্যা ছুটিল। রামকান্তও তাহার সঙ্গে চলিল।
তাহারা কিয়ৎক্ষণ এদিকে সেদিকে সন্ধান করিয়াও কোথাও তাহাকে দেখিতে পাইল না; তখন গোপাল পাগলের মত চিৎকার করিয়া ডাকিতে লাগিল, “লীলা— লীলা—
এই সময়ে লীলা একটি ছোট গলির ভিতর হইতে ছুটিয়া বাহিরে হইয়া আসিল। গোপাল ছুটিয়া গিয়া তাহাকে কোলে করিয়া তাহার মুখচুম্বন করিল। গোপাল বলিল, “মা, এতক্ষণ কোথায় গিয়েছিলে? আমি ভেবে মরি।”
লীলা বলিল, “এক মাগী এসে বলিল যে, তুমি আমাকে ঐ দিকে ডাকিতেছে; আমি তাহার সঙ্গে গেলে, সে আমাকে জোর করে একখানা গীড়ীতে তুলিতেছিল। আমি তাহার হাত কামড়াইয়া ধরিলে সে আমার হাত ছাড়িয়া দিয়াছে। আর অমনই আমি ছুটিয়া পলাইয়া আসিয়াছি।”
গোপাল চিন্তিত ও বিস্মত হইয়া বলিল, “মাগী! কি রকম মাগী?”
“একটা বুড়ী।”
‘কোথায় গেল?”
“তা জানি না, বোধ হয়, গাড়ী করে চলে গেছে।”
গাড়ী চলিয়া গিয়াছে কিনা গোপাল দেখিতে ছুটিতেছিল; কিন্তু রামকান্ত তাহাকে প্রতিবন্ধক দিয়া বলিল, “এই মাগীর সন্ধানে গিয়া কোন লাভ নাই, সে নিশ্চয়ই এতক্ষণে অনেকদূর গিয়াছে। এখন স্পষ্টই জানা যাইতেছে যে, তোমার মেয়ের ক্ষতি করিবার জন্য কেহ চেষ্টা পাইতেছে, তুমি আর কালবিলম্ব না করিয়া নরহরিবাবুর সঙ্গে দেখা কর।”
এই বলিয়া রামকান্ত সে স্থান পরিত্যাগ করিল। গোবিন্দরাকে সংবাদ দিবার মত তাহার অনেক কথা সংগ্রহ হইয়াছে, আর তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে বিলম্ব করা উচিত নহে।
তাহার গাড়ী তখনও দূরে দাঁড়াইয়া ছিল। সে সত্বর গাড়ীতে উঠিয়া বসিল — গাড়ী ছুটিতে লাগিল।
৩১
গোবিন্দরাম নবাব সাজিয়াছিলেন, কিন্তু তিনি জানিতেন যে, এক নবাব সাজে থাকিলে তাঁহার চলিবে না। সেইজন্য তিনি আগে হইতেই দুই-তিনটা বাড়ী স্থির করিয়া রাখিয়াছিলেন। কলুটোলার বাড়ীতে তিন নবাব। সিমলার বাড়ীতে বৃদ্ধ নরহরি বাবু।
রামকান্ত আসিয়া গোবিন্দরামকে সেদিনকার সমস্ত কথা বলিল। ঘনশ্যাম যে কৃতান্ত এ বিষয়ে রামকান্ত নিশ্চিত হইতে পারে নাই—তবে এটা স্থির যে, ঘনশ্যাম নৈহাটির কোন স্টেশনে গিয়াছেন—সম্ভবতঃ ইহার কোন গুপ্ত আড্ডা আছে।
গোপাল ও তাহার কন্যা লীলার কথা শুনিয়া গোবিন্দরাম বিশেষ চিন্তিত হইলেন। তিনি প্রথম হইতে কৃতান্তের উপর একটু সন্দেহ করিয়াছিলেন, এখন সেই সন্দেহ আরও বদ্ধমূল হইল।
গোপাল গোবিন্দরামের সহত দেখা করিয়া কাগজ-পত্র দিয়াছে। তাহাতেই গোপাল জানিতে পারিয়াছে যে, সুহাসিনী নরেন্দ্রভূষনের একজন ওয়ারিসান। নরহরিবেশী গোবিন্দরাম সুহাসিনীর মাতার সহিত দেখা করিতে তাহাকে বলিয়াছেন, গোপাল তাহাই বরাহনগরে রওনা হইয়াছে।
তখন প্রায় সন্ধ্যা আসন্ন, দিবালোক ম্লান হইয়াছে,চারিদিকে ধীরে ধীরে অন্ধকার ঘনীভূত হইতেছে।
সুহাসিনী উদ্যানমধ্যে চিত্তিতমনে বেড়াইতেছিল। সুরেন্দ্রনাথের ফাঁসীর হুকুম হওয়ার তাহার হৃদয় একেবারে ভাঙিয়া গিয়াছে, সে আর কাহারও সহিত কথা কহে না, সুবিধা পাইলেই বাগানে গিয়া নিৰ্জনে বসিয়া থাকে, আর সুরেন্দ্রনাথের কথা ভাবে—আজও সে বাগানের এককোণে গিয়া বসিয়াছিল।
সহসা একটা শব্দ হওয়ায় সুহাসিনী মাথা তুলিল; দেখিল, বেড়ার বাহিরে দুইটি লোক দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। তাহাকে মাথা তুলিতে দেখিয়া একব্যক্তি বেড়ার নিকটস্থ হইল। অতি সাবধানে মৃদুস্বরে বলিল, “তাঁহার বাপ একবার আপনার সহিত দেখা করিতে চান।”
সুহাসিনী সত্বর উঠিয়া দাঁড়াইল; বলিল, “আমি জানি, তিনি আমাদের ত্যাগ করেন নাই, কোথায় তিনি?”
“ঐ গাড়ীতে, তিনি বিশেষ কারণে লুকাইয়া আসিয়াছেন—না হইলে ত প্রকাশ্যভবেই আসিতেন।”
“চল—কোথায়?”
সুহাসিনী সত্বর বেড়া সরাইয়া পথে আসিল। সেদিকে একটা গলিপথ, সেই গলিপথের মধ্যে একখানা গাড়ী দাঁড়াইয়া আছে। এ পথে বড় লোকজন চলিত না। সুহাসিনী, সুরেন্দ্রনাথের পিতা গোবিন্দরাম আসয়াছেন ভাবিয়া, কোনদিকে না চাহিয়া সত্বরপদে গাড়ীর নিকটস্থ হইল।
অপর লোকটি বেড়ার আড়ালে নিস্পন্দভাবে এতক্ষণ দাঁড়াইয়াছিল। সুহাসনী তাহার দিকে না চাহিয়া গাড়ীর দ্বারে আসিল।
অমনই সেই লুক্কাইত লোকটি নিমেষমধ্যে লাফাইয়া আসিয়া দুসহস্তে তাহাকে জড়াইয়া ধরিল; সুহাসিনী চিৎকার করিয়া উঠিল, তখনই অপর লোক তাহার মুখ চাপিয়া ধরিয়া সবলে তাহাকে গাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করাইতে চেষ্টা করিল। সুহসিনী চিৎকার করিতেও পারিল না। এই সময়ে সেই গলিপথে একটি লোক আসিতেছিল, এক-একবার সুহাসিনীর বাড়ীর দিকে চাহিতেছিল।
সহসা তাহার কানে সুহাসিনীর অস্ফুট চিৎকারধ্বনি প্রবেশ করিল। লোকটি চমকিত হইয়া সেইদিকে ফিরিয়া দেখিল, দুইটি লোকে একটি বালিকাকে জোর করিয়া গাড়ীতে তুলিতেছে।
তখন সেইলোক লাফাইয়া উঠিল, তাহার হাতে এক প্রকান্ড লাঠি ছিল, সে পশ্চাত হইতে এক ব্যক্তির মস্তকে সজোরে সেই লাঠি মারিল।
লাঠি খাইয়া সুহাসিনীকে ছাড়িয়া দিয়া দুর্বৃত্ত পলাইয়া গেল; পরক্ষণে অপর ব্যক্তিও এই ব্যাপার দেখিয়া সজোরে সুহাসিনীকে ধরাতলে নিক্ষেপ করিয়া উর্দ্ধশ্বাসে ছুটিয়া পলাইল।
লোকটি তাহাদের অনুসরণ করিল না, সুহাসিনী পড়িয়াগিয়াছিল, তাহার হাত ধরিয়া তুলিল; বলিল, ভয় নাই, চল—কোথায় তোমাদের বাড়ী, বল—রাখিয়া আসি—ইহারা কে?”
সুহাসিনী ব্যাকুলভাবে বলিল, “এই আমাদের বাড়ী।”
“তবে তোমারই নাম সুহাসিনী—ইহারা কে?”
“জানি না, আসুন বাড়ীতে। আমার এখানে বড় ভয় করিতেছে।”
“চল, আমি এদিকে না আসিলে ইহারা তোমাক লইয়া যাইত। বাগানের দরজা কোনদিকে আমি তাহাই খুজিতে খুজিতে এইদিকে আসিতেছিলাম।”
“হাঁ, বাড়ীতে চলুন।”
সুহাসিনী লোকটির সহিত বাগানে প্রবেশ করিল; যাইতে যাইতে বলিল, “আপনি আমাদের কাছে আসিয়াছেন?”
“হাঁ, একটু কাজ আছে।’
সুহাসিনী আর কোন কথা কহিল না, সত্বরপদে বাড়ীর দ্বারে আসিল; তখন সে হঠাৎ লোকটির দিকে ফিরিয়া বলিল, “এ সকল কথা কাহাকেও বলিবেন না—এমন কি মাকেও না।”
“কেন? এ রকম ব্যাপার কে করিতে সাহস করিয়াছিল, তাহার সন্ধান করা উচিত।”
“মা কেবল ব্যস্ত হইবেন। যাহাদের ষড়যন্ত্রে তিনি ফাঁসী যাইতেছেন, তাহাদেরই এই কাজ।”
“কিসের ষড়যন্ত্র—কে তাহারা?”
“তাঁহার পিতা নিশ্চয়ই এ কথা আপনাকে বলিয়াছেন, আপনি তাঁহার নিকট হইতে অসিতেছেন?” ‘তোমার ভুল হইয়াছে, তুমি কাহার কথা বলিতেছ?”
“গোবিন্দরাম বাবু।”
“আমি তাঁহার নিকট আসি নাই।”
“সুহাসিনী বিস্মিতভাবে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, “আপনি তবে কাহার নিকট হইতে আসিয়াছেন?”
এই সময়ে সুহাসিনীর মা সেইদিকে আসিলেন; তিনি বলিলেন, “এ কে?”
লোকটি বলিল, “আমার নাম গোপাল, রেলে পয়েন্টম্যানের কাজ করি—গরীবলোক আপনাদের মত বড়লোকের বাড়ীতে আমার আসাই অন্যায়—তবে একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে আসিয়াছি।”
“বল কি কথ।”
“আপনার পিতামহীর ভাই এর নাম কি ছিল?”
সুহাসিনীর মা নিতান্ত বিস্মিতভাবে গোপালের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। কোন কথা কহিলেন না।
গোপাল বলিল, “তাঁহার নাম কি নরেন্দ্রভূষণবাবু?”
সুহাসিনীর মা বলিলেন, “প্রথমে আমি শুনিতে চাই যে, এ কথা জানিবার তোমার আবশ্যক কি?”
গোপাল বলিল, “আমি কতকগুলি কাগজ-পত্র জানিয়াছি যে, আমার শাশুড়ীর মা নরেন্দ্রভূষণ বাবুর এক ভগিনী হইতেন; আমার একটি ছোট মেয়ে আছে—শুনিয়াছি নরেন্দ্রভূষণ বাবুর কোন সন্তানাদি ছিল না, অথচ তিনি অনেক টাকা রাখিয়া গিয়াছেন। এই টাকা তাঁহার ওয়ারিসানগণ পাইবে। তাহা হইলে আমার মেয়ে আর আপনার এই মেয়ে তাঁহার ওয়ারিসান।”
সুহাসিনীর মা বলিলেন, “এ সকল খবর কে দিল?”
“আমার স্ত্রীর বাক্সে কতকগুলি কাগজ-পত্র পাইয়াছি, তাহাতে কতক জানিয়াছিলাম; তাহার পর নরহরিবাবু বলিয়া একটি লোকের কাছে গিয়া তাঁহাকে এ বিষয়ে সন্ধান করিতে অনুরোধ করি; তিনি এইরকম সব মামলার তদ্বির করেন, তিনিই বলিলেন যে, নরেন্দ্রভূষণ বাবুর আর এক ওয়াারিসান আছে, সে আপনার মেয়ে; তিনিই আমাকে আপনার কাছে আসতে বলিয়াছিলেন।”
“হাঁ, তাঁহার নাম নরেন্দ্রভূষণ ছিল বটে, তবে তুমি যে কাহার কথা বলিতেছে, তাহা আমি ঠিক জানি না।”
“এই নরেন্দ্রভূষণবাবু পশ্চিমে গিয়া বড়লোক হইয়া অনেক টাকা রাখিয়া গিয়াছেন। অনেক দিন অবধি আদালত হইতে ইহার ওয়ারিসানদের সন্ধান হইতেছে; বোধ হয়, আমি সপ্রমাণ করিতে পারিব যে, ইনিই সেই নরেন্দ্রবাবু।”
“আমি পিতার কাছে শুনিয়াছিলাম যে, তাঁহার মামা নরেন্দ্রভূষণ বাবু যখন পশ্চিমে গিয়াছিলেন, তখন বড় গরীব ছিলেন। তাহার পর তাঁহার আর কোন সন্ধান পান নাই।”
“খুব সম্ভব, আপনার কন্যাও তাঁহার সম্পত্তির একভাগ পাইবেন, নরহরি বাবু এ সন্ধান করিতেছেন।”
“তিনি কে?”
“তাঁহার এই কাজ সম্পত্তি যদি তিনি আমাদের দেওয়াইয়া দিতে পারেন, তাহা হইলে তাঁহাকে শতকরা এক টাকা করিয়া দিতে হইবে।”
“আমার মেয়ের যাহা আছে, যথেষ্ট।”
“কিন্তু আমার মেয়ে বড় গরীব।”
“সে পাইলে আমরা সুখী হইব।”
“যদি আমার মেয়ে ও আপনার মেয়ে যথার্থই সম্বন্ধে ভগিনী হয়, তাহা হইলে আপনার মেয়েও এই সম্পত্তি পাইবেন। নরেন্দ্রভূষণ বাবু এই মর্মে একখানা উইলও করিয়ো গিয়াছেন যে, তাঁহার সম্পত্তি সমভাগে বিভক্ত হইবে।”
সুহাসিনী বলিল, “মা ইহাকে ইহার মেয়েকে সঙ্গে করিয়া আনিতে বল, সে নিশ্চয়ই আমার ভগিনী।” সুহাসিনীর মা বলিলেন, “হাঁ, আনিবে বই কি; এ সম্বন্ধে আর কি হয়, জানিবার জন্য আমরা ব্যস্ত রহিলাম।”
গোপাল বলিল, “আমি নরহরি বাবুর সঙ্গে আবার কাল দেখা করিব, যদি কিছু নতুন কথা জানিতে পারি, আপনাদের বলিয়া যাইব।”
সুহাসিনী বলিল, “অনুগ্রহ করিয়া এবার আপনার মেয়েকে সঙ্গে আনিবেন।
সুহাসিনী এই গরীব লোকটাকে এত সম্মান করিয়া কথা কহিতেছে দেখিয়া, সুহাসিনীর মা বিস্মিত হইলেন, কিন্তু কিছু বলিলেন না।
গোপাল বুঝিল, সে সুহাসিনীকে একটু পূর্ব্বে দস্যুদের হাত হইতে রক্ষা করিয়াছিল বলিয়াছিল বলিয়াই সে তাহাকে এত সম্মান করিতেছে।
“এবার যেদিন আসিব, লীলাকে সঙ্গে আনিব, “বলিয়া গোপাল দমদমার দিকেফিরিল। সেখানে বন্ধুর বাড়ীতে লীলাকে রাখিয়াছিল।
৩২
গোপাল প্রায় রাত্রি আটটার সময় বন্ধুর বাড়ীতে উপস্থিত হইল; দ্বার হইতে ডাকিল, “লীলা–লীলা—“ তাহার কন্ঠস্বর শুনিলে লীলা তৎক্ষণাৎ ছুটিয়া আসে—কই, আজ সে আসিল না কেন? গোপাল ভাবিল, “হয় ত সে এতক্ষণে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে।”
এই সময়ে তাহার বন্ধুও বাড়ীর হইয়া আসিয়া তাহাকে দেখিয়া নিতান্ত বিস্মিতভাবে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। তাহার ভাব দেখিয়া গোপালও বিস্মিত হইল; বলিল, “লীলা কি এরই মধ্যে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে?”
বন্ধু সে কথায় উত্তর না দিয়া বলিল, “তুমি তাহা হইলে গাড়ীচাপা পড় নাই—মা কালী রক্ষা করিয়াছেন!”
“গাড়ী চাপা কি? তোমার কি মাথা খারাপ হইয়া গিয়াছে—অমন করিয়া আমার দিকে চাহিয়া আছ কেন? লীলা কোথায়?”
“লীলা কোথায়, তুমি কি তাহা জান না।”
গোপাল বিস্মিত ভাবে বলিল, “আমি কিরুপে জানিব—আমি কি এখানে ছিলাম? তাহার কি হইয়াছে, শীঘ্র আমাকে বল।”
তখন সেই বন্ধু বলিল, “সন্ধ্যার সময়ে এক মেম এখানে এসে বলিল, যে, তুমি গাড়ীচাপা পড়িয়া হাসপাতালে গিয়াছ, অবস্থা ভাল নয়, তাই লীলাকে দেখিবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছি। সে হাঁসপাতালের মেম—নিজেই লীলাকে লইতে আসিয়াছি।”
“আর তুমি সেই কথা বিশ্বাস করিলে?”
“কি করিব—মেম—তাহাতে তাহার গাড়ীর উপর একজন পাহারাওয়ালা বসে—কেমন করে অবিশ্বাস করিব?”
গোপাল মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল; বলিল, “সৰ্ব্বনাশ হইয়াছে! দুই-দুইবার লীলাকে ভগবান রক্ষা করিয়াছিলেন। হায় হায়! এবার তাহাকে হারাইলাম।”
গোপাল ব্যাকুলভাবে কাঁদিয়া উঠিল। তাহার বন্ধু লজ্জিত ও দুঃখিত হইয়ল বলিল, “এমন জাল জুয়াচুরি, মিথ্যাকথা, মিথ্যাসাজ কেমন করিয়া বুঝিব? তাহারা লীলাকে লইয়া কি করিবে?”
“আর কি করিবে, আমার মাথা খারাপ করিবে—মারিয়া ফেলিবে।”
“তবে পুলিসে খবর দাও—চল।”
গোপালও ভাবিল, বসিয়া বসিয়া ব্যাকুলভাবে কাঁদিলে লীলাকে পাইবে না, পুলিসে সংবাদ দিলে কিছু বিহিত হইতে পারে; তাহার পর নরহরি বাবুকেও এখনই সব কথা বলা উচিত, তিনিও তাহার সন্ধান করিতে পারেন। গোপাল জিজ্ঞাসা করিল, “গাড়ীর কোনদিকে গেল?”
“কলিকাতার দিকে গিয়াছে।”
“ভাড়াটিয়া গাড়ী?”
“না, ঘরের ভাল গাড়ী—ইহাতে কেমন করে অবিশ্বাস করি।”
“তোমার কি দোষ ভাই? আমার অদৃষ্টের দোষ।”
“তবে চল, আর দেরি করিয়ো না।”
গোপাল বন্ধুকে সঙ্গে লইয়া থানায় উপস্থিত হইল। ইনস্পেক্টর তাহার এজাহার লিখিয়া লইয়া বলিল, “যাও, সন্ধান হইবে।”
হতাশচিত্তে গোপাল ফিরিল। তখন অনেক রাত্রি হইয়াছিল, সুতরাং তখন গেলে নরহরিবাবুর সঙ্গে দেখা হইবার সম্ভবনা নাই—কাজেই গোপাল বন্ধুর বাড়ী অতিকষ্টে সে রাত্রি কাটাইল।
পরদিবস প্রাতেরামকান্ত গোবিন্দরামের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিল। আসিয়া দেখিল, তাঁহার দ্বারে গোপাল বসিয়া আছে।
গোপালের সমস্ত রাত্রি ঘুম হয় নাই, অন্ধকার থাকিতে থাকিতেই সে নরহরি বাবুর সহিত দেখা করিতে আসিয়াছিল। দ্বার খোলা না দেখিয়া সেইখানেই বসিয়াছিল—বসিয়া বসিয়া অভাগিনীর কথা ভাবিতেছিল। রামকান্ত তাহাকে দেখিয়া বিস্মিতভাবে জিজ্ঞাসা করিল, “কি হে, তুমি এত সকালে এখানে কি মনে করিয়া—খবর কি?”
গোপাল লীলার সম্বন্ধে সকল কথা বলিল। রামকান্ত কোন কথা না বলিয়া তাহার হাত ধরিয়া তাহাকে নরহরির বাবুর বাড়ীর ভিতরে লইয়া গেল।
তখন নরহরিবাবু সবে মাত্র উঠিয়া মুখ ধুইতে বসিয়াছিলেন। রামকান্ত বলিল, “এই লোকটির মেয়ে চুরি গিয়াছে, সেই যে মেয়ে—”
নরহরি বাবু একটু চমকিত হইয়া গোপালের মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “সব কথা খুলিয়া বল।”
গোপাল বলিল, “কি খুলিয়া বলিব—আমার মাথার ঠিক নেই, এক মেম আসিয়া আমার বন্ধুর বাড়ী হইতে আমার মেয়েকে লইয়া গিয়াছে—সে বলিয়াছিল, আমি গাড়ী চাপা পড়িয়াছি—এসবই মিথ্যা কথা।”
“কখন লইয়া গিয়াছে?”
“সন্ধ্যার পর—কাল।”
“গাড়ী সঙ্গে ছিল?”
“হাঁ, ঘরের গাড়ী—উপরে একজন পাহারাওয়ালা ছিল।”
“তোমার বন্ধু তাহা হইলে এই গাড়ী চিনিতে পারিবে—মেমকে দেখিলেও চিনিতে পারিবে?”
“সম্ভব, তবে ঠিক বলিতে পারি না।”
“কাহারও উপর তোমার সন্দেহ হয়?”
“কেমন করিয়া বলিব, আমি গরীব লোক।”
রামকান্ত বলিল, “ইহার পূর্ব্বেও একবার তাহাকে চুরি করিবার চেষ্টা করিয়াছিল। সেবার এক বুড়ী তাহাকে ভুলাইয়া গাড়ীতে তুলিতেছিল।”
গোপাল বলিল, “হাঁ, সেদিন লীলা তাহার হাত কামড়ইয়া পালাইয়া আসিয়াছিল।
নরহরি বাবু বলিলেন, “তুমি কাল সন্ধ্যার সময়ে কোথায় যাইবে, কাহাকেও সে কথা বলিয়াছিলে?”
“হাঁ, আমার বন্ধুকে বলিয়াছিলাম যে, আমি কাল বরাহনগরে যাইতেছি।”
‘সেখানে কি শুনিলে?”
“শুনিলাম, সুহাসিনী ও আমার মেয়ে সম্বন্ধে ভগিনী, আমার শাশুড়ীর মামা, আর সুহাসিনীর মাতামহের মামা, একই লোক—সেই নরেন্দ্রভূষণবাবু। যাহারা আমার মেয়েকে চুরি করিয়াছে, তাহারাই এই সুহাসিনীকেও জোর করিয়া লইয়া যাইতেছিল।”
গোবিন্দরাম বিস্মিত হইয়া গোপালের মুখের দিকে চাহিলেন।
তিনি সুহাসিনীকে অত্যন্ত স্নেহ করেন, কেহ সেই সুহাসিনীকেও সরাইতে চাহে—তাহাকে জোর করিয়া ধরিয়া লইয়া যাইতেছিল; তাহা হইলে এখন স্পষ্টই জানা যাইতেছে যে, লীলা ও সুহাসিনী নরেন্দ্রভূষণবাবুর ওয়ারিসান।
তাহার অন্য কোন ওয়ারিসান ইহদের বিষয় জানিতে পারিয়াছে, সমস্ত সম্পত্তি নিজে ভোগ করিবার জন্য ইহাদের দুইজনের প্রাণনাশ করিবার চেষ্টায় আছে—এ লোক কে?
কৃতান্ত এ বিষয়ে অনুসন্ধান করিতেছিল, সে গোপালের কাছে গিয়াছিল, নিশ্চয় সে সুহাসিনীর মার কাছেও গিয়াছিল, সে সম্পত্তি সম্বন্ধে সকল কথাই বোধ হয়, জানিতে পারিয়াছে—তাহা হইলেও তাহার এ সম্পত্তি পাইবার সম্ভবনা কোথায়? ইহারা দুইজন মরিলে সে বিষয় পাইবে কেন? তবে কি সে-ও নরেন্দ্রভূষণবাবুর একজন ওয়ারিসান–না, তাহা হইতে পারে না, তবে হয় ত সে অন্য কোন ওয়ারিসানকে হাত করিয়াছে। যাহা হউক, হহার বিশেষ সন্ধান লইতে হইল; মনে হয়, যেন বিনোদিনীও এই নরেন্দ্রভূষণের একজন ওয়ারিসান ছিল। তিনি সুহাসিনী সম্বন্ধে যাহা যাহা ঘটিয়াছিল, তাহা গোপালকে আনুপূর্ব্বিক বলিতে বলিলেন। সকল শুনিয়া, “এই সুহাসিনীর কথা পরে হইবে—এখন কথা হইতেছে, তোমার মেয়েকে খুঁজিয়া বাহির বরিতে হইবে।”
গোপাল ব্যগ্রভাবে বলিল, “তাহা হইলে—তাহা হইলে লীলাকে পাওয়া যাইবে?”
“প্রায়ই কোন কাজেই আমি নিষ্ফলা হই না। তবে একটা কথা আছে বাপু।”
“বলুন।”
“আমি যে তোমার কাজে নিযুক্ত হইয়াছি, তাহা কাহাকেও বলিয়ো না, পুলিসে সংবাদ দিয়াছ ভালই, আমি সতন্ত্রভাবে সন্ধান করিব।”
“পুলিসের উপরে আমার ভরসা নাই।”
“আমারও বিশ্বাস যে, এই সম্পত্তির জন্য কোন লোক তোমার কন্যাকে হস্তগত করিয়াছে।”
“তাহা হইলেই ত হইল, তাহারা তাহাকে মারিয়া ফেলিবে, সে বাঁচিয়া থাকিলে তাহাদের উদ্দেশ্য সফল হইবে না।”
“প্রাণেও না মারিতে পারে—লুকাইয়া রাখিলেও তাহাদের কাজ উদ্ধার হইবে।”
“এখন উপায়?”
“তোমার মেয়েকে তাহারা খুন করিতে ইচ্ছা করিলেই অনায়াসেই পারিত—তাহা হইলেই চুরি করিয়া লইত না।”
“তবে তাহারা তাহাকে আটকাইয়া রাখিবে?”
“সম্ভব, সেইজন্য আশা করিতেছি, তাহাকে খুঁজিয়া বাহির করিতে পারিব।” বলিয়া গোবিন্দরাম উঠিয়া দাঁড়াইলেন।
গোপাল বলিল, “তবে আপনার কাছে আবার কখন আসিব?”
“সুবিধা মত আসিয়ো।”
“তাহা হইলে লীলাকে আমি পাইব?”
“হাঁ, এত শীঘ্র হতাশ হইয়ো না। ব্যাকুল হইলে মেয়ে আসিবে না।”
গোপাল ও রামকান্ত বিদায় হইলে গোবিন্দরাম, গোপাল যে কাগজগুলি দিয়া গিয়াছিল, তাহাই আবার ভাল করিয়ো পড়িতে লাগিলেন। দেখিলেন, নরেন্দ্রভূষণের চারি ভগিনী। প্রথমা ভগিনীর এক কন্যা হয়, তাহার বিবাহ হইয়াছিল, কিন্তু তাহার সন্তানাদি হইয়াছিল কিনা, তাহা এ কাগজ-পত্রে নাই। দ্বিতীয়া ভগিনীর কন্যা গোপালের শাশুড়ী, গোপালের কন্যা লীলা। তৃতীয়া ভগিনীর পুত্র সুহাসিনীর মাতামহ।
গোবিন্দরাম বলিলেন, “এই কাগজ-পত্রে ত স্পষ্টই প্রমাণ হইতেছে যে, নরেন্দ্রভূষণের ওয়ারিসান, এই লীলা আর সুহাসিনী। তাহার বড় ভগিনীর কেহ আছে কিনা, ইহাই অনুসন্ধানের বিষয়। এখন ছোট ভগিনী সম্বন্ধে কি? ইহার ভিতরে তাহার কোন কথা নাই কেন? এই যে অন্য কাগজে তাহা আছে, দেখিতেছি।”
কনিষ্ঠা ভগিনীর এক পুত্র হইয়াছিল, তাহার ঔরসে এক কন্যা হয়, সেই কন্যা কুলত্যাগ করিয়া যায়, ইহারও একটা মেয়ে হইয়াছিল, সে যখন গৃহত্যাগ করিয়া যায়, তখন তাহার সেই মেয়েটির বয়স পাঁচ বৎসর মাত্র, মেয়েটির নাম বিনোদিনী।
গোবিন্দরাম বিস্মিত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “বিনোদিনী! যে স্ত্রীলোকের মৃতদেহ বাক্সের মধ্যে পাওয়া যায়, তাহারও নাম বিনোদিনী, ঠিক হইয়াছে—তবে আমার অনুমান ঠিক।”
৩৩
গোবিন্দরাম বহুক্ষণ নীরবে বসিয়া রহিলেন। তিনি মনে মনে যে সন্দেহ করিয়াছিলেন, তাহা যে প্রকৃত হইবে, ইহা তিনি কখনও মনে করেন নাই। তবে বিনোদিনীও নরেন্দ্রভূষণ বাবুর একজন ওয়ারিসান? তবে বিনোদিনী নামে অনেক স্ত্রীলোক থাকিতে পারে—এই বিনোদিনী—যে বিনোদিনী খুন হইয়াছে, সেই কি নরেন্দ্রভূষণ বাবুর ওয়ারিসান? তাহা যদি হয়, তাহা হইলে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যাইতেছে যে, এই বিনোদিনী—গোপালের কন্যা লীলা—এবং সুহাসিনী—এই তিনজনই নরেন্দ্রভূষণ বাবুর ওয়ারিসান বলিয়া প্রমাণিত হইতেছে। এই তিনজনের মধ্যে একজন খুন হইয়াছে, একজনকে একবার খুন করিবার চেষ্টা হইয়াছিল, একবার চুরি করিবার চেষ্টা করিয়াছিল—আর শেষবার তাহাকে চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছে। তাহার পর সুহাসিনীও নিরাপদ নহে, তাহাকেও জোর করিয়া লইয়া যাইবার চেষ্টা করিয়াছিল। তাহা হইলে কেবল বাকী থাকিতেছে, নরেন্দ্রভূষণের জ্যেষ্ঠা ভগিনী, তাহার নিশ্চয়ই কোন ওয়ারিসান আছে, সেই এই তিনজনকে মারিবার চেষ্টা করিতেছে—একজনকে হত্যাও করিয়াছে। তবে কথা হইতেছে, এই বিনোদিনী যথার্থ নরেন্দ্রভূষণের ওয়ারিসান কি না?
এইখানে গোবিন্দরামের চিন্তাসূত্র ছিন্ন হইয়া গেল, সন্দেহবশে তিনি মনে মনে অত্যন্ত বিচলিত হইয়া উঠিলেন। এই বিনোদিনী সেই বিনোদিনী কি না, তাহা তিনি ঠিক বলিতে পারেন না, তবে তাঁহার মন বারংবার বলিতে লাগিল যে, হাঁ, এই বিনোদিনীই সেই বিনোদিনী। তাহা যদি হয়, তবে সে খুন হইয়াছে—নরেন্দ্রভূষণের টাকার জন্য। এ অবস্থায় তাঁহার পুত্র সুরেন্দ্রনাথ যে খুন করে নাই, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। বিনোদিনীকে নরেন্দ্রভূষণের ওয়ারিসান বলিয়া সপ্রমাণ করিতে পারিলে সুরেন্দ্রকে নিদোষী সপ্রমাণ করা কঠিন হইবে না। তাহা হইলে নরেন্দ্রভূষণের প্রথমা ভগিনীর ওয়ারিসানই খুনী, সে নিশ্চয়ই এখানে আছে—বিনোদিনীকে খুন করিয়াছে—লীলাকে চুরি করিয়াছে—সুহাসিনীকে সরাইতে পারিলেই সে একাই সমস্ত টাকা পাইবে। তাহাই যদি সত্য হয়, তবে সে কে? কোথায় আছে? কৃতান্ত নিজে নহে—না, তাহা হইতে পারে না, এ বিষয়ে কোন প্রমাণ নেই, সন্দেহ করিবার কোন কারণ দেখিতেছি না।
তিনি এইরূপ মনে মনে আলোচনা করিতেছিলেন, এই সময়ে রামকান্ত তথায় উপস্থিত হইল। গোবিন্দরাম তাহাকে বলিলেন, “খবর কি?”
রামকান্ত বলিল, “বিশেষ কিছু না। গোপালের সেই সব কাগজ-পত্র পড়িলেন?”
“হাঁ, পড়িয়াছি, নিশ্চয়ই এই গোপালের কন্যা লীলা নরেন্দ্রভূষণ বাবুর একজন ওয়ারিসান—আর সে আপাততঃ চুরি গিয়াছে। কিন্তু যখন আমরা জানিতে পারিব যে, কে মেয়েটিকে চুরি করিয়াছে, তখন এই রহস্য অনেকটা পরিষ্কার হইয়া যাইতে পারে।”
“হাঁ, তা পারে, তবে আমরা কিরূপে জানিব যে, কে এই মেয়ে চুরি করিয়াছে?”
“আমি জানি, আমার মাথা হইতে এ কথা সরাইতে পারিবে না।”
“কে সে?”
“স্বয়ং কৃতান্ত।”
“কতকটা তাহাই মনে হয়, তবে ঠিক করিয়া কিছু বলা যায় না।”
“সে যদি না হয়, তাহা হইলে কে আর করিবে?”
“আপনি বলিতেছেন যে, আপনার নিকট যে লোক আসিয়াছিল, সে-ই কৃতান্ত। তাহা যদি হয়, তবে সে দমদমা স্টেশনে রেলে উঠিয়াছিল, সেই গাড়ীতে খুনের বাড়ীর দাসীও গিয়াছিল, তাহা হইলে নৈহাটির মধ্যে কোন জায়গায় তাহার একটা আড্ডা আছে—আমার বিশ্বাস,সেই মাগিটাই মেম সাজিয়াই গোপালের মেয়েকে চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছে।”
“তুমি যাহা বলিতেছ, এ সমস্তই আমি ভাবিয়া দেখিয়াছি; আমি মনে মনে একটা স্থিরও করিয়াছি। আজ আমার সঙ্গে কৃতান্তের দেখা করিবার কথা আছে।”
“সে নিজে আসিবে?”
“না, ঘনশ্যাম মূৰ্ত্তিতে আসিবে—সে যাহা আমাকে বলিবে, আমি তাহা আগেই বুঝিয়াছি, তাহাই যদি বলে, তবে তোমাকে আমার সঙ্গে দিন কত বাহিরে যাইতে হইবে।”
“কোথায় যাইতে হইবে, গুরুদেব?”
“কৃতান্তের সঙ্গে দেখা হইবার পর তোমাকে সকল বলিব।”
রামকান্ত কোন কথা কহিল না। গোবিন্দরাম বলিলেন, “আর দেরী করা উচিত নয়, বেলা দুই প্রহরের পর কৃতান্তের আসিবার কথা আছে—চল কলুটোলায়—সেখানে গিয়া আমাকে নবাব হইতে হইবে– তুমি আরদালী হইবে।”
রামকান্ত মৃদুহাস্য করিয়া বলিল, “যো হুকুম।”
উভয়ে তখনই কলুটোলায় ফিরিলেন। রামকান্ত দেখিল, বাগবাজারের মুদি সেই বাড়ীর সম্মুখে ঘুরিতেছে—তাহাকে দেখিয়া রামকান্ত ভাবিল, “মুদিটা ফিরিয়াছে দেখিতেছি—এখন ইহার সহিত কথা কওয়া হইবে না, পরে দেখা যাইবে।”
তাঁহারা পূর্ব্ব হইতেই নবাব ও আরদালীর বেশ ধারণ করিয়াছিলেন। তাঁহারা গৃহে ফিরিয়া আসিয়া দেখিলেন যে, স্বয়ং কৃতান্ত নবাবের জন্য অপেক্ষা করিতেছেন।
নবাব বলিলেন, “আমি দুই একটা জিনিস কিনিবার জন্য হইয়াছিলাম; আপনাকে বোধ হয়, অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিতে হইয়াছে?”
কৃতান্ত বলিলেন, “না, এইমাত্র আসিয়াছি।”
“অনেক দিন আপনাকে দেখি নাই?”
“সৰ্ব্বদাই কাজে ব্যস্ত থাকি, সময় পাই না।”
“আজ নিশ্চয়ই কোন কথা আছে?”
“একটু ঘনশ্যামবাবুর উপর সন্তুষ্ট হইয়াছেন?”
“হাঁ, তিনি আমার কাজে বিশেষ যত্ন করিতেছেন।”
“হাঁ, তাঁহার সঙ্গে কাল আমার দেখা হইয়াছিল।”
“তিনি আর কিছু সন্ধান পাইয়াছেন?”
“হাঁ, তিনি আমাকে ত বলিলেন যে, আর এক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি আপনাকে নরেন্দ্রভূষণবাবুর ওয়ারিসানদের সংবাদ দেবেন। তবে এ কথা বলিবার জন্য আপনার কাছে আসি নাই।”
“তবে কি জন্য বলুন।”
“আপনার কাছে বিদায় লইতে আসিয়াছি।”
“সে কি! কোথায় যাইবেন?”
“দিন-কতকের জন্য পশ্চিমে যাইতে হইবে—একটা কাজ পড়িয়াছে।”
নবাব মুখখানা ম্লান করিয়া বলিলেন, “আপনার সঙ্গে আর দেখা হইবে না, বড় দুঃখিত হইলাম, আমি যদি আর একসপ্তাহেরে মধ্যে নরেন্দ্রভূষণের বিষয় জানিতে পারি, তাহা হইলে আমিও শীঘ্রই দেশে ফিরিব, অনেক দিন এখানে রহিয়াছি।”
কৃতান্ত কুমার বলিলেন, “তাহা ত নিশ্চয়—কাহার বাড়ী ছাড়িয়া বিদেশে থাকিতে ইচ্ছা হয়?” নবাব বলিলেন, “আপনি কতদিনে ফিরিবেন?”
কৃতান্তকুমার বলিলেন, “বেশীদিন নয়, বোধ হয়, একমাসের মধ্যেই ফিরিতে পারিব।”
নবাব বলিলেন, “তাহা হইলে হয় ত আমার সঙ্গে দেখা হইলেও হইতে পারে।”
কৃতান্তকুমার বলিলেন, “সম্ভব, পাছে দেখা না হয় বলিয়া দেখা করিতে আসিলাম।”
নবাব জিজ্ঞাসা করিলেন, “তাহা হইলে ঘনশ্যাম বাবু এক সপ্তাহের পরেই আমার সঙ্গে দেখা করিবেন?”
“হাঁ, তিনিও আপাততঃ বাহিরে যাইতেছেন।”
“তাহা হইলে নরেন্দ্রভূষণ বাবুর ওয়ারিসান কলিকাতায় নাই?”
“তিনি আমাকে এখনও বিশেষ কিছু বলেন নাই।”
এই বলিয়া কৃতান্ত উঠিলেন; নবাব তাঁহাকে আর থাকিবার জন্য অনুরোধ করিলেন না; কৃতান্ত বিদায় হইলেন।
কৃতান্তকুমার চলিয়া গেলে রামকান্ত আসিয়া বলিল, “এ কি মতলবে এবর আসিয়াছিল—কি বলিল?”
গোবিন্দরাম বলিলেন, “ঠিক বলিতে পারি না, তবে এখন ঠিক বুঝিয়াছি, কৃতান্ত ও ঘনশ্যাম একই লোক; বলিল, বিদেশে যাইতেছে। আর আমরা নিশ্চিন্ত বসিয়া থাকিলে লীলা ও সুহাসিনীকে রক্ষা করিতে পারিব না।”
“তাহা হইলে আপনি মনে করেন ইহারই লোক লীলাকে চুরি করিয়াছে—সুহাসিনীকেও জোর করিয়া লইয়া যাইতেছিল।”
“হাঁ, আমি এ বিষয়ে প্রায় নিশ্চিত হইয়াছি। সেদিন পারে নাই, আবার তাহাকে ধরিয়া লইয়া যাইবার চেষ্টা করিবে।”
“তাহা হইলে বিনোদিনীকে নরেন্দ্রভূষণের ওয়ারিসান বলিয়া এই লোকেই খুন করিয়াছে?”
“খুব সম্ভব।”
“তাহা হইলে এ কথা পুলিস কমিশনারকে সংবাদ দিলেই ত সুরেন্দ্র বাবু খালাস হইতে পারেন?”
“এখন ইহার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ নাই, এখন পুলিসে সংবাদ দিলে কোন কাজ হইবে না।”
“তাহা হইলে উপায়?”
“উপায় ইহাকে হাতে-নাতে ধরিতে হইবে।”
“কিরূপে ইহাকে ধরা যাইবে?”
“আমার বিশ্বাস, কলিকাতার কাছে নৈহাটির মধ্যে কোন স্থানে কৃতান্তের একটা আড্ডা আছে—খুব সম্ভব, সেইখানে ঝি মাগীটা আছে, সেইখানেই গোপালের মেয়েটাকে লুকাইয়া রাখিয়াছে। সেইখানেই এ সুহাসিনীকেও পাঠাইবে, তাহার পর কোন গতিকে ইহাদের দুইজনকে হত্যা করিবে, তাহা হইলে নরেন্দ্রভূষণের অন্য ওয়ারিসান সমস্ত টাকা পাইবে—”
“সে কে, কৃতান্ত নিজে নয়?”
“ঠিক বলিতে পারি না—সম্ভবতঃ নয়, কোন এক ওয়ারিসানকে হাত করিয়াছে।”
“তাহা হইলে বোধ হইতেছে, কৃতান্তই হাবার মাথার মৃতদেহ চাপাইয়া লইয়া যাইতেছিল।”
“খুব সম্ভব, ইহার একখানা ঘরের গাড়ী আছে, এই গাড়ীই সেদিন হাতিবাগানে রাখিয়াছিল—এই গাড়ীতেই গোপালের মেয়েকে লইয়া গিয়াছে।”
“তাহা হইলে নিশ্চয়ই সে সেদিন দমদমার রেলে উঠিয়া এইখানে গিয়াছিল।”
“হাঁ, আমার বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।”
“তাহা হইলে এখন কি করিতে বলেন?”
“ইহার এই আড্ডা খুজিয়া বাহির করিতে হইবে, ইহার সঙ্গ লইলে আজই হউক, কালই হউক, ইহার আড্ডা জানিতে পারিবে। সম্ভবতঃ, তুমি এবার আর তাহাকে চোখের আড়াল দিয়ো না।”
রামকান্ত সবেগে বলিল, “আবার! আর যাদু আমার চোখে ধুলা দিতে পারিতেছে না।”
গোবিন্দরাম গম্ভীরভাবে বলিলেন, “আমি যাহা ভাবিতেছি—তাহা সমস্তই অনুমান মাত্র, এখনও কোন প্রমাণ নাই। ভগবান করুণ, আমি যাহা ভাবিতেছি, তাহাই যেন ঠিক হয়, এখনও পনের দিন সময় আছে—এই পনের দিনের মধ্যে সুরেন্দ্রর ফাঁসী হইবে না। ভগবান নিশ্চয়ই আমাদের সহায় হইবেন। এই পনের দিনের মধ্যে সমস্ত রহস্যের উদ্ভেদ করিতে হইবে।”
৩৪
রামকান্তকে কৃতান্তের অনুসরণ করিতে পাঠাইয়া গোবিন্দরাম সুহাসিনীর জননীকে একখানি পত্র লিখিতে আরম্ভ করিলেন।
তাঁহাকে কন্যা সম্বন্ধে বিশেষ সাবধান হইতে অনুরোধ করিলেন; আরও লিখিলেন যে, সুরেন্দ্রর খালাস পাইবার বিশেষ সম্ভবনা হইয়াছে, হতাশ হইবার কোন কারণ নাই।
তিনি পত্রখানি বন্ধ করিতেছিলেন, এমন সময়ে ম্লানমুখে রামকান্ত তথায় আসিয়া উপস্থিত হইল। এত শীঘ্র যে সে ফিরিবে, ইহা গোবিন্দরাম আশা করেন নাই। সেইজন্য একটু বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “কি ব্যাপার, এত শীঘ্র ফিরিলে যে?”
রামকান্ত বিষণ্ণভাবে বলিল, “শয়তান তাহার সহায়—এবারও সে আমার চোখে ধূলা দিয়াছে।”
“সে কি! তুমি বড় অসাবধান।”
“হাঁ, কি করিব? সে একেবারেই বাড়ী যাই নাই, ঘনশ্যামের যে ঠিকানা দিয়াছিল, সেখানে গিয়া জানিলাম, ঘনশ্যামও আজ সকালে রেলে কোথায় গিয়াছে।”
“কেমন করিয়া জানিলে কৃতান্ত বাড়ী যায় নাই?”
“তাহার বিশেষ সন্ধান লইয়াছি, সে কাল রাত্রি হইতে একেবারেই বাড়ী যায় নাই।”
“ইহাতে লোকটার যে অনেক আড্ডা আছে, তাহা বেশ জানা যাইতেছে।”
“এখন উপায়?”
“উপায়, ইহার আড্ডার সন্ধান করা, আর চুপ করিয়া থাকিলে চলিতেছে না। আমি যাহা করিতে ইচ্ছা করিয়াছি, আর তোমাকে যাহা করিতে হইবে, সব তোমাকে বুঝাইয়া বলিতেছি।”
“বলুন, আপনি যাহা বলিবেন, তাহা প্রাণপণে করিব।”
“প্রথম—কৃতান্ত ভিন্ন ভিন্ন নামে, ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বাস করে, ইহার কলিকাতার বাহিরেও আড্ডা আছে।”
“এ ত বুঝা যাইতেছে।”
“হাঁ, তবে এ আড্ডা কোথায় এটা জানা গিয়াছে যে, এই আড্ডা কলিকাতা হইতে খুব দূরে নহে, সেখানে ঘোড়ার গাড়ীতেও যাওয়া যায়।”
“আমিও তাহাই মনে করি।”
“তাহা হইলে এই স্থান হইতে সাত-আট ক্রোশের বেশী নয়, ঘোড়ার গাড়ী ঘোড়া না বদলাইয়া ইহাপেক্ষা অধিক দূর যাইতে পারে না।”
“বিশেষতঃ ঘরের গাড়ী।”
“হাঁ, ইহাও ঠিক, সেই গাড়ী সেই আড্ডাতেই থাকে, সেই গাড়ীর কোচম্যান, সহিত তাহারই দলের লোক, এই গাড়ীতেই লীলাকে লইয়া গিয়াছে, তাহা হইলে বুঝা যাইতেছে, এই আড্ডা ব্যারাকপুর ও কলিকাতার মধ্যে কোন স্থানে।”
“আপনি যাহাই বলতেছেন, তাহাই ঠিক।”
“যখন এখানে গাড়ী যায়, তখন এ স্থান নিশ্চয়ই ট্রাঙ্ক রোডের উপরে বা ইহার নিকটে, অথচ কোন রেল স্টেশনের কাছে।”
“তাহা হইলে এখান হইতে ব্যারাকপুর পর্য্যন্ত আমাদের সকল জায়গায় অনুসন্ধান করিতে হইবে?”
“হাঁ, ইহাই আমি স্থির করিয়াছি।”
“কি বেশে? নবাব ও আরদালী হইয়া গেলে কি সুবিধা হইবে?”
“না, তুমি মুসলমান বাক্সওয়ালা হইবে, আর আমি পাট কিনিতে বাহির হইব।”
“দুইজনে তাহা হইলে একত্রে যাওয়া যাইবে না?”
“না, তুমি বাক্সতে সাবান, ছুরি, কাঁচি, রুমাল মোজা প্রভৃতি লইয়া গ্রামে গ্রামে বেচিবে, আলাহিদা যাইবে, সব বাড়ী দেখিবে, কোথায় ইহার আড্ডা সন্ধান লইবে। আমিও পাট ও ভূষিমালের দালাল হইয়া স্বতন্ত্রভাবে গিয়া সন্ধান লইব। এরূপ করিলে দুই-চারদিনের মধ্যেই জানিতে পারিব, এ কোথায় যায় আর কোথায় থাকে।”
“বুঝিয়াছি, কবে রওনা হইবেন?”
“আজ সমস্ত ঠিক করিয়া লও, কাল সকালেই রওনা হইব।”
রামকান্ত বাক্সওয়ালা সাজিবার জন্য বাজারে বাহির হইল। গোন্দিরামও প্রস্তুত হইবার জন্য সমস্ত আয়োজন করিতে লাগিলেন।
তাঁহাদের উভয়ের সিমলার বাড়ীতে রাত্রে মিলিত হইবার কথা ছিল। যখন গোবিন্দরাম ও রামকান্ত মিলিত হইলেন, তখন উভয়ের এমনই পরিবর্ত্তন হইয়াছে যে, আগে হইতে জানা না থাকিলে উভয়ে উভয়কে চিনিতে পারিতেন না।
কাহার সাধ্য রামকান্তকে মুসলমান না বলে—ঠিক সেই বেশ, সেই ভাব, মাথায় মুসলমানী টুপি, পরিধানে লুঙ্গি, সঙ্গে মুটের মস্তকে বাক্স, এই মুটে গোবিন্দরামের বহুকালের বিশ্বাসী ভৃত্য।
গোবিন্দরামকে দেখিলে নব্য বাঙালী যুবক বলিয়া বোধ হয়, তাঁহার পরিধানে রেলির থান, তাহার উপর চাপকান, হাতে একটা গ্লডস্টোন ব্যাগ।
তাঁহারা সেই রাত্রিতেই সিমলার বাড়ী পরিত্যাগ করিলেন। একখানা গাড়ী আনিয়া রামকান্ত শিয়ালদহ স্টেশনে গেল, তথা হইতেই প্রাতের গাড়ীতেই রওনা হইবে।
গোবিন্দরাম আর একখানা গাড়ীতে বেলঘরিয়ার দিকে চলিলেন। রামকান্ত ঘুঘুডাঙা ও দমদম ক্যান্টনমেন্ট প্রভৃতি স্থানে বাড়ী বাড়ী ঘুরিলেন, কিন্তু কৃতান্ত বা ঘনশ্যাম বা সেই ঝির কোন সন্ধানই পাইলেন না, তখন তিনি সোদপুর রওনা হইলেন। বেলঘরিয়া দেখিয়া গোবিন্দরামের খড়দহ দেখিবার কথা ছিল।
বেলঘরিয়ায় গিয়া গোবিন্দরামের সহিত বিনয়কুমার নামে একটি ভদ্রলোকের দেখা হইল; কথায় কথায় সুমাধব ও বিনোদিনীর খুনের কথা উঠিল। তিনি বলিলেন, “সুমাধব আমার বিশেষ বন্ধু ছিলেন।”
গোবিন্দরাম বিস্মিতভাবে বলিলেন, “তাহা হইলে আপনি খুনের মোকদ্দমায় সাক্ষ্য দিয়াছিলেন।”
“না, আমাকে কেহ ডাকে নাই, আমি অনর্থক সাক্ষ্য দিতে যাইব কেন? তবে আমি তাঁহার সকল কথাই জানিতাম। তিনি যে দিন খুন হন, সেদিন অনেক রাত্রে আমার সঙ্গে সেই বাড়ীর কাছে তাঁহার দেখা হইয়াছিল। গেবিন্দরাম বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিলেন, “তাহা হইলে আপনি এ বিষয়ে সকলই জানেন; আমি কতক কতক শুনিয়াছিলাম।”
“আমি যাহা জানি, তাহা আর কেহ জানে না।”
“আপনার পুলিসে সংবাদ দেওয়া উচিত ছিল।”
“গায়ে পড়িয়া! আপনি ত খুব লোক দেখিতেছি, অনর্থক পুলিসে হাঙ্গামায় যায় কে?”
“আপনার সঙ্গে তাঁহার সে রাত্রে দেখা হইয়াছিল?”
“সেই বাড়ীর কাছে, আমাকে স্ত্রীলোকটার কথা বলিয়া তাঁহার বাড়ী সে রাত্রে লইয়া যাইবার জন্য অনেক জেদাজেদী করিয়াছিলেন।”
“আপনি সঙ্গে গেলে বোধ হয়, তিনি খুন হইত না।”
“হাঁ, দুইটা জায়গায় তিনটা খুন হইত।”
“দুইজন থাকিলে কি সাহস করিত?”
“তাহারাও দলে ভারি ছিল, হাবাটা ত ছিলই, স্পষ্ট জানা যাইতেছে। আর তাঁহার যে এইরূপ ঘটিবে, তাহা আমি জানিতাম।”
“কিরূপে জানিতেন?”
‘সেইদিনই তিনি বলিয়াছেন যে, আর একটা লোক তাঁহার পিছনে বড় লাগিয়াছে, স্ত্রীলোকটি তাহাকে না কি আগে ভালোবাসিত, এখন আবার সে ইহার কাছে যাওয়া-আসা করিতেছে, ইহাকে লইয়া স্ত্রীলোকটির সহিত তাঁহার প্রায়ই ঝগড়া হইতেছিল। আমি তখনই ভাবিয়াছিলাম,সুমাধবের অদৃষ্টে দুঃখ আছে, শেষে খুন পৰ্য্যন্ত হইল।”
“তিনি আর কিছু বলেন নাই?”
“বলেন নাই! আমি তাঁহাকে বলিলাম, “বাপু, ভাল চাও ত এ স্ত্রীলোকে ছাড়িয়া দাও।” সে বলিল, “ছাড়িয়া দিব, সে যদি আবার আসে, তাহা হইলে তাহার হাড় এক জায়গায়, মাস এক জায়গায় করিব, আর ইহার বাড়ী আসিলে তাহারই একদিন কি, আমারই একদিন।”
“সে কে, তিনি তাহা কি কিছু বলিয়াছেন?”
“হাঁ, বলিয়াছেন, সুরেন্দ্র বলিয়া একটা লোক-তা ঠিক হইয়াছে, তাহার ফাঁসী হইয়াছে, খুন কি কখনও চাপা থাকে। একটা সামান্য মেয়ে মানুষের জন্যে দুটো ভদ্রলোক মারা গেল, স্ত্রীলোকটাও মরিল, ইহা দেখিয়া-শুনিয়াও লোকের শিক্ষা হয় না।
গোবিন্দরাম ভাবিলেন, তবে ইহারও বিশ্বাস সুরেন্দ্র খুনী।
তিনি অতিকষ্টে মনোভাব গোপন করিলেন। সেখান হইতে বিদায় হইতেছিলেন, এমন সময়ে একজন বৈরাগী আসিয়া গান ধরিল; –
“বল মাধাই স্বরে।
হরিনাম বিনে আর কি ধন আছে সংসারে?
এই নামের গুণে, গহন বনে, শুষ্ক তরু মুঞ্জরে।
বল মাধাই—”
বিনয়কুমার বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “বাপু, গান বন্ধ কর, এখানে কিছু হইবে না।”
বৈরাগী গান বন্ধ করিয়া বলিল, “রাগ করিতেছেন কেন? আজ আর গান না করিলে চলিবে; আজ যে বিদেশী বাবু গঙ্গার ধারের বাগানে আছেন, তিনি আমাকে বেশ দু-পয়সা দিয়েছেন।”
“তাহা দিবে না কেন? সে বদ্ধ মাতাল।”
গোবিন্দরাম বলিলেন, “এ বাবুটি কে?”
বৈরাগী বলিল, “মহৎ লোক।”
বিনয়কুমার বলিলেন, “ঘোর মাতাল; দিন রাত খাইতেছে, ত্রি-সংসারে কেহ নাই, বলে কোথায় পূর্বাঞ্চলে তার জমিদারী আছে।”
গোবিন্দরাম বলিলেন, “তাহা হইলে ইহার নিকট পাটের সন্ধান পাওয়া যাইতে পারে।
বিনয় কুমার বলিলেন, “হাঁ, ভাল লোক স্থির করিয়াছেন, বরং মদের সন্ধান লইবেন, কাজ হইবে।”
গোবিন্দ হাসিয়া বলিলেন, “আপনি দেখিতেছি, লোকটার উপর বড় বিরক্ত।”
বিনয়কুমার বলিলেন, “মহাশয়, তাহার সঙ্গে আমার আলাপ নাই, লোকে যাহা বলে তাহাই বলিতেছি; লোকটা প্রায় ছয়মাস এখানে আছে, কোন ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করে না; কোথায় বাহির হয় না, কাহারও সঙ্গে দেখা করে না; তাহার পর সে যে বাগানে আছে, সেটা পড়োবাগান, বাড়ীটা ভাঙ্গা, চিরকাল শুনিয়া আসিতেছি, বাড়ীটায় ভূত আছে। এখানকার কেহ সন্ধ্যার পর সেদিকে যায় না। এখন আপনি বুঝিয়া দেখুন, এ লোকটা কেমন।”
গোবিন্দরাম বলিলেন, “এইজন্যই যে লোকটা খারাপ, এ কথা বলা যায় না।”
“সে আপনার ইচ্ছা, আপনি আলাপ করিয়া দেখিবেন।”
এই বলিয়া বিনয়কুমার বিরক্তভাবে চলিয়া গেলেন। বৈরাগীও প্রস্থান করিয়াছিল।
গোবিন্দরাম চিন্তিতভাবে বলিলেন, “এই লোকটাকে আমার একবার দেখিতে হইল।”
৩৫
রাত্রে পেনেটির গঙ্গার ঘাটে গোবিন্দরাম ও রামকান্তের মিলিত হইবার কথা ছিল। সন্ধ্যা হইবামাত্র গোবিন্দরাম ঘাটে উপস্থিত হইলেন; দেখিলেন, রামকান্ত তাহার পূর্ব্বে আসিয়া ঘাটে বসিয়া আছে।
রামকান্ত গোবিন্দরামকে দেখিয়া বলিল, “গুরুদেব, অনেক কথা জানিয়াছি।”
গোবিন্দরাম বলিলেন, “প্রথমে শুনিতে চাই, কেহ ত তোমায় অনুসরণ করে নাই?”
রামকান্ত বলিল, “না, কোন ভয় নাই, আমি খুব সাবধানে আছি।”
“আমার সঙ্গে এখানে একটা লোকের আলাপ হইয়াছে, সে কতকটা বোধ হয়, আমাকে সন্দেহ করিয়াছে–সে আমাদের সঙ্গ লইতে পারে।”
“তাহার নাম বিনয় না?”
“তুমি কেমন করিয়া জানিলে?”
“অনেক কথা জানিয়াছি; এখানকার সব লোকেই তাহাকে চিনে, আর তাহাকে খারাপ লোক বলে।”
“যাক, তাহার কথা –কোন সূত্র পাইলে?”
“দুইটা পাইয়াছি।”
“কি—কি?”
“প্রথম—সোদপুরে গঙ্গার ধারে একজন হিন্দুস্থানী একটা বাগান ভাড়া লইয়াছে, এখানে সে ও তাহার সঙ্গে একটি বাঙ্গালি স্ত্রীলোক, মধ্যে মধ্যে আসে, তাহারা এখানে বাস করে না, দুই এক দিন থাকিয়া চলিয়া যায়–আমরা এই রকমই ত খুজিতেছি।”
“এটার সন্ধান ভাল করিয়া লইতে হইবে। আর কি জানিয়াছ?”
“আর একটি বিদেশী লোক এখানে গঙ্গার ধারের একটা বাগানে থাকে।”
“আমি তাহার কথা শুনিয়াছি। তুমি ইহার বিষয় কি শুনিয়াছ,বল শুনি।”
“এই লোকটা দারুণ মাতাল, দিন রাত মদে ডুবিয়া আছে। লোকটা কাহারও সঙ্গে দেখা করে না, কাহারও সঙ্গে আলাপ নাই, কেবল দুইটা চাকর আর একটা দাসী আছে।”
“ইহাতে বলা যায় না, সে কৃতান্তের দলের লোক।”
“হাঁ, তাহা নয়—তবে এ লোকটার সন্ধান লইতে হইবে; শুনিয়াছি, ইহাদের একখানা গাড়ী আছে।”
“কোথায়ও যায় না, তবে গাড়ী লইয়া কি করে?”
“এইজন্যই ত সন্দেহ।”
“ইহারও সন্ধান লইতে হইবে–গোপালের মেয়ের কোন সন্ধান পাইলে?”
“না, অনেককেই জিজ্ঞাসা করিয়াছি, কেহ ইহার কোন সন্ধান বলিতে পারে না। এই বিদেশী লোকটার চাকরদের বিষয়ে একটু নতুনত্ব আছে।”
“কি রকম?”
“শুনিলাম, চাকরদের দুইজন মধ্যে মধ্যে কোথায় চলিয়া যায়, তখন দুইজন নতুন লোক আসে—আবার চলিয়া গেলে পুরাতন দুইজন ফিরিয়া আসে।”
“হাঁ, এটা সন্দেহজনক নিশ্চয়।”
“নিশ্চয়ই। আমি স্থির করিয়াছি, কাল এই বাগানে প্রবেশ করিব।”
“জিনিস বেচিতে?”
“হাঁ, মাতালের মুখ হইতে কথা বাহির করিতে বিশেষ বিলম্ব হইবে না।”
“আমিও পাটের সন্ধানে এই বাবুর সঙ্গে আলাপ করিতে যাইব, তুমি চাকরদের দিকে নজর রাখিয়ো।”
“এই ঠিক বন্দোবস্ত।”
“তাহার পর কাল রাত্রে আবার এখানে আসিয়া উভয়ে মিলিব।”
“হাঁ, তাহাই করিব।”
“যাহাই হউক, আর সময় নাই—আর কেবল বারটা দিন আছে মাত্র—এই বার দিনের মধে সকল কাজ শেষ করিতে হইবে, নতুবা সুরেন্দ্রর রক্ষার আর কোন উপায় নাই।”
“গুরুদেব! আমরা যাহা ভাবিয়াছি, তাহা যদি ঠিক না হয়?”
“না হয়, ভগবান সহায়—তবে এ পর্যন্ত আমার অনুমান কখনও মিথ্যা হয় নাই।”
“ভগবান করুণ, তাহাই হউক।”
এই সময়ে গোবিন্দরাম রামকান্তের গা টিপিলেন, এতক্ষণ ঘাটে কেহ ছিল না, তাঁহারা কাহার পদশব্দ শুনিলেন। কে ধীরে ধীরে যেন ঘাটের দিকেই আসিতেছিল।
গোবিন্দরাম অনুচ্চস্বরে বলিলেন, “যাও তুমি অন্যদিকে যাও—আমি এইদিকে যাই, কাল আবার এখানে দেখা হইবে।”
উভয়ে অন্ধকারে অন্তর্হিত হইলেন। একটু অগ্রসর গোবিন্দরাম যে ব্যক্তি আসিতেছিল, তাহাকে দেখিবার চেষ্টা পাইলেন। স্পষ্ট দেখিলেন, সে বিনয়কুমার।”
গোবিন্দরাম মনে মনে বলিলেন, “লোকে বড় মিথ্যা বলে নাই।”
পরদিবস গোবিন্দরাম, প্রাতেই গঙ্গার ঘাটের দিকে চলিলেন। চারিদিকেই ভাল ভাল বাগান, একটা ক্ষুদ্র গলির ভিতরে একটা পড়োবাগান দেখিতে পাইলেন। তাহার মধ্যেস্থ বাড়ীটিও ভগ্নপ্রবন, কোন লোক যে এ বাড়ীতে আছে বলিয়া বোধ হয় না।
গোবিন্দরাম বলিলেন, “নিশ্চয়ই এই সেই বাগান, এইটাই ভাঙ্গাবাড়ী—এইখানেই সেই লোক থাকে।” তিনি অগ্রসর হইয়া বাড়ীর দ্বারের দিকে চলিলেন, কিন্তু সহসা তাঁহার এক ব্যক্তির প্রতি দৃষ্টি পড়িল; তিনি দেখিলেন, একটি ব্রাহ্মণ পন্ডিত গোছের লোক, গঙ্গার দিকে যাইতেছেন। গোবিন্দরাম ভাবিলেন, হয় ত লোকটি স্নানে যাইতেছে, কিন্তু এ দিকে ত ঘাট নাই—সবই ভাল করিয়া দেখা ভাল। তিনি পথিপার্শ্বস্থ একটি বৃক্ষের অন্তরালে দাঁড়াইলেন।
তখন তিনি দেখিলেন, ব্রাহ্মণ একটি লোককে কি সঙ্কেত করিতেছে, পর মুহূর্তে তিনি দেখিলেন, আর একটি লোক উঠিয়া দাঁড়াইয়া হাত নাড়াইয়া কি সঙ্কেত করিল, তৎপরে তাহারা কোথায় গেল, তিনি আর তাহাদের দেখিতে পাইলেন না। তাহারা বাগানের প্রাচীরের পশ্চাতে কোথায় চলিয়া গেল। তিনি অগ্রসর হইলে উভয়ের কাহাকেই আর দেখিতে পাইলেন না।
গোবিন্দরাম বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “লোক দুইটা কোন দিকে কোথায় গেল, নৌকায় যায় নাই ত? কিন্তু তিনি গঙ্গার ধারে আসিয়া দেখিলেন, সেখানে একটা অর্ধভঙ্গ মন্দির রহিয়াছে, ব্রাহ্মণ ও সেই লোকটি এই মন্দিরে প্রবেশ করিলেন। গোবিন্দরাম ভাবিলেন, “বোধ হয়, ব্রাহ্মণ এই মন্দিরের পুরোহিত, লোকটা মন্দিরের চাকর–যাক্, ইহাদের কথা ভাবিয়া লাভ কি, যাহা করিতে আসিয়াছি, তাহাই করা যাক্।”
তিনি বাগানের ভিতর প্রবেশ করিলেন, সেখানেও এক নতুন ব্যাপার দেখিলেন। বাগানের ভিতরে জল আনিবার জন্য গঙ্গা হইতে একটা বড় নালা রহিয়াছে, ঐ নালার মুখে একটা কবাট, একব্যক্তি সেই কবাটের পার্শ্বে কোদাল লইয়া মাটি কাটিতেছে।
লোকটা গোবিনন্দরামের পদশব্দ শুনিয়া, মাথা তুলিয়া তাঁহার দিকে চাহিল; তৎক্ষণাৎ সে ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটিয়া একদিকে পালাইল।
গোবিন্দরাম বলিলেন, “এ লোকটা মাটি কাটিতেছিল, আমার দেখিয়া পলাইল কেন? এ বাড়ীর কাছে অনেক অদ্ভুদ ব্যাপার দেখিতেছি; দেখা যাক, বাড়ীর মালিকটি কি রকম।
তিনি বাড়ীর দ্বারে আসিলেন। দেখিলেন, নীচের একটি ঘরে একটি লোক কি রন্ধন করিতেছে। তাহাকে দেখিয়া গোবিন্দরাম ভাবিলেন, “এইটিই দেখিতেছি, বাবুর চাকর, ঠিক একটি বনমানুষ বলিলেও অত্যুক্তি হয় না।”
সে ফিরিয়া চাহে না দেখিয়া গোবিন্দরাম গলার শব্দ করিলেন। তখন সেই মুর্ত্তি তাঁহার দিকে ফিরিয়া বলিল, “এখানে কি চাও?”
“বাবু কাহারও সঙ্গে দেখা করেন না।”
“তাঁহার কাছেই আসিয়াছি—কিছু লাভ হইবে–তোমারও দুই পয়সা আছে।”
“তিনি ঘুমোচ্ছেন।”
“এখনই উঠিবেন—আমি অপেক্ষা করিতে পারি?”
“কি দরকার?”
“আমার মদের দরকার আছে—শুনিয়াছি, বাবুর অনেক মদের দরকার।”
“অনেক”
“আমার কাছ থেকে লইলে তোমাকে খুসি করিব।”
“ধারে?”
“ধারে দিব বই কি—বাবু বড়লোক।”
“কত আমার?”
“এখন দশ টাকার নোটখানা লও—পরে আরও খুসী করিব।”
ভৃত্য সত্বর নোটখানি বস্ত্রমধ্যে রাখিয়া বলিল, যাও—উপরে।”
গোবিন্দরাম সত্বর উপরে উঠিতে লাগিলেন। দুই তিনটা গৃহে কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না; পরে দেখিলেন, একটা ঘরে একটা ফরাসের উপরে একটি তাকিয়া ও একটি বাবু; বাবুটি অর্দ্ধশায়িত হইয়া ফরাসীতে তামাক টানিতেছেন। তিনি সেই ধুমপান রত বাবুটির নিকটস্থ হইয়া বলিলেন, “আপনার নাম শুনিয়া আসিয়াছি।”
বাবুটি বলিয়া উঠিলেন, “তুমি কে হে বাপু?”
গোবিন্দরাম বিনীত ভাবে বলিলেন, “আমার মদের কারবার আছে—আপনার অনেক খরচ—তাহাই।”
“সব বেটা মদওয়ালাকে আমি চিনি—ধারে কেবল জল।”
“আপনার মত বড়লোকে ধার দিব না? আপনি মহৎ লোক।”
“ঠকাইবার আর জায়গা পাও নাই—আমি লোককে ঠকাই?”
“মহৎ লোকের মহৎ কথা—কত বোতল পাঠাইব?”
“চুপ রও।”
এই বলিয়া তিনি একটা বোতল হইতে গেলাসে মদ ঢালিয়া গালধঃকরণ করিলেন; তৎপরে বলিলেন, “খেয়ে থাক?”
গোবিন্দরাম বিনীতভাবে বলিলেন, “না হুজুর।”
বাবু বলিয়া উঠিলেন, “গাধা!”
গোবিন্দরাম তটস্থভাব দেখাইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। বাবু আর এক গেলাস মদ উদরস্থ করিলেন; তৎপরে বলিলেন, “তার পর?”
গোবিন্দরাম বলিলেন, “তবে কত বোতল পাঠাইব?”
বাবু বলিলেন, “ধারে?”
“হাঁ হুজুর, আপনাকে ধারে দিব না ত কাহাকে দিব।”
“কে তোমাকে আমার কাছে পাঠাইয়াছে—সে-ই?”
“কাহার কথা বলিতেছেন, বুঝিলাম না; আমি আপনার নাম শুনিয়া আসিয়াছি।”
“আচ্ছা, চার ডজন আজই পাঠাইবে—টাকার জন্য ভয় নাই।”
“আপনার কাটে টাকার ভয় কি?”
“আমি শীঘ্রই দু-পাঁচ লাখ টাকা পাইব।”
“আপনার টাকার অভাব কি?”
“এখন আছে—শীঘ্রই থাকিবে না—ক্রোড়পতি হইব।”
“হইবেন বই কি?”
“চুপ রও—নাও হইতে পারি।”
“হুজুর যা বলেন।”
“পাই ত তাহার জন্যই পাইব—তাহাকে বখরা দিতে হইবে।”
“সে কে?”
“তোমার বাপু, সে কথায় কাজ কি?”
“না, নিশ্চয়ই কিছু নাই।”
“আমি ক্রোড়পতি।”
“নিশ্চয়ই।”
“এখন নয়, হইব।”
“হইবেন বই কি—তা না হলে আমাদের চলিবে কিসে?”
গোবিন্দরাম একটু নীরবে থাকিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন, “তবে আপনি অন্য কাহারও সম্পত্তি পাইবেন?”
বাবুটি রাগত হইয়া বলিলেন, “মিথ্যাকথা, কে তোমাকে সম্পত্তির কথা বলিল—আমি না-ই পাই, তোমার কি হে বাপু?”
গোবিন্দরাম যেন খুব অপ্রস্তুত হইলেন, এরূপভাব দেখাইয়া বলিলেন, “না, তাহাই বলিতেছি, তবে এখন বিদায় হইতে পারি—আপনি-আপনার নামটা জানিতে পারিলে বোতলগুলো পাঠাইয়া দিতে পারি।”
“আমার নাম—চমৎকার নাম, শ্যামসুন্দর; এই মদনমোহনের পাশাপাশি—সকলেই আমাকে জানে।”
“অবশ্যই, আপনাকে কে না চেনে?”
“কালই যেন সব বোতল আসে।”
“অবশ্যই আসিবে।”
“তবে এখন অনুগ্রহ করে দূর হও।”
গোবিন্দরাম গমনোদ্যত হইয়া দ্বার পর্য্যন্ত গিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইলেন; বলিলেন, “আপনার জননীর মাতুল মহাশয় বড়ই মহৎ লোক ছিলেন।”
শ্যামসুন্দর চোখ বিস্তৃত করিয়া বলিলেন, “আমার মার মামাকে তুমি কিরুপে চিনিলে? বাবা, তুমি যে সবজান্তা দেখিতেছি।”
গোবিন্দরাম বলিলেন, “আমাদের কারবার অনেক দিনের—তিনি আমাদের দোকান হইতে মাল লইতেন। আমাদের সাবেক খাতার প্রতি পাতায় তাঁহার নাম জ্বল জ্বল করিতেছে।”
“বটে—বটে—তবে তিনি নিশ্চয়ই মহৎ লোক ছিলেন—আজ যদি তিনি বেঁচে থাকতেন, তবে ত তিনি আমার ইয়ার।”
“হাঁ, নরেন্দ্রভূষণবাবু বড় মহৎ লোক ছিলেন।”
শ্যামসুন্দর চক্ষু বিষ্ফোরিত করিয়া প্রায় লম্ফ দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইবার উপক্রম করিলেন, কিন্তু উঠিলেন না—তিনি বোতল হইতে একপাত্র সুরা ঢালিয়া তৎক্ষণাৎ গলায় ঢালিয়া দিলেন। তিনি আর কোন কথা কহেন না দেখিয়া, গোবিন্দরাম আর এখানে বিলম্ব করা আবশ্যক বিবেচনা বরিলেন না। তিনি একটি নমস্কার করিয়া ধীরে ধীরে বিদায় হইলেন। শ্যামসুন্দর আর কোন কথা কহিলেন না।
বাহিরে আসিয়া গোবিন্দরাম ভাবিলেন, “কতকটা স্থির হইল, এই লোকটার সঙ্গে কৃতান্তের আলাপ আছে; লোকটা সম্পূর্ণই তাহার হাতের মধ্যে—কৃতান্ত যাহাই বলে তাহাই করে। কেবল ইহাই নহে, দেখা যাইতেছে যে, এই শ্যামসুন্দর শীঘ্রই কাহারও সম্পত্তি পাইবার আশা করিতেছে। তাহার পর নরেন্দ্রভূষণের নাম বলায় যেরূপ ভাব দেখিলাম, তাহাতেই বুঝিতে পারা যাইতেছে যে, এই শ্যামসুন্দরও নরেন্দ্রভূষণের একজন ওয়ারিসান। তবে ইহাকে যেরূপ দেখিতেছি, তাহাতে এ লোকটা সম্পূর্ণ অপদার্থ, ইহাকে অন্যে হাত করিয়াছে, এ অন্য লোকের হাতের গুতুলমাত্র—সে কে? নিশ্চয়ই কৃতান্ত। এখনও কি আমার অনুমান মিথ্যা হইবে? আমার যদি ভুল হয়, তাহা হইলে কি সর্ব্বনাশ হইবে! আর দশদিন মাত্র সময় আছে—ভাবিলে প্রাণ ব্যাকুল হইয়া ওঠে, বৃদ্ধ বয়সে ভগবান অদৃষ্টে এত কষ্ট লিখিয়াছিলেন। আর দশদিন মাত্র সময়—এই দশদিনের মধ্যে কিছু করিতে না পারিলেই—কি করিব—কি হইবে—ভগবানই জানেন।” এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে গোবিন্দরাম পুনরায় বেলঘরিয়ার বাজারের দিকে চলিলেন; সেইখানে তিনি বাসা লইয়াছিলেন।