২৫
এদিকে গোবিন্দরাম সন্ধ্যার কিছু পূর্ব্বে পুত্রের গৃহসান্নিধ্যে আসিয়া উপস্থিত হইলেন; দ্বারে পাহারা ছিল। ‘হুকুম নাই”, বলিয়া তাহারা তাঁহাকে বাড়ীতে প্রবেশ করিতে দিল না। তিন বলিলেন, “ভালই হইল, যদি হাবা সুরেন্দ্রনাথকে চিনিতে পারে—চোখের উপর সে দৃশ্য দেখিয়া হয় ত সহ্য করিতে পারিব না; তাহা অপেক্ষা সব চুকিয়া যাক্, পরে সাহেবের কাছে সব শুনিব।”
এইরূপ ভাবিয়া তিনি এক বৃক্ষতলে দাঁড়াইলেন, সেখান হইতে সুরেন্দ্রনাথের গৃহদ্বার তো দেখিতে পাওয়া যায়।
তিনি দেখিলেন, সন্ধ্যার প্রাক্কালে সাহেব ও অক্ষয়কুমার সুরেন্দ্রনাথকে লইয়া আসিলেন। তাঁহারা তিনজনে বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করিলেন।
সন্ধ্যার সময়ে সবেগে আর একখানা গাড়ী আসিল। তন্মধ্যে হইতে কয়েকজন নামিয়া বাড়ীর ভিতর চলিয়া গেল; তখন অন্ধকার হইয়াছিল,তিনি সেখান হইতে তাহাদের চিনিতে পারিলেন না। কিয়ৎক্ষণ পরেই আবার বাড়ীর ভিতর হইতে জনকয়েক আসিয়া গাড়ীতে উঠিল; একখানা গাড়ী চলিয়া গেল।
তাহার পর গোবিন্দরাম দেখিলেন—পোষাক ও টুপি দেখিয়া চিনিলেন যে, এবার সাহেব বাহির হইয়া আসিয়াছেন; তাহা হইলে কাজ হইয়া গিয়াছে; কি হইয়াছে, জানিবার জন্য তিনি ছুটিয়া সাহেবের নিকটে আসিলেন। ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হইল?”
সাহেব ভ্রূকুটি করিয়া মাথা নাড়িয়া বলিলেন, “আপনি কি তাহা অনুমান করিতে পারেন নাই?”
সাহেবের কন্ঠস্বরে একান্ত বিস্মিত হইয়া গোবিন্দরাম বলিলেন, “না, কেমন করিয়া জানিব? দ্বিতীয় গাড়ীখানাতে কৃতান্ত বাবু নিশ্চয়ই হাবাকে আনিয়াছিলেন।”
সাহেব বলিলেন, “হাবা আসে নাই। সে পলাইয়াছে—কি কেহ তাহাকে চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছে।”
“সে কি! কে তাহাকে লইয়া গিয়াছে?”
“আপনি সে কথাটা আমাদের বলিলে আমরা বাধিত হইব।”
“আমি! আমি কিরূপে বলিব?”
“তবে রামকান্ত বলিবে।”
“সে কখনও জানিয়া শুনিয়া তাহাকে পালাইতে দিবে না।”
“মহাশয়, আপনার নিকটে গোপন করিব না—আপনাকেই আমরা সন্দেহ করিয়াছি।”
“আমাকে! কেন?”
“হাবার সহিত আপনার ছেলের দেখা হইবার সমস্ত বন্দোবস্ত স্থির হইয়া গিয়াছে—এমন সময়ে হাবা পলাইল, ইহাতে কি মনে হয়? কাহার স্বার্থে হাবাকে সরাইয়া দেওয়া? আপনি ও আপনার গুণবান পুত্র জানিতেন যে, হাবা তাহাকে দেখিলেই চিনিতে পারিবে, তাহাই হাবাকে সরাইয়া দেওয়া হইয়াছে। এখন আপনি কি বলিতে চাহেন?”
“আপনি কি বলিতেছেন, আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছিনা। ইহাই যদি হইবে তবে আমি হাবাকে তাহার কাছে আনিবার জন্য আপনাকে এত জেদ করিব কেন?”
“তাহা আপনি ভাল জানেন।”
“তাহা হইলে আপনি আমাকে এ বিষয়ে দোষী মনে করিতেছেন?”
“আমি কাহাকেও দোষী মনে করি না; আমি এতদিন আপনাকে বন্ধুভাবে দেখিয়াছি—সে সম্বন্ধ আজ হইতে বিনষ্ট হইল—যান”, বলিয়া সাহেব গাড়ীতে গিয়া উঠিলেন। গাড়ী চলিয়া গেল।
গোবিন্দরাম কিয়ৎক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের ন্যায় অধম্মুখে তথায় নীরবে দাঁড়াইয়া রহিলেন। জীবনে তাহার কখনও এরূপ অবস্থা হয় নাই; তাঁহার বোধ হইল, যেন এ বৃদ্ধ বয়সে তাঁহার পদতল হইতে পৃথিবী সরিয়া যাইতেছে।
গোবিন্দরাম গৃহে ফিরিলেন। কি করিবেন সমস্ত রাত্রি তাহাই চিন্তা করিলেন; ভাবিলেন, “ইহার ভিতরে স্পষ্টতঃই একটা গুরুতর রহস্য আছে—আমার প্রাণ থাকিতে আমি বিশ্বাস করিতে পারিব না যে, সুরেন্দ্র এই ভয়াবহ কাজ করিয়াছে। অসম্ভব—অসম্বব! তবে কে এরূপে হাবাকে সরাইল? যদি হাবা সুরেন্দ্রনাথকে চিনিতে না পারিত, তাহা হইলে পুলিস তাহাকে ছাড়িয়া দিতে বাধ্য হইত; তখন হাবা কোথাকার, কাহার লোক পুলিস তাহারই সন্ধান করিত—এইজন্যই হাবাকে সরাইয়াছে। হয় ত সুরেন্দ্র ফাঁসী যাক, এই ইচ্ছায় ইহাকে লুকাইয়া ফেলিয়াছে। এত রহস্য ভেদ করিলাম, আর এ রহস্য ভেদ করিতে পারিব না? বয়স হইয়াছে—বৃদ্ধ হইয়াছি, ডিটেকটিভগিরি বহুকাল ছাড়িয়া দিয়াছি, তবুও এখনও অকর্ম্মণ্য হই নাই। সুরেন্দ্র জন্য আমাকে এ কাজে আবার নামিতে হইবে। দেখি, কতদূর কি করিতে পারি; এখন ত কিছুই ভাবিয়া স্থির করিতে পারিতেছিনা। তবে সুরেন্দ্র যে এ কাজ করে নাই—ইহা নিশ্চয়; কিন্তু সে কোন কথা খুলিয়া বলিতেছে না, যত গোলযোগ ওইখানে। তাহার বিরুদ্ধে পুলিসে যে প্রমাণ পাইয়াছে, সে সম্বন্ধেও কিছু বলিতেছে না। কেনই বা সে এরূপ করিতেছে?” সমস্ত রাত্রি গোবিন্দরাম এ বিষয় লইয়া আলোচনা করিলেন, কিন্তু কিছুই ভাবিয়া স্থির করিতে পারিলেন না—যে লোক কত শত জটিল রহস্যের উদ্ভেদ করিয়াছেন, তিনি আজ কি উপায়ে নিজের পুত্রকে রক্ষা করিবেন, তাহা স্থির করিতে পারিলেন না—আপনার লোক বিপন্ন হইলে সুবিজ্ঞ ব্যক্তিও হতবুদ্ধি হয়
সকাল হইয়া গিয়াছে। গোবিন্দরাম সমস্ত রাত্রি জাগরণে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছেন; তাঁহার মস্তিষ্ক সুশীতল করিবার জন্য বাড়ীর বাহিরে আসিয়া পদচারণ করিতে লাগিলেন। এই সময়ে এক ব্যক্তি আসিয়া তাঁহাকে প্রনাম করিল।
গোবিন্দরাম দাঁড়াইলেন। সে আবার প্রনাম করিল; তখন গোবিন্দরাম তাঁহার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “কে—রামকান্ত?”
রামকান্তকে দেখিলে চিনিতে পারা যায় না, তাহার পরিধানে অত্যন্ত মলিন বসন, মাথার চুলগুলিও অত্যন্ত অপরিষ্কার, তাহার মুখ অত্যন্ত বিশুষ্ক—তাহাকে দেখিয়া গোবিন্দরাম বিস্মিত হইলেন। রামকান্ত কথা কহে না দেখিয়া গোবিন্দরাম বলিলেন, “রামকান্ত ব্যাপার কি—কি হইয়াছে?”
রামকান্ত বলিল, “আর কি হইবে! এইবার পাঁচটা ছেলে-পুলে নিয়ে অনাহারে মরিতে হইবে।”
“কেন, কি হইয়াছে?”
“আমাকে তাড়াইয়া দিয়াছে—এতদিনের চাকরী হইতে ডিসমিস্ হইলামপেনসও গেল। এখন আপনিই আমার ভরসা; আপনার ছেলেকে গ্রেপ্তার করিয়াছিলাম বলিয়া আপনি রাগ করিয়াছেন।”
“রাগ করিব কেন? তোমার কর্ত্তব্য তুমি করিয়াছিলে।”
“আমি যাহা করিয়াছি, কোন রকমে কি আমার দ্বারা সে অপরাধের মোচন হয় না?”
“হাঁ, হয়।”
“বলুন—বলুন—আমি এখনই তাহা করিব।”
“সুরেন্দ্র যে নির্দোষী তাহা সপ্রমাণ করিতে পারিলে—তুমি যাহা করিয়াছ, সে ত্রুটির সংশোধন হয়।”
“নিশ্চয় করিব—আমি এখন বেশ বুঝিয়াছি যে, তিনি কখনও এই ভয়ানক কাজ করেন নাই; অন্য কেহ করিয়াছে, সেই আমাদের চোখে ধুলা দিয়া হাবাকে লইয়া গিয়াছে।”
“হাঁ, আমারও তাহাই সন্দেহ; তাহা হইলে তুমি আমার সঙ্গে কাজ করিতে প্রস্তুত আছ? তুমি পুলিসে যাহা পাইতে তাহার ডাবল মাইনা আমার কাছ পাইবে।”
“এ কথা আবার আমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন! ভগবান আমাকে আপনার কাছে পাঠাইয়াছিলেন, তাহাই আশ্রয় পহিলাম।”
“ভাল, তাহা হইলে আজ হইতে তুমি কাজে বহাল হইলে। আমার ছেলের সম্বন্ধে পুলিসে কি কি প্রমাণ পাইয়াছে,শুনিতে চাই।”
“শ্যামকান্তের কাছে যাহা শুনিয়াছি, তাহাই বলিতেছি।”
“শ্যামকান্ত তাহলে ডিসমিস্ হয় নাই?”
“না, তাহার একমাসের মাহিনা জরিমানা হইয়াছে মাত্র।”
“কি কি প্রমাণ পাইয়াছি, শুনি।”
“সুরেন্দ্রবাবুর বাড়ীতে একটা লাঠী পাওয়া গিয়াছে—সেই লাঠীতে রক্তের দাগ আছে; সুতরাং এই লাঠিতে তিনি জমিদারকে খুন করিয়াছেন; তাহার পর তাঁহার হাতে লেখা একখানা চিঠিও পাওয়া গিয়াছে—স্ত্রীলোকটিকে সুরেন্দ্র বাবু শাসাইয়া পত্র লিখিয়াছিলেন।”
গোবিন্দরাম এ কথায় কোন উত্তর না দিয়া বলিলেন, “যখন হাবাকে লইয়া যায়, তখন তোমরা উপস্থিত ছিলে; জানই ত যে, আমি তাহাকে সরাই নাই। কাহার প্রতি তোমার সন্দেহ হয়?”
“কাহার উপরে যে আমার সন্দেহ হয়, তাহা আমি ঠিক বলিতে পারি না। সাহেব আমার কথা ত একেবারেই শুনিলেন না –তিনি কৃতান্তকে মাথায় তুলিয়াছেন। আশ্চর্য্যের বিষয় যে, এরকম ভাবে কৃতান্ত গাধা হইল—তাহার উপর—”
“যাক, এ সকল কথা, এখন আমার সঙ্গে একত্রে কাজ করিতে সম্মত হইলে?”
“হাঁ, আগেও বলিয়াছি, আপনি মরিতে বলিলেও মরিব।”
“তাহা হইলে প্রথমে আমার সঙ্গে তোমাকে যাইতে হইবে।”
“অনেক দিনের জন্য?”
“এখন বলতে পারি না।”
“কোথায় যাইবেন?”
“কোন কথা জিজ্ঞাসা করিয়ো না, কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারিবে না, এই কড়ারে যদি সম্মত হও, তবে—”
মধ্যে পথে বাধা দিয়া রামকান্ত ব্যগ্রভাবে বলিল, “আপনি যাহা বলিলেন, তাহাই করিব—কোন কথা কহিব না।”
গোবিন্দরাম গম্ভীরভাবে বলিলেন, “কোথায় যাইব, এখন বলিতে পারি না; তবে সুরেন্দ্রকে নিদোষী সপ্রমাণ করিবার জন্য যাহা করা প্রয়োজন, তাহাই করিতে হইবে। তুমি যে আমার সহিত একত্রে কাজ করিতেছ, ইহা যেন কেহ জানিতে না পারে—সাবধান! অনেক রাত্রে আমার সঙ্গে গোপনে দেখা করিবে।”
রামকান্ত সেইরূপই কার্য্য করিবে বলিয়া বিদায় হইল।
২৬
দুইমাস অতীত হইয়া গিয়াছে। গোবিন্দরাম আর কলিকাতায় নাই—কোথায় গিয়াছেন, তাহা কেহ জানে না। কৃতান্তকুমার বলিয়াছেন যে, তিনি হাবাকে লইয়া গিয়া তাহারই কাছে আছেন। পাছে, পুলিসে তাহার কোন সন্ধান পায়, এই ভয়ে নিজেই তাহার কাছে আছেন।
পুলিসের সাহেব কতকটা এইরূপ বিশ্বাস করিয়াছেন। গোবিন্দরামেরা সন্ধানে চারিদিকে সুদক্ষ গোয়েন্দা পাঠাইয়াছেন, কিন্তু তাহার এ পর্যন্ত্য তাঁহার কোন সন্ধান পায় নাই। তবে সকলেই ইহাতে বিস্মিত হইয়াছেন; গোবিন্দরাম যে পুত্রকে বিপদে ফেলিয়া বিদেশে গিয়া নিশ্চিন্তে বসিয়া থাকিবেন, ইহা কখনই সম্ভপর নহে। তিনি যে একটা কিছু করিতেছেন, তাহাতে কাহারই কোন সন্দেহ নাই।
সুহাসিনীর মাকে তাঁহার কথা জিজ্ঞাসা করা হইয়াছিল; তিনি বলিয়াছিলেন যে, তিনি কিছুই জানেন না, গোবিন্দরাম কোথায় গিয়াছেন, তাহা তাহাকে কিছুই বলিয়া যায় নাই।
দুই মাস অতীত হইল, গোবিন্দরাম নিরুদ্দেশ হইয়াছেন। সুরেন্দ্রনাথ দায়রায় প্রেরিত হইয়াছেন, তাঁহার বিচার আরম্ভ হইয়াছে।
দুই মাস জেলে থাকিয়া সুরেন্দ্রনাথের সে আকৃতি আর নাই—তিনি শীর্ণকায় হইয়া গিয়াছেন। দুই মাসের মধ্যে পিতার কোন সংবাদ না পাইয়া তিনি আরও ম্রিয়মান হইয়া পড়িয়াছেন।
একজন বিখ্যাত কৌসিলী তাঁহার সহিত জেলে দেখা করিয়াছিলেন। তাঁহার নিকট সুরেন্দ্রনাথ শুনিলেন যে, তিনি তাঁহার পক্ষ সমর্থন করিবেন; কে তাহাকে নিযুক্ত করিয়াছেন, তাহা তিনি কিছুতেই প্রকাশ করিলেন না—সুরেন্দ্রনাথ পিতার কথা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি বলিলেন যে, তাঁহার কোন সংবাদই তিনি রাখেন না।
আদালত লোকে লোকারণ্য হইয়াছে। সুরেন্দ্রনাথ ম্লানমুখে কাঠগড়ায় দাঁড়াইয়া রহিয়াছেন। জুরিগণ নিজ নিজ স্থানে উপবিষ্ট হইয়াছেন—লাল পোষাক পরিধান করিয়া জজ গম্ভীরভাবে চারিদিক চাহিয়া দেখিতেছেন।
ক্ষণপরে উকিল উঠিয়া মোকদ্দমা আরম্ভ করিলেন। তিনি বলিলেন, “দুই মাস পূর্ব্বে একদিন রাত্রি একটার সময়ে দুইজন পাহারাওয়ালা হাতীবাগানের রাস্তায় একব্যাক্তিকে ধৃত করে, সে একটা টিনের বাক্স মাথায় করিয়া লইয়া যাইতেছিল। তাহাকে থানার আনিয়া এই বাক্স খুলিলে তন্মধ্যে একটি সুন্দরী যুবতী স্ত্রীলোকের মৃতদেহ দেখিতে পাওয়া যায়। ঐ মৃতদেহের বক্ষে একখানা ছোরা আমূলবিদ্ধ রহিয়াছে। ঐ ছোরার নিন্মে একখানা তাস—ইস্কাবনের টেক্কা ছিল। যে লোকটা ধরা পড়িয়াছিল, পরে জানা যায় যে, সে হাবা ও কালা—তাহার নিকট কিছুই জানিবার সম্ভবনা নাই। তবুও পুলিস কৌশল করিয়া তাহাকে ছাড়িয়া দিলে সে বাগবাজারে একটা বাড়ীতে আসিল, তখন জানিতে পারা গেল যে, স্ত্রীলোকটি এই বাড়ীতেই বাস করিত; আরও জানিতে পারা গেল যে, এ বাড়ীতে আরও একটা খুন হইয়াছে—তাহার মৃতদেহ বাড়ীতেই পড়িয়া আছে। অনুসন্ধানে জানা গিয়াছে, মৃতদেহ পুরুষটি একজন জমিদার-নাম সুধামাধব রায়; স্ত্রীলোকটি তাহারই রক্ষিতা ছিল—নাম বিনোদিনী। বাড়ী হইতে কোন দ্রব্যাদি অপহূত হয় নাই, সুতরাং বোঝা যাইতেছে যে, অর্থলোভে কেহ এই দুইজনকে খুন করে নাই—রাগ, ঈর্ষা, প্রতিহিংসাই এই খুনের কারণ।
আসামী নিজে উকীল, শিক্ষিত ভদ্রবংশজাত—শীঘ্রই একজন ধনীর কন্যাকে বিবাহ করিবেন—তিনি একরূপ দৈব্য সাহায্যেই ধৃত হইয়াছেন, বলিলে অত্যুক্তি হয় না। তাঁহার বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে;—প্রথমতঃ, তাঁহার পকেট হইতে একখানা পকেট-বইএকজন চোর তুলিয়া লয়, তাহাতে এই বিনোদিনীর একখানা ফটো ছবি ছিল—ছবিতে স্ত্রীলোকের হস্তাক্ষরে লিখিত আছে, “ভুলো না আমায় “ সুতরাং বোঝা যাইতেছে যে, এই বিনোদিনীর সহিত আসামীর প্রণয় ছিল। তাহার পর মৃতদেহে যে তাস পাওয়া গিয়াছে, ঠিক সেইরূপ তাস আসামীর বাড়ীতে পাওয়া গিয়াছে, তাহার ভিতরেও একখানা তাস নাই—যেখানা নাই, সেখানা ইস্কাবনের টেক্কা।
আসামী খুনের পর দিবস রাত্রে বাগবাজারের সেই বাড়ীতে আসিয়াছিলেন, ডিটেকটিভ অক্ষয়বাবু ও রামকান্ত ইহাকে দেখিয়া চিনিতে পারিয়াছেন। দুঃখের বিষয়, আমরা রামকান্তকে দিয়া সাক্ষ দিতে পারিব না, কারণ রামকান্ত পুলিস হইতে ডিসমিস্ হইয়া যে কোথায় গিয়াছে, তাহার কোন সন্ধান নাই। আসামীর বাড়ীতে একটা মোটা লাঠী পাওয়া গিয়াছে, উহাতে রক্তচিহ্ন আছে। ডাক্তার পরীক্ষা করিয়া বলিয়াছেন যে, এইরূপ লাঠীর আঘাতেই সুধামাধব রায়ের মৃত্যু হইয়াছে। বাগবাজারের এই বাড়ীতে একখানা চিঠির খাম পাওয়া গিয়াছে—তাহা আসামীর হাতের লেখা বলিয়া বুঝিতে পারা যাইতেছে; ইহাতেও আরও সপ্রমাণ হইতেছে যে, এই বিনোদিনীর সহিত আসামীর প্রণয় ছিল; সুতরাং আসামীর বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে; কিন্তু আসামী কোন কথা বলিতেছে না, কেবল বলিতেছেন, তিনি নিদোষী। এ অবস্থায় জুরিগণ বিবেচনা করিবেন যে, আসামী দোষী না নির্দোষী। এখন আমি একে একে সাক্ষিগণকে ডাকিব, আর অধিক আমার কিছু বলিবার নাই।”
সাক্ষীর জবানবন্দী হইল; উভয় পক্ষের কৌন্সিলিদ্বয় দীর্ঘ বক্তৃতা করিলেন, জজও তাঁহার মতামত প্রকাশ করিলেন। তৎপরে জুরিগণ পরামর্শ করিবার জন্য উঠিয়া গেলেন।
সকলেই বঝুয়াছিলেন যে, আসামীর রক্ষা পাইবার আর উপায় নাই। একজন মুসলমান ভদ্রলোক বরাবর অতি মনোযোগের সহিত এই মোকদ্দমা শুনিতেছিলেন। জুরিগণ উঠিয়া গেলে তিনি পার্শ্বস্থ এক ব্যাক্তিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কিরূপ বুঝিতেছেন?”
তিনি বলিলেন, “আর বুঝিবার কি আছে—নিশ্চয়ই লোকটার ফাঁসী হইবে।”
“আমার বোধ হয়, এ খুন করে নাই।”
“আর ‘করে নাই!’প্রমাণ ত শুনিলেন—লোকটা কিছু না বলাতেই ইহার ফাঁসী হইবে–সব খুলিয়া বলিলে হয় ত দ্বীপান্তর হইত।”
এই সময়ে জুরিগণ প্রত্যগমণ করায় সকলে ব্যগ্রভাবে তাঁহাদের দিকে চাহিল। সকলে তাঁহাদের মত জানিবার জন্য ব্যাকুল হইল। চারিদিক নীরব-নিস্তব্ধ।
জজ, জুরিগণের মতামত জানিবার ইচ্ছা প্রকাশ করায় তাঁহাদের মধ্যে একজন উঠিয়া বলিলেন, “আমরা সকলে একমত হইয়াছি।”
জজ জিজ্ঞাসা করিলেন, “বলুন, আসামী দোষী না নির্দোষী।”
“দোষী।”
মুহূর্ত্তের জন্য আসামীর মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল; কিন্তু তিনি অবিচলিতভাবে সেইরূপ দাঁড়াইয়া রহিলেন।
জজ বলিলেন, “আসামী তোমার কিছু বলিবার আছে?”
সুরেন্দ্রনাথ দৃঢ়স্বরে বলিলেন, “না, আমার কিছুই বলিবার নাই।”
জজ ফাঁসীর হুকুম প্রদান করিলেন। প্রহরীরা আসামীকে জেলের দিকে লইয়া চলিল।
সুরেন্দ্রনাথ যাইতেছিলেন, সেই সময়ে কে যেন তাঁহার পার্শ্বে বলিলেন, “ভয় নাই, আমি তোমাকে বাঁচাইব।”
সুরেন্দ্রনাথ চমকিত হইয়া ফিরিলেন; দখিলেন, একজন মুসলমান ভদ্রলোক তাঁহার পার্শ্বে দাঁড়াইয়া রহিয়াছেন। তিনিই কি এই কথা তাঁহাকে বলিলেন? কিন্তু অঁহার মুখের দিকে চাহিয়া বোধ হইল না যে, তিনি কোন কথা কহিয়াছেন। সুরেন্দ্রনাথ কিছু স্থির করিতে পারিলেন না। প্রহরিদিগের সহিত জেলে প্ৰস্থান করিলেন।
২৭
সুরেন্দ্রনাথের ফাঁসীর হুকুম হওয়ায় পুলিসে কৃতান্তকুমারের মান অতিশয় বাড়িয়া গিয়াছে। তিনি যে এ মোকদ্দমা সম্বদ্ধে অধিক কিছু করিয়াছিলেন, বলিয়া বোধ হয় না; তবুও সুরেন্দ্রনাথ দোষী প্রমাণিত হওয়ায় সকলেই তাঁহার প্রশংসা করিতে লাগিল।
পরদিবস মুসলমান ভদ্রলোকটি অনুন্ধান করিয়া কৃতান্তকুমারের সহিত দেখা করিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া কৃতান্তকুমার বিস্মিত হইলেন; বলিলেন, “আপনাকে সুরেন্দ্রনাথের মোকদ্দমায় দেখিয়াছিলাম না?”
তিনি বলিলেন, “হাঁ, সেইজন্যই আপনার নিকটে আসিয়াছি।”
“কেন, সুরেন্দ্রনাথকে কি আপনি চিনিতেন?”
“না, আপনি এ খুনের তদন্ত করিয়াছিলেন, ইহাতেই বুঝিয়াছি, আপনি সুদক্ষ লোক—আমার একটু অনুসন্ধানের কাজ আছে—তবে প্রথমে নিজের পরিচয় দেওয়া আবশ্যক।”
“বলুন, কি কাজ আছে।”
“বলিতেছি, আমার নাম জাফর আলি খাঁ, অযোধ্যায় বাড়ী, কিছু জমিদারীও আছে, তাহাই লোকে আমাকে নবাব বলে। একটি লোকের সন্ধানে আমি কলিকাতায় আসিয়াছি; আপনি সুদক্ষ লোক—আপনি তাঁহার সন্ধান করিয়া দিতে পারিবেন; অবশ্য ইহার জন্য আপনি যাহা চাহিবেন, তাহাই দিব।”
“বলুন, কে সে লোক।”
“তাঁহার নাম নরেন্দ্রভূষণ, বহুকাল আগে তিনি অযোধ্যায় ছিলেন।”
“হাঁ, তিনি সেখানেই মারা যান।”
বিস্মিতভাবে জাফর আলি বলিলেন, “আপনি তাঁহাকে চিনেন?
“কৃতান্তকুমার বলিলেন, “আপনি ইহাতে বিস্মিত হইতেছেন কেন?”
জাফর আলি বলিলেন, “হাঁ, হইবারই কথা।
কৃতান্তকুমার বলিলেন, “আমি ইহার সম্বন্ধে একটু সন্ধান রাখি—ইনি অনেক টাকা রাখিয়া গিয়াছেন।”
“তবে তিনি অনেক টাকা রাখিয়া গিয়াছেন?”
“হাঁ, তাঁহার ওয়ারিসানরা কোথায় আছে, তাহা কেন জানে না?”
“তবে তাঁহারা বড়লোক?”
কৃতান্তকুমার কহিলেন, “কিরূপে বলিব, তাঁহারা কে কোথায় আছে, এ পর্যন্ত্য সে সন্ধান হয় নাই। নরেন্দ্রনাথবাবুর সন্তানাদি ছিল না, চারি ভগিনী ছিল—তাহাদের নিশ্চয়ই সন্তানাদি হইয়াছে; কিন্তু ইহাদের কে কোথায় আছে, তাহার সন্ধান হয় নাই। কয়েকবার সরকার হইতে ইহাদের সন্ধান হইয়াছে; আমার উপরেও ইহাদের সন্ধানের ভার পড়িয়াছিল, আমার তত সময় না থাকায় আমি আর একজনের উপর সন্ধানের ভার দিয়াছি। কিন্তু আপনি এ সন্ধান করিতেছেন কেন?”
নবাব বলিলেন, “তিনি এক সময়ে আমার পিতার প্রাণরক্ষা করিয়াছিলেন। তাঁহার জীবিত কালে আমরা কৃতজ্ঞতা দেখাতে পারি নাই, তাহাই ভাবিয়াছি, তাঁহার ওয়ারিসানদের কিছু টাকা দিয়া উপকার করিব—আমারও সন্তানাদি নাই।”
মুহুর্ত্তের জন্য কৃতান্তকুমারের মুখ যেন হর্ষে উৎফুল্ল হইল। তিনি মনোভাব গোপন করিয়া বলিলেন, “যদি আপনি নরেন্দ্রভূষণ বাবুর ওয়ারিসানদের যথার্থই অনুসন্ধান করিতে চাহেন, তাহা হইলে আমি যে লোককে এই সন্ধানের ভার দিয়াছি, আপনার কাছে সেই লোকটিকে পাঠিয়া দিতে পারি।”
নবাব জাফর আলি ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “তাহা হইলে বড় উপকার করা হয়; আমি জানিতাম, আপনার দ্বারা কাজ হইবে।”
“এ অতি সামান্য কাজ, তবে যে লোকটার কথা বলিতেছি, তাহার পারিশ্রমিক দিতে হইবে।”
“টাকার আমার অভাব নাই, তিনি যাহা চাহিবেন, তাহাই দিব।”
“তাহা হইলে কালই তাঁহাকে আপনার কাছে পাঠাইয়া দিব—এখানে আপনি কোথায় আছেন?”
“কুলটোলায় বাড়ী ভাড়া লইয়াছি।”
“বেশ, কাল সে লোক আপনার কাছে যাইবে।”
“দেখিবেন—ভুলিবেন না, মোকদ্দমায় বুঝিয়াছিলাম, আপনি সুদক্ষ লোক, আপনার দ্বারাই আমার কার্য্যেদ্ধার হইবে।”
“এ ত সামান্য কাজ; আপনি বিদেশী লোক—আপনার সাহায্যে করা ত আমাদের কৰ্ত্তব্য।”
“তাহা হইলে আর আপনার সময় নষ্ট করিব না।”
নবাব বিদায় লইয়া উঠিলেন। বাহিরে তাঁহার গাড়ী ছিল, সঙ্গের আরদালী গাড়ীর দরজা খুলিয়া দিল, নবাব ধীর পদবিক্ষেপে গাড়ীতে উঠিলেন। তিনি পুনঃ পুনঃ কৃতান্তবাবুকে সেলাম করিয়া চলিয়া গেলেন। বোধ হয়, আমাদের বলিতে হইবে না যে, এ নবাব আর কেহ নহেন, স্বয়ং গোবিন্দরাম-আর তাহার আরদালী—সেই রামকান্ত।
গোবিন্দরাম ছদ্মবেশে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তিনি নিজ চেহারার এতই পরিবর্ত্তন করিয়া নবাব জাফর আলি খাঁ হইয়াছিলেন যে, কেহই তাঁহাকে চিনিতে পারে নাই। এমন কি তাঁহার পুত্র সুরেন্দ্রনাথও আদালতে তাঁহাকে চিনিতে পারেন নাই। রামকান্তও পুরা আরদালী হইয়াছিল। গোবিন্দরামের কায়দাকরণে তাহারও ছদ্মবেশ বড় চমৎকার হইয়াছিল, এমন কি, তীক্ষ্ণদৃষ্টি কৃতান্তকুমারও তাহাকে চিনিতে পারিলেন না।
উভয়ে বাসায় ফিরিয়া আসিলে রামকান্ত বলিলেন, “গুরুদেব, তাহা হইলে আমাদের এই কৃতান্ত কুমারের উপরেই আপাততঃ নজর রাখিতে হইতেছে।”
গোবিন্দরাম বলিলেন, “হাঁ, তবে এখনও আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত হইতে পারি নাই—ইহার সঙ্গে একটু মেশামেশি করিতে হইবে। আমাদের ছদ্মবেশ ধরিতে পারে নাই।”
“আজ পারে নাই—পরে ধরিতে পারিলেও পারে।”
“সম্ভব কম—আমার বিশ্বাস, এই নরেন্দ্রভূষনের টাকার সহিত কৃতান্ত জড়িত আছে। আমার কাছে একটা লোক পাঠাইবে বলিয়াছে। দেখা যাক্, কতদূর কি হয়। প্রথমে এই নরেন্দ্রভূষনের ওয়ারিসানদের সন্ধান লইতে হইবে। এখন সুরেন্দ্রনাথের খবর কি পাইলে?”
“বেশী কিছুই না। তিনি ছোটলাট সাহেবের নিকট দরখাস্ত করিয়াছেন; সুতরাং একমাসের মধ্যে তাঁহার ফাঁসী হইবে না।”
“তাহা হইলে আমাদের আরও একমাস সময় আছে।”
“হাঁ, একমাসে যে আমরা কি করিতে পারিব, তাহা ত বুঝিতেছি না।”
“ভগবান আমাদের সহায়।”
“বাগবাজারে আরও একজন লোক যে যাওয়া-আসা করিত, তাহা মুদী বলিয়াছে—এই লোকটাকে খুঁজিয়া বাহির করিতে পারিলে কতক কাজ হইতে পারে।”
“ইহাকে পাইবার ভরসা খুব কম।”
“তাহা হইলে উপায়?”
“কৃতান্তকুমারের উপর আমাদের সন্দেহ হইয়াছে। এ যেন খুন করিয়াছে, এ কথা আমি বলি না; তবে এ যে হাবাকে ইচ্ছা করিয়া পলাইতে দিয়াছিল; ইহা ঠিক।”
“আমারও সেই সন্দেহ।”
“তাহার পর এ নরেন্দ্রভূষণের ওয়ারিসানদের সন্ধান করিবার জন্য ব্যস্ত–হয় ত সে তাহাদের কাহারও কাহারও সন্ধান পাইয়াছে—দেখি, কৃতান্ত যে লোকটাকে পাঠাইবে বলিয়াছে, সে কি বলে।”
“আমাকে এখন কি করিতে বলেন?”
“উপস্থিত কিছুই নয়, এ লোকটা আসিলে তাহার উপর তোমাকে বিশেষ নজর রাখিতে হইবে।”
“যাহা হুকুম করিবেন, তাহাই করিব।”
“এখনও একমাস সময় আছে।”
“ভগবান করুন, এই এক মাসের মধ্যেই আমরা যেন প্রকৃত খুনীকে ধরিতে পারি।”
“দেখি কতদূর কি হয়।”
২৮
পরদিবস প্রাতে একটি বৃদ্ধলোক নবাবের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিলেন। নবাবের ছদ্মবেশে গোন্দিরাম তাঁহার প্রতীক্ষা করিতেছিলেন।
তিনি আসিয়া বলিলেন, “কৃতান্ত বাবু আপনার কাছে আমাকে পাঠাইলেন, আমার নাম, শ্রী ঘনশ্যাম দত্ত।”
নবাব বলিলেন, “আসুন—বসুন।”
ঘনশ্যাম বসিয়া বলিলেন, “কৃতান্তবাবু আমাকে সকল কথা বলিয়াছেন, বহুদিন হইতে এ কাজ করিয়া আমি এ বিষয়ে পাকা হইয়া গিয়াছি, তাহাতেই আশা করি, শীঘ্রই নরেন্দ্রভূষণবাবুর ওয়ারিসানগণকে খুঁজিয়া বাহির করিতে পারিব।”
“কৃতান্ত বাবু আপনার কথা আমাকে বলিয়াছেন।”
“হাঁ, তবে কাজের কথাটা সর্ব্বপ্রথমেই হওয়া ভাল।”
“হাঁ, বলুন কি চাহেন।”
“এ অনুসন্ধানের জন্য যে খরচ-পত্র হইবে তাহা আপকনাকে দিতে হইবে।”
“তাহা ত নিশ্চয়ই—এই এক শত টাকা এখন লউন, পরে যখন যেমন প্রয়োজন হইবে, লইবেন।”
নবাব দশখানি নোট ঘনশ্যামের হাতে দিলেন। ঘনশ্যাম অতি সাবধানে নোটগুলি গুনিয়া পকেটে পুরিলেন; পরে ধীরে ধীরে বলিলেন, “একটা কথা মিটিল; এখন দ্বিতীয় কথা—আমার পারিশ্রমিক।”
“বলুন, কি চান?”
“পাঁচ শত টাকা আমাকে দিতে হইবে। আর সন্ধান করিয়া যদি তাহাদের বাহির করিতে পারি, তাহা হইলে আমাকে হাজার টাকা পুরস্কার দিতে হইবে।”
“তাহাই দিব—আমার টাকার অভাব নাই—আমি মনে করিয়াছিলাম, আপনি আরও অধিক চাহিবেন।”
“আমি সে প্রকৃতির লোক নই—অন্যায় কথা আমি কখনও বলি না।”
“তাহা দেখিতেছি, ইহাতে আপনার প্রতি বিশেষ সন্তুষ্ট হইলাম। কতদিনে আপনার নিকটে সন্ধান পাইব, মনে করেন?”
“তাহা ঠিক বলিতে পারি না, তবে শীঘ্রই কোন-না-কোন সন্ধান পাইবেন—একটা কথা–”
নবাব সত্বর উঠিয়া বলিলেন, “বসুন, এখনই আসিতেছি।”
তিনি বাহিরে আসিয়া আরদালীবেশী রামকান্তকে ইঙ্গিত করিলেন। রামকান্ত ছুটিয়া নিকটস্থ হইলে
গোবিন্দরাম বলিলেন, “কে আসিয়াছে মনে কর?”
“কেন কে? কৃতান্তবাবু ইহাকে পাঠাইয়াছেন।”
“হাঁ, পাঠাইয়াছেন বটে—স্বয়ংই আসিয়াছেন।”
“রামকান্ত নিতান্ত বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “বলেন কি! এ যে বেজায় বুড়ো লোক।”
“বুড়ো সাজিয়াছে—কৃতান্ত ছদ্মবেশে সিদ্ধহস্ত—তবে গোবিন্দরামের চোখে ধূলি দেওয়া বড় সহজ নয়। আমি দেখিয়াই চিনিয়াছি—অপর কাহারও সাধ্য নাই যে, ইহাকে চিনে।”
“আমাদের চিনিতে পারে নাই ত?”
“না, তুমি বেশ বদলাইয়া ফেল, ততক্ষণ আমি ইহাকে কথায় কথায় বসাইয়া রাখিব, তাহার পর গুপ্তভাবে ইহার সঙ্গে সঙ্গে যাও—দেখ এ কোথায় যায়। খুব সম্ভব, বাড়ী যাইবে না, অন্য কোনখানে যাইবে।”
“আচ্ছা দেখা যাক”, বলিয়া রামকান্ত বেশ পরিবর্ত্তন করিতে গেল। গোবিন্দরামও বৃদ্ধের কাছে ফিরিয়া আসিলেন; বলিলেন, “আপনি কি বলিতে যাইতেছিলেন?”
বৃদ্ধ বলিলেন, “কৃতান্ত বাবুর কাছে আপনার মহৎ উদ্দেশ্যের বিষয় সকলই শুনিয়াছি, এখন কথা হইতেছে যে, নরেন্দ্রভূষনের অনেক ওয়ারিসান থাকিতে পারেন–তাঁহারা তাঁহার সমস্ত টাকাই পাইবেন—এ সত্ত্বেও আপনি তাঁহাদের সকলকে টাকা দিতে চাহেন?”
“হাঁ, আমি আমার কৃতজ্ঞতা দেখাতে চাই।”
“খুব মহৎ উদ্দেশ্য। আবার হয় ত নরেন্দ্রভূষন বাবুর মেবল একমাত্র ওয়ারিসানই এখন জীবিত আছেন।”
“তাহা হইলে কেবল তাঁহাকেই সমস্ত দিব।”
“খুব মহৎ উদ্দেশ্য। এখন আমি সকল বুঝিয়া লইলাম, আর কিছু জিজ্ঞাসার নাই। এখন বিদায় হইতে পারি?”
“হাঁ, কতদিনে সংবাদ পাইব?”
“যত শীঘ্র পারি, সংবাদ দিব।”
ঘনশ্যাম বিদায় হইলেন। দূরে থাকিয়া রামকান্ত তাঁহার অনুসরণ করিল।
গোবিন্দরাম যাহা ভাবিয়াছিলেন, ঠিক তাহাই ঘটিল। ঘনশ্যাম বাড়ীর দিকে না গিয়া বরাবর বড়বাজারের দিকে চলিলেন। মেছুয়া বাজারে আসিয়া তিনি একখানা ভাড়াটিয়া গাড়ী ডাকিলেন। তিনি গাড়ীতে উঠিয়া বসিবামাত্র গাড়ী হাঁকাইয়া দিল।
রামকান্ত বলিয়া উঠিল, “কি বিপদ! কাছে আর একখানা ও যে গাড়ী নাই—গুরুদেব বলিলেবন কি? চোখে ধূলা দিয়া পালাল যে দেখিতেছি—যা থাকে কপালে, গাড়ীর সঙ্গ ছাড়া হইব না—ছটিতেই হইল।” কিন্তু রাজপথে গাড়ীর পশ্চাতে ছুটিলে লোকে ভাবিবে কি? হয় ত চোর বলিয়া তাহারা তাকে ধরিয়া ফেলিবে–পায়ে ছুটিয়া গাড়ীর সঙ্গে সঙ্গে থাকাও সহজ নহে। তবুও রামকান্ত হতাশ হইল না। সে প্রাণপণে গাড়ীর পশ্চাতে ছুটিতে লাগিল।
২৯
ঘনশ্যামের গাড়ী চিৎপুর দিয়া বরাবর উত্তর দিকে যাইতেছিল—বিডন-উদ্যান পার হইয়া গেল; সৌভাগ্যক্রমে রামকান্ত এইখানে একখানা গাড়ী পাইল। গাড়ীতে উঠিয়া কোচম্যানের কানে কানে কি বলিল—কোচম্যান তৎক্ষণাৎ গাড়ী হাঁকাইয়া দিল।
তখন এক গাড়ীর পশ্চাতে আর এক গাড়ী সমভাবে ছুটিতে লাগিল; গাড়ী দুইখানা ক্রমে শোভাবাজার আসিল। রামকান্ত ভবিল, “বেটা কি বাগবাজারের সেই বাড়ীতেই যাইতেছে নাকি? দেখা যাক্, কোথায় যায়।”
গাড়ী কলিকাতা ছাড়াইয়া দমদমা স্টেশনের দিকে চলিল। এমন সময়ে রামকান্তের কোচম্যান বলিল, “আগকার গাড়ী স্টেশনে যাইতেছে।”
রামকান্ত বলিল, “তবে এখানে গাড়ী থামাও, আমি এখান হইতে হাঁটিয়া যাইব—আমার জন্য এইখানে অপেক্ষা কর।”
রামকান্ত গাড়ী হইতে নামিয়া দেখিল যে, ঘনশ্যাম স্টেশনে প্রবেশ করিল—সে-ও সত্বর তাঁহার পশ্চাতে চলিল।
এইবার সে আর একজনকে স্টেশনে দেখিয়া বিস্মিত হইল; দেখিল, বাগবাজারে সেই মুদি বাক্স-পেটরা লইয়া দাঁড়াইয়া আছে। মুদি তাহাকে চিনিতে পারিল না।
রামকান্ত মুদীর পাশ দিয়া যাইতেছিল, সহসা মুদী একরুপ বিষ্ময়সূচক শব্দ করিয়া উঠিল; রামকান্ত তাহার দিকে চাহিল।
মুদী আপনা-আপনি বলিয়া উঠিল, “এই যে, সেই ঝি মাগী! এ কোথায় যাইতেছে—এত গয়না গাটি কোথায় পাইল?
রামকান্ত এই কথা শুনিয়া দাঁড়াইল; দেখিল, যথার্থই একটি স্ত্রীলোক গাড়ীতে উঠিবার জন্য প্লাটফর্মের দিকে যাইতেছে, ঘনশ্যাম তাহার পশ্চাতে যাইতেছে।
ইতিমধ্যে গাড়ী আসিয়া পৌঁছিয়াছিল। রামকান্ত টিকিট ঘরে গিয়া ব্যগ্রভাবে বলিল, “একখানা টিকিট?”
টিকিটবাবু বিরক্ত ভাবে বলিলেন, “বাপু, এতক্ষণ কি ঘুমাইতেছিলে? কোথায়—কোন ক্লাস?”
রামকান্ত কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া বলিল, “যে ক্লাস হউক।”
“আরে কোথাকার টিকিট তাই বল না।”
তাড়াতাড়ি রামকান্তের মাথা খারাপ হইয়া গিয়াছিল; বলিল, “ঐ যে যে লোকটি এইমাত্র টিকিট লইলেন, তিনি যেখানে যাইবেন।”
টিকিটবাবু রোষভরে টিকিট দ্বার বন্ধ করিয়া দিলেন।
রামকান্ত উন্মত্তের ন্যায় দ্বারে আঘাত করায় তিনি ভিতর হইতে বলিয়া উঠিলেন, “বেশী চালাকী করিয়ো না, এখনই পুলিসের জিম্মা করিয়া দিব।”
এই সময়ে গাড়ী ছাড়িয়া দিল। এত কষ্ট করিয়া এতদূর ঘনশ্যামের পশ্চাতে পশ্চাতে আসিয়া তাহাকে হারাইতে হইল! তাহার চোখের উপর সে রেলে উঠিয়া চলিয়া গেল—কোথায় গেল, তাহা সে কিছুই জানিতে পারিল না; গোবিন্দরাম শুনিলে কি বলিবেন? আর উপায় নাই—ঘনশ্যাম কোথাকার টিকিট লইয়াছিল, তাহা জানিবার কোন উপায় নাই—টিকিট-বাবু তাড়াতাড়ি টিকিট দিয়াছেন, কে কোনখানা লইল কিরূপে জানিবেন? তবে রামকান্ত অনুসন্ধানে জানিল যে, এ গাড়ী নৈহাটি পর্যন্ত্য যাইবে, সুতরাং ঘনশ্যাম নৈহাটির অধিক যাইতে পারিবে না।
এই বার সেই মুদীর কথা তাহার মনে হইল; তবে ঘনশ্যাম এই স্ত্রীলোকের সহিত মিলিত হইয়া একত্রে কোন স্থানে গেল। ভাবিল, “সেই ঝি—তাহা হইলে নিশ্চয়ই সেই মৃত স্ত্রীলোকের দাসী—খুনের দিন হইতে সে নিরুদ্দেশ হইয়াছে, সুতরাং সে সনশ্চয়ই কে খুন করিয়াছে জানে; সম্ভবতঃ সে এই খুনের সহায়তা করিয়াছিল, তাহাই পালাইয়াছে। আমি কি গাধা—দুইজনকে হাতে পাইয়াও পলাইতে দিলাম—এখন উপায়?”
রামকান্ত এই সকল ভাবিয়া নিজের উপর নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইল। রামকান্ত তখন মুদীর সন্ধানে গেল। সে দেখিয়াছিল যে, মুদী গাড়ীতে উঠে নাই—বোধ হয়, পরের গাড়ীর অপেক্ষায় বসিয়া আছে, নৈহাটি হইতে সে আরও দূরে যাইবে। যথার্থ তাহাই, মুদী দেশে যাইতেছিল, তাহার গাড়ী আসিবার দেরি আছে বলিয়া সে তাহার মাল-পত্র লইয়া একাধারে বসিয়াছিল।
রামকান্ত তাহার নিকটে আসিয়া বসিল; বলিল, “তুমি কতদূর যাইবে?”
“কুষ্ঠিয়া যাইব।”
“তোমায় যেন কোথায়ে দেখিছি বলিয়া বোধ হয়, কলিকাতায় থাক?”
“হাঁ, বাগবাজারে আমার একখানা মুদীর দোকান আছে।”
“বাগবাজারে! যেখানে খুন হইয়াছিল?”
“হাঁ, আমার দোকানের সম্মুখেই খুন হইয়াছিল। মাগীটা এইমাত্র গাড়ীতে এল।”
“কোন মাগী”
“তুমি সেই খুনের বিষয় বুঝি কিছুই জান না?”
“না, বিশেষ কিছু জানি না—মেবল শুনিয়াছিলাম, বাগবাজারে দুইটা খুন হইয়াছে।”
“হাঁ, একটি মেয়েমানুষ সেই বাড়ীটায় থাক্তি—তাহার একজন ঝি ছিল, মেয়ে মানুষটি খুন হইলে সেই দিন থেকে সেই ঝিটাও কোথায় পালিয়ে যায়—আজ তাহাকে এই স্টেশনে দেখিলাম।”
“হয় ত তোমার ভুল হইয়াছে।”
“ভুল হইবে কেন? তাহাকে কতবার সেই বাড়ীতে দেখিয়াছি, তবে ইহার অবস্থা ফিরিয়াছে বলিয়া বোধ হয়—অনেক গহনা গায়ে দিয়াছে—”
“তাহা হইলে এই ঝিটা জানে, কে খুন করিয়াছে?”
“তাহা ত আদালতে ঠিক হইয়া গিয়াছে, যে খুন করিয়াছিল, তাহার ফাঁসীর হুকুম হইয়া গিয়াছে।”
“হাঁ, ভাল কথা মনে পড়িয়াছে— তোমর সঙ্গে আলাপ হইয়া ভালই হইল।”
“কেন?”
‘যে লোকটির ফাঁসীর হুকুম হইয়াছে, তাহার বাপের কাছে আমি কাজ করিতাম। তিনি বলেন যে, তাঁহার ছেলে খুন করনে নাই—অন্য লোক খুন করিয়াছে।”
“এই তুমি বলিলে খুনের বিষয় কিছু জান না।”
“সব জানিতাম না, তিনি সব আমাকে এখন বলেনও নাই। তবে দুই পয়সা রোজগার করিবার একটা উপায় আছে।”
“কি রকমে?”
“তুমি অনায়াসে কিছু পাইতে পার।”
‘কেমন করে?”
“তিনি এই ঝিটাকে খুজিতেছেন, তুমি ইহাকে চেন—আজও তাহাকে দেখিয়াছ—সে নিশ্চয়ই আবার কলিকাতায় ফিরিবে, তুমি ইচ্ছা করিলে ইহাকে ধরাইয়া দিতে পার। ইহার জন্য তুমি যাহা চাও, তাহাই তিনি দিতে পারিবেন। কেবল ইডাই নহে, যদি তুমি এই স্ত্রীলোকের সন্ধান দিতে পার, তাহা হইলে তিনি তোমার হাজার টাকা পুরস্কার দিবেন।”
“হাজার টাকা?”
“হাঁ গো হাঁ, তিনি খুব বড়লোক।”
“তাই ত, কি করিব ভাবিতেছি।”
“এমন সুবিধা কি কেহ কখনও ছাড়ে?”
“দেশে রওনা হইয়াছি।”
“দুই মাস পরে দেশে গেলেই বা ক্ষতি কি?
“সত্যসত্য দিবে তা
“নিশ্চয়ই, বল ত আমি এখনই তোমাকে তাঁহার কাছে লইয়া যাইতে পারি।
মুদী কোন কথা না কহিয়া ভাবিতে লাগিল। টাকার লোভ বড় লোভ—সে কি করিবে সহসা স্থির করিয়া উঠিতে পারিল না। রামকান্তত বলিল, “কি বল, আমার সঙ্গে যাইবে? এমন সুবিধা ছাড়িয়ো না। হাতের লক্ষী পায়ে ঠেলিতে নাই।”
মুদী চিন্তিতমনে বলিল, “হাঁ, তোমার মতেই মত—তবে বাড়ী রওনা হইয়াছি, আমার বাড়ী কুষ্ঠিয়া—আমি তিন দিনের মধ্যেই ফিরিয়া আসিব, তিন দিনে আর কোন গোল হইবে না।”
তিন দিন কি, তিন ঘন্টাও এখন নষ্ট করা উচিত নয়, তবে যদি এ লোকটা নিতান্ত রাজী না হয়, তাহার উপায় কি? অধিক পীড়াপীড়ি করিলে পাছে সে ভয় পাইয়া বিগড়াইয়া যায়, এই ভয়ে রামকান্ত তাহার কথায় সম্মত হইতে বাধ্য হইল; বলিল, “একান্ত যদি যাইতে চাও–যাও, কিন্তু তিন দিনের বেশী দেরী করিলে এ কাজ ফসকাইয়া যাইবে,বাপু।”
মুদী বলিল, “আমি কথা দিয়া যাইতেছি, নিশ্চয়ই আসিব। তিন দিনের একদিনও বেশী দেরি করিব না।”
“তবে তাহাই, এই কথাই থাকিল।”
“হাঁ, কোথায় তোমার সঙ্গে দেখা করিব?”
“আমি তোমার দোকানে যাইব, আমার থাকিবার কোন স্থিরতা নাই।”
“আমার গাড়ীর আর দেরি নাই।”
“যাও ভুলো না।”
“না, ভুলিব কেন! আমার দুই পয়সা হইবে?”
মুদী টিকিট কিনিতে চলিল; অগত্যা রামকান্ত স্টেশনের বাহিরে আসিল।