১০
রামকান্ত গাড়ী বিদায় দিয়া দাঁড়াইল। কৃতান্তবাবু বৈঠকখানার দিকে চলিলেন। তাঁহার চলিবার ভাব দেখিয়া অক্ষয়কুমার, ইনস্পেক্টরকে বলিলেন, “দেখিতেছেন, পাছে লোক দুইটার পায়ের দাগ নষ্ট হয় বলিয়া কৃতান্তবাবু কেমন সাবধানে আসিতেছেন—ইঁহার ডিটেক্টিভগিরির বেশ একটা স্বাভাবিক গুণ আছে।”
ইনস্পেক্টর হাসিয়া বলিলেন, “বরং বেশী সাবধান—বোধ হইতেছে, যেন কাঁটার উপর দিয়া চলিয়াছেন—অন্ততঃ ইহার পায়ের দাগ কিছুতেই পড়িবে না।”
“কৃতান্তবাবুর এত সাবধান হইবার কোন আবশ্যকতা ছিল না—এখন মাটি শুকাইয়া শক্ত হইয়া গিয়াছে। যাহা হোউক, তিনি নিকটস্থ হইলে অক্ষয়কুমার বলিলেন, “আসুন এইদিকে—আগে সকলে শুনুন।”
তিনি এতক্ষণ মুখ ঢাকিয়াছিলেন এখন মাথা হইতে চাদরখানা নামাইলেন। তিনি খর্বকায়—তত সুপুরুষ নহেন—গোঁপ দাড়ী নাই—চক্ষু দুইহি গোল—যেন জ্বলিতেছে। তাঁহাকে দেখলেই সহজে বুঝিতে পারা যায়, যেন প্রকৃতিদেবী তাঁহাকে নানা বেশ ধারণ করিবার জন্যই সৃষ্টি করিয়াছেন।।
কৃতান্তকুমার অক্ষয়কুমারের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “ব্যাপার কি?”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “তাহা কি বলিতে হইবে?”
“কতক বুঝিয়াছি—”
“আপনি গাড়ী হইতে নামিতে এত ইতস্ততঃ করিতেছিলেন কেন?”
“আপনার রামকান্ত প্রকান্ড গৰ্দ্দভ বলিয়া। সে একেবারে আমাকে এই বাড়ীর দরজায় আনিয়াছে; এখন অবধি কতবার এই বাড়িতে আসিতে হইবে, তাহার ঠিকানা নাই—এখন আমাকে যদি সকলে দেখিতে পায়, চিনিয়া ফেলে, তাহা হইলে –”
“হাঁ, বুঝিয়াছি—আপনি শুনিয়াছেন, সেই বাক্সের ভিতরকার মৃতদেহের বিষয়?”
“হাঁ, শুনিয়াছি—কতক কতক।”
“সাহেব এ তদন্তে আপনাকে সঙ্গে লইতে বলিয়াছেন।”
“এরূপ গুরুতর কাজ গোবিন্দরামকে দিলেই ভাল হইত।”
“তিনি অনেক দিন এ সমস্ত কাজ ত্যাগ করিয়াছেন। তিনিই আপনাকে এ মোকদ্দমায় নিযুক্ত করিতে সাহেবকে বিশেষ অনুরোধ করিয়াছেন।”
“তাঁহাকে ধন্যবাদ। এখন জিজ্ঞাসা করিতে চাই, আপনারা এ সম্বন্ধে কতদূর কি করিয়াছেন?”
“সংক্ষেপে আপনাকে সকলই বলিতেছি। যে স্ত্রীলোকের মৃতদেহ বাক্সের মধ্যে পাওয়া গিয়াছে, সে কে তাহা জানিতে পারি নাই। কোথা হইতে হাবা তাহার মৃতদেহ লইয়া গিয়াছিল, তাহা জানিবার জন্য তাহাকে ছাড়িয়া দেওয়া হয়, সে এই বাড়ীতে আসিয়াছিল।”
“আমি স্বাধীনভাবে কাজ করিতে পাইব ত?”
“নিশ্চয়।”
“আমি স্বাধীনভাবে আমার মনের মত কাজ করিতে চাই।”
“ইহাতে আমাদের বাধা দিবার কোন কারণ নাই—আমাদের সকলেরই উদ্দেশ্য এক।”
“আপনি কতদিনে এই খুনীকে ধরিতে পারিবেন, মনে করেন?”
“সম্ভবতঃ একমাসে।”
অক্ষয়কুমার আর কোন কথা কহিলেন না। কৃতান্তকুমারকে লাস ও বাড়ীটা দেখাইবার জন্য চলিলেন।
তাঁহার কথায় অক্ষয় কুমার যে বিশেষ সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন, তাহা বলিয়া বোই হয় না। তিনি নিজে বিচক্ষণ সুদক্ষ ডেটেকটিভ—তাঁহার বিশেষ সুখ্যাতি ছিল; আর এই কৃতান্তকুমার নতুন লোক—ইঁহার যে অনন্যসুলভ ক্ষমতা আছে, তাহা অক্ষয়কুমার স্বীকার করেন; তবে উভয়ের পরস্পর সদ্ভাব ছিল না।
সহসা মৃতদেহটা দেখিয়া কৃতান্তকুমার যেন শিহরিয়া উঠিলেন। অক্ষয়কুমারের তীক্ষ্ণদৃষ্টি তাহা দেখিল। তিনি মৃদুহাস্য করিয়া বলিলেন, “কি কৃতান্তবাবু, আপনার ন্যায় লোকেও সে লাস দেখিয়া শিহরিয়া উঠে?”
কৃতান্তকুমার হাসিয়া বলিলেন, “ওঃ! সেজন্য নহে—এ বিষয়টা পূর্ব্বে শুনি নাই—এখন দেখিতেছি, সন্ধান সহজেই হইবে। স্ত্রীলোকের মৃতদেহটা কাহার স্থির করা কঠিন বটে, কিন্তু এটি কে জানা কঠিন হইবে না।”
“হাঁ, এ কথা ঠিক—ইনি গঙ্গারামপুরের জমিদার—এই বাড়ীতে ইহার একটি রক্ষিতা স্ত্রীলোক ছিল।”
“ইহার নাম কি জানিতে পারিয়াছেন?”
“হাঁ, সুধামাধব রায়।”
“কিরূপে জানিলেন?”
“ইনি শ্যামবাজার থানার ইনস্পেক্টর—ইনি ইহাকে চিনিতেন।”
কৃতান্তকুমার মৃতদেহটি বিশেষ লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, “ঘড়ি আর চেন ছড়াটা এখনও রহিয়াছে—সুতরাং অর্থলোভে খুন নয়। ইহার পকেট অনুসন্ধান করা হইয়াছে?”
“হাঁ, পকেটে এই মানিব্যাগটি ছিল—ইহাতে দুখানা দশ টাকার নোট আর সাতটা টাকা ছিল।”
“আর কিছু ছিল?”
“হাঁ, এই চিঠি খানা।”
কৃতান্তকুমার পত্রখানি হাতে লইয়া পড়িলেন; –
“আজ রাত্রি দশটার সময় আমার বাড়ীর দরজা খোলা থাকিবে—আসা চাই বিনোদিনী।”
কৃতান্তকুমার বলিলেন, “তাহা হইলে জানা যাইতেছে, এই স্ত্রীলোকের নাম বিনোদিনী।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “তাহা আমি আগেই জেনেছিলাম—কেবল ইহাই নহে, আমি খুনীকেও দেখিয়াছি।”
কৃতান্তকুমার বিস্মিতভাবে বলিয়া উঠিলেন, “কোথায়—কখন?”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “এইখানে—এই বাড়ীতে—কাল রাত্রে।”
তাহার পর যাহা ঘটিয়াছিল, তিনি সমস্ত কৃতান্তকুমারকে বলিলেন। কৃতান্তকুমার বিশেষ মনোযোগের সহিত সকল শুনিয়া বলিলেন, “তাহা হইলে আপনি মনে করেন যে, এই লোকটাই এই দুইটা খুন করিয়াছে?”
“হাঁ, আমার ত ইহাই বিশ্বাস।”
“কিন্তু এ লোকটা দুইটা খুন করিতে এক পথ অবলম্বন করে নাই, একজনের বুকে ছোরা মারিয়াছে—অপরের মথায় লাঠি মারিয়াছে।
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “আমার অনুমান, খুনী এই বিনোদিনীর সঙ্গে পরামর্শ করিয়া এই জমিদারকে খুন করিবার ষড়যন্ত্র করিয়াছিল—এই লোকটা যখন আহারাদি করিতেছিল, তখন খুনী হঠাৎ আসিয়া আক্রমন করে, পরে দুইজনের খুব মারামারি হয়, শেষে ইহার মাথায় লাঠি মারায় মৃত্যু হয়। পরে খুনী পাছে বিনোদিনী সকল কথা প্রকাশ করিয়া ফেলে, এই ভয়ে বিনোদিনীকেও খুন করে—যখন বিনোদিনী ঘুমাইতেছিল, তখন তাহার বুকে ছোরা মারিয়াছিল। তাহার পর খুনীর ইচ্ছা ছিল যে, লাস দুইটা সরাইবে, তাহাই হাবাটাকে আনিয় তাহার মাথায় লাস সহ বাক্সটা দিয়াছিল—ভাবিয়াছিল, স্ত্রীলোকের লাসটা সরাইয়া পরে এই লোকটার লাস সরাইবে।”
“তাহা হইলে পুলিস হাবাকে না ধরিলে সে এই লাসটা লইতে আসিত।”
“নিশ্চয়ই।”
“সম্ভব, কিন্তু কথা হইতেছে যে, খুনী নিশ্চয়ই জানিত যে, স্ত্রীলোকটি বাঁচিয়া নাই, তবে সে কাল রাত্রে এখানে আসিয়া তাহাকে ডাকিবে কেন?
“হয় ত স্ত্রীলোকটির নাম বিনোদিনী, সে হয় ন দাসী।”
“সে এই ভদ্রলোকটিকে পত্র লিখিবে কেন?”
“হয় ত কোন কারণে কর্ত্রী নিজের হাতে পত্র লেখে নাই।”
কৃতান্তকুমার আর কোন কথা কহিলেন না। বাহিরের দ্বারে আসিয়া তিনি বলিলেন, “এখানে আর কিছু দেখিবার নাই, চলুন।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “তাহা হইলে এখন কি করিতে চাহেন?”
“এই পৰ্য্যন্ত, এখন আপনার লোকেদের বলিয়া দিন যে, আমি আর এ বাড়ীতে আসিব না। “তাহাই হইবে, আপনি যাহাকে ইচ্ছা সঙ্গে লইতে পারেন।”
“ঐ রামকান্ত আর শ্যামকান্তই থাক।”
“তাহাই হইবে। আপনি হাবাকে দেখিতে চাহেন?”
“না, এখন নয়, সময়ে তাহার সহিত দেখা করিব। তাহার দ্বারা আমি যাহা করিতে চাই, আমাকে এখন যদি সে দেখে তবে সে কাজ পন্ড হইবে।”
তখন লাস পাঠাইয়া দিয়া সকলে সে বাড়ী পরিত্যাগ করিলেন। চারিজন পাহারাওয়ালা সেই বাড়ীর পাহারায় নিযুক্ত রহিল।
১১
কৃতান্তকুমার এই খুন সম্বন্ধে বিশেষ কিছু যে করিতেছেন বলিয়া বোধ হইল না। তিনি এই ঘটনার পর অধিকাংশ সময়ই বাড়ীতে বসিয়া কাটাইতেন। তাঁহার বাক্স নানা কাগজে পূর্ণ। তিনি একদিন অপরাহ্নে তাঁহার বাক্স হইতে কতকগুলি কাগজ পত্র বাহির করিয়া বিশেষ রূপে লক্ষ্য করিয়া দেখিতেছিলেন।
এই কাগজ-পত্র গুলি দেখিয়া তিনি মনে মনে বলিলেন, “হাঁ, এতদিনে সমস্ত কাগজ-পত্র ঠিক হইয়াছে, নরেন্দ্রভূষণ রায়ের পুত্রকন্যা ছিল না, তাহার কেবল চারি ভগিনী ছিল। নরেন্দ্রভূষণ পাঞ্জাবে গিয়া অনেক টাকা উপার্জন করে, প্রায় সাত লক্ষ টাকা রাখিয়া গিয়াছে, এখন সুদে-আসলে অন্ততঃ দশ-এগার লাক্ষ টাকা জমিয়াছে। এই সমস্ত টাকাই পাঞ্জাব গভর্ণমেন্টের হাতে রহিয়াছে। ওয়ারিসান না পাওয়ায় টাকা কেহই পায় নাই। নরেন্দ্রভূষণ এখন দেশ হইতে বিদেশে অর্থোপার্জ্জন করিতে যায়, তখন দেশে তাহার চারিটি ভগিনী ছিল। সে সময় নরেন্দ্রভূষণের অবস্থা দরিদ্র। প্রায় তাহার চলিত না। নরেন্দ্রভূষণের চারি ভগিনীর মধ্যে দুই কলিকাতায় বিবাহ হয়। অনুসন্ধানে জানিয়াছি যে, এই চারি ভগিনীর চারিজন ওয়ারিসান আছে—তিনজন স্ত্রীলোক, একজন পুরুষ। তাহাদের কেহই এই সম্পত্তির বিষয় অবগত নহে। কারণ এ পর্যন্ত কেহই এ সম্পত্তি পাইবার জন্য চেষ্টা পায় নাই। এ অবস্থায় এই চারিজনই সমভাগে সম্পত্তি পাইবে, কিন্তু যদি হইাদের মধ্যে তিনজন মরিয়া যায়, তাহা হইলে অবশিষ্ট শেষ যে জীবিত থাকিবে, সে-ই সমস্ত সম্পত্তি পাইবে। এখন এই কলিকাতায় প্রথমে যে দুই ভগিনীর বিবাহ হইয়াছিল, তাহারই বিষয় দেখা যাউক। নরেন্দ্রভূষণের প্রথমা ভগিনী নয়নতারা পুত্র হরেন্দ্রকুমার, তাহার কন্যা জাহ্নবী—এই জাহ্নবীর সুহাসিনী নামে এক কন্যা আছে। সন্ধানে জানা গিয়াছে, এই কন্যা জীবিত আছে, তাহার সন্ধানও পাইয়াছি। তাহার পিতা এই সহরে অনেক টাকা উপার্জ্জন করিয়া কালগ্রাসে পতিত হইয়াছে—সে তাহার মায়ের সহিত বরাহনগরে একটা বাগানবাটিতে থাকেন। ইহার সহিত একবার দেখা করিতে হইবে। নরেন্দ্রভূষণের দ্বিতীয়া ভগিনী জীবনতারা—তাহার কন্যা কাত্যায়নী; এই কাত্যায়নীর কন্যার সহিত গোপালের বিবাহ হয়—গোপালের এক নাবালিকা কন্যা আছে। শুনিয়াছি, গোপাল এখন চন্দননগরের স্টেশনে কাজ করে, তাহার সন্ধানেও যাইতে হইবে। রামকান্তের আসিবার কথা আছে, প্রথমে তাহার সহিত কাজ মিটাইয়া অন্য ব্যবস্থা দেখা যাইবে।
এইরূপ স্থির করিয়া কৃতান্তকুমার কাগজ-পত্র গুটাইয়া রাখিয়া উঠিলেন। এই সময়ে রামকান্তের আসিবার কথা ছিল। তিনি পোষাক পরিয়া তাহার অপেক্ষায় বাহিরে আসিলেন। দেখিলেন, রামকান্ত আসিতেছে।
রামকান্ত নিকটস্থ হইলে কৃতান্তকুমার বলিলেন, “নতুন কিছু সংবাদ আছে না কি হে?”
রামকান্ত বলিল, “না, বাড়ীটা খানাতল্লাসী করিয়া আর নতুন কিছুই জানিতে পারা যায় নাই।”
“কোন কাগজ-পত্র পাওয়া যায় নাই?”
“না, তবে একখানা খাম পাওয়া গিয়াছে, তাহাতে লেখা শ্রীমতী বিনোদিনী দাসী।”
“সেটা কোথায়?”
“অক্ষয়বাবুর কাছে—তিনি আপনাকে দেখাইবেন বলিয়া নিজে রাখিয়াছেন।”
“বাড়ীটা কাহার জানা গিয়াছে?”
“হাঁ, বহুবাজারের একটি ভদ্রলোকের।”
“মুদীর কাছে কিছু জানিতে পারিয়াছ?”
“সে বলে সুধামাধববাবু স্ত্রীলোকটিকে রাখিয়াছিলেন; তাহা সে দাসীর নিকট শুনিয়াছিল।”
“আর কাহাকেও এ বাড়ীতে আসিতে দেখিয়াছ?”
“হাঁ, আর একটি যুবককে মাঝে মাঝে আসিতে দেখিয়াছি।”
“কে সে।”
“তাহা বলিতে পারে না।”
“আর কেহ আসিত?”
“হাঁ, আর একজন, কয়দিন আগে আসিয়াছিল।”
কৃতান্তকুমার গম্ভীর মুখে বলিলেন, “এই লোকটাই খুনী।”
রামকান্তও সোৎসাহে বলিল, “এই লোকটাই পুলিশের লোক বলিয়া পরিচয় দিয়া আমার চোখে ধূলি দিয়াছিল।”
“হাঁ, এই লোকটাকেই খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে। চারিদিকে নজর রাখ, কখনও চোখে পড়িতে পারে।”
“ধরিতে পারিলে হাজার টাকা পুরস্কার আছে—তাহার জন্য নহে; ইহার জন্য আমার চাকরী গিয়াছিল, সেইজন্যই ইহাকে ধরিব।”
“তুমি এই জমিদারের সন্ধান লইয়াছিলে?”
“হাঁ,সকলেই তাঁহাকে বড় ভাল লোক বলিয়া জানিত। তাঁহার আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধব কেহই জানিত না যে, তাঁহার বাগবাজারে সেই বাড়ীতে এই স্ত্রীলোকটি ছিল।”
“ইহাতে বোঝা যাইতেছে যে, লোকটা অনেক রাত্রে এই স্ত্রীলোকের বাড়ীতে একাকী আসিত। যাক্, আজ এই পর্যন্ত্য, আমি এখন একটু ব্যস্ত আছি।”
“তাহা হইলে আমার উপর কি হুকুম?”
“না, আপাততঃবেশী কিছু বলিবার নাই, সেই লোকটাকে ধরিবার চেষ্টা কর, আর যাহা করিতে হয় আমি করিব। অক্ষয়কুমারকে বলিয়ো, আমি একটা—একটা কেন, দুইটা সূত্র পাইয়াছি; শীঘ্রই তাঁহার সঙ্গে দেখা করিব।”
রামকান্ত বিদায় হইতেছিল, সহসা দাঁড়াইয়া বলিল, “আমি আপনাকে একটা কথা বলিতে ভুলিয়াছি, অক্ষয়বাবু হাবাকে কথা কহিতে শিখাইতেছেন।”
কৃতান্তকুমারও গমনে উদ্যত হইয়াছিলেন, “কি?” বলিয়া দাঁড়াইলেন।
রামকন্ত বলিল, “একটি লোককে দিয়া তিনি হাবাকে ইসারায় কথা কহিতে শিখাইতেছেন।”
কৃতান্তকুমার মৃদুহাস্য করিলেন; হাসিয়া বলিলেন, “কত বৎসরে এ কাজ হইবে?”
“বোধ হয় অধিক দিন লাগিবে না—হাবা বেশ শিখিতেছে।”
“মন্দ নয়, কিন্তু তাহার কথা কহিবার ঢের পূর্ব্বেই আমরা কাজ উদ্ধার করিতে পারিব।”
এই বলিয়া তিনি অগ্রসর হইয়া একখানা গাড়ী ডাকিলেন। গাড়ী নিকটস্থ হইলে তন্মধ্যে উঠিয়া বসিলেন, “বরাহনগর।”
গাড়োয়ান বলিল, “বাবু, ভাড়া?”
কৃতান্তকুমার বলিলেন, “ভয় নাই, সন্তুষ্ট করিব।” কৃতান্তকুমার ব্যয়কুণ্ঠ ছিলেন না, গাড়োয়ানরা প্রায় সকলেই তাহাকে চিনিত। গাড়োয়ান আর কিছু না বলিয়া গাড়ী হাঁকাইল।
যথাসময়ে গাড়ী বরাহনগরে আসিয়া একটা সুন্দর উদ্যানের সম্মুখে দাঁড়াইল। ঐ উদ্যানের মধ্যে একটি সুন্দর অট্টালিকা, ছবির মত বাগানটিও বাড়ীটি—দুই-ই হাসিতেছে।
কৃতান্তকুমার গাড়ী হইতে নামিলেন; গাড়োয়ানকে অপেক্ষা করিতে বলিয়া উদ্যান মধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। বাগানের দ্বার অবধি সুন্দর রাস্তা বাড়ীর দরজা পর্যন্ত গিয়াছে। ঐ পথের দুই পার্শ্বে নানা রকম ফুলের গাছ; অনেক গাছে ফুল ফুটিয়াছে। কৃতান্তকুমার ভাবিলেন, “ইহাদের অনেক টাকা, তবুও দেখা যাক্, নরেন্দ্রভূষণের সম্পত্তি সম্বন্ধে কি বলে? টাকা এমনই জিনিস—হাজার থাকিলেও লোকে আরও চায়।”
তিনি বাড়ীর দরজায় আসিলে একজন ভৃত্য তাঁহার নিকটস্থ হইল। তিনি তাহাকে বলিলেন, “আমি কর্ত্রী ঠাকুরাণীর সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছি; শীঘ্র সংবাদ দাও—বল যে, তাঁহার কন্যার সম্বন্ধে বিশেষ কোন কথা আছে।”
“বসুন, সংবাদ দিতেছি”, বলিয়া ভৃত্য তাঁহাকে একটি সুসজ্জিত প্রকোষ্ঠে লইয়া বসাইল।
কিয়ৎক্ষণ পরে পার্শ্ববর্তী দ্বার খুলিয়া গেল। কৃতান্তকুমার বিস্মিত হইয়া দেখিলেন, এক সুপুরুষ, বলিষ্ঠ যুবক সেই দ্বারপথে তথায় আগমন করিলেন। তিনি নিকটস্থ হইয়া বলিলেন, “মহাশয় কি কর্ত্রী ঠাকুরাণীর সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছেন?”
“হাঁ, একটু বিশেষ প্রয়োজনীয় কথা আছে।”
“তিনি আমাকে আপনার নিকট পাঠাইলেন, কি বলিবার আছে বলুন।”
“আপনি কে, অনুগ্রহ করিয়া বলিবেন কি?”
“আমার নামে বোধ হয় আপনার কোন প্রয়োজন নাই—তবে এই পৰ্য্যন্ত জানুন যে, শীঘ্রই আমি তাঁহার জামাতা হইব।”
১২
কৃতান্তকুমার সসম্ভ্রমে মস্তক অবনত করিলেন; মনে মনে বলিলেন, “কি আপদ! ইহারই মধ্যে জামাই ঠিক হইয়া গিয়াছে—তৎপর না হইলে সমস্ত পন্ড হইবে, দেখিতেছি।”
যুবক বলিলেন, “এখন শুনিলেন যে, আমার সহিত এই বাড়ীর কর্ত্রী ঠাকুরাণীর কি সম্বন্ধ; তাহাই বলিতেছি, আপনার কি কথা আছে, তাহা আপনি তাহা আপনি আমাকে অনুগ্রহ করিয়া বলিতে পারেন।”
কৃতান্তকুমার কোন কথা না কহিয়া যুবকের আপদমস্তক পর্যবেক্ষণ করিতেছিলেন। তিনি যে ভাবে চাহিতেছিলেন, তাহা যে নিতান্ত অসভ্যতা, বোধ হয়, তাহা তিনি নিজেই বুঝিতেছিলেন।
তাঁহার ভাবে বিরক্ত হইয়া যুবক আবার বলিলেন, “মহাশয়, আপনি কি এখানে আমার চেহারা দেখিতে আসিয়াছেন? তবে ইহাও জানিয়া রাখুন, আমি অসভ্যতা প্রায়ই মাপ করি না।”
কৃতান্তকুমার নিতান্ত বিনীত ভাবে বলিলেন, “আমি যদি কিছু অন্যায় করিয়া থাকি, আমাকে মাপ করিবেন; আমি যে এরূপভাবে আপনার দিকে চাহিতেছিলাম, তাহার কারণ আছে; আমার বোধ হইতেছিল যে, আমি আপনাকে যেন পূর্ব্বে কোথায় দেখিয়াছি। আপনাকে কোথায় দেখিয়াছি, তাহাই ভাবিতে ভাবিতে অন্যমনা হইয়াছিলাম, তাহাই আপনার কথার উত্তর দিতে বিলম্ব হইয়াছে—ক্ষমা করিবেন।”
যুবক বলিলেন, “আমার মনে হয় না যে, আপনার সঙ্গে আপনার সঙ্গে আমার আর দেখা হইয়াছিল। আমার নাম সুরেন্দ্রনাথ—আমি ওকালতি করি; গোবিন্দ বাবুর নাম শুনিয়া থাকিবেন—তিনি আমার পিতা।”
কৃতান্তকুমার বলিলেন, “এখন দেখিতেছি, আমার ভুল হইয়াছে, আপনার সহিত পূর্ব্বে আমার কখনও পরিচয় হয় নাই; হয় আপনার চেহারার মত আর কাহাকেও দেখিয়া থাকিব। কর্ত্রী ঠাকুরাণীর সহিতই আমার কথা ছিল, যখন তাঁহার নিকট বলিতে পারিতেছিনা তখন থাক্—অনর্থক আপনাকে কষ্ট দিলাম, কিছু মনে করিবেন না।
এই বলিয়া কৃতান্ত কুমার বাড়ী হইতে বাহির হইয়া গাড়ীর দিকে চলিলেন। সুরেন্দ্রনাথ তাঁহাকে প্রতিবন্ধক দিলেন না। তবে তাঁহার ভাব দেখিয়া বিস্মিত হইলেন। কৃতান্তকুমার গাড়ীতে উঠিয়া কোচম্যানকে বলিলেন, “একদম হাবড়া স্টেশনে যাও।”
কোচম্যান গাড়ী হাঁকাইয়া দিল।
গাড়ীতে বসিয়া কৃতান্তকুমার মনে মনে বলিলেন, “কি বিষয় গোলযোগের ভিতরেই গিয়া পড়িতেছি। এ দেখিতেছি,আমাদের গোবিন্দরামেরই ছেলে। আর এ বিবাহ করিতে যাইতেছে, নরেন্দ্রভূষণের একজন উত্তরাধিকারীণীকে? আর এই সুরেন্দ্রনাথকে আমি নিশ্চয়ই পূর্ব্বে কোথায় দেখিয়াছি, কোথায়— গোবিন্দরামের বাড়ী? সেখানে ত জীবনে আমি কখনও যাই নাই; তবে কোথায়? এখন মনে হইতেছে না, এ বিষয়টা ও সন্ধান লইতে হইতেছে।”
তাহার পর তিনি আবার ভাবিলেন, “যাহাই হউক, নরেন্দ্রভূষণের এই ওয়ারিসানের সহিত কথাবার্তা কহিবার উপায় কি? আজ ত দেখা করিল না, কখনও কি করিবে? যদি আমি এই দুইটি স্ত্রীলোক—মাতা ও কন্যার কাছে কোন প্রস্তাব করি, তাহা হইলে ইহারা এই সুরেন্দ্রনাথকে বলিবে—সুরেন্দ্র গিয়া তাঁহার পিতা গেবিন্দরামকে বলিবে—তাহা হইলে সেই বুড়োময়না সকলই বুঝিতে পারিবে। না, আমাকে অন্য উপায় দেখিতে হইবে। আজ থাক্ আর একদিন আসিয়া ইহাদের বাড়ীটা ভাল করিয়া দেখিতে হইবে—এখন আর বিলম্ব করিলে চলিবে না। এখন আর এক ওয়ারিসনকে দেখা যাক, তাহার মা নাই—বাপ আছে। সন্ধান পাইয়াছি, তাহার বয়স অধিক নয়। দেখা যাক, ইহার বাপকে প্রথমে—সেই সম্পত্তির কথা সে কিছু জানে কি না?”
অক্ষয়কুমার কি পুলিশের সাহেব যদি কৃতান্তকুমারের এই সকল কথা শুনিতে পাইতেন, তাহা হইলে তাঁহারা নিশ্চয়ই বিস্মিত হইতেন, কারণ তাঁহারা তাঁহার উপর খুনের তদন্তের ভার দিয়াছিলেন, তিনিও স্বীকার করিয়া বলিয়াছিলেন যে, এক মাসের মধ্যে খুনীকে ধরিয়া দিবেন, অথচ দেখা যাইতেছে যে, কৃতান্তকুমার অন্য বিষয় লইয়াই মহাব্যস্ত আছেন—খুনের বিষয় একবারও ভাবিতেছেন না। খুন সম্বন্ধে রামকান্তের সহিত কথা কহা ব্যতীত আর কিছুই করিতেছেন না
তবে কৃতান্তকুমারের উপর তাঁহাদের খুবই বিশ্বাস আছে। গোয়েন্দাগিরিতে তাঁহার অদ্ভুত ক্ষমতা যে আছে তাহা তাঁহারা বেশ জানেন; অপরাধীকে ধৃত করা সম্বন্ধেও তাঁহার প্রথা নতুন, সুতরাং তাঁহারা নিশ্চিন্ত ছিলেন। বিশ্বাস ছিল, কৃতান্তকুমার যাহা বলিয়াছেন তাহা করিবেন, এক মাসের মধ্যে খুনীকে অবশ্যই ধরিয়া আনিবেন।
গাড়ী হাবড়া স্টেশনে আসিলে কৃতান্তকুমার চন্দননগরের একখানা টিকিট কিনিয়া ট্রেনে উঠিলেন। যথা সময়ে ট্রেন চন্দননগর স্টেশন উপস্থিত হইল; কৃতান্তকুমার গাড়ী হইতে নামিয়া প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াইলেন।
গাড়ী স্টেশন ছাড়িয়া চলিয়া গেলে এবং অন্যান্য যাত্রিগণ স্টেশন হইতে বাহির হইয়া গেলে, তিনি একজন রেলের জমাদারকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখানে গোপাল বলিয়া কোন লোক কাজ করে?”
সে বলিল, “গোপাল! কোন গোপাল?”
“এই রেলে―এই স্টেশনে সে কাজ করে।”
“এক গোপাল পয়েন্টম্যান আছে।”
“হাঁ, হাঁ—সেই-ই।”
“ঐ ডিষ্ট্যান্ট সিগ্নাল গুমটিতে সে থাকে।”
“বটে, এই লাইনের উপর যাইব?”
“পাশ দিয়া যান। গোপালকে আপনার কি দরকার?”
“সে আমাদের দেশের লোক।”
জমাদার আর কোন কথা না কহিয়া অন্য কাজে চলিয়া গেল।
কৃতান্তকুমার লাইনের উপর দিয়া দূর গুমটির দিকে চলিলেন। কিয়দ্দুর আসিয়া কৃতান্তকুমার দেখিলেন, একটি দ্বাদশবর্ষীয়া বালিকা হাতে করিয়া কি লইয়া গুমটির দিকে যাইতেছে। কৃতান্তকুমার মনে মনে বলিলেন, “এইটি-ই সেই—বাবর জন্য কিছু খাবার লইয়া যাইতেছে।
কে ভাবিবে যে, পয়েন্টম্যানের মেয়েটা পাঁচ লাখ টাকার মালিক? কেন পাঁচ লাখ টাকা কেন? যদি বরানগরের মেয়েটি হঠাৎ মরিয়া যায়, তাহা হইলে এই মেয়েটি সমস্ত সম্পত্তি পাইবে; তবে ইহার বাপ গোপাল নিশ্চয়ই এ বিষয়ে কিছুই জানে না—জানে কি না জানে, তাহা প্রথমে দেখা আবশ্যক।”
এই বলিয়া তিনি দ্রুতপদে চলিলেন। তাঁহার ইচ্ছা যে, তিনি বালিকাকে গিয়া ধরিবেন; কিন্তু বালিকাও দ্রুতপদে চলিতেছিল, বিশেষতঃ লাইনের উপর দিয়া সে সর্ব্বদাই গমনাগমন করিত, সুতরাং এ কার্য্যে সে বিশেষ অভ্যস্ত হইয়াছিল, এইজন্য কৃতান্তকুমারের সাধ্য নাই, তাহাকে ধরিতে পারেন। মেয়েটি প্রথমেই গুমটি ঘরের দ্বারে পৌঁছিল। গোপাল তাহাকে দেখিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিল। কন্যার হাত হইতে খাবার নামাইয়া লইয়া, তাহাকে ক্রোড়ে তুলিয়া বারংবার তাহার মুখচুম্বন করিল। সংসারে গোপালের এই মেয়েটি ব্যতীত আর কেহ ছিল না, এ মেয়েটি তাহার সংসারে একমাত্র বন্ধন—ভলবাসার একমাত্র আধার এবং তাহার নয়নের তারা ছিল।
সহসা গোপালের দৃষ্টি কৃতান্তকুমারের প্রতি পড়িল। এত দূরে এই গুমটিতে কোন ভদ্রলোক আসিত না, কৃতান্তকুমারে বেশভূষা বড়লোকের ন্যায়, গোপাল বিস্মিত হইল, কন্যাকে তথায় রাখিয়া কয়েক পদ তাঁহার দিকে অগ্রসর হইল।
কৃতান্তকুমার গোপালের নিকটবর্ত্তী হইয়া বলিলেন, “তোমার নাম গোপাল—আর ঐটি বুঝি তোমার কন্যা?”
গোপাল একটু বিস্মিতভাবে বলিল, “হাঁ, আপনার কি আমার কাছে কিছু দরকার আছে?
“হাঁ, এই মেয়েটি ঠিক ইহার মার মত দেখিতে হইয়াছে।”
“ইহার মাকে আপনি চিনিতেন?”
“না, দুই একবার দেখিয়াছিলাম মাত্র, তবে তোমার শ্বাশুড়িকে আমি চিনিতাম।
“আপনাকে আমি কখনও দেখি নাই; আপনি কি জন্য আসিয়াছেন?”
“আমি ভাবিয়াছিলাম যে, তোমার কন্যা একটা সম্পত্তির ওয়ারিসন হইতে পারে।”
গোপাল ম্লানহাসিয়া বলিল, “আমাদের মত গরীব আবার কবে কাহার ওয়ারিসান হয়।”
তোমার শ্বাশুড়ীর মার নাম কি ছিল, তিনি কাহার কন্যা, জান?”
“আমার স্ত্রী যখন ছেলেমানুষ, তখন তিনি মরিয়া গিয়াছিলেন—আমি তাঁহাদের বিষয় কিছু জানি না।”
“হাঁ, আমারই ভুল হইয়াছে, আমি যাহার কথা ভাবিতেছিলাম, তবে সে অন্যলোক–”
এই সময়ে দূরে তীব্র বংশীধ্বনি হইল। গোপাল বলিয়া উঠিল, “কলিকাতার গাড়ী আসিয়াছে, আমাকে পয়েন্ট ঠিক করিতে হইবে—আমি চলিলাম”, বলিয়া সে ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটিয়া গিয়া পয়েন্ট সবলে চাপিয়া ধরিল; পয়েন্টের উপরের লৌহচক্রখানা ঘুরিয়া ডিসট্যান্ট সিগন্যালের সাদা পাখা বাহির হইল।
গোপাল যেরূপভাবে দাঁড়াইয়া পয়েন্ট ধরিয়াছিল, তাহাতে তাহার পশ্চাদ্দিক্ কৃতান্তকুমারের দিকে পড়িয়াছিল, সুতরাং গোপাল তাঁহাকে দেখিতে পাইতেছিল না।
কৃতান্তকুমারও ভাবিলেন যে, ইহার নিকট আর কিছু জানিবার নাই—সুতরাং আর অপেক্ষা বৃথা। সেই সময়ে তিনি দেখিলেন, গোপালের কন্যা অনেক দূরে—স্টেশনের দিকে গিয়াছে। লাইনের ধারে অনেক বনফুল ফুটিয়াছে, বালিকা তাহাই আগ্রহের সহিত কুড়াইতেছে। এই বালিকার নাম লীলা
লীলাকে দেখিলে গরীব পয়েন্টম্যানের কন্যা বলিয়া মনে হয় না—প্রকৃতই সে দেখিতে বড় সুন্দর, তবে অযত্নে তাহার অপরূপ রূপ ভষ্মাচ্ছাদিত অনলের ন্যায় শোভা পাইতেছিল। প্রসৃত কৃষ্ণকেশভার পৃষ্ঠ ও স্কন্ধ ঢাকিয়া বিসর্পিত।
কৃতান্তকুমার লীলার রূপে ও সরলতায় মুগ্ধ হইয়াই হউক, আর যে কারণে হউক, তাহার নিকটে আসিয়া দাঁড়াইলেন; পকেট হইতে মানিব্যাগ বাহির করিয়া একটি টাকা তাহাকে দিতে গেলেন; কিন্তু লীলা মাথা নাড়িয়া সরিয়া দাঁড়াইল—সে গরীবের কন্যা বটে—কিন্তু ভিখারী নহে।
কৃতান্তকুমার যেন দুঃখিত হইয়া, ব্যাগটি পকেটে রাখিলেন, কিন্তু ব্যাগটির মুখ যে বন্ধ করেন নাই, তাহা বোধ হয় জানিতে পারেন নাই; কতকগুলি টাকা লাইনের মধ্যে ছড়াইয়া পড়িয়া গেল। তিনি বোধ হয়, ইহাও জানিতে পারিলেন না। তিনি সত্বরপদে লাইনের উপর দিয়া স্টেশনের দিকে চলিলেন।
লীলা টাকা পড়িতে দেখিয়াছিল, তাহাই বলিয়া উঠিল, “বাবু—বাবু।” কিন্তু কৃতান্তকুমার তাহার কথাও বোধহয়, ব্যস্ততাপ্রযুক্ত শুনিতে পাইলেন না। সেইরূপ দ্রুতপদে স্টেশনের দিকে চলিতে লাগিলেন।
তখন লীলা সত্বর লাইনের উপর আসিয়া টাকাগুলি কুড়াইতে লাগিল। টাকাগুলি কুড়াইয়া, ছুটিয়া গিয়া কৃতান্তকুমারকে দিবে, ইহাই তাহার ইচ্ছা।
১৩
তখন পশ্চিম গগন প্রান্তে রক্তবর্ণ সূর্য্য নীরবে প্রশান্ত ধরণীবক্ষে স্বর্ণধারা বর্ষণ করিতেছিল। পশ্চাতে যে একখানা ট্রেন আসিতেছে, টাকা কুড়াইতে গিয়া লীলা তাহা ভুলিয়া গিয়াছিল; সে সৰ্ব্বদা পিতার নিকট গুমটিতে থাকিত, সুতরাং কখন কোন গাড়ী কোন দিক হইতে আসিবে, তাহা সে সব জানিত। দূরস্থ গ্রামের নিরীহ লোকেরা গাড়ীর সময় জানিতে হইলে তাহাকেই জিজ্ঞাসা করিত; সুতরাং গাড়ী আসিবার সময় হইলে সে কখনও লাইনের উপর থাকিত না। কিন্তু আজ টাকা কুড়াইতে গিয়া সে গাড়ীর কথা একেবারে ভুলিয়া গেল।
গাড়ী দূরে দেখা দিয়াছে, মহাশব্দে শন্ শন্ করিয়া ঝড়ের বেগে ছুটিয়া আসিতেছে; ডাকগাড়ী— চন্দননগরে থামিবে না—একেবারে কলিকাতায়। ড্রাইভারও ক্ষুদ্র লীলাকে দেখিতে পায় নাই, দূর হইতে পয়েন্টে শ্বেত মার্কা দেখিয়াছে, সুতরাং রাস্তা পরিষ্কার আছে; তবুও নিশ্চিত হইবার জন্য সে ইঞ্জিন হইতে মুখ বাড়াইয়া দেখিয়াছে যে, পয়েন্টম্যান ঠিক নিয়ম মত পয়েন্ট ধরিয়া আছে।
পয়েন্টম্যান আট দশ টাকা মাসিক বেতন পায় বটে—কিন্তু তাহার উপর কত জনের যে প্রাণ নির্ভর করে, তাহা কয়জন ভাবিয়া দেখেন? তাহার একটু ভ্রম হইলে সমস্ত ট্রেনখানি এক নিমেষে চূর্ণ-বিচূর্ণ হইতে পারে—শত শত লোক অকালে প্রাণ হারাইতে পারে।
গোপাল বহু বৎসর রেলে পয়েন্টম্যানের কাজ করিতেছে, এ পর্যন্ত তাহার কখনও ভুল হয় নাই, যখন সে পয়েন্ট ধরিত, তখন সে জগৎসংসার সব ভুলিয়া যাইত, এমন কি, তাহার প্রাণের লীলাকেও ভুলিত; তাহার প্রাণ মন অস্তিত্ব সমস্ত যুগপৎ পয়েন্ট ও গাড়ীতে সন্নিবিষ্ট হইয়া যাইত; এই দুইটার মধ্যে সে নিজেকেও একেবারে হারাইয়া ফেলিত—তাহার আর অন্য জ্ঞান থাকিত না। গাড়ী নিরাপদে চলিয়া গেলে সে নিশ্বাস ছাড়িয়া সর্ব্বদা ভগবানের নাম করিত।
আজ পয়েন্ট ধরিয়া মহুর্তের জন্য তাহার মন বিচলিত হইল। তাহার মন মুহূর্তের জন্য লীলার কথা উদয় হইল, সে কোথায়—লাইনের উপর নাই ত? গাড়ী আসিবার সময় সে কখনও লাইনের উপর থাকিত না। গোপালের অপেক্ষা গাড়ীর সময় তাহার আরও বেশী মুখস্থ ছিল; সুতরাং গোপাল জানিত যে, লীলা কখনই এখন লাইনের উপর নাই। তবুও গোপালের মন কেন বিচলিত হইল, সে মুখ ফিরাইয়া দেখিল; দেখিল, কৃতান্তকুমার দূরে স্টেশনের দিকে যাইতেছেন—আর লীলা লাইনের পর দিয়া তাঁহার পশ্চাতে ছুটিতেছে—পশ্চাতে যে গাড়ী আসিতেছে, সে জ্ঞান তাহার নাই।
গোপালের হৃদয় হৃদয়ের মধ্যে বসিয়া গেল। শেষে বুঝিল, আর এক মুহূর্তে তাহার নয়নতারা হৃদয়ের আলো লীলা গাড়ীর নীচে পড়িয়া পেষিত হইবে।
গোপালের নিকট হইতে গাড়ী আর একশত হাতও দূরে নাই—আর অপর দিকে পয়েন্ট হইতে দুইশত হাত দূরে লীলা লাইনের উপর দিয়া ছুটিতেছে—গাড়ির কথা তাহার একেবারে মনে নাই। সে ছুটিতেছে, আর মধ্যে মধ্যে অবনত হইয়া লাইনের ভিতর হইতে কি কুড়াইয়া লইতেছে। তাহার কেশদাম বায়ুভরে উড়িয়া মুখের উপর পড়িতেছে। একহাতে কেশ সরাইয়া, কখনও বা তাহা ধরিয়া হেঁট হইয়া অপর হাতে টাকা তুলিতেছে, বরাবর বহুদূর পর্য্যন্ত এইরূপ টাকা ছড়াইয়া পড়িয়াছে।
মহাবেগে মহাশব্দে ধূম উদগীরণ করিতে করিতে ডাকগাড়ী মহাকায় ক্রুদ্ধ দৈত্যের মত ছুটিয়া আসিতেছে; অপর দিকে হাওয়া চলিতেছিল বলিয়া গাড়ীর শব্দ লীলার কর্ণে প্রবিষ্ট হয় নাই।
আর তাহার রক্ষা পাইবার কোন আশা নাই। ড্রাইভার তাহাকে দেখিল, কিন্তু গাড়ী থামাইবার তখন আর সময় নাই। কি সৰ্ব্বনাশ!
একজন কেবল এ অবস্থায় লীলার প্রাণ রক্ষা করিতে পারে—সে তাহার পিতা—গোপাল। এখনও গাড়ী পয়েন্টে আসে নাই; গোপাল ইচ্ছা করিলে, পয়েন্ট ছাড়িয়া দিলে গাড়ী অন্য লাইনে চলিয়া যাইতে পারে; যে লাইনের উপর লীলা আছে, তাহার উপর দিয়া যাইবে না। তবে ইহাতে গাড়ী যে লাইনে যাইবে, তাহা বন্ধ থাকিতে পারে, তাহাতে অন্য গাড়ী আসিতে পারে, সুতরাং এই প্রবল বেগমান্ গাড়ী তাহার উপর গিয়া চূর্ণ-বিচূর্ণ হইবে—গাড়ীর সমস্ত আরোহী এক পলকে মৃত্যুমুখে নিক্ষিপ্ত হইবে। এক পলকের জন্য গোপালের মনে এ কথা উদিত হইল—অমনই সঙ্গে সঙ্গে কে যেন বলিল, “শত সহস্রের প্রাণ তোমার হাতে—এ দুর্ঘটনার দায়ী তুমি, তাহা হইলে নরকেও তোমার স্থান হইবে না।”
গোপালের চক্ষের উপর ঝক্কিল, লোমহর্ষক দৃশ্য—যেন তাহার প্রাণের লীলার উপর দিয়া গাড়ী চলিয়া যাইতেছে, লীলার দেহ পেষিত হইয়া টুকরা টুকরা মাংসপিন্ডে পরিণত হইয়াছে। কি ভয়ানক! গোপালের মাথায় সমুদয় চুলগুলো রুষ্ট সজারুর মত কাঁটার ন্যায় সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া উঠিল। তাহার চক্ষু হইতে তারাদ্বয় যেন ছিন্ন হইয়া বাহির হইতে চায়। সহসা বিদ্যুতের ন্যায় চকিতে তাহার মনে একটা কথা উদিত হইল, যদি গাড়ী অপর লাইনে দিই—তাহা হইলে স্টেশন হইতে আমার ভুল দেখিতে পাইবে, স্টেশন এখান হইতে অনেক দূর, নিশ্চয় তাহারা লাল দেখাইবে, গাড়ীও থামিবে, কোন ক্ষতি হইবে না, কেবল আমার চাকরী যাইবে, তাহা যাক্, আমার লীলা ত বাঁচিবে। তবে তাহাই করি।”
গোপাল পয়েন্ট ফিরাইতে যাইতেছিল, এমন সময়ে স্টেশন হইতে বংশীধ্বনি হইল। সে ধ্বনি তীক্ষ্ণ তীরের ন্যায় গোপালের কর্ণে প্রবেশ করিল। তখন গোপাল বুঝিল, স্টেশন হইতে হুগলীর গাড়ী ছাড়িয়াছে।
হায়, আর বুঝি রক্ষা হইল না। সে যে অপর লাইনে ডাকগাড়ী দিতেছিল, সেই লাইন দিয়াই হুগলীর গাড়ী আসিতেছে। পয়েন্ট একটু ঘুরাইলে দুই গাড়ীতে সংঘৰ্ষণ হইবে, এক নিমিষে চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া যাইবে, সহস্ৰ সহস্ৰ লোক হঠাৎ মৃতুমুখে পতিত হইবে।
এই সময়ে দুই দিক হইতে দুই গাড়ীর বাঁশী বাজিয়া উঠিল; তখন গোপালের মাথায় ঘোরতর বিপ্লব উপস্থিত হইল, সে পাষাণের মত হইয়া গেল, সে সব ভুলিয়া গেল—এমন কি নিজেকেও। উভয় দিক হইতে উভয় গাড়ীর তীব্র বংশীধ্বনি গোপালের কর্ণে যেন বিকটস্বরে বলিল, “এই সকল নরনারী তোমার কি করিয়াছে যে, তুমি ইহাদের হত্যা করিতে যাইতেছ? এ মহাপাপের প্রায়শ্চিত্ত নাই, গোপাল সাবধান!”
“হাঁ, ভগবান—না—না—এ কাজ আমি কিছুতেই পারিব না—লীলা মরে, আমিও এইরূপে মরিব, সব ফুরাইয়া যাইবে। লীলা—লীলা–লীলা—” এই কথাগুলা গোপালের উন্মত্ত বিচঞ্চল মস্তিষ্কে বারেক চকিতে উদিত হইল মাত্র। তখন তাহার মস্তিষ্কে প্রবল ঝটিকা বহিতেছে। সে দৃঢ়হস্তে সবলে পয়েন্ট চাপিয়া ধরিল, মহাবেগে রুষ্ট প্রকান্ড আরণ্য জন্তুর মত ডাকগাড়ী নিজের লাইন ধরিয়া তীরবেগে বাহির হইয়া গেল। আজ বুঝি ক্ষুদ্র লীলার রক্তেই শত শত লোকের প্রাণরক্ষা হইল!
গোপাল তখন পয়েন্ট ছাড়িয়া দিয়া যথায় ছিল, সেই দিকে ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটিল; লীলাকে রক্ষা করিবার কোন উপায় ছিল না—তবে একবার শেষ দেখা। গোপাল দেখিল, এই সময়ে সহসা লীলা পশ্চাদিকে মুখ ফিরাইল। তৎক্ষণাৎ সে গাড়ীর আড়ালে পড়িল—লীলাকে গোপাল আর দেখিতে পাইল না।
এতক্ষণ লীলা গাড়ী দেখিল, কিন্তু গাড়ী তাহার উপর—কমলকলিকার উপর প্রকান্ড কৃষ্ণ হস্তীর পদক্ষেপের আর এক বিপদ বিলম্ব। লীলা কাঁপিতে কাঁপিতে জানুভরে বসিয়া পড়িল।
গোপাল উন্মেত্তের মত চাৎকার করিয়া উঠিল, “লীলা শুয়ে—শুয়ে পড়।”
প্রতিকূল বায়ুও সে স্বর বিপরীত দিকে বহিয়া লইয়া গেল। লীলা কিছুই শুনিল না—হায় হায়! সৰ্ব্বনাশ হইল! বুঝি সব ফুরাইল! তাহার পর গোপাল আর কিছু দেখিতে পাইল না। কেবল দেখিল, ডাকগাড়ী প্রবলবেগে লীলার উপর দিয়া চলিয়া যাইতেছে—তখনই চলিয়া গেল।
গোপাল ছুটিয়া সেইস্থানে আসিল, লীলা কি আছে—না পেষিত হইয়া গিয়াছে? গোপালের নিশ্বাস-প্ৰশ্বাস পর্য্যন্ত রোধ হইয়া আসিয়াছিল। গোপাল দেখিল, লাইনের মধ্যেস্থলে তাহার লীলা উপুড় হইয়া পড়িয়া আছে—তাহার হাত মাথার দিকে বিস্তৃত, তাহার মুখ মাটির দিকে—সে নিশ্চল—নিস্পন্দ।
“হা ভগবান! এই করিলে—শেষ অন্ধের যষ্ঠি কাড়িয়া লইলে! গোপাল ব্যাকুলভাবে কাঁদিয়া উঠিল। কাঁদিতে কাঁদিতে লীলাকে কোলে তুলিয়া লইল।
তখন লীলা চক্ষু মেলিল; সহাস্যবদনে—এ হাসি বোধ হয়, স্বর্গেও নাই—বলিল, “বাবা কাঁদিতেছ কেন? আমায় ত লাগে নাই, তবে গাড়ীগুলো যখন উপর দিয়া যাইতেছিল, তখন কি ভয়ানক শব্দ! এখনও যেন কানে তালা ধরিয়া রহিয়াছে। কেন বাবা, তুমি ত কতবার বলিয়াছ, গাড়ী আসিয়া পড়িলে উপুড় হইয়া শুইয়া পড়িবে; আমি ঠিক তাহাই করিয়াছিলাম—আমার কিছুই লাগে নাই—এই দেখ, টাকাগুলোও ছড়াইয়া ফেলি নাই। বাবা, সেই ভদ্রলোকটি এখনও স্টেশনে আছেন, চল তাহাকে দিয়া আসি।”
গোপালের চক্ষু দিয়া দরবিগলিতধারে আনন্দাশ্রু বহিতেছিল। সে গদগদকণ্ঠে বলিল, “ভগবান আজ তোকে ফিরাইয়া দিয়াছেন, আমি তাঁহাকে দিন রাত ডাকি। আর সেই লোকটা—পরে তাহাকে দেখিব।”
ডাকগাড়ীর ড্রাইভার কিছুদূরে গাড়ী থামাইয়াছিল; কিন্তু এক্ষণে সে লীলাকে গোপালের ক্রোড়ে নিরাপদ দেখিয়া গাড়ী জোর করিয়া চালাইয়া দিল। বংশীধ্বনি হওয়ায় গোপাল সেইদিকে ফিরিয়া দেখিল, গাড়ী আবার তীর বেগে ছুটিয়াছে—ড্রাইভার ও গার্ড উভয়ই সাহেবই তাহার দিকে টুপি খুলিয়া সবেগে নাড়িতেছে। তখনই অপর লাইন দিয়া আর একখানা ট্রেন মহাবেগে চলিয়া গেল। এই উভয় ট্রেনের আরোহীবর্গের কেহ বুঝিল না, আজ তাহারা একটা কি ভয়ানক সাংঘাতিক বিপদের হাত এড়াইয়া গেল।
১৪
প্রাগুক্ত ঘটনার পর দিবস সহরের সর্ব্বত্র পুলিস হুলিয়া দিয়াছে;–”একটা স্ত্রীলোকের মৃতদেহ একটি বাক্সের ভিতর পাওয়া গিয়াছে—ইহার বড় ফটোগ্রাফ লওয়া হইয়াছে—আজ লালদীঘির ধারে ঐ ফটোগ্রাফ টাঙাইয়া রাখা হইবে। সকলেই সেখানে গিয়া ঐ ফটোগ্রাফ দেখিতে অনুরোধ করা যাইতেছে। এই স্ত্রীলোক কে, যে বলিবে, এবং ইহার সম্বন্ধে কোন সন্ধান দিতে যে পারিবে, তাহাকে পঞ্চাশ টাকা পুরস্কার দেওয়া ইইবে।”
আজ বৈকালে বহুলোক আজ লালদীঘীতে আসিয়া জমিয়াছে। নানালোকে নানাকথা কহিতেছে সত্য, কিন্তু এই স্ত্রীলোক যে কে, তাহা কেহই বলিতে পারিতেছে না। রামকান্ত ও শ্যামকান্ত উভয়েই ছদ্মবেশে এই ভিড়ের মধ্যে ছিল। রামকান্ত তাহার চক্ষুদ্বয়কে বিশেষ সতর্ক রাখিয়াছিল। একজনকে দেখিয়া তাহার বোধ হইল, যেন এই লোকটাকেই সে সেদিন রাত্রে বাগবাজারের বাড়ীতে দেখিয়াছিল, কিন্তু লোকটা একখানা রুমালে মুখের নীচের দিকটা চাপা দিয়াছিল; সেইজন্য রামকান্ত তাহার মুখ ভাল দেখিত পাইল না। ভাবিল, “দেখা যাক্, কতক্ষণ এ মুখে রুমাল দিয়া থাকে।”
তখন রামকান্ত, শ্যামকান্তকে লোকটার উপর নজর রাখিতে বলিল। তাহার সন্দেহ হইয়াছিল মাত্র, নিশ্চিত হইতে পারে নাই; ভাবিল, “দেখিতেছি, এ ভদ্রলোক—যদি ভুল করিয়া ইহাকে গ্রেপ্তার করি, তাহা হইলে কেবল যে হাস্যস্পদ হইতে হইবে, এরূপ নহে—উপরওয়ালার কাছেও প্রচুর লাঞ্ছনা উপভোগ করিতে হইবে–কাজেই হঠাৎ কিছু করা ভাল নহে।
যখন রামকান্ত এরূপ গবেষণায় নিযুক্ত ছিল, সেই সময়ে লোকটি তাহার দৃষ্টি বহিভূর্ত হইয়া গেল—ভিড়ের মধ্যে সে কোন দিকে চলিয়া গেল।
রামকান্ত তাহার সন্ধানে যাইতেছিল, এমন সময়ে ভিড়ের বাহিরের দিকে একটা মস্ত গোল উঠিল। রামকান্ত বলিয়া উঠিল, “তাহাকেই কি গ্রেপ্তার করিল না কি—দেখা যাক্, ব্যাপার কি” বলিয়া রামকান্ত সত্বরপদে যেখানে গোলযোগ হইতেছিল, সেইখানে উপস্থিত হইল। দেখিল, দুইজন পাহারাওয়ালার সহিত এক হিন্দুস্থানীর মহা যুদ্ধ আরদ্ধ হইয়াছে; পাহারাওয়ালাদ্বয় সেই হিন্দুস্থানীটার হাত দুইটা চাপিয়া ধরিয়াছে, আর শ্যামকান্ত তাহার গলা টিপিয়া ধরিয়াছে, সুতরাং রামকান্ত আর বাকী থাকে কেন—তাহাদের সহিত যোগদান করিল। তখন হিন্দুস্থানীকে তাহারাই পাগড়ীর কাপড়ে বাঁধিয় ফেলিতে তাহাদের অধিক ক্লেশ পাইতে হইল না।
শ্যামকান্ত হাঁপাইতে হাঁপাইতে রামকান্তকে বলিল, “বেটা একজনের পকেট মারিতেছিল হে!”
একজন পাহারাওয়ালা বলিল, “শীঘ্র থানায় লইয়া চলুন—না হইলে লোকে ইহাকে মারিয়া ফেলিবে—যে পারিতেছে, সেই মারিতেছে।”
রামকান্ত বলিল, “ইহাকে আগে একখানা গাড়ীতে পুরিয়া ফেল।” একজন পাহারাওয়ালা ছুটিয়া এক খানা গাড়ী আনিল। তখন রামকান্ত ও শ্যামকান্ত সেই হিন্দুস্থানিটাকে লইয়া সেই গাড়ীতে উঠিল; পাহারাওয়ালাদ্বয় গাড়ীর ছাদের উপর উঠিল। গাড়ীর মধ্যে রামকান্ত হিন্দুস্থানীর লোকটার বস্ত্রাদি খানাতল্লাশী করিল। তাহাতে বাহির হইল, একটি ঘড়ি ও চেন—তিনটা মানিব্যাগ—রুমালে বাঁধা চারিটি টাকা—আর একখানা ছোট পকেট বহি।”
রামকান্ত যেমন সেই পকেট-বইখানা খুলিল, অমনি তন্মধ্য হইতে একখানি ফটোছবি গাড়ীর খোলের মধ্যে পড়িয়া গেল। রামকান্ত সত্বর সেখানি তুলিয়া লইয়া দেখিল—ছবি সেই হত স্ত্রীলোকের।