১
আজ কলিকাতার যা অবস্থা,ত্রিশ বৎসর পূর্বে সে অবস্থা ছিল না। তখন কলিকাতায় রাজপথের দুইপার্শ্বে দুর্গন্ধ, পঙ্কিল, গভীর নদমা ছিল; সেই নৰ্দ্দমায় কোটী কোটী মশক পালিত হইত। এখনকার মত তখন সকল রাস্তায় সমুজ্জ্বল গ্যাসালোক ছিল না, যে সময়ের কথা বলা হইতেছে, সে সময়ে গ্যাস কেবল কলিকাতায় নতুন আসিয়াছে; অধিকাংশ রাস্তায় কেরোসিন তেলের আলোক, তাহাতে পথিকের বড় সুবিধা হইত না।
এখন যেখানে প্রকান্ড অট্টালিকামালা শোভা পাইতেছে, তখন সেখানটা হয় উদ্যান, কি একটি জঙ্গল অধিকার করিয়াছিল। হাতীবাগান,জোড়াবাগান, বাদুড়বাগান,সিংহের বাগান,বিবির বাগান সত্য সত্যিই ছিল। সেই সময়ে একদিন আষাড় মাসের গভীর রাত্রে হাতীবাগানের পথিমধ্যে দুইজন পাহারাওয়ালা কথোপকথন করিতেছিল। রাত্রি নিস্তব্ধ, তাহাতে একটু পূৰ্ব্বেই খুব এক পশলা বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে। পথিমধ্যে স্থানে স্থানে জল জমিয়াছে—পার্শ্বস্থ নৰ্দ্দমা দিয়া কল কল রবে জলস্রোত ছুটিয়াছে। এত অন্ধকার যে, কোন দিকে কিছুই দেখা যায় না। কেরোসিনের আলোগুলির অধিকাংশই প্রবল ঝটিকাবেগে নিভিয়া গিয়াছে। কেবল দূরে দূরে দুই একটি অলোস্তিমিত ভাবে জ্বলিতেছিল—তাহাতে আলো না হইয়া চারিদিকে অন্ধকার আরও ঘনীভূত হইয়াছে। তবে মধ্যে মধ্যে বিদ্যুৎ চমকিত হইতেছে—তাহাতেই পথ কিঞ্চিৎ দেখা যাইতেছে—সেই চকিত বিদ্যুতের আলোকে রাস্তার জল চক মক্ করিয়া উঠিতেছে। পথে জনমানব নাই—কুকুর শৃগাল পর্যন্ত এই দুৰ্য্যোগে যে যেখানে পাইয়াছে, আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে; এ দুর্যোগে এত রাত্রে কে এ সময় বাহির হইবে? কেবল দুইজন পাহারাওয়ালা একটি আলোকস্তম্ভের নিকট দাঁড়াইয়াছিল।
ইহারা দুইজনে দুইদিক হইতে পাহারা দিতে দিতে আসিয়া এই স্থানে মিলিত হইয়াছিল। একাকী নির্জন পথে ঘোর অন্ধকারে, বিশেঃষত এই দুর্যোগে ঘুরিয়া বেড়াইতে ক্লেশানুভব করিয়াই ইহারাই পরস্পর সম্মুখীন হইয়া দাঁড়াইয়া কথোপকথন করিতেছিল।
উভয়েরই মস্তকে বৃহৎ তালপাতার ছাতা ছিল, হাতে পুলিশের লন্ঠন ছিল—তখনও টিপ টিপ করিয়া বৃষ্টি পড়িতেছিল, সুতরাং ছাতা মাথায় দিয়া উভয়ে দাঁড়াইয়াছিল। কিন্তু এত প্রবলবেগে বায়ু বহিতে ছিল যে, তাহারা অতি সবলে ছাতি ধরিয়াছিল,তবুও ছাতি হাত হইতে মধ্যে মধ্যে উল্টাইয়া যাইতেছিল। একজন বলিল, “দেশে অন্নের সংস্থান থাকিলে, কে এ চাকরী করিতে আসে? এমন দুর্যোগে—এমন রাত্রি ভাই আর কখনও দেখিয়াছ?”
অপরে বলিল, “অন্নের সংস্থান থাকিলে স্ত্রী-পরিবার ছাড়িয়া কে এই শহরে বিঘোরে মরিতে আসে—পেটের দায়ে সব করিতে হয়।”
এই ত প্রায় একটা বাজে—একটা কাক পক্ষী দেখিলাম না—মানুষের কথা ত দুরে থাক।” এই দুর্যোগে—এই রাত্রে কাহার মরণ হইয়াছে যে,বাহির হইবে। আমরা আছি পেটের দায়ে।”
এই সময় অপরে তাহার হাত টিপিল। কিছু একটা হইয়াছে ভাবিয়া সে কথাবন্ধ করিল। তখন উভয়ে উৎকর্ণ হইয়া শুনিতে লাগিল। তাহারা উভয়েই সুস্পষ্ট কাহার পদশব্দ শুনিতে পাইল। তাহারা বুঝিল, এক ব্যক্তি দ্রুতপদে সেইদিকে আসিতেছে। এত রাত্রে, এই দুর্যোগে কে আসে দেখিবার জন্য তাহারা কৌতূহলাক্ৰান্ত হইল; যেদিক হইতে পদশব্দ আসিতেছিল, সেই দিকে উভয়ে নিজ নিজ লন্ঠনের আলো নিক্ষেপ করিল।
ক্রমে পদশব্দ নিকটবর্ত্তী হইল। ক্রমে পদশব্দকারী তাহাদের প্রায় সম্মুখীন হইল। সেই সময়ে তাহারা দেখিল, একটি ভদ্রলোক সত্বরপদে চলিয়াছেন, তাঁহার মাথায় ছাতা,গায়ে রেশমী চাদর, বেশ পরিপরটি —দেখিলেই ভদ্রলোক বলিয়া বুঝিতে পারা যায়। বৃষ্টির ঝাপটা হইতে কোন রকমে মাথাটা বাঁচাইবার জন্য তিনি ছাতা এত নীচু করিয়া চলিতেছেন যে, পাহারাওলাদ্বয় তাহার মুখ দেখিতে পাইল না। তাহার চলনে, পরিচ্ছদে, ভাবে কোন সন্দেহের কারণ নাই দেখিয়া পাহারাওলাদ্বয় তাঁহাকে কিছু বলিল না—তাঁহাকে চলিয়া যাইতে দিল। অনর্থক ভদ্রলোককে কি বলিয়া ধরিবে?
একজন বলিল, “বাবু আমোদ করিতেছিলেন—এখানেই কাছে কোনখানে বোধহয়, বাবুর বিবি সাহেবের আস্তানা।”
অপরে প্রতিবন্ধক দিয়া বলিল, “চুপ, আর একজন কে আসিতেছে।” যথার্থই সেই নির্জন রাত্রে আর এক ব্যক্তির পদশব্দ তাহারা শুনিতে পাইল।
যে ভদ্রলোকটি পূর্ব্বে আসিয়াছিলেন, তিনি সত্বরপদে দৃষ্টির বহির্ভূত হইয়া গেলেন; তৎপরেই অন্য ব্যক্তি পাহারাওলাদিগের নিকটবর্ত্তী হইল। তাহারা দেখিল, তাহার বেশ সাধারণ মুটে-মুজুরের ন্যায়। গায়ে কোন বস্ত্ৰ নাই—পায়ে জুতাও নাই। সে একটা বড় টিনের বাক্স মাথায় করিয়া চলিয়াছে। বাক্সটি যে খুব ভারী, তাহা তাহার ভাব দেখিলেই বুঝিতে পারা যায়।
এত রাত্রে এই ভদ্রলোককে এইরূপ একটা প্রকান্ড বাক্স একাকী লইয়া যাইতে দেখিয়া,পাহারাওলাদ্বয়ের সন্দেহ হইল। একজন অপরকে বলিল, “এ বেটা দেখিতেছি,বাক্সটা কাহারও বাড়ী হইতে না বলিয়া সংগ্রহ করিয়াছে। ভাবিয়াছে, এত রাত্রে—এই দুর্যোগে আমরা নাক ডাকাইয়া ঘুমাইতেছি।”
অপরে বলিল, “দেখা যাক, কি বলে।”
উভয়ে রাস্তার মধ্যেস্থলে গিয়া সেই লোকটার সম্মুখে দাঁড়াইল। একজন তাহার মুখের উপর লন্ঠেনের আলো ফেলিয়া বলিল, “কি হে বাপু, তোমার বাক্সটি কোথায় লইয়া যাইতেছ?”
লোকটি দাঁড়াইল। বিস্মিতভাবে পাহারাওলাদ্বয়ের দিকে চাহিল; কিন্তু কোন কথা কহিল না।
একজন পাহারাওলা তাহাকে ধাক্কা দিয়া বলিল, “বাপু, তোমার এ বাক্সে কি আছে?”
অপর পাহারাওলা বলিল, “কাপড়—গিন্নির পোষাক—তাহা হইলে বাপু তোমার গিন্নির পোষাকগুলি লোহার তৈরী। এ বাক্সটা যদি দেড় মন ভারী না হয়,তাহা হইলে আমার নাম সদানন্দ পাঁড়ে নয়।”
মুটেটা ইহাতেও কোন কথা কহিল না; উভয়ের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করিয়া চাহিয়া রহিল।
যে ব্যক্তি অগ্রে গিয়াছিল, সে নিশ্চয়ই পাহারাওলাদিগের কথাবার্তা শুনিতে পাইয়াছিল। যাহাই হোউক, তাহাকে আর দেখেতে পাওয়া গেল না। পাহারাওলা দুইটিও এই ব্যক্তিকে লইয়া মহা ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিল। তখন তাহাদের তাহার বিষয় ভাবিবার সময় ছিল না।
মুটে কোন কথা কহে না দেখিয়া পাহারাওলা বলিল, “বটে, বদজাতি—কথা কহিবে না? আচ্ছা থাক—থানায় গেলে তুমি না কথা কও, তোমার বাবা কথা কহিবে।”
এই বলিয়া তাহারা দুইজনে তাহার দুই হাত ধরিয়া,তাহাকে টানিয়া থানার দিকে লইয়া চলিল। মুটে তখনও কোন কথা কহিল না, নীরবে তাহাদের সঙ্গে চলিল।
এই সময়ে একটু দূরে একখানা গাড়ীর শব্দ হইল। বোধ হইল, যেন একখানা গাড়ী প্রবলবেগে অপরদিকে চলিয়া গেল। থানা বহুদূরে নহে। থানায় আসিয়া পাহারাওলাদ্বয় তাহাদের আসামীকে একটা ঘরের ভিতর লইয়া আসিল; তথায় একজন স্থূলকায় ব্যক্তি অৰ্দ্ধশায়িত ছিলেন। তিনি উঠিয়া বসিয়া বলিলেন, “কি ব্যাপার, সঙ্গে এ আবার কে রে?”
একজন পাহারাওলা বলিল, “এই লোকটা হাতীবাগানের রাস্তায় এই রাত্রে এই বাক্সটা লইয়া যাইতেছিল; নিশ্চয়ই কোনখান থেকে বাক্সটা চুরি করিয়াছে।”
স্থূলকায় ব্যক্তি সেই থানার দারোগা। দারোগা বলিলেন, “ও কি বলে?”
“কিছুই বলে না—জিজ্ঞেস করিলেও কথা কহে না।
“বটে, দেখি কথা কহে কি না?”
এই বলিয়া দারোগা সাহেব উঠিয়া দাঁড়াইলেন। রোষষায়িত লোচনে বলিলেন, “বাপু হে, এটা শশুর বাড়ী নয়, এখানে চালাকী চলিবে না। বল দেখি বাপু, বাক্সটা কোথায় পাইয়াছ?”
লোকটা কোন কথা না কহিয়া কেবল কপালে দুই হাত দিল। ইতিপূৰ্ব্বে সেই বাক্সটা পাহারাওয়ালাদ্বয় ধরাধরি করিয়া তাহার মস্তক হইতে গৃহতলে নামাইয়া রাখিয়াছিল।
দারোগা বলিলেন, “বাপু, তুমি বলিতে চাও—তুমি কালা ও হাবা। বিশ বৎসর পুলিশে আছি— অনেক দেখিয়াছি, অনেক শুনিয়াছি। যাও বেটাকে গারদে রাখ; কাল সকলে দেখা যাইবে।”
মুটে ইহাতেও কোন কথা কহিল না। পাহারাওয়ালাদ্বয় বিরক্ত হইয়া সবলে তাহাকে ধাক্কা মারিতে মারিতে গারদ ঘরে লইয়া চলিল।
তখন দারোগা, আর যাহারা গৃহমধ্যে ছিল, তাহাদের বলিলেন, “বাক্সটা খুলিয়া ফেল দেখি—শালা কি চুরি করিয়াছে দেখা যাক্।”
বাটালী ও হাতুড়ী দিয়া শীঘ্রই বাক্সটা খুলিয়া ফেলা হইল
তৎপরে স্বয়ং দারোগা সাহেব ডালাটা তুলিয়া ধরিলেন। এবং প্রজ্জ্বলিত বাতিটা সম্মুখে লইয়া বাক্সের ভিতরটা দেখিলেন। দেখিয়াই ভয় ও বিস্ময়ে কেমন একরকম হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “কি ভয়ানক!” বাক্সের ভিতরে একটি বিলসিতযৌবনা নবীনার মৃতদেহ!
২
দারোগা সাহেব নিজের মুখেই প্রকাশ যে, তিনি বিশ বৎসর পুলিসে চাকরী করিতেছেন; সুতরাং এমন ভয়ানক দৃশ্য তিনি অনেকবারই দেখিয়াছেন; তবুও তাঁহার মুখ পাংশুবর্ণ হইয়া গেল। বাক্সের ভিতর কি আছে দেখিবার জন্য সকলে ব্যগ্রভাবে বাক্সের নিকট আসিল।
দারোগা বলিলেন, “আমি আগে ভাবিয়াছিলাম, বেটা চোর—তাহা নয়, খুনী।”
কেহই মৃতদেহ স্পর্শ করিতে সাহস করিল না, হাঁ করিয়া বিস্মিতভাবে মৃতদেহের দিকে চাহিয়া রহিল। মৃতদেহটি একটি পরমরুপবতী যুবতীর। বয়স অষ্টাদশ বৎসরের অধিক হইবে না। একখানি সুন্দর ফিরোজা রঙের রেশমী কাপড়ে তাহার ক্ষীণ কটিদেশ বেষ্টিত। হাতে দুগাছা সোনার বালা,গলায় একছড়া নেকলেস। যুবতী অৰ্দ্ধনিমীলিতনয়নে চাহিয়া আছে—যেন সে সেই বাক্সের চতুপার্শ্বস্থ লোকদিগকে দেখিতেছে। মুখখানি এত সুন্দর,তখনও যেন তাহার নধর অধরে মৃদুমন্দ হাসিটি ফুটিয়া রহিয়াছে।
একজন বলিল,”কে বলিবে মারিয়াছে—যেন ঘুমাইতেছে।”
আর একজন বলিল, “হাঁ, চিরজীবনের মত।”
এমন কোমলাঙ্গী পরমরুপলাবণ্যসম্পন্না স্ত্রীলোককে কে নৃশংস খুন করিল, ভাবিয়া সেই পুলিস- প্রহরিগণও হৃদয়ে অত্যন্ত বেদনা অনুভব করিল।
দারোগা ধীরে ধীরে বলিলেন, “ছোরাখানা এখনও বুকে রহিয়াছে।” যথার্থই সুন্দরীর পরিহিত রেশমী বস্ত্রাভ্যন্তরে বুকের উপর একখানি ছোরার বাঁট দেখা যাইতেছে—ছোরার বাঁটটি হস্তিদন্তনিম্মিত। ছোরাখানিও ছোট, ঠিক বুকের মাঝখানে বিদ্ধ হইয়াছে—তাহাই রমনীর মৃত্যু মুহূর্তের মধ্যে হইয়াছে। বোধ হয়, সে কষ্ট অনুভব করিবার সময়ও পায় নাই—এখনও মুখখানিতে হাসিটা লাগিয়া রহিয়াছে।
ছোরাখানি এখনও বিদ্ধ থাকায় শরীরস্থ রক্তও অধিক নিঃসৃত হইতে পারে নাই—বস্ত্রে নাম মাত্র রক্ত লাগিয়াছে।
দারোগা সাহেব গম্ভীরভাবে বলিলেন, “এখন বুঝেতেছি, বেটা কেন কোন কথা কহে নাই; কাল কথা হইবে। মৃতদেহ দেখিলে কি বলে দেখা যাক—দেরী করা কর্ত্তব্য নয়।”
এই সময়ে একজনকে মৃতদেহ স্পর্শ করিতে উদ্যত দেখিয়া, দারোগা বলিয়া উঠিলেন, “উঁ— হুঁ—না—হাত দিয়ো না হে—গুরুতর ব্যাপার। ইনস্পেক্টর সাহেবকে না বলিয়া আমি কিছুই করিতে পারি না—বাক্স যেমন আছে, তেমনই থাক—কেহ হাত দিয়ো না। আমাদের পরম সৌভাগ্য যে, খুনীকে আমরা লাশশুদ্ধ ধরিতে পারিয়াছি।”
ইনস্পেক্টর সাহেবকে সংবাদ পাঠাইয়া দারোগা বলিলেন, “আমাদের পরম সৌভাগ্য যে,আজ গারদ ঘরে আর কেহ নাই; না হইলে কে জানিত যে,লোকটা কাহাকে দিয়া কাল বাহিরে সংবাদ পাঠাইত। তবুও একজন যাও,দেখিয়া আইস,সে কি করিতেছে—পাহারায় যে আছে, তাহাকেও ইহার উপর বিশেষ নজর রাখিতে বলিবে।”
কিয়ৎক্ষণ পরে সেই লোক ফিরিয়া আসিয়া বলিল, “দারোগা সাহেব, লোকটা কি করিতেছে, আপনি মনে করেন?”
“কেন কি হইয়াছে?”
“নাক ডাকাইয়া ঘুমাইতেছে?”
“সব বদমাইসী।”
“ড়, থশডশ নয়—যথার্থই ঘুমাইতেছে। আমি ধাক্কা মারিয়া দেখিয়াছি।”
“তাই ত–হয় ত—না—নিশ্চয়ই অনেক দূর হইতে বাক্সটা আনিয়াছে, তাই ঘুমাইয়া পড়িয়াছে।”
“এ রকম প্রায় দেখা যায় না—খুন করিয়া থানায় আসিয়া এ রকম ঘুম—”
“যা হোক, তুমি মধ্যে মধ্যে গারদে গিয়া দেখিবে, এ কি করে।”
হুকুম মত দশ মিনিট অন্তর এক-একজন গিয়া তাহাকে দেখিতে লাগিল;কিন্তু দেখিল,সে যথার্থই নিশ্চিন্তমনে নিদ্রা যাইতেছে।
কিয়ৎক্ষণ পরে ইনস্পেক্টর সাহেব আসিলেন। দারোগার নিকটে সকল শুনিয়া বলিলেন, “যেমন বাক্সটা আছে,তেমনই থাক—এ সব গুরুতর বিষয়। ডিপুটি কমিসনার সাহেবাকে এখনই সংবাদ দিতেছি।” অতি প্রত্যুষেই কমিসনার সাহেব সরকারী ডাক্তারকে সঙ্গে লইয়া থানায় উপস্থিত হইলেন। তিনি সমস্ত শুনিয়া বলিলেন,”লোকটা লাস দেখিয়াছে?”
ইনস্পেক্টর বলিলেন, “না, আপনার অপেক্ষায় কিছুই করি নাই।”
“ভালই করিয়াছেন। এ সব গুরুতর বিষয়ে বিশেষ সাবধনতা আবশ্যক। দেখি,বাক্সটা।”
দুইজন বাক্সটা টানিয়া আনিয়া সাহেবের সম্মুখে রাখিল। তিনি বলিলেন, “এখান হইতে কথা কহিলে আসামী গারদে কিছু শুনিতে পাইবে বলিয়া, বোধ হয়?”
“না, কিছুই শুনিতে পাইবে না।”
ভাল, তাহার কালা হইবার বিষয় আমি বিশ্বাস করি না।” বলিয়া তিনি টিনের বাক্সটি বিশেষরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিতে লাগিলেন।
বাক্সটি বিশেষরূপে পরীক্ষা করিয়া সাহেব বলিলেন, “এ বাক্সটা কেবল সুন্দর তাহা নহে—ইহা মূল্যবান, অনেক টাকা দাম, বিলাতী। পরে দেখা যাইবে, কাহারা এরূপ বাক্স বিক্রয় করে।” তৎপরে ডাক্তারের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “এবার মৃতদেহটা আপনি দেখুন—এখন বিশেষ কিছু দেখিবার আবশ্যক নাই—ব্যবচ্ছেদের সময় ভাল করিয়া দেখিবেন। আমি ইহা যেমন আছে, বাক্সশুদ্ধ পাঠাইয়া দিতেছি।”
ডাক্তার মৃতদেহ দেখিয়া বলিলেন, “বেশ বুঝিতে পারা যাইতেছে, কেহ ইহাকে হঠাৎ ছোরা মারিয়াছিল; এত জোরে মারিয়াছিল যে, প্রায় বাঁট পর্যন্ত বসিয়া গিয়াছে। এ কি! ছোরা একখানা তাস ভেদ করিয়া গিয়েছে যে! তাসখানা ইহার বুকে এখনও সংলগ্ন রহিয়াছে, সেইজন্য বেশি রক্ত পড়ে নাই।”
সাহেব বলিলেন, “কি তাস?”
সাহেব বলিলেন, “ইস্কাবনের টেক্কা।”
৩
এই অত্যাশ্চৰ্য্য কথা শুনিয়া সকলে বিস্মিত হইয়া বাক্সের নিকটস্থ ও কৌতূহলাক্রান্ত হইয়া মৃতদেহের দিকে চাহিতে লাগিল।
খুনী খুন করিবার সময় প্রায়ই কোন নিদর্শন রাখিয়া যায় না। ইহা সত্য হইলেও প্রকৃতই মৃতদেহের বুকে একখানি ইস্কাবনের টেক্কা রহিয়াছে। ছোরা সেই তাসখানা ভেদ করিয়া রমণীর বুকে আমূল বিদ্ধ হইয়াছে।
তাসখানি পুরু, চক্চকে—পশ্চাদ্ভাগ ও চতুষ্প্রান্ত সবর্ণরঞ্জিত; দেখিলেই বুঝিতে পারা যায় যে, ইহা দামী তাসের একখানা— সাধারণতঃ বড় লোক ব্যতীত কেহ এরূপ তাস ব্যবহার করে না।
সকলেই বিস্মিত হইয়া ভাবিলেন, “এ তাসের অর্থ কি?”
ডিপুটি-কমিসনার সাহেব তাসখানি দেখিয়া বলিলেন, “যথার্থই একখানা তাস রহিয়াছে বটে। দিন দিন কত দেখিতে হয়—একদিন আগে এ কথা কেহ আমাকে বলিলে, আমি হাসিয়া উড়াইয়া দিতাম। ডাক্তারবাবু, আপনি এ সম্বন্ধে কি মনে করেন?”
ডাক্তার বলিলেন, “ডাক্তারী হিসেবে বলিতে হয় যে, স্ত্রীলোকটি নিদ্ৰীত অবস্থায় খুন হইয়াছে। এ নিশ্চয়ই ঘুমাইয়াছিল, সেই সময়ে খুনী ইহার বুকে তাসখানি রাখিয়া তাহার উপর ছোরা মারিয়াছিল।”
সাহেব বলিলেন, “ইহাও হইতে পারে যে, খুনী প্রথমে ছোরা তাসখানা বিদ্ধ করিয়া লইয়াছিল, রক্ত চারিদিকে ফিনকি দিয়া না পড়ে তাহার জন্যই হয় ত এরূপ করিয়াছিল।”
“হাঁ, ইহাও সম্ভব।”
“সম্ভবের আলাচনা ক্রমে করা যাইবে। এটা সাধারণ খুন নহে,সুতরাং বিশেষ সতর্কতার সহিত ইহার সন্ধান করিতে হইবে; এই তাসকে প্রথমে সূত্র হিসাবে ধরিয়া অনেক সন্ধান পাওয়া যাইতে পারে।”
“হয় ত ভুলপথ ধরাইবার জন্য খুনী ইচ্ছা করিয়া ইহার বুকে তাসখানি রাখিয়াছিল।”
“ইহাও হইতে পারে। যাহা হউক, আমি প্রথমে সেই মুটেটাকে জিজ্ঞাসা করিব; আমার বিশ্বাস, সে মুটেই হইবে। যাও, সেই লোকটাকে এইখানে লইয়া আইস।” তাহার পর তিনি ডাক্তারের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “একটু পরেই মৃতদেহ পরীক্ষার জন্য পাঠাইব।”
ডাক্তার বলিলেন, “পরীক্ষার নতুন কিছু যে প্রকাশ পাইবে বলিয়া বোধ হয় না; এখন আপনার অনুসন্ধানের উপরই সকল নির্ভর করিতেছে।”
কিয়ৎক্ষণ পরে সেই লাস-বাহককে সাহেবের সম্মুখে উপস্থিত করা হইল। সে গাঢ় নিদ্রায় নিমগ্ন হইয়াছিল যে, তাহাকে জাগ্রত করা সহজ হয় নাই। সে চক্ষু মুছিতে মুছিতে আসিয়া সাহেবের সম্মুখে দাঁড়াইল। সাহেব প্রথমে তাহার আপদমস্তক তীক্ষ্ণদৃষ্টিপাতে বিশেষরূপে লক্ষ্য করিতে লাগিলেন। কিন্তু সে অবিচলিত ভাবে দাঁড়াইয়া রহিল—কেবল মুখে ঈষৎ বিরক্ততা প্রকাশ করিল।
তাহাকে বিশেষরূপে লক্ষ্য করিয়া সাহেব বলিলেন, “এ লোকটা খুন করে নাই—ইহার হাত মুটের মত, মাথায় যে সৰ্ব্বদা মোট বহে, তাহাও স্পষ্ট দেখা যাইতেছে। সে যে এরূপ সুন্দরী স্ত্রীলোককে খুন করিবে, তাহা সম্ভবপর নহে। বিশেষতঃ এই তাস—ইহার মাথায় এ সকল ফন্দী আসিতে পারে না। তবে এটা স্থির, যে খুন করিয়াছে, তাহাকে এ জানে, নিশ্চয়ই তাহাকে ধরাইয়া দিবে।”
তিনি আবার কিয়ৎক্ষণ তাহার দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন, “এই বাক্সের ভিতর কি আছে, তুমি জান?”
তিনি ভাবিয়াছিলেন, হঠাৎ তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলে সেও একটা কিছু বলিয়া ফেলিবে; কিন্তু সে কোন কথা কহিল না, তাঁহার মুখের দিকে কেবল চাহিয়া রহিল।
সাহেব বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “তোমার মলব চুপ করিয়া থাকা। হাঁ, মলব বড় মন্দ নহে—তবে তোমাকে এ চালাকী ছাড়িতে হইবে। দিন কত জেলে থাকিলে তোমার দিব্য জ্ঞানলাভ হইবে। সত্যকথা খুলিয়া বলাই তোমার পক্ষে এখন সৎপরামর্শ। আমার বিশ্বাস, তুমি নির্দোষী—কেবল ঘটনাচক্রে এই বিপদে পড়িয়াছ। কে তোমাকে এই বাক্সটা লইয়া যাইতে দিয়াছিল, বলিলেই আমি তোমাকে এখনই ছাড়িয়া দিব।”
লোকটা কোন উত্তর দিল না। বিষণ্ণভাবে নিজের মুখে ও কান হাত দিল। সাহেব বলিলেন, “তুমি বলিতে চাও,তুমি হাবা আর কালা। আচ্ছা দেখা যাক।”
তখন তিনি হাত মুখ নাড়িয়া বাক্স দেখাইয়া নানারূপ সঙ্কেতে তাহাকে বুঝাইতে চেষ্টা পাইলেন; কিন্তু তাহাতেও সে কোন ভাব প্রকাশ করিল না।
সাহেব বলিলেন, “তুমি যতদুর হাবা ও কালা, তাহা বুঝিয়াছি।” এই বলিয়া তিনি নিন্মলিখিত দুইটা লাইন অপরের দ্বারা বাঙ্গালায় লিখাইয়া তাহার সম্মুখে ধরিলেন;-
“তুমি কথা না কহিলে নিজেকে দোষী স্বীকার করিতেছ—ইহাতে তোমার ফাঁসী অবধারিত হইবে।”
মুটে কাগজের দিকে চাহিল,তৎপরে আবার বিষণ্নভাবে ঘাড় নাড়িল। সাহেব হতাশ হইলেন। একব্যক্তিকে ডাকিয়া কানে কানে কি বলিলেন। তৎপরে মুটের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “না, এ লোকটা নির্দোষী — ইহাকে ছাড়িয়া দাও।”
দুইজন কনেস্টবল ইহার দুই পার্শ্বে দাঁড়াইয়াছিল, তাহারা ইঙ্গিত পাইবামাত্র সরিয়া দাঁড়াইল। কিন্তু মুটে তথাপি নড়িল না।
সাহেব বলিলেন, “তোমায় ছাড়িয়া দিলাম, তুমি এখন যাইতে পার।”
তবুও সে নড়িল না।
তখন সাহেব দূরস্থ এক ব্যক্তিকে কি ইঙ্গিত করিলেন। সে তৎক্ষণাৎ মুটের পশ্চাতে গিয়া পিস্তলে একটা ফাঁকা আওয়াজ করিল।
এরূপ নিকটে সহসা বন্দুকের শব্দ হইলে এমন লোক কেহ নাই যে, চমকাইয়া না উঠে; কিন্তু সে লোকটা ইহাতেও চমকিত হইল না, কেবল বারুদের ধুম নাসিকায় প্রবেশ করায়, কোথা হইতে ধূম আসিল দেখিবার জন্য সে একবার মুখ সেইদিকে ফিরাইল।
সাহেব বলিলেন, “এ যথার্থই হাবা ও কালা। দেখিতেছি, লোকটা অনেক ভোগাইবে।” তৎপরে তিনি হুকুম দিলেন, “ইহাকে সাবধানে গারদে রাখ। মৃতদেহটা পরীক্ষার জন্য পাঠাইয়া দাও। এ লোকটাকে ডিটেকটিভদের হাতে দিতে হইবে। তবে একবার আমি গোবিন্দরামের সহিত পরামর্শ করিব। যদি কেহ এ রহস্যভেদ করিতে পারেন ত তিনিই পারিবেন। তাঁহার উপর আমার খুব বিশ্বাস আছে।”
৪
গোবিন্দরামের এখন বয়স হইয়াছে। তিনি এখন বৃদ্ধ। ডিটেকটিভ কার্য্যে বেশ দুই পয়সা উপার্জন করিয়া এখন মানিকতলার নিকটে একটি সুন্দর বাগান-বাটিতে নির্জনে বাস করেন। আর ডিটেকটিভদের কাজ করেন না; লোকজনের সঙ্গে মিশামিশি—দেখা-সাক্ষাৎ পর্যন্ত ছাড়িয়া দিয়াছেন।
তাঁহার স্ত্রী বহুকাল স্বর্গারোহণ করিয়াছেন। তাঁহার কেবলমাত্র এক পুত্র ছিল; এইটাই তাহার সংসারের একমাত্র বন্ধন। পুত্র উকিল হইয়াছেন, দেখিতে সুপুরুষ, অল্প বয়স—আটাশ বৎসরের বেশি হইবে না; এখনও বিবাহ করেন নাই বটে, কিন্তু বিবাহ স্থির হইয়া গিয়াছে—দুই মাস পরে শুভদিনে শুভলগ্নে তাঁহার বিবাহ হইবে। গোবিন্দরামের পুত্রের নাম সুরেন্দ্রনাথ।
তাঁহার ওকালতীর সুবিধা হইবে বলিয়া গোবিন্দরাম পুত্রকে নিজের কাছে রাখেন নাই। এখনও পুত্রের সমস্ত ব্যয়ভার তিনি নিজে বহন করিতেছেন। সুরেন্দ্রনাথ বহুবাজারে একটি ক্ষুদ্র বাটি সুসজ্জিত করিয়া তথায় বাস করিতেছেন। দিন দিন তাঁহার পসারও বৃদ্ধি পাইতেছে।
প্রত্যহই তিনি অন্ততঃ একবার পিতার সহিত দেখা করিতেন। রবিবার রাত্রে পিতার সহিত একত্রে আহার করিতেন।
যেদিন রাত্রে বাক্সের মধ্যে মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল, সেইদিন সুরেন্দ্রনাথ পিতার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছিলেন।
আজ তাহাকে বিমর্ষ ও মুখ বিশুষ্ক দেখিয়া গোবিন্দরাম জিজ্ঞাসা করিলেন, “সুরেন, আজ তোমার মুখ এমন শুক্ন কেন?”
এ প্রশ্নে সুরেন্দ্রনাথ যেন একটু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইলেন। বলিলেন, “কই না, কিছু হয় নাই—তবে একটু সদি লাগিয়াছে।”
“তাহা হইলে আজ এখানেই থাক—ডাক্তার বাবুকে ডাকাইয়া পাঠাই। একটা ফ্ল্যানেলের জামা গায়ে দাও।”
“না বাবা, আমায় সামান্য সর্দি লাগিয়াছে মাত্ৰ।“
এই সময়ে ভৃত্য আসিয়া গোবিন্দরামের হাতে এক টুকরা কাগজ দিল। তিনি সেটা দেখিয়া দাঁড়াইয়া উঠিলেন। উঠিয়া পুত্রকে বলিলেন, “একটি ভদ্রলোক দেখা করিতে আসিয়াছেন; তুমি এইখানে খবরের কাগজ পড়, আমি এখনই আসিতেছি।”
এই বলিয়া গোবিন্দরাম অন্য গৃহে প্রস্থান করিলেন।
পুলিশ-সাহেব স্বয়ং তাঁহার নিকট আসিয়াছেন, বহুদিন পুলিশের সহিত তাঁহার কোন সম্বন্ধ ছিল না; সাহেবকে সমাদরে বসাইয়া গোবিন্দরাম বলিলেন, “কিজন্য এ অনুগ্রহ করিয়াছেন। কিছু কি নতুন ব্যাপার ঘটিয়াছে?”
সাহেব বলিলেন, “হাঁ, একেবারেই নতুন। তাহাই আপনার সঙ্গে পরামর্শ করিতে আসিলাম।”
“আপনারা আমাকে যথেষ্ট অনুগ্রহ করেন?”
সাহেব খুন সম্বন্ধে সমস্ত কথা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে গোবিন্দরামকে বলিলেন; কিছুই গোপন করিলেন না। গোবিন্দরাম শুনিয়া বলিলেন, “আর কিছু নাই?”
“না, লোকটা এখন হাজতে আছে; কোন কথাই কহে না। মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করিয়াও কিছু জানিতে পারা যায় নাই; কেবল এইমাত্র—আহারের পর দুই ঘন্টার মধ্যে তাহার মৃত্যু হইয়াছে।”
“বিশেষ রহস্যপূর্ণ ব্যাপার সন্দেহ নাই।”
“আপনিই কেবল এ রহস্যভেদ করিতে পারিবেন।”
“কিরূপে বলিব—যেরূপ শুনিলাম, তাহাতে একটি মাত্র সূত্র কেবল দেখিতেছি।”
“এই ইস্কাবনের টেক্কা?”
“হাঁ, ইহা কতকটা হইলেও হইতে পারে, আবার না হইলেও হইতে পারে। হয় ত খুনী ইহার দ্বারা কেবল আপনাদের চোখে ধাঁধা দিতে চায়; যখন স্ত্রীলোকটি কে জানিতে পারা যাইবে, তখন এ তাসখানা কাজে আসিতে পারে।”
“হাঁ, স্ত্রীলোকটি যে কে, এইটি জানাই প্রথম প্রয়োজন। এখনও কিছুই জানিতে পারা যায় নাই; তবে ফটোগ্রাফ তোলা হইয়াছে—থানায় থানায় দরজায় ঐ ফটোগ্রাফ টাঙাইয়া দেওয়া হইবে। তাহা হইলে কেহ-না-কেহ ইহাকে চিনিতে পারিবে।”
“আমি হইলে ঠিক এরূপ করিতাম না।”
“কেন?”
‘এত তাড়াতাড়ি ফটো বাহির করিতাম না; আবশ্যক হইলে পরে করিতাম।”
“তাহা হইলে আপনি কিরূপে অনুসন্ধান আরম্ভ করিতেন?”
“আমার বিশ্বাস, লোকটা যথার্থই হাবা ও কালা; সে কেবল বাক্সটা বহিয়া লইয়া যাইতেছিল। খুব সম্ভব, এ জানে না, বাক্সে কি ছিল।”
“আমারও কতকটা ঐ রকম মত; তবে এ যে খুনের বিষয় একেবারেই জানিত না, তাহা আমি বিশ্বাস করি না।”
‘সে খুনীর লোক হইতে পারে—তবে খুন সম্বন্ধে কিছু না জানিতেও পারে; দেখা যাক্ আলোচনা করিয়া। রাত্রি একটার সময়ে একজন লোক দ্রুতপদে হাতীবাগানের রাস্তা দিয়া যায়; তাহার একটু পরেই এই লোকটা বাক্স মাথায় করিয়া সেইখানে আসে;পাহারাওয়ালারা তাহাকে ধরে, অপর ব্যক্তি সত্বরপদে চলিয়া যায়; ইহাতে বেশ বুঝিতে।
পারা যায়, নিকটে তাহার জন্য একখানা গাড়ী অপেক্ষা করিতেছিল। সে সেই গাড়ীতে চড়িয়া চলিয়া যায়। পাহারাওয়ালাদের উচিত ছিল, সেই লোকটাকে আগে ধরা।”
“হাঁ, তাহা ঠিক—তবে এখন গতানুশোচনা বৃথা।”
“না, পাহারাওয়ালাদের অপরাধ নাই, তাহারা কেমন করিয়া জানিবে যে, বাক্সের ভিতর এমন একটা মৃতদেহ আছে। এই ভাল যে, তাহারা এ লোকটাকে চলিয়া যেতে দেয় নাই—তাহা হইলে দুজনেই লাসটা লইয়া সরিয়া পড়িত।”
“এই তাসের অর্থ কি?”
“আপনাদের চক্ষে ধূলি দিবার চেষ্টা।”
“নিশ্চয়ই খুনটা নিকটস্থ কোন বাড়ীতে হইয়াছে; গাড়ীখানা বাড়ীর দরজায় না আনিয়া, একটা মুটের মাথায় মৃতদেহ চাপাইয়া লইয়া যাওয়া কি খুনী নিরাপদ মনে করিয়াছিল?”
“নিশ্চয়ই, মুটেটা কালো ও হাবা। সে ধরা পড়িলে, সে কিছুই বলিতে পারিবে না; প্রকৃতপক্ষে তাহাই হইয়াছে।”
“হাঁ, ঠিক তাই ঘটিয়াছে।”
“খুনটা যে কারণে হউক, আমরা তাহার উদ্দেশ্যের বিষয় এখন কিছুই জানি না। আমার অনুমান, খুনী রাত্রে এই স্ত্রীলোকের বাড়ীতে আসে, হাবাকে দরজায় রাখিয়া যায়—স্ত্রীলোকটি ঘুমাইতেছিল, তাহাকে খুন করিয়া তাহারই বাক্সের মধ্যে তাহাকে বন্ধ করে। তাহার পর বাক্সটা আনিয়া দরজায় হাবাকে দেয়। হাবা বাক্সটা লইয়া চলিতে থাকে—আগে আগে খুনী যায়। নিকটেই গাড়ী ছিল, হাবা ধরা না পড়িলে সেই বাক্সটা গাড়ীতে তুলিত; তাহার পর সহরের বাহিরে কোনখানে গিয়া লাসটা ফেলিয়া আসিত।”
“কতক এই রকমই বোধ হইতেছে। কিন্তু এখন কোন সূত্র ধরিয়া কাজ করিলে খুনী ধরা পড়িবে, তাহাই কথা হইতেছে।”
“সূত্র ত আপনাদের হাতেই আছে।”
“কিসে—কি সূত্র আমরা পাইয়াছি?”
“কেন হাবা।”
“সে কথা কহিতে পারে না, তাহার নিকট কিছুই জানিবার সম্ভবনা নাই।”
“আছে, এই হাবা আকাশ হইতে একেবারে কলিকাতায় পড়ে নাই—সে কোন স্থানে নিশ্চয়ই বাস করিত। সে কোথায় থাকিত, সন্ধান পাইলেই জানা যাইবে, সে কে—কাহার নিকট থাকিত, সুতরাং এই হাবা যে কে, ইহাই প্রথমে জানা আবশ্যক।”
“ইহা সহজ নয়।”
“কঠিনও নয়—এই হাবার নিকট কি পাওয়া গিয়াছে?”
“ইহার ট্যাকে তিনটা সিকী, একটা দুয়ানী আর একখানা বড় কয়লা পাওয়া গিয়াছে।”
গোবিন্দরাম ধীরে ধীরে বলিলেন, “কয়লা! হাঁ, কয়লাটা পরে আমাদের অনেক কাজে লাগিবে। এখন আমার পরামর্শ যে, যত শীঘ্র পারেন, ইহাকে ছাড়িয়া দিন।”