প্রতিশোধ
ব্রিটিশ-শাসিত ভারতের একটি করদ-রাজ্যে একদা সংঘটিত এক ঘটনার ভয়াবহ বিবরণী শুনলে মনে হয় অরণ্যের অধিষ্ঠাত্রী প্রকৃতি দেবী কখনো কখনো তাঁর বন্য সন্তানের ওপর মানুষের অত্যাচার দেখে বিচলিত হয়ে পড়েন এবং তখনই তার প্রতিশোধপরায়ণ ন্যায়দণ্ড নেমে আসে হতভাগ্য অপরাধীর মাথার উপর অদৃশ্য অমোঘ বজ্রের মতো!
ঘটনাটি নীচে দেওয়া হল…
বহু বৎসর আগে ব্রিটিশ-শাসিত ভারতের একটি অরণ্যসংকুল করদ রাজ্যে পদার্পণ করেছিলেন জনৈক ইউরোপের অধিবাসী; ভদ্রলোকের নাম ফ্র্যাঙ্ক বাক। নিছক দেশভ্রমণের আনন্দ উপভোগ করার জন্য ফ্রাঙ্ক বাক সাহেব ভারতে আসেননি, তিনি এসেছিলেন অর্থ উপার্জনের আশায়। ফ্র্যাঙ্ক বাকের পেশা ছিল অতিশয় অভিনব, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন জীবন্ত বন্য পশু ধরে দেশবিদেশের সার্কাস ও চিড়িয়াখানার কর্তৃপক্ষের কাছে জন্তুগুলোকে সরবরাহ করতেন তিনি, বিনিময়ে গ্রহণ করতেন প্রচুর অর্থ।
ভারতবর্ষে তিনি এসেছিলেন কয়েকটা বাঘের জন্য। ইউরোপের একটি বিখ্যাত চিড়িয়াখানার কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিষ্ঠানে কয়েকটি ভারতীয় ব্যাঘ্র সংগ্রহ করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন এবং ওইসব জীবন্ত ও বিপজ্জনক পণ্যের জন্য উক্ত প্রতিষ্ঠান যে পরিমাণ অর্থ দিতে সম্মত ছিলেন সেই টাকার অঙ্কটা মোটেই তুচ্ছ মনে করতে পারেননি ফ্র্যাঙ্ক বাক সাহেব।
অতএব সাত সাগর তেরো নদী পেরিয়ে ভদ্রলোক পদার্পণ করলেন ভারতের মাটিতে।
যে করদ রাজ্যে ফ্র্যাঙ্কবাক উপস্থিত হয়েছিলেন, সেই রাজ্যে সরকারি চাকরি করতেন তারই এক বন্ধু। উক্ত বন্ধুবর ছিলেন ইউরোপের মানুষ। তার সঠিক নাম ফ্র্যাঙ্ক বাক আমাদের বলেননি, অতএব আমরা তাঁকে মি. এক্স নামেই অভিহিত করব। করদ রাজ্যটির নাম জানাতেও বাক সাহেব রাজি নন, তাই পূর্বোক্ত রাজ্যটির নামও আমরা দিতে পারলাম না।
যাই হোক, নামধাম জানতে না-পারলেও কাহিনির রসগ্রহণ করতে বোধ হয় আমাদের বিশেষ অসুবিধা হবে না ।
যথাস্থানে পৌঁছে ফ্র্যাঙ্ক বাক খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলেন ওই রাজ্যের বনে-জঙ্গলে বাঘের অভাব নেই। ফ্র্যাঙ্কের বন্ধু পূর্বোক্ত মি. এক্স জানালেন সেইদিনই একটা মস্ত বাঘ মহারাজের ফঁদে ধরা পড়েছে। বাঘটি এখন রাজার সম্পত্তি। তবে বাক সাহেব যদি জন্তুটাকে দেখতে চান তাহলে মি. এক্স তাকে অকুস্থলে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন। বলাই বাহুল্য ফ্র্যাঙ্ক বাক জন্তুটাকে দেখতে চাইলেন এবং বন্ধুবর মি. এক্সের সঙ্গে যাত্রা করলেন নির্দিষ্ট স্থানের উদ্যেশে। একটু পরেই ধৃত পশুটিকে দেখতে পেলেন বাক সাহেব। এমন প্রকাণ্ড বাঘ ইতিপূর্বে কখনো তার চোখে পড়েনি। কিন্তু সেইসঙ্গে এমন আর একটি দৃশ্য তার দৃষ্টিগোচর হল, যা দেখার জন্য তিনি আদৌ প্রস্তুত ছিলেন না।
একটা সংকীর্ণ খাঁচার মধ্যে আবদ্ধ হয়েছে পূর্বোক্ত ব্যাঘ্র এবং খাঁচার গরাদের ফাঁকে লোহার সাঁড়াশি দিয়ে জনৈক ব্যক্তি চেপে ধরেছে বাঘের থাবা; আর একজন লোক অতিশয় মনোযোগ সহকারে থাবার নখগুলোকে উৎপাটিত করছে লৌহনির্মিত একটি যন্ত্রের সাহায্যে। অতি সংকীর্ণ খাঁচার মধ্যে বাঘের নড়াচড়া করারও উপায় নেই, তাই ক্রোধে ও যাতনায় বার বার গর্জন করে বাঘ এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে কিন্তুআত্মরক্ষার কোনো চেষ্টাই করতে পারছে না।
ফ্র্যাঙ্ক বাক তাঁর বন্ধুর কাছে জানতে চাইলেন, এমন নিষ্ঠুরভাবে জন্তুটাকে কষ্ট দেওয়া হচ্ছে কেন? উত্তরে বন্ধুবর জানালেন, বাঘের থাবাগুলো থেকে এক-এক করে সবকয়টি নখই তুলে ফেলা হবে, কারণ এই কাজ করার আদেশ দিয়েছেন করদ-রাজ্যের অধীশ্বর স্বয়ং!
অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে ফ্র্যাঙ্ক বাক স্থানত্যাগ করলেন।
পরের দিন সকালে বাক সাহেবের আস্তানায় উপস্থিত হলেন মি. এক্স। বন্ধুর মুখে ফ্র্যাঙ্ক জানলেন বাঘটির সঙ্গে ছয়টি কুকুরের লড়াই হবে–রাজামশাই জানিয়েছেন মি. ফ্র্যাঙ্ক বাক যদি বাঘ আর কুকুরের লড়াই দেখতে চান, তবে যেন মি. এক্স-র সঙ্গে সেইদিনই সন্ধ্যার পর যথাস্থানে গমন করেন। অত্যন্ত ঘৃণার সঙ্গে বাক সাহেব জানালেন বাঘের থাবা থেকে নখ তুলে ফেলা হয়েছে মাত্র বারো ঘণ্টা আগে, তার পায়ের ক্ষত থেকে এখনও নিশ্চয় রক্ত ঝরে পড়ছে। এই অবস্থায় ছয়টি হিংস্র কুকুরের বিরুদ্ধে বাঘকে যদি লড়াই করতে বাধ্য করা হয়, তবে সেটা লড়াই হবে না, হবে হত্যাকাণ্ড! এমন নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড দেখার প্রবৃত্তি যে তার নেই, সেই কথাই জানিয়ে দিলেন ফ্র্যাঙ্ক বাক।
মি. এক্স জানালেন, বাঘের থাবা থেকে নখগুলোকে উৎপাটিত করেই রাজামশাই ক্ষান্ত হননি, তার নির্দেশে বাঘের মুখটাকেও চামড়া দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়েছে–সুতরাং বাঘ শুধু তার নখ থেকেই বঞ্চিত হয়নি, তার মুখের ধারালো দাঁতগুলিও এখন সম্পূর্ণ অকেজো। মি. এক্স আরও জানালেন, যে কুকুরগুলোকে বাঘের উপর লেলিয়ে দেওয়া হবে, সেগুলোর জন্ম হয়েছে অতি-বৃহৎ হাউন্ড-জাতীয় কুকুর ও বন্য নেকড়ের সংমিশ্রণে! ওই বর্ণসংকর নেকড়ে-কুকুরের আকৃতি-প্রকৃতি নেকড়ের চাইতেও ভয়ংকর। অতি ভয়াবহ ছয়-ছয়টি এমন রক্তলোলুপ জানোয়ারের আক্রমণে নখদন্তহীন অসহায় ব্যাঘ্রের শোচনীয় মৃত্যু দেখে আনন্দ পাবেন রাজামশাই আর সেই রাজকীয় পুলকের অংশগ্রহণ করার জন্যই ফ্র্যাঙ্ক বাক সাহেবকে সাদরে আহ্বান জানাচ্ছেন করদ-রাজ্যের অধীশ্বর; মহারাজের তরফ থেকেই উক্ত নিমন্ত্রণবার্তা বহন করে এনেছেন মি. এক্স।
অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ফ্র্যাঙ্ক বাক জানালেন এমন পৈশাচিক নিষ্ঠুর দৃশ্য দেখতে তিনি ইচ্ছুক নন, আর মি. এক্স-এর মধ্যে যদি কিছুমাত্র মনুষ্যত্ব বোধ থাকে তবে তিনিও নিশ্চয়ই অকুস্থলে অনুপস্থিত থাকবেন।
মুখ নীচু করে অস্পষ্ট স্বরে মি. এক্স জানালেন ওইরকম অনুষ্ঠানে যোগ দেবার আগ্রহ তার নেই, কিন্তু যথাস্থানে না-গেলে তার চাকরি থাকবে না বলেই নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে তাকে রাজ-আদেশ পালন করতে হবে।
ক্রুদ্ধ ফ্র্যাঙ্ক বাক অতঃপর যে মন্তব্য করেছিলেন সেটা বন্ধুবরের পক্ষে আদৌ সম্মানজনক নয়। মি. এক্স চুপ করে বন্ধুর কটু উক্তি শুনলেন, তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন একটি কথাও না-বলে…
সেদিনটা খুব ঘোরাঘুরি করার ফলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন ফ্র্যাঙ্ক বাক, তাই সন্ধ্যার একটু পরেই আহারাদির পালা শেষ করে নিদ্রাদেবীর আরাধনায় মনোনিবেশ করলেন। ঘুমটা বেশ জমে এসেছিল, অকস্মাৎ তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করল বহু মানুষের কণ্ঠনিঃসৃত কোলাহল-ধ্বনি। কান পেতে শব্দটা শুনতে শুনতে সাহেব অনুভব করলেন, প্রাসাদের দিক থেকে, অর্থাৎ যেখানে বাঘ আর কুকুরের লড়াই হওয়ার কথা সেই দিক থেকেই ভেসে আসছে জনতার কোলাহল।
একটু পরেই একটা যান্ত্রিক শব্দ শোনা গেল, মনে হল বন্দুকের শব্দ। তারপরেই আবার বহু মানুষের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর।
ফ্র্যাঙ্ক বাক শব্দতত্ত্ব নিয়ে বেশিক্ষণ মাথা ঘামালেন না, শ্রান্ত শরীরকে আবার সমর্পণ করলেন নিদ্রার ক্রোড়ে।
পরের দিন প্রভাতেই আবার বাক সাহেবের আস্তানায় আবির্ভূত হলেন মি. এক্স। বন্ধুকে সম্বোধন করে তিনি বললেন, ওহে ফ্র্যাঙ্ক! কাল রাতে কী হয়েছিল জান?
নীরস স্বরে ফ্র্যাঙ্ক বাক বললেন, জানাজানির কী আছে? বাঘের মৃত্যু ছিল অবশ্যম্ভাবী। তাই হয়েছে নিশ্চয়ই?
হ্যাঁ বাঘটা মারা পড়েছে বটে; তবে ওইসঙ্গে মারা গেছে একটি কুকুর, আর
আর?
আর মহারাজের শিশুপুত্র!
বল কী? আশ্চর্য হয়ে গেলেন ফ্র্যাঙ্ক বাক, এমন অদ্ভুত ঘটনা ঘটল কী করে?
অতঃপর মি. এক্স-এর মুখ থেকে যে আশ্চর্য ঘটনার বিবরণ শুনেছিলেন ফ্র্যাঙ্ক বাক তা হচ্ছে। এই :
একটা বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণের মাঝখানে ধৃত বাঘটিকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রাঙ্গণের চারপাশ ঘিরে দণ্ডায়মান সুউচ্চ প্রাচীরের ওপর থেকে প্রাচীরবেষ্টিত আঙিনার দৃশ্য দেখার ব্যবস্থা ছিল। বাঘ আর কুকুরের লড়াই দেখার জন্য পূর্বোক্ত স্থানে আসন গ্রহণ করেছিলেন রাজামশাই। মজা দেখার জন্য রাজ্যের বহু মানুষও সেখানে সমবেত হয়েছিল। নিরাপদে বসে পশুদের হানাহানি দেখার জন্যই রাজামশাই প্রাচীরবেষ্টিত ওই গোলাকৃতি প্রাঙ্গণটি তৈরি করেছিলেন। একটু পরেই প্রাচীরের গাত্র-সংলগ্ন দ্বারপথে ছয়টা নেকড়ে-কুকুর ঢুকিয়ে দিয়ে দরজাটা আবার বন্ধ করে দেওয়া হল। কুকুরগুলো প্রথমে বাঘের কাছে আসতে চায়নি, দূরে দাঁড়িয়ে তারা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে ডোরাদার জন্তুটিকে নিরীক্ষণ করতে লাগল। কিন্তু বাঘকে নিশ্চেষ্ট ও নীরব দেখে তাদের সাহস হল, এগিয়ে এসে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বোধ হয় তারা বাঘের অসহায় অবস্থা বুঝতে পারল–সঙ্গেসঙ্গে শুরু হল আক্রমণ। থাবা থেকে তখনও রক্ত ঝরছে, মুখও রয়েছে বাঁধা তবু বাঘের শরীরের মর্মস্থানে কুকুরের দংশন মারাত্মক হয়ে চেপে বসতে পারল না–অদ্ভুত কৌশলে মাটির ওপর গড়াগড়ি দিয়ে বাঘ আত্মরক্ষা করতে লাগল। মাঝে মাঝে দু-একটা কুকুর কামড় বসাতে পারছিল বটে, কিন্তু সেই কামড় মারাত্মক দংশনে পরিণত হওয়ার আগেই বাঘ তার বিশাল গুরুভার দেহ দিয়ে এত জোরে প্রাচীরের দেয়ালের সঙ্গে আততায়ীদের চেপে ধরছিল যে; চাপের যাতনায় আর্তনাদ করে কুকুরগুলো কামড় ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছিল। এইভাবে প্রায় আধঘণ্টা লড়াই চলার পরেও দেখা গেল বাঘের দেহ প্রায় অক্ষত, কুকুরের দাঁত বাঘের শরীরে কোথাও রক্ত ঝরাতে পারেনি। হঠাৎ একটা কুকুর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঘের গলায় দাঁত বসিয়ে দিল। কিছুতেই নিজেকে মুক্ত করতে না-পেরে বাঘ এইবার তার থাবা ব্যবহার করল এক থাপ্পড়ে সে কুকুরটাকে তার গলার ওপর থেকে সরিয়ে দিল। বাঘের থাবা থেকে তখনও রক্ত ঝরছিল, চড় মারার সময়ে তার চোখে-মুখে যে যন্ত্রণার চিহ্ন ফুটে উঠেছিল সেটাও দর্শকদের চোখ এড়িয়ে যায়নি। আচমকা মার খেয়ে কুকুরটা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। দারুণ আক্রোশে সে আবার লাফ দিল বাঘের কণ্ঠদেশ লক্ষ করে। কুকুরের দুর্ভাগ্য তার কামড় বাঘের গলার উপর পড়ল না, দাঁত বসল মুখ-বাঁধা চামড়ার ফঁসের উপর। অন্ধ আক্রোশে কুকুরটা সেই চামড়ার বাঁধনটাকেই কামড়ে ধরল প্রাণপণে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ধারালো দাঁতের পেষণে কেটে গেল চামড়া কিন্তু বাঘের মুখ তখনও সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হল না। এমন শক্ত করে চোয়ালের দু-পাশ দিয়ে মোটা চামড়ার বন্ধনী দেওয়া হয়েছিল যে, এক পাশের চামড়া কুকুরের কামড়ে ছিঁড়ে গেলেও অন্যদিকের চামড়ার বাঁধন বাঘকে পুরোপুরি হাঁ করতে দিল না শুধু মুখের একদিক ফাঁক হয়ে বেরিয়ে এল একটিমাত্র দাঁত। তৎক্ষণাৎ সেই একটিমাত্র দাঁতের সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করল বাঘ, থাবা দিয়ে কুকুরটাকে চেপে ধরে বেরিয়ে-আসা দাঁতটাকে সে সজোরে বসিয়ে দিল শত্রুর দেহে। আমরা যেভাবে শুকনো খাদ্যের টিন ছুরি দিয়ে কেটে ফেলি, ঠিক সেইভাবেই কুকুরের শরীরটাকে লম্বালম্বিভাবে চিরে ফেলল বাঘ একটিমাত্র দাঁতের আঘাতে।
কুকুরটা তখনই মারা পড়ল। অন্যান্য কুকুরগুলো ভয়ে বাঘের সান্নিধ্য ত্যাগ করে সরে গেল। বাঘ তাদের দিকে ফিরেও তাকাল না, লাফ মেরে সে পাঁচিলের উপর ওঠার চেষ্টা করতে লাগল।
বাঘের লাফালাফিতে প্রথমে বিশেষ চিন্তিত হননি রাজামশাই, কারণ ইতিপূর্বেও অনেকগুলো বাঘ ওই প্রাঙ্গণের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছে এবং প্রাচীরের উচ্চতা যে বাঘের নাগালের বাইরে, সেই সত্যও প্রমাণিত হয়ে গেছে অনেকবার।
কিন্তু বাঘের একটা থাবা যখন পাঁচিলের মাথায় পড়ে ফসকে গেল, তখন রাজামশাই ভীত হয়ে পড়লেন। তিনি বুঝলেন এই সৃষ্টিছাড়া জন্তুটার সঙ্গে অন্যান্য বাঘের তুলনা চলে না–থাবায় নখ ছিল না বলেই সে উপরে উঠতে পারেনি, নখ থাকলে সেইবারই সে পাঁচিলের মাথায় নখ বসিয়ে উঠে পড়ত। বাঘের থাবা যে বার বার ফসকে যাবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই, অতএব রাজামশাই একজন ভৃত্যকে বন্দুক আনতে বললেন।
বাঘ বন্দুকের জন্য অপেক্ষা করল না, প্রচণ্ড এক লম্ফপ্রদান করে সে উঠে পড়ল পাঁচিলের উপর। সমবেত জনতার কণ্ঠে জাগল ভয়ার্ত চিৎকার।
বাঘ কোনোদিকে নজর দিল না, সোজা ছুটল সামনের দিকে। প্রাসাদের গায়েই রাজামশাইয়ের যে-বাগানটা ছিল সেই বাগানের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল বিদ্যুদবেগে
তখন ঘোর গ্রীষ্মকাল, প্রাসাদের ভিতর রাজার একমাত্র শিশুপুত্র গরমে ছটফট করছিল, তাই তাকে নিয়ে বেরিয়েছিল রাজবাড়ির দাসী উদ্যানের মুক্ত বায়ু সেবন করতে। একটা ছোটো ঠেলাগাড়ির ওপর শিশু রাজকুমারকে বসিয়ে দাসী বাগানের পথে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, আচম্বিতে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো সেখানে হল রুদ্রমূর্তি ব্যাঘ্রের আবির্ভাব।
রাজপুত্রকে ফেলে দাসী দিল চো চো চম্পট, বাঘ তাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করল না, ধেয়ে এল ঠেলাগাড়িতে উপবিষ্ট রাজপুত্রের দিকে।
ইতিমধ্যে এসে পড়েছে বন্দুক। অগ্নি-উদ্গার করে গর্জে উঠেছে মানুষের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র, মৃত্যুশয্যায় লুটিয়ে পড়েছে বাঘ। কিন্তু মরার আগে সিংহাসনের একমাত্র উত্তরাধিকারীকে সে পাঠিয়ে দিয়েছে শমন-ভবনে।
একমাত্র পুত্রকে হারিয়ে শোকে দুঃখে পাগলের মতো হয়ে গেছেন করদ-রাজ্যের অধীশ্বর।