প্যারামন

প্যারামন

অধ্যাপক গ্রাউস চতুর্মাত্রিক জগতের দ্বিঘাত সমীকরণটির সমাধান বের করতে করতে হঠাৎ করে থেমে গেলেন, তিনি মাথা ঘুরিয়ে তার ছাত্রছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, তোমরা বলতে পারবে মানুষ পৃথিবীর অন্য জীবিত প্রাণী থেকে কোন দিক দিয়ে ভিন্ন?

চতুর্মাত্রিক জগতের দ্বিঘাত সমীকরণের সাথে এই প্রশ্নটির কোনো সম্পর্ক নেই কিন্তু তার ছাত্রছাত্রীরা সেটা নিয়ে মোটেও অবাক হল না। আপনভুলো এই বৃদ্ধ অধ্যাপক ক্লাসে পড়াতে পড়াতে মাঝে মাঝেই এরকম আনমনা হয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছুতে চলে যান। সেই ভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে করতে প্রায় সময়েই ক্লাসের সময় পার হয়ে যায়- আপনভুলোলা অধ্যাপকের সেটাও মনে থাকে না।

অধ্যাপক গ্রাউসের প্রশ্ন শুনে ছাত্রছাত্রীরা তাদের চেয়ারে নড়েচড়ে বসল। সামনের দিকে বসে থাকা চটুল ধরনের ছাত্রীটি বলল, চেহারা। অবশ্যই চেহারা। অন্য সব প্রাণীদের থেকে মানুষ দেখতে ভালো।

অধ্যাপক গ্রাউস হাসিমুখে বললেন, চেহারাটা আপেক্ষিক। আমাদের সবার চেহারা যদি বানরের মতো হত তা হলে সেটাকেই আমাদের ভালো মনে হত।

দার্শনিক ধরনের একজন বলল, একজন মানুষ যদি ভালো হয় তা হলে তার চেহারা খারাপ হলেও তাকে দেখতে ভালো লাগে।

অনেকেই তার কথায় সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়তে থাকে এবং আলোচনাটা মানুষের ভালোমন্দের দিকে ঘুরে যাবার উপক্রম হয়। প্রফেসর গ্রাউস আবার সবাইকে থামালেন, বললেন, আমি জানতে চাইছি-মানুষ কেমন করে অন্য প্রাণীদের থেকে ভিন্ন।

পিছনের দিকে বসে থাকা একজন বলল, ভাষা! মানুষের ভাষা আছে অন্য কোনো প্রাণীর ভাষা নেই।

প্রফেসর গ্রাউস মাথা নাড়লেন, বললেন, হ্যাঁ। তুমি এটা ঠিকই বলেছ। অন্যান্য প্রাণীদের কারো কারো খুব সহজ কিছু তথ্য আদান প্রদানের ব্যবস্থা আছে-কিন্তু মানুষের মতো কারো নেই। মানুষের ভাষা অত্যন্ত উঁচু মানের।

মাঝামাঝি বসে থাকা একজন ছাত্রী বলল, পশুপ্রাণীর ভাষা খুব সহজ তথ্য বিনিময়ের জন্যে ব্যবহার হয়-নিরাপত্তার জন্যে বংশবিস্তারের জন্যে।

এবারে অনেকেই পশুপাখির তথ্য বিনিময় নিয়ে কথা বলতে শুরু করে এবং আলোচনাটা আবার অন্য দিকে ঘুরে যাবার উপক্রম হয়। প্রফেসর গ্রাউস সবাইকে থামালেন, বললেন, আমি পশুপাখির ভাষা নিয়ে আলোচনায় যেতে চাই না আমি জানতে চাই মানুষ কোন দিক দিয়ে পশুপাখি থেকে ভিন্ন। অন্য জীবিত প্রাণী থেকে ভিন্ন।

কঠোর চেহারার একজন বলল, অন্য সকল জীবিত প্রাণী থেকে মানুষ অনেক বেশি নিষ্ঠুর। অন্য জীবিত প্রাণী কোনো প্রয়োজন না হলে একে অন্যকে হত্যা করে না, মানুষ প্রয়োজন ছাড়াও হত্যা করে। নিষ্ঠুরতা দেখায়। পশুতে পশুতে কখনো যুদ্ধ হয় না-মানুষে মানুষে যুদ্ধ হয়।

প্রফেসর গ্রাউস কঠোর চেহারার এই তরুণের কঠিন কথাগুলো শুনে কিছুক্ষণের জন্যে আনমনা হয়ে গেলেন। একটা নিঃশ্বাস ফেললেন এবং বললেন, তোমার কথার মাঝে খানিকটা সত্যতা আছে কিন্তু আমার মনে হয় তুমি মানুষকে একটু বেশি কঠোরভাবে বিচার করছ। মূল মানবগোষ্ঠী নিষ্ঠুর নয়–তার একটা বিচ্ছিন্ন অংশ নিষ্ঠুর। আমার ধারণা সেই মানুষগুলোকে বিশ্লেষণ করলে তার কারণটি বের হয়ে যাবে।

কঠোর চেহারার তরুণটি প্রতিবাদ করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার পাশে বসে থাকা কালো চুলের মেয়েটি তাকে বাধা দিয়ে বলল, প্রাণীদের সবাই বেঁচে থাকে তাদের সহজাত প্রবৃত্তি দিয়ে। মানুষ সহজাত প্রবৃত্তির ওপর নির্ভর করে না-মানুষ বেঁচে থাকার জন্যে তাদের শিখে থাকা জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে।

প্রফেসর গ্রাউস সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন, বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় মানুষের ভেতরে তার সহজাত প্রবৃত্তি কতটুকু রয়ে গেছে সেটা পরীক্ষা করে দেখতে পারলে মন্দ হত না!

কালো চুলের মেয়েটি বলল, সেটি কেমন করে দেখা যাবে?

প্রফেসর গ্রাউস বললেন, সেটি দেখার সহজ কোনো উপায় নেই। আমরা মানুষের যে সমাজে বাস করি সেই সমাজ কখনোই একজনকে শুধু সহজাত প্রবৃত্তির ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকার মতো কাজে ঠেলে দেবে না।

প্রফেসর গ্রাউস অন্যমনস্কভাবে টেবিলে তার আঙুল দিয়ে শব্দ করছিলেন, তখন অস্থির ধরনের ছটফটে একজন তরুণী বলল, প্রফেসর গ্রাউস। আপনি কীভাবে একজন মানুষকে অন্য জীবিত প্রাণী থেকে আলাদা করেন?

আমি?

ছটফটে তরুণীটি মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। আপনি।

প্রফেসর গ্রাউস হাসার ভঙ্গি করে বললেন, আমি চতুর্মাত্রিক জগতের গণিত পড়াই, এই বিষয়গুলো সম্পর্কে খুব ভালো জানি না। তোমাদের থেকে এই বিষয়গুলো সম্পর্কে বেশি জানি বলে মনে হয় না। তবে আমার ধারণা–

ধারণাটা কী না বলে প্রফেসর গ্রাউস চুপ করে অনেকটা আপনমনে চিন্তা করতে থাকেন। ছাত্রছাত্রীরা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে এবং প্রফেসর গ্রাউস একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমার ধারণা মানুষ একমাত্র প্রাণী যে তার জ্ঞানটুকু মস্তিষ্কের বাইরেও রাখতে পারে।

প্রফেসর গ্রাউস ঠিক কী বলছেন বুঝতে না পেরে বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীই একটু ভুরু কুঁচকে তাকাল। প্রফেসর গ্রাউস বললেন, অন্য সব প্রাণীর বুদ্ধিমত্তাই থাকে তাদের মস্তিষ্কে। আমাদের বেলায় সেটা সত্যি নয়। আমরা যখন কিছু একটা জানি সেটা বইপত্রে লিখে রাখতে পারি। যার মস্তিষ্কে সেই জ্ঞানটুকু নেই সে বই থেকে সেটা শিখে নিতে পারে। কাজেই বলা যেতে পারে মানুষের কার্যকর মস্তিষ্ক শুধু তার মাথার করোটির মাঝে নেই সেটা বইপত্র লাইব্রেরি জার্নালে ছড়িয়ে আছে। একটি বানর এক গাছের ডাল থেকে অন্য গাছের। ডালে লাফ দেবার সময় তার নিজের মস্তিষ্কের ভেতরের তথ্য কিংবা জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে। মানুষকে একটা ডাল থেকে অন্য ডালে লাফ দিতে হলে সে সেটা নিয়ে পড়াশোনা করতে পারে। নিউটনের সূত্র পড়ে সে ইচ্ছে করলে নিজের নিরাপত্তার জন্যে লাফ নাও দিতে পারে।

ধারালো চেহারার লাল চুলের একটা মেয়ে হাত তুলে জিজ্ঞেস করল, অধ্যাপক গ্রাউস-এই ব্যাপারটা আপাতদৃষ্টিতে অনেক ভালো মনে হয়। আপনি কি মনে করেন এর মাঝে কোনো বিপদ লুকিয়ে থাকতে পারে?

অধ্যাপক গ্রাউস মাথা নেড়ে বললেন, আমি খুবই খুশি হয়েছি যে তুমি এই প্রশ্নটা করেছ। আমি তোমাকে এই প্রশ্নটা করি, দেখি তুমি কী উত্তর দাও।

মেয়েটি ভুরু কুঁচকে কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, আমি তো কোনো বিপদ লুকিয়ে থাকতে দেখছি না। আমাদের আগের প্রজন্ম আমাদের বয়সে যেটুকু জানত আমরা সেই একই বয়সে তাদের থেকে অনেক বেশি জানি। আমাদের আগের প্রজন্মের যেটুকু বিশ্লেষণী ক্ষমতা ছিল আমাদের বিশ্লেষণী ক্ষমতা তার থেকে অনেক বেশি। সারা পৃথিবী জোড়া নেটওয়ার্কে যে তথ্য আছে আমরা চোখের পলকে সেটা পেতে পারি, বিশ্লেষণ করতে পরি, আমাদের কাজে ব্যবহার করতে পারি। প্রফেসর গ্রাউস আমি এর মাঝে কোনো বিপদ দেখতে পাই না।

প্রফেসর গ্রাউস একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমি পাই।

ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই এবারে সোজা হয়ে বসল, বসে তারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে প্রফেসর গ্রাউসের দিকে তাকাল তার কথা শোনার জন্যে। প্রফেসর গ্রাউস নিচু গলায় বললেন, আমরা যদি ধরে নিই আমাদের মস্তিষ্ক দুই ভাগে বিভক্ত এক ভাগ আমাদের মাথার ভেতরে দ্বিতীয় ভাগ হচ্ছে পৃথিবীর লাইব্রেরি, জার্নাল কিংবা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নেটওয়ার্ক, তা হলে আমরা দেখব যতই দিন যাচ্ছে আমরা মস্তিষ্কের দ্বিতীয় ভাগ অর্থাৎ বাইরের অংশটুকুতে লাইব্রেরি, জার্নাল কিংবা নেটওয়ার্কে অনেক বেশি নির্ভর করতে শুরু করেছি। বাইরের জগৎ থেকে তথ্য নেয়া কিংবা সেই তথ্য বিশ্লেষণ করা যতই সহজ হয়ে যাচ্ছে দশ বিলিয়ন নিউরনের আমাদের এই মস্তিষ্কটাকে ততই আমরা কম করে ব্যবহার করছি।

প্রফেসর গ্রাউস একটু থামতেই ধারালো চেহারার মেয়েটি বলল, কিন্তু আমরা যদি এই . পদ্ধতিতেই আগের চাইতে বেশি সৃষ্টিশীল হতে পারি তা হলে কি সমস্যা আছে?

প্রফেসর গ্রাউস মাথা নাড়লেন, বললেন, না নেই। কিন্তু

প্রফেসর গ্রাউস আবার থেমে গেলেন এবং তার ছাত্রছাত্রীরা ধৈর্য ধরে তার কথা শোনার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। প্রফেসর গ্রাউস বললেন, এখন পর্যন্ত বুদ্ধিমত্তাটুকু আমাদের মস্তিকে, বাইরের জগতে আছে তথ্য। বাইরের জগতে যেটুকু বুদ্ধিমত্তা আছে সেটা তুচ্ছ। কিন্তু এই তুচ্ছ বুদ্ধিমত্তা যদি কোনোভাবে বিকশিত হয়ে উঠে আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে আমরা খুবই অসহায় হয়ে পড়ব।

ধারালো চেহারার লাল চুলের মেয়েটি তার জ্বলজ্বলে চোখে বলল, সেটা কি কখনো হতে পারে?

প্রফেসর গ্রাউস মাথা নাড়লেন, বললেন, আমি জানি না।

***

নিউলাইট কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর উপস্থিত সব ডিরেক্টরদের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি আজ আপনাদের একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেবার জন্যে ডেকেছি।

ডিরেক্টরদের সবাই বয়স্ক, ম্যানেজিং ডিরেক্টরের কথায় নড়েচড়ে এক কোনায় বসে থাকা লাল চুলের মেয়েটির দিকে তাকাল। মেয়েদের বয়স সব সময় অনুমান করা যায় না, এই মেয়েটিরও বয়স অনুমান করা সম্ভব নয়–ত্রিশ থেকে পঞ্চাশের ভেতর যে কোনো একটা বয়স হতে পারে। এই মেয়েটি ডিরেক্টরদের কেউ নয়, কোম্পানির একজন সাধারণ গবেষক, ম্যানেজিং ডিরেক্টর যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি দেবে তার সাথে এই মেয়েটির নিশ্চয়ই একটা ভূমিকা আছে।

ম্যানেজিং ডিরেক্টর হাত তুলে মেয়েটিকে দেখিয়ে বলল, গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি দেবার আগে আমি আপনাদের সাথে আমাদের গবেষক লানার পরিচয় করিয়ে দিই।

লানা তার জায়গায় বসে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে হাত নাড়ল। ম্যানেজিং ডিরেক্টর বলল, আজ থেকে সাত বছর আগে লানা আমার কাছে গবেষণার একটি বিষয় নিয়ে এসেছিল। আমার কাছে কখনো কোনো গবেষক সরাসরি আসে না। কিন্তু লানা এসেছিল তার কারণ তার ডিপার্টমেন্ট তার গবেষণার প্রস্তাবটি সরাসরি নাকচ করে দিয়েছিল।

ম্যানেজিং ডিরেক্টর একটু হেসে বলল, আমারও সেই প্রস্তাবটি সরাসরি নাকচ করে দেয়া উচিত ছিল, কারণ প্রস্তাবটি ছিল অত্যন্ত উদ্ভট, আজগুবি এবং বিপজ্জনক। ঠিক কী কারণে জানি না আমি সেই উদ্ভট আজগুবি আর বিপজ্জনক প্রস্তাবটি অনুমোদন করে দিয়েছিলাম। লানা অত্যন্ত মেধাবী এবং পরিশ্রমী গবেষক, গবেষণা কাজের নেতৃত্ব দিতেও তার কোনো তুলনা নেই। চার বছরের মাথায় সে প্রথম প্রটোপাইপ তৈরি করেছে। ছয় বছরে ফিল্ড টেস্ট শেষ করেছে এবং এই সপ্তম বছরে তার একটা বাণিজ্যিক মডেল তৈরি হয়েছে। আমরা বাণিজ্যিক মডেলটি বাজারে ছাড়ার জন্যে প্রস্তুত এবং আজকে আপনাদের সবাইকে ডেকেছি তার ঘোষণাটি দেয়ার জন্যে। 

সবচেয়ে বয়স্ক ডিরেক্টর খনখনে গলায় বলল, তুমি তো দেখি এক ধরনের হেঁয়ালি ভরা কথা বলছ। কী মডেল কীসের মডেল কিছুই তো বুঝতে পারলাম না।

ম্যানেজিং ডিরেক্টর হাসি হাসি মুখে বলল, সেটা আপনাদের জানানোর জন্যে আজকে এখানে লানা এসেছে। ম্যানেজিং ডিরেক্টর লানার দিকে তাকিয়ে বলল, লানা। তুমি বল।

লানা উঠে দাঁড়িয়ে হলোগ্রাফিক প্রজেক্টরটা চালু করে বলল, আমি তখন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। আমাদের গণিতের একজন প্রফেসর ছিলেন, তার নাম প্রফেসর গ্রাউস। একদিন ক্লাসে আমাদের জিজ্ঞেস করলেন মানুষের মাঝে অন্য প্রাণীর পার্থক্য কোথায় আমরা সেটা জানি কি না। আমরা সবাই আমাদের মতো করে উত্তর দেবার চেষ্টা করেছিলাম-প্রফেসর গ্রাউস সেগুলো পুরোপুরি মানতে রাজি নন। তিনি বলেছিলেন মানুষের সাথে অন্য প্রাণীর পার্থক্য তার মস্তিষ্কের ব্যাপ্তিতে। অন্য সব প্রাণীর মস্তিষ্ক তার করোটিতে। মানুষের মস্তিষ্কের একটা অংশ তার করোটিতে বাকিটুকু বাইরের জগতে, নেটওয়ার্কে।

উপস্থিত ডিরেক্টরদের সবাই নিজেদের ভেতরে মৃদুস্বরে কথা বলতে শুরু করে। লানা বলল, আপনারা কেউ কি অস্বীকার করতে পারবেন, বাইরের নেটওয়ার্কের তথ্য ছাড়া আমরা কেউ এক মুহূর্ত বেঁচে থাকতে পারি না। এখন কয়টা বাজে? আজ কোথায় যেতে হবে? কীভাবে যেতে হবে? কী খাব? কী করব? কার সাথে কথা বলব? শরীর কি ভালো আছে? তালো না থাকলে কেন ভালো নেই? কোথায় জানাব? কীভাবে চিকিৎসা করাব? এরকম সব প্রশ্নের উত্তরের জন্যে আমাদের নেটওয়ার্কের ওপর নির্ভর করতে হয়। লানা এক নিঃশ্বাসে অনেকগুলো কথা বলে একটু থেমে যোগ করল, আজকে যদি আপনাদের বলা হয় নেটওয়ার্কের সাহায্য না নিয়ে আপনাদের একটা দিন কাটাতে হবে–সারা পৃথিবীর একজন মানুষও সেটি পারবে না।

ডিরেক্টরদের বেশিরভাগই নিজের অজান্তেই মাথা নাড়ে। লানা তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা ক্রমাগত তথ্যটুকু নেই নেটওয়ার্ক থেকে, সেগুলো বিশ্লেষণ করাই নেটওয়ার্ককে দিয়ে, সেগুলো ব্যবহার করি নেটওয়ার্ককে দিয়ে কিন্তু সেটা করতে হয় কোনো এক ধরনের ইন্টারফেসিং মডিউল দিয়ে। সেটা চোখ দিয়ে দেখতে হয় কান দিয়ে শুনতে হয়, হাত দিয়ে স্পর্শ করতে হয়। আমি তখন নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম যদি আমাদের জীবন পৃথিবীর নেটওয়ার্কের সাথে এত ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত হয়ে থাকে যে এটা আসলে মস্তিষ্কের একটা অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয় তা হলে কেন আমরা সত্যি সত্যি নেটওয়ার্ককে মস্তিষ্কের অংশ তৈরি করে ফেলি না?

বয়স্ক ডিরেক্টর খনখনে গলায় জিজ্ঞেস করল, তুমি কী বলতে চাইছ? কীভাবে নেটওয়ার্ককে মস্তিষ্কের অংশ করে ফেলবে?

লানা ভিডিও প্রজেক্টরে স্পর্শ করতেই পেছনের ত্রিমাত্রিক একটা যন্ত্রের ছবি ভেসে উঠল এবং সেটা ধীরে ধীরে ঘুরতে থাকে। লানা হাত দিয়ে সেটাকে স্পর্শ করে বলল, এই যন্ত্রটা দিয়ে। আপনাদের এটা বড় করে দেখানো হয়েছে। আসলে এটা খুবই ঘোট, মাথার চামড়ার নিচে ঠিক করোটির উপর বায়ো গ্লু দিয়ে আটকে দেয়া যায়। পুরো অপারেশন শেষ করতে সময় নেয় দশ মিনিট, মাথার চামড়ার ক্ষত সারতে সময় নেয় চব্বিশ ঘণ্টা। যন্ত্রটি চালু হয় এক সপ্তাহ পরে খুব ধীরে ধীরে। কয়েক সপ্তাহ পর যখন এটা পুরোপুরি চালু হয়ে যায় তখন মানুষের মস্তিষ্ক সরাসরি নেটওয়ার্কের সাথে যোগাযোগ করতে পারে।

বৃদ্ধ ডিরেক্টর আবার তার খনখনে গলায় বলল, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না তুমি কী বলছ!

লানা বলল, আমি একটা উদাহরণ দিই। মনে করুন আপনার মাথায় আমরা এই যন্ত্রটা লাগিয়েছি। কাজেই আপনি এখন সরাসরি নেটওয়ার্কের সাথে যোগাযোগ করতে পারবেন- আপনার মস্তিষ্ক যেটা করবে আপনি সেটা জানতেও পারবেন না। ধরা যাক আপনি আপনার স্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করবেন কিন্তু তার ভিডি ফোনের নম্বর মনে করতে পারছেন না। আগে আপনাকে ইন্টারফেস খুলে নেটওয়ার্ক থেকে নম্বরটি নিতে হত। এখন আপনি বুঝতেও পারবেন না কিন্তু আপনার মস্তিষ্ক নেটওয়ার্ক থেকে নম্বরটি নিয়ে আসবে আপনি দেখবেন হঠাৎ করে নম্বরটি আপনি জেনে গেছেন!

তুলনামূলকভাবে কম বয়সী একজন ডিরেক্টর অবিশ্বাসের গলায় বলল, আমি এটা বিশ্বাস করি না।

লানা বলল, বিশ্বাস করার কথা নয়। কিন্তু এটা সত্যি। আমরা ফিল্ড টেস্ট করেছি। কয়েক হাজার মানুষের ওপরে পরীক্ষা করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পরীক্ষা করতে দিয়েছে?

না, প্রথমে দেয় নাই।

তা হলে?

আমরা দরিদ্র দেশে গিয়ে সেই দেশের মানুষকে দিয়ে পরীক্ষা করেছি। পরীক্ষার ফলাফল দেখার পর আমাদের শেষ পর্যন্ত এই দেশে পরীক্ষার অনুমতি দিয়েছে। আমরা তখন আমাদের দেশেও তার ফিল্ড টেস্ট করেছি।

কী দেখেছ?

সেটা আমি নিজে না বলে সরাসরি দেখাতে চাই। মাথায় এই যন্ত্রটি বসানো হয়েছে এরকম একজন মেয়েকে আমি আপনাদের সামনে আনব। আপনারা তার সাথে কথা বলুন।

লানা ইঙ্গিত করতেই দরজা খুলে সোনালি চুলের একটা মোল-সতের বছরের মেয়ে ঘরে এসে ঢুকল, লানা হাত নেড়ে ডাকল, ত্রিনা, এদিকে এস।

ত্রিনা নামের মেয়েটা লানার কাছে এগিয়ে আসে। লানা মেয়েটার পিঠে হাত রেখে বলল, এ হচ্ছে ত্রিনা। ঠিক ছয় সপ্তাহ আগে তার মাথায় এই যন্ত্রটা বসানো হয়েছে। আমরা তাকে অভ্যস্ত হওয়ার জন্যে দুই সপ্তাহ সময় দিয়েছি। এখন তার মস্তিষ্ক সব সময়েই নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত। আপনারা তাকে যেভাবে খুশি প্রশ্ন করতে পারেন।

বুড়ো ডিরেক্টর খনখনে গলায় জিজ্ঞেস করল, এই মেয়ে, বল দেখি আমার স্ত্রী কী করে?

মেয়েটি বুড়ো ডিরেক্টরের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার স্ত্রী নেই। দুই বছর আগে মারা গেছেন।

বড় ছেলের নাম কী?

ক্লাড। একজন শিল্পী।

একজন মহিলা ডিরেক্টর জিজ্ঞেস করল, পরের মহাকাশ ফ্লাইট কবে আছে?

মঙ্গলবার। দুপুর তিনটা চৌত্রিশ মিনিট।

এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবর কী?

তাতিস্কার প্রেসিডেন্টকে এই মাত্র গুলি করে মেরে ফেলেছে।

মেরে ফেলেছে নাকি? সত্যি?

হ্যাঁ সত্যি।

মধ্যবয়স্ক একজন বলল, পাইয়ের এক হাজার চারশত পঁচানব্বইতম সংখ্যাটি কী?

চার। তারপর এক নয় সাত তিন পাঁচ।

মানুষটি বিস্ময়ে শিস দেয়ার মতো একটা শব্দ করল, অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কেমন করে এটা করছ?

মেয়েটা হাসার ভঙ্গি করে বলল, আমি কিছুই করছি না। আমি শুধু আপনাদের প্রশ্নটার উত্তর কী হতে পারে সেটা চিন্তা করছি এবং সাথে সাথে উত্তরটা জেনে যাচ্ছি। কীভাবে হচ্ছে সেটা আমি জানি কারণ সেটা আমাকে বলা হয়েছে, কিন্তু ব্যাপারটা যখন ঘটছে আমি বুঝতেও পারছি না। এটা করা হচ্ছে আমার অজান্তে।

অবিশ্বাস্য। অতি উৎসাহী একজন ডিরেক্টর হাততালি দিয়ে বলল, অবিশ্বাস্য!

লানা জিজ্ঞেস করল, আপনারা কি লিনাকে আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে চান?

ডিরেক্টরদের কয়েকজন মাথা নেড়ে বলল, না। আর কিছু জিজ্ঞেস করার নেই।

লানা ত্রিনাকে বিদায় দিয়ে ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে জিজ্ঞেস করল, আপনারা কি আর কিছু জানতে চান?

ম্যানেজিং ডিরেক্টর বলল, না। আপাতত কিছু জানতে চাই না। তুমি বস। সে ডিরেক্টরদের দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা এই মাসের শেষ থেকে এই যন্ত্রটি বাজারজাত করব। আমরা এর নাম দিয়েছি প্যারামন। প্যারামনকে নিয়ে চমৎকার কিছু বিজ্ঞাপন তৈরি করা হয়েছে আমি সেগুলোও আপনাদের দেখাব। আমার ধারণা প্রথম এক বছরে আমরা এক বিলিয়ন প্যারামন বিক্রি করতে পারব।

উপস্থিত ডিরেক্টররা আবার শিস দেয়ার মতো একটা শব্দ করল। ম্যানেজিং ডিরেক্টর বলল, এই হিসেবটি অত্যন্ত সতর্ক হিসেব। প্রকৃত সংখ্যাটি আরো অনেক বেশি হওয়ার কথা। আমার ধারণা আগামী পাঁচ বছরে পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ এটা তাদের মাথায়। লাগিয়ে নেবে। আমরা সারা পৃথিবীতে একটা অসাধারণ বিপ্লব দেখার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছি।

বৃদ্ধ ডিরেক্টর লানার দিকে তাকিয়ে বলল, এই মেয়ে। তুমি এরকম একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার করেছ, তোমার নিশ্চয়ই খুব গর্ব হচ্ছে?

লানা মাথা নেড়ে বলল, না।

বৃদ্ধ ডিরেক্টর অবাক হয়ে বলল, কেন না?

আমি আমার যন্ত্রের এই মডেলটি নিয়ে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। প্রফেসর গ্রাউসের অনেক বয়স হয়েছে একটা ক্লিনিকে আছেন। কাউকে চিনতে পারেন না। আমি আমার যন্ত্রটির কথা তাকে বলেছি। তখন তিনি

লানা থেমে গেল। বৃদ্ধ ডিরেক্টর বলল, তখন তিনি কী?

লানা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, প্রফেসর গ্রাউস খপ করে আমার হাত ধরে বললেন, না-না-না। তুমি এটা কিছুতেই বাজারজাত কোরো না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন? প্রফেসর গ্রাউস বিড়বিড় করে বললেন, তা হলে মানুষ এই যন্ত্রটার ওপর নির্ভরশীল হয়ে যাবে। নিজের মস্তিষ্ক ব্যবহার করবে না। মানুষের সৃজনশীলতা নষ্ট হয়ে যাবে। আমি বললাম, আমরা তো এখনো বাইরের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছি এখন কি আমাদের সৃজনশীলতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে? প্রফেসর গ্রাউস বললেন, এখন বাইরের নেটওয়ার্ক আমাদের সাহায্যকারী। তোমার যন্ত্র ব্যবহার করা হলে মূল মস্তিষ্ক হয়ে যাবে সাহায্যকারী আর নেটওয়ার্কটাই হবে আমাদের মূল মস্তিষ্ক।

লানা একটু থেমে বলল, আমি বাসায় ফিরে এসে বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করেছি। চিন্তা করে দেখেছি প্রফেসর গ্রাউস আসলে ঠিকই বলেছেন। এই প্যারামন আমাদের মস্তিষ্ককে ধীরে ধীরে অকেজো করে দেবে–আমরা নেটওয়ার্কের ওপর এত নির্ভরশীল হয়ে যাব যে নিজের মস্তিষ্ক আর ব্যবহার করব না।

বৃদ্ধ ডিরেক্টর সরু চোখে লানার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কী বলতে চাইছ?

আমি প্যারামন বাজারজাত করতে চাই না।

ম্যানেজিং ডিরেক্টর হা হা করে হেসে বলল, এটা বাজারজাত করা হবে কি হবে না সেটা তোমার সিদ্ধান্ত নয় লানা। সেটা কোম্পানির সিদ্ধান্ত। তুমি কোম্পানির গবেষক হিসেবে তোমার কাজ করেছ। আমরা কোম্পানির ডিরেক্টর হিসেবে আমাদের কাজ করব।

লানা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু আমি তবু আপনাদের কাছে কাতর গলায়। অনুরোধ করতে চাই, প্যারামন বাজারজাত করবেন না। এটা বিজ্ঞানের একটা ছোট আবিষ্কার হিসেবে থাকুক। ল্যাবরেটরিতে এর প্রভাব নিয়ে গবেষণা হোক, কিন্তু পুরো মানবজাতিকে টার্গেট করে প্যারামনকে বাজারজাত করবেন না। দোহাই আপনাদের।

মধ্যবয়স্ক একজন ডিরেক্টর লানার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি একজন বুড়ো প্রফেসরের কথায় পুরো বিষয়টাকে নেতিবাচক হিসেবে দেখতে শুরু করেছ। আমরা এতজন ডিরেক্টর এটাকে মোটেও নেতিবাচক হিসেবে দেখছি না। আমরা মনে করি প্যারামন আমাদের মানসিক জগতে একটা যুগান্তকারী বিপ্লব বয়ে আনবে। আমরা সাধারণ মানুষও অসাধারণ মানুষ হয়ে উঠব।

লানা বলল, মানুষ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে অসাধারণ হয়ে উঠুক। আমি কৃত্রিমভাবে জোর করে তাদের অসাধারণ হতে দিতে চাই না।

বৃদ্ধ ডিরেক্টর খনখনে গলায় বলল, সেই বিষয়টি তোমার আগে চিন্তা করা উচিত ছিল মেয়ে। এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তীর তোমার হাতের ধনুক থেকে ছুটে গেছে, এখন সেই তীরকে তোমার হাতে ফিরিয়ে আনতে পারবে না।

লানা অসহায়ভাবে নিউলাইট কোম্পানির বয়স্ক ডিরেক্টরদের দিকে তাকিয়ে রইল।

***

অ্যালার্মের শব্দ শুনে গভীর রাতে ফায়ার ব্রিগেডের চিফ মিশি ঘুম থেকে উঠে বসে। শহরের কোথাও আগুন লেগেছে। মিশি জানালার কাছে এসে পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকায়, শহরের দক্ষিণ দিকে আগুনের লাল আভা, মাঝে মাঝে আগুনের শিখাঁটিও দেখা যাচ্ছে। বছরের এই সময়টা শুকনো সময়, প্রতি বছরই বেশ কয়েকটা ছোটখাটো এবং অন্তত একটা বড় অগ্নিকাণ্ড হয়। মনে হচ্ছে এটা এ বছরের বড় অগ্নিকাণ্ড-মিশি আগুনের লাল আভাটির দিকে তাকিয়ে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল। দক্ষিণের ইউনিটগুলোকে এখনই চালু করে আগুনের কাছে পাঠাতে হবে।

মিশি ইউনিটগুলোর জরুরি সংকেতটি ব্যবহার করতে গিয়ে হঠাৎ করে আবিষ্কার করে যে জরুরি সংকেতটি মনে করতে পারছে না। কয়েকবার চেষ্টা করেও মনে করতে না পেরে মিশি হঠাৎ করে এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করে। তার কী হয়েছে? কেন সে এই অতি সাধারণ সংকেতটি মনে করতে পারছে না? মিশি তার ডেপুটির যোগাযোগ সংকেতটিও মনে করতে পারল না। কী আশ্চর্য!

মিশির স্ত্রী ঘুম থেকে উঠে ঘুম ঘুম চোখে মিশির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি মাঝরাতে ঘরের মাঝখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন?

দক্ষিণে আগুন লেগেছে। কিন্তু কিন্তু—

কিন্তু কী?

আমি ইউনিটের জরুরি সংকেত মনে করতে পারছি না।

মনে করতে পারছ না? কী বলছ তুমি?

হ্যাঁ। ডেপুটির নাম্বারও মনে করতে পারছি না। নিরাপত্তা বাহিনী কেন্দ্রীয় যোগাযোগ-কিছুই মনে করতে পারছি না।

মিশির স্ত্রী ভীত চোখে বলল, কী বলছ তুমি? কী হয়েছে তোমার?

জানি না। আমি কিছুই মনে করতে পারছি না।

মিশির স্ত্রী স্বামীর হাত ধরে বলল, দাঁড়াও দাঁড়াও–তুমি আগেই এত ঘাবড়ে যেও। আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলি।

এক মুহূর্ত পর মিশির স্ত্রী শূন্য দৃষ্টিতে মিশির দিকে তাকিয়ে বলল, কী আশ্চর্য! আমিও কিছু মনে করতে পারছি না।

সত্যি?

হ্যাঁ সত্যি। মিশির স্ত্রী বলল, শুধু ডাক্তারের নম্বর নয় কারো নম্বর মনে করতে পারছি না।

মিশি কাছাকাছি একটা চেয়ারে ধপ করে বসে বলল, তার মানে বুঝতে পারছ?

কী?

নেটওয়ার্ক ফেল করেছে।

নেটওয়ার্ক ফেল করেছে! মিশির স্ত্রী আতঙ্কিত গলায় চিৎকার করে উঠল, কী বলছ তুমি?

হ্যাঁ। তা না হলে এতক্ষণে ওই আগুন নিভিয়ে দেয়ার কাজ শুরু হয়ে যেত।

কী হবে এখন?

মিশি কিছু বলার আগেই হঠাৎ করে ঘরের আলো নিভে গেল। মিশির স্ত্রী একটা চাপা আর্তনাদ করে মিশিকে আঁকড়ে ধরল। জানালা দিয়ে আগুনের লাল আভা ঘরের দেয়ালে বিচিত্র প্রায় অলৌকিক এক ধরনের আলো ছায়া তৈরি করেছে। সেদিকে তাকিয়ে থেকে মিশি চাপা গলায় বলল, আমাদের পৃথিবী মনে হয় এভাবেই ধ্বংস হয়ে যাবে।

বাইরে তখন অসংখ্য অসহায় মানুষের কোলাহল শোনা যেতে থাকে।

***

রাষ্ট্রপ্রধান শুকনো মুখে বিজ্ঞান আকাদেমির প্রধান প্রফেসর তাকিতাকে জিজ্ঞেস করলেন, এখন কী হবে প্রফেসর তাকিতা?

প্রফেসর তাকিতা মাথা নেড়ে বললেন, আমি জানি না।

রাষ্ট্রপ্রধান ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে বললেন, আপনি আমাদের বিজ্ঞান আকাদেমির প্রধান; আপনি বলতে পারেন না যে আমি জানি না।

পারি মহামান্য রাষ্ট্রপতি। প্রফেসর তাকিতা শুকনো গলায় বললেন, আমি বিজ্ঞান আকাদেমির প্রধান কারণ নেটওয়ার্কের বিজ্ঞান বিষয়ের সকল তথ্যে আমার অধিকার ছিল সবচেয়ে বেশি। এখন নেটওয়ার্ক নেই এখন আমার ভেতরে আর আপনার রান্নাঘরের বাবুর্চির ভেতরে খুব একটা পার্থক্য নেই। প্রফেসর তাকিতা তার হাতের কাগজটা রাষ্ট্রপ্রধানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, এই দেখেন আমি বেশ কিছুক্ষণ থেকে চার অঙ্কের একটা সংখ্যার বর্গমূল বের করার চেষ্টা করছি। পারছি না। আমার মস্তিষ্ক নেটওয়ার্কের সাহায্য নিতে নিতে এত অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল যে এখন আমি এই তুচ্ছ সমস্যাটাও নিজে সমাধান করতে পারছি না।

তার মানে কী?

তার মানে হচ্ছে যদি নেটওয়ার্ক আবার চালু না করা যায় তা হলে মানব সভ্যতার সমাপ্তি এখানেই।

রাষ্ট্রপ্রধান আতঙ্কিত গলায় বললেন, নেটওয়ার্ক আবার চালু করা না যায়-মানে কী? কেন এটা চালু করা যাবে না?

বিজ্ঞান আকাদেমির প্রধান তাকিতা তার চেয়ারটিতে হেলান দিয়ে বসে বললেন, নেটওয়ার্কটি কীভাবে আবার চালু করা যাবে সেই তথ্যটি আমাদের দিতে পারে শুধু এই নেটওয়ার্কটি। বলতে পারেন এটা এক ধরনের হেঁয়ালির মতো-নেটওয়ার্কটি চালু থাকলেই আমরা নেটওয়ার্ক চালু করতে পারব। এখন নেটওয়ার্ক চালু নেই তাই নেটওয়ার্কটি আবার কীভাবে চালু করা যাবে আমরা জানি না।

তার মানে এই নেটওয়ার্ক আর চালু হবে না?

না। এটা চালু করার মতো বুদ্ধিমত্তা আমাদের নেই। আমরা আমাদের মাথায় প্যারামন লাগিয়ে নিজের মস্তিষ্ক ব্যবহার করতে ভুলে গেছি। শুধু তাই নয় আমরা গত কয়েক প্রজন্ম প্যারামন লাগিয়ে পার করেছি– আমাদের মস্তিষ্কে নিউরনের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। সিনান্স সংযোগ বলতে গেলে নেই। আমরা এখন আর সত্যিকার মানুষ নই মহামান্য রাষ্ট্রপ্রধান, আমরা এখন হচ্ছি অবমানব।

অবমানব?

হ্যাঁ।

এখন পৃথিবীতে কী হবে?

নৈরাজ্য এবং বিশৃঙ্খলা। প্রথম কয়েক বছর রাজত্ব করবে অস্ত্রধারীরা। রোগ শোক অনাহারে বেশিরভাগ মানুষ মরে যাবে। মানুষজন তখন ছোট ছোট এলাকায় ভাগ হয়ে যাবে। নূতন নেতৃত্ব সৃষ্টি হবে-যার গায়ে জোর বেশি সে হবে নেতা। তারপর সম্পূর্ণ নূতন একটি সমাজ ব্যবস্থা তৈরি হবে। অবমানবের নূতন এক ধরনের সমাজ। আফ্রিকার জঙ্গলের গরিলাদের সমাজের মতো কিংবা বোনিওর ওরাং ওটানের সমাজের মতো কিংবা–

থামুন! রাষ্ট্রপ্রধান চিৎকার করে বললেন, আপনি থামুন।

প্রফেসর তাকিতা দুর্বলভাবে বললেন, আমি থামছি মহামান্য রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু বাইরের পৃথিবী থেমে নেই। তাকিয়ে দেখুন। তারা কিন্তু এর মাঝে পিছনের দিকে যাত্রা শুরু করে দিয়েছে। 

রাষ্ট্রপ্রধান জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন, দূরে আগুনের লেলিহান শিখা, কালো ধোঁয়া এবং মানুষের চিৎকার। ধীরে ধীরে এদিকে এগিয়ে আসছে।

***

গাছের বাকলের ছোট পোশাক পরা দুজন কিশোর-কিশোরী গাছের আড়ালে লুকিয়ে আছে। তাদের সুস্থ-সবল দেহ থেকে যেন জীবনের আভা ফুটে বের হচ্ছে। কিশোরটির হাতে একটা ধনুক, মেয়েটি ছোট একটা পাতায় কোনো একটা গাছের আঠা ধরে রেখেছে। ছেলেটি তার নিজ হাতে তৈরি তীরে গাছের আঠাটি লাগিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, কী মনে হয়? কাজ করবে?

কিশোরীটি মাথা নেড়ে বলল, আমি অনেক খুঁজে বের করেছি। একশবার কাজ করবে।

কিশোরটি তার ধনুকে তীর লাগিয়ে দূরে ঘাস খেতে থাকা হরিণটির দিকে তাক করল। তীর দিয়ে শরীর অবশ করিয়ে দেয়ার এই নূতন গাছের আঠাটি তারা পরীক্ষা করছে, সত্যি সত্যি এটা কাজ করবে কি না সেটা তারা এখনো জানে না। নূতন কিছু করার মাঝে সব সময়ই থাকে নূতন এক ধরনের উত্তেজনা। দুজনে গভীর আগ্রহ নিয়ে হরিণটির দিকে তাকিয়ে থাকে।

আমাজান অরণ্যের গভীরে পৃথিবীর মানুষের চোখের আড়ালে থেকে যাওয়া এই আদিবাসী মানুষেরা তখনো জানত না, পুরো পৃথিবীতে নূতন করে সভ্যতা গড়ে তোলার দায়িত্বটি তাদেরকেই নিতে হবে।  

মস্তিষ্ক নামে সৃষ্টিজগতের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটির তারা কখনো অবমাননা করে নি।