পুনর্মিলন

পুনর্মিলন

মহাকবি ভাস রচিত ‘মধ্যম’ নাটিকার আখ্যানভাগ কিঞ্চিৎ অদল—বদল করিয়া বলিতেছি।

পঞ্চপাণ্ডব বিন্ধ্যাবটীতে মৃগয়া করিতে গিয়াছেন। মধ্যম পাণ্ডব একটু বেশী চঞ্চল ও দুঃসাহসিক,তাই দল হইতে ছিটকাইয়া পথভ্রষ্ট হইয়া বনমধ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন। সহসা একটি রাক্ষস তাঁহার সম্মুখে আসিয়া বলিল—’যুদ্ধং দেহি।’

রাক্ষসটি তরুণ, আষাঢ়ের সজলজলদ তুল্য তাহার কান্তি, কণ্ঠস্বরে বাল্যের মধুরতা যৌবনের গাম্ভীর্য এখনও দ্বন্দ্ব করিতেছে। তাহাকে দেখিয়া ভীমের মনে যুগপৎ বীর ও বাৎসল্য রসের সঞ্চার হইল। বলিলেন—’অয়ে বালক, তোমার সঙ্গে আমি লড়িব না, বরং তোমার পিতাকে ডাক।’

রাক্ষস ঘাড় নাড়িয়া বলিল—’চাতুরী চলিবে না। হয় যুদ্ধ কর নতুবা পরাজয় স্বীকার করিয়া আমার সঙ্গে চল। আমার জননী ব্রতপালন করিয়া অভুক্ত আছে আজ তাঁহার পারণ্য। একটি হৃষ্টপুষ্ট মানুষ আনিতে বলিয়াছেন। তোমাকে বেশ স্থূলকায় দেখিতেছি, তোমার দ্বারাই তাঁহার ক্ষুন্নিবৃত্তি হইবে।’

ভীমের কৌতূহল হইল। বলিলেন—’বেশ, চল।’

অনেক বনজঙ্গল গিরি নদী অতিক্রম করিয়া রাক্ষস ভীমকে একটি প্রকাণ্ড পর্বতগুহার দ্বারদেশে আনিল। ডাকিল—’মাতঃ, আহার্য উপস্থিত।’

ভিতর হইতে রাক্ষসী বলিল—’চিরজীবী হও বৎস, তোমাকে গর্ভে ধারণ করা সার্থক হইল।’

অতঃপর ভীম রোমাঞ্চিত হইয়া শুনিলেন রাক্ষসী তাহার এক চেটীকে বলিতেছে—’হঞ্জে, মনুষ্যটিকে বড় বড় করিয়া কর্তন কর। উত্তমরূপে সিদ্ধ হইলে কিঞ্চিৎ গন্ধক স্ফোটন দিয়া সন্তলন করিয়া নামাইও। বক্ষস্থল ও বাহুদ্বয় ছেলের জন্য রাখিও, পদদ্বয় তোমার, মুণ্ডটি আমি খাইব।’

রাক্ষস বলিল—’মাতঃ, একবার বাহিরে আসিয়া দেখ কেমন শিকার আনিয়াছি।’

রাক্ষসী বলিল—’ও আর দেখিব কি। সব মানুষই সমান, ভাল করিয়া রাঁধিলে কে ঋষি কে চণ্ডাল টের পাওয়া যায় না। আমার এখন সময় নাই, চুল বাঁধিতেছি।’

রাক্ষস বলিল—’চুল বাঁধা এখন থাকুক, একবার বাহিরে আসিয়া দেখ।’

পুত্রের নির্বন্ধাতিশয়ে রাক্ষসী গুহা হইতে নির্গত হইয়া বাহিরে আসিল। ভীমকে দেখিয়া চমকিত হইয়া জিহ্বা দংশন করিয়া কহিল—’ওমা, আর্যপুত্র যে! ছি ছি লজ্জায় মরি! ওরে উন্মাদ, ওরে ঘটোৎকচ, প্রণাম কর বেটা।’

ভীম বলিলেন—’কে ও, দেবী হিড়িম্বা? প্রিয়ে, আজ ধন্য আমি।’

রাক্ষসী কি খাইল ভাস তাহা লেখেন নাই।

১৩৩৬(১৯২৯)