পুতুলের মা খুকী আজ ভয়ানক ব্যস্ত। আজ কিনা ছোট্ট পুতুলের জন্মদিন, তাই খুব খাওয়ার ধুম লেগেছে। ছোট্ট টেবিলের উপর ছোট্ট ছোট্ট থালা বাটি সাজিয়ে, তার মধ্যে কি চমৎকার ক’রে খাবার তৈরি ক’রে রাখা হয়েছে। আর চারিদিকে সত্যিকারের ছোট্ট ছোট্ট চেয়ার সাজানো রয়েছে, পুতুলেরা বসে খাবে ব’লে।
খুকীর যে ছোটদাদা, তার কিনা সাড়ে চার বছর বয়স, তাই সে বলে, “পুতুলরা খেতেই পারে না, তাদের আবার জন্মদিন কি?” কিন্তু খুকী সে কথা মানবে কেন? সে বলে, “পুতুলরা সব পারে। কে বলল পারে না? কে বলল যে কক্ষনো কোনোদিন তারা কথা বলে না, কক্ষনো কোনোদিন খায় না?”—খোকাপুতুলের যখন অসুখ করেছিল তখন সে কি ‘মা, মা’ বলে কাঁদত না? নিশ্চয়ই কাঁদত। তা না হ’লে খুকী জানল কী ক’রে যে তার অসুখ করেছে? খুকীর দাদা এ সবের জবাব দিতে পারে না, তাই সে, “বোকা মেয়ে, হাঁদা মেয়ে” ব’লে মুখ ভেংচিয়ে চলে যায়।
খুকী গেল তার মা’র কাছে নালিশ করতে। মা সব শুনে-টুনে বললেন, “সব সময়ে সকলের কাছে কি পুতুলরা জ্যান্ত হয়? যেদিন দেখবি পুতুল সত্যি ক’রে খাবার খাচ্ছে, সেদিন ছোড়দাকে ডেকে দেখাস্।” খুকী বললে, “আজকে যদি ওরা জেগে উঠে খাবার খেতে থাকে, তখন কী মজাই হবে! আমার বোধ হয় রাত্তিরে যখন আমরা ঘুমিয়ে থাকি, তখন তাদের দিন হয়! তা না হলে আমরা তো দেখতে পেতাম? সেই যে একদিন টিনের তৈরি দুষ্টু পুতুলটা খাট থেকে পড়ে গিয়েছিল— নিশ্চয় ওরা রাত্রে উঠে মারামারি করেছিল! তা না হলে খাট থেকে পড়ল কেন? আজ থেকে আমি ঘুমোবার সময় খুব ভালো ক’রে কান পেতে থাকব।”
পুতুলের জন্মদিনে কি চমৎকার খাবার! ময়দার মিঠাই, ময়দার পিঠে, ছোট্ট ছোট্ট নারকলের মোয়া, আর ছোট্ট ছোট্ট গুড়ের টিক্লি— এম্নি সব আশ্চর্য আশ্চর্য জিনিস। রাতরে শোবার আগে খুকী তার পুতুলদের ঝেড়ে মুছে নাইয়ে খাইয়ে ঘুম পাড়াল আর বলে দিল, “এই দেখ্, খাবার-টাবার রইল, রাত্রে উঠে খাস্।” কোথায় কে বসবে, কোনটার পর কোনটা খাবে, ঝগড়া করলে কে কী শাস্তি পাবে সব ব’লে, তারপর দুষ্টু পুতুলটাকে খুব ব’কে ধমকে, আর ছোট্ট পুতুলকে জন্মদিনের জন্য খুব খানিকটা আদর-টাদর ক’রে, তারপর খুকী গেল বিছানায় শুতে। যেম্নি শোয়া অম্নি ঘুম।
খুকীও ঘুমিয়েছে, আর অম্নি ঘরের মধ্যে কাদের টিপ্টিপ্ পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। তাদের একজন খুকুমণির জুতোর কাছে, ঘরের কোণে ছবির বইগুলোর কাছে, পুতুলদের চাদর-ঢাকা খাটের কাছে ঘুরে বেড়াচ্ছে; এটা ওটা শুঁকছে, আর কুটুর-কুটুর ক’রে এতে ওতে কামড়িয়ে দেখছে! খানিকটা বর্ণ-পরিচয়ের পাতা খেয়ে দেখল, ভালো লাগে না; জুতোর ফিতেটা চিবিয়ে দেখল, তার মধ্যে কিচ্ছু রস নেই; টিনের পুতুলটাকে কামড়িয়ে দেখল— ওরে বাবা, কী শক্ত! এমন সময় হঠাৎ অন্ধকারে তার চোখ পড়ল— টেবিলে সাজানো ও সব কী রে!
দৌড়ে চেয়ার-টেয়ার উল্টিয়ে এক লাফে টেবিলের উপর চ’ড়ে সে একটুখানি শুঁকেই ব্যস্ত হয়ে বলল, “কিঁচ্ কিঁচ্ কীঁ—চ্ !” তার মানে, “ওগো শিগ্গির এস— দেখে যাও!” অম্নি টিপ্ টিপ্ টুপ্ টুপ্ ট্যাপ্ ট্যাপ্ থপ্ ক’রে সেইরকম আর একটা এসে হাজির। ঠিক সেইরকম লোমে ঢাকা ছেয়ে রং, সেইরকম সরু লম্বা ল্যাজ, আর সেইরকম চোখা চোখা নাক আর মিট্মিটে কালো কালো চোখ। দু’জনের উৎসাহ আর ধরে না! এটা কী সুন্দর! ওটা কেমন চমৎকার!” এম্নি ক’রে, দেখতে দেখতে, যত খাবার সব চেটেপুটে শেষ!
সকালবেলায় খুকী উঠে দেখল— ওমা! কি আশ্চর্য! সব খাবার শেষ হয়ে গেছে! কখন যে পুতুলগুলো জেগে উঠল, কখন যে খেল, আর কখন যে আবার ঘুমোল, কিছুই সে টের পায়নি। “খেয়েছে! খেয়েছে! সব খাবার খেয়েছে” ব’লে সে এমন চেঁচিয়ে উঠল যে মা বাবা ছোড়দা বড়দা সবাই ছুটে এসে হাজির।
ব্যাপার দেখে আর খুকীর কথা শুনে সবাই বলল, “তাই তো! কি আশ্চর্য!” খালি ছোড়দা বলল, “তা বই কি! ও নিজে খেয়ে এখন বলছে— পুতুলে খেয়েছে।” দেখ তো কি অন্যায়!
আসলে ব্যাপারটা যে কী, তা কেবল মা জানেন আর বাবা জানেন, কারণ তাঁরা ঘরের কোণে ইঁদুরের ছোট্ট ছোট্ট পায়ের দাগ দেখেছিলেন। কিন্তু সে কথা খুকীকে যদি বল, সে কক্ষনো তোমার কথা বিশ্বাস করবে না।