১ মে
তন্দ্রাকাকিমা মারা গেলে তাঁর মফস্সলের বাড়িটা উত্তরাধিকারসূত্রে আমিই পেলাম। আমিই ছিলাম তাঁর একমাত্র আত্মীয়। তাঁর মৃত্যুতে তেমন দুঃখ পাইনি, কারণ তাঁকে আমি প্রায় চিনতামই না। আর বাড়িটা পেয়ে যে আমার খুব একটা আনন্দ হয়েছে, তাও নয়। কারণ বাড়িটা প্রাচীন, কুৎসিত, জীর্ণ এবং অস্বস্তিকর। হয়তো সময়কালে বাড়িটার চেহারা ভালোই ছিল। স্বামী নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার পর তন্দ্রাকাকিমা বহু বছর ধরে বাড়িটায় একাই ছিলেন। কোনওরকম সংস্কারের চেষ্টা করেননি বাড়িটাকে। তাঁর সামান্য পাগলামির লক্ষণ ছিল, হয়তো সেই কারণেই বাড়িটা ছেড়ে কখনও কোথাও যাননি। বাড়ি ও তন্দ্রাকাকিমা একই সঙ্গে কালের প্রকোপে জীর্ণ থেকে জীর্ণতর হতে শুরু করলেন। কখনও কখনও তাঁকে দেখা যেত বাইরের উঠোনে ইজিচেয়ারে বসে আছেন, হাসছেন আপনমনে, অথবা শোনা যেত তাঁর একটানা করুণ বিলাপ। সে-বিলাপের সুর অদ্ভুত—তার কোনও তুলনা নেই। তিনি সত্যিই পাগল ছিলেন কিনা কেউ জানত না, জানার চেষ্টাও করত না। তাঁকে দেখেশুনে শান্ত বলেই মনে হত। আর কেউ তাঁকে বিরক্তও করত না। সুতরাং, অবশেষে, তাঁর বার্ধক্যের ভারে নুয়ে পড়া শরীর একদিন নিষ্প্রাণ হল। তিনি মারা গেলেন। আর বাড়িটার মালিক হলাম আমি।
এক মেঘলা বিকেলে বাড়িটায় গেলাম।
বাড়িটা বিক্রি করে দেওয়ার আগে ওটা আমি ঘুরেফিরে দেখব। বলা যায় না, হয়তো এমন কিছু পেয়ে যাব যা আমি ভালোবেসে রাখতে চাই। কিন্তু না, পছন্দ হওয়ার মতো বা কাছে রাখার মতো কিছুই সেখানে পেলাম না। মিনিট দশেকের মধ্যেই আমার অনুসন্ধানের কাজ সেরে বেরিয়ে পড়ছিলাম, কিন্তু বৃষ্টি নামল অঝোরে। গায়ের হালকা সোয়েটারে শীত বাঁধ মানতে চায় না। তাই বৃষ্টি শেষ হওয়ার অপেক্ষায় রইলাম। কিন্তু অঝোর বর্ষণের পাগল করা ছন্দের কোনও পরিবর্তন নেই। সুতরাং সময় কাটাতে বাড়ির নোংরা স্যাঁতসেঁতে ঘরগুলো ঘুরে দেখতে লাগলাম।
একতলায় কৌতূহল জাগিয়ে তোলার মতো কিছুই পেলাম না। দোতলার দিকে উঠতে যাব, নজরে পড়ল সিঁড়ির পাশেই একটা দরজা। অন্যান্য দরজার তুলনায় বেশ মজবুত—তবে প্রাচীনতার সাক্ষর তার প্রতি অঙ্গে। দরজাটা খুলতেই একটা ভ্যাপসা গন্ধ ছিটকে এল নাকে।
ভেতরটা অন্ধকার। তবে স্পষ্ট নজরে পড়ল, কয়েক ধাপ সিঁড়ি দরজার কাছ থেকে নেমে গেছে নীচে। তাহলে কি নীচে কোনও পাতালঘর রয়েছে? যেমনটা থাকত আগেকার দিনের জমিদারবাড়িতে। কিছুটা ভয় ও কিছুটা সেই দুর্গন্ধের কারণে দরজাটা আবার বন্ধ করে দিলাম। নীচের পাতালঘরে আর যাই থাকুক, কোনও দামি জিনিস নেই।
তারপর দোতলায় উঠে এলাম।
দোতলায় একটিমাত্র ঘরেই কিছু ভাঙাচোরা আসবাবপত্র রয়েছে। অন্যগুলো নিছকই ঘরের কঙ্কাল। বুঝলাম, এই ঘরটাতেই তন্দ্রাকাকিমা থাকতেন। চলে আসছিলাম, কিন্তু কী খেয়াল হল ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারগুলো খুলে দেখলাম। তারই একটা ড্রয়ারে বইটা পেলাম।
সময়ের ভারে বইটা স্যাঁতসেঁতে, জীর্ণ। ওটা খুলতেই আশ্চর্য ব্যাপারটা নজরে পড়ল। বাঁধানো হলেও গোটা বইটা হাতে লেখা। অর্থাৎ একটা পাণ্ডুলিপিকে কেউ বইয়ের মতো করে বাঁধিয়ে নিয়েছে। হয়তো তন্দ্রাকাকিমাই। বইয়ের কোনও-কোনও পাতা ছিঁড়ে যাওয়ায় সেলোটেপ দিয়ে জোড়া। পাতা ওলটাতেই অদ্ভুত খসখস শব্দে বইটা যেন আর্তনাদ করে উঠল। কিছু কাগজের গুঁড়ো উড়ে পড়ল মেঝেতে। পাতাগুলোয় অসংখ্য ভাঁজ ও নোংরা থাকা সত্ত্বেও লেখা এখনও পড়া যায়। ছোট-ছোট পরিষ্কার অক্ষরে কোনও পুরুষালি হাতে সযত্নে লেখা। জিনিসটা মনে হল, ডায়েরি অথবা দিনলিপি গোছের। প্রথম দু-একটা লাইন পড়লাম।
বইটা আবার ড্রয়ারে রাখতে গিয়ে আরও একটা লাইন চোখে পড়ল। তখন মাঝে-মাঝে পাতা উলটে কিছু কিছু জায়গা পড়ে দেখলাম। তারপর বইটা বন্ধ করে নিয়ে এলাম নীচের ঘরে। বাইরের ঘরে জানলার পাশে একটা সাবেকী আমলের চেয়ার নিয়ে বসলাম। আলো অত্যন্ত ঝাপসা, পৃষ্ঠাগুলোও ভঙ্গুর, কিন্তু তবুও সেই বিস্ময়কর দিনলিপি পড়তে শুরু করলাম। একটুও না থেমে, এতটুকু বিশ্রাম না নিয়ে পড়ে চললাম…চেয়ারে আমি যেন অঙ্গাঙ্গিভাবে বসে আছি। আমার শিরদাঁড়া অচল, অনড়। আর আমার মাংস যেন কোনও ঠান্ডা তরল, শিরদাঁড়াকে ঘিরে চুঁইয়ে চুঁইয়ে বয়ে চলেছে। আলো ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসে, কিন্তু আমার দু-চোখ বইয়ের পাতায় স্থির। আলো জ্বালতে গিয়ে দেখি লোডশেডিং। অগত্যা খুঁজেপেতে একটা আধজ্বলা মোমবাতি নিয়ে এলাম। পকেট থেকে দেশলাই বের করে সেটা জ্বাললাম। বসিয়ে দিলাম জানলার তাকে। আলোর সমস্যা আংশিক দূর হল। জানলার কাচে বৃষ্টির ছাঁটের অবিরাম বিলাপ, আকাশ মেঘে-মেঘে অন্ধকার। বাইরের খোলা উঠোনে এলোমেলো ঝোড়ো বাতাসে ঝরাপাতা উড়ে যায়। এরকম বই পড়ার উপযুক্ত পরিবেশই বটে! বইয়ের শুরু মে মাসের চার তারিখের রোজনামচা দিয়ে…
8 মে
ওঃ ভগবান! কাল কী ভয়ঙ্করই না একটা রাত গেছে।
এতদিনের মধ্যে গতরাতেই সবচেয়ে খারাপ অবস্থা গেছে। অন্যান্য দিনের কথা স্পষ্ট মনে থাকলে ভালো হত। এখন মনে হচ্ছে, এই ডায়েরি আমার আরও আগে থেকে লেখা উচিত ছিল। কিন্তু নিজের স্বরূপ যে-বইয়ের প্রধান বিষয়, সে-বই লিখতে শুরু করাটা এক প্রচণ্ড দুঃসাহসের কাজ। তাই আরও আগে এ সাহস হয়নি। সে যাই হোক, গত রাতের মতো খারাপ অবস্থা যে অন্য কোনও রাতে হয়নি, সে-বিষয়ে আমার সন্দেহ নেই। হয়তো সেই কারণেই মনে হচ্ছে, আজই এ-ডায়েরি শুরু করা দরকার। আমার মনের বিভিন্ন অনুভূতির বহিঃপ্রকাশের জন্যেও এর প্রয়োজন আছে। এখন শুধু ভাবছি, সামনের মাসে পাতালঘরে নেমে যেতে নিজেকে জোর করে রাজি করাতে পারব তো?
কিন্তু রাজি আমাকে হতেই হবে। তাতে কোনও সন্দেহ নেই, এবং অ-রাজি হওয়ার সপক্ষে কোনওরকম যুক্তি-তর্ক খাড়া করতে আমি কখনও চেষ্টাও করব না। কোনওরকম অজুহাত চলবে না। বরং সামনের মাসে আরও আগে আমি পাতালঘরে নেমে যাব। বেশি দেরি করাটা কখনওই ঠিক হবে না। কে জানে কোত্থেকে কী বিপদ ঘটে বসে। হয়তো আমি নিজেকে সামলাতে পারব, কিন্তু তবুও…গত রাতে পাতালঘরে যেতে বোধহয় একটু দেরি করেছি। দেরি করতে চাইনি, কিন্তু কী করে বুঝব? যখন টের পাই যে ওটা হতে চলেছে, তখন আমি ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়ি আর প্রাথমিক লক্ষণগুলো ধরবার চেষ্টা করি। কিন্তু সবসময়ে ঠিক স্পষ্ট করে ধরতে পারি না। অদ্ভুত এক অস্বস্তি-আশঙ্কার মধ্যে পরিবর্তনটা শুরু হয়, এবং যখন আমি বেশি ভয় পেয়ে যাই তখন ভালোমতো বুঝে ওঠার আগেই ওটার সূত্রপাত হয়। আমার ভীষণ ভয় করে। ভবিষ্যতে আমাকে আরও সাবধান হতে হবে।
এখন আমি আমার ঘরে বসে আছি। সমস্ত খুঁটিনাটি মনে করবার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। যদি সঠিক তথ্যই না লিখতে পারি তাহলে এই ডায়েরির প্রয়োজন কী? তখন আমার বা অন্য কারও কাছে এর কোনও দামই থাকবে না। জানি না, অন্য কাউকে কখনও এটা দেখাব কিনা। বর্তমান পরিস্থিতিতে সে-সিদ্ধান্ত নেওয়া রীতিমতো বিপজ্জনক। কারণ, যদি কাউকে এটা দেখাই, তাহলে সেইসঙ্গে আমাকে যথাযথ প্রমাণও হাজির করতে হবে। সেটাই তো আমার সমস্ত আশঙ্কার কারণ। আমি চাই না, কেউ আমাকে পাগল ভাবুক।
গত রাতে খাওয়াদাওয়ার পর আমার স্ত্রী একটু অস্থির হয়ে পড়ে। আমরা বাইরের ঘরে বসে ছিলাম। ও মাঝে-মাঝে টেবিল-ঘড়ির দিকে দেখছিল, আর আড়চোখে আমাকে লক্ষ করছিল। মাথা না ঘুরিয়ে চোখের কোণ দিয়ে ওর এই লক্ষ করাটা আমার মোটেও ভালো লাগেনি। অবশ্য ওকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, আর আমিও সেটা না দেখার ভান করে বসে রইলাম। পাতালঘরে যাওয়ার কথা শুনলেই আমার ভীষণ ভয় করে। সেইজন্যেই যতক্ষণ পারি ওটাকে ভুলে থাকতে চাই। রাত তখনও খুব বেশি হয়নি। কিন্তু বাইরের আকাশ স্পষ্ট নক্ষত্রময়। জানলার পাশেই আমি বসে ছিলাম, যাতে সময় হলেই বুঝতে পারি। খবরের কাগজে মগ্ন থাকার ভান করে বসে থাকলেও আমার মন অত্যন্ত অস্থির। অস্থির মন নিয়ে পড়া যায় না। খবরের কাগজের সমস্ত খবর আমার কাছে এক ঝাপসা আস্তরণ। না, এটা সেই প্রতীক্ষিত লক্ষণ নয়—অন্তত আমার তাই ধারণা। ঘরের সবক’টা আলোই জ্বলছে। সুতরাং সতর্কভাবে তন্দ্রার চোখ এড়িয়ে মাঝে-মাঝে জানলা দিয়ে বাইরে দেখছিলাম। ওর দুশ্চিন্তার বোঝা আমি আর বাড়াতে চাই না। বেচারা তন্দ্রা। কিন্তু ওর চোখে ত্রাসের ইশারা আমার শরীরে এক অদ্ভুত আনন্দ জাগিয়ে তুলল। যেন সুখ-ভালোবাসার চরম তৃপ্তির আনন্দ। ঠিক জানি না। হয়তো আমার অসুখের এটাই প্রাথমিক লক্ষণ, অথবা কোনও পুরুষের সুস্থ- স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। বলতে পারছি না, কারণ আমি অন্যান্য মানুষের মতো নই। কিন্তু তবুও সেই অনুভূতি চিনতে পারামাত্রই নিজের ওপরে আমার ঘৃণা হল। সুতরাং বুঝলাম, পরিবর্তনটা তখনও সত্যি-সত্যি শুরু হয়নি।
তখন সবচেয়ে যেটা খারাপ লাগে, তা হল পরিবেশের তফাত। আরামের প্রলেপ মাখানো বাইরের ঘর, উজ্জ্বল আলো, শৌখিন নরম চেয়ার-এর মাঝে আমি বসে আছি, অথচ একই সঙ্গে জানি, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে এই পরিবেশের কী অমানুষিক পরিবর্তনই না ঘটে যাবে…মনে পড়লে আমার শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে। বেশিরভাগ সময় সাধারণ জীবনযাপন করে এবং কোনও-কোনও সময় সাধারণ জীবনযাপনের ভান করার চেষ্টায় পরিবর্তনটাকে আমার আরও বেশি ঘেন্না করে। নিজের ওপর বিতৃষ্ণা আসে, রাগ হয়—যদিও জানি, এটা একটা রোগ। এতে আমার কোনও দোষ নেই। এর জন্যে কাকে দোষ দেব? হয়তো আমার কোনও পূর্বপুরুষই এই অদ্ভুত রোগের জন্যে দায়ী, জানি না। তবে হলফ করে বলতে পারি, এতে আমার কোনও হাত নেই। তা যদি থাকত, তাহলে আমি কবে আত্মহত্যা করতাম। তাতে কোনও সন্দেহ নেই…।
দেওয়ালে টাঙানো সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো আয়নার দিকে অবিরাম চোরা-চাউনিতে দেখতে লাগলাম—যদি কোনও পরিবর্তনের লক্ষণ নজরে পড়ে। অবশ্য জানি, এত তাড়াতাড়ি কোনও চিহ্ন নজরে পড়বে না। কিন্তু তাড়াতাড়ি নজরে পড়াই ভালো, নইলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। প্রথমদিকটায় আমি নিজেকে সামলে রাখতে পারলেও তন্দ্রা সে ভয়াবহ দৃশ্য সইতে পারবে না। আমি নিজে হলেও হয়তো সইতে পারতাম না। যদি সত্যিই চেয়ে থাকি ওই সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো আয়নার দিকে, এবং নিজেকে দেখি, তাহলে…।
এই কারণেই পাতালঘরে কোনও আয়না নেই।
ন’টার সময় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। বাইরের আকাশ এখন আরও পরিষ্কার, আরও নক্ষত্রময়। জানলায় লেসের কাজ করা পরদা—তন্দ্রার হাতের কাজ। ও চকিতে আমার দিকে তাকাল, পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে নিল। অতি সন্তর্পণে খবরের কাগজটা ভাঁজ করে চেয়ারে রাখলাম। এই মুহূর্তে আমি অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং শাস্ত।
‘সময় হয়ে গেছে—’ আস্তে-আস্তে বললাম।
‘হুঁ—’ ছোট্ট করে উত্তর দিল তন্দ্রা, স্বস্তির ভাবটাকে বেশ কষ্ট করেই ও গোপন রাখল।
আমরা বাইরের ঘর ছেড়ে পাতালঘরের সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। তন্দ্ৰাই প্রথম নেমে গেল নীচে। ভিজে স্যাঁতসেঁতে সিঁড়ির ধাপ সোজা নেমে গেছে। তার ডানদিকে নোনাধরা দেওয়াল, আর বাঁদিকে একটা রেলিং।
আমাদের বাড়িটা পুরোনো। ওপরতলাগুলো জোড়াতালি দিয়ে পরিষ্কার রাখলেও পাতালঘর ও তার সিঁড়ি সেই একই রকম আছে—প্রাচীন ও ছমছমে। যখন সুস্থ থাকি তখন চেষ্টা করেও নীচে যেতে পারি না। বর্তমান পরিস্থিতিতে তার কারণ সহজেই বোঝা যায়। আর, ইচ্ছে করেই পাতালঘর ও তার চারপাশকে এরকম কুৎসিত রাখা হয়েছে—তাই রাখা উচিত। এতে এই পরিবেশের সঙ্গে আমার অদ্ভুত রোগটা তবু খাপ খেয়ে যায়।
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ তার প্রতিধ্বনির সঙ্গে মিশে গিয়ে এক বিচিত্র ফাঁপা শব্দের জন্ম দিল। নীচের বদ্ধ মৃত হাওয়া সিঁড়ি বেয়ে ছুটে এল আমাদের কাছে। হঠাৎ মাথাটা কেমন ঘুরে উঠল। নোনাধরা দেওয়ালে এক হাত দিয়ে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করলাম। সিঁড়ির ধাপে পা পিছলে গেল। অন্য হাত দিয়ে আচমকা আঁকড়ে ধরলাম সিঁড়ির রেলিং। মোটামুটি সামলে নিলেও আমার পা এক ধাপ ছাড়িয়ে সশব্দে আছড়ে পড়ল পরের ধাপে। শব্দ শুনে আমার স্ত্রী ঘুরে তাকাল। ওর মুখের অভিব্যক্তি এককথায় অপার্থিব। দু-চোখ সাদা এবং বিস্ফারিত। মুখ হাঁ করা। এক সুদীর্ঘ মুহূর্ত ওর অভিব্যক্তির কোনও পরিবর্তন হল না। কারও মুখে এর চেয়ে বেশি আতঙ্ক ও ত্রাসের উলঙ্গ ছাপ আমি কখনও দেখিনি। অন্তত অকারণে তো নয়ই। আর ওর ভয় পাওয়ারও কোনও কারণ নেই। ওর অন্তত জানা উচিত যে, আমি কখনও ওর কোনও ক্ষতি করব না। তবুও, ভয় পাওয়ার জন্যে ওকে আমি দোষ দিই না। কিন্তু ওই আতঙ্কের ছাপ আমাকে কষ্ট দিল। যাকে আমি ভালোবাসি, সেও যে আমাকে দেখে এতখানি ভয় পেতে পারে সে-কথা ভেবে নিজের ওপরেই ঘৃণা হল। আর ততক্ষণে সেই অভিব্যক্তি মিলিয়ে গিয়ে তন্দ্রা হাসল, ঠোঁট কামড়ানো ছোট্ট হাসি। হয়তো মনের ভয়কে মুখে প্রকাশ করায় ও লজ্জা পেল। আমিও হাসলাম। এবং তখনই বুঝলাম, আজ অনেক দেরি করে ফেলেছি। আমার মুখ শক্ত হয়ে উঠেছে, আর দাঁতগুলো যে অস্বাভাবিক বড় হয়ে গেছে সেটা বেশ বুঝতে পারছি। জানি, নিজেকে সামলে রাখার ক্ষমতা ক্রমশ আমি হারিয়ে ফেলছি।
সিঁড়ির শেষেই কোণ ঘেঁষে সেই পাতালঘর। ওকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলাম। নিজেই খুললাম পাতালঘরের দরজা। ও একটু পিছিয়ে দাঁড়াল। ভেতরে ঢুকে ওর দিকে তাকালাম। আবার হাসলাম। ওর মুখ পাণ্ডুর, যেন অন্ধকার পাতালঘরের পরিবেশে সাদা আলোর ছোঁয়া পেয়ে উদ্ভাসিত ও সামনে এগিয়ে এল। ওর মুখটা যেন হাওয়ায় ভেসে চলে এল। ওর গলার শুভ্রতা তুলনাহীন। সেই গলায় নীল শিরার আঁকাবাঁকা রেখা স্পষ্ট নজরে পড়ল আমার। শিরার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। দরজা বন্ধ করার সময়ে একটা কষ্টকৃত অনিচ্ছায় ভরা দুঃখের ভাব ফুটিয়ে তুলল ও। হয়তো সত্যিই কোনও দুঃখ ওর হচ্ছে। তারপর দরজা বন্ধ হল। শুনতে পেলাম তালা দেওয়ার শব্দ। দরজায় কান পেতে আরও শুনতে চেষ্টা করলাম। কয়েক মুহূর্ত নীরবতা। জানি, ও বাইরে অপেক্ষা করছে। কল্পনায় দেখলাম, ও দাঁড়িয়ে আছে, অপলকে চেয়ে আছে, খিল দেওয়া দরজার দিকে, ওর উজ্জ্বল মুখে স্বস্তি ও দুঃখের অদ্ভুত মিশ্র অভিব্যক্তি। আর তারপরই শুনতে পেলাম ওর হালকা পায়ের শব্দ। ও সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। অবশেষে কানে এল ওপরের দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ। আমাদের দুজনের কথা ভেবেই দুঃখ পেলাম।
ঘরের এক কোণে বসে দু-হাতে মুখ ঢাকলাম। মুখটা এখনও আমার নিজেরই। তবে ভীষণ খসখসে ও শক্ত লাগছে। স্পষ্ট বুঝতে পারছি, আর বেশি দেরি নেই। প্রত্যেক মাসে পরিবর্তনটা ক্রমশ তাড়াতাড়ি এবং সহজে হচ্ছে। আগের মতো আর যন্ত্রণা হয় না। জানি না, এ-লক্ষণ ভালো না খারাপ। শুধু এইটুকু বুঝতে পারছি, সমস্ত খুঁটিনাটি লিখে রাখা অত্যন্ত কষ্টের ব্যাপার হবে। যেমন কষ্ট হয় আমার পাতালঘরে যেতে। কী যন্ত্রণা সেখানে আমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে, সেই কথা ভেবে।
ভোরবেলা আমার স্ত্রী যখন দরজায় টোকা মারল তখনও নিজেকে ভীষণ দুর্বল লাগছিল। কিন্তু এমনিতে আমি ঠিক আছি। এর মধ্যেই সকাল হয়ে গেছে দেখে অবাক লাগছে। পাতালঘরে সময় ঠাহর করা যায় না। আমিও ঘড়ি নিয়ে যাই না।
প্রথমবারে আমার সাড়া পায়নি তন্দ্রা। তাই দরজা খোলার আগে দ্বিতীয়বার শব্দ করল। দরজা সামান্য ফাঁক করে উঁকি মারল ও। দেখলাম, দরজার ফাঁকে ওর কৌতূহলী আয়ত চোখ। যখন দেখল সব ঠিক আছে, তখন দরজাটা হাট করে খুলে দিল। ওর সাবধানতা দেখে আশ্বস্ত হলেও কোথায় যেন একটা দুঃখের কাঁটা খচখচ করছে। এই হতচ্ছাড়া অসুখ নিয়ে আর পারি না।
ও একবারও জিগ্যেস করল না আমি কেমন ছিলাম। ও জানে, সে নিয়ে কোনও কথা আমি বলতে পারি না। সত্যি, ওর কি জানতে কৌতূহল হয় না? নিশ্চয়ই হয়। ও জানে না যে আমি এই ডায়েরি রাখছি। এটা আমার পড়ার ঘরের ড্রয়ারে চাবি দিয়ে রাখব। এখন টেবিলে বসে আছি, জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছি বাইরের গাছপালার দিকে।
সবকিছু আজ শান্ত, অথচ গতকাল রাতটা এক দুঃস্বপ্নের রাত গেছে। আজকের স্মৃতির চেয়েও ভয়ঙ্কর। যদি সত্যিই ওটা দুঃস্বপ্ন হত! আশ্চর্য, আমি যখন আবার ‘আমি’তে ফিরে আসি তখন সমস্ত স্মৃতি কেমন অদ্ভুতভাবে একই সঙ্গে ফিরে আসে। এ নিয়ে ভেবেচিন্তে পরে কিছু লেখার চেষ্টা করব। কেন করব জানি না। কেনই বা এই ডায়েরি লিখতে ইচ্ছা করে, তাও জানি না। হয়তো এটাই মনের সমস্ত ভাব প্রকাশের একটা পথ। যাই হোক, এখন বেশ আরাম লাগছে। ভাবছি, একটু বিশ্রাম করব। ওই জিনিসটা নিজেকে যেসব আঘাত করেছে, আমার শরীরে সেইসব আঘাতের দাগ ও যন্ত্রণা। শরীর আমাদের একটাই। ফলে ভীষণ শ্রান্ত লাগছে। পরে আবার লিখব।
৬ মে
অসুখটার কথা ভাবছিলাম। কাল সারাটা দিন ওটার কথাই ভেবেছি। এভাবে ভাবতে বেশ অসুবিধে ও কষ্ট হয়। আমি যখন…‘আমি’ থাকি না…তখন কোনও চিন্তাও আমার মনে থাকে না। যদিও বা থাকে, পরে সুস্থ হওয়ার পর সেগুলো আর মনে পড়ে না। বোধহয় সেই সময়টা আমার মন অনেকটা পশুর মতো কাজ করে। তখন আমার কীরকম লাগছিল সেই সম্পর্কে শুধু একটা অস্পষ্ট মোটামুটি স্মৃতি থেকে যায়। মানে, তখন ওটার কীরকম লাগছিল। জানি না, আমি আর ওই প্রাণীটা একই কিনা, তবে আমরা একই শরীরে ভাগাভাগি করে থাকি।
যাই হোক, পরিবর্তনের পর আমার মনে যুক্তি বা কারণের কোনও জায়গা থাকে না। ওই প্রাণীটা নেহাতই খেয়ালখুশি মতো কাজ করে। যে-খেয়ালখুশি মানুষের মস্তিষ্কের ছকে ঠিক খাপ খায় না। না কি আমার মস্তিষ্কই তখন পালটে যায়? তবে স্মৃতির কিছু-কিছু অংশ খুব জোরালো ছাপ রেখে যায়। কতকগুলো প্রায় স্পষ্ট মনে পড়ে। কিন্তু সেগুলো নিছকই ওটার ভাবনা সম্পর্কে। ওটা কী করছিল বা কেমন দেখতে, তার স্মৃতি ফিরে আসে না। অনেকটা যেন পরিবেশ ও ঘটনাকে ভুলে গিয়ে শুধু মনের অনুভূতিকে মনে করতে চেষ্টা করা। কিন্তু কী সাঙ্ঘাতিক জোরালো সেই অনুভূতি! সে-অনুভূতিকে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এতই জটিল।
মনে হয়, ওই প্রাণীটার বেশিরভাগ অনুভূতিই প্রয়োজন থেকে জন্ম নেয়। প্রয়োজন ও ক্ষুব্ধ হতাশা। কিন্তু সঙ্গে মেশানো থাকে ভয়ানক হিংস্রতা, ঘৃণা ও লিপ্সা। কোনও সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের মনে কখনও এই মিশ্র অনুভূতি ঠিক এভাবে জন্ম নেয় না। হয়তো বিচারবুদ্ধির বাঁধন না থাকলে খেয়ালখুশিতে যে-আবেগ তৈরি হয়, তার চরিত্র এরকমই তীব্র। অন্তর মথিত করে সেটা উঠে আসে, সত্যিকারের দৈহিক কার্যকলাপের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক থাকে না। অদ্ভুত জিনিসটার ভেতরে সেটা নরকের আগুনের মতো জ্বলতে থাকে। সেইজন্যেই ওটা বন্য হিংসায় পাগল হয়ে ওঠে। তখন ওটার মনে ওই মিশ্র অনুভূতিই কাজ করে।
পাতালঘরে সত্যি-সত্যি যা ঘটে, তা হল…সমস্ত আবেগ, স্মৃতিকে পাশে সরিয়ে, আমি শুধু ঘটনার বিচারে দেখতে চেষ্টা করছি। যেন আমি এক তৃতীয় ব্যক্তি, পাতালঘরে দাঁড়িয়ে সমস্ত ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। (ঈশ্বর না করুন, কারও যেন সে-দৃশ্য দেখার দুর্ভাগ্য না হয়। তাহলে নিশ্চয়ই সে পাগল হয়ে যাবে…অবশ্য জানি না, পাতালঘরে ওই অদ্ভুত জিনিসটার সঙ্গে একসঙ্গে বন্দি থাকলে পাগল হওয়ার সময়টুকুও পাওয়া যাবে কিনা। সেটুকু সময় আমার দ্বিতীয় স্বরূপ কি দেবে?)
পাতালঘরের দৃশ্যটা আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। ওটা ঝাঁপিয়ে পড়ে গদি আঁটা দেওয়ালে, বাঁকানো নখে ও ভয়ঙ্কর শ্বদন্তে ছিঁড়ে ফালা ফালা করে দেয় দেওয়ালের গদি। ওটা ছিটকে পড়ে মেঝেতে, ঘাপটি মেরে বসে থাকে এক মুহূর্ত, দাঁত খিঁচিয়ে অদ্ভুত গর্জন করে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে দেওয়ালে। এক সর্বনাশা রাগ ওটাকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়, বারবার ছুটে যায় পাগল করা আবেগে। ওটা মাঝে মাঝে থামে শুধু ভেতরের রাগকে নতুন করে আরও তীব্র করার জন্যে, তারপর আগের চেয়েও হিংস্রভাবে উন্মত্ত আক্রোশে লাফিয়ে পড়ে। অবশেষে একসময় ওটা হাঁফিয়ে পড়ে, সমস্ত শক্তি নিঃশেষ করে শ্রান্ত হয়ে বসে থাকে প্রতীক্ষায়। গত রাতে ওটা দরজা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পাতালঘরের দরজা অনেক ভারী, অনেক শক্ত।
জানি না, ওটা দেওয়ালে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় যে শব্দ হয়, সেগুলো তন্দ্রা শুনতে পায় কিনা। তার চেয়ে খারাপ, অনেক খারাপ ওটার হিংস্র ঠোঁট চিরে বেরিয়ে আসা বিকৃত গর্জন। সেগুলোও কি তন্দ্রা শুনতে পায়? সে বড় বীভৎস হবে। ওই শব্দের নৃশংসতায় মানুষের বুক কেঁপে উঠবে।
গত রাতে, খাওয়ার সময়, তন্দ্রাকে অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি। ও নিজে হাতে মাংস রেঁধে দিয়েছিল। ও জানে, মাংস আমি ভালোবাসি। কিন্তু ও এমনভাবে আমার দিকে চেয়ে রইল যেন এক্ষুনি কোনও বন্য পশুর মতো আমি মাংসের টুকরোগুলো ছিঁড়ে খেতে শুরু করব। হয়তো পাতালঘরের শব্দগুলো ও শুনতে পায়…ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে, সে-দৃশ্য ও দেখতে পায় না। এমনিতেই সহজ হয়ে উঠতে ওর তিন-চারদিন লেগে যায়…তারপর ধীরে-ধীরে ও সুস্থ হয়ে ওঠে।
অবশ্য আমিও এখন পুরোপুরি সুস্থ।
৭ মে
আমি সম্পূর্ণ সুস্থ এবং স্বাভাবিক।
হঠাৎই মনে পড়ল, এই কথাটা আমার বলা হয়নি। এটা জানিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন আছে, তাই জানিয়ে রাখলাম। যদি কখনও কেউ এ-লেখা পড়ে, তাহলে তাদের জানা উচিত, আমি পাগল নই। আমার অসুখটা মনের অসুখ নয়, দেহের অসুখ। এ রোগ পুরোপুরি শারীরিক। নিশ্চয়ই তাই, নইলে সে-সময় শুধুমাত্র শারীরিক পরিবর্তন হবে কেন?
পরিবর্তনের কথা আমি এখনও লিখিনি। সেটা লেখা খুব কঠিন। কিন্তু শরীরের কিছু-কিছু অংশ আমি দেখতে পাই। হাত, পা, বুক—কিন্তু মুখটা দেখতে পাই না। কারণ সেখানে কোনও আয়না নেই। মুখটা কেবল স্পর্শে অনুভব করতে পারি। জানি না, পরিবর্তনের পর আমার মুখের যা চেহারা হয়, সে-স্মৃতি মনে থাকলে আমি তা সহ্য করতে পারতাম কিনা। এও জানি না, সে-মুখের নিখুঁত বর্ণনা আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব হত কিনা। দেখি, একদিন রাতে এই ডায়েরি সঙ্গে নিয়ে পাতালঘরে যাব, তারপর যতক্ষণ পারি লিখব—যেমন-যেমন পরিবর্তন হবে সেগুলোর বর্ণনা তেমন-তেমন দেওয়ার চেষ্টা করব। অন্তত যতক্ষণ পর্যন্ত আমার সুস্থ মন সেই পরিবর্তনের সঙ্গে যুঝে স্থির থাকতে পারবে…যতক্ষণ পর্যন্ত আমি ‘আমি’ থাকব।
যে-প্রশ্নটা সর্বক্ষণ আমার মাথায় ঘোরে সেটা হল অন্য কোনও মানুষ কখনও এ রোগে ভুগেছে কি না। যদি জানতে পারতাম আমি একাই এই অসুখের শিকার নই, তাহলে হয়তো কিছুটা স্বস্তি পেতাম। এটা ঠিক সমব্যথী খুঁজে পাওয়ার স্বস্তি নয়; এতে আমি অন্তত এটুকু আশ্বাস পেতাম, এ-রোগ থাকাটা কোনও অস্বাভাবিক-অসম্ভব ব্যাপার নয়। আমি যে এ-অসুখে ভুগছি, তার দোষ আমার নয়। এ-অবস্থাতেও আমি ধৈর্য ধরে থাকতে পারি, যদি জানতাম, এ রোগের কোনও ওষুধ নেই, এ-রোগ যার হওয়ার তার হবেই, কারও কারও ক্ষেত্রে এ-রোগ অনিবার্য।
আমার মতো অসুস্থ কোনও মানুষের ঘটনা খুঁজে বের করার অনেক চেষ্টা আমি করেছি। লাইব্রেরিতে গিয়ে এ নিয়ে গবেষণা করেছি…শেষদিকে লাইব্রেরিয়ান মহিলাটিও হয়তো আমাকে সন্দেহ করত। ভদ্রমহিলা মধ্যবয়েসী, অদ্ভুত রকমের মোটা, আর সাজগোজও উগ্র। হয়তো এ ধরনের চাকরিতে এ ধরনের সাজগোজই কর্তৃপক্ষ পছন্দ করেন। এ ছাড়া, তার মুখে আছে এক অদ্ভুত উপোসী ভাব। তার ধারণা, যে-জিনিস নিয়ে আমি গবেষণা করি, অর্থাৎ লাইক্যানথ্রপি, সেটা মথ ও প্রজাপতির পর্যবেক্ষণবিজ্ঞান। শত গবেষণাতেও কোনও ফল আমি পাইনি। প্রাচীন সব মোটা মোটা বই, চামড়ায় বাঁধানো বিভিন্ন মনস্তত্ত্বের বই ইত্যাদিতে একদিকে যেমন সব উপকথা কিংবদন্তির উল্লেখ আছে, তেমনই অন্যদিকে রয়েছে বিকৃত মানসিকতার কথা। এ-ধরনের অসুখের অনেকগুলো ঘটনারই উল্লেখ সেসব বইয়ে রয়েছে, কিন্তু প্রত্যেক ক্ষেত্রেই রোগী মানসিক দিক থেকেও অসুস্থ ছিল। সত্যিকারের কোনও দৈহিক পরিবর্তন তার হত না। শুধু মাঝে মাঝে সেই উন্মাদ রোগীর মনে হত, তার শরীরে একটা পরিবর্তন আসছে…কিন্তু কিংবদন্তিরও তো একটা ভিত্তি থাকতে হবে। প্রত্যেক কিংবদন্তিরই কিছু না কিছু সত্যের ভিত্তি আছে। এই ধারণা আর বিশ্বাসকেই আমি ভীষণভাবে আঁকড়ে ধরি। কিছু একটা আমাকে যে আঁকড়ে ধরতেই হবে।
শুনেছি, আমার ঠাকুর্দার প্রপিতামহ নাকি অভিযাত্রী ছিলেন এবং কোন একটা অভিযানে গিয়ে এক বল্কান মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। ট্রানসিলভ্যানিয়ার আল্পস-এর পার্বত্য অঞ্চলে বহুদিন ছিলেন তিনি। জানি না, এর মধ্যে আমার অসুখের কার্যকারণের গোপন বীজ লুকিয়ে আছে কিনা। কিন্তু এ-জাতীয় বেশিরভাগ কিংবদন্তিরই জন্ম ওই ট্রানসিলভ্যানিয়া অঞ্চলে। জায়গাটা নিশ্চয়ই এ-রোগের এক বিশাল ঘাঁটি। আর, এও আমার মনে হয়, রোগটা বংশগত। অন্য কারও থেকে এ-রোগ আমার শরীরে সংক্রামিত হয়েছে, এ আমি বিশ্বাস করি না। বরাবরই আমি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকি। সব জিনিসেই আমার সংযম রয়েছে। আমি মদ-সিগারেট খাই না, নারী সংসর্গ করাটাও আমার নেশা নয়, স্বাস্থ্যও আমার বরাবরই ভালো। সুতরাং আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এ-রোগ আমার শরীরে উত্তরাধিকার সূত্রে বর্তেছে। ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে আমার পূর্বপুরুষের পাপ আমাকে বয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে। একজনের অপরাধে শাস্তি পেতে হচ্ছে একজন নিরপরাধকে, আমাকে।
আমার অসুখটা নিশ্চয়ই রক্তে অথবা শরীরের কোষে মিশে আছে। আমার ধারণা, বংশপরম্পরায় ওটা রক্তে বয়ে চলে। কিন্তু থাকে সুপ্ত অবস্থায়, অপেক্ষা করে, প্রচ্ছন্নভাবে ঘাপটি মেরে বসে থাকে পুরুষ থেকে পুরুষে। অবশেষে একদিন…হয়তো একশো বছর পর-পর…কিংবা হাজার বছর পর-পর…অসুখটা জেগে ওঠে। ঘুম ভেঙে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আর তারপর, যত দিন যায়, ওটা হয়ে ওঠে আরও ভয়ঙ্কর, আরও তীব্র। যার এই অসুখ, সে যত বড় হতে থাকে ততই শক্তিশালী হয়ে ওঠে অসুখটা। শরীর থেকে ক্রমশ শক্তি শুষে নিয়ে পৈশাচিক রূপ নেয়, এবং মেতে ওঠে ধ্বংসের তাণ্ডবে…।
এই আমার বিশ্বাস। এ-বিশ্বাস না করে আমার উপায় নেই।
এই অসুখের জন্যে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ, কোনওরকমেই আমি দায়ী নই। এ আমার জীবনে এক অভিশাপ—জন্মগত অভিশাপ। এই অভিশাপের বীজ কবে রোপিত হয়েছে? যেদিন আমার সেই পূর্বপুরুষ এক ভয়ঙ্কর নোংরা খেলায় মেতে উঠে এই রোগের বীজাণুকে আলিঙ্গন করেছিলেন, সেদিন? এই কারণেই পূর্বপুরুষদের আমি ঘৃণা করি। এ-কথা ভাবতে ভালো লাগে, এ-পাপ তাদের, আমার নয়। যদি আমার কোনও কাজ এ-রোগের জন্যে দায়ী হত তাহলে আমি হয়তো দুশ্চিন্তায় পাগল হয়ে যেতাম। আমার মন পঙ্গু হয়ে যেত। এজন্যে আমার ভয় হয়। এ-ভয়ের যথেষ্ট কারণও আছে। যে-রোগে আমি ভুগছি, সে রোগ যে-কোনও লোককে পাগল করে দিতে পারে…।