পিশাচ প্রহর । তিন – জুলাই

১ জুলাই

আগামীকাল আবার আমাকে পাতালঘরে যেতে হবে।

বারবার সে-কথা না ভাবতে চেষ্টা করেছি। অন্য চিন্তায় মেতে থাকব বলে এই ডায়েরি লেখাও বন্ধ করে দিয়েছিলাম, কিন্তু অসম্ভব। সে-চিন্তা আমার মন থেকে যাচ্ছে না, বরং শরীরে মনে ঢেউয়ের মতো উথালপাথাল করে। এই স্নায়বিক চাপ আর বেশি-দিন সইতে পারব বলে মনে হয় না। এখন লিখতে বসে আমার হাত কাঁপছে, শরীর ঘামছে। অসুখ হয়েছে বলে এভাবে নিজেকে শাস্তি দেওয়াটা ভীষণ অন্যায় হচ্ছে। অবুঝ স্বার্থপর এক সমাজের জন্যে নিজেকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া নিতান্তই অবিচার। সময়টা এগিয়ে এসেছে বলে এসব ভাবছি, না কি এটাই বাস্তব সত্য, তা জানি না। অসুখের সময়-চক্র শুরুর সঙ্গে-সঙ্গে আমার চিন্তারও যে পরিবর্তন হয়, তা জানি। সে-কথা অস্বীকার করি না। তা সত্ত্বেও আমার যুক্তিতে কোনও ফাঁক নেই।

পাতালঘরটা অসুখটাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে না তো? এ নিয়ে আগে কখনও ভাবিনি। মনে হয়তো কথাটা এসেছে, কিন্তু যুক্তিহীন চিন্তা ভেবে আমল দিইনি। অথচ এ-কথাও তো সত্যি যে, পাতালঘরে যাওয়া শুরু করার আগে অসুখটা এতটা খারাপ ছিল না। তখনও নিজের ওপর আমার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ ছিল। এমনকী শেষবার যখন হোটেলে রাত কাটিয়েছি, যেবার মাতালটা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেল, সেবারও আমি নিজেকে সামলে রাখতে পেরেছিলাম। মাতালটার মৃত্যুই ছিল পাতালঘর তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রধান কারণ। কিন্তু এখন পেছনে তাকিয়ে বুঝতে পারছি তার মৃত্যুতে আমার কোনও হাত ছিল না, এবং সেই প্রধান কারণ পুরোপুরি মিথ্যে। ঠিকমতো বিচার-বিবেচনা না করেই আমি কাজ করেছি। এ-কথা ভেবে দেখিনি পাতালঘর আমার অসুখকে বাড়িয়ে তুলতে পারে, আমাকে নিরাপদ রাখার বদলে আমার ক্ষতি করতে পারে। এর একটা প্রমাণ বর্ষার রাতে সেই আগন্তুকের ঘটনা। তাই এখন ভাবছি, ওই ঘরই হয়তো আমার অসুখকে ক্রমশ বিপজ্জনক পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ-ভাবনার যুক্তিগত কারণও আছে। আকাশ দেখতে পেলে আমার কষ্ট বরাবর কম হত, আর এখন বদ্ধ ঘরে নিজেকে বন্দি রাখার ফলে অবস্থা হয়ে উঠেছে আরও মারাত্মক। এ-সবই আমার অনুমান। সত্যি-মিথ্যে জানি না। তবে যাই হোক, একটিবার পরখ করে দেখতে দোষ কী!

সাহস করে কালকের রাতটা পাতালঘরের বাইরে কাটালে কেমন হয়? পারব…?

৩ জুলাই, সকাল

লিখে আমার মনের ভাব বোঝানো যাবে না। আমি হতাশ হয়ে পড়েছি। নিজের ওপর ঘেন্না হচ্ছে। জানি, ব্যাপারটা আমার দোষ নয়, কিন্তু তাতে মনের লজ্জা তো দূর হয়। না, আর বীভৎসতাও কমে না। এত যন্ত্রণা কোনও মানুষের শরীর সহ্য করতে পারে না। আমার হৃৎপিণ্ড ফেটে চুরমার হয়ে যাবে, গলে জল হয়ে যাবে মস্তিষ্ক। তাহলে সমস্ত স্মৃতি তরল হয়ে চুঁইয়ে পড়বে, এবং আমিও মারা যাব। কিন্তু কই, আমি তো এখনও বেঁচে আছি। এর চেয়ে মরে যাওয়া ভালো ছিল। আত্মহত্যার কথাও ভেবেছি। সত্যি-সত্যি ক্ষুর বের করে তাকিয়ে থেকেছি আমার কবজির নীল শিরাগুলোর দিকে। কিন্তু পারিনি। কারণ ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসা তাজা রক্ত আমাকে ওই ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেবে। শরীর থেকে ধীরে-ধীরে আত্মার নিষ্ক্রমণের মুহূর্তেও আমার মনে পড়বে সেই নৃশংস রাতের কথা…ওভাবে আমি মরতে পারব না। ঘুমের ওষুধ সঙ্গে থাকলে এই মুহূর্তে খেয়ে সমস্ত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতাম। কিন্তু নেই। কখনও ঘুমের ওষুধ আমি ব্যবহার করিনি। ওষুধপত্র খাওয়াটা আমি পছন্দ করি না।

এখন একটু ভালো লাগছে। এতক্ষণ শুয়ে ছিলাম। বিশ্রামের পর আরও স্পষ্টভাবে ঘটনাগুলো দেখতে পাচ্ছি। অবশ্য তার মানে এই নয় যে, সেসবের জন্যে আমিই দায়ী। আত্মহত্যা করলে আমি শাস্তি পাব, কিন্তু যে-অসুখটা আমাকে ভয়ঙ্করে পরিবর্তন করে অমানুষিক অপরাধ করিয়ে নিল, সে তো শাস্তি পাবে না!

নিজের প্রতি ঘৃণায় আমার মনে আগুন জ্বলছে, এ-ঘৃণা অতলান্ত। ইস, যদি কাল রাতটা পাতালঘরে থাকতাম…কিন্তু কী করে জানব? কল্পনায় কী করে বুঝব কী ঘটতে চলেছে? আমি খুব শান্তশিষ্ট মানুষ। আমার দেহ যে এ-ধরনের কাজে ব্যবহার হতে পারে তা আমার ধারণার বাইরে। মনে হচ্ছে, মাংসকাটা ছুরি নিয়ে নিজের হাত দুটো কবজি থেকে কেটে ফেলি, দাঁতগুলো উপড়ে ফেলি গোড়াসমেত। ঈশ্বর জানেন, যদি অতীতকে পালটে ফেলা সম্ভব হত তাহলে এ প্রশ্ন উঠত না। ওই ঘটনা ঘটবার আগে নিজেকে আমি খুন করে ফেলতাম। কিন্তু এখন সে-প্রশ্ন অবান্তর। যা হয়ে গেছে, হয়ে গেছে। কিন্তু আমার এত লজ্জা করছে…

আজ সকালে বাড়ি ফিরে এসে স্বাভাবিকভাবে চলার চেষ্টা করেছি। ভীষণ কষ্ট হলেও এমন ভাব করেছি যেন কিছুই হয়নি। আমার স্ত্রী মুখে কোনও কথা না বললেও দেখেছি, অবাক চোখে আমাকে খুঁটিয়ে লক্ষ করছে। সারাটা রাত কোথায় কাটিয়েছি সে-কথা পর্যন্ত জিগ্যেস করল না। তবুও ওকে বললাম, ব্যবসার কাজে হঠাৎই আমাকে চলে যেতে হয়েছিল। জানি না আমার কথা ও বিশ্বাস করল কিনা। কাল রাতটা যে…‘সেই’ রাত ছিল সে-কথা দুজনের কেউই মুখ ফুটে উচ্চারণ করলাম না। হয়তো ও ভাবছে, এ-মাসে সেরকম কিছু হয়নি, অথবা ভাবছে অসুখটা আমি সামলে উঠতে শিখেছি। অথবা হয়তো…অনিচ্ছাসত্ত্বেও এ-কথা আমাকে লিখতে হচ্ছে…হয়তো ও ভাবছে অসুখটার কথা আমি ভুলে গেছি এবং এ-অসুখ নিতান্তই মনের অসুখ। কী জানি, জানি না। ওর চালচলনে মনে হল যেন আমাকে কিছু জিগ্যেস করবে, কিন্তু করল না। এ-ব্যাপারটা তলিয়ে দেখতে হবে পরে, যখন আরও স্পষ্টভাবে চিন্তা করতে পারব। আমার মনে এখনও আগুন জ্বলছে। গত রাতের কথা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না। মেয়েটার মুখ সর্বক্ষণ চোখের সামনে ভাসছে…এখন কাজের মধ্যে শুধু বারবার দাঁত মেজেছি, আর নখের ভেতরগুলো জলে ধুয়ে পরিষ্কার করেছি। গায়ের জামাটা আমাকে পুড়িয়ে ফেলতে হয়েছে।

৩ জুলাই, বিকেল

ঘটনাটা সব খবরের কাগজেই বেরিয়েছে!

শেষ শহর সংবাদ সংস্করণে শেষ রাতের ঘটনাও খুঁটিনাটি সমেত প্রকাশিত হয়। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এ-কথা আমি আগে ভাবিনি। নিজের চিন্তায় এত বেশি মগ্ন ছিলাম যে, সেই দুশ্চিন্তায় পৃথিবীর বাকি লোকের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। স্বাভাবিকভাবেই খবরটা প্রতি কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় বেরিয়েছে, আর ওরা সমস্ত ঘটনাটা ভুল ব্যাখ্যা করেছে!

দুপুরে খেতে বসেই খবরের কাগজ আমার প্রথম চোখে পড়ে। সারা সকাল নিজের দুশ্চিন্তায় কাগজ দেখে উঠতে পারিনি। তন্দ্রা, খাওয়ার টেবিলের একপাশে কাগজগুলো ভাঁজ করে সাজিয়ে রেখেছিল। প্রথম পৃষ্ঠার খবর হওয়ার ফলে ভাঁজ করা অবস্থাতেও ওই খবরটা স্পষ্ট চোখে পড়েছে। সুতরাং খাওয়া শুরু করার আগে ওগুলো পড়তে শুরু করলাম। সে-সময়টা তন্দ্রা চেষ্টা করে অন্যমনস্ক থাকার ভান করল। একদিক দিয়ে ভালোই হল, কারণ মনের ক্ষোভ বা রাগ লুকিয়ে রাখতে পারলাম না। কাগজের রঙচড়ানো খবরের ঢং যে-কোনও সংযমী শক্ত মানুষকেও ধৈর্য হারাতে বাধ্য করবে। তন্দ্রা জানে আমি কীরকম শক্ত ধাতের মানুষ। আমার শুধু একটাই আশা, ও যেন অন্তত বুঝতে পারে কাগজের খবরগুলো কীরকম মিথ্যে করে লেখা। ওরা কল্পনায় ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে ঘটনাটাকে যা নয় তাই করে সাজিয়েছে। এতটা বাড়িয়ে লেখা ওদের ঠিক হয়নি।

বাড়িতে আমি দুটো কাগজ রাখি। সে দুটোতেই যখন প্রথম পাতায় ওই খবর জায়গা পেয়েছে, তখন বুঝতে আর বাকি থাকে না অন্যান্য কাগজ কী করেছে। ওরা লিখেছে, এ-কাজ নিঃসন্দেহে কোনও পাগল খুনির! পাগল খুনি! যতরকম ভয়ঙ্কর বীভৎস শব্দ আছে, যতরকম সস্তা চমক আছে, যতরকম নৃশংস কথা হতে পারে, সমস্ত জঘন্য খুঁটিনাটি বিবরণসমেত তাতে লেখা। আর প্রত্যেকটা কাগজেই (নিজের দুটো কাগজ শেষ হওয়ার পর বাইরে বেরিয়ে তৃতীয় ও চতুর্থ কাগজও কিনে পড়ে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে) এ-ঘটনাকে উন্মত্ত ব্যক্তির কাজ বলে উল্লেখ করেছে। কাগজের কাজ হল প্রকৃত ঘটনাকে শুধুমাত্র তথ্যসমেত তুলে ধরা। যে-জিনিস তারা জানে না তা নিয়ে উলটোপালটা তত্ত্ব কেউ তাদের কাছে শুনতে চায়নি। কিন্তু কাগজ বিক্রির দিকে ওদের এত ঝোঁক যে, তার জন্যে আজেবাজে অশ্লীল কথা লিখতেও ওরা পেছপা হয়নি। কী সাঙ্ঘাতিক নোংরা চরিত্রের ইতর লোকগুলো। এমনকী এ-কথারও ইঙ্গিত দিয়েছে। যে, খুনটা যৌনতাভিত্তিক! এটাই সবচেয়ে খারাপ লাগল। প্রত্যেকটা কাগজেই ইঙ্গিত করেছে যে, মেয়েটিকে ধর্ষণ করা হয়েছে। আমার ভীষণ বমি পাচ্ছে। ওরা লিখেছে যে, মেয়েটির বেশবাস ছিল অগোছালো বিস্রস্ত, ছিন্নভিন্ন ঊরু রক্তাক্ত, নাড়িভুঁড়ি বের করে নেওয়া হয়েছে পেট চিরে, গায়ের ব্লাউজ, ব্রা, আর শায়া শতচ্ছিন্ন হয়ে টুকরো-টুকরো, এবং গোপন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাশবিক আক্রমণে নৃশংসভাবে বিধ্বস্ত। সমস্ত তথ্যই এমনভাবে সাজানো যাতে মনে হয় মেয়েটিকে বলাৎকার করা হয়েছে। মেয়েটা যেরকম ধস্তাধস্তি করেছিল তাতে যে বেশবাস বিশৃঙ্খল হয়ে পড়তে পারে, তা কী ওরা বোঝে না? না কি লোকগুলো এমনই বিকৃত মনের যে, প্রতিটি কাজকেই যৌনতা প্রণোদিত ছাড়া ভাবতে পারে না? না কি ওরা সত্যকে এড়িয়ে যাচ্ছে—বেশি কাগজ যাতে বিক্রি হয় সেইজন্যে?

রাগে আমার সর্বশরীর জ্বলছে! কাগজগুলো যে এত দায়িত্বজ্ঞানহীন হতে পারে তা আমার জানা ছিল না! আর জনতাকেও বলিহারি যাই…কাগজের বিক্রি বাড়াতে কিছু চটকদার আগাপাস্তলা মিথ্যে খবর দিলেই হল, লোকে হু-হু করে কাগজ কিনবে। আমাদের সমাজটার হল কী যে, নারী পুরুষ নির্বিশেষে এ-ধরনের খবর পড়ে খুশি হয়! এ-ধরনের সমাজে কোনও অসুস্থ মানুষ কী করে আশা করবে যে, সে ভালো হয়ে উঠবে? ভীষণ দুঃখ পেলাম। মনে এখন শুধু দুঃখ আর হতাশা।

কাগজগুলো সব আমার ঘরে রয়েছে। সবকটার চেহারা একই রকম। শিরোনামে সামান্য তফাত থাকলেও মিথ্যেগুলোয় কোনও তফাত নেই। ‘জঙ্গলে উন্মত্ত খুনির হাতে যুবতীর মৃত্যু’ থেকে শুরু করে ‘আসক্ত শয়তানের হাতে তরুণী নিহত’ ও ‘লাভার্স লেনে যুবতীর ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ’ পর্যন্ত সবরকম শিরোনামই রয়েছে। আর কোনও গল্পেই শারীরিক অসুখের কোনও উল্লেখ পর্যন্ত নেই। ওরা সবাই কি অন্ধ? না কি সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে ভয় পায়? নির্দোষ ব্যক্তির চেয়ে মানসিক রোগীকে ওরা কি বেশি পছন্দ করে? এখন আমি কী করি? ভেবেছি প্রত্যেকটা কাগজের সম্পাদকীয় দপ্তরে চিঠি লিখব, জানাব আসলে গত রাতে কী ঘটেছিল, আমার অসুখটাই বা আসলে কী। চিঠিগুলো ওরা নির্ঘাত ছাপবে, তা সে বিক্রি বাড়াবার জন্যে হলেও। কিন্তু কে জানে, কলম চালিয়ে চিঠির এখানে ওখানে আবার ইচ্ছেমতো পালটে দেবে কি না। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস, যেটুকু সত্যি ওই চিঠিতে থাকবে, সেটুকু ওরা নষ্ট করে ছাপবে। খবরের কাগজের সম্পাদকদের বিশ্বাস নেই, এ-কথা অনেক ঠেকে শিখেছি। এই নোংরা কাগজের সম্পাদকগুলোকে যদি কোনও বন্ধ ঘরে একা পেতাম, বন্ধ পাতালঘরে, মাসের সেই ভয়ঙ্কর রাতে…? সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ওদের মুখের চেহারাগুলো কিরকম পালটে যায় সেটা একবার দেখতে ইচ্ছে করে। তখন ওরা বুঝতে পারবে আমার নামে নোংরা কুৎসা ছড়িয়ে কী ভুলই না ওরা করেছে। ওদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার এই একমাত্র উপায়। নিজেদের ভুলের মাশুল কীভাবে দিতে হয় ওরা সেটা হাড়ে-হাড়ে টের পাবে। এতে ভুল শোধরানোর কোনও পথ থাকবে না, তবে এ-শাস্তি ওদের পাওয়া উচিত। ওরা…।

না, এসব ভাবা ঠিক হচ্ছে না। শুনতে পাচ্ছি, বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডের দ্রিমিদ্রিমি শব্দ, শিরা দিয়ে টালমাটাল গতিতে ছুটে চলেছে উষ্ণ রক্ত। মনে হয় এ গত রাতেরই কোনও প্রতিক্রিয়া, অসুখের পরবর্তী প্রভাব। নিজের ভাবনাকে এভাবে বলগাহীনভাবে এগোতে দেওয়াটা হয়তো ঠিক নয়। এতে অসুখটার সঙ্গে যুদ্ধ করার বদলে আমার মন তার আবেগের শিকার হয়ে পড়েছে। বিনা প্রয়োজনে কখনও এটাকে প্রভাব বিস্তার করতে দেব না। কিন্তু আমার মনের বর্তমান অবস্থা একেবারে অযৌক্তিক নয়। অচেনা অজানা লোকেরা, যারা সত্যের ‘স’-ও জানে না, আমার গায়ে বিনা কারণে মিথ্যে কলঙ্ক লেপে দিয়েছে। তারা সত্যের পরোয়া করে না। ওদের শাস্তি পাওয়া দরকার। এসব লোক মরে গেলেই ভালো।

আমার ভীষণ বিরক্তি এবং রাগ হচ্ছে। আর লিখতে পারছি না। পরে কাগজওলাকে বলব, ওইসব আজেবাজে নোংরা কাগজ আমাকে যেন আর না দেয়…।

৩ জুলাই, রাত

শত কষ্ট হলেও সত্যি-সত্যি কী ঘটেছিল তা বলতে আমি বাধ্য। সমস্ত ঘটনা, সমস্ত সত্য—সব আমাকে লিখতে হবে। এভাবে আত্মশুদ্ধি হলে হয়তো আমি স্বস্তি পাব, অথবা আমার হতাশা হয়তো আরও বাড়বে… কিন্তু সেসব না ভেবেই আমাকে এ-কাজ করতে হবে। সেটা যে কোনও অসুস্থ লোকের কাজ, কোনও বিকৃতকামীর নৃশংস অপরাধ নয়, তা আমি প্রমাণ করবই। আমি একজন বিকৃত মানসিকতার পুরুষ, এই আখ্যাটাই আমাকে বেশি কষ্ট দিচ্ছে। আমি একজন বিকৃতকামী। এত লোক থাকতে সবাই আমাকেই এরকম ভুল বুঝল!

আমার একমাত্র প্রার্থনা, তন্দ্রা যেন খবরের কাগজগুলোর কথা বিশ্বাস না করে। কোনও ব্যাপারে নিজস্ব চিন্তার ক্ষমতা ওর নেই। নিজের মত গড়ে তোলার বদলে ও যা পড়ে তাই বিশ্বাস করে। ও আমাকে ওই চোখে দেখবে, মিথ্যা রটনায় বিশ্বাস করবে, সে-কথা ভাবতে গেলে আমি পাগল হয়ে যাই। ও যদি বিশ্বাস করে বসে যে, সত্যিই আমি একটা অল্পবয়েসী মেয়েকে ধর্ষণ করেছি, তাহলে ওর মনের অবস্থাটা কী হবে? আমি এরকম নোংরা নৃশংস কাজ করতে পারি, এ-কথা কেউ ভাবতে পারে মনে হলেই আমি স্থবির হয়ে যাই। যে এ-কথা বিশ্বাস করবে তাকে আমি ঘেন্না করি, ভীষণ ঘেন্না করি। বরাবরই শরীরে ও মনে আমি অত্যন্ত পবিত্র। এমনকী স্ত্রীর সঙ্গেও যৌনসংসর্গ যথাসম্ভব কম রাখতে আমি চেষ্টা করেছি। যৌন ক্ষুধায় অস্থির হওয়ার মতো অপরাধও কোনওদিন আমি করিনি। যা করেছি শুধু তন্দ্রাকে তৃপ্তি দেওয়ার জন্যেই করেছি। আমার ধারণা ও একটু বেশি কামপ্রবণ, কিন্তু ওকে আমি শাসনে রাখতে পেরেছি। উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে পেরেছি সংযমই স্বাস্থ্য ও পবিত্রতার মূলমন্ত্র। যৌনসংসর্গে উচ্ছৃঙ্খল হওয়া মাদকদ্রব্যের নেশা করা, কিংবা মাতলামির মতোই নোংরা রুচির কাজ।

হয়তো প্রেমিক-প্রেমিকাদের গোপন মিলনের জায়গায় ওই ঘটনাটা ঘটার ফলেই খবরের কাগজওলাদের মনে ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তা নিতান্তই কাকতালীয় যোগাযোগ। শপথ করে বলতে পারি, নোংরাভাবে মেয়েটাকে আমি স্পর্শ পর্যন্ত করিনি। পরিবর্তন হলেও যদি আমার মনে সে লোভ আসত, তাহলে তাকে দমন করার মতো ক্ষমতা আমার নৈতিক আদর্শ দেখাতে পারত। কিন্তু সে-লোভ আমার হয়নি। তার সামান্য ইশারাও পাইনি। মেয়ের জায়গায় কোনও পুরুষ হলে যেমনটি হত, ঠিক তাই। প্রথমত মেয়ে, তার ওপর যুবতী, সুন্দরী। চোখে-মুখে সস্তা চটকের সাজ। বিশ্বাস করুন, যা ঘটে গেছে তার সঙ্গে এসবের কোনও সম্পর্ক নেই। দিব্যি করে বলছি। কারণ আমি জানি, কোনও অবস্থাতেই কোনও মেয়ের ওপর অবস্থার সুযোগ আমি নেব না।

ওরা যে ব্যাপারটা ভুল বুঝেছে তাতে একদিক দিয়ে মনে হয় ভালোই হয়েছে। এতে পুলিশ ভুল পথে এগোবে। ওরা কোনও পাগল বিকৃতকামী মানুষকে খুঁজবে। আমাকে সন্দেহ করার কোনও উপায় নেই। আমার চালচলন, জীবনযাত্রায় কোনওদিন নিন্দের আঁচ পর্যন্ত লাগেনি। ওরা যতই তদন্ত করবে, ততই সত্য থেকে দূরে সরে যাবে। একটু আগে রাতের খবরে বলল, এই খুনের সঙ্গে লাইব্রেরিয়ানের মৃত্যুর কোনও যোগসূত্র থাকলেও থাকতে পারে। বেচারা অন্ধ গর্দভগুলো! এ-কথা ওরা ভাবল কেমন করে? আমার তো মাথায় কিছু আসছে না। মনে হয়, দুটো খুনকে একই খুনির কাজ বলে ওরা নিজেদের পরিশ্রম বাঁচাচ্ছে। সে যাই হোক, অন্তত এটুকু নিশ্চিত যে, সত্যের খোঁজ ওরা কোনওদিনই পাবে না।

সমস্ত ঘটনা গুছিয়ে লেখার মতো মনের অবস্থা এখনও ফিরে পাইনি। খবরের কাগজওলাদের ওপর আমার বিরক্তি, রাগ একটুও কমেনি। তা ছাড়া গত রাতের ঘটনায় মন অত্যন্ত বিচলিত। আসলে কী হয়েছিল সব কাল লিখব। খুব ঠান্ডা মাথায় কোনও কিছু বাদ না দিয়েই লিখব।

৬ জুলাই

শান্ত মনে যতক্ষণ না সব কিছু গুছিয়ে লিখতে পারব বলে মনে করেছি ততক্ষণ অপেক্ষা করেছি। এর আগে নিজেকে বিশ্বাস করতে পারিনি। কিন্তু এখন আমি তৈরি। সে-রাতে কী হয়েছিল সমস্ত এখন বলব, প্রমাণ করে দেব খবরের কাগজওলারা কী মারাত্মক ভুল করেছিল।

সেদিন বিকেলে বহুদূর পর্যন্ত বেড়াতে গিয়েছিলাম। পায়ে হেঁটে। বিকেলের টিফিন সেরে যখন বেরিয়েছি তখনও সূর্য অস্ত যেতে অনেক দেরি। সে-রাতটা যে কোন রাত তা তন্দ্রার হয়তো খেয়াল ছিল না, অথবা হয়তো ও ভেবেছিল, আমি একটু পরেই ফিরে আসব। অন্তত বেরোনোর সময় কোনও কথা ও জিগ্যেস করেনি। রাতটা যে কোথায় কাটাব তার ছিটেফোঁটা বুদ্ধিও মাথায় আসেনি, তবে এটুকু জানি, ওই অসহ্য পাতালঘর থেকে আমাকে চলে যেতে হবে অনেক দূরে। ওই ঘরে ফিরে যাওয়ার যন্ত্রণা আমি সইতে পারব না। আমাকে পালিয়ে যেতে হবে শহর ছেড়ে, লোকালয় ছেড়ে। কোনওরকম ঝুঁকি আমি নিতে চাই না। আমার ধারণা…তখন সে-ধারণা একেবারে বদ্ধমূল সত্যিই আমার বিশ্বাস, পাতালঘরে বন্দি থেকেই গত কয়েক মাসে পরিবর্তনের ধাপগুলো এত দ্রুতগতিতে খারাপের দিকে মোড় নিয়েছে। বাইরের হাওয়া-বাতাস, আকাশ, চাঁদ, এসব থেকে আড়ালে থাকার পরিবর্তন আনতে শক্তি দরকার হয় আরও বেশি। সুতরাং, স্বাভাবিক কারণেই পরিবর্তনের চরিত্রও হয়ে উঠেছে আরও মারাত্মক। এখন জানি, আমার সে বদ্ধমূল ধারণা পুরোপুরি ভুল। যে-পরিশ্রম করে পরিবর্তনটা আসে তার সঙ্গে তার ভয়ঙ্করতার কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু তখন আমার বিশ্বাস এটাই ছিল। কোনও বিপদের আভাস আমি পাইনি।

উদ্দেশ্যহীনভাবে কিছুক্ষণ পথে পথে ঘুরে বেড়ালাম, তারপর সন্ধে হয়ে আসতেই লোকালয় ছেড়ে রওনা হলাম। হেঁটে চললাম শহরের পশ্চিম দিকে। ধীরে অথচ অবিচলিত পদক্ষেপে এগিয়ে চললাম। খুব শিগগিরই শহর, লোকালয় পড়ে রইল পেছনে। হঠাৎই দেখি, আমি দাঁড়িয়ে খোলা রাস্তায়। চওড়া সড়কে প্রচণ্ড শব্দ তুলে ধুলোর মেঘ উড়িয়ে মাঝে মাঝে ছুটে যায় মোটরগাড়ি। কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। গাড়ি আমি কোনওদিনই পছন্দ করি না, বরং হাঁটতে অথবা ট্রেনে চড়তে ভালো লাগে। হয়তো আমি একটু সেকেলে, কিন্তু তাতে ক্ষতিটা কী? আজকের দিনে, আজকের মতো অলস শিথিল যুগে, সেটাই হয়তো নীতি ও পবিত্রতার লক্ষণ। একসময়ে আঁধার নেমে এল, রাস্তা দিয়ে ছুটে যাওয়া গাড়ির হেডলাইট জ্বলে উঠল। বুঝলাম, এবার আমাকে একেবারে নির্জনে যেতে হবে, সুতরাং প্রথম মেঠো পথটা চোখে পড়তেই বড় রাস্তা ছেড়ে সেদিকে পা বাড়ালাম।

রাস্তাটা সরু, এবড়োখেবড়ো। এগিয়ে গেছে উত্তর দিকে। রাস্তার দু-ধারে বড়-বড় গাছ। আরও দূরে তাকালে দেখা যায় গাছের ঘন সারি। বড় রাস্তার শব্দ ক্রমে আমার কানে মিলিয়ে আসে। এ-রাস্তায় গাড়ি নেই। কোনও পথচারীও নেই আমার মতো। কিন্তু ধুলোময় পথে ভালো করে তাকালে চোখে পড়ে গাড়ির চাকার দাগ। তখনও বুঝিনি, এ-পথে গাড়ি-ঘোড়া লোকজন আসার সময় তখনও শেষ হয়নি। বিশ্বাস করুন, দিব্যি করে বলছি, তখনও আমি জানতাম না এ পথ এগিয়ে গেছে এখানকার ‘প্রেমকুঞ্জের’ দিকে। এ-কথা আমার মনেও আসেনি। এ-সব আমি পছন্দও করি না। না, আমি কচি খোকা নই। আমি জানি, বিয়ের আগেই ছেলেমেয়েদের মধ্যে কত নোংরা কাজ এখানে হয়। দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির ভেতরে। জঙ্গলে। কিন্তু তখনও বুঝিনি, সেরকম একটা জায়গার দিকেই আমি এগিয়ে চলেছি।

রাস্তাটা চড়াই। সাপের মতো এঁকেবেঁকে উঠে গেছে ওপরে। প্রায় ঘণ্টাখানেক হাঁটার পরও কোনও লোকজনের দেখা পেলাম না। বারকয়েক দু-একটা কুকুর চোখে পড়ল। ওরা আমাকে দেখে দাঁত খিঁচিয়ে চিৎকার করতে লাগল। আমি তেড়ে যেতেই লেজ গুটিয়ে পালাল। পালানোর সময় বারবার পেছন ফিরে দেখতে লাগল আমাকে। কুকুররা বরাবরই আমাকে দেখলে ভয় পায়। ভয়ঙ্কর চেহারার সাহসী কুকুরও আমাকে দেখলে ছুটে পালায়। এতে বেশ মজা লাগে। এমনটা কেন হয়, কেউই বুঝতে পারে না। হঠাৎ একটা বিশাল হাউন্ড রাস্তার ঠিক মাঝে আমার সামনে রুখে দাঁড়াল। কোত্থেকে ওটা এল কে জানে। কারই-বা কুকুর? একের পর এক এত কুকুর আসছে কোথা থেকে? ওরা কি আমার গন্ধ পায়?

হাউন্ডটার ছুঁচলো দাঁত প্রকট। এই আঁধারেও স্পষ্ট চোখে পড়ে। আমি এক অদ্ভুত শব্দ করে চকিতে এগিয়ে গেলাম ওটার দিকে। কুকুরটা সঙ্গে-সঙ্গে ছুটে পালাল। ব্যাপারটা এত মজার যে, আমার ভীষণ হাসি পেল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই টিলার মাথায় পৌঁছে গেলাম। রাস্তাটা শেষ হয়েছে এক বিশাল গর্তের কাছে। হয়তো কোনও কারণে এখানে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছিল, সঠিক বলতে পারি না। তবে লোকজন কেউই নেই। নিস্তব্ধ। নির্জন। অন্ধকার ইতিমধ্যে আরও জাঁকিয়ে বসেছে। আমি বিশ্রাম নিতে থাকলাম। একটা চ্যাপটা পাথরের ওপর বসে জামার দুটো বোতাম খুলে দিলাম। বেশ গরম লাগছে। এতটা পথ উঠে এসে রীতিমতো ঘামছি। এখন এই খোলা জায়গায় একা একা বসে ভালো লাগছে। মনে পড়ছে ছোটবেলার কথা। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর হয়ে ভাবলাম পরিবর্তন খুব সামান্যই হবে এবং পুরোনো দিনের মতো এই জঙ্গলে ছোটাছুটি করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। একবারের জন্যেও মনে হয়নি অন্য কোনও মানুষের সঙ্গে আমার দেখা হতে পারে। চারদিক এত নির্জন, এত শান্ত। শহরের শব্দ আর জঙ্গলের শব্দ এক নয়। এ শব্দে এক অদ্ভুত মায়া আছে। যেন সঙ্গীতের মূর্ছনার মতো। চোখ বুজে বসে থাকতে ভীষণ ভালো লাগছিল। আমার ধারণা, ওভাবেই সারাটা রাত আমি কাটিয়ে দিতাম, আর নৃশংস কোনও ঘটনাও সেখানে ঘটত না—যদি না কালো গাড়িটা হঠাৎই এসে হাজির হত…।

বহুদূরে থাকতেই গাড়িটার ইঞ্জিনের শব্দ আমার কানে এল। প্রথমে ভেবেছিলাম গাড়িটা হয়তো বড় রাস্তা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে, কিন্তু ক্রমে সে শব্দ কাছে এগিয়ে আসতে লাগল। বিরক্ত হলাম। এ-সময়ে কেউ এসে পড়ুক, আমি চাই না। এই নির্জন খাদের দিকে গাড়ি নিয়ে কে-ই বা আসবে? কেন আসবে? গাড়িটা যে এ-পথেই আসছে সে-বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম, তারপর পাথর ছেড়ে ধীরে-ধীরে জঙ্গলে গিয়ে ঢুকলাম। ঝোপের আড়ালে বেশ কিছুটা ঢুকে আত্মগোপন করলাম। জানি, বাইরে থেকে কেউ আমাকে আর দেখতে পাবে না। আস্তে হাঁটুগেড়ে বসলাম। হাঁটুর তলায় ঝরাপাতা, মাটি শুকনো ও ভঙ্গুর। তবু কেমন এক অদ্ভুত আস্বাদ হাঁটু দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে আমার শরীরে ঢুকতে লাগল। অন্ধকার এখনও ঘন হয়নি। সুতরাং সামনের কাঁচা রাস্তা আমার চোখের সামনে স্পষ্ট। এখানে ঘাপটি মেরে বসে রাস্তার শেষে গর্তটাও দেখতে পাচ্ছি। একটু পরেই ধুলোর মেঘ উড়িয়ে গাড়িটা উঠে এল। রাস্তার একেবারে শেষ প্রান্তে গিয়ে থামল। অপেক্ষায় রইলাম। ভাবলাম, গাড়ির ড্রাইভার এখনই দেখতে পাবে যে, সামনে আর পথ নেই এবং গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যাবে। কিন্তু তা হল না। গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হল। মনে-মনে প্রচণ্ড রাগ হল। যেন আমার গণ্ডি দেওয়া জমিতে কেউ অনধিকার প্রবেশ করেছে। নিচু হয়ে ঝোপের ফাঁকদিয়ে গাড়িটাকে দেখতে লাগলাম। আর তখনই বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা ঠিক কী হচ্ছে।

গাড়িতে একটা মেয়ে রয়েছে। দুটো ছেলে আর একটা মেয়ে। গাড়িতে কী হচ্ছে তা স্পষ্ট দেখতে না পেলেও যথেষ্ট শব্দ, খিলখিল হাসি ও টুকরো-টুকরো কথা আমার কানে এল। এবার বুঝলাম গাড়িতে কী কাণ্ডটা হচ্ছে। শরীরের ভেতর রাগ উথলে উঠল। আমার হাতের আঙুল বসে গেল শুকনো মাটিতে, গলা দিয়ে বেরিয়ে এল চাপা গর্জন। খালি ভাবছি, এই বোধহয় ওরা চলে যাবে। ওরা এখনও যাচ্ছে না কেন? কিন্তু ওরা গেল না। হঠাৎই জমাট হয়ে এল অন্ধকার এবং মেঘের আড়াল থেকে আত্মপ্রকাশ করল পূর্ণিমার চাঁদ। চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ল গাড়িটার কালো চকচকে শরীরে। আর তার ভেতর থেকে ভেসে আসছে ইতর নোংরা শব্দ। ইচ্ছে হল চলে যাই, যত জোরে পারি ছুটে পালিয়ে যাই। কিন্তু কী একটা অদ্ভুত আকর্ষণ আমাকে বেঁধে রাখল। যেতে আর পারলাম না। এমনকী গাড়িটার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারলাম না। মনে হয় পরিবর্তনটা তখনই এসে থাকবে, কিন্তু কখন যে ওটা শুরু হল আর শেষ হল, টেরই পাইনি। এমনকী শেষ হওয়ার পরও বুঝতে পারিনি আমি অমানুষ হয়ে গেছি।

আর তখনই ওরা গাড়ি থেকে নেমে এল। মেয়েটা খিলখিল করে খুব হাসছে, বেশবাস মোটামুটি বিস্রস্ত। ও প্রথমে নেমে গাড়িটার একপাশে দাঁড়ালো। নিজের শাড়ি, ব্লাউজ ঠিকঠাক করতে লাগল। লোক দুটো এবার গাড়ি থেকে নামল। একজনের হাতে একটা বড় চাদর। সেটা সে পথের ধারে শুকনো পাতার ওপর ছড়িয়ে দিল। অন্য লোকটার হাতে একটা বোতল। সম্ভবত মদের বোতল। সে বেরিয়ে এসেই এক হাতে মেয়েটাকে জাপটে ধরে চুমু খেল। দেখলাম, তার ঠোঁট পিষে যাচ্ছে মেয়েটার ঠোঁটে। স্পষ্ট বুঝতে পারছি, মেয়েটার মুখে ফুটে উঠছে তৃপ্তির আমেজ। না, মেয়েটা ভালো নয়।

ঝোপের আড়ালে গুড়ি মেরে বসে সবই দেখলাম। ওরা তিনজনে চাদরটার ওপরে ঘন হয়ে বসল। দ্বিতীয় লোকটা টেনে খুলে নিল মদের বোতলের ছিপি। তারপর দুজনে মিলে ঢকঢক করে মদ খেতে লাগল। একবার বোতল থেকে এ এক চমুক খায়, তারপর ও খায় এক চুমুক। আর ফাঁকে-ফাঁকে চলল মেয়েটাকে নিয়ে ফষ্টিনষ্টি। চলল ওর বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ নিয়ে বিচিত্র খেলা। একে-একে খসে গেল ওর গায়ের শাড়ি, কুশলী হাতের প্রচেষ্টায় খুলে গেল ওর ব্লাউজ। অবশেষে উন্মুক্ত হল ব্রা। মেয়েটা শুয়ে পড়ল চাদরের ওপর। ধীরে-ধীরে তুলে ধরল শেষ অন্তর্বাস।

এবার শুরু হল তিনটে শরীরের মিলিত শ্রম। চাঁদের আলো পিছলে যায় তিনটে অর্ধ অনাবৃত সরীসৃপ-শরীরে…প্রথমে একজন তারপর আর একজন…ওঃ, আমি আর লিখতে পারছি না। এমন কিছু-কিছু জিনিস আছে স্বাভাবিক সুস্থ মানুষ যার মুখোমুখি হতে পারে না। ওরা কীসব করতে লাগল, আমি গুড়ি মেরে বসে রইলাম ঝোপের আড়ালে, সমস্ত একে-একে দেখলাম…।

নিজেকে সংযত করলাম। হয়তো সামনের বীভৎস দৃশ্য আমাকে সম্মোহিত করে রেখেছিল। সেই কারণেই মনে সংযম এসেছে বিনা আয়াসে। ইচ্ছে হল নখ-দাঁত নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি জঘন্য নোংরা কীটগুলোর ওপর, ওদের চরম শাস্তি দিই, শেষ করে দিই ওদের অশ্লীল নষ্টামির। কিন্তু অপেক্ষায় রইলাম। অনেকক্ষণ পর কামতৃপ্ত দুটো মানুষ উঠে বসল, নিজেদের জামাকাপড় পরতে লাগল। মেয়েটা তখন আধশোয়া অবস্থাতেই হাসছে। দুষ্টু হাসি।

কিছুক্ষণ ও চাদরের ওপরে শুয়ে রইল। ওকে দেখে পরিতৃপ্ত বলেই মনে হল। যেন এই বদ কাজে ভীষণ আনন্দ পেয়েছে। মেয়েটার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালাম। দেখলাম ওর ঠোঁটে শয়তানির বাঁকা হাসি। হাঁটু মুড়ে মাথা এলিয়ে ও আবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। দেখলাম ওর নরম গলা, ঢেউ খেলানো পিঠ, সাদা ধবধরে ঊরু। মেয়েটার সবই যেন দূষিত কদর্য। চাঁদের আলোর এক রুপোলি বর্শা বিদ্ধ করেছে ওর নগ্ন শরীর এবং নিজের দেহকে আবৃত করতে একটুও ব্যস্ত নয় ও। ওর দুধ-সাদা দুটো পা দু-পাশে ছড়ানো, সমস্ত পোশাক-আশাক স্তূপীকৃত একপাশে। এত নীচ অশ্লীল নোংরামি আমি কখনও কল্পনাও করিনি।

এরপর এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল। কী হল ঠিক বুঝতে পারলাম না। লোক দুটো আচমকাই উঠে বসল গাড়িতে। ওরা কর্কশভাবে হাসছে। তারপর দুজনের একজন জানলা দিয়ে গলা বাড়িয়ে মেয়েটাকে কী যেন বলল। মেয়েটা চমকে উঠে বসল, সোজা হয়ে দাঁড়াল এক লাফে। চিৎকার করে ছুটে গেল গাড়িটার দিকে। চেষ্টা করল দরজা খুলে গাড়িতে উঠতে, কিন্তু ততক্ষণে গাড়ি চলতে শুরু করেছে। মেয়েটার মুখে ফুটে উঠেছে অসহায় ত্রস্ত ভাব, আর লোক দুটো খুশি খুশি, গাড়িটা ঘুরিয়ে ওরা যে-পথে এসেছে সেই পথে রওনা হল। মেয়েটা গাড়িতে ওঠার জন্যে কাতর স্বরে ওদের কাছে অনুনয়-বিনয় করতে লাগল। কিন্তু ওদের মন ভিজল না। গাড়িটা চলে গেল। যাওয়ার সময় জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে একজন হাত নেড়ে বিদায় জানাল মেয়েটাকে। আর ও অভদ্র নোংরা ভাষায় ওদের গালাগালি দিতে লাগল। সেসব শব্দ দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করা কোনও ভদ্রলোকের পক্ষে সম্ভব নয়।

মেয়েটা দাঁড়িয়েই রইল, চোখের নজর ঢালু রাস্তা ধরে এগিয়ে চলা গাড়িটার দিকে আর আপনমনেই কীসব বিড়বিড় করতে থাকল। ওর হাত দুটো কোমরের পেছনে, নিতম্বে। ওর বিড়বিড় করে বলা কথাগুলো মাঝে-মাঝে শুনতে পেলেও তার অর্থ বিন্দুমাত্রও বুঝলাম না, কারণ কোনওদিন ওসব কথা শুনিওনি। অথচ আমার বয়েস নেহাত কম নয়। কিন্তু এটুকু বুঝলাম যে, শব্দগুলোর সম্পর্ক শুধুমাত্র যৌনতার সঙ্গে। কারণ রাগ হলেও মেয়েটার নোংরা চরিত্র বদলায়নি। বদলাতে পারে না। এর চেয়ে বড় পাপী আমি জীবনে দেখিনি। আমার ধারণা, নিজেদের বাসনা চরিতার্থ হলে পর লোকদুটো হঠাৎই ভয় পেয়ে যায়, এবং নিজেদের পাপের জন্যে, অন্যায়ের জন্যে মেয়েটাকে দায়ী করে ওকে শাস্তি দিতে ফেলে পালায়। এ ছাড়া অন্য কোনও ব্যাখ্যা আমার মাথায় আসছে না। তবে চলে যাওয়ার সময় ওরা অমন হাসছিল কেন কে জানে। নারী পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে সমস্ত ব্যাপার আমার মাথায় ঢোকে না। কিন্তু এটুকু বুঝি কোনটা পাপ, অন্যায়, এবং এই মেয়েটা পাপী। একে শাস্তি দেওয়া উচিত।

মেয়েটাকে আঘাত করার ইচ্ছে আমার ছিল না। কী ইচ্ছে ছিল তাও জানি না। মেয়েটা চাদরের কাছে ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। তারপর উঠে দাঁড়ালাম, বেরিয়ে এলাম খোলা জায়গায়। মেয়েটা তখন নিচু হয়ে শায়াটা তুলছিল। আমি নিঃশব্দে ঠিক ওর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মেয়েটা শায়াটা সবে মাথা গলিয়ে গলায় পরেছে, নামাতে যাবে কোমর পর্যন্ত—এমন সময় আমি হয়তো অস্ফুট কোনও শব্দ করে থাকব—হঠাৎই ও চকিতে ঘুরে দাঁড়াল আমার দিকে।

ও চিৎকার করেছিল কিনা ঠিক মনে নেই। ওর মুখ ত্রাসে বিস্ময়ে বিস্ফারিত, কিন্তু কোনও শব্দ আমার কানে এল না। হয়তো আতঙ্কে ওর চিৎকার গলায় আটকে গেছে, কিংবা আমার কান হয়তো তখনকার মতো স্থবির হয়ে পড়েছিল। টলতে টলতে কয়েক পা পিছিয়ে গেল মেয়েটা—হাত দুটো ওপরে তোলা, হাতের তালু সামনে এগিয়ে আমাকে বাধা দেওয়ার কাল্পনিক প্রচেষ্টায় রত। শায়াটা নেমে গেছে ওর পা পর্যন্ত, সেখানে জট পাকিয়ে রয়েছে। ওর মুখে অদেখা অচেনা বিকৃত ভয়ের অসংখ্য রেখা। আমি ধীরে-ধীরে ওকে লক্ষ্য করে এগিয়ে চললাম। আমার নখর হাত সামনে থাবার মতো বাড়ানো, দাঁতের ওপর থেকে সরে গেছে ঠোঁটের আবরণ।

আরও কাছে যেতেই মেয়েটা শায়া পায়ে জড়িয়ে পড়ে গেল মাটিতে। ওর চোখ আমার মুখ থেকে এক মুহূর্তের জন্যেও সরল না। ওর শরীরে উবু হয়ে যখন ঝুঁকে পড়লাম তখনও ও সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে। ওর আতঙ্ক আমাকে যেন আরও উৎসাহ জোগাল। শপথ করে বলছি, আমি শুধু ওকে ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আতঙ্কের মধ্যে কী যেন একটা নেশা আছে…আতঙ্কের অদ্ভুত গন্ধ, আমেজ…আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। ভয় ও রক্তের গন্ধ অনেকটা একই রকম। পারলাম না নিজেকে সংযত করতে। এ-সবই ওই মেয়েটার দোষ। ওই লোক দুটোর মতো আমাকেও সে বাধ্য করল এই নৃশংস কাজে। দেখলাম ওর সাদা ঊরুর ঝলক, নড়ে উঠল ওর রঙিন ঠোঁট, আর আমার মনে জেগে উঠল ছিন্নভিন্ন করার ইচ্ছে, ফালা ফালা করে ধ্বংস করার ইচ্ছে। মনে হল আমার ধারালো নখ বসিয়ে দিই ওর নরম মাংসে, যাতে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসে উষ্ণ রক্ত, শেষ হয়ে যায় ওর কলঙ্কিত নোংরা জীবন।

আর তখনই আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম মেয়েটার ওপর।

সর্বক্ষণ ও সরাসরি চেয়ে রইল আমার চোখে।

অবশেষে ওর চোখ হয়ে এল আচ্ছন্ন, ঘোলাটে। অস্বাভাবিক সময় পর্যন্ত বেঁচে ছিল মেয়েটা।

পরে কী হয়েছিল মনে নেই। মনে নেই ওর মৃতদেহের ওপর কতক্ষণ আমি উবু হয়ে বসে ছিলাম, কিংবা কী করেছি ওর দেহ নিয়ে। খবরের কাগজে মেয়েটার মৃতদেহের যে-অবস্থার কথা লিখেছে তা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে আমি নিশ্চয়ই বেশ কিছু সময় ওখানে বসে কাটিয়েছি। কিন্তু আর কিছু ওরা ঠিক লেখেনি। এসব যে গুছিয়ে লিখতে পারলাম তার জন্যে আনন্দ হচ্ছে। অন্তত সত্যি ঘটনাটুকু তো কাগজে-কলমে লেখা রইল।

এই হল আসল ঘটনা—ঠিক যেভাবে সব ঘটেছিল।

২০ জুলাই

গত দু-সপ্তাহ আর ডায়েরি লিখিনি। এমনকী ওটা পড়িওনি। মনে হয় ওই শেষ ঘটনাটা লেখার পর আমি নিস্তেজ, ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। অসুখটার কথা কিছুদিন ভুলে গিয়ে আরাম করতে বেশ ভালোই লেগেছে। এই হল আধুনিক সভ্যতার এক বিরাট দোষ : এখানে আরাম বা বিশ্রামের সময় নেই। সৌভাগ্যক্রমে কোনওদিনই অর্থ, যশ অথবা সুখের পেছনে দৌড়নোর নেশা আমার ছিল না। নিজের ইচ্ছেয় তারা কেউ আমার কাছে এলেই আমি সন্তুষ্ট, না এলেও অসন্তুষ্ট নই। আমি যুক্তিবাদী, সুখ-দুঃখে নির্বিকার এবং নিঃসন্দেহে কালের ইতিহাসে কয়েকশো বছর পরে জন্মগ্রহণ করেছি। কিন্তু তার জন্যে আমার কোনও অভিযোগ নেই। অহঙ্কার প্রকাশ করা আমার স্বভাব নয়, তবে এটুকু বেশ বুঝতে পারছি, ক্রমে ক্রমে এই অসুখটাকেও জীবনের অন্যান্য ঘটনার মতো আমি মানিয়ে নিতে পারব। হাজার হলেও মাসে একটা মাত্র রাত তো! বছরে মাত্র বারোটা রাত আমাকে কষ্ট পেতে হবে। এর চেয়েও খারাপ অসুখ তো আমার হতে পারত! অনেকেরই তো হয়। কিন্তু সে-অসুখগুলো সবার কাছে সাধারণ ও পরিচিত বলে বিশেষ কোনও গুরুত্ব পায় না। আর আমার অসুখটা যেহেতু অপরিচিত, সেহেতু সত্যিকারের যত না তার চেয়েও বেশি লোকে ভয় পায়। ক্যানসার, কুষ্ঠরোগ কিংবা অন্ধ হয়ে যাওয়ার চেয়ে নিশ্চয়ই এ-অসুখ ভয়ঙ্কর নয়। একমাত্র নিজের অহঙ্কারই আমাকে ভাবতে শিখিয়েছিল এ-অসুখ নৃশংস, ভয়ানক। সেসব চিন্তাকে এখন দূরে সরাতে পেরেছি বলে ভালো লাগছে। অসুখটাকে আমি চরিত্র অনুযায়ী যথাযথ বিচার করতে শিখেছি। এ যদি আমার পরীক্ষা হয়ে থাকে তাহলে সে পরীক্ষায় আমি সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছি। এখন আমি অনেক সুখী, অন্তত আগের চেয়ে। কারণ এই প্রথম আমি গুছিয়ে ভাবতে পারছি—অন্যান্য জিনিস সম্পর্কে যেরকম গুছিয়ে চিন্তা করতে পারি অসুখটা নিয়েও সেরকম পারছি। ছোট-ছোট সুখ, ছোট-ছোট আনন্দ-খুশির মতো এই যন্ত্রণাকেও আমি মেনে নিয়েছি। নিষ্ঠুর সমাজকে নিয়ে যেমন বাঁচতে শিখেছি, তেমনই এই অসুখকে নিয়েও আমি বাঁচতে পারব। তন্দ্রার স্বল্পবুদ্ধি যদি আমাকে ধৈর্যের সীমা অতিক্রম না করায়, তাহলে এই অসুখও পারবে না।

সেই রাতের কথা যা লিখেছি সবই পড়ে দেখেছি। ও-লেখার সবটাই বাস্তব এবং সত্যি। আমার ধারণা, ওই লেখার ফলে আমি নিজেকে আরও স্পষ্ট চোখে নিখুঁতভাবে দেখতে পাচ্ছি। একটা জিনিস আমার নজরে পড়েছে। ক’দিন আগে হলেও এ নিয়ে আমি দুশ্চিন্তায় পড়তাম। কিন্তু এখন নিজেকে আরও বেশি করে বুঝতে পারছি…ব্যাপারটা হল, সেই রাতের ঘটনা লেখার সময়ে আমি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আমাকে ‘আমি’ বলেই উল্লেখ করেছি। কখনও ‘ওই প্রাণীটা’ বা ‘অমানুষটা’ বলে উল্লেখ করিনি। স্পষ্টই বোঝা যায়, ওই শব্দগুলো সত্যের মুখোমুখি না হয়ে আত্মরক্ষার নিষ্ফল মিথ্যে প্রচেষ্টা মাত্র। কারণ ‘ওই প্রাণী’ বা ‘অমানুষ’—যাই বলি, সেটা আসলে আমিই। আমরা এক ও অদ্বিতীয়—বাইরের রূপ আমাদের যাই হোক না কেন, আসলে আমরা একই। এ-কথা স্বীকার করতে আমি এতটুকু ভয় পাচ্ছি না। এতেই বোঝা যাচ্ছে আমার চিন্তা কীরকম সুষম পথে চলেছে। কী সুন্দর গুছিয়ে ভাবতে শিখেছি আমি। কিন্তু আমার লেখার ধরনটা হঠাৎ পালটে গেল কেন? সে কি ওই ঘটনার খুঁটিনাটি মনে আনতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছি বলে? না কি সেই ভয়ঙ্কর অমানুষটা ক্রমশ আমার শরীর ও মনের কাছাকাছি এগিয়ে আসছে, এবং আমিও ওটার দিকে এগিয়ে চলেছি? অথবা নিছকই লেখার সুবিধের জন্যে? কারণ যাই হোক না কেন, লক্ষণটা খারাপ নয়, ভালো। এতে অস্বীকারের গোঁয়ার্তুমির চেয়ে সততা বেশি দেখা যাচ্ছে। অবশ্য সে-রাতটা এক অস্বাভাবিক রাত ছিল…এক বিস্ময়কর রাত…পাতালঘরের ভয়ঙ্কর রাতগুলোর চেয়ে ওই রাতের স্মৃতি যে অন্যভাবে মনে পড়বে, এতে আর আশ্চর্য কী! এখন ধৈর্য ধরে দেখতে হবে পাতালঘরে এ-রাতটা কেমন যায় : বন্দি রাত। ডায়েরিটা তখন সঙ্গে করে নিয়ে যাব। এবারে প্রচুর সময় হাতে নিয়ে যেতে হবে। বাইরে থাকার ঝুঁকি আর নেব না। নতুন কোনও দুর্ঘটনাকে আর কখনও প্রশ্রয় দেব না। কিন্তু…এখন ঠিক বুঝতে পারছি না সে-রাতে বাইরে থেকে খারাপ হয়েছে না ভালো হয়েছে। হয়তো ভালোই হয়েছে। কথাটা নির্মম মনে হলেও আমি নিরুপায়। বাস্তব সব সময়েই নির্মম। আর যদি কেউ ভেবে দেখে যে, কত নিষ্পাপ তরুণকে ওই মেয়েটা নষ্ট করত, কীভাবে তাদের ঠেলে দিত পাপ, অন্যায় আর ধ্বংসের পথে হ্যাঁ, তাহলে হয়তো বলা যায়, অনেক ভালো মানুষকে আমি রক্ষা করেছি। আর মেয়েটার মরে গিয়ে ভালোই হয়েছে। ওর বেঁচে থাকার কোনও প্রয়োজন ছিল না। বয়েসে কম হলেও পাপের ভারে ও বৃদ্ধা। দুশ্চরিত্র কলুষিত জীবন নিয়ে বেঁচে থেকে ও মোটেই সুখী হত না…।

ওই ঘটনার পরের দিন আমি সত্যি-সত্যি আত্মহত্যার কথা ভাবলাম কী করে! তখন মনে আবেগ বেশি ছিল, তাই স্বভাববিরুদ্ধ আচরণ করেছি। কিন্তু এখন সব ঠিক আছে। অনেক—অনেকদিন পরে গত দুটো সপ্তাহ ভীষণ ভালোভাবে কেটেছে। এর কারণ বলা মুশকিল, তবে ব্যাপারটা যেন অনেকটা, আমি কোনও কাজে সফল হয়েছি…যেন হঠাৎই কিছু পেয়েছি, অনেক দিন ধরে মনের অজান্তে যে জিনিসটা আমি খুঁজছিলাম যেন হঠাৎই সেটা আমার হাতে এসে গেছে। অথচ তবুও কোনও পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি না। কী পেলাম তা জানি না। সেটা চোখেও দেখতে পাচ্ছি না। নিশ্চয়ই জিনিসটা অদৃশ্য, অস্পৃশ্য—হয়তো আমার মনের কোনও হতাশা—যার অস্তিত্ব আছে বলে জানতাম না—চিরকালের মতো দূরে সরে গেছে। হয়তো সেই রাতের ঘটনার আঘাতে আমার মনের আড়াল আবরণ চুরমার হয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই এরকমই কিছু একটা হয়ে থাকবে। মনের চিন্তাভাবনা আবেগের পথ ধরে আমি ঠিকঠাক এগোতে পারছি না, তবে সেটা অনুভব করতে পারছি। এ কোনও নতুন অনুভূতি নয়, এ আমার তৃপ্তিকে এক নতুন গভীরতায় পৌঁছে দিয়েছে। মনে পড়ে, ছোটবেলায় এরকম হত। আমার সুন্দর আদরের খেলনাটা যখন ভেঙে ফেলি, তখন অনেকটা এরকম লেগেছিল। যে-নৃশংস কুকুরটা আমাকে আক্রমণ করেছিল, তাকে মেরে ফেলার সময়ও এরকম হয়েছিল। এ বড় অদ্ভুত ব্যাপার। সবচেয়ে আশ্চর্য হল, তিন-তিনটে বিচ্ছিন্ন ঘটনা কী করে একই অনুভূতির জন্ম দেয়! আমার ভারি অবাক লাগছে…।

২৮ জুলাই

দিনটা এগিয়ে আসছে। আমি একেবারে নির্বিকার। আমার শরীর পুরোপুরি সুস্থ, মনও পরিষ্কার। আমি পবিত্র জীবন যাপন করি। তা সত্ত্বেও যদি আমাকে একটা রাত কষ্ট পেতে হয় তাহলে সে নিয়ে অনুযোগ করার কিছু নেই। শুধু আমার বউ যদি এরকম অদ্ভুত ব্যবহার করাটা বন্ধ করত! সারাটা মাস ওকে বড় বেশি দূরের মানুষ বলে মনে হয়েছে। হয়তো খবরের কাগজের মিথ্যে খবরগুলোর কিছু-কিছু বিশ্বাস করে ও আমার ওপর রাগ করে থাকবে। কিন্তু সে-কথা ও মুখে বলেনি। ওই ব্যাপারে একটা কথা পর্যন্ত উচ্চারণ করেনি। খবরটা এখন আর প্রথম পাতায় নেই, নতুন কেচ্ছাকাহিনি, মিথ্যে গপ্পো তার জায়গা নিয়েছে। কিন্তু প্রতিদিনই ভেতরের পাতায় ছোট্ট করে এক প্যারায় প্রকাশিত হচ্ছে পুলিশী তদন্তের অগ্রগতির কাহিনি। প্রত্যেকদিনই ওরা বলে, অপরাধী গ্রেপ্তার হল বলে! আমার হাসি পায়। ভগবান করুন, ওরা যেন কোনও নির্দোষ ছাপোষা লোককে গ্রেপ্তার না করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার বিশ্বাস, যদি ওরা কাউকে গ্রেপ্তার করে, তাহলে সে কোনও দাগী বিকৃতকাম অপরাধী হবে এবং সে হয়তো আমার অপরাধের চেয়েও বড় কোনও অপরাধের জন্যে দায়ী—সুতরাং আমার দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই! ভুল পাপে শাস্তি পেলে কোনও অবিচার হয় না, যদি সে-পাপী অন্য কোনও পাপ করে থাকে। আর আমার কথা যদি ওঠে বা সেই লোকটির, যে লাইব্রেরিয়ানকে খুন করেছে…তাহলে বলব, কোনও অন্যায় হয়েছে বলে আমি মনে করি না।

২৯ জুলাই

বিকেলে বেড়াতে বেরিয়ে যখন ফিরে আসছি দেখি একজন মিস্ত্রি আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে। বাইরে একটা লরি দাঁড়িয়ে ছিল। লরিটা যেন আমার খুব চেনা। পাতালঘর তৈরির সময় এই লরিতেই কি মালপত্র ইট-সিমেন্ট সব এসেছিল। কিন্তু মিস্ত্রিটাকে চিনতে পারলাম না। হয়তো নতুন কোনও লোক। তন্দ্রাকে এ-বিষয়ে প্রশ্ন করতেই ও চমকে উঠল, তারপর অস্বীকার করে বলে উঠল, ‘না তো, কেউ তো আসেনি।’

প্রথমে কৌতূহল হল। তারপর ভাবলাম, ও আমার প্রতি অবিশ্বাসী হয়ে উঠছে না তো? নইলে চমকে উঠে এত নাভার্স হয়ে পড়বে কেন? কিন্তু এ-চিত্তা ভয়ঙ্কর। এ-ভাবনা মনে আনা আমার উচিত হয়নি। এ-জিনিস চিন্তা করাও পাপ। আসল ব্যাপারটা যে কী সেটা এখন অনুমান করতে পারছি। নিশ্চয়ই পাতালঘরটাকে আরও আরামের করে তোলার জন্যে নতুন কিছু ও করে থাকবে। হয়তো নতুন গদি লাগিয়েছে আরও পুরু করে, অথবা লাগিয়েছে বেশি পাওয়ারের আলো। এ ছাড়া আর কী হতে পারে জানি না। হয়তো তন্দ্রা আমাকে চমকে দিতে চায়, তাই এখন কিছু বলছে না। ওর ধারণা, পাতালঘরে গিয়ে সেটা হঠাৎ দেখলে আমি ভীষণ খুশি হব। বলা যায় না, হতেও পারি। মিস্ত্রিটা যদি পাতালঘরে গিয়ে থাকে তাহলে দেওয়ালে গদি লাগানোর একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ তন্দ্রা তাকে গুছিয়ে বলতে পেরেছে তো? বোকাসোকা রাজমিস্ত্রিরাও সময়ে সময়ে চালাক হয়ে ওঠে, সব বুঝতে পারে। আমার ধারণা, ওদের অনেকে হয়তো খবরের কাগজও পড়ে। সে যাই হোক, নিজেদের ঘরের দেওয়ালে গদি লাগাব, এতে কার কী বলার থাকতে পারে? আমাদের খুশি, তাই লাগিয়েছি।

এখন আবার ভাবছি, লোকটা পাতালঘরের দরজায় আরও জবরদস্ত তালা লাগাতে আসেনি তো? তন্দ্রাকে ক’দিন ধরে বড় অদ্ভুত লাগছে…যেন অনেক দূরের মানুষ। সম্ভবত ও ভয় পেয়ে থাকবে। বেচারা! এরকমটা কেন হয়েছে বেশ বুঝতে পারছি। ওর সঙ্গে আরও মিষ্টি ব্যবহার আমাকে করতে হবে, ক্ষমা করতে হবে ওর দুর্বলতা। ওকে ভালোবাসার কোনও প্রমাণ দেওয়া প্রয়োজন। দেখি, আজ রাতে ওর ঘরে যাব।

ওর সঙ্গে শোব। আমি গেলে ও বরাবরই খুশি হয়, চোখেমুখে ফুটে ওঠে কৃতজ্ঞতার ছাপ। ওর কাছে যাইনি আজ অনেক দিন। কিন্তু সে ওর দোষ। ও আমাকে হাবভাবে এটা কখনও জানায় না। জানে না, আমি এসব যা করি সব ওরই সুখের জন্যে। হয়তো ও ভাবছে, যতটা সম্ভব এসব কামনা-বাসনা এড়িয়ে চলাই ভালো…।

৩০ জুলাই

তন্দ্রা ভীষণ পালটে গেছে।

মেয়েমানুষের মনের হদিস কে বুঝতে পারে?

সবচেয়ে সরল ও নির্বোধ মেয়েরও মনের গভীরতার তল পাওয়া যায় না। আমার ধারণা, অন্তর্দৃষ্টির ব্যাপারে কোনও মানুষের চেয়ে আমি কম নই। আমার যুক্তিবাদী মন যে-কোনও যুক্তিবাদী গভীরতা পরিমাপ করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তন্দ্রার ব্যবহারে এতটা পরিবর্তন কী কারণে এল তা আমি তলিয়ে উঠতে পারছি না। বেশ কিছুদিন ধরে এটা লক্ষ করছি, কিন্তু কাল রাতে ব্যাপারস্যাপার চরমে পৌঁছেছে। হয়তো কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই এরকমটা হচ্ছে। হয়তো স্ত্রী-মনের অণু-পরমাণুর গতি এরকমই চঞ্চল, বিক্ষিপ্ত, অস্থির। এ কথা ভাবতেও আমার খারাপ লাগছে। আমি নিয়মবদ্ধ সুশৃঙ্খল জীবন পছন্দ করি। তা বলে অন্যান্য সম্ভাবনাকেও অস্বীকার করি না। বরং খোলা মনে মেনে নিই। খোলা মন না থাকলে আমার মতো পরিস্থিতিতে কোনও মানুষ বাঁচতে পারে না। যদি জানতে পারি যে, এ ধরনের অসুখ নিয়ে মানসিক ভারসাম্য একমাত্র আমিই বজায় রাখতে পেরেছি, তাহলে এতটুকুও অবাক হব না। হয়তো এ-উক্তির কোনও মূল্য নেই, কিন্তু তবুও মূলধন করার জন্যে নিজের নৈতিক উৎকর্ষগুলো কোনও মানুষের জানা দরকার। অহঙ্কারকে আমি কখনও প্রশ্রয় দিই না।

গত রাতে ওর ঘরে গিয়েছিলাম। ও সকাল-সকাল শুয়ে পড়েছিল। তার একটু পরেই ঠিক করলাম, ওর ঘরে যাই। কিন্তু সবই অন্যরকম ঠেকল। ওর ঘরের দরজা খুলতেই চকিতে উঠে বসল তন্দ্রা : গায়ের চাদরটা গলার কাছে আঁকড়ে ধরা, বিস্ফারিত দু-চোখ আমারই দিকে তাকিয়ে। যেন অন্ধকারে শুয়ে ও এই মুহূর্তটারই প্রতীক্ষা করছিল। ভাবছিল, কখন আমি আসব। এতেই আমার অবাক লেগেছে। আর যেভাবে ও আমার দিকে তাকিয়ে ছিল…হ্যাঁ, অস্বীকার করব না, সে-চাউনি উলঙ্গ আতঙ্কের। ওর গায়ে হাত রাখতেই ও কুঁকড়ে গেল। কোনও কথা না বললেও ওর শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল, ওর হাত খুঁজতে লাগল আমার মুখ। ওর মুখের অভিব্যক্তিতে, চোখের চাউনিতে আমার ঘেন্না হল। যেন ও ভাবছে এ রাতটাই আমার অসুখের রাত। হয়তো দিনক্ষণের হিসেব ও হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু এটা তো ওর জানা উচিত যে, দিনের হিসেবে আমার কোনও ভুল হবে না! আমার বউ কেন আমাকে ভয় পাবে? এ কি খবরের কাগজের সেই নৃশংস মিথ্যে গল্পগুলোর পরিণাম? না কি পরিস্থিতির চাপে ও ভেঙে পড়েছে? আমার প্রতি সহানুভূতিতে আমার সঙ্গে তন্দ্রাও হয়তো কষ্ট পাচ্ছে? না, এ একেবারে অসম্ভব নয়। আমার পাতালঘরে যাওয়ার রাতটা এগিয়ে এলে ওকে দেখে সত্যি একটু অন্যরকম মনে হয়। শুনেছি ভালোবাসার মানুষের জন্যে অনেকে কষ্ট পায়। এমনও শোনা গেছে, স্ত্রী সন্তানসম্ভবা হলে স্বামী প্রসব বেদনা অনুভব করে। এটাও হয়তো অনেকটা সেইরকম। এ-কথা ভাবতেই আমার ভালো লাগছে, কারণ তন্দ্রা আমাকে ভয় পায়—এ-চিন্তা মনে আনতেও আমার কষ্ট হয়।

আমাদের বিয়ের প্রথম-প্রথম তন্দ্রা আমাকে ভীষণ ভালোবাসত। এমনকী আদর সোহাগও করত। সে-আদর-ভালোবাসা ছিল বলগাহীন, উত্তাল। সত্যি বলতে কী, সংযমী হওয়ার জন্যে ওকে কয়েকবার মুখ ফুটে পর্যন্ত আমি অনুরোধ করেছি। ইন্দ্ৰিয়গত মাৎসর্যে নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়া কোনও মেয়ের পক্ষেই ঠিক নয়। সঠিক জানি না, ইন্দ্রিয়গত মিলনে সুখ-তৃপ্তি অনুভব করাটা পাপ কিনা, তবে তাতে গা ভাসিয়ে দেওয়া নিশ্চয়ই পাপ। একবার তন্দ্রা চেষ্টা করেছিল বিবাহজনিত সম্পর্কে প্রধান ভূমিকা নিতে। কয়েকবার সরাসরি এসে আমাকে জিগ্যেস করেছিল আমি ওর সঙ্গে এখন শুতে যাব কিনা। এ নিয়ে ওকে কঠোরভাবে এক বক্তৃতা দিয়েছি। সত্যি, ওকে দোষ দেওয়া যায় না। ও তো নিষ্পাপ, অনভিজ্ঞ—বুঝতে পারে না ওর আচরণে দোষটা কোথায়। ওর অতিরিক্ত কামনা, উলঙ্গ তৃষ্ণা দিয়ে ও আমাকেই খুশি করতে চেয়েছিল। মনে হয়, সত্যিকারের একজন তরুণীর এটুকু বোঝা উচিত যে, এটা পাপ। কিন্তু আমি বিচার করার কে? নিজেকে নীতিবাগীশ বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা কখনও আমি করিনি। আমি শুধুই একজন নীতিবাদী মানুষ, জীবনযাপনের প্রকৃত পথ সবাইকে দেখানোর চেষ্টা করি। তন্দ্রার প্রতি ব্যবহারে একটু কঠোর আমাকে হতে হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সে ওর ভালোর জন্যেই।

গত রাতের ব্যাপারটা অবশ্য একেবারে অন্যরকম। ওর মধ্যে এতটুকু ইচ্ছে কিংবা আকুতি দেখিনি। সবকিছু হয়ে যাওয়ার পর যখন আমি চলে আসছি, তখন ও যেন খুশি হল, স্বস্তি পেল। তার আগে সারাটা সময় ও শুয়ে শুয়ে চোখ তুলে অদ্ভুত ভাবে চেয়ে থেকেছে আমার মুখের দিকে। এতে ভীষণ অস্বস্তি লাগছিল। স্বামীর দায়িত্ব পালনের সময় কখনওই আমি ঠিক সহজ হতে পারি না, স্বস্তি পাই না। কিন্তু এ আরও খারাপ। একে ঠিক…অস্বস্তি বলা যায় না, কিন্তু অন্য কোনও প্রতিশব্দও আমার জানা নেই। যেন ক্রমে বেড়ে ওঠা এক বিপজ্জনক অনুভূতি। ও যেন আমার দিকে এমন করে আর না তাকায়! ভয়, ত্রাসের মধ্যে কী যেন একটা আছে…জানি না সে কী…এতে মনে হয় কল্পনায় ভেসে ওঠে… অস্পষ্ট সব ছবি। সঠিক বুঝিয়ে বলা মুশকিল। আমার মনের শান্ত পরদার ঠিক নীচেই যেন গুড়ি মেরে লুকিয়ে থাকে অস্পষ্ট, অনিশ্চিত সব ইচ্ছে—ঝাপসা, নোংরা, অন্ধকার। এবং কোনও কারণে নৃশংস, ভয়ঙ্কর। পরদায় ঢাকা বিভিন্ন ছবি। এর চেয়ে ভালোভাবে আর বলতে পারব না।

৩১ জুলাই

বরাবরের মতো ভয় ও বিরক্তি নিয়ে আগামীকালের প্রতীক্ষায় আছি, অবশ্য সঙ্গে একটু কৌতূহলও হচ্ছে। জানতে ইচ্ছে করছে, অসুখটার ওপর গত মাসের প্রভাব কতটা পড়েছে। গোটা জুলাই মাসটা এত শান্তিতে কেটেছে। নিজের সঙ্গে অনেক ভালোভাবে আমি বোঝাপড়া করতে শিখেছি। সুতরাং অসুখটায় যদি সত্যিই কোনও পরিবর্তন দেখতে পাই তাহলে আমি এতটুকু অবাক হব না। ওটার রাসায়নিক গঠনে পরিবর্তন নিয়ে আসতে গত মাসটা হয়তো অনুঘটকের কাজ করে থাকবে হয়তো ভালোর দিকেই। যাই হোক না কেন, আমার ধারণা, সে পরিবর্তন আমি নির্বিকারভাবে মেনে নিতে পারব।

তন্দ্রাকে যদি এতটা অস্বাভাবিক বা দূরে-দূরে মনে না হত তাহলে ওকে হয়তো আগ্রহ নিয়েই আমার আশা ও অনুমানের কথা বলতাম। তবে এখন বলাটা বোধহয় ঠিক হবে না, অন্তত যতক্ষণ না আমি নিজে জানতে পারছি। মিথ্যে আশা-আনন্দ জাগিয়ে কোনও লাভ নেই। আজ সকালেও ও বড় অদ্ভুত ব্যবহার করল। রুমালটা বসবার ঘরে ফেলে এসেছিলাম। সেটা আনতে গেছি, নজরে পড়ল তন্দ্রা আড়ালে থেকে লুকিয়ে-লুকিয়ে আমাকে দেখছে। শুধু ওর কপাল ও কাজল-কালো চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। চকিতে ও সরে গেল।

এগিয়ে গেলাম ওর কাছে। জিগ্যেস করলাম, ‘কী ব্যাপার, তন্দ্রা? কী খুঁজছ?’

‘না—মানে, কিছু না—’ তারপর কী ভেবে ও বলল, ‘তুমি কি এখন ওই ঘরে যাচ্ছ?’

অবাক হলাম।

‘কোন ঘরে?’

তন্দ্রা চোখ নামাল। অস্ফুট কণ্ঠে বলল, ‘ইয়ে পাতালঘরে…’

ওর অভিব্যক্তি আমাকে আগেই জানিয়ে দিয়েছিল ও কী বলতে চায়। বিরক্তি ও রাগে উত্তর দিলাম, ‘হঠাৎ এ-কথা মনে হওয়ার কারণ?’

আশ্চর্য! এ-কথা হঠাৎ ও ভাবছে কেন? ও তো জানে, পাতালঘরটাকে আমি কী অসম্ভব ঘৃণা করি। নিতান্ত প্রয়োজন না পড়লে সেখানে আমি যাই না। সুতরাং নিশ্চুপ তন্দ্রার দিকে তাকিয়ে কঠোর স্বরে বললাম, ‘তুমি জানো না, নেহাত দরকার না পড়লে আমি ওখানে যাই না?’

ও যেন একটু আশ্বস্ত হল।

দিনটা যত কাছে এগিয়ে আসছে ওর মানসিক চাপ তত বেড়ে উঠছে। হয়তো ভয় পেয়ে ভাবছে, সময় হওয়ার আগেই অসুখটা শুরু হতে পারে। আমাকে হয়তো পাতালঘরে আরও বেশি সময় কাটাতে হতে পারে—এক রাতের জায়গায় দু-রাত। দু-রাত! ঈশ্বর করুন, তা যেন কোনওদিন না হয়।

বুঝতে পারছি, তন্দ্রা কেন এত চিন্তিত হয়ে পড়ছে। ও যে আমাকে ভালোবাসে এ তারই একটা প্রমাণ। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও প্রমাণিত হয়, আমার অসুখটাকে ও একেবারেই বুঝে উঠতে পারেনি। এ আমারই দুর্ভাগ্য।

১ আগস্ট

শরীরে শক্তি আমার টগবগ করে ফুটছে। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর অনেকটা পথ চটপট হেঁটে এসেছি। একটা খোলা মাঠে বাচ্চাদের খেলতে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। ওদের বাঁচার উৎসাহের অংশ নিতে চেয়েছি। তখনই মনে পড়ল, আমার কখনও ছেলেমেয়ে হবে না। কোনও সন্তানকে পৃথিবীতে আনতে আমি পারব না। পারব না এ ভয়ঙ্কর অভিশাপের বোঝা তাদের মাথায় তুলে দিতে। ভীষণ দুঃখ পেলাম। বাচ্চাগুলো আনন্দ খুশিতে এত প্রাণবন্ত, এত উচ্ছল যে, ভাবতে কষ্ট হয়, প্রকৃতির নিয়মে ওদেরও বড় হতে হবে, মুখোমুখি হতে হবে জীবনের জটিল সমস্যার। আমার ছোটবেলাটা সুখের ছিল না। অন্তত আমার তা মনে পড়ে না—অবশ্য দু-একটা বিশেষ ঘটনা ছাড়া। তা বলে অন্য কাউকে আমি হিংসে করি না, কারণ আমার শৈশব আমাকে পৌঁছে দিয়েছে সত্যিকারের পৌরুষের দিকে। আমার গোটা অতীত জীবনটার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলতে পারি, এমন কোনও কাজ আমি কখনও করিনি যার জন্যে আজও আমার দুঃখ হয়। যা কিছু আমার দুঃখ, সব অন্য কারণে। যে-কারণ আমার সৃষ্টিরও আগে নিহিত। যদি কেউ নিজের জীবনধারাকে এক অবিচ্ছিন্ন অব্যাহত রেখায় দেখতে পায়, যাতে কোনও জটিলতা নেই, কোনও কলঙ্ক নেই, কোনও লজ্জা নেই, যেমনটি সে চেয়েছিল ঠিক তেমনটি, তাহলে সেটা হল তার জীবনের চরম শান্তি।

আজ রাতের দিকে উন্মুখ হয়ে চেয়ে আছি। কখন পরিবর্তনটা আসবে। আমার স্থির বিশ্বাস, আজ একটা না একটা উন্নতির লক্ষণ দেখবই…না কি আমি জানি যে, উন্নতির কোনও প্রয়োজন নেই, যতটা ভাবতাম আমার অসুখ ততটা খারাপ নয়! আশা করি ওই অমানুষটার মনোভাবও আমারই মতো স্থির, শান্ত থাকবে।

থাকবে কিনা সেটা জানা যাবে আজ রাতে। পাতালঘরে।

১ আগস্ট, রাত

যাক, দরজায় খিল দেওয়া হয়েছে। তন্দ্রা ওপরে চলে গেছে। পাতালঘরে আমি একা। তন্দ্রা আমার সঙ্গে আজ খুব মিষ্টি ব্যবহার করেছে। যেসব খাবার আমি ভালোবাসি বেছে বেছে সেগুলো রান্না করেছে। আর খাওয়ার সময় আমার সামনে বসে এ-কথা সে-কথা নিয়ে শুধু বকবক করে গেছে। খুশিতে মুখ উজ্জ্বল। সম্ভবত ও চেষ্টা করেছে আমার মনটাকে অন্যদিকে নিয়ে যেতে, পাতালঘর থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে। ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে ওর এই অবুঝ চেষ্টার প্রশংসা করতে হয়। সুতরাং ওকে নিশ্চিন্ত করে হাতে প্রচুর সময় নিয়ে নীচে নেমে এলাম। ভেবেছিলাম ও হয়তো নাভার্স হয়ে পড়বে, ভয় পাবে, তাই ওকে সঙ্গে না নিয়েই আমি চলে এসেছি পাতালঘরে। ওর আতঙ্কবিকৃত মুখ আমি সামনাসামনি দাঁড়িয়ে দেখতে পারব না। জানি একটু পরেই ও নেমে আসবে। বাইরে থেকে খিল দিয়ে দেবে দরজায়। সত্যিই তাই হল। আমি নেমে আসার প্রায় মিনিটপাঁচেক পর ও এল। দরজায় খিল দিয়ে ফিরে গেল ওপরে।

পাতালঘরে নতুন কিছু চোখে পড়ল না। কিন্তু ভেবেছিলাম, নতুন কিছু অবশ্যই দেখতে পাব। তন্দ্রা হয়তো মিস্ত্রি দিয়ে সে-কাজ করিয়ে থাকবে। কিন্তু কই? তালাও সেই একই আছে। দেওয়ালের গদিও সেই একই জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া। হয়তো মিস্ত্রি ডেকে ও ঘর সারাবার এবং গদি সারাবার হিসেব নিতে চেয়েছিল। হয়তো পরের মাসে সারাইয়ের কাজ হবে। ভাবছি একটা বেশি পাওয়ারের আলো ঘরে লাগালে ভালো হত। এই আলোতে ডায়েরি লিখতে বেশ কষ্ট হয়। বিশেষ করে ঘরের কোণে আলো প্রায় পৌঁছয় না। যদি…।

এইমাত্র একটা ভয়ঙ্কর জিনিস আমার নজরে পড়েছে। এর মানে বুঝতে আমি হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি। একটা ঠান্ডা ইস্পাতের ছুরি যেন আমার শিরদাঁড়া কেটে নেমে যাচ্ছে। শরীরের মাংস জমাট বেঁধে গেছে বরফে। একটু আগেও লিখছিলাম। লিখতে-লিখতে হঠাৎ চোখ পড়েছে দেওয়ালে, আর…দেওয়ালে একটা ফুটো রয়েছে! ছোট্ট ফুটো। প্রথমটায় আমার চোখে পড়েনি। ছোট হলেও একজনের দেখবার পক্ষে যথেষ্ট…অন্তত পাতালঘরটুকু দেখবার পক্ষে। ফুটোটা আগে ছিল না। তাছাড়া মেঝেতে এখনও সিমেন্ট বালির গুঁড়ো পড়ে রয়েছে। সুতরাং বুঝতে অসুবিধে নেই যে, ফুটোটা নতুন করা হয়েছে। হয়তো এইজন্যেই সে-মিস্ত্রিটা এসেছিল। কিন্তু দেওয়ালে ফুটো করিয়ে তন্দ্রার কী লাভ? ওকে কি ভূতে পেয়েছে? এরকম নিষ্ঠুর অমানুষিক কাজ ও করবে কেন? নিশ্চয়ই ও পাগল হয়ে গেছে। পরিবর্তন হওয়ার পর ও নিশ্চয়ই পাতালঘরে উঁকি মেরে দেখবে! কিন্তু সে দেখে ওর লাভ কী? এ আমি বিশ্বাস পর্যন্ত করতে পারছি না। তন্দ্রা! তন্দ্রা পারল এমন নৃশংস পাশবিক কাজ করতে! ও আমাকে দেখবে…পালটে যেতে দেখবে…মানুষ থেকে একটা অমানুষে…এ আমি ভাবতেও পারছি না। যে-দেওয়ালে ফুটোটা আছে এখন আমি সেখানে উবু হয়ে মাথা নিচু করে বসে আছি। জানি, ফুটো দিয়ে এখন আমাকে দেখা যাবে না, কিন্তু পরে কী করব? পরিবর্তন হয়ে যাওয়ার পর? ওটার তো এত বুদ্ধিসুদ্ধি নেই, বুদ্ধিসুদ্ধির পরোয়াও করে না। সে কি তখন পারবে এই দরজার কাছে গুড়ি মেরে তন্দ্রার দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে থাকতে? একবার ভেবেছিলাম গায়ের জামাটা খুলে ফুটোতে গুঁজে দেব, কিন্তু ভয় হয় অসুখের মধ্যে ভয়ঙ্কর দাপাদাপির সময় জামাটা হয়তো ছিন্নভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়বে মেঝেতে। কিংবা তন্দ্ৰা হয়তো কোনও কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে জামাটা ফেলে দেবে ঘরের ভেতর। আমার কিছুই করার নেই। আমাকে ও দেখবেই!

ভয়ে, আশঙ্কায় আমার শরীর খারাপ লাগছে। ভীষণ বমি পাচ্ছে। মাথাও ঘুরছে। তন্দ্রা আমার সঙ্গে কেন এমন করছে? এ কি নিছকই অসুস্থ কৌতূহল? ওর মনে এমন কি কোনও বিকৃতি আছে যা আমার আগে নজরে পড়েনি? না কি এখনও ও আমাকে অবিশ্বাস করে? তাই প্রমাণ চায় যে, আমি পাগল নই—এ সবই আমার কল্পনা নয়, সত্যি। জানি না। ও আমাকে ধীরে-ধীরে পালটে যেতে দেখবে এ সাঙ্ঘাতিক চিন্তা আমি মনেও আনতে পারছি না। ভগবান জানেন, দেখার পর ওর মনের অবস্থা কী হবে! আমার একমাত্র কামনা, ও যেন এটাকে অসুখ বলে বুঝতে পারে, সত্যের মুখোমুখি হয়ে ও যেন পাগল না হয়ে যায়। কিন্তু ওর মন তেমন শক্ত নয়, আর আমার ভয় হচ্ছে…আমাকে অন্য চেহারায় দেখার সময় অন্যান্যদের চোখের দৃষ্টি আমার স্পষ্ট মনে আছে। ওই সেলসম্যান লোকটা, মাতালটা, মেয়েটা…ওদের মুখে ফুটে উঠেছিল বিকৃত মানসিকতার ছায়া। আর তন্দ্রার সেরকম মনের জোর কোথায়? স্বাভাবিক অবস্থাতেই দেখেছি আমার দিকে চেয়ে ওর চোখের পাতায় উলঙ্গ আতঙ্ক থরথর করে কাঁপছে। খবরের কাগজে মৃতদেহ ছিন্নভিন্ন করার, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন করার ওই মিথ্যে গল্পগুলো পড়ার পর…সে-রাতে বিছানায়…ওর চোখেমুখে ছিল আতঙ্ক…মুখ চাঁদের মতোই চকচকে সাদা…কাঁপছে, বিকৃত হয়ে চেনা চেহারা পালটাচ্ছে অতি ধীরে…আর অবশেষে আমি দেখতে পাচ্ছি শুধু নগ্ন আতঙ্ক। অন্যান্য অভিব্যক্তি মিলিয়ে গেছে কোন অতলে…আমি তাকিয়ে থাকি…মনে হয়…খালি মনে হয় এ-আতঙ্ককে বাঁচতে দেওয়া ঠিক নয়…একে বিনাশ করতে হবে…স্বাভাবিক হওয়ার পর কী করে আমি ওর মুখোমুখি দাঁড়াব…যখন…।

ওপরের দরজা বন্ধ করার শব্দ পেলাম।

মনে হয় তন্দ্রা সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে। নেমে আসছে পাতালঘরে আমাকে দেখতে…।

২ আগস্ট?

মনে হয় সকাল হয়েছে। এখন ঠিক আছি—যদিও খুব ক্লান্ত। আমার জামাকাপড় ছিঁড়ে টুকরো-টুকরো। শিগগিরই তন্দ্রা দরজা খুলতে নেমে আসবে। গত রাতের পর কী করে ও আমার মুখোমুখি হবে?

ওকে কত করে চলে যেতে বলেছি কিন্তু ও আমার কথার উত্তর পর্যন্ত দেয়নি, শুধু পাতালঘরের ভেতরে চোখ রেখে অপেক্ষা করেছে। উত্তেজিত থাকার ফলে অসুখটা সময়ের আগেই শুরু হয়ে গেছে, এবং সমস্ত সংযম আমি হারিয়ে ফেলেছি। ও স-ব দেখেছে। ওকে আমি ঘেন্না করি। ও যা করেছে তার কোনও ক্ষমা নেই। রাগে, লজ্জায়, ঘেন্নায় আমার শরীরে আগুন জ্বলছে। যখন ও দরজা খুলবে তখন আমাকে ভীষণ শান্ত সংযত থাকতে হবে। নইলে হয়তো ওর গায়ে হাত তুলে বসব। হাত তোলাই উচিত। আরও খারাপ শাস্তি ওকে দেওয়া উচিত। ও যা অন্যায় করেছে তাতে কোনও শাস্তিই যথেষ্ট নয়। ওর জন্যেই অসুখটা কাল আরও খারাপের দিকে গেছে। স্পষ্ট মনে আছে, আমি গর্জে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়েছি দেওয়াল থেকে দেওয়ালে, চেয়েছি দাঁতে নখে সব কিছু ছিন্নভিন্ন করে পাতালঘর থেকে মুক্তি পেতে, চেষ্টা করেছি ফুটোটাকে ছিঁড়েখুঁড়ে একাকার করে দিতে, আর সারাটাক্ষণ তন্দ্রা দাঁড়িয়ে ছিল ফুটোটার কাছে, অবিনাশী দেওয়ালের ওপাশে। দেখছিল পাতালঘরের প্রতিটি ঘটনা। ও একটা পিশাচ, ডাইনি, শয়তান! ভাষায় ওকে বর্ণনা করা যায় না…।

২ আগস্ট?

আজ তারিখ কত, জানি না। সময় বোঝারও কোনও উপায় নেই। মনে হয় যেন এক যুগ কেটে গেছে। এই ডায়েরি নিয়ে আর মাথা ঘামাচ্ছি না। কারণ এখন ডায়েরি লেখা অনর্থক। পেনের কালিও শেষ হয়ে এসেছে। আলোটাও হয়ে এসেছে ক্ষীণ, নিষ্প্রভ। হয়তো একটু পরেই সব অন্ধকার হয়ে যাবে। শরীরের রক্ত দিয়ে হয়তো এই ডায়েরি লেখা যাবে, কিন্তু সে-কষ্ট স্বীকারে কোনও লাভ আছে বলে মনে হয় না…রক্ত আমার একটুও ভালো লাগে না। রক্ত আমাকে বহু স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। এখনও, কিছু একটা লিখতে হবে, এই চিন্তাটা আমার মন জুড়ে রয়েছে। পাগল হয়ে যাওয়ার পথে এ এক প্রতিবন্ধক, আমার বন্ধু। খিদে তেষ্টা আমি সইতে পারি, কিন্তু মানসিক সুস্থতা হারিয়ে আমি বাঁচতে পারব না।

এখনও বুঝতে পারছি না তন্দ্রা কেন আমার সঙ্গে এমনটা করল। ওর প্রতি এতটুকুও রাগ আমার নেই, কেন জানি না। কখনও-সখনও ও নেমে এসে উঁকি মারে এই পাতালঘরে। দিনে একবার, সপ্তাহে একবার… কী জানি? আমার কাছে কোনও তফাত নেই। কখনও কোনও কথা ও বলে না। কথা বললে তার উত্তরও দেয় না। কখনও-কখনও এক অদ্ভুত শব্দ করে ও, অনেকটা যেন খলখল হাসির শব্দ। ও কি পাগল হয়ে গেছে? যখন ওকে অনুনয় বিনয় করি ও চলে যায়…।

?

ভীষণ খিদে পাচ্ছে।

দেওয়াল থেকে গদিগুলো ছিঁড়ে খেতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। উলটে তেষ্টা আরও বেড়েছে। আলোটা এখন একেবারে নিভু-নিভু। ওটার ঠিক নীচে দাঁড়িয়ে কোনওরকমে লিখতে পারছি। চোখের নজরও ঝাপসা হয়ে এসেছে। শরীর দুর্বল, মাথা ঝিমঝিম করছে। আর বেশি লিখতে পারব বলে মনে হয় না।

এখন বুঝেছি, এখানেই আমাকে মরতে হবে। তার জন্যে আমার কোনও দুশ্চিন্তা নেই। আমি মারা যাব ঠিক, তবে নিজের দোষে নয়। এটুকুই আমার সান্ত্বনা। এ পরিণতির জন্যে আমি দায়ী নই। যেমন আমার জীবনের যত দুঃখ যত কষ্ট সবকিছুর জন্যে দায়ী আমার পূর্বপুরুষদের পাপ। আমি নির্দোষ। আর এখন আমি মরতে চলেছি আমার স্ত্রীর পাগলামির শিকার হয়ে। এ অন্যায়, তবে ভালোই হয়েছে। এখন শুয়ে পড়ব। আর কিছু বোধহয় লেখার নেই।

বুঝতে পারছি রাত হয়েছে। কামড় বসিয়ে দিলাম হাতে…।

এখানেই ডায়েরি শেষ। অবশ্য এর পরের কয়েকটা পাতায় কিছু অসংলগ্ন দুর্বোধ্য আঁচড়ের দাগ আমার চোখে পড়ল। সেগুলো হয়তো অন্ধকারে ডায়েরি লেখার চেষ্টায়, অথবা মানুষের হাত-ওলা কারও অসতর্ক হিজিবিজি। ধীরে-ধীরে বাঁধানো ডায়েরিটা বন্ধ করে জানলা দিয়ে তাকালাম বাইরের বৃষ্টির দিকে। ভীষণ শব্দে কোথাও বাজ পড়ল, বাইরের উঠোনে বিশাল দেবদারু গাছ ঝড়ে টলোমলো, আকাশে ঘন মেঘ অচঞ্চল, স্থির। দূরে শোনা গেল কোনও কুকুরের আর্ত চিৎকার।

বহুক্ষণ একভাবে বসে রইলাম। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ডায়েরিটা পকেটে রাখলাম। ক্রমশ রাত বাড়ছে। দোতলার সিঁড়ির কাছে এগিয়ে গেলাম। সামনেই সেই প্রাচীন দরজা। পাতালঘরে যাওয়ার পথ। আমাকে সেখানে যেতে হবে। কিছুক্ষণ ইতস্তত করলাম, কিন্তু আমাকে যেতেই হবে। দরজা খুলতেই সেই ভ্যাপসা গুমোট হাওয়া আমাকে ঘিরে ধরল। সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলাম। যেন কোনও অন্ধকার কবরে নেমে চলেছি।

ডায়েরির কথামতো পাতালঘরটা একটা কোণে দাঁড়িয়ে। সিমেন্টের মেঝেতে আমার পায়ের শব্দ অস্বাভাবিক সোচ্চার। পাতালঘরের দরজায় খিল দেওয়া। কোনও কিছু না ভেবেই চটপট খিল খুলে ফেললাম। বিচিত্র শব্দ তুলে খিলটা খুলল। মরচের গুঁড়ো, ধুলো, মাটি ঝরে পড়ল মেঝেতে। দরজাটা খুলতে চেষ্টা করলাম কিন্তু খুলল না। তখনই নজরে পড়ল দরজায় এক বিরাট তালা। সময়ের প্রকোপেও সে তালা দুর্বল হয়নি। আর দরজাটাও নেহাত পলকা নয়। কোণের দিকে সরে দাঁড়াতেই দেখতে পেলাম ফুটোটা। ফুটোর চারপাশে সিমেন্ট বালি খসে পড়েছে। চোখ রাখলাম ফুটোতে, কিন্তু কিছুই নজরে পড়ল না। শুধু অন্ধকার। সুতরাং অত্যন্ত শান্তভাবে ফিরে এলাম সিঁড়ির কাছে, ধীরে ধীরে উঠতে শুরু করলাম। ওপরে গিয়ে ওই তালার চাবিটা খুঁজে দেখতে হবে। ওটা তন্দ্রাকাকিমার কাছে যখন ছিল, তখন এই বাড়িতেই কোথাও না কোথাও আছে। খুঁজে আমাকে দেখতেই হবে। সিঁড়ির ওপরের ধাপে পৌঁছতেই গোটা সিঁড়িটা কেঁপে উঠল আমার ভারে। তারপর হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে লাগল। প্রচণ্ড এক লাফে আমি ছিটকে গেলাম দরজার বাইরে। উলটে পড়লাম মেঝেতে। উঠে দাঁড়িয়েই উন্মাদের মতো ছুটতে শুরু করলাম। সদর দরজা খুলে ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে আমি ছুটে চললাম।

আমার সাহস আছে, শক্তিও কম নেই, কিন্তু সেদিন আমি শুধু ছুটেছি। ওই বাড়ি থেকে চলে গেছি অনেক দূরে। বৃষ্টিতে আমার শরীর ভিজে সারা। হু-হু বাতাসে কেমন শীত-শীত করছে। জ্যাকেটটা আমি ভুলে ফেলে এসেছি।

এসব বেশ কিছুদিন আগের কথা। তন্দ্রাকাকিমার ওই বাড়িতে আর ফিরে যাইনি। কিন্তু একদিন যাব। প্রায়ই কৌতূহল হয় পাতালঘরে এখন কী আছে, কে আছে? ভয় পাওয়ার মতো নিশ্চয়ই কিছু নেই। কারণ সেসব ঘটনা তো বহুদিন আগের। আর তন্দ্রাকাকিমা নিশ্চয়ই পরে একসময় ওই ঘরে গিয়েছিলেন, নইলে ডায়েরিটা পেলেন কী করে? পুরোনো খবরের কাগজ ঘেঁটে দেখেছি। একটা অমীমাংসিত খুনের ঘটনা আমার নজরে পড়েছে। হতে পারে এই খুনটার কথাই হয়তো ডায়েরিতে উনি লিখেছিলেন। কিংবা নাও হতে পারে। উনি নিশ্চয়ই পাগল ছিলেন, এর সবটাই হয়তো তাঁর কল্পনা। কল্পনা না হয়ে পারে না। কিন্তু তবুও খালি ভাবি, সে-রাতে তন্দ্রাকাকিমা পাতালঘরে কী দেখেছিলেন? তখনই কি তিনি প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর স্বামী পাগল, আর সেইজন্যেই তাঁকে বন্দি রেখে চলে গেছেন? না কি তিনি অন্য কিছু দেখেছিলেন? এমন কিছু, যা দেখে তিনি পাগল হয়ে গিয়েছিলেন?

সে যাই হোক, কোনওদিন আমি জানতে পারব না। তন্দ্রাকাকিমা নিজে কোনও ডায়েরি রাখতেন বলে মনে হয় না। এতে অবশ্য আমার দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কী-ই বা থাকবে। অলৌকিকে আমি বিশ্বাস করি না। কোনওদিন করিনি।

কাকার ডায়েরিটা আমার কাছে রয়েছে, সময় পেলেই ওটা বারবার পড়ি, চেষ্টা করি আসল সত্যকে খুঁজে বের করতে। কোনও-কোনও দিন উজ্জ্বল পূর্ণিমার রাতে ডায়েরিটা পড়ি, একা বসে থাকি জানলার পাশে, আর মাঝে-মাঝে তাকিয়ে থাকি রুপোলি থালার মতো চাঁদের দিকে। রাত যেন আর কাটতে চায় না। আমি একেবারে একা। তাই বড় একঘেয়ে লাগে। তাই ভাবছি সময় কাটানোর জন্যে ওইসব রাতে ডায়েরি লিখব। সবকিছু কাগজে-কলমে লিখে রাখব। যেমন এই মুহূর্তে আমি চুপচাপ বসে আছি, তাকিয়ে আছি গোল ধবধবে চাঁদের দিকে, আর মাঝে-মাঝে লক্ষ করছি আমার হাত দুটো আঙুল…আঙুলের নখ…।