পিশাচ প্রহর । তিন – জুন

২ জুন

গত সপ্তাহে সত্যি-সত্যি একজন ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু সে-প্রশ্ন কখনওই ওঠে না। প্রথম থেকেই অবশ্য সেটা জানি, কিন্তু তা সত্ত্বেও এ-চিন্তা যে-আমার মনে এসেছে, তাতেই বোঝা যায় আমি কতখানি মরিয়া হয়ে উঠেছি। এখন আমি খড়কুটো আঁকড়ে ধরতেও প্রস্তুত—প্রস্তুত নিজেকে বাঁচানোর সামান্য সুযোগের জন্যে যে-কোনও ঝুঁকি নিতে। এটুকু জানি, সুস্থ আমাকে হতেই হবে—আর সে-সুস্থতা আসবে ভেতর থেকে—আমার শরীরের গভীর থেকে।

ডাক্তারের কাছে যাওয়ার বুদ্ধিটা তন্দ্রাই আমার মাথায় ঢুকিয়েছে। অবশ্য খুব কায়দা করে, পরোক্ষভাবে। মনস্তত্ত্ববিদ সম্পর্কে কী একটা কথা যেন ও তুলেছিল যে-কাগজে তাঁদের সম্পর্কে কীসব লেখালিখি হচ্ছে—অর্থাৎ, কোনওরকমে ‘মনস্তত্ত্ববিদ’ শব্দটা বারবার আমার কানে ঢোকানো এবং খোলাখুলি উপদেশ না দিয়ে আমাকে ডাক্তারের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করা। ওর মতলব সফলও হয়েছিল, কারণ সত্যিই আমি ডাক্তার দেখানোর কথা ভাবতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু তা একেবারেই অসম্ভব।

সাধারণ ডাক্তারের কথা না বলে ও যে মনস্তত্ত্ববিদের কথা বলেছে, তাতে আমি বেশ আঘাত পেয়েছি। ও আমার মতোই ভালোভাবে জানে, এ রোগটা দেহের—মনের নয়। বহুবারই ওকে সে-কথা বলেছি। কিন্তু ওর কথাতেও যুক্তি আছে। কোনও সাধারণ ডাক্তার আমার কথা বিশ্বাস করবে না। আমাকে পাগল ভাববে এবং শেষ পর্যন্ত সে-ই পাঠাবে কোনও মনস্তত্ত্ববিদের কাছে। আর, মনস্তত্ত্ববিদ ডাক্তারও ব্যর্থ হবেন, কারণ তিনি এমন একটা মানসিক রোগের চিকিৎসা করতে চাইবেন যার কোনও অস্তিত্বই নেই। আমার কথা তাঁদের বিশ্বাস করানোর একমাত্র পথ আমার পরিবর্তনটা সত্যি-সত্যি দেখতে দেওয়া, আর সে আমি মরে গেলেও পারব না।

সে-কথা চিন্তা করে বহুদিন পর আবার প্রাণখোলা হাসি হেসে উঠলাম। কল্পনায় দেখতে পাচ্ছি, সাইকিয়াট্রিস্টের চেম্বারে আমি বসে আছি। সময়টা রাত। সেই বিশেষ রাত। তাঁর নির্দেশমতো আমি গদি আঁটা বিছানায় শুয়ে পড়লাম। তিনি আমার পাশেই চেয়ারে বসে। একটু আগেই আমার অসুখের খুঁটিনাটি সব তাঁকে বলেছি। তিনি ধৈর্য ধরে শুনেছেন আর মাঝে-মাঝে মাথা নেড়েছেন। আমার কথা শেষ হলে তিনি আত্মবিশ্বাসে ভরা মার্জিত মৃদু স্বরে কথা বলতে শুরু করলেন। তাঁর মাথায় টাক, চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা, মুখে পেশাদারি অভিজ্ঞতার ছাপ, পায়ের ওপর পা তুলে তিনি বসে আছেন, হাঁটুর ওপর নোটবই। কথা বলার সময় আমার দিকে তিনি তাকিয়ে নেই, তাঁর চোখ নোটবইয়ের দিকে। আমিও তাঁর দিকে দেখছি না। আমার চোখ জানলায় নিবন্ধ।

সমস্ত দৃশ্যটা আমার মনে নিখুঁত ছবিতে স্পষ্ট। এমনকী দেওয়ালে আঁটা তাঁর বিদেশি ডিগ্রিসমেত নেমপ্লেটও আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। জানলা দিয়ে আসা চাঁদের আলো সেই নেমপ্লেটে ঠিকরে পড়ছে। বিশাল টেবিল, ভারি ভারি একগাদা বইয়ের সারি। সব দেখে আমার চোখ আবার ফিরে যায় জানলার দিকে। পাতালঘরে থাকার চেয়ে যখন আমি চাঁদ দেখতে পাই তখন পরিবর্তনটা অনেক তাড়াতাড়ি এবং সহজে আসে। বুঝতে পারি, পরিবর্তন শুরু হয়েছে। ডাক্তারবাবু কথা বলে যান হালকা স্বরে। হয়তো বলছেন, এ-সবই আমার মনের ভুল, উদ্ভট কল্পনা, এ অসম্ভব, রোগগ্রস্ত দুর্বল মনের চিত্র-প্রলাপ। সে-কথা ভালো করে বোঝাবার জন্যে আমার দিকে ফিরলেন তিনি। তাকালেন আমার চোখে। আর তাঁর মুখ…তাঁর মুখ দেখেই আমার প্রচণ্ড হাসি পেল…সে-মুখ যেন টুকরো-টুকরো হয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে পড়বে। সেই শীতল, বিজ্ঞানীর, বুদ্ধিদীপ্ত মুখ অকস্মাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে অতীতের অতলে, হয়ে ওঠে প্রাগৈতিহাসিক, কুসংস্কারে বিশ্বাসী এক ভয়ার্ত মুখ। তাঁর ঠোঁট দিয়ে বেরিয়ে আসে দুনিয়া কাঁপানো এক ভয়ঙ্কর চিৎকার। আর তারপর…।

জানি না, ব্যাপারটা হয়তো হাসির নয়, কিন্তু তবুও, আবার হাসতে পেরে ভালো লাগছে।

৩ জুন

আজ রাতে আমাকে পাতালঘরে যেতেই হবে।

কারণ অসুখটা হবে বলে ভয় করছে। আমার স্ত্রীও ভয় পাচ্ছে। গত রাতেই ওকে একটু অস্থির ও চিন্তিত দেখেছি। ক্রমশ ওর অবস্থা খারাপ হচ্ছে। আবারও ও আকারে-ইঙ্গিতে বলেছে, আমার ডাক্তারের সাহায্য নেওয়া দরকার। সাহায্য! কে আমাকে সাহায্য করবে? কী সাহায্য করবে? ও কিছুতেই বুঝতে চায় না। হয়তো ভয়ঙ্কর চরম সত্যটাকে ও বিশ্বাস করতে চায় না, মন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়। তার চেয়ে আমি পাগল হলেই ও যেন স্বস্তি পেত। কিন্তু মাঝে-মাঝে নিজের চেয়ে ওর সুস্থতা নিয়ে আমার চিন্তা হয়। আর নিজের কথা ভেবে শুধু ভগবানকে ডাকি যে, অসুখটা যেন আরও খারাপের দিকে না যায়, যেন প্রতি মাসে ওই একটা ভয়ানক রাত নিয়ে আমি স্বাভাবিকভাবে জীবন কাটাতে পারি…কিন্তু ওই একটা রাতকেই আমি ভয় পাই। ভয় পাই পাতালঘরটাকেও। পরিবর্তনের পরেও আমার মধ্যে কিছু স্মৃতি, কিছু আবেগ থেকে যায়। আমি কষ্ট পাই। আজ, একমাস পরেও, সে-অনুভূতি আমার স্পষ্ট মনে আছে। পশুটার প্রচণ্ড দাপাদাপির সঙ্গে মনে পড়ে যায় বুকের ভেতরে এক তীব্র যন্ত্রণা, অতীতের যন্ত্রণা। মনে পড়ে সেই ছোটবেলায়, এক পূর্ণিমার রাতে একটা শিকারি হাউন্ডকে আমি মেরে ফেলেছিলাম। কুকুরটা আমাকে আক্রমণ করতে আসছিল…সে-কথায় পরে আসব। কিন্তু তখন আজকের এই ভবিষ্যতের কথা আমি ভাবিনি। বর্তমানকে আমি সহ্য করতে পারি, কিন্তু ভবিষ্যতের ভাবনা আমাকে পাগল করে তোলে। যত দিন যাবে, ততই যদি সে ভবিষ্যৎ ক্রমে খারাপের দিকে যেতে থাকে…।

বলা যায় না, হয়তো অসুখটা ভালোও হয়ে যেতে পারে। সেটা একেবারে অসম্ভব নয়। অনেক রোগ নিজে থেকেই সেরে যায়, শরীরে নিজে থেকেই তৈরি হয় প্রতিরোধের ক্ষমতা। শুধু সেই আশাতেই বুক বেঁধে থাকি। ভাবি, কোনও এক মাসে সেই বিশেষ দিনটা পার হয়ে যাবে, অথচ এই অসুখটা আর হবে না। তখন স্পষ্টই বুঝব, আমি সেরে উঠছি।

আমি ছেলেমেয়ে চাই না। সেরে উঠলেও চাই না। এই রোগের পরিসমাপ্তি আমাকে দিয়েই হোক। আমার বংশধরদের মধ্যে এই রোগ আমি ছড়িয়ে দিতে চাই না। তন্দ্রা এতে দুঃখ পেয়েছে! ও যে মা হতে চায়। এটা বুঝতে চায় না, কেন তা অসম্ভব, কী আতঙ্কময় পরিণতি লুকিয়ে রয়েছে সে-ইচ্ছের পেছনে। হয়তো আমি পাগল হলেই ওর পক্ষে ছিল ভালো। কখনও-কখনও মনে হয়, ও হয়তো ভাবে আমার কিছু একটা হয়েছে…হ্যাঁ, সে-কথা আমি অস্বীকার করি না…কিন্তু পাগল তো আমি হইনি। সুতরাং, এই ডায়েরিতে লিখে রাখার জন্যেই এ-কথা উল্লেখ করলাম। জানি না, সবটা আমার মনের ভুলও হতে পারে।

গত এক মাস কিছু লিখিনি। লেখার মতো কিছু ছিল না। রোগটা যত কাছে আসে ততই লিখতে ইচ্ছে করে। সেই কারণে প্রথমে প্রতিদিন লিখব ঠিক করলেও কাজে তা হয়ে উঠছে না। যতক্ষণ পারি সমস্ত আমি ভুলে থাকতে চাই। কিন্তু পারি কই? নইলে, এখনও আমার মনে পড়ে কেন সেই মাতালটার কথা? যার সঙ্গে এক পূর্ণিমার রাতে একটা নির্জন হোটেলে আমার দেখা হয়েছিল। কেনই বা মনে পড়ে বৃষ্টি ঝরা রাতের সেই আগন্তুকের কথা? আমার অসুখের এক ভয়ঙ্কর রাতে যে এসে আশ্রয় নিয়েছিল আমাদের বাড়িতে। তারপর…। সে-কথায় মনে পড়ে যায়, ওই ভয়ঙ্কর রাত আবার ফিরে আসবে—প্রতি মাসেই ফিরে আসবে। ইচ্ছে আছে, আজ রাতে ডায়েরিটা পাতালঘরে সঙ্গে করে নিয়ে যাব। যতক্ষণ পারি, যতটুকু পারি, কাগজে-কলমে ধরে রাখার চেষ্টা করব…হয়তো একদিন এই ডায়েরি সত্যিকারের কাজে আসবে। হয়তো লিখতে গিয়ে নিজের ওপর আমার ঘেন্না করবে। কিন্তু চেষ্টা আমাকে করতেই হবে।

যতখানি সম্ভব আমাকে জানতে হবে। হয়তো সেই তথ্য থেকেই পেয়ে যাব এ রোগকে নির্বাসন দেওয়ার কোনও অদ্ভুত পথ।

এখন বিশ্রাম করা দরকার। আজ রাতে অনেক পরিশ্রম হবে, কষ্ট হবে। আজকের দিনটা ভারি চমৎকার। আকাশ পরিষ্কার। জানি, রাতও পরিষ্কার থাকবে। দেখা যাবে গোল রুপোর থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদ। চাঁদকে বাইরে রেখে বদ্ধ পাতালঘরে যেতে ভীষণ কষ্ট হবে। কিন্তু উপায় কী…।

৩ জুন, রাত

যাক, দরজা বন্ধ করে খিল দেওয়া হয়ে গেছে। শুনতে পেলাম, তন্দ্রার পায়ের শব্দ সিঁড়ি বেয়ে উঠছে, অবশেষে ওপরের দরজাটাও বন্ধ হয়ে গেল। এখন পাতালঘরে আমি একা। এখনও ঠিকই আছি। আজ রাতে একটু তাড়াতাড়ি চলে এসেছি। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে আমার ভয় করছিল। ডায়েরিটা সঙ্গে নিয়ে এসে ভালোই হয়েছে। কিছু একটা কাজ নিয়ে অন্তত মেতে থাকতে পারব। অপেক্ষার সময়টুকু আর ক্লান্তিকর মনে হবে না। চুপচাপ সেই ভয়ঙ্কর পরিবর্তনের প্রতীক্ষায় বসে থাকার চেয়ে কিছু একটা করা তবু ভালো।

লিখতে-লিখতে হাতের দিকে তীক্ষ্ণ লক্ষ রাখছি। লক্ষ রাখছি আঙুলের নখের দিকে। এখনও নখগুলো ঠিকই আছে। এখনও কিছু শুরু হয়নি। আমার আঙুলগুলো লম্বা, সরু। নখ ছোট করে কাটা। খুব সাবধানে আমাকে লক্ষ রাখতে হবে, যাতে পরিবর্তনের প্রাথমিক লক্ষণগুলো চোখ এড়িয়ে না যায়। সমস্ত কিছুর নিখুঁত বিবরণ ডায়েরিতে আমি লিখে রাখতে চাই।

পাতালঘরে কোনও আসবাবপত্র নেই। থাকলে তা নেহাতই চুরমার হত। ঘরের এক কোণে উবু হয়ে বসে হাঁটুর ওপর ডায়েরি রেখে লিখছি। পাতাগুলো যেন সামান্য রঙিন মনে হচ্ছে। একটা বেশি পাওয়ারের বাল্‌ব লাগালে ভালো হত। আলোটা পাতালঘরের ছাদের গায়ে গর্ত করে বসানো, ওপরে জালের ঢাকা দেওয়া। জালটা একটু তোবড়ানো মনে হচ্ছে, কিন্তু সেটা আমারই কীর্তি বলে মনে পড়ছে না। অবশ্য মনে না পড়ারই কথা। পাতালঘরটা স্পষ্ট দেখতে পাওয়ার পক্ষে আলোটা যথেষ্ট নয়। আগে কখনও এটা খেয়াল করে দেখিনি। অন্যান্য সময় নিজের ভাবনাতেই এত ব্যস্ত থাকি যে, চারপাশের কথা ভুলে যাই। কিন্তু আজ যে অনেক তাড়াতাড়ি এসে পড়েছি…।

পাতালঘরটা কংক্রিটের তৈরি। দেওয়ালগুলো বেশ পুরু এবং দরজাটায় বড়-বড় লোহার বল্টু লাগানো। ঘরের চার দেওয়ালেই পুরু গদি আঁটা। তন্দ্রা আর আমি মিলেই গদিগুলো লাগিয়েছি। মাটির তলায় ঘর তৈরি করছি কেন, রাজমিস্ত্রিকে এ-প্রশ্নের উত্তর দিতেই আমরা হিমশিম খেয়েছি, তার ওপর দেওয়ালে গদি লাগানো! সুতরাং, সে-কাজটুকু কষ্ট করে নিজেরাই সেরে নিয়েছি। পাতালঘর তৈরির সময় মিস্ত্রিকে বলেছিলাম, ঘরটা আমাদের পোষা কুকুরের জন্যে। সে সন্দেহ করে বহুরকম প্রশ্ন করেছে, আমাদের অদ্ভুত খেয়ালের কথা চিন্তা করে উপদেশও দিয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তৈরি করে দিয়েছে ঘরটা। আমাদের কোনও কুকুর নেই। কুকুররা আমাকে ঠিক পছন্দ করে না। আমাকে দেখলে ভয় পায়। মনে হয়, আমি সুস্থ থাকার সময়েও ওরা আমার ওই অদ্ভুত রোগের গন্ধ পায়। আমার রোগটা যে শুধুই দেহগত, এটা তার একটা বড় প্রমাণ। আবার মনে পড়ছে সেই শিকারি হাউন্ডটার কথা।

এই ঘরে একটা অদ্ভুত ভ্যাপসা গন্ধ রয়েছে। দমবন্ধ হয়ে আসছে। মনে হয়, গদির নীচে দেওয়ালগুলো স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেছে। গদির তুলোগুলো ক্রমশ জমাট বেঁধে গেছে। ওগুলো শিগগিরই পালটাতে হবে। ঘরটাকে যতটা সম্ভব আরামের করে তুলতে হবে। জায়গায় জায়গায় গদি ছিঁড়ে গেছে, তুলো ছড়িয়ে পড়েছে মেঝেতে। গদিটা শক্ত মোলায়েম রেক্সিনে মোড়া। সুতরাং বুঝতে পারছি, আমার…মানে ওটার…নখগুলো খুব শক্তিশালী এবং ধারালো। ওগুলো গদিতে বসে যায় খুব সহজে, যেন মাখনে ছুরি কেটে বসছে। অন্ধ আক্রোশে দেওয়ালে থাবা বসানোর সময় কখনও কি আমার নখ ভেঙে যায়নি? ছেঁড়া জায়গাগুলো ভালো করে খুঁজে দেখতে হবে। সেটাই হবে পরিবর্তনের জলজ্যান্ত অকাট্য প্রমাণ। পরে তন্নতন্ন করে খুঁজব। হয়তো কিছু না কিছু পেয়ে যাব। ওটা যে ভয়ঙ্কর শক্তিতে প্রচণ্ড ক্রোধে দেওয়ালে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাতে ওই শক্ত বাঁকানো নখও ভেঙে যাবে। আমি জানি। আমার চেয়ে কে আর ভালো জানবে!

ওই নৃশংস বাঁকানো নখগুলো! ওগুলোর কথা মনে পড়লেই আমি শিউরে উঠি। চামড়া টান-টান হয়ে কুঁচকে যাওয়া বাঁকানো আঙুলের ডগায় ওগুলো নড়েচড়ে বেড়ায়। যেভাবে এই শক্ত গদিতে ওগুলো কেটে বসে, ছিঁড়ে ফালা ফালা করে দেয়, তাতে ভাবি, মাংসের মতো কোমল জিনিস পেলে তার কী অবস্থা হবে! কোনও মানুষের নরম গলার কী অবস্থা হবে! এ-কথা ভাবলেও আমার শরীর কেঁপে ওঠে। নরম মাংসের স্পর্শ আমি স্পষ্ট অনুভব করি, আর সে-অনুভূতি আমার মনে ঘৃণার জন্ম দেয়। কিন্তু তবু সে-অনুভূতি থেকে মুক্তি নেই। ওটা আমাকে বারবার নিজের পরিচয় দিতে চায়। স্পষ্ট দেখতে পাই, কীভাবে সেই থাবা আঁকড়ে বসে যায় গলায়, নখের তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ ফরসা চামড়ায় আঁচড় কেটে এগোয়, অবশেষে চামড়া কেটে গলায় ঢুকে যায় দশ আঙুল, গলার শিরা কাঁপতে থাকে দপদপ করে। বাঁকানো নখগুলো এখন অদৃশ্য, আঙুলের ডগায় রক্তের উষ্ণ স্পর্শ, রক্ত ফিনকি দিয়ে ছিটকে আসে আমার মুখে। টের পাই উষ্ণ নোনতা স্বাদ। রক্তের গন্ধে আমার মাথা ঘুরতে থাকে, সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে, শুধু পড়ে থাকে একটা আতঙ্কবিকৃত থরথর মুখ। সে মুখের ক্রমশ পরিবর্তন হয়, চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসে, গলার ভেতরে মৃত্যুর ঘড়ঘড় শব্দ হয়, আমার তীক্ষ্ণ শ্ব-দন্ত নেমে আসে…আমি ঝুঁকে পড়ি সেই মুখটার ওপর…নরম ফরসা গলায় আমার শ্ব-দন্ত…বসে যায়…নরম উষ্ণ মাংসে ওরা ডুবে যায়, অদৃশ্য হয়…এক টানে ছিঁড়ে নেয়…গলার নলি…।

৪ জুন

এইমাত্র ডায়েরি মেরামতের কাজ শেষ করলাম। ছেঁড়া জায়গাগুলো সেলোটেপ দিয়ে জুড়ে দিয়েছি। নিশ্চয়ই গত রাতে পৃষ্ঠাগুলো আমি ছিঁড়েছি—ওই অসুখের সময়। কিছুই আমার মনে নেই। হয়তো ইচ্ছে করে ছিঁড়িনি, ওই অন্ধ রাগের সময় হাতের কাছে যা কিছু থাকে তাই তছনছ হয়ে যায়। ডায়েরির পৃষ্ঠাগুলো দু-ভাগে বা চারভাগে সমান করে ছেঁড়া নয়, এলোপাতাড়িভাবে ছিঁড়ে তছনছ করা। ওপরের মলাটটা ছিঁড়ে একেবারে টুকরো-টুকরো হয়ে গেছে, কিন্তু পৃষ্ঠাগুলো এখনও পড়া যাচ্ছে। পেনটাও শুকনো ডালের মতো ভেঙে দু-টুকরো হয়ে গেছে। এত শক্তি, এত ক্ষমতা, কল্পনা করা যায় না। আমি বরাবরই শক্তিশালী, নিয়মিত ব্যায়ামও করি। কিন্তু পরিবর্তনের মাধ্যমে যে বন্য শক্তি আমার মধ্যে আসে তা দুঃস্বপ্নের বাইরে। যেন আমার পেশি, তন্ত্রী সবই বদলে যায়। বাইরের মতো ভেতরে-ভেতরেও একটা পরিবর্তন ঘটে। হয়তো শুধুমাত্র একটা শরীরের আমরা শরিক নই, ছোট্ট মস্তিষ্কেও আমরা দুজনেই জায়গা করে নিই। এটা আশার কথা যে, ওটাকে আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন সত্তা বলে ভাবতে পারছি। অথচ আমার নিজের শরীরেই ওটার আঘাত ও ক্ষতের চিহ্ন থেকে যায়। একইসঙ্গে দুটো শরীরের অস্তিত্ব কখনওই থাকতে পারে না। ব্যাপারটা বড় গোলমেলে, আমার যুক্তির নাগালের বাইরে—কিন্তু আমি অনেকের চেয়েই বেশি বুদ্ধিমান এবং যুক্তিবাদী। এ-অদ্ভুত রোগের মোকাবিলা করে, তার সঙ্গে নিয়ত লড়াই করে ক’জন মানুষ আমার মতো নিজের সুস্থতা বজায় রাখতে পারত? এজন্যে আমার গর্ব হয়। আমি ব্যর্থ হইনি। নিজের মনের জোর সত্যিই আমার গর্বের কারণ।

পরিবর্তনের কথা আমার লেখা হয়নি। মনে আছে, ওটার শুরু হওয়াটা স্পষ্ট টের পেয়েছিলাম। তখন আমি নিশ্চয়ই লিখছিলাম, কিন্তু যে-কোনও কারণেই হোক ডায়েরিতে সে-কথা লেখা নেই। লেখার শেষ কয়েকটা লাইন জড়ানো, অস্পষ্ট আঁচড় মাত্র। আমার হাতের লেখা বলে চেনা যায় না। মনে হয়, সেটাই পরিবর্তনের একটা লক্ষণ। জিনিসটার হাত দুটোর অমানুষিক শক্তির কথা লিখছিলাম, তখনই হঠাৎ লেখা শেষ হয়েছে। একেবারে মাঝপথে। আমার ধারণা, হাতের আঙুল, চামড়া, টান-টান হয়ে বেঁকে যাওয়ার ফলেই ওই অদ্ভুত জড়ানো লেখার জন্ম হয়েছে। কিন্তু তারপর আর কিছু লেখা নেই।

গত রাতে পরিবর্তনটা একটু অন্যরকম মনে হয়েছে। আগের চেয়ে জোরালো না হলেও একটু অন্যরকম। মনে হয়, আমি এখন অসুখটার এক নতুন ধাপে এসে পৌঁছেছি…অসুখটা এখন পালটাচ্ছে…হয়তো ভালোর দিকে যাচ্ছে।

ওটার চিন্তাশক্তি আগের চেয়ে বেড়েছে। অথবা আমার স্মৃতিশক্তি আরও প্রখর হয়েছে। দুটোর যেটাই হোক, এখন টুকরো ঘটনা ছাড়াও বেশ কিছু চিন্তাভাবনা আমি স্পষ্ট মনে করতে পারছি। সমস্ত হতাশা, খিদে, ঘৃণা, এসবের কথা আমার মনে আছে। কিন্তু সে ছাড়াও মনে পড়ছে ঝাপসা ছেঁড়া-ছেঁড়া চিন্তার অংশ। আমার চিন্তা নয়, ওটার চিন্তা। সে-চিন্তা অনেকটা মানুষের চিন্তার মতো। তাই তো হওয়া উচিত। ওই ভয়ঙ্কর জিনিসটার শরীরে মানুষের মতো চিন্তার ক্ষমতা আছে, এ-কথা কল্পনা করাটাও এক দুঃস্বপ্ন। এক দুশ্চিন্তা। ওটাকে আমার মনের ভাগ আমি দিতে চাই না। কিন্তু বেশ মনে আছে, ওটা যুক্তি দিয়ে চিন্তা করে দেখছিল, কী করে পাতালঘর থেকে বেরনো যায়। মনে আছে, ওটার দাপাদাপির মাঝে এক নীরব মুহূর্ত। তখন ওটা ঘাপটি মেরে মেঝেতে বসে সাদা চোখ দুটো ঘুরিয়ে চারদিক দেখছিল, খুঁজে বেড়াচ্ছিল দেওয়ালে বা দরজায় কোনও পলকা জায়গা। হয়তো তন্দ্রাকে ফাঁকি দিয়ে ভুলিয়ে দরজা খোলাবার কথাও ওটা ভাবছিল। অবশ্য ও-ঘর থেকে বেরনোর কোনও রাস্তা নেই। সবরকমেই আমরা সাবধান হয়েছি। যদি ওটা আমার মতো বুদ্ধিমানও হয়ে ওঠে, তবুও পাতালঘর থেকে বেরিয়ে আসার কোনও পথ খুঁজে পাবে না।

এটাই হল অসুখের পরিবর্তন : জিনিসটার ক্রমশ বুদ্ধিমান ও যুক্তিবাদী হয়ে ওঠা। হয়তো ওটা এভাবে ধীরে-ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠছে…মানুষের মতো। হয়তো আমি ও সে ক্রমশ কাছাকাছি চলে আসছি। কাছে কে এগিয়ে যাচ্ছে, আমি না সে, তা বলা অসম্ভব। হয় অসুখটা ক্রমেই আমাকে দখল করে নিচ্ছে, অথবা আমি বোধহয় সেরে উঠছি। জানি না, এই নতুন পরিবর্তনটা ভালো না খারাপ…আমি ভয়ে কেঁপে উঠি, শরীর ঘেমে যায়, পাকস্থলীতে টের পাই কোনও বরফের শক্ত মুঠির অস্তিত্ব। সব মিলিয়ে অন্ধ ত্রাস।

এখন আমি অনেক শান্ত। কিছুক্ষণের জন্যে শুয়ে পড়লাম। ঠোঁটে এখনও রক্ত ও ফেনার স্বাদ, যদিও অনেকবার দাঁত মেজেছি। গত রাতে ঠোঁটে কামড় বসিয়ে দিয়েছিলাম। ঠোঁট ফুলে গেছে, সেইসঙ্গে অসহ্য যন্ত্রণা। জিভে কোনও স্বাদ পাচ্ছি না—হয়তো সবটাই আমার মনের অনুভূতি। আজ সকালে স্বাভাবিক হয়ে ঢোক গিলতেই কেমন বমি-বমি ভাব এল। তন্দ্রা যতক্ষণ না দরজা খুলে দিচ্ছে ততক্ষণ দাঁত মেজে মুখ ধুতে পারব না ভেবে গা গুলিয়ে উঠল। তন্দ্রার অপেক্ষায় সময় আর কাটতে চায় না। অবশ্য পাতালঘরে সময় বোঝার উপায় নেই। সময় সেখানে যেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আমার অসুখের সঙ্গে কি এর কোনও সম্পর্ক আছে? সময়টা মাপতে পারলে বেশ হত।

গত রাতে যে অসুখটা বেশিক্ষণ ছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। অন্তত আমার তাই মনে হয়েছে। অবশ্য এবারে বেশি ঘটনা, বেশি স্মৃতি মনে থাকার ফলে অসুখটা অপেক্ষাকৃত দীর্ঘস্থায়ী বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আমার স্ত্রী বলেছে, রোজকার সময়ে ও যখন দরজায় এসে ধাক্কা দেয় তখন কোনও সাড়া পায়নি। প্রতিদিন ও দরজা খোলার আগে আমি চেঁচিয়ে সাড়া দিই, বলি, সব ঠিক আছে, তন্দ্রা, দরজা খোলো। অথচ আজ সকালে আমি সে-সময়ে সাড়া দিইনি। তন্দ্রা বলছে, ও নাকি কীসব…অদ্ভুত আওয়াজ শুনেছে…কিন্তু কোনও উত্তর পায়নি। শব্দগুলো ঠিক কীরকম, তা ও ভেঙে বলেনি।

সুতরাং ও ওপরে ফিরে গিয়ে আরও এক ঘণ্টা অপেক্ষা করেছে। বেশ বুঝতে পারছি, ওই একটা ঘণ্টা ওর কী আতঙ্কে, কী উৎকণ্ঠায় কেটেছে। খালি ভেবেছে, আমার কী হল। বেচারি তন্দ্রা! ও আমাকে এত ভালোবাসে, অথচ বুঝতে চায় না। বিয়ের সময় আমার অসুখের কথা ও জানত না। পরে সেটা জানতে পেরে ও এক বিরাট আঘাত পেয়েছে। সে তীব্র আঘাত যে ও সইতে পেরেছে, তাতে আমি ওর কাছে চিরকৃতজ্ঞ। আমার মতোই দুশ্চিন্তা ও আশঙ্কায় এখন ওর দিন কাটছে।

এক ঘণ্টা পর ও আবার নেমে এসেছে, ধাক্কা দিয়েছে পাতালঘরের দরজায়। এবারে আমি সাড়া দিয়েছি, তারপর ও দরজা খুলেছে। খুব ধীরে-ধীরে ও দরজার পাল্লা ফাঁক করে ঘরে উঁকি মেরেছে। স্পষ্ট শুনতে পেয়েছি ওর আচমকা শ্বাস টানার শব্দ। আমার জন্যে ভয়ে ও যেন পাগল হয়ে গেছে। অথচ মনে হয় না, আমাকে ও ভয় পায়।

প্রথমবার ওর দরজায় ধাক্কা দেওয়া আমি শুনতে পাইনি—অথবা মনে নেই। যখন ও সে-কথা বলল, তখন বেশ অবাক হয়ে গেছি। অস্পষ্ট আভাসে মনে পড়ছে, আমি ঘাপটি মেরে দরজার ঠিক পাশে বসে ছিলাম, আমার দু-ঊরুর পেশি টান-টান, দু-হাত সামনে বাড়ানো খোলা অবস্থায়, যেন কারও দরজা খোলার জন্যে অপেক্ষা করছি। কিন্তু সে-স্মৃতি ভীষণ ঝাপসা। কখন যে ওভাবে বসে ছিলাম, মনে নেই। তবে এটুকু জানি, তন্দ্রার জন্যে ওভাবে কখনও আমি অপেক্ষা করব না। করতে পারি না।

৬ জুন

ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। অসুখটা এ মাসে এত বেশিক্ষণ ছিল কেন সেই কথা ভাবছি। যতদূর মনে পড়ে, আগে অসুখটা এতক্ষণ থাকত না। আমার এ-অসুখের শুরু থেকে গুছিয়ে লিখতে চাই। তাতে অসুখটার উন্নতি, অবনতি অথবা পরিবর্তনগুলো অনেক স্পষ্ট হবে। মনে-মনে বেশ বুঝতে পারছি, নতুন একটা পরিবর্তন আসছে। সেইজন্যেই ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, এটা যেন অসুখ সেরে ওঠার প্রথম লক্ষণ হয়। এ-পর্যন্ত দিনের পর দিন ওটা ক্রমশ খারাপের দিকে গেছে। এ মাসে অসুখটা আরও বেশিক্ষণ স্থায়ী হওয়ায় মনে হতে পারে আমার অদ্ভুত রোগটা অবনতির দিকে আরও এক ধাপ নেমে গেছে, কিন্তু একই সঙ্গে এ-কথাও তো ভাবতে হবে, এবারে সুস্থ হওয়ার পর ওটার চিন্তাগুলো পর্যন্ত আমার মনে ছিল। এরকমটা আগে কখনও হয়নি। অন্তত পুরোপুরি পরিবর্তনটা যে-দিন থেকে শুরু হল তারপর তো নয়ই। একেবারে প্রথমে অসুখটা যখন শুরু হয়, তখনও এরকম অসুখের সময়ের চিন্তা আমি মনে রাখতে পারতাম। আমি যে আবার সুস্থতার দিকে ফিরে চলেছি, এটা হয়তো তারই ইঙ্গিত। আমি হয়তো ক্রমে সেরে উঠছি। এবারে অসুখের প্রকোপটা হয়তো কম ছিল, যার জন্যে সারতে সময় বেশি লেগেছে। বুঝতে পারছি না, এখন যে-অবস্থায় আছি তার চেয়ে আর কত খারাপের দিকে আমি যেতে পারি…।

পুরোনো কথা ভাবতে গিয়ে টের পেলাম, অসুখটা ঠিক কবে শুরু হয় আমার মনে নেই। নিশ্চয়ই খুব ধীরে-ধীরে ওটা প্রভাব বিস্তার করেছে আমার শরীরের ওপর। হঠাৎ একদিনে যদি এ-রোগ আমাকে গ্রাস করত তাহলে দিনটা নিশ্চয়ই স্পষ্ট মনে থাকত। দুর্বল মনের কোনও মানুষ হয়তো সে স্মৃতিকে মন থেকে মুছে ফেলতে চাইত, কিন্তু আমি পুরুষের মতোই তার মুখোমুখি হতাম।

যদি তখন আসল ব্যাপারটা ধরতে পারতাম, তাহলে নিশ্চয়ই যে করে হোক এ-রোগকে প্রতিরোধ করতাম। জানি না কীভাবে, কিন্তু আপ্রাণ চেষ্টা করতাম। কিন্তু কী করে বুঝব? কুসংস্কারে কোনওকালেই আমি বিশ্বাস করি না। বিশ্বাস করি না ওই—ওই জিনিসটাকেও…যাতে আমি পরিণত হই মাসে একদিন। স্বর্গ, দেবতা, পরি, ডাইনি, শয়তান, এসবেও আমার বিশ্বাস নেই। আমার বাবা-মাও বিশ্বাস করতেন না। তাঁরা সবসময় সত্যি কথাটাই আমাকে বলতেন : মানুষের ভাগ্য মানুষের নিজের হাতে, ঈশ্বরের হাতে নয়। সুতরাং, কী করে আমি বিশ্বাস করি…নামটা আর উচ্চারণ করব না…ওই অদ্ভুত জিনিসটার অস্তিত্বে? জানি, এভাবে আমি সত্যকে অস্বীকার করতে চাইছি, যেন সেটা স্বীকার করলেই আমি হেরে যাব, আরও দুরারোগ্য হয়ে উঠবে আমার ব্যাধি। কিন্তু শত চেষ্টাতেও কাগজে-কলমে সে-কথা আমি লিখতে পারছি না। এমন নয় যে, এ কোনও দুর্বল মানুষের জখম মস্তিষ্কের সত্য অস্বীকারের প্রয়াস, বরং বলা যায়, এ আমার নীরব জেহাদ—ওই অসুখের প্রতি। অসুখের নামটা আমি জানি। ভালোমতোই জানি। নামটা আমার চিন্তায় ঘূর্ণির মতো পাক খায়, কখনও তলিয়ে যায়, কখনও ভেসে ওঠে। তার চরিত্র আমি জানি। কিন্তু তাকে কখনও অস্বীকার করি না। সেটুকু মনের জোর আমার আছে। সবকিছু জেনেশুনেও আমি সহজ-স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি। এ-রোগ জন্ম মুহূর্ত থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে আমার রক্তে মিশে রয়েছে। রক্তের স্রোতের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে শরীরের প্রতিটি শিরায়, প্রতিটি ধমনীতে। আমি বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে অসুখটাও তেজিয়ান হয়ে উঠেছে…ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করেছে আত্মপ্রকাশের মাহেন্দ্র মুহূর্তের…আজ এসব বুঝতে পারছি। আগে বুঝতে পারিনি। বোঝা সম্ভবও ছিল না। না, এ দোষ আমার নয়।

ছোটবেলায় আমি একটু রাগী ছিলাম। কথায় কথায় চিৎকার করে হাত-পা ছুড়ে রেগে উঠতাম। কিন্তু বহু ছেলেই ছোটবেলায় ওরকম করে থাকে। ব্যাপারটা নেহাতই সাধারণ। কিন্তু কখনও আমার শারীরিক পরিবর্তন হয়েছিল বলে মনে পড়ে না। তার কোনওরকম আভাসও পাইনি। কিন্তু তবুও…হঠাৎ-হঠাৎ হিংস্র হয়ে ওঠা…যখন ঝগড়া করতাম অন্য ছেলেদের সঙ্গে, কিংবা প্রিয় খেলনা আছাড় মেরে ভেঙে ফেলতাম টুকরো-টুকরো করে…সেই সময় অমানুষিক ওই রাগের যুক্তিসঙ্গত কোনও কারণ খুঁজে পেতাম না। এমন নয় যে ওইসব ছেলেদের দেখে আমার রাগ অথবা বিরক্তি হত। অথবা মন খারাপ থাকত, তাও নয়।

মনে আছে, একবার আমাদের পাশের বাড়ির একটা ছেলে, আমারই বয়েসি তবে চেহারায় ছোটখাটো, আমার কপালে ঢিল ছুড়ে মেরেছিল। ভীষণ ব্যথা পেয়েছিলাম। কপাল ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল আমার মুখ বেয়ে। ছেলেটা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ভয় পাওয়ার প্রথম কারণ, ঢিলটা ও অকারণেই ছুড়ে মেরেছে। আর দ্বিতীয় কারণ, ওর চেয়ে আমার গায়ে জোর অনেক বেশি। ইচ্ছে করলেই আমি প্রতিশোধ নিতে পারি। কিন্তু তা করিনি। এমনকী আমার রাগও হয়নি। এতে ছেলেটা ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিল। কারণ ও জানত, বদরাগী বলে আমার কুখ্যাতি আছে। রক্তাক্ত মুখে আমি শুধু ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। মন ছিল শান্ত। মনে আছে, জিভ দিয়ে ঠোঁটের কোণ থেকে রক্ত চেটে নিয়েছিলাম। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছিল। হয়তো কপালে আঘাত পাওয়ার জন্যেই। সুতরাং চুপচাপ দাঁড়িয়ে রক্ত চাটতে লাগলাম জিভ দিয়ে।

ওর আঘাতের প্রতিবাদ না করায় ছেলেটা নিশ্চয় ভেবে থাকবে আমি ওকে ভয় করি, কারণ ওই ঘটনার পর থেকেই ও সর্বদা আমার পেছনে লাগত। স্কুল ছুটির পর আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকত। ঢিল ছুড়ত, কখনও ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিত, কখনও বা ঘুষি মারত। কিন্তু ওর ওপর কখনও আমার এতটুকু রাগ হত না। কখনও ইচ্ছে হত না ওকে পালটা ধাক্কা দিই বা ঘুষি মারি। ওর সমস্ত অত্যাচার আমি বিনা দুঃখকষ্টে মেনে নিতাম। ও বুক ফুলিয়ে অন্য ছেলেদের বলে বেড়াত আমি ওকে কী ভীষণ ভয় পাই। সবাই এ নিয়ে আমাকে ঠাট্টা করত, রাগাত। কিন্তু সেসবে আমি কান দিতাম না। অন্য লোকে কী ভাবে না ভাবে সে নিয়ে আমি কোনওদিনই মাথা ঘামাই না। যখন রাগ হওয়াটা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত এবং প্রয়োজন, তখন আমার যে একটুও রাগ হত না, এ তারই একটা উদাহরণ।

আর অন্য সময়ে…কোনও কারণ ছাড়াই…একটা দিনের কথা মনে পড়ে। তখন সন্ধে হয়ে আসছে। আমি খেলা করছিলাম আমার সবচেয়ে প্রিয় খেলনা নিয়ে। খেলনাটা একটা দম দেওয়া রেলগাড়ি। অনেকক্ষণ ধরে ওটা নিয়ে খেলছিলাম, মনমেজাজ বেশ খুশিই ছিল। কিন্তু তারপর, হঠাৎই, ওটা হাতে তুলে নিয়ে প্রচণ্ড আছাড় মারলাম মেঝেতে। বিরাট ধাতব শব্দ তুলে ওটাকে ধ্বংস করতে লাগলাম। যতক্ষণ না ওটা টুকরো-টুকরো হয়ে গেল অফুরন্ত ক্রোধে ওটাকে চুরমার করে চললাম। এমন সময় মা ঘরে এলেন। খেলনাটা ভেঙেছি বলে ভীষণ রাগ করলেন, বললেন, আর কোনওদিনও আমাকে খেলনা কিনে দেবেন না, কিন্তু সে-কথা আমি কানেই তুললাম না। এমনকী পরে, তার পরদিন, রেলগাড়িটা ভেঙে ফেলেছি বলে কোনও দুঃখও আমার হল না। যখনই ওটার কথা মনে পড়ল, তখনই মনে হল জিনিসটা ভাঙার পক্ষে বেশ জুতসই ছিল। ওটা ভেঙেছি বলে বেশ আনন্দ হল। এক অদ্ভুত তৃপ্তি।

এ-ধরনের খাপছাড়া আচরণ আমাকে অন্যান্য রাগী ছেলেমেয়ের থেকে আলাদা করে তুলল। এখন বুঝতে পারছি, ওইরকম রাগ নির্দিষ্ট দিন পর-পর হত, ঠিক এই অসুখটার মতো। কিন্তু তখন সেটা টের পাইনি, টের পাওয়ার কোনও কারণও ছিল না। আমার মা-বাবাও সেটা বুঝতে পারেননি। তাঁরা ভেবেছিলেন, এ শিশুসুলভ আবেগ ছাড়া কিছু নয়। এ নিয়ে বিশেষ দুশ্চিন্তাও তাঁদের হয়নি। আর হবেই বা কেন?

মায়ের কথা আমার বিশেষ মনে নেই। হয়তো বাবার ব্যক্তিত্বের ছায়ায় মা হারিয়ে গিয়েছিলেন। বাবা ছিলেন বিশাল চেহারার পুরুষ, লম্বা-চওড়া, কঠোর প্রকৃতির। সেই সঙ্গে নীতিবাগীশ ও ধার্মিক। আমাকে সবরকম অন্যায়ের ছায়া থেকে বাঁচিয়ে তিনি মানুষ করেছিলেন। কখনও কখনও আমার বুকের দিকে আঙুল উঁচিয়ে গম্ভীর গলায় তিনি বক্তৃতা দিতেন। বেশিরভাগই উপদেশ। কীভাবে তিনি অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন, সবরকম কুসঙ্গ এড়িয়ে চলেছেন ইত্যাদি। বাবাকে আমি ভীষণ ভয় পেতাম। চেষ্টা করতাম ঠিক পথে চলতে। যাতে তাঁদের মুখ উজ্জ্বল হয়। আজও, এই মুহূর্তে, আমি সেই পথ থেকে সরে আসিনি—শুধু আমার এই অসুখটা ছাড়া। ভাবতে অবাক লাগে, বাবাও এই ভয়ঙ্কর অসুখটা নিজের রক্তে বয়ে বেড়িয়েছেন। সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে সেই নীতিবাগীশ, জ্ঞানী, ধার্মিক ব্যক্তিটি অভিশাপের বোঝা তুলে দিয়েছেন তাঁর পুত্রের মাথায়, মিশিয়ে দিয়েছেন আমার রক্তে। এ-অসুখ যে আমার নিজের দোষে নয়, এটা তার আরও একটা অকাট্য প্রমাণ। কারণ বাবার মতো ভালোমানুষও এই অসুখে প্রতি মাসে আক্রান্ত হতেন, আমারই মতো। আর অবাক হতেন সেই ভয়ঙ্কর রূঢ় সত্যকে আবিষ্কার করে—যেমনটা আমি হয়েছি।

মাত্র একবার বাবা আমার সঙ্গে অন্যায় ব্যবহার করেছিলেন। নিছক অকারণেই। আমার ওপর ওই একবারই তিনি রাগ করেছিলেন। কারণ পাশের বাড়ির কুকুরটাকে আমি মেরে ফেলেছিলাম। আর বাবা বুঝেও বুঝতে চাননি যে, সেই কাজটা আমাকে নিরুপায় হয়েই করতে হয়েছিল।

যে ছেলেটি সবসময় আমার পেছনে লাগত, ঢিল ছুড়ত, আমার সেই প্রধান শত্রুরই কুকুর ছিল সেটা। ছেলেটার নাম আমার মনে নেই। ও নেহাতই সাধারণ ছিল, মনে রাখার মতো নয়। কিন্তু কুকুরটাকে আমার স্পষ্ট মনে আছে। একটা হাউন্ড। বিশাল ভয়ঙ্কর এক শিকারি জন্তু। ছেলেটা যখনই আমার পেছনে লাগত, কুকুরটা ওর সঙ্গে থাকত। মালিকের নিষ্ঠুর খেলার সঙ্গে যুক্ত হত ওটার হিংস্র গর্জন ও দাঁতখিঁচুনি। ছেলেটা আমাকে যখন বিরক্ত করত, তখন কুকুরটা হলদে চোখ মেলে আমাকে লক্ষ করত। ওটার লম্বা জিভ ঝুলে থাকত বাইরে, ধারালো দাঁত বসানো চোয়াল নড়ে উঠত এদিক-ওদিক—যেন আমার হেনস্থা দেখে মনে মনে ভীষণ খুশি হচ্ছে। সে সময় কুকুরটার দিকে তেমন মনোযোগ কখনও আমি দিইনি। কুকুরটাকে বা ছেলেটাকে, কাউকেই আমি বিশেষ আমল দিতাম না। তবে ঘৃণা করতাম বেশি জন্তুটাকেই। জানি, কুকুর যে মানুষের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু সেটা একটা প্রবাদে দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু তা নিতান্তই আবেগপ্রবণ মূর্খ ব্যক্তিদের নির্বোধ ধারণা। ভয়ঙ্কর পশুগুলোর ছলনাময় আচরণই এ-ধারণার কারণ। আর বিশেষ করে এই কুকুরটা এক নৃশংস ভয়ানক প্রাণী। তার বহুরঙা গায়ের চামড়া ও হলদে দাঁত তাকে আরও বেশি ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। ওটা কখনও আমাকে আক্রমণ করেনি, কিন্তু বলতে পারি, আমার শরীরে দাঁত বসাতে পারলে কুকুরটা খুশিই হত।

একদিন রাতে অনেক দেরি করে বাড়ি ফিরছিলাম। শহর থেকে আমাদের বাড়ি বেশ কয়েক মাইল দূরে, গ্রামে। অত রাতে বাইরে কী করতে বেরিয়েছিলাম মনে নেই, তবে বাড়ি ফেরার সময় রাত যে অনেক হয়েছিল তা স্পষ্ট মনে পড়ে। সে-রাতে আকাশে নিশ্চয়ই চাঁদ ছিল, কারণ সবকিছুই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। ওই ছেলেটার বাড়ির পাশ দিয়েই আমাদের বাড়ির পথ, কারণ একই রাস্তায় আমরা থাকতাম। ওদের বাড়িকে এড়িয়ে যেতে গেলে আমাকে জঙ্গল দিয়ে অনেকটা পথ ঘুরে যেতে হয়। বিনা কারণে জঙ্গলের ঘুরপথ দিয়ে যেতে চাইনি বলেই সেই ঘটনার সূত্রপাত।

যাই হোক, আপনমনে ওদের বাড়িটা পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি, কোথা থেকে উদয় হল আমার শত্রু। বরাবরের মতোই আমাকে লক্ষ্য করে পাথর ছুড়তে লাগল, আর আমিও ওকে তেমন গুরুত্ব দিলাম না। হেঁটে চললাম। ও একটা বড় পাথর সজোরে ছুড়ে মারল আমার পিঠে। প্রচণ্ড ব্যথা লাগল। বুঝলাম, পিঠে বেশ খানিকটা কেটে গেছে। কিছুটা পথ গিয়ে আমি সম্ভবত রাস্তার ধারে বসে পড়েছিলাম। ভাবছিলাম, ছেলেটা আমাকে এত ঘৃণা করে কেন, এবং একটু পরে আমিও ওকে প্রচণ্ড ঘৃণা করতে শুরু করলাম। এর আগে ওর সম্পর্কে এ ধরনের মনোভাব আমার কখনও আসেনি, হয়তো এতদিনের অত্যাচার অবিচারের যোগফল আজকের এই পুঞ্জীভূত ঘৃণা ও ক্রোধ। বসে বসেই ওর প্রতি আমার ঘৃণা ক্রমশ বাড়তে লাগল। মনে পড়ল প্রথমবারের কথা, যেবার ও আমার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল, আর আমি পেয়েছিলাম নিজের রক্তের স্বাদ। যে-কোনও কারণেই হোক, সেই রক্তের স্বাদ এখন আরও তীব্রভাবে টের পেলাম। জানি, যদি এসবের ইতি না টানি তবে ওই ছেলেটা চিরকাল আমাকে বিরক্ত করবে। সুতরাং উঠে দাঁড়িয়ে ফিরে চললাম ওদের বাড়ির দিকে।

ছেলেটা উঠোনে দাঁড়িয়ে ছিল—একটা ভাঙা টালির ঘরের ঠিক পাশে। আমাকে দেখতে পেয়ে ও একটা পাথর তুলে নিয়ে গালাগাল দিতে শুরু করল। নোংরা কথাগুলো শুনে আমার অসহ্য রাগ হল। এই প্রথম বুঝলাম, ছেলেটা কতখানি ছোটলোক। এতদিন কী করে যে ওর বদমাইশি সহ্য করেছি কে জানে। আমাকে বিরক্ত করার জন্যে ইচ্ছে হল ওকে শাস্তি দিই, কিন্তু শাস্তি দেওয়ার ইচ্ছেটা আরও বেশি হল ওর নোংরা স্বভাবের জন্যে, কুটিল মনের জন্যে। এরকম একটা মানুষের শিক্ষা হওয়া খুব দরকার।

সোজা এগিয়ে গেলাম ওর কাছে। খুব কাছে না যাওয়া পর্যন্ত ওর গালাগাল দেওয়া বন্ধ হল না। তারপর ওর ধীর আচ্ছন্ন বুদ্ধি দিয়ে ছেলেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারল ব্যাপারটা ঠিক অন্যান্যবারের মতো হচ্ছে না, কারণ ও পেছোতে শুরু করল। আমি ওর দিকে এগিয়ে যেতে থাকলাম, অত্যন্ত ধীর পায়ে। পাথরটা যখন ও ছুড়ে মারল সেটা সোজা আমার মুখে এসে লাগল, কিন্তু সে আঘাত আমি টেরই পেলাম না। ও দৌড়ে পালাল টালির ঘরের দিকে, আর আমি চকিতে টালির ঘর ও বাড়ির মাঝে গিয়ে দাঁড়ালাম। মনে আছে, কীভাবে ওর চঞ্চল চোখ এদিক-ওদিক ছিটকে তাকাচ্ছিল সাহায্যের জন্যে, পালানোর পথ খোঁজার জন্যে।

চেহারায় আমি ওর তুলনায় অনেক বড়সড়, শক্তিও আমার বেশি—স্কুলে সমবয়েসিদের সকলের চেয়েই আমি চেহারায় বড়—সুতরাং ও ভীষণ ভয় পেল। ওর এই ভয় পাওয়া আমাকে খুশি করল না। বরং প্রতিশোধের ইচ্ছেটা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল…বুঝলাম, ও স্পষ্ট জানতে পেরেছে ওকে শাস্তি পেতে হবে, বুঝতে পেরেছে ও খারাপ। আজ যদি ওকে শাস্তি না দিই, ও ভাববে কোনও অন্যায় ও করেনি। সে আমি সহ্য করতে পারব না। ওর দিকে আরও এক পা এগিয়ে যেতেই ও পালাতে চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। এখনও আমি অত্যন্ত ক্ষিপ্র এবং তৎপর, আর তখন তো আমার গতি ছিল শিকারি বেড়ালের মতো। দু-হাতে ওকে আঁকড়ে ধরলাম। গলা টিপে ধরে ওকে ছুড়ে ফেললাম মাটিতে। ও আমাকে লাথি মারার চেষ্টা করল, কিন্তু ওর পা দুটো একপাশে সরিয়ে আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম ওর দেহের ওপর। ছোট্ট হাতে আমার মুখে ঘুষি চালাতে লাগল ছেলেটা, কিন্তু সে-আক্রমণ পোকার কামড়ের চেয়েও তুচ্ছ। শক্ত দু-হাতে ওর গলা টিপে ধরলাম। শুরু হল ওর শাস্তি। ইচ্ছে ছিল, ওর পাপ অনুযায়ী ভয়ঙ্কর শাস্তিই ওকে দেব। ওর গলায় আমার হাতের চাপ ক্রমশ বাড়তে লাগল, ওর চোখজোড়া বিস্ফারিত হতে হতে কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম করল। মনে-মনে খুশি হলাম। উহুঁ, খুশির তুঙ্গে এগিয়ে চললাম—যেন চরম এক আনন্দ ধীরে-ধীরে এগিয়ে আসছে। আমার আঙুলের চাপ যত বাড়ছে, তত তাড়াতাড়ি সেই আনন্দ এগিয়ে আসছে কাছে। যেন আমার আঙুল বেয়ে উঠে আসছে কাঁধে, তারপর চুঁইয়ে চুঁইয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে। ওর ঘুষি চালানো একসময় থেমে গেল। ওর ছোট-ছোট হাত আমার কবজি চেপে ধরল, কিন্তু নিষ্ফল চেষ্টায়। শরীরের সমস্ত শক্তি দু-হাতে ঢেলে আমি ক্রমশ চাপ বাড়িয়ে চললাম।

ঠিক সেই মুহূর্তে নৃশংস জন্তুটা আমাকে আক্রমণ করল।

ওটা কখন যে গুড়ি মেরে আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করিনি। কুকুরটা ধূর্ত এবং ভয়ঙ্কর। আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে ওকে আমার নজরে পড়েনি। ছেলেটাকে ছেড়ে দিয়ে কুকুরটাকে নিয়ে আমি গড়িয়ে পড়লাম মাটিতে। কুকুরটা শক্তিশালী, কিন্তু সমান-সমান যুদ্ধে আমার কাছে নিতান্তই শিশু। ওটাকে নীচে ফেলে চেপে বসলাম ওর শরীরে, দু-হাতে গলার বেল্টটা আঁকড়ে ধরে মোচড় দিতে লাগলাম। ক্রমে পশুটার দমবন্ধ হয়ে আসতে লাগল। কুকুরটার ধারালো দাঁতে আমার হাতের মাংস ছিঁড়ে গেছে, হাত বেয়ে রক্ত ঝরে পড়ছে কুকুরটার লোমশ শরীরে।

রক্ত দেখে আমার সবকিছু গোলমাল হয়ে গেল। মাথায় বেজে উঠল অমানুষিক তীব্র এক টঙ্কার। তখনই বুঝলাম, পশুটা কত ভয়ঙ্কর এবং ওটাকে ধ্বংস করা কতখানি প্রয়োজন। গলার বেল্টে মোচড় বাড়াতেই বেল্টের চামড়া কেটে বসল ওটার লোমশ নরম গলায়। কুকুরটার লম্বা জিভ চোয়াল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে বাইরে। ওটার মাথা প্রচণ্ড জোরে ঠুকে দিলাম মাটিতে—যাতে পশুটার দাঁতগুলো ঢুকে যায় ওর নিজের হাসি মাখানো জিভে।

কুকুরটার মুখে বিশ্রী ধূর্ত হাসিটা এখন আর নেই। আর ওর চোখের দৃষ্টিরও কোনও তুলনা নেই। বুঝলাম, কুকুরটা মরতে চলেছে। আর, নিজেও বুঝেছে, ওর নৃশংসতার শাস্তি ওকে এইভাবে পেতে হচ্ছে। ওটার চোখ দুটো হলদে সেদ্ধ ডিমের মতো পাক খেয়ে বেরিয়ে আসতে চাইল কোটরের বাইরে। আমার হাসি পেল, কিন্তু সেরকম হাসলাম না। কারণ, তাতে আমার হাতের বাঁধন আলগা হয়ে যেতে পারে। তাই পুরোপুরি মরে না যাওয়া পর্যন্ত ওটাকে ছাড়লাম না।

অবশেষে যখন উঠে দাঁড়ালাম, দেখলাম, ছেলেটা সামলে উঠে পালিয়েছে। সম্ভবত বাড়িতে ঢুকে পড়েছে। হয়তো ওকে অনুসরণ করতাম, কিন্তু যে-কোনও কারণেই হোক ওর প্রতি আর আমার কোনও ঘৃণা নেই। হয়তো ভেবেছি, অপরাধের যথেষ্ট শাস্তি ও পেয়ে গেছে। হলফ করে বলতে পারি, আর কখনও ও আমাকে বিরক্ত করবে না। চাঁদের আলোয় কুকুরটাকে দেখাচ্ছে তেলকালি মাখানো নরম ন্যাকড়ার মতো। আমার ভালো লাগল। ভীষণ ভালো লাগল। কাজটা বেশ নির্ঝঞ্ঝাটে শেষ হয়েছে। খুশিমনে ফিরে চললাম বাড়িতে। হাতের ব্যথা সেদিন অনেক দেরিতে টের পেয়েছিলাম।

পরদিন সকালে ছেলেটার বাবা এলেন আমাদের বাড়িতে। কীসব কথাবার্তা বললেন আমার বাবার সঙ্গে। তিনি চলে গেলে বাবা আমাকে ডাকলেন। দেখলাম, বাবা ভীষণ রেগে গেছেন। তাঁকে বুঝিয়ে বললাম, আত্মরক্ষার জন্যে ওই কাজ আমাকে করতে হয়েছে, নয়তো কুকুরটাই আমাকে মেরে ফেলত। কিন্তু বাবার ধারণা আমি ছেলেটাকে প্রথমে মারধোর করেছি এবং কুকুরটা ওকে বাঁচাতে গিয়ে মারা গেছে। এমনকী বাবাও ওইসব আজগুবি কথা বিশ্বাস করতেন যে, কুকুর অত্যন্ত প্রভুভক্ত প্রাণী। আর আমি তাঁকে বোঝাব সাধ্য কী। হাতের কাটা জায়গাগুলো বাবাকে দেখালাম, কিন্তু কোনও ফল হল না। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, আমি ছেলেটাকে মারতে গেছি। কী অদ্ভুত। ওই একবারই বাবা আমার ওপর অবিচার করেছিলেন। এবং কিছুদিনের মধ্যেই সে ঘটনা তিনি ভুলে গিয়েছিলেন।

এর পর আর কখনও কেউ আমার সঙ্গে ঠাট্টা করেনি বা পাথর ছোড়েনি।

৭ জুন

আজ খুব সকাল-সকাল উঠেছি। ইচ্ছে আছে দুপুরে খাওয়ার আগে পর্যন্ত এই ডায়েরি লিখব। কুকুরটার বিষয়ে গতকালের লেখাটা আর একবার পড়লাম। মনে হয় না অসুখটার সঙ্গে এ-ঘটনার কোনও সম্পর্ক আছে। বলতে গেলে নিজেকে বাঁচানোর জন্যেই কুকুরটাকে সেদিন আমি মেরে ফেলতে বাধ্য হয়েছিলাম। অন্য কেউ হলেও তাই করত। কিন্তু এ থেকে আমার শারীরিক ক্ষমতার কিছুটা পরিচয় পাওয়া যায়। এ ছাড়া স্বাভাবিক অবস্থায় আমার সহ্যশক্তি যে কতখানি তারও আন্দাজ পাওয়া যাবে। সুতরাং কাগজে-কলমে এর উল্লেখের প্রয়োজন আছে। এখন অসুখের শুরুর সময়কার ঘটনাগুলো মনে-মনে আবার ঠিক করে নিয়ে স্পষ্টভাবে লেখার চেষ্টা করব। সময়ের সঙ্গে অসুখটার তীব্রতা কীভাবে বেড়ে চলেছে তাও আমি ভালোভাবে গুছিয়ে লিখে রাখতে চাই—যাতে বুঝতে পারি, এর পরের পরিবর্তনটা কীভাবে আমার জীবনে আসতে চলেছে।

ওই সময়কার যে-ছবিটা আজও আমার মনে জোরালো ও স্পষ্ট তা হল বন-জঙ্গল। গ্রামে এক বিশাল জীর্ণ বাড়িতে আমরা থাকতাম। তার পেছনেই ছিল গভীর জঙ্গল। বাড়িটায় হাওয়া বাতাস ছিল প্রচুর, আর ছিল এক অদ্ভুত ঠান্ডা স্যাঁতসেঁতে ভাব। সেটা আমার একটুও ভালো লাগত না। কিন্তু জঙ্গলে আমার সবসময় ভালো লাগতো—শুধু ওই অদ্ভুত সময়গুলো ছাড়া। আর ভালো লাগত একা-একা জঙ্গলে যেতে। নির্জন জায়গায় নিজেকে কেমন যেন নিরাপদ মনে হয়।

জঙ্গলের ছবিটা এখনও আমার মনে আছে। অবশ্য চাঁদের আলো ছাড়া সে-ছবি আমি কল্পনায় আনতে পারি না। দিনের আলোয় দেখা জঙ্গলের দৃশ্য আমর মনে ধূসর, অস্পষ্ট। হতে পারে দিনের আলোয় অন্যান্য আকর্ষণই এই অস্পষ্টতার কারণ, এ ছাড়া নির্দিষ্ট কোনও স্মৃতি সবসময়েই তাৎক্ষণিক অনুভবের শিকার হয়ে পড়ে। কিন্তু রাতে! একটা রাতের কথা আমার মনে আছে…না কি অনেক রাতের স্মৃতি একই রকম হওয়ায় সেগুলো একটা রাতের স্মৃতিতে মিশে গেছে?

চারপাশের লম্বা-লম্বা শালগাছের মাঝে একটু খোলা জায়গায় আমি দাঁড়িয়ে আছি। জঙ্গলটা একটা ছোট পাহাড়ের ওপর, আর পাহাড়ের নীচে ঘন অন্ধকার ছায়ায় লুকিয়ে রয়েছে আমাদের বাড়িটা। উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে বাড়ির ছাদটা আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। জায়গাটা অন্ধকার হলেও গাছের মাথাগুলো চাঁদের আলোয় রুপোর মতো চকচক করছে। হাওয়ায় দুলছে অসংখ্য রুপোর পাত। চারদিক ভীষণ শান্ত, কয়েক টুকরো পেঁজা তুলোর মতো মেঘ চাঁদকে পাশ কাটিয়ে ভেসে যাচ্ছে দূরে। ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে এক আকুল আকাঙ্ক্ষা আমাকে গ্রাস করল, কিসের যেন এক অস্পষ্ট অদ্ভুত ইচ্ছে। বসন্তকালে যেমনটা হত, অনেকটা সেইরকম। স্কুলে বসে জানলা দিয়ে আকুল চোখে চেয়ে থাকতাম বাইরের কচি ঘাস আর রঙিন ফুলের দিকে। কী যেন একটা করতে ইচ্ছে করত।

কিন্তু এ-ইচ্ছে তার চেয়েও অনেক বেশি তীব্র। কী যেন আমাকে করতে হবে, অথচ করতে পারছি না। তখন ভেবেছিলাম এ হয়তো কোনও যৌন কামনা। হয়তো সেই জন্যেই জামা-প্যান্ট সব খুলে ফেলেছিলাম—এমনকি জুতো-মোজা পর্যন্ত। সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম বনের মধ্যে। ঠান্ডা ছিল না, কিন্তু আমার কাঁপুনি আসছিল। চাঁদের আলোর এক তীক্ষ্ণ রুপোলি বর্ণা গাছের ঘন পাতা ভেদ করে এসে ঠিকরে পড়েছে শুকনো পাতা ছাওয়া মাটিতে। তার শীতল দ্যুতি আমাকে যেন বরফ করে দিল। আর আমি শুধু দাঁড়িয়ে রইলাম। মাথা পেছনে হেলিয়ে, মুখ হাঁ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে। কাঁপতে লাগলাম। যেন আমার শরীরের প্রতিটি শিরায়, প্রতিটি স্নায়ুতে ভয়ঙ্কর এক তড়িৎপ্রবাহ ছুটে চলেছে। কতক্ষণ ওইভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না। নিশ্চয়ই অনেকক্ষণ, কারণ তখন রাত ভোর হয়ে এসেছে। হঠাৎ সব কিছু শেষ হয়ে গেল। সেই ইচ্ছেটাও আচমকা গেল মিলিয়ে। খেয়াল করলাম, আমি চিৎকার করছি। ঠিক চিৎকার নয়—অনেকটা কোনও পশুর গর্জনের মতো, যেন কোণঠাসা কোনও জন্তুর আর্তনাদ। একসময় থামলাম। চারদিক নিস্তব্ধ ছায়া-ছায়া অন্ধকার। কেমন অদ্ভুত লাগছে। নিজেকে ভীষণ নগ্ন লাগছে, একা লাগছে। এইসব করেছি বলে লজ্জা করছে।

তখনও আমার ধারণা ছিল এর সবটাই যৌন কামনা। কিন্তু একটা বিচিত্র স্বস্তিও পেলাম। জামাকাপড় পরে ফিরে এলাম বাড়িতে। সে-মাসে আর তেমন কিছু হয়নি। সবকিছুই ঠিকঠাক চলেছিল। মনে ফিরে এসেছিল প্রশান্তি। যা বলছিলাম, এটা কোনও বিশেষ রাতের স্মৃতি, না কি বহু মাস বহু রাতের একই স্মৃতির যোগফল, তা জানি না। তখন আমি নিশ্চয়ই খুব ছোট ছিলাম…।

এইমাত্র যা লিখেছি তাই নিয়েই ভাবছিলাম। মনে হয় এ-ঘটনা একবার নয়, বহুবারই ঘটেছে। টুকরো-টুকরো স্মৃতি মনে পড়ে আমি নগ্ন হয়ে জঙ্গলে দৌড়চ্ছি, গুড়ি মেরে বসে আছি গাছপালার আড়ালে, ওত পেতে রয়েছি কোনও পাথরের পেছনে। ঘটনাগুলোই শুধু আমার মনে আছে, সে সময়কার ভাব-অনুভূতি কিছু মনে নেই। যেমন মনে আছে বন্ধ পাতালঘরে ওটার দুরন্ত দাপাদাপির স্মৃতি। মনে হয় না, জঙ্গলে আমি কারও ভয়ে দৌড়ে পালাচ্ছিলাম বা লুকিয়ে ছিলাম গাছপালার আড়ালে। শুধু এটুকু বলতে পারি, জঙ্গলে আমি একা ছিলাম—একেবারে একা।

তখন কোনওরকম শারীরিক পরিবর্তন যে আসেনি সেটা স্পষ্ট মনে পড়ে। কোনওরকম সন্দেহ তাতে নেই। আর আশ্চর্য, কবে যে প্রথম পরিবর্তনটা এল তা আমার মনে নেই। পরিবর্তনটা সম্পর্কে কীভাবে সচেতন হলাম তাও জানি না। এটা নিশ্চয়ই অত্যন্ত ধীরে ক্রমে ক্রমে এসেছে। যার ফলে কোনওরকম স্পষ্ট দাগ আমার স্মৃতিতে নেই।

পরিবর্তনের প্রথম যে-স্মৃতি মনে পড়ে সেটা হয়েছিল আমার শোয়ার ঘরে, জঙ্গলে নয়। সম্ভবত এটা অসুখ শুরু হওয়ার অনেক পরের ঘটনা। আমি সেদিন বিছানায় বসে ছিলাম, ঝুঁকে পড়ে পরীক্ষা করছিলাম আমার হাত দুটো। বিছানাটা জানলার ঠিক পাশে। জানলায় তাকালে সরাসরি চোখে পড়ে রুপোলি চাঁদ, শোয়ার ঘরে চাঁদের আলোয় ছায়ার লুকোচুরি।

হাত দুটো রাখা ছিল আমার কোলে, আলোর এক তীক্ষ্ণ ফলা ঠিকরে পড়েছে তাদের গায়ে। আমি সম্পূর্ণ নগ্ন। শরীরের তুলনায় আমার শিরদাঁড়াকে আরও বেশি নগ্ন লাগছে। যেন সেখান থেকে চামড়া পর্যন্ত ছাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে। বসে বসে লক্ষ করছি নিজের হাত দুটো। এ প্রথমবারের ঘটনা হতেই পারে না, কারণ আমি যেন জানতাম কীসের প্রত্যাশায় আমি অধীরভাবে অপেক্ষা করছি। মনে আছে, আমার হাতের নখগুলো কীভাবে বাড়তে শুরু করল, হাত কাঁপতে লাগল, চামড়া খসখসে হয়ে কুঁচকে এল, আঙুলগুলো ক্রমশ বেঁকে যেতে লাগল কোনও পশুর…।

তারপর কী করেছি মনে নেই।

৮ জুন

তন্দ্রা বউ হিসেবে খুব ভালো।

ও যা সহ্য করে আর কোনও মেয়ে করত কিনা জানি না। মিথ্যে কথা বলব না, ওকে দেখতে তেমন একটা সুন্দরী নয়। হয়তো প্রেম-ভালোবাসার নদীতে শেষ কুটো হিসেবেই ও আমাকে আঁকড়ে ধরেছে, কিন্তু আমি তা মনে করি না। আমি বিশ্বাস করি ও আমাকে ভালোবাসে। আমার অসুখের কথাটা ও মাঝে মাঝে বুঝতে চায় না দেখে আমি বিরক্ত হই, কিন্তু এ ছাড়া ও খুব ভালো মেয়ে। ওর বোঝা উচিত আমি কখনও ওর ক্ষতি করব না। ওর কেন, কারও ক্ষতি করব না। কারও যাতে ক্ষতি না হয় সেজন্যে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করি। আসলে আমি ভীষণ লাজুক এবং শান্ত। এই কারণেই আমার অসুখটাকে নিছক শারীরিক বলে বুঝতে না পারলে লোকের চোখে ওই বৈসাদৃশ্যটা প্রকট হয়ে ওঠে। লোকে বোঝে না, তখন আমি অন্য কিছু হয়ে যাই, হয়ে উঠি বিপজ্জনক। কিন্তু তবুও নিজেকে কোনওরকমে আমি সামলে নিয়েছি, আর সেইজন্যেই কাউকে কখনও আমি আঘাত করিনি, কারও কোনও ক্ষতি করিনি।

তন্দ্রাকে কথা দিয়েছি আজ ওকে বাইরে খাওয়াতে নিয়ে যাব। শুনে ও ভীষণ খুশি হয়েছে। আমরা খুব একটা বেরোই না। জমকালো জীবন আমার ভালো লাগে না। আমি ঘরে থাকতেই ভালোবাসি। কিন্তু মাঝে-মধ্যে বেরোলে মন্দ কী! তন্দ্রাও বেড়াতে ভালোবাসে, তবে আমার সঙ্গে এ-বিষয়ে ও একমত যে, এ ধরনের বেড়ানো-টেড়ানো বছরে দু-তিনদিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেই ভালো। ও জামাকাপড় পরে তৈরি হচ্ছে। যদি রাত না হয়ে যায় ফিরে এসে আবার লিখতে বসব।

উঃ, আজকের সন্ধেটা কী বিচ্ছিরিই না কাটল!

এইমাত্র আমরা ফিরেছি, আর তন্দ্রা সোজা ওর ঘরে গিয়ে ঢুকেছে। হয়তো আমার ওপর রাগ করেছে। আজ বেরনোর আগে আমার দশবার ভাবা উচিত ছিল। মেয়েদের মরজি স্বয়ং ভগবানও বুঝতে পারেন না। ওরা জীবন সম্পর্কে ভীষণ অবুঝ।

সন্ধের শুরুতেই গোলমাল। তন্দ্রা এমন একটা ব্লাউজ গায়ে দিল যেটা ও জানে আমি ভীষণ অপছন্দ করি। ব্লাউজটা কাঁধ খোলা, হাতকাটা, কদর্য রুচির। এটা পরলে ওকে বেশ্যার মতো দেখায়। প্রথমে ভালো কথায় বলতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু সহজ সত্যিটা শুনে ও বিরক্ত হল। মেয়েরা কেন যে সত্যি কথা শুনলে রাগ করে, আর মনভোলানো প্রশংসায় খুশি হয়, কে জানে। আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখলেই আমার কথাটা যে কতখানি সত্যি তা ও বুঝতে পারত। এত বছর বিয়ে হওয়ার পর ওর অন্তত জানা উচিত বিনা কারণে তোষামোদ করা আমার স্বভাব নয়, আর নিজের বউয়ের কদর্য বেশবাস আমি কখনও বরদাস্ত করি না। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওই ব্লাউজটা ও পরল, এবং বাড়ি থেকে বেরনোর আগেই সে নিয়ে একপ্রস্থ ঝগড়া হয়ে গেল। অবশেষে ওর কাছে হার মানলাম। কিন্তু সেটাই হল আমার ভুল। এ-নিয়ে সারাটা রাত যে আমার মেজাজ তিরিক্ষে হয়ে থাকবে সেটা আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল।

রেস্তোরাঁয় ঢুকে একটা খালি টেবিল দেখে বসতেই লক্ষ করলাম বেশ কয়েকজন লোকের নজর তন্দ্রার দিকেই। কিন্তু ও সেটা খেয়াল করেছে বলে মনে হল না। ও হাসিখুশি হয়ে বসল, দেখতে লাগল ঘরের চারদিকে। আমার বিশ্বাস, ঘরের প্রতিটি লোক নির্ঘাত ভেবেছে ও ফষ্টিনষ্টি করার জন্যে কাউকে খুঁজছে। ওর ওই পোশাক দেখে আর কী-ই বা তারা ভাববে? অপমানে মাটিতে মিশে গেলাম। লোকগুলোর মনের ভাব আমি সহজেই অনুমান করতে পারছি। তন্দ্রাকে দেখে ওরা ভেবেছে কোনও বেশ্যাকে আমি রাস্তা থেকে তুলে এনেছি। লিপস্টিকের কল্যাণে ওর ঠোঁটজোড়া টুকটুকে লাল, সামনে ঝুঁকে বসায় বুকের উপত্যকা উন্মুক্ত। টেবিল ছেড়ে উঠে যেতে নেহাত লজ্জা হল, নইলে সেই মুহূর্তেই রেস্তোরাঁ ছেড়ে বেরিয়ে পড়তাম। প্রতিজ্ঞা করলাম, বাড়ি ফিরেই ওই ব্লাউজটা জ্বলন্ত উনুনে গুঁজে দেব। তাহলে আর কোনওদিন আমাকে এরকম লজ্জায় পড়তে হবে না। আর আশ্চর্যের কথা, বেচারা তন্দ্রা টেরও পাচ্ছে না ওকে নিয়ে সবার মনে কী কাণ্ডটাই না হয়ে চলেছে। ও এতই সরল আর নিষ্পাপ! খুশি হয়ে ও চারপাশে দেখতে লাগল, আর আমি কাউকে না দেখার ভান করতে লাগলাম। যদিও নজরে সবাইকেই পড়ছিল। রেস্তোরাঁয় আরও ক’জন মেয়ে ওই ধরনের কি তার চেয়েও বাজে পোশাক পরে এসেছে। তখনই বুঝলাম, রেস্তোরাঁটা বিশেষ সুবিধের নয়। এখানে আমাদের আসা ঠিক হয়নি। এখানে আগে কখনও আসিনি। কিন্তু রেস্তোরাঁটার নাম আছে। আর সেই নাম শুনে আমি ঠকেছি। রেস্তোরাঁর দেওয়ালের রঙ গোলাপি। ঘরের আলো প্রয়োজনের তুলনায় কম উজ্জ্বল। সেই অল্প আলোতেও দেওয়ালে আঁটা স্তনসর্বস্ব অভিনেত্রীদের নোংরা ছবিগুলো স্পষ্ট চোখে পড়ছে। মেনু কার্ডে দেখলাম, খাবারের দাম অত্যন্ত বেশি। স্বাভাবিক।

বেয়ারা এসে তন্দ্রার পেছন থেকে টেবিলে ঝুঁকে পড়ল। একটু বেশিই। হলফ করে বলতে পারি, ব্যাটা তন্দ্রার লো কাট ব্লাউজের ভেতরে উঁকি মারার চেষ্টা করছে। লোকটার সেই আঠালো হাসিটা মনে পড়লে এখনও আমার রাগ হচ্ছে। বেয়ারাটার সরু গোঁফ ও কোঁকড়ানো বাবরি চুল। কথাবার্তার ভঙ্গিও কেমন অদ্ভুত। সুতরাং সে যদি অর্ডার ভুল করে অন্য খাবার নিয়ে আসে তাহলে আমার ধৈর্যের বাঁধ যে ভেঙে পড়বে তাতে আর আশ্চর্য কী।

এমনিতে বিদেশি খাবার আমি খুব একটা পছন্দ করি না। কিন্তু তন্দ্রার কথা মনে রেখেই অপছন্দের কাজ আমাকে করতে হয়। বেয়ারাকে বলেছিলাম ফ্রায়েড রাইস আর চিলি প্রন নিয়ে আসতে। তন্দ্রা চিংড়ি মাছ ভালোবাসে। যখন সে ফিরে এল, তার হাতে চাও-মিন আর সুইট অ্যান্ড সাওয়ার প্রন। দেখলে বমি আসে। শুরু থেকে এত কিছু দেখে এটা আর হজম করা যায় না। রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক, কিন্তু তা হলেও নিজেকে সংযত করা উচিত ছিল। তন্দ্রাও বলছে, প্লেট দুটো আমার বেয়ারার মুখে ছুড়ে মারা উচিত হয়নি। কিন্তু তাতে আমার বিন্দুমাত্র দুঃখ নেই। এই হ্যাংলা মানুষগুলোর স্পর্ধা অসহ্য। রাগের মাথায় কোনও ভাবনাচিন্তা না করেই যা করার করে ফেলেছি। দু-হাতে দুটো খাবারের প্লেট তুলে নিয়ে চকিতে বসিয়ে দিয়েছি বেয়ারাটার দু-গালে। লোকটা সামনের দিকে ঝুঁকে নোংরা ভাবে হাসছিল। খাবারে মাখামাখি মুখ নিয়ে সটান পড়ে গেল মেঝেতে। এরকম পরিস্থিতিতে বোধহয় এর চেয়ে ভদ্র ব্যবহার করা যায় না। আমি চিৎকার করে গালিগালাজও করিনি, লোকটাকে কোনও কথাও বলিনি, আর হাত-পা ছুড়ে ভিড়ও জমাইনি। শুধু প্লেট দুটো ওর মুখে ছুড়ে মেরেছি।

তারপর আমরা বেরিয়ে এসেছি। কেউ আমাদের বেরিয়ে যেতে বলেনি। আমরা নিজে থেকেই চলে এসেছি। নোংরা ব্যবহারের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ায় রেস্তোরাঁর লোকগুলো মনে হয় আমার ওপর খুশিই হয়েছে। বেরিয়ে আসার সময় তন্দ্ৰা কাঁদছিল। চারপাশে তাকিয়ে দেখি সকলেই আমাদের দিকে তাকিয়ে। আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে তারা তন্দ্রার শরীরের দিকে তাকিয়ে। কেউ-কেউ ক্রুদ্ধভাবে এই ঘটনা নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা কাটাকাটি করছে, কেউ বা হাসাহাসি করছে। কিন্তু আমি সেসব গায়ে মাখলাম না। মাথা সোজা রেখে সদর্পে রেস্তোরাঁ ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। এতটুকু সময়ের জন্যে নিজেদের সম্মান আমি নষ্ট হতে দিইনি।

তন্দ্রা কিছুতেই বুঝবে না, এর সবটাই ওর দোষ। ও সোজা ওর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। দরজায় খিল দেওয়ার শব্দ আমি শুনেছি। একে মেয়েলিপনা ছাড়া আর কী বলব। আমি কখনও ওর ঘরে যাই না।

যাই হোক, আজ সন্ধের ঘটনায় তন্দ্রার অন্তত একটা শিক্ষা হবে। এবারে ও হয়তো বুঝবে এত ঘন-ঘন বাইরে বেরনোটা ঠিক নয়।

৯ জুন

আজ সকালেও তন্দ্রার রাগ পড়েনি। কিছুক্ষণ তো আমার সঙ্গে কথাই বলেনি। তাতে ক্ষতি নেই, কারণ তখনও আমার মনে ঘুরছে সেই সন্ধেটার কথা, মনে পড়ছে বীভৎস রেস্তোরাঁটার কথা। কিন্তু ও একবার বলে বসল, অমন বিনা কারণে আমার নাকি রেগে ওঠাটা ঠিক হয়নি। বিনা কারণে! এমনকী এরকম ইঙ্গিতও দিল যে, এটা আমার রোগের একটা লক্ষণ! মাসের এই মাঝামাঝি সময়ে! এতেই বোঝা যায়, রোগটাকে তন্দ্রা এখনও ঠিক চিনে উঠতে পারেনি। টেবিলের কানা আঁকড়ে ধরে নিজেকে সংযত করেছি। ওকে কোনও কথাই বলিনি। কিন্তু আমার মুখে সম্ভবত ভয়ঙ্কর রাগ ফুটে উঠেছিল, কারণ তন্দ্রা কোনও কথা না বলে উঠে চলে গেল। ওকে দেখে মনে হল যেন শাস্তি পেয়েছে।

ওর বোকামোর ব্যাপারে আমাকে আরও ধৈর্য ধরতে হবে। কোনও সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে জিনিসটা বুঝে ওঠা বেশ কষ্টকর। তন্দ্রাকে যেদিন অসুখটার কথা সমস্ত খুলে বলেছি, তখন ও যা আঘাত পেয়েছে তা বলার নয়। মাঝে-মাঝে মনে হয় ওই আঘাত ওকে মানসিক দিক থেকে অসুস্থ করে তোলেনি তো? সেরকম না হলেও কিছুটা অসুস্থ ও হয়েছে। নইলে মাঝে মাঝে অমন যুক্তিহীন কাজ করে বসে কেন? যেমন, ওর ধারণা ওই বেশ্যা-মার্কা ব্লাউজটায় ওকে দারুণ মানায়, তারপর বাচ্চা মেয়ের মতো রোজ সন্ধেয় বেড়াতে বেরনোর বায়না, আর যুক্তিসঙ্গত সত্যিকারের রাগকে আমার রোগের লক্ষণ বলে মনে করা। নাঃ, ওর ব্যাপারে আমাকে আরও ধৈর্য ধরতে হবে। বেচারা!

যখন আমাদের বিয়ে হয় তখন পরিস্থিতি এতটা খারাপ ছিল না। আরও পরে, অনেক পরে, অসুখটা খারাপ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই খারাপের দিকে যাওয়াটা এত ধীরে হয়েছে যে, আমি আগে থেকেই তা অনুমান করতে পেরেছি, এবং কোনওরকম দুর্ঘটনা যাতে না হয় তার বন্দোবস্তও করেছি। অবশ্য তখন পাতালঘরটা হয়নি—তৈরি করার কোনও প্রয়োজন ছিল না। প্রয়োজন যখন হল, তখন ওটা তৈরির জন্যে হাতে প্রচুর সময়ও ছিল।

হ্যাঁ, পরিবর্তন আমার একটা হত। তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এখনকার মতো এতটা হত না। পুরোটা তো হতই না। তখনও আমাকে মানুষের মতোই দেখাত। প্রথমদিকে, যখন আয়নায় তাকাতে ভয় পেতাম না, নিজের চেহারা আমি দেখেছি। স্পষ্ট মনে আছে, আমার মুখ দেখে মনে হত যেন সপ্তাখানেক দাড়ি-গোঁফ কামাইনি। ব্যস, আর কিছুই নয়। দাঁতগুলো ছিল লম্বা, কিন্তু তখনও পর্যন্ত সেগুলো ঠোঁট দিয়ে ঢাকা দিতে পারতাম। দেখে মনে হত আমার দাঁত উঁচু। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ছিল চোখ দুটোর। সে দুটো নিঃসন্দেহে ছিল কোনও জন্তুর চোখ—অন্তত মানুষের চোখ তো নয়ই। কিন্তু যে আমার অসুখের কথা জানে না, জানে না স্বাভাবিক সময়ে আমাকে কেমন দেখায়, তার চোখে মোটেও অস্বাভাবিক কিছু ধরা পড়বে না। তারা শুধু ভাববে আমাকে দেখতে অত্যন্ত কুৎসিত।

নিজেকে সামলে রাখার ক্ষমতা সে-সময়ে আমার ছিল। অসুখটার দাপটে কখনও কাবু হতাম না। শুধু শরীরের ভেতর ওটা জ্বরের মতো আগুন জ্বালিয়ে দিত। আর আমিও মোটামুটিভাবে ‘আমি’তেই থাকতাম। এসব পাতালঘরের দরকার হয়ে পড়ার অনেক আগের ঘটনা। তন্দ্রাকেও তখন এ-অসুখের কথা বলিনি। সব গোপন রেখে ওকে বিয়ে করাটা হয়তো আমার অন্যায় হয়েছে, কিন্তু কখনও ভাবিনি অসুখটা আরও খারাপের দিকে মোড় নেবে। আর আমার নিশ্চিত বিশ্বাস, তন্দ্রাকে সব জানিয়েও কোনও লাভ হত না। আমাকে ও বিয়ে করতই।

সেইসব রাতে, যখন অসুখটা হত, আলো নিভিয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তাম। অবশ্য আমাদের শোয়ার ঘর আলাদা। তন্দ্রাকে বলতাম, আমার শরীরটা ভালো নেই। ও আর আমাকে বিরক্ত করত না। ক্রমে ক্রমে অসুখের মাসিক নিয়মটা নিশ্চয়ই ও খেয়াল করেছিল, কারণ একবার এই মাসিক অসুখ নিয়ে ও বেশ একটা স্থূল রসিকতা করে আমার সঙ্গে। আর আমিও স্বামীকে কী বলা উচিত না বলা উচিত, তার ওপরে এক জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দিয়ে ফেলেছিলাম।

কিন্তু ক্রমে অবস্থা আরও খারাপের দিকে যেতে লাগল। অবশেষে ঠিক করলাম, আর ঝুঁকি নেওয়া ঠিক নয়, তাই মাসে একবার করে শহরের বাইরে চলে যেতে লাগলাম। ওকে বলতাম ব্যবসার কাজে যেতে হচ্ছে। আমার ধারণা, ও অবিশ্বাস করত না। ওর কথাবার্তায় সন্দেহের কোনও সুর ছিল না, আর এই বাইরে যাওয়া নিয়ে অশ্লীল কোনও ঠাট্টাও করত না। ও জানত, রক্ষিতা পোষা অথবা মাসে একটা রাত পয়সা দিয়ে ফুর্তি লুটতে যাওয়া আমার চরিত্রের বাইরে। সুতরাং ও আমাকে বিশ্বাস করত। কোনও প্রশ্ন করত না।

আমি চলে যেতাম তিরিশ-চল্লিশ মাইল দূরের কোনও ছোট টাউনে। প্রতি মাসে এক নতুন টাউন বেছে নিতাম। গিয়ে উঠতাম কোনও ছোট সস্তার হোটেলে। কারণ, সস্তার হোটেলে খোঁচা-খোঁচা দাড়িওলা কুৎসিত কোনও লোককে কেউ খেয়াল করবে না। সেখানে একটা ছোট্ট নোংরা ঘরে কাটিয়ে দিতাম ভয়ঙ্কর সেই দীর্ঘ রাত। অবস্থা যত খারাপই হোক না কেন, সারাটা রাত ঘর ছেড়ে এক মুহূর্তের জন্যেও বেরোতাম না। আর অবস্থা খারাপ কাকে বলে! ভীষণ ইচ্ছে করত বাইরে বেরিয়ে পড়তে। কী যেন একটা…করতে ইচ্ছে করত…হয়তো নগ্ন হয়ে জঙ্গলে ছুটে বেড়ানোর ইচ্ছেটা আবার মাথাচাড়া দিত। কিন্তু প্রচণ্ড যুদ্ধ করে সে ইচ্ছেকে দমন করতাম। ঘর ছেড়ে বেরোতাম না। ভেতর থেকে সবসময় দরজায় তালা দিয়ে রাখতাম। কেউ আমাকে বাইরে থেকে তালা দিয়ে রাখলে হয়তো আরও ভালো হত, কিন্তু হোটেলের কোনও বেয়ারাকে তো সে-অনুরোধ করা যায় না। তাতে লোকের সন্দেহ হত। সুতরাং নিজের মনের জোরের ওপর ভরসা করতেই হত। সৌভাগ্যবশত আমার মন অত্যন্ত শক্ত, তাই কোনওরকমে সব সামলে নিতাম। সময়ে সময়ে অবস্থা ভীষণ খারাপ হয়ে পড়ত, কিন্তু তাও হার স্বীকার করিনি।

আরও পরে যখন বুঝলাম ব্যাপারটা ক্রমশ হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে, তখন পাতালঘরের প্রয়োজন হয়ে পড়ল। এ-পরিকল্পনা অনেকদিন ধরেই মাথায় ঘুরছিল। সুতরাং তন্দ্রাকে অসুখের কথা সব খুলে বললাম। সে যে কী কষ্ট। তন্দ্রা বুদ্ধিতে দুনিয়ার সেরা নয়, তাই প্রথমটায় পুরো ব্যাপারটা ইয়ার্কি মেরে উড়িয়ে দিল। বিশ্বাসই করতে চাইল না। ভাবল, আমি ঠাট্টা করছি। কিন্তু যখন কন্ট্রাক্টর ডেকে পাতালঘর তৈরির কাজ শুরু করলাম, তখন ও বুঝতে পারল আমি ঠাট্টা করছি না। হয়তো ভাবল, আমার মাথার ঠিক নেই। নাঃ, সে-কথা ও মুখে কখনও বলেনি। তবে ওর চাউনিতে সেটা স্পষ্ট বোঝা যেত। যখন পাতালঘরের দেওয়ালে গদি মোড়ার কাজ শুরু হল, তখন ও আপনমনেই গজগজ করত আর মাথা নাড়ত। যেন বলতে চাইত, এ-পাগলামির কোনও মানে হয়। কোনও মানে হয় এসব পণ্ডশ্রমে সময় নষ্ট করার? এ-মনোভাব হওয়াটাই স্বাভাবিক। ওকে একটুও দোষ দেওয়া যায় না।

অবশ্য এখন ও বোঝে। ধীরে-ধীরে বুঝতে পারছে। যদিও মাঝে মাঝে বোকার মতো ভুল করে, শরীরের আর মনের অসুখের পার্থক্যটা বুঝতে চায় না, বুঝতে চায় না স্বাভাবিক আর অস্বাভাবিকের তফাত। পারবে, সময় হলেই পারবে।

পাতালঘর তৈরি হয়েছে আজ ছ’মাস। প্রতি মাসেই সে ঘরে আমাকে যেতে হয়েছে, আর তন্দ্রাও বিনা প্রশ্নে ওর কর্তব্য পালন করেছে। ও বউ হিসেবে খুব ভালো। মাঝে-মাঝে ওর নির্বুদ্ধিতায় বা অবুঝ ব্যবহারে আমি যে সামান্য বিরক্ত হই, সেটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। সংসারে এমনটা হয়েই থাকে—বিশেষ করে যখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বুদ্ধির তফাতটা এত বেশি।

আমার বউকে নিয়ে আমি খুশি। ওর দোষ-ত্রুটির ব্যাপারে আমাকে আরও ধৈর্য ধরতে হবে। অবুঝ বলে ক্ষমা করতে হবে। ওর মনে কোনওরকম আঘাত দিলে চলবে না। আঘাত আমি কাউকে কখনও দেব না…।

৯ জুন

প্রতি মাসের সেই বিশেষ রাতে তন্দ্রার আড়ষ্ট ব্যবহারকে আমি কখনও দোষ দিইনি। এর সূত্রপাতের জন্যে আমিই দায়ী। যদিও আমার ভূমিকা ছিল নিরুপায় দর্শকের মতো। কারণ আমি স্বপ্নেও কল্পনা করিনি, কেউ কখনও এসে মাঝরাতে পাতালঘরের দরজা খুলে আমাকে স্বাধীনতা এবং মুক্তি দেবে। তখন আমি—কিংবা সেই ভয়ঙ্কর-আকস্মিক সেই ঘটনায় বিহ্বল, হতচকিত। তারপর পাতালঘরের সিঁড়ির ধাপে আমি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি লোকটাকে। তার দু-চোখে উদগ্র কৌতূহল, ক্রমে ক্রমে সেটাকে ঠেলে সরিয়ে নিঃসীম গাঢ় আতঙ্ক সেখানে জায়গা করে নিচ্ছে…তারপর…।

না, প্রথম থেকে গুছিয়ে শুরু করাই ভালো।

পাতালঘর তৈরির পর সেটা দ্বিতীয় মাস। নতুন পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে পরিবর্তনটা তখনও আমার ভালো করে সয়ে ওঠেনি। পাতালঘরে যাওয়ার সময় হয়ে এলেই মনটা কেমন অস্থির হয়ে পড়ে, মেজাজ হয়ে ওঠে রুক্ষ। তখনও পর্যন্ত তন্দ্রা বেশ সহজভাবেই আমার কাছাকাছি থাকত। সেদিনও ছিল।

দিনটা সকাল থেকেই ছিল মেঘলা। তার ওপরে ডিসেম্বরের শীত, সন্ধে হতেই অঝোরে বৃষ্টি নামল। সে-বৃষ্টির বিরাম নেই। মনে আমার মিশ্র অনুভূতি। একই সঙ্গে বাইরের বৃষ্টির কথা, তন্দ্রার কথা ও আমার অসুখটার কথা ভাবছিলাম। চিন্তার সূত্র হঠাৎই টুকরো-টুকরো হয়ে ছিঁড়ে গেল দরজায় প্রচণ্ড করাঘাতের শব্দে। ভীষণ ব্যস্ততায় কেউ দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে।

আমার বিরক্তি আচমকা বেড়ে উঠল। সাধারণত পাতালঘরে যাওয়ার আগে আমি চুপচাপ থাকি, তন্দ্রার সঙ্গেও বেশি কথা বলি না। কিন্তু এ তো দেখছি অপ্রত্যাশিত উপদ্রব!

তন্ত্রা ঘরে এল। একবার দরজার দিকে তাকিয়ে আমার দিকে তাকাল। অর্থাৎ দরজা খুলবে কি না। আমি সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে কিছুক্ষণ হয়তো দ্বিধাগ্রস্ত থেকেছি। সংবিৎ ফিরে দেখি তন্দ্রা দরজা খুলে দিয়েছে এবং দরজায় দাঁড়িয়ে বছর পঁয়তিরিশের একজন পুরুষ। গায়ে বর্ষাতি, হাতে ব্রিফকেস। মাথার চুল ভিজে লেপটে আছে কপালের ওপর। গাল বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে।

‘এ অসময়ে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত।’ কপালের ভিজে চুল সরিয়ে সে বলল, ‘কিন্তু কী করব বলুন, ঝড়-বৃষ্টিতে পথ হারিয়ে ফেলেছি’—তন্দ্রার দিক থেকে চোখ সরিয়ে ঘরে বসে থাকা আমাকে দেখল আগন্তুক।

তন্দ্রা আমার দিকে একপলক তাকিয়ে ভদ্রলোককে লক্ষ করে বলল, ‘আসুন—ভেতরে আসুন।’

আগন্তুক ভেতরে ঢুকল। তার বর্ষাতি থেকে জল ঝরতে লাগল। তন্দ্রা এগিয়ে গিয়ে দরজাটা আবার বন্ধ করে দিল।

‘নমস্কার—’

তাকিয়ে দেখি লোকটি আমার খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি নির্লিপ্তভাবে একটা হাত তুলে প্রতিনমস্কারের ইঙ্গিত করলাম। তারপর মনোযোগ দিলাম একটা বইয়ের দিকে। আড়চোখে লক্ষ করলাম, তন্দ্রা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

আমার অসহযোগী মনোভাব আগন্তুক ও তন্দ্রাকে বিব্রত করে তুলল। ও লোকটিকে ইশারায় ডেকে নিয়ে গেল ভেতরের ঘরে। যাওয়ার সময় ব্রিফকেসটা আমার চেয়ারের পাশে নামিয়ে রেখে তন্দ্রাকে অনুসরণ করল সে। তার বিদায়ী হাসির উত্তর জানাতে সামান্য হাসতে চেষ্টা করেছি, এবং সঙ্গে-সঙ্গেই প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পেয়েছি। আমি সহজভাবে হাসতে পারছি না। ঠোঁটে টান লাগছে।

ওরা চলে যেতেই হাতের বই রেখে ঝটপট উঠে দাঁড়ালাম। মুখের ওপর হাত বুলিয়ে চিৎকার করে ডাকতে চাইলাম তন্দ্রাকে। কথা জড়িয়ে গেল। বাইরের বজ্রপাতের শব্দে, বৃষ্টির শব্দে সে চিৎকার আরও অস্পষ্ট শোনাল। কিন্তু দেখি, তন্দ্ৰা হঠাৎই আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। যেন ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের কোনও ইশারা ওকে জানিয়ে দিয়েছে—আর সময় নেই। কার্যকারণহীন ভয় ফুটে উঠেছে ওর চোখেমুখে। ‘চলো’ ধীর স্বরে ওকে বললাম।

‘চলো—’ ও পাতালঘরে নামার সিঁড়ির কাছে এগিয়ে গেল। ওকে অনুসরণ করে আমি সিঁড়ি ধরে নামতে শুরু করলাম। তখন হঠাৎ পেছন ফিরে দেখি, সেই অচেনা আগন্তুক বিস্ময় এবং কৌতূহল নিয়ে দূর থেকে আমাদের লক্ষ করছে।

পাতালঘরের দরজা বন্ধ করার ঠিক আগে শান্ত গলায় তন্দ্রা বলল, ‘ভদ্রলোক সেলম্যান—বলছেন, কাল সকালেই চলে যাবেন—রাতটা বসবার ঘরেই কাটিয়ে দেবেন—’

উত্তর দিলাম না। উত্তর দেওয়ার মতো শারীরিক অবস্থা আমার নেই। কিন্তু মনে-মনে বললাম, তোমাকে আমি বিশ্বাস করি, তন্দ্রা। তারপর শেষবারের মতো ওর চোখে তাকালাম। অথচ অবাধ্য দৃষ্টি যে ওর গলার আঁকাবাঁকা নীল শিরার দিকে ছুটে যেতে চায়!

দরজা বন্ধ করে খিল দিয়ে দিল তন্দ্রা। তালা দিতে যাবে, সিঁড়ির দরজা থেকে কেউ যেন ওকে ডাকল। হয়তো আমাদের অতিথি তন্দ্রাকে বা আমাকে খোঁজার ভান করে পাতালঘরের কাছে নেমে আসতে চায়। কানে এল তন্দ্রার দ্রুত পায়ের শব্দ। তালা না দিয়েই ও সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। সুতরাং ঘরের এক কোণে বসে সেই ভয়ঙ্কর মুহূর্তের প্রতীক্ষায় রইলাম…।

এর পরের ঘটনা স্মৃতির পাতায় বিক্ষিপ্ত, ঝাপসা অথচ ইঙ্গিতময়। রাত হয়তো তখন অনেক হবে—ওটা পাতালঘরের ভেতরে বন্য আক্রোশে দাপাদাপির চূড়ান্ত করছে—হঠাৎ শোনা গেল দরজার খিল খোলার শব্দ। ওটা চকিতে থেমে যায়। ওত পেতে বসে…পাতালঘরের দরজা ধীরে-ধীরে খুলে যায়…দরজায় দাঁড়িয়ে এক পুরুষের ছায়ামূর্তি। প্রথম নজরে সে কিছু দেখতে পায়নি। তাই কী ভেবে ফিরে যায় সিঁড়ির দিকে। এমন সময় ভয়ঙ্কর জিঘাংসা পাতালঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে। মুক্তি। আগন্তুক থমকে দাঁড়ায় সিঁড়ির ধাপে। ফিরে তাকায়। তার দু-চোখে নিঃসীম গাঢ় আতঙ্কের বন্যা। চিত্রার্পিত শ্লথ ভঙ্গিতে সে দাঁড়িয়ে আছে। আমি যখন খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, তখন তার মানসিক ভারসাম্য পুরোপুরি লোপ পেয়েছে…।

সকালবেলায় পাতালঘরের বাইরে আমাকে আবিষ্কার করে তন্দ্রা ভীষণ অবাক হল। ওপরে এসে, পাতালঘরের খিল কে খুলল, সে নিয়ে প্রশ্ন তোলায় আমি প্রথমে নিস্পৃহ ভাব দেখালাম। পরে বললাম, ‘ওই সেলসম্যান ভদ্রলোক হয়তো চলে যাওয়ার আগে খুলে দিয়ে থাকবেন।’

উত্তরে তন্দ্রার চোখে যে-ভয় ও দ্বন্দ্ব ফুটে উঠল তা আমার চিরদিন মনে থাকবে। ও আচমকা ঘুরে দাঁড়িয়ে চলে গেল। যাওয়ার আগে চেয়ারের পাশে রাখা অক্ষত ব্রিফকেসটার দিকে একটা আলতো দৃষ্টি ছুড়ে দিল। কিন্তু আমি জোর গলায় বলতে পারি, আমার স্ত্রী ওই আগন্তুকের অন্তর্ধানের আসল কারণ তখনও বুঝে উঠতে পারেনি। ওর ভয়, সন্দেহ, দ্বিধা—সবই ছিল অনুমাননির্ভর।

মাঝরাতের ঘটনার ধারাবাহিকতা আমার স্মৃতির নাগাল এড়িয়ে গেলেও নির্দিষ্ট দূরত্বে সে তার মাইলফলক গেঁথে রেখে গেছে। নইলে এখনও আমার মনে পড়ে কেন সেই বৃষ্টিঝরা রাতের কথা? যেন স্পষ্ট দেখতে পাই, আমি মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে এগিয়ে চলেছি, আর আমার ঠিক সামনেই কারও ছুটন্ত পায়ের শব্দ…দুঃস্বপ্নের ঘোরে কেউ মরণপণ ছুটে চলেছে। আমি নিজেকে নিবৃত্ত করতে চাইলেও ওটা বাঁধ মানে না। তীব্র আবেগের প্ররোচনায় এগিয়ে চলে। অবশেষে সেই আগন্তুক অন্ধকার ভিজে পথে দিক ঠাহর করতে পারে না। আগাছা ও জঙ্গলের সীমা শেষ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে অতল খাদে। তার চিৎকার আমি শুনতে পাইনি। চিৎকার করার ক্ষমতা তার ছিল না। অন্ধ ক্রোধ ও হতাশায় ওটা ফুঁসে উঠতে লাগল। বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে ক্রুদ্ধ গর্জন করে উঠল। কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে চলল…।

বাড়িতে ফিরে এসেও ওই প্রাণীটার রাগ কমেনি। সারা বাড়ি টহল দিয়ে বেড়িয়েছে। বেশ মনে পড়ে, তন্দ্রার শোয়ার ঘরের দরজার বাইরে ঘাপটি মেরে বসে ওটা অপেক্ষা করছিল…একবার দরজায় চাপ দিয়ে পর্যন্ত দেখেছে…দরজা খোলেনি…বন্ধ। অথচ আমি জানি, তন্দ্রার কোনও ক্ষতি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু ওটা সবসময় তো আমার কথা শোনে না। অস্থির হয়ে পড়ে।

অবশেষে আবার সচেতন হয়ে উঠলাম। আকাশ তখন পরিষ্কার হয়ে আসছে। বৃষ্টিও থেমে গেছে। পাতালঘরে ফিরে গিয়ে এক কোণে শ্রান্ত শরীরে বসে রইলাম। তন্ত্রা এসে আমাকে খোলা ঘরে আবিষ্কার করল…।

এ-ঘটনায় আমি সাবধান হইনি…হওয়ার কথাও নয়। অন্যের গোপনীয়তায় কেউ এসে আচমকা অধিকার জাঁকিয়ে বসুক, এ আমি একটুও পছন্দ করি না। পাতালঘরে কাউকে আমি আসতে বলিনি, খিলও খুলতে বলিনি। তবে কেন এসেছিল সেই আগন্তুক? অসুখের সময়ে কেউ আমাকে দেখবে, এ আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। তা ছাড়া তার গায়ে আমার আঁচড়টি পর্যন্ত পড়েনি…সে নিজেই নিজের মৃত্যু ডেকে এনেছিল। এত সব চিন্তা করে মনে হয়, যতটা প্রয়োজন ততটা গুরুত্ব বোধহয় অসুখটাকে আমি দিইনি।

৯ জুন, সন্ধ্যা

না, সব কথা এখনও খুলে বলিনি। তাই অস্বস্তি হচ্ছে। কোনও মিথ্যে ঘটনা লিখেছি তা নয়, তবে হোটেলের সেই মাতালটার কথা এখনও আমি বাদ রেখে দিয়েছি। সব কথাই তো আমাকে লিখতে হবে, নইলে এই ডায়েরি লেখার মানে কী! সুতরাং তার কথাই এখন লিখব। অবশ্য তার সঙ্গে এমন কিছু হয়নি যার জন্যে আমাকে দোষ দেওয়া যায়।

এ-ঘটনা ঘটে পাতালঘর তৈরির আগে। শেষ যে-রাতটা আমি শহরের বাইরে হোটেলে কাটিয়েছিলাম সেই রাতে। তখন পাতালঘর তৈরির কথা ভেবেছি, কিন্তু তন্দ্রার জন্যে ঘর তৈরির কাজে হাত দিতে পারিনি। কারণ, তাহলে ওকে আমার অসুখের সব কথাই খুলে বলতে হয়। মনে হয়, ওই মাতাল লোকটার ঘটনাই শেষ পর্যন্ত আমাকে মনস্থির করতে বাধ্য করে। সেই ঘটনা থেকেই বুঝতে পারি, পরিস্থিতি-বিশেষে আমি কীরকম বিপজ্জনক হয়ে উঠি। আমার নিজেকে সামলানোর ক্ষমতা কীরকম পলকা হয়ে যায়। মোটের ওপর, ভগবান যা করেন তা মঙ্গলের জন্যে, কারণ সেইজন্যেই তো সাততাড়াতাড়ি তৈরি হল পাতালঘর। তা ছাড়া এখনও বলব, আমি নির্দোষ। সে-রাতে যা হয়েছে তার জন্যে আমি দায়ী নই। দায়ী ছিল ওই মাতালটা নিজেই। ঠিক বৃষ্টিভেজা রাতের সেই আগন্তুকের মতো…।

সেটা ছিল একটা সস্তা দরের নোংরা হোটেল। অন্যান্য যেসব হোটেলে উঠতাম সেগুলোর মতোই—বেশ মনে আছে। একটা সরু গলির মধ্যে হোটেলের ঢোকার দরজা। দরজায় পুরোনো একটা সাইনবোর্ড। রঙ চটে গেলেও বোঝা যায় এককালে হোটেলের নামটাই লেখা ছিল। ঢুকতেই চোখে পড়ে ফাটলধরা ময়লা বারান্দা। ডান দিকে চুন-বালি খসা একটা ছোট্ট ঘর, অফিসঘর। আরও এগিয়ে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। বিভিন্ন অসমান ধাপে ঘুরপাক খেয়ে উঠে গেছে সিঁড়িটা। অফিসঘরে ঢুকে দেখি কেউ নেই। দু-চারবার ‘কেউ আছেন নাকি?’ বলে চিৎকার করতেই ঢুলু ঢুলু চোখে একটা রোগা চেহারার লোক সিঁড়ির নীচের ফোকর থেকে বেরিয়ে এল। পরনে ময়লা পাজামা, আর চেক চেক ছাপা শার্ট। আমার মুখের কাছে এসে হাই তুলে প্রশ্ন করল লোকটা, ‘কী চাই?’

বমি পেল। হাইয়ের সঙ্গে ভেসে এল দিশি মদের কদর্য গন্ধ। তখনই আমার বোঝা উচিত ছিল সেটা কী ধরনের হোটেল। কারা রাত কাটাতে আসে সেই হোটেলে। সেই মাতালটাও এসেছিল। এসব লোকের মরে যাওয়াই ভালো।

লোকটা টেবিলের পেছনে গিয়ে কোত্থেকে একটা ময়লা খাতা বের করে তাকাল আমার দিকে।

শান্ত স্বরে বললাম, ‘রাতটা থাকতে চাই।’

লোকটা এক হাত পেতে অন্য হাতে খাতাটা খুলে এগিয়ে দিল আমার দিকে। একশোটা টাকা দিয়ে নাম সই করলাম খাতায়। লোকটা জড়ানো গলায় বলল, ‘আরও পঞ্চাশ টাকা দিন।’

বুঝলাম গলা কাটছে, তবুও আপত্তি করলাম না। আমার হাতে নষ্ট করার মতো বেশি সময় নেই।

আমার মুখে তিন-চারদিনের খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। কোনও হোটেলে গিয়ে ওঠার আগে দু-তিনদিন আমি দাড়ি কামাতাম না। কারণ অসুখের সময় কেউ যদি আচমকাই আমাকে দেখে ফেলে, তাহলে অবাক হয়ে ভাববে এত তাড়াতাড়ি, মাত্র দু-তিন ঘণ্টায় কী করে কোনও লোকের মুখময় দাড়ি গজায়। ব্যাপারটা ছোট্ট হলেও মারাত্মক। তাই আমি সাবধান থাকি। কেউ আমাকে কখনও সন্দেহ করেনি। অবশ্য আজকের যুগে কে-ই বা এসব নিয়ে মাথা ঘামায়! আজ মনস্তত্ত্ববিদদের যুগে আমি এক কিংবদন্তি।

লোকটা নিজেও দাড়ি কামায়নি। হয়তো এই হোটেলের কেউই দাড়ি-টাড়ি কামায় না। দেড়শো টাকা পকেটে ঢুকিয়ে টেবিলের ড্রয়ার থেকে আমাকে একটা চাবি দিল সে।

‘রুম নম্বর তিন। সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাঁ-দিকে।’

তারপর আমাকে একা রেখেই টলতে টলতে বেরিয়ে গেল।

ওপরে ঘরে গিয়ে হাতের সুটকেসটা এক কোণে রাখলাম। ভেতর থেকে খিল-ছিটকিনি দিয়ে দরজা ভালো করে বন্ধ করলাম। সমস্ত আলো নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম বিছানায়। জামাকাপড় ছাড়লাম না। ঘরে জানলা একটাই। ছোট। সবক’টা গরাদে নেই। জানলা দিয়ে পাশের বাড়ির দেওয়াল চোখে পড়ে। সুতরাং চাঁদ দেখতে পেলাম না। চাঁদ না দেখলে পরিবর্তনের সময় ভীষণ কষ্ট হয়, যন্ত্রণা হয় অমানুষিক। আর সেইজন্যেই চাঁদটাকে আমি সবসময় কল্পনা করে নিই, অন্ধকার আকাশে বিশাল হলদে থালার মতো। ওই নোংরা ছোট ঘরটা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে কী ইচ্ছেটাই না করছিল। মনে আছে, কী ভয়ঙ্কর ধৈর্য নিয়ে আমি প্রতীক্ষায় থেকেছি। ভগবানকে ডেকেছি, যাতে পরিবর্তনটা তাড়াতাড়ি এসে আবার তাড়াতাড়ি চলে যায়। বারবারই উঠে জানলার কাছে গেছি, ঘরে পায়চারি করেছি, এক কোণে রাখা কুঁজোর নোংরা জল নিয়ে চোখেমুখে ঝাপটা মেরেছি। তারপর নিশ্চয়ই আবার বিছানায় শুয়ে পড়েছিলাম, কারণ পরের যে-ঘটনা মনে পড়ে তাতে আমার শরীরে পরিবর্তন এসে গেছে। আমি চিৎ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছি, খালি এপাশ-ওপাশ করছি, সেইসঙ্গে অধীর ক্রুদ্ধ গর্জন। সারা শরীর আমার ঘামে ভিজে গেছে। বিছানাও ভিজে। শরীরের তলায় বিছানার সস্তা ছাপা চাদর কুঁচকে গেছে। এক হাতে চেপে ধরে আছি খাটের মাথার কাছে কাঠের বাজু। সে হাত আর আমার হাত নয়—পালটে গেছে। অবস্থা ভীষণ খারাপ। যেন প্রচণ্ড জ্বরে ভুল দেখছি। কিন্তু শরীরের শক্তি আমার কমেনি, তাই কোনওরকমে সে যন্ত্রণা সহ্য করছি আর ভাবছি এত খারাপ অবস্থা আগে কখনও হয়নি।

তার ঠিক পরেই শুনতে পেলাম বারান্দা ধরে হেঁটে আসা মাতালটার পায়ের শব্দ। মাতালদের আমি বরাবরই ভীষণ ঘৃণা করি—শুধু মাতাল কেন, যারা ওষুধ বা মাদকদ্রব্য ছাড়া সুখী হয় না, সন্তুষ্ট হয় না, কিংবা যারা জীবনধারণের জন্যে কৃত্রিম সাহায্যের আশ্রয় নেয়, তাদেরও। এই মাতালটা তারস্বরে চিৎকার করে গান গাইছিল আর পায়ে বিচিত্র শব্দ তুলে এগিয়ে আসছিল।

সে যখন আমার ঘরের দরজার কাছে এগিয়ে আসতে লাগল তখনও আমি নিশ্চল নিস্পন্দভাবে শুয়ে। নিশ্চয়ই লোকটা ঘর ভুল করে থাকবে, কারণ সে এসে থামল আমারই দরজার সামনে। ঠেলে খুলতে চেষ্টা করল দরজা। তারপর দুমদুম করে ধাক্কা মারতে শুরু করল। আর জড়ানো গলায় বিস্ময় প্রকাশ করতে লাগল বারবার যে, তার ঘরে কোন হতভাগা এসে ঢুকেছে।

সব শুনেও আমি নিজের জায়গায় নিথর। আমার চোখ কোটরে অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় ঘুরছে, ঠোঁটে আমার ফেনার রাশি। লোকটার অশ্রাব্য গালিগালাজে তার প্রতি এক প্রলয়ঙ্কর ঘৃণা আমাকে পেয়ে বসল। এ রকম ঘৃণা আমি কখনও কাউকে করিনি। একটা বীভৎস ভয়ঙ্কর চিন্তা আমার মনে খেলে গেল…যদি মাতালটার প্রচণ্ড ধাক্কায় এই সস্তা দরজার পলকা খিল ভেঙে পড়ে? যদি ঘরে ঢুকে লোকটা আমার এই অবস্থা দেখে? ক্রোধে আতঙ্কে আর চুপচাপ শুয়ে থাকতে পারলাম না। বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠলাম, ছুটে গেলাম দরজার কাছে, দরজায় কান পেতে ঝুঁকে পড়লাম। শুনতে চেষ্টা করলাম।

লোকটার ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ ও চাপা জড়ানো স্বগতোক্তি স্পষ্ট শুনতে পেলাম। দরজাটা চেপে ধরলাম, যাতে মাতালটার আক্রমণে সেটা ভেঙে না পড়ে। আমার গায়ে এখন অমানুষিক শক্তি, কারণ আমি এখন আর ‘আমি’ নই, পালটে গেছি। খিল ভেঙে দরজা খোলে কার সাধ্যি! গালের খোঁচা-খোঁচা দাড়িতেও খসখসে হাতে দরজাটা বড় মোলায়েম ও গরম ঠেকল।

দরজার ধাক্কা ক্রমে প্রচণ্ডতা ও কম্পাঙ্কে বাড়তে লাগল। ভয় পেলাম, এই শব্দে হোটেলের সবাই হয়তো জেগে উঠতে পারে, তারপর ঝঞ্ঝাট হতে পারে। হয়তো সেই পাজামা পরা ম্যানেজারটা—হয়তো ম্যানেজারই হবে—এসে বলবে, দরজা আমাকে খুলতেই হবে। তখন? নিঃশব্দে প্রতীক্ষায় রইলাম। শরীরের ভেতর রক্ত ফুটছে টগবগ করে, উথলে উঠছে গলা দিয়ে। লোকটা শব্দ করেই চলল। মনে হয়, সেই মুহূর্তেই আমি দরজা খুলেছিলাম।

না, লোকটাকে কোনওরকম আঘাত আমি করিনি। কিন্তু আমাকে দেখার পর তার সেই চোখের দৃষ্টি আমি কোনওদিন ভুলব না। তার চোখ, মুখ…লোকটা চকিতে এক পা পিছিয়ে গেল। আমারও ভীষণ ইচ্ছে হল এগিয়ে যাওয়ার, কিন্তু জানি, সেটা কোনওমতেই ঠিক হবে না। হয়তো জায়গায় দাঁড়িয়েই বিদ্যুৎঝলকের মতো লোকটাকে আক্রমণ করেছিলাম, ভালোমতো মনে নেই। কারণ আচমকাই লোকটা লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে। যেন ভেজা কাপড়ের এক পুঁটলি। আর তা থেকে অ্যালকোহল ও রক্তের মিশ্র বীভৎস গন্ধ বেরোচ্ছে।

এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলাম। আমার আঙুল বাতাস আঁকড়ে ধরছে। তারপর নিজেকে সামলে নিলাম। সজোরে দরজা বন্ধ করে আবার খিল ও ছিটকিনি এঁটে দিলাম ভেতর থেকে। মনে আছে, দরজায় হেলান দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ হাঁফিয়েছি। নিশ্চয়ই ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, জেগে উঠে মাতালটা আরও লোকজন ডেকে আনবে এবং তারা দরজা ভেঙে আমার ঘরে ঢুকবে। তার মধ্যেই আমাকে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে হবে, হয়তো এই ভয়ই অনুঘটকের কাজ করে থাকবে, কারণ সঙ্গে-সঙ্গেই আমি আবার বিছানায় শুয়ে পড়েছি, আর যখন চোখ খুললাম, দেখি আমি আবার স্বাভাবিক হয়ে গেছি।

পরদিন সকালে সেই ম্যানেজারকে ভীষণ উত্তেজিত দেখলাম। শুনলাম, একটু আগেই মাতালটার দেহ সরানো হয়ে গেছে। ম্যানেজার আমাকে জিগ্যেস করল, ‘রাতে কোনও গোলমাল শুনেছেন?’

‘হ্যাঁ, বাইরের বারান্দায় কেউ যেন গান গাইছিল—মাতাল অবস্থায়।’

এবার সে বলল, ‘হোটেলের একজন বোর্ডার গত রাতে মারা গেছে। আপনার ঘরের দরজার কাছে তার ডেডবড়ি পড়ে ছিল।’

আমি ভীষণ অবাক হয়ে সে-বিষয়ে আরও প্রশ্ন করলাম।

ম্যানেজার বলল, ‘দেখে মনে হয় ভদ্রলোক হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। এ ছাড়া অন্য কারণ তো দেখছি না। একজন বেয়ারা আমাকে বলছিল, ভদ্রলোক নাকি নীচে খাওয়ার ঘরে বসে বোতলের পর বোতল মদ গিলছিলেন। তারপর সিঁড়ি বেয়ে উঠতে নিশ্চয়ই তাঁর অনেক পরিশ্রম হয়েছে। সেই ধকলটাই তিনি আর সইতে পারেননি। জানেন তো, মদ খেলে হার্টের কীরকম ক্ষতি হয়? একেবারে শেষ করে দেয়। তা ছাড়া ভদ্রলোকের কপালের পাশে, ঠিক রগের কাছটায়, একটা বড় কাটা দাগ ছিল। সেটা হয়তো পড়ে যাওয়ার সময় হয়ে থাকবে—’

এবং মৃত্যুর ব্যাপারটা যাতে ধামাচাপা পড়ে সে-বিষয়ে মোটামুটি ব্যবস্থা তাঁরা নিয়েছেন।

এই হল হোটেলের সেই মাতালের কাহিনি। এতে আমার কোনও দোষ ছিল না। আমি তাকে কোনওরকম আঘাত করিনি।

১১ জুন

লাইব্রেরিয়ান মহিলাটি আজকাল আমাকে সন্দেহ করতে শুরু করেছে। এ-বিষয়ে আর কোনও সন্দেহ নেই। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ভীষণ ভয় পেয়েছি। কোনও কিছু সন্দেহ করার মতো বুদ্ধি তার আছে বলে কখনও ভাবিনি, কিন্তু এখন দেখছি, না ভেবে ভুল করেছি…যেসব ব্যাপার বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা নিছক হেসে উড়িয়ে দেয়, এ-মহিলা সে সব বিশ্বাস করতে রাজির চেয়েও বেশি। অর্থাৎ আমার পক্ষে দারুণ বিপজ্জনক। জানি না এখন কী করব। লাইব্রেরিতে আর যাব না, কিন্তু সে যদি ইতিমধ্যেই আমাকে সন্দেহ করে থাকে…কী জানি। এরকম একটা বোকা মেয়েছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনও মানে হয়!

আজ লাইব্রেরিতে গিয়েই মহিলাটি সম্পর্কে আমার সন্দেহের সূত্রপাত। তার টেবিলকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় রোজকার মতো সৌজন্যের হাসি বিনিময় হল, কিন্তু লক্ষ করলাম, তার টেবিলে একটা ক্যালেন্ডার রয়েছে। সকলের চোখের সামনে প্রকট ক্যালেন্ডারটা, যেন সে কোনও তারিখ খুঁটিয়ে দেখছে। আগে ওখানে কোনও ক্যালেন্ডার ছিল না। তাহলে এখন, আজ, হঠাৎ কেন এল? লাইব্রেরির কোনও বই মেম্বাররা নিয়ে ক’দিন করে আটকে রাখছে, এ যদি জানা প্রয়োজন হয় তাহলে ক্যালেন্ডার তো বরাবরই তার কাছে থাকবে। তাছাড়া, বইয়ের পেছনে তো তারিখের ছাপ মারা থাকে। উহুঁ, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কবে কবে পূর্ণিমা আছে সেটা দেখার জন্যেই ক্যালেন্ডারটা আনা হয়েছে।

ওটা দেখামাত্রই এ-কথা আমার মনে এসেছিল, কিন্তু তখনও এতটা নিশ্চিত হতে পারিনি। হয়তো মহিলাটি নির্দোষ হলেও হতে পারে। সন্দেহের অবকাশে সবাইকেই আমি রেহাই দিতে চেষ্টা করি। কিন্তু যখন সে পেছনের অন্ধকার ঘর পর্যন্ত আমাকে অনুসরণ করে এল…

লাইব্রেরির পেছনের ঘরটা অন্ধকার অন্ধকার। বড়-বড় গবেষণার বইগুলো ওই ঘরেই থাকে। ও-ঘরে খুব একটা কেউ যায় না। সেখানে পুরোনো একটা বই দেখছি, হঠাৎ লাইব্রেরিয়ান সে-ঘরে এল। দু-হাত ভরতি বই। যেন তাকে রাখতে এসেছে, এরকম ভান করতে লাগল। কিন্তু আমার চোখে ধুলো দেবে একটা মেয়েছেলে!

সে আমাকে লক্ষ করছিল। ঘুরে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকাতেই সে বোকা-বোকা হাসল। আবোল-তাবোল কী একটা বলল—আমি একদৃষ্টে তাকিয়েই আছি—তারপর বইগুলোকে উলটোপালটা জায়গায় কোনওরকমে ঠেলেঠুলে ঢুকিয়ে দিয়ে ত্রস্ত পায়ে বেরিয়ে গেল। মহিলাটি হাঁটে ভারি বিশ্রীভাবে। চলার সময় তার পেছনটা অশ্লীল ইশারায় খারাপভাবে দুলতে থাকে। তার চেহারা মোটাসোটা অথচ নোংরা। বয়েস হয়েছে, তবে সে রকম ছাপ পড়েনি। বহুবার দেখেছি, অল্পবয়েসি ছেলেরা টেবিলের সামনে ঝুঁকে পড়ে তার সঙ্গে কথা বলছে। এমন ভান করছে, যেন কয়েকটা বই সম্পর্কে তাদের ভীষণ কৌতূহল। মেয়েটা যে বদ স্বভাবের তা আমি ভালোই জানি। সে যে এখনও আইবুড়ি তাতে আর আশ্চর্য কী! দেখে তো সতী বলেও মনে হয় না। কিন্তু ও যে সন্দেহ করছে, তাতে আমি ভয় পাচ্ছি। মেয়েটা বিপজ্জনক। জানি না, হুট করে কী করে বসবে…।

বেরোনোর সময় সে আমার সঙ্গে গায়ে পড়েই আলাপ করতে চাইল। আমি কেন তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছি সে-কথা জিগ্যেস করল। অর্থাৎ জোর করে আমার কাছ থেকে কিছু শুনতে চায়, গাঢ় করতে চায় পরিচয়-সৌজন্যের সূক্ষ্ম রেখা। সংক্ষেপে ও নীরবে। তার কথায় সায় দিয়ে বেরিয়ে এলাম। পেছনে না তাকালেও বুঝতে পারলাম তার লোভী চোখ আমার শরীরে এখনও আমূল বিদ্ধ।

এবারে বুঝেছি ভদ্রমহিলা কেন আমার সঙ্গে আলাপ গড়ে তুলতে চায়, যাতে সে আমার সম্পর্কে আরও তথ্য জানতে পারে। সে ভান করছে যেন আমার সঙ্গে ছেনালি করছে, কিন্তু তার উদ্দেশ্য অন্য। আরও অনেক গভীর। কিন্তু ছেনালি নষ্টামি করার জন্যে আমার মতো মানুষকে বেছে নিয়ে সে বিরাট ভুল করেছে। তার বোঝা উচিত ছিল।

অবশ্য এর পরেও স্বীকার করব, ভদ্রমহিলা হয়তো সত্যিই আমার সঙ্গে আলাপ জমাতে চায়। জানি, মেয়েদের কাছে আমার চটক আছে। আর এ তো সামান্য এক নষ্ট মেয়েছেলে। হয়তো এর একগাদা পুরুষবন্ধুও আছে। কিন্তু তাকে দেখে তন্দ্রার চেয়েও সাদাসিধে মনে হয়। তা যদি হয়, তাহলে আর ভয়ের কিছু নেই। অবশ্য তা বলে কোনও মেয়ে এভাবে কোনও বিবাহিত সুখী পুরুষের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টির চেষ্টা করবে, এ অত্যন্ত জঘন্য। এ-ধরনের মেয়েদের মরে যাওয়াই উচিত। এদের বেঁচে থাকা ঠিক নয়, সমাজকে এরা দূষিত করে।

নাঃ, হঠাৎ করে লাইব্রেরিতে যাওয়া বন্ধ করাটা মোটেও ঠিক হবে না। এতে তার সন্দেহ আরও বাড়বে। বরং মেয়েটার সঙ্গে কথা বলে দেখি, ও আমার সম্পর্কে ঠিক কতটুকু জানে…।

১৫ জুন

আজ আবার লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম। আবারও মেয়েটা আলাপ জমানোর চেষ্টা করেছে। এবার তার সঙ্গে মিনিটকয়েক কথা বলেছি তার হাবভাব বোঝার জন্যে। কিন্তু সে যে কী ভাবে, তা বলা মুশকিল। এ-ধরনের মেয়ে সম্পর্কে খুব একটা অভিজ্ঞতা আমার নেই। এ-মেয়েটা যেন আমাকে লোভ দেখাচ্ছে। কী সাঙ্ঘাতিক! কিন্তু আমার সন্দেহ একেবারে হয়তো অমূলক নয়। এমন কোনও প্রশ্ন আমাকে সে জিগ্যেস করেনি যাতে মনে হতে পারে যে, সে আমাকে সন্দেহ করে। কিন্তু যেভাবে জোর করে সে আলাপের জের টেনে চলেছে তা দেখলে রীতিমতো ঘেন্না হয়। নিজের ভয়ঙ্কর রাগ চেপে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। এরপর মেয়েটা যখন পেছন নাড়িয়ে বুক ঝুঁকিয়ে বসল তখন আর একটু হলেই রাগে চিৎকার করে উঠেছিলাম।

মুখে দুষ্টু হাসি হেসে সে চোখ ঠেরে কথা বলছে। পরনে তার আঁটোসাটো বুক খোলা একটা ব্লাউজ, (তন্দ্রা সেদিন যেরকম পরেছিল?)। তাতে যে-কারণে ব্লাউজ পরা, সেই কারণ নিজেই অর্ধেকের বেশি প্রকট। একটা মেয়ের যুবতী শরীরকে ব্লাউজের ফাঁক দিয়ে টেনে বের করে নিলে কীরকম হয়? ক্যালেন্ডারটা আজও টেবিলে রয়েছে, কিন্তু আড়চোখে চেয়ে দেখি তাতে চাঁদের হ্রাসবৃদ্ধির পালা দাগ দেওয়া নেই। সুতরাং মনে হয় না, একে আর ভয় পাওয়ার কোনও কারণ আছে। আমি যতটা ভেবেছিলাম মেয়েটা তার চেয়েও বেশি বোকা।

এরপর কবিতার বই নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলাম, কয়েকটা কবিতা পড়ার ভানও করলাম, যাতে তাকে ভুল পথে ঠেলে দেওয়া যায়। কবিতা আমার একটুও ভালো লাগে না। যতসব বাজে জঞ্জাল। কিন্তু মেয়েটাকে বোকা বানানো গেছে। এখন শুধু ভগবানকে ডাকছি, যেন কেউ মেয়েটার সঙ্গে আমাকে কথা বলতে না দেখে থাকে। তাতে লোকে আমাকে ভুল বুঝবে। আমি লম্পট নই।

২৪ জুন

আজ লাইব্রেরিয়ানের আসল মতলব বোঝা গেল। যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই— মেয়েটা নষ্ট চরিত্রের। আমার অসুখ নিয়ে কোনও সন্দেহ সে করেনি। সে নেহাতই আমাকে চায়। আমার ধারণা, পুরুষদের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করাটাই তার পেশা। তাকে দেখে এ-ব্যাপারে প্রচুর অভিজ্ঞতা আছে বলেই মনে হয়।

আজ বিকেলে আবার আমার পেছন পেছন মেয়েটা আঁধারি ঘরটায় এসেছে। তখন লাইব্রেরি প্রায় বন্ধ হওয়ার সময়, তাই গোটা লাইব্রেরিতে শুধু আমরাই একা ছিলাম। তার ঘরে ঢোকার শব্দ আমি শুনতে পাইনি। কারণ আমি একমনে পড়ছিলাম। উঁচু-উঁচু ব়্যাকের মাঝে ঠিকরে আসা আলো প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম, সুতরাং চোখের নজরেও অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণতার প্রয়োজন। হঠাৎই দেখি ভদ্রমহিলা আমার ঠিক পাশটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। চমকে উঠে সরে যেতেই খিলখিল করে হেসে উঠল সে। জিগ্যেস করল, ‘আমাকে দেখে ভয় পেয়েছেন বুঝি?’ চোখে এক অশ্লীল ইঙ্গিত। আমি কিছু বলে ওঠার আগেই আরও বলল, ‘আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, অন্তত আপনার।’

তার চোখের বদ ঝিলিকে নষ্ট আত্মার ছায়া। চিকচিক করে জ্বলছে সেই চোখ। আর তাদের ভয়ঙ্কর রূপের দিকে মুগ্ধ আমি তাকিয়ে আছি। যেন চঞ্চল কোনও আগুনের শিখা আমার সামনে দপদপ করছে…কী অদ্ভুত তার সম্মোহনী শক্তি। কিন্তু কেন? কোনও নীতিবাগীশ লোককে নীচ প্রবৃত্তি ও অশুভ কেন এমনভাবে টানে? কেন সে পারে না চোখ ফিরিয়ে নিতে? পাপকে দেখার আতঙ্ক কি এতই প্রবল? শত চেষ্টা করেও পারলাম না অন্যদিকে চোখ ফেরাতে, আর অসভ্য মেয়েছেলেটা আমার ঘৃণাকে লিপ্সা বলে ভুল করল। আরও কাছে এগিয়ে এল আমার। কীসব বলল মনে নেই। আজেবাজে কিছু কথা। অশ্লীল হেসে কিছু একটা বলতে হয়, তাই বলল। মনে হয় জিগ্যেস করেছিল আমি কেন এত লাজুক আর শান্ত।

আমি কোনও উত্তর দিতে পারিনি। চেষ্টা করেও তার সঙ্গে কোনও কথা বলতে পারিনি। মনে আছে, তাকে দেখে আমার কী প্রচণ্ড ঘেন্না করছে সে-কথা বলতে মুখ খুলেছিলাম, কিন্তু মুখে কথা আসেনি। আর তারপর সে হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল আমার হাত। তার আঙুল আলতো করে ছুঁয়ে গেল আমার বাহু, কিন্তু তাতেই মনে হল সে-স্পর্শ যেন স্বয়ং শয়তানের। একটা বরফ-শীতল ঘৃণার স্রোত বাহু বেয়ে চলে গেল হাৎপিণ্ডে, সব কিছু ঝাপসা হয়ে এল। বই, বইয়ের ব়্যাক, দেওয়াল—সব কিছু মিলিয়ে গেল এক লাল কুয়াশায়। শুধু দেখা যায় তার জঘন্য মুখ—ক্রমশ আমার দিকে এগিয়ে আসছে।

মেয়েটা কি আমাকে চুমু খেতে আসছে? যদি ওই চড়টা না মারতাম তাহলে আমার বিশ্বাস সে সত্যি-সত্যিই আমাকে চুমু খেত। চড় যে মারব, সেটা কখন ঠিক করলাম জানি না। এ নিশ্চয়ই শুধুমাত্র প্রতিবর্ত ক্রিয়া। আত্মরক্ষার তাগিদে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কখন কীভাবে কাজ করে কেউ বলতে পারে না। সুতরাং সেই কারণেই তাকে থামাতে হল। ভদ্রমহিলার গালে সর্বশক্তিতে এক প্রচণ্ড চড় কষিয়ে দিলাম। আগে কখনও কোনও মেয়ের গায়ে হাত তুলিনি, কিন্তু এতে আমার দুঃখ নেই। এ-প্রাণীটা মেয়েছেলেরও অধম, মানুষেরও অধম। নিজের জীবনের কাছেই সে এক ঘৃণার বস্তু, পুরুষের শরীর শুষে বেঁচে থাকা এক জীবাণু।

চড়টা মেরেই আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে চলে এসেছি ঘর থেকে। সে আর আমার পেছন-পেছন আসেনি। একটা কথাও বলেনি। মনে হয় আমার হাতে চড় খেয়ে হতভম্ব হয়ে গেছে। হয়তো পড়ে গেছে মাটিতে। সেটা দেখার জন্যে আর অপেক্ষা করিনি। সোজা লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে চলে এসেছি বাড়িতে। আমার হাত এখনও কাঁপছে। এ এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। জানি, এ আমি কখনও ভুলব না। মনে শুধু এইটুকু আশা যে, ভালো কিছু অন্তত করতে পেরেছি। আমার বিচারবুদ্ধি ও আচরণ দেখে মেয়েটা বুঝবে যে, দুনিয়ার সব লোককেই বিকৃত কামের ফাঁদ পেতে নষ্ট করা যায় না।

২৪ জুন, রাত

সত্যি কথা বলতে কী এইমাত্র ভীষণ এক আঘাত পেয়েছি। অত্যাশ্চর্য কাকতালীয় সন্দেহ নেই। একটু আগে বিকেলের ডায়েরি লেখা শেষ করে নীচে গিয়েছিলাম রেডিয়োতে খবর শুনতে। লাইব্রেরিয়ানকে কেউ খুন করেছে মনে হয়। খবরে বলল, লাইব্রেরির পেছনের ঘরে ভদ্রমহিলাকে পাওয়া গেছে। দুটো উঁচু বইয়ের ব়্যাকের মাঝে তার দেহটা পড়ে ছিল। মাথায় পাওয়া এক প্রচণ্ড আঘাতে তার ঘাড় ভেঙে গেছে। মাথাটা সম্পূর্ণ ঘুরে গেছে পেছনদিকে। যে জায়গায় দাঁড়িয়ে মেয়েটা আমার সঙ্গে নোংরা মতলব হাসিল করার চেষ্টা করেছিল, মনে হয় এ ঘটনা ঠিক সেই জায়গাতেই ঘটেছে। আমার ধারণা, হয়তো একই রকম পরিস্থিতিতে ঘটেছে। পুরুষ দেখলেই পেছনের ঘর পর্যন্ত অনুসরণ করা তার স্বভাব ছিল, আর সেই জর্জর কাম অনুসরণে সভ্যতা-ভব্যতার লেশমাত্র থাকত না। মনে হয়, আমার কাছে প্রত্যাখ্যান পেয়ে সে হতাশ হয়ে পড়ে অথবা মরিয়া হয়ে ওঠে। জানি না, মনের জোর আছে এমন পুরুষের মুখোমুখি হলে এসব ইতর মেয়েছেলেরা কী করে। আমার অনুমান যে, সে আমার পরের পুরুষটিকে কবজা করে ফাঁদে ফেলার জন্যে আরও বেশি পরিশ্রম করেছিল। আর সেই লোকটি, অর্থাৎ খুনি, নিশ্চয়ই কোনও আদর্শবাদী মানুষ ছিল, আমারই মতো। মেয়েটার কদর্য ইঙ্গিতে নিজের রাগ সে আর সামলে রাখতে পারেনি। হয়তো সে মেয়েটাকে মারতে চায়নি—যদিও মরে গিয়ে একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে—শুধু আমারই মতো এক বিরাশি সিক্কার চড় বসিয়ে দিয়েছিল। শুধু নিজেকে সংযত করতে না পারায় তার আঘাত হয়ে গেছে মারাত্মক। আমার ধারণা, এইরকমটাই হয়ে থাকবে। অবশ্য আমার ভুলও হতে পারে। সে যাই হোক, ওই নোংরা মেয়েছেলেটার জন্যে আমার এতটুকু দুঃখ নেই। সে মারা গেছে ভালোই হয়েছে। বাঁচা গেছে।

আমার স্ত্রীও শুনল খবরটা, তারপর আমাকে জিগ্যেস করল, ‘যে-সময়ে মেয়েটা খুন হয় ওই সময়ে তুমি লাইব্রেরিতে ছিলে না?’

‘মনে হয় আমি বেরিয়ে পরার পরেই খুনটা হয়েছে।’

তন্দ্রাকে বললাম না যে, আমি জানি খুনটা কেন কীভাবে হয়েছে। তাতে ওর অস্বস্তি আরও বাড়ত। এ-ধরনের মেয়েছেলেও যে থাকতে পারে, তা ও কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারবে না, বরং শুধুই দুশ্চিন্তার শিকার হয়ে পড়বে।

‘তুমি তাহলে পুলিশে যাও।’ তন্দ্রা বলল, ‘তুমি হয়তো ওদের কোনও সাহায্য করতে পারবে।’

‘কী করে করব?’ বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘লাইব্রেরিতে তখন অন্য কোনও লোককে আমি দেখিনি। সুতরাং, শুধু-শুধু পুলিশী ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার কোনও মানে হয় না।’

কিন্তু খুনিকে আমি মনে-মনে সমর্থন করি। খুন করা এক বীভৎস পাপ, মানছি, কিন্তু কিছু-কিছু পরিস্থিতিতে এর প্রয়োজন আছে। যখন কারও আদর্শ, নীতি বিপন্ন হয়, তখন খুব সহজেই মানুষ নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, করে বসে এমন কাজ, স্বাভাবিক অবস্থায় যে-কাজের কথা আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। তন্দ্রাকে এসব খুলে বলা যায় না। সময়ে সময়ে যে আইনের নীতি ঠিক নাও হতে পারে, সে কথা বোঝার মতো বুদ্ধি ওর নেই।

সুতরাং আমার উত্তর শুনে ও একমত হল। যদিও জানি, মনে-মনে ও ভাবছে, সমাজের প্রতি কর্তব্য পালন আমি করছি না।

নিঃসন্দেহে পুলিশ আজ নয় কাল অপরাধীকে ধরবেই। হয়তো খুনি নিজেই তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করবে। বুঝবে, নেহাত আত্মরক্ষার তাগিদে প্রয়োজনে পড়ে খুনটা সে করেছে, এবং তার কাহিনি শুনে আদালত তাকে এমন কিছু কঠিন শাস্তি দেবে না। শাস্তি তাকে পেতে হবেই, কারণ সেটাই আইন, কিন্তু আমি ভাবছি তাকে শাস্তি না দিয়ে প্রশংসা করা উচিত। তার একমাত্র অপরাধ, নিজেকে সে সংযত করতে পারেনি—যে-অবস্থা আমার হয়েছিল। কিন্তু আমার কথা আলাদা। সবাই যে আমার মতো শক্ত মনের সংযমী মানুষ হবে এটা কী করে আশা করি!

২৭ জুন

আজ সকালে চা খাওয়ার সময় তন্দ্রার সঙ্গে বড় অদ্ভুত কথাবার্তা হল। কয়েক মিনিট ধরেই মনে হচ্ছিল ও কী একটা বলবে, কিন্তু ইতস্তত করছে। আমি আন্দাজ করলাম ও হয়তো মাসের তারিখ নিয়ে, (দিনটা যে আবার কাছে এগিয়ে আসছে) অথবা পাতালঘর নিয়ে, বা হয়তো কোনও ডাক্তার দেখানো নিয়ে কিছু বলবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল তা নয়।

‘ওরা এখনও খুনিকে ধরতে পারেনি।’ ও বলল।

অর্থাৎ লাইব্রেরিয়ানকে যে খুন করেছে তন্দ্রা তার কথাই বলছে। আপাতদৃষ্টিতে পুলিশ কোনও সূত্র খুঁজে পায়নি। ঝোঁকের বশে হয়ে যাওয়া খুনের সমাধান করা সহজ কাজ নয়। কারণ সেক্ষেত্রে খুনের কোনও উদ্দেশ্য থাকে না, আর এক্ষেত্রে খুনি সম্ভবত লাইব্রেরিয়ানের সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল। প্রার্থনা করতে লাগলাম, খুনি যেন কাগজ-কলমের আইনকে ফাঁকি দিতে পারে। সে যা করেছে তা আদর্শ ও নীতির মহৎ আইনের নির্দেশেই করেছে।

মৃদু স্বরে বললাম, ‘হয়তো কোনওদিনই ধরতে পারবে না।’

‘তুমি যে সে-সময়ে ওখানে ছিলে সে-কথা ওদের গিয়ে বললে ভালো হয় না?’

তন্দ্রা প্রশ্ন করল।

‘কেন?’

‘না…মানে, খুনি যখন খুন করে তখন তুমি হয়তো ওই লাইব্রেরিতেই ছিলে। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, তুমি বাড়িতে আসার আগেই খুনটা হয়েছে। হয়তো তুমি তাদের কোনও সূত্র দিলেও দিতে পারবে…’

‘তোমাকে তো বললাম, আমি কিছুই দেখিনি।’

‘পুলিশে যেতে কি তোমার…ভয় করছে?’ ইতস্তত করে ও প্রশ্ন করল। প্রশ্নটা করার সময় ও অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। কী করে এ-ধারণা ওর মাথায় এল বলতে পারি না।

‘পুলিশে যেতে আমার কীসের ভয়?’ আরও বললাম, ‘আমি কিছুই জানি না। আমি চাই লোকটা যেন সাজা না পায়, কারণ, লাইব্রেরিয়ানটি নষ্ট চরিত্রের মেয়েমানুষ ছিল।’

এ-কথা বললাম না যে, ওই মেয়েই আমাকে ফাঁদে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু তন্দ্রা হয়তো আন্দাজ করে থাকবে, কারণ ও ভীষণ অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকাল, তারপর টেবিল ছেড়ে চলে গেল নিজের ঘরের দিকে।

ওর কাছ থেকে এ-আচরণ বড় বিচিত্র। মানুষের জীবনে পরিবেশের প্রভাব সাঙ্ঘাতিক। হয়তো তন্দ্রার বেলায়ও তাই হয়েছে। মধ্যবিত্তদের এক অদ্ভুত ধারণা আছে যে, মানুষের তৈরি আইনের ক্ষমতা মানুষের চেয়েও অনেক বেশি। বুঝি না মানুষ কী করে এত সহজে অন্যের নির্দেশে চলে। সমাজের নিয়মকে তারা ঈশ্বরের নিয়ম বলে কেন মনে করে? সাধারণ আইন ও পরিস্থিতি-নির্ভর আইনের কোনও তফাত তারা বোঝে না। বোঝে না প্রকৃতির চিরন্তন আইন, ঈশ্বর ও আদর্শবাদের সূক্ষ্ম পার্থক্য। নিজেদের তৈরি আইনের হেরফের অথবা কখনও ভুল আইন তাদের নিজেদের পথেই প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। সংস্কার থেকেই এসবের উৎপত্তি, এবং এ দেখে আমার সত্যি কষ্ট হয়। শুধু একবার ভাবুন, আমার নিজের বেলায় ব্যাপারটা কীরকম দাঁড়াবে…যদি কেউ আমার এই অসুখের কথা জানতে পারে তাহলে তারা আমাকে ঘৃণা করবে, শাস্তি দেবে। দেশের হর্তাকর্তারা হয়তো এ-অসুখ হওয়াটা বেআইনি বলে একটা আইন পাশ করিয়ে দেবেন। কিন্তু তাতে লাভটা কী হবে? অসুখ-বিসুখ তো আর সরকারি নিয়ম মেনে চলে না। সুতরাং অক্ষম নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও আমাকে লোকে অপরাধী ভাববে। এ-কারণেই অসুখটার কথা কাউকে আমি জানতে দিতে চাই না। পুরোনো, প্রায় ভুলে যাওয়া সংস্কার, আতঙ্ক ও কুসংস্কার একসঙ্গে হাত মেলাবে সরকারি আমলাদের নতুন শক্তির সঙ্গে, তারপর আমাকে ধ্বংস করবে। এ বড় ভয়ঙ্কর রোগ। সমস্ত খুঁটিনাটি জানা সত্ত্বেও এর বিরুদ্ধে লড়বার ক্ষমতা কারও নেই। মাঝে-মাঝে ভীষণ আফসোস হয়। তিনশো বছর আগে হলে লোকে আমার এই ক্ষমতাকে অন্তত স্বীকার করত, ভয় পেত। কিন্তু আজ শুধু আমার বিরুদ্ধে আইন তৈরি হবে। আমার মানসিক ভারসাম্য যে এখনও বজায় আছে সে নেহাতই আমার সৌভাগ্য। নইলে এসব চিন্তায় আমি পাগল হয়ে যেতাম।

ওই সময়টা কাছে এগিয়ে এলেই আমার এরকম আজেবাজে চিন্তা হয়। নিষ্ফল আক্রোশ আর হতাশা আমাকে কুরে কুরে খায়। পাতালঘরটাকে আমি ঘেন্না করি…ভীষণ ঘেন্না করি…বিশ্বাস করুন…।