পিশাচের রাত – ৫

পাঁচ

নাটোর মোড়ের কাছে মিস্টার ফক্স খেলা দেখাচ্ছিলেন। পরনে একটা শতচ্ছিন্ন কালো রঙের কোট। তার নানান জায়গায় রঙিন কাপড়ের তালি মারা। কোটের ওপরে তেলচিটে ময়লার আস্তরণ। ফলে ঝকঝকে রোদে কোটটা চকচক করছে।

মিস্টার ফক্সের বয়েস কত কেউ জানে না। চিকু ছোটবেলা থেকেই দেখছে, মিস্টার ফক্স পথে-পথে ঘুরে ভানুমতীর খেলা দেখান।

মিস্টার ফক্সের মাথায় কালো হ্যাট। বয়েসের ভাঁজ পড়া মুখে পাউডার মাখা। চোখে সুর্মার টান। আর ঠোঁটে লিপস্টিক।

মিস্টার ফক্স একটা ছোট মাপের পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ান বাজাচ্ছিলেন, আর সেই তালে তালে মাথা নাড়ছিলেন। তাঁর সামনে বিশাল ঢোলা হাফ প্যান্ট পরা একটি ছেলে ডিগবাজির কসরত দেখাচ্ছিল। ওর নাম মাস্টার পটল।

অ্যাকর্ডিয়ান বাজাতে-বাজাতে মিস্টার ফক্স হাঁক পেড়ে বলছিলেন, ‘ওয়েলকাম, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন। দেখে যান মিস্টার ফক্সের শো। মিস্টার ফক্স—দ্য গ্রেট ম্যাজিশিয়ান। জাদুসম্রাট পি. সি. সরকারের ছাত্র মিস্টার ফক্স। এখন আপনাদের ডিগবাজির খেলা দেখাচ্ছে মাস্টার পটল। চলে আসুন…দেখে যান দ্য গ্রেট শো অফ মিস্টার ফক্স…।’

অনেকে বলে মিস্টার ফক্সের মাথায় ছিট আছে। আর মাস্টার পটল তো হাবাগোবা আধপাগল!

ব্যাপারটা সত্যি বলেই মনে হয় চিকুর। নইলে দোলের দিন সকালে কেউ ভানুমতীর খেলা দেখাতে বেরোয়!

আজ দোল। পথে-ঘাটে অলিতে-গলিতে শুধু রং খেলা চলছে।

চিকুও রং খেলতে বেরিয়েছে রাস্তায়। খেলতে খেলতে নাটোর মোড়ের কাছে এসে দ্যাখে দোলের মধ্যেই মিস্টার ফক্সের ‘শো’ চলছে। মাস্টার পটল প্রাণপণে ডিগবাজি খেয়ে চলেছে।

মাস্টার পটলের বয়েস আঠেরো কি উনিশ হবে। গোলগাল মুখে বোঁচা নাক। চোখজোড়া চিনেম্যানদের মতো। আর সবচেয়ে আশ্চর্য হল ওর মাথার চুলের ছাঁট। ন্যাড়া মাথার চার-পাঁচ জায়গায় উলের বলের মতো একথোকা করে চুল।

মিস্টার ফক্সের গায়ে অনেকে রং দিচ্ছে। মাস্টার পটলকে তাক করে কেউ-কেউ রং-ভরা বেলুন ছুড়ে মারছে। কিন্তু ওঁদের কোনওদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই।

‘আসুন, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন! ইউনিক শো-ম্যান মিস্টার ফক্স, আর তাঁর ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট মাস্টার পটল—ওঁদের ইউনিক খেলা দেখে যান। হোলির স্পেশাল অ্যাট্রাকশন! আসুন, আসুন…।’

আশেপাশে লেডিজ খুব একটা কেউ ছিল না। আট থেকে বারো-চোদ্দো—এই বয়েসের কয়েকটি রোগাসোগা রং মাখা বালিকা কিংবা কিশোরী মাস্টার পটলের তুমুল ডিগবাজি দেখছিল। আর থেকে-থেকেই হেসে উঠছিল, এ-ওর গায়ে ঢলে পড়ছিল।

পটলের ডিগবাজি শেষ হলে তবেই মিস্টার ফক্স তাঁর বিচিত্র খেলা শুরু করেন।

তাসের হাতসাফাই, চার-পাঁচটা পিংপং বল লোফালুফি, কোটের পকেট থেকে অনন্ত রুমালের চেন বের করা, জ্যান্ত সাপ জল দিয়ে গিলে নিয়ে আবার উগরে দেওয়া, আরও কত কী!

পালা করে মিস্টার ফক্স আর মাস্টার পটলের খেলা চলতে থাকে। তারই ফাঁক-ফোঁকরে মিস্টার ফক্স ভিড় করে দাঁড়ানো মানুষজনের কাছে আবেদন রাখেন : ‘আমার খেলায় খুশি হয়ে যদি কিছু বখশিশ দিতে ইচ্ছে করে তা হলে দিন। পুয়োর ম্যান। প্লিজ হেল্প।’

বাড়ির জানলায়, বারান্দায় কিংবা ছাদে মেয়েদের ভিড়। সেদিকে হাত তুলে মিস্টার ফক্স বলে ওঠেন, ‘মা-জননীরা, একজন আর্টিস্টকে হেল্প করুন। আমি জাদুসম্রাট পি. সি. সরকারের ছাত্র মিস্টার ফক্স। আপনারা আমার মাদার এবং সিস্টার। প্লিজ হেল্প।’

মিস্টার ফক্সের সামনে টুং-টাং পয়সা পড়ছিল। মাস্টার পটল ‘থ্যাংক য়ু…থ্যাংক য়ু’ বলে সেগুলো কুড়িয়ে নিচ্ছিল। আর মিস্টার ফক্স টুপি খুলে মাথা ঝুঁকিয়ে সাহেবি কায়দায় সাহায্যকারীকে অভিবাদন জানাচ্ছিলেন।

দোলের দিনে এই মজার খেলা অনেকেই উপভোগ করছিল। মিস্টার ফক্সের ভোজবাজির খেল এতই অদ্ভুত যে, আগে বহুবার দেখা হলেও আবার দেখতে ইচ্ছে করে। মাসদুয়েক আগেও মিস্টার ফক্সের সঙ্গে একটা বাদামী রঙের নেড়ি কুকুর থাকত—তার গলায় ফুলের মালা, কপালে লাল তিলক। নাম ছিল ভণ্ডুল। মিস্টার ফক্সের পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ানের তালে তালে দু-পায়ে খাড়া হয়ে নাচ দেখাত। ভণ্ডুল এখন নেই। লরি চাপা পড়ে মারা গেছে।

বেলা একটা বেজে গেলে মিস্টার ফক্স বাড়ি ফিরে যান। স্নান-খাওয়া-দাওয়া সেরে বিকেলে আবার বেরোন খেলা দেখাতে। তারপর সন্ধের আঁধার নামলেই খেলার পালা শেষ হয়। শুধুমাত্র বর্ষাকাল ছাড়া মিস্টার ফক্সের রোজই এক রুটিন। অসুখ-বিসুখ না হলে একটি দিনও কামাই নেই।

দোলের দিন বিকেলেও মিস্টার ফক্সের খেলা চলল। সঙ্গে মাস্টার পটলের ডিগবাজি। মাস্টার পটলের মাথায়-মুখে গোলাপী আবির। যখন সে দর্শকদের দিকে তাকিয়ে হাসছে তখন কেমন অদ্ভুত লাগছে। মনে হচ্ছে ভিনগ্রহের কোনও প্রাণী। তাকে ঘিরে জমজমাট ভিড়। সকালে যারা রাস্তায় বেরোয়নি, তারাও এখন হাজির। মিস্টার ফক্সের ভানুমতীর খেলা সবাইকে মাতিয়ে রেখেছে।

খেলার পালা শেষ হতে হতে সন্ধে নামল। তারপর অন্ধকার।

তল্পিতল্পা গুটিয়ে মিস্টার ফক্স আর মাস্টার পটল আমবাগানের পথ ধরল।

মিস্টার ফক্সের একটু-আধটু নেশা করার অভ্যেস আছে। তাই আমবাগানের ভেতরে ঢুকে তিনি একটা বড়সড় গাছের গোড়ায় গুছিয়ে বসলেন। তারপর ম্যাজিকের সরঞ্জামের কালো ঝোলাটা মাস্টার পটলের হাতে দিলেন। বললেন, ‘তুই যা, রান্নাবান্নার ব্যবস্থা কর গিয়ে। আমি ঘণ্টাখানেক পরে যাচ্ছি। ও. কে.?’

অনুগতের মতো ঘাড় নাড়ল মাস্টার পটল। মাথায় দুবার হাত বুলিয়ে ম্যাজিকের ঝোলাটা কাঁধে তুলে নিল। তারপর রওনা হল আস্তানার দিকে। আস্তানা বলতে রেললাইনের ওপারে একটা ঝুপড়ি।

হঠাৎই পূর্ণিমার গোল চাঁদটাকে দেখা গেল। ছোট-ছোট বাড়ির মাথা ছাড়িয়ে, গাছপালার আড়াল সরিয়ে হাজির হয়ে গেছে আকাশে।

দূর থেকে হোলির উৎসবের ঢাক-ঢোল করতালের আওয়াজ ভেসে আসছিল। দোলের পূর্ণিমা তিথিতে কীর্তনের দল পথে-পথে বেরিয়ে পড়েছে।

মিস্টার ফক্স কোটের পকেট থেকে একটা ছোট মাপের বোতল বের করলেন। আমবাগানের চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলেন, কেউ কোথাও নেই। শুধু দুজন ম্যাজিশিয়ান হাজির : এখানে গাছতলায়—মিস্টার ফক্স, আর আকাশে চাঁদ। চাঁদকে মিস্টার ফক্স ম্যাজিশিয়ান বলে মানেন। ছোটবেলায় বাবার কাছে যখন হাতসাফাইয়ের ম্যাজিক শিখতেন তখন বাবা বলতেন, চাঁদ হচ্ছে এ-ক্লাস ম্যাজিশিয়ান। সারা মাস ধরে কেমন ছোট-বড় হওয়ার খেলা দেখায়! তারপর অমাবস্যায় একেবারে ভ্যানিশ হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, এ খেলা সে দেখিয়ে যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে! ভাবা যায়! বোতলের ছিপি খুলতে খুলতে চাঁদের দিকে তাকালেন মিস্টার ফক্স।

কিন্তু দেখলেন, চাঁদটা আর নেই!

একটা কালো ছায়া চাঁদকে আড়াল করে দিয়েছে।

‘মিস্টার ফক্স, ভালো আছেন? কেমন যেন ভাঙা কর্কশ গলায় কালো ছায়াটা জিগ্যেস করল।

মিস্টার ফক্স একটু অবাক হয়ে গেলেন। বহুদিন ধরে এই এলাকায় তিনি ম্যাজিক দেখান। তাই এলাকার মানুষজনদের মধ্যে অনেককেই চেনেন। কিন্তু কারও সঙ্গেই খুব একটা আলাপ করেন না। বরং বলা যায় একটা দূরত্ব রেখে এড়িয়ে চলেন। এখন, এই জ্যোৎস্না রাতে, তাদেরই কেউ আচমকা এই নির্জন আমবাগানে এসে তাঁর কুশল জিগ্যেস করবে—এটা বেশ অস্বাভাবিক।

একটু সময় নিয়ে মিস্টার ফক্স বললেন, ‘হ্যাঁ—ভালো আছি। কিন্তু আপনি কে?’

উত্তরে চাঁদের দিক থেকে ছায়াটা একটু পাশে সরে গেল। তখনই ওটা ছায়া থেকে কায়া হয়ে গেল। জ্যোৎস্নার আলো মানুষটার চোখেমুখে এসে পড়ায় মিস্টার ফক্স তাকে চিনতে পারলেন। এই এলাকারই পরিচিত একজন মানুষ।

মিস্টার ফক্স অবাক হয়ে বললেন, ‘আপনি!’

মানুষটা কেমন ধরা গলায় বলল, ‘আপনাকে একটা ম্যাজিক দেখাতে এসেছি। এ-ম্যাজিকের কৌশল আপনিও জানেন না।’

মিস্টার ফক্স অবাক চোখে মানুষটাকে দেখতে লাগলেন। তাঁর কেমন যেন ঘোর লেগে গিয়েছিল। তিনি কোনও কথা বলতে পারছিলেন না। শুধু ভাবছিলেন, এই লোকটা কি সত্যি ম্যাজিশিয়ান? কই, কখনও তো এরকম শোনেননি! তা হলে নিশ্চয়ই মজা করছে।

‘এবার ভালো করে দেখুন…আমার ম্যাজিক শুরু হচ্ছে…।’ সত্যি-সত্যিই যেন ম্যাজিক শুরু হল।

মানুষটা চওড়ায় বাড়তে লাগল। ওর জামা-প্যান্টের সেলাইগুলো সেই চাপে ফড়ফড় করে ছিঁড়ে যেতে লাগল। বোতামগুলো খই ফোটার মতো ছিটকে গেল এদিক-ওদিক। তারই সঙ্গে মানুষটার মুখ দিয়ে একটা পাশবিক গর্জন বেরিয়ে এল।

ম্যাজিক তখনও চলছিল।

লোকটা মাথায় খানিকটা লম্বা হয়ে, কুঁজো হয়ে ঝুঁকে পড়ল—যেন ওর শিরদাঁড়াটা বেঁকে গেল। ওর চোয়ালটা কুকুরের মতো লম্বাটে হয়ে এগিয়ে এল সামনের দিকে। চোখ দুটো এতক্ষণ দেখা যায়নি—এবার দেখা গেল। হালকা সবুজ রঙের দুটো মার্বেল—অন্ধকার কোটরে ধকধক করে জ্বলছে।

মানুষটা চোখের সামনে একটা লোমশ জন্তুতে বদলে গেল। তার হাত-পায়ের আঙুলের ডগা থেকে বেরিয়ে এল হিংস্র বাঁকানো নখ। কান দুটো ছুঁচলো হয়ে মাথাচাড়া দিল। মুখ হাঁ করতেই দেখা গেল ঝকঝকে সাদা দাঁতের সারি। তার মধ্যে শ্বদন্ত দুটো মিস্টার ফক্সের হতভম্ব চোখের সামনেই মাপে বড় হতে লাগল!

ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় সত্যিই যেন এক অলৌকিক ম্যাজিক!

মানুষটা—অথবা, অমানুষটা—শূন্যে হিংস্র কামড় দিয়ে হাঁ বন্ধ করল। ‘খটাস’ শব্দ হল। নির্জন রাত সেই শব্দে কেঁপে উঠল। ভয়ঙ্কর নেকড়ে-মানুষটা যখন এক থাবার ঘায়ে মিস্টার ফক্সের চোয়ালের অর্ধেকটা উড়িয়ে দিল, তখনও তাঁর দু-চোখ অবাক বিস্ময়ে এই নতুন ম্যাজিকটা দেখে চলেছে।

একটু পরে মিস্টার ফক্সকে ছিন্নভিন্ন করে হোলি খেলার পর, তাঁর মৃতদেহ ফেলে রেখে অমানুষটা অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। মিস্টার ফক্সের ঠেলে-বেরিয়ে-আসা চোখজোড়া তখন নিষ্প্রাণ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে পূর্ণিমার চাঁদের দিকে।

এক ম্যাজিশিয়ান আর-এক ম্যাজিশিয়ানকে অপলক চোখে প্রাণভরে দেখছে।

ছয়

এবারের হইচইটা বেশ বড়সড় চেহারা নিল। গত পূর্ণিমায় খুন হওয়া মানুষটা কারও চেনা ছিল না। এমনকী হাজার চেষ্টা করেও পুলিশ তার আত্মীয়স্বজন কাউকেই খুঁজে পায়নি। কিন্তু মিস্টার ফক্সের ব্যাপারটা একেবারেই আলাদা। তাঁকে সবাই চিনত। সাহেবি পোশাক পরা নিরীহ চেহারার এই মানুষটিকে সবাই পছন্দ করত। আর ছোট-বড় সকলের কাছেই ওঁর ম্যাজিকের আকর্ষণ ছিল চুম্বকের চেয়েও বেশি।

খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সবাই একমত হল যে, দু-দুটো খুনই একই লোকের কাজ—যদি অবশ্য খুনিকে আদৌ ‘লোক’ বলা যায়। জাঙ্গিকুল ফাঁড়ি থেকে বড়বাবু অবিনাশ মাইতি একজন সেপাইকে সঙ্গে নিয়ে একদিন চলে এলেন চিকুদের বাড়িতে।

প্রথম খুনের ফাইলটা তিনি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় খুনটা হওয়ার পর সেই বন্ধ হয়ে যাওয়া ফাইল আবার খুলতে হয়েছে। আর একইসঙ্গে তাঁর কানে এ-খবরও পৌঁছেছে যে, প্রথম খুনটা চিকু নামে এলাকার একটি ছেলে নিজের চোখে দেখেছে।

তার দু-চারদিন পরেই তিনি হাজির হয়েছেন চিকুদের বাড়িতে। কিন্তু চিকুকে নানান প্রশ্ন করেও তাঁর সমস্যার কোনও সমাধান হয়নি। শুধু চিকুর জবানবন্দি তাঁর ফাইলে গেঁথে দিয়েছেন।

খুনির পরিচয় নিয়ে নানান জল্পনা-কল্পনা আবার নতুন করে শুরু হল।

কেউ বলল, খুনি কোনও ক্ষুধার্ত হিংস্র পশু।

তখন প্রশ্ন উঠল, তা হলে সে মৃতদেহটা ফেলে রেখে চলে গেল কেন?

কেউ বলল, খুনি পশুর মতো নৃশংস কোনও মানুষ।

তখন প্রশ্ন উঠল, তা হলে খুনের উদ্দেশ্য কী?

কেউ-কেউ বলল, খুনি ভিনগ্রহের কোনও হিংস্র প্রাণী।

তাতে কে যেন জিগ্যেস করল, এর মহাকাশযানটা তা হলে কোথায় নেমেছিল? একটা মহাকাশযান কি সকলের চোখের আড়ালে নামা সম্ভব?

হরিহরবাবুর বাংলা কোচিং-এ গিয়ে চিকুরা জোর আলোচনায় মেতে ওঠে। আর সেই আলোচনায় চিকুই হল মধ্যমণি—কারণ, প্রথম খুনটা দেখার সুবাদে ও এখন বিখ্যাত হয়ে পড়েছে।

হরিহরবাবু ঘরে এসে ঢুকতেই ওদের চাপা গুঞ্জন পলকে থেমে গেল।

হরিহরবাবুর বয়েস প্রায় ষাটের কাছাকাছি। মাথার চুল ধবধবে সাদা, তবে গোঁফ কাঁচা-পাকা। লম্বা রোগা চেহারা। গাল সামান্য ভাঙা, টানা-টানা চোখ শান্ত। চোখে সরু মেটাল ফ্রেমের চশমা। ভাঁজ পড়া কপালে ছোট্ট চন্দনের টিপ। গলায় গোলমরিচের দানার মাপের রুদ্রাক্ষের মালা। পাঞ্জাবির গলার কাছে মালার খানিকটা উঁকি দিচ্ছে।

হরিহরবাবু ধার্মিক মানুষ। ধর্মগ্রন্থ চর্চা তাঁর নেশা। বাংলা পড়াতে-পড়াতে প্রায়ই সংস্কৃত সাহিত্যের উদাহরণে চলে যান। তবে চিকুদের কখনওই একঘেয়ে লাগে না। স্যারের পড়ানোটা এত সুন্দর যে, ভীষণ কাছে টানে।

হরিহরবাবু মেঝেতে গুছিয়ে বসলেন, তারপর কৌশিককে লক্ষ করে বললেন, ‘কৌশিক, পাখার রেগুলেটারটা এক পয়েন্ট কমিয়ে দে তো। আমার কেমন যেন শীত-শীত করছে।’

বারকয়েক কাশলেন হরিহরবাবু। ওঁর একটু কাশির ধাত আছে। কৌশিক রেগুলেটার ঘুরিয়ে জায়গামতো বসে পড়তেই হরিহরবাবু পড়াতে শুরু করলেন।

‘এবার তোদের গা-ঝাড়া দিয়ে বসতে হবে। সামনের বছরটা পেরোলেই বলতে গেলে মাধ্যমিক। রেজাল্ট যেন সবার ভালো হয়। নইলে আমার বদনাম হয়ে যাবে। নে, খাতা-পেন নিয়ে সব রেডি হয়ে নে। আজ আমরা পড়ব ভারতচন্দ্রের “অন্নপূর্ণা ও ঈশ্বরী পাটনি”। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি ছিলেন ভারতচন্দ্র। সেই রাজার অনুরোধে লিখেছিলেন “অন্নদামঙ্গল” কাব্য। এ জন্যে রায়গুণাকর উপাধি পেয়েছিলেন। সেই “অন্নদামঙ্গল”-এর একটা অংশ হল “অন্নপূর্ণা ও ঈশ্বরী পাটনি”—বুঝলি?’

চিকুরা সবাই ঘাড় নাড়ল। এরপর হরিহরবাবু শ্রাবণীকে কবিতাটা জোরে-জোরে পড়তে বললেন।

কবিতা পড়া শেষ হলে তিনি আলোচনা শুরু করলেন।

‘এই জায়গাটা খেয়াল কর। দেবী অন্নপূর্ণা ঈশ্বরী পাটনিকে তাঁর স্বামীর পরিচয় দিচ্ছেন। যেহেতু সে-সময়ে স্ত্রীরা স্বামীর নাম মুখে উচ্চারণ করত না সেহেতু দেবী তাঁর স্বামী মহাদেবের পরিচয় দিতে গিয়ে কৌশল করে বলছেন—

“অতি বড় বৃদ্ধ পতি সিদ্ধিতে নিপুণ।

কোন গুণ নাহি তাঁর কপালে আগুন॥

কু-কথায় পঞ্চমুখ কণ্ঠ-ভরা বিষ।

কেবল আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ॥”

‘দেবী এখানে স্বামীর নিন্দার ছলে তাঁর গুণের কথা বলছেন। তাঁর স্বামী মহাদেব “বৃদ্ধ” মানে আসলে জ্ঞানবৃদ্ধ। দেবী বলছেন, তিনি “সিদ্ধিতে নিপুণ”। এর একটা অর্থ হল মহাদেব সিদ্ধির নেশা করেন। আর আসল অর্থ হল, তিনি যোগসিদ্ধ পুরুষ। এরপর “কপালে আগুন”। মহাদেবের কপালে একটি চোখ আছে। রেগে গেলে সেই চোখ দিয়ে আগুন ঝরে…।’

পড়ানো চলতে লাগল।

তারই মাঝে কাকিমা এসে স্যারকে চা-বিস্কুট দিয়ে গেলেন। আর ওদের জন্য একটা প্লেটে আটটা সিঙাড়া রেখে গেলেন। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, ‘তোমরা পড়ার ফাঁকে-ফাঁকে খেয়ে নিয়ো কিন্তু।’

পড়ানোর সময় যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে তখন হঠাৎ করেই তিতুন আর প্রদীপ্ত মিস্টার ফক্সের খুন হওয়ার কথাটা তুলল।

হরিহরবাবু নমস্কারের ভঙ্গিতে কপালে আঙুল ছোঁয়ালেন। তারপর মন দিয়ে ওদের কাছ থেকে দোলপূর্ণিমার খুনের ঘটনাটা শুনতে লাগলেন।

শোনা শেষ হলে তিনি একটু কেশে নিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, ব্যাপারটা আমি শুনেছি। তোরা ওসবে মাথা ঘামাস না। বোধহয় কুকুর-টুকুরের কাজ।’

চিকু আর চুপ করে থাকতে পারল না। প্রতিবাদের গলায় বলে উঠল, ‘না, স্যার, কুকুর নয়। ওই হিংস্র জানোয়ারটাকে আমি নিজের চোখে দেখেছি!’

হরিহরবাবু আগ্রহ নিয়ে চিকুর অভিজ্ঞতার কথা শুনতে চাইলেন। তারপর বললেন, ‘আগেই কিছু-কিছু কথা আমার কানে এসেছিল। এখন ব্যাপারটা স্পষ্ট হল। তবে জানোয়ারটা ঠিক কী ধরনের সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।’

‘অনেকটা মানুষের মতো, স্যার।’ চিকু উত্তেজিত হয়ে বলল।

‘মানুষের মতো!’

‘হ্যাঁ, স্যার—তবে মাপে অনেক বড়। গায়েও নিশ্চয়ই অনেক জোর হবে। হাতের নখগুলো লম্বা-লম্বা, বাঁকানো…।’

হরিহরবাবু কেমন যেন বিব্রত হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ কী ভাবলেন—তারপর বললেন, ‘এ যেন শ্রীকৃষ্ণের নৃসিংহ অবতার! ভক্ত প্রহ্লাদকে রক্ষা করতে নৃসিংহ অবতার সেজে ভগবান হিরণ্যকশিপুকে নিধন করেছিলেন। যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত। অভ্যুত্থানমধর্মস্য…।’

শ্লোকটা শেষ করে স্যার বললেন, ‘…বলা তো যায় না, যে- দুজন মানুষ খুন হয়েছে তারা হয়তো ভালো লোক ছিল না। সেইজন্যেই ভগবান পশুর রূপ ধরে তাদের বিনাশ করেছেন।’

কথা শেষ করতে-করতে কপালে আঙুল ছোঁয়ালেন হরিহরবাবু।

বোধহয় ভগবানকে প্রণাম জানালেন।

চিকুর মুখ দেখে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল স্যারের ব্যাখ্যা ওর পছন্দ হয়নি।

ওরা চাপা গলায় নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগল। তারপর বেরিয়ে এল বাইরে।

সাত

পরের পূর্ণিমায় আর-একটা খুন হতেই ত্রাসের ভয়ঙ্কর ছায়া নেমে এল জাঙ্গিকুলে। নানান গুঞ্জন, আলোচনা আর বিশ্লেষণ থেকে পূর্ণিমার সঙ্গে খুনের সম্পর্কের ছবিটা স্পষ্ট হয়ে গেল। সবাই বলল, পূর্ণিমার রাতেই খুনির মাথায় খুনের পাগলামি দেখা দেয়।

এবারে খুন হলেন একজন বিধবা ভদ্রমহিলা।

রাত সাড়ে ন’টার সময় তিনি সাইকেল-রিকশা করে ফিরছিলেন। জাঙ্গিকুলের একমাত্র নার্সিংহোম ‘আরোগ্য নিকেতন’-এর কাছাকাছি এসে রিকশাওয়ালা দেখতে পায় পথের ওপরে একটা মাঝারি মাপের গাছের গুঁড়ি আড়াআড়িভাবে পড়ে আছে। রিকশাওয়ালা বেশ অবাক হয়ে যায়। কারণ, কাঁচা রাস্তার ওপরে গাছের গুঁড়ি ফেলে কে আর ডাকাতির চেষ্টা করে! সাইকেল-রিকশা থামিয়ে ক’পয়সাই বা পাওয়া যাবে!

এইসব কথা আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে সে রিকশা থেকে নেমে পড়ে। তারপর গাছের গুঁড়িটা সরাতে এগিয়ে যায়।

ঠিক তখনই পাশের একটা পোড়ো জমির অন্ধকার আগাছার জঙ্গল থেকে একটা পাশবিক গর্জন ভেসে আসে।

রিকশাওয়ালা আর দেরি করেনি। আগের দু-দুটো খুনের কথা তার বেশ মনে ছিল। সুতরাং একমাত্র আরোহীকে রিকশায় ফেলে রেখে সে প্রাণপণে ছুট লাগায়।

তখন গর্জনটা কাছে এগিয়ে আসতে থাকে।

আরোহী ভদ্রমহিলার আর কিছু করার ছিল না। পরদিন ভদ্রমহিলার ছিন্নভিন্ন দেহটা বীভৎস অবস্থায় পাওয়া গেল। সেইসঙ্গে পাওয়া গেল সাইকেল-রিকশাটার ধ্বংসাবশেষ।

পঞ্চাশতলা একটা বাড়ির ছাদ থেকে রিকশাটা আছড়ে পড়লে সেটার যে দশা হত, কেউ স্রেফ গায়ের জোরে রিকশাটার সেই হাল করেছে। যেন রাগে আক্রোশে অন্ধ হয়ে কোনও ক্ষিপ্ত জানোয়ার রিকশাটাকে চূর্ণবিচূর্ণ করার চেষ্টা করেছে।

এই খুনটার পর খুনির পরিচয় নিয়ে একটা নতুন সমস্যা দেখা দিল। খুনি কি কোনও পশু, না কি মানুষ?

এতদিন অনেকেরই ধারণা ছিল খুনি কোনও শক্তিশালী পশু। কিন্তু পশু কি বুদ্ধি খাটিয়ে পথের মাঝে গাছের গুঁড়ি ফেলে রাখতে পারে! তা হলে খুনি নিশ্চয়ই পশুর আড়ালে কোনও মানুষ।

সুতরাং পূর্ণিমার সঙ্গে সম্পর্কটা সকলে মেনে নিলেও খুনির পরিচয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলতেই লাগল।

থানার বড়বাবু বেশ ফাঁপরে পড়লেন। মৃতদেহ নিয়ে নিয়মমাফিক দায়দায়িত্ব পালন করার পর আর কিছু করার আছে কি না সেটাই ভাবছিলেন। তিনি বেশ বুঝতে পারছিলেন, এই খুনের তদন্তের ফলাফল হবে ঠিক আগের খুন দুটোর মতোই—শূন্য।

রোহনরা কিন্তু প্রায় খেপে উঠল। কিছু একটা করার জন্য ওরা অস্থিরভাবে ছটফট করতে লাগল। এলাকার লোককে সতর্ক করার প্রথম ধাপ হিসেবে ওরা মাইক নিয়ে প্রচার শুরু করল। সাইকেল-রিকশায় ব্যাটারি আর মাইক লাগিয়ে রোহনের দলের দু-চারজন এলাকায় ঘুরতে লাগল।

রোহনদের ঘোষণা শুনতে-শুনতে চিকুর মনে হচ্ছিল, ভোট এসে গেছে। আর মাইকে ঘোষণা কে করছে কে জানে! ‘স’গুলো সব ইংরেজি ‘এস’-এর মতো করে উচ্চারণ করছে। তবে রোহনদের দলের বেশিরভাগই ‘স্যামবাজারের সসীবাবু’। মাইকে তখন শোনা যাচ্ছিল :

‘পূর্ণিমার রাতে সন্ধের পর সবাই সাবধানে থাকবেন। একা-একা রাস্তায় বেরোবেন না। বিপদ হতে পারে।…পল্লীবাসীগণ, আপনারা জানেন, গত তিন-তিনটে পূর্ণিমায় আমাদের এলাকায় তিন-তিনটে খুন হয়ে গেছে। তাই আপনাদের সাবধান করে বলছি, আগামী পূর্ণিমার রাতে রাস্তায় কেউ বেরোবেন না। সন্ধের পর সবাই সাবধানে থাকবেন…নইলে বিপদ হতে পারে।…পল্লীবাসীগণ, আপনারা জানেন…।’

শুধু যে মাইকে প্রচার তা-ই নয়, রোহনরা ঠিক করল পরের পূর্ণিমার রাতে ওরা আর্মস নিয়ে এলাকায় টহল দেবে। সে-কথা চিকু জানতে পারল ছোটকুর কাছে। ছোটকু তখন যথারীতি বিশুদার চায়ের দোকানে বসে আড্ডা মারছিল।

চিকুর সঙ্গে কথা বলতে-বলতে ছোটকু হঠাৎ বিশুদার দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করল, বিশুদা, তুমি রাতে দোকানে আর থেকো না। মানে, পূর্ণিমার রাতে কারও পাকা বাড়িতে গিয়ে শেলটার নিয়ো। এ-খুনিকে বিশ্বাস নেই।’

উত্তরে বিশুদা একগাল হেসে জবাব দিল, ‘আমার কী আছে যে আমাকে কেউ খুন করবে? আমাকে যমেও নেবে না।’

কিন্তু পূর্ণিমা যতই এগিয়ে আসতে লাগল ততই বিশুদার সাহস কমতে লাগল। শুধু বিশুদা কেন, জাঙ্গিকুলের প্রায় সকলেই ভাবতে লাগল, এবার কার পালা?

বুদ্ধপূর্ণিমার দিন বিকেলবেলা প্রবল ঝড় উঠল।

আকাশের একটা কোণ মেঘে মেঘে কালো হয়ে গেল। বৃষ্টিও পড়ল কিছুক্ষণ। গত ক’দিন ধরে গুমোট গরম যেভাবে চেপে বসেছিল তাতে জাঙ্গিকুলের সকলেই একটা কালবৈশাখীর জন্য অপেক্ষা করছিল। তার সঙ্গে বৃষ্টির আশাও ছিল।

বিকেল পাঁচটার পর ঝোড়ো হাওয়া আচমকা ধুলোর ঝড় তুলে সবাইকে অন্ধ করে দিল। কাপড়ে, রুমালে কিংবা হাতে মুখ-চোখ ঢেকে পথচারীরা যে যার মতো আশ্রয় খুঁজে নিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

বিশুদা ঝড় ওঠার সঙ্গে-সঙ্গেই দোকানের ঝাঁপ ফেলে দিয়েছিল। যে-দুজন খদ্দের চায়ের কাপ হাতে বেঞ্চিতে বসে ছিল তারা একছুটে চলে এল দোকানের ভেতরে।

আকাশে মেঘ ডেকে উঠল ‘গুড়ুম-গুড়ুম’।

তার একটু পরেই বৃষ্টি শুরু হল।

মরুভূমিতে তেষ্টায় গলা-বুক যখন শুকিয়ে কাঠ তখন কয়েকফোঁটা মিষ্টি জল পেলে তৃষ্ণার্ত পথিক ভগবানকে কৃতজ্ঞতা জানায়, তার চোখে জল এসে যায় আনন্দে। এখন রুক্ষ শুকনো মাটি ভগবানের দেওয়া এই আকাশ-জলকে প্রাণভরে শুষে নিচ্ছিল, আর মাটি থেকে সোঁদা গন্ধ উঠছিল।

বাঁখারির ঝাপ-ফেলা দোকানের ভেতর থেকে বিশুদা এই গন্ধ পাচ্ছিল। খদ্দেররা বিশুদার সঙ্গে বৃষ্টি, চাষবাস নিয়ে আলোচনা করছিল। বলছিল, বেশ কিছুক্ষণ ধরে বৃষ্টি হলে দারুণ হয়। কিন্তু একটু পরেই বৃষ্টি থেমে গেল।

বরুণদেবের হয়তো খেয়াল হয়েছে এখন বর্ষাকাল নয়—ভুল করে তিনি বৃষ্টি শুরু করে দিয়েছেন।

বৃষ্টি থামতেই খদ্দের দুজন চলে গেল।

তারপর রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা হয়ে এল।

রোহনদের ঘোষণা, পূর্ণিমার রাতে অজানা খুনির শিকার হওয়ার ভয়, আর শেষ পর্যন্ত এই ঝড়বৃষ্টি—সব মিলিয়ে জাঙ্গিকুল যেন কারফিউর আওতায় চলে গেল।

সিগারেট কিনতে এসে পাড়ারই একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক বলে গেলেন, রাজবাড়ির দিকে একটা বড় তেঁতুলগাছ ঝড়ে উলটে পড়েছে। তাতে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে স্টেশনের দিকটা লোডশেডিং হয়ে গেছে।

সুতরাং সাতটা বাজতে না বাজতেই বিশুদা পাতা উনুনে কড়াই বসিয়ে রাতের রান্না শুরু করে দিল। রসুন পেঁয়াজ দিয়ে আলু-বেগুনের তরকারিটা হয়ে গেলে তারপর পাঁচখানা আটার রুটি। ব্যস। এর সঙ্গে একটুকরো কাঁচা পেঁয়াজ আর একটা কাঁচালঙ্কা। সব মিলিয়ে দারুণ ভোজ।

বিশুদার ভীষণ একঘেয়ে লাগছিল, আর বারবার হাই উঠছিল। অন্যদিন খদ্দের থাকে রাত ন’টা-দশটা পর্যন্ত। কোথা দিয়ে সময় কেটে যায় টেরই পাওয়া যায় না। আর আজ থেকে-থেকেই চোখ টানছে।

রান্নার কাজ মিটে যেতেই বিশুদা পাতা উনুনে জল ছিটিয়ে আগুন নিভিয়ে দিয়েছে। কাল ভোরে উঠে উনুন পরিষ্কার করতে হবে। ছাই ঘেঁটে না-পোড়া কয়লাগুলো বের করে নিয়ে নতুন করে উনুন সাজাতে হবে। তারপর আবার একটা নতুন দিনের শুরু।

সাড়ে আটটার সময় বিশুদা খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ল। সুইচ টিপে বাল্‌বটা নিভিয়ে দিতেই সব অন্ধকার হয়ে গেল। একটু পরে, অন্ধকারটা চোখে সয়ে আসতেই, বাঁখারির ফাঁকফোকর দিয়ে জ্যোৎস্নার আলো দেখা গেল। সেই আলোর দিকে তাকিয়ে নানান কথা ভাবতে লাগল বিশুদা।

গতবারে যখন দেশের বাড়িতে যায় তখন ছোট ছেলেটার সর্দি-জ্বর দেখে এসেছিল। পরে চিঠিতে জেনেছে, ছেলে ভালো আছে। আর বড় মেয়েটার বিয়ে দেওয়ার জন্য পাত্রের খোঁজ চলছে। সাড়ে চার বিঘে ধানজমি নিয়ে শরিকি মোকদ্দমা চলছিল—সেটার কোনও হেস্তনেস্ত হয়নি। আরও ক’বছর এভাবে ঝুলে থাকবে কে জানে!

ভাবতে ভাবতে বিশুদা আনমনা হয়ে গিয়েছিল। দেশের বাড়ির মাঠেঘাটে মনে-মনে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎই একটা চাপা গুড়গুড় শব্দ বিশুদার স্বপ্ন ভেঙে দিল।

মেঘ ডাকল নাকি?

শব্দটা শোনা গেল আবার!

না—মেঘ তো নয়! তবে কী?

ঠিক তখনই—বিশুদার প্রশ্নের জবাবেই যেন একটা হিংস্র গর্জন শোনা গেল।

তেলচিটে বিছানায় চমকে উঠে বসল বিশুদা। তার বুকের ভেতরে ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে ধান ভানছিল কেউ। সারা শরীর কুলকুল করে ঘামতে লাগল।

বেড়ার গা ঘেঁষে একটা বিশাল কালো ছায়া দাঁড়িয়ে আছে। ছায়াটার আড়ালে জ্যোৎস্না কোথায় হারিয়ে গেছে।

বিশুদা পলকে বুঝতে পারল পূর্ণিমার মৃত্যু তার দোকানের ঝাঁপ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। কারণ, গর্জন শোনা ছাড়াও নাকে একটা পাশবিক গন্ধ আসছিল—চিড়িয়াখানায় যেরকম গন্ধ পাওয়া যায়।

দোকান থেকে বেরোনোর পথ সামনের দিকে। পিছনদিকে বাঁশ, দরমা, টিন দিয়ে শক্তপোক্ত দেওয়াল। বছর সাতেক আগে একবার পিছনের দরমা ভেঙে বিশুদার দোকানে চুরি হয়েছিল। তারপর বিশুদাই ওটাকে মজবুত করেছে। এখন দরমা, টিন ভেঙেচুরে সেদিক দিয়ে পালানোর উপায় নেই। পালাতে পারলে বিশুদা হয়তো বেঁচে যেত। কারণ, পিছনে ঢালু নালা। তার পাড়ে বড়-বড় দু-চারটে গাছ। গাছ পেরিয়ে মজুমদারদের বাগানবাড়ির পাঁচিল। কোনওরকমে সেই পাঁচিল ডিঙোতে পারলে আর ভয় ছিল না।

বিশুদা বিছানায় বসে ঘামছিল। তার হাত-পা অবাধ্যভাবে কাপছিল। তবু তারই মধ্যে পশুটাকে দেখার একটা দুরন্ত কৌতূহল মনের মধ্যে উঁকিঝুঁকি মারছিল।

বেড়ার গায়ে আঁচড় কাটার খচর-খচর শব্দ হচ্ছিল। ছায়াটা অস্থিরভাবে এপাশ-ওপাশ চলে বেড়াচ্ছে। আর হিংস্রভাবে গজরাচ্ছে। বিশুদা কাঁপতে কাঁপতে সামনের বেড়ার কাছে গেল। বেড়ার ফোকরে চোখ রাখল। চিড়িয়াখানার গন্ধটা আরও জোরালোভাবে নাকে এল। অস্পষ্টভাবে একটা লোমশ শরীরকে দেখতে পেল বিশুদা। ঠিক দেখতে পেল নয়—বরং যেন অনুভব করল।

হাঁটুর কাছটা সামান্য ভাঁজ করা অবস্থায় দুটো লোমশ পা হেঁটে বেড়াচ্ছে—শিম্পাঞ্জি দু-পায়ে হেঁটে বেড়ালে যেমনটি দেখায়।

তবে কি এসব কোনও হিংস্র শিম্পাঞ্জির কাজ?

এ-কথা ভাবতে-না-ভাবতেই একটা জোরালো থাবা এসে পড়ল বেড়ার গায়ে। কাগজের দেওয়ালের মতো বেড়ার দেওয়াল ফুঁড়ে একটা লোমশ হাত ভেতরে ঢুকে এল। সেই হাতের লোমশ আঙুলে লম্বা-লম্বা বাঁকানো নখ।

বিশুদা একটা মারাত্মক চিৎকার করে উঠল।

চিৎকারটা বিশুদাকেই অবাক করে দিল। তার ভেতরে যে এত তীব্র, এত শক্তিশালী, এত ভয়ঙ্কর চিৎকারের ক্ষমতা লুকিয়ে আছে তা বিশুদা নিজেই কোনওদিন জানত না।

চিৎকার করেই বিশুদা দোকানের পিছনদিকে একটা কোণে চলে গেল। সেখানে দুটো টিনের মাঝে সামান্য একটু ফাঁক আছে। একটা খাটো বাঁশের টুকরো নিয়ে বিশুদা সেই দুর্বল জায়গায় পাগলের মতো গুঁতো মারতে লাগল।

ক’দিন আগেই না বিশুদা ছোটকুকে বলেছিল, ‘…আমাকে যমেও নেবে না!’ এখন দোরগোড়ায় যম এসে গেছে। হিংস্রভাবে দাপাদাপি করছে, গরগর করছে।

বাঁশের গুঁতোয় বেড়ার দেওয়ালে গর্ত হতে সময় লাগল না। সেই গর্তে বিশুদা শরীরটা জোর করে গলিয়ে দিতে চাইল। বেড়ার খোঁচায় গেঞ্জি ছিঁড়ে গেল, গায়ে ধারালো আঁচড় পড়ে রক্ত ঝরতে লাগল, লুঙ্গি ফেঁসে গেল কয়েক জায়গায়।

কিন্তু বিশুদার তাতে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। ওই বড়-বড় বাঁকানো নখে ফালা ফালা হওয়ার চেয়ে বাঁখারির আঁচড় অনেক ভালো! বিশুদা যখন ফোকর দিয়ে শরীরটাকে প্রায় অর্ধেকটা গলিয়ে দিয়েছে, ঠিক তখনই শুনতে পেল দোকানের সামনের ঝাঁপ ভেঙে পড়ার শব্দ। তারপরই গর্জনটা লাফিয়ে চলে এল বিশুদার বিছানার কাছে।

হাঁকপাঁক করে শরীরটাকে কোনওরকমে দোকানের বাইরে নিয়ে এল বিশুদা। তারপরই ঢালু জমিতে গড়িয়ে পড়ে গেল চওড়া নালার দিকে।

চাঁদের আলোয় নালার জল চিকচিক করছিল। বিশুদা টাল সামলাতে না পেরে তার মধ্যে গিয়ে পড়ল।

কয়েক সেকেন্ড বিশুদার মনে হল, সে চিৎ হয়ে একটা নরম বিছানায় শুয়ে আছে। আকাশের গোল চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। হাঁসফাঁস করা গরমে নালার ঠান্ডা জল যেন বাতানুকূল রাজশয্যা।

তারপরই দেখল তার দোকানের পিছনের দেওয়ালটা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে। আর একটা প্রকাণ্ড কালো শরীর দোকানের গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসছে বাইরে।

বিশুদা ভয়ার্ত খরগোশের মতো লাফিয়ে উঠে পড়ল নালা থেকে। নালার দুর্গন্ধ সারা গায়ে মাখামাখি হলেও বিশুদার নাক তেমনভাবে কাজ করছিল না। শুধু একটা জান্তব প্রবৃত্তি বিশুদাকে ভেতর থেকে চেঁচিয়ে বলছিল, ‘পালাও! পালাও!’

নালার ওপারে উঠে তাড়াহুড়ো করে ছুটতে গিয়ে একটা গাছের গুড়িতে বিশুদা ধাক্কা খেল। কোনওরকমে টাল সামলে নিয়ে ছুটল মজুমদারদের বাগানবাড়ির পাঁচিলের দিকে। একলাফে পাঁচিলে উঠে ওপারে ঝাপ দিয়ে পড়ল বিশুদা। একইসঙ্গে শুরু করল কানফাটানো আর্তচিৎকার।

জ্যোৎস্নার আলোয় প্রাণীটা থমকে দাঁড়াল। মাথা তুলে একবার পূর্ণিমার চাঁদের দিকে তাকাল। তারপর চাপা গর্জন করে বড়-বড় পা ফেলে নেমে এল নালার দিকে।

অনায়াসে লাফিয়ে নালা পেরোল প্রাণীটা। তারপর ক্ষিপ্রভাবে ছুটে গেল বাগানবাড়ির পাঁচিলের দিকে। বাঁ হাতে পাঁচিলটা আঁকড়ে ধরে পোলভল্টের ভঙ্গিতে একলাফে শরীরটাকে নিয়ে ফেলল বাগানের ভেতরের স্যাঁতসেঁতে জমিতে।

আর ঠিক তখনই দুটো টর্চের জোরালো আলো প্রাণীটার মুখে এসে পড়ল। বিশুদার চিৎকারে ছুটে এসেছে মজুমদারদের দুই দারোয়ান। দূর থেকে ওরা খুনিকে লক্ষ্য করে টর্চের আলো ফেলেছে। হঠাৎ কী যে হল, প্রাণীটা একটা গর্জন করে পাঁচিল টপকে বেরিয়ে গেল বাইরে।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর দারোয়ান দুজন সাহস জোগাড় করে অতি সন্তর্পণে এগিয়ে এল পাঁচিলের কাছে। আঙুলের ওপরে দাঁড়িয়ে শরীরটা উঁচু করে ওরা পাঁচিলের বাইরেটা চোখ বুলিয়ে দেখল।

জ্যোৎস্নার সাদা আলোয় সবকিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ওরা দেখল, একটা বিশাল কালো ছায়া সামান্য কুঁজো হয়ে ত্রস্ত পায়ে হেঁটে চলেছে। একটু পরেই ওটা কয়েকটা গাছের আড়ালে চলে গেল।

ওরা দুজন ফিরে এসে দেখল বাগানবাড়ির চাতালে বিশুদা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।

আট

পরদিনই বিশুদার কাহিনি জাঙ্গিকুলে ছড়িয়ে গেল। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ শোনার জন্য বহুলোক আসতে লাগল বিশুদার দোকনে। দোকানের বিক্রি একলাফে বেড়ে গেল।

রোহনরা সন্ধেবেলা চা খেতে বসে সব শুনল বিশুদার কাছে। রোহন বলল, ‘বিশুদা, পরের পূর্ণিমায় তুমি আমার বাড়িতে থাকবে। এর যেন কোনও নড়চড় না হয়।’

বিশুদা চোখ বড় করে বলল, ‘সে আর বলতে! ওই গোরিলার হাতে আমার মরার কোনও সাধ নেই। কাল ওই ডাকাবুকো দারোয়ান দুজন না থাকলে ওই গোরিলাটা আমাকে নির্ঘাত খতম করে যেত।’

ছোটকু বলল, ‘গোরিলা কেমন করে বুঝলে?’

‘যা সাইজ, আর যা গন্ধ!’

রোহন কী যেন চিন্তা করছিল। একটু পরে বলল, ‘বিশুদা, তুমি দোকানটা রিপেয়ার করে নিয়ো। যা লাগে আমি দিয়ে দেব।’

‘তুমি আর আমার জন্যে কত করবে!’

বিশুদা অভাব অনটনে পড়লে রোহনের থেকে টাকা ধার নেয়। কিন্তু রোহন কখনও সে-ধার শোধ নেয় না। বিশুদা কৃতজ্ঞতায় ওকে বিনাপয়সায় চা-বিস্কুট খাওয়াতে চায়, কিন্তু সেখানেও নিস্তার নেই। রোহন সবসময় জোর করে পয়সা দেয়। আর বলে, ‘এভাবে দানছত্র খুললে তোমার ব্যবসা লাটে উঠবে। তখন বড় মেয়েটার বিয়ে দেবে কী করে!’

ছোটকু রোহনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বস, অটো করে পাবলিসিটিটা তা হলে চালিয়ে যাই—কী বলো?’

‘না, না—ওটা থামাবি না। যেভাবে হোক মার্ডার ঠেকাতেই হবে।’

সুতরাং রোহনদের প্রচার আরও জোরদারভাবে শুরু হল। এবং পরের পূর্ণিমার দিন সন্ধে হতে না হতেই রাস্তাঘাটে লোকজন একেবারে কমে গেল।

সময়টা গ্রীষ্মকাল হলেও সাতটা সাড়ে সাতটা বাজতে না বাজতে দোকানপাটের ঝাঁপ পড়ে গেল ঝপাঝপ। ফলে রাত আটটার সময় মনে হল যেন রাত বারোটা বেজে গেছে। শুধু শিবতলার হর-পার্বতীর মন্দিরটাই ছিল ব্যতিক্রম।

আজ স্নানযাত্রা পূর্ণিমা। আকাশের চাঁদ অন্যান্য পূর্ণিমার মতোই শান্ত, ধ্যানে মগ্ন। তবু মনে হয় যেন সে ভয়ঙ্কর কোনও কিছুর জন্য অপেক্ষা করছে।

হর-পার্বতীর মন্দিরে ঘণ্টা বাজছিল। চারপাশে বহুদূর পর্যন্ত আর কোনও শব্দ না থাকায় সেই ঘণ্টার শব্দের রেশ অনেকক্ষণ পর্যন্ত কানে লেগে রইল।

মন্দিরের ভেতরে পুরুতমশাই পুজো করছিলেন। অথচ পুজো দেখার জন্য আজ আর কেউ বসে নেই। ভয় এমনই জিনিস! দেবতার চেয়েও ভয়কে বেশি সমীহ করে মানুষ। আজ তা হলে কে-ইবা প্রসাদ নেবে, আর কে-ইবা নেবে শান্তির জল!

পুরুতমশাই ঠিক খেয়াল করেননি। তিনি দেবতার আরতিতে ব্যস্ত ছিলেন। একজন ভক্ত মন্দিরের দরজায় মসৃণ শ্বেতপাথরের ওপরে বসে ছিল। দু-চোখে তার মুগ্ধ দৃষ্টি। ভক্তির আবেগে চোখের কোল বেয়ে নেমেছে জলের ধারা। দেবতার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলছিল সে।

পুজো শেষ করে পুরুতমশাই পিছনে ফিরতেই তাকে দেখতে পেলেন। অবাক হয়ে গেলেন তিনি। আজ মন্দিরের বারান্দা, শান-বাঁধানো চাতাল, সব খাঁ-খাঁ করছে। অথচ অন্যান্য দিন কত ভক্ত সেখানে ভিড় করে থাকে।

পঞ্চপ্রদীপ নিয়ে এই সাহসী ভক্তের কাছে এলেন পুরুতমশাই। লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে প্রদীপশিখার তাপ নিয়ে মাথায় বোলাল। পুরুতমশাই অবাক হয়ে বললেন, ‘এ কী, আপনি! আজ কেউ আসেনি—অথচ আপনি এসেছেন!’ হাসলেন পুরুতমশাই : ‘আপনার কি ভয়ডর নেই?’

উত্তরে ভক্ত স্মিত হেসে বলল, ‘আমার কাছে ভয়ের চেয়ে ভগবানের টান বেশি। মুক্তির আশায় আশায় আমি খ্যাপা কুকুরের মতো এক মন্দির থেকে আর এক মন্দিরে ঘুরে বেড়াই…।’

‘মুক্তি কি অত সহজে পাওয়া যায়! আমরা সবাই তো মুক্তির আশাতেই বসে আছি।’

পুরুতমশাইকে পাশ কাটিয়ে ভক্ত দেবতার মূর্তির দিকে দু-পা এগিয়ে গেল। মেঝেতে হাঁটুগেড়ে বসে পড়ল। তারপর গড় হয়ে প্রণাম করে আবেগ-ভরা গলায় বলে উঠল, ‘আমায় মুক্তি দাও, ভগবান—এই অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি দাও…।’

পুরুতমশাই খানিকটা করুণার চোখে এই কষ্ট পাওয়া ভক্তকে দেখছিলেন। ভাবছিলেন, এর জীবন অভিশপ্ত কেন? আর প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই তাঁর প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলেন।

ভক্ত মানুষটি তখনও গড় হয়ে প্রণামের ভঙ্গিতে মাথা ঝুঁকিয়ে ঠাকুরকে ডাকছিল। সেই অবস্থাতেই তার শরীরটা ফুলতে শুরু করল। জামা ছেঁড়ার শব্দ পাওয়া গেল। আর লোকটার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল পশুর গোঙানি।

কয়েক সেকেন্ড পর সেই মানুষটা, কিংবা অমানুষটা, সোজা হয়ে দাঁড়াল—ঘুরে তাকাল পুরুতমশাইয়ের দিকে। পঞ্চপ্রদীপ হাতে নিয়ে হতভম্ব পুরুতমশাই তাঁর বদলে যাওয়া ভক্তকে দেখছিলেন।

কী ভয়ঙ্কর বীভৎস চেহারা! ঘন কালো লোমে ঢাকা কোনও আদিম মানুষ যেন! হিংস্র চোয়াল পশুর মতো লম্বাটে। দু-পাটি ধারালো দাঁত আলো পড়ে ঝকঝক করছে। দাঁত থেকে সুতোর মতো সরু হয়ে লালা ঝরে পড়ছে।

অমানুষটা সামান্য কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাঁটু দুটো কিছুটা ভাঁজ হয়ে থাকায় পা দুটো টানটান সোজা হতে পারছে না। দুটো লোমশ হাত দু’পাশে ঝুলছে। হাতের আঙুল বাঁকানো, নখও একইরকম।

একটা চাপা গর্জন করে প্রাণীটা তার ছেঁড়া আলুথালু পোশাকে এক টান মারল। তারপর পায়ের এক ঝটকায় সেটা দূরে ছিটকে ফেলে দিল। এবং পুরুতমশাইয়ের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইল। দুটো হলদে সবুজ চোখ। নিশাচর পশুর মতো জ্বলজ্বল করছে। অথচ সেই চোখে মানুষের মতো দৃষ্টি।

পুরুতমশাই বেশ বুঝতে পারছিলেন, মৃত্যু সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। অপেক্ষা করছে।

তাই তিনি আর অপেক্ষা করতে চাইলেন না।

অমানুষটাকে অবাক করে দিয়ে তার শরীরের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন দুঃসাহসী পুরুতমশাই। জ্বলন্ত পঞ্চপ্রদীপটা চেপে ধরলেন তার মুখে : ‘শয়তান!’

বীভৎস রক্ত-হিম-করা গর্জন শোনা গেল। নাকে এল লোম এবং চামড়া পুড়ে যাওয়ার গন্ধ।

পুরুতমশাই তখন পাগলের মতো ধস্তাধস্তি করছিলেন আর চিৎকার করছিলেন, ‘তুই পাপী! তুই ছদ্মবেশী পাপী! ভগবান তোকে বিনাশ করবে!’

অমানুষটা বোধহয় কথা বলতে চাইল। কিন্তু তার মুখ দিয়ে শুধুই পাশবিক গর্জন বেরিয়ে এল। এক ঝটকায় সে পুরুতমশাইয়ের দেহটা সজোরে ছিটকে দিল শ্বেতপাথরের দেওয়ালে। পিতলের পঞ্চপ্রদীপ দেওয়ালে ঠোক্কর খেয়ে আছড়ে পড়ল মেঝেতে। ঠং-ঠং করে ধাতব শব্দ হল। আর তার ঠিক পাশাপাশি শোনা গেল একটা ভোঁতা শব্দ। পুরুতমশাইয়ের ভারি দেহটা ঠিকরে পড়েছে মেঝেতে।

যন্ত্রণায় গজরাতে গজরাতে পুরুতমশাইয়ের কাছে এগিয়ে এল প্রাণীটা। সামান্য ঝুঁকে পড়ে নিথর দেহটা অবলীলায় তুলে নিল। তারপর পশুর মতো ক্ষিপ্রতায় একলাফে শ্বেতপাথরের বারান্দা পেরিয়ে মন্দিরের শানবাঁধানো চত্বরে নেমে এল।

প্রাণীটা এবার রাতের আকাশের দিকে মুখ তুলল। তাকাল পূর্ণিমার চাঁদের দিকে। তারপর এক আকুল দীর্ঘ গর্জনে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে দিল।

জাঙ্গিকুলের অনেকেই শুনতে পেল সেই গর্জন। রোহনরাও শুনতে পেল। ওরা তখন রাজবাড়ির কাছাকাছি ছিল। গর্জনটা শুনতে পেয়েই ওরা শব্দের নিশানা ধরে ছুটতে শুরু করল। ছুটতে ছুটতেই রোহন কোমর থেকে রিভলবার বের করে নিল।

জলাপুকুর, দেশপ্রিয় সুইটস, বিশুদার চায়ের দোকান পেরিয়ে ওরা মিনিটখানেকের মধ্যেই পৌঁছে গেল শিবতলার হর-পার্বতীর মন্দিরের কাছাকাছি।

এদিক থেকেই তো গর্জনটা এসেছে বলে মনে হল! অথচ চারদিক শুনশান, চুপচাপ।

শুধু আশপাশের দু-একটা বাড়ির বারান্দায় কৌতূহলী কয়েকটা মুখ দেখা গেল। সবক’টা মুখই ভয়ে ফ্যাকাসে। মন্দিরের দিকে চোখ পড়ল রোহনের।

শানবাঁধানো চত্বরে ঢোকার গ্রিলের দরজাটা হুড়কো দিয়ে আটকানো। তবে মূল মন্দিরটা খানিকটা উঁচুতে হওয়ায় রাস্তা থেকেই ভেতরটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। দরজা হাট করে খোলা। ঝকঝকে আলোয় দেবতার মূর্তি প্রাণবন্ত উজ্জ্বল। অথচ পুরুতমশাইকে দেখা যাচ্ছে না।

গোটা মন্দিরটা কেমন যেন নিঝুম। ঠিক কোথা থেকে ভেসে এল গর্জনটা?

কিছুক্ষণ এলোমেলো খোঁজাখুঁজির পর রোহনের কেমন যেন সন্দেহ হল। পুরুতমশাইকে দেখা যাচ্ছে না কেন? অথচ ঘণ্টাখানেক আগে এ-পথ দিয়ে টহল দেওয়ার সময় রোহনরা তাঁকে দেখেছে! তাঁকে জিগ্যেস করলে হয়তো গর্জনটার কোনও হদিস পাওয়া যেতে পারে।

রোহন রিভলবার উঁচিয়ে ধরল। ওর সঙ্গে যে আরও চারজন শাগরেদ ছিল তারাও নিরস্ত্র নয়। কারও হাতে রড, কারও হাতে ভোজালি। ওরা সবাই তৈরি। খুনিকে হাতের কাছে পেলে ওরা কিছুতেই ছেড়ে দেবে না।

ওরা মন্দিরের গ্রিলের দরজার কাছে এগিয়ে গেল। গ্রিলের গেট খুলে রোহনরা মন্দিরের শানবাঁধানো চত্বরে ঢুকে পড়ল। এবং পুরুতমশাইকে ওরা খুঁজে পেল।

মন্দিরের চত্বরে বেশ কয়েকটা কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া আর শিমুল গাছ রয়েছে। তাদের গোড়াগুলো সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে বেদির মতো করা। বেশিরভাগ সময় ভক্তরা এখানে বসে থাকে, নামকীর্তন শোনে। সেইরকমই একটা বেদির ওপরে পুরুতমশাইয়ের ছিন্নভিন্ন দেহটা শোয়ানো। মাথাটা বেদি ছাড়িয়ে নিচের দিকে ঝুলে পড়েছে। হাঁ করা মুখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে।

গোটা বেদিটা রক্তে মাখামাখি। রক্তের দাগ গড়িয়ে এসেছে নিচে। শানবাঁধানো চত্বরে রক্তের ধারা তৈরি হয়ে গেছে। রক্তের ছাপ চত্বরের নানান জায়গায়, মন্দিরের সিঁড়িতে, এমনকী মন্দিরের ভেতরেও।

রোহনের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। এরকম দুঃসাহসী খুনি! দেবতার সামনে খুন করতেও সে ভয় পায় না! খুনি আশপাশে কোথাও লুকিয়ে নেই তো!

রোহনরা মন্দিরের প্রতিটি জায়গা তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখল। ওদের বুকের ভেতরে টিপটিপ শব্দ হচ্ছিল। একইসঙ্গে রোহনের ভীষণ রাগ হচ্ছিল। এত চেষ্টা করেও খুনটাকে ওরা ঠেকাতে পারল না!

মন্দিরের ভেতরে অবহেলায় পড়ে থাকা পঞ্চপ্রদীপটা রোহনের চোখে পড়েছিল। সেটা হাতে নিয়ে ভালো করে দেখল ও। প্রদীপের তেলের গায়ে কয়েক গোছা লোম লেপটে রয়েছে।

খুঁটিয়ে নজর করতেই ও দেখল, বেশ কয়েকটা লোম আধপোড়া। তা হলে কি পঞ্চপ্রদীপের আগুনে খুনির গায়ের লোম পুড়ে গেছে? পুরুতমশাইয়ের সঙ্গে খুনির কি ধস্তাধস্তি হয়েছে?

ঠিক তখনই রোহনের এক শাগরেদ নান্টু মেঝেতে ঝুঁকে পড়ে কী যেন তুলে নিল। তারপর রোহনকে ডেকে বলল, ‘এগুলো কী দ্যাখো তো, রোহনদা—।’

রোহন কাছে এসে ভালো করে দেখল।

মটরদানার মতো গোল-গোল তিনটে বিচি। সেগুলোয় ফুটো করা—বোধহয় মালা গাঁথা ছিল। খুলে পড়ে গেছে।

রোহন বিচিগুলো নিয়ে পকেটে রাখল। ওর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল।

মন্দিরের ভেতরেও অল্পবিস্তর রক্তের ছাপ ছিল। কিন্তু কোনও ছাপই হাতের কিংবা পায়ের বলে স্পষ্ট চেনা যায় না।

অনেক খোঁজাখুঁজি করেও রোহনরা খুনির কোনও চিহ্ন পেল না। কেউ কোথাও নেই। মন্দিরের পিছনদিকে একটা পোড়ো জমি আছে—গাছপালা আর কাঁটাঝোপে ভরা। খুনি হয়তো সেদিক দিয়ে সরে পড়েছে।

হতাশ হয়ে রোহনরা বেরিয়ে এল রাস্তায়। দেখল, কয়েকজন কৌতূহলী মানুষ সাহস করে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। তাদেরই একজন রোহনের কাছে এগিয়ে এসে জানতে চাইল, ‘কী হয়েছে, রোহন? গর্জনটা কীসের কিছু বুঝতে পারলে?’

রোহন ক্লান্তভাবে মাথা নেড়ে ‘না’ বলল। তারপর : ‘পুরুতমশাই খুন হয়েছেন। আমরা ফাঁড়িতে খবর দিতে যাচ্ছি—।’ রোহনের বাড়ি থেকে সাইকেল নিয়ে রোহন আর ছোটকু রওনা হল থানার দিকে।

যেতে-যেতে ছোটকু বলল, ‘বস, আজ হেভি প্রেস্টিজে লাগল মাইরি। আমাদের এরিয়ায় নাকের ডগায় মার্ডার করে মার্ডারার হাওয়া হয়ে গেল!’

রোহন ধীরে-ধীরে মাথা নাড়ল। ওর ভেতরে অপমানটা টগবগ করে ফুটছিল।

নয়

স্কুলের লাগোয়া এক অপরূপ বাগানে হরিহরবাবু দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাগানে ঝকঝকে সবুজ সব ফুলের গাছ। তাতে ফুটে রয়েছে নানান রঙিন ফুল। সেই ফুলের মেলার মাঝে আরও এক ঝাঁক রঙিন ফুল ছুটোছুটি করছিল। একদল ছেলে-মেয়ে।

ওরা এলোমেলোভাবে ছুটোছুটি করছে। নিজেদের মধ্যে হইচই কলরোল তুলে বাগানটাকে একেবারে মাতিয়ে দিয়েছে ফুলের মতো স্কুলপড়ুয়ার দল।

বাগানের একটা বেদিতে বসে মুগ্ধ চোখে ওদের দেখছিলেন হরিহরবাবু। তাঁর কোনও ছেলেমেয়ে নেই। তবে তার জন্য কোনও দুঃখও নেই। ছাত্র-ছাত্রীরাই তাঁর সন্তান।

বিকেলের রোদ মরে এসেছিল। কিন্তু সন্ধের ছায়া তখনও নামেনি। হরিহরবাবু দেখলেন, দূরে, পুবের দিগন্তে, তালগাছের সারির ফাঁক দিয়ে চাঁদ উঁকি দিয়েছে। পূর্ণিমার চাঁদ।

ছুটোছুটি করা ছেলেমেয়ের দলও চাঁদ দেখতে পেল।

কী যে হল, হঠাৎই ওরা খেলাধুলো ছেড়ে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। সবাই একইসঙ্গে হাঁ করে তাকাল পূর্ণিমার চাঁদের দিকে। হরিহরবাবু বেদি ছেড়ে উঠে পড়লেন। ওরা সবাই কেন অবাক হয়ে চাঁদ দেখছে সেটা বুঝতে চেষ্টা করলেন।

ওদের নিষ্পাপ মুখগুলো দেখছিলেন হরিহরবাবু। না, ওরা ফুল নয়—বরং ফুলের চেয়ে কিছু বেশি। ‘ছোটবেলা’র মতো দারুণ জিনিস আর হয় না! মনে-মনে ভাবলেন তিনি। আর ঠিক তখনই একটা ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটতে শুরু করল।

ছেলে-মেয়েগুলোর মুখ বদলে যেতে লাগল। নিষ্পাপ মুখগুলো বিকৃত হয়ে জন্তুর চেহারা নিল। চোয়াল লম্বাটে হয়ে গেল। সারি সারি ধারালো দাঁত তৈরি হয়ে গেল সেখানে। হাতে পায়ে ঘাড়ে লোম গজিয়ে উঠল। কানের ওপর দিকটা ছুঁচলো হয়ে গেল।

তারপর ওরা সমস্বরে এক দীর্ঘ গর্জন তুলে আকাশ-বাতাস মাতিয়ে দিল।

হরিহরবাবু ভয়ে কাঁপছিলেন আর কুলকুল করে ঘামছিলেন। চিৎকার শেষ করে ছেলে-মেয়েগুলো হরিহরবাবুর দিকে ঘুরে দাঁড়াল। এক বিচিত্র পাশবিক স্বরে ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে…’ সুর করে গাইতে শুরু করল। যেন স্কুলের প্রার্থনা সঙ্গীত গাইছে।

এবং ওরা হরিহরবাবুর দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। হরিহরবাবু বাঁশপাতার মতো থরথর করে কাঁপতে শুরু করলেন।

একইসঙ্গে মৃত্যুর প্রহর গুনতে লাগলেন। ঠিক তখনই তাঁর ঘুমটা ভেঙে গেল।

উঃ, কী বিশ্রী স্বপ্ন!

সারা শরীর ঘামে ভেজা। বিছানার চাদরটাও ভিজে গেছে। অবসন্ন চোখে দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন হরিহরবাবু। সন্ধে প্রায় ছ’টা। আর ঠিক তখনই স্ত্রীকে দেখতে পেলেন। তাঁর মাথার কাছটিতে দাঁড়িয়ে। মুখে কৌতুকের হাসি।

‘সেই তখন থেকে ডাকছি। ওরা সব পড়তে এসে গেছে।’

ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলেন হরিহরবাবু। দেওয়ালে টাঙানো মা-কালীর ফটোর দিকে তাকিয়ে কপালে হাত ঠেকালেন। মা—মা-গো!

‘ঘুমের মধ্যে অমন গোঙাচ্ছিলে কেন? তোমাকে কি বোবায় ধরেছিল?’

‘কে জানে!’ বিছানা থেকে নেমে পড়লেন হরিহরবাবু : আসলে একটা বাজে স্বপ্ন দেখছিলাম। ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন…।’

‘তোমার তো আবার অল্পেতেই ভয়!’ হরিহরবাবুর স্ত্রী হাসলেন : ‘শরীর ভালো না লাগলে আজ আর পড়াতে হবে না—।’

হরিহরবাবু প্রস্তাবটাকে আমলই দিলেন না। কোচিং ক্লাস কামাই করা তিনি একেবারে পছন্দ করেন না।

পোশাক পালটে নিয়ে বাইরের ঘরে এলেন তিনি। চিকু, প্রিয়াংকা, কৌশিকের দল হাজির। ওদের দিকে একপলক তাকিয়েই দুঃস্বপ্নটার কথা মনে পড়ে গেল। সংকোচের হাসি হেসে বললেন, ‘দুপুরের ঘুমটা একটু লম্বা হয়ে গেছে…।’

চিকু হাঁ করে হরিহরবাবুকে দেখছিল। ওর শরীরের ভেতরে শিরায় শিরায় বরফকুচির স্রোত বইতে শুরু করল। ওর মাথা ঝিমঝিম করছিল। চোখের দৃষ্টি কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসছিল।

চিকু টলে পড়ে যাচ্ছিল। কোনওরকমে পাশে বসা প্রিয়াংকাকে ধরে নিজেকে সামলে নিল।

প্রিয়াংকা টের পেল চিকুর হাত বরফের মতো ঠান্ডা। ও অবাক হয়ে চিকুর চোখে তাকাল। চাপা গলায় জিগ্যেস করল, কী হয়েছে?’

চিকুও নিচু গলায় জবাব দিল, ‘আমি সব বুঝতে পেরে গেছি।’

‘কী বুঝতে পেরেছ?’

চিকু কোনও উত্তর দিল না। চোখের ইশারায় হরিহরবাবুকে দেখাল। তারপর ডানহাতের দুটো আঙুল ভাঁজ করে আর দুটো আঙুল টানটান করে রিভলবারের আদল তৈরি করল। সেই রিভলবারটা স্যারের দিকে তাক করে মুখে চাপা শব্দ করে স্যারকে মিছিমিছি ‘গুলি’ করল চিকু।

প্রিয়াংকা কিছু বুঝতে না পেরে ঠোঁট উলটে প্রশ্নের ভঙ্গি করল।

চিকু হেসে বলল, ‘এখন না—আগে পড়া শেষ হোক—তারপর। তুমি আমার সঙ্গে থেকো—তা হলে সব বুঝতে পারবে।’

চিকুর উসখুস ভাবটা হরিহরবাবু লক্ষ করেছিলেন। তিনি জিগ্যেস করলেন, ‘চিকু, কিছু বলবি?’

চিকু মাথা নাড়ল : ‘না, স্যার।’

‘প্রিয়াংকার সঙ্গে কী কথা বলছিস?’

হরিহরবাবুর কৌতূহলটা চিকুর কানে বড্ড বাড়াবাড়িরকম ঠেকল। তাই ও অম্লানবদনে বলে বসল, ‘পুরুতমশাইয়ের মার্ডারটা নিয়ে আলোচনা করছিলাম, স্যার।’

গত পূর্ণিমার পর মাত্র তিনটে দিন পার হয়েছে। পুরুতমশাইয়ের হত্যাকাণ্ড জাঙ্গিকুলের ছোট-বড় সবাইকে একেবারে ভিত পর্যন্ত নড়িয়ে দিয়েছে। লোকজনের কথাবার্তা আলোচনায় এখন থেকেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে আগামী পূর্ণিমায় সন্ধে হলেই যে যার ঘরে ঢুকে পড়বে। দরজায় খিল এঁটে নিরাপদ আশ্রয়ে বসে থাকবে। অপঘাতে কেউ আর মরতে চাইবে না।

চিকুর কথায় কোচিং সরগরম হয়ে উঠল। সুযোগ পেয়ে সকলেই পূর্ণিমার খুনগুলো নিয়ে নানান মন্তব্য করতে লাগল।

হরিহরবাবু হাত তুলে সবাইকে চুপ করতে ইশারা করলেন। একটু কেশে নিয়ে বললেন, ‘শোন, এই খুনগুলো নিয়ে আমিও অনেক ভেবেছি। তোদের তো আগে একদিন বলেছি, এ যেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নৃসিংহ অবতার। তা ছাড়া, যারা খুন হয়েছে তাদের সবারই নিয়তি ছিল মৃত্যু। তবে জানবি, তাদের আত্মার মৃত্যু হয়নি। গীতায় আছে, আত্মা অবিনাশী, নিত্য, অজ, অব্যয়। আত্মার জন্মও নেই, মৃত্যুও নেই। আত্মার আসল রূপ হল…।’

চিকু স্যারের কথা শুনছিল। কিন্তু প্রতিমুহূর্তেই ওর হাসি পাচ্ছিল। কারণ রোহনদার কথাগুলো ওর মনে পড়ছিল।

গত পূর্ণিমার পরের দিন বিকেলে রোহনের সঙ্গে চিকু দেখা করেছিল। দেখা করার জন্য রোহনই ওকে খবর পাঠিয়েছিল।

বিশুদার চায়ের দোকানে বসে মন্দিরের খুন নিয়ে চিকুর সঙ্গে আলোচনা করেছিল রোহন। তারপর মন্দির থেকে পাওয়া মটরদানার মতো তিনটে বিচি চিকুকে দেখিয়েছিল।

‘এগুলো কী বল তো! সকাল থেকে অনেককে দেখিয়েছি। ওরা বলছে…।’

বিচিগুলো দেখামাত্রই চিনতে পারল চিকু। রুদ্রাক্ষ। রোহন কথা বলে যাচ্ছিল : ‘…মনে হয় খুনির সঙ্গে ধস্তাধস্তির সময় পুরুতমশাইয়ের গলার মালাটা ছিঁড়ে পড়ে গেছে।’

চমকে উঠল চিকু। কখনও না! কারণ, মন্দিরে ও প্রায়ই যায়। পরীক্ষার আগে তো বেশ ঘন-ঘন যায়। পুরুতমশাইকে ও বেশ খুঁটিয়ে লক্ষ করেছে। ওঁর গলায় রুদ্রাক্ষের মালা ছিল না। বরং লকেটওয়ালা একটা সোনার চেন ছিল। মৃত্যুর পরেও সেটা ওঁর গলায় ছিল।

তা হলে?

বিধবা ভদ্রমহিলা খুন হওয়ার পর থেকেই সকলের ধারণা হয়েছিল যে, খুনি আসলে কোনও মানুষ। আবার তার বাইরের চেহারাটা অনেকটা পশুর মতো হওয়ায় কারও কারও ধারণা হয়েছিল, সে মানুষ এবং পশুর মাঝামাঝি কোনও প্রাণী। তার সঙ্গে পূর্ণিমার সম্পর্কটা জুড়ে দিয়ে কে যেন প্রথম ওয়্যারউল্ফ বা নেকড়ে মানুষের কথা বলেছিল।

বিশুদা বুদ্ধপূর্ণিমার রাতে শুধু শব্দ শুনেছিল—কাউকে তেমন স্পষ্টভাবে দেখতে পায়নি। তবে পশু বলেই মনে হয়েছিল।

কিন্তু পুরুতমশাইয়ের খুনের পর নেকড়ে-মানুষের ধারণাটা জোরালো চেহারা পেয়ে গেছে। নেকড়ে মানুষ। যে-মানুষ প্রতি পূর্ণিমার রাতে ভয়ঙ্কর হিংস্র অমানুষে বদলে যায়, হয়ে যায় অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক পশু। তারপর, পূর্ণিমা কেটে গেলেই, সে আবার সুস্থ-স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।

চিকু মনে-মনে এরকম একজন অসুস্থ মানুষকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল।

রুদ্রাক্ষের মালা…রুদ্রাক্ষের মালা…রুদ্রাক্ষর মালা…। একটা সন্দেহের ছায়া মনের কোণে উঁকি দিতে শুরু করল। এরপর রোহন পঞ্চপ্রদীপের কথা বলল। বলল, প্রদীপের গায়ে লোম পাওয়া গেছে। তাতে আধপোড়া লোমও আছে। হয়তো পঞ্চপ্রদীপের শিখায় খুনির শরীর পুড়ে গেছে।

বেশ উত্তেজিতভাবে রোহন আর চিকু প্রায় ঘণ্টাখানেক আলোচনা চালিয়ে গিয়েছিল। শেষে রোহন বলল, ‘ফাঁড়ির মাইতিবাবু বলছিলেন এবার কলকাতা থেকে গোয়েন্দার দল আসবে। সঙ্গে ফোরেনসিক এক্সপার্টরাও থাকবে। সে ওরা যা পারে করুক। তবে ওদের আগে মার্ডারারকে ধরতে পারলে আমার মনটা ঠান্ডা হত।’

‘রোহনদা, তুমি আমাকে দু-চারদিন সময় দাও।’ চিকু বলল।

‘কেন রে?’

‘আমার একটা সন্দেহ হচ্ছে…।’ রোহন অবাক হয়ে চিকুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। এখন স্যারের দিকে তাকিয়ে রোহনের মুখটা মনে পড়ল চিকুর।

স্যারের আত্মার কচকচি তখনও চলছিল। আর চিকু অবাক হয়ে স্যারকে দেখছিল।

স্যারের গলায় রুদ্রাক্ষের মালাটা নেই। স্যারের বাঁ গালে চোখের নিচে নাকের পাশে তুলো আর স্টিকিং প্লাস্টার লাগানো।

হরিহরবাবু পড়াতে আসামাত্রই ওঁর মুখের ব্যান্ডেজ সকলের চোখে পড়েছে। তিতুন, সুকান্ত, প্রদীপ্তরা জিগ্যেসও করেছে, ‘স্যার, মুখে কী হয়েছে?’

উত্তরে স্যার হেসে বলেছেন, ‘ও কিছু নয়—সামান্য একটু পুড়ে গেছে।’

চিকু কোনও কথা বলতে পারেনি। ওর শরীরের ভেতরে বরফকুচির স্রোত বইতে শুরু করেছিল।

হরিহরবাবুই কি তা হলে পূর্ণিমার নরপিশাচ?

‘…গত পূর্ণিমার রাতগুলোয় যারা মারা গেছে ভগবান তাদের ভবিতব্য আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন। মারে কৃষ্ণ রাখে কে! কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে হাজির হয়ে অর্জুন যখন বিষাদে কাতর হয়ে বলেছিলেন, আত্মীয়স্বজনকে আমি হত্যা করতে পারব না, তখন শ্রীকৃষ্ণ হেসে বলেছিলেন, হে পার্থ, তুমি ওদের হত্যা করবে কী, আমি তো ওদের আগেই মেরে রেখেছি! জাঙ্গিকুলের ঘটনাটাও ঠিক একইরকম, বুঝলি? এখানে ওই খুনি স্রেফ নিমিত্ত মাত্র। ভগবান ওই চারজনকে আগেই মেরে রেখেছিলেন…। আর, একজন বেঁচে গেছে কারণ…রাখে কৃষ্ণ মারে কে! বেঁচে যাওয়া তার কপালে ছিল।’

জ্ঞানগর্ভ ব্যাখ্যা শেষ করে হরিহরবাবু আবার লেখাপড়ায় ফিরে এলেন। বই আর খাতা খুলে ওরা সবাই পড়ায় মন দিল।

কিন্তু চিকুর বুকের ভেতরটা টিপটিপ করছিল। কিছুতেই ওর পড়ায় মন বসছিল না।

পড়ানোর মাঝে কাকিমা একবার ঘরে এলেন। হরিহরবাবুকে চা-বিস্কুট দিলেন। আর চিকুদের দিলেন একটা করে কেক।

কাকিমা বোধহয় বিকেলে স্নান করেছেন। ফরসা টলটলে মুখ, কপালে বড় মাপের সিঁদুরের টিপ, গালে লাল আভা। কাকিমাকে দেখলেই কেমন কাছের মানুষ বলে মনে হয়। আর হরিহরবাবু? ওঁকে কাকিমার স্বামী বলে ভাবতে চিকুর বেশ কষ্ট হচ্ছিল।

পড়ানো শেষ হয়ে যাওয়ার পর সবাই যখন বই-খাতা-ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়াল, চিকু তখনও বসে রইল। ওর ভেতরে কেমন একটা রাগ আর জেদ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। স্যারকে ও কয়েকটা কথা জিগ্যেস করতে চায়। বুঝতে চায় ওর সন্দেহটা সত্যি কি না।

‘কী রে, চিকু—তুই যে বসে রইলি—বাড়ি যাবি না? স্নেহের সুরে হরিহরবাবু জিগ্যেস করলেন।

‘আপনার সঙ্গে….ক কয়েকটা ক-কথা আছে, স্যার।’ আমতা-আমতা করে চিকু বলল।

বন্ধুরা সব ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। শুধু প্রিয়াংকা জুতো পায়ে দিয়ে দরজার চৌকাঠের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। কাকিমা ভেতরের ঘরে হয়তো সংসারের কাজে ব্যস্ত।

‘কী কথা?’

অন্দরে কোথাও টেলিফোন বেজে উঠল। কাকিমা ফোন ধরে কথা বলতে লাগলেন। বাইরের ঘর থেকে চিকু আবছাভাবে কাকিমার গলা পাচ্ছিল।

‘আপনার গলার রুদ্রাক্ষের মালাটা কোথায় গেল, স্যার?’ পলকে চারপাশটা কেমন স্তব্ধ হয়ে গেল। শুধু সিলিং পাখার ভনভন শব্দ কানে বাজছিল। হরিহরবাবুর বাঁ চোখটা একবার কেঁপে উঠেই আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল।

‘কোথাও বোধহয় খুলে পড়ে গেছে। আ-আমি ঠিক খ্-খেয়াল করিনি….।’

‘আপনার মুখ পুড়ে গেল কী করে?’

‘বললাম তো, সামান্য একটু পুড়ে গেছে!’ হরিহরবাবু হঠাৎই রেগে উঠলেন।

‘না, স্যার—ঠিক কীভাবে পুড়ল আপনাকে বলতে হবে।’ জেদি গলায় বলল চিকু।

‘এতবড় তোর স্পর্ধা। আমার কাছে জবাবদিহি চাস।’ হরিহরবাবু উত্তেজিত হয়ে পড়ছিলেন। ওঁর গলার স্বর থরথর করে কাঁপছিল। দরজার কাছ থেকে প্রিয়াংকা চিকুকে ডাকল, ‘চিকু কী হচ্ছে! চলে এসো!’

ওর দিকে না তাকিয়েই হাতের একটা ইশারা করল চিকু। বই-খাতা-ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর ফস করে বলে বসল, ‘আপনার বাঁ গালে পঞ্চপ্রদীপের ছাপ পড়ে গেছে।’

চিকুকে অবাক করে দিয়ে হরিহরবাবুর বাঁ হাতটা সঙ্গে-সঙ্গে গালে পৌঁছে গেল। ওঁর হাতের আঙুল আন্দাজে ভর করে পঞ্চপ্রদীপের ছাপটাকে খুঁজতে চাইল।

একইসঙ্গে চিকুর প্রমাণ খোঁজার পালা শেষ হল। অসুস্থ নরপশুটাকে ও খুঁজে পেয়ে গেছে।

কিন্তু ও এতটুকুও ভয় পেল না, কারণ, এতদিনে ও বুঝে গেছে, পূর্ণিমার রাত ছাড়া এই মানুষটাকে ভয় করার কোনও কারণ নেই। ও টান-টান গলায় বলল, ‘আপনার রুদ্রাক্ষের মালাটা গত পূর্ণিমার রাতে শিবতলার মন্দিরে ছিঁড়ে পড়ে গেছে, স্যার। আর সে-রাতে পুরুতমশাই বোধহয় আপনার সঙ্গে একটু ধস্তাধস্তি করেছিলেন…।’

‘চিকু! চিকু, তুমি কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ! এসব আজেবাজে কথা বলার সাহস তুমি কোথা থেকে পেলে! অসভ্য, ইতর…।’ স্যার রেগে গিয়ে কথাগুলো বলছিলেন বটে, তবে সেগুলো কেমন যেন ফাঁকা আওয়াজের মতো শোনাচ্ছিল। আর স্যারের মুখ-চোখও কেমন অপরাধীর মতো ফ্যাকাসে লাগছিল।

ঠিক এই সময়ে অন্দরমহল থেকে কাকিমা বেরিয়ে এলেন। কাকিমাকে দেখে চিকুর বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। নিপাট ভালোমানুষ কাকিমা বোধহয় হরিহরবাবুর আসল চেহারাটা জানেন না। জানলে তিনি হয়তো শোকে-দুঃখে আত্মহত্যাই করবেন।

কাকিমার সামনে আর কোনও কথা বলতে পারল না চিকু। হরিহরবাবু চিকুর দিকে দু-পা এগিয়ে এলেন, মুখের ভাব মোলায়েম করে বললেন, ‘তোর বয়েস অল্প। তোর না জানার জগৎটা বড় বেশি। জানবি পাপ করলে তার শাস্তি পেতেই হবে। শ্রীকৃষ্ণের নৃসিংহ অবতার হিরণ্যকশিপুকে ধ্বংস করেছিল…’

চিকু চোয়াল শক্ত করে বলল, ‘আমি কোনও পাপ করিনি…।’

কাকিমা স্বামীকে জিগ্যেস করলেন, ‘কী হয়েছে? ভেতর থেকে চেঁচামেচি শুনতে পাচ্ছিলাম…এত শোরগোল কীসের?’

স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে হরিহরবাবু হাসলেন : ‘ও কিছু নয়। চিকুকে একটু শাসন করছিলাম। তবে ছোট ছেলে…আমি ওকে ক্ষমা করে দিয়েছি—।’ চিকু ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এল।

প্রিয়াংকা এতক্ষণ ওর হাত ধরে টানছিল। বাইরে এসেই প্রিয়াংকা চিকুকে জিগ্যেস করল, ‘কী ব্যাপার বলো তো! তোমাদের কথাবার্তার আমি কোনও মিনিং খুঁজে পাচ্ছি না। স্যারের সঙ্গে পঞ্চপ্রদীপ আর পুরুতমশাইয়ের রিলেশান কী?’

‘চলো—যেতে-যেতে সব বলছি। তবে তুমি এখন কাউকে কোনও কথা বলতে পারবে না। প্রমিস?’

চিকুর হাত ছুঁয়ে প্রিয়াংকা বলল, ‘প্রমিস।’

ওরা সাইকেল চালাতে শুরু করল।

বাতাসে অনেকক্ষণ ধরেই একটা ঝড়ের গন্ধ টের পাওয়া যাচ্ছিল। গুমোটের মধ্যে ঠান্ডা বাতাস মাঝে-মধ্যেই খেলে বেড়াচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, শিগগিরই একটা কালবৈশাখী হবে। তবে তার সঙ্গে একটু বৃষ্টি হলে ভালো হয়, চিকু ভাবল।